হযরত ইবরাহীম (আ)
হযরত ইবরাহীম (আ) একজন বিশিষ্ট নবী ও রাসূল। মুসলিম জাতির আদি পিতা (কুরআন, ২২ ও ৭৮)। আল্লাহ তাআলা তাঁহাকে কয়েকটি বিষয়ে কঠিন পরীক্ষা করেন। সকল পরীক্ষাতেই তিনি সফলতার সহিত উত্তীর্ণ হন (২ ও ১২৪)। এইজন্য তিনি আল্লাহ তাআলার খুবই প্রিয়ভাজন হন। আল্লাহ তাঁহাকে বিশেষ বন্ধুরূপে গ্রহণ করেন (৪:১২৫)। তাই তাঁহার উপাধি হয় খালীলুল্লাহ (আল্লাহ্ বিশেষ বন্ধু)। তিনি মেহমানদারিতে খুবই প্রসিদ্ধ ছিলেন বলিয়া তাহার উপনাম হয় ‘আবুদ-দায়ফীন অর্থাৎ মেহমানদের পিতা (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১৩, ১৪০)।
বাইবেলের বর্ণনামতে তাঁহার পূর্বনাম ছিল আবরাম অর্থাৎ মহাপিতা। তাঁহার ৯৯ বৎসর বয়সে সদাপ্রভু তাঁহাকে দর্শন দান করত তাহার নাম রাখেন ‘আবরাহাম অর্থাৎ বহু লোকের বা জাতির পিতা (Genesis, 17:5)। পরবর্তী কালের অনেক গবেষকই এই বিশ্লেষণ করিয়াছেন যে, ইবরাহীম বা আবরাহাম হিব্রু শব্দ, যাহা ‘আব (পিতা) ও রাহাম (দল বা অধিকাংশ লোক) শব্দদ্বয়ের সমন্বয়ে গঠিত, যাহার অর্থ বহু দল বা অধিকাংশ লোকের পিতা। ইহা অনারব শব্দ (বুতরু আল-বুসতানী, দাইরাতুল-মাআরিফ, ১খ, ২০৮)।
আবির্ভাবকাল
হযরত ইবরাহীম (আ) কখন দুনিয়াতে আবির্ভূত হইয়াছিলেন তাহা একেবারে সঠিক করিয়া বলা না গেলেও বিভিন্ন বর্ণনা হইতে মোটামুটি একটি ধারণা পাওয়া যায়। সবগুলি বর্ণনাই প্রায় একই রকম। অধিকাংশের বর্ণনামতে হযরত নূহ (আ)-এর প্লাবন হইতে ১২৬৩ (মতান্তরে ১০৯৯) বৎসর পর তিনি আবির্ভূত হন এবং হযরত আদম (আ) হইতে ৩৩৩০ (এক বর্ণনায় ৩৩৩৭) বৎসর পর (ইবনুল জাওযী, আল-মুনতাজাম, ১খ, ২৫৮; আছ-ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ.৭৬)। আবু উমামা (রা) বর্ণনা করেন যে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (স)-কে জিজ্ঞাসা করিল, নূহ (আ) ও ইবরাহীম (আ)-এর মধ্যে কত ব্যবধান। তিনি বলিলেন, দশ কারূন (প্রজন্ম) (ইনুল-জাওযী, প্রাগুক্ত)। উল্লেখ্য যে, প্রতি ১০০ (এক শত) বৎসরকে এক কারূন বলা হয়। ইবন হাবীব তাহার আল-মুহাব্বার গ্রন্থে ইবন আব্বাস (রা) হইতে একটি রিওয়ায়াত উদ্ধৃত করিয়াছেন। উহাতে এইভাবে হিসাব প্রদান করা হইয়াছে যে, হযরত আদম (আ) হইতে নূহ (আ)-এর সময়কাল ২২২০ (দুই হাজার দুই শত বিশ) বৎসর, নূহ (আ) হইতে ইবরাহীম (আ) পর্যন্ত ১১৪৩ মতান্তরে ১১৬৫ বৎসর। তদনুযায়ী হযরত আদম (আ) হইতে ইবরাহীম (আ)-এর সময়কাল ৩৩৪৩ বা ৩৩৬৫ বৎসর (ইবন হাবীব, আল-মুহাব্বার, পৃ. ১)। ইবন কুতায়বার বর্ণনায় হযরত নূহ (আ) ও ইবরাহীম (আ)-এর মধ্যে ব্যবধান এই সকল বর্ণনা হইতে একটু বেশী বলিয়া পরিদৃষ্ট হয়। তাঁহার বর্ণনামতে উভয়ের মধ্যে ২২৪০ বৎসরের ব্যবধান (আল-মাআরিফ, পৃ. ৩১)। অনেকের মতে তিনি খৃ.পূ. ২০১৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং আর্চবিশপের মতে খৃ.পূ. ১৯৯৬ সালে। তবে প্রথম মতটিই যুক্তিযুক্ত (আনওয়ার-ই আম্বিয়া, পৃ. ৪৬)।
তৎকালীন বাদশাহ নমরূদের পরিচয়
অধিকাংশ ইতিহাসবিদ-এর মতে হযরত ইবরাহী (আ) পরাক্রমশালী বাদশাহ নমরূদ ইবন কূশ মতান্তরে কিনআন ইবন কূশ-এর আমলে জন্মগ্রহণ করেন। কাহারও কাহারও মতে সে ইযদিহাক-এর গভর্নর ছিল। কিন্তু অধিকাংশের মতে সে নিজেই বাদশাহ ছিল। ইব্ন ইসহাক বলেন, তাহার রাজত্ব পূর্ব হইতে পশ্চিমে বিস্তৃত ছিল। সে বাবিলে বসবাস করিত। কথিত আছে যে, সমগ্র বিশ্বের রাজত্ব করেন তিন বক্তি ও নমরূদ, যুল-কারনায়ন ও সুলায়মান ইব্ন দাউদ (আ)। কেহ কেহ বুখত নসরকেও ইহাদের অন্তর্ভুক্ত করিয়া চারজনের কথা বলিয়াছেন, কিন্তু ইবনুল-আমীর উহা বাতিল বলিয়া মত প্রকাশ করিয়াছেন (আল-কামিল, ১৩, ৭২)। তাহার বংশলতিকা হইল : নমরূদ ইব্ন কিনআন ইবন কূশ ইব্ন সাম ইব্ন নূহ (আত-তাবারী, তারীখ, ১৩, ১১৯)। সে-ই প্রথম স্বেচ্ছাচারী ও কঠোর আচরণকারী রাজা ছিল। সে বিবিধ ধরনের খারাপ আদর্শের প্রচলন করে। প্রথম মাথায় তাজ (রাজমুকুট) পরিধান করে, শয়তানের সহায়তায় জ্যোতির্বিদ্যার প্রসার ঘটায় এবং তারকার প্রতি দৃষ্টিপাত করত উহা পর্যবেক্ষণ করিয়া ভূত-ভবিষ্যৎ গণনা করিতে শুরু করে (ইব্ন কুতায়বা, আল-মাআরিফ, পৃ. ৩১) এবং এই কাজে কিছু লোক নিয়োজিত করে, যাহারা কাহিন (গণক) ও মুনাজজিম (জ্যোতিষী) নামে পরিচিত। সে-ই প্রথম লোকজনকে তাহার পূজা করিতে উদ্বুদ্ধ করে এবং নিজকে ক্ষমতাধর বিধাতা বলিয়া দাবি করে, আল্লাহর অবাধ্যতা ও বিরোধিতার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে। এক বর্ণনামতে তাহার সময়ই অগ্নিপূজার প্রচলন হয় এবং জ্যোতির্বিদ্যার উদ্ভব ঘটে (আল-মাসউদী, মুরূজুয-যাহাব, ১খ, ৪৪)। আল্লাহ তাআলা তাহাকে দীর্ঘ জীবন দান করেন। দীর্ঘদিন সে রাজত্ব করে (এক বর্ণনামতে চারি শত বৎসর)। কোনও দলীল-প্রমাণই তাহাকে গোমরাহী হইতে ফিরাইতে পারে নাই। অবশেষে তাহাকে ধ্বংস করিবার জন্য আল্লাহ তাআলা মশক বাহিনী প্রেরণ করেন। এত অধিক পরিমাণে মশা বাহির হয় যে, সূর্যকে পর্যন্ত আড়াল করিয়া ফেলে । মশক বাহিনী নমরূদের সেনাবাহিনীর রক্ত মাংস খাইয়া ফেলিল, শুধুমাত্র হাড্ডিগুলি অবশিষ্ট রহিল। অবশেষে একটি মশা নমরূদের নাক দিয়া মগজে ঢুকিয়া পড়িল। সেখানে নানারূপ উৎপাত করিয়া নমরুদকে অস্থির করিয়া ফেলিত। তাই সর্বদাই হাতুড়ি দ্বারা তাহার মস্তক পিটাইতে হইত। মানুষ তাহার প্রতি এইভাবে দয়া প্রদর্শন করিত যে, দুই হাত দিয়া অনবরত সজোরে তাহার মাথায় আঘাত করিতে থাকিত। এইভাবে আরো চারি শত বৎসর জীবিত থাকিয়া শাস্তি ভোগ করে (মতান্তরে ৪০ বৎসর, কাহারো বর্ণনামতে ৪০ দিন)। এইরূপ অপদস্থ অবস্থায় তাহার মৃত্যু হয় (ইবনুল-জাওযী, আল-মুনতাজাম, ১খ, ২৮০-২৮১; ইব্ন কুতায়বা, আল-মাআরিফ, পৃ. ৩১; মুহাম্মাদ আল-ফাকী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ.৭৭)।
ইবরাহীম (আ)-এর জন্ম ও বংশপরিচয়
তাঁহার জন্মস্থান সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। কাহারও মতে তিনি আহওয়ায় প্রদেশের সূস নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন, কাহারও মতে কৃছার পার্শ্ববর্তী সাওয়াদ নামক স্থানে। কাহারও মতে যাওয়াবী ও কাসকার সীমান্তের পার্শ্ববর্তী ওয়ারকা নামক স্থানে। অতঃপর তাঁহার পিতা কৃছার যে প্রান্তে নমরূদ বসবাস করিত তাহাকে সেখানে লইয়া যায়। কাহারও মতে হাররান নামক স্থানে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। অতঃপর তাঁহার পিতা তাঁহাকে বাবিলে লইয়া আসে (আত-তাবারী, তারীখ, ১খ, ১১৯; আছ-ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৭৬)। হাফিয ইব্ন আসাকির তাঁহার জন্মস্থান সম্পর্কে দুইটি মত উদ্ধৃত করিয়াছেন এবং বাবিলকেই সঠিক বলিয়া রায় দিয়াছেন। তিনি হিশাম ইবন আম্মার সূত্রে ইবন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণনা করেন যে, ইবরাহীম (আ) দামিশক-এর বার নামক শস্য-শ্যামল গ্রামের কাসিয়ূন পর্বতের পাদদেশে জন্মগ্রহণ করেন। অতঃপর তিনি বলেন, তবে সঠিক হইল তিনি বাবিলে জন্মগ্রহণ করেন। উপরিউক্ত স্থানের কথা এইজন্য তাঁহার প্রতি আরোপ করা হইয়াছে যে, লুত (আ)-এর সহায়তাকল্পে তিনি যখন সেখানে গমন করেন তখন সেখানে সালাত আদায় করেন (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১৩, ১৪০; মুহাম্মাদ আল-ফাকী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৬১)। খ্যাতনামা ভূগোলবিদ য়াক্ত আল-হামারী ও আল-বাকরী আল-আদালুসীর বর্ণনা হইতেও এই মতের সমর্থন পাওয়া যায়। তাহাদের বর্ণনামতে বাবিলে অবস্থিত কৃছা রাব্বা নামক স্থানেই ইবরাহীম (আ) জন্মগ্রহণ করেন, সেখানেই তাঁহাকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয় (য়াকুত আল-হাবী, মুজামুল-বুলদান, ৪খ, ৪৮৭; আল-বাকরী আল-আনদালুসী, মুজামু মাসতাজাম, ৪খ, ১১৩৮)।
ইবন ইসহাক-এর বর্ণনামতে হযরত নূহ (আ) ও ইবরাহীম (আ)-এর মধ্যখানে মাত্র দুইজন নবী হূদ (আ) ও সালিহ (আ) আগমন করেন। তাঁহাদের সময়কাল শেষ হওয়ার পর মানুষ যখন চরম গোমরাহী ও শিরক-এ লিপ্ত হইল, এক আল্লাহর পরিবর্তে মূর্তিপূজা ও নক্ষত্র পূজায় নিমগ্ন হইল, তখন আল্লাহ তাআলা তাঁহার বান্দাদিগকে সুপথে আনিবার জন্য ইবরাহীম (আ)-কে নবীরূপে প্রেরণ করিবার ইচ্ছা করিলেন। এমতাবস্থায় জ্যোতিষী ও গণকগণ তৎকালীন পরাক্রমশালী বাদশাহ নমরূদের নিকট গিয়া বলিল, আমরা আমাদের বিদ্যার মাধ্যমে দেখিতে পাইতেছি যে, আপনার এই অঞ্চলে অমুক বৎসরের অমুক মাসে ইবরাহীম নামে এক শিশু জন্মগ্রহণ করিবে। সে আপনার ধর্ম ধ্বংস করিয়া ফেলিবে এবং মূর্তি ভাঙ্গিয়া ফেলিবে। আপনার রাজত্বের বিলুপ্তিও তাহার দ্বারাই হইবে। কোন কোন বর্ণনায় আছে, তাহারা বলিয়াছিল যে, ইহা তাহারা পূর্ববর্তী নবীদের গ্রন্থে পাইয়াছে (ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৭৭; আত-তাবারী, তারীখ, ১খ, ১২০; ইবনুল-জাওযী, আল-মুনতাজাম, ১খ, ২৫৯)। অতঃপর গণকদের বর্ণনাকৃত সেই বৎসরের সেই মাস শুরু হইলে নমরূদ তাহার এলাকার প্রত্যেক গর্ভবতী মহিলার নিকট একজন লোক প্রেরণ করিল। সে উক্ত মহিলার প্রতি নজর রাখিতে লাগিল। অতঃপর যখনই কোন মহিলা কোন পুত্রসন্তান প্রসব করিত তখনই নমরূদের নির্দেশে তাহাকে হত্যা করা হইত। কিন্তু আযরের স্ত্রী, ইবরাহীম (আ)-এর মাতার ব্যাপারটি ছিল ভিন্ন। তিনি অল্প বয়স্কা থাকায় তাঁহাকে দেখিয়া গর্ভবতী বলিয়া মনে হইত না। তাই নমরূদের মোতায়েনকৃত লোক কেহই তাহার গর্ভ আঁচ করিতে পারে নাই। ইবরাহীম (আ)-এর মাতা যখন প্রসব বেদনা অনুভব করিলেন তখন নিকটস্থ পর্বত গুহায় চলিয়া গেলেন। সেখানে ইবরাহীম (আ) জন্মগ্রহণ করিলেন। অতঃপর প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সমাপন করত গুহার মুখ বন্ধ করিয়া তিনি বাড়ি ফিরিয়া আসিলেন। ইহার পর তিনি গুহায় গিয়া তাঁহাকে দেখিয়া আসিতেন। তিনি যখনই যাইতেন দেখিতেন যে, ইবরাহীম জীবিত আছেন এবং স্বীয় বৃদ্ধাঙ্গুলী চোষণ করিতেছেন। আল্লাহ তাআলা এই চোষণের মাধ্যমেই তাঁহার রিযিক দিয়াছিলেন (আত-তাবারী, তারীখ, ১খ, ১১৯-১২০; আল-মুনতাজাম, ১খ, ২৫৯)। আবু রুয়ক বর্ণনা করেন যে, ইবরাহীম (আ)-এর মাতা যখনই আসিতেন তখনই তাঁহাকে বৃদ্ধাঙ্গুলী চুষিতে দেখিতেন। একদিন তিনি বলিলেন, তাঁহার অঙ্গুলীতে কি আছে তাহা অবশ্যই আমি দেখিব। অতঃপর তিনি দেখিতে পাইলেন যে, ইবরাহীম (আ) এক অঙ্গুলী দিয়া পানি, এক অঙ্গুলী দিয়া দুধ, এক অঙ্গুলী দিয়া মধু, এক অঙ্গুলী দিয়া খেজুর এবং এক অঙ্গুলী দিয়া ঘি চোষণ করিতেছেন (ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৭৮)। আর তাহার স্ত্রীকে গর্ভ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলিয়াছিলেন, আমি একটি পুত্র সন্তান প্রসব করিয়াছিলাম, সে মৃত্যুবরণ করিয়াছে। আর ইহা শুনিয়া বিশ্বাস করিলেন এবং চুপ হইয়া গেলেন। ইবরাহীম (আ) সেখানে বড় হইতে লাগিলেন। খুব দ্রুত তিনি বড় হইয়া উঠেন। তাঁহার বয়বৃদ্ধির সময়-কালকে আল্লাহ তাআলা বরকতময় করিয়া দেন। তাই তাঁহার একদিন ছিল এক মাসের ন্যায় (মতান্তরে এক সপ্তাহের ন্যায়), এক মাস ছিল এক বৎসরের ন্যায়। তিনি উক্ত পর্বত গুহায় মোট ১৫ মাস ছিলেন। এক দিন তিনি তাঁহার মাতাকে বলিলেন, আমাকে বাহির করিয়া লইয়া চলুন, আমি বাহিরের দৃশ্য দেখিব। অতঃপর মাতা তাঁহাকে রাত্রিবেলায় বাহির করিয়া লইয়া আসেন। এই বর্ণনামতে ইবরাহীম (আ) তাঁহার পিতাকে জানান যে, তিনি তাহার পুত্র। তাঁহার মাতাও আযরকে জানান যে, ইবরাহীম তাহার পুত্র। ইহার পর সমস্ত ঘটনা তাহাকে অবহিত করেন। ইহাতে আযর অত্যন্ত আনন্দিত হন (আত-তাবারী, ১খ, ১২০)। উপরিউক্ত বর্ণনা হইতে বুঝা যায় যে, গুহা হইতে বাহির হইবার সময় ইবরাহীম (আ)- যুবা বয়সে উপনীত হন। কারণ এক মাস এক বৎসরের সমান হইলে ১৫ মাস অর্থাৎ ১৫ বৎসর। ছালাবীও এই মত ব্যক্ত করিয়াছেন যে, গুহায় থাকিতেই ইবরাহীম (আ) যুবকে পরিণত হন (ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৭৮)।
তাহার জন্ম সম্পর্কে সুদ্দী ইবন মাসউদ (রা) ও অন্যান্য সাহাবী সূত্রে ভিন্ন বর্ণনা দিয়াছেন। তাহা হইল : নমরূদ একদিন স্বপ্ন দেখিল যে, একটি তারকা উদিত হইয়াছে। উহা চন্দ্র ও সূর্যের আলোকে স্তিমিত করিয়া দিয়াছে, এমনকি উহাদের আর একটুও আলো নাই। ইহাতে নমরূদ দারুণভাবে ঘাবড়াইয়া গেল। সে যাদুকর, গণক, জ্যোতিষী প্রমুখকে ডাকিয়া ইহার অর্থ জিজ্ঞাসা করিল। তাহারা বলিল, আপনার রাজত্বে এক শিশু জন্মগ্রহণ করিবে, যাহার হাতে আপনার ও আপনার রাজত্বের ধ্বংস অনিবার্য (ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৭৭)। নমরূদের বাসস্থান ছিল বাবিল শহরে। অতঃপর সে সেখান হইতে বাহির হইয়া অন্য এলাকায় চলিয়া গেল এবং মহিলাদিগকে রাখিয়া সকল পুরুষকে বাহির করিয়া লইয়া আসিল, যাহাতে উক্ত শিশু কোন মহিলার গর্ভে আসিতে না পারে। অতঃপর সে নির্দেশ দিল যে, কোন পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করিলেই যেন তাহাকে হত্যা করা হয়। এইভাবে নমরূদ তাহাদের বহু পুত্রসন্তান হত্যা করিয়া ফেলিল। অতঃপর শহরে তাহার কোন একটি প্রয়োজন দেখা দিল। সে ইবরাহীম (আ)-এর পিতা আয়রকে ছাড়া আর কাহাকেও বিশ্বাস করিতে পারিল না। তাহাকে ডাকাইয়া আনিয়া কাজ বুঝাইয়া দিল এবং বলিল : দেখিও, তোমার স্ত্রীর সহিত মেলামেশা করিও না। আর তাহাকে বলিল, আমি আমার দীনকে উহা হইতে বেশী গুরুত্ব দিই। আর যখন এলাকায় গিয়া উক্ত কাজ সমাপন করিল তখন তাহার মনে হইল, পরিবারের কি অবস্থা একটু দেখিয়া যাই না! অতঃপর স্ত্রীকে দেখিয়া নিজকে আর বশে রাখিতে পারিল না। তাহার সহিত মেলামেশা করিল। অতঃপর স্ত্রীকে লইয়া সে বর্তমান কূফা ও বসরার মধ্যবর্তী উর নামক স্থানে চলিয়া গেল। সেখানে একটি গর্তে সে স্ত্রীকে লুকাইয়া রাখিল। সেখানেই সে স্ত্রীর খানাপিনা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়া আসিত। এদিকে যখন অনেক দিন অতিবাহিত হইল তখন বাদশাহ বলিল, গণকদের কথা মিথ্যা। তোমারা তোমাদের স্ব স্ব গৃহে ফিরিয়া যাও। তখন তাহারা ফিরিয়া আসিল। ওদিকে সেই গুহায় ইবরাহীম (আ) জন্মগ্রহণ করিলেন। প্রতিদিন তাহার এক সপ্তাহ, প্রতি সপ্তাহ এক মাস, প্রতি মাস এক বৎসরের মত অতিবাহিত হইতে লাগিল। বাদশাহ তাহা ভুলিয়া গেল। ইবরাহীম (আ) বড় হইয়া উঠিলেন। তিনি তাঁহার পিতামাতা ছাড়া অন্য কোন সৃষ্টি দেখেন নাই। ইবরাহীমের পিতা তাহার সঙ্গী-সাথীদিগকে বলিল, আমার একটি পুত্র আছে যাহাকে আমি লুকাইয়া রাখিয়াছি। তাহাকে যদি আমি লইয়া আসি তাহা হইলে কি বাদশাহের ভয় আছে : তাহারা বলিল, না, তাহাকে লইয়া আস। তিনি গিয়া তাহাকে গুহা হইতে বাহিরে লইয়া আসিল (আত-তাবারী, তারীখ, ১৩, ১২০-১২১; আছ-ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৭৭-৭৮; ইবনুল-আছীর, আল-কামিল, ১খ, ৭৩)।
ইবন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত আছে যে, ইবরাহীম (আ)-এর মাতা যখন গর্ভবতী হইলেন তখন গণকগণ নমরূদকে বলিল, যে শিশু পুত্রের সংবাদ আমরা আপনাকে দিয়াছিলাম সে অদ্য রাত্রে মায়ের গর্ভে আসিয়াছে। তখন নমরূদ পরবর্তীতে ভূমিষ্ট সকল শিশুপুত্রকে হত্যার নির্দেশ দিল। অতঃপর ইবরাহীম (আ)-এর মাতার যখন সন্তান প্রসবের সময় ঘনাইয়া আসিল এবং প্রসব বেদনা আরম্ভ হইল তখন এই ভয়ে তিনি বাড়ি হইতে পলায়ন করিলেন যে, জানাজানি হইয়া গেলে তাহার সন্তানকে হত্যা করা হইবে। অতঃপর শুষ্ক একটি ঝর্ণার নিকট আসিয়া তিনি সন্তান প্রসব করিলেন। সন্তানকে একটি বস্ত্রখণ্ডে আচ্ছাদিত করিয়া একটি গর্তে রাখিলেন। অতঃপর ফিরিয়া আসিয়া স্বামীকে তিনি একটি পুত্রসন্তান প্রসবের কথা জানাইলেন এবং তাহাকে কোথায় রাখিয়া আসিয়াছেন তাহাও জানাইলেন। অতঃপর তাহার পিতা আসিয়া তাহাকে উক্ত স্থান হইতে লইয়া গিয়া শুষ্ক ঝর্ণার নিকট একটি গর্ত খুঁড়িয়া তাহার মধ্যে রাখিল এবং হিংস্র জন্তুর ভয়ে উহার মুখ পাথর দ্বারা বন্ধ করিয়া দিল। তাঁহার মাতা বিভিন্ন সময়ে আসিয়া তাহাকে দুধ পান করাইয়া যাইতেন (আছ-ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৭৭)।
বংশ লতিকা
তাওরাত-এর বর্ণনামতে তাঁহার বংশলতিকা হইল : ইবরাহীম ইবন তারাহ (বয়স ২৫০ বৎসর) ইব্ন নাহ্র (বয়স ১৪৮ বৎসর) ইব্ন নূহ আলায়হিস সালাম (Genesis, 11: 10-27; ইবন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ১৩৯; আত-তাবারী, তারীখ, ১২, ১১৯)। তাঁহার বংশ লতিকার ছক নিম্নরূপঃ
সাম এর জন্মের সময় তাহার পিতা নূহ (আ)-এর বয়স ৫০০ বৎসর
আরফাখশা-এর “ “ “ “ সাম “ “ ১০০ “
শালিহ “ “ “ “ আরফাখশায় “ “ ১২৫ “
আবির “ “ “ “ শালিহ “ “ ৩০ “
ফালিজ “ “ “ “ আবির “ “ ৩৪ “
রাউ “ “ “ “ ফালিজ “ “ ৩০ “
সারূজ “ “ “ “ রাউ “ “ ৩২ “
নাহূর “ “ “ “ সারূজ “ “ ৩০ “
তারাহ “ “ “ “ নাহূর “ “ ২৯ “
আবরাম/ইবরাহীম “ “ “ “ তারাহ “ “ ৭৫ “
মোট-৯৮৫ বৎসর।
(আল-নাজজার, কাসাসুল-আম্বিয়া,পৃ. ৭৩)।
ইতিহাস ও বাইবেলে ইবরাহীম (আ)-এর পিতার নাম তারাহ বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। কিন্তু কুরআন কারীমে তাহাকে আর বলা হইয়াছে। ইরশাদ হইয়াছে; }}uT! J6, zi is। “স্মরণ কর, ইবরাহীম তাহার পিতা আষরকে বলিয়াছিল, আপনি কি মূর্তিকে ইলাহরূপে গ্রহণ করেন?” (৬ : ৭৪)? তাই উলামায়ে কিরাম এই অসামঞ্জস্য দূরীকরণে বিভিন্ন প্রকারের ব্যাখ্যা পেশ করিয়াছেন।
(১) কাহারও মতে তারাহ ও আযর একই ব্যক্তি। তারাহ তাহার নামবাচক বিশেষ্য ( Le) আর আযর গুণবাচক বিশেষ্য (s; Le)। ইহাদের মতে আযর হিব্রু শব্দ যাহার অর্থ মূর্তি প্রেমিক, তারাহ মূর্তির সহিত সর্বদাই জড়িত ছিল। সে মূর্তি তৈরি করিত এবং মূর্তির পূজাও করিত। এইজন্য তাহাকে আযর উপাধি দেওয়া হয় এবং এই উপাধিতেই সে প্রসিদ্ধি লাভ করে। আর কিছু লোকের ধারণা, আযর শব্দের অর্থ » অর্থাৎ নির্বোধ বা বেওকুফ ও অকেজো বৃদ্ধ (আয-যাবীদী, তাজুল-আরূস, ৩খ, ১১)। তারাহ-এর মধ্যে এই বিশেষণ বর্তমান ছিল বিধায় এই গুণবাচক বিশেষ্যের দ্বারাই সে পরিচিত হইয়া যায়। তাই কুরআন কারীমে তাহার উক্ত প্রসিদ্ধ গুণবাচক বিশেষ্য তথা উপাধিতেই উল্লেখ করা হইয়াছে। আল্লামা সুহায়লী তাঁহার রাওদুল উনুফ গ্রন্থে এই মত বর্ণনা করিয়াছেন (১খ, ৭৪)।
(২) কাহারও কাহারও মতে উক্ত আয়াতে ইবরাহীম (আ)-এর পিতার নাম উল্লেখ নাই। এখানে আয়াতের অর্থ সেই মূর্তি যাহা তাহার পিতা তৈরি করিত এবং যাহার সে পূজাও করিত। এই মর্মে মুজাহিদ (র) হইতে একটি রিওয়ায়াত রহিয়াছে যে, কুরআন কারীমের উল্লিখিত আয়াতের অর্থ হইল । অর্থাৎ ali Ci তুমি কি আরকে উপাস্য বলিয়া মান্য কর, অর্থাৎ মূর্তিকে উপাস্য মান? আল্লামা সানআনীর ধারণাও ইহাই। মোটকথা ইহাদের মতে কুরআন কারীমে ইবরাহীম (আ)-এর পিতার নাম উল্লেখ করা হয় নাই। আল্লামা আবদুল ওয়াহহাব নাজজার-এর রায় হইল, মুজাহিদ (র)-এর মতটিই যুক্তিযুক্ত এবং গ্রহণযোগ্য। কারণ মিসরের প্রাচীন দেবতাদের মধ্যে একটির নাম ছিল আয়ুরীস, যাহার অর্থ “শক্তিশালী ও সাহায্যকারী খোদা”। আর মূর্তি পূজারীদের মধ্যে পূর্ব হইতেই এই প্রথা প্রচলিত ছিল যে, তাহারা প্রাচীন দেবতাদের নামে লূতন দেবতাদের নামকরণ করিত। তাই এই মূর্তিটির নামও প্রাচীন মিসরীয় দেবতার নাম অনুসারে আর রাখা হয়। আর উহারই কথা কুরআন কারীমে উল্লিখিত হইয়াছে (হিফজুর রাহমান সিউহারবী, কাসাসুল-কুরআন, ১৩, ১৫২-১৫৩)।
(৩) একটি প্রসিদ্ধ বর্ণনামতে ইবরাহীম (আ)-এর পিতার নাম তারাহ আর চাচার নাম আযর। চাচাই তাহাকে পুত্রস্নেহে লালন-পালন করে। তাই কুরআন কারীমে তাহাকে ইবরাহীম (আ)-এর পিতা বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। চাচা তো পিতার সমপর্যায়ের। রাসূলুল্লাহ (স)-এর একটি হাদীছেও ইহার সমর্থন পাওয়া যায়। তিনি ইরশাদ করিয়াছেন : “চাচা পিতার ন্যায়ই” (সিউহারবী, প্রাগুক্ত)।
তবে কুরআন কারীমের সুস্পষ্ট বর্ণনায় আয়রকে ইবরাহীম (আ)-এর পিতা বলা হইয়াছে। তাই অযথা উহার কোন রূপক অর্থ গ্রহণ বা অন্য কোনও জটিল বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে বলিয়া যুক্তিযুক্ত মনে হয় না। যদি স্বীকারও করিয়া লওয়া হয় যে, আযর অর্থ মূর্তি প্রেমিক বা উহা দেবতার নাম, তবুও ইহার জটিল বিশ্লেষণে যাওয়ার প্রয়োজন নাই। উভয় অবস্থাতেই বলা যায় যে, আযর তাহার নামই ছিল। যেমন মূর্তিপূজারিগণ প্রাচীন কাল হইতেই নিজেদের সন্তানদিগের দেবতার গোলামসূচক নাম রাখিত (যথা আবদুল উযযা, আবদ মানাত প্রভৃতি), আর কখনো কখনো সরাসরি মূর্তির নামে নাম রাখিত। এই ক্ষেত্রেও তাহাই ঘটিয়া থাকিবে।
প্রকৃতপক্ষে কালদীয় ভাষায় বড় পূজারীকে বলা হয় আদার। আরবী ভাষায় ইহাকেই আর বলা হয় । ইবরাহীম (আ)-এর পিতা তারাহ যেহেতু মূর্তি নির্মাতা এবং সবচেয়ে বড় পূজারী ছিল, এইজন্য আযর নামেই সে প্রসিদ্ধি লাভ করে। অথচ ইহা তাহার নাম নহে, উপাধি। আর উপাধি যেহেতু নামের স্থান দখল করে সেহেতু কুরআন কারীমেও তাহাকে উক্ত নামেই উল্লেখ করা হইয়াছে (হিফজুর রাহমান সিউহারবী, কাসাসুল কুরআন, ১খ, ১৫৩)।
নির্বোধ, বেওকুফ বা অকেজো বৃদ্ধ প্রভৃতি বিশেষণের কারণে আর বলা মোটেও সমর্থনযোগ্য নহে। কারণ হযরত ইবরাহীম (আ)-এর চরিত্র এতই উন্নত ছিল যে, পিতার সম্মুখে যখন তিনি মূর্তি পূজার অসারতা তুলিয়া ধরিলেন তখন পিতা রাগান্বিত হইয়া তাহাকে ভর্ৎসনা ও হুমকি প্রদর্শন করিয়া বলিয়াছিল :
“হে ইবরাহীম! তুমি কি আমার দেব-দেবী হইতে বিমুখ? যদি তুমি নিবৃত্ত না হও তবে আমি প্রস্তরাঘাতে তোমার প্রাণনাশ করিবই । তুমি চিরদিনের জন্য আমার নিকট হইতে দূর হইয়া যাও” (১৯ ও ৪৬)।
এত কর্কশ ভাষা ও কঠোর আচরণের পরও তিনি স্বীয় পিতার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা ও ভক্তি রাখিয়া বিনয়াবনতভাবে তাহার শান্তি কামনা করিয়াছিলেন এবং তাহার জন্য আল্লাহর নিকট দুআ করার অঙ্গীকার করেন। তিনি বলেন :
“তোমার প্রতি সালাম । আমি আমার প্রতিপালকের নিকট তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিব। নিশ্চয় তিনি আমার প্রতি অতিশয় অনুগ্রহশীল” (১৯৪৭)।
সুতরাং এমন মহামানব হইতে স্বীয় পিতাকে নির্বোধ, বেওকুফ, অকেজো বৃদ্ধ প্রভৃতি অসম্মান সূচক বিশেষণে সম্বোধন করা বা তাহার সামনে উক্ত শব্দ ব্যবহার করা একেবারেই অসম্ভব (আবদুল ওয়াহহাব নাজজার, পৃ. ৭০)। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ইতিহাস ও বাইবেলে বর্ণিত তারাহ ও কুরআনে বর্ণিত আযর একই ব্যক্তি। আর তাহার নামবাচক বিশেষ্য । ); গুণবাচক বিশেষ্য (any Le) নহে। আর তারাই হয়ত-বা তাহার নাম নহে, আযর শব্দের অনুবাদ, ভুলক্রমে তারাহ নামটি উল্লিখিত হইয়াছে। আর তাওরাতের অন্যান্য অনূদিত নামের ন্যায় ইহা অনুবাদ না থাকিয়া বরং প্রকৃত নাম হইয়া গিয়াছে (সিউহারবী, কাসাসুল কুরআন, ১খ, ১৫৩-১৫৪)।
ইবরাহীম (আ)-এর পিতা আযর ছিল কাঠমিস্ত্রী। সে কাঠের মূর্তি তৈরি করিত এবং মূর্তি পুজকদের নিকট উহা বিক্রয় করিত (আন-নাজজার, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৭৯)।
হাফিজ ইবন আসাকির ইসহাক ইবন বিশর আল-বাহিলী সূত্রে বর্ণনা করেন যে, ইবরাহীম (আ)-এর মাতার নাম ছিল উমায়লা। আল-কালবীর বর্ণনামতে তাহার নাম ছিল নূনা বিনত কারবানা ইব্ন কারছী। আস-সুহায়লী “লায়ূছা” বলিয়া তাহার আরো একটি নামের উল্লেখ করিয়াছেন। তিনি ছিলেন আরফাখশায ইবন সাম ইবন নূহ (আ)-এর বংশধর (ইবন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ১৪০; ঐ লেখক, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ১১৯; আস-সুহায়লী, আর-রাদুল উনুফ, ১খ, ৭৫)।
তারাহ-এর বয়স যখন ৭৫ বৎসর তখন পুত্র ইবরাহীম (আ) জন্মগ্রহণ করেন। তারাহ-এর অপর দুই পুত্র ছিল নাহ্র ও হারান। হারান জ্যৈষ্ঠ, ইবরাহীম (আ) মধ্যম ও নাহ্র কনিষ্ঠ। হারানের পূত্র লূত (আ)। হারান তাহার পিতার জীবদ্দশায় স্বীয় জন্মভূমি কালদানীদের ভূমি অর্থাৎ বাৰিলে মারা যান। ইতিহাস ও সীরাতবিদগণের নিকট ইহাই প্রসিদ্ধ। হাফিজ ইবন আসাকির ইহাকেই সহীহ বলিয়াছেন (ইব্ন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১৩, ১৪০; ঐ লেখক, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ১১৯; মুহাম্মদ আল-ফাকী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৬১)।
আল-কুরআন কারীমে হযরত ইবরাহীম (আ)
কুরআন কারীমের বহু স্থানে হযরত ইবরাহীম (আ)-এর আলোচনা করা হইয়াছে। তাহার হিদায়াত প্রাপ্তি, পিতা ও কওমের প্রতি তাওহীদের দাওয়াত এবং মূর্তির অসারতা প্রতিপাদন করিয়া যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য প্রদান, জালিম ও জাহিল বাদশাহের সহিত বিতর্ক, তাঁহার অগ্নিপরীক্ষা, বার্ধক্যে সন্তান লাভ, সন্তান ও পরিবারবর্গের জন্য দুআ, ফেরেশতাদের সহিত কথোপকথন, কাবা গৃহ নির্মাণ ও হজ্জের ঘোষণা প্রদান প্রভৃতি বিষয়ে মাক্কী ও মাদানী উভয় প্রকার সূরাতেই তাঁহার ব্যাপক আলোচনা করা হইয়াছে। একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ সূরাও তাহার নামে নামকরণ করা হইয়াছে, যাহা মক্কায় অবতীর্ণ হয়। কুরআনুল কারীমের মোট ২৫টি সূরার ৬৯টি স্থানে তাহার নাম উল্লেখ করা হইয়াছে। তন্মধ্যে সূরা বাকারা, আল-ই ইমরান, আন-নিসা, আল-আনআম, হ্রদ, আন-নাহল, মারয়াম, আল-আম্বিয়া, আল-হাজ্জ ও আস-সাফফাত-এ বিস্তারিত আলোচনা করা হইয়াছে। যে সকল সূরা ও আয়াতে তাঁহার আলোচনা করা হইয়াছে তাহার একটি ছক নিম্নরূপঃ
ক্রমিক নং – সূরার নাম ও ক্রমিক নং – আয়াত সংখ্যা
১. আল-বাকারা-২ – ১২৪, ১২৫, ১২৬, ১২৭, ১৩০, ১৩২, ১৩৩, ১৩৫, ১৩৬, ১৪০, ২৫৮, ২৬০।
২. আল-ইমরান-৩ – ৩৩, ৬৫, ৬৭, ৬৮, ৮৪, ৯৫, ৯৭।
৩. আন-নিসা-৪ – ৫৪, ১২৫, ১৬৩।
৪. আল-আনআম-৬ – ৭৪, ৭৫, ৮৩, ১৬১।
৫. আত-তাওবা-৯ – ৭০, ১১৪।
৬. হূদ-১১ – ৬৯, ৭৪, ৭৫, ৭৬।
৭. ইউসুফ-১২ – ৬, ৩৮।
৮. ইবরাহীম-১৪ – ৩৫।
৯. আল-হিজর-১৫ – ৫১।
১০. আন-নাহল-১৬ – ১২০, ১২৩।
১১. মারয়াম-১৯ – ৪১, ৪৬, ৫৮।
১২. আল-আম্বিয়া-২১ – ৫১, ৬০, ৬২, ৬৯।
১৩. আল-হাজ্জ-২২ – ২৬, ৪৩, ৭৮।
১৪. আশ-শুআরা-২৬ – ৬৯।
১৫. আল-আনকাবূত-২৯ – ১৬, ৩১।
১৬. আল-আহযাব-৩৩ – ৭।
১৭. আল-সাফফাত-৩৭ – ৮৩, ১০৪, ১০৯।
১৮. সাদ-৩৮ – ৪৫।
১৯. আশ-শূরা-৪২ – ১৩।
২০. আয-যুখরুফ-৪৩ – ২৬।
২১. আয-যারিয়াত-৫১ – ২৪।
২২. আন-নাজম-৫৩ – ৩৭।
২৩. আল-হাদীস-৫৭ – ২৬।
২৪. আল-মুমতাহানা-৬০ – ৪।
২৫. আল-আলা-৮৭ – ১৯।
(আন-নাজজার, পৃ. ৭৭; সিঊহারবী, কাসাসুল কুরআন, ১খ, ১১৭-১৬৮)।
কুরআনুল কারীমে হযরত ইবরাহীম (আ) সম্পর্কে যে আলোচনা করা হইয়াছে উহার বিশদ বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হইল :
“এবং স্মরণ কর, যখন ইবরাহীমকে তাঁহার প্রতিপালক কয়েকটি কথা দ্বারা পরীক্ষা করিয়াছিলেন এবং সেইগুলি সে পূর্ণ করিয়াছিল। আল্লাহ বলিলেন, আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা করিতেছি। সে বলিল, আমার বংশধরগণের মধ্য হইতেও? আল্লাহ বলিলেন, আমার প্রতিশ্রুতি জালিমদের প্রতি প্রযোজ্য নহে। এবং সেই সময়কে স্মরণ কর যখন কাবাগৃহকে মানবজাতির মিলন কেন্দ্র ও নিরাপত্তা স্থল করিয়াছিলাম এবং বলিয়াছিলাম, তোমরা মাকামে ইবরাহীমকে সালাতের স্থানরূপে গ্রহণ কর এবং ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে তাওয়াফকারী ইতিকাফকারী, রুকূ ও সিজদাকারীদের জন্য আমার গৃহকে পবিত্র রাখিবার আদেশ দিয়াছিলাম। স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম বলিয়াছিল, হে আমার প্রতিপালক! ইহাকে নিরাপদ শহর করিও। আর ইহার অধিবাসীদের মধ্যে যাহারা আল্লাহ ও আখিরাতে ঈমান আনে তাহাদিগকে ফলমূল হইতে জীবিকা প্রদান করিও। তিনি বলিলেন, যে কেহ কুফরী করিবে তাহাকেও কিছু কালের জন্য জীবনোপভোগ করিতে দিব। অতঃপর তাহাকে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করিতে বাধ্য করিব এবং কত নিকৃষ্ট তাহাদের প্রত্যাবর্তনস্থল! স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম ও ইসমাঈল কাবাগৃহের প্রাচীর তুলিতেছিল তখন তাহারা বলিয়াছিল, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের এই কাজ গ্রহণ কর। নিশ্চয় তুমি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের উভয়কে তোমার অনুগত কর এবং আমাদের বংশধর হইতে তোমার এক অনুগত উম্মত করিও। আমাদিগকে ইবাদতের নিয়ম-পদ্ধতি দেখাইয়া দাও এবং আমাদের প্রতি ক্ষমাশীল হও। তুমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। হে আমাদের প্রতিপালক! তাহাদের মধ্য হইতে তাহাদের নিকট এক রাসূল প্রেরণ করিও যে তোমার আয়াতসমূহ তাহাদের নিকট তিলাওয়াত করিবে, তাহাদিগকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবে এবং তাহাদিগকে পবিত্র করিবে। তুমি তো পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। যে নিজকে নির্বোধ করিয়াছে সে বীতত ইবরাহীমের ধর্মাদর্শ হইতে আর কে বিমুখ হইবে! পৃথিবীতে তাহাকে আমি মনোনীত করিয়াছি; আর আখিরাতেও সে অবশ্যই সৎকর্মপরায়ণের অন্যতম। তাহার প্রতিপালক যখন তাহাকে বলিয়াছিলেন, আত্মসমর্পণ কর, সে বলিয়াছিল, জগৎসমূহের প্রতিপালকের নিকট আত্মসমর্পণ করিলাম। এবং ইবরাহীম ও ইয়াকূব এই সম্বন্ধে তাহার পুত্রগণকে নির্দেশ দিয়া বলিয়াছিল, হে পুত্রগণ! আল্লাহই তোমাদের জন্য এই দীনকে মনোনীত করিয়াছেন। সুতরাং আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম) না হইয়া তোমরা কখনও মৃত্যুবরণ করিও না। ইয়াকূবের নিকট যখন মৃত্যু আসিয়াছিল তোমরা কি তখন উপস্থিত ছিলে? সে যখন পুত্রগণকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, আমার পরে তোমরা কিসের ইবাদত করিবে? তখন তাহারা বলিয়াছিল, আমরা আপনার ইলাহ-এর এবং আপনার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাক-এর ইলাহ-এরই ইবাদত করিব। তিনি একমাত্র ইলাহ এবং আমরা তাঁহার নিকট আত্মসমর্পণকারী (২ : ১২৪-১৩৩)।
“তাহারা বলে, ইয়াহুদী বা খৃস্টান হও, ঠিক পথ পাইবে। বল, বরং একনিষ্ঠ হইয়া আমরা ইবরাহীমের মিল্লাত (ধর্মাদর্শ অনুসরণ করিব এবং সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না” (২ ও ১৩৫-৬)।
“তোমরা কি বল, ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাঁহার বংশধরগণ অবশ্যই ইয়াহূদী কিংবা খৃস্টান ছিল? বল, তোমরা কি বেশী জান, না আল্লাহ? আল্লাহর নিকট হইতে তাহার কাছে যে প্রমাণ আছে তাহা যে গোপন করে তাহার অপেক্ষা অধিকতর জালিম আর কে হইতে পারে? তোমরা যাহা কর আল্লাহ সে সম্বন্ধে অনবহিত নহেন” (২: ১৪০)।
“তুমি কি ঐ ব্যক্তিকে দেখ নাই, যে ইবরাহীমের .. সহিত তাহার প্রতিপালক সম্বন্ধে বিতর্কে লিপ্ত হইয়াছিল, যেহেতু আল্লাহ তাহাকে কর্তৃত্ব দিয়াছিলেন। যখন ইবরাহীম বলিল, তিনি আমার প্রতিপালক যিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান। সে বলিল, আমিও তো জীবন দান করি ও মৃত্যু ঘটাই। ইবরাহীম বলিল, আল্লাহ সূর্যকে পূর্ব দিক হইতে উদয় করান, তুমি উহাকে পশ্চিম দিক হইতে উদয় করাও তো। অতঃপর যে কুফরী করিয়াছিল সে হতবুদ্ধি হইয়া গেল। আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না” (২৪ ২৫৮)।
“যখন ইবরাহীম বলিল, হে আমার প্রতিপালক! কিভাবে তুমি মৃতকে জীবিত কর আমাকে দেখাও। তিনি বলিলেন, তবে কি তুমি বিশ্বাস করনা? সে বলিল, কেন করিব না, তবে ইহা কেবল আমার চিত্ত প্রশান্তির জন্য। তিনি বলিলেন, তবে চারিটি পাখি লও এবং উহাদিগকে তোমার বশীভূত করিয়া লও। তৎপর তাহাদের এক এক অংশ এক এক পাহাড়ে স্থাপন কর। অতঃপর উহাদিগকে ডাক দাও। উহারা দ্রুত গতিতে তোমার নিকট আসিবে। জানিয়া রাখ যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রবল পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়” (২. ২৬০)।
“নিশ্চয় আল্লাহ আদমকে, নূহকে ও ইবরাহীমের বংশধর এবং ইমরানের বংশধরকে বিশ্বজগতে মনোনীত করিয়াছেন। ইহারা একে অপরের বংশধর। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ” (৩ : ৩৩-৩৪)।
“হে কিতাবীগণ! ইবরাহীম সম্বন্ধে কেন তোমরা তর্ক কর, অথচ তাওরাত ও ইনজীল তো তাহার পরেই অবতীর্ণ হইয়াছিল? তোমরা কি বুঝ না? হাঁ, তোমরা তো সেইসব লোক, যে বিষয়ে তোমাদের সামান্য জ্ঞান আছে সে বিষয়ে তোমরাই তো তর্ক করিয়াছ, তবে যে বিষয়ে তোমাদের কোন জ্ঞান নাই সে বিষয়ে কেন তর্ক করিতেছ? আল্লাহ জ্ঞাত আছেন এবং তোমরা জ্ঞাত নহ। ইবরাহীম ইয়াহুদীও ছিল না, খৃস্টানও ছিল না; সে ছিল একনিষ্ঠ আত্মসমর্পণকারী এবং সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্তও ছিল না। নিশ্চয় মানুষের মধ্যে তাহারা ইবরাহীমের ঘনিষ্ঠতম যাহারা তাহার অনুসরণ করিয়াছে এবং এই নবী ও যাহারা ঈমান আনিয়াছে, আর আল্লাহ মুমিনদের অভিভাবক” (৩ : ৬৫-৬৮)।
“বল, আমরা আল্লাহতে এবং আমাদের প্রতি যাহা অবতীর্ণ হইয়াছে এবং ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাহার বংশধরগণের প্রতি যাহা অবতীর্ণ হইয়াছিল এবং যাহা মূসা, ঈসা ও অন্যান্য নবীগণকে তাহাদের প্রতিপালকের নিকট হইতে প্রদান করা হইয়াছে তাহাতে ঈমান আনিয়াছি; আমরা তাহাদের মধ্যে কোন তারতম্য করি না এবং আমরা তাঁহারই নিকট আত্মসমর্পণকারী” (৩ : ৮৪)।
“বল, আল্লাহ সত্য বলিয়াছেন। সুতরাং তোমারা একনিষ্ঠ ইবরাহীমের (ধর্মাদর্শ অনুসরণ কর, সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নহে” (৩ : ৯৫)।
“নিশ্চয় মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল তাহা তো বাক্কায়; উহা বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারী। উহাতে (কাবা গৃহে) অনেক সুস্পষ্ট নিদর্শন আছে, যেমন মাকামে ইবরাহীম। আর যে কেহ সেথায় প্রবেশ করে সে নিরাপদ” (৩ : ৯৬-৯৭)।
“অথবা আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে মানুষকে যাহা দিয়াছেন সেজন্য কি তাহারা তাহাদিগকে ঈর্ষা করে? আমি ইবরাহীমের বংশধরকেও তো কিতাব ও হিকমত প্রদান করিয়াছিলাম এবং তাহাদিগকে বিশাল রাজ্য দান করিয়াছিলাম।“ (৪:৫৪)
“তাহার অপেক্ষা দীনে কে উত্তম যে সৎকর্মপরায়ণ হইয়া আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করে এবং একনিষ্ঠভাবে ইবরাহীমের মিল্লাত (ধর্মাদর্শ অনুসরণ করে? আল্লাহ ইবরাহীমকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করিয়াছেন” (৪:১২৫)
“আমি তো তোমার নিকট ওহী প্রেরণ করিয়াছি, যেমন নূহ ও তাহার পরবর্তী নবীগণের নিকট ওহী প্রেরণ করিয়াছিলাম। ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাহার বংশধরগণ, ঈসা, আইয়ূব, ইউনুস, হারূন ও সুলায়মানের নিকটও ওহী প্রেরণ করিয়াছিলাম এবং দাঊদকে যাকূর দিয়েছিলাম।“
“স্মরণ কর, ইবরাহীম তাহার পিতা আরকে বলিয়াছিল, আপনি কি মূর্তিকে ইলাহরূপে গ্রহণ করেন :আমি তো আপনাকে ও আপনার সম্প্রদায়কে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে দেখিতেছি। এইভাবে আমি ইবরাহীমকে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর পরিচালন ব্যবস্থা দেখাই, যাহাতে সে নিশ্চিত বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়। অতঃপর রাত্রির অন্ধকার যখন তাহাকে আচ্ছন্ন করিল তখন সে নক্ষত্র দেখিয়া বলিল, ইহাই আমার প্রতিপালক। অতপর যখন উহা অস্তমিত হইল তখন সে বলিল, যাহা অস্তমিত হয় তাহা আমি পছন্দ করি না। অতঃপর যখন সে চন্দ্রকে সমুজ্জ্বলরূপে উদিত হইতে দেখিল তখন বলিল, ইহা আমার প্রতিপালক । যখন ইহাও আস্তমিত হইল তখন সে বলিল, আমাকে আমার প্রতিপালক সৎপথ প্রদর্শন না করিলে আমি অবশ্যই পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হইব। অতঃপর যখন সে সূর্যকে দীপ্তিমানরূপে উদিত হইতে দেখিল তখন বলিল, “ইহা আমার প্রতিপালক, ইহা সর্ববৃহৎ। যখন ইহাও অস্তমিত হইল তখন সে বলিল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যাহাকে আল্লাহর শরীক কর তাহার সহিত আমার কোন সংশ্রব নাই। আমি একনিষ্ঠভাবে তাঁহার দিকে মুখ ফিরাইতেছি যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করিয়াছেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নহি। তাহার সম্প্রদায় তাহার সহিত বিতর্কে লিপ্ত হইল। সে বলিল, তোমরা কি আল্লাহ সম্বন্ধে আমার সহিত বিতর্কে লিপ্ত হইবে? তিনি তো আমাকে সৎপথে পরিচালিত করিয়াছেন। আমার প্রতিপালক অন্যবিধ ইচ্ছা না করিলে তোমরা যাহাকে তাহার সহিত শরীক কর তাহাকে আমি ভয় করি না। সব কিছুই আমার প্রতিপালকের জ্ঞানায়, তবে কি তোমরা অনুধাবন করিবে না? তোমরা যাহাকে আল্লাহর শরীক কর আমি তাহাকে কিরূপে ভয় করিব? অথচ তোমরা আল্লাহর শরীক করিতে ভয় কর না, যে বিষয়ে তিনি তোমাদিগকে কোন সনদ দেন নাই। সুতরাং যদি তোমরা জান তবে বল, দুই দলের মধ্যে কোন দল নিরাপত্তা লাভের বেশী হকদার” (৬৭৪-৮১)?
“আর ইহা আমার যুক্তি-প্রমাণ যাহা ইবরাহীমকে দিয়াছিলাম তাহার সম্প্রদায়ের মুকাবিলায়; যাহাকে ইচ্ছা মর্যাদায় আমি উন্নীত করি। নিশ্চয় তোমার প্রতিপালক প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ । আর আমি তাহাকে দান করিয়াছিলাম ইসহাক ও ইয়াকুব, ইহাদের প্রত্যেককে সৎপথে পরিচালিত করিয়াছিলাম এবং তাহার বংশধর দাঊদ, সুলায়মান ও আইয়ুব, ইউসুফ, মূসা ও হারূনকেও; আর এইভাবেই আমি সৎকর্মপরায়ণদিগকে পুরস্কৃত করি” (৬ : ৮৩-৮৪)।
“বল, আমার প্রতিপালক তো আমাকে সৎপথে পরিচালিত করিয়াছেন। উহাই সুপ্রতিষ্ঠিত দীন, ইবরাহীমের মিল্লাত (ধর্মাদর্শ); সে ছিল একনিষ্ঠ এবং সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না” (৬ : ১৬১)।
“উহাদের পূর্ববর্তী নূহ, আদ ও ছামূদের সম্প্রদায়, ইবরাহীমের সম্প্রদায় এবং মাদয়ান ও বিধ্বস্ত নগরের অধিবাসিগণের সংবাদ কি উহাদের নিকট আসে নাই? উহাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শনসহ উহাদের রাসূলগণ আসিয়াছিল। আল্লাহ এমন নহেন যে, তাহাদের উপর জুলুম করেন, কিন্তু উহারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি জুলুম করে” (৯ : ৭০)।
“ইবরাহীম তাহার পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিয়াছিল, তাহাকে ইহার প্রতিশ্রুতি দিয়াছিল বলিয়া। অতঃপর যখন ইহা তাহার নিকট সুস্পষ্ট হইল যে, সে আল্লাহর শত্রু, তখন ইবরাহীম উহার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করিল। ইবরাহীম তো কোমল হূদয় ও সহনশীল” (৯ : ১১৪)।
“আমার ফেরেশতাগণ তো সুসংবাদ লইয়া ইবরাহীমের নিকট আসিল। তাহারা বলিল, সালাম। সেও বলিল, ‘সালাম। সে অবিলম্বে এক কাবাবকৃত গো-বৎস লইয়া আসিল। সে যখন দেখিল, তাহাদের হস্ত উহার দিকে প্রসারিত হইতেছে না, তখন তাহাদিগকে অবাঞ্ছিত মনে করিল এবং তাহাদের সম্বন্ধে তাহার মনে ভীতির সঞ্চার হইল। তাহারা বলিল, ভয় করিও না, আমরা তো নূতের সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হইয়াছি। আর তাহার স্ত্রী দণ্ডায়মান এবং সে হাসিয়া ফেলিল। অতঃপর আমি তাহাকে ইসহাকের ও ইসহাকের পরবর্তী ইয়াকুবের সুসংবাদ দিলাম। সে বলিল, কী আশ্চর্য! সন্তানের জননী হইব আমি, যখন আমি বৃদ্ধা এবং এই আমার স্বামী বৃদ্ধ! ইহা অবশ্যই এক অদ্ভুত ব্যাপার। তাহারা বলিল, আল্লাহর কাজে তুমি বিস্ময় বোধ করিতেছ? হে পরিবারবর্গ! তোমাদের প্রতি রহিয়াছে আল্লাহর অনুগ্রহ ও কল্যাণ। তিনি তো প্রশংসাহ ও সম্মানাহ্। অতঃপর যখন ইবরাহীমের ভীতি দূরীভূত হইল এবং তাহার নিকট সুসংবাদ আসিল তখন সে দূতের সম্প্রদায়ের সম্বন্ধে আমার সহিত বাদানুবাদ করিতে লাগিল। ইবরাহীম তো অবশ্যই সহনশীল, কোমল হূদয়, সতত আল্লাহ অভিমুখী। হে ইবরাহীম! ইহা হইতে বিরত হও; তোমার প্রতিপালকের বিধান আসিয়া পড়িয়াছে; উহাদের প্রতি তো আসিবে শাস্তি যাহা অনিবার্য” (১১ : ৬৯-৭৬)।
“এইভাবে তোমার প্রতিপালক তোমাকে মনোনীত করিবেন এবং তোমাকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিবেন এবং তোমার প্রতি ও ইয়াকূবের পরিবার-পরিজনের প্রতি তাঁহার অনুগ্রহ পূর্ণ করিবেন, যেভাবে তিনি ইহা পূর্বে পূর্ণ করিয়াছিলেন তোমার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম ও ইসহাকের প্রতি। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়” (১২ : ৬)।
“আমি (ইউসুফ) আমার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকুবের মতবাদ অনুসরণ করি । আল্লাহর সহিত কোন বস্তুকে শরীক করা আমাদের কাজ নহে। ইহা আমাদের ও সমস্ত মানুষের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ; কিন্তু অধিকাংশ মানুষই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না” (১২ : ৩৮)।
“স্মরণ কর, ইবরাহীম বলিয়াছিল, হে আমার প্রতিপালক! এই নগরীকে নিরাপদ করিও এবং আমাকে ও আমার পুত্রগণকে প্রতিমা পূজা হইতে দূরে রাখিও। হে আমার প্রতিপালক! এই সকল প্রতিমা তো বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করিয়াছে। সুতরাং যে আমার অনুসরণ করিবে সেই আমার দলভুক্ত, কিন্তু কেহ আমার অবাধ্য হইলে তুমি তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। হে আমাদের প্রতিপালক! আমি আমার বংশধরদের কতককে বসবাস করাইলাম অনুর্বর উপত্যকায় তোমার পবিত্র গৃহের নিকট। হে আমাদের প্রতিপালক! এইজন্য যে, উহারা যেন সালাত কায়েম করে। অতএব তুমি কিছু লোকের অন্তর উহাদের প্রতি অনুরাগী করিয়া দাও এবং ফলাদি দ্বারা উহাদের রিযিকের ব্যবস্থা করিও, যাহাতে উহারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি তো জান যাহা আমরা গোপন করি ও যাহা আমরা প্রকাশ করি। আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর কিছুই আল্লাহর নিকট গোপন থাকে না। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্ই, যিনি আমাকে আমার বার্ধক্যে ইসমাঈল ও ইসহাককে দান করিয়াছেন। আমার প্রতিপালক অবশ্যই প্রার্থনা শুনিয়া থাকেন। হে আমার প্রতিপালক! আমাকে সালাত কায়েমকারী কর এবং আমার বংশধরদের মধ্য হইতেও। হে আমাদের প্রতিপালক! আমার প্রার্থনা কবুল কর। হে আমাদের প্রতিপালক! যেই দিন হিসাব অনুষ্ঠিত হইবে সেই দিন আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে এবং মুমিনগণকে ক্ষমা করিও” (১৪ ও ৩৫-৪১)।
“আর উহাদিগকে বল ইবরাহীমের অতিথিদের কথা, যখন উহারা তাহার নিকট উপস্থিত হইয়া বলিল, সালাম, তখন সে বলিয়াছিল, আমরা তোমাদের আগমনে আতংকিত! উহারা বলিল, ভয় করিও না, আমরা তোমাকে এক জ্ঞানী পুত্রের শুভ সংবাদ দিতেছি। সে বলিল, তোমরা কি আমাকে শুভ সংবাদ দিতেছ আমি বার্ধক্যগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও? তোমরা কি বিষয়ে শুভ সংবাদ দিতেছ? উহারা বলিল, আমরা সত্য সংবাদ দিতেছি; সুতরাং তুমি হতাশ হইও না। সে বলিল, যাহারা পথভ্রষ্ট তাহারা ব্যতীত আর কে তাহার প্রতিপালকের অনুগ্রহ হইতে হতাশ হয় : সে বলিল, হে ফেরেশতাগণ! তোমাদের আর বিশেষ কি কাজ আছে : উহারা বলিল, আমাদিগকে এক অপরাধী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রেরণ করা হইয়াছে, তবে পূতের পরিবারবর্গের বিরুদ্ধে নহে, আমরা অবশ্যই ইহাদের সকলকে রক্ষা করিব, কিন্তু তাহার স্ত্রীকে নহে। আমরা স্থির করিয়াছি যে, সে অবশ্যই পশ্চাতে অবস্থানকারীদের অন্তর্ভুক্ত” (১৫ : ৫১-৬০)।
“ইবরাহীম ছিল এক ‘উম্মাত, আল্লাহর অনুগত, একনিষ্ঠ এবং সে ছিল না মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত। সে ছিল আল্লাহর অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞ। আল্লাহ তাহাকে মনোনীত করিয়াছিলেন এবং তাহাকে পরিচালিত করিয়াছিলেন সরল পথে। আমি তাহাকে দুনিয়ায় দিয়াছিলাম এবং আখিরাতেও সে নিশ্চয়ই সৎকর্মপরায়ণদের অন্যতম। এখন আমি তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করিলাম, তুমি একনিষ্ঠ ইবরাহীমের ধর্মাদর্শ অনুসরণ কর এবং সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না” (১৬ : ১২০-১২৩)।
“স্মরণ কর, এই কিতাবে উল্লিখিত ইবরাহীমের কথা; সে ছিল সত্যনিষ্ঠ, নবী। যখন সে তাহার পিতাকে বলিল, হে আমার পিতা! তুমি তাহার ইবাদত কর কেন যে শুনে না, দেখে না এবং তোমার কোন কাজেই আসে না? হে আমার পিতা! আমার নিকট তো আসিয়াছে জ্ঞান যাহা তোমার নিকট আসে নাই; সুতরাং আমার অনুসরণ কর, আমি তোমাকে সঠিক পথ দেখাইব। হে আমার পিতা! শয়তানের ইবাদত করিও না। শয়তান তো দয়াময়ের অবাধ্য। হে আমার পিতা! আমি তো আশংকা করি যে, তোমাকে দয়াময়ের শাস্তি স্পর্শ করিবে, তখন তুমি হইয়া পড়িবে শয়তানের বন্ধু । পিতা বলিল, হে ইবরাহীম! তুমি কি আমার দেব-দেবী হইতে বিমুখ? যদি তুমি নিবৃত্ত না হও তবে আমি প্রস্তরাঘাতে তোমার প্রাণনাশ করিবই; তুমি চিরদিনের জন্য আমার নিকট হইতে দূর হইয়া যাও। ইবরাহীম বলিল, তোমার প্রতি সালাম। আমি আমার প্রতিপালকের নিকট তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিব, নিশ্চয় তিনি আমার প্রতি অতিশয় অনুগ্রহশীল। আমি তোমাদিগের হইতে ও তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাহাদের ইবাদত কর তাহাদিগ হইতে পৃথক হইতেছি। আমি আমার প্রতিপালককে আহবান করি; আশা করি, আমার প্রতিপালককে আহবান করিয়া আমি ব্যর্থকাম হইব না। অতঃপর সে যখন তাহাদিগ হইতে ও তাহারা আল্লাহ ব্যতীত যাহাদের ইবাদত করিত সেই সকল হইতে পৃথক হইয়া গেল তখন আমি তাহাকে দান করিলাম ইসহাক ও ইয়াকূব এবং প্রত্যেককে নবী করিলাম। এবং তাহাদিগকে আমি দান করিলাম আমার অনুগ্রহ ও তাহাদের নাম-যশ সমুচ্চ করিলাম” (১৯ : ৪১-৫০)।
“আমি তো ইহার পূর্বে ইবরাহীমকে সৎপথের জ্ঞান দিয়াছিলাম এবং আমি তাহার সম্বন্ধে ছিলাম সম্যক পরিজ্ঞাত। যখন সে তাহার পিতা ও তাহার সম্প্রদায়কে বলিল, এই মূর্তিগুলি কী, যাহাদের পূজায় তোমরা রত রহিয়াছ? উহারা বলিল, আমরা আমাদের পিতৃপুরুষগণকে ইহাদের পূজা করিতে দেখিয়াছি। সে বলিল, তোমরা নিজেরা এবং তোমাদের পিতৃপুরুষগণও রহিয়াছ সুস্পষ্ট ভ্রান্তিতে । উহারা বলিল, তুমি কি আমাদের নিকট সত্য আনিয়াছ; না তুমি কৌতুক করিতেছ? সে বলিল, না, তোমাদের প্রতিপালক তো আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর প্রতিপালক, যিনি উহাদের সৃষ্টি করিয়াছেন এবং এই বিষয়ে আমি অন্যতম সাক্ষী। শপথ আল্লাহর! তোমরা চলিয়া গেলে আমি তোমাদের মূর্তিগুলি সম্বন্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা অবলম্বন করিব। অতঃপর সে চূর্ণ-বিচূর্ণ করিয়া দিল মূর্তিগুলিকে, উহাদের প্রধানটি ব্যতীত; যাহাতে উহারা তাহার দিকে ফিরিয়া আসে। উহারা বলিল, আমাদের উপাস্যগুলির প্রতি এইরূপ করিল কে? সে নিশ্চয়ই সীমালংঘনকারী। কেহ কেহ বলিল, এক যুবককে উহাদের সমালোচনা করিতে শুনিয়াছি, তাহাকে বলা হয় ইবরাহীম। উহারা বলিল, তাহাকে উপস্থিত কর লোকসম্মুখে, যাহাতে উহারা সাক্ষ্য দিতে পারে। উহারা বলিল, হে ইবরাহীম! তুমিই কি আমাদের উপাস্যগুলির প্রতি এইরূপ করিয়াছ? সে বলিল, সেই তো ইহা করিয়াছে, এই তো ইহাদের প্রধান। ইহাদিগকে জিজ্ঞাসা কর, যদি ইহারা কথা বলিতে পারে। তখন উহারা মনে মনে চিন্তা করিয়া দেখিল এবং একে অপরকে বলিতে লাগিল, তোমরাই তো সীমালংঘনকারী! অতঃপর উহাদের মস্তক অবনত হইয়া গেল এবং উহারা বলিল, তুমি তো জানই যে, ইহারা কথা বলে না। ইবরাহীম বলিল, তবে কি তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ইবাদত কর যাহা তোমাদের কোন উপকার করিতে পারে না, ক্ষতিও করিতে পারে না? ধিক তোমাদিগকে এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাহাদের ইবাদত কর তাহাদিগকে! তবে কি তোমরা বুঝিবে না? উহারা বলিল, তাহাকে পোড়াইয়া দাও এবং সাহায্য কর তোমাদের দেবতাগুলিকে, তোমরা যদি কিছু করিতে চাই। আমি বলিলাম, হে অগ্নি! তুমি ইবরাহীমের জন্য শীতল ও নিরাপদ হইয়া যাও। উহারা তাহার ক্ষতি সাধনের ইচ্ছা করিয়াছিল কিন্তু আমি উহাদিগকে করিয়া দিলাম সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত। এবং আমি তাহাকে ও লূতকে উদ্ধার করিয়া লইয়া গেলাম সেই দেশে যেথায় আমি কল্যাণ রাখিয়াছি বিশ্ববাসীর জন্য। এবং আমি ইবরাহীমকে দান করিয়াছিলাম ইসহাক এবং পৌত্ররূপে ইয়াকূব; আর প্রত্যেককেই করিয়াছিলাম সৎকর্মপরায়ণ এবং তাহাদিগকে করিয়াছিলাম নেতা। তাহারা আমার নির্দেশ অনুসারে মানুষকে পথ প্রদর্শন করিত; তাহাদিগকে ওহী প্রেরণ করিয়াছিলাম সঙ্কর্ম করিতে, সালাত কায়েম করিতে এবং যাকাত প্রদান করিতে; তাহারা আমারই ইবাদত করিত” (২১ : ৫১-৭৩)।
“এবং স্মরণ কর, যখন আমি ইবরাহীমের জন্য নির্ধারণ করিয়া দিয়াছিলাম সেই গৃহের স্থান, তখন বলিয়াছিলাম, আমার সহিত কোন শরীক করিও না এবং আমার গৃহকে পবিত্র রাখিও তাহাদের জন্য যাহারা তাওয়াফ করে এবং দাঁড়ায়, রুকু করে ও সিজদা করে। এবং মানুষের নিকট হজ্জের ঘোষণা করিয়া দাও, উহারা তোমার নিকট আসিবে দূর-দূরান্ত পথ অতিক্রম করিয়া” (২২ : ২৬-২৭)।
“ইবরাহীম ও নূতের সম্প্রদায় এবং মাদয়ানবাসীরা (তাহাদের নবীগণকে অস্বীকার করিয়াছিল)। আর অস্বীকার করা হইয়াছিল মূসাকেও। আমি কাফিরদিগকে অবকাশ দিয়াছিলাম, অতঃপর তাহাদিগকে শাস্তি দিয়াছিলাম । অতএব কেমন ছিল শাস্তি” (২২ ও ৪৩-৪৪)।
“ইহা তোমাদের পিতা ইবরাহীমের মিল্লাত। তিনি পূর্বে তোমাদের নামকরণ করিয়াছেন মুসলিম এবং এই কিতাবেও; যাহাতে রাসূল তোমাদের জন্য সাক্ষী হয় এবং তোমরা সাক্ষীস্বরূপ হও মানবজাতির জন্য” (২২ : ৭৮)।
“উহাদের নিকট ইবরাহীমের বৃত্তান্ত বর্ণনা কর। সে যখন তাহার পিতা ও তাহার সম্প্রদায়কে বলিয়াছিল, তোমরা কিসের ইবাদত কর? উহারা বলিল, “আমরা মূর্তির পূজা করি এবং আমরা নিষ্ঠার সহিত উহাদের পূজায় নিরত থাকিব। সে বলিল, তোমরা প্রার্থনা করিলে উহারা কি শোনে অথবা উহারা কি তোমাদের উপকার কিংবা অপকার করিতে পারে? উহারা বলিল, না, তবে আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদিগকে এইরূপ করিতে দেখিয়াছি। সে বলিল, তোমরা কি ভাবিয়া দেখিয়াছ, কিসের পূজা করিতেছ, তোমরা এবং তোমাদের অতীত পিতৃপুরুষেরা? উহারা সকলেই আমার শত্রু, জগতসমূহের প্রতিপালক ব্যতীত; যিনি আমাকে সৃষ্টি করিয়াছেন, তিনিই আমাদিগকে পথ প্রদর্শন করেন। তিনিই আমাকে দান করেন আহার্য ও পানীয় এবং রোগাক্রান্ত হইলে তিনিই আমাকে রোগমুক্ত করেন; এবং তিনিই আমার মৃত্যু ঘটাইবেন, অতঃপর পুনর্জীবিত করিবেন এবং আশা করি, তিনি কিয়ামত দিবসে আমার অপরাধ মার্জনা করিয়া দিবেন। হে আমার প্রতিপালক! আমাকে জ্ঞান দান কর এবং সঙ্কর্মপরায়ণদের শামিল কর। আমাকে পরবর্তীদের মধ্যে যশস্বী কর এবং আমাকে সুখময় জান্নাতের অধিকারীদের অন্তর্ভুক্ত কর। আর আমার পিতাকে ক্ষমা কর, তিনি তো পথভ্রষ্টদের শামিল ছিলেন। এবং আমাকে লাঞ্ছিত করিও না পুনরুত্থান দিবসে, যেদিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি কোন কাজে আসিবে না; সে দিন উপকৃত হইবে কেবল সে, যে আল্লাহর নিকট আসিবে বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ লইয়া” (২৬ : ৬৯-৭৯)।
“স্মরণ কর ইবরাহীমের কথা, সে তাহার সম্প্রদায়কে বলিয়াছিল, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর এবং তাহাকে ভয় কর; তোমাদের জন্য ইহাই শ্রেয় যদি তোমরা জানিতে! তোমরা তো আল্লাহ ব্যতীত কেবল মূর্তিপূজা করিতেছ এবং মিথ্যা উদ্ভাবন করিতেছ। তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাহাদের পূজা কর তাহারা তোমাদের জীবনোপকরণের মালিক নহে। সুতরাং তোমরা জীবনোপকরণ কামনা কর আল্লাহর নিকট এবং তাহারই ইবাদত কর ও তাহার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। তোমরা তাঁহারই নিকট প্রত্যাবর্তিত হইবে” (২৯ ও ১৬-১৭)।
“যখন আমার প্রেরিত ফেরেশতাগণ সুসংবাদসহ ইবরাহীমের নিকট আসিল, তাহার বলিয়াছিল, আমরা এই জনপদবাসীদিগকে ধ্বংস করিব, ইহার অধিবাসীরা তো জালিম। ইবরাহী বলিল, এই জনপদে তো দূত রহিয়াছে। উহারা বলিল, সেথায় কাহারা আছে তাহা আমরা ভাল জানি, আমরা তো দূতকে ও তাহার পরিজনবর্গকে রক্ষা করিবই, তাহার স্ত্রীকে ব্যতীত; সে তো পাশ্চাতে অবস্থানকারীদের অন্তর্ভুক্ত” (২৯ ও ৩১-৩২)।
“স্মরণ কর, যখন আমি নবীদের নিকট হইতে অংগীকার গ্রহণ করিয়াছিলাম এবং তোমার নিকট হইতেও এবং নূহ, ইবরাহীম, মূসা ও মারইয়াম-তনয় ঈসার নিকট হইতেও। তাহাদের নিকট হইতে গ্রহণ করিয়াছিলাম দৃঢ় অংগীকার” (৩৩৭)।
“আর ইবরাহীম তো তাহার (নূহের) অনুগামীদের অন্তর্ভুক্ত। স্মরণ কর, সে তাহার প্রতিপালকের নিকট উপস্থিত হইয়াছিল বিশুদ্ধ চিত্তে। যখন সে তাহার পিতা ও তাহার সম্প্রদায়কে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, তোমরা কিসের পূজা করিতেছ; তোমরা কি আল্লাহর পরিবর্তে অলীক ইলাহগুলিকে চাও? জগতসমূহের প্রতিপালক সম্বন্ধে তোমাদের ধারণা কি? অতঃপর সে তারকারাজির দিকে একবার তাকাইল এবং বলিল, আমি অসুস্থ। অতঃপর উহারা তাহাকে পশ্চাতে রাখিয়া চলিয়া গেল । পরে সে সন্তর্পণে উহাদের দেবতাগুলির নিকট গেল এবং বলিল, তোমরা খাদ্য গ্রহণ করিতেছ না কেন? তোমাদের কী হইয়াছে যে, তোমরা কথা বল না? অতঃপর সে উহাদের উপর সবলে আঘাত হানিল। তখন ঐ লোকগুলি তাহার দিকে ছুটিয়া আসিল। সে বলিল, তোমরা নিজেরা যাহাদিগকে খোদাই করিয়া নির্মাণ কর তোমরা কি তাহাদেরই পূজা কর? প্রকৃতপক্ষে আল্লাহই সৃষ্টি করিয়াছেন তোমাদিগকে এবং তোমরা যাহা তৈরী কর তাহাও। উহারা বলিল, ইহার জন্য এক ইমারত নির্মাণ কর, অতঃপর ইহাকে জ্বলন্ত অগ্নিতে নিক্ষেপ কর। উহারা তাহার বিরুদ্ধে চক্রান্তের সংকল্প করিয়াছিল; কিন্তু আমি উহাদিগকে অতিশয় হেয় করিয়া দিলাম। সে বলিল, আমি আমার প্রতিপালকের দিকে চলিলাম। তিনি আমাকে অবশ্যই সৎপথে পরিচালিত করিবেন। হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এক সৎকর্মপরায়ণ সন্তান দান কর। অতঃপর আমি তাহাকে এক স্থিরবুদ্ধি পুত্রের সুংবাদ দিলাম। অতঃপর সে যখন তাহার পিতার সঙ্গে কাজ করিবার মত বয়সে উপনীত হইল তখন ইবরাহীম বলিল, বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে আমি যবাহ করিতেছি, এখন তোমার অভিমত কি বল? সে বলিল, হে আমার পিতা! আপনি যাহা আদিষ্ট হইয়াছেন, তাহাই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাইবেন। যখন তাহারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করিল এবং ইবরাহীম তাহার পুত্রকে কাত করিয়া শায়িত করিল, তখন আমি তাহাকে আহবান করিয়া বলিলাম, হে ইবরাহীম! তুমি তো স্বপ্নদেশ সত্যই পালন করিলে! এইভাবেই আমি সৎকর্মপরায়ণদিগকে পুরস্কৃত করিয়া থাকি। নিশ্চয়ই ইহা ছিল এক স্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাহাকে মুক্ত করিলাম এক মহান কুরবানীর বিনিময়ে। আমি ইহা পরবর্তীদের স্মরণে রাখিয়াছি । ইবরাহীমের উপর শান্তি বর্ষিত হউক। এইভাবে আমি সৎকর্মপরায়ণদিগকে পুরস্কৃত করিয়া থাকি। সে ছিল আমার মুমিন বান্দাদের অন্যতম। আমি তাহাকে সুসংবাদ দিয়াছিলাম ইসহাকের। সে ছিল এক নবী, সৎকর্মপরায়ণদের অন্যতম। আমি তাহাকে বরকত দান করিয়াছিলাম এবং ইসহাককেও; তাহাদের বংশধরদের মধ্যে কতক সৎকর্মপরায়ণ এবং কতক নিজেদের প্রতি স্পষ্ট অত্যাচারী” (৩৭ : ৮৩-১১৩)।
“স্মরণ কর আমার বান্দা ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকূবের কথা। উহারা ছিল শক্তিশালী ও সূক্ষ্মদর্শী। আমি তাহাদিগকে অধিকারী করিয়াছিলাম এক বিশেষ গুণের, উহা ছিল পরলোকের স্মরণ। অবশ্যই তাহারা ছিল আমার মনোনীত উত্তম বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত” (৩৮ : ৪৫-৪৭)।
“তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করিয়াছেন দীন যাহার নির্দেশ দিয়াছিলেন তিনি নূহকে আর যাহার আমি ওহী করিয়াছি তোমাদের এবং যাহার নির্দেশ দিয়াছিলাম ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই বলিয়া যে, তোমরা দীনকে প্রতিষ্ঠা কর এবং উহাতে মতভেদ করিও না” (৪২ ও ১৩)।
“স্মরণ কর, ইবরাহীম তাহার পিতা ও সম্প্রদায়কে বলিয়াছিল, তোমরা যাহাদের পূজা কর তাহাদের সহিত আমার কোন সম্পর্ক নাই; সম্পর্ক আছে শুধু তাঁহারই সহিত, যিনি আমাকে সৃষ্টি করিয়াছেন এবং তিনিই আমাকে সৎপথে পরিচালিত করিবেন। এই ঘোষণাকে সে স্থায়ী বাণীরূপে রাখিয়া গিয়াছে তাহার পরবর্তীদের জন্য, যাহাতে উহারা প্রত্যাবর্তন করে” (৪৩ : ২৬-২৮)।
“তোমার নিকট ইবরাহীমের বৃত্তান্ত আসিয়াছে কি? যখন উহারা তাহার নিকট উপস্থিত হইয়া বলিল, ‘সালাম। উত্তরে সে বলিল, “সালাম। ইহারা তো অপরিচিত লোক। অতঃপর ইবরাহীম তাহার স্ত্রীর নিকট গেল এবং একটি মাংসল গো-বৎস ভাজা লইয়া আসিল ও তাহাদের সামনে রাখিল এবং বলিল, তোমরা খাইতেছ না কেন? ইহাতে উহাদের সম্পর্কে তাহার মনে ভীতির সঞ্চার হইল। উহারা বলিল, ভীত হইও না। অতঃপর উহারা তাহাকে এক জ্ঞানী পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিল। তখন তাহার স্ত্রী চিৎকার করিতে করিতে সম্মুখে আসিল এবং গাল চাপড়াইয়া বলিল, এই বৃদ্ধা-বন্ধ্যার সন্তান হইবে। তাহারা বলিল, তোমার প্রতিপালক এইরূপ বলিয়াছেন; তিনি প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ। ইবরাহীম বলিল, হে ফেরেশতাগণ! তোমাদের বিশেষ কাজ কি? উহারা বলিল, আমাদিগকে এক অপরাধী সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরণ করা হইয়াছে, উহাদের উপর নিক্ষেপ করিবার জন্য মাটির শক্ত ঢেলা, যাহা সীমালংঘনকারীদের জন্য চিহ্নিত তোমার প্রতিপালকের নিকট হইতে” (৫১ : ২৪-৩৪)।
“এবং (তাহাকে কি অবগত করানো হয় নাই যাহা আছে) ইবরাহীমের কিতাবে, যে পালন করিয়াছিল তাহার দায়িত্ব? উহা এই যে, কোন বহনকারী অপরের বোঝা বহন করিবে না” (৫৩: ৩৭-৩৮)।
“আমি নূহ ও ইবরাহীমকে রাসূলরূপে প্রেরণ করিয়াছিলাম এবং আমি তাহার বংশধরগণের জন্য স্থির করিয়াছিলাম নবুওয়াত ও কিতাব, কিন্তু উহাদের অল্পই সৎপথ অবলম্বন করিয়াছিল এবং অধিকাংশই ছিল সত্যত্যাগী” (৫৭ : ২৬)।
“তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তাহার অনুসারীদের মধ্যে রহিয়াছে উত্তম আদর্শ, যখন তাহারা তাহাদের সম্প্রদায়কে বলিয়াছিল, তোমাদের সঙ্গে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাহার ইবাদত কর তাহার সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নাই। আমরা তোমাদিগকে মানি না। তোমাদের ও আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হইল শত্রুতা ও বিদ্বেষ চিরকালের জন্য, যদি না তোমরা এক আল্লাহতে ঈমান আন। তবে ব্যতিক্রম তাহার পিতার প্রতি ইবরাহীমের উক্তি, আমি নিশ্চয়ই তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিব এবং তোমার ব্যাপারে আল্লাহর নিকট আমি কোন অধিকার রাখি না। ইবরাহীম ও তাহার অনুসারিগণ বলিয়াছিল, হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদিগকে কাফিরদের পীড়নের পাত্র করিও না। হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদিগকে ক্ষমা কর; তুমি তো পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়” (৬০ : ৪-৫)।
“ইহা তো আছে পূর্ববর্তী গ্রন্থে- ইবরাহীম ও মূসার গ্রন্থে” (৮৭ : ১৮-১৯)।
হাদীছে হযরত ইবরাহীম (আ)
“আবু হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, কিয়ামতের দিন ইবরাহীম (আ) তাঁহার পিতা আযরের সাক্ষাত পাইবেন। আযরের চেহারা থাকিবে কালিমালিপ্ত ও ধূলিমলিন। ইবরাহীম তাহাকে বলিবেন, আমি তোমাকে বলিয়াছিলাম না যে, আমার অবাধ্য হইও না? তখন তাহার পিতা বলিবে, আজ আর তোমার অবাধ্য হইব না। তখন ইবরাহীম বলিবেন, হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমার সহিত অঙ্গীকার করিয়াছিলেন যে, পুনরুত্থান দিবসে আমাকে অপদস্থ করিবেন না। আল্লাহর রহমত হইতে আমার পিতা দূরীভূত, ইহা হইতে বড় অপমান আমার জন্য আর কি হইতে পারে! তখন আল্লাহ তাআলা বলিবেন, আমি কাফিরদের উপর জান্নাত হারাম করিয়া দিয়াছি। অতঃপর তাহাকে বলা হইবে, হে ইবরাহীম! তোমার পায়ের নীচে কি? তিনি সেই দিকে তাকাইবেন। তাকাইয়া দেখিবেন নোংরা এক পুরুষ হায়েনা। অতঃপর উহার চার পা ধরিয়া উহাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হইবে” (আল-বুখারী, আস-সাহীহ, ৪ খ., ১৭৭-২৭৮, কিতাবুত তাফসীর, সূরা আল-আম্বিয়া)।
“ইবন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (স) খুতবা দিতে গিয়া বলিলেন, তোমরা হাশরের ময়দানে উখিত হইবে নগ্নপদে, নগ্ন মস্তকে ও নগ্ন শরীরে। যেভাবে আমি প্রথম সৃষ্টির সূচনা করিয়াছিলাম সেইভাবে পুনরায় সৃষ্টি করিব; প্রতিশ্রুতি পালন আমার কর্তব্য, আমি ইহা পালন করিবই । অতঃপর কিয়ামত দিবসে সর্বপ্রথম যাহাকে কাপড় পরানো হইবে তিনি ইবরাহীম (আ) (আল-বুখারী, আস-সাহীহ, কিরমানীর ভাষ্যযুক্ত, ১৭খ., ২১৩; কিতাবুত তাফসীর, সূরাতুল আম্বিয়া)।
“সামুরা (রা) হইতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, গত রাত্রে (মিরাজের রাত্রে) আমার নিকট দুইজন আগন্তুক আসিল। অতঃপর আমরা লম্বা এক ব্যক্তির নিকট আসিলাম। সোজাসুজিভাবে আমি তাহার মস্তক দেখিতে পাইতেছিলাম না। তিনি ইবরাহীম আলায়হিস সালাম” (আল-বুখারী, আস-সাহীহ, ৪ খ, ২৭৯, হাদীছ নং ৩১৩৮)।
“মুজাহিদর হইতে বর্ণিত। তিনি এক মজলিসে ইবন আব্বাস (রা)-এর নিকট হইতে শুনিলেন যে, লোকজন তাহার নিকট দাজজালের আলোচনা প্রসঙ্গে বলিল যে, তাহার চক্ষুদ্বয়ের মধ্যখানে লিখিত থকিবে ৫ (কাফির) অথবা ১-৬-এ (কাফ, ফা, রা)। ইবন আব্বাস (রা) বলিলেন, আমি ইহা শুনি নাই। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (স) বলিয়াছেন, আর ইবরাহীম (-এর আকৃতি জানিতে চাহ?) তবে তোমাদের সঙ্গীর (রাসূলুল্লাহ্র) প্রতি তাকাও” (বুখারী, আস-সাহীহ, ৪ খ, ২৭৯, হাদীছ নং ৩১৩৯; মুসলিম, আস-সাহীহ, ৭ খ., ৯৭)।
“আবু হুরায়রা (রা) হইতে। বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (স) বলিয়াছেন : ইবরাহীম (আ) তিনটি ছাড়া কখনও (আপাত দৃষ্টিতে) মিথ্যা বলেন নাই। উহার দুইটি আল্লাহর জন্য। তিনি বলিয়াছিলেন, আমি অসুস্থ; আর বলিয়াছিলেন, বরং উহাদের এই বড়টি উহা করিয়াছে। আর একটি হইল, একদিন তিনি ও সারা এক স্বৈরাচারী জালিম বাদশাহর রাজ্যে উপস্থিত হইলেন। অতঃপর বাদশাহকে বলা হইল, অমুক স্থানে এক ব্যক্তি আসিয়াছে, তাহার সহিত এক মহিলা আছে যে পরমা সুন্দরী । অতঃপর বাদশাহ ইবরাহীম (আ)-এর নিকট লোক পাঠাইল। (তিনি আসার পর) বাদশাহ তাহাকে সারা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিল যে, এই মহিলা কে? ইবরাহীম (আ) বলিলেন, সে আমার ভগ্নী। অতঃপর তিনি সারার নিকট আসিয়া বলিলেন, সারা! এই ভূখণ্ডে আমি আর তুমি ছাড়া কোন মুমিন নাই। আর এই বাদশাহ আমাকে জিজ্ঞাসা করিলে, আমি তাহাকে জানাইয়াছি যে, তুমি আমার ভগ্নী। তাই আমাকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করিও না। অতঃপর বাদশাহ সারার নিকট লোক পাঠাইল। সারা যখন তাহার নিকট প্রবেশ করিলেন তখন সে হাত দিয়া তাহাকে ধরিতে গেলে তাহার হাত অবশ হইয়া গেল। অতঃপর সে বলিল, আল্লাহর কাছে আমার জন্য দুআ কর, আমি আর তোমার ক্ষতি করিব না। তিনি আল্লাহর নিকট দুআ করিলেন। তাহার হাত ঠিক হইয়া গেল। সে দ্বিতীয়বার পুনরায় তাঁহাকে ধরিতে গেল, তখন অনুরূপভাবে অথবা তাহার চেয়ে আরো শক্তভাবে তাহার হাত অবশ হইয়া গেল। সে বলিল, আল্লাহর কাছে আমার জন্য দুআ কর। আমি আর তোমার ক্ষতি করিব না। তিনি দুআ করিলেন। তাহার হাত ঠিক হইয়া গেল। তখন সে তাহার এক প্রহরীকে ডাকিয়া বলিল, তোমরা আমার নিকট কোন মানুষ আননি, আনিয়াছ এক শয়তান। অতঃপর হাজারকে তাহার খিদমত করিতে দিল। অতঃপর সারা ইবরাহীমের নিকট আসিলেন। তিনি তখন সালাতে দণ্ডায়মান ছিলেন। তাই হাত দিয়া ইশারায় তাহার সংবাদ জিজ্ঞাসা করিলেন। সারা বলিলেন, আল্লাহ কাফিরের অথবা বলিয়াছিলেন, পাপিষ্ঠের চক্রান্ত নস্যাঁত করিয়া দিয়াছেন এবং হাজারকে খিদমত করিতে দিয়াছে। আবু হুরায়রা (রা) বলেন, হে আরববাসী! তিনি হইলেন তোমাদের মাতা” (আল-বুখারী, আস-সাহীহ, ৪খ., ২৮০, হাদীছ নং ৩১৪৩; মুসলিম, আস-সাহীহ, ৭খ., ৯৮-৯৯)।
“উম্মু শুরায়ক (রা) হইতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) গিরগিটি হত্যা করার নির্দেশ দিয়াছেন । উহা ইবরাহীম (আ)-এর অগ্নিতে ফুঙ্কার দিয়াছিল” (আল-বুখারী, আস-সাহীহ, ৪খ., ৫৯৮, কিতাবুখ আম্বিয়া)।
“ইবন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) বায়তুল্লাহ-এ প্রবেশ করিলেন এবং সেখানে ইবরাহীম (আ) ও মারয়াম (আ)-এর প্রতিকৃতি দেখিতে পাইলেন। তিনি বলিলেন, তাহাদের কি
অবস্থা! তাহারা তো শুনিয়াছে যে, যে গৃহে প্রতিকৃতি থাকে ফেরেশতাগণ সেখানে প্রবেশ করেন না। এই যে ইবরাহীমের প্রতিকৃতি, তিনি কখনও তীর দ্বারা ভাগ্য পরীক্ষা করেন নাই” (বুখারী, আস-সাহীহ, কিতাবুল আম্বিয়া, ৪খ. ৫৯৭)।
“ইবন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) যখন বায়তুল্লাহ্-য় মূর্তি দেখিলেন তখন সেখানে প্রবেশ করিলেন না। তিনি সেইগুলি সরাইয়া ফেলিবার নির্দেশ দিলেন। অতঃপর উহা নিশ্চিহ্ন করিয়া দেওয়া হইল। তিনি ইব্রাহীম ও ইসমাঈল (আ)কে দেখিলেন যে, তাহাদের হাতে তীর। তিনি বলিলেন, আল্লাহ উহাদের (মুশরিকদের) ধ্বংস করুন। আল্লাহর কসম! এই দুইজন কখনো তীর দ্বারা ভাগ্য পরীক্ষা করেন নাই” (বুখারী, প্রাগুক্ত)
“আবু হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত। একদিন রাসূলুল্লাহ (স)-এর নিকট গোশত আনা হইল। তিনি বলিলেন, আল্লাহ কিয়ামতের দিন পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলকে এক ময়দানে একত্র করিবেন। অতঃপর ঘোষণাকারী তাহাদিগকে ঘোষণা শুনাইবে এবং সমস্ত ময়দান সমতল হওয়ার কারণে সকলের দৃষ্টিগোচর হইবে এবং সূর্য নিকটবর্তী হইবে। অতঃপর তাহারা ইবরাহীম (আ)–এর নিকট গিয়া বলিবে, আপনি দুনিয়াতে আল্লাহর নবী ও বন্ধু ছিলেন। আমাদের জন্য আপনার প্রতিপালকের নিকট সুপারিশ করুন। অতঃপর তিনি তাঁহার আপাত মিথ্যাগুলির কথা উল্লেখ করিয়া বলিবেন, ইয়া নাফসী! ইয়া নাফসী! তোমরা মূসার নিকট যাও” (বুখারী, আস-সাহীহ, কিতাবুল আম্বিয়া, ৪খ., ৫৯৯, হাদীছ নং-৩১৪৬)।
ইবন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, ইবরাহীম (আ) আশি বৎসর বয়সে বাইস (কাম) দ্বারা খাতনা করেন অথবা কাদূম নামক স্থানে খতনা করেন” (বুখারী, আস-সাহীহ, কিতাবুল আম্বিয়া, ৪., ২৭৯, হাদীছ নং ৩১৪০; মুসলিম আস-সাহীহ, ৭খ, ৯৭)।
“ইব্ন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত। নবী (স) হাসান ও হুসায়নকে ঝাড়ফুঁক করিতেন এবং বলিতেন, তোমাদের (আদি) পিতা ইসমাঈল ও ইসহাককে এই বলিয়া ঝাড়ফুক করিতেন ।
“আমি আল্লাহর পূর্ণ শব্দাবলী দ্বারা শরণ লইতেছি সকল শয়তান হইতে এবং সকল ভীতিপ্রদ বিষাক্ত কীট-পতঙ্গ হইতে এবং সকল ক্ষতিকর কুদৃষ্টি হইতে”।
“আবু যার (রা) মিরাজের হাদীছ বর্ণনা করিয়া বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (স) বলেন…. অতঃপর আমি ইবরাহীম (আ)-এর নিকট দিয়া গেলাম। তিনি বলিলেন, মারহাবা! পুণ্যবান নবী এবং পুণ্যবান বৎস! আমি বলিলাম, ইনি কে? জিবরীল বলিলেন, ইনি ইবরাহীম” (আল-বুখারী, আস-সাহীহ, বাউল খালক, হাদীছ নং ৪১২৭)।
“আনাস (রা) হইতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স)-এর জন্য উঁহুদ পর্বত উদ্ভাসিত হইল। অতঃপর তিনি বলিলেন, এই পর্বত আমাদিগকে ভালবাসে, আমরাও উহাকে ভালবাসি। হে আল্লাহ! ইবরাহীম মক্কা হারাম করিয়াছেন আর আমি উহার দুই কঙ্করময় মরুভূমির মধ্যখানে যাহা আছে তাহা হারাম করিতেছি” (আল-বুখারী, বাদউল-খালক, হাদীছ নং ৩১৫১)।
“উম্মুল মুমিনীন আইশা (রা) হইতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, তুমি কি দেখ নাই যে, তোমার সম্প্রদায় যখন কাবা নির্মাণ করে তখন তাহা ইবরাহীম-এর ভিত হইতে কমাইয়া দেয়? আমি বলিলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি উহাকে ইবরাহীমের ভিত-এর উপর ফিরাইয়া দেন না কেন? তিনি বলিলেন, তোমার সম্প্রদায় যদি সদ্য কুফরী হইতে (ইসলামে) না আসিত (তবে আমি উহা করিতাম)” (আন-নাসাঈ, আস-সুনানুল-কুবরা, কিতাবুত-তাফসীর, ৬খ, ২৯০; আল-বুখারী, বাদউল-খালক, হাদীছ নং ৩১৫২)।
“কাব ইবন উজরা (রা) হইতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (স)-কে জিজ্ঞাসা করিলাম যে, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনাদের আহলে বায়ত-এর উপর কিভাবে সালাম পেশ করিতে হইবে? কারণ সালাম কিভাবে পেশ করিব তাহা তো আল্লাহ আমাদিগকে শিক্ষা দিয়াছেন। তিনি বলিলেন, তোমরা বলিও।
[ ]
(বুখারী, বাদউল খালক, হাদীছ নং ৩১৫৩)।
“ওয়াছিলা ইবনুল আসকা (রা) হইতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, আল্লাহ ইবরাহীমের বংশধরদের মধ্যে ইসমাঈলকে মনোনীত করেন, ইসমাঈলের বংশধরদের মধ্য হইতে বা কিনানাকে, বানূ কিনানার বংশধরদের মধ্য হইতে কুরায়শকে এবং কুরায়শদের মধ্য হইতে বা হাশিমকে এবং বানূ হাশিমের মধ্য হইতে আমাকে মনোনীত করেন” (তিরমিযী, আল-জামি আস-সাহীহ, ৫খ., ৫৮৩, কিতাবুল মানাকিব, হাদীছ নং ৩৬০৫)।
“যায়দ ইবন আরকাম (রা) হইতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (স)-এর সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই যবাহগুলি কিজন্য? তিনি বলিলেন, তোমাদের পিতা ইবরাহীম (আ)-এর সুন্নাত” (ইবন মাজা, ২৩, ২০৪, আবওয়াবুল-আদাহী)।
“আবু হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, মুমিনদের শিশুরা জান্নাতবাসী হইবে। ইবরাহীম (আ) হইবেন তাহাদের তত্ত্বাবধায়ক” (আল-হাকেম আন-নায়সাবুরী, আল-মুসতাদরাক, ২৩, ৩৭০, কিতাবুত-তাফসীর)।
“ইবন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত তিনি বলেন, ইবরাহীম (আ)-কে যখন অগ্নিতে নিক্ষেপ করা হয় তখন তাঁহার শেষ বাক্য ছিল LSI, II”আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কত উত্তম কর্মবিধায়ক” । আর তোমাদের নবী অনুরূপ বলিয়াছেন, “যাহাদিগকে লোকে বলিয়াছিল, তোমাদের বিরুদ্ধে লোক জমায়েত হইয়াছে, সুতরাং তোমরা তাহাদিগকে ভয় কর। কিন্তু ইহা তাহাদের ঈমানকে দৃঢ়তর করিয়াছিল এবং তাহারা বলিয়াছিল, আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কত উত্তম কর্মবিধায়ক” (আল-হাকেম, আল-মুসতাদরাক, ২৩, ২৯৮, কিতাবুত-তাফসীর)।
জাবির (রা) হইতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, “ইবরাহীম খলীল (আ)-কে এই আরবী ভাষা ইলহাম করা হইয়াছিল” (প্রাগুক্ত, ২খ, ৩৪৪)।
ইবন আব্বাস (রা) বলেন, “ইসলামের ত্রিশটি অংশ। ইবরাহীম (আ)-এর পূর্বে আর কেহ উহা পূর্ণ করেন নাই। আল্লাহ তাআলা বলিয়াছেন,, s al, “ (৫৩: ৩৭)।
“এবং ইবরাহীমের কিতাবে, যে পালন করিয়াছিল তাহার দায়িত্ব” (প্রাগুক্ত, ২খ, ৪৭০)।
আনাস ইবন মালিক (রা) হইতে বর্ণিত। এক লোক রাসূলুল্লাহ (স)-এর নিকট আসিয়া বলিল, ইয়া খায়রাল-বারিয়্যা : (হে সৃষ্টির সর্বোত্তম ব্যক্তি)! রাসূলুল্লাহ (স) বলিলেন, “তাহা তো ইবরাহীম (আ)” (মুসলিম, আস-সাহীহ, খ, ৯৭, কিতাবুল-ফাদাইল)।
বাইবেলে হযরত ইবরাহীম (আ)
বাইবেলের আদিপুস্তকে ইবরাহীম (আ) সম্পর্কে যে বিবরণ পাওয়া যায় উহার সংক্ষিপ্তসার এই যে, সদাপ্রভু হযরত ইবরাহীম (আ)-কে নিজ আত্মীয়-স্বজন ও স্বদেশ ত্যাগ করিয়া কানআনে হিজরত করিতে বলেন এবং তাঁহাকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, তিনি তাঁহার মাধ্যমে এক মহাজাতি উদগত করিবেন। যাহারা তাঁহার অনুসরণ করিবে তাহারা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হইবে এবং যাহারা তাহার অবাধ্যাচরণ হইবে তাহারা অভিশপ্ত হইবে। তদনুসারে তিনি পঁচাত্তর বৎসর বয়সে নিজ স্ত্রী সারা ও ভ্রাম্পুত্র লুত (আ)-কে সঙ্গে লইয়া নিজের পশপাল ও সম্পদরাজিসহ কানআনে হিজরত করেন। এখানে পৌঁছিবার পর সদাপ্রভু তাহাকে এই এলাকা দান করার প্রতিশ্রুতি দেন। পরে এই এলাকায় দুর্ভিক্ষ শুরু হইলে তিনি সস্ত্রীক মিসরে রওয়ানা হইলেন। সেখানে পৌঁছিবার পর সমসাময়িক মিসর-রাজ অসদুদ্দেশ্যে সারাকে অপহরণ করে। তাঁহার সহিত অসৎ আচরণ করিতে উদ্যত হইলে আল্লাহ তাআলা তাহার হস্তদ্বয় অবশ করিয়া দেন এবং সারা (রা) সসম্মানে ফিরিয়া আসেন। মিসর-রাজ ইবরাহীম (আ)-কে উপঢৌকনস্বরূপ অনেক ধন-সম্পদ দান করে এবং সারার সেবিকা হিসাবে হাজার (রা)-কে দান করে (দ্র. বাইবেলের আদিপুস্তক, ১২৪১-২০)। অনুরূপ আরও একটি ঘটনা বাইবেলে উক্ত হইয়াছে (দ্র. আদিপুস্তক, ২০ : ১-১৮)।
অতঃপর ইবরাহীম (আ) সারা ও লুত (আ)-কে রইয়া তথা হইতে পুনরায় কানআনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হইলেন। লূত (আ)-এরও পর্যাপ্ত গবাদি পশু ও অন্যান্য সম্পদ ছিল। তাঁহাদের দুইজনের পশুসম্পদের প্রাচুর্যের কারণে একত্রে বসবাস অসম্ভব হইয়া পড়িলে ইবরাহীম (আ) ভ্রাতুস্পুত্রকে জর্দানে স্থানান্তরের পরামর্শ দিলে তিনি তথায় স্থানান্তরিত হইলেন এবং ইবরাহীম (আ) কানআনে থাকিয়া গেলেন (দ্র, আদিপুস্তক, ১৩ ও ১৮; আরও দ্রত নিবন্ধ)।
ইবরাহীম (আ) তাঁহার নিঃসন্তান অবস্থার কথা উল্লেখ করিলে আল্লাহ তাআলা তাঁহাকে সন্তানদানের প্রতিশ্রুতি দিলেন এবং আরও বলিলেন যে, তাঁহার অধস্তন বংশধর প্রায় চারি শত বৎসর বিদেশীদের অধীনস্ত থাকিবে। অবশেষে তাহারা প্রচুর সহায়-সম্পদসহ এই অবস্থা হইতে মুক্তি পাইবে। সদাপ্রভু তাঁহার বংশধরকে মিসর হইতে ফোরাত নদী পর্যন্ত বিশাল ভূভাগ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিলেন (আদিপুস্তক, ১৬ ও ১-২১)। এখানে তাঁহাকে যেই সন্তান দানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হইয়াছিল তিনি হইলেন হযরত ইসমাঈল (আ)। কারণ আদিপুস্তকে পরবর্তী অধ্যায়ে ইসমাঈল (আ)-এর জন্ম ও তাঁহার বৃত্তান্ত বর্ণনা করা হইয়াছে।
ইসমাঈল (আ)-এর জন্ম : সারা (রা) নিঃসন্তান হওয়ায় তাঁহার সেবিকা হাজার (রা)-কে স্বউদ্যোগে হযরত ইবরাহীম (আ)-এর সহিত বিবাহ দিলেন এবং তাঁহার গর্ভে হযরত ইসমাঈল (আ) জন্মগ্রহণ করেন। সতীনের সহিত মনোমালিন্যের কারণে একদা হাজার (রা) গৃহ হইতে পলায়ন করেন। পথিমধ্যে সদাপ্রভুর দূত তাহার সহিত সাক্ষাত করিয়া তাহাকে বাড়ি ফিরিয়া যাইতে ও সারার অনুগত হইয়া থাকিতে বলেন। তিনি তাহাকে আরও সুসংবাদ দিলেন যে, তাঁহার গর্ভ হইতে একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করিবে এবং তাহার পর্যাপ্ত বংশবৃদ্ধি ঘটিবে । ইবরাহীম (আ)-এর ছিয়াশি বৎসর বয়সে ইসমাঈল (আ) জন্মগ্রহণ করেন (আদিপুস্তক, ১৬ ও ১-১৬)।
ত্বকচ্ছেদের নিয়ম স্থাপন ও সদাপ্রভু ইবরাহীম (আ)-কে দর্শন দিয়া তাঁহার আব্রাম (মহাপিতা) নাম পরিবর্তন করিয়া আব্রাহাম (বহু লোকের পিতা) রাখিলেন এবং ইহার কারণ স্বরূপ বলিলেন যে, তিনি বহু জাতির পিতা হইবেন। সদাপ্রভু এই পর্যায়ে তাঁহাকে লিঙ্গাগ্রের ত্বকচ্ছেদের স্থায়ী নির্দেশ দান করেন। তখন তাঁহার বয়স নিরানব্বই বৎসর এবং ইসমাঈল (আ)-এর বয়স তের বৎসর। নির্দেশ অনুসারে তিনি তাঁহার ও তাঁহার পোষ্যবর্গের লিঙ্গাগ্রের ত্বকচ্ছেদ করেন। এই পর্যায়ে সদাপ্রভু তাঁহাকে সারার গর্ভে আরও একজন পুত্রসন্তান লাভের সুসংবাদ দান করেন, অপরদিকে ইসমাঈল (আ)-এর বংশে প্রতাপশালী বারোজন শাসকের আবির্ভাব হইবারও সুসংবাদ দিলেন (দ্র. আদিপুস্তক, ১৭ ও ১-২৭)।
লুত (আ)-এর কওমের জন্য ইবরাহীম (আ)-এর প্রার্থনা : মস্লির এলোন বনের নিকটে অপরিচিত মানববেশে তিনজন ফেরেশতা হযরত ইবরাহীম (আ)-এর সহিত সাক্ষাত করিলেন। তিনি তাহাদের জন্য যথাসাধ্য আপ্যায়নের ব্যবস্থা করিলেন। আহার শেষে তাহারা তাহাকে ইসহাক (আ)-এর জন্মলাভের এবং তাঁহার হইতে এক মহাজাতির আবির্ভাবের সুসংহ্লাদ দিলেন, অতঃপর লূত (আ)-এর কওমের ধ্বংসের দুঃসংবাদ জানাইলেন ( আদিপুস্তক, ১৮ ও ১-২২)। বাইবেলে এই ঘটনার বর্ণনা কুরআন মজীদের বর্ণনার প্রায় অনুরূপ (দ্র. ১৫ : ৫১-৫৯; ৫১ : ২৪-৩৩)।
ইসহাক (আ)-এর জন্ম ও ইসমাঈল (আ)-এর নির্বাসন ও ইবরাহীম (আ)-এর একশত বৎসর বয়সে ইসহাক (আ) জন্মগ্রহণ করেন এবং তিনি পুত্রের আট দিন বয়সে তাহার লিঙ্গাগ্রের ত্বকেচ্ছেদ করিলেন। দুই স্ত্রীর মধ্যকার মনোমালিন্যের কারণে এবং প্রথমা স্ত্রীর দাবিতে ইবরাহীম (আ) হাজার (রা)-কে শিশুপুত্র ইসমাঈল (আ)-সহ সংগে কিছু রুটি ও পানি দিয়া বাড়ি হইতে বিদায় করিয়া দিলেন। তিনি শিশুপুত্রসহ বের শেবা প্রান্তরে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। এদিকে পানীয় ফুরাইয়া গেলে তিনি শিশু পুত্রের জীবন নাশের আশংকা করিলেন এবং তাহাকে এক স্থানে শোয়াইয়া রাখিয়া দূরে বসিয়া রোদন করিতে লাগিলেন। এই অসহায় মুহূর্তে আল্লাহর দূত আগমন করিয়া তাঁহাকে অভয় দিলেন এবং তাহার জন্য পানির একটি ঝর্ণা প্রবাহিত করিলেন। বালকটি বড় হইয়া ধনুর্দ্ধর হইল এবং পারণ প্রান্তরে বসতি বসতি স্থাপন করিল (দ্র. আদিপুস্তক, ২১ : ১-২১; বিস্তারিত দ্র. শিরো. ইসমাঈল (আ))।
ইবরাহীম (আ)-এর মহাপরীক্ষা ও এই সকল ঘটনার পর সদাপ্রভু ইবরাহীম (আ)-এর পরীক্ষা নিলেন। তিনি তাঁহাকে পুত্র ইসহাক (আ)-কে মোরিয়া দেশে লইয়া গিয়া সেখানে তাহাকে কুরবানী করার নির্দেশ দিলেন। তদনুযায়ী তিনি দুইজন দাসসহ ইসহাক (আ)-কে লইয়া নির্দিষ্ট স্থানে গমন করিলেন। সেখানে পৌঁছিয়া তিনি কোরবানগাহ নির্মাণ করিয়া পুত্রের হস্ত-পদ বাঁধিয়া খড়গহস্তে তাহাকে কুরবানী করিতে উদ্যত হইলে আকাশ হইতে সদাপ্রভুর দূত তাহাকে ডাকিয়া কহিলেন, ইসহাকের প্রতি তোমার হস্ত বিস্তার করিও না। কারণ তুমি সদাপ্রভুকে ভয় কর এবং নিজের অদ্বিতীয় পুত্রকেও দিতে অসম্মত নাও। ইবরাহীম (আ) পশ্চাৎদিকে তাকাইয়া কোপেরদ্ধ একটি মে দেখিতে পাইলেন এবং তিনি উহাকে কুরবানী করিলেন। ইহার পর সদাপ্রভু তাঁহার পর্যাপ্ত বংশবৃদ্ধির এবং তাঁহাদেরকে পৃথিবীতে অনুগ্রহ প্রাপ্ত ও প্রভাব-প্রতিপত্তি করিবার প্রতিশ্রুতি দিলেন। পরে ইবরাহীম (আ) সপরিবারে বের-শেবাতে বসতি স্থাপন করেন (দ্র. আদিপুস্তক, ২২ : ১-১৯; ইসমাঈল (আ) শীর্ষক নিবন্ধে বিস্তারিত দ্র.)।
ইবরাহীম (আ)-এর বিবাহ ও মৃত্যু ও পরবর্তী পর্যায়ে ইবরাহীম (আ) কটুরা নাম্নী এক মহিলাকে বিবাহ করেন। তাঁহার গর্ভে সিন, যকষন, মদান, মিদিয়ন, যিশবক ও শূহ জন্মগ্রহণ করেন। ইবরাহীম (আ) আপন সর্বস্ব ইসহাক (আ)-কে দান করেন এবং অপরাপর স্ত্রীর সন্তানদিগকে বিভিন্ন দান দিয়া নিজ জীবদ্দশায় পূর্বদেশে প্রেরণ করেন। অতঃপর ইবরাহীম (আ) একশত পঁচাত্তর বৎসর কয়সে ইনতিকাল করেন। পুত্র ইসমাঈল ও ইসহাক (আ) তাঁহাকে মন্ত্রির সম্মুখে হেতীয় সোহরের পুত্র ইফ্রোনের ক্ষেত্রস্থিত মপলা গুহাতে দাফন করেন। স্ত্রী সারার কবরও এখানেই। ভূমিটির ক্রয় সূত্রে মালিক ছিলেন ইবরাহীম (আ) (দৃ. আদিপুস্তক, ২৫ : ১-১৮)। দাওয়াত ও তাবলীগ
হযরত ইবরাহীম (আ) কখন নবুওয়াত প্রাপ্ত হন তাহার সঠিক সময় জানা না গেলেও আল-কুরআনুল কারীমের বিবরণ হইতে প্রতীয়মান হয় যে, বাল্যকাল হইতেই আল্লাহ তাআলা তাঁহাকে সঠিক জ্ঞান ও হিদায়াত দান করিয়াছিলেন। ইরশাদ হইয়াছে :
“ আমি তো ইহার পূর্বে ইবরাহীমকে সৎপথের জ্ঞান দিয়াছিলাম এবং আমি তাহার সম্বন্ধে ছিলাম সম্যক পরিজ্ঞাত” (২১ : ৫১)।
সীরাত ও ইতিহাসবিদগণ কর্তৃক বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনা হইতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, বাল্যকাল হইতেই তিনি ছিলেন সত্যানুসন্ধানী। ইমাম ছালাবী বর্ণনা করিয়াছেন যে, গুহার মধ্যে থাকিয়া ইবরাহীম (আ) যখন যুবক হইলেন তখন একদিন তাহার মাতাকে বলিলেন, আমার প্রতিপালক কে? মাতা বলিল, আমি । তিনি বলিলেন, আপনার প্রতিপালক কে? মাতা বলিল, তোমার পিতা। তিনি বলিলেন, আমার পিতার প্রতিপালক কে? মাতা বলিল, নমরূদ। তিনি বলিলেন, নমরূদের প্রতিপালক কে? তখন মাতা তাহাকে এক ধমক দিয়া বলিল, চুপ কর। তখন ইবরাহীম (আ) চূপ করিয়া গেলেন। অতঃপর তাঁহার মাতা স্বামীর নিকট ফিরিয়া আসিয়া বলিল, আমাদের লূতন বালক, যে তোমার পুত্র, আমি দেখিতেছি যে, সে জগত্বাসীর দীন পরিবর্তন করিয়া ফেলিতেছে। অতঃপর ইবরাহীম (আ) যাহা যাহা বলিয়াছিলেন তাহা স্বামীকে শুনাইল। ইবরাহীম (আ) তাঁহার পিতাকে অনুরূপ প্রশ্ন করিয়াছিলেন। তাঁহার পিতা মায়ের অনুরূপ জবাব দিয়াছিলেন। নমরূদের প্রতিপালক কে? এই প্রশ্নের জবাবে পিতা তাহাকে একটি চপেটাঘাত করিয়া বলিল, চুপ কর (আছ-ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৭৮)।
ইবরাহীম (আ) যুবক অবস্থায় একদিন পিতার সহিত (এক বর্ণনামতে মাতার সহিত) গুহা হইতে বাহির হইয়া আসিলেন। তখন সূর্য অস্ত গিয়াছে। তিনি চতুষ্পদ জন্তু ও অন্যান্য সৃষ্টি দেখিয়া কৌতূহলবশত সেইগুলি সম্পর্কে পিতাকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। পিতাও তাহার প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগিলেন যে, এইটি উট, এইটি গাভী, ঐটি ঘোড়া, ঐটা বকরী প্রভৃতি। ইবরাহীম (আ) বলিলেন, নিশ্চয়ই এইগুলির একজন প্রতিপালক আছেন যিনি তাহাদের সৃষ্টিকর্তা। অতঃপর তিনি আসমান-যমীনের সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করিলেন এবং বলিলেন, যিনি আমাকে সৃষ্টি করিয়াছেন, রিযিক দিয়াছেন, আহার করাইয়াছেন, পান করাইয়াছেন, তিনিই ঠিক আমার প্রতিপালক। তিনি ভিন্ন আমার আর কোন ইলাহ (উপাস্য) নাই (ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৭৮-৭৯)। অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মাথা তুলিলেন। সেখানে তিনি যুহরাঃ (শুক্র) মতান্তরে মুশতারী (বৃহস্পতি) নক্ষত্র দেখিতে পাইয়া বলিলেন, এই আমার রব । কিছুক্ষণ পর তাহা অদৃশ্য হইয়া গেল। তাহা দেখিয়া তিনি বলিলেন, যাহা অস্ত যায় আমি তাহা পছন্দ করি না অর্থাৎ যে প্রতিপালক অদৃশ্য হয় তাহাকে আমি পছন্দ করি না। ইব্ন আব্বাস (রা)-এর বর্ণনামতে তিনি মাসের শেষদিকে বাহির হইয়াছিলেন তাই নক্ষত্রোদয়ের পূর্বে তখন চন্দ্র দেখিতে পান নাই। অতঃপর রজনীর মধ্য অথবা শেষভাগে তিনি সমুজ্জ্বল চন্দ্র উদিত হইতে দেখিলেন এবং বলিলেন, এই আমার প্রতিপালক। উহা যখন অদৃশ্য হইল তখন তিনি বলিলেন, আমাকে আমার প্রতিপালক সৎপথ প্রদর্শন না করিলে আমি অবশ্যই পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হইব। অতঃপর ভোর হইলে সূর্যকে দীপ্তিমানরূপে উদিত হইতে দেখিয়া তিনি বলিলেন, ইহা আমার প্রতিপালক, ইহা সর্ববৃহৎ। যখন তাহা অদৃশ্য হইল তখন আল্লাহ তাআলা তাঁহাকে বলিলেন, “আত্মসমর্পণ কর”। তিনি বলিলেন, “জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট আত্মসমর্পণ করিলাম” (২ : ১৩১)।
অতঃপর তিনি তাহার কওমের নিকট আসিয়া তাহাদিগকে দাওয়াত দিয়া বলিলেন, “হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যাহাকে আল্লাহর শরীক কর তাহার সহিত আমার কোন সংশ্রব নাই। আমি একনিষ্ঠভাবে তাঁহার দিকে মুখ ফিরাইতেছি যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করিয়াছেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নহি” (৬ ও ৭৬-৭৯; আত-তাবারী, তারীখ, ১খ, ১২১)। ইবন কাছীর প্রমুখ এই মত প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন যে, ইবরাহীম (আ) গুহা হইতে বাহির হইয়াই এই সকল কথাবার্তা বলিয়াছিলেন। কারণ তখন তিনি ছোট ছিলেন। তাহারা ইহাকে ইসরাঈলী রিওয়াত বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন (দ্র, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ১৪৩)। তাহাদের মতে ইবরাহীম (আ) প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর নক্ষত্র, চন্দ্র ও সূর্যকে প্রতিপালক বলিয়াছিলেন এবং তাহা অস্ত যাওয়ার পর ঐ সকল কথাবার্তা বলিয়াছিলেন। ইহার উদ্দেশ্য ছিল কওমের সামনে প্রশ্ন রাখা এবং তাহাদের বিবেক জাগ্রত করা। কাহারও কাহারও মতে সম্প্রদায়ের নিকট এই কথা প্রমাণ করার জন্য যে, যাহা পরিবর্তনশীল তাহা কখনও প্রতিপালক হওয়ার উপযুক্ত নহে। ইহাই অধিকাংশ ‘আলিমের মত যে, তিনি কওমকে হুশিয়ার করার জন্য অথবা তাহাদের সহিত বিদ্রূপ করার জন্য এইরূপ বলিয়াছিলেন (ইবনুল আছীর, আল-কামিল, ১খ.,৭৩)। তবে যেহেতু পূর্বেই ইমাম ছালাবীর বরাতে উল্লেখ করা হইয়াছে যে, আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম (আ)-এর গুহার মধ্যে প্রতিপালিত হওয়ার সময়ের মধ্যে বরকত দেওয়ার ফলে তিনি দ্রুত বড় হইয়া উঠেন এবং যখন তিনি গুহার বাহিরে আসেন তখন যুবা বয়সে পদার্পণ করিয়াছিলেন, সেই হেতু ইমাম তাবারী বর্ণিত প্রথমোক্ত মতটি সঠিক হইতে পারে যে, গুহা হইতে বাহির হইয়া সত্যানুসন্ধানের জন্য তিনি ঐ সকল বাদানুবাদ করিয়াছিলেন। আর ইহাই আয়াতের (৬ ও ৭৬-৭৯) সহজ-সরল ব্যাখ্যা।
ইবরাহীম (আ)-এর পিতা আযর মূর্তি বানাইত। অতঃপর উহা সন্তানদিগকে বিক্রয় করিতে দিত। ইবরাহীম (আ) গুহা হইতে বাহিরে আসিবার পর সে তাহাকেও উহা বিক্রয় করিবার জন্য দিল। ইবরাহীম (আ) উহা লইয়া বাজারে গিয়া জোরে জোরে বলিতেন, “কে এমন জিনিস ক্রয় করিবে যাহা তাহার কোন ক্ষতিও করিবে না, উপকারও করিবে না”। তাঁহার ভ্রাতাগণ মূর্তি বিক্রয় করিয়া ফিরিয়া আসিত। কিন্তু তাঁহার মূর্তি সেইভাবেই পড়িয়া থাকিত, কেহই ক্রয় করিত না । অতঃপর তিনি উহা নদীতে লইয়া যাইতেন এবং তাঁহার কওম যে গোমরাহী ও মূর্খতায় ডুবিয়া ছিল তাহার প্রতি বিদ্রূপবশত উহাদের মস্তক পানিতে ডুবাইয়া বলিতেন, ‘পানি পান কর। আস্তে আস্তে তাঁহার মূর্তির প্রতি এই আচরণের কথা এবং তাহাদের সহিত এই বিদ্রুপের কথা ছড়াইয়া পড়িতে লাগিল (ইবনুল আছীর, আল-কামিল, ১খ.,৭৩; তাবারী, তারীখ, ১খ., ১২০)।
অতঃপর হযরত ইবরাহীম (আ) বিভিন্ন পন্থায় তাঁহার সত্যের প্রতি আহবান করার কাজ চালাইয়া যাইতে লাগিলেন। পিতাকে তিনি অত্যন্ত বিনীতভাবে বুঝাইলেন যে, তাঁহার নিকট সত্যের জ্ঞান আসিয়াছে যাহা দ্বারা তিনি জানিতে পরিয়াছেন যে, এই সকল মূর্তির পূজা করা শয়তানের ইবাদত, যাহার ফলে আল্লাহর শাস্তি অবধারিত। কিন্তু পিতা উহা ককূল করিল না, বরং উল্টা তাঁহার প্রাণনাশের হুমিক দিল । কিন্তু ইবরাহীম (আ) তাহার সহিত অত্যন্ত ন্ত্র ও মার্জিত আচরণ করেন, তাহার কল্যাণ কামনা করেন এবং আল্লাহর নিকট তাহার জন্য মাগফিরাত চাওয়ার অঙ্গীকার করেন। কুরআন কারীমে ইরশাদ হইয়াছে :
“স্মরণ কর, এই কিতাবে উল্লিখিত ইবরাহীমের কথা; সে ছিল সত্যনিষ্ঠ নবী। যখন সে তাহার পিতাকে বলিল, হে আমার পিতা! তুমি তাহার ইবাদত কর কেন যে শুনে না, দেখে না এবং তোমার কোন কাজেই আসে না? হে আমার পিতা! আমার নিকট তো আসিয়াছে জ্ঞান যাহা তোমার নিকট আসে নাই; সুতরাং আমার অনুসরণ কর, আমি তোমাকে সঠিক পথ দেখাইব। হে আমার পিতা! শয়তানের ইবাদত করিও না। শয়তান তো দয়াময়ের অবাধ্য। হে আমার পিতা! আমি তো আশঙ্ক করি যে, তোমাকে দয়াময়ের শাস্তি স্পর্শ করিবে, তখন তুমি হইয়া পড়িবে শয়তানের বন্ধু। পিতা বলিল, হে ইবরাহীম! তুমি কি আমার দেব-দেবী হইতে বিমুখ যদি তুমি নিবৃত্ত না হও তবে আমি প্রস্তরাঘাতে তোমার প্রাণ নাশ করিবই; তুমি চিরদিনের জন্য আমার নিকট হইতে দূর হইয়া যাও। ইবরাহীম বলিল, তোমার প্রতি সালাম। আমি আমার প্রতিপালকের নিকট তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিব, নিশ্চয়ই তিনি আমার প্রতি অতিশয় অনুগ্রহশীল। আমি তোমাদের হইতে এবং তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাহাদের ইবাদত কর তাহাদের হইতে পৃথক হইতেছি। আমি আমার প্রতিপালককে আহবান করি; আশা করি, আমার প্রতিপালককে আহবান করিয়া ব্যর্থকাম হইব না” (১৯ ৪১-৪৮)।
কওমকে দাওয়াত
তিনি তাঁহার সম্প্রদায়কে ও পিতাকে বুঝাইলেন যে, মূর্তি কখনো উপাস্য ও প্রতিপালক হইতে পারে না, বরং প্রতিপালক তো তিনি যিনি আসমান-যমীনের সৃষ্টিকর্তা। কুরআন শরীফে এই ব্যাপারে ইরশাদ হইয়াছে :
“তাহাদের নিকট ইবরাহীমের বৃত্তান্ত বর্ণনা কর। সে যখন তাহার পিতা ও তাহার সম্প্রদায়কে বলিয়াছিল তোমরা কিসের ইবাদত কর? তাহারা বলিল, আমরা মূর্তির পূজা করি এবং আমরা নিষ্ঠার সহিত উহাদের পূজায় নিরত থাকিব। সে বলিল, তোমরা প্রার্থনা করিলে ইহারা কি শোনে? অথবা উহারা কি তোমাদের উপকার কিংবা অপকার করিতে পারে? তাহারা বলিল, না, তবে আমরা আমাদের পিতৃ-পুরুষদিগকে এইরূপই করিতে দেখিয়াছি। সে বলিল, তোমরা কি ভাবিয়া দেখিয়াছ কিসের পূজা করিতেছ, তোমরা এবং তোমাদের অতীত পিতৃপুরুষেরা? উহারা সকলেই আমার শত্রু, জগতসমূহের প্রতিপালক ব্যতীত; যিনি আমাকে সৃষ্টি করিয়াছেন, তিনিই আমাকে পথ প্রদর্শন করেন। তিনিই আমাকে দান করেন আহার্য ও পানীয় এবং রোগাক্রান্ত হইলে তিনিই আমাকে রোগমুক্ত করেন এবং তিনিই আমার মৃত্যু ঘটাইবেন, অতঃপর পুনর্জীবিত করিবেন। এবং আশা করি তিনি কিয়ামত দিবসে আমার অপরাধ মার্জনা করিয়া দিবেন” (২৬ : ৬৯-৮২)।
সুদ্দী বর্ণনা করেন যে, প্রতি বৎসর তাহাদের একটি ঈদ হইত। তাহারা সকলেই সেখানে সমবেত হইত। সেই ঈদ হইতে যখন তাহারা প্রত্যাবর্তন করিত তখন মূর্তিগৃহে প্রবেশ করিয়া উহাকে সিজদা করিত। ইহার পর বাড়ি ফিরিত (ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৮০)। ইবরাহীম (আ)-এর পিতা আযর তাহাকে বলিল, হে ইবরাহীম! আমাদের একটি ঈদ আছে। তুমি যদি আমাদের সঙ্গে সেখানে যাইতে তবে আমাদের দীন অবশ্যই তোমার ভাল লাগিত । অতঃপর ঈদের দিন তাহারা ঈদে গমন করিল। ইবরাহীম (আ) তাহাদের সহিত বাহির হইলেন। কিছু দূর গিয়া তাহার মনে কিছু একটা উদয় হইল। তিনি বলিলেন, আমি অসুস্থ। প্রকৃতপক্ষে তিনি তাহাদের দেবতাদিগকে অপদস্থ করত উহাদের অক্ষমতা ও অসারতা প্রত্যক্ষভাবে প্রমাণ করিতে এবং আল্লাহর প্রভুত্ব ও তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করিতে চাহিলেন। আল্লাহর সত্য দীনকে সহায়তা কল্পেই তিনি এই কৌশল অবলম্বন করিয়াছিলেন। কুরআন শরীফে ইরশাদ হইয়াছে :
“অতঃপর সে তারকারাজির দিকে একবার তাকাইল এবং বলিল, আমি অসুস্থ। অতঃপর উহারা তাহাকে পশ্চাতে রাখিয়া চলিয়া গেল” (৩৭ : ৮৮-৯০)।
অতঃপর তিনি তাহাদিগকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন :
“শপথ আল্লাহর, তোমরা চলিয়া গেলে আমি তোমাদের মূর্তিগুলি সম্বন্ধে অবশ্যই কৌশল অবলম্বন করিব” (২১ : ৫৭)।
তাহাদের মধ্যে দুর্বল এক ব্যক্তি পিছনে পড়িয়া গিয়াছিল, সে ইহা শুনিয়া ফেলিল। মুজাহিদ ও কাতাদার বর্ণনামতে, ইবরাহীম (আ) ইহা আস্তে আস্তে বলা সত্ত্বেও সে উহা শুনিয়া ফেলে এবং প্রচার করিয়া দেয়। অতঃপর ইবরাহীম (আ) দ্রুতপদে ও সন্তর্পণে তাহাদের দেবতা গৃহে আসিলেন। তিনি বিরাট এক মন্দিরে আসিলেন। মন্দিরের দরজায় বিরাটকায় একটি মূর্তি স্থাপিত ছিল। উহার পার্শ্বে ছিল আরো ছোট একটি, তাহার পার্শ্বে আরো ছোট একটি। এমনিভাবে প্রত্যেকটির পার্শ্বে ছিল তাহার চাইতে ছোট একটি মূর্তি। তাহার সম্প্রদায় বিভিন্ন রকমের খাবার তৈরি করিয়া তাহাদের দেবতাদের সম্মুখে ভোজ হিসাবে রাখিয়া দিয়াছিল এবং বলিয়াছিল, আমরা যখন প্রত্যাবর্তন করিব এবং ততক্ষণে আমাদের দেবতাগণ আমাদের খাবারে আশির্বাদ দিয়া দিবে তখন আমরা উহা খাইব। ইবরাহীম (আ) মন্দিরে প্রবেশ করিয়া যখন উহাদিগকে এবং উহাদের সম্মুখে রাখা খাবার দেখিলেন তখন বলিলেন, “তোমরা খাদ্য গ্রহণ করিতেছ না কেন” (৩৭ : ৯১)? উহারা যখন ইবরাহীম (আ)-এর কথার কোন উত্তর দিল না তখন তিনি ঠাট্টা ও বিদ্রুত করিয়া বলিলেন, “তোমাদের কী হইয়াছে যে, তোমরা কথা বল না”? অতপর তিনি উহাদের উপর সজোরে আঘাত হানিলেন” (৩৭ : ৯২-৯৩)। তিনি একখানি লোহার কুঠার লইয়া প্রতিটি মূর্তিকে ভাঙ্গিয়া চূর্ণ-বিচূর্ণ করিয়া ফেলিলেন। প্রধান মূর্তিটি ছাড়া আর একটিও অবশিষ্ট রহিল না। তখন কুঠারখানি উহার ঘাড়ে ঝুলাইয়া রাখিলেন যাহাতে তাহার সম্প্রদায় উহাকে দোষারোপ করে। ইহার পর তিনি বাহির হইয়া আসিলেন। ইহার প্রতিই ইঙ্গিত করা হইয়াছে কুরআন কারীমে ।
“অতপর সে চূর্ণ বিচূর্ণ করিয়া দিল মূর্তিগুলিকে উহাদের প্রধানটি ব্যতীত; যাহাতে উহারা তাহার দিকে ফিরিয়া আসে” (২১ ও ৫৮)।
প্রকৃতপক্ষে ইহা ছিল একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ যে, তাহারা যদি কোন কিছু বুঝিতে পারিত তবে অবশ্যই যে তাহাদের প্রতি এইরূপ খারাপ আচরণ করিতে ইচ্ছা করে তাহাকে প্রতিহত করিতে পারিত। কিন্তু তাহাদের মূর্খতা, বুদ্ধির স্বল্পতা ও গোমরাহীর প্রচণ্ডতায় কোন শিক্ষাই গ্রহণ করিল না বরং ঈদ হইতে ফিরিয়া আসিয়া দেবতা গৃহে প্রবেশ করিল এবং উহাদিগকে এই অবস্থায় দেখিয়া বলিল :
“আমাদের উপাস্যগুলির প্রতি এইরূপ করিল কে? সে নিশ্চয়ই সীমালংঘনকারী। কেহ কেহ বলিল, এক যুবককে উহাদের সমালোচনা করিতে শুনিয়াছি; তাহাকে বলা হয় ইবরাহীম” (২১ : ৫৯-৬০)।
তাহাকেই আমরা এই ব্যাপারে সন্দেহ করি । কেননা সে দেবতাদিগকে গালি দেয় ও সমালোচনা করে। এই সংবাদ যখন বাদশাহ নমরূদ ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের নিকট পৌঁছিল তখন তাহারা বলিল, তাহাকে উপস্থিত কর তোক সম্মুখে, যাহাতে উহারা প্রত্যক্ষ করিতে পারে (২১ : ৬১) যে, সে-ই ইহা করিয়াছে। তাহারা বিনা প্রমাণে তাঁহাকে দোষারোপ করিতে অপছন্দ করিল। প্রকৃতপক্ষে ইবরাহীম (আ)-এর উদ্যেশ্য ইহাই ছিল যে, সকল লোক একত্র হউক। তাহা হইলে সকল মূর্তিপূজকের সম্মুখে তিনি প্রমাণ করিয়া দিবেন যে, তাহারা গোমরাহীর মধ্যে রহিয়াছে, যেমন মূসা (আ) ফিরআওনকে বলিয়াছিলেন :
“তোমাদের নির্ধারিত সময় উৎসবের দিন এবং যেই দিন পূর্বাহ্নে জনগণকে সমবেত করা হইবে” (২০ ও ৫৯)।
অতঃপর যখন তাঁহাকে আনা হইল তখন লোকজন বাদশাহ নমরূদের নিকট সমবেত হইল। তাহারা বলিল,
“হে ইবরাহীম! তুমিই কি আমাদের উপাস্যগুলির প্রতি এইরূপ করিয়াছ” (২১ : ৬২)? উত্তরে ইবরাহীম (আ) বলিলেন,
“বরং ইহাদের এই প্রধান, সেই তো ইহা করিয়াছে, ইহাদিগকে জিজ্ঞাসা কর যদি ইহারা কথা বলিতে পারে” (২১ ও ৬৩)।
প্রকৃতপক্ষে ইহার উদ্দেশ্যে ছিল তাহাদের নিকট হইতে এই কথার স্বীকারোক্তি আদায় করা যে, ইহারা কথা বলিতে পারে না। এইগুলি জড় পদার্থ, অন্যান্য জড় পদার্থের ন্যায়ই। তখন তাহারা মূর্তি ভাঙ্গার জন্য তাহাকে যে দোষারোপ করিয়াছিল উহা হইতে ফিরিয়া আসিল এবং পরস্পর বলিতে লাগিল, আমরাই তাহার উপর জুলুম করিয়াছি; সে তো ঠিকই বলিয়াছে। যেমন ইরশাদ হইয়াছে ।
“তখন তাহারা মনে মনে চিন্তা করিয়া দেখিল এবং একে অপরকে বলিতে লাগিল, তোমরাই তো সীমালংঘনকারী” (২১ : ৬৪)।
ইহার পর তাহারা বুঝিতে পারিল এবং বলিল, উহারা তো কোন ক্ষতি করিতে পারে না, উপকার করিতে পারে না, কোন কিছু ধরিতেও পারে না। উহারা তো কথা বলিতে পারে না যে, কে এইরূপ করিয়াছে তাহা আমাদিগকে বলিয়া দিবে। হাত দিয়া ধরিতেও পারে না যে, আমরা তোমাকে সত্য বলিয়া সমর্থন করিব। কুরআন কারীমে ইরশাদ হইয়াছে :
“অতঃপর উহাদের মস্তক অবনত হইয়া গেল এবং উহারা বলিল, তুমি তো জানই যে, ইহারা কথা বলে না” (২১ : ৬৫)।
অতঃপর তাহাদের উপর ইবরাহীম (আ)-এর যুক্তি প্রমাণ যখন অকাট্য বলিয়া বিবেচিত হইল এবং তাহারা পরাজয়ের গ্লানি লইয়া মাথা নোয়াইয়া ফেলিল তখন ইবরাহীম (আ) বলিলেন :
“তবে কি তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ইবাদত কর যাহা তোমাদের কোন উপকার করিতে পারে না, ক্ষতিও করিতে পারে না? ধিক তোমাদিগকে এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাহাদের ইবাদত কর তাহাদিগকে! তবুও কি তোমরা বুঝিবে না” (২১ ও ৬৬-৬৭)?
তখন তাঁহার সম্প্রদায় আল্লাহর ব্যাপারে তাঁহার সহিত বিতর্ক করিতে প্রবৃত্ত হইল। তাহাদের দাবি ছিল, ইবরাহীম (আ) যাহার ইবাদত করেন তাহা হইতে তাহাদের উপাস্য ও দেবতারাই উত্তম। তখন ইবরাহীম (আ) উদাহরণ দিয়া তাহাদিগকে বুঝাইলেন যাহাতে তাহারা বুঝিতে পারে যে, তাহারা যাহার ইবাদত করে উহা অপেক্ষা আল্লাহই ইবাদত পাওয়ার বেশী যোগ্য এবং তাহাকেই ভয় করা উচিৎ। কুরআন কারীমে ইরশাদ হইয়াছে ।
“তাহার সম্প্রদায় তাহার সহিত বিতর্কে লিপ্ত হইল। সে বলিল, তোমরা কি আল্লাহ সম্বন্ধে আমার সহিত বিতর্কে লিপ্ত হইবে? তিনি তো আমাকে সৎপথে পরিচালিত করিয়াছেন। আমার প্রতিপালক অন্যবিধ ইচ্ছা না করিলে তোমরা যাহাকে তাহার শরীক কর তাহাকে আমি ভয় করি না। সব কিছুই আমার প্রতিপালকের জ্ঞানায়ত্ত, তবে কি তোমরা অনুধাবন করিবে না? তোমরা যাহাকে আল্লাহ্ শরীক কর আমি তাহাকে কিরূপে ভয় করিব? অথচ তোমরা আল্লাহর শরীক করিতে ভয় কর না, যে বিষয়ে তিনি তোমাদিগকে কোন সনদ দেন নাই। সুতরাং যদি তোমরা জান তবে বল, দুই দলের মধ্যে কোন্ দল নিরাপত্তা লাভের বেশী হকদার” (৬ ও ৮০-৮১)?
নমরূদের সহিত বিতর্ক
অতঃপর নমরূদ ইবরাহীম (আ)-কে বলিল, তুমি যে ইলাহের ইবাদত কর এবং যাহার ইবাদত করিতে অন্যকে দাওয়াত দাও, যাহার শক্তির কথা উল্লেখ কর এবং অন্যের উপর প্রাধান্য দাও তিনি কে? ইবরাহীম (আ) বলিলেন, তিনি আমার প্রতিপালক, যিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান। নমরূদ বলিল, আমিও তো জীবন দান করি ও মৃত্যু ঘটাই। ইবরাহীম বলিল, তুমি কিভাবে জীবন দান কর ও মৃত্যু ঘটাওঃ নমরূদ বলিল, আমি দুই ব্যক্তিকে ধরিয়া আনিব যাহাদিগকে আমার নির্দেশে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হইয়াছে। অতঃপর উহাদের একজনকে হত্যা করিব। এইভাবে আমি তাহার মৃত্যু ঘটাইলাম। আর অপরজনকে ক্ষমা করিয়া মুক্তি দিব। এইভাবে আমি তাহার জীবন দান করিলাম। তখন ইবরাহীম (আ) বলিলেন, “আল্লাহ সূর্যকে পূর্ব দিক হইতে উদয় করান, তুমি উহাকে পশ্চিম দিক হইতে উদয় করাও তো। তখন যে কুফরী করিয়াছিল সে (নমরূদ) হতবুদ্ধি হইয়া গেল” (২: ২৫৮)। সে বুঝিতে পারিল যে, ইহা তাহার দ্বারা সম্ভব নহে। দলীল-প্রমাণে সে পরাস্ত হইল (তাবারী, তারীখ, ১খ, ১২২-১২৩; ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৭৯)।
এইসব বাদানুবাদে ও দলীল-প্রমাণে পরাস্ত হইয়া নমরূদ ও তাহার সম্প্রদায় ইবরাহীম (আ)-এর উপর দারুণভাবে ক্ষিপ্ত হইল। তাহারা আলোচনা করিল যে, ইবরাহীমকে কাটিয়া টুকরা টুকরা
করিতে হইবে। কিন্তু তাহারা ভাবিয়া দেখিল যে, এই শাস্তি তো কিছুক্ষণের মধ্যে শেষ হইয়া যাইবে, তাহাতে তাহাদের অন্তরে ক্রোধের যে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হইয়াছে উহা নিভিবে না। তাই তাঁহাকে এমন শাস্তি দিতে হইবে যাহা তিল তিল করিয়া তাহাকে দগ্ধীভূত করিবে। তাহারা সবশেষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিল যে, তাঁহাকে অগ্নিতে দগ্ধিভূত করিয়া হত্যা করিতে হইবে। আর এমন অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করিতে হইবে যে, উহার উপর দিয়া উডডীয়মান পাখিও যেন পুড়িয়া যায় এবং যাহা ইতিহাসে প্রসিদ্ধ হইয়া থাকে (মাহমূদ যাহরান, কাসাস মিনাল-কুরআন, পৃ. ৫৬)।
কুরআন কারীমে এই দিকেই ইঙ্গিত করা হইয়াছে :
“উহারা বলিল, তাহাকে পোড়াইয়া দাও এবং সাহায্য কর তোমাদের দেবতাগুলিকে, তোমরা যদি কিছু করিতে চাহ” (২১৪ ৬৮)।
মুজাহিদ বলেন, আমি একবার আবদুল্লাহ ইবন উমার (রা)-এর সম্মুখে উক্ত আয়াত তিলাওয়াত করিলাম। তখন তিনি বলিলেন, মুজাহিদ! তুমি কি জান কে সর্বপ্রথম ইবরাহীম (আ)-কে অগ্নিতে দগ্ধীভূত করার প্রস্তাব করিয়াছিল? আমি বলিলাম, না। তিনি বলিলেন, পারস্যের এক বেদুঈন। আমি বলিলাম, হে আবু আবদুর রাহমান! পারস্যে কি বেদুঈন আছে। তিনি বলিলেন, হ্যাঁ, কুদীরাই পারস্যের বেদুঈন। তাহাদেরই এক ব্যক্তি ইবরাহীম (আ)-কে আগুনে দগ্ধীভূত করিবার প্রস্তাব করিয়াছিল (তাবারী, তারীখ, ১খ, ১২৩)। ইব্ন জুরায়জ শুআয়ব আল-জুব্বাঈ সূত্রে বর্ণনা করেন যে, যে ব্যক্তি এই প্রস্তাব করিয়াছিল তাহার নাম হায়যান। আল্লাহ তাহাকে মাটিতে ধ্বসাইয়া দিয়াছেন এবং কিয়ামত পর্যন্ত সে মাটির নীচে ধ্বসিতে থাকিবে (ইবনুল-আছীর, আল-কামিল, ১খ, ৭৫)।
অতঃপর নমরূদ কাষ্ঠ সংগ্রহ করার নির্দেশ দিল এবং ইবরাহীম (আ)-কে বন্দী করিয়া রাখিল। তাঁহার জন্য একটি পাকা প্রাচীরযুক্ত ইমারত নির্মাণ করিল (ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৮১; তাবারী, তারীখ, ১খ, ১২৩-১২৪)। এই সম্পর্কে কুরআন কারীমে বলা হইয়াছে :
“তাহারা বলিল, ইহার জন্য এক ইমারত নির্মাণ কর, অতঃপর ইহাকে জ্বলন্ত অগ্নিতে নিক্ষেপ কর” (৩৭ : ৯৭)।
ইহার পর তাহারা বিভিন্ন প্রকারের কাষ্ঠ সংগ্রহ করিল। এক বর্ণনামতে এক মাস যাবত এই কাষ্ঠ সংগ্রহ অভিযান চলে। ইহাকে তাহারা ধর্মীয় দিক হইতে পূণ্যের কাজ মনে করিত, এমনকি কোন মহিলা রোগাক্রান্ত হইলে তাহা আরোগ্যের জন্য অথবা কোন কাম্য বস্তু পাওয়ার জন্য কাষ্ঠ সংগ্রহ করার মানত করিত (তাবারী, তারীখ, ১খ, ১২৩-১২৪; ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৮১)। কাষ্ঠ সংগৃহীত হইলে চতুর্কি হইতে তাহারা উহাতে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করিল। এই অগ্নির তেজ এত তীব্র ছিল যে, উপর দিয়া কোন পাখি উড়িয়া যাইতে লাগিলে তাহা পুড়িয়া ছাই হইয়া যাইত। অগ্নি প্রজ্জ্বলনের পর তাহারা ইবরাহীম (আ)-কে ইমারতের উপরে উঠাইয়া হাত-পা বাঁধিল। অতঃপর ইবলীসের পরামর্শ মত একটি প্রস্তর নিক্ষেপণ যন্ত্র (মিনজানীক) বানাইল এবং ইবরাহীম (আ)-কে উহাতে উঠাইল। তাহারা যখন তাঁহাকে অগ্নিকুণ্ডে ফেলিতে উদ্যত হইল তখন জিন ও মানব ব্যতীত আসমান-যমীন, পাহাড়-পর্বত ও উহার মধ্যে যত সৃষ্টি আছে ফেরেশতাসহ সবাই একবাক্যে চীৎকার করিয়া আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ জানাইল, “হে আল্লাহ! পৃথিবীর বুকে ইবরাহীম ছাড়া আর দ্বিতীয় কেহ নাই যে, তোমার ইবাদত করিবে। তোমার জন্যই তাঁহাকে অগ্নিতে জ্বালানো হইতেছে। তাঁহাকে সাহায্য করিবার জন্য আমাদিগকে অনুমতি দাও।”
তখন আল্লাহ তাআলা বলিলেন, আমি তাঁহার ব্যাপারে অধিক অবগত। সে যদি তোমাদের মধ্যে কাহারও নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে অথবা কাহারো সাহায্য কামনা করে তবে সে যেন তাহাকে সাহায্য করে। আমি তাঁহাকে সেই ব্যাপারে অনুমতি দিলাম । আর যদি আমি ছাড়া অন্য কাহারো সাহায্য প্রার্থনা না করে তবে আমিই তাহার জন্য যথেষ্ট (ইবনুল-আছীর, আল-কামিল, ১খ, ৭৬)। এক বর্ণনামতে ইবরাহীম (আ)-কে আগুনে নিক্ষেপ করিতে উদ্যত হইলে পানির ফেরেশতা তাঁহার নিকট আসিয়া বলিল, আপনি চাহিলে আমি অগ্নি নিভাইয়া দিব। কারণ পানি ও বৃষ্টির ভাণ্ডার আমার হাতে। বাতাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত ফেরেশতা আসিয়া বলিল, আপনি চাহিলে এই অগ্নিকুণ্ড আমি বাতাসে উড়াইয়া দিব। কিন্তু ইবরাহীম (আ) বলিলেন, তোমাদের কাহারো নিকট আমার কোন প্রয়োজন নাই (ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৮১)।
অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মাথা উঠাইয়া বলিলেন, হে আল্লাহ! আকাশে তুমিই একক সত্তা এবং দুনিয়াতে আমি এক ব্যক্তি। দুনিয়াতে আমি ছাড়া আর এমন কেহ নাই, যে তোমার ইবাদত করিবে (তাবারী, তারীখ, ১খ, ১২৪; ছালাবী, প্রাগুক্ত)। ইবন কাছীরের বর্ণনা মতে ইবরাহীম (আ) এই বলিয়া দুআ করিয়াছিলেন, “তুমিই আসমানে একক ও যমীনেও একক। আমার জন্য তুমিই যথেষ্ট ও উত্তম কর্মবিধায়ক” (আল কামিল, ১খ, পৃ. ৭৬)। মুমির আরকাম (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, ইবরাহীম (আ)-কে হাত পা বাঁধিয়া যখন তাহারা অগ্নিতে নিক্ষেপ করিতেছিল তখন তিনি বলিলেন,
“তুমি ছাড়া কোন ইলাহ নাই। তুমি জগৎসমূহের প্রতিপালক, প্রশংসা তোমারই। রাজত্ব ও কর্তৃত্ব তোমারই। তোমার কোন শরীক নাই” (প্রাগুক্ত)। এক বর্ণনামতে তখন জিবরীল (আ) আসিয়া বলিলেন, ইবরাহীম! তোমার কোন প্রয়োজন আছে কি? তিনি বলিলেন, আপনার কাছে কোন প্রয়োজন নাই। জিবরীল (আ) বলিলেন, তবে তোমার প্রতিপালকের নিকট আবেদন কর। তিনি বলিলেন, তিনি আমার অবস্থা সম্পর্কে সব কিছুই অবগত আছেন। তাই তাঁহার অবগতিই যথেষ্ট।
“আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি কত উত্তম কর্মবিধায়ক” (প্রাগুক্ত; ইবন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ১৪৬)। অতঃপর তাহারা মিনজানীকের সাহায্যে তাঁহাকে অগ্নিতে নিক্ষেপ করিল। তখন আল্লাহ তআলা আগুনকে বলিলেন ।
“হে অগ্নি! তুমি ইবরাহীমের জন্য শীতল ও নিরাপদ হইয়া যাও” (২১৪ ৬৯)।
সুদ্দীর বর্ণনামতে আল্লাহ তাআলার নির্দেশে জিবরীল (আ) এই ঘোষণা দিয়াছিলেন (ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৮২)। এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে প্রজ্জ্বলিত অগ্নি ইবরাহীম (আ)-এর জন্য শীতল ও নিরাপদ হইয়া গেল । শুধু তাহাই নহে, উহা তাহার জন্য পরম আরামদায়ক স্থান হইয়া গেল। তাহার হাত-পায়ের রশিগুলি আগুনে পুড়িয়া তিনি মুক্ত হইয়া গেলেন। আগুনের প্রতি আল্লাহ তআলার উক্ত নির্দেশ শোনার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর সমস্ত অগ্নিই সেই দিন নির্বাপিত হইয়া গিয়াছিল। কাব আল-আহবার, কাতাদা ও যুহরী (র) বলেন, পৃথিবীর বুকে ঐদিন কেহই অগ্নি দ্বারা কোন কাজ করিতে পারে নাই। ইবরাহীম (আ)-এর হাত-পায়ের রশি ব্যতীত অগ্নি ঐদিন কোন কিছুকেই দগ্ধীভূত করে নাই (তাবারী, তারীখ, ১খ, ১২৪)। আলী ইবন আবী তালিব ও ইবন আব্বাস (রা) বলেন, আল্লাহ তাআলা যদি তাহার নির্দেশের মধ্যে ১৮ (শীতল) শব্দের পর– (নিরাপদ) শব্দ না আনিতেন তবে অগ্নি এমন ঠাণ্ডা হইয়া যাইত যে, ঠাণ্ডায় ইবরাহীম ইন্তিকাল করিতেন (প্রাগুক্ত)। গিরগিটি (39) ব্যতীত সকল প্রাণীই সেই দিন ইবরাহীম (আ)-এর আগুন নিভাইতে চেষ্টা করে। এই জন্যই নবী (স) উহাকে হত্যা করিবার নির্দেশ দিয়াছেন এবং তাহাকে ক্ষুদ্র দৃষ্কৃতিকারী (a) নামে অভিহিত করিয়াছেন (বুখারী, আস-সাহীহ, কিতাবুল-আম্বিয়া, ৪খ, ৫৯৮)।
ইবরাহীম (আ) ৭ দিন (ইবন আবী হাতিমের বর্ণনায় ৪০ দিন, আম্বিয়া-ই কুরআন, ‘খ., পৃ. ১৯৯) উক্ত অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে অবস্থান করেন। মিনহাল ইবন উমার হইতে বর্ণিত আছে যে, ইবরাহীম (আ) বলিয়াছেন, আমি আগুনের মধ্যে অবস্থানকালীন দিনগুলিতে যে সুখ-স্বচ্ছন্দ ও আরাম-আয়েশ ভোগ করিয়াছিলাম তেমন সুখ-স্বচ্ছন্দ ও আরাম-আয়েশ জীবনে আর কখনো পাই নাই (ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৮২)। ইবন ইসহাক প্রমুখ বলেন, আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম (আ)-এর আকৃতিতে ছায়ার ফেরেশতাকে প্রেরণ করিলেন। তিনি ইবরাহীম (আ)-এর পার্শ্বে আসিয়া উপবেশন করিলেন এবং তাঁহাকে সান্ত্বনা দিতে লাগিলেন।
কয়েক দিন পর নমরূদ একটি বাহনে করিয়া সেই অগ্নিকুণ্ডের নিকট দিয়া যাইতেছিল। ইবরাহীম (আ) যে পুড়িয়া ছাইভষ্ম হইয়া গিয়াছেন এই ব্যাপারে তাহার কোনই সন্দেহ ছিল না। কিন্তু সে তাকাইয়া দেখিল, ইবরাহীম (আ) উহার মধ্যে বসিয়া আছেন। পার্শ্বে তাঁহারই মত এক লোক। সে নিজের চক্ষুকে বিশ্বাস করিতে পারিতেছিল না। সে যাত্রা বিরতি করিয়া ফিরিয়া আসিল এবং তাহার সম্প্রদায়কে ডাকিয়া বলিল, আমি যেন ইবরাহীমকে আগুনের মধ্যে জীবিত দেখিলাম। আমার সন্দেহ হইতেছে। তোমরা আমার জন্য একটি সুউচ্চ স্তম্ভ নির্মাণ কর যেখান হইতে আমি নিম্নে তাকাইয়া অগ্নির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করিতে পারি। তাহারা স্তম্ভ নির্মাণ করিলে নমরূদ সেখান হইতে তাকাইয়া দেখিল, ইবরাহীম (আ) একটি ফুল বাগানে বসিয়া আছেন এবং তাঁহার পার্শ্বে উপবিষ্টে তাহারই মত এক লোক অর্থাৎ ফেরেশতাকেও সে দেখিতে পাইল।
নমরূদ ইবরাহীম (আ)-কে ডাকিয়া বলিল, ইবরাহীম! তোমার উপাস্য অতি মহান, যাহার শক্তির ফলে তোমার মধ্যে এবং আগুনের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হইয়াছে। তাই তোমার কোন ক্ষতি হয় নাই। ইবরাহীম! তুমি কি উহা হইতে বাহির হইয়া আসিতে পার? ইবরাহীম (আ) বলিলেন, হাঁ। নমরূদ বলিল, তুমি কি এই ভয় কর যে, তুমি ঐখানে অবস্থান করিলে তোমার কোন ক্ষতি হইবে? ইবরাহীম (আ) বলিলেন, না। নমরূদ বলিল, উঠিয়া দাঁড়াও এবং উহা হইতে বাহির হইয়া আস। ইবরাহীম (আ) উঠিয়া উহার মধ্য দিয়া হাঁটিয়া বাহির হইয়া আসিলেন।
নমরূদের নিকটে আসিলে সে বলিল, ইবরাহীম! তোমার পার্শ্বে উপবিষ্ট তোমারই আকৃতিতে যে লোকটিকে দেখিয়াছিলাম সেই লোকটি কে? ইবরাহীম (আ) বলিলেন, তিনি ছায়ার ফেরেশতা। আমাকে সঙ্গ দিতে আল্লাহ তাআলা তাঁহাকে আমার নিকট প্রেরণ করিয়াছিলেন। নমরূদ বলিল, হে ইবরাহীম! আমি তোমার উপাস্যের উদ্দেশ্যে কিছু কুরবানী করিব। কারণ আমি তাহার শক্তি ও দৃঢ়তা দেখিয়াছি, যাহা তোমার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করিয়াছেন, যখন তুমি কেবল তাঁহারই ইবাদত কর এবং তাঁহারই একত্ব স্বীকার করা ব্যতীত আর সবকিছুই অস্বীকার করিয়াছিলে। আমি তাঁহার জন্য চার হাজার গাভী যবাহ করিব। ইবরাহীম (আ) বলিলেন, তুমি তোমার এই দীনে থাকাবস্থায় তিনি তোমার কিছুই ককূল করিবেন না, যতক্ষণ না তুমি উহা ত্যাগ করিয়া আমার দীন গ্রহণ কর। নমরূদ বলিল, হে ইবরাহীম! আমি আমার রাজত্ব ত্যাগ করিতে পারি না। তবে শীঘ্রই আমি উহা যবাহ করিব। অতঃপর সত্যই সে উহা যবাহ করিল এবং ইবরাহীম (আ)-কে লূতন কোন শাস্তি দেওয়া হইতে বিরত রহিল। সে ইবরাহীম (আ)-কে বলিল, তোমার প্রতিপালক কতই না উত্তম হে ইবরাহীম! (ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৮২-৮৩; আত-তাবারী, তারীখ, ১খ, ১২৪; ইবনুল আছীর, আল-কামিল, ১খ, ৭৬)।
বিবাহ
হযরত ইবরাহীম (আ) কত বৎসর বয়সে বিবাহ করেন তাহা সুস্পষ্টরূপে জানা যায় না। তবে অগ্নিকুণ্ড হইতে বাহির হওয়ার অব্যবহিত পরই তিনি বিবাহ করেন বলিয়া ধারণা করা হয়। স্বীয় চাচাতো ভগ্নি সারা বিনত হারান আল-আকবারকে তিনি বিবাহ করেন। সুদ্দীর বর্ণনামতে সারা ছিলেন হাররান সম্রাটের কন্যা। তিনি তাহার কওমের দীনের ব্যাপারে সমালোচনা করিতেন। ইবরাহীম (আ) যখন শাম অভিমুখে রওয়ানা হন তখন সারার সাক্ষাত পান এবং তাহাকে এই শর্তে বিবাহ করেন যে, তিনি তাহাকে পরিবর্তন করিতে পারিবেন না (তাবারী, তারীখ, ১খ, ১২৫; ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৮৩; ইবনুল জাওযী, তারীখুল মুনতাজাম, ১খ, ২৬২)। তবে হাফিজ ইব্ন কাছীর এই মতটিকে বিরল বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। আর কেহ কেহ ধারণা করেন, যেমন সুহায়লী কুতায়বা ও মাকাশ হইতে বর্ণনা করিয়াছেন যে, সারা ইবরাহীম (আ)-এর ভ্রাতা হারানের কন্যা, লুত (আ)-এর ভগ্নী। ইহাদের দাবি হইল, তখনকার শরীআতে ভ্রাতুস্পুত্রীকে বিবাহ করা বৈধ ছিল। কিন্তু হাফিজ ইবন কাছীর এই মতটিকে জোরদারভাবে প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন এবং বলিয়াছেন যে, ইহা অজ্ঞতার ফল এবং ইহার সপক্ষে কোন প্রমাণ নাই। যদি মানিয়াও লওয়া যায় যে, তখনকার সময়ে উহা বৈধ ছিল, যেমন ইয়াহুদী পণ্ডিতগণ হইতে বর্ণিত আছে, তবুও আম্বিয়া-ই কিরাম উহার উপর আমল করেন নাই। ইব্ন কাছীর–এর মতে সারা ইবরাহীম (আ)-এর চাচা হারান এর কন্যা ছিলেন। ইহাই অধিকতর সঠিক ও প্রসিদ্ধ বলিয়া তিনি মত ব্যক্ত করিয়াছেন (ইব্ন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ১৫০)।
হিজরত
হযরত ইবরাহীম (আ) স্বীয় পিতা, তাঁহার সম্প্রদায় ও বাদশাহকে অত্যন্ত নম্রভাবে নসীহতের দ্বারা, যুক্তি ও বুদ্ধির দ্বারা বিভিন্নভাবে এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার দাওয়াত দিলেন। তাঁহার সহিত শরীক করিতে নিষেধ করিলেন এবং মূর্তিপূজা ত্যাগ করিতে বলিলেন। কিন্তু তাহারা উহা প্রত্যাখ্যান করিল। তাঁহার সম্প্রদায় তাঁহাকে আগুনে ফেলিল। কিন্তু আল্লাহ তাহা ঠাণ্ডা ও নিরাপদ করিয়া দিলেন। আর পিতা তাঁহাকে উক্ত পথ তাগ না করিলে প্রস্তরাঘাতে প্রাণনাশ করার হুমকি দিল। তাঁহার প্রতি কেবল স্ত্রী সারা এবং ভ্রাতুস্পুত্র লুত (আ) ইব্ন হারান ব্যতীত আর কেহ ঈমান আনয়ন করিল না (আবদুল ওয়াহহাব আন-নাজ্জার, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৮৩)। ইহাতে ইবরাহীম (আ) ভীষণভাবে মনক্ষুণ্ণ হইলেন এবং স্বদেশ ভূমি ত্যাগ করত অন্যত্র গিয়া দীন প্রচার করিতে মনস্থ করিলেন। তিনি বলিলেনঃ
“আমি আমার প্রতিপালকের দিকে চলিলাম, তিনি আমাকে অবশ্যই সৎ পথে পরিচালিত করিবেন” (৩৭ : ৯৯)।
অতঃপর নিরাশ হইয়া তিনি বাবেলের কৃছা হইতে বাহির হইয়া কালদানীগণের বাসস্থান ফুরাত নদীর পশ্চিম তীরের কাছাকাছি উর নামক একটি জনপদে হিজরত করিলেন। এই সফরে তাঁহার সঙ্গে ছিলেন স্বীয় স্ত্রী সারা ও ভ্রাতুস্পুত্র লুত (আ) (ইব্ন কুতায়বা, আল-মাআরিফ, পৃ. ৩২; আবদুল ওয়াহহাব আন-নাজ্জার, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৮৩)। কিছুদিন পর এখান হইতে হারান (হাররান) চলিয়া যান এবং সেখানে দীন-ই হানীফের প্রচার শুরু করেন। এই সময়ে তিনি স্বীয় পিতা আযর-এর হিদায়াতের জন্য দুআ করিতে থাকেন। কারণ অত্যন্ত স্র ও দয়াদ্র হূদয়ের অধিকারী হওয়ার কারণে পিতা কর্তৃক দীন-ই হানীফের দাওয়াত প্রতাখ্যান এবং তাঁহাকে ভর্ৎসনা করা সত্ত্বেও তিনি বলিয়াছিলেন :
“তোমার প্রতি সালাম। আমি আমার প্রতিপালকের নিকট তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিব। নিশ্চয়ই তিনি আমার প্রতি অতিশয় অনুগ্রহশীল” (১৯৪৭)।
অবশেষে আল্লাহ তাআলা ওহীর মাধ্যমে তাঁহাকে জানাইয়া দিলেন যে, তাঁহার পিতা ঈমান আনয়ন করিবে না, সে আল্লাহর শত্রুই থাকিয়া যাইবে। এই কথা জানার পর ইবরাহীম (আ) তাঁহার পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা হইতে বিরত থাকেন। কুরআন কারীমে ইহাই সুস্পষ্টভাবে বলা হইয়াছে :
“ইবরাহীম তাহার পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিয়ছিল, তাহাকে ইহার প্রতিশ্রুতি দিয়াছিল বলিয়া। অতঃপর যখন ইহা তাহার নিকট সুস্পষ্ট হইল যে, সে আল্লাহর শত্রু তখন ইবরাহীম উহার সম্পর্ক ছিন্ন করিল। ইবরাহীম তো কোমল হূদয় ও সহনশীল” (৯ : ১১৪)।
বাইবেলের বর্ণনামতে এই সফরে ইবরাহীম (আ)-এর পিতা তারাহ (আযর) ও সঙ্গে ছিল। এই হারানে অবস্থানকালে ২০৫ (মতান্তরে ২৫০) বৎসর বয়সে তারাহ মৃত্যুবরণ করে (Genesis, 11 : 31-32; মুহাম্মদ আল-ফুকা, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৬১; ইবন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১খ, ১৫০)। এইভাবে দীন-ই হানীফ-এর দাওয়াত দিতে দিতে তিনি হারান হইতে হিজরত করিয়া ফিলিসতীন পৌঁছিলেন। এই সফরেও তাঁহার সঙ্গী ছিলেন স্বীয় স্ত্রী সারা, ভ্রাতুস্পুত্র লূত এবং তাঁহার স্ত্রী কুরআন কারীমে লূত (আ) কর্তৃক ইবরাহীম (আ)-এর উপর ঈমান আনয়ন এবং তাঁহার সহিত হিজরত করার কথা এইভাবে বিবৃত হইয়াছে :
“লূত তাহার (ইবরাহীম-এর) প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করিল। ইবরাহীম বলিল, আমি আমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগ করিতেছি। তিনি তো পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়” (২৯ ও ২৬)।
আর হাদীছে বর্ণিত হইয়াছে যে, উছমান (রা) যখন স্বীয় স্ত্রী হযরত রুকায়্যা (রা)-কে লইয়া হাবশা হিজরত করেন তখন রাসূলুল্লাহ (স) বলিয়াছিলেনঃ
“নিশ্চয়ই লূত (আ)-এর পর উছমানই প্রথম ব্যক্তি, যে সস্ত্রীক হিজরত করিয়াছে (আবদুল ওয়াহহাব নাজ্জার, কাসাসুল কুরআন, পৃ. ৮৪)।
অতঃপর ইবরাহীম (আ) ফিলিসতীনের পশ্চিমাঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। তৎকালে এই অঞ্চলটি কানআনীদের অধীনস্থ ছিল। অতঃপর নিকটেই শাকীম (বর্তমান নাম নাবলুস) নামক স্থানে চলিয়া যান। আহলে কিতাবের বর্ণনামতে ফিলিসতীনে থাকাকালে আল্লাহ তাহার নিকট ওহী প্রেরণ করেন, তোমার পর এই ভূমিকে আমি বরকতময় করিব। তখন ইবরাহীম (আ) সেখানে একটি কুরবানীর স্থান তৈরি করিলেন এই নিমাতের শুকরিয়াস্বরূপ (Genesis, 12 : 8; ইব্ন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ১৫০)। নাবলুসেও তিনি বেশি দিন অবস্থান করেন নাই। আরো পশ্চিম দিকে অগ্রসর হইয়া মিসর চলিয়া যান। মিসরের রাজত্ব ছিল তখন আমালীক সম্প্রদায়ের হাতে রোমানগণ যাহাদিগকে ‘হাকসূস নামে অভিহিত করিত (আবদুল ওয়াহহাব নাজজার, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৮৪)। কোন কোন ঐতিহাসিকের বর্ণনামতে মিসরের তৎকালীন ফির আওন ছিল অত্যাচারী বাদশাহ আদ-দাহ্হাক-এর ভ্রাতা। দাহ্হাক-এর পক্ষ হইতে সে তখন মিসরের গভর্নর ছিল। আর কাহারও মতে তাহার নাম ছিল সিনান ইবন ‘আলওয়ান ইবন উবায়দ ইব্ন উওয়ায়জ ইবন ‘আমলাক ইব্ন লাউদ ইব্ন সাম ইব্ন নূহ (আ)। ইবন হিশাম তাঁহার তীজান গ্রন্থে ‘আমর ইবন ইমরুউল কায়স ইবন মাইনূন (মায়ালশূন) ইবন সাবা বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। সে ছিল মিসরে। কোন কোন বর্ণনায় তাহার নাম সাদূফ বা সাদূক বলিয়াও উল্লেখ আছে (ইবনুল আছীর, আল-কামিল, ১খ., ৭৭)। সুহায়লী ইহা বর্ণনা করিয়াছেন (ইব্ন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ১৫২)।
ইবরাহীম (আ) স্ত্রী সারাসহ মিসরে প্রবেশ করিলেন। সারা ছিলেন অপরূপ সুন্দরী (তাবারী, তারীখ, ১খ, ১২৫)। আল্লাহ তাআলা তাহাকে সম্মান দিয়াছিলেন। ফিরআওন ছিল দুশ্চরিত্র । কোন এক লোক তাহাকে গিয়া খবর দিল, আপনার রাজ্যের অমুক স্থানে এক লোক আপসয়াছে। তাহার সহিত এক অপূর্ব সুন্দরী মহিলা আছে। তখন ফিরআওন ইবরাহীম (আ)-কে ডাকিয়া পাঠাইল। ইবরাহীম (আ) তাহার নিকট গেলে ফিরআওন জিজ্ঞাসা করিল, তোমনর সঙ্গের মহিলাটি কে? ইবরাহীম (আ) বলিলেন, আমার ভশ্রী। তিনি আশংকা করিয়াছিলেন যে, স্ত্রী পরিচয় দিলে দুস্তরিত্র ফিরআন তাহাকে হত্যা করিয়া ফেলিবে এবং সারাকে গ্রহণ করিবে । ফিরআওন ইবরাহীম (আ)-কে বলিল, উহাসেজ্জিত করিয়া আমার নিকট পাঠাইয়া দাও। আমি উহাকে সেখিব। ইবরাহীম (আ) সারার নিকট আসিয়া বলিলেন, বাদশাহ আমার নিকট তোমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করায় আমি বলিয়াছি যে, তুমি আমার ভগ্নী। তাই তাহার নিকট গিয়া অষ্ঠিাকে আবার মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করিও না। কারণ তুমি আমার দীনী ভগ্নী। এই দেশে তুমি আর আমি ছাড়া আর কোন মুমিন ব্যক্তি নাই।
অতঃপর সারা বাদশাহর নিকট গেলেন। এদিকে ইবরাহীম (আ) নামাযে দণ্ডায়মান হইলেন ৷ সারাকে দেখিয়া বাদশাহ বিমোহিত হইয়া গেল এবং তাঁহাকে ধরিতে গেলে তাহার হাত অবশ হইয়া গেল। ইহাতে সে ঘাবড়াইয়া গিয়া বলিল, তোমার প্রতিপালকের কাছে দুআ কর যেন আমার হাত ঠিক হইয়া যায়। আল্লাহর কসম! আমি তোমাকে আর কষ্ট দিব না। তোমার সহিত সদ্ব্যবহার করিব। সারা তখন দুআ করিলেন। আল্লাহ তাআলা তাহাকে মুক্ত করিয়া দিলেন। সে পুনরায় তাহাকে ধরিতে গেল। এইবারও পূর্বের ন্যায় অথবা তদপেক্ষা কঠিনভাবে হাত অবশ হইয়া গেল । এইবারও বাদশাহ বলিল, আমার জন্য আল্লাহর নিকট দুআ কর, আমি তোমার আর কোন ক্ষতি করিব না। সারা দুআ করিলেন। তাহার হাত ঠিক হইয়া গেল । কোন কোন বর্ণনামতে বাদশাহ তিনবার এইরূপ আচরণ করিয়াছিল এবং তিনবারই সারার দুআয় ভালো হইয়া যায়। অতঃপর বাদশাহ তাহার এক প্রহরীকে ডাকিয়া বলিল, তুমি কোন মানুষ আমার কাছে আন নাই, বরং আনিয়াছ এক ডাইনী (জিন)। বাদশাহ অতঃপর হাজারসহ বেশ কিছু উপটৌকন দিয়া তাহাকে ইবরাহীম ((আ)-এর নিকট পাঠাইয়া দিল। তিনি ইবরাহীম (আ)-এর নিকট ফিরিয়া আসিলেন। ইবরাহীম (আ) তখন নামাযরত ছিলেন। তিনি নামায শেষ করিয়া তাহার দিকে ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কি খবর? সারা বলিলেন, আল্লাহ তাআলা কাফির দুবৃত্তদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করিয়া দিয়াছেন। আর সে হাজারকে খেদমতের জন্য দিয়াছে। হযরত আবু হুরায়রা (রা) এই হাদীছ বর্ণনা করিয়া বলেন, তিনিই তোমাদের মাতা, হে আরব সম্প্রদায়! (বুখারী, আস-সাহীহ, ৪খ, ২৭০, কিতাবুল-আম্বিয়া; মুসলিম, আস-সাহীহ, ৭, ৯৮-৯৯; ইব্ন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১৩, ১৫০; আত-তাবারী, তারীখ, ১খ, ১২৫-১২৬)।
কোন কোন বর্ণনায় পাওয়া যায়, সারা ইবরাহীম (আ)-এর নিকট হইতে রওয়ানা হওয়ার পর আল্লাহ তাআলা সারা ও ইবরাহীমের মধ্যে পর্দা তুলিয়া দেন, যাহাতে ইবরাহীম (আ)-এর নিকট হইতে বাহির হওয়ার সময় হইতে প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত তাহার সকল কর্মকাণ্ড দেখিতে পান। কিভাবে তিনি বাদশাহর নিকট পৌঁছিলেন এবং কিভাবে আল্লাহ তাহাকে হেফাজত করিলেন সব কিছুই তিনি স্বচক্ষে দেখিতে পান। সারার সম্মানার্থে এবং ইবরাহীম (আ)-এর মানসিক প্রশান্তির জন্য আল্লাহ তাআলা এই ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। কারণ সারাকে তিনি অত্যধিক ভালবাসিতেন। কথিত আছে, হাওয়া (আ)-এর পরে তিনিই ছিলেন সর্বাধিক সুন্দরী মহিলা (ইবন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ১৫২; ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৮৪)। হাজার (রা)-এর পরিচয়
বাইবেলে হযরত হাজার (আ)-কে ইবরাহীম (আ)-এর স্ত্রী সারার মিসরীয় দাসী বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে (দ্র. Genesis, l6: 1)। সারা বন্ধ্যা ও নিঃসন্তান ছিলেন। ইবরাহীম (আ) নিঃসন্তান ও নির্বংশ থাকিবেন ইহা তাহার নিকট খুবই দুঃখের বিষয় ছিল। তাই সন্তানের আশায় তিনি আপন দাসী হাগারকে আপন স্বামী আব্রামের সহিত বিবাহ দেন (Genesis, 16 : 3)। এই সূত্র ধরিয়া পাশ্চাত্যের সকল লেখক এবং কোন কোন মুসলিম লেখকও তাহাদের অনুসরণ করত হাজারকে সাধারণ একজন দাসী বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। কিন্তু ইহা সঠিক নহে, বরং বলা যায় অজ্ঞতা বা বিদ্বেষের ফল। প্রকৃতপক্ষে হাজার ছিলেন মিসরের রাজকন্যা (দ্র. আল-কিসাঈ, কাসাসুল আম্বিয়া, ১খ, ১৪২; ইসলামী বিশ্বকোষ ২০ খ, ৫৬০-৬১)।
আল্লাহ তাআলার প্রতি তাঁহার দৃঢ় বিশ্বাস, অবিচল আস্থা, ও মজবুত ইয়াকীন ছিল। তাই সম্পূর্ণ জনমানবহীন মরু প্রান্তরে সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় মাত্র কয়েকটি খেজুর ও কিছু পানি দিয়া ইবরাহীম (আ) যখন চলিয়া যাইতেছিলেন তখন শিশু সন্তানসহ নিশ্চিত মৃত্যুর হাতছানি দেখিয়া তিনি ইবরাহীম (আ)-এর পিছু গমন করত জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমাদিগকে এই জনমানবহীন মরুপ্রান্তরে রাখিয়া আপনি কোথায় যাইতেছেন?” কয়েকবার এইরূপ বলার পরও ইবরাহীম (আ)-এর পক্ষ হইতে কোন উত্তর না পাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আল্লাহই আপনাকে এইরূপ করিতে নির্দেশ দিয়াছেন কি?” ইবরাহীম (আ) বলিলেন, হাঁ। তখন যেন তিনি আশ্রয় খুঁজিয়া পাইলেন। দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলিলেন, “তাহা হইলে আল্লাহ আমাদিগকে ধ্বংস করিবেন না” (ইবন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১৩, ১৫৪)।
তিনটি মিথ্যা কথন
পূর্বে আলোচিত হযরত ইবরাহীম (আ)-এর কর্মকাণ্ডে বাহ্যত প্রতীয়মান হয় যে, তিনটি স্থানে তিনি মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছেন : (১) তাঁহার সম্প্রদায় তাঁহাকে মেলায় যাইতে বলিলে তিনি বলিয়াছিলেন আমি অসুস্থ; (২) মন্দিরের মূর্তিগুলি ভাঙ্গিয়া বড়টির ঘাড়ে কুঠার রাখিয়া দিয়াছিলেন এবং তাহাদের জিজ্ঞাসার উত্তরে বলিয়াছিলেন : উহাদের এই বড়টিই এই করিয়াছে; (৩) হিজরত করিয়া মিসরে উপস্থিত হইলে সেখানকার জালিম বাদশাহর নিকট স্বীয় স্ত্রী সারাকে ভগ্নী পরিচয় দেন। হাদীছেও ইহার সমর্থন পাওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন :
“নবী ইবরাহীম (আ) তিনটি স্থলে ছাড়া আর কখনও মিথ্যা (বাহ্যত) বলেন নাই….” (বুখারী, আস-সাহীহ, ৪খ, ২৮০; মুসলিম, আস-সাহীহ, ৭খ, ৯৭-৯৮)।
এই হাদীছটি হাদীছের বিভিন্ন কিতাবে উল্লিখিত আছে। এতদ্ব্যতীত বুখারীতে আরো একটি দীর্ঘ হাদীছ আছে যাহা শাফাআতের হাদীছ নামে খ্যাত (উহা বিভিন্ন অধ্যায়ে, যথা সূরা বাকারার তাফসীর অধ্যায়ে, কিতাবুর রিকাক ও কিতাবুত-তাওহীদ-এ উল্লিখিত হইয়াছে)। উহাতে ইবরাহীম (আ) সম্পর্কে যে আলোচনা করা হইয়াছে তাহার সারাংশ হইল ও হাশরের ময়দানে যখন সকল মানুষ হযরত আদম ও নূহ (আ)-এর নিকট আল্লাহর দরবারে সুপারিশের অনুরোধ করিয়া এক পর্যায়ে ইবরাহীম (আ)-এর নিকট গিয়া বলিবে, আপনি আল্লাহর খলীল! আপনি আমাদের জন্য সুপারিশ করুন যেন শীঘ্রই তিনি আমাদের ফায়সালা করেন। তখন তিনি বলিবেন, আমি লজ্জাবোধ করিতেছি। কারণ দুনিয়াতে আমি তিনটি মিথ্যা বলিয়াছিলাম : [ ] এবং স্ত্রীকে বলিয়াছিলাম [ ] সাহীহ বুখারী ছাড়াও এই রিওয়ায়াত মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ, সাহীহ ইবন খুযায়মা, হাকেমের মুসতাদরাক, মুজাম তাবারানী, মুসান্নাফ ইবন আবী শায়বা, তিরমিযী ও মুসনাদ আবী আওয়ানাতে বিভিন্ন সাহাবী হইতে রিওয়ায়াত বর্ণিত আছে। কোনটিতে সংক্ষিপ্ত, কোনটিতে বিস্তারিত । ইহারই কোন কোন বর্ণনায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হইয়াছে যে, [ ] অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, “ইবরাহীম (আ)-এর তিনটি মিথ্যার প্রতিটিই কেবলমাত্র আল্লাহর দীনের স্বার্থেই বলিয়াছিলেন।”
মোটকথা এই উভয় রিওয়ায়াতই বুখারী ও মুসলিমের রিওয়ায়াত যাহা সর্বপ্রকার ত্রুটিমুক্ত। এই রিওয়ায়াত ইবরাহীম (আ)-এর ন্যায় একজন উঁচু স্তরের মহান নবীর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে। যদিও এই সকল রিওয়ায়াতের কোন কোনটিতে স্পষ্ট করিয়া দেওয়া হইয়াছে যে, রাসূলুল্লাহ (স) এই ক্ষেত্রে ‘মিথ্যা (95)–এর দ্বারা সেই প্রচলিত সাধারণ অর্থ বুঝান নাই যাহা কথাবার্তা ও আচার-আচরণে খুবই ঘৃণ্য ও কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। ইহার বিপরীত তিনি এই কথা স্পষ্ট করিয়া দিয়াছেন যে, ইবরাহীম (আ) এই তিনটি কথা কোন ব্যক্তিস্বার্থে কিংবা পার্থিব কোন লাভের জন্য বলেন নাই; বরং সত্যের দুশমনদের বিরুদ্ধে আল্লাহ তাআলার খাঁটি দীনের স্বার্থেই বলিয়াছিলেন।
ইহা ঠিক যে, কোন কোন রিওয়ায়াত সুস্পষ্টভাবে ইহাকে মিথ্যা (is)–এর সাধারণ অর্থ হইতে পৃথক করিয়া দিয়াছে। তবুও প্রথমত, এই অতিরিক্ত ব্যাখ্যা বুখারী-মুসলিমের রিওয়ায়াতে নাই, যদিও সাহীহ রিওয়ায়াতে তাহা উল্লেখ আছে। দ্বিতীয়ত, সত্যবাদিতা যখন নবীদের অবিচ্ছেদ্য এবং নবীর পবিত্র ও নিষ্পাপ থাকার জন্য অপরিহার্য একটি গুণ, উপরন্তু কুরআন কারীমে যখন বিশেষভাবে ইবরাহীম (আ) সম্পর্কে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হইয়াছে, তখন তাঁহার সম্পর্কে বাহ্যিক মিথ্যার আরোপ শোভনীয় হয় না।
“স্মরণ কর, এই কিতাবে উল্লিখিত ইবরাহীমের কথা; সে ছিল সত্যনিষ্ঠ নবী” (১৯৪১)।
এখানে [ [ শব্দটি আধিক্যবোধক [ ] শব্দ। সেই সত্তার প্রতি উহা ব্যবহৃত হয় ‘সত্যবাদিতা’ যাহার স্বভাবগত গুণ।
“ইবরাহীম ছিল এক ‘উম্মাত, আল্লাহর অনুগত, একনিষ্ঠ এবং সে ছিল না মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত; সে ছিল আল্লাহর অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞ; আল্লাহ তাহাকে মনোনীত করিয়াছিলেন এবং তাহাকে পরিচালিত করিয়াছিলেন সরল পথে” (১৬ ও ১২০-১২১)।
এখানে [ ] মনোনীত করা ও [ ] (হিদায়াত করা) এমন দুইটি গুণ যাহার সহিত মিথ্যা [ ] বাহ্যিক কিংবা বাস্তব কোন ভাবেই সম্পৃক্ত হইতে পারে না।
“আমি তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করিলাম, তুমি একনিষ্ঠ ইবরাহীমের ধর্মাদর্শ অসুরণ কর” (১৬ : ১২৩)।
ইনি সেই ইবরাহীম (আ) যাহার মিল্লাতের অনুসরণ-অনুকরণ করিতে সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ (স) ও তাঁহার উম্মতকে নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে।
“আমি তো ইহার পূর্বে ইবরাহীমকে সৎপথের জ্ঞান দিয়াছিলাম এবং আমি তাহার সম্বন্ধে ছিলাম সম্যক পরিজ্ঞাত” (২১ : ৫১)।
ইহাতে এবং এই জাতীয় অন্যান্য আয়াতে ইবরাহীম (আ)-এর যেই সকল বিশেষ গুণের উল্লেখ করা হইয়াছে, ইহার পর এক মুহূর্তের জন্যও আর এমন লূত-পবিত্র ও মহান সত্তা সম্পর্কে মিথ্যার কল্পনাও করা যায় না। সে মিথ্যা বাস্তবিক অর্থে [ ] হউক বা শুধুমাত্র বাহ্যিক অর্থেই হউক। অবশ্য আলোচনার বিষয় এই যে, উক্ত দুই সাহীহ রিওয়ায়াতের এই তিনটি বিষয়কে রাসূলুল্লাহ (স) এমন একজন সম্মানিত নবী সম্পর্কে “মিথ্যা” [ ] বলিয়া কেন অভিহিত করিলেন, অথচ তাঁহার পবিত্র সত্তা দীনের প্রয়োজন ও ইসলামী আকীদা সম্পর্কে সন্দেহ-সংশয় দূর করার উপকরণস্বরূপ, সন্দেহ সংশয় সৃষ্টির করার জন্য নহে । বিশেষত এই তিনটি কথা যখন স্ব স্ব স্থানে কোন অবস্থাতেই মিথ্যা নহে, না বাহ্যিকভাবে আর না প্রকৃত অর্থে।
নিঃসন্দেহে হযরত সারা হযরত ইবরাহীম (আ)-এর দীনী ভগ্নী এবং চাচাতো বোন ছিলেন (ইবৃনে কাছীর)। আবার [ ] এইজন্য বলিয়াছিলেন যে, তাঁহার মন-মানসিকতা খুবই খারাপ ছিল
হযরত ইবরাহীম (আ) যদিও তিনি শারীরিক দিক দিয়া মারাত্মকভাবে রোগাক্রান্ত ছিলেন না। তাই [ ] বলাও সঠিক। আবার নিঃসন্দেহে তিনি বিতর্কের পদ্ধতিতে প্রতিপক্ষকে নিরুত্তর করিয়া দেওয়ার জন্য বলিয়াছিলেন, [ ] আর ইহা, কোনক্রমেই মিথ্যা ছিল না। তাহা হইলে উক্ত হাদীছদ্বয়ে এইভাবে কেন বর্ণনা করা হইল :
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়া উলামায়ে কিরাম দুইটি পন্থা অবলম্বন করিয়াছেন : (১) ইহা খবরে ওয়াহিদ। এইজন্য জোর গলায় ইহা বলিয়া দেওয়া উচিৎ যে, যদিও এই রিওয়ায়াতদ্বয় সাহীহায়নে আছে এবং এইজন্য ইহা মাশহুর-এর পর্যায়ে পৌঁছিয়াছে কিন্তু রাবীদের এই রিওয়ায়াতে মারাত্মক ভ্রম হইয়াছে। তাই ইহা মোটেও গ্রহণযোগ্য নহে। কারণ একজন নবীর প্রতি মিথ্যারোপের তুলনায় রাবীদের ভুল স্বীকার করা বহু গুণ ভাল এবং সঠিক পন্থা। ইমাম রাযী (র)-এর মতও অনুরূপ; তিনি এই মতই অবলম্বন করিয়াছেন।
(২) ইহা অকাট্য, সর্বসম্মমত ও সুনিশ্চিত আকীদা যে, নবী-রাসূলগণের প্রতি মিথ্যারোপ করা কোন অবস্থাতেই সঠিক নহে। এমতাবস্থায় যদি মাশহুর বা মুতাওয়াতির পর্যায়ের কোন সহীহ রিওয়ায়াতে এমন ধরনের কোন বিষয় থাকে যাহা নবুওয়তের শান বিরোধী, তবে সেই রিওয়ায়াত সাহীহ বলিয়া গণ্য করত সেই বিশেষ বাক্যসমূহের এমন ব্যাখ্যা করা উচিৎ যাহা দ্বারা মূল বিষয়েরও ক্ষতি না হয় এবং সহীহ রিওয়ায়াতসমূহও অস্বীকার করিতে না হয়। তাই সাহীহায়ন-এর এই সকল রিওয়ায়াত প্রত্যাখ্যান করা যাইবে না এবং [ ] তথা “তিনটি মিথ্যা” শীর্ষক বাক্যাংশের এই ব্যাখ্যা করা উচিত যে,এই স্থলে মিথ্যা [ ] অর্থ “এমন কথা যাহা সঠিক [ ] ও সৎ উদ্দেশ্যে বলা হইয়াছে কিন্তু শ্রোতা উক্ত উদ্দেশ্য না বুঝিয়া নিজের মনমত একটা অর্থ বুঝিয়া লইয়াছে”। আর এই অর্থ শুধুমাত্র ইবরাহীম (আ)-এর ঘটনার জন্যই উদ্ভব করা হয় নাই, বরং অলঙ্কার শাস্ত্রের [ ] পরিভাষায় উহাকে মাআরীদ”-এর মধ্যে গণ্য করা হইয়াছে। বাগ্মীদের কথায় ইহার বিস্তর প্রচলন রহিয়াছে। শাফাআতের হাদীছের [ ] বাক্যটিও এই ব্যাখ্যার সমর্থন করে। জমহুর আলিমগণের মত ইহাই। তাঁহারা ইমাম রাযী ও তাঁহার এ মতের অনুসারী আলিমগণের মত সঠিক বলিয়া স্বীকার করেন না।
হিফজুর রাহমান সিউহারবী উল্লিখিত? দীর্ঘ আলোচনার পর স্বীয় মতামত এইভাবে ব্যক্ত করিয়াছেন যে, উপরিউক্ত মত দুইটি হইতে পৃথক সাদামাটা ও পরিষ্কার রাস্তা এই যে, সহীহ হাদীছকে অস্বীকার এবং উহার শব্দাবলীর সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা করা ছাড়াই বিষয়টি এমনভাবে সমাধা করা যায় যাহাতে আসল বিষয় “নবীদের নিষ্পাপ” [ ] হওয়ার ব্যাপারে কোন প্রশ্ন না উঠিতে পারে, আর এই ধরনের ক্ষেত্র হইতে অবৈধভাবে ফায়দা হাসিলকারী ও রাসূলুল্লাহ (স)-এর হাদীছের সহিত ঠাট্টা-বিদ্রূপকারিগণেরও কুফরী করার সাহস না হয় এবং তাহারা সে অবকাশ না পায়। ইহার বিশদ বিবরণ এই যে, “নবীগণের নিষ্পাপ হওয়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহে দীন-এর মৌলনীতি ও গুরত্বপূর্ণ আকীদার অন্তর্ভুক্ত, বরং বলিতে গেলে দীন ও মাযহাবের সত্যতার ভিত্তি শুধু এই একটি বিষয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত। কারণ নবীগণও কোন কোন অবস্থায় মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করিতে পারেন, তাই উহা দীন ও হকের সাহায্যের জন্যই হউক না কেন–এই কথা স্বীকার করিয়া লইলে যে নবীর আনীত সকল শিক্ষার মধ্যে কোন্টি তাঁহার প্রকৃত উদ্দেশ্যের সহিত সম্পৃক্ত ও অকাট্য সত্য, আর কোন্টি মিথ্যার রঙ্গে রঙ্গীন তাহা পৃথক করা অসম্ভব হইয়া দাঁড়াইবে। ফলে নবীর দীন ও মাযহাব কোনটিরই আর বিশ্বাসযোগ্যতা থাকিবে না। তাই “নবীগণ নিষ্পপ” এই অকাট্য বিশ্বাস ও আকীদা উহার স্বস্থানে অপরিবর্তনীয়। তাই নিঃসন্দেহে যাহা এই আকীদার অন্তরায় ও পরিপন্থী হইবে তাহাই অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করিতে হইবে, নতুবা উহার সঠিক ব্যাখ্যা করিয়া উক্ত আকীদার অনুকূল করিতে হইবে।
এমনিভাবে ইহাও স্বতসিদ্ধ যে, কুরআন কারীমের তাফসীর কেবল আরবী শব্দের অভিধানের ভিত্তিতেই করা সম্ভব নহে, বরং উহা বুঝিবার জন্য অভিধানের সাহায্য ও মাধ্যম যেমন প্রয়োজন, তদপেক্ষা আরো বেশী প্রয়োজন আল্লাহর নবী (স)-এর কথা, কাজ ও অবস্থাবলী সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের যাহা সাহাবায়ে কিরাম-এর মাধ্যমে রাবী-পরম্পরায় আমাদের নিকট আসিয়া পৌঁছিয়াছে। অবশ্য এ কথাও মনে রাখিতে হইবে যে, রাসূলুল্লাহ (স)-এর সকল হাদীছই অবিকল তাঁহার মুখ নিসৃত বাণী নহে; বরং কিছু কিছু এমনও রহিয়াছে যাহা রাবী নিজের শব্দে রাসূলুল্লাহ (স)-এর বাণীর সারমর্ম বর্ণনা করিয়াছেন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে নিজের পক্ষ হইতে কিছু ব্যাখ্যাও তিনি পেশ করিয়াছেন।
এই গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি সামনে রাখিয়া আলোচ্য বিষয়টি এইভাবে সমাধান করা যাইতে পারে যে, বুখারীর হাদীছ নিঃসন্দেহে গ্রহণযোগ্য। আর ইহাও স্বীকৃত যে, এই গ্রন্থ সমালোচনা ও যাচাই বাছাই করার পর উম্মতের মধ্যে প্রসিদ্ধি ও গ্রহণযোগ্যতা লাভের এমন মর্যাদা লাভ করিয়াছে যে, কিতাবুল্লাহর পর উহাকে অধিকতর শুদ্ধ কিতাব বলা হয়। এতদ্সত্তেও ইহা সম্ভব যে, রিওয়ায়াতের ভাবার্থ বর্ণনা [ ] হওয়ার কারণে উহার কোনও রিওয়ায়াতে রাবীর পক্ষ হইতে শব্দের ব্যাখ্যায় বা শব্দের প্রয়োগে কোন রকম ত্রুটি সৃষ্টি হইয়া গিয়াছে এবং রিওয়ায়াত যদিও উহার সনদ পরম্পরা ও মতনের দিক দিয়া মৌলিক বা আইব্নতভাবে স্বীকার্য হয় তবুও উক্ত বাক্যের ব্যাখ্যাকে ত্রুটিযুক্ত [ ] বলিয়া গণ্য করা হইবে এবং আসল রিওয়ায়াত প্রত্যাখ্যান করার পরিবর্তে শুধু উহার ত্রুটি প্রকাশ করা হইবে। ইহার উৎকৃষ্টতম উদাহরণ হইল বুখারীর মিরাজ সম্পর্কিত হাদীছ । মুহাদ্দিছগণ এই ব্যাপারে একমত যে, আনাস (রা) হইতে বর্ণিত মুসলিমের হাদীছ-এর তুলনায় আবদুল্লাহ ইবন আবী নামিরা (রা) হইতে বর্ণিত বুখারীর হাদীছের বর্ণনায় ক্রটি [ ] রহিয়াছে এবং ইহার বিন্যাসে [ ] ভুল বিদ্যমান। আর মুসলিমের রিওয়ায়াত উক্ত দুর্বলতা ও ভুলত্রুটি হইতে মুক্ত। অথচ এই উভয় বর্ণনাই রিওয়ায়াত (বর্ণনা) ও দিরায়াত (যুক্তি)-এর দিক দিয়া সঠিক ও গ্রহণযোগ্য।
তাই কোন সন্দেহ ও সংশয় ছাড়াই এই কথা মানিয়া নিতে হয় যে, হযরত ইবরাহীম (আ) সম্পর্কিত এই দীর্ঘ রিওয়ায়াত দুইটি অর্থগত রিওয়ায়াত [ ]-এর অন্তর্ভুক্ত। আর কখনো এই দাবি করা যাইবে না যে, শব্দ ও বাক্যের এই পরিপূর্ণ কাঠামো অবিকল রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মুখ-নিঃসৃত বাক্য; বরং ইহা তাহার বক্তব্যের মর্ম ও অর্থ প্রকাশ করে। কাজেই উভয় রিওয়ায়াতে বর্ণনাকৃত ঘটনা সত্য হওয়া সত্ত্বেও আলোচ্য বিষয়ের হাদীছের শব্দাবলী সনদ পরম্পরায় কোন রাবীর শাব্দিক ত্রুটির পরিণতি এবং তাহার দ্বারাই এই দুর্বলতা [ ]- এর সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রহিয়াছে। বিশেষত যখন উহার জন্য এই আলামতও রহিয়াছে যে, হযরত ইবরাহীম (আ), সারা ও মিসরের বাদশাহর এই ঘটনা তাওরাতে (বাইবেলে)ও উল্লিখিত আছে এবং সেখানে অসতর্কতামূলক ও অসংলগ্ন বাক্যও প্রচুর রহিয়াছে। তাই সম্ভবত রাবীর দ্বারা এই ইসরাঈলী (রিওয়ায়াত এবং উক্ত সাহীহ রিওয়ায়াতের মধ্যে বর্ণনার সময় তালগোল পাকাইয়া গিয়াছে। আর এইজন্যই তিনি ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়া আলোচ্য বিষয়ে উল্লিখিত শব্দ প্রয়োগ করিয়াছেন (হিফজুর রাহমান সিউহারবী, কাসাসুল-কুরআন, ১খ., ১৯৭-২০৮)।
মিসর হইতে সিরিয়া প্রত্যাবর্তন : অতঃপর হযরত ইবরাহীম (আ) মিসর হইতে সিরিয়া প্রত্যাবর্তন করিলেন এবং পবিত্র ভূমি ফিলিসতীনের আস-সাব নামক স্থানে অবতরণ করিলেন। তাঁহার সহিত তখন বহু চতুষ্পদ জন্তু, দাসদাসী ও প্রচুর ধন-সম্পদ ছিল। হাজার (আ)ও তাহাদের সঙ্গে ছিলেন। অতঃপর ইবরাহীম (আ)-এর নির্দেশে লুত (আ) তাঁহার সম্পদ লইয়া সাদূমে চলিয়া যান (ইবন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১৩, ১৫২)। ইবরাহীম (আ) এখানে একটি কূপ খনন এবং একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। উক্ত কূপের পানি ছিল স্বচ্ছ ও সুমিষ্ট। তাঁহার বকরিগুলি সেখান হইতে পানি পান করিত। ইবরাহীম (আ) সেখানে বেশ কিছু দিন অবস্থান করেন।
ফিলিসতীনের নিকটস্থ কিততা বা কাত নামক স্থানে হিজরত
অতঃপর সেখানকার অধিবাসিগণ তাহাকে কষ্ট দিল। তিনি সেখান হইতে বাহির হইয়া ফিলিসতীনের পার্শ্ববর্তী রামলা ও ঈলিয়ার মধ্যবর্তী কিতা নামক স্থানে চলিয়া গেলেন। আল্লাহ তাআলা ওহীর মাধ্যমে তাঁহাকে উত্তর-দক্ষিণে ও পূর্ব-পশ্চিমে দৃষ্টি প্রসারিত করিতে বলিলেন এবং তাঁহাকে সুসংবাদ দিলেন যে, এই ভূমি সবটাই তোমার এবং তোমার পরবর্তী বংশধরদের জন্য একেবারে শেষ যমানা পর্যন্ত আমি বরাদ্দ করিব। আর তোমার বংশধর অতিশয় বৃদ্ধি করিব, এমনকি তাহাদের সংখ্যা হইবে মাটির ধুলিকণা সম। এই সুসংবাদ বর্তমান উম্মতের সহিত সংশ্লিষ্ট, বরং উহার বিরাট এক সংখ্যাই উম্মতে মুহাম্মাদ (স)। রাসূলুল্লাহ (স)-এর একটি হাদীছ হইতে ইহার সমর্থন পাওয়া যায়। তিনি বলিয়াছেন :
“আল্লাহ তাআলা আমার জন্য পৃথিবীকে একত্রিত করিয়া দিয়াছেন। আর আমি উহার পূর্ব-পশ্চিম দর্শন করিয়াছি। আমার উম্মতের রাজত্ব ততদূর পর্যন্ত পৌঁছিবে যতদূর আমার জন্য একত্র করা হইয়াছিল” (ইবন কাছীর, আল-ইবনুল-আছীর, আল-কামিল, ১খ, ৭৯)।
সাববাসীদের নিকট হইতে চলিয়া আসার পর উক্ত কূপের পানি শুকাইয়া যায়। ফলে তাহারা নিজদের কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ ও অনুশোচনা করে এবং বলে, আমরা একজন সৎ লোককে আমাদের নিকট হইতে বিতাড়িত করিয়াছি। অতঃপর তাহারা ইবরাহীম (আ)-এর অনুগমন করিয়া তাঁহার সন্ধান লাভ করে এবং তাঁহাকে ফিরিয়া যাইবার আবেদন করে। তিনি বলিলেন, যে দেশ হইতে আমাকে বহিষ্কার করা হইয়াছে সেখানে আমি আর ফিরিয়া যাইব না। তাহারা বলিল, আপনি যে কূপ হইতে পানি পান করিতেন এবং আমরাও আপনার সহিত পান করিতাম তাহা শুকাইয়া গিয়াছে। তিনি তাহাদিগকে তাহার ছাগলের পাল হইতে সাতটি ছাগল দিয়া বলিলেন, এইগুলি সঙ্গে করিয়া লইয়া যাও। ইহাদিগকে পানি পান করিতে দিলেই কূপ হইতে স্বচ্ছ ও সুমিষ্ট পানি বাহির হইবে। উহা হইতে তোমরাও পান করিও। তবে কোন ঋতুবতী মহিলা যেন অঞ্জলী ভরিয়া উক্ত পানি পান না করে। তাহারা ছাগলগুলি লইয়া চলিয়া আসিল। সেইগুলি কূপের নিকট গেলেই উহা হইতে স্বচ্ছ পানি প্রবাহিত হইল। তাহারা উহা হইতে পানি পান করিল। এইভাবে বেশ কিছু দিন অতিবাহিত হইবার পর একদিন উহার নিকট এক ঋতুবতী মহিলা আসিল এবং উহা হইতে অঞ্জলী পূর্ণ করিয়া পানি পান করিল। সঙ্গে সঙ্গে উক্ত কূপের পানি শুকাইয়া গেল এবং আজ পর্যন্ত উহা শুষ্ক রহিয়াছে (আত-তাবারী, তারীখ, ১খ, ১২৭; ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ.৮৫; ইবনুল আছীর, আল-কামিল, ১খ, ৭৯)।
ফেরেশতাদের আগমন এবং পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দান
ইবরাহীম (আ) এই কিতা বা কাত নামক স্থানেই বসবাস করিতে থাকেন। তাহার নিকট যাহারা আগমন করিত তিনি তাহাদের মেহমানদারী করিতেন। আল্লাহ তাআলা তাঁহাকে প্রচুর ধন-সম্পদ ও চাকর-বাকর দান করিয়ছিলেন। এই সময় লূত (আ)-এর সম্প্রদায় এক জঘন্য অপকর্ম করিত যাহা বিশ্ববাসীর কেহ ইতিপূর্বে করে নাই। সঙ্গে সঙ্গে লুত (আ)-কে তাহারা অমান্য করিত এবং তাহার উপদেশ প্রত্যাখ্যান করিত। অতঃপর তাহাদিগকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আল্লাহ এই সময় ফেরেশতা প্রেরণ করেন। তাহারা প্রথমে ইবরাহীম (আ)-এর নিকট আগমন করেন মেহমানের বেশে। ইবরাহীম (আ)-এর অভ্যাস ছিল সব সময় মেহমানকে সঙ্গে লইয়া আহার করা। কিন্তু ইহাদের আগমনের পূর্বে পনের দিন পর্যন্ত কোন মেহমানের আগমন ঘটে নাই । ইহাতে তিনি খুবই বিচলিত ছিলেন। অতঃপর ফেরেশতাগণ মেহমানদের বেশে আগমন করিলে তিনি খুবই খুশী হন। তিনি তাহাদের জন্য একটি ভুনা মাংসল গোবৎস লইয়া আসিলেন। কিন্তু তাহারা উহা না খাইয়া হাত গোটাইয়া বসিয়া রহিলেন। ইবরাহীম (আ) তাহাদিগকে বলিলেন, আপনারা খাইতেছেন না কেন? তাহাদের হস্তসমূহ খাবার স্পর্শ করিতেছে না দেখিয়া ইবরাহীম (আ) শংকিত হইয়া পড়িলেন। তাহারা বলিলেন, আপনি ভীত হইবেন না। আমরা লূত (আ)-এর সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হইয়াছি। তাঁহার স্ত্রী সারা নিকটে দণ্ডায়মান ছিলেন। আর ইবরাহীম (আ) তাহাদের সহিত আহারে বসিয়াছিলেন। তাহারা তাহাদের প্রেরিত হইবার কারণ অবহিত করিলেন এবং তাঁহার পুত্র ইসহাক-এর জন্মের ও ইসহাকের পর ইয়াকুবের জন্মের সুসংবাদ দিলেন। ইহা শুনিয়া সারা হাসিয়া ফেলিলেন। কুরআন কারীমে উক্ত ঘটনা এইভাবে বর্ণিত হইয়াছে :
“আর তাহার স্ত্রী দণ্ডায়মান এবং সে হাসিয়া ফেলিল। তারপর আমি তাহাকে ইসহাকের ও ইসহাকের পরবর্তী ইয়াকুবের সুসংবাদ দিলাম। সে বলিল, কি আশ্চর্য! সন্তানের জননী হইব আমি যখন আমি বৃদ্ধা এবং এই আমার স্বামী বৃদ্ধ! ইহা অবশ্যই এক অদ্ভুত ব্যাপার। তাহারা বলিল, আল্লাহর কাজে তুমি বিস্ময়বোধ করিতেছ? হে পরিবারবর্গ! তোমাদের প্রতি রহিয়াছে আল্লাহর অনুগ্রহ ও কল্যাণ। তিনি তো প্রশংসাহ ও সম্মানা” (১১ : ৭১-৭৩)।
সারার এই হাসির কারণ সম্পর্কে আলিমগণ বিভিন্ন রকমের ব্যাখ্যা দিয়াছেন। সুদ্দী বলেন, তাহারা যখন আহার গ্রহণ করিতেছিলেন তখন তিনি বলিয়াছিলেন, কি অদ্ভুত আমাদের এই সকল মেহমান! আমরা তাহাদের সম্মানার্থে প্রাণপণ খেদমত করিতেছি, আর তাহারা আমাদের আহার গ্রহণ করিতেছেন না! কাতাদা বলেন, লূত (আ)-এর সম্প্রদায়ের কর্মকাণ্ড এবং শাস্তি নিকটবর্তী জানিয়া তিনি হাসিয়াছিলেন। মুকাতিল ও কালবী বলেন, তিনি ইবরাহীম (আ)-এর ভয় পাওয়ায় হাসিয়াছিলেন। কারণ তিনি চাকর-বাকর ও পরিবার-পরিজন বেষ্টিত থাকিয়া ভয় পাইয়াছিলেন । ইবন আব্বাস (রা) বলেন, তাঁহার ও তাঁহার স্বামীর বার্ধক্যে পৌঁছা সত্ত্বেও সন্তান হওয়ার সংবাদে তিনি হাসিয়াছিলেন। তাঁহার বয়স ছিল তখন ৯০ বৎসর । আর ইবরাহীম (আ)-এর বয়স এই বর্ণনামতে ১২০ বৎসর। কিন্তু বাইবেলের বর্ণনামতে সুসংবাদ দেওয়া এই পুত্র ইসহাক (আ) যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন ইবরাহীম (আ)-এর বয়স ১০০ বৎসর (তাবারী, তারীখ, ১৩, ১২৮; ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া; পৃ. ৮৬; Genesis, 21 : 5)। তবে মুজাহিদ ও ইকরিমা (র) বলেন, কুরআন কারীমে উল্লিখিত [ ] শব্দটির অর্থ “তিনি হাসিলেন” নহে; বরং “তিনি ঋতুবতী হইলেন”। আরবী পরিভাষায় ইহার ব্যবহার পাওয়া যায়। যেমন খরগোশ যখন ঋতুবতী হয় তখন বলা হয়, “খরগোশটি ঋতুবতী হইয়াছে” (ছালাবী, প্রাগুক্ত)।
লূত সম্প্রদায়ের ব্যাপারে বাদানুবাদ
হযরত ইবরাহীম (আ) ছিলেন খুবই কোমল হূদয়। তিনি যখন জানিতে পারিলেন যে, ফেরেশতাগণ লূত সম্প্রদায়কে ধ্বংস করিতে আসিয়াছেন তখন সেই সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁহার হূদয় বিগলিত হইল। তিনি ফেরেশতাদের সহিত তাহাদের ব্যাপারে বাদানুবাদ শুরু করিলেন। তাহাদের প্রতি আল্লাহর রহমত কামনা করিলেন। কুরআন কারীমে ইরশাদ হইয়াছে :
“অতঃপর যখন ইবরাহীমের ভীতি দূরীভূত হইল এবং তাহার নিকট সুসংবাদ আসিল তখন সে নূতের সম্প্রদায়ের সম্বন্ধে আমার সহিত বাদানুবাদ করিতে লাগিল। ইবরাহীম তো অবশ্যই সহনশীল, কোমল হূদয়, সতত আল্লাহ অভিমুখী” (১১ : ৭৪-৭৫)।
৩৫৬
তাঁহার এই বাদানুবাদের বিষয়টি কুরআন কারীমে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয় নাই, বরং বাইবেলে উহার উল্লেখ রহিয়াছে (আবদুল ওয়াহহাব নাজ্জার, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৯৫)। মুসলিম সীরাতবিদগণও উহার উল্লেখ করিয়াছেন। সাঈদ ইব্ন জুবায়র, সুদ্দী, কাতাদা ও মুহাম্মাদ ইব্ন ইসহাক প্রমুখ বর্ণনা করিয়াছেন যে, ফেরেশতাগণ বলিলেন যে, আমরা এই জনপদের অীধবাসীদিগকে ধ্বংস করিব। ইবরাহীম (আ) বলিলেন, তোমরা কি এমন জনপদ ধ্বংস করিবে, যেখানে তিন শত মুমিন রহিয়াছে। তাহারা বলিলেন, না। তিনি বলিলেন, যেখানে দুই শত মুমিন রহিয়াছে। তাহারা বলিলেন, না। তিনি বলিলেন, চল্লিশজন মুমিন থাকিলে তাহারা বলিলেন, না। তিনি বলিলেন, চৌদ্দজন মুমিন থাকিলে তাহারা বলিলেন, না। ইবরাহীম (আ) ধারণা করিয়াছিলেন যে, লূত (আ)-এর স্ত্রীসহ সেখানে চৌদ্দজন মুমিন রহিয়াছে। তাই তাহাদের কথায় তিনি স্বস্তি লাভ করিলেন এবং চুপ হইয়া গেলেন। ইব্ন ইসহাক বলেন, এইভাবে বলিতে বলিতে বলিতে সর্বশেষ বলিলেন, সেখানে একজন মুমিন থাকিলে তোমাদের কি অভিমত? তাহারা বলিলেন, না, একজন মুমিন থাকিলেও সেই জনপদ আমরা ধ্বংস করিব না। তারপর ইবরাহীম (আ) যখন ফেরেশতাদের নিকট হইতে লূত সম্প্রদায়ের সম্পর্কে অবহিত হইলেন যে,তাহাদিগকে মাটির ঢেলা নিক্ষেপ করিয়া বিলীন করিয়া দেওয়া হইবে (৫১ ৩৩)। তখন দূত (আ)-এর প্রতি স্নেহভরে বলিলেন,
“সেখানে তো ত রহিয়াছে। তাহারা বলিল, সেথায় কাহারা আছে, তাহা আমরা ভাল জানি। আমরা তো লূতকে ও তাহার পরিজনবর্গকে রক্ষা করিবই। তাহার স্ত্রীকে ব্যতীত; সে তো পশ্চাতে অবস্থানকারীদের অন্তর্ভুক্ত” (২৯ ও ৩২)।
অতঃপর আল্লাহর পক্ষ হইতে স্থির সিদ্ধান্ত ঘোষিত হইল :
“হে ইবরাহীম! ইহা হইতে বিরত হও। তোমার প্রতিপালকের বিধান আসিয়া পড়িয়াছে; উহাদের প্রতি তো আসিবে শাস্তি যাহা অনিবার্য” (১৯৭৬) (দ্র. ইবন কাছীর, আল-বিদায়া, ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ১৭৮-১৭৯; আত-তাবারী, তারীখ, ১৩, ১৫৩-১৫৪)।
পুত্রের সুসংবাদ : ইবরাহীম (আ) সৎ সন্তানের জন্য যে দুআ করেন আল্লাহ তাআলা উহা কবুল করেন। জিবরীল (আ) সুসংবাদ দিলেন যে, আল্লাহ তাহাকে সারার গর্ভে এক সন্তান দিবন। তাঁহার বংশধরদের মধ্যে অসংখ্য নবী আগমন করিবে (আল-কিসাঈ, কাসাসুল-আম্বিয়া, ১খ, ১৪২)।
প্রথম পুত্র ইসমাইল (আ)-এর জন্ম
আল-কুরআনে ইবরাহীম (আ)-এর প্রথম পুত্র ইসমাঈল (আ)-এর জন্মবৃত্তান্ত বিস্তারিতভাবে উল্লিখিত হয় নাই। বাইবেলের বর্ণনামতে ইবরাহীম (আ) আল্লাহর নিকট সুসন্তান প্রার্থনা করেন। আল্লাহ তাঁহাকে উহার সুসংবাদ দেন। কুরআন কারীমেও ইহার উল্লেখ আছে। ইরশাদ হইয়াছে :
“(ইবরাহীম বলিল, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এক সকর্মপরায়ণ সন্তান দান কর। অতঃপর আমি তাহাকে এক স্থিরবুদ্ধি পুত্রের সুসংবাদ দিলাম” (৩৭ : ১০০-১০১)।
বায়তুল মাকদিসের কাছে যখন তাঁহার বিশ বৎসর কাটিয়া গেল তখন স্ত্রী সারা তাঁহাকে বলিলেন, আল্লাহ তো আমাকে সন্তান হইতে বঞ্চিত করিয়াছেন। তাই আপনি হাজারের সহিত মেলামেশা করুন। হয়তবা আল্লাহ তাহা হইতে আপনাকে একটি সন্তান দান করিবেন। সারা হাজারকে ইবরাহীম (আ)-এর সহিত বিবাহ দেন। ইবরাহীম (আ) তাহার সহিত মেলামেশা করিলেন, ফলে তিনি গর্ভবতী হইলেন। বাইবেলের বর্ণনামতে গর্ভবতী হইয়া হাজার নিজকে বড় মনে করিল এবং স্বীয় মালিক সারার উপর বড়াই করিতে লাগিল। সারা ইহাতে ক্ষুব্ধ হইলেন এবং এই সম্পর্কে ইবরাহীম (আ)-এর নিকট অভিযোগ করিলেন। ইবরাহীম (আ) তাহাকে বলিলেন, তাহার ব্যাপারে তোমার যাহা ইচ্ছা তাহাই কর। ইহাতে হাজার ভয় পাইয়া পলায়ন করিলেন এবং সেখানে একটি কূপের নিকট গিয়া উপস্থিত হইলেন তখন কোন এক ফেরেশতা তাহাকে বলিলেন, তুমি ভয় পাইও না। তোমার গর্ভস্থ এই শিশু কল্যাণময়। ফিরিশতা তাহাকে ফিরিয়া যাইবার নির্দেশ দিলেন এবং বলিলেন যে, অতিসত্ত্বর সে এক পুত্রসন্তান প্রসব করিবে। তাহার নাম রাখিবে ইসমাঈল । তাহার হস্ত সকলের বিরুদ্ধে ও সকলের হস্ত তাহার বিরুদ্ধে হইবে; সে তাহার ভ্রাতৃবর্গের সকল দেশের মালিক হইবে। হাজার তখন আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করিলেন (দ্র. Genesis, 16 2-13; ইবন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ১৫৩)। এই সুসংবাদ তাহার পরবর্তী বংশধর হযরত মুহাম্মাদ (স)-এর উপর প্রযোজ্য হয়। কারণ তাঁহার দ্বারাই আরববাসী নেতৃত্ব লাভ করে এবং পূর্ব-পশ্চিম তথা সমগ্র ভূখণ্ডের মালিক হয়। আল্লাহ তাহাদিগকে উপকারী ইলম ও সৎকাজের তাওফীক দান করিয়াছেন যাহা তাহাদের পূর্ববর্তী কোন উম্মতকেই দান করেন নাই। আর ইহা কেবল তাহাদের রাসূলের মর্যাদার কারণে এবং তাহার রিসালাতের বরকতে (ইব্ন কাছীর, আল-বিদায়া, প্রাগুক্ত)। অতঃপর হাজার ফিরিয়া আসিলেন এবং ইসমাঈল (আ) ভূমিষ্ঠ হইলেন। বাইবেলের বর্ণনামতে তাহার জন্মের সময় ইবরাহীম (আ)-এর বয়স ছিল ৮৬ বৎসর। দ্বিতীয় পুত্র ইসহাক (আ)-এর জনের ১৩ বৎসর পূর্বে প্রথম পুত্র ইসমাঈল (আ) জন্মগ্রহণ করেন। (ইবন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়া- নিহায়া,১৩, ১৫৩)।
ইসমাঈল (আ)-এর জন্মের পর আল্লাহ পৃথকভাবে ইবরাহীম (আ)-কে সারার গর্ভে ইসহাক (আ)-এর জন্মের সুসংবাদ দেন। ইবরাহীম (আ) তখন আল্লাহর উদ্দেশে সিজদায় পড়িয়া যান। আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম (আ)-কে বলিলেন, ইসমাঈলের ব্যাপারে তোমার দুআ কবুল করিয়াছি। তাহার উপর আমি বরকত নাযিল করিয়াছি। তাহাকে অধিক সন্তান দান করি এবং অধিক সন্তানের দাদা হিসাবে তাহার মৃত্যু দিব। তাহার বংশে ১২ জন মহান ব্যক্তিত্ব জন্মগ্রহণ করিবে। তাহাকে আমি বিরাট এক গোষ্ঠীর সর্দার বানাইব।
ইহাও এই বিরাট উম্মতের জন্য সুসংবাদ। আর সেই ১২ জন মহান ব্যক্তিত্ব হইলেন খুলাফায়ে রাশিদীন, যাহাদের সম্পর্কে জাবির ইবন সামুরা (রা) বর্ণিত হাদীছে সুসংবাদ আসিয়াছে যে, রাসূলুল্লাহ (স) বলেন : (আমার উম্মতে) ১২ জন আমীর হইবে। ইহার পর কি একটা কথা বলেন তাহা আমি বুঝিতে পারি নাই। অতঃপর আমি আমার পিতার নিকট জিজ্ঞাসা করিলাম, তিনি কি বলিলেন : আমার পিতা বলেন, তিনি বলিয়াছেন, সকলেই হইবে কুরায়শ বংশের। বুখারী ও মুসলিম এই হাদীছ রিওয়ায়াত করিয়াছেন (ইব্ন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ১৫৩)। অন্য এক রিওয়ায়াতে আছে যে, এই বিষয়টি সর্বদাই কায়েম থাকিবে। অপর এক বর্ণনায় আছে যে, ১২ জন খলীফা হইবে সকলেই কুরায়শ বংশীয়। ইহাদের মধ্যেই চার খলীফা আবু বা, উমার, উছমান ও আলী (রা)। ইহাদের মধ্যে উমার ইবন আবদিল-আযীযও রহিয়াছেন। আব্বাসী বংশের কতক খলীফাও ইহার অন্তর্ভুক্ত। ইহার দ্বারা পরপর ১২ জন বুঝানো হয় নাই, বরং যে কোন সময়ের ১২ জন হইতে পারে। অনুরূপভাবে শীআগণ ১২ জন ইমামের যে বিশ্বাস করিয়া থাকে, যাহাদের প্রথম হইলেন হযরত আলী (রা) ইবন আবী তালিব এবং শেষ হইল মুহাম্মদ ইবনুল-হাসান আল আসকারী- তাহাও বুঝানো হয় নাই (প্রাগুক্ত; আরও দ্র. নিবন্ধ ইসমাঈল (আ)}! হাজার ও ইসমাঈল (আ)-এর মক্কায় আবাসন
এই সম্পর্কে এক দীর্ঘ হাদীছের বর্ণনা নিম্নরূপ :
“আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নারীরা ইসমাঈল (আ)-এর মাতার নিকট হইতে সর্বপ্রথম কোমরবন্ধের ব্যবহার রপ্ত করে। তিনি তাঁহার (সতীন) সারা (রা) হইতে স্বীয় চিহ্নাদি লুকাইবার জন্য একটি কোমরবন্ধ ধারণ করেন। অতঃপর ইবরাহীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ইসমাঈলের মাতা ও তাহার দুগ্ধপোষ্য শিশুকে (ইসমাঈল) লইয়া আসিলেন। তাহাদেরকে তিনি একটি প্রকাণ্ড বৃক্ষের নিচে, মসজিদের উচ্চ ভূমিতে যমযমের স্থানে রাখিলেন। সে সময় মক্কায় কোন জনবসতি কিংবা পানির ব্যবস্থা ছিল না। তিনি তাহাদেরকে সেখানে রাখিলেন। আর তাহাদের পাশে এক ঝুড়ি খেজুর ও এক মশক (চামড়ার তৈরী পানির পাত্র) পানি রাখিলেন। অতঃপর ইবরাহীম (আ) তথা হইতে রওয়ানা হইলেন। ইসমাঈলের মাতা তাঁহার পিছনে পিছনে যাইতেছিলেন এবং বলিতেছিলেন, হে ইবরাহীম! আপনি আমাদেরকে এই জনপ্রাণীহীন উপত্যকায় রাখিয়া কোথায় যাইতেছেন? এখানে তো বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিত পরিবেশ কিছুই নাই। তিনি তাঁহাকে এই কথা বারবার বলিতে থাকিলেন। কিন্তু ইবরাহীম (আ) তাহার কথায় ভ্রূক্ষেপ করিলেন না। তিনি পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, আল্লাহ কি আপনাকে ইহার নির্দেশ দিয়াছেন? ইবরাহীম (আ) বলিলেন : হাঁ। তখন ইসমাঈলের মাতা বলিলেন, তবে আল্লাহ আমাদেরকে ধ্বংস করিবেন না। অতঃপর তিনি স্বস্থানে ফিরিয়া আসিলেন। ইবরাহীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বিদায় হইলেন। তিনি তাহাদের দৃষ্টিসীমার বাহিরে ‘সানিয়াহ্ নামক স্থানে পৌঁছিয়া কাবা ঘরের দিকে মুখ ফিরাইলেন এবং দুই হাত তুলিয়া দুআ করিলেনঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! আমি পানি ও তরুলতাশূন্য উষর এক প্রান্তরে আমার সন্তানদের একটি অংশ তোমার মহাসম্মানিত ঘরের কাছে আনিয়া বসবাসের জন্য রাখিয়া গেলাম।…. অতএব তুমি লোকদের অন্তরকে তাহাদের প্রতি অনুরক্ত করিয়া দাও, ফলমূল হইতে তাহাদেরকে খাবার দান কর, যেন তাহারা কৃতজ্ঞ ও শোকরকারী বান্দাহ হইতে পারে” (১৪ : ৩৭)।
ইসমাঈলের মাতা ইসমাঈলকে বুকের দুধ পান করাইয়া লালন-পালন করিতে লাগিলেন। তিনি নিজে মশকের পানি পান করিতে থাকিলেন। পরিশেষে পাত্রের পানি শেষ হইয়া গেল, তিনি নিজে এবং তাঁহার সন্তান পিপাসাকাতর হইয়া পড়িলেন। তিনি দেখিলেন যে, তাঁহার দুগ্ধপোষ্য শিশু পিপাসায় ছটফট করিতেছে। তিনি তাহা সহ্য করিতে না পারিয়া উঠিয়া চলিয়া গেলেন। সেখানে সাফা পাহাড়কে তিনি তাঁহার সর্বাধিক নিকটে দেখিতে পাইলেন। তিনি সাফা পাহাড়ে উঠিয়া চারিদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিলেন। উপত্যকার দিকে এই আশায় তাকাইলেন যে, কাহারো দেখা পাওয়া যায় কি না, কিন্তু কাহারো দেখা পাইলেন না। অতএব তিনি সাফা পাহাড় হইতে নামিয়া আসিলেন এবং উপত্যকা পার হইয়া মারওয়া পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছিয়া তাহাতে আরোহণ করিলেন। পাহাড়ের উপর দাঁড়াইয়া তিনি এদিক-সেদিক তাকাইয়া দেখিলেন কাহাকেও দেখা যায় কি না, কিন্তু কোন লোকজন দেখিতে পাইলেন না। এমনিভাবে তিনি দুই পাহাড়ের মাঝখানে সাতবার দৌড়াইলেন। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) বর্ণনা করিয়াছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলিয়াছেন : এই কারণেই লোকেরা (হজ্জের সময়) উভয় পাহাড়ের মধ্যে দৌড়াইয়া (সাঈ করিয়া) থাকে। ইসমাঈলের মা (শেষবারের মত) দৌড়াইয়া মারওয়া পাহড়ে উঠিলে একটি শব্দ শুনিতে পাইলেন। তিনি নিজেকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, কি ব্যাপার! আওয়াজ শুনিতে পাইলাম যেন। অতঃপর তিনি শব্দের প্রতি কান খাড়া করিলেন। তিনি আবার শব্দ শুনিতে পাইলেন এবং মনে মনে বলিলেন, তুমি আমাকে আওয়াজ শুনাইলে, হয়তো তোমার কাছে আমার বিপদের কোন প্রতিকার আছে। হঠাৎ তিনি (বর্তমান) যমযমের কাছে একজন ফেরেশতাকে দেখিতে পাইলেন। তিনি তাহার পায়ের গোড়ালি দিয়া মাটি খুঁড়িতেছিলেন এবং এইভাবে পানি ফুটিয়া বাহির হইল। তিনি ইহার চারিপাশে বাঁধ দিলেন এবং অঞ্জলি ভরিয়া মশকে পানি ভরিতে লাগিলেন। তিনি মশকে পানি ভরিতে ছিলেন, এদিকে পানি উথলিয়া পড়িতে থাকিল । অন্য বর্ণনায় আছে, তিনি মশক ভরিয়া পানি রাখিলেন। ইবন আব্বাস (রা) বর্ণনা করিয়াছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলিয়াছেন । ইসমাঈলের মায়ের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হউক। যদি তিনি যমযমকে ঐ অবস্থায় রাখিয়া দিতেন, অথবা বলিয়াছেন : তাহা হইতে যদি মশক ভরিয়া তিনি পানি না রাখিতেন, তবে যমযম একটি প্রবহমান ঝর্ণায় পরিণত হইত। নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলিয়াছেন । তিনি পানি পান করিলেন এবং তাঁহার সন্তানকে দুধ পান করাইলেন। ফেরেশতা তাঁহাকে বলিলেন, আপনি ধ্বংস হইয়া যাওয়ার ভয় করিবেন না। কেননা এখানে আল্লাহর ঘরের স্থান নির্দিষ্ট আছে, যাহা এই ছেলে ও তাঁহার পিতা নির্মাণ করিবেন। আল্লাহ এখানকার বাসিন্দাদেরকে ধ্বংস করেন না। ঘটনাক্রমে বনী জ্বরহুমের কাফেলা অথবা বনী জ্বরহুম গোত্রের লোক এই পথ ধরিয়া কাদাআ নামক স্থান দিয়া আসিতেছিল। তাহারা মক্কার নিম্নভূমিতে পৌঁছিলে সেখানে কিছু পাখি বৃত্তাকারে উড়িতে দেখিয়া বলিল, এসব পাখি নিশ্চয়ই পানির উপর চক্কর খাইতেছে। আমরা তো এই মরুভূমিতে আসিয়াছি অনেক দিন হইল, কিন্তু কোথাও পানি দেখি নাই। তাহারা একজন অথবা দুইজন অনুসন্ধানকারীকে খোঁজ নেওয়ার জন্য পাঠাইল। তাহারা গিয়া পানি দেখিতে পাইল এবং ফিরিয়া গিয়া তাহাদেরকে জানাইল। কাফেলার লোকেরা অনতিবিলম্বে পানির দিকে চলিয়া আসিল।
ইসমাঈলের মাতা তখন পানির কাছে বসা ছিলেন। তাহারা আসিয়া তাহাকে বলিল, আপনি কি আমাদেরকে এখানে আসিয়া অবস্থান করার অনুমতি দিবেন? তিনি বলিলেন, হ্যাঁ, কিন্তু পানির উপর তোমাদের কোন মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হইবে না। তাহারা বলিল, হাঁ, তাহাই হইবে। আবদুল্লাহ ইব্ন আব্বাস (রা) বর্ণনা করিয়াছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলিয়াছেন : ইসমাঈলের মায়ের উদ্দেশ্য ছিল তাহাদের সহিত পরিচিত হইয়া একটা অন্তরংগ ও সহানুভূতিসম্পন্ন পরিবেশ গড়িয়া তোলা। ঐ সকল লোক অসিয়া এখানে বসতি স্থাপন করিল এবং কাফেলার অন্যান্য লোকও তাহাদের পরিবার-পরিজনদেরকে ডাকিয়া আনিল। অবশেষে সেখানে বেশ কয়েক ঘর বসতি গড়িয়া উঠিল। ইসমাঈল যৌবনে পদার্পণ করিলেন এবং তাহাদের নিকট হইতে আরবী ভাষা শিখিলেন। তাঁহার স্বাস্থ্য-চেহারা ও সুরুচিপূর্ণ জীবন তাহারা খুবই পছন্দ করিল। তিনি বড় হইলে ঐ লোকেরা তাহাদের এক কন্যার সহিত তাঁহার বিবাহ দিল।
ইতিমধ্যে ইসমাঈলের মা ইন্তিকাল করিলেন। ইসমাঈলের বিবাহের পর ইবরাহীম (আ) মক্কায় আসিলেন নিজের রাখিয়া যাওয়া পরিজনের খোঁজে। তিনি ইসমাঈলকে বাড়িতে পাইলেন না। তিনি পুত্রবধূর কাছে জিজ্ঞাসা করিলেন, ইসমাঈল কোথায় গিয়াছে? সে বলিল, খাদ্যের সংস্থান করার জন্য তিনি বাহিরে গিয়াছেন। অন্য বর্ণনায় আছে : তিনি শিকারে বাহির হইয়াছেন। ইবরাহীম (আ) তাহাদের জীবনযাত্রা ও সাংসারিক বিষয়াদির খোঁজ নিলেন। পুত্রবধূ বলিল, আমরা খুব খারাপ অবস্থায় আছি। কঠোরতা ও সংকীর্ণতা আমাদেরকে গ্রাস করিয়াছে। এসব কথা বলিয়া সে অভিযোগ করিল। তিনি বলিলেন, তোমার স্বামী আসিলে তাহাকে আমার সালাম জানাইয়া বলিবে, সে যেন তাহার ঘরের দরজার চৌকাঠ পরিবর্তন করে।
বাড়ী ফিরিয়া ইসমাঈল (আ) যেন কিছু অনুভব করিতে পারিলেন। তিনি স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, কেহ আসিয়াছিলেন কি? স্ত্রী বলিল, হ, এরূপ একজন বৃদ্ধ লোক আসিয়াছিলেন। তিনি আপনার সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞাসা করিলে আমি তাঁহাকে অবহিত করিলাম। আমাদের সংসারযাত্রা কিভাবে চলিতেছে তিনি তাহাও জিজ্ঞাসা করিলেন। আমি তাঁহাকে জানাইলাম যে, আমরা খুব কষ্ট-ক্লেশের মধ্যে দিনাতিপাত করিতেছি। ইসমাঈল (আ) জিজ্ঞাসা করিলেন, তিনি কি তোমাকে কোন কথা বলিয়া গিয়াছেন? স্ত্রী বলিল, হাঁ! তিনি আমাকে আপনাকে সালাম পৌঁছাইতে বলিয়াছেন এবং আপনাকে আপনার ঘরের চৌকাঠ পরিবর্তন করিতে বলিয়াছেন। ইসমাঈল (আ) বলিলেন, তিনি আমার পিতা। তিনি তোমাকে পরিত্যাগ করিতে আদেশ দিয়াছেন। সুতরাং তুমি তোমার পরিবার-পরিজনের কাছে চলিয়া যাও। পরে তিনি তাহাকে তালাক দিলেন এবং ঐ গোত্রেরই অন্য এক মেয়েকে বিবাহ করিলেন।
আল্লাহর ইচ্ছামত ইবরাহীম (আ) বেশ কিছু দিন আর এদিকে আসেন নাই। পরে তিনি যখন আবার আসিলেন তখনও ইসমাঈলের সাথে তাঁহার দেখা হইল না। পুত্রবধূর কাছে গিয়া ইসমাঈলের কথা জিজ্ঞাসা করিলে সে বলিল, তিনি আমাদের খাদ্যের সন্ধানে গিয়াছেন। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমরা কেমন আছ? তিনি তাহাদের সাংসারিক জীবন ও অন্যান্য বিষয়েও জানিতে চাহিলেন। ইসমাঈলের স্ত্রী বলিল, আমরা খুব ভাল এবং স্বচ্ছল অবস্থায় দিন যাপন করিতেছি। এই কথা বলিয়া সে মহান আল্লাহর প্রশংসা করিল। ইবরাহীম (আ) জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমরা কি খাও? পুত্রবধূ বলিল, গোত। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, কি পান কর? সে বলিল, পানি। তখন ইবরাহীম (আ) দুআ করিলেন : হে আল্লাহ! ইহাদের গোশত ও পানিতে বরকত দান করুন। নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলিয়াছেনঃ সেই সময় তাহাদের কাছে কোন খাদ্যশস্য ছিল না, যদি থাকিত তাহা হইলে ইবরাহীম (আ) তাহাদের খাদ্যশস্যেও বরকতের দুআ করিতেন। এইজন্যই মক্কা ছাড়া অন্য কোথায়ও শুধু গোশত ও পানির উপর নির্ভর করিলে তাহা স্বাস্থ্যের জন্য অনুকূল হয় না। ইবরাহীম (আ) বলিলেন, তোমার স্বামী ফিরিয়া আসিলে তাহাকে আমার সালাম জানাইয়া বলিবে, সে যেন তাহার ঘরের চৌকাঠ হিফাজত করিয়া রাখে।
ইসমাঈল (আ) ফিরিয়া আসিয়া স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমার কাছে কেহ কি আসিয়াছিল? স্ত্রী বলিল, হাঁ! আমার কাছে একজন সুন্দর সুঠাম বৃদ্ধ লোক আসিয়াছিলেন। স্ত্রী বৃদ্ধের কিছু প্রশংসাও করিল। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, কিভাবে আমাদের জীবিকা ও ভরণপোষণ চলিতেছে? আমি বলিলাম, আমরা বেশ ভাল আছি। ইসমাঈল (আ) জিজ্ঞাসা করিলেন, তিনি কি তোমাকে কোন উপদেশ দিয়াছেন? স্ত্রী বলিল, হাঁ! তিনি আপনাকে সালাম জানাইয়াছেন এবং ঘরের চৌকাঠ হিফাজত করার হুকুম দিয়া গিয়াছেন। সব কথা শুনিয়া ইসমাঈল (আ) বলিলেন, তিনি আমার পিতা এবং তুমি ঘরের চৌকাঠ। তিনি আমাকে তোমার সহিত বৈবাহিক সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখার নির্দেশ দিয়া গিয়াছেন।
ইবরাহীম (আ) আল্লাহর ইচ্ছায় বেশ কিছু দিন পর্যন্ত আর এখানে আসেন নাই। একদিন ইসমাঈল (আ) যমযম কূপের পাশে একটি প্রকাণ্ড বৃক্ষের নিচে বসিয়া তাহার তীর ঠিক করিতেছিলেন। এমন সময় ইবরাহীম (আ) আসিলেন। ইসমাঈল (আ) পিতাকে দেখিয়া উঠিয়া আগাইয়া গেলেন। অতঃপর যেভাবে পিতা পুত্রের সঙ্গে এবং পুত্র পিতার সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করিয়া থাকে, তাঁহারাও তাহাই করিলেন। তিনি বলিলেন, হে ইসমাঈল! আল্লাহ্ আমাকে একটি কাজের নির্দেশ দিয়াছেন। ইসমাঈল (আ) বলিলেন, আপনার প্রভু আপনাকে যে কাজের নির্দেশ দিয়াছেন তাহা আঞ্জাম দিন। তিনি বলিলেন, তুমি এই কাজে আমাকে সাহায্য কর। পুত্র বলিলেন, আমি আপনাকে অবশ্যই সাহায্য করিব। ইবরাহীম (আ) বলিলেন, আল্লাহ আমাকে এখানে একখানা ঘর নির্মাণ করার নির্দেশ দিয়াছেন। এই কথা বলিয়া তিনি একটি উঁচু টিলার দিকে ইশারা করিয়া বলিলেন, ইহার চারিদিকে ঘর নির্মাণ করিতে হইবে। অতঃপর তাঁহারা এই ঘরের ভিত্তি স্থাপন করিলেন। ইসমাঈল (আ) পাথর বহিয়া আনিতেন, আর ইবরাহীম (আ) তাহা দ্বারা ভিত গাঁথিতেন। চতুর্দিকের দেয়াল অনেকটা উঁচু হইয়া গেলে ইবরাহীম (আ) এই পাথরটি আনিয়া (মাকামে ইবরাহীম) উহার উপর দাঁড়াইয়া ভিত গাঁথিতে থাকিলেন এবং ইসমাঈল (আ) পাথর আনিয়া যোগান দিতে থাকিলেন। পিতা-পুত্র উভয়ে ঘর নির্মাণকালে প্রার্থনা করিতে থাকিলেন : “হে আমাদের প্রভু! আমাদের এই প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম কবুল করুন। আপনি সব কিছু শুনেন এবং জানেন” (২ : ১২৭)। রাবী বলেন, তাঁহারা নির্মাণ কাজ করিতে থাকিলেন। তাঁহারা উভয়ে কাবা ঘরের চারিদিকে প্রদক্ষিণ করিতেছিলেন এবং বলিতেছিলেনঃ “হে আমাদের প্রভু! আমাদের এই প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা” (বুখারী, কিতাবুল আম্বিয়া, ১খ, পৃ. ৪৭৪-৬)। বুখারীর অপর বর্ণনায়ও প্রায় অনুরূপ বর্ণিত হইয়াছে।
হাজার ও ইসমাঈল (আ)কে জনমানবহীন মরু ভূমিতে রাখিয়া যাওয়ার কারণ সম্পর্কে বাইবেলে এমন তথ্য পরিবেশন করা হইয়াছে যাহাতে উভয় পূণ্যবতী মহিলার চরিত্রে কালিমা লেপন করা হয়। এদিকে হাজার (আ)-এর কথা বলা হইয়াছে যে, “সে নিজের গর্ভ হইয়াছে দেখিয়া স্বীয় মালিক সারাকে তুচ্ছ জ্ঞান করিতে লাগিল” (Genesis, 16 :4)। ইহাতে সারার প্রতি তাঁহার হিংসা সুস্পষ্ট। অপরদিকে ইসমাঈল (আ)-এর জন্মের পর সারার উক্তিতে হিংসা প্রকাশ পায় : “তুমি ঐ দাসীকে ও উহার পুত্রকে দূর করিয়া দাও; কেননা আমার পুত্র ইসহাকের সহিত ঐ দাসীপুত্র উত্তরাধিকারী হইবেনা“ (Genesis, 21 : 10)। শুধু তাহাই নহে, প্রকারান্তরে ইবরাহীম (আ)-এর উপরও এই দোষ গিয়া আপতিত হয় যে, তিনি সারার এহেন অযৌক্তিক আবদার রক্ষা করিয়া অন্যায়ের সমর্থন করেন। অনেক মুসলিম ইতিহাস ও সীরাতবিদও ইহার অনুসরণে অনেক ঘটনা লিখিয়াছেন যাহা মূলত অলীক ইসরাঈলী রিওয়ায়াত বৈ কিছুই নহে।
প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তাঁহার খলীলকে বিভিন্ন রকমের পরীক্ষায় নিপতিত করিয়াছিলেন। আর তিনি সে পরীক্ষাসমূহে সফলতার সহিত উত্তীর্ণও হইয়াছিলেন (দ্র. ২ : ১২৪)। হাজার ও ইসমাঈল (আ)-কে মক্কায় আবাসনের নির্দেশ মূলত আল্লাহই দিয়াছিলেন। সম্ভবত ইহার দুইটি উদ্দেশ্য ছিল? (১) ইবরাহীম (আ)-কে ঈমানী পরীক্ষা করা; আল্লাহর নিকট অনেক আবেদন-নিবেদনের পর বার্ধক্যে আসিয়া এক পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করিল। কিন্তু প্রাণপ্রিয় স্ত্রী ও আদরের সেই সন্তানকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে রাখিয়া আসিতে আল্লাহ তাআলা তাঁহাকে নির্দেশ দিলেন। এই নির্দেশ পালন করা যে কত কঠিন ছিল তাহা সহজেই অনুমেয়। তাইতো তাহাদিগকে রাখিয়া আসিবার সময় একটি বারও তিনি পিছনে ফিরিয়া তাকান নাই, এমনকি হাজার-এর প্রশ্নের সময়ও না। অবশেষে যখন তিনি বুঝিতে পারিলেন যে, পাহাড়ের আড়ালের কারণে তাহারা তাহাকে দেখিতে পাইতেছে না, তখন তিনি কাবাগৃহের দিকে ফিরিয়া দুআ করিলেন। এইভাবে সফলতার সহিত এই পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হন। (২) হাজার ও ইসমাঈলকে মক্কায় আবাসন করার মাধ্যমে বায়তুল্লাহকে পুন প্রতিষ্ঠিত করা এবং ইহাকে সমস্ত বিশ্ব মুসলিমের কিবলারূপে নির্ধারণ করা। এইজন্য প্রয়োজন ছিল উহার পুনর্নির্মাণ যাহা ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আ)-এর দ্বারা তিনি করাইয়াছিলেন। আর পরবর্তীতে ইহার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজন ছিল এখানে একটি জাতির গোড়াপত্তন ও বসতি স্থাপন। উক্ত নির্দেশের মাধ্যমে ইহাই বাস্তবায়িত হইয়াছে। সুতরাং একমাত্র আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থেই তিনি তাহাদিগকে এই মরু প্রান্তরে রাখিয়া গিয়াছিলেন।
স্বীয় পুত্রকে যবেহ করার নির্দেশ
পূর্বেই বর্ণিত হইয়াছে যে, ইবরাহীম (আ) যখন তাঁহার কওমের নিকট হইতে হিজরত করেন তখন আল্লাহর নিকট তিনি একজন নেককার সন্তান প্রার্থনা করিয়াছিলেন। অতঃপর আল্লাহ তাহাকে একজন স্থিরবুদ্ধি পুত্রের সুসংবাদ দেন। আর সেই ‘স্থিরবুদ্ধি পুত্র হইলেন ইসমাঈল (আ), যিনি ইবরাহীম (আ)-এর ৮৬ বৎসর বয়সকালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনিই তাহার প্রথম সন্তান। আর ইসহাক (আ)-এর জন্মের সময় ইবরাহীম (আ)-এর বয়স ছির ৯৯ বৎসর (ইবন কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ৪খ, ১৪)। ইহাতে কাহারও কোন দ্বিমত নাই। অতঃপর ইসমাঈল (আ) যখন বয়ঃপ্রাপ্ত হইলেন, ইবন আব্বাস (রা)-এর বর্ণনামতে পিতার ন্যায় নিজের কাজসমূহ নিজেই আঞ্জাম দিতে সক্ষম হইলেন, তখন ইবরাহীম (আ)-কে স্বপ্নে দেখানো হইল ইসমাঈলকে যবাহ করিতে। হাদীছে বর্ণিত আছে, নবীগণের স্বপ্নও ওহীর অন্তর্ভুক্ত (ইবন কাছীর, আল-বিদায়া, ১২, ১৫৭)।
কাহারও মতে ইসমাঈল (আ)-এর বয়স হইয়াছিল তখন ১৩ বৎসর, আর কাহারও মতে ৭ বৎসর (ছানাউল্লাহ পানীপতি, আত-তাফসীরুল মাযহারী, ৮, ১২৮; ইমাদ যুহায়র হাফিজ, আল কাসাসুল-কুরআনী, পৃ. ১০৫)। ইহা ছিল ইবরাহীম (আ)-এর জন্য কঠিন এক পরীক্ষা। বার্ধক্যে প্রাপ্ত অতি কামনার ধন স্নেহ ও আদরের দুলালকে একবার তো জনমানবহীন মরু প্রান্তরে নির্বাসন দিতে হইয়াছে। তাহাতেও সান্তনা ছিল যে, মাঝেমধ্যে তাঁহাকে দেখিয়া যাইতে পারিতেন। কিন্তু এইবার যে একেবারে বাহ্ করার নির্দেশ, তাহাও আবার স্বহস্তে। আর কোন দিন সেই মুখ আর দেখা যাইবে না। কিন্তু এই পরীক্ষায়ও তিনি সফলতার সহিত উত্তীর্ণ হন। সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ পালনের জন্য তিনি প্রস্তুত হইয়া গেলেন এবং স্বীয় পুত্রের নিকট বিষয়টি উপস্থাপন করিলেন যাহাতে প্রফুল্ল চিত্তে সে রাজী হইয়া যায় এবং জোর-যবরদস্তি করিয়া যবাহ্ করিতে না হয়। ইহার বিবরণ কুরআন কারীমে এইভাবে প্রদত্ত হইয়াছে :
“অতঃপর আমি তাহাকে (ইবরাহীমকে) এক স্থিরবুদ্ধি পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। অতঃপর সে যখন তাহার পিতার সঙ্গে কাজ করিবার মত বয়সে উপনীত হইল তখন ইবরাহীম বলিল, বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, আমি তোমাকে যবাহ করিতেছি, এখন তোমার অভিমত কি বল” (৩৭ ১০১-১০২)।
পুত্র ইসমাঈল এই কথার সঙ্গে সঙ্গে নির্দিধায় ও সোৎসাহে উত্তর দিলেন:
“সে বলিল, হে আমার পিতা! আপনি যাহা আদিষ্ট হইয়াছেন তাহাই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাইবেন” (৩৭ : ১০২)।
কোন কোন ইতিহাসবিদের বর্ণনামতে ইবরাহীম (আ) প্রথমেই যবাহের কথাটি প্রকাশ করেন নাই, বরং যবাহের স্থানে (মিনা) পৌঁছিয়া তাহাকে এই কথা জানান এবং ইসমাঈল (আ) তখন উক্ত উত্তর দেন। প্রথমে তাঁহাকে কাষ্ঠ সংগ্রহ করার কথা বলা হইয়াছিল (তাবারী, তারীখ, ১খ., ১৪০-১৪১)।
কোন কোন রিওয়ায়াত হইতে জানা যায় যে, ইবরাহীম (আ) যাহাতে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হইতে পারেন সেইজন্য শয়তান আপ্রাণ চেষ্টা করে। আবু হুরায়রা (রা) কাব আল-আহবার (রা) হইতে রিওয়ায়াত করেন যে, এই সময় অর্থাৎ তাঁহারা রওয়ানা হইলে শয়তান একজন মানুষের আকৃতি ধারণ করিয়া ইসমাঈলের মাতার নিকট গিয়া বলে, তুমি কি জান, ইবরাহীম তোমার পুত্রকে কোথায় লইয়া যাইতেছে? তিনি বলিলেন, তাহাকে ঐ ঘাটিতে কাষ্ঠ সগ্রহের জন্য লইয়া যাইতেছে। সে বলিল, না, আল্লাহর কসম! তাহাকে যবাহ করিতে লইয়া যাইতেছে। তিনি বলিলেন, কখনও না । সে তাহার প্রতি আমার চাইতে বেশি দয়াশীল এবং বেশি মহব্বত করে। শয়তান বলিল, সে নাকি মনে করে যে, আল্লাহ তাহাকে উহা করিতে নির্দেশ দিয়াছেন। তিনি বলিলেন, আল্লাহ যদি তাঁহাকে সে আদেশ দিয়াই থাকেন তবে তাঁহার প্রতিপালকের আনুগত্য করাতে এবং তাঁহার আদেশ শিরোধার্য করিয়া ভালই করিয়াছেন। শয়তান এখানে বিফল হইয়া দ্রুত তাঁহার পুত্রের নিকট চলিয়া গেল। অতঃপর তাঁহাকে পিতার পেছনে চলিতে দেখিল। সে নিকটে গিয়া বলিল, হে বালক! তুমি কি জান, তোমার পিতা তোমাকে কোথায় লইয়া যাইতেছে? ইসমাঈল (আ) বলিলেন, ঐ ঘাটি হইতে আমরা আমাদের পরিবারের জন্য কাষ্ঠ সংগ্রহ করিব। সে বলিল, আল্লাহর কসম! সে তোমাকে যবাহ করিতে লইয়া যাইতেছে। তিনি বলিলেন, কেন? শয়তান বলিল, সে মনে করে যে, আল্লাহ তাহাকে ঐরূপ নির্দেশ দিয়াছেন। তিনি বলিলেন, তবে তিনি যে বিষয়ে নির্দেশিত হইয়াছেন তাহা পালন করুন। আমি আল্লাহর নির্দেশ শুনিব ও মান্য করিব। এখানেই বিফল হইয়া শয়তান ইবরাহীম (আ)-এর নিকট গিয়া বলিল, শায়খ! কোথায় যাইতেছ? ইবরাহীম (আ) বলিলেন, ঐ ঘাটিতে আমার প্রয়োজনে যাইতেছি। সে বলিল, আল্লাহর কসম! আমি শয়তানকে দেখিয়াছি সে তোমার নিকট আসিয়া তোমার পুত্রকে যবাহ করিতে নির্দেশ দিয়াছে । ইবরাহীম (আ) তাহাকে চিনিতে পারিলেন । তিরস্কার করিয়া বলিলেন, আমার নিকট হইতে দূর হ, হে অভিশপ্ত! আল্লাহর কসম! আমি আমার প্রতিপালকের হুকুম তামীল করিবই। অতঃপর শয়তান ব্যর্থ হইয়া রাগান্বিত অবস্থায় ফিরিয়া আসিল, তাঁহাদের কোন অনিষ্ট করিতে পারিল না। আল্লাহর মদদ ও সাহায্যে তাঁহারা শয়তান হইতে নিরাপদ রহিলেন (আত-তাবারী, তারীখ, ১৩, ১৪০-১৪১; আছ-ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ১০১)।
ইবন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত আছে যে, ইবরাহীম (আ)-কে যখন এই আদেশ দেওয়া হইল তখন আল মাশআরুল-হারামে ইবলীস তাহার নিকট পৌঁছে। তিনি দ্রুত তাহাকে পিছনে ফেলিয়া সম্মুখে চলিয়া যান। তিনি আল-জামরাতুল আকাবার নিকট গেলে ইবলীস তাঁহার নিকট হাজির হয়। তিনি ইবলীসকে ৭টি কঙ্কর নিক্ষেপ করিলে সে চলিয়া যায়। জামরাতুল উসতার নিকট আবার সে ইবরাহীম (আ)-এর নিকট হাজির হয়। ইবরাহীম (আ) এখানেও তাহাকে ৭টি কঙ্কর নিক্ষেপ করেন, ফলে সে চলিয়া যায়। অতঃপর আবার সে আল-জামরাতুল-কুবরায় তাহার নিকট আগমন করে। এবারও তিনি তাহার প্রতি সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করেন। ফলে সে চলিয়া যায় এবং ইবরাহীম (আ) আল্লাহর নির্দেশ পালন করেন (আছ-ছালাবী, প্রাগুক্ত)।
অতঃপর পর্বত ঘাটিতে যবাহ-এর জন্য পিতাপুত্র উভয়েই সস্তষ্ট চিত্তে প্রস্তুত হইলেন এবং ইসমাঈলকে কাত করিয়া, আর কাহারো মতে উপুড় করিয়া শোয়াইলেন। ইব্ন আব্বাস (রা) বলেন, তাঁহাকে কাত করিয়া শোয়াইয়া কাঁধের দিক হইতে যবাহ করিতে উদ্যত হন এইজন্য যাহাতে যবাহ-এর সময় তাহার মুখের দিকে দৃষ্টি না পড়ে। কাহারও মতে অন্যান্য প্রাণী যবাহ্-এর ন্যায় চীৎ করিয়াই শোয়াইয়াছিলেন কিন্তু মাথাটি ঘুরাইয়া কাত করিয়া দিয়াছিলেন। ইব্ন ইসহাকের বর্ণনামতে ইসমাঈল (আ) পিতাকে বলিয়াছিলেন, হে পিতা! আমাকে যবাহ করার সময় শক্ত করিয়া বাঁধিবেন যাহাতে আমার হইতে আপনার শরীরে কিছু না লাগে। তাহা হইলে আমার ছওয়াব ও পুরস্কার কম হইয়া যাইবে। কারণ মৃত্যু খুবই কঠিন। আমি ছটফট করিতে পারি। আর আপনার ছুরি ভালমত ধারালো করুন যাহাতে উহা ভালোমত চালাইয়া আমার কষ্ট লাঘব করিতে পারেন। আর আমাকে কাত করিয়া শায়িত করাইবেন এবং আমার মুখমণ্ডল নীচের দিকে রাখিবেন, পার্শ্বদেশে শয়ন করাইবেন না। কারণ আমার আশঙ্কা হয় যে, আমার মুখমণ্ডলে আপনার দৃষ্টি পড়িলে আপনার অন্তর বিগলিত হইয়া যাইবে, ফলে উহা আল্লাহর নির্দেশ পালনে অন্তরায় হইয়া দাঁড়াইবে। আর আপনি যদি ভাল মনে করেন যে, আমার জামাটি আমার মাতার নিকট ফেরৎ দিলে ইহা তাহার জন্য সান্ত্বনাস্বরূপ হইবে তাহা হইলে দিবেন। তখন ইবরাহীম (আ) তাঁহাকে বলিলেন, বৎস! আল্লাহর নির্দেশ পালনে তুমি কতইনা ভাল সাহায্যকারী! অতঃপর ইসমাঈল (আ) যেভাবে বলিয়াছিলেন, সেইভাবেই তিনি তাঁহাকে শক্ত করিয়া বাঁধিলেন, ছুরি ধারালো করিলেন। অতঃপর কাত করিয়া শয়ন করাইলেন এবং তাঁহার মুখমণ্ডল হইতে দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরাইয়া রাখিলেন। অতঃপর আল্লাহর নাম লইলেন এবং তিনি আল্লাহু আকবার বলিয়া তাহার কণ্ঠদেশে ছুরি চালনা করিলেন। ইসমাঈলও তাশাহহুদ [ ] পড়িয়া মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হইয়াছিলেন, কিন্তু আল্লাহ তাঁহার হাতের মধ্যেই ছুরি উল্টাইয়া দিয়াছিলেন। ইবরাহীম (আ) যথাসাধ্য চেষ্টা করিলেন, কিন্তু আল্লাহর নির্দেশে ছুরি একটুও কাটিল না। এক বর্ণনামতে ছুরি ও গলার মধ্যখানে আল্লাহ ধুম্রজালের একটি আবরণ সৃষ্টি করিয়া দিয়াছিলেন। অতঃপর আল্লাহর পক্ষ হইতে ঘোষণা আসিল, যাহা কুরআন কারীমে এইভাবে উল্লিখিত হইয়াছে :
“তখন আমি তাহাকে আহবান করিয়া বলিলাম, হে ইবরাহীম! তুমি তো স্বপ্নদেশ সত্যই পালন করিলে! এইভাবেই আমি সৎকর্মপরায়ণদিগকে পুরস্কৃত করিয়া থাকি। নিশ্চয়ই ইহা ছিল এক স্পষ্ট পরীক্ষা” (৩৭ : ১০৪-১০৬)।
অতঃপর আল্লাহ তাআলা বিরাট এক দুম্বা প্রেরণ করিয়া তাহাই যবাহ করার নির্দেশ দিলেন। কুরআন কারীমে ইরশাদ হইয়াছে: ” আমি তাহাকে মুক্ত করিলাম বিরাট এক কুরবানীর বিনিময়ে” (৩৭ :১০৭)।
জমহূর আলিমদের মতে উহা ছিল সাদা রংয়ের, ডাগর কালো চোখ ও জোড়া বিশিষ্ট একটি দুম্বা, যাহা ইবরাহীম (আ) একটি পেরেক দ্বারা ছাবীর পর্বতের পাদদেশে বাঁধা অবস্থায় পাইয়াছিলেন (ইব্ন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১৩, ১৫৮)। ইবন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত যে, তাঁহার নিকট অবতরণ করানো হয় একটি ডাগর কালো চোখ, জোড়া বিশিষ্ট দুম্বা যাহা ডাকিতেছিল। ইহা ছিল সেই দুম্বা, যাহা আদম (আ)-এর পুত্র হাবীল কুরবানী হিসাবে পেশ করিয়াছিলেন এবং তাহা কবুল হইয়াছিল । ছাওরী (র) ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, দুটি জান্নাতে চল্লিশ (মতান্তরে ৭০) বৎসর যাবত চরিয়া বেড়াইয়াছিল। অতঃপর ছাবীর পর্বতে উহা অবতরণ করানো হয় (ইবন কাছীর, প্রাগুক্ত; আছ-ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ১০০)।
মুজাহিদের বর্ণনামতে তিনি উহা মিনায় যবাহ করেন। উবায়দ ইবন উমায়রের বর্ণনামতে মাকামে ইবরাহীমে । উক্ত দুম্বার শিং মাকামে ইবরাহীমে লটকানো ছিল বলিয়া জানা যায়। ইমাম আহমাদ (র) সাফিয়্যা বিনত শায়বা সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (স) মক্কা বিজয়ের পর কাবা শরীফের তত্ত্বাবধায়ক ও চাবিরক্ষক উছমান ইবন তালহা (রা)-কে ডাকিয়া বলিয়াছিলেন, আমি যখন বায়তুল্লাহ শরীফে প্রবেশ করিয়াছিলাম তখন উহাতে দুইটি শিং দেখিয়াছিলাম। কিন্তু তোমাকে উহা ঢাকিয়া দেওয়ার নির্দেশ দিতে ভুলিয়া গিয়াছিলাম। তাই এখন উহা ঢাকিয়া দাও। কারণ বায়তুল্লাহতে এমন কিছু থাকা সমীচীন নহে যাহা মুসল্লীর সালাতে বিঘ্ন ঘটায়। সুফইয়ান (র) বলেন, দুম্বার দুইটি শিং সর্বদাই বায়তুল্লাহ-এ লটকানো ছিল। অতঃপর বায়তুল্লাহ–এ আগুন লাগিলে উহাও পুড়িয়া যায়। ইহাতে প্রমাণিত হয় যে, ইসমাঈল (আ) যবীহ ছিলেন. ইসহাক (আ) নহে। কারণ তিনি বাল্যকালে কখনও মক্কায় আসেন নাই (ইবন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১খ, ১৫৮)। ইবন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত আছে যে, উক্ত দুম্বার খুলি সর্বদাই মীযাব- এর নিকট লটকানো ছিল (প্রাগুক্ত)।
ইবরাহীম (আ)-এর পুনঃ আগমন ও বায়তুল্লাহ নির্মাণ
পূর্বে বর্ণিত আগমনের বেশ কিছু দিন অতিবাহিত হইবার পর ইবরাহীম (আ) পুনরায় (মক্কায়) আগমন করিলেন। ইসমাঈল তখন যমযমের নিকটেই একটি গাছের নীচে তীর ঠিক করিতেছিলেন। পিতাকে দেখিয়াই তিনি তাঁহার নিকট গেলেন এবং দীর্ঘদিন পর সাক্ষাত হইলে পিতা পুত্রের সহিতও পুত্র পিতার সহিত যেমন করে তেমনই করিলেন (অর্থাৎ উভয়ে উভয়কে জড়াইয়া ধরিলেন এবং কোলাকুলি করিলেন)। অতঃপর তিনি বলিলেন, ইসমাঈল! আল্লাহ আমাকে একটি কাজের নির্দেশ দিয়াছেন। তিনি বলিলেন, আপনার প্রতিপালক আপনাকে যেই নির্দেশ দিয়াছেন তাহা পালন করুন। ইবরাহীম (আ) বলিলেন, তুমি কি আমাকে সাহায্য করিবে? তিনি বলিলেন, আমি আপনাকে সাহায্য করিব। এক বর্ণনামতে ইবরাহীম (আ) বলিয়াছিলেন, আল্লাহ তোমাকে নির্দেশ দিয়াছেন আমাকে উক্ত কাজে সাহায্য করিতে। ইসমাঈল উত্তর দিয়াছিলেন, তাহা হইলে অবশ্যই আমি তাহা করিব (তাবারী, তারীখ, ১খ, ১৩৩)। ইবরাহীম (আ) বলিলেন, আল্লাহ আমাকে ঐখানে একটি গৃহ নির্মাণের নির্দেশ দিয়াছেন। এই বলিয়া তিনি ইশারায় পার্শ্ববর্তী একটি উঁচু টিলা দেখাইয়া দিলেন। ইবন আব্বাস (রা) বলেন, এই সময়ে তাঁহারা উভয়ে মিলিয়া বায়তুল্লাহর ভিত্তি স্থাপন করিলেন ইসমাঈল (আ) পাথর আনিয়া দিতেছিলেন, আর ইবরাহীম (আ) উহা দ্বারা ভিত তৈরি করিতেছিলেন। এইভাবে ভিত উঁচু হইয়া গেলে ইসমাঈল এই পাথরটি (মাকামে ইবরাহীম) লইয়া আসিলেন। অতঃপর উহা তাহার জন্য রাখিলেন। ইবরাহীম (আ) উহার উপর দাঁড়াইয়া বায়তুল্লাহ নির্মাণ করিতেছিলেন। আর ইসমাঈল পাথর আনিয়া দিতেছিলেন। এই সময় তাঁহারা বলিতেছিলেনঃ
“হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের এই কাজ গ্রহণ কর, নিশ্চয় তুমি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা (২ : ১২৭)।
ইব্ন আব্বাস (বা) বলেন, তাঁহারা উহা নির্মাণ করিতে করিতে বায়তুল্লাহর চতুষ্পর্শ্বে চক্কর দেন আর বলেন :
(আল-বুখারী, আস-সাহীহ, কিতাবুল-আম্বিয়া, ৪খ, ৬০২)।
এক বর্ণনামতে তিনি ভিত্তি নির্মাণ করিয়া যখন রুকনে য়ামানীর কাছে পৌঁছিলেন তখন ইবরাহীম (আ) ইসমাঈলকে একটি সুন্দর পাথর আনিতে নির্দেশ দেন এবং বলেন, আমি রুকনের উপর উহা স্থাপন করিব যাহা বিশ্ববাসীর জন্য একটি প্রতীক হইয়া থাকিবে। ইসমাঈল (আ) একটি পাথর আনিলে ইবরাহীম (আ) ইহা পছন্দ করিলেন না। বলিলেন, অন্য একটি লইয়া আইস । ইসমাঈল (আ) পাথরের সন্ধানে গেলেন। ফিরিয়া আসিয়া দেখিলেন, সেখানে পাথর স্থাপন করা হইয়াছে। জিজ্ঞাসা করিলেন, পিতা! কে এই পাথর আনিয়া দিল? তিনি বলিলেন, যিনি তোমার উপর নির্ভর করেন নাই। জিবরাঈল উহা আকাশ হইতে লইয়া আসিয়াছেন (তাবারী, তারীখ, ১খ., ১২৯)। এক বর্ণনামতে নূহ (আ)-এর প্লাবনের সময় আল্লাহ কাবাকে আকাশে উঠাইয়া লন এবং হাজারে আসওয়াদকে আবু কুবায়স পর্বতে উঠাইয়া রাখেন। অতঃপর ইবরাহীম (আ)-এর নির্মাণের সময় যখন তিনি ইসমাঈল (আ)-কে সুন্দর পাথর আনিতে নির্দেশ দেন যাহা বিশ্ববাসীর জন্য প্রতীক হইবে তখন আবু কুবায়স পর্বত হইতে ডাক আসে যে, আমার নিকট তোমার একটি আমানত আছে। এই সেই আমানত, গ্রহণ কর। এই বলিয়া আবু কুবায়স পর্বত হাজারে আসওয়াদকে ইবরাহীম (আ)-এর নিকট সোপর্দ করে। অতঃপর ইবরাহীম (আ) উহা যথাস্থানে স্থাপন করেন (আছ-ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৯২-৯৩)।
ইবন আব্বাস (রা) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (স) বলিয়াছেন, “হাজারে আসওয়াদ জান্নাতের পাথর। ইহা বরফের চাইতেও অধিক সাদা ছিল। কিন্তু পাপীদের পাপ উহাকে কালো বানাইয়া ফেলিয়াছে” (আহমাদ ইবন হাম্বাল, মুসনাদ, ৫খ., ১৯, হাদীছ নং ৩০৪৭)।
ইবরাহীম (আ) বায়তুল্লাহ কোথায় নির্মাণ করিবেন আল্লাহ তাহা জানাইয়া দেন। কুরআন কারীমে ইরশাদ হইয়াছে :
“এবং স্মরণ কর, আমি ইবরাহীমের জন্য নির্ধারণ করিয়া দিয়াছিলাম, সেই গৃহের স্থান” (২২ : ২৬)।
তবে কিভাবে তিনি তাহা নির্ধারণ করিয়া দিয়াছিলেন। সেই ব্যাপারে বিভিন্ন রকমের বর্ণনা পাওয়া যায় যাহার অধিকাংশই অলীক ইসরাঈলী রিওয়ায়াত। এক বর্ণনামতে আল্লাহ তাআলা জিবরীল (আ)–কে প্রেরণ করেন। তিনি আসিয়া ইবরাহীম (আ)-কে উহার স্থান দেখাইয়াদেন (আত-তাবারী, তারীখ, ১খ., ১২৯)। ইমাম বাগাবীর বর্ণনামতে আল্লাহ প্রচণ্ড বায়ু প্রবাহিত করেন। ফলে কাবার ভিত্তিমূলের আশপাশের অংশ নিচু হইয়া যায় এবং কাবার ভিতটুকু উঁচু থাকে। ইবরাহীম (আ) সেই উঁচু স্থানে কাবা নির্মাণ করেন (ছানাউল্লাহ পানিপতি, আত-তাফসীরুল মাযহারী, ৬খ., ২৭৪)। ইবন জারীর, ইবন আবী হাতিম, বায়হাকী প্রমুখ সুদ্দী হইতে বর্ণনা করিয়াছেন যে, তিনি একটি বায়ু প্রেরণ করেন যাহার নাম খাজুজ। উহার দুইটি ডানা ও একটি মস্তক ছিল। তাহা সর্পের আকৃতিবিশিষ্ট। উক্ত বায়ু প্রথম বায়তুল্লাহর ভিত্তিস্থলের চতুম্পার্শ্বের সব কিছু নীচু করিয়া দেয়। অতঃপর তাহারা দুইজন সেই উঁচু স্থানে কাবা নির্মাণ করেন (প্রাগুক্ত; ইবন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ., ১৬৫)।
বায়তুল্লাহর ভিত্তি পূর্ব হইতেই ছিল, না ইবরাহীম (আ) প্রথম উহার ভিত্তি স্থাপন করেন। এই ব্যাপারে দুইটি মত পাওয়া যায়। একটি মত হইল, পূর্ব হইতেই উহা ছিল । সর্বপ্রথম আদম (আ) উহা নির্মাণ করেন। তিনি সেখানে একটি গম্বুজের মত প্রতিষ্ঠিত করেন। ফেরেশতাগণ তাহাকে বলিয়াছিলেন, আপনার পূর্বে আমরা এই গৃহ তাওয়াফ করিয়াছি। নূহ (আ)-এর নৌকাও চল্লিশ দিন যাবত ইহার তাওয়াফ করিয়াছে। তবে এ সবই ইসরাঈলী বর্ণনা যাহার সম্পর্কে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মত হইল, ইহার সত্যায়নও করা যাইবে না, মিথ্যা বলিয়া সাব্যস্তও করা যাইবে না, (ইবন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ., ১৬৩)। অপর এক বর্ণনা পাওয়ায় যে, আল্লাহ তাআলার নির্দেশে ফেরেশতাগণ জান্নাত হইতে একটি তাঁবু লইয়া সেখানে স্থাপন করেন হযরত আদম (আ)-এর ইবাদতের জন্য। অতঃপর তাঁহার পুত্র শীছ (আ) মাটি ও প্রস্তর দ্বারা সেখানে কাবা নির্মাণ করেন (ইব্ন কুতায়বা, আল-মাআরিফ, পৃ. ১২, শীছ শিরো.)। অতঃপর নূহ (আ)-এর প্লবনের সময় ইহা আকাশে উঠাইয়া লওয়া হয় এবং ইবরাহীম (আ)-কে পুনরায় উহা নির্মাণের নির্দেশ দেওয়া হয়। তাই ইবরাহীম (আ) উহার পুনঃনির্মাণ করেন।
বিশুদ্ধতম মতটি হইল ইবরাহীম (আ)-ই কাবা শরীফ প্রথম নির্মাণ করেন। তাঁহার পূর্বে এখানে কাবাগৃহ ছিল না। কারণ কোন সহীহ হাদীছে পাওয়া যায় না যে, পূর্বে এখানে কাবা ছিল । যাহা কিছু পাওয়া যায় তাহা ইসরাঈলী রিওয়ায়াত যাহার গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে পূর্বেই উল্লেখ করা হইয়াছে। হাফিজ ইবন কাছীরও এই মতটি সমর্থন করিয়াছেন। তিনি বর্ণনা করিয়াছেন, কাবা শরীফ আকাশে অবস্থিত বায়তুল মামূরের ঠিক সোজা নীচে অবস্থিত, এমনকি যদি উহা নিম্নে পতিত হয় তবে কাবা গৃহের উপরই পতিত হইবে। তেমনিভাবে উহা সাত আসমানের ইবাদত গৃহের সোজা নিচে। যেমন সালাফদের কেহ কেহ বলেন, প্রত্যেক আসমানেই একটি করিয়া ইবাদত গৃহ আছে। সেখানে সেই আসমানবাসী আল্লাহ্ ইবাদত করিয়া থাকে। বিশ্ববাসীদের জন্য যেরূপ কাবা গৃহ, আসমানবাসীদের জন্যও উক্ত গৃহ সেইরূপ। অতঃপর আল্লাহ ইবরাহীম (আ)-কে তাহার একটি গৃহ বানাইবার নির্দেশ দিলেন যাহা বিশ্ববাসীর জন্য সেই পর্যায়ের হইবে। আকাশের ফেরেশতাদের জন্য যেমন ঐ সকল ইবাদাত গৃহ এবং আল্লাহ তাঁহাকে উহার জন্য পূর্ব হইতেই নির্ধারণ করিয়া রাখা স্থান নির্দেশ করেন (ইব্ন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ., ১৬৩; ড. সালাহ আল-খালিদী, আল-কাসাসুল কুরআনী, ১খ., ৪০৭-৪০৯; ইমাদ যুহায়র হাফিজ, আল-কাসাসুল কুরআনী, পৃ. ১১৮-১১৯)।
যে পাথরের উপর দাঁড়াইয়া ইবরাহীম (আ) বায়তুল্লাহ নির্মাণ করেন তাহা প্রাচীন কাল হইতেই কাবা শরীফের দেওয়ালের সহিত সংলগ্ন অবস্থায় ছিল। উমর (রা)-এর সময়কালে তিনি উহা বায়তুল্লাহ হইতে কিছুটা (পূর্বে) সরাইয়া দেন, যাহাতে বায়তুল্লাহর তাওয়াফকারীদের দ্বারা উহার নিকট দাঁড়াইয়া সালাতরত ব্যক্তিদের সালাতে কোনরূপ অসুবিধা না হয়। উক্ত পাথরে সুস্পষ্টরূপে ইবরাহীম (আ)-এর পায়ের ছাপ পড়িয়া যায়। ইসলামের প্রথম যুগেও উক্ত ছাপ সুস্পষ্টরূপে বিদ্যমান ছিল এবং মানুষের মনে রেখাপাত করিত। যেমন আবু তালিবের একটি কবিতায় উক্ত হইয়াছে :
“পাথরে ইবরাহীমের জুতাবিহীন নগ্ন পায়ের চিহ্ন” (ইবন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ., ১৬৪)। উল্লেখ্য যে, অদ্যাবধি উক্ত চিহ্ন সুস্পষ্ট রহিয়াছে।
এই কাবা গৃহই ইবাদতের জন্য নির্মিত বিশ্বের সর্বপ্রথম গৃহ। আল্লাহ ইহাকে বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারী বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। এখানে যেই প্রবেশ করুন না কেন আল্লাহ তাহার নিরাপত্তার ঘোষণা দিয়াছেন এবং সেখানে যাওয়ার সামর্থ্যবানদের জন্য এই গৃহকে কেন্দ্র করিয়া হজ্জ সম্পন্ন করা ফরয করিয়া দিয়াছেন। কুরআন কারীমে ইরশাদ হইয়াছে ।
“মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল তাহা তো বাক্কায়; উহা বরকতময় ও বিশ্ব জগতের দিশারী। উহাতে অনেক সুস্পষ্ট নিদর্শন আছে, যেমন মাকামে ইবরাহীম এবং যে কেহ সেথায় প্রবেশ করে সে নিরাপদ। মানুষের মধ্যে যাহার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঐ গৃহের হজ্জ করা তাহার অবশ্য কত” (৩ : ৯৬-৯৭)।
এই ঘরকে আল্লাহ তাআলা মানবজাতির মিলন কেন্দ্র ও নিরাপত্তাস্থল করিয়াছেন। এখানে অবস্থিত মাকামে ইবরাহীমকে সালাতের স্থান বানাইবার নির্দেশ দিয়াছেন ইহার তাওয়াফকারী, ইহাতে ইতিকাফকারী, রুকু ও সিজদাকারীদের জন্য। তাই কুরআন কারীমে ইরশাদ হইয়াছে ।
“এবং সেই সময়কে স্মরণ কর, যখন কাবা গৃহকে মানবজাতির মিলন কেন্দ্র ও নিরাপত্তাস্থল করিয়াছিলাম এবং বলিয়াছিলাম, তোমরা ইবরাহীমের দাঁড়াইবার স্থানকেই সালাতের স্থানরূপে গ্রহণ কর এবং ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী, রুকু ও সিজদাকারীদের জন্য আমার গৃহকে পবিত্র রাখিতে আদেশ দিয়াছিলাম” (২: ১২৫)।
হজ্জের ঘোষণা
কাবা গৃহের নির্মাণকর্ম সমাপ্ত হওয়ার পর আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম (আ)-কে হজ্জের ঘোষণা দেওয়ার নির্দেশ দেন। কুরআন কারীমে ইরশাদ হইয়াছে :
“এবং মানুষের নিকট হজ্জের ঘোষণা করিয়া দাও। উহারা তোমার নিকট আসিবে পদব্রজে ও সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উষ্ট্রসমূহের পিঠে, ইহারা আসিবে দূর-দূরান্ত পথ অতিক্রম করিয়া যাহাতে তাহারা তাহাদের কল্যাণময় স্থানগুলিতে উপস্থিত হইতে পারে এবং তিনি তাহাদিগকে চতুষ্পদ জন্তু হইতে যাহা রিযক হিসাবে দান করিয়াছেন উহার উপর নির্দিষ্ট দিনগুলিতে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করিতে পারে। অতঃপর তোমরা উহা হইতে আহার কর এবং দুস্থ ও অভাবগ্রস্তকে আহার করাও” (২২ : ২৭-২৮)।
বর্ণিত আছে যে, ইবরাহীম (আ)-কে যখন হজ্জের ঘোষণা দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হইল তখন তিনি বলিলেন, হে আমার প্রতিপালক! এই ঘোষণা আমি কিভাবে মানুষের নিকট পৌঁছাইব, আমার আওয়ায তো তাহাদের পর্যন্ত যাইবে না? আল্লাহ তাআলা বলিলেন, তুমি ঘোষণা দাও, পৌঁছাইবার দায়িত্ব আমার। অতঃপর তিনি মাকামে ইবরাহীমে দাঁড়াইয়া গেলেন। এক বর্ণনামতে তিনি পাথরের উপর দাঁড়াইয়াছিলেন, অপর এক বর্ণনাতে সাফা পর্বতে, ভিন্নমতে আবু কুবায়স পর্বতে দাঁড়াইয়া বলিলেন, “হে লোকসকল! তোমাদের প্রতিপালক একটি গৃহ নির্মাণ করিয়াছেন; তোমরা উহার হজ্জ কর।” বর্ণিত আছে যে, এই ঘোষণার সময় পাহাড়সমূহ নীচু হইয়া যায়, বিশ্বের সর্বত্র তাঁহার আওয়ায পৌঁছিয়া যায় এবং মাতৃগর্ভে ও পিতৃ ঔরসে যাহারা রহিয়াছে সকলেই উহা শুনিতে পায়। পাথর, কাঁচা-পাকা ঘরবাড়ী, গাছপালা ও কিয়ামত পর্যন্ত যাহাদের তাকদীরে আল্লাহ তাআলা হাজ্জ লিখিয়াছেন- তাহারা সকলেই উহা শুনিয়াছে এবং উহার উত্তর দিয়াছে। এইজন্য হজ্জ আদায়কারী বলিয়া থাকে, এL)- এ “আমি হাজির হে আল্লাহ! আমি হাজির” (ইবন কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ৩খ, ২১৬)। ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আ) নিজেদের হাজ্জ সমাপনের নিয়ম-কানুন জানাইয়া দেওয়ার জন্য আল্লাহর নিকট দুআ করেন এবং ভুল-ত্রুটি হইতে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তাঁহাদিগকে পূর্ণ অনুগত করার জন্যও দুআ করেন। ইরশাদ হইয়াছে :
“হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের উভয়কে তোমার একান্ত অনুগত কর এবং আমাদের বংশধর হইতে তোমার এক অনুগত উম্মত করিও। আমাদিগকে ইবাদতের (অর্থাৎ হজ্জের) নিয়ম-কানুন দেখাইয়া দাও এবং আমাদের প্রতি ক্ষমাশীল হও। তুমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু” (২: ১২৮)।
তাঁহারা আরো দুআ করিয়াছেন যে, তাঁহাদের বংশধরদের মধ্যে যেন আল্লাহ একজন মহান রাসূল প্রেরণ করেন, যিনি উম্মাতকে হিদায়াত করিবেন। কুরআন কারীমে ইরশাদ হইয়াছে :
“হে আমাদের প্রতিপালক! তাহাদের মধ্য হইতে তাহাদের নিকট এক রাসূল প্রেরণ করিও যে তোমার আয়াতসমূহ তাহাদের নিকট তিলাওয়াত করিবে, তাহাদিগকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবে এবং তাহাদিগকে পবিত্র করিবে। তুমি তো পরাক্রমশীল, প্রজ্ঞাময়” (২: ১২৯)।
আল্লাহ তাআলা তাঁহাদের এই দুআ কবুল করিয়াছিলেন। অতঃপর ইসমাঈল (আ)-এর বংশে প্রেরণ করেন সর্বশেষ নবী হয়রত মুহাম্মাদ (স)-কে তাই রাসূলুল্লাহ (স) বলিয়াছেন, “আমি আল্লাহর নিকট রক্ষিত উম্মুল কিতাবে ‘খাতামুন নাবিয়্যীন হিসাবেই লিপিবদ্ধ ছিলাম। আর তখন আদম (আ)-এর রূহ দেহে প্রবেশ করে নাই। অতি সত্ত্বর আমি তোমাদিগকে ইহার ব্যাখ্যা দিব। আমি হইলাম আমার আদি পিতা ইবরাহীমের দুআ এবং ঈসা (আ)-এর সুসংবাদ” (আহমাদ, আল-মুসনাদ, ৪খ, ১২৭-১২৮; ডঃ সালাহ আল-খালিদী, আল-কাসাসুল-কুরআনী, ১খ, ৪০৯)।
আবু উমামা (রা) বলেন, আমি বলিলাম ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার প্রথম সৃষ্টি কিভাবে :তিনি বলিলেন, “আমি ইবরাহীমের দুআ ও ঈসার সুসংবাদ। আমার মাতা এমন আলোকচ্ছটা দেখিয়াছিলেন যাহা দ্বারা শাম-এর প্রাসাদসমূহ আলোকিত হইয়া গিয়াছিল” (আহমাদ, আল-মুসনাদ, ৫খ, ২৬২)। বায়তুল্লাহ নির্মাণের পর ইবরাহীম (আ) আরো দীর্ঘদিন জীবিত ছিলেন (আবদুল, আল-মুসনাদ, ৫খ।, ২৬২)। বায়তুল্লাহ নির্মাণের পর ইবরাহীম (আ) আরো দীর্ঘদিন জীবিত ছিলেন (আবদুল ওয়াহহাব নাজ্জার, কাসাসুল-কুরআন, পৃ. ১০৯)।
আল-মাসজিদুল আকসা নির্মাণ
বায়তুল মাকদিস-এ অবস্থিত আল-মাসজিদুল আকসাও সর্বপ্রথম হযরত ইবরাহীম (আ) নির্মাণ করেন। বায়তুল্লাহ নির্মাণের চল্লিশ বৎসর পর তিনি উহা নির্মাণ করেন। আবু যার (রা) বলেন, আমি বলিলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! পৃথিবীতে সর্বপ্রথম কোন্ মসজিদ নির্মিত হইয়াছে :তিনি বলিলেন, আল-মাসজিদুল-হারাম। আমি বলিলাম, ইহার পর? তিনি বলিলেন, আল-মাসজিদুল আকসা। আমি বলিলাম, এতদোভয়ের মধ্যে ব্যবধান কত? তিনি বলিলেন, চল্লিশ বৎসর (আল-বুখারী, আস-সাহীহ, কিতাবুল- আম্বিয়া/ বাদউল-খালক, হাদীছ নং ৩১৫০)।
খতনার সুন্নাত
আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম (আ)-এর নিকট হইতে খতনা করার অঙ্গীকার লইয়াছিলেন। হাদীছে বর্ণিত হইয়াছে যে, ইবরাহীম (আ) কাম নামক স্থানে বা কাদূম নামক অস্ত্র দ্বারা খতনা করিয়াছিলেন। তখন তাঁহার বয়স ছিল ৮০ বৎসর (বুখারী, কিতাবুল আম্বিয়া, হাদীছ নং ৩১৪০)। অন্য এক বর্ণনামতে তাঁহার ৯৯ বৎসর বয়সকালে তিনি এই সুন্নাত পালন করেন। ইসমাঈল (আ)-এর বয়স ছিল তখন ১৩ বৎসর । তখন ইবরাহীম (আ), ইসমাঈল (আ) এবং ইবরাহীম (আ)-এর যত দাস ছিল সকলেই খাতনা করেন। বারনাবাসের বাইবেলে খতনার কারণস্বরূপ বলা হইয়াছে যে, আদম (আ) যখন স্বীয় প্রভুর নাফরমানী করেন তখন মানত করেন যে, আল্লাহ তওবা কবুল করিলে তিনি শরীরের কোন একটি অঙ্গ কাটিয়া ফেলিবেন। অতঃপর তাঁহার তওবা কবুল হইলে তিনি মানত পূর্ণ করিতে চাহিলেন। কিন্তু কিভাবে তাহা করিবেন সেই ব্যাপারে পেরেশান হইয়া গেলেন। তখন জিবরীল (আ) আসিয়া উক্ত স্থানটি নির্দেশ করিলেন। অতঃপর তিনি উহা কাটিয়া ফেলিলেন। সম্ভবত তাঁহার বংশধরগণ এই সুন্নাত ত্যাগ করিয়াছিল। তাই আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম (আ)-কে উক্ত সুন্নাত জীবিত করার নির্দেশ দেন (আবদুল ওয়াহহাব আন-নাজ্জার, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৯৪)।
মৃতকে জীবিত করা স্বচক্ষে দেখার আবেদন
হযরত ইবরাহীম (আ) বাল্যকাল হইতেই অজানাকে জানিবার প্রতি কৌতূহলী ছিলেন। তাই আল্লাহ তাআলা যখন তাঁহার নিকট ওয়াহী পাঠাইলেন যে, তিনি একদিন সকল মৃতকে জীবিত করিবেন এবং সবাইকে একদিন তাহার নিকট একত্র করিবেন, অতঃপর সঙ্কর্মপরায়ণকে প্রতিদান ও পুরস্কার হিসাবে জান্নাত দান করিবেন এবং অসৎকর্মপরায়ণকে তাহার কর্মের প্রতিফল হিসাবে জাহান্নামে নিক্ষেপ করিবেন তখন তিনি মৃতকে আবার কিভাবে জীবিত করিবেন তাহা স্বচক্ষে দেখিবার কৌতূহল জাগিল তাঁহার মধ্যে। তিনি আল্লাহকে বলিলেন, 3 3 s, “হে আমার প্রতিপালক! কিভাবে তুমি মৃতকে জীবিত কর তাহা আমাকে দেখাও”। আল্লাহ বলিবেন, “তবে কি তুমি বিশ্বাস কর না”। তিনি বলিলেন, “কেন করিব না, তবে ইহা কেবল আমার চিত্ত প্রশান্তির জন্য।” তখন আল্লাহ তাহাকে উহা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করাইবার জন্য বলিলেন :
“তবে চারটি পাখী লও এবং উহাদিগকে তোমার বশীভূত করিয়া লও। তৎপর তাহাদের এক এক অংশ এক এক পাহাড়ে স্থাপন কর। অতঃপর উহাদিগকে ডাক দাও। উহারা দ্রুত গতিতে তোমার নিকট আসিবে” (২ : ২৬০)।
ইবন আব্বাস (রা)-এর বর্ণনামতে ইবরাহীম (আ) চারটি পাখী ও বক, ময়ুর, মোরগ ও কবুতর লইলেন। মুজাহিদ বকের স্থলে কাকের কথা বলিয়াছেন। কোন কোন বর্ণনায় কবুতরের স্থলে হাঁস আর কোন কোন বর্ণনায় শকুনের কথা উল্লেখ আছে। পাখীগুলিকে যবাহ করার পর উহাদের গোশত, রক্ত, লোম সবই একত্রে মিশাইয়া ফেলার নির্দেশ দেওয়া হইল। অতঃপর ইবন আব্বাস, হাসান ও কাতাদার বর্ণনামতে ঐগুলিকে চারটি পর্বতের উপর রাখিয়া আসিতে বলা হইল। কোন কোন বর্ণনামতে ৭টি, আবার কোন কোন বর্ণনা মতে ১০টি পর্বতের উপর। অতপর নির্দেশমত উক্ত কাজ সম্পন্ন করার পর ইবরাহীম (আ) ডাক দিলেনঃ হে টুকরা টুকরা হইয়া যাওয়া হাড্ডিসমূহ, বিচ্ছিন্ন হইয়া যাওয়া গোশতসমূহ এবং যোগাযোগ বন্ধ হইয়া যাওয়া শিরাসমূহ! তোমরা একত্র হও। তোমাদের মধ্যে আল্লাহ তাআলা রূহ ফিরাইয়া দিবেন । ইহা শুনিবা মাত্রই এক হাড্ডি অপর হাড়ির উপর, ঝাপাইয়া পড়িল, একটি পাখা অপর পাখার উপর উড়িয়া গিয়া পড়িল এবং এক রক্ত অন্য রক্তের সহিত মিশিয়া গিয়া প্রবাহিত হইতে লাগিল। ফলে প্রতিটি পাখির কাছে তাহার রক্ত, মাংস ও পাখা ফিরিয়া আসিল এবং সবগুলিই পূর্বের ন্যায় জীবিত হইয়া গেল (আল-আসী, রূহুল মাআনী, ৩খ, ২৮-২৯; আল-কুরতুবী, আল-জামিলি আহকামিল কুরআন, ৩৩, ৩০০-৩০১)।
ইবরাহীম (আ)-এর ইনতিকাল
হযরত ইবরাহীম (আ)-এর ইনতিকালের ব্যাপারে কুরআন ও হাদীছে কোন সুস্পষ্ট বর্ণনা পাওয়া যায় না। ইব্ন আসাকির প্রমুখ ইবরাহীম (আ)-এর নিকট মালাকুল মওত আগমনের বিবিধ বিবরণ দিয়াছেন। কিন্তু তাহার সত্যতা নিশ্চিত নহে। তন্মধ্যে একটি এই যে, মালাকুল মওত এক বৃদ্ধের আকৃতিতে তাঁহার নিকট আগমন করেন। সুদ্দী বর্ণনা করেন যে, ইবরাহীম (আ) ধনী লোক ছিলেন। তাঁহার প্রচুর খাদ্যদ্রব্য ছিল। তিনি লোকজনকে উহা দ্বারা মেহমানদারী করিতেন। একবার তিনি লোকজনকে আহার করাইতেছিলেন। তখন তিনি এক বৃদ্ধকে দেখিতে পাইলেন, যে রৌদ্রে হাঁটিয়া যাইতেছিল। তখন তিনি একটি গাধা প্রেরণ করিয়া তাহাকে আনাইলেন এবং আহার করিতে দিলেন। বৃদ্ধ তাহার মুখে আহার দিতে গিয়া একবার চোখের মধ্যে দিলেন, একবার কানের মধ্যে দিলেন। অতঃপর এক লোকমা যখন মুখে দিলেন তখন উহা পেটের মধ্য দিয়া তাহার মলদ্বার দিয়া বাহির হইয়া গেল। ইবরাহীম (আ) পূর্বে আল্লাহর নিকট দরখাস্ত করিয়া রাখিয়াছিলেন যে, তাহার রূহ যিনি কবয করিবেন তাঁহাকে তিনি মৃত্যু সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিয়া লইবেন। বৃদ্ধের এই হাল দেখিয়া তিনি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, হে বৃদ্ধ! তোমার কি অবস্থা? এইরূপ করিতেছ কেন? বৃদ্ধ বলিল, ইবরাহীম! বয়সের ভারে আমার আজ এই অবস্থা। ইবরাহীম (আ) জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমার বয়স কত? বৃদ্ধ বলিল, এত… এত….। ইবরাহীম (আ) হিসাব করিয়া দেখিলেন, বৃদ্ধের বয়স তাঁহার বয়স হইতে মাত্র দুই বৎসর বেশী। ইবরাহীম (আ) তাহাকে বলিলেন, তোমার ও আমার মধ্যে মাত্র দুই বৎসরের ব্যবধান। আমি যখন তোমার বয়সে উপনীত হইব তখন তো তোমার মতই হইয়া যাইব। বৃদ্ধ বলিল, হ্যাঁ। ইবরাহীম (আ) দুআ করিলেন, হে আল্লাহ! আমাকে তাহার পূর্বেই উঠাইয়া লউন । বৃদ্ধ তখন উঠিয়া দাঁড়াইল এবং তাঁহার জান কবয করিল। এই বৃদ্ধই ছিলেন মালাকুল মওত ৷ ইবরাহীম (আ)-এর বয়স ছিল তখন ২০০, মতান্তরে ১৯৫ ও ১৭৫ বৎসর (আত-তাবারী, তারীখ, ১খ., ১৬০-১৬১; আছ-ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ১০৪)।
কাহারও কাহারও বর্ণনামতে তিনি আকস্মিকভাবে ইনতিকাল করেন। আহলে কিতাবদের বর্ণনামতে তিনি রোগাক্রান্ত হইয়া ১৭৫, মতান্তরে ১৯৫ বৎসর বয়সে ইনতিকাল কলেন । তাঁহাকে কানআনে অবস্থিত হেবরূন নামক গ্রামের সেই স্থানে দাফন করা হয় যাহা তিনি স্বীয় স্ত্রী সারাকে কবর দেওয়ার জন্য ইফরূন আল-হায়ছী নামক এক ব্যক্তির নিকট হইতে ৪০০ মিছকালের বিনিময়ে ক্রয় করিয়াছিলেন এবং সারাকে সেখানে দাফন করিয়াছিলেন। পুত্র ইসমাঈল ও ইসহাক (আ) মিলিয়া তাঁহাকে উক্ত স্থানে সারার নিকট দাফন করেন (ইব্ন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ১৭৪)। উক্ত স্থানের নামকরণ করা হইয়াছে মাদীনাতুল-খালীল। বর্তমানেও এই নামই প্রচলিত আছে। পূর্বে ইহার নাম ছিল কারয়া আওবা [ ] (আবদুল ওয়াহহাব আন-নাজ্জার, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ১১০)। ইহা হেবরূনেরই একটি অংশ। বর্তমানে গোটা হিবরূনকেই ‘মাদীনাতুল খালীল বলা হয়। ইবনুল-কালবীর বর্ণনামতে ইবরাহীম (আ) ২০০ বৎসর জীবিত ছিলেন। আবূ হাতিম ইবন হিববান তাঁহার সাহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করিয়াছেন যে, মুফাদ্দাল ইবন মুহাম্মদ জুনদী সূত্রে আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, ইবরাহীম (আ) কাদূম নামক স্থানে (কাহারো কাহারো মতে কাদূম নামক অস্ত্রের সাহায্যে) খাতনা করেন। তখন তাঁহার বয়স হইয়াছিল ১২০ বৎসর । ইহার পর তিনি ৮০ বৎসর জীবিত ছিলেন। হাফিজ ইবন আসাকির ইহা আবু হুরায়রা (রা) হইতে মাওকুফরূপে রিওয়ায়াত করিয়াছেন (ইব্ন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ১৭৪)।
স্ত্রী ও সন্তান-সন্তুতি
হযরত ইবরাহীম (আ)-এর চার পত্নীর নাম জানা যায়, যাহাদের গর্ভে তাঁহার বহু সন্তান-সন্তুতির জন্ম হয়। প্রথম পুত্র ইসমাঈল (আ) হাজার-এর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। অতঃপর দ্বিতীয় সন্তান ইসহাক (আ) জন্মগ্রহণ করেন সারার গর্ভে। সারার মৃত্যুর পর ইবরাহীম (আ) কানআনের কানক্রা, মতান্তরে কারা বিনত আকতান (মতান্তরে আকতার) নাম্নী এক মহিলাকে বিবাহ করেন। তাহার গর্ভে ছয় পুত্রঃ মায়ান, যামরান, সারাজ, যাকশান ও বুসর জন্মগ্রহণ করে। ইহার পর ইবরাহীম (আ) হাজ্বন (মতান্তরে হাজুরা) বিন্ত আমীন (মতান্তরে উহায়ব)-কে বিবাহ করেন। তাহার গর্ভে পাঁচ পুত্র ও কায়সান, সূরাজ (মতান্তরে শামরূখ)। আমীম, লুতান ও নাফিস জন্মগ্রহণ করে। আবুল কাসিম আস-সুহায়লী তাঁহার আত-তারীফ ওয়াল-আলাম গ্রন্থে এইরূপ উল্লেখ করিয়াছেন (ইব্ন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ১৭৫; আত-তাবারী, তারীখ, ১খ., ১৫৯; আছ-ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ১০৩)।
ইসমাঈল (আ) ও ইসহাক (আ)-সহ তাঁহার মোট ১৩ পুত্রের নাম জানা যায়। ইবন কুতায়বা অবশ্য বলিয়াছেন, কাতুরার গর্ভে ৪ সন্তান এবং হাজুরার গর্ভে ৭ সন্তানের জন্ম হয়। সর্বমোট ইবরাহীম (আ)-এর ১৩ সন্তান ছিল (ইব্ন কুতায়বা, আল-মাআরিফ, পৃ. ৩৩)।
ইবরাহীম (আ) জীবিত থাকিতেই তাঁহার পুত্রদিগকে বিভিন্ন স্থানে বসতি করান। ইসমাঈল (আ)-কে মক্কায়, ইসহাক (আ)-কে শামে এবং অন্যান্য পুত্রকে বিভিন্ন দেশে আবাসন করান। তাহারা ইবরাহীম (আ)-এর নিকট আর করিল, হে পিত! আপনি ইসহাক ও ইসমাঈলকে আপনার নিকটস্থ জায়গায় বসবাস করাইলেন এবং আমাদিগকে অপরিচিত জায়গায়, দূরদেশে বসবাস করিতে বলিয়াছেন! তিনি বলিলেন, আমাকে এইরূপ নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। অতঃপর তিনি তাহাদিগকে আল্লাহর নামসমূহ হইতে একটি নাম শিক্ষা দিলেন। তাঁহারা সেই নাম লইয়াই পানি ও অন্যান্য সাহায্য প্রার্থনা করিত (আছ-ছালাবী, পৃ. ১০৪)।
পরবর্তী কালে যত নবী-রাসূল আগমন করিয়াছেন সবই হযরত ইবরাহীম (আ)-এর পুত্র ইসমাঈল (আ) ও ইসহাক (আ)-এর বংশধর হইতে। সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (স) ইসমাঈল (আ)-এর বংশধর আর অন্যান্য সকল নবী ইসহাক (আ)-এর বংশধর। ইসহাক (আ)-এর পুত্র ইয়াকূব (আ)। তাঁহার পুত্র ইউসুফ (আ) নবী ছিলেন। ইতিহাস ও তাফসীর বিশারদ ইবন জারীর তাবারী ইবরাহীম (আ)-এর অন্যান্য পুত্রের এবং তাঁহাদের বংশধরদের বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করিয়াছেন (দ্র. তাবারী, তারীখ, ১৩, ১৫৯-৬০)।
দৈহিক অবয়ব
একাধিক বর্ণনা হইতে জানা যায় যে, হযরত ইবরাহীম (আ)-এর দৈহিক গঠন ও আকৃতি ছিল হযরত রাসূলে কারীম (আ)-এর ন্যায়। ইবন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত : রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, আমি ঈসা ইবন মারয়াম, মূসা ও ইবরাহীম (আ)-কে দেখিয়াছি। ঈসা হইলেন লাল বর্ণের হাল্কা পাতলা গড়ন ও প্রশস্ত বক্ষধারী, মূসা হইলেন গৌর বর্ণের বিশাল দেহধারী। সাহাবীগণ তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ইবরাহীম (আ) কেমন ছিলেন? তিনি বলিলেন, তোমাদের সঙ্গীর (অর্থাৎ তাঁহার নিজের) প্রতি তাকাও (বুখারী, আস-সাহীহ, ৪খ, ২৭৯, কিতাবুল-আম্বিয়া, হাদীছ নং ৩১৩৯)।
ইমাম বুখারী ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করিয়াছেন যে, লোকজন তাঁহাকে দাজ্জাল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিল, যাহার উভয় চক্ষুর মধ্যখানে কাফির অথবা,– লেখা। তিনি বলিলেন, আমি তাহা শুনি নাই। তবে রাসূল (স) বলিয়াছেন, ইবরাহীম (আ)-এর আকৃতি, তাহা তোমাদের সঙ্গীর প্রতি তাঁকাও (আল-বুখারী, ৪খ, ২৭৯, হাদীছ নং ৩১৩৯)। ইমাম বুখারী কিতাবুল-হাজ্জ ও কিতাবুল-লিবাস-এ ইহা বর্ণনা করিয়াছেন (ইব্ন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ১৭৩)।
বৈশিষ্ট্যাবলী
ইবরাহীম (আ) ছিলেন আল্লাহর খলীল। কুরআন কারীমে ইরশাদ হইয়াছে :
“আল্লাহ ইবরাহীমকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেন” (৪ : ১২৫)।
তিনিই প্রথম মেহমানদারী করেন, ছারীদ (রুটি ও গোশতের শুরুয়া মিশ্রিত খাদ্য) বানান এবং তাহা মিসকীনদিগকে খাওয়ান। মেহমানকে সাথে না লইয়া সকাল বা সন্ধ্যার তিনি আহার গ্রহণ করিতেন না। কখনো একজন মেহমান তালাশ করিতে দুই বা ততোধিক মাইল যাইতেন। কিয়ামত পর্যন্ত তাঁহার এই মেহমানদারী চালু থাকিবে। তিনিই প্রথম গোঁফ খাটো করেন, ক্ষৌরকর্ম করেন, নখ কর্তন করেন, মিসওয়াক করেন, চুলে সিঁথি করেন, কুলি করেন, নাকে পানি দেন এবং নাক ঝাড়িয়া সাফ করেন, পানি দ্বারা ইসতিনজা করেন (ইব্ন কুতায়বা, আল-মাআরিফ, পৃ. ৩০)। তিনিই প্রথম খাতনা করেন। আবু হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত আছে যে, ইবরাহীম (আ) ৮০ বছর বয়সে কাদূম নামক স্থানে, মতান্তরে বাইস দ্বারা খাতনা করেন (বুখারী, আস-সাহীহ, ৪খ, ২৭৯, কিতাবুল-আম্বিয়া, হাদীস নং ৩১৪০; মুসলিম, আস-সাহীহ, ৭, ৯৭)। কোন কোন বর্ণনামতে ইহার কারণ ও ঘটনা এইরূপ ছিল যে, আমালেকাদের সহিত তাঁহার ঘোরতর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে উভয় পক্ষের বিপুল সংখ্যক লোক নিহত হয়। দাফনকালে ইবরাহীম (আ) তাঁহার সঙ্গীদিগকে শনাক্ত করিতে পারিতেছিলেন না। তখন তিনি মুসলমানদের চিহ্ন রূপ খাতনা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। অতঃপর কাদূম নামক স্থানে তিনি সেই দিন খাতনা করেন (ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ১০৫)। তিনিই প্রথম পাজামা পরিধান করেন। সুফয়ান ইব্ন উয়ায়না (র)-এর আযাদকৃত দাস ফাদিল হইতে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহ ইবরাহীম (আ)-এর নিকট ওহী প্রেরণ করেন, হে ইবরাহীম! পৃথিবীবাসীর মধ্যে তুমিই আমার নিকট অধিক সম্মানিত ব্যক্তি। কাজেই যখন তুমি সিজদা করিবে তখন মাটি যেন তোমার সতর দেখিতে না পায়। তখন তিনি পাজামা বানাইয়া লন (ছালাবী, প্রাগুক্ত)। ১৫০ বৎসর বয়সে সর্বপ্রথম বার্ধক্যের চিহ্নরূপ তাঁহার চুল-দাড়ি সাদা হয়। বর্ণিত আছে যে, সারার গর্ভে যখন ইসহাকের জন্ম হয় তখন কানআনবাসিগণ বলিতে থাকে, তোমরা কি আশ্চর্যান্বিত হইবে না এই বৃদ্ধ ও বৃদ্ধার ব্যাপারে! তাহারা একটি পুত্র সন্তান কুড়াইয়া আনিয়া তাহাকে পালক পুত্র বানাইয়াছে। তখন আল্লাহ ইসহাকের আকৃতি ইবরাহীমের মত করিয়া দিলেন। তাঁহাদের মধ্যে পার্থক্য করা যাইত না। তাই আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম (আ)-কে বাধ্যর্কের চিহ্ন দ্বারা চিহ্নিত করিয়া দিলেন (ইব্ন কুতায়বা, আল-মাআরিফ, পৃ. ৩০-৩১)। অতঃপর তিনি তাঁহার এই অবস্থা দেখিয়া বলিলেন, হে আমার প্রতিপালক! ইহা কি? আল্লাহ বলিলেন, ইহা সম্মানের বিষয়। তিনি বলিলেন, হে আমার প্রতিপালক! আমার সম্মান আরো বৃদ্ধি করিয়া দিন (ছালাবী, কাসাস, পৃ. ১০৫)।
তিনি আল্লাহর নিকট দুআ করিয়াছিলেন যে, নবুওয়াত যেন তাঁহার বংশে অব্যাহত থাকে । আল্লাহ এই দুআ কবুল করিয়াছিলেন। তাঁহার বংশের দুইটি ধারা ইসমাঈল ও ইসহাক (আ) হইতেই পরবর্তী কালের সকল নবী আগমন করিয়াছিলেন। আনাস ইবন মালিক (রা) হইতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, আমি বনী ইসরাঈলের আট হাজার জন নবীর পর আগমন করিয়াছি (ছালাবী, কাসাস, পৃ. ১০৪)। তাঁহাকে পরবর্তীদের মধ্যে যশস্বী করা হইয়াছে। তিনি দুআ করিয়াছিলেন :
“আমাকে পরবর্তীদের মধ্যে যশস্বী কর” (২৬ : ৮৪)।
আল্লাহ উহা ককূল করিয়াছিলেন। তাঁহাকে বিভিন্ন রকমের পরীক্ষা করা হইয়াছে এবং আল্লাহর পক্ষ হইতে সাক্ষ্য দেওয়া হইয়াছে যে, তিনি উহাতে উত্তীর্ণ হইয়াছেন এবং দায়িত্ব পালন করিয়াছেন (দ্র, ২৪ ১২৪; ৫৩ : ৩৭)। সেই সকল পরীক্ষায় সফলতার সহিত উত্তীর্ণ হইবার পর আল্লাহ তাঁহাকে মানুষের নেতা বানাইয়া দেন। তিনি এই নেতৃত্ব যেন তাঁহার বংশের মধ্যে থাকে সেই দুআ করিয়াছিলেন এই শর্তে যে, জালিমগণ উহা পাইবে না (২৪ ১২৪)। তাই পরবর্তীতে যত নবী আগমন করিয়াছেন সবই তাঁহার বংশধর। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করিয়াছেন :
“ইবরাহীম ছির এক উম্মাত আল্লাহর অনুগত, একনিষ্ঠ এবং সে ছিল না মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত” (১৬৪ ১২০)।
তাঁহাকে বাল্যকালেই সঠিক জ্ঞান ও হিদায়াত দেওয়া হইয়াছিল (২১ : ৫১)। তিনি ছিলেন একত্ববাদীদের নেতা। একত্ববাদের ক্ষেত্রে তাঁহার ছিল জোরালো বক্তব্য ও সুদৃঢ় যুক্তি-প্রমাণ। বাল্যকাল হইতেই তিনি উক্ত জোরালো বক্তব্য ও সৃদৃঢ় প্রমাণের দ্বারা মানুষকে হকের দিকে আহবান করেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :
“আর ইহা আমার যুক্তি-প্রমাণ যাহা ইবরাহীমকে দিয়াছিলাম তাহার সম্প্রদায়ের মুকাবিলায়; যাহাকে ইচ্ছা আমি মর্যাদায় আমি উন্নীত করি” (৬ : ৮৩)।
তাঁহাকেই সর্বপ্রথম আল্লাহ একনিষ্ঠ মুসলিম নাম দিয়াছেন। ইয়াহুদী খৃস্টানগণ ইবরাহীম (আ) তাহাদের দলভুক্ত বলিয়া যে দাবী করিয়াছিল আল্লাহ তাহা নাকচ করেন এবং তাঁহার ইসলাম ও ইখলাসের সাক্ষ্য দেন (দ্র. ৩ : ৬৭)। তিনিই প্রথম কুরবানীর রীতি চালু করেন। তাঁহাকেই প্রথম আল্লাহ কাবাগৃহের স্থান দেখাইয়া দেন এবং সেখানে তিনি বায়তুল্লাহ নির্মাণ করেন। তিনিই প্রথম আল্লাহর জন্য অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হন। অতঃপর আগুনকে তাহার জন্য ঠাণ্ডা ও শান্তিদায়ক করা হয়। তিনিই প্রথম নবী, যাঁহার আবেদনের প্রেক্ষিতে আল্লাহ মৃতকে জীবিত করিয়া দেখান। তাঁহাকে কিয়ামতের দিন সাদা চাদর পরিধান করানো হইবে এবং আল্লাহর আরশের বাম পার্শ্বে তাঁহার জন্য মিম্বর স্থাপন করা হইবে (ছালাবী, কাসাস, পৃ. ১০৬)। রাসূল (স) বলেন, কিয়ামতের দিন সকলকে নগ্ন পা, নগ্ন মস্তক ও নগ্ন শরীর তথা জন্মের দিনের ন্যায় উঠানো হইবে। প্রথম যাহাকে কাপড় পরানো হইবে তিনি ইবরাহীম (আ) (বুখারী, আস-সাহীহ, কিতাবুত তাফসীর, সূরাতুল আম্বিয়া, কিরমানী ভাষ্য ১৭খ., ২১৩)। রাসূল (স) আরো বলেন, তিনি হইবেন মুসলিম শিশুদের অভিভাবক এবং জান্নাতবাসীদের নেতা। তিনিই প্রথম আল্লাহর জন্য হিজরত করেন। আল্লাহ তাঁহার স্মৃতি বিজড়িত স্থানকে মানুষের কিবলারূপে নির্ধারণ করেন এবং তাঁহাকে মানুষের ইমাম ও উত্তম আদর্শের ধারক বানান (৬০ : ৪)। সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মাদ (স)-কে এবং তাঁহার শ্রেষ্ঠ উম্মতকেও ইবরাহীম (আ)-এর মিল্লাতের আনুগত্য করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে (১৬ : ১২৩)। আল্লাহ তাঁহাকে, (সহনশীল), । (কোমল হূদয়) ও এ. (সতত আল্লাহ অভিমুখী) বিশেষণে বিশেষিত করিয়াছেন (১১ : ৭৫)। এই সকল বৈশিষ্ট্য দ্বারা আল্লাহ তাঁহাকে সম্মানিত করিয়াছেন (আছ-ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ১০৪-১০৬; তু. ইব্ন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ১৬৬-১৭২)।
ইবরাহীম (আ)-এর উপর নাযিলকৃত সহীফা ও উহার বিষয়বস্তু
হাদীছ ও ইতিহাস গ্রন্থসমূহ হইতে জানা যায় যে, হযরত ইবরাহীম (আ)-এর উপর দশখানা সহীফা নাযিল হইয়াছিল। আবার ইদরীস আল-খাওলানী আবু যার (রা) হইতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (স)-কে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ তাআলা কতখানি কিতাব নাযিল করিয়াছেন : তিনি বলিলেন, এক শত সহীফা আর চারখানি কিতাব । আল্লাহ তাআলা আদম (আ)-এর উপর দশখানি, শীছ (আ)-এর উপর পঞ্চাশখানা, খানুখ বা ইদরীস (আ)–এর উপর ত্রিশখানা এবং ইবরাহীম (আ)-এর উপর দশখানা সহীফা নাযিল করেন। ইহা ছাড়া তিনি তাওরাত, যাবূর, ইনজীল ও ফুরকান নাযিল করেন। আবু যার (রা) বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ইবরাহীম (আ)-এর সহীফায় কি ছিল? তিনি বলিলেন সবই উপদেশমূলক নীতিকথা (J)। উদাহরণস্বরূপ উদ্ধৃত করা যায়?
“হে স্বেচ্ছাচারী, অহংকারী বাদশাহ! আমি তোমাকে এইজন্য প্রেরণ করি নাই যে, তুমি একটার পর একটা দুনিয়ার সম্পদ জমা করিবে, বরং এইজন্য প্রেরণ করিয়াছি যে, তুমি আমা হইতে মজলুমের বদদোআ ফিরাইয়া রাখিবে। কারণ আমি তাহা ফেরৎ দেই না, যদিও তাহা কোন কাফিরের পক্ষ হইতেও আসে। উহাতে আরও উপদেশ বাক্য ছিল যে, বুদ্ধিমান যতক্ষণ পর্যন্ত বুদ্ধিহারা না হয়, তাহার উচিৎ সময়কে চার ভাগে ভাগ করা : এক ভাগে সে আল্লাহকে ডাকিবে এবং তাঁহার সহিত গোপনে কথোপকথন করিবে; এক ভাগে আল্লাহর সৃষ্টি-নিচয় লইয়া চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করিবে; এক ভাগে নিজের কৃতকর্মসমূহের হিসাব লইবে এবং একভাগ নিজের প্রয়োজন যথা হালাল জীবিকা জোগাড় করার জন্য রাখিবে। বুদ্ধিমানের উচিৎ সে যেন তিনটি কাজ ছাড়া আর কিছুর জন্য প্রচেষ্টা না চালায় : (১) পরকালের জন্য পাথেয় সঞ্চয় করা; (২) নিজের জীবনযাত্রার ব্যবস্থা করা এবং (৩) হারাম নহে এমন বস্তুর স্বাদ আস্বাদন করা। জ্ঞানীর উচিৎ তাহার সময়কাল সম্পর্কে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হওয়া; নিজের অবস্থা অনুযায়ী অগ্রগামী হওয়া এবং নিজের জিহ্বাকে হেফাজত করা। যে জানে যে, তাহার কথা তাহার কাজ হইতে নিকৃষ্ট প্রয়োজনীয় কথাবার্তা ছাড়া অনর্থক ও অবান্তর কথাবার্তা তাহার কম হইবে (আত্-তাবারী, তারীখ, ১৩, ১৬১; আছ-ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ১০৬-১০৭)।
তাঁহার সাহীফার আরও উপদেশ হইল : শান্তি বর্ষিত হউক সেই ব্যক্তির উপর যে মেহমানের সম্মান করে। যে তাহাকে অপদস্থ করে সে জাহান্নামের সর্বশেষ স্তরে থাকিবে। আবু যার (রা) বলেন, এইজন্যই ইবরাহীম (আ) মেহমান ছাড়া আহার করিতেন না (ইবনুল-জাওযী, তারীখুল-মুনতাজাম, ১খ, ২৭২-২৭৩)।
জান্নাতে তাঁহার প্রাসাদ : হাফিজ আবূ বাকর আল-বাহ্র আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে বর্ণনা করিয়াছেন যে, রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, জান্নাতে একটি প্রাসাদ আছে, আমার মনে হয় তিনি বলিয়াছিলেন, উহা মুক্তার তৈরী, যাহাতে কোন ফাটল কিংবা ভাঙ্গন নাই। আল্লাহ উহা তাঁহার বন্ধু ইবরাহীম (আ)-কে আপ্যায়িত করার জন্য তৈরি করিয়াছেন (ইব্ন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১৩, ১৭২)।
একটি অযৌক্তিক আপত্তি ও উহার জবাব
লাইডেন হইতে প্রকাশিত ইংরাজী ইসলামী বিশ্বকোষের প্রথম সংস্করণে ইবরাহীম (আ) সম্বন্ধে কতগুলি অযৌক্তিক ও বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য উপস্থাপন করা হইয়াছে। উহাতে বলা হইয়াছে যে, কুরআন কারীমে একটি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ইবরাহীম (আ)-কে কাবা গৃহের নির্মাতা এবং দীন-ই হানীফ-এর প্রবর্তক হিসাবে তুলিয়া ধরা হয় নাই। অবশ্য দীর্ঘকাল পর তাঁহাকে এই সকল বিশেষণে বিশেষিত বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। মাক্কী সূরাগুলির কোথাও ইবরাহীম (আ)-এর সহিত ইসমাঈল (আ)-এর সম্পর্ক দৃষ্টিগোচর হয় না এবং তাঁহাকে প্রথম মুসলমান বলিয়াও কোথাও উল্লেখ করা হয় নাই; বরং তাঁহাকে কেবল একজন নবী ও পয়গাম্বর হিসাবে দেখা যায়। সেখানে তাঁহাকে কাবা গৃহের প্রতিষ্ঠাতা, ইসমাঈলের পিতা, ‘আরব-এর পয়গাম্বর ও পথপ্রদর্শক এবং দীন-ই হানীফ-এর প্রচারক বলিয়া উল্লেখ করা হয় নাই। অবশ্য মুহাম্মাদ (স)-এর মাদানী যিন্দেগী শুরু হইলে তখন মাদানী সূরায় হযরত ইবরাহীম (আ)-এর উল্লেখকালে সঙ্গে সঙ্গে উক্ত বৈশিষ্ট্যাবলীর উল্লেখও করিতে দেখা যায়। প্রশ্নকারিগণ ইহার কারণ হিসাবে উল্লেখ করিয়াছেন যে, মাক্কী যিন্দিগীতে তিনি (রাসূলুল্লাহ স.) সকল বিষয়েই ইয়াহূদীদের উপর নির্ভর করিতেন এবং তাহাদের রীতিনীতি পছন্দ করিতেন। তাই ইবরাহীম (আ)-কেও সেই দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখিতেন ইয়াহুদীগণ যে দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখিত। কিন্তু মদীনায় যখন ইয়াহুদীগণ ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ করিতে অস্বীকার করিল তখন তিনি ইয়াহূদীদের ইয়াহূদীবাদ হইতে পৃথক ইবরাহীমী দাওয়াতের ভিত্তি স্থাপন করিলেন এবং ইবরাহীম (আ)-কে দীনে হানীফ-এর প্রচারক, আরবের পয়গাম্বর, ইসমাঈল (আ)-এর পিতা এবং কাবা গৃহের ভিত্তি স্থাপনকারী হিসাবে পেশ করিলেন। এই প্রশ্ন এবং এই সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্র. মুহাম্মাদ হিফজুর রাহমান সিউহারবী, কাসাসুল-কুরআন, দিল্লী, ১খ, ১৪০-১৫১)। এই সম্পর্কে দাইরাতুল মাআরিফ আল-ইসলামিয়া : ১/১খ, ২৮প,-এ মুহাম্মদ ফারীদ ওয়াজদীর একটি সংযোজন দেওয়া হইয়াছে যাহার অনুবাদ নিম্নে দেওয়া হইল।
মুসলিম-অমুসলিম কোন ঐতিহাসিক এই কথা বলেন নাই যে, রাসূলুল্লাহ (স) ইসলামী দাওয়াত প্রচার-প্রসারের জন্য ইয়াহুদীদের সাহায্য লইয়াছেন; বরং তাঁহারা সকলেই ইহার বিপরীত বর্ণনা করিয়াছে যে, মক্কা ও মদীনা উভয় জায়গার ইয়াহূদীরই তাঁহার ঘোর বিরোধী ছিল এবং তাঁহার বিরুদ্ধে জনগণকে উস্কানী দিত। খোদ কুরআন কারীমে উল্লিখিত হইয়াছে, “তুমি ইয়াহুদী ও মুশরিকদিগকে মুমিনদের প্রতি সর্বাধিক কট্টর দুশমনরূপে দেখিতে পাইবে এবং তাহাদিগকে তুমি মুমিনদের সর্বাধিক নিকটতম বন্ধুরূপে দেখিতে পাইবে যাহারা নিজদিগকে খৃস্টান বলিয়া দাবি করে” (৫ : ৮২)।
জাহিলী যুগে আরবগণ ইয়াহূদীগণকে কোন মূল্যই দিত না; বরং তাহাদের সম্পর্কে এমনও বর্ণনা পাওয়া যায় যে, ইয়াহূদীদের প্রতিবেশী থাকাও তাহারা পছন্দ করিত না এবং যে সকল স্থান তাহারা নিজেদের হিজরতের জন্য মনোনীত করিয়াছিল সেইখান হইতে ইয়াহুদীগণকে তাহারা বিতাড়নের পক্ষপাতী ছিল।
ইসমাঈল (আ)-এর জন্মদাতা বা আদনানী আরবের প্রথম পুরুষ যে ইবরাহীম (আ), কুরআন কারীমেই এই কথা প্রথম ঘোষণা করা হয় নাই। বরং তাওরাতে ইহার পূর্বেই বলিয়া দেওয়া হইয়াছে যে, ইব্রাহীম তাঁহার দ্বিতীয় স্ত্রী (?) হাজার এবং তাঁহার সন্তান ইসমাঈলকে আরব ভূমিতে নির্বাসিত করেন এবং সেইখান হইতেই ইসমাইলী আরবের সৃষ্টি হয়।
ইসলাম ইব্রাহীম (আ)-কে ইয়াহুদীবাদের সহিত সম্পৃক্ত হওয়াকে কখনও সম্মানজনক বলিয়া বিবেচনা করে নাই বরং উল্টাভাবে ইয়াহূদীদের এই দাবি যে, ইবরাহীম ইয়াহুদী ছিলেন- দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রত্যাখ্যান করিয়াছে। তাই ইরশাদ হইয়াছে :
“ইরাহীম ইয়াহূদীও ছিল না, খৃষ্টানও ছিল না, সে ছিল একনিষ্ঠ মুসলিম” (৩ : ৬৭)।
“তুমি বল, হে কিতাবীগণ! ইবরাহীম সম্বন্ধে কেন তোমরা তর্ক কর, অথচ তাওরাত ও ইন্জীল তো তাহার পরেই নাযিল হইয়াছিল; তোমরা কি বুঝ না” (৩ : ৬৫)?
ইসলাম কখনও ইয়াহুদীবাদের সহায়তায় মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়াইবার পক্ষপাতী ছিল না। কারণ কুআনের শিক্ষাই হইল, ইসলাম বনী আদমের জন্য মনোনীত সেই প্রাচীন দীন যাহা আল্লাহ তাআলা মানুষের জন্য ওহীর মাধ্যমে প্রেরণ করিয়াছিলেন । ইহার পর বিভিন্ন দীন ও মতবাদের প্রবক্তাগণ উহাতে পরিবর্তন করিয়া উহার আসল পথ হইতে দূরে সরাইয়া দিয়াছে। অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাহাদের এই পরিবর্তন-পরিবর্ধন হইতে উহাকে পাক-পবিত্র করিবার জন্য যুগে যুগে রাসূল প্রেরণ করিয়াছেন। এইভাবে শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (স) আগমন করিয়াছেন।
কুরআন কারীমে বলা হইয়াছে :
“তিনি তোমাদের জন্য দীন-এর সেই পথই বিধিবদ্ধ করিয়াছেন, যাহার নির্দেশ দিয়াছিলেন তিনি নূহকে, আর যাহা আমি প্রত্যাদেশ করিয়াছি তোমাকে এবং যাহার নির্দেশ দিয়াছিলেন মূসা ও ঈসাকে এই বলিয়া যে, তোমরা দীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং উহাতে মতভেদ করিও না।… উহাদের নিকট জ্ঞান আসিবার পর কেবল বিদ্বেষবশত উহারা নিজেগিদের মধ্যে মতভেদ ঘটায়; এক নির্ধারিত কাল পর্যন্ত অবকাশ সম্পর্কে তোমার প্রতিপালকের পূর্ব সিদ্ধান্ত না থাকিলে উহাদের বিষয়ে ফয়সালা হইয়া যাইত। উহাদের পর যাহারা কিতাবের উত্তরাধিকারী হইয়াছে তাহারা কুরআন সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর সন্দেহে রহিয়াছে। সুতরাং তুমি উহার দিকেই আহবান কর (অর্থাৎ সেই সম্মিলিত ভিত্তির উপর ঐক্যবদ্ধ করিতে যাহা সকল দীন-এর মধ্যে রহিয়াছে, যাহাতে সকল দীন এক হইয়া যায়- ওয়াজদী) এবং উহাতেই প্রতিষ্ঠিত থাক যেইভাবে তুমি আদিষ্ট হইয়াছ এবং উহাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করিও না। বল, আল্লাহ যে কিতাব নাযিল করিয়াছেন আমি তাহাতে বিশ্বাস করি (সকল দীনের ঐক্য প্রতীয়মান করার জন্য) এবং আমি আদিষ্ট হইয়াছি। তোমাদের মধ্যে ন্যায়বিচার করিতে। আল্লাহই আমাদেরও প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক। আমাদেরকে কর্ম আমাদের এবং তোমাদের কর্ম তোমাদের; আমাদের ও তোমাদের মধ্যে বিবাদ-বিসম্বাদ নাই (অর্থাৎ কোন শত্রুতা ও ঝগড়া নাই)। আল্লাহ্ই আমাদিগকে একত্র করিবেন এবং প্রত্যাবর্তন তাঁহারই নিকট” ৪২ : ১৩-১৫)।
উপরে উল্লিখিত এই সকল আয়াত সূরা আশ-শূরা-র, যাহা মক্কায় নাযিল হয়।
ইহা হইতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, কুরআন দীনকে ইহার প্রথম ভিত্তির উপর ফিরাইয়া লইয়া যাইতে চাহে যাহা নূহ (আ)-এর যুগে কায়েম হইয়াছিল, ইবরাহীম (আ)-এর যুগে নহে। স্পষ্ট বলা হইয়াছে যে, ইবরাহীম (আ) সেই ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত থাকিবার ব্যাপারে নূহ (আ)-এর অনুসারীমাত্র, লূতন ভিত্তির প্রতিষ্ঠাতা নহেন। কুরআন কারীমে প্রত্যক্ষভাবে মিল্লাতে ইবরাহীম-এর অনুসরণ করার যে নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে তাহা এইজন্য নহে যে, তিনি ইসলামের প্রথম প্রবর্তক, বরং এইজন্য যে, তিনি আরবের একটি বৃহৎ গোত্রের আদি পিতা। তাই এমনিভাবে তাহাদের মধ্যে তাঁহার অনুসরণের আগ্রহ সৃষ্টি করা হইয়াছে।
কাবা সম্পর্কে কথা এই যে, উহা অদ্ভুত আকৃতির কোন মন্দির ছিল না, যেমন কারনায়ক (দ্র. ৫০৭) অথবা জনগণের পছন্দমত কোন সুরম্য অট্টালিকা ছিল না, যাহাতে বিচিত্র কারুকার্য খচিত থাকিবে এবং বিভিন্ন গোত্র উহা দখল করিতে বিবাদে লিপ্ত হইবে। উহা ছিল নিতান্তই সাধারণ চতুষ্কোণ একটি ইমারত আর আরবগণ চতুষ্কোণ ইমারতকেই কাবা বলে। আর তাহা ছিল সেই ধরনের ইমারত যাহা লোকে স্বহস্তে নির্মাণ করে। তাই তাহাতে স্থাপত্যের কোন অলংকরণ নাই, কারণ উহা ইবাদতখানা। অতএব ইবরাহীম (আ), যাঁহাকে সকল উম্মতই নবী বলিয়া মান্য করে নিজের জন্য এবং নিজের সন্তানদের সালাত আদায় করার জন্য এমনি একটি গৃহ নির্মাণ করিবেন, ইহা কি অসম্ভব ব্যাপার!
আর ইহা যখন প্রমাণিত যে, ইবরাহীম (আ) তাঁহার পুত্রকে এই অঞ্চলে বসবাস করিবার জন্য রাখিয়া আসিয়াছিলেন, যেমন তাওরাতে স্পষ্টভাবে উল্লিখিত আছে, তখন সেইখানে তাঁহার জন্য সাধারণ একটি ইবাদাতখানা নির্মাণ করা ছিল অতীব জরুরী। আজ পর্যন্ত কেহই এই ব্যাপারে মতভেদ করেন নাই যে, ইবরাহীম (আ)-ই উক্ত ইবাদাতখানার ভিত্তি স্থাপন করেন। অতঃপর এই উক্তি করা কিভাবে সঠিক হইতে পারে যে, মুহাম্মাদ (স) কেবল উক্ত গৃহের মর্যাদা বৃদ্ধি করিবার জন্য উহাকে ইবরাহীম (আ)-এর নির্মিত বলিতেছেন (যদিও ইবরাহীম (আ) ইহার নির্মাতা ছিলেন না)]। এই গৃহের নাম বায়তুল্লাহ হওয়া কাবার কোন বৈশিষ্ট্যের কারণে নহে। মুসলমানদের নিকট সকল মজিদই বায়তুল্লাহ। কাবার মর্যাদা এইজন্য বৃদ্ধি পাইয়াছে যে, উহা মক্কায় প্রতিষ্ঠিত প্রথম বায়তুল্লাহ যাহা মানুষের ইবাদতের জন্য নির্মিত হইয়াছে।
রাসূলুল্লাহ (স) তাঁহার ইসলামের প্রচারের ভিত্তিসমূহের মধ্যে খানা-ই কাবাকে যে একটি ভিত্তিরূপে গ্রহণ করেন নাই তাহার প্রমাণ হইল, মক্কায় অবস্থানের গোটা সময়টিতে তিনি বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকেই মুখ করিয়া সালাত আদায় করেন।
ইসলাম যাহাকে তাহার দাওয়াতের ভিত্তি স্বরূপগ্রহণ করিয়াছে তাহা হইল আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত দীন। আর এই দীন-এর দ্বারাই ইসলাম মানুষের মধ্যকার মতপার্থক্যের অবসান করিতে প্রয়াসী। ইসলাম প্রত্যেককে সুষ্ঠুভাবে জানাইয়া দিয়াছে যে, প্রত্যেকেই নিজ নিজ আমলের যিম্মাদার এবং তার জন্য জওয়াবদিহি করিতে হইবে। তাই আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেন (অনু) ও ইয়াকূব–এর নিকট যখন মওত আসিয়াছিল তোমরা কি তখন উপস্থিত ছিলে? সে যখন পুত্রগণকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, আমার পরে তোমরা কিসের ইবাদত করিবে? তাহারা বলিয়াছিল, আমরা
আপনার ইলাহ-এর ও আপনার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাক-এর ইলাহ-এরই ‘ইবাদত করিব। তিনি একমাত্র ইলাহ এবং আমরা তাঁহার নিকট আত্মসমর্পণকারী । সেই উম্মাত অতীত হইয়াছে- উহারা যাহা অর্জন করিয়াছে তাহা উহাদের, তোমরা যাহা অর্জন কর তাহা তোমাদের । তাহারা যাহা করিত সে সম্বন্ধে তোমাদিগকে কোন প্রশ্ন করা হইবে না” (২: ১৩৩-১৩৪)।
উপরের বক্তব্য হইতে ইহাই প্রমাণিত হয় যে, ইসলাম কোনও ব্যক্তি, গোত্র বা বংশের সহিত সম্পৃক্ত হওয়ার পক্ষপাতী নহে। আল্লাহ কর্তৃক নাযিলকৃত বিধানের উপর উহা নির্ভরশীল, অন্য কিছুর উপর নহে। তাই ইসলাম বংশ, দেশ ও বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উপর গুরুত্ব আরোপ করিয়াছে। আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেন : “হে মানুষ! আমি তোমাদিগকে সৃষ্টি করিয়াছি এক পুরুষ ও এক নারী হইতে, পরে তোমাদিগকে বিভক্ত করিয়াছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাহাতে তোমরা একে অপরের সহিত পরিচিত হইতে পারে। তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে অধিক মুক্তাকী। আল্লাহ্ সব কিছু জানেন, সমস্ত খবর রাখেন” (৪৯: ১৩)।
অতঃপর ইসলাম ইহার উপর গুরুত্ব আরোপ করিয়াছে যে, মানুষের ঐক্যের চাহিদা হইল, তাহাদের দীনও এক হইবে, আর তাহাই হইল সেই সর্বপ্রাচীন দীন যাহা আল্লাহ তাআলা ওহীর মাধ্যমে দ্বিতীয় আদম হযরত নূহ (আ)-কে প্রদান করিয়াছিলেন যাহা ইতিপূর্বে বর্ণিত হইয়াছে।
স্মর্তব যে, এই দীন একটি স্বাভাবিক ও প্রকৃতিগত ভিত্তির উপর কায়েম হওয়া উচিত, আর তাহা হইল মানুষের ফিত্রাত আর বুদ্ধি ও বিদ্যা উহার মূল বিষয় হওয়া বাঞ্ছনীয়। কারণ এই দুইটি বিষয়ই জাহিরী ও বাতিনী উন্নতির মূল উৎস। ইহা ছাড়া মানুষের আর কোনও গত্যন্তর নাই । কিয়ামত পর্যন্ত তাহাদের মানসিক প্রশান্তির জন্য এই দীনের বিকল্প আর কোন পন্থা নাই (দাইরাতুল মাআরিফ আল-ইসলামিয়্যা)।
গ্রন্থপঞ্জী : (১) আল-কুরআনুল-কারীম, স্থা; হাদীছ? (২) আল-বুখারী, আস-সাহীহ, স্থা; আল-বুখারী বিশারহিল কিরমানী, দার ইহয়াইত তুরাছ আল-আরাবী, বৈরূত, লেবানন, ২য় সং ১৪০১/১৯৮১, ১৭ খ., ১৮ খ., স্থা; (৩) মুসলিম, আস-সাহীহ, দারুল-আফাঁক আল-জাদীদা, বৈরূত তা. বি., ৭খ, ৯৭-৯৮; (৪) আত-তিরমিযী, আল-জামি, মিসর, ১ম সং ১৩৮৫/১৯৬৫, ৫খ, ৩২২, ৫৮৩; ((৫) আন-নাসাঈ, আস-সুনান, দারুল ‘ইমিয়্যা, বৈরূত লেবানন, ১ম সং. ১৪১১/১৯৯১, ৬খ, ২৯০; (৬) ইবন মাজা, আস-সুনান, আর-রিয়াদ, ১ম সং. ১৪০৩/১৯৮৩, ২খ, ২০৪; (৭) আহমাদ ইবন হাম্বাল, আল-মুসনাদ, দারুল-মাআরিফ, মিসর ১৩৭৭/১৯৫৭, ৫খ, ১৯; (৮) আল-হাকিম, আল-মুসতাদরাক, দারুল কিতাব আল-আরাবী, বৈরূত, লেবানন তা, বি., ১খ, ৩৮৪, কিতাবুল জানাইয, ২খ, ২৯৮, ৩৭০, ৩৪৪, ৪৭০।
তাফসীর : (৯) আল-আলুসী, রূহুল-মাআনী, দার ইহয়াইত-তুরাছ আল-আরাবী, ৪র্থ সং. বৈরূত ১৪০৫/১৯৮৫, ৩খ, ২৮-২৯, আরও স্থা.; (১০) আল-কুরতুবী, আল-জামিলি-আহকামিল-কুরআন, মাকতাবাতুর রিয়াদ আল-হাদীছা তা, বি, ৩খ, ৩০০-৩০১, আরও বহু স্থা; (১১) আত-তাবারী, জামিউল বায়ান, দারুল মাআরিফ, মিসর তা. বি., ৩খ, ৩০-৯৬; আরো বহু স্থা.; (১২) ইবন কাছীর, তাফসীর, দারুল-মারিফা, ২য় সং, বৈরূত ১৪০৭/১৯৮৭, ১খ.; ১৬৯-১৯০, আরও বহু স্থা., (১৩) আশ-শাওকানী, ফাতহুল-কাদীর, মাকতাবা মুসতাফা আল-হালাবী, মিসর ২য় সং. ১৩৮৩/১৯৬৪, ২খ, ৫০৯-৫১৩, স্থা। মিসর তা. বি., ১খ, ১৩৯-১৮৩; (১৭) ইবনুল আছীর, আল-কামিল-দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, বৈরূত, লেবানন, ১ম সং. ১৪০৭/১৯৮৭, ১খ, ৭২-৯৫; (১৮) ইবন খালদূন, তারীখ, দারুল কিতাব, বৈরূত ১৯৮১ খৃ., ১খ, ৫৮-৭১; (১৯) মুহাম্মাদ ই দারওয়াযা, তারীখুল জিন্স আল-আরাবী, আল-মাকতাবাতুল আসরিয়া, ১ম সং, বৈরূত ১৩৭৯/১৯৫৯, ১খ, ১১৫-১১৯; (২৮) ইবনুল জাওযী, আল-মুনতাজাম, ফী তারীখিল-মুক ওয়াল-উমাম, দারুল-কুতুব আল-ইলমিয়া, বৈরূত, লেবানন, ২য় সং. ১৪১৫/১৯৯৫, ১খ, ২৫৭-৩০৩; (২১) আল-মাসউদী, মুরূজুয-যাহাব, দারুল-মারিফা, বৈরূত ১৪০৩/১৯৮২, ১খ, ৪৪-৪৬; (২২) ইবন কুতায়বা, আল-মাআরিফ, দারুল-মাআরিফ, মিসর, ২য় সং. ১৯৬৯ খৃ., পৃ. ৩০-৩৩; (২৩) ইব্ন হাবীব আল-বাগদাদী, কিতাবুল-মুহাব্বার, আল-মাকতাব আত-তুজজারী, বৈরূত তা.বি., পৃ. ৪।
কাসাস: (২৪) আত-তাবারী, কাসাসুল আম্বিয়া, দারুল-ফিকর, বৈরূত ১৪০৯/১৯৮৯, পৃ. ১৩৩-২০৪; (২৫) ইবন কাছীর, কাসাসুল আম্বিয়া, মুআস্সাসাতুল মাআরিফ, বৈরূত, লেবানন, ১ম সং, ১৪১৬/১৯৯৬, পৃ. ১৫১-১৭৬; (২৬) আল-কিসাঈ, কাসাসুল-আম্বিয়া, লাইডেন ১৯২২ খৃ., ১খ. ১২৮-১৪৫; (২৭) আছ-ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, তুরস্ক ১২২৬ হি., পৃ. ৭৬-১০৯; (২৮) আবদুল ওয়াহহাব আন-নাজ্জার, কাসাসুল আম্বিয়া, দারুল-ফিকর, বৈরূত তা, বি., পৃ. ৭১-১১০; (২৯) ড. মুহাম্মদ আত-তায়্যিব আন-নাজ্জার, তারীখুল আম্বিয়া, দারুত-তিবাআ আল-মুহাম্মাদিয়া, আল-আযহার, মিসর, ১ম সং. ১৩৯৯/১৯৭৯, পৃ. ৯৫-১১৫; (৩০) মুহাম্মাদ আল-ফাকী, কাসাসুল-আম্বিয়া, মাতাবিউশ-শারানী আল-হাদীছা আর-রিয়াদ, ১ম সং. ১৩৯৯/১৯৭৯, পৃ. ৬০-১১০; (৩১) আফীফ আবদুল-ফাত্তাহ তাবারা, মাআল-আম্বিয়া ফিল-কুরআন, দারুল-মালাবিস, বৈরূত, ১৬ সং. ১৯৮৭ খৃ., ১০৫-১৩৬; (৩২) ড. সালাহ আল-খালিদী, আল-কাসাসুল-কুরআনী, দারুল কালাম, দিমাশক, ১ম সং. ১৪১৯-১৯৯৮, ১খ, ৩০১-৪৭০; (৩৩) ইমাদ যুহায়র আল-হাফিজ, আল-কাসাসুল-কুরআনী, দারুল কালাম, দিমাশক, ১ম সং. ১৪১০/১৯৯০, পৃ. ৫৫-১৪৩; (৩৪) মাহমূদ যাহরান, কাসাসুল-কুরআন, দারুল-কিতাব আল-আরাবী, মিসর, ১ম সং, ১৩৭৫/১৯৫৬ খৃ., ৪৭-৭৯; (৩৫) মুহাম্মাদ আহমাদ জাদুল-মাওলা ও অন্যান্য, কাসাসুল-কুরআন, দারুল-জীল, বৈরূত তা. বি., পৃ. ৩২-৪৯; (৩৬) হিফজুলরাহমান সিউহারবী, কাসাসুল কুরআন, ১খ, ১৫১-২২৩।
বিবিধ : (৩৭) আল-বাকরী আল-আনদালুসী, মুজামু মাস্তাজাম, ‘আলামুল-কুতুব, বৈরূত, অন্যান্য, ৩য় সং. ১৪০৩/১৯৮৩, ৪খ, ১১৩৯; (৩৮) ইয়াকূত আল-হামাবী, মুজামুল-বুলদান, দার সাদির, বৈরূত ১৩৭৬/১৯৫৭, ৪খ, ৪৮৭; (৩৯) আস-সুহায়লী, আর-রাওদুল-উনুফ, দারুন-নাসর, কায়রো, ১ম সং. ১৩৮৭/১৯৬৭, ১খ, ৭৪-৭৫; (৪০) বুরুস আল-বুসতানী, দাইরাতুল মাআরিফ, দারুল-মারিফা, বৈরূত তা, বি., ১খ, ২৪৪-২৪৫; (৪১) মাওসূআ ‘আব্বাস মাহমূদ আল-”আকাদ, দারুল-কিতাব আল-আরাবী, বৈরূত-লেবানন, ১ম সং. ১৯৭০ খৃ., পৃ. ৩১৯-৫৩৮; (৪২) আল-মাওসূআতুল- ‘আরবিয়্যা আল-আলামিয়্যা, মাকতাবা আল-মালিক ফাহদ আল-ওয়ানিয়া, রিয়াদ, ১ম, সং. ১৪১৬/১৯৯৬, ১খ, ৫৯-৬০; (৪৩) মুহাম্মাদ মুরতাদা আয-যাবীদী, তাজুল-আরূস, দার সাদির, বৈরূত ১৩৮৬/১৯৬৬, ৩খ, ১১; (৪৪) Bible, Genesis, স্থা.; (৪৫) বাংলা অনু, পবিত্র বাইবেল, আদিপুস্তক; (৪৬) The Encyclopedia of Religion, Macmillan publishing Co., New York 1993, vol. 1, P. 13-17; (47) The New Encyclopedia of Britannica, U.S.A. 1995, vol. 1, 36-37; (48) Encyclopedia Americana, U.S.A. 1972, vol. 1, 45; (49) Jewish Encyclopedia, New York 1901, vol. 1, 83-91; (50) Colliers Encyclopedia, Crowell Collier and Macmillan, Ine., 1966, vol. 1, 26; (51) The New Caxton Encyclopedia, The caxton publishing Co. Ltd., London 1977, vol. 1, 11; (52) Everymans Encyclopaedia, 6Th. ed., J.M. Dent Ltd., London- Melbourne- Toronto 1978, vol. 1, 29-30; (53) The new book of Knowledge, Grolier incorporcted. New York 1979, vol. 17; (54) Encyclopedia Italiana, Roma 1949, vol. I, 115-116; (55) E. I, E. J. Brill, Leiden 1971, vol. 1, 980-981; (৫৬) ইসলামী বিশ্বকোষ, ইফাবা, ঢাকা ১৯৮৫ খৃ., ৪খ, ৩৭৯-৩৮৪।
আবদুল জলীল