হযরত আদম (আ)

হযরত আদম (আ)

উপক্রমণিকা

হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম একাধারে মানবজাতির আদি পিতা, এই পৃথিবীতে আল্লাহ তাআলার প্রেরিত খলীফা (প্রতিনিধি) এবং প্রথম নবী ও রাসূল। মানবজাতির এবং নবুওয়াত ও রিসালাতের সূচনা হয় তাহার মাধ্যমে। তাঁহার বংশধর হিসাবেই মানুষকে আরবী, উর্দু, ফার্সী প্রভৃতি ভাষায় ‘আদমী নামে অভিহিত করা হইয়া থাকে।

নবী-রাসূলগণ যেহেতু শিষ্টাচার ও সভ্যতারই পয়গামবাহক, তাই আদম (আ)-কে মানব সভ্যতারও পথিকৃতরূপে অভিহিত করা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত। তাঁহার জীবনেতিহাস আলোচনাকালে যথাস্থানে বরাতসহ তাহা বিবৃত হইবে। অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবে বিশ্ব সৃষ্টির সূচনা সম্পর্কে প্রথমে আলোচনা করা হইল।

বিশ্ব সৃষ্টির বিবরণ

আল্লাহ তাআলার মহান সত্তা যেমন একক লা-শরীক, তেমনি তাঁহার গুণাবলীতেও তিনি অনন্য। তাঁহার অসংখ্য গুণবাচক নামসমূহের একটি হইতেছে : কোনরূপ পূর্ব নমুনা ব্যতীতই সম্পূর্ণ লূতনভাবে উদ্ভাবনকারী, যাহার সৃষ্টিকর্মে কোনরূপ উপায়-উপকরণ বা যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয় না। আল্লামা রাগিব ইস্পাহানী তদীয় বিখ্যাত মুফরাদাতুল কুরআনে লিখিয়াছেন :

“কোনরূপ পূর্ব নমুনার অনুকরণ-অনুসরণ ব্যতিরেকে উদ্ভাবন করাকে ইবদা বলা হয়।”

“আর বাদী শব্দটি যখন আল্লাহর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় তখন এই অর্থ হয় সেই সত্তা যিনি কোন যন্ত্রপাতি, উপায়-উপকরণ, স্থান-কাল-পাত্র ব্যতিরেকেই সৃষ্টি করিয়াছেন, অস্তিত্বে আনয়ন করিয়াছেন” (মুফরাদাত)।

একই অর্থে আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমে নিজের সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ

“আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর স্রষ্টা এবং যখন তিনি কোন কিছু করিতে সিদ্ধান্ত করেন তখন উহার জন্য শুধু বলেন, ‘হও’ আর অমনি উহা হইয়া যায়” (২: ১১৭)।

বিশ্ব সৃষ্টি সংক্রান্ত কুরআনুল কারীমের আয়াতসমূহ পর্যালোচনা করিলে ইহার দ্বিবিধ তত্ত্ব পাওয়া যায়। কোন কোন আয়াতের দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ প্রথমে পৃথিবী সৃষ্টি করিয়া তারপর আকাশমণ্ডলী সৃষ্টি করেন। যেমন :

“তিনি পৃথিবীর সবকিছু তোমাদের জন্য সৃষ্টি করিয়াছেন। তৎপর তিনি আকাশের দিকে মনসংযোগ করেন এবং উহাকে সপ্ত আকাশে বিন্যস্ত করেন; তিনি সর্ববিষয়ে সবিশেষ অবহিত।” (২ : ২৯)।

“যিনি পৃথিবী ও সমুচ্চ আকাশমণ্ডলী সৃষ্টি করিয়াছেন তাহার নিকট হইতে উহা (কুরআন) অবতীর্ণ” (২০ : ৪)।

“বল, তোমরা কি তাঁহাকে অস্বীকার করিবেই যিনি পৃথিবী সৃষ্টি করিয়াছেন দুই দিনে এবং তোমরা তাঁহার সমকক্ষ দাঁড় করাইতেছ? তিনি তো জগৎসমূহের প্রতিপালক। তিনি স্থাপন করিয়াছেন অটল পর্বতমালা ভূ-পৃষ্ঠে এবং উহাতে রাখিয়াছেন কল্যাণ এবং চারিদিনের মধ্যে উহাতে ব্যবস্থা করিয়াছেন খাদ্যের সমভাবে যাাকারীদের জন্য। অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করেন যাহা ছিল ধুম্রপুঞ্জবিশেষ। অনন্তর তিনি উহাকে ও পৃথিবীকে বলিলেন, তোমরা উভয়ে আস (আল্লাহর বিধানের অনুগত হইয়া) ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়। ইহারা বলিল, আমরা আসিলাম অনুগত হইয়া । অতঃপর তিনি আকাশমণ্ডলীকে দুই দিনে সপ্তাকাশে পরিণত করিলেন এবং প্রত্যেক আকাশে উহার বিধান ব্যক্ত করিলেন এবং আমি নিকটবর্তী আকাশকে সুশোভিত করিলাম প্রদীপমালা দ্বারা এবং করিলাম সুরক্ষিত। ইহা পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ আল্লাহর ব্যবস্থাপনা” (৪১ : ৯-১২)।

“আমি কি করি নাই ভূমিকে শয্যা ও পর্বতসমূহকে কীলকঃ আমি সৃষ্টি করিয়াছি তোমাদেরকে জোড়ায় জোড়ায়। তোমাদের নিদ্রাকে করিয়াছি বিশ্রাম এবং রাত্রিকে করিয়াছি আবরণস্বরূপ এবং দিবসকে করিয়াছি জীবিকা আহরণের সময়। আর আমি নির্মাণ করিয়াছি তোমাদের ঊর্ধ্বদেশে সুস্থিত সপ্ত আকাশ এবং সৃষ্টি করিয়াছি প্রোজ্জ্বল দীপ এবং বর্ষণ করিয়াছি মেঘমালা হইতে প্রচুর বারি, যাহাতে তদ্বারা আমি উৎপন্ন করি শস্য, উদ্ভিদ ও ঘন সন্নিবিষ্ট উদ্যান” (৭৮ ও ৬-১৬)।

“নিশ্চয় তোমার প্রতিপালক মহাস্রষ্টা মহাজ্ঞানী” (১৫ : ৮৬; আরো দ্র. ৩৬ : ৮১)।

“পৃথিবীর সবকিছুই তিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করিয়াছেন” (২ : ২৯)।

আবার বহু আয়াতে আকাশরাজি সৃষ্টির কথা প্রথমে উল্লিখিত হইয়াছে যাহাতে ধারণা হইতে পারে যে, আকাশমালাই পৃথিবীর পূর্বে সৃষ্টি হইয়াছে। যেমন :

“সকল প্রশংসা আল্লাহরই যিনি আকাশমণ্ডলী ও যমীন সৃষ্টি করিয়াছেন, আর সৃষ্টি করিয়াছেন অন্ধকার ও আলো” (৬১)।

“তিনিই যথাবিধি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করিয়াছেন” (৬ ও ৭৩)।

“তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেন; অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন। তিনিই দিবসকে রাত্রি দ্বারা আচ্ছাদিত করেন যাহাতে উহাদের একে অন্যকে দ্রুত গতিতে অনুসরণ করে, আর সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্ররাজি, যাহা তাঁহারই আজ্ঞাধীন তাহা তিনিই সৃষ্টি করিয়াছেন। জানিয়া রাখ, সৃজন ও আদেশ তাঁহারই। মহিমময় বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহ্” (৭ : ৫৪; আরও দ্র. ১১ : ৭; ১৪ ও ১৯ ও ৩২; ২৫ : ৫৯; ২৭ ও ৬; ২৯ ও ৪৪; ৩৬ : ৮১; ৩০ ও ৮; ৩৯ ও ৩৮, ৪৫ ও ২২, ৫৭ ও ৪; ৬৪ ও ৩; ৬৫ : ১২ ইত্যাদি)।

এখানে ছয় দিনে সৃষ্টি সংক্রান্ত আয়াতসমূহের দিন (I) শব্দটির ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণ ইহা যে দুনিয়ার ২৪ ঘন্টার দিন নহে তাহা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করিয়াছেন (দ্র. ই.ফা. প্রকাশিত আল-কুরআনুল কারীম ৭ : ৫৪-এর টীকায়, পৃ. ২৩৪)।

আল-কুরআনের সূরা হজ্জে বলা হইয়াছে ।

“তোমাদের প্রতিপালকের নিকট একদিন তোমাদের গণনার সহস্র বৎসরের সমান” (২২ : ৪৭)। অন্য আয়াতে বলা হইয়াছে :

“এমন একদিনে যাহার পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার বৎসর” (৭০:৪)।

বলা বাহুল্য, সূরা আরাফ (৭ : ৫৪)-এ ছয় দিনে সৃষ্টি সংক্রান্ত আয়াতের টীকায় মাওলানা আবদুল মাজেদ দরিয়াবাদী ‘প্রাক-সৃষ্টি যুগের সেই দিনগুলি যে আমাদের কয়েক ঘন্টার পৃথিবী ও সূর্যের গতি ভিত্তিক দিন ছিল না, তাহাই বলিয়াছেন।

আল্লামা ইউসুফ আলীও তদীয় কুরআন অনুবাদের টীকায় (১৯৩৪ সালে প্রকাশিত) ইয়াওম বলিতে দিন বুঝাইবার উপর গুরুত্ব আরোপ করিয়াও শেষ পর্যন্ত ছয় দিন বলিতে সৃষ্টির বিবর্তনের সুদীর্ঘ ছয়টি মেয়াদ বুঝানো হইয়াছে বলিয়া তিনিও মন্তব্য করিয়াছেন।

আল্লামা ইবন কাছীর (মৃ. ৭৭৪ হি.) আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া গ্রন্থে বলেন, তাফসীরকারগণ উক্ত ছয় দিনের পরিমাণ সম্পর্কে দ্বিবিধ মতামত প্রকাশ করিয়াছেন। জমহুর মুফাসসিরীন ঐ দিনগুলো আমাদের প্রাত্যহিক ছয়দিন বলিয়া মনে করেন। অপরদিকে ইবন আব্বাস, মুজাহিদ, দাহহাক, কাব আহবার উহাকে আমাদের দিবস হিসাবে এক হাজার বৎসরের এক এক দিন বলেন। ইবন জারীর ও ইবন আবী হাতিম এই রিওয়ায়াতসমূহ বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (র) জাহমিয়াদের বিরুদ্ধে লিখিত গ্রন্থে এই মতের প্রতি সমর্থন জানাইয়াছেন। ইব্‌ন জারীর এবং পরবর্তী যুগের কিছু সংখ্যক আলিমও এই মতের সমর্থক (১খ, পৃ. ১২)।

মুফতী মুহাম্মদ শফী (র) বলেন : “বিশ্ব সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহ তাআলার কাছে দিবারাত্রির পরিচয়ের অন্য কোন লক্ষণ নির্দিষ্ট থাকিতে পারে। যেমন জান্নাতের দিবারাত্রি সূর্যের পরিক্রমণ অনুযায়ী হইবে না” (মাআরিফুল কুরআন, সংক্ষেপিত, পৃ. ৪৪৫, মদীনা মুনাওয়ারা সং.)।

বিশুদ্ধ রিওয়ায়ত অনুযায়ী, যে ছয় দিনে জগত সৃষ্টি হইয়াছে উহা রবিবার হইতে শুরু করিয়া শুক্রবার শেষ হয়, শনিবারে জগৎ সৃষ্টির কাজ হয় নাই (ইব্‌ন কাছীর)।

সূরা হা-মীম সাজদার (৪১) নবম ও দশম আয়াতে দুইদিনে ভূমণ্ডল সৃষ্টি এবং দুই দিনে পাহাড়-পর্বত, সাগরমালা, খনি, উদ্ভিদ, মানুষ, জীব-জানোয়ার সৃষ্টির কথা বলা হইয়াছে। যেমন :

“তিনি পৃথিবী সৃষ্টি করিয়াছেন দুই দিনে” (৫১ : ৯)।

“ইহাতে খাদ্যের ব্যবস্থা করিয়াছেন চারি দিনে” (৪১ : ১০)।

যে দুই দিনে ভূমণ্ডল সৃষ্টি করা হইয়াছে উহা ছিল রবিবার ও সোমবার, দ্বিতীয় যে দুই দিনে ভুমণ্ডলের সাজ-সরঞ্জাম, পাহাড় পর্বত, নদ-নদী ইত্যাদি সৃষ্টি করা হয় তাহা ছিল মঙ্গল ও বুধবার।

“অতঃপর তিনি আকাশমণ্ডলীকে দুই দিনে সপ্তাকাশে পরিণত করিলেন” (৪১ ও ১২)। বলাবাহুল্য, এই দুই দিন হইবে বৃহস্পতি ও শুক্রবার। ইব্‌ন জারীর সৃষ্টি শুরুর প্রথম দিন সম্পর্কে মুহাম্মাদ ইব্‌ন ইসহাকের বরাতে বলেন।

“তাওরাতপন্থীরা (অর্থাৎ ইয়াহুদীরা) বলে, আল্লাহ সৃষ্টি শুরু করেন রবিবারে। ইনজীল অনুসারী খৃস্টানরা বলে, আল্লাহ সৃষ্টি শুরু করেন সোমবারে। আমরা মুসলমানগণ বলি, আল্লাহ্ সৃষ্টি শুরু করেন শনিবার দিন, যেমনটি রাসূলুল্লাহ্ (সা) হইতে আমাদের নিকট পর্যন্ত তথ্য পৌঁছিয়াছে।”

ইমাম ইব্‌ন কাছীর সাহাবী আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর হাদীছও উদ্ধৃত করিয়াছেন যাহাতে বলা হইয়াছে ।

“আল্লাহ্ তাআলা শনিবারে মাটি সৃষ্টি করেন” (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, পৃ. ১২)। তারপর তিনি লিখেন?

“সুতরাং সৃষ্টিকার্য ছয় দিনেই সম্পন্ন হয় এবং ঐদিনগুলোর শেষ দিন ছিল শুক্রবার। এই জন্য মুসলমানগণ উহাকে সাপ্তাহিক ঈদরূপে গ্রহণ করে- যে দিনটি হইতে আমাদের পূর্বেকার আহলে কিতাবকে আল্লাহ্ বিচ্যুত করিয়া দিয়াছিলেন” (পূ. এ/১খ, পৃ. ১৩)।

সৃষ্টির সূচনা সম্পর্কিত এই বিবরণটি ঈষৎ গরমিলসহ বাইবেলে বর্ণিত হইয়াছে (তু. পবিত্র বাইবেল, পুরাতন ও লূতন নিয়ম, বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি, আদি পুস্তক)। এখানে প্রশ্ন জাগিতে পারে, সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ যেখানে কুন (বা হও) বলমাত্র সব কিছু হইয়া যায়, সেখানে সৃষ্টি কার্যে এই ছয় দিন বা ছয়টি বিশাল মেয়াদকাল অতিবাহিত হইল কেন? হযরত সাঈদ ইবন জুবায়র (র) এই সম্পর্কে বলেন :

“মহান আল্লাহ্ তাআলা স্বীয় কুদরতে নিঃসন্দেহে এক নিমেষে সবকিছু সৃষ্টি করিতে পারেন, কিন্তু মানুষকে বিশ্বব্যবস্থা পরিচালনায় ধারাবাহিকতা ও কর্মসম্পৰ্কতা শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যেই হইতে ছয় দিন ব্যয় করা হইয়াছে [মাআরিফুল কুরআন (সংক্ষেপিত), পৃ. ৪৪৫]।

সূরা আম্বিয়ার একটি আয়াত হইতে প্রতীয়মান হয় যে, পৃথিবী ও আকাশমণ্ডলী প্রথমে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে একত্রে মিশিয়া ছিল। আল্লাহ্ তাআলা বলেন :

“যাহারা কুফরী করে তাহারা কি ভাবিয়া দেখে না যে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী মিশিয়াছিল ওৎপ্রোতভাবে, অতঃপর আমি উভয়কে পৃথক করিয়া দিলাম এবং প্রাণবান সমস্ত কিছু সৃষ্টি করিলাম পানি হইতে, তবুও কি উহারা ঈমান আনিবে না” (২১:৩০)

সৃষ্টির বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্র. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ।

আদম (আ) পৃথিবীর আদি মানব

হযরত আদম (আ) যে পৃথিবীর আদি মানব এবং সমগ্র মানব জাতির আদি পিতা তাহা কুরআন করীমের বিভিন্ন আয়াত ও মহানবী (স)-এর হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। যেমন আল্লাহ্ তাআলা বলেন :

“আল্লাহর নিকট নিশ্চয়ই ঈসার দৃষ্টান্ত আদমের দৃষ্টান্ত সদৃশ। তিনি তাহাকে মৃত্তিকা হইতে সৃষ্টি করিয়াছিলেন, অতঃপর তাহাকে বলিয়াছিলেন, ‘হও, ফলে সে হইয়া গেল” (৩ : ৫৯)।

অর্থাৎ আদম (আ) পিতা ও মাতা ব্যতীতই আল্লাহর কুদরতে সৃষ্ট, সরাসরি মাটি হইতে। আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেন ।

“তিনিই তোমাদেরকে এক বক্তি হইতে সৃষ্টি করিয়াছেন ও উহা হইতে তাহার স্ত্রী সৃষ্টি করেন, যাহাতে সে তাহার নিকট শান্তি পায়” (৭ : ১৮৯)।

অন্য আয়াতে তাঁহার স্ত্রী হাওয়াকেও তাঁহারই দেহ হইতে সৃষ্টির উল্লেখ করিয়া আল্লাহ তাআলা বলেন :

“হে মানব! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি হইতেই সৃষ্টি করিয়াছেন এবং যিনি তাহা হইতে তাহার স্ত্রী সৃষ্টি করেন, যিনি তাহাদের দুইজন হইতে বহু নরনারী ছড়াইয়া দেন” (৪ : ১)।

উক্ত আয়াতের পাদটীকায় তাফসীর উছমানীতে বলা হইয়াছে :

হযরত আদম (আ) হইতে প্রথমে হযরত হাওয়াকে তাঁহার বাম পাঁজর হইতে সৃষ্টি করেন। তারপর তাঁহাদের দুইজন হইতে সমস্ত নরনারী সৃষ্টি করিয়া বিশ্বব্যাপী ছড়াইয়া দেন। ফলে মূলত এক অভিন্ন প্রাণ ও ব্যক্তি হইতেই আল্লাহ্ তাআলা সমস্ত মানবজাতিকে সৃষ্টি করিয়াছেন (তাফসীরে উছমানী, পৃ. ৫৮)।

প্রায় ঐ একইরূপ বক্তব্য আসিয়াছে অন্য আয়াতে?

“হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করিয়াছি এক পুরুষ ও এক নারী হইতে, পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করিয়াছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাহাতে তোমরা একে অপরের সহিত পরিচিত হইতে পার” (৪৯ ও ১৩)।

সুতরাং পৃথিবীর তাবৎ মানবই যে একই ব্যক্তি ও এক অভিন্ন দম্পতি হইতে বিশ্বব্যাপী বিস্তার লাভ করিয়াছে এবং তাহাদের আদি পিতা আদম (আ), তাহা কুরআন শরীফের বর্ণনা হইতে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। আল্লাহ্ তাআলা বিভিন্ন আয়াতে মানবজাতিকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বনী আদম বা আদম-সন্তান বলিয়া সম্বোধন করিয়াছেন (দ্র. ৭ : ২৭, ৩১, ৩৫, ৩৬ ও ৬০-৬১)।

শাফাআত সংক্রান্ত হাদীছে রহিয়াছে, কিয়ামতের দিন সমবেত মানবমণ্ডলী আদম (আ)-এর নিকট গিয়া আবেদন করিবে?

“হে আদম! আপনি মানবজাতির আদি পিতা। আল্লাহ্ তাআলা আপনাকে স্বহস্তে সৃষ্টি করিয়াছেন। তাঁহার পক্ষ হইতে ‘রূহ আপনার মধ্যে ফুঁকিয়া দেন। তাঁহার ফেরেশতাকূল দিয়া আপনাকে সিজদা করাইয়াছেন। তাঁহার জান্নাতে আপনাকে বাস করিতে দিয়াছেন। আমরা কী মহাসংকটে রহিয়াছি তাহা কি আপনি লক্ষ্য করিতেছেন না? আপনি কি আপনার প্রতিপালকের দরবারে আমাদের জন্য সুপারিশ করিবেন না”? (বুখারী, ১খ, পৃ. ৪৭০, পারা-১৩, কিতাবুল আম্বিয়া, আদম ও তদীয় বংশধরগণের সৃষ্টি সংক্রান্ত অধ্যায়)। আল-কুরআনে আদম (আ) প্রসঙ্গ

মানব সৃষ্টি আর আদম (আ)-এর সৃষ্টির কথা আল-কুরআনের বর্ণনায় মূলত এক ও অভিন্ন ব্যাপার। কেননা, কুরআন তথা আসমানী সমস্ত কিতাবের বক্তব্য অনুযায়ী হযরত আদম (আ)-ই হইতেছেন প্রথম মানব। কুরআন শরীফের পঁচিশটি স্থানে আদম শব্দটি ব্যবহৃত হইয়াছে। যেমন ৪ ২ : ৩১, ৩৩, ৩৪, ৩৫ ও ৩৭; ৩ : ৩৩, ৫৯; ৫ : ২৭; ৭ : ১১, ১৯, ২৬, ৩১, ৩৫ ও ১৭২; ১৭ : ৬১ ও ৭০; ১৮৫০; ৯ : ৫৮; ২০ : ১১৫, ১১৬, ১১৭, ১২০ ও ১২১; ৩৬ : ৬০।

আদিপুস্তক

উক্ত আয়াতসমূহে তাহার সৃষ্টির বিবরণ, সৃষ্টির উপাদান, সৃষ্টির উদ্দেশ্য, তাহাকে সৃষ্টির ব্যাপারে আল্লাহ্ তাআলার ফেরেশতাদের নিকট ঘোষণা দান, ফেরেশতাগণের উক্তি ও সে ব্যাপারে আল্লাহ্ তাআলার জবাব, আল্লাহ্ পাক কর্তৃক আদম (আ)-কে জ্ঞান ও মর্যাদা দান, আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতাগণ কর্তৃক আদম (আ)-কে সিজদা করা ও ইহাতে আযীলের অস্বীকৃতি, কুযুক্তি উত্থাপন এবং পরিণামে বিতাড়িত শয়তানে পরিণত হওয়া, আদম (আ)-এর জান্নাতে অবস্থান ও সঙ্গীরূপে স্ত্রী হাওয়াকে লাভ, শয়তানের প্ররোচনায় জান্নাতে আদম ও হাওয়া দম্পতির নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ ও পরিণামে জান্নাত হইতে পৃথিবীতে অবতরণ, তাঁহাদের তওবা কবুল হওয়া, তাহাদের বংশবিস্তার, হাবীল-কাবীলের দ্বন্দ্ব ও তাহাদের কুরবানী, কাবীল কর্তৃক হাবীলকে হত্যা প্রভৃতি প্রসঙ্গ বর্ণিত হইয়াছে।

আদম (আ)-এর নাম সম্পর্কে

আদম শব্দটির আরবী বা অনারবী হওয়া সম্পর্কে মতভেদ রহিয়াছে। সর্বাধিক প্রসিদ্ধ অভিমত হইল উহা হিব্রুভাষায় ৬১। শব্দ হইত গৃহীত- যাহার অর্থ পৃথিবী। কেননা, পৃথিবীর মাটি হইতে তিনি সৃষ্ট (দায়েরাতুল মাআরিফ, আরবী, ১খ, পৃ. ৪৫)। আবু মনসূর জাওয়ালি বলেন, আদম, সালিহ, শুআয়ব ও মুহাম্মাদ (সা) ব্যতীত সকল নবীর নামই অনারবী।

জাওহারী বলেন, আদম শব্দটি আরবী (দায়েরাতুল মাআরিফিল ইসলামিয়া = আরবী ইসলামী বিশ্বকোষ, দ্র. আদম প্রসঙ্গ)।

ইমাম আবু জাফর তাবারী (র) বলেন, হযরত ইবন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন : মহান আল্লাহ ফেরেশতা আযরাঈল (আ)-এক পৃথিবীতে পাঠাইলেন। তিনি পৃথিবীর উপরিভাগের যে মাটি লইয়া যান উহা দ্বারাই আদম (আ)-কে সৃষ্টি করা হয়। পৃথিবীর উপর আস্তরণ বা ভূ-ত্বককে যেহেতু আরবীতে ১ (আদীম) বলা হইয়া থাকে, সে জন্য তাহার নামকরণ করা হয় আদম (l)।

সাঈদ ইবন জুবায়র (রা)-ও বলেন, আদম (আ)-কে যেহেতু আদীমুল আরদ (ভূত্বক) হইতে সৃষ্টি করা হয় এই জন্যই তাহার নাম আদম রাখা হয়।

হযরত আলী (রা) বলেন, আদম (আ)-কে সৃষ্টি করা হয় আদীম বা ভূ-ত্বক হইতে। তাহাতে উত্তম-অধম, কল্যাণকর ও অকল্যাণকর সবকিছুই ছিল। এই জন্যই তুমি আদম সন্তানদের মধ্যে বিভিন্নতা দেখিতে পাও। তাহাদের মধ্যকার কেহ বা পুণ্যবান ও কল্যাণকর, আবার কেহ পাপাচারী ও অকল্যাণকর (তাফসীরে তাবারী, আরবী), (সূরা বাকারার ৩১নং আয়াতের তাফসীর)। রাগিব ইসফাহানী বলেন,

“আদম-মানবজাতির আদি পিতা, তাহার এইরূপ নামকরণের কারণ হইল তাহার দেহ আদীমুল আরদ বা ভূ-ত্বক হইতে সৃষ্ট। আবার কেহ কেহ বলিয়াছেন : তাঁহার দেহের,১/ বা গো-ধুম বর্ণের জন্য তাহার এইরূপ নামকরণ করা হইয়াছে (আল-মুফরাদাত ফী গারীবিল কুরআন, পৃঃ ১৪, দ্র. আদম, দারুল-মারিফা, কায়রো)।

কেহ কেহ আবার আদম শব্দটি ১। (আদম) অথবা a১। শব্দ হইতে গৃহীত বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। উহার অর্থ সমন্বিত ও সংমিশ্রিত। এই অর্থ দ্বারা আদম (আ)-এর মধ্যে বিভিন্ন শক্তি ও উপাদানের সমন্বয় ও সংমিশ্রণ ঘটিয়াছে বুঝায়। কেননা মাটি ও পানির মিশ্রণে তাহার খামীর প্রস্তুত করা হইয়াছিল।

কেহ কেহ আবার [ ] শব্দটি [ ] শব্দ হইতে উদ্ভূত বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। ইহার অর্থ অনুসরণযোগ্য। কিন্তু যামাখশারী শব্দটি আরবী বলিলেও নিম্নোক্ত কারণে শব্দটি অনারব বলিয়া প্রতীয়মান হয়। শব্দটির বহুবচন ১ll এবং ইহার বা ক্ষুদ্রত্ববোধকরূপ দ্বারা ইহাই প্রতিপন্ন হয় যে, শব্দটি অন-আরবী, অন্যথায় উভয়রূপেই আদ্যাক্ষর অপরিবর্তিত থাকিত।

হিব্রু ভাষায় [ ] শব্দের অর্থ মানবজাতি। ফিনিশীয় এবং সাবাঈ ভাষায়ও শব্দটির একই রূপ। ইংরেজী সাহিত্য ও অন্যান্য ভাষায় [ ] ও [ ] শব্দ ইন্জীল এবং তাওরাতের মাধ্যমে প্রচলিত হইয়াছে। বাইবেলের আদিপুস্তকে উল্লিখিত আছে যে, আদম তাহার স্ত্রীর নাম [ ] এই জন্য রাখিয়াছিলেন যে, তিনি জীবকূলের মাতা (আরও দ্র. হিব্রু, বিশ্বকোষ, হাওওয়া নিবন্ধ)। এবং [ ]–এর অর্থ যে কোন বিষয়ের জন্মদাতা, গোত্র বা জাতির বড় নেতা এবং আদি পুরুষ।যেমন দক্ষিণাত্যের ওয়ালী উর্দু কবিদের বাবা আদম ছিলেন। আরও তু. ১৮৮৪, পৃ. ৩৯৬। (দ্র. ইসলামী বিশ্বকোষ, ইফা প্রকাশিত, ১খ, নিবন্ধ আদম, পৃ. ২৪)।

আদম সৃষ্টির উদ্দেশ্য

কুরআন শরীফের সূরা বাকারায় সর্বপ্রথম যেখানে আদম (আ) সৃষ্টি প্রসঙ্গটি উল্লিখিত হইয়াছে সেখানেই তাঁহার সৃষ্টির উদ্দেশ্য আল্লাহ তাআলা সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করিয়াছেন। আল্লাহ্ তাআলা বলেন :

“(স্মরণ কর সে সময়ের কথা), যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদেরকে বলিলেন, আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করিতেছি” (২ :৩০)।

ইমাম তাবারী বলেন, এই আয়াতের অর্থ হইল, আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি প্রেরণ করিব। এই ব্যাখ্যা হাসান ও কাতাদার অভিমতের সহিত অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ। ইবন আব্বাস (রা) বলেন, পৃথিবীর প্রথম বাসিন্দা ছিল জিন্ন জাতি। তাহারা এখানে ফিঙ্গা-ফাসাদ, হানাহানি ও খুন-খারাবীতে লিপ্ত হইল। তখন আল্লাহ তাআলা তাহাদের শাস্তি বিধানের জন্য ফেরেশতাদের একটি বাহিনীসহ ইবলীসকে পাঠাইলেন। ইবলীস ও তাহার সাথী ফেরেশতাগণ তাহাদেরকে হত্যা করিল এবং বিভিন্ন সাগরের দ্বীপে ও পাহাড়-পর্বতে তাড়াইয়া দিল। অতঃপর আল্লাহ্ তাআলা আদমকে সৃষ্টি করিয়া তাহাকে ও মানবজাতিকে তাহাদের স্থলাভিষিক্ত করিলেন। সেই হিসাবে উক্ত আয়াতের অর্থ দাঁড়ায়? আমি পৃথিবীতে জিন্ন জাতির স্থলাভিষিক্ত সৃষ্টি করিব- যাহারা তাহাদের স্থলাভিষিক্ত হইয়া পৃথিবীতে বসবাস করিবে এবং তাহা আবাদ করিবে।

ইব্‌ন যায়দ-এর সূত্রে ইউনুস (র) বর্ণনা করেন, আল্লাহ্ পাক ফেরেশতাগণকে বলিলেন : আমি মনস্থ করিয়াছি পৃথিবীতে এমন একটি লূতন জাতি সৃষ্টি করিব যাহারা পৃথিবীতে আমার খলীফা (প্রতিনিধি) হইবে। ঐ সময় ফেরেশতাগণ ছাড়া আল্লাহর আর কোন মাখলুক ছিল না বা পৃথিবীতে অন্য কোন সৃষ্ট জীবও ছিল না। আল্লাহ পাক ফেরেশতাগণকে খবর দিয়াছিলেন যে, তিনি পৃথিবীতে তাঁহার খলীফা সৃষ্টি করিবেন। তাহারা সেখানে তদীয় সৃষ্টিকূলের মধ্যে আত্মাহ পাকের বিধান কার্যকরী করিবে।

 ইব্‌ন মাসউদ (রা) প্রমুখ সাহাবী হইতে বর্ণিত আছে যে, ঐ খলীফার প্রকৃতি কী হইবে ফেরেশতাগণের এইরূপ প্রশ্নের জবাবে আল্লাহ্ তাআলা বলিলেন : তাহার কতক সন্তান এমনও হইবে যাহারা পৃথিবীতে ফিন্যা-ফাসাদ, হিংসা-বিদ্বেষ ও হানাহানি, খুনাখুনিতে লিপ্ত হইবে।

ইবন মাসউদ (রা) হইতে উদ্ধৃত উক্ত রিওয়ায়াত অনুসারে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা হইবে, আমি পৃথিবীতে আমার মাখলুকসমূহের মধ্যে আইব্‌ন পরিচালনার্থ আমার খলীফা নিয়োগ করিব। সেই খলীফা হইবে আদম এবং তাহার সেই সব সন্তানরা যাহারা আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করিবে এবং সৃষ্টিকূলের মধ্যে ইব্‌নসাফ কায়েম করিবে। তবে ফাসাদ সৃষ্টি ও অন্যায় কার্যাদি সংঘটিত হইবে খলীফা ভিন্ন অন্য আদম সন্তানদের দ্বারা। আল্লাহ্ তাআলা ফেরেশতাগণের প্রশ্নের উত্তরে বলিয়াছেন ও খলীফার বংশধরদের মধ্যকার একটি অংশ ফিত্না-ফাসাদ, বিদ্বেষ, হানাহানি ও খুনাখুনিতে লিপ্ত হইবে। এখানে লক্ষ্যণীয়, এই জবাবে ফিত্না-ফাসাদ, হানাহানি ও খুনাখুলির সহিত খলীফার বংশধরদের একাংশকেই কেবল সম্পৃক্ত করা হইয়াছে, স্বয়ং খলীফাঁকে বা তদীয় সৎকর্মশীল বংশধরগণকে এই অপবাদ হইতে আল্লাহ্ তাআলা মুক্ত রাখিয়াছেন (তাফসীর তাবারী, ১খ, সূরা বাকারার ৩০তম আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে)। তাফসীরে মাআলিমুত-তানযীলের ভাষায় খলীফা প্রেরণের উদ্দেশ্য : সেই নতুন সৃষ্টি হইবে পৃথিবীতে তাঁহার প্রতিনিধিস্বরূপ, যাহাতে সে তাহার বিধান কার্যকরী করে এবং তাহার ফয়সালাসমূহকে বাস্তবায়িত করিতে পারে।

এতদসংক্রান্ত মওলানা আবদুল মাজেদ দরিয়াবাদীর ব্যাখ্যামূলক পাদটীকা প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেন,

“মনে রাখতে হবে যে, দুনিয়ায় কোন ধর্মই মাটির মানুষকে আল্লাহর খিলাফত ও প্রতিনিধিত্বের মত এমন সুমহান মর্যাদায় অভিষিক্ত করেনি। জাহেলী ধর্ম ও মতবাদের কথাতো বলাই বাহুল্য, খোদ ইহুদী ধর্ম এবং তার বিকৃত সংস্করণ তথা খৃষ্ট ধর্মও এক্ষেত্রে ইসলাম থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। এ প্রসঙ্গে বাইবেলে শুধু বলা হয়েছে- সদাপ্রভু ঈশ্বর পৃথিবীতে বৃষ্টি বর্ষান নাই, আর পৃথিবীতে কৃষিকর্ম করিতে মনুষ্য ছিল না। আর পৃথিবী হইতে কুজ্জটিকা উঠিয়া সমস্ত ভূতলকে জলসিক্ত করিল। আর সদাপ্রভু ঈশ্বর মৃত্তিকার ধূলিতে আদমকে (অর্থাৎ মনুষ্যকে) নির্মাণ করিলেন এবং তাহার নাসিকায় ফুঁ দিয়া প্রাণ বায়ু প্রবেশ করাইলেন। তাহাতে মনুষ্য সজীব প্রাণী হইল (আদি পুস্তক ২ : ৫-৭)।

“যেন অন্যান্য প্রাণী যেভাবে অস্তিত্ব লাভ করেছিল, আদম নামের এক প্রাণীও অনুরূপ অস্তিত্ব লাভ করল। বেশীর চেয়ে বেশী তার কর্ম ছিল ভূমি কর্ষণ। কোথায় সুদীর্ঘ ও অন্তঃসারশূন্য এ বিবরণ যেখানে মানুষকে আবদ্ধ করা হয়েছে হালচাষের সংকীর্ণ গণ্ডীতে আর কোথায় কুরআনের সংক্ষিপ্ত সারগর্ভ ও সর্বাঙ্গীন বিবরণ যেখানে মানুষকে আসীন করা হয়েছে খিলাফতে ইলাহীর অনন্য মর্যাদায়” (তাফসীরে মাজেদী, বাংলা অনু, ইফা, পৃ. ৬৯; সূরা বাকারার ৩০নং আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে পাদটীকা নং-১১০)।

আল্লাহর খিলাফতের তাৎপর্য

পৃথিবীতে আল্লাহর খিলাফত বা প্রতিনিধিত্বের তাৎপর্য ব্যাখ্যায় মিসরীয় মুফাঁসির সাইয়েদ কুতুব শহীদ (র) বলিয়াছেন,

“অর্থাৎ যখন মহান আল্লাহর সর্বোচ্চ ইচ্ছা এই নতুন সৃষ্টির হাতে পৃথিবীর দায়দায়িত্ব ন্যস্ত করার বিষয়টি চূড়ান্ত করে ফেলেছে, তিনি পৃথিবীর বুস্কে মানুষের হাতকে ক্ষমতাশালী করে দিয়েছেন। তার কাছে ন্যস্ত করেছেন নব নব উদ্ভাবন ও আবিষ্কার। বিভিন্ন বস্তুর মিশ্রণ ও সংযোজন, পরিবর্তন ও পরিমার্জন এবং পৃথিবীর অভ্যন্তরে বিদ্যমান শক্তি ও খনিজ দ্রব্যাদি উত্তোলন এবং গোটা সৃষ্টি জগতকে আল্লাহ্ অনুমতিক্রমে আপন অনুগত করার খোদায়ী ইচ্ছা বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা। এটাই ছিল আল্লাহ কর্তৃক তার কাছে অর্পিত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।

“আর আল্লাহ মানুষকে সকল সুপ্ত শক্তি, যোগ্যতা ও প্রতিভা দান করলেন যাতে সে পৃথিবীর শক্তিকে এবং সকল খনিজ দ্রব্য ও কাঁচা মালকে ব্যবহার করতে পারে। আর আল্লাহর ইচ্ছাকে বাস্তবরূপ দিতে যে প্রচ্ছন্ন ক্ষমতার প্রয়োজন, তাও তাকে দিলেন।

“আর পৃথিবী ও গোটা সৃষ্টিজগতকে পরিচালনাকারী প্রাকৃতিক শক্তি এবং এই নতুন সৃষ্টিকে (মানুষকে) এবং তার শক্তি ও ক্ষমতাকে পরিচালনাকারী প্রাকৃতিক শক্তিগুলোর মধ্যে পরিপূর্ণ সমন্বয় সাজুয্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল, যাতে বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির মধ্যে সংঘাত না বেধে যায় এবং এই বিশাল বিশ্বে মানুষের শক্তি ধ্বংস হয়ে না যায়।

“তখন মানুষ অর্জন করলো এক সুমহান মর্যাদা। এই প্রশস্ত পৃথিবীতে মানুষ হয়ে দাঁড়ালো এক পরম সম্মানিত ও মর্যাদাবান সৃষ্টি।

“এ সবই হলো মহান আল্লাহর ‘আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি বা খলীফা পাঠাতে মনস্থ করেছি এই উক্তির কিছু ব্যাখ্যা। সচেতন স্নায়ুমণ্ডল ও উন্মুক্ত অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে এবং এই নব্য সৃজিত প্রতিনিধির হাতে এই বিশাল পৃথিবীতে যা কিছু সংঘটিত হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করলে এ উক্তির উপরিউক্ত ব্যাখ্যাই দেওয়া যায়” (তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন, বাংলা অনু, সূরা বাকারার ৩০ তম আয়াতের ব্যাখ্যায়, ১খ, পৃ. পৃ. ১০৬।

ফেরেশতাগণের মন্তব্য

তাহারা বলিল, “আপনি কি সেখানে এমন কাহাকেও সৃষ্টি করিবেন যে অশান্তি ঘটাইবে ও রক্তপাত করিবে? আমরাই তো আপনার সপ্রশংস ও স্ততিগান ও পবিত্রতা ঘোষণা করি।” তখন আল্লাহ তাআলা বলিলেন : “আমি জানি যাহা তোমরা জান না।“

 ফেরেশতাকুলের এই উক্তি আপক্তি, অহঙ্কার কিংবা তাঁহাদের আদম-সন্তানদের প্রতি বিদ্বেষপ্রলূত ছিল না। যেমন ইব্‌ন কাছীর বলিয়াছেনঃ

ইহা আল্লাহ তাআলার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপত্তিসূচক বা মানব সন্তানদের প্রতি বিদ্বেষপ্রলূত ছিল না যেমনটি কোন তাফসীরকার ধারণা করিয়াছেন (মুখতাসার তাফসীরে ইব্‌ন কাছীর, ১খ, পৃ. ৪৯)।

ইহার যুক্তিও তিনি ব্যাখা করিয়াছেন এইভাবে ও বস্তত তাহারা ইহার রহস্য জানিবার জন্যই এই প্রশ্ন করে (তাফসীর ইব্‌ন কাছীর-উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায়)।

আল্লাহ তাআলা তখন আমি জানি তোমরা যাহা জান না বলিয়া ফেরেশতাদের প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত জবাব দিলেন। ইব্‌ন কাছীর তাঁহার এই কথার ব্যাখ্যাস্বরূপ লিখেন ও অর্থাৎ তোমরা জান না, অচিরেই তাহাদের মধ্যে নবী-রাসূল, সিদ্দীক, শহীদ ও পুণ্যবানদের উদ্ভব হইবে (কাসাসুল আম্বিয়া (আরবী), পৃ.১১-৪]।

মাটি সংগ্রহের জন্য পৃথিবীতে ফেরেশতা প্রেরণ

তারপর আল্লাহ তাআলা তাঁহার পরিকল্পনা অনুসারে মানব সৃষ্টির জন্য পৃথিবী মাটি লইয়া যাওয়ার জন্য ফেরেশতাকুল শিরোমণি জিবরাঈল ও মীকাঈলকে পৃথিবীতে পাঠাইলেন। মাটি তখন আল্লাহর দোহাই দিয়ে তাহার অঙ্গহানি না করিতে অনুরোধ করিল। তাঁহারা দুই জনই পরপর খালি হাতে পৃথিবী হইতে ফিরিয়া যান এবং আল্লাহর দোহাই দিয়া পৃথিবীর অনুরোধে তাঁহাদের এ ব্যাপারে অসামর্থ্যের কথা আল্লাহ তাআলার কাছে আরয করেন। অতঃপর আল্লাহর হুকুমে মালাকুল মওত আযরাঈল পৃথিবীতে নামিয়া আসেন এবং পৃথিবীর আল্লাহর দোহাই দিয়া তাহার অনুরোধ উপেক্ষা করিয়া পৃথিবীর নানাবর্ণের নানা ধরনের মাটি লইয়া যান। পৃথিবীর ‘আল্লাহর দোহাই’-এর জবাবে তিনি বলেন, আল্লাহর দোহাই শুনিয়া আমি কি তাহার হুকুম পালন না করিয়াই ফিরিয়া যাইব? তাহা কোন ক্রমেই হইতে পারে না। উক্ত মাটি ভিজান হইলে তাহা এঁটেল মাটিতে পরিণত হয়। অতঃপর তাহা বিকৃত হইয়া দুর্গন্ধযুক্ত হওয়া পর্যন্ত পতিত অবস্থায়ই থাকে।

“আমি মানুষকে ছাঁচে ঢালা কর্দমের ঠনঠনে শুষ্ক মাটি হইতে সৃষ্টি করিয়াছি” (১৫ : ২৬)।

উক্ত আয়াতে ঐ দিকেই ইঙ্গিত করা হইয়াছে। তারপর আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের প্রতি নির্দেশ দিলেন, আমি মৃত্তিকা দ্বারা একটি মানুষ সৃষ্টি করিব। তাহাকে আমি যখন পূর্ণাঙ্গ রূপ দান করিব এবং তাহার মধ্যে রূহ সঞ্চার করিব তখন তোমরা তাহার সম্মানার্থে সিজদাবনত হইবে। তারপর আল্লাহ তাআলা তাঁহার বরকতপূর্ণ কুদরতী হাতে আদমের অবয়ব সৃষ্টি করিলেন, যাহাতে ইবলীস তাহার ব্যাপারে অহঙ্কার করিতে না পারে। দীর্ঘ চল্লিশ বৎসর পর্যন্ত আদমের ঐ অবয়ব পড়িয়া রহিল। ফেরেশতাগণ তাহার পার্শ্ব দিয়া অতিক্রমকালে তাহাকে অত্যন্ত সমীহ করিতেন, কিন্তু ইবলীসের গায়ে জ্বালা ধরিয়া যাইত। ইবলীস আদমের দেহকে লক্ষ্য করিয়া বলিত, কী কাজের জন্য তোমাকে সৃষ্টি করা হইয়াছে। সে ঐ দেহের মুখ দিয়া প্রবেশ করিয়া উহার পশ্চাৎদেশ দিয়া বাহির হইত এবং ফেরেশতাগণকে অভয় দিয়া বলিত, “ইহাকে দেখিয়া ঘাবড়াইয়া যাইও না। ইহা একটি ফাপা জিনিস, আমি তাহাকে বাগে পাওয়া মাত্রই উহার সর্বনাশ করিয়া ছাড়িব।”

অতঃপর যখন আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা অনুযায়ী আদমের দেহে রহ সঞ্চারের সময় উপস্থিত হইল তখন তিনি ফেরেশতাগণকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন : আমি উহাতে রুহ সঞ্চার করিলে তোমরা তাহাকে সিজদা করিবে।

যথা সময়ে যখন তাহাতে রূহ সঞ্চার করা হইল এবং রূহ তাহার মস্তকে পৌঁছিল তখন আদম (আ) হাঁচি দিয়া উঠিলেন। ফেরেশতাগণ তাহাকে লক্ষ্য করিয়া বলিনে? বলুন, আল-হামদুলিল্লাহ। তিনি আল-হামদুলিল্লাহ বলিলেন, তখন আল্লাহ তাহার উদ্দেশ্যে বলিলেন :.L, L, অর্থাৎ তোমার প্রতি আল্লাহ রহম করুন। রূহ যখন তাহার চক্ষে প্রবেশ করিল তখন তিনি জান্নাতের ফলফলাদি দেখিতে পাইলেন। রূহ তাহার বুকে ও পেটে প্রবেশ করিলে তাহার ক্ষুধা ও আহার প্রবৃত্তি জাগ্রত হইল। রূহ তাঁহার পদদ্বয়ে পৌঁছিতে না পৌঁছিতেই আদমের দেহ জান্নাতের ফল আহরণের উদ্দেশ্যে উঠিয়া দাঁড়াইতে চেষ্টা করিল।

আদম (আ)-এর সালাম

হযরত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত এক হাদীছে হযরত আদম (আ) কে সৃষ্টির অব্যবহিত পরের একটি বর্ণনা রহিয়াছে এইভাবে। নবী করীম (স) বলেন :

“আল্লাহ তাআলা আদমকে সৃষ্টি করিলেন। তাঁহার দৈর্ঘ্য ছিল ষাট হাত। আল্লাহ তাআলা বলিলেন : যাও, ঐ যে ফেরেশতাগণ বসিয়া রহিয়াছে উহাদেরকে সালাম দাও। তাহারা কী জবাব দেয় তাহা শুনিবে। কেননা, উহাই হইবে তোমার ও তোমার সন্তানদের অভিবাদন। তিনি গিয়া বলিলেন, আস্সালামু আলায়কুম। জবাবে তাহারা বলিলেন, আসোলামু আলায়কা ওয়া রাহমাতুল্লাহ। তাঁহারা রহমতুল্লাহ শব্দটি যোগ করিলেন। তারপর যাহারাই জান্নাতে প্রবেশ করিবে, তাহারা তাহারই আকৃতির হইবে। অতঃপর মানুষের আকৃতি খর্ব হইতে হইতে বর্তমান অবস্থায় উপনীত হইয়াছে” (আল-আদাবুল মুফরাদ, ৪৪৭ নং অধ্যায়, হাদীছ নং ৯৭৮, পৃ. ২৫৪; ১৯৭৬ সালে তাশখন্দে মুদ্রিত, ইফা মুদ্রিত মকৃত অনুবাদ, ২খ, পৃ. ৪৯১-৪৮২; বুখারী ২৩, পৃ. ১১৯-২০; কিতাবুল ইসতিযান, বাব-বাদউস সালাম; মুসলিম, কিতাবুল জান্নাত ও সিফাতু নাঈমিহা ওয়া আহলিহা)।

আদম (আ)-এর শ্রেষ্ঠত্ব

আল্লাহ তাআলা নূরের তৈরী ফেরেশতা ও আগুনের তৈরী জিন্ন জাতির উপর কেন আদমকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করিলেন, কিভাবে শ্রেষ্ঠত্ব দান করিলেন, কেনই-বা মানবজাতির মধ্যে অশান্তি সৃষ্টিকারী রক্তপাতকারী থাকা সত্ত্বেও এই কাদামাটির সৃষ্টি মানুষকেই খলীফা (প্রতিনিধি) বানাইয়া দুনিয়ায় পাঠাইবার জন্য বাছিয়া লইলেন, তাহার কারণও বর্ণিত হইয়াছে আল-কুরআনে। আল্লাহ তাআলা বলেন।

“আর তিনি আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন, তৎপর সে সমুদয় ফেরেশতাদের সম্মুখে প্রকাশ করিলেন এবং বলিলেন, এই সমুদয়ের না আমাকে বলিয়া দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও” (২: ৩১)।

ফেরেশতাগণের জ্ঞানভাণ্ডারে সে জ্ঞান ছিল না। তাই তাহাদের পক্ষে তাহা বলা সম্ভবত হয় নাই। তাহারা লা জবাব হইয়া গেলেন। তাঁহাদের তখনকার অবস্থা এইভাবে বিবৃত হইয়াছে :

“তাহারা বলিল, আপনি মহান, পবিত্র! আপনি আমাদেরকে যাহা শিক্ষা দিয়াছেন তাহা ছাড়া আমাদের তো কোন জ্ঞানই নাই। আপনিই জ্ঞানময় ও প্রজ্ঞাময় “ (২: ৩১)।

সুতরাং ফেরেশতাকুলের উপর আদম (আ)-এর সুস্পষ্ট প্রাধান্য সূচিত হইল। শুধু বস্তুসমূহের নামই আল্লাহ তাআলা আদম (আ)-কে শিক্ষা দিয়াছিলেন এমন নহে। আল্লামা রাগিব আল ইসফাহানীর ভাষায়? “নামকের পরিচয় চিত্র অন্তরে ও মস্তিষ্কে ধারণ ব্যতীত নামের পরিচয় অর্জন সম্ভব নহে” (আল-মুফদারাত ফী গারীবিল কুরআন, পৃ: ২৪৪)।

মওলানা আশরফ আলী থানবী (র) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, “পৃথিবীর যাবতীয় বস্তুর বাহ্যিক পরিচয় ও লক্ষণাদি এবং এইগুলির বৈশিষ্ট্যাবলী তাঁহাকে ব্যাপকভাবে শিক্ষা দিয়াছেন” (দ্র. তাফসীরে বয়ানুল কুরআন, সূরা বাকারার ৩১তম আয়াত)। অন্যান্য বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থেও অনুরূপ ব্যাখ্যা রহিয়াছে। আল্লামা কুরতুবী বলেন, “আরবী ভাষায় যাত, নাক্স, আইব্‌ন ও ইসম শব্দগুলি সমার্থক”। তাফসীরে কাশশাফে আছে, “আল্লাহ তাআলা আদমকে ঐ সমস্ত নামের নামকসমূহের জ্ঞান দান করিলেন।” বায়যাবী বলেন, “তিনি তাঁহাকে বস্তুসমূহের নাম, সত্তা, গুণাবলী, ধর্ম, সেই সাথে যাবতীয় জ্ঞানের সূত্র ও নীতিমালা এবং প্রযুক্তির নিয়মকানুন ও এই গুলির উপকরণাদির ব্যবহার পদ্ধতি শিক্ষা দিয়াছেন।” ইমাম রাযী (র) তাফসীরে কাবীরে লিখেন, “আল্লাহ তাআলা তাহাকে প্রতিটি বস্তুর বিবরণ, সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্যর জ্ঞান দান করিলেন”।

আল্লামা মাযহারী তাবীল হিসাবে তাঁহার নিজস্ব একটি মত প্রকাশ করিয়াছেন। উক্ত আয়াতে উল্লিখিত • (নামসমূহ) শব্দের দ্বারা আল্লাহর সত্তা ও গুণবাচক নামসমূহ বুঝান হইয়াছে। এইগুলির সংক্ষিপ্ত ও সামগ্রিক ইলম তিনি পাইয়া গিয়াছিলেন এবং প্রতিটি গুণের সহিত এমন পরিপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হইয়া গিয়াছিল যে, যখন যে গুণের প্রতি তিনি নিবিষ্ট হইতেন, মুহূর্তেই তাহা তাহার সত্তায় পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত হইত। উদাহরণস্বরূপ যখন তাহার উপর,(আল-আওয়ালু) গুণবাচক পবিত্র নামটির বিভাসন ঘটিল তখন প্রতিটি বস্তু তাঁহার মানসপটে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল।

অনুরূপভাবে (আল-আখিরু) নামটির বিভাসনের প্রসঙ্গও অনুরূপ (দ্র. তাফসীরে মাজেদী, সূরা বাকারার ৩১ নং আয়াতের ব্যাখ্যায়)।

সাম্প্রতিক কালের মিসরীয় তাফসীর (আরবী) ফী যিলালিল কুরআন-এর লেখক সায়্যিদ কুতব শহীদ এই নামসমূহ শব্দের একটি ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়াছেন এইভাবে :

মানুষের জ্ঞানগত শ্রেষ্ঠত্ব

“এ পর্যায়ে আমরা যেন অন্তর্চক্ষু দিয়া দেখতে পাচ্ছি যে, যা ফেরেশতারা দেখেছিলেন, খিলাফতের দায়িত্ব অর্পণকালে যে গুপ্ত রত্নভাণ্ডার আল্লাহ্ মানুষকে দিয়েছিলেন তার কিছুটা আমরা উপলব্ধি করতে পারছি। সে জিনিসটা হচ্ছে নাম দ্বারা নির্দিষ্ট জিনিসকে চিহ্নিত করার ক্ষমতা। ব্যক্তি ও বন্ধুর নামকরণের ক্ষমতা এবং সেই নামকে ঐ ব্যক্তি বা বস্তুর সংকেত চিহ্ন হিসাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হওয়া। পৃথিবীতে মানুষের জীবন যাপনের ক্ষেত্রে এটি সবচেয়ে মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা, মানুষ এভাবে নামকে জিনিসের সঙ্কেত হিসাবে ব্যবহার করতে না পারলে কিরূপ জটিলতা দেখা দিত তা কল্পনা করলেই এই ক্ষমতার মূল্য কত তা আমরা বুঝতে পারি। পারস্পরিক লেনদেন ও মনোভাব ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে কী দুঃসহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো, তা একটু চিন্তা করলেই পরিষ্কার হয়ে যায়। একটি জিনিস সম্পর্কে দুজনে আলোচনা করতে চাইলে ঐ জিনিসটা হাযির করতে হতো। নচেৎ পুরো কথাটাই দুর্বোধ্য থেকে যেতো। মনে করুন একটা পাহাড় সম্পর্কে কথা বলতে হলে বক্তা ও শ্রোতাকে সশরীরে সোজাসুজি পাহাড়ের কাছে চলে যেতে হতো। কোন ব্যক্তি সম্বন্ধে কথা বলতে হলে সেই ব্যক্তিকে সশরীরে হাজির করে নিতে হতো। এভাবে এ সমস্যা এত কঠিন আকার ধারণ করতো যে, আল্লাহ মানুষকে নাম ব্যবহারের ক্ষমতা না দিলে তাদের গোটা জীবনটাই দুর্বিসহ হয়ে উঠতো” (ফী যিলালিল কুরআন, ১খ, পৃ. ১০৫-১০৬, বাংলা অনু., সূরা বাকারা ৩০-৩৩ আয়াতের ব্যাখ্যায়)। সুতরাং হযরত আদমের জ্ঞান কেবল বস্তুসমূহের নামের জ্ঞান ছিল না, ছিল ব্যাপক জ্ঞান-যাহা এই মহাবিশ্বে আল্লাহর প্রতিনিধিরূপে দায়িত্ব পালনের জন্য অপরিহার্য ছিল (দ্র. তফসীরে উসমানী, ১খ, ২৪-২৫)।

ফেরেশতাগণের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি ও উহার স্বীকারোক্তি

 আদমকে দুনিয়াতে আল্লাহ্ তাআলা খলীফারূপে কেন প্রেরণ করা হইবে এবং ফেরেশতাগণই বা কী করিয়া আদম সন্তানের দুর্বলতা উপলব্ধি করিলেন, তাহার একটি বর্ণনা দিয়াছেন মওলানা হিফযুর রহমান। তিনি বলেন, “এটা মনে করা ভুল যে, এ স্থলে ফেরেশতাদের জিজ্ঞাসা এ উদ্দেশ্যে ছিল যে, তারা আল্লাহর সাথে বাদানুবাদ করতে বা তাঁর সিদ্ধান্তের মধ্যে ছিদ্রান্বেষণ করতে চেয়েছিলেন, বরং তাঁরা আদম সৃষ্টির তাৎপর্য এবং তাকে খলীফা বানানোর রহস্য কি তা জানতে চেয়েছিলেন। যা হোক, আল্লাহ্ তাআলা তাদের এরূপ বাকভঙ্গির উপর তাদেরকে সাবধান করে দেন। অতঃপর তাদের সেই জিজ্ঞাসার, যার মধ্যে আদমকে হেয় প্রতিপন্ন করার আভাস ছিল, উত্তর এমনভাবে দেন যাতে ফেরেশতারা শুধু আদমের শ্রেষ্ঠত্বই স্বীকার করেনি, বরং নিজেদের দুর্বলতা ও পশ্চাৎপদতা নিজেরাই প্রত্যক্ষ করেছিল। যেহেতু মহা প্রজ্ঞাশীল আল্লাহর নৈকট্যে তারা ছিলেন তাই তৎক্ষণাৎ বুঝে নিলেন যে, আল্লাহর প্রশ্নের উদ্দেশ্য তাদেরকে পরীক্ষা করা নয়, বরং এই মর্মে সতর্ক করে দেওয়া যে, আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের যোগ্যতা আল্লাহর পবিত্রতা মাহাত্ম্য বর্ণনার আধিক্যের উপর নয়, ইলম-এর উপর নির্ভর করে। কেননা বিশ্ব পরিচালনা ইম ব্যতীত সম্ভব নয়। অতএব যখন আল্লাহ্ তাআলা আদমকে পরিপূর্ণ ইম-এর অধিকারী করেছেন তখন নিঃসন্দেহে তিনিই দুনিয়ার প্রতিনিধিত্বের অধিক যোগ্য। আর প্রকৃত ব্যাপার এই যে, আল্লাহ্ তাআলা ফেরেশতাদের উপর যে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন তাতে তারা দুনিয়ায় সমস্ত কামনা-বাসনা ও রিপুর তাড়না থেকে মুক্ত। তাই এ সমস্ত ব্যাপারে তাদের কোন ধারণাই নেই, আর আদমকে যেহেতু এ সমস্ত ব্যাপারে মুখোমুখি হতে হবে তাই এ সমস্ত বিষয়ে জ্ঞানলাভ করা তার জন্যে একটি স্বাভাবিক ঘটনা। মহাজ্ঞানী আল্লাহ্ তাআলা প্রকৃতই তাঁকে ঐ সমস্ত জিনিসের জ্ঞান দান করেছিলেন এবং তার জন্য যা কিছু জানার প্রয়োজন ছিল সবকিছুই তাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন।

“মোটকথা হযরত আদম (আ)-কে জ্ঞান নামক গুণ দ্বারা গুণান্বিত করায় ফেরেশতারা বাধ্য হয়েছিলেন তাঁর খিলাফতের যোগ্যতাকে স্বীকার করে নিতে। তারা একথা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, যদি আমাদেরকে আল্লাহর খলীফা করা হতো তাহলে বিশ্বসৃষ্টির যাবতীয় রহস্য থেকে আমরা মূর্খই রয়ে যেতাম এবং আল্লাহ্ তাআলা সৃষ্টির পরতে পরতে যে সমস্ত জ্ঞান সন্নিবেশিত করেছেন তা অনবহিত রয়ে যেতাম। এ জন্যে যে, না আমাদের পানাহারের প্রয়োজন আছে, সে জন্য জমির নীচে সংরক্ষিত রিযিক ও ধনভাণ্ডারের অন্বেষণ করব, না আমাদের ডুবে যাওয়ার আশংকা আছে যে, সে জন্য বিভিন্ন প্রকারের নৌযান উদ্ভাবন করব এবং না আমাদের রোগ-ব্যাধির আশঙ্কা আছে যে, সে জন্য বিভিন্ন প্রকারের ঔষধের বৈশিষ্ট্য ও রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া, প্রাকৃতিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, মহাকাশ সম্পর্কিত জ্ঞান, চিকিৎসা বিদ্যা, বস্তুগত জ্ঞান প্রভৃতি অগণিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের রহস্য উদ্ধারের চেষ্টা করব। এটা শুধু মহান সৃষ্টি মানবের জন্যেই সাজে যে, তারা পৃথিবীতে “আল্লাহর প্রতিনিধি হবে এবং ঐ সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান ও রহস্যাদি আয়ত্ত করে আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করবে” (কাসাসুল কুরআন, ১খ, ইফা প্রকাশিত পৃ. ১৮-২১, সংক্ষেপিত ও ঈষৎ সম্পাদিত)।

কিন্তু যে ইবলীস আদম সৃষ্টির সূচনা হইতেই প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলিয়া-পুড়িয়া মরিতেছিল, আদম অবয়বে পদাঘাত করিয়া যে তাহার বিদ্বেষ চরিতার্থ করিত, তাহার সম্মুখে ঐ মহা সত্যটি উঘাটিত হইল না। তাই ফেরেশতাগণ যেখানে আল্লাহর আদেশ পাওয়ামাত্র সিজদায় পড়িয়া গেলেন, ইবলীস তখন অন্য পথ ধরিল। তাহার জন্য অন্য পরিণতি অপেক্ষা করিতেছিল। আল-কুরআনের ভাষায়

“যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বলিলাম, আদমকে সিজদা কর, তখন ইবলীস ব্যতীত সকলেই সিজদা করিল, সে অমান্য করিল ও অহঙ্কার করিল। সুতরাং সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হইল” (২ : ৩৪)।

ইবশীসের দম্ভ ও তাহার পরিণতি

আল্লাহ তাআলা যাহির-বাতিন অস্তর-বাহির সবকিছু অবগত থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববাসীর জ্ঞাতার্থে ইবলীসকে তাহার নির্দেশ পালন না করার কারণ জিজ্ঞাসা করেন এবং তাহার ঔদ্ধত্যপূর্ণ কূটতর্ক ও ইহার পরিণতিতে করুণ পরিণতির কথাও আসমানী কিতাবসমূহে বর্ণনা করেন। আল-কুরআনের ভাষায়?

“তিনি বলিলেন, আমি যখন তোমাকে আদেশ দিলাম তখন কী তোমাকে নিবৃত্ত করিল যে, তুমি সিজদা করিলে না? সে বলিল, আমি তাহার তুলনায় শ্রেষ্ঠ, আল্লাহ্ আমাকে অগ্নি দ্বারা সৃষ্টি করিয়াছেন এবং তাহাকে কদম দ্বারা সৃষ্টি করিয়াছেন। তিনি বলিলেন, এই স্থান হইতে নামিয়া যাও, এখানে থাকিয়া অহঙ্কার করিবে ইহা হইতে পারে না। সুতরাং বাহির হইয়া যাও, তুমি অধমদের অন্তর্ভুক্ত” (৭ : ১২-১৩)।

“তখন ফেরেশতাগণ সকলে একত্রে সিজদা করিল, ইবলীস ব্যতীত। সে সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হইতে অস্বীকার করিল। আল্লাহ্ বলিলেন, “হে ইবলীস! তোমার কি হইল যে, তুমি সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হইলে না? সে বলিল, আপনি গন্ধযুক্ত কর্দমের শুষ্ক ঠঠনে মৃত্তিকা হইতে যে মানুষ সৃষ্টি করিয়াছেন, আমি তাহাকে সিজদা করিবার নহি। তিনি বলিলেন, তবে তুমি এখান হইতে বাহির হইয়া যাও; কারণ তুমি তো অভিশপ্ত এবং কর্মফল দিবস পর্যন্ত অবশ্যই তোমার প্রতি রহিল লানত” (১৫ : ৩০-৩৪)।

এইভাবে মহান আল্লাহ্ তাআলার একটি আদেশ অমান্য করায় আসমানে-যমীনে আযাষীলের দীর্ঘকালের ইবাদত-বন্দেগী ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইল।

শয়তানের অবকাশ প্রার্থনা ও দম্ভোক্তি

“সে (ইবলীস) বলিল, পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত আমাকে অবকাশ দিন। তিনি বলিলেন, যাহাদিগকে অবকাশ দেওয়া হইয়াছে তুমি অবশ্যই তাহাদের অন্তর্ভুক্ত হইলে। সে বলিল, আপনি আমাকে শাস্তি দান করিলেন, এইজন্য আমিও আপনার সরল পথে মানুষের জন্য নিশ্চয়ই ওঁৎ পাতিয়া থাকিব। অতঃপর আমি তাহাদের নিকট আসিবই তাহাদের সম্মুখ, পশ্চাৎ, দক্ষিণ ও বাম দিক হইতে এবং আপনি তাহাদের অধিকাংশকেই কৃতজ্ঞ পাইবেন না। তিনি বলিলেন, এই স্থান হইতে ধিকৃত ও বিতাড়িত অবস্থায় বাহির হইয়া যাও। মানুষের মধ্যে যাহারা তোমার অনুসরণ করিবে নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সকলের দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করিবই” (৭ : ১৪-১৮)।

কুরআন শরীফের অন্যত্র ঐ একই ঘটনার বিবরণ আসিয়াছে ভিন্নশব্দে :

“তিনি বলিলেন, হে ইবলীস! আমি যাহাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করিলাম তাহার প্রতি সিজদাবনত হইতে তোমাকে কিসে বাধা দিল? তুমি কি ঔদ্ধত্য প্রকাশ করিলে, না তুমি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন সে বলিল, আমি উহা হইতে শ্রেষ্ঠ; আপনি আমাকে আগুন হইতে সৃষ্টি করিয়াছেন এবং উহাকে সৃষ্টি করিয়াছেন কর্দম হইতে। তিনি বলিলেন, তুমি এখান হইতে বাহির হইয়া যাও, নিশ্চয় তুমি বিতাড়িত এবং তোমার উপর লানত স্থায়ী হইবে, কর্মফল দিবস পর্যন্ত। সে বলিল, হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমাকে অবকাশ দিন উথান দিবস পর্যন্ত। তিনি বলিলেন, “তুমি অবকাশ-প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হইলে অবধারিত সময় উপস্থিত হওয়ার দিন পর্যন্ত? সে বলিল, ‘আপনার ক্ষমতার শপথ! আমি উহাদের সকলকেই পথভ্রষ্ট করিব, তবে উহাদের মধ্যে আপনার একনিষ্ঠ বান্দাদেরকে নহে।‘ তিনি বলিলেন, “তবে ইহাই সত্য, আর আমি সত্যই বলি, তোমার দ্বারা ও তোমার অনুসারীদের দ্বারা আমি জাহান্নাম পূর্ণ করিবই।” (৩৮ : ৭৫-৮৫)।

কুরআন শরীফের অন্যত্র শয়তানের দম্ভোক্তিটি বিবৃত হইয়াছে এইভাবে :

“সে বলিল, হে আমার প্রতিপালক! আপনি যে আমাকে বিপথগামী করিলেন, তজ্জন্য আমি পৃথিবীতে মানুষের নিকট পাপকর্মটি অবশ্যই শোভন করিয়া তুলিব এবং আমি উহাদের সকলকেই বিপথগামী করিব, তবে উহাদের মধ্যে আপনার নির্বাচিত বান্দাগণ ব্যতীত” (১৫ : ৩৯-৪০)।

তাহারই বিভ্রান্তকরণের কৌশল কত ব্যাপক হইবে, তাহার বর্ণনা রহিয়াছে সূরা আরাফের ১৪ হইতে ১৮ নং আয়াতে।

আল্লাহ তাআলা ও পূণ্যবান আদম সন্তানদের ব্যাপারে তাহার গভীর আস্থার কথা উল্লেখ করিয়া শয়তানের অনুসারীদের কঠোর পরিণতির কথা বর্ণনা করেন এই ভাবে :

“বিভ্রান্তদের মধ্যে যাহারা তোমার অনুসরণ করিবে, তাহারা ব্যতীত আমার বান্দাদের উপর তোমার কোনই ক্ষমতা থাকিবে না। অবশ্যই জাহান্নাম তাহাদের সকলেরই প্রতিশ্রুত স্থান, উহার সাতটি দরজা আছে, প্রত্যেক দরজার জন্য পৃথক পৃথক শ্ৰেণী আছে” (১৫ : ৪২-৪৫)। হাওয়া (আ)-এর সৃষ্টি ও বেহেশতে বসবাসের আদেশ

আল্লাহ্ তাআলা বলেন :

“এবং আমি বলিলাম, হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর এবং যেথা ইচ্ছা স্বচ্ছন্দে আহার কর ….” (২:৩৫)।

এই আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আল্লামা ইবন কাছীর (র) বলেন, “আয়াতের বিন্যাস হইতে বুঝা যায়, হাওয়া (আ) আদম (আ)-এর জান্নাতে প্রবেশের পূর্বেই সৃষ্টি হইয়াছেন। কিন্তু কেহ কেহ বলেন, হাওয়ার সৃষ্টি হইয়াছে আদম (আ)-এর জান্নাতে প্রবেশের পর, যেমনটি সুদ্দী হযরত ইব্‌ন আব্বাস (রা) ও সাহাবীগণের অনেকের বরাতে বর্ণনা করেন। এই বর্ণনায় বলা হয় : ইবলীস জান্নাত হইতে বহিষ্কৃত হয় এবং আদম (আ)-কে জান্নাতে বসবাস করিতে দেওয়া হয়। তিনি তখন জান্নাতে একাকী ঘোরাফেরা করিতেন, তাঁহার সাথে বসবাসের জন্য তাহার স্ত্রী ছিলেন না। একবার তিনি ঘুম হইতে উঠিয়া দেখিলেন, তাঁহার শিয়রে একজন নারী উপস্থিত, যাহাকে আল্লাহ্ তাআলা তাঁহার বাম পাজর হইতে সৃষ্টি করিয়াছিলেন। তিনি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কে? হাওয়া বলিলেন, আমি নারী। আদম বলিলেন, তুমি কেন সৃষ্টি হইয়াছ? হাওয়া বলিলেন, যাহাতে আপনি আমার সহিত বসবাস করেন এবং শান্তি লাভ করেন। ফেরেশতাগণ তখন আদমের বিদ্যার দৌড় কি পর্যন্ত পৌঁছিয়াছে দেখার উদ্দেশ্যে আদমকে প্রশ্ন করিলেন, এর নাম কি হে আদম? জবাবে আদম বলিলেন, হাওয়া। ফেরেশতাগণ বলিলেন, তাহার হাওয়া নামকরণের কারণ কি? আদম (আ) বলিলেন, সে এ বা জীবিত বস্তু হইতে নির্গত হইয়াছে বলিয়া তাহার নামকরণ করা হইয়াছে” (মুখতসর তাফসীরে ইব্‌ন কাছীর, ১খ, ৫৪, মুহাম্মদ আলী সাব্‌নী সম্পা.)।

আদম-হাওয়া কোন জান্নাতে ছিলেন?

এ সম্পর্কে আলিমগণের মধ্যে মতভেদ রহিয়াছে। জমহুর উলামার মতে, উহা সেই জান্নাতুল মাওয়া যাহার ওয়াদা মুত্তাকী বান্দাদের জন্য করা হইয়াছে। কুরআন ও হাদীছের আলোকে তাঁহারা এই মত পোষণ করেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন :

“আমি বলিলাম, হে আদম! তুমি ও তোমার সহধর্মিনী জান্নাতে বসবাস কর” (২৩৫)।

আবু হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত মুসলিম শরীফের হাদীছে আছে : “আল্লাহ্ তাআলা সমস্ত লোককে একত্র করিবেন। যখন জান্নাতকে মুমিনদের জন্য সুসজ্জিত অবস্থায় প্রস্তুত করা হইবে তখন তাহারা আদম (আ)-এর নিকট গিয়া বলিবেন, পিত! আমাদের জন্য জান্নাতের দ্বার উন্মোচন করুম। তখন তিনি বলিবেন, তোমাদেরকে তোমাদের পিতার অপরাধ ভিন্ন অন্য কিছুই জান্নাত হইতে বহিস্কৃত করে নাই।” ইব্‌ন কাছীর (র) “আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া গ্রন্থে হাদীছটি উদ্ধৃত করিয়া বলেন, ঐ জান্নাত যে জান্নাতুল মাওয়া ছিল এ ব্যাপারে এই উক্তিটিই শক্তিশালী প্রমাণ।

পক্ষান্তরে অন্য একদল আলিম তাহাদের একটি গাছ ছাড়া সকল গাছের ফলমূল খাওয়া, সেখানে তাঁহাদের নিদ্রা যাওয়া, সেখান হইতে তাঁহাদের বহিষ্করণ, সেখানে ইবলীসের প্রবেশ এবং ওয়াসওয়াসা প্রদান, আদমের অপরাধ ও তাহার প্রভূর আদেশ মান্যকরণ প্রভৃতি কারণে মনে করেন যে, উহা জান্নাতুল মাওয়া হইতে পারে না। নিশ্চয়ই উহা দুনিয়ায় অন্য কোন বাগান হইবে।

উবায় ইব্‌ন কাব, আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা), ওয়াহ্ ইবন মুনাব্বিহ, সুফিয়ান ইব্‌ন উয়ায়না, ইবন কুতায়বা প্রমুখ হইতে অনুরূপ বর্ণিত হইয়াছে। কাযী মুনযির ইবন সাঈদ বাল্বতী তদীয় তফসীরে এই অভিমতই গ্রহণ করিয়াছেন এবং এ সম্পর্কে তিনি স্বতন্ত্র একখানা পুস্তকও রচনা করিয়াছেন। ইমাম আবু হানীফা (র) ও তদীয় সঙ্গীগণও এরূপ মত পোষণ করিতেন বলিয়া তিনি উল্লেখ করিয়াছেন। আবু আবদুল্লাহ্ মুহাম্মদ ইব্‌ন উমার আর-রাযী ইব্‌ন খাতীব আর-রাঈ তদীয় তাফসীর গ্রন্থে আবুল কাসিম বালখী ও আবু মুসলিম ইস্পাহানী হইতে এবং কুরতুবী তদীয় তাফসীর গ্রন্থে মুতাযিলা ও কাদরিয়াদের অনুরূপ মত রহিয়াছে বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। তাওরাতের বর্ণনাও অনুরূপ (পবিত্র বাইবেলে, পৃ. ৩)।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হইবে না যে, যাহারা বলেন, আদম ও হাওয়া (আ) দুনিয়ার কোন বাগানেই ছিলেন, তাহারা যুক্তি দেন যে, তাহারা যদি চিরস্থায়ী জান্নাতেই বসবাস করিতেন, তাহা হইলে–ঐ নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফলভক্ষণে চিরস্থায়ী জান্নাতের তাহারা অধিকারী হইবেন– ইবলীসের এইরূপ বলার কী কারণ থাকিতে পারে।

আবার যাহারা বলেন, তাঁহারা স্থায়ী জান্নাতে বা জান্নাতুল মাওয়ায় বসবাস করিতেন, তাহারা বলেন, তাঁহারা যদি ঐ এই অস্থায়ী দুনিয়ার কোন অস্থায়ী বাগানেই বসবাস করিতেন, তাহা হইলে যেখানে স্থায়িত্ব বলিয়া কিছুই নাই সেখানে শাজারাতুল-খুদ বা স্থায়ী বৃক্ষের কথা আসে কোথা হইতে? আবার কোন কোন তাফসীরকার বলেন, উহা চিরস্থায়ী জান্নাত–জান্নাতুল মাওয়াও নহে, পৃথিবীর কোন বাগানও নহে, আম্লাহ্ তাআলা ঊর্ধ্ব জগতে তাঁহাদের জন্য এক বিশেষ জান্নাত সৃষ্টি করিয়াছিলেন (আবদুল ওয়াহহাব নাজ্জার, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৮-১০)।

নিষিদ্ধ ফল কোনটি ছিল?

জান্নাতে বসবাসের আদেশ দানের সাথে সাথে আদম ও হাওয়া (আ)-এর প্রতি কঠোরভাবে একটি নিষেধাজ্ঞাও আল্লাহ্ তাআলার পক্ষ হইতে জারী করা হইয়াছিল। তাহা ছিল এইরূপ :

“কিন্তু এই বৃক্ষের নিকটবর্তী হইও না; হইলে তোমরা অন্যায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত হইবে” (২ : ৩৫ ও ৭ : ১৯)।

এই নিষিদ্ধ বৃক্ষ ও ইহার ফলটি কী ছিল তাহা নিয়াও তাফসীরবিদগণের মধ্যে মতানৈক্য রহিয়াছে। কেহ বলিয়াছেন, উহা ছিল আঙ্গুর। ইব্‌ন আব্বাস, সাঈদ ইব্‌ন জুবায়র, শাবী, জাদা ইব্‌ন হুবায়রা, মুহাম্মদ ইব্‌ন কায়স, সুদ্দী প্রমুখ হইতে এরূপ বর্ণিত হইয়াছে।

ইব্‌ন আব্বাস, হাসান বাসরী, ওয়াহ্ ইব্‌ন মুনাব্বিহ প্রমুখ হইতে বর্ণিত আছে, ইয়াহুদীদের ধারণা, উহা ছিল গম। ওয়াহ্ বলেন, এমন একটি শস্যফল যাহা সমুদ্রের ফেনার চাইতেও কোমল এবং মধুর চাইতেও সুমিষ্ট। সুফিয়ান ছাওরী হযরত হুসায়ন (6) হইতে বর্ণনা করেন, উহা হইতেছে খেজুর। ইব্‌ন জুরায়জ (র) হযরত মুজাহিদের সূত্রে বর্ণনা করেন, উহা হইতেছে ডুমুর ফল। কাতাদা ও ইব্‌ন জুরায়জের উহাই অভিমত। আবুল আলিয়া বলেন, উহা এমন একটি বৃক্ষ ছিল যাহা ভক্ষণে বায়ু নিঃসরণ হইত আর জান্নাতে বায়ু নিঃসরণ ছিল অশোভনীয় (কাসাসুল আম্বিয়া, ইবন কাছীর, পৃ. ২০-২১)।

আল্লামা ইবন জারীর এই প্রসঙ্গে তাঁহার আলোচনায় একটি সিদ্ধান্তমূলক মন্তব্য করিয়াছেন। তিনি বলেন, “সঠিক কথা এই যে, আল্লাহ তাআলা আদম (আ) ও হাওয়াকে একটি সুনির্দিষ্ট বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করিতে বারণ করেন। ঐ জাতীয় সমস্ত বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করিতে তিনি বারণ করেন নাই। তাহারা উহা ভক্ষণ করেন। সুনির্দিষ্টভাবে ঐ বৃক্ষটি কী ছিল তাহা আমাদের জানা নাই। কেননা আল্লাহ তাআলা তদীয় বান্দাগণের জন্য আল-কুরআন বা মহানবী (স) সহীহ হাদীছে উহার কোন দলীল-প্রমাণ বর্ণনা করেন নাই। কেহ কেহ বলিয়াছেন, উহা গম গাছ ছিল, কেহ বলিয়াছেন, উহা ছিল আঙুর গাছ, কেহ বলিয়াছেন ডুমুর গাছ। ইহার যে কোনটিই হইতে পারে। উহা এমন একটি বিষয় যাহার জ্ঞান দ্বারা জ্ঞানী ব্যক্তির কোন উপকার হওয়ার সম্ভাবনা বা ইহা জ্ঞাত না থাকার কারণে ইহার জ্ঞানহীন ব্যক্তির কোনরূপ ক্ষতির আশঙ্কা নাই” (মুখতাসার ইব্‌ন কাছীর, সূরা বাকারার ৩৭ নং আয়াতের ব্যাখ্যায়, পৃ. ৫৫)।

ঐ নিষিদ্ধ বৃক্ষের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে সায়্যিদ কুতব (র) বলেন, “সম্ভবত ঐ গাছটিকে পার্থিব জীবনের যাবতীয় নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতীক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।”

এই নিষিদ্ধ করণের যুক্তিও সায়্যিদ কুতব ব্যাখ্যা করেন এইভাবে, “কিছু নিষিদ্ধ জিনিস না থাকলে স্বাধীন ইচ্ছা শক্তির অস্তিত্ব বুঝা যায় না এবং স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন মানুষকে ইচ্ছাশক্তিহীন পশুপাখি থেকে পৃথক করা যায় না। মানুষ কতটা ধৈর্য সহকারে আল্লাহর সাথে কৃত অংগীকার ও বিধিনিষেধ মেনে চলতে পারে তার পরীক্ষা নিষিদ্ধ জিনিস ছাড়া হতে পারে না। সুতরাং স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও নির্বাচন ক্ষমতাই হলো মানুষ ও পশুর মধ্যে পার্থক্য করার মাপকাঠি। যাদের ভাল-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায় বাছবিছার করার ক্ষমতা নাই এবং নির্বিচার জীবন যাপন করে তারা দেখতে মানুষ হলেও আসলে পশু” (ফী যিলালিল কুরআন, বঙ্গানুবাদ, ১খ, পৃ. ১০৯)।

শয়তানের শত্রুতার ব্যাপারে সতর্কবাণী :

“হে আদম! নিশ্চয়ই এ তোমার ও তোমার স্ত্রীর শত্রু, সুতরাং সে যেন কিছুতেই তোমাদিগকে জান্নাত হইতে বাহির করিয়া না দেয়। দিলে তোমরা দুঃখ-কষ্ট পাইবে” (২০১১৭)।

সাথে সাথে জান্নাতে তাঁহাদের জন্য রক্ষিত সুখ-শান্তির কথাটাও বলিয়া দেওয়া হয়,

“তোমার জন্য ইহাই রহিল যে, তুমি জান্নাতে ক্ষুধার্তও হইবে না, নগ্নও হইবে না এবং সেখানে পিপাসার্তও হইবে না, রৌদ্রক্লিষ্টও হইবে না” (২০ : ১১৮-১১৯)।

وسوس اليه الشيطن قال يادم هل أدلك على شجرة الخلد ولك لا يبلى .

“অতঃপর শয়তান তাহাকে কুমন্ত্রণা দিল। সে বলিল, হে আদম! আমি কি তোমাকে বলিয়া দিব জীবনপ্রদ বৃক্ষের কথা ও অক্ষয় রাজ্যের কথা” (২০ : ১২০)?

অন্যত্র তাহার এই কুমন্ত্রণার কথা বিবৃত হইয়াছে এইভাবে :

“পাছে তোমরা উভয়ে ফেরেশতা হইয়া যাও কিংবা তোমরা স্থায়ী হও এইজন্যেই তোমাদের প্রতিপালক এই বৃক্ষ সম্বন্ধে তোমাদিগকে নিষেধ করিয়াছেন। সে তাহাদের উভয়ের নিকট শপথ করিয়া বলিল, আমি তো তোমাদের হিতাকাঙ্খীদের একজন। এইভাবে সে তাহাদেরকে প্রবঞ্চনার দ্বারা অধঃপতিত করিল” (৭ : ২০-২২)।

এই প্রসঙ্গে আদম (আ) ও ইবলীসের মধ্যকার ঐ সময়ের কথোপকথন চমৎকারভাবে বিধৃত হইয়াছে আল্লামা ইদরীস কান্দেহলভীর বর্ণনায়। তিনি লিখেন, “হযরত আদম (আ) জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কোন বৃক্ষের কথা বলিতেছ হে? জবাবে শয়তান তাঁহাকে সেই বৃক্ষের কথাটি বলিল যাহার নিকট যাইতে আল্লাহ তাআলা আদম (আ)-কে নিষেধ করিয়াছিলিন। তখন তিনি বলিলেন, ইহা তো নশ্বরত্ব ও পতনের বৃক্ষ। অবিনশ্বরতা ও অমরতত্ত্বের বৃক্ষ নহে, বরং ইহা হইতেছে অপমানিত ও লজ্জিত হওয়ার বৃক্ষ। আল্লাহর নৈকট্য ও তাহার দরবারে সম্মান বৃদ্ধির পরিবর্তে তাহার হইতে দূরত্ব বৃদ্ধি ও অপদস্থ হওয়ার হেতু। আর এইজন্যই আল্লাহ তাআলা উহার নিকটে যাইতে বারণ করিয়াছেন। এই বৃক্ষে তোমার কথিত ফায়দাসমূহ নিহিত থাকিলে পরম দয়ালু আল্লাহ তাআলা নিশ্চয়ই আমাদেরকে বারণ করিতেন না।”

প্রতুত্তরে শয়তান বলিল, “তোমাদের প্রভু তোমাদের ক্ষতি হইবে ভাবিয়া ইহার ফল খাইতে বারণ করেন নাই, বরং তোমরা যাহাতে চির অমর অথবা ফেরেশতায় পরিণত না হও সেই জন্যই তিনি বারণ করিয়াছেন, যাহাদের না আছে পানাহারের দুশ্চিন্তা আর না আছে স্ত্রী-পুত্রের ভাবনা। তোমরাও যদি তাহা হইয়া যাও তাহা হইলে খিলাফতের গুরুদায়িত্ব কী করিয়া পালিত হইবে। পৃথিবীর খিলাফতের দায়িত্ব তো স্ত্রী-পুত্র-পরিজন, পানাহার ও আয়-উপার্জনের ব্যস্ততার মাধ্যমেই পালন করিতে হইবে। আর ইহা বলাই বাহুল্য যে, স্ত্রী-পুত্র-পরিজন লইয়া ব্যস্ত থাকিলে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী কখন হইবে? তোমাদের দ্বারা খিলাফত বা প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব পালন করানোই যেহেতু তাহার উদ্দেশ্য, তাই নিজের নিকট হইতে তোমাদেরকে দূরে পাঠাইয়া দিতেছেন। আর এই বৃক্ষের ফল ভক্ষণে যেহেতু আল্লাহর নৈকট্য লাভ ঘটে, তাই তোমাদেরকে ইহা হইতে বিরত রাখা হইয়াছে। অধিকন্তু বেহেশতে মৃত্যু নাই। তোমাদেরকে কেবল খিলাফতের রীতি-নীতি শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশে অস্থায়ীভাবে কিছু দিন বেহেশতে বসবাসের আদেশ দেওয়া হইয়াছে, তারপর তিনি তাহার নৈকট্য হইতে দূরে পৃথিবীতে প্রেরণ করিবেন। সেখানে যাইয়া তোমাদের ও তোমাদের সন্তান-সন্তুতির নানারূপ ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন হইতে হইবে। অবশেষে সকলেরই মৃত্যু হইবে। পৃথিবীতে যাওয়ার ও খিলাফত লাভের পর আল্লাহ তাআলার এই নৈকট্য আর তোমাদের ভাগ্যে জুটিবে না” (মাআরিফুল কুরআন, কান্দেহলভী, ১খ, পৃ. ৯৬-৯৭)।

আবু হুরায়রা (রা) রাসূলুল্লাহ (স) হইতে একটি হাদীছে বর্ণনা করেন :

“জান্নাতে এমন একটি গাছ আছে, আরোহী তাহার ছায়ায় শতাব্দীকাল ধরিয়া পথ পরিক্রমার পরও সে উহা অতিক্রম করিয়া শেষ করিতে পারিবে না। উহাই শাজারাতুল খুল বা কথিত অনন্ত জীবনপ্রদ বৃক্ষ” (আহমাদ, জিলদ ২, পৃ. ৪৫৫; আবু দাউদ তায়ালিসী, তদীয় মুসনাদে, পৃ. ৩৩২)। নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ

“যখন তাহারা উভয়ে উহা হইতে ভক্ষণ করিল, তখন তাহাদের লজ্জাস্থান তাহাদের নিকট প্রকাশ হইয়া পড়িল। আদম তাহার প্রতিপালকের হুকুম অমান্য করিল, ফলে সে ভ্রমে পতিত হইল” (৭ : ২২; তু. ২০ : ১২১)।

 এই নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণের ব্যাপারে হাওয়াই তাঁহার স্বামীর তুলনায় অগ্রণী ছিলেন এবং তিনিই তাঁহাকে তাহা ভক্ষণে উৎসাহিত করিয়াছিলেন (কাসাসুল আম্বিয়া, ইবন কাছীর, পৃ. ২৫)। আবু হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত বুখারীর একটি হাদীছেও ইহার প্রতি ইঙ্গিত রহিয়াছে, যাহাতে নবী করীম (স) বলেন :

“বনূ ইসরাঈলরা না হইলে গোশত দুর্গন্ধযুক্ত হওয়ার ব্যাপারটা কখনো ঘটিত না, আর হাওয়া হইলে মহিলারা তাহাদের স্বামীর ব্যাপারে কখনও খিয়ানতও করিত না” (বুখারী, আম্বিয়া, পৃ. ৪৬৯; কাসাসুল আম্বিয়া, ইবন কাছীর, পৃ. ২৬-এ উদ্ধৃত)।

বাইবেলের বর্ণনা হইতে জানা যায় যে, হাওয়াকে যে প্রাণী নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণে প্রলুব্ধ করিয়াছিল সে ছিল সর্প। বিশালাকৃতি ও সুসজ্জিত রূপ লইয়া সে হাওয়ার কাছে আগমন করে। তাহার প্ররোচনায় হাওয়া নিজেও নিষিদ্ধ ফল খান এবং আদম (আ)-কেও ইহা খাওয়ান। এ সময় তাহাদের চক্ষু খুলিয়া যায় এবং তাহারা দিব্যি উপলব্ধি করিতে পারেন যে, তাঁহারা উলঙ্গ ও বিবস্ত্র হইয়া পড়িয়াছেন। কাল বিলম্ব না করিয়া ডুমুর ফলের পাতা দ্বারা লজ্জা নিবারণে প্রবৃত্ত হন। ওয়াহব ইব্‌ন মুনাবিও অনুরূপ বর্ণনা করিয়াছেন।

তাহাদের পোশাক বা আবরণ ছিল একটি দীপ্তি বা আলোকরশ্মি যাহা তাহাদের উভয়ের লজ্জাস্থানকে আড়াল করিয়া রাখিয়াছিল। ইবন আবী হাতিম (র) উবায় ইব্‌ন কাব (রা) হইতে একটি হাদীছ বর্ণনা করিয়াছেন যাহাতে নবী করীম (স) বলেন :

“আল্লাহ তাআলা আদমকে দীর্ঘদেহী ও ঘন চুলবিশিষ্ট মানুষরূপে সৃষ্টি করেন। তাঁহার দেহ ছিল খর্জুর বৃক্ষের ন্যায় দীর্ঘ। তিনি যখন বৃক্ষের ফল আস্বাদন করিলেন তখন তাহার বস্ত্রাভরণ খসিয়া পড়িল। এই প্রথমবারের মত তাহার লজ্জাস্থান অনাবৃত হয়। তিনি যখন তাঁহার লজ্জাস্থানের দিকে তাকাইলেন তখন দ্রুতবেগে বেহেশতের মধ্যে দৌড়াইত শুরু করিলেন। একটি বৃক্ষশাখায় তাঁহার কেশদাম আটকাইয়া গেল। তিনি তাহা সজোরে টানিলেন। তখন পরম দয়াময় আল্লাহ তাঁহাকে ডাক দিয়া বলিলেন, হে আদম! তুমি আমা হইতে পলায়ন করিতেছ? দায়ময়ের সেই আহবান শুনিয়া আদম জবাব দিলেন, প্রভু! না, বরং লজ্জাবশত” (ইবন কাছীর, বিদায়া, ১খ, ৭৮)।

সুফিয়ান ছাওরী (র) ইব্‌ন আব্বাস (রা) হইতে সূরা আরাফের উপরিউক্ত আয়াতের (আয়াত নং ২২) ব্যাখ্যায় বর্ণনা করেন : জান্নাতের বৃক্ষপত্র বলিতে এখানে ডুমুর গাছের পাতাই বুঝান হইয়াছে। আল্লামা ইব্‌ন কাছীর উহা উদ্ধৃত করিয়া মন্তব্য করিয়াছেন ।

সম্ভবত ইহা আহলে কিতাব হইতে গৃহীত। আয়াতটি ব্যাপক অর্থবোধক অর্থাৎ জান্নাতের যে কোন বৃক্ষপত্রই ইহার অর্থ হইতে পারে। কিন্তু যদি ধরিয়াই নেওয়া হয় যে, উহা ডুমুরের পাতা ছিল তাহাতেও কোন ক্ষতি নাই।

আদম (আ)-এর অধস্তন বংশধরগণ

আদম (আ)-এর সন্তান-সন্তুতির আলোচনা প্রসঙ্গে কথিত তাওরাতের (বাইবেলের) বর্ণনা উল্লেখ করিয়া ইব্‌ন কাছীর (র) বলেন : শীছ-এর জন্মকালে আদম (আ)-এর বয়স ছিল ১৩০ বৎসর। তারপর তিনি আরও ৮০০ বৎসরকাল জীবিত ছিলেন। তাঁহার ১৬৫ বৎসর বয়সে তাঁহার পুত্র আনুশের জন্ম হয়, তারপর তিনি আরও ৮০৭ বৎসর জীবিত ছিলেন। আনুশের ৯০ বৎসর বয়সে তৎপুত্র কীনানের জন্ম হয়। তারপর আনুশ আরও ৮১৫ বৎসরকাল জীবিত ছিলেন। কীনানের ৭০ বৎসর বয়সে তৎপুত্র মালাঈলের জন্ম হয়। তারপরও কীনান আরও ৮৪০ বৎসরকাল জীবিত ছিলেন। মাহলাইলের ৬৫ বৎসর বয়সে তৎপুত্র আরদ-এর জন্ম হয়। তারপর মাহলাঈল আরও ৮৩০ বৎসর জীবিত ছিলেন। যার ১৬২ বৎসর বয়সে উপনীত হইলে তৎপুত্র খানূখ জন্মগ্রহণ করেন। তারপরও য়াদ আরও ৮০০ বৎসর বাঁচিয়াছিলেন। খানূখের ৬৫ বৎসর বয়সে মালিহ–এর জন্মগ্রহণ করেন। তারপর খানূখ আরও ৮০০ বৎসর জীবিত ছিলেন। মালিহের ১৮৭ বৎসর বয়সে তৎপুত্র লামাকের জন্ম হয়। তারপরও মাশালিহ আরও ৭৮২ বৎসর জীবিত থাকেন। লামাকের ১৮২ বৎসর বয়সে তৎপুত্র নূহ (আ)-এর জন্ম হয়। লামাক তাহার পরেও ৫৯৫ বৎসর জীবিত ছিলেন। নূহ (আ) ৫০০ বৎসরে উপনীত হইলে তদীয় তিন পুত্র সাম, হাম ও আফিছ-এর জন্ম হয় (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ., পৃ. ৮৮-৮৯)।

উক্ত হিসাবকে যথার্থ বলিয়া ধরিয়া নিলে আদম (আ)-এর জন্ম সাল হইতে নূহ (আ)-এর ৫০০ বৎসর বয়স পর্যন্ত সময়কাল ছিল : ১৩০+১৬৫+৯০+৭০+৫+১৬২+৬+১৮৭+১৮+ ৫০০= ১৬১৬ বৎসর। নূহ (আ) যেহেতু আয়ু পাইয়াছিলেন আরও চারি শত পঞ্চাশ বৎসর, তাই উহাও হিসাবে ধরিয়া হয় মোট ২০৬৬ বৎসর। বাইবেলের বর্ণনা বলিয়া কথিত উক্ত বিবরণটি উদ্ধৃত করিয়া আল্লামা ইবন কাছীর (র) মন্তব্য করেন : “উক্ত ইতিহাসপঞ্জী আসমানী কিতাবের বর্ণনারূপে সংরক্ষিত থাকার ব্যাপারে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রহিয়াছে। বহু সীরাতবিদ এরূপ অভিমত ব্যক্ত করিয়া এ ব্যাপারে আহলি কিতাবদের বক্তব্যের সমালোচনা করিয়াছেন। উক্ত বর্ণনায় যে অবিবেচনাপ্রলূত অতিরঞ্জন রহিয়াছে তাহা বলাই বাহুল্য। অনেকে এই বর্ণনাটিতে ব্যাখ্যাস্থলে অনেক সংযোজন করিয়াছেন এবং তাহাতে প্রচুর ভুল রহিয়াছে”(প্রাগুক্ত)।

বাইবেলের আদিপুস্তকের ৪, ৫, ১১, ২১ ও ২৫তম অধ্যায়ে প্রদত্ত বর্ণনার ভিত্তিতে বিখ্যাত ফরাসী পণ্ডিত মরিস বুকাইলী হযরত ইবরাহীম (আ) পর্যন্ত কুড়ি পুরুষের নাম, তাহাদের জন্মসন, আয়ুষ্কাল এবং তৎকালে আদম (আ)-এর জন্মের পর কত বৎসর অতিক্রান্ত হইয়াছে তাহার যে ছক আঁকিয়াছেন, তাহা নিম্নরূপ (নামগুলি যেহেতু আমদের একান্তই অপরিচিত ভাষার, তাই মরিস বুকাইলীর পুস্তকে উদ্ধৃত রোমান হরফে লিখিত নামগুলির সাথে অনুবাদক আখতার- উল-আলমের অনুবাদ পুস্তকে ব্যবহৃত বাংলা প্রতিবর্ণায়নকেই বাছিয়া নেওয়া নিরাপদ বিবেচনা করিয়াছি)।

আদম (আ)-এর অধস্তন বংশধরগণ ইবরাহীম (আ) পর্যন্ত কুড়ি পুরুষ

নাম – হযরত আদমের সৃষ্টির কত কত বৎসর পর জন্ম – আয়ুষ্কাল – হযরত আদমের সৃষ্টির কত বৎসর পর মৃত্যু

১। হযরত আদম – * – ৯৩০ – ৯৩০

২। শেথ (শীছ আ) – ১০৩ – ৯১২ – ১০৪২

৩। ইনোশ – ২৩৫ – ৯০৫ – ১১৪০

৪। কৈনন – ৩২৫ – ৯১০ – ১২৩৫

৫। মহলে – ৩৯৫ – ৮৯৫ – ১২৯০

৬। জেদ – ৪৬০ – ৯৬২ – ১৪২২

৭। ইনোক – ৬২২ – ৩৬৫ – ৯৮৭

৮। মধুশেলহ্‌ – ৬৮৭ – ৯৬৯ – ১৬৫৬

৯। লামাক – ৮৭৪ – ৭৭৭ – ১৬৫১

১০। হযরত নূহ (আ) – ১০৫৬ – ৯৫০ – ২০০৬

১১। শেম (শাম) – ১০৫৬ – ৬০০ – ২১৫৬

১২। অর্ফকষদ – ১৬৫৮ – ৪৩৮ – ২০৯৬

১৩। শেলহ – ১৬৯৩ – ৪৩৮ – ২১২২

১৪। এবার – ১৭২৩ – ৪৬৪ -২১৮৭

১৫। পেলেগ – ১৭৫৭ – ২৩৯ – ১৯৯৬

১৬। রিয়ু – ১৭৮৭ – ২৩৯ – ২০২৬

১৭। স্বরূগ – ১৮১৯ – ২৩০ – ২০৪৯

১৮। নাহোর – ১৮৪৯ – ২৩০ – ১৯৯৭

১৯। তেরহ – ১৮৭৮ – ২০৫ -২০৮৩

২০। হযরত ইবরাহীম – ১৯৪৮ – ১৭৫ – ২১২৩

এই ছকটি পেশ করার পর মরিস বুকাইলি সুস্পষ্টভাবে লিখেন : উল্লেখ্য যে, এই ছকে ব্যবহৃত পরিসংখ্যান বাইবেলের আদিপুস্তকের পুরোহিতদের রচিত পাঠ হইতেই প্রাপ্ত, এই জাতীয় তথ্যাদির যাহা একমাত্র উৎস। বাইবেলের বর্ণনানুসারে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, ইবরাহীম (আ) আদম (আ)-এর ১৯৪৮ বৎসর পর জন্মগ্রহণ করেন (The Bible the Quran and Science, তাজ কোম্পানী, দিল্লী, পৃ. ৪৭)।

লূক লিখিত সুসমাচারের বর্ণনা মোটামুটি উক্তরূপ। তবে তাহাতে ১৩ নং ক্রমিকে কৈননের নাম উক্ত হইয়াছে এবং তৎপরবর্তী শেলহ-এর নাম ১৪ নম্বরে আসিয়াছে। ফলে লূকের বর্ণনায় ইবরাহীম (আ) পর্যন্ত বংশলতিকা ২১ পুরুষে পৌঁছিয়া গিয়াছে। মথি লিখিত সুসমাচারের ইবরাহীম (আ)-এর পূর্ববর্তী বংশলতিকা অনুপস্থিত। কিন্তু লূক ও মথি উভয়ের বর্ণনার মধ্যে ইবরাহীম (আ) হইতে হযরত ঈসা (আ) পর্যন্ত বংশলতিকার ব্যাপারে যথেষ্ট গরমিল পরিলক্ষিত হয়। ঐ বংশলতিকা বর্ণনায় দুইটি ধাপ আছে। প্রথম ধাপে ইবরাহীম (আ) হইতে দাউদ (আ) পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় ধাপে হযরত দাউদ (আ)-এর পর হইতে ঈসা (আ) পর্যন্ত বিবৃত হইয়াছে। তুলনামূলকভাকে পার্থক্যটি সুস্পষ্ট করিয়া তুলিয়া ধরার মানসে মরিস বুকাইলি পাশাপাশি ছক আঁকিয়াছেন নিম্নরূপঃ

প্রাক-দাউদ বংশতালিকা মথির বর্ণনানুসারে : মথি ইবরাহীম (আ)-এর পূর্বের কোন নাম উল্লেখ করেন নাই

লুকের বর্ণনানুসারে :

 (১) আদম (২) শীছ (৩) ইনোস (৪) কৈনান (৫) মাহালালীল (৬) জেরদ (৭) ইনোক (৮) মেথুশেলহ (৯) লামেক (১০) নূহ (১১) শেম (শাম) (১২) অকষদ (১৩) কৈনান (১৪) শেলহ (১৫) ইবর (১৬) পেলেগ (১৭) রিয়ু। (১৮) স্বরূপ (১৯) নাহুর (২০) তেরহ (২১)

ইবরাহীম দাউদ (আ)-উত্তর ঈসা (আ)-এর বংশতালিকা

মখির বর্ণনানুসারে

১। ইবরাহীম (আ) ২। ইসহাক (আ) ৩। ইয়াকূব (আ) ৪। এহুদা ৫। পেস ৬। হেযরন ৭। রাম ৮। আমীনাদব ৯। নহশোন ১০। সলমোন ১১। বোয়স ১২। ওবেদ ১৩। যিশয় ১৪। দাউদ (আ)

লূক-এর বর্ণনানুসারে

(২২) ইসহাক (আ) (২৩) ইয়াকূব (আ) (২৪) ইহুদা (২৫) পেরস (২৬) হেযরন (২৭) অর্নি (২৮) অদমান (২৯) আম্মীনাদব (৩০) নহশোন (৩১) সালা (৩২) বোয়স (৩৩) ওবেদ (৩৪) যিশয় (৩৫)

দাউদ (আ) লক্ষণীয়, উক্ত ছকে উভয় বর্ণনার মধ্যে যেমন নামগত বিস্তর ফারাক রহিয়াছে, তেমনি রীতিমত একটি পুরুষেরও তারতম্য হইয়া গিয়াছে। মথির বর্ণনায় যেখানে ইবরাহীম (আ) হইতে দাউদ (আ) পর্যন্ত ১৪ পুরুষ দেখান হইয়াছে, সেখানে লূকের বর্ণনায় তাহা ১৫ পুরুষ।

দাউদ (আ) হইতে ঈসা (আ) পর্যন্ত বংশতালিকাঃ

মথির বর্ণনানুসারে – ১৪। দাউদ (আ) ১৫। সুলায়মান (আ) ১৬। রহবিয়াম ১৭। আবিয় ১৮। আসা ১৯। যিহোশাফ্‌ট ২০। যোরাম ২১। উযিয় ২২। যোথম ২৩। আহস ২৪। যিকনিয় ২৫। মনঃশি ২৬। আমোস ২৭। যোশিয় ২৮। যিকনিয় (ইয়াহূদীদের বাবিল দেশে নির্বাসন) ২৯। শলটিয়েল ৩০। সরুব্বাবিল ৩১। অবীহূদ ৩২। ইলীয়াকিম ৩৩। আসোর ৩৪। সাদেক ৩৫। আখীম ৩৬। ইলীদ ৩৭। ইলিয়াসর ৩৮। মওন ৩৯। ইয়াকূব ৪০। ইউসুফ ৪১। যীশু (ঈসা আ)

লূকের বর্ণনানুসারে – ৩৫। দাউদ (আ) ৩৬। নাথান ৩৭। মওথ ৩৮। মিন্না ৩৯। মিলিয়া ৪০। ইলিয়াকিম ৪১। যোনম ৪২। ইউসুফ ৪৩। যুদা ৪৪। শামাউন ৪৫। লেবি ৪৬। মওত ৪৭। যোরীম ৪৮। ইলীয়েশর ৪৯। ইউসা ৫০। এর ৫১। ইলমাদস ৫২। কোষম ৫৩। আদ্দী ৫৪। মল্কি ৫৫। নেরি ৫৬। শল্টিয়েন ৫৭। সরুব্বাবিল ৫৮। রীষা ৫৯। যোহানা ৬০। যুদা ৬১। যোশেখ ৬২। শিমিয়ি ৬৩। মওপিয় ৬৪। মাট ৬৫। নাগ ৬৬। ইলি ৬৭। নহুম ৬৮। আমোষ ৬৯। মওযিয় ৭০। ইউসুফ ৭১। যান্নায় ৭২। মলকি ৭৩। লেবি ৭৪। মওত ৭৫। এলি ৭৬। ইউসুফ ৭৭। যীশু (হযরত ঈসা)

উক্ত বংশলতিকাটি একান্তই ইসরাঈলী উৎস তথা বাইবেলের পুরাতন নিয়ম ও লূতন নিয়ম হইতে প্রাপ্ত। এতদ্ব্যতীত এই সংক্রান্ত অন্য কোন বিবরণ পাওয়া যায় না। লোক পরম্পরার গড়পড়তা বয়স অনুমান করিয়া আদম (আ)-এর যুগ নির্ণয়ের প্রয়াস পাইবার কোনই উপায় নাই। তাই ফরাসী পণ্ডিত মরিস বুকাইলী উক্ত ছকগুলি উদ্ধৃত করার পর বিভিন্ন পর্যায়ের উপর বিচার-বিশ্লেষণপূর্বক তাহার বিখ্যাত The Bible The Quran & Science পুস্তকের বিভিন্ন স্থানে মন্তব্য করিয়াছেন :

“বাইবেলের পুরাতন নিয়মের এতদসংক্রান্ত তথ্য ও পরিসংখ্যান যে আধুনিক যুগের জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকে একেবারে অগ্রহণযোগ্য তা অন্যরা তো বটেই খোদ ভ্যাটিকান কাউন্সিলও স্বীকার করে নিয়েছে। তারা বাইবেলের পুরাতন নিয়মের এই ধরনের তথ্য পরিসংখ্যানকে সেকেলে বলে সর্বসম্মত অভিমত প্রকাশ করেছেন। অথচ দেখা যাচ্ছে বাইবেলের নতুন নিয়মের (ইঞ্জিল) সুসমাচারগুলিতেঅবলীলায় বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সত্যের সাথে সঙ্গতিবিহীন এইসব সেকেলে তথ্য ও পরিসংখ্যান গ্রহণ করা হইয়াছে। সুতরাং যারা মনে করেন যে, সুসমাচারসমূহের বর্ণনা ঐতিহাসিকভাবে সঠিকত্বের দাবিদার, তাদের সে দাবি যে কতটা ভিত্তিহীন, এই থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়” (বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান, পৃ. ১৫০, আখতার-উল-আলম অনূদিত)।

“লূক তদীয় সুসমাচারে হযরত ইবরাহীম (আ)-এর পূর্বপুরুষের যে তালিকা তুলিয়া ধরিয়াছেন, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিচারে তাহা আদৌ গ্রহণযোগ্য নহে” (Bible Quran & Science, পৃ. ১০০)।

১৮৬৩ সালে ইয়াহুদী-খৃস্টধর্ম ও তাহাদের শাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শী ভারতীয় আলিম মওলানা রহমতুল্লাহ কীরানভী (১২৩৩ হি.-১৩০৮ হি./১৮১৮ খৃ.-১৮৯১ খৃ.) কর্তৃক লিখিত বিখ্যাত ইযহারুল হক গ্রন্থের চারটি খণ্ডে বাইবেলের পুরাতন ও লূতন নিয়মে যে অসংখ্য বিকৃতি এবং বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত বিভিন্ন সংস্করণে যে অসংখ্য তারতম্য পরিলক্ষিত হয় তাহা বিস্তারিতভাবে তুলিয়া ধরেন, যাহাতে বাইবেলের অনির্ভরযোগ্যতা অকাট্যভাবে প্রমাণিত ও স্বীকৃত হইয়াছে। সেই গ্রন্থ হইতে এই সংক্রান্ত কেবল দুইটি ছকই নিম্নে উদ্ধৃত করা হইতেছে।

ইতোপূর্বে আমরা আল্লামা ইবন কাছীর (র)-এর আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া এবং মরিস বুকাইলীর বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান গ্রন্থে উদ্ধৃত বাইবেলের পুরাতন ও লূতন নিয়মের বরাতে আদম (আ) হইতে পরবর্তী দশ পুরুষ নূহ (আ) পর্যন্ত অধস্তন পুরুষগণের কাহার কোন বয়সে সন্তানের জন্ম হইয়াছিল তাহার বর্ণনা দিয়া আসিয়াছি। এবার নিম্নে ছকটি লক্ষ্য করুনঃ

আদম (আ) হইতে নূহ (আ) (প্লাবন) পর্যন্ত কাহার কত বৎসর বয়সে সন্তানের জন্ম হয়

নাম – বাইবেলের হিব্রু ভাষ্যমতে – সামারিয়ান ভাষ্যমতে – গ্রীক ভাষ্যমতে

১। হযরত আদম (আ) ১৩০ বৎসর – ১৩০ বৎসর – ২৩০ বৎসর

২। হযরত শীছ (আ) ১০৫ – ১০৫ – ২০৫

৩। কৈনান ৭০ – ৭০ – ১৭০

৪। সাবালাবীল ৬৫ – ৬৫ – ১৬৫

৫। য়ারদ – ১৬২ – ৬২ – ১৬৫

৬। ইনূক (ইদরীস আ) ৬৫ – ৬৫ – ১৬৫

৭। মেধু শালেহ ১৮৭ – ৬৭ – ১৮৭

৮। লামাক – ১৮২ – ৫৩ – ১৮৮

৯। নূহ (আ) ৬০০ – ৬০০ – ৬০০

মোটঃ ১৬৫০ – ১৩০৭ – ২২৬২

(টীকা ও ইযহারুল হক, আরবী, ২খ, পৃ. ৪৩১, রিয়াদ মুদ্রণ ১৯৮৯ খৃ.; ঐ, ইংরেজী ভাষ্য, ওলী রাযীকৃত, রিয়াদ ১৯৯২ খৃ., ২খ, পৃ. ৬২)।

নূহ (আ)-এর প্লাবন হইতে ইবরাহীম (আ)-এর জন্ম পর্যন্ত।

নাম – হিব্রু বাইবেলের ভাষ্যমতে – সামানিয়ান বাইবেলের ভাষ্যমতে – গ্রীক বাইবেলের ভাষ্যমতে

সাম – ২ বৎসর – ২ বৎসর – ২ বৎসর

আখশদ – ৩৫ – ১৩৫ – ১৩৫

কৈনান – ? – ? – ১৩০

সালাহ – ৩০ – ১৩০ – ১৩০

ইবর – ৩৪ – ১৩৪ – ১৩৪ –

পেলেগ – ২৩০ – ১৩০ – ২৩০

রিযূ – ০২ – ১৩২ – ১৩২

সরূগ – ৩০ – ১৩০ – ১৩০

নহুর – ২৯ – ৭৯ – ৭৯

তারেহ (ইবরাহীম (আ)-এর পিতা আযর) – ৭০ – ৭০ – ৭০

মোট : ২৯০ – ৯৪২ – ১০৭২

উক্ত ছকটি আপন কিতাবে সন্নিবেশিত করিয়া মওলানা রহমতুল্লাহ কীরানভী (র) লিখেন : “এই মতপার্থক্যও এতই অধিক যে, উক্ত ভাষ্যগুলির মধ্যে সাযুজ্য বিধান কোনক্রমেই সম্ভবপর নহে এবং যেহেতু হিব্রু ভাষ্যমতে ইবরাহীম (আ)-এর জন্ম মহাপ্লাবনের ২৯২ বৎসর পর বলিয়া প্রতীয়মান হয় এবং নূহ (আ) মহাপ্লাবনের পর ৩৫০ বৎসরকাল জীবিত ছিলেন, যাহার সুস্পষ্ট উল্লেখ আদিপুস্তক, নবম পরিচ্ছেদ-এর ২৮তম শ্লোকে রহিয়াছে, এই হিসাবে নূহ (আ)-এর ওফাতের সময় ইবরাহীম (আ)-এর বয়স ৫৮ বৎসর হইতে হয়, যাহা ঐতিহাসিকগণের সর্ববাদীসম্মত মতের বিরোধী। গ্রীক এবং সামারিয়ান ভাষ্যও উহাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। কেননা প্রথমোক্ত ভাষ্যমতে ইবরাহীম (আ)-এর জন্ম নূহ (আ)-এর ইন্তিকালের ৭২২ বৎসর পূর্বেকার ঘটনা এবং দ্বিতীয়োক্ত ভাষ্যমতে উহা ছিল ৫৯২ বৎসর পূর্বের কথা। ছক আঁকিলে দাঁড়ায় এইরূপঃ

গ্রীক ভাষ্য – সামেরিয়ান ভাষ্য – হিব্রু ভাষ্য

ক। নূহ (আ)-এর মহাপ্লাবন হইতে তাহার ইনতিকাল পর্যন্ত – ৩৫০ – ৩৫০ – ৩৫০

খ। মহাপ্লাবন হইতে ইবরাহীম (আ)-এর জন্ম পর্যন্ত – ১০৭২ – ৯৪২ – ২৯২

অতএব (গ) নূহ (আ)-এর ইনতিকাল হইতে ইবরাহীম (আ)-এর জন্ম পর্যন্ত – ১০৭২-৩৫০ / ৯৪২-৩৫০ / ২৯২-৩৫০

৭২২ বৎসর – ৫৯২ বৎসর – ৫৮ বৎসর

অর্থাৎ ঐ সময় ইবরাহীম (আ)-এর বয়স ছিল ৫৮ বৎসর (ইযহারুল হক, আরবী, ২য় খণ্ডের পাদটীকায়, যাহা ডঃ মুহাম্মাদ আবদুল কাদির খলীল মালাক্কায়ী কর্তৃক লিখিত, পৃ. ৪৩৫)।

উপরন্তু গ্রীক ভাষ্যে অষদ ও শালেহ-এর মধ্যে এক পুরুষ বর্ধিত করা হইয়াছে (তিনি হইলেন কৈনান, যাহার কথা ইতোপূর্বে উল্লেখিত হইয়াছে), হিব্রু ও সামেরিয়ান ভাষ্যে তাহার কোন উল্লেখ নাই। লূক তদীয় সুসমাচার গ্রন্থে গ্রীক বর্ণনার উপর নির্ভর করিয়াছেন, তাই ঈসা (আ)-এর বংশলতিকার বর্ণনায় তিনি কৈনানের নাম বর্ধিত করিয়াছেন। উক্ত অসঙ্গত মতানৈক্যের দরুন খৃস্টীয় পণ্ডিতগণের মধ্যে মতভেদের সৃষ্টি হইয়াছে। ঐতিহাসিকগণ ঐ কারণেই উক্ত ভাষ্যত্রয়কে উপেক্ষা করিয়াছেন এবং অনির্ভরযোগ্য ঠাওরাইয়াছেন। তাঁহারা বলিয়াছেন, উক্ত সময়ের ব্যবধান ছিল ৩৫২ বৎসরের। অনুরূপভাবে বিখ্যাত ইয়াহুদী ঐতিহাসিক ইউসীকস উহার উপর আস্থা স্থাপন করেন নাই। তিনি বলেন, উক্ত মেয়াদ ছিল ৯৯৩ বৎসর, যেমনটি হেনরী স্কট-এর বাইবেলের ব্যাখ্যা গ্রন্থে উল্লিখিত হইয়াছে (ইযহারুল হক, আরবী, ২, পৃ. ৪৩৫-৪৩৬; কুরআন ছে বাইবেল তক, মওলানা তকী উছমানী কৃত উর্দু ভাষ্য, ২খ, পৃ. ১৮, ৭ম সং, ১৪১০ হি., করাচী; ঐ, ইংরেজী ভাষ্য, ওলী রাযীকৃত, ২খ, পৃ. ৬৩-৬৪, ২য় সং, রিয়াদ, ১৪১২/১৯৯২)।

আদম (আ)-এর বয়স বা সময়কাল নির্ণয় অথবা তাঁহার বংশধরদের তালিকা বর্ণনায় বাইবেলের বর্ণনা যে আদৌ গ্রহণযোগ্য নহে, উপরিউক্ত আলোচনার দ্বারা তাহা সুস্পষ্ট হইয়া গিয়াছে। গোটা খৃস্টান জগতের সম্মুখে উপরিউক্ত পুস্তক দুইখানা-ইযহারুল হক ও The Bible The Quran & Science চ্যালেঞ্জরূপে বিদ্যমান রহিয়াছে। ইবন হিশাম (মৃত্যু ২১৮ হি./৮২৮ খৃ.) তাঁহার সীরাত গ্রন্থে আদম (আ) হইতে মুহাম্মাদ (স) পর্যন্ত নিম্নরূপ বংশতালিকা উল্লেখ করিয়াছেন :

 (১) আদি পিতা হযরত আদম (আ)

(২) হযরত শীছ (আ)

(৩) ইয়ানিশ (আশ)

(৪) কায়নাথ

(৫) মাহলীল

(৬) ইয়াদ

(৭) আখন্মুখ অর্থাৎ (হযরত ইদরীস (আ)

(৮) মাতুলালাখ

(৯) লামাক

(১০) নূহ (আ)

(১১) সাম

(১২) আর ফাখশাজ

(১৩) শালেখ

(১৪) আয়বার (পূর্বোক্ত তালিকায় ইবরবা এর নামে যিনি উক্ত হইয়াছেন; অন্যমতে ইহার নাম আবে)। তাবারীর মতে ফালেগ ও আবেরের মাঝখানে কায়আন নামক আরেক পুরুষ ছিলেন। তবে তিনি যাদুকর ছিলেন বলিয়া তওরাতে তাহার নাম বাদ দেওয়া হইয়াছে” (পাদটীকা সীরাতুন্নবী, ইবন হিশাম, ইফা, প্রকাশিত, ১খ, পৃ.৫)।

(১৫) ফালেখ (মতারে (ফালেগ)

(১৬) রাউ (রিয়ু)

(১৭) সাগ

(১৮) নাহূর।

(১৯) তারেহ (আর)

(২০) ইবরাহীম (আ)

(২১) ইসমাঈল (আ)

(২২) নাবিত

(২৩) ইয়াশজাব

(২৪) ইয়াকুব

(২৫) তায়রাহ

(২৬) নাহুর

(২৭) মুকাওয়াম

(২৮) উদাদ

(২৯) উদ্‌

(৩০) আদনান

(৩১) মাআদ

(৩২) নিযার

(৩৩) মুদার

(৩৪) ইলয়াস

(৩৫) মুদরাকা (আসল নাম আমির)

(৩৬) খুযায়মা

(৩৭) কিনানা

(৩৮) নাদর

(৩৯) মালিক

(৪০) ফির (আসল নাম কুরায়শ, মতান্তরে ফিহর, উপাদি কুরায়শ; কুরায়শ বংশের আদি পুরুষ)

(৪১) গালিব

(৪২) লুআই

(৪৩) কাব

(৪৪) মুররা

(৪৫) কিলাব

(৪৬) কুসাই

(৪৭) মুগীরা (আব্‌দ মানাফ)

(৪৮) হাশিম (আসল নাম আমর)

(৪৯) শায়বা (আসল নাম আবদুল মুত্তালিব)

(৫০) আবদুল্লাহ

(৫১) মুহাম্মাদ, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম (ইবন হিশাম, সীরাতুন নবী, পৃ. ৩-৭)।

লক্ষণীয়, হযরত আদম (আ) হইতে ইবরাহীম (আ) পর্যন্ত বিশ পুরুষের বংশতালিকায় উক্ত সময়ের ব্যবধান দেখান হইয়াছে প্রায় ২০০০ বৎসর।

মোটামুটি যতদূর জানা যায়, ঈসা (আ)-এর ১৮০০ বৎসর পূর্বে হযরত ইবরাহীম (আ)-এর আগমন ঘটে। বাইবেলের আদিপুস্তকের তথ্যানুসারে আদম (আ) কমবেশী ঈসা (আ)-এর ৩৮০০ বৎসর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন (The Bible The Quran & Science, P. 47)। লূকের বর্ণনানুসারে ঈসা (আ) আদম (আ)-এর ৭৭তম অধস্তন পুরুষ; অথচ ইবন হিশামের উদ্ধৃত বংশতালিকায় তাঁহার ৫৭০ বৎসর পরে জন্মগ্রহণকারী আমাদের নবী করীম (স)-কে ৫১তম অধস্তন পুরুষরূপে দেখান হইয়াছে। অথচ হিসাবমতে ৭৭ পুরুষ পর্যন্ত সময়ের ব্যবধান ৩৮০০ বৎসর হইলে ৫১তম পুরুষ পর্যন্ত পৌঁছিতে লাগে ৩৮০০-৭৬=৫০x৫০=২৫০০ বৎসর। কিন্তু কার্যত আমরা এই ব্যবধান পাইতেছি ৩৮০০+৫৭০=৪৩৭০ বৎসরের।

অপরদিকে যদি আমরা লুকের পরিবর্তে মথির বর্ণনার উপর নির্ভর করি, তাহা হইলে ঈসা (আ) পর্যন্ত ৪১ প্রতি দুই পুরুষের ব্যবধান গড়ে প্রায় ৯৫ বৎসর (৩৮০০-৪০)। এই হিসাবে ৫১তম পুরুষ পর্যন্ত সময়ের ব্যবধান দাঁড়ায় প্রায় ৪৭৫ বৎসর। পক্ষান্তরে লূকের বর্ণনামতে আমাদের নবী করীম (স)-এর জন্মসাল হওয়া কথা ছিল, তাহার প্রকৃত জন্মসাল (৫৭০)-এর ১৮৭০ বৎসর পূর্বে, অন্যদিকে মথির বর্ণনা অনুসারে তাহার জন্মসাল হওয়া উচিত ছিল আরও ৩৮০ বৎসর পরে। সুতরাং বাইবেলের কোন বর্ণনাই যথার্থ বলিয়া মানিয়া লওয়া যায় না।

এখানে আরেকটি কথা প্রণিধানযোগ্য। প্রথম দিকের বংশধরগণ যত দীর্ঘ আয়ু লাভ করিয়াছেন, শেষ দিকের বংশধরগণ তেমনটি লাভ করেন নাই। সুতরাং মথির বর্ণনানুসারে ঈসা (আ) ৪১তম পুরুষ হইলে আমাদের নবী (স)-এর জন্মগ্রহণের বক্তব্যকে কোনমতেই মানিয়া নেওয়া যায় না। এই কারণেই “ফাদার কানেসগিয়েসার তাঁর পুস্তকে এ মর্মে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন যে, “কেউ যেন যীশুখৃস্ট সংক্রান্ত বাইবেলের কোন সুসমাচারের বর্ণনাকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ না করেন। কেননা বাইবেলের লেখকগণ কোন বিশেষ পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে অথবা কোন বিশেষ বিষয়ের মোকাবেলা করার প্রয়োজনেই হয়তো বা নিজ নিজ জনপদে প্রচলিত লোককাহিনীকে এভাবে লিপিবদ্ধ করে গেছেন” (The Bible The Quran & Science, P. 47 পৃ. ৬৪)।

ফরাসী পণ্ডিত মরিস বুকাইলীর পুস্তকের অসংখ্য স্থানে তাই বাইবেলের পুরাতন ও লূতন নিয়মকে “আল্লাহ কর্তৃক নাযিলকৃত নহে, বরং পণ্ডিত ও ধর্মশাস্ত্রজ্ঞদের রচনা” অবৈজ্ঞানিক ও অনির্ভরযোগ্য বলিয়া মন্তব্য করিয়াছেন। এই কারণেই মহানবী (স) ইসরাঈলীদের রিওয়ায়াত সম্পর্কে সাবধান বাণী উচ্চারণ করিয়াছেন :

“আহলি কিতাবদের বর্ণনাকে সত্য বা মিথ্যা বলিতে যাইও না” (মিশকাত, বুখারী, পৃ. ২৮; বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান-আখতার-উল-আলম অনূদিত, পৃ. ৮২)।

সূরা বাকারার ৩৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফতী মুহাম্মাদ শফী (র) বলেন, “আদম (আ)-কে বিশেষ গাছ বা উহার ফল খাইতে নিষেধ করা হইয়াছিল এবং তাহাকে এ ব্যাপারেও সাবধান করিয়া দেওয়া হইয়াছিল যে, শয়তান তোমাদের শত্রু। কাজেই সে যেন তোমাদেরকে পাপে লিপ্ত করিয়া না দেয়। এতদসত্ত্বেও হযরত আদম (আ)-এর তাহা খাওয়া আপাতদৃষ্টিতে পাপ বলিয়া মনে হয়। অথচ নবীগণ পাপ হইতে মুক্ত ও পবিত্র। সঠিক তথ্য এই যে, নবীগণের যাবতীয় পাপ হইতে মুক্ত ও পরিশুদ্ধ থাকার কথা যুক্তি ও রিওয়ায়াত দ্বারা প্রমাণিত। চার ইমাম ও উম্মতের সর্বসম্মত অভিমতেও নবীগণ ছোটবড় যাবতীয় পাপ হইতে মুক্ত ও পবিত্র। কারণ নবীগণকে গোটা মানবজাতির অনুসরণীয় আদর্শ হিসাবে প্রেরণ করা হইয়াছিল। যদি তাঁহাদের দ্বারাও আল্লাহ পাকের ইচ্ছার পরিপন্থী ছোট-বড় কোন পাপকাজ সম্পন্ন হইত, তবে নবীগণের বাণী ও কার্যাবলীর উপর আস্থা ও বিশ্বাস উঠিয়া যাইত। যদি নবীগণের উপর আস্থা ও বিশ্বাস না থাকে তবে দীন ও শরীআতের স্থান কোথায় অবশ্য কুরআন পাকের অনেক আয়াতে কতক নবী (আ) সম্পর্কে এ ধরনের ঘটনার বর্ণনা রহিয়াছে যাহাতে মনে হয় যে, তাহাদের দ্বারাও পাপ সংঘটিত হইয়াছে এবং আল্লাহ পাকের পক্ষ হইতে এজন্য তাহাদেরকে সর্তক করিয়া দেওয়া হইয়াছে। হযরত আদম (আ)-এর ঘটনাও এ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত।

এ ধরনের ঘটনাবলী সম্পর্কে উম্মতের সর্বসম্মত মত এই যে, ভুলবশত বা অনিচ্ছাকৃত কারণে নবীদের দ্বারা এ ধরনের কাজ সংঘটিত হইয়া থাকে। কোন নবী জানিয়া শুনিয়া বা ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহ পাকের হুকুমের পরিপন্থী কোন কাজ করেন নাই। এ ক্রটি ইজতিহাদগত ও অনিচ্ছাকৃত এবং তাহা ক্ষমার যোগ্য। শরীআতের পরিভাষায় ইহাকে পাপ বলা চলে না এবং এ ধরনের ভুল ও ত্রুটি-বিচ্যুতি সেসব বিষয়ে হইতেই পারে না যাহার সম্পর্ক ধর্মীয় শিক্ষা ও প্রচার এবং শরীআতের বিধি-বিধানের সহিত রহিয়াছে এবং তাঁহাদের ব্যক্তিগত কাজকর্মে এ ধরনের ভুল-ত্রুটি হইতে পারে। হযরত আদম (আ)-এর এই ঘটনা সম্পর্কে তাফসীরবিদগণ বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়াছেন। _ (১) হযরত আদম (আ) কে যখন নিষেধ করা হইয়াছিল, তখন এক নির্দিষ্ট গাছের প্রতি ইঙ্গিত করিয়াই তাহা করা হইয়াছিল। কিন্তু তাহাতে শুধুমাত্র সে গাছটিই উদ্দিষ্ট ছিল না, বরং সে জাতীয় যাবতীয় গাছই ইহার অন্তর্ভুক্ত ছিল। যেমন হাদীছে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (স) একখণ্ড রেশমী কাপড় ও স্বর্ণ হাতে নিয়া ইরশাদ করিলেন, “এ বস্তু দুইটি আমার উম্মতের পুরুষদের জন্য হারাম”। এ কথা সুস্পষ্ট যে, শুধু ঐ বিশেষ কাপড় ও স্বর্ণখণ্ড ব্যবহারই হারাম ছিল না যে দুইটি হুযুর (সা)-এর হাতে ছিল, বরং যাবতীয় রেশমী কাপড় ও স্বর্ণ সম্পর্কেই ছিল এই হুকুম, কিন্তু এখানে হয়তো এ ধারণাও হইতে পারে যে, এ নিষেধাজ্ঞার সম্পর্ক সেই বিশেষ কাপড় ও স্বর্ণ খণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল যেগুলি সে সময় তাহার হাতে ছিল। অনুরূপভাবে হযরত আদম (আ)-এর হয়তো এ ধারণা হইয়াছিল যে, যে গাছের প্রতি ইঙ্গিত করিয়া নিষেধ করা হইয়াছিল, এ নিষেধের সম্পর্ক ঐ গাছটিতেই সীমাবদ্ধ। শয়তান এ ধারণা তার অন্তরে বদ্ধমূল করিয়া দিয়াছিল এবং কসম খাইয়া বিশ্বাস জন্মাইল যে, আমি তোমাদের হিতাকাঙ্খী। তোমাদেরকে এমন কোন কাজের পরামর্শ দেই না যাহা তোমাদের পক্ষে ক্ষতিকর হইতে পারে। যে গাছ সম্পর্কে নিষেধ করা হইয়াছিল তাহা অন্য গাছ।

 তাহা ছাড়া এমনও হইতে পারে যে, শয়তান এ কুমন্ত্রণা তাঁহার অন্তঃকরণে সঞ্চারিত করিয়াছিল যে, এ গাছ সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞা আপনার সৃষ্টির সূচনা পর্বের সহিত সম্পৃক্ত ছিল। যেমন সদ্যজাত শিশুকে জীবনের প্রথম পর্যায়ে শক্ত ও গুরুপাক আহার হইতে বিরত রাখা হয়, কিন্তু সময় ও শক্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে সব ধরনের আহার্য গ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়। সুতরাং এখানে আপনি শক্ত সমর্থ হইয়াছেন। এখন সে বিধিনিষেধ কার্যকর নয়।

আবার এ সম্ভাবনাও রহিয়াছে যে, শয়তান যখন আদম (আ)-কে সেই গাছের উপকারিতা ও গুণাবলীর বর্ণনা দিতেছিল, যেমন সেই গাছের ফল খাইলে আপনি অনন্তকাল নিশ্চিন্তে জান্নাতের নেয়ামতাদি ও সুখ-সাচ্ছন্দ্য ভোগ করিতে পারিবেন। তখন তাঁহার সৃষ্টির প্রথম পর্বে সে গাছ সম্পর্কে আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কথা তাহার মনে ছিল না। কুরআন শরীফের উj,- (আদম ভুলিয়া গেল এবং আমি তাহার মধ্যে সংকল্পের দৃঢ়তা পাই নাই) আয়াতও এ সম্ভাবতা সমর্থন করে। যাহাতে এ ধরনের বহু সম্ভাবনা থাকিতে পারে। তবে সারকথা এই যে, হযরত আদম (আ) বুঝিয়া শুনিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে এ হুকুম অমান্য করেন নাই, বরং তাহার দ্বারা ভুল হইয়া গিয়াছিল, যাহা প্রকৃতপক্ষে কোন পাপ নয়। অবশ্য আদম (আ) স্বীয় ভুলের জন্য তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনার পর তাঁহাকে মাফ করিয়া দেওয়া হয়ে (তাফসীর মাআরিফুল কুরআন, মাদীনা মুনাওয়ারা থেকে মুদ্রিত, পৃ. ৩১)।

উপরন্তু আল্লাহ তাআলা এ ঘটনার জন্য আদম (আ)-এর চেয়ে ইবলীসকেই অধিকতর দায়ী করিয়াছেন (দ্র. ২ : ১২০, ২: ৩৬, ৭ : ২১, ২২)। উপরিউক্ত আয়াতসমূহের প্রত্যেকটিতেই শয়তানকে আদম (আ)-কে প্ররোচিত করার জন্য দায়ী করা হইয়াছে এবং আদম (আ)-এর পদস্খলন বলিয়া ঐ ঘটনাকে অবিহিত করা হইয়াছে, পাপ বলা হয় নাই। আদম ও হাওয়ার দুনিয়ায় অবতরণ

পূর্ব সতর্কীকরণ সত্ত্বেও নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণের জন্য আল্লাহ আদম (আ)-কে লক্ষ্য করিয়া বলিলেনঃ (৭ : ২২)।

“আমি কি তোমাদেরকে এই বৃক্ষের নিকটবর্তী হইতে বারণ করি নাই এবং আমি কি তোমাদেরকে বলি নাই যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু” (৭ : ২২)।?

আদম (আ) ও হাওয়া (আ) তাঁহাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হইয়া আল্লাহর শিখানো তওবার বাণী দ্বারা দোআ করিলেন ।

“হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি অন্যায় করিয়াছি। যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং দয়া না করেন তবে আমরা নিশ্চিতভাবেই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হইব” (৭ : ২৩)।

“তোমরা সকলেই এখান হইতে নামিয়া যাও। পরে যখন আমার পক্ষ হইতে তোমাদের নিকট হেদায়াত আসিবে তখন যাহারা আমার হেদায়াত অনুসরণ করিবে তাহাদের কোন ভয় নাই এবং তাহারা দুঃখিতও হইবে না। যাহারা কুফরী করিবে ও আমার নির্দেশসমূহ অমান্য করিবে, তাহারাই অগ্নিবাসী, সেখানে তাহারা স্থায়ী হইবে” (২ : ৩৮-৯)।

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় শায়খুল হিন্দ মওলানা মাহমূদুল হাসান (র) লিখিয়াছেন, আল্লাহ তাআলা হযরত আদম (আ)-এর তওবা তো কবুল করিলেন কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে জান্নাতে পুনর্গমনের নির্দেশ দিলেন না, বরং পৃথিবীতে বসবাসের যে হুকুম দিয়াছিলেন তাহাই বহাল রাখিলেন। কেননা উহাই ছিল তাঁহার হিকমতের অনুকূল। যেহেতু আদম (আ)-কে দুনিয়ার খলীফা মনোনীত করা হইয়াছিল, বেহেশতের জন্য নহে, সাথে সাথে আল্লাহ তাআলা বলিয়া দিলেন, যাহারা আমার আদেশ পালনকারী হইবে, পৃথিবীতে বসবাস তাহাদের জন্য ক্ষতিকর হইবে না বরং লাভজনকই হইবে। তবে যাহারা নাফরমান তথা আম্লাহর আদেশ অমান্যকারী হইবে, তাহাদের জন্য জাহান্নাম, আর এই পার্থক্য বিধানের জন্য সমুচিত ক্ষেত্রও এই পৃথিবীই (ফাওয়াইদে শায়খুল হিন্দ, তাফসীর উছমানী, টীকা নং ৬১, ২ ও ৩৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা)। এই ব্যাখ্যায় উল্লিখিত প্রথম নির্দেশটি ছিল এইরূপঃ

“আমি বলিলম, তোমরা একে অন্যের শক্ররূপে নামিয়া যাও, পৃথিবীতে কিছু কালের জন্য তোমাদের বসবাস ও জীবিকা রহিল” (২: ৩৬)।

লক্ষণীয়, এখানে তোমরা নামিয়া যাও আদেশে বহুবচন বোধক ক্রিয়াপদ ব্যবহৃত হইয়াছে। অন্যত্র বলা হইয়াছে :

“তিনি বলিলেন, তোমরা উভয়ে একই সঙ্গে জান্নাত হইতে নামিয়া যাও। তোমরা পরস্পর পরস্পরের শত্রু” (২০১২৩)।

এখানে দ্বিবাচক ক্রিয়াপদ ব্যবহার করিয়া আদম (আ) ও ইবলীসকে বুঝান হইয়াছে। ইব্‌ন আবী হাতিম হযরত ইব্‌ন আব্বাস (র)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন : “আদম (আ)-কে মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী দানা নামক স্থানে নামাইয়া দেওয়া হয়। পক্ষান্তরে হাসান হইতে বর্ণিত আছে : “আদম (আ)-কে ভারতবর্ষে, হাওয়াকে জিদ্দায়, ইবলীসকে দাক্তিমসানে, যাহা বসরা হইতে কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত এবং সর্পকে ইসফাহানে নামাইয়া দেওয়া হয়।” ইবন আবী হাতিমেরও অনুরূপ একটি বর্ণনা রহিয়াছে। আস-সুদ্দী (র) বলেন, “আদম (আ) ভারতবর্ষে অবতরণ করেন এবং তাহার সহিত হাজরে আসওয়াদ অবতীর্ণ হয়। আদম (আ)-এর হাতের মুষ্টিতে তখন জান্নাতের লতাপাতা ছিল যাহা তিনি ভারতবর্ষে রোপণ করেন, ফলে সেখানে সুগন্ধি বৃক্ষ উৎপন্ন হয়” (কাসাসুল আম্বিয়া, ইব্‌ন কাছীর, পৃ. ২৯)।

ইব্‌ন উমার (রা)-এর বর্ণনায় আদম (আ) সাফায় এবং হাওয়া মারওয়ায় অবতরণ করিয়াছিলেন বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে। ইবন আবু হাতিমও অনুরূপ বর্ণনা করিয়াছেন (প্রাগুক্ত, পৃ. ৩১)।

আবদুর রাযযাক হযরত আবূ মূসা আশআরী (রা)-এর বরাতে বর্ণনা করেন : “আল্লাহ তাআলা যখন আদম (আ)-কে জান্নাত হইতে পৃথিবীতে নামাইয়া দিলেন তখন তাঁহাকে সর্বপ্রকার কাজ শিক্ষা দেন। তিনি তাঁহাকে জান্নাতের ফলমূল পাথেয়স্বরূপ সাথে দিয়া দেন। তোমাদের এইসব ফলমূল হইতেছে জান্নাতের সেই ফলমূলেরই অংশ। তবে হাঁ, তোমাদের এই ফলমূলগুলি পরিবর্তিত ও বিকৃত হয়, কিন্তু সেগুলি ছিল অপরিবর্তিত ও অবিকৃত” (হাকিম, ২খ, পৃ. ৪৫৩)।

সহীহ মুসলিমে উল্লিখিত হযরত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীছে আছে : “সর্বোত্তম দিন, যাহাতে সূর্যোদয় হয়, জুমুআর দিন। কেননা এই দিনেই আদম (আ)-কে সৃষ্টি করা হয়, এই দিনেই তাঁহাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয় এবং এই দিনেই তাঁহাকে জান্নাত হইতে বাহির করা হয়”।

আদম (আ)-এর তওবা

আবু হাতিম হযরত উবায় ইব্‌ন কাব (রা) বর্ণিত হাদীছ বর্ণনা করেন যাহাতে বলা হইয়াছে :রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, আদম (আ) আল্লাহ তাআলার দরবারে আরয করেন, আমি যদি তওবা করি এবং আপনার দিকে রুজু হই তাহা হইলে কি আমি বেহেশতে ফিরিয়া যাইতে পারিব? জবাবে আল্লাহ তাআলা বলেন : হাঁ। এই প্রসঙ্গেই আয়াত নাযিল হয় :

“অতঃপর আদম তাহার প্রতিপালকের নিকট হইতে কিছু বাণী প্রাপ্ত হইল। আল্লাহ তাহার প্রতি ক্ষমাপরবশ হইলেন। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু” (২ : ৩৭)।

মুজাহিদ, কাতাদা, সাঈদ ইবন জুবায়র প্রমুখ হইতে বর্ণিত আছে যে, সেই বিশেষ প্রার্থনা বাক্য ছিল সূরা আরাফের ২৩ নং আয়াতে বর্ণিত বাক্যগুলি :

“হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি অন্যায় করিয়াছি, যদি তুমি আমাদেরকে ক্ষমা কর এবং দয়া না কর তবে তো আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হইব” (৭ ২৩; তাফসীর তাবারী, জিলদ ১, পৃ. ২৪৪-২৪৫)।

হাকেম তদীয় মুস্তাদরাক গ্রন্থে সাঈদ ইবন জুবায়র-ই আব্বাস (র) সূত্রে উপরিউক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন : “আদম (আ) বলিলেন : আপনি কি আমাকে স্বহস্তে সৃষ্টি করেন নাই। জবাবে তাঁহাকে বলা হইল : হাঁ। তিনি প্রশ্ন করিলেন : আপনি কি আমার মধ্যে আপনার রূহ fu^কিয়া দেন নাই? জবাবে বলা হইল : হাঁ। তিনি আবার প্রশ্ন করিলেন : আমি যদি তওবা করি, আপনি কি আমাকে জান্নাতে ফিরাইয়া নিবেন? জবাবে আত্মাহ অআলা বলিলেন : হাঁ (হাকেম, ২২, পৃ. ৫৪৫)। হাকেম উহা সহীহ বলিয়া মন্তব্য করিয়াছেন (ইবন কাছীর, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৩১)।

হাকেম হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (র) বর্ণিত রিওয়ায়াত উদ্ধৃত করেন, রাসূলুল্লাহ (স) বলিয়াছেন : আদমের যখন পদস্খলন হইল তখন তিনি বলিলেন, প্রভু! মুহাম্মাদ (স)-এর উসীলায় আমি আপনার নিকট যাজ্ঞা করিতেছি, আপনি আমাকে ক্ষমা করিয়া দিন। আল্লাহ তাআলা বলিলেন : তুমি মুহাম্মাদকে কেমনে চিনিতে পারিলে অথচ এখনও আমি তাহাকে সৃষ্টি করি নাই। জবাবে আদম (আ) বলিলেন : যখন আপনি স্বহস্তে আমাকে সৃষ্টি করিলেন এবং আমার মধ্যে আপনার ‘রূহ’ ফুঁকিয়া দিলেন তখন আমি মাথা উঠাইয়া আরশের পায়াসমূহের মধ্যে লিখিত দেখিতে পাইলাম : ১und । তখন আমি উপলব্ধি করিতে পারিলাম যে, নিশ্চয়ই আপনার সৃষ্টির মধ্যে সর্বাধিক প্রিয় সত্তা ব্যতীত অন্য কাহাকেও আপনি আপনার পবিত্র নামের সহিত সম্পর্কিত করেন নাই। আল্লাহ তাআলা বলিলেনঃ তুমি যথার্থই বলিয়াছ হে আদম! নিশ্চয় তিনি আমার কাছে সৃষ্টি জগতের সকলের তুলনায় প্রিয়। যখন তুমি তাহার উসীলায় ক্ষমা প্রার্থনা করিয়াছ, তখন আমি তোমাকে মাফ করিয়া দিলাম। মুহাম্মাদ না হইলে আমি তোমাকেও সৃষ্টি করিতাম না (হাকিম, মুস্তাদরাক, জিলদ ২, পৃ. ৬১৫)। হাদীছটির মূল উৎস আল-মুসতাদরাক, ২খ., পৃ. ৬১৫ এবং তাবারানীর মুজামুস সাগীর, পৃ. ২০৭। উক্ত গ্রন্থদ্বয় হইতে ইহা বায়ত্বকীর দালাইলুন নুবুওয়্যা, বাব মা জাআ ফীমা তাহাদ্দাছা বিহি (স) বিনিমাতি রব্বিহি; ইব্‌ন আসাকির, ২খ., পৃ. ৩২৩; হায়ছামীর মাজমাউয যাওয়াইদ, ৮খ., পৃ. ২৫৩ প্রভৃতি গ্রন্থে উক্ত হইয়াছে। হাকেম ইহার সনদসূত্র যথার্থ বলিয়া মত ব্যক্ত করিলেও তাহা যথার্থ নহে। হাদীছের যথার্থতা যাচাইকারী ইমামগণ, যথা ইমাম যাহাবী, ইবন কাছীর (তারীখ, ২খ., পৃ. ৩২৩), ইবন হাজার আসকালানী, ইব্‌ন হিব্বান, আবূ নুআয়ম,ইব্‌ন তায়মিয়া প্রমুখ ইমামগণ ইহাকে জাল হাদীছ (মনগড়া) ও বাতিল রিওয়ায়াত বলিয়া মত প্রকাশ করিয়াছেন। ইমাম বায়হাকী, ইবনুল জাওযী, তাহাবী প্রমুখ উক্ত রিওয়ায়াতের কতক রাবীর কঠোর সমালোচনা করিয়াছেন (বিস্তারিত দ্র. নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদীছিদ দাঈফা ওয়াল-মাওদূআহ, ৪র্থ সং.বৈরূত-দামিক ১৩৯৮ হি., ১., পৃ. ৩৮-৪৭, নং ২৫)। অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে আদম (আ) আল্লাহর শিখানো দোআটি ছিল?

আদম (আ) ও মূসা (আ)-এর বাদানুবাদ

আদম (আ) কর্তৃক নিষিদ্ধ গাছের ফল ভক্ষণ, বেহেশত হইতে তাঁহার নির্গমন ও এই পৃথিবীতে আগমন বাহ্যত তাঁহার অপরাধ ও শাস্তি মনে হইলেও ইহাই ছিল মহান কুশলী স্রষ্টার অভিপ্রায়। এই ব্যাপারে হযরত মূসা (আ) কর্তৃক আদি পিতা আদম (আ)-এর অভিযুক্ত হওয়া এবং সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাহার জবাব দানের বিবরণও এই সত্যের প্রতি ইঙ্গিত করে। বুখারী শরীফে হযরত আবু হুরায়রা (রা) কর্তৃক বর্ণিত হাদীছে বলা হইয়াছে যে, নবী করীম (স) বলেন : মূসা (আ) আদম (আ)-এর সহিত বিতর্কে বলিলেন : আপনিই মানব জাতিকে আপনার ত্রুটির কারণে বেহেশত হইতে বহিষ্কার করিয়াছেন এবং তাহাদের দুর্ভাগ্য-দুর্গতির কারণ হইয়াছেন। আদম (আ) বলিলেনঃ হে মূসা! তুমি সেই ব্যক্তি যাহাকে আল্লাহ তাহার রিসালাত ও বাক্যালাপের জন্য নির্বাচিত ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করিয়াছেন। তুমি কি এমন একটি ব্যাপারে আমাকে দোষারোপ করিতেছ যাহা আমাকে সৃষ্টি করার পূর্বেই আল্লাহ আমার জন্য নির্ধারিত করিয়া রাখিয়াছিলেন। রাসূলুল্লাহ (স) বলেন : আদম (আ) বিতর্কে মূসা (আ)-এর উপর জয়ী হন। বুখারীর এক রিওয়ায়াতে রাসূলুল্লাহ (স) এই কথাটি ২ বার এবং অন্য রিওয়ায়াতে ৩ বার বলিয়াছেন বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে।

এই প্রসঙ্গে ইমাম আহমদ উল্লেখ করেন আদম (আ) মূসা (আ)-এর প্রতি তাওরাত নাযিলের কথা উল্লেখের সময় সাথে সাথে তাঁহাকে প্রশ্ন করেন : “আমি আগের, নাকি যিকর (তাওরাত) আগের?” জবাবে মূসা (আ) বলিলেন : না, বরং যিকর (তাওরাত) আগের। এই বর্ণনায় আরও আছে, মূসা (আ) আদম (আ) কে বলিয়াছিলেন : “আপনি সেই আদম যাহাকে আল্লাহ স্বহস্তে সৃষ্টি করিয়াছেন, তাঁহার ফেরেশতা দিয়া আপনাকে সিজদা করাইয়াছেন, আপনাকে জান্নাতে বসবাস করাইয়াছেন। তারপর আপনি সেই কাজটি করিলেন, যাহা আপনি করিয়াছিলেন”। আহমদের অন্য বর্ণনায় আছে, আদম (আ) ঐ সময় মূসা (আ) কে প্রশ্ন করেন : “আমার সৃষ্টির পূর্বেই কি তুমি আমার ব্যাপারে উহা লিখিত পাও নাই?” মূসা (আ) তাহা স্বীকার করিলেন। এইভাবে আদম (আ) মূসাকে পরাস্ত করিলেন (আহমাদ, ২২, ৩৯২)।

ইব্‌ন আবু হাতিমের বর্ণনায় আছে, আদম (আ) মূসা (আ)-কে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, তাওরাত আমার জন্মের কত আগে লিখিত হইয়াছিল। মূসা (আ) বলেন : চল্লিশ বৎসর আগে। আদম (আ) আবার প্রশ্ন করেন : তাহাতে কি পাও নাই?

 (আদম তাহার প্রতিপালকের আদেশ অমান্য করে এবং ভ্রমে পতিত হয়, ২০ ১২১? জবাবে মূসা (আ) বলিলেন : হাঁ। তখন আদম (আ) বলিলেন : যে কাজটি আমি করিব বলিয়া আমাকে সৃষ্টির চল্লিশ বৎসর পূর্বেই লিপিবদ্ধ করা হইয়াছে, তাহা আমি কেন করিলাম এইজন্য তুমি আমাকে ভর্ৎসনা করিতেছ?” রাসূলুল্লুাহ (স) বলেন : আদম মূসার উপরে জয়ী হইলেন। ইমাম মুসলিমও হযরত আবু হুরায়রা (রা) হইতে অনুরূপ বর্ণনা করিয়াছেন (মুসলিম, হাদীছ নং ২৬৫২; কাসাসুল আম্বিয়া, ইবন কাছীর, পৃ. ৩৬)।

বায়হাকীর বর্ণনায় আদম (আ)-এর জবাবী বাক্যটি আরও জোরদারভাবে বর্ণিত হইয়াছে এইভাবে : “তুমি এমন একটি ব্যাপারে আমাকে তিরস্কার করিতেছ যাহা মহান আল্লাহ কর্তৃক পূর্বেই স্থিরীকৃত হইয়াছিল” (বায়হাকী, ফী আল-আসমা ওয়াস-সিফাত ১খ, ৩১৬)।

মূসা ও আদম (আ)-এর এই বাদানুবাদ কোথায় কিভাবে হইয়াছিল সেই সম্পর্কে মতভেদ আছে। (১) য়াযীদ ইবন হরমূ-এর বর্ণনায় (তাঁহাদের প্রতিপালকের দরবারে) কথাটি আছে।

(২) মুহাম্মাদ ইবন সীরীন-এর বর্ণনায় আছে: (মূসা ও আদমের সাক্ষাৎ হয়)।

(৩) আম্মার ও শাবীর বর্ণনায় আছে a [আদম (আ) মূসা (আ)-এর সহিত সাক্ষাৎ করিলেন)]।

(৪) হযরত উমর (রা) কর্তৃক বর্ণিত হাদীছে আছে: মূসা (আ) আদম (আ)-এর সহিত সাক্ষাৎ করেন।

(৫) আবূ দাউদের বর্ণনায় আছে :  (মূসা বলেন : হে আল্লাহ! আমাকে আদমকে দেখাইয়া দিন)।

ফাতহুল বারীতে হাফিয ইবন হাজার বলেন, উক্ত ঘটনা কখনকার তাহা লইয়া পণ্ডিতগণের মধ্যে মতভেদ রহিয়াছে। কেহ কেহ বলিয়াছেন, হয়তোবা উহা মূসা (আ)-এর আমলের ঘটনা। মূসা (আ)-এর মুজিযাস্বরূপ আল্লাহ তাআলা তখন আদম (আ)-এর প্রতি ওহী প্রেরণ করেন এবং তিনিই তাহাকে কথা বলান অথবা তাহার জন্য আদম (আ)-এর কবর উন্মোচিত করিয়া দেন এবং তাঁহার কাশফ হয়। তখন তাঁহারা দুইজন কথোপকথন করেন অথবা তাহাকে আদম (আ)-এর রূহ দেখাইয়া দেন, যেমনটি নবী করীম (স)-কে মিরাজ রজনীতে নবী-রাসূলগণের রূহ দেখান হইয়াছিল অথবা তাঁহাকে স্বপ্নে আদম (আ)-কে দেখান হয়। আর নবী-রাসূলগণের স্বপ্নও ওহীবিশেষ যদিও তাহা পরবর্তী কালে সংঘটিত হয়। ইহা ব্যাখ্যাসাপেক্ষ, যেমনটি ইসমাঈল যাবীহুল্লাহ (আ)-এর ব্যাপারে ঘটিয়াছিল অথবা ইহা মূসা (আ)-এর ইন্তিকালের পরে সংঘটিত হইয়াছিল। তাঁহার মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই আলমে বারযাখে এই সাক্ষাৎকার ঘটে। প্রথম আসমানে তাহাদের উভয়ের রূহের সাক্ষাৎ হয়। ইবন আবদিল বারর ও কাসিবী এই মত দৃঢ়ভাবে পোষণ করেন। ইব্‌ন উমার (রা) বর্ণিত হাদীছে তো এইরূপ উক্ত হইয়াছে যে, মূসা (আ) যখন বলিলেন : ‘আপনিই আদম? আদম (আ) বলিলেন ৪ আপনি কে? তিনি বলিলেন, আমি মূসা। উহা নিশ্চয়ই পরে সংঘটিত হয় নাই। উহা পরকালে সংঘটিত হইবে। হাদীছেঅতীত বাচক শব্দ প্রয়োগ করা হইয়াছে। এই অর্থে উহা নিশ্চিতভাবেই সংঘটিত হইবে। ইবনুল জাওযী বারযাখে তাহাদের সাক্ষাতের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করিয়াছেন। আবার উহা একটি রূপক বা মিছাল হওয়ার কথাটাও উড়াইয়া দেওয়া যায় না। তখন উহার অর্থ হইবে, যদি তাহাদের দুইজনের সাক্ষাৎ হইত, তবে অবশ্যই তাহাদের মধ্যে উক্তরূপ বাক্যালাপ হইত (ফাতহুল বারী, ১১খ, পৃ. ৫১৫; দারুর রায়্যান বিত-তুরাছ, ২য় সং, কায়রো ১৯৮৯)।

শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিছ দিহলবী (র) বলেন : উহার সারমর্ম হইল, স্বপ্নে কোন ফেরেশতা বা পুণ্যবান লোকের কাছে অজ্ঞাত বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসার মাধ্যমে কোন ব্যক্তির জ্ঞানলাভের মতো রূহের জগতে মূসা (আ) হযরত আদম (আ)-এর নিকট জিজ্ঞাসা করিয়া উক্ত ঘটনাগর্ভে নিহিত বিষয়াদি জানিয়া লইয়াছিলেন। আল্লাহ তাআলা মূসা (আ)-এর জন্য ইলম-এর এই দ্বার উন্মুক্ত করিয়াছিলেন (তালীকুস সাবীহ ‘আলা মিশকাত মাসাবীহ, ইদ্রিস কান্দেহলবী, পৃ. ৭৭)।

তওবা কবুলের পর তিরস্কার নিষিদ্ধ

পূর্বেই আলোচনা করা হইয়াছে যে, আদম (আ)-এর নিষিদ্ধ গাছের ফল ভক্ষণ কোন অপরাধ ছিল না, তবুও তাহার মত মর্যাদাসম্পন্ন সত্তা এবং আদি মানব ও আদি নবীর পক্ষে তাহা শোভনীয় হয় নাই বিধায় তাঁহার এই কর্মটিকে (পদস্খলন) বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে। একই আয়াতের ৪১শব্দটির অর্থে জীবন বিস্বাদ হইয়া যাওয়া। কুরতুবী প্রমুখ তাফসীরবিদগণ আয়াতে উক্ত শব্দটি এই অর্থেই ব্যবহৃত হইয়াছে বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন (দ্র. কুরতুবী, ঐ আয়াতের ব্যাখ্যায়)। ইবনুল আরাবী শব্দের আলোচনা প্রসঙ্গে লিখেন : কুরআন শরীফের উক্ত আয়াত আলোচনা প্রসঙ্গ ৰা এই সংক্রান্ত উক্ত হাদীছের আলোচনা প্রসঙ্গ ছাড়া আজ আমাদের মধ্যকার কাহারও জন্য আদম (আ)-এর অপরাধ প্রসঙ্গ আলোচনা করা জায়েয নহে। নিজেদের পক্ষ হইতে যেখানে নিজদের নিকটবর্তী কালের এবং নিজেদের প্রায় সমপর্যায়ের পিতৃপুরুষগণের সম্পর্কে এইরূপ আলোচনা জায়েয নহে, সেখানে আমাদের আদি পিতা এবং সবচাইতে সম্মানিত পিতা ও সর্বপ্রথম নবীর ব্যাপারে এইরূপ নিন্দাসূচক আলোচনা কীরূপে জায়েয হইতে পারে- যেখানে আল্লাহ তাআলা তাঁহার কৈফিয়ত গ্রহণ করিয়া তাঁহার তওবা কবুল করিয়া তাহাকে ক্ষমাও করিয়া দিয়াছেন? এই কারণেই আবু নসর কুশায়রী (র) বলেন : কুরআনে ব্যবহৃত উক্ত শব্দের কারণে আদম (আ)-কে গুনাহগার ও পথভ্রষ্ট বলা জায়েয নহে। কুরআন পাকের যেখানেই কোন নবী অথবা রাসূল সম্পর্কে এরূপ ভাষণ প্রয়োগ করা হইয়াছে, তাহা হয় অনুত্তম (5, js) বুঝানোর জন্য, না হয় নবুওয়াত পূর্ববর্তী অবস্থা বুঝানোর জন্যই ব্যবহৃত হইয়াছে। তাই কুরআনী আয়াতে ও হাদীছ রিওয়ায়াতের প্রসঙ্গ ব্যতিরেকে নিজেদের পক্ষ হইতে এরূপ বিষয়ের অবতারণা করার বৈধতা বা অনুমতি নাই (কুরতুবী, ২০ : ১২২,-এর তাফসীর প্রসঙ্গে; তাফসীর মাআরিফুল কুরআন, মুফতী মুহাম্মদ শফী, উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায়)। দাউদ (আ)-কে আদম (আ)-এর আয়ু দান

হাকেম আবু ইয়ালা হযরত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীছ উদ্ধৃত করেন যাহাতে বলা হইয়াছেঃ “সর্বপ্রথম আদম (আ)-এর দেহের যে অংশে রূহ সঞ্চারিত হয় তাহা হইল তাহার চক্ষু ও নাসারন্ধ্র। তখন তিনি হাঁচি দিলেন। তখন আল্লাহ তাআলা বলিলেন : L, L. (তোমার প্রভু তোমার প্রতি সদয় হউন)। তারপর আল্লাহ তাআলা বলিলেনঃ হে আদম! উহাদের দিকে (ফেরেশতাদের প্রতি ইঙ্গিত করিয়া) যাও এবং তাহাদের উদ্দেশ্যে বল ও আস্সালামু আলায়কুম। তারপর লক্ষ্য কর তাহারা কী বলে। আদম তাহাদের নিকট গেলেন এবং তাহাদেরকে সালাম দিলেন। জবাবে ফেরেশতাগণ বলিলেন : ওআলায়কাস্ সালামু ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। আল্লাহ তাআলা বলিলেন : ইহাই তোমার এবং তোমার সন্তানদের অভিবাদন পদ্ধতি। তখন আদম বলিলেনঃ হে প্রভু পরোয়ারদিগার! আমার সন্তান কী? আল্লাহ তাআলা বলিলেন : আমার হাত গ্রহণ কর হে আদম! আদম বলিলেন : আমি আমার প্রভুর ডান হাত বাছিয়া নিতেছি এবং আমার প্রভুর উভয় হাতই ডান হাত এবং বরকতময়। অতপর আল্লাহতাআলা তদীয় হাতের তালু প্রসারিত করিলেন। আদমের অনাগতকালের সকল সন্তানকেই পরম দয়াময়ের হাতের তালুর মধ্যে দেখা গেল। তাহাদের অনেকের মুখমণ্ডলই দীপ্তিময়। তন্মধ্যে এক ব্যক্তির দীপ্তি আদমের অত্যন্ত পছন্দ হইল। তিনি বলিলেন : ‘প্রভূ! একে? জবাবে আল্লাহতাআলা বলিলেনঃ তোমারই সন্তান দাউদ।

আদম (আ) তখন জিজ্ঞাসা করিলেন : প্রভু। আপনি তাহার জন্য বয়স কী পরিমাণ বরাদ্দ করিয়াছেন : আল্লাহ তাআলা বলিলেন : আমি তাহার জন্য ষাট বৎসর আয়ু বরাদ্দ করিয়াছি। আদম বলিলেন : প্রভু! আমার আয়ু হইতে তাহার আয়ু পূর্ণ করিয়া দিন-যাহাতে তাহার আয়ু শত বৎসর হয়। আল্লাহ তাআলা তাহাই করিলেন এবং তাহাকে সাক্ষীও রাখিলেন। তারপর যখন আদমের আয়ু গত হইল আল্লাহ তাআলা তখন মৃত্যুর ফেরেশতাকে প্রেরণ করিলেন। তখন আদম (আ) তাহাকে বলিলেন : আমার আয়ুর চল্লিশ বৎসর কি অবশিষ্ট নাই? ফেরেশতা তাঁহাকে বলিলেন : আপনি কি তাহা আপনার পুত্র দাউদকে দান করেন নাই? আদম অস্বীকার করিলেন, ফলে তাঁহার সন্তানরাও অস্বীকার করে। তিনি বিস্মৃত হইলেন, তাই তাহার সন্তানরাও বিস্তৃত হয় (আবূ ইয়ালা, মুসনাদ, ১১খ., ৪৫৩)।

তিরমিযীর এতদসংক্রান্ত বর্ণনাটি এইরূপ : হযরত আবু হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (স) বলিয়াছেনঃ “আল্লাহ তাআলা আদমকে সৃষ্টি করার পর তাঁহার পৃষ্ঠদেশে হাত বুলাইলে তাহার পৃষ্ঠদেশ হইতে কিয়ামত পর্যন্ত যাহারা সৃষ্টি হইবে তাহার সেই অনাগত সন্তানগণ বাহির হইয়া পড়িল। আল্লাহ তাআলা তাহাদের মধ্যকার প্রতিটি মানুষের চক্ষুদ্বয়ের মধ্যবর্তী স্থানে একটি জ্যোতির ঔজ্জ্বল্য সৃষ্টি করিলেন। তারপর সেইগুলিকে আদমের সম্মুখে উপস্থাপিত করিলেন। আদম (আ) বলিলেন : প্রভু! ইহারা কাহারা? জবাবে আল্লাহ তাআলা বলিলেন, উহারা হইতেছে তোমারই সন্তান-সন্তুতি। তিনি এক ব্যক্তির দিকে তাকাইয়া তাহার চক্ষুদ্বয়ের মধ্যবর্তী জ্যোতির ঔজ্জ্বল্যে বিমোহিত হইলেন। আদম বলিলেন : প্রভু! এই ব্যক্তিটি কে? জবাবে আল্লাহ তাআলা বলিলেন : এই ব্যক্তি হইতেছে তোমার বংশধরদের শেষ দিকের একজন, তাহার নাম দাঊদ। আদম পুনরায় বলিলেন : আপনি তাহার জন্য কী পরিমাণ আয়ু বরাদ্দ করিয়াছেন। আল্লাহ তাআলা বলিলেন : ষাট বৎসর। আদম বলিলেন : প্রভু। আমার আয়ু হইতে তাহার বয়স আরও চল্লিশ বৎসর বাড়াইয়া দিন। যখন আদমের বয়স পূর্ণ হইল, তখন তাহার কাছে মৃত্যুর ফেরেশতা আসিলেন। তখন তিনি বলিয়া উঠিলেন : আমার আয়ুর চল্লিশ বৎসর কী অবশিষ্ট রহিয়া যায় নাই? ফেরেশতা বলিলেন : আপনি কি উহা আপনার সন্তান দাউদকে দান করেন নাই? আদম অস্বীকার করিলেন, তাই তাঁহার সন্তানরাও অস্বীকৃতিপ্রবণ। আদম বিস্মৃত হইলেন, তাই তাঁহার সন্তানরাও বিস্মৃতিপ্রবণ।

তিরমিযী বর্ণনাটিকে হাসান সহীহ বলিয়া মন্তব্য করিয়াছেন (কাসাসুল আম্বিয়া (ইবন কাছীর), পৃ. ৪৩)। ইবন আবী হাতিম (র) হযরত আবু হুরায়রা বর্ণিত এই রিওয়ায়াতে আরও বর্ণনা করিয়াছেন, তারপর আল্লাহ তাআলা আদমের বংশধরগণকে তাঁহার সম্মুখে উপস্থাপিত করিয়া বলিলেন : ইহারা তোমার সন্তান। তখন তাহাদের মধ্যে কুষ্ঠ ও শ্বেত রোগগ্রস্ত, অন্ধ এবং নানাবিধ ব্যাধিগ্রস্ত লোকজন দেখিতে পাইয়া আদম বলিলেন : প্রভু! আমার সন্তানদিগকে এইরূপ করিলেন কেন? আল্লাহ তাআলা বলিলেন : যাহাতে তাহারা নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে। তারপর দাউদের ঘটনাটি তিনি উল্লেখ করেন (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ৮১)।

ইমাম-আহমাদ (র) হযরত আবূ দারদা (রা) হইতে বর্ণনা করেন, আল্লাহ তাআলা আদমকে সৃষ্টির সময় তাহার ডান কাঁধে আঘাত করিলেন এবং এইভাবে তাঁহার শ্বেত শুভ্র একদল সন্তানকে নির্গত করিলেন। তাহাদেরকে মুক্তার ন্যায় দেখাইতেছিল। তারপর তিনি তাহার বাম কাঁধে আঘাত করিলেন এবং এইভাবে তাঁহার একদল কৃষ্ণকায় সন্তানকে নির্গত করিলেন। তাহাদেরকে কয়লার ন্যায় দেখাইতেছিল। তারপর তাঁহার ডান পার্শ্ববর্তীদের সম্পর্কে বলিলেন : ইহারা জান্নাতী, আমি কোনও পরোয়া করি না আর বাম পার্শ্ববর্তীদের সম্পর্কে বলিলেনঃ ইহারা জাহান্নামী, আমি কোনও পরোয়া করি না।

ইবন আবিদ দুনিয়ার রিওয়ায়াতে হাসান হইতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, আল্লাহ তাআলা আদম (আ)-কে সৃষ্টি করার পর তাঁহার ডান পার্শ্বদেশ হইতে জান্নাতীগণকে এবং তাঁহার বাম পার্শ্বদেশ হইতে জাহান্নামীদেরকে নির্গত করেন । তাহারা ভূ-পৃষ্ঠে নিক্ষিপ্ত হয়। তাহাদের মধ্যে অন্ধ, বধির ও অন্যান্য ব্যাধিগ্রস্তরা ছিল। আদম (আ) বলিলেন, প্রভু! আমার সন্তানদেরকে সমান করিয়া সৃষ্টি করিলেন না কেন? আল্লাহ তাআলা বলিলেন, আমার শুকরিয়া আদায় করা হউক উহাই আমার ইচ্ছা।

আবু হাতিম ইবন হিব্বান উদ্ধৃত হযরত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত রিওয়ায়াতে এই তথ্য আছে : এ সময় আল্লাহ তাআলা বলিলেন, আর তখন তাহার হস্তদ্বয় মুষ্টিবদ্ধ ছিল, তুমি তোমার ইচ্ছামত দুই হাতের একটি বাছিয়া নাও। আদম বলিলেন, আমি আমার প্রভুর দক্ষিণ হস্ত বাছিয়া লইলাম এবং আমার প্রভুর উভয় হস্তই দক্ষিণ হস্ত (তাহার শানের উপযুক্ত) ও বরকতময়। তারপর আল্লাহ তাআলা উভয় হস্ত প্রসারিত করিলেন। তখন উভয় হস্তে আদম ও তাহার সন্তান-সন্তুতিকে দেখা গেল। আদম বলিলেন, প্রভু! উহারা কাহারা? আল্লাহ তাআলা বলিলেন, উহারা তোমার সন্তান-সন্তুতি। প্রত্যেকটি মানুষের চক্ষুদ্বয়ের মধ্যবর্তী স্থানে তাহাদের আয়ু লিপিবদ্ধ ছিল। তাহাদের মধ্যকার এক ব্যক্তিকে সর্বাধিক উজ্জ্বল দীপ্তিময় দেখা গেল। তাহার আয়ু কেবল চল্লিশ বৎসর লিখিত ছিল। আদম বলিলেন, সে কে? আল্লাহ তাআলা বলিলেন, তোমার সন্তান দাউদ, আর তাহার আয়ু আল্লাহ তাআলা কেবল চল্লিশ বৎসর লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। আদম বলিলেন, প্রভু! ইহার আয়ু বৃদ্ধি করিয়া দিন। আল্লাহতাআলা বলিলেন : তাহার জন্য উহাই নির্ধারিত করা হইয়াছে। তখন আদম বলিলেন, আমি আমার নিজ আয়ু হইতে তাহার জন্য ষাট বৎসর দিয়া দিলাম। আল্লাহ তাআলা বলিলেন, উহা হইতেছে তোমার ও তাহার মধ্যকার ব্যাপার। তুমি জান্নাতে বসবাস কর। তারপর আদম আল্লাহ যত দিন চাহিলেন ততদিন জান্নাতে বসবাস করিলেন। তারপর সেখান হইতে অবতরণ করিলেন।

আদম তাঁহার মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করিতে থাকেন। অবশেষে নির্দিষ্ট সময়ে মৃত্যুর ফেরেশতা তাঁহার নিকট আসিলেন। আদম তাহাকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন : আপনি সময়ের পূর্বেই আসিয়াছেন। আমার জন্য তো হাজার বৎসর আয়ু বরাদ্দ করা হইয়াছে। মৃত্যুর ফেরেশতা বলিলেন : হাঁ, তাহা সত্য বটে, তবে আপনি আপনার পুত্র দাউদের জন্য তাহা হইতে ষাট বৎসর দান করিয়া ফেলিয়াছেন। আদম তাহা অস্বীকার করিয়া বসিলেন। এজন্য তাহার সন্তানদের মধ্যেও অস্বীকার করার প্রবণতা দেখা দেয়। আদম বিস্মৃত হন, সুতরাং তাহার সন্তানদের মধ্যেও বিস্মৃতি প্রবণতা দেখা দেয়। সেই দিন হইতেই লিপিবদ্ধ করার এবং সাক্ষী রাখার আদেশ দেওয়া হয় (ইব্‌ন হিব্বান, হাদীছ নং ৬১৩৬; আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ., ৮২)।

কিন্তু পূর্বোল্লিখিত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত অন্য হাদীছে দাউদ (আ)-এর বয়স চল্লিশ বৎসরের স্থলে ষাট বত্সর বলিয়া উল্লেখ রহিয়াছে। আল্লাহকে সব বলিয়া স্বীকারোক্তি

আল্লাহতাআলা কুরআন শরীফে ইরশাদ করেন :

“স্মরণ কর, তোমার প্রতিপালক আদম সন্তানের পৃষ্ঠদেশ হইতে তাহার বংশধরকে বাহির করেন এবং তাহাদের নিজেদের সম্বন্ধে স্বীকারোক্তি গ্রহণ করেন এবং বলেন, আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই; তাহারা বলে, হাঁ, অবশ্যই, আমরা সাক্ষী রহিলাম। ইহা এইজন্য যে, তোমরা যেন কিয়ামতের দিন না বল, আমরা তো এ বিষয়ে গাফিল ছিলাম। কিংবা তোমরা যেন না বল, আমাদের পূর্বপুরুষগণই তো আমাদের পূর্বে শিরক করিয়াছে, আর আমরা তো তাহাদের পরবর্তী বংশধর। তবে কি পথভ্রষ্টদের কৃতকর্মের জন্য আপনি আমাদেরকে ধ্বংস করিবেন” (৭ : ১৭২-৩)

হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) এই আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (স)-কে বলিতে শুনিয়াছি : আল্লাহ তাআলা আদম (আ)-কে সৃষ্টি করিয়া তাহার দক্ষিণ হস্ত আদমের পৃষ্ঠে বুলাইয়া তাঁহার সন্তানদিগকে নির্গত করেন এবং বলেন, ইহাদিগকে জান্নাতের জন্য এবং জান্নাতীদের আমলসহ সৃষ্টি করিয়াছি। তারপর তিনি পুনরায় তাঁহার পৃষ্ঠে হাত বুলাইয়া আরও অনেক বংশধরকে নির্গত করিলেন এবং বলিলেন : ইহাদিগকে জাহান্নামের জন্য এবং জাহান্নামীদের আমলসহ সৃষ্টি করিয়াছি। এক ব্যক্তি বলিল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাহা হইলে আর আমল দিয়া কী হইবে? রাসূলুল্লাহ (স) বলিলেনঃ “যখন আল্লাহ তাআলা কোন বান্দাকে জান্নাতের জন্য সৃষ্টি করেন তখন তিনি তাহাকে জান্নাতীদের আমল করার তৌফিক দেন, জান্নাতীদের আমল করা অবস্থায় তাহার মৃত্যু হয় এবং উহার দ্বারাই সে জান্নাতে প্রবেশ করে। পক্ষান্তরে যখন তিনি কোন বান্দাকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেন, তাহাকে তিনি জাহান্নামের আমল করার আকাশ দেন। জাহান্নামীদের আমলে রত থাকা অবস্থায়ই সে মৃত্যুবরণ করে এবং উহার দ্বারাই সে জাহান্নামে প্রবেশ করে (আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী প্রমুখ ইমাম মালিক সূত্রে হাদীছটি বর্ণনা করেন; আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১ খ., ৮৩)।

হযরত উবাই ইবন কাব (রা)-এর এ সংক্রান্ত বর্ণনায় আরও কিছু তথ্য রহিয়াছে। যেমন আল্লাহ তাআলা আদম সন্তানদের পৃষ্ঠদেশ হইতে তাহাদের সন্তানদিগকে নির্গত করিয়া তাহাদের সকলকে একত্র করেন, তাহাদিগকে বিভিন্নরূপ করেন, তারপর তাহাদিগকে অবয়ব দান করেন, তারপর তাহাদিগকে বাকশক্তিসম্পন্ন করেন। তাহারা বাক্যালাপ করে। তারপর তিনি তাহাদের নিকট হইতে অঙ্গীকার গ্রহণ করেন এবং তাহাদিগকে তাহাদের সত্তার উপর সাক্ষী করেন এই বলিয়া যে, আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নহি। তাহারা সকলে বলিল : হাঁ (আপনি আমাদের প্রতিপালক)। তখন আল্লাহ তাআলা বলিলেন, আমি তোমাদের উপর সপ্ত আকাশ, সপ্ত যমীন এবং তোমাদের পিতা আদমকে সাক্ষী রাখিতেছি, যেন কিয়ামতের দিন তোমরা বলিতে না পার যে, তোমরা ইহা জ্ঞাত ছিলে না। জানিয়া রাখ, আমি ব্যতীত কোন ইলাহ নাই। আমি ব্যতীত কোন প্রতিপালক নাই এবং আমার সহিত অন্য কাহাকেও শরীক সাব্যস্ত করিও না। অচিরেই আমি তোমাদের নিকট আমার রাসূলগণকে প্রেরণ করিব। তাহারা তোমাদিগকে আমার অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করাইয়া দিবেন। আমি তোমাদের প্রতি আমার কিতাবসমূহ নাযিল করিব। তাহারা বলিল, আমরা সাক্ষ্য দিতেছি যে, আপনি আমাদের প্রভু ও মাবুদ, আপনি ব্যতীত আমাদের আর কোন প্রতিপালক ও মাবুদ নাই। তাহারা সকলে ইহা স্বীকার করিল। আদম (আ)-কে তাহাদের উপর তুলিয়া ধরা হইল, তিনি তাহাদের দিকে তাকাইয়া রহিলেন। তিনি তাহাদের মধ্যে ধনী-গরীব, সুশ্রী-কুশ্ৰী সকলকেই দেখিলেন। তিনি বলিলেন : প্রভু! আপনার বান্দাদের সকলকে আপনি যদি সমান করিয়া সৃষ্টি করিতেন। আল্লাহ তাআলা বলিলেন : আমি চাহিয়াছি যাহাতে (নিমাতসমূহের জন্য) আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা হয় (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ৮৪)।

তিনি নবীগণকে প্রত্যক্ষ করিলেন। তাঁহাদের মধ্যকার কেহ কেহ উজ্জ্বল প্রদীপের মত চমকাইতেছিলেন। রিসালাত ও নবুওয়াত সম্পর্কে তাঁহাদের নিকট হইতে স্বতন্ত্র একটি অঙ্গীকার গ্রহণ করা হইয়াছিল, যাহা তাঁহার নিম্নোক্ত বাণীতে বিধৃত হইয়াছে :

“স্মরণ কর, যখন আমি নবীদের নিকট হইতে অঙ্গীকার গ্রহণ করিয়াছিলাম; তোমার নিকট হইতেও এবং নূহ, ইবরহীম, মূসা ও মরিয়ম তনয় ঈসার নিকট হইতেও গ্রহণ করিয়াছিলাম দৃঢ় অঙ্গীকার” (৩৩ : ৭)।

উবাই (রা) হইতে বর্ণনা উদ্ধৃত করিয়া ইমাম রাযী (র) বলেন, “সেদিন আল্লাহ কিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী সকল আদম-সন্তানকে সৃষ্টি করিয়া তাহাদের অবয়ব দান করেন বা শক্তিসম্পন্ন করেন। তাহারা কথা বলে এবং আল্লাহ তাআলা তাহাদের নিকট হইতে অঙ্গীকার গ্রহণ করেন। সাথে সাথে তাহাদিগকেই তাহাদের সম্পর্কে সাক্ষী রাখেন, আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নহি? জবাবে তাহারা বলেন, হাঁ। এই অঙ্গীকার গ্রহণের স্থান সম্পর্কে বিভিন্ন মত রহিয়াছে :

(১) কাহারো মতে, উহা রূহের জগতে ঘটিয়াছিল;

(২) কাহারো মতে, আদম (আ)-এর দুনিয়ায় আগমনের পর উক্ত ঘটনাটি ঘটে;

(৩) কেহ কেহ আরাফাতের “নামান” নামক স্থানের কথা উল্লেখ করিয়াছেন। যেমন ইবন আব্বাস (র) হইতে বর্ণিত আছে : আল্লাহ তাআলা নামানে অঙ্গীকার গ্রহণ করেন অর্থাৎ আরাফাতে (তানযীমুল আশতাত, ১খ, পৃ. ১১৩, ইসলাহী কুতুবখানা, দেওবন্দ)। ঘটনাটি ঘটিয়াছিল যিলহজ্জ মাসের নবম তারিখে (বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, পৃ. ৮৩; ইবন আব্বাস বর্ণিত হাদীছ)।

বান্দাদেরকে সাক্ষী রাখার তৎপর্য

আয়াতে সুস্পষ্টভাবে বলা হইয়াছে : “আল্লাহ তাআলা তাহাদিগকে তাহাদের নিজেদের সম্পর্কে সাক্ষী রাখিলেন” (৭১৭২)।

এই সাক্ষী রাখার ব্যাপারটি কী ছিল তাহার ব্যাখ্যা সম্পর্কেও বিভিন্ন মত রহিয়াছে। (১) কেহ কেহ ইহাকে রূপক অর্থে গ্রহণ করিয়াছেন। যেমন তাফসীর বায়যাবীতে আছে যে, আল্লাহ তাআলা তাহাদের কাছে দলীল-প্রমাণ উপস্থাপিত করিয়া তাহাদের বিবেক-বুদ্ধিতে এই মোগ্যতা ও সহজাত শক্তি প্রদান করেন যে, তাহারা আল্লাহর একত্ববাদ সুস্পষ্টভাবে অনুধাবন করিতে সক্ষম হয়। ফলে তাহারা এ সমস্ত সত্তার সমপর্যায়ে উন্নীত হইয়া যায় যাহাদিগকে আল্লাহ তাআলা– (আমি কি তোমাদের প্রভু নই) বলার সাথে সাথে জবাব দিয়াছিল,(হাঁ), আপনি আমাদের প্রতিপালক! আল্লাহকে রব বা প্রতিপালকরূপে চিনিয়া লওয়ার শক্তি প্রদানের পর তাহারা যে উহাতে সক্ষম ও সমর্থ হইয়া উঠিয়াছে, উহাকেই উক্ত আয়াতে ১৪ বা সাক্ষী রাখা বলা হইয়াছে। (২) অনেকের মতে এই অঙ্গীকার শাব্দিকভাবেই করা হইয়াছিল, রূপক অর্থে নহে। হযরত ইব্‌ন আব্বাস (রা)-এর হাদীছে উহাই ব্যক্ত হইয়াছে এইভাবে : “নবী করীম (স) বলেন, আল্লাহ তাআলা আদমের সন্তানদের নিকট হইতে তাঁহার পৃষ্ঠদেশে থাকা অবস্থায় অঙ্গীকার গ্রহণ করেন, অতঃপর তাঁহার পৃষ্ঠদেশ হইতে তাহার সমস্ত বংশধরকে নির্গত করেন। তারপর তাহার সম্মুখে তাহাদিগকে ছড়াইয়া দেন। তারপর তাহাদের সহিত সামনাসামনি কথোপকথন করেন। তিনি জিজ্ঞাসা করেন, আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নহি। তাহারা বলে, হাঁ, আমরা অবশ্যই সাক্ষী রহিলাম (সুনান নাসায়ীর বরাতে বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, জিলদ ১, পৃ. ৮৩)।

সহীহ হাদীছের এই বর্ণনা হইতে সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, আসলেই আক্ষরিক অর্থে সাক্ষী রাখার ব্যাপারটি ঘটিয়াছিল। তালীকুস সাবীহ ফী শারাহ মিশকাতিল মাসাবীহ গ্রন্থে এরূপই উল্লিখিত হইয়াছে। আল্লামা শাব্বীর আহমাদ উছমানী (র) তদীয় তাফসীরে লিখেন, “সৃষ্টির ঊষালগ্নে প্রদত্ত সেই খোদায়ী শিক্ষার প্রভাবেই সর্বযুগের পৃথিবীর সর্বএলাকার আদম সন্তানদের মধ্যে সাধারণভাবে আল্লাহর প্রভুত্বের বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণা বিদ্যমান দেখা যায়। ইহা সুস্পষ্ট যে, সৃষ্টির শুরুর সেই ঊষা লগ্নে গোটা মানবজাতিকে নিশ্চয়ই রবুবিয়তের এই আকীদা-বিশ্বাস শিক্ষা দেওয়া হইয়াছিল (তাফসীরে উছমানী, ৭ : ১৭২ আয়াতের পাদটীকা)।

আল্লাহকে রব হিসাবে স্বীকার করিবার সেই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকারের কথা স্মরণ আছে বলিয়াও কোন কোন মনীষী উল্লেখ করিয়াছেন। হযরত আলী (রা) বলেন : “আমার সেই অঙ্গীকারের কথা সুস্পষ্ট স্মরণ আছে যে দিন আমার প্রভু পরয়ারদিগার আমার নিকট হইতে অঙ্গীকার গ্রহণ করেন। আমি সুস্পষ্টরূপে তাহাদিগকেও চিনিতে পারি যাহারা সেই দিন আমার ডান দিকে ও আমার বাদ দিকে উপস্থিত ছিলেন।” সাহল ইবন আবদুল্লাহ তস্তরী (র) বলেন, “আমি কি তোমাদের রব নহি” দিবসের সেই অঙ্গীকারের কথা আমার স্মরণ আছে (আল- ইয়াওয়াকীতুল জাওয়াহির গ্রন্থে ইহা উল্লিখিত রহিয়াছে)।

হযরত যুন-নূন মিসরী (র)-কে এই সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হইলে তিনি বলেন, “উহা যেন এখনও আমার কানে বাজিতেছে।” কেহ কেহ তো উহাকে এমনি ঘটনা বলিয়া ধারণা করিয়াছেন যেন উহা মাত্র গতকল্য ঘটিয়াছে (তাফসীর রূহুল মাআনী, উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে)। একটি সংশয় নিরসন

‘আলাস্তু বিরাব্বিকুম’ দিবসের আলোচনাসম্বলিত আয়াত ও হাদীছের বর্ণনায় বাহ্যত একটি বৈপরিত্য পরিলক্ষিত হয়, যাহাতে সাধারণ পাঠকগণ বিভ্রান্ত হইতে পারেন। ব্যাপারটি এই যে, আয়াতের দ্বারা প্রতীয়মান হয়, আদম সন্তানদিগকে আদম সন্তানদেরই পৃষ্ঠদেশ হইতে নির্গত করা হইয়াছিল (দ্র. ৭ : ১৭২)। পক্ষান্তরে হাদীছের বর্ণনায় আছে : “অতঃপর তিনি আদমের পৃষ্ঠদেশে তাঁহার দক্ষিণ হস্ত বুলাইয়া দিলেন এবং তাঁহার মধ্য হইতে তাঁহার বংশধরগণকে নির্গত করিলেন”। তাহা হইলে ব্যাপারটি আসলে কী ঘটিয়াছিল? আদম সন্তানদিগকে আদমেরই পৃষ্ঠদেশ হইতে নির্গত করা হইয়াছিল, নাকি তাহাদেরই পরস্পরের পৃষ্ঠদেশ হইতে নির্গত করা হইয়াছিল?

প্রকৃতপক্ষে যাহা ঘটিয়াছিল তাহা এই যে, আদম (আ)-এর প্রত্যক্ষ সন্তান অর্থাৎ তাহার নিজ পুত্র-কন্যাগণকে তাঁহারাই পৃষ্ঠদেশ হইতে নির্গত করা হয়। এভাবে ধারাবাহিকতাসহ সকলেই সকলের পিতার পৃষ্ঠদেশ হইতে নির্গত হয়। তাই কুরআন ও হাদীছের উভয় বর্ণনাই সঠিক। সর্বপ্রথম নির্গমন যেহেতু আদমেরই পৃষ্ঠদেশ হইতে হইয়াছিল তাই হাদীছে সেভাবেই উল্লিখিত হইয়াছে। পক্ষান্তরে আয়াতের বর্ণনায় মধ্যবর্তী সন্তানদের মধ্য হইতে পরবর্তী সন্তানদের নির্গমনের উল্লেখ রহিয়াছে। সুতরাং উভয় বর্ণনার মধ্যে কোনই বৈপরিত্য নাই। শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদিছ দেহলবী (র) প্রণীত হুজ্জাতুল্লাহিল-বালিগা এবং আল-ইয়াওয়াকীত ওয়াল-জাওয়াহির প্রভৃতি গ্রন্থে এইরূপ উল্লিখিত হইয়াছে (তালীসকু সাবীহ ফী শারহি মিশকাতিল মাসাবীহ-এর বরাতে তানযীমুল আশতাত-হাল্লি আবীসাতিল মিশকত, ১ খ., ১১৫)।

ইবন কাছীর (র) হযরত আবু হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (স) বলিয়াছেনঃ আল্লাহ তাআলা আদম (আ)-কে ষাট হাত উচ্চতাবিশিষ্ট করিয়া সৃষ্টি করেন। তারপর কমিতে কমিতে মানবাকৃতি আজিকার পর্যায়ে পৌঁছিয়াছে (বুখারী ও মুসলিমের বরাতে আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১, পৃ. ৮৫)।

এক বর্ণনা হইতে জানা যায়, তাঁহার দেহের প্রস্থ ছিল সাত হাত (আহমাদ, ২ খৃ., ৫৩৫)। এতদ্ব্যতীত এক রিওয়ায়াতে তো স্পষ্টভাবে আছে, ১w.suel, বাট হাত উর্ধদিকে)। হযরত শায়খ আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী (র) ইহার ব্যাখ্যায় বলিতেনঃ আদম (আ)-এর এই দৈহিক উচ্চতা বেহেশতে ছিল । যখন তাঁহাকে পৃথিবীতে নামাইয়া দেওয়া হয় তখন তাহা সঙ্গতভাবে হ্রাস করিয়া দেওয়া হয় (বদরে আলম মীরাঠী, তর্জমানুস্ সুন্নাহ, ১খ, ৪৬৯, ইফাবা প্রকাশিত)।

হযরত ইবন আব্বাস (রা) কর্তৃক বর্ণিত : “পৃথিবীতে আদম (আ)-এর সর্বপ্রথম খাদ্য ছিল গম। জিবরাঈল (আ) তাঁহার কাছে সাতটি গমের দানাসহ উপস্থিত হন। আদম (আ) তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন : উহা কি? জিবরাঈল (আ) বলিলেন : উহা সেই নিষিদ্ধ ফল যাহা ভক্ষণ করিতে বেহেশতে আপনাকে বারণ করা হইয়াছিল, কিন্তু এতদসত্ত্বেও আপনি তাহা ভক্ষণ করিয়াছিলেন। আদম (আ) জিজ্ঞাসা করিলেন : উহা দ্বারা আমি কী করিব? জবাবে জিবরাঈল (আ) বলিলেন : উহা আপনি ভূমিতে বপন করিবেন। সে মতে তিনি তাহা বপন করেন। এই বর্ণনায় আছে । ঐ দানাসমূহের প্রত্যেকটির ওজন ছিল লক্ষ দানার চেয়েও বেশী। ঐ দানাগুলি বপনের পর ফসল উৎপন্ন হয়, তিনি উহা কর্তন করিয়া ঘরে উঠান, মাড়াইয়া পিষিয়া আটা বানান। অতঃপর মণ্ড বা খামীর করিয়া রুটি প্রস্তুত করেন। এইভাবে বহু রকম ক্লেশ ও পরিশ্রমের পর উহা ভক্ষণ করেন (তারীখ তাবারী, ১খ, ১২৮)। ইহাই ছিল আল্লাহ তাআলার পূর্ব-সতর্কবাণীর তাৎপর্য,যাহাতে তিনি আদম (আ)-কে বলিয়া দিয়াছিলেন?

“শয়তান যেন তোমাদের উভয়কে জান্নাত হইতে বাহির করিয়া না দেয়, দিলে তোমরা দুঃখ-কষ্ট পাইবে।”

ইবন আসাকির কর্তৃক উদ্ধৃত হযরত আনাস (রা) বর্ণিত হাদীছ হইতে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (স) বলিয়াছেন : “আদম ও হাওয়াকে পৃথিবীতে একত্রে নামাইয়া দেওয়া হয়। তখন তাহাদের পরণে ছিল জান্নাতের বৃক্ষপত্র। একত্র হওয়ার পর উত্তাপক্লিষ্ট আদম বসিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে হাওয়াকে উদ্দেশ্য করিয়া বলেন : হে হাওয়া! তাপ আমাকে ক্লিষ্ট করিয়াছে। রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, তখন জিবরাঈল তুলা লইয়া আসিয়া হাওয়াকে উহা দ্বারা সূতা কাটিতে বলেন এবং উভয়কে কাপড় বয়ন শিখাইয়া দেন (আল-বিদায়া ও ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ৭৪)। এইভাবে পৃথিবীতে তাঁহাদের বস্ত্র পরিধানের ব্যবস্থা হয়। কিন্তু তাঁহাদের প্রথম পরিহিত পোশাক ভেড়ার লোমের দ্বারা নির্মিত ছিল বলিয়া অন্য রিওয়ায়াতে উল্লিখিত হইয়াছে। প্রথমে ভেড়ার দেহ হইতে পশম খসাইয়া তারপর উহা হইতে সূতা কাটেন। তারপর আদম (আ) তাহার নিজের জন্য একটি জোব্বা এবং হাওয়া (আ)-এর জন্য একটি কামীস ও একটা ওড়না তৈয়ার করেন” (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১খ, ৮৫)।

আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত ইবন আব্বাস (রা) বলেন : জান্নাতের যে বৃক্ষপত্রে আদম ও হাওয়া (আ) সর্বপ্রথম লজ্জা নিবারণ করিয়াছিলেন, উহা ছিল ডুমুর বৃক্ষের পত্র (৭ : ২২ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে)। ইবন কাছীর এই বর্ণনা উদ্ধৃত করিয়া মন্তব্য করেন, সম্ভবত উহা আহলে কিতাবগণের নিকট হইতে প্রাপ্ত তথ্য। আয়াতের বাহ্যিক অর্থ সুনির্দিষ্ট কোন বৃক্ষের প্রতি ইঙ্গিতবহ নহে, ব্যাপক অর্থে উহা ব্যবহৃত। আর উহা মানিয়া লইলেও কোন ক্ষতি নাই। আল্লাহই সম্যক অবগত (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ৭৩)।

আদম ও হাওয়া (আ) জান্নাতে কোন সন্তান লাভ করিয়াছিলেন কি না তাহা লইয়া মতানৈক্য রহিয়াছে। ইবন কাছীর (র) বলেন : জান্নাতে ঐ দম্পতি যুগলের কোন সন্তান জন্মগ্রহণ করিয়াছিল কিনা তাহা লইয়া সীরাতবিদগণের মধ্যে মতভেদ রহিয়াছে। তাহাদের কেহ কেহ বলিয়াছেন : জান্নাতে তাহাদের কোন সন্তান জন্ম গ্রহণ করে নাই। আবার অন্যরা বলিয়াছেন : না, বরং সেখানেই তাঁহাদের সন্তানের জন্ম হইয়াছে। কাবিল এবং তাহার ভগ্নীটির জন্ম জান্নাতেই হইয়াছিল।

ইমাম ইবন জারীর তাবারী (র) তদীয় ইতিহাস গ্রন্থে হাওয়ার গর্ভে বিশ দফায় চল্লিশজন সন্তানের জন্মগ্রহণের কথা উল্লেখ করিয়াছেন। ইব্‌ন ইসহাক তাহাদের নামসমূহও বর্ণনা করিয়াছেন (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ৮৯; আল-কামিল ফিত-তারীখ, ১খ, ৪২)। আবার কহে কেহ এক শত কুড়ি দফায় প্রত্যেক দফায় একজন পুত্র সন্তান ও একজন কন্যা সন্তান মোট দুই শত চল্লিশজন সন্তানের জন্ম লাভের কথা উল্লেখ করিয়াছেন। সর্বপ্রথম দফায় কাবীল এবং তাহার যমজ ভগ্নী একলীমা এবং সর্বশেষ দফায় আবদুল মুগীছ এবং তদীয় যমজ ভগ্নী উম্মুল মুগীছ জন্মগ্রহণ করেন। তারপর ক্রমান্বয়ে তাহাদের সন্তান-সন্তুতির সংখ্যা বৃদ্ধি পাইতে থাকে, যাহার কথা আল্লাহ তাআলা ব্যক্ত করিয়াছেন এইভাবে :

“হে মানব! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর যিনি তোমাদিগকে এক ব্যক্তি হইতে সৃষ্টি করিয়াছেন ও যিনি তাহা হইতে তাহার স্ত্রীকে সৃষ্টি করেন, যিনি তাহাদের দুইজন হইতে বহু নর-নারী ছড়াইয়া দেন” (৪:১)

ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করিয়াছেন যে, চারি লক্ষ সন্তান-সন্তুতি ও অধস্তন বংশধর না দেখিয়া আদম (আ) এই পৃথিবী হইতে বিদায় নেন নাই (কাসাসুল আম্বিয়া, ইবন কাছীর, পৃ. ৫৭)। তাঁহার এই সন্তান-সন্তুতির মধ্যে তাঁহার পুত্র শীছ (আ) ছিলেন অনন্য মর্যাদার অধিকারী। হাবীলের নিহত হওয়ার পর আদম (আ) এতই ভাঙ্গিয়া পড়েন যে, আওযাঈ-হাসান-ইবন আতিয়্যা বর্ণিত রিওয়ায়াতে আছে আদম (আ) জান্নাতে অবস্থান করেন এক শত বৎসর। বর্ণনান্তরে ষাট বৎসর; জান্নাত হারানোর দুঃখে আক্ষেপ করিয়া কান্নাকাটি করিয়া কাটান চল্লিশ বৎসর (ইব্‌ন আসাকিরের বরাতে কাসাসুল আম্বিয়া, ইবন কাছীর প্রণীত, পৃ. ২৯)।

শীছ শব্দের অর্থ আল্লাহর দান। পুত্র বিরহে শোকাতুর আদম (আ) আল্লাহর এই দান পাইয়া অনেকটা শান্ত হইয়াছিলেন। এই শীছ (আ) পরবর্তীতে আসমানী গ্রন্থধারী রাসূলও হইয়াছিলেন। সুতরাং তাঁহার মর্যাদা অন্যদের তুলনায় অনেক বেশী ছিল।

আদম (আ)এর পুত্র শয়তানের দাস?

আদম-হাওয়া (আ)-এর সন্তান-সন্তুতির আলোচনা প্রসঙ্গে ইমাম আহমদ প্রমুখ বিশিষ্ট মুহাদ্দিছ বর্ণিত এক হাদীছে আছে, হুযূর (স) বলেন : হাওয়ার সন্তানগণ বাঁচিত না। একবার হাওয়ার গর্ভে সন্তান আগমন করিলে শয়তান তাঁহার নিকট আসিয়া বলিল, তুমি উহার নাম আবদুল হারিছ রাখিয়া দাও। তাহা হইলে সে বাঁচিবে। সে মতে তিনি তাহার আবদুল হারিছ বলিয়া নামকরণ করিলেন এবং সত্য সত্যই এই সন্তানটি বাঁচিয়া যায়। উহা ছিল শয়তানের প্ররোচনা ও নির্দেশ (কাসাসুল আম্বিয়া (উর্দু খুলাসাতুল আম্বিয়ার অনুবাদ), গদ্যানুবাদ মোহাম্মদ হাসান এফ.এম.এম.এ, বি-এড, ইসলামিয়া, লাইব্রেরী, আন্দরকিল্লা চট্টগ্রাম, ১ম প্রকাশ ১৯৪, পৃ. ৪৫; আহমদ ৫খ, ১১)।

তিরমিযী, ইবন জারীর, ইবন আবী হাতিম, ইবন মারদুয়ায় প্রমুখ বিশিষ্ট মুহাদ্দিছ ও মুফাসসিরও তাঁহাদের তাফসীরে এই হাদীছ রিওয়ায়াত করিয়াছেন। হাকেম ও তদীয় মুস্তাদরাক কিতাবে উহা উদ্ধৃত করিয়াছেন। হাকেম তো রীতিমত উহার “সনদ সহীহ, যদিও বুখারী মুসলিম (র) উহা রিওয়ায়াত করেন নাই” বলিয়া মন্তব্য করিয়াছেন। তিরমিযী বলিয়াছেন ও হাদীছটি হাসান-গরীব পর্যায়ের, উমার ইবন ইবরাহীমের সূত্র ছাড়া অন্য কোন সুত্রে উহা আমরা প্রাপ্ত হই নাই। কেহ কেহ আবদুস সামাদ সূত্রে বর্ণনা করিলেও উহাকে মারফু পর্যায়ে উত্তীর্ণ করেন নাই অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (স)-এর বাণীরূপে নহে, সাহাবীর উক্তিরূপেই বর্ণনা করিয়াছেন (তিরমিযী, হাদীস নং ৩০৭৭)। আল্লামা ইবন কাছীর (র) হাদীছটির সূত্র সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনার পর সিদ্ধান্ত টানিয়াছেন এইভাবে ও স্পষ্টতই উহা কাব আহবার সূত্রে প্রাপ্ত, স্পষ্টতই রাবী উহা ইসরাঈলী উপাখ্যান হইতে প্রাপ্ত হইয়াছেন (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ৮৯)। উক্ত হাদীছ সম্পর্কে আমাদের এই দীর্ঘ আলোচনার কারণ হইতেছে হারিছ শয়তানের একটি নাম। তাই আবদুল হারিছ অর্থ শয়তানের দাস। আল্লাহর খিলাফতের মর্যাদা লাভকারী এবং শয়তানের তার্যিমী সিজদাপ্রাপ্ত সম্মানিত আদম (আ)-এর সন্তানের এরূপ নামকরণ সহজে মানিয়া লওয়া যায় না।

এজন্য হাসান বসরী (র), যে সমস্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় উক্ত হাদীছ বলিয়া কথিত রিওয়ায়াত বর্ণনা করা হইয়াছে, সেগুলির ভিন্ন ব্যাখ্যা করিয়াছেন। তিনি যদি উক্ত বর্ণনাটিকে মরফু হাদীছ বলিয়া মানিয়া লইতেন তাহা হইলে ভিন্নতর ব্যাখ্যার আশ্রয় লইতেন না।

আল্লামা ইবন কাছীর (র) একটি যুক্তির দ্বারাও উক্ত বর্ণনাটির মারফু হাদীছ হওয়ার বিষয়টি নাকচ করিয়া দিয়াছেন। তাহার যুক্তি হইল : আল্লাহ তাআলা অদম (আ) ও হাওয়া (আ)-কে মানব জাতির উৎসমূলরূপে এবং তাঁহাদের দ্বারা অগণিত মানব-মানবী সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিয়াছেন। এমতাবস্থায় হাওয়ার সন্তান বাঁচিত না তাহা কেমন করিয়া হইতে পারে! নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, উহাকে নবী করীম (স)-এর হাদীছ বলাটা ভ্রম প্রমাদ, ইহাকে মওকুফ বা সাহাবীর উক্তি আখ্যা দেওয়াই বিশুদ্ধতর। আমি আমার তাফসীর গ্রন্থে উহাই লিখিয়াছি (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ৯০)।

হাবীল-কাবীলের ঘটনা ও পৃথিবীর প্রথম নরহত্যা

কুরআন শরীফে হাবীল-কাবীলের ঘটনা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবৃত হইয়াছে। কেননা ইহাই ছিল পৃথিবীতে হানাহানি ও ভ্রাতৃ-হননের সর্বপ্রথম ঘটনা।  

পূর্বেই উক্ত হইয়াছে যে, আদি মাতা হাওয়া (আ) প্রতিবারে দুইজন করিয়া সন্তান প্রসব করিতেন। উহাদের একজন পুত্র সন্তান এবং অন্য জন কন্যা সন্তান।

ফার্সী ‘খুলাসাতুল আম্বিয়া অবলম্বনে রচিত উর্দু কাসাসুল আম্বিয়া কিতাবের (মূল ফার্সী ভাষ্য হাজী মুহাম্মদ সাঈদ, উর্দু গ্রন্থাবলীর বিখ্যাত প্রকাশক, খালাসীটোলা, কোলকাতা, উর্দু ভাষ্য তদীয় পুত্র হাজী মুহাম্মদ শফীর এবং অপর উর্দু ভাষ্যটি গোলাম নবী কুমিল্লায়ী, প্রকাশক অধুনালুপ্ত কুরআন মঞ্জিল, বাবু বাজার, ঢাকা, বাংলা কাসাসুল আম্বিয়া পুঁথি উহা অবলম্বনেই রচিত। –জালালাবাদী)। বর্ণনা অনুযায়ী হযরত আদম (আ) ও হাওয়া দম্পতি ভারতবর্ষে আসিয়া বসবাস শুরু করিলে হাওয়া গর্ভবতী হন এবং প্রথমবারের মত একটি পুত্র সন্তান ও একটি কন্যা সন্তান প্রসব করেন। পুত্রটির নাম রাখা হয় কাবীল এবং কন্যাটির নাম রাখা হয় একলিমা । কন্যাটি অত্যন্ত রূপবতী ছিল। দ্বিতীয় দফায় তাহার গর্ভে যে যমজ পুত্র-কন্যার জন্ম হয় তাহাদের নাম রাখা হয় যথাক্রমে হাবীল ও গাযা। গাযা ততটা রূপবতী ছিল না। তাহাদের যখন বিবাহের বয়স হইল তখন একদা হযরত জিবরাঈল (আ) আদম (আ)-এর নিকট আগমন করিয়া বলেন, আল্লাহ তাআলা আপনার প্রতি সালাম জানাইয়া নির্দেশ দিয়াছেন যে, আপনি যেন হাবীলের সাথে কাবীলের যমজ ভগ্নির এবং কাবীলের সাথে হাবীলের যমজ ভগ্নির বিবাহের ব্যবস্থা করেন। সেমতে আদম (আ) তাঁহার উভয় সন্তানকে ডাকিয়া আল্লাহর নির্দেশের কথা তাহাদিগকে জানাইয়া দেন। কিন্তু কাবীল বাকিয়া বসিল এবং সে তাহার রূপবতী যমজ ভগ্নি একলিমাকে কোনমতেই হাতছাড়া করিতে রাজি হইল না। সে বলিল, আপনি যেহেতু হাবীলকে অধিক ভালবাসেন এইজন্য এরূপ বলিতেছেন। এইভাবে সর্বপ্রথম কাবীলই পৃথিবী বক্ষে পিতৃ-আদেশ অমান্য করিল। কিন্তু আদম (আ) তাহার আপত্তি অগ্রাহ্য করিয়া শেষ পর্যন্ত হাবীলের সহিত একলিমার বিবাহ দেন। কাবীল তাহাতে অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হইয়া উঠে এবং হাবীলকে চাপ দিতে থাকে যেন তিনি একলিমাকে তালাক দেন, যাহাতে সে একলিমাকে গ্রহণ করিতে পারে। কিন্তু হাবীল কোনক্রমেই তাহাতে সম্মত হইলেন না। তিনি বলিলেন, একলিমা আমার বৈধ স্ত্রী। আমার পিতা আল্লাহর হুকুমে আমার সহিত তাহার বিবাহ দিয়াছেন। এমতাবস্থায় কোনক্রমেই আমি পিতৃ আদেশ ও আল্লাহর আদেশ লজ্জন করিতে পারি না। যখন তাহাদের এই বাদানুবাদের কথা আদম (আ)-এর কর্ণগোচর হইল তখন তিনি তাহাদের সান্ত্বনার জন্য উভয়কে আল্লাহর দরবারে কুরবানী পেশ করিতে নির্দেশ দিলেন। সাথে সাথে বলিয়া দিলেন, যাহার কুরবানী আল্লাহর দরবারে কবুল হইবে, একলিমা তাহারই অধিকারে থাকিবে। সে মতে হাবীল একটি উৎকৃষ্ট দুম্বা এবং কাবীল কিছু নিকৃষ্ট শস্য কুরবানীরূপে উৎসর্গ করিয়া মিনার পাহাড় শীর্ষে রাখিয়া দিলেন, যাহার বর্ণনা রহিয়াছে কুরআনের এই আয়াতে?

“আদমের দুই পুত্রের বৃত্তান্ত তুমি তাহাদেরকে যথাযথভাবে শোনাও। যখন তাহারা উভয়ে কুরবানী করিয়াছিল, তখন একজনের কুরবানী কবুল হইল এবং অন্য জনের কবুল হইল না” (৫ : ২৭)।

মোটকথা, উভয় ভ্রাতাই কুরবানী করিলেন এবং মিনার পাহাড় চূড়ায় নিজ নিজ কুরবানী রাখিয়া তাহা কবুল হওয়ার জন্য আল্লাহর দরবারে দুআ করিলেন। এমন সময় ধুম্রবিহীন একটি আগুনের হষ্কা আসিয়া উট পাখির মত হাবীলের কুরবানীকে গ্রাস করিল। কাবীলের কুরবানী সেখানে পড়িয়াই রহিল। তখন কাবীল হাবীলের প্রতি আরও ক্ষিপ্ত হইয়া বলিল : adiu J6 “আমি অবশ্যই তোকে হত্যা করিব”। এবারে হাবীল বলিলেন, iiiii.! অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকীদের কুরবানী কবুল করেন”। উহাতে ক্ষিপ্ত হইয়া কাবীল হাবীলকে হত্যা করে (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, পৃ. ৯৩)।

কাহিনী আকারে উপরে উদ্ধৃত হাবীল-কাবীলের সংঘাতের উক্ত ঘটনা এইরূপই বাংলা, উর্দু ও ফার্সী ভাষায় কাসাসুল আম্বিয়ার বদৌলতে লোকায়ত সাহিত্যের পর্যায়ে উন্নীত হইয়াছে। পুঁথি সাহিত্য ছাড়াও অধুনা প্রকাশিত পুঁথিভিত্তিক গদ্য পুস্তকাদিতেও উক্ত কাহিনীর এই বিবরণ দেশব্যাপী প্রচারিত হইতেছে (দ্র. আদি ও আসল কাছাছুল আম্বিয়া, কৃত এম, এন, ইমদাদুল্লাহ, এম. এ., বি.এ. অনার্স, রয়েল সাইজে ২ খণ্ডে প্রকাশিত, ৬৪০ পৃষ্ঠা কলেবর, প্রকাশক বাংলাদেশ তাজ কোম্পানী লিমিটেড, ৬. প্যারীদাস রোড, ঢাকা)। কিন্তু মৌলিক তাফসীর, হাদীছ ও ইতিহাস গ্রন্থসমূহের বর্ণনার আলোকে পর্যালোচনা না করিলে মূল বক্তব্য যথার্থ হইলেও উহাকে কাহিনীসুলভ অতিরঞ্জনের ছাপ রহিয়াছে বলিয়া প্রতীয়মান হয়। কেননা, তাফসীর তাবারী, ইবন কাছীর (র) কৃত বিশ্বকোষ পর্যায়ের ইতিহাস গ্রন্থ “আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া প্রভৃতি গ্রন্থে হাবীলের সহিত একলিমার বিবাহ হইয়াছিল বলিয়া কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না।

সুদ্দী, আবু মালিক, ইবন আব্বাস ও ইবন মাসউদ (রা) সূত্রে বর্ণিত আছে যে, কাবীল বয়সে হাবীলের চাইতে বড় ছিল। যমজ ভগ্নির রূপে বিমোহিত হইয়া সে বিবাহের ব্যাপারে পিতৃ-আদেশ অমান্য করে এবং তাহাকে বিবাহের ব্যাপারে নিজের অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালায়। আদম (আ) তাহাদের উভয়কে কুরবানী করার পরামর্শ বা আদেশ দেন। তারপর তিনি হজ্জের উদ্দেশ্যে মক্কায় চলিয়া যান।

আদম (আ) মক্কায় চলিয়া যাওয়ার পর হাবীল-কাবীল দুই ভাই কুরবানী দেন। হাবীলের অনেক মেষ ছাগল ছিল। তিনি একটি হৃষ্টপুষ্ট পশু কুরবানী দিলেন। পক্ষান্তরে কাবীল তাহার ক্ষেতের নিম্ন মানের এক আঁটি ফসল উৎসর্গ করিল। আকাশ হইতে আগুন আসিয়া হাবীলের কুরবানীকে গ্রাস করিল, কিন্তু কাবীলের উৎসর্গীকৃত ফসল পড়িয়া রহিল। আগুন তাহা স্পর্শ করিল না। তখন কাবীল ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিল এবং বলিল, আমি তোমাকে হত্যা করিব যাহাতে তুমি আমার ভগ্নিকে বিবাহ করিতে না পার (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১ম জিলদ, পৃ. ৮৬; তাফসীর তাবারী, ৬খ, পৃ. ১৯১)।

এই উক্তি হইতে প্রতীয়মান হয় যে, একলিমার সাথে হাবীলের বিবাহ হয় নাই। রাবী আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা) বলেন, “আল্লাহর কসম! নিহত ব্যক্তি (অর্থাৎ হাবীল) তাহাদের উভয়ের মধ্যে অধিকতর বলিষ্ঠ ছিল। কিন্তু তাহার সংযম তাহাকে ভ্রাতার উপর হাত ভোলা হইতে বিরত রাখে (প্রাগুক্ত)।

আবু জাফর বাকির (র)-এর এক বর্ণনামতে, আদম (আ)-এর উপস্থিতিতেই তাহার উক্ত পুত্রদ্বয়ের কুরবানী প্রদান এবং হাবীলের কুরবানী কবুল হওয়ার ও কাবীলের কুরবানী কবুল না হওয়ার ঘটনা ঘটে এবং তিনি তাহা অবলোকনও করিয়াছিলেন। এই সময় কাবীল তাহাকে অভিযুক্ত করিয়া বলে, আপনি তাহার পক্ষে দুআ করিয়াছেন বলিয়াই তাহার কুরবানী কবুল হইয়াছে, আমার পক্ষে দুআ করেন নাই বলিয়া আমার কুরবানী কবুল হয় নাই। ঐ সময়ই সে হাবীলকে হত্যার হুমকি দেয়।

হাবীল নিজেকে নির্দোষ বলিয়া ঘোষণা করিয়া বলেন, তোমার কুরবানী কবুল না হওয়ার জন্য আমি দায়ী নই । আল্লাহ তাআলার চিরন্তন রীতি এই যে, তিনি কেবল মুত্তাকী লোকদের কুরবানী কবুল করেন। আল্লাহ ভীতির পথ অবলম্বন করিলে তোমার কুরবানীও কবুল হইত । তুমি তাহা কর নাই। তাই তোমার কুরবানী কবুল হয় নাই। ইহাতে আমার কী অপরাধ (তাফসীর মাআরিফুল কুরআন, ১ম জিলদ, মুফতী মুহাম্মদ শফী, সূরা মায়িদার ২৭ নং আয়াতের ব্যাখ্যায়)।

আল্লাহর আদেশ শরীয়তের বিধান সকলের শিরোধার্য হওয়া উচিত–স্বয়ং পিতার মুখে তাহা শুনিয়াও কাবীল তাহা গ্রাহ্য করে নাই। আদম (আ) কেবল পিতাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন আল্লাহর প্রথম নবীও। তাই শুধু পিতারূপে আদেশ দিয়াই তিনি ক্ষান্ত হন নাই, নবীসুলভ প্রজ্ঞাও তিনি এই ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন এবং কুরবানী প্রদানের মাধ্যমে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণের সমান সুযোগ উভয় পুত্রকেই প্রদান করেন। সে পরীক্ষায়ও যখন কাবীল উত্তীর্ণ হইতে পারিল না, বরং তাহার চক্ষের সম্মুখেই হাবীলের কুরবানী কবুল হইল এবং নিজের অগ্রহণযোগ্যতা দিবালোকের মত স্পষ্ট হইয়া উঠিল, তখন তাহার সংযত ও নিবৃত্ত হইয়া যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সে নিবৃত্ত হইল না, বরং রাগে, ক্ষোভে ও অপমানে তাহার হিতাহিত জ্ঞান লোপ পাইল। তাহার মধ্যে জিঘাংসা ও পশুপ্রবৃত্তি মাথাচাড়া দিয়া উঠিল। সে পিতার সম্মুখেই আপন সহোদর ভাইকে হত্যার প্রকাশ্য হুমকি দিয়া বসিল : আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করিব।

এই ক্ষেত্রে হাবীলের যেহেতু কোন অপরাধ ছিল না, তাই তিনি পাল্টা রাগ করিয়া তাহার চাইতে দুর্বলতর প্রতিপক্ষকে চ্যালেঞ্জ করিতে পারিতেন। কিন্তু তিনি ছিলেন মুত্তাকী, পিতৃভক্ত, সচ্চরিত্রের অধিকারী। তিনি অত্যন্ত সংযতভাবে বুদ্ধিগ্রাহ্য ভাষায় কুরবানী কবুল হওয়া না হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করিয়া ভাইকে শান্ত করিবার চেষ্টা করিলেন। পরোক্ষে অগ্রজকে আল্লাহভীতি অবলম্বনের আহ্বান জানাইলেন। কিন্তু কাবীলের জিদ আরও বৃদ্ধি পাইল। অগত্যা হাবীল তদীয় অগ্রজের এই সীমালঙ্ঘন ও তাহার প্রাণসংহারী প্রচেষ্টার মুখেও চরম ধৈর্য ও সংযমের পরিচয় দিবেন বলিয়া নিজের সংকল্পও ঘোষণা করিলেন এইভাবে : “আমাকে হত্যা করার জন্য তুমি হাত তুলিলেও তোমাকে হত্যা করার জন্য আমি হাত তুলিব না; আমি তো জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি” (৫ : ২৮)।

কিন্তু এতসব উপদেশ সত্ত্বেও কাবীলের পাপাচারী মন টলিল না। সে তাহার সংকল্পে অটল থাকিল। সর্বশেষে তিনি তাহাকে জাহান্নামের শাস্তির কথাটাও স্মরণ করাইয়া দিলেন : “তুমি আমার ও তোমার পাপের ভার বহন কর এবং অগ্রবর্তী হও, ইহাই আমি চাহি এবং ইহা যালিমদের কর্মফল” (৫ : ২৯)।

কিন্তু তারপরেও কাবীল নিবৃত্ত হইল না। “অতঃপর তাহার চিত্ত ভ্রাতৃ হত্যায় তাহাকে প্ররোচিত করিল। ফলে সে তাহাকে হত্যা করিল। তাই সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হইল” (৫ :৩০)।

সেই ক্ষতির পরিমাণ যে কী বিপুল হযরত ইবন মাসউদ (রা) বর্ণিত হাদীছে তাহার বিবরণ দেওয়া হইয়াছে এইভাবে:

“রাসূলুল্লাহ (স) বলিয়াছেন, অন্যায়ভাবে নিহত প্রত্যেকটি ব্যক্তির একটি দায়ভাগ আদমের প্রথম সন্তানটির উপর বর্তায়। কেননা হত্যার রীতি সেই সর্বপ্রথম প্রবর্তন করিয়াছিল” (আহমাদ, জিলদ ১, পৃ. ৩৮৩, ৪৩০ ও ৪৩৩)। এই ব্যাপারে কুরআন শরীফেও সতর্কবাণী রহিয়াছে। আল্লাহ তাআলা বলেন :

“নরহত্যা অথবা দুনিয়া ধ্বংসাত্মক কার্য করা হেতু ব্যতীত কেহ কাহাকেও হত্যা করিলে সে যেন দুনিয়ার সকল মানুষকেই হত্যা করিল” (৫ : ৩২)। হাবীল-কাবীলের মনোমলিন্যের কারণ

কুরআন মাজীদে আদমের দুই পুত্রের বিবরণ বর্ণনা প্রসঙ্গে তাহাদের এক ভাই অপর ভাইকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে বলিয়া বিবৃত হইয়াছে। কিন্তু ঐ পুত্রদ্বয়ের নাম উল্লেখ করা হয় নাই। এমনিভাবে কোন কোন হাদীছে ও (উদাহরণস্বরূপ দ্র. আহমাদ ইবন হাম্বাল, মুসনাদ, আত-তাবারী, তাফসীর, কায়রো সং, ১০খ, ২৩০; রিওয়ায়াত ১১৭৬৭-১১৭৬৯) ইবনায় আদাম বা আদমের পুত্রদ্বয় শব্দই ব্যবহৃত হইয়াছে। এতদসত্ত্বেও মুফাসসিরগণ ইহা দ্বারা হযরত আদম আলায়হিস সালামের দুই পুত্র হাবীল (নিহত) এবং কাবীল (হস্তা)-কেই বুঝান হইয়াছে বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। খুব সম্ভব এই ব্যাপারে মুফাসসিরগণের তথ্যসূত্র হইল ইসরাঈলী রিওয়ায়াত, বিশেষত তাওরাত (দ্র. বাইবেলের আদিপুস্তক, ৪ ও ১০-১৬ প্রভৃতি)। সেখানে তাহাদের নাম হাবীল ও কাবীল বলিয়া উল্লেখিত হইয়াছে (দ্র. আদিপুস্তক, ৪ : ১-১৬)। উহাকেই আরবীকরণের সময়ে হাবীল ও কাবীলরূপে উল্লেখ করা হইয়াছে। এই তথ্যের উপর ভিত্তি করিয়াই আত-তাবারী তাহার ইতিহাস গ্রন্থে প্রত্যেক জায়গায়ই কাবীলকে কাইনরূপেই উল্লেখ করিয়াছেন (আত-তাবারী, তারীখ, নির্ঘন্ট)। কোন কোন মুফাসসির (যথা হাসান ও দাহহাক প্রমুখ)। [ ] কথাটি ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করিয়া উহা দ্বারা বানূ ইসরাঈল-এর ঘটনা বুঝানো হইয়াছে বলিয়া অভিমত ব্যক্ত করিয়াছেন (দ্র. আত-তাবারী, তাফসীর, গবেষণা সম্পা, মাহমূদ শাকির, কায়রো, ১০খ, ২২০, রিওয়ায়াত ১১৭২১; আর-রাযী, তাফসীর কাবীর, কায়রো ১৩১৮ হি, ৩খ, ৪০২; আল-আসী, রূহুল মাআনী, ৬খ, ১১১)। কিন্তু সাহাবী, তাবিঈ ও মাফাসসিরগণের অধিকাংশের মত হইল, উক্ত কথাটি দ্বারা হযরত আদম (আ)-এর ঔরসজাত দুই পুত্রকেই বুঝানো হইয়াছে (দ্র. আত-তাবারী, ১০খ, ২২০)। স্বয়ং কুরআন-হাদীছের কিছু বর্ণনা (কাক প্রেরণ করা প্রভৃতি) দ্বারা ইহার সমর্থন পাওয়া যায় (প্রাগুক্ত বরাত)।

কুরবানীর কারণ সম্পর্কেও মতভেদ রহিয়াছে। স্বয়ং কুরআন মাজীদে এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হয় নাই, বরং “উভয়ে যখন নিজ নিজ কুরবানী পেশ করিয়াছিল” (৫ : ৮২)-এর দ্বারা বাক্য শুরু করা হইয়াছে। ইহাতে বুঝা যায় যে, উভয়ের মধ্যে কুরবানী কবুল হওয়া ও না হওয়ার ব্যাপারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। আত-তাবারী বিভিন্ন সাহাবী (রা) ও তাবিঈ (র) হইতে বর্ণনা করিয়াছেন যে, এই কুরবানী তাহারা স্বেচ্ছায় অথবা আল্লাহ তাআলার নির্দেশের আওতাধীনে করিয়াছিলেন (আত-তাবারী, ১০, পৃ. ২০৩-এর বরাতে ইসলামী বিশ্বকোষ, ২৫খ, পৃ. ২৩৬)। মওলানা হিফযুর রহমানও কুরআনে তাহাদের বিবাহ কাহিনীর কোন উল্লেখ না থাকার কথাটা উল্লেখ করিয়া উক্ত ভ্রাতৃদ্বয়ের মনোমালিন্যের কারণ যে বিবাহ না হইয়া কেবল কুরবানী কবুল হওয়া না হওয়া জনিত মনোমালিন্যও হইতে পারে সে দিকেই প্রকারান্তরে ইঙ্গিত করিয়াছেন (দ্র. কাসাসুল কুরআন, বঙ্গানুবাদ, ১খ, ৫৬)।

কাবীল কর্তৃক ভাইকে হত্যা

কাবীলের মনে ভ্রাতৃ-হত্যার জন্য জিঘাংসাভাব জাগিয়াছিল সত্য, কিন্তু ইতোপূর্বে হত্যাকৰ্ম তো পৃথিবীতে আর কোন দিন ঘটে নাই। তাই হত্যার প্রক্রিয়াও তাহার জানা ছিল না। কীভাবে তাহার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করিবে এইজন্য তাহার চিন্তার অবধি ছিল না। এমতাবস্থায় ইবলীস উপস্থিত হইল। মুহূর্তে সে একটি মানুষের রূপ ধারণ করিয়া কাবীলের সম্মুখ দিয়া ধীরে ধীরে হাঁটিতে লাগিল এবং কাবীলের দৃষ্টির অগোচরে একটি কৃত্রিম সাপ বানাইয়া পথের উপর ছাড়িয়া দিল। সাপটি ধীরে ধীরে মানবরূপী ইবলীসের দিকে অগ্রসর হইতেছিল। অমনি সে যমিন হইতে বৃহৎ একখণ্ড পাথর উঠাইয়া সর্পের মস্তক লক্ষ্য করিয়া সজোরে নিক্ষেপ করিল। পাথরের আঘাতে তৎক্ষণাৎ সর্পটি মারা গেল। ইহা কাবীলের চোখের সম্মুখেই ঘটিল। ইব্‌ন জুরায়জের বর্ণনায় সাপের স্থলে পাখির কথা উল্লেখ রহিয়াছে (তাফসীর মাযহারী, ৩খ, পৃ. ৮১)।

কাবীলের সমস্যা দূরীভূত হইয়া গেল। হত্যা করিবার উপায় সে শিখিয়া ফেলিল। সুতরাং আর কাল বিলম্ব না করিয়া সে নিজেও বৃহদাকার পাথর হাতে লইয়া ঘুমন্ত হাবীলের মস্তক লক্ষ্য করিয়া সজোরে নিক্ষেপ করিল। সঙ্গে সঙ্গে হাবীলের মৃত্যু ঘটিল। কাসাসুল আম্বিয়ার বর্ণনামতে, এই ঘটনাটি ঘটে হযরত আদম (আ)-এর মক্কা শরীফে হজ্জ করিতে যাওয়াকালীন অনুপস্থিতির সুযোগে। কিন্তু ইবন কাছীর (র)-এর বর্ণনায় উহা ঘটে হযরত আদম (আ)-এর আপন বাড়িতে উপস্থিত থাকাকালে। তাঁহার বর্ণনায় সুস্পষ্টভাবে উল্লিখিত আছেঃ “একদা রাত্রিবেলা যখন হাবীলের চারণভূমি হইতে ফিরিতে বিলম্ব হইতেছিল, তখন চিন্তিত পিতা আদম (আ) কি কারণে বিলম্ব হইতেছে তাহা দেখিবার জন্য কাবীলকে চারণভূমিতে পাঠাইলেন” (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, পৃ. ৮৬; কাসাসুল আম্বিয়া, আরবী, ইবন কাছীর, পৃ. ৫৩)।

সেমতে কাবীল চারণভূমিতে গিয়া উপস্থিত হইল। তখন সত্য সত্যই হাবীল সেখানেই ছিলেন। কাবীল তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া বলিল, তোমার কুরবানী কবুল হইল, আমারটা হইল না।

জবাবে হাবীল বলিলেন, “আল্লাহ কেবল মুত্তাকীদের পক্ষ হইতেই কবুল করিয়া থাকেন।”

তিনি এই বাক্যের দ্বারা বুঝাইতে চাহিয়াছেন যে, তাকওয়া হইতেছে কবুলিয়তের পূর্বশর্ত। তুমি যদি তাকওয়া অবলম্বন করিয়া কবুলিয়তের সেই পূর্বশর্ত পূরণ করিতে ব্যর্থ হও, তবে তাহাতে আমার অপরাধ কি? কাবীলের কাছে উহার কোন সদুত্তর ছিল না। এইজন্য লজ্জিত হওয়ার পরিবর্তে তাহার ক্রোধ ও জিঘাংসাই বৃদ্ধি পায় এবং হস্তস্থিত একটি লৌহদণ্ড দ্বারা আঘাত করিয়া তাহার প্রাণ সংহার করে।

ইব্‌ন কাছীর (র)-এর বাকভঙ্গি হইতে প্রতীয়মান হয় যে, উহা সৰ্ববাদীসম্মত মত নহে। তাই তিনি আরও লিখেন, কাহারও কাহারও মতে সে তাহার দিকে একটি প্রস্তরখণ্ড নিক্ষেপ করে যাহা তাহার মস্তিষ্কে পতিত হইয়া তাহা চূর্ণ-বিচূর্ণ করিয়া ফেলে। তখন হাবীল নিদ্রিত অবস্থায় ছিলেন। আবার কেহ কেহ বলিয়াছেন, বরং সে তাহাকে সজোরে গলা চাপিয়া ধরিয়া শাসরুদ্ধ করে এবং তারপর হিংস্র প্রাণীদের মত কামড়াইয়া তাহার দেহকে ক্ষতবিক্ষত করিয়া ফেলে। এইভাবে হাবীলের মৃত্যু হয়। আল্লাহই সম্যক অবগত (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, পৃ. ৮৬)।

দামিশকের উত্তরে অবস্থিত কাসিউন পাহাড়ের চূড়ায় একটি গুহাকে রক্ত গুহা বলিয়া অভিহিত করা হইত। বর্তমানে ইহা “আরবাঈন” নামে পরিচিত। কাবীল হাবীলকে উক্ত স্থানে হত্যা করিয়াছিল বলিয়া জনশ্রুতি রহিয়াছে। এই জনশ্রুতির কথা আহলে কিতাব সূত্রে প্রাপ্ত। উহা কতটুকু সত্য তাহা একমাত্র আল্লাহই জানেন।

হাফিয ইব্‌ন আসাকির (র) তদীয় গ্রন্থে ‘আহমাদ ইব্‌ন কাছীর (র)-এর জীবনী আলোচনা প্রসঙ্গে একটি আশ্চর্যজনক কথা লিপিবদ্ধ করিয়াছেন।

‘তিনি (আহমদ ইবন কাছীর) একজন পুণ্যবান ব্যক্তি ছিলেন। তিনি একদা নবী করীম (স) আবু বাকর (রা) ও হাবীলকে স্বপ্নে দেখেন। তিনি ঐ সময় হাবীলকে আল্লাহর নামে কসম দিয়া জিজ্ঞাসা করেন যে, সত্য সত্যই ঐ স্থানটি তাহার হত্যাস্থল কিনা? তিনি শপথ পূর্বক তাহা স্বীকার করেন এবং বলেন যে, তিনি আল্লাহর নিকট দুআ করিয়াছিলেন যে, ঐ স্থানটিকে যেন তিনি দুআ কবুলের স্থানরূপে গ্রহণ করিয়া লন। আল্লাহ তাআলা তাহার সেই দুআটি কবুলও করেন। হাফিয ইবন কাছীর (র) মন্তব্য করেন যে, ইহা একটি স্বপ্নমাত্ৰ (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, পৃ. ৮৭)।

হাবীলকে হত্যার পরিণতিতে কাবীলের কি সর্বনাশ সাধিত হইল তাহার বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহ পাকের বাণী :

“ফলে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হইল”। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় সায়্যিদ কুতব শহীদ বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত হইয়া ধ্বংসের গহ্বরে নিপতিত হইল। নিজের সাহায্যকারী ও সাথী ভাইকে হারাইল। কেননা খুনীর জীবন কখনও সুখের হয় না। সে আখিরাতেও ক্ষতিগ্রস্ত হইল। ফলে সে হত্যা সংক্রান্ত তাহার প্রথম পাপ ও পরবর্তীতে পাপে ক্ষতিগ্রস্ত হইল। অতঃপর তাহার অপরাধের ফলশ্রুতিতে মৃত ভাইয়ের শবদেহ পচিয়া দুর্গন্ধ ছড়াইয়া অসহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করিল। আল্লাহ তাআলার সুগভীর প্রজ্ঞা সেই দুর্ধর্ষ খুনীর সম্মুখে তাহার একটি অক্ষমতা প্রকাশ করিয়া দিল। সে ভাইয়ের মৃতদেহ দাফন-কাফনে অক্ষম হইয়া পড়িল, এমনকি ক্ষুদ্র কাক যাহা পারে তাহাও সে পারে না এমন লজ্জাকর অবস্থায় সে নিপতিত হইল (ফী যিলালিল কুরআন, ২খ, পৃ. ৮৭৭; সূরা মায়িদার ৩০ নং আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে)।

আল্লামা শাব্বীর আহমদ উছমানী (র) তাহার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ব্যাখ্যায় বলেন : “পার্থিব ক্ষতি তো এই যে, এমন একজন পুণ্যবান ভাই যিনি তাহার বাহুবল হইতে পারিতেন, তাহাকেই সে হারাইল আর নিজে উম্মাদ হইয়া মৃত্যুবরণ করিল। হাদীছে আছে, যুলুম এবং ঘনিষ্ঠজনদের সহিত সম্পর্কচ্ছেদ করা এমন দুইটি পাপ যাহার শাস্তি আখিরাতের পূর্বে এই দুনিয়াতেও ভোগ করিতে হয়। আর পারলৌকিক ক্ষতি এই যে, যুলুম, ঘনিষ্ঠ জনদের সহিত সম্পর্কচ্ছেদ, ইচ্ছাকৃতভাবে নরহত্যা এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির দ্বার উন্মোচন করায় পৃথিবীতে এই জাতীয় যাবতীয় পাপের উদ্বোধনকারীরূপে সেই সকল পাপে তাহার একটি অংশ থাকিয়া যাইবে, যাহা স্পষ্টভাবে হাদীছে উক্ত হইয়াছে (সূরা মাইদার ৩০ নং আয়াতের তর্জমার পাদটীকায়, তাফসীরে উছমানী, ১খ, পৃ. ৫২২, পাদটীকা ১০৮)।

প্রথম লাশ দাফন

পৃথিবীতে যেহেতু ইতোপূর্বে কোন মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে নাই, তাই হাবীলের লাশ কাবীলের জন্য এক মহা সমস্যা হইয়া দেখা দিল। লাশ এইভাবে পড়িয়া থাকিলে তাহা পিতা-মাতা ও অন্যান্য ভাই-বোনের গোচরে আসিবে। হাবীলকে যেহেতু সে প্রকাশ্যেই হত্যার হুমকি দিয়াছিল এবং তাহার প্রতি তাহার বিদ্বেষ ও কোপানলের কথা অজ্ঞাত ছিল না, তাই এই লাশ দেখামাত্র যে কেহ চক্ষু খুঁজিয়া বলিয়া দিবে যে, ইহা একমাত্র কাবীলেরই কাজ হইতে পারে। তাই দুশ্চিন্তায় কাবীল দিক-বিদিক জ্ঞান হারাইয়া ফেলিল এবং লাশ কাঁধে তুলিয়া এদিক-সেদিক ছুটিতে লাগিল। ভাইয়ের লাশ লইয়া কাবীলের উদ্ৰান্তভাবে বেড়াইবার এই মেয়াদ কেহ চল্লিশ দিন, আবার কেহ এক বৎসর কাল দীর্ঘ ছিল বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন (তাফসীর মাযহারী, ৩খ, পৃ. ৮১; বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, পৃ. ৮৮)।

“অতঃপর আল্লাহ একটি কাক পাঠাইলেন, যে তাহার ভ্রাতার মৃতদেহ কিভাবে গোপন করা যায় তাহা দেখাইবার জন্য মাটি খনন করিতে লাগিল। সে বলিল, হায়! আমি কি এই কাকের মতও হইতে পারিলাম না, যাহাতে আমার ভ্রাতার মৃতদেহ গোপন করিতে পারি। অতঃপর সে অনুতপ্ত হইল” (৫ : ৩১)।

আস-সুদ্দী কতক সাহাবীর বরাতে বর্ণনা করেন যে, ঐ সময় আল্লাহ তাআলা দুইটি সহোদর কাক প্রেরণ করিয়াছিলেন। উভয় কাক সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং তাহাদের একটি অপরটিকে হত্যা করে। হত্যাকৰ্ম সম্পন্ন করার পর হন্তা কাকটি মাটি খনন করিয়া তাহার মৃত ভাইয়ের দেহটি গর্তে নিক্ষেপ করিল এবং তারপর তাহা মাটি চাপা দিল। তাহা প্রত্যক্ষ করিয়া কাবীল বলিয়া উঠিল, হায়! আমি কি ঐ কাকটির মতও হইতে পারিলাম না যে, আমার ভাইয়ের লাশটি লোকচক্ষুর অন্তরালে গোপন করিয়া ফেলি! তখন সে কাকের অনুসরণে ঐরূপই করিল এবং হাবীলের মৃতদেহ দাফন করিল (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, পৃ. ৮৮; তাফসীর তাবারী, ৬খ, পৃ. ১৯৭; তাফসীর রূহুল মাআনী, ৬খ, পৃ. ১১৫-১১৬)।

এই ঘটনার পর্যালোচনা প্রসঙ্গে আল্লামা হিফযুর রহমান লিখেন, হাবীল ছিলেন আল্লাহর প্রিয়পাত্র আর কাবীল ছিল অভিশপ্ত। তাই হাবীলের পবিত্র মৃতদেহের যাহাতে অবমাননা না হয়, আদম সন্তানগণের মৃত্যুর পর যাহাতে সম্মানজনকভাবে তাহাদের মৃতদেহ দাফনের সুন্নাত বা রীতি প্রবর্তিত হয় এবং কাবীলকে যেন তাহার লজ্জাজনক অপরাধের দরুন এই দুনিয়ায়ও লাঞ্ছিত অপমানিত হইতে হয়, সে তাহার নির্বুদ্ধিতা ও অদূরদর্শিতার কথা যাহাতে হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করিতে পারে তজ্জন্য এই ব্যবস্থা করা করা হইয়াছিল। এইজন্য আপন অপরাধ গোপন করার মত সাধারণ জ্ঞানটুকুও তাহার মনে উদ্রেক হয় নাই, বরং এমন একটি প্রাণীকে এই ব্যাপারে তাহার পথিকৃত করা হইল যাহার ধূর্ততা ও সহজাত নোংরামী সর্বজন বিদিত। ফলে শেষ পর্যন্ত কাবীলকে এই খোদোক্তি করিতে হয় হায়! আমি এই কাকটির মতও হইতে পারিলাম না (হিফযুর রহমান, কাসাসুল কুরআন, ১খ, ৬২)।

কাবীলের পরিণতি

মুজাহিদ (র)-এর বরাতে আল্লামা ইব্‌ন কাছীর (র) বলেন, “ভ্রাতৃ হত্যার দিনই কাবীলকে তাৎক্ষণিকভাবে উহার শাস্তি দেওয়া হয়। তাহার নলাকে তাহার উরুর সহিত সংলগ্ন করিয়া দেওয়া হয়, তাহার মুখমণ্ডলকে সূর্যের দিকে করিয়া দেওয়া হয়। সূর্য যে দিকে আবর্তিত হইত তাহার মুখমণ্ডলকে সেদিকেই ঘুরাইয়া দেওয়া হইত। ইহা ছিল তাহার পাপের আশু ফলস্বরূপ এবং তাহার দ্রোহ ও আপন ভ্রাতার প্রতি বিদ্বেষের পরিণতি।” রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, “আখিরাতের প্রাপ্য শাস্তি ছাড়াও দুনিয়ার ত্বরিৎ শাস্তি লাভের জন্য বিদ্রোহ ও নিকট আত্মীয়তা সম্পর্ক ছেদনের মত পাপ আর হয় না”(আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, পৃ. ৮৮; আরও দ্র. আবু দাউদ (৪৯০২), তিরমিযী (২৫১১), ইবন মাজা (৪২১১), আহমাদ, ৫খ, পৃ. ৩৬, ৩৮ ও ৩৮ এবং আল-আদাবুল-মুফরাদ, অধ্যায় ৩৩, হাদীছ নং ৬৭, তাশখন্দ মুদ্রণ ১৩৯০/১৯৭০)।

বাইবেল পুরাতন নিয়মের আদি পুস্তকে কাবীলের পরিণতি বর্ণিত হইয়াছে এইভাবে :“এরপর একদিন মাঠে থাকার সময় কয়িন তার ভাই হেলের সঙ্গে কথা বলছিল, আর তখন সে হেবকে আক্রমণ করে মেরে ফেলল। তখন সদাপ্রভু কয়িনকে বলেন, তোমার ভাই হেবল কোথায়? কয়িন বলল, আমি জানি না। আমার ভাইয়ের দেখাশোনার ভার কি আমার উপর? তখন সদাপ্রভু বললেন, এ তুমি কি করেছ? দেখ, জমি থেকে তোমার ভাইয়ের রক্ত আমার কাছে কাঁদছে। জমি যখন তোমার হাত থেকে তোমার ভাইয়ের রক্তগ্রহণ করবার জন্য মুখ খুলেছে, তখন জমির অভিশাপই তোমার উপর পড়ল। তুমি যখন জমি চাষ করবে, তখন তা আর তোমাকে তেমন ফসল দেবে না। তুমি পলাতক হয়ে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াবে। তখন কয়িন সদাপ্রভুকে বলল, এই শাস্তি আমার সহ্যের বাইরে। আজ তুমি আমাকে জমি থেকে তাড়িয়ে দিলে, যার ফলে আমি তোমার চোখের আড়াল হয়ে যাব। পলাতক হয়ে আমি পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াব, ফলে যার সামনে আমি পড়ব সে-ই আমাকে খুন করতে পারে। তখন সদাপ্রভু তাকে বললেন, তাহলে যে তোমাকে খুন করবে, তার উপর সাত গুণ প্রতিশোধ নেয়া হবে। এই বলে সদাপ্রভু কয়িনের জন্য এমন একটা চিহ্নের ব্যবস্থা করলেন যাতে কেউ তাকে হাতে পেয়েও খুন না করে” (আদিপুস্তক, ৪ ও ৮-১৫, সৃষ্টির আদিতে, প্রকাশক বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি, ঢাকা)।

বাইসেলের এই বর্ণনা বিভ্রান্তিকর। ইবন কাছীর (র) বলেন, আহলে কিতাব তথা ইয়াহুদী-খৃস্টান সমাজ যাহাকে তৌরাত বলিয়া মনে করে তাহাদের গ্রন্থে আমি দেখিয়াছি যে, আল্লাহ তাআলা কাবীলকে তাৎক্ষণিক শাস্তি না দিয়া অবকাশ দিয়াছিলেন এবং সে এডেনের পূর্ব দিকে অবস্থিত নূদ অঞ্চল বসবাস করে যাহাকে তাহারা কান্নীম নামে অভিহিত করিয়া থাকে (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, পৃ. ৮৮)। বর্তমান বাইবেলেও এই বক্তব্য বিদ্যমান আছে। কাবীলের বংশতালিকা প্রমাণ করে যে, তাৎক্ষণিকভাবে কাবীল শাস্তিপ্রাপ্ত হইয়া ধ্বংস হইয়া যায় নাই, বরং সুদীর্ঘ কাল পৃথিবীতে বসবাস করিয়া বংশ বিস্তার করিয়াছে।

পুত্র বিরহে আদম (আ)

এই প্রথমবারের মত পৃথিবীতে মানুষের মৃত্যু, তাহাও আবার নিজের প্রাণপ্রিয় সন্তানের মৃত্যু। তাই পুত্র বিরহে আদম (আ) ও মা হাওয়া (আ) অত্যধিক বিমর্ষ হইয়া পড়িলেন। পূর্বেই উক্ত হইয়াছে যে, হাবীল হত্যার সময় আদম (আ) হজ্জ উপলক্ষে মক্কা শরীফে ছিলেন। মক্কা হইতে প্রত্যাবর্তনের পর অনেক খোঁজ করিয়াও তিনি হাবীলের কোন সন্ধান পাইলেন না। লোকজনকে জিজ্ঞাসা করিলে তাহারাও ইহার কোন উত্তর দিতে পারিল না। কাবীলের অন্যায় জিদ এবং খুনের হুমকির কথা তাহার জানা ছিল। তাই হাবীলের ব্যাপারে তাহার দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। তাবারী ও ইবন কাছীর (র) প্রমুখ ঐতিহাসিকগণের গ্রন্থাবলীতে হাবীলের মৃত্যুতে আদম (আ)-এর শোকগাথা উদ্ধৃত হইয়াছে :

“বদলে গেছে জনপদ সব বদলেছে তার বাসিন্দারা
পৃথ্বী আনন ধুসরিত বীভৎস আজ বসুন্ধরা
রঙিনেরা রঙ হারালো সুস্বাদুরা স্বাদের খ্যাতি
লাবণীদের লাবণ্য নেই নেই চেহারায় রূপের ভাতি”।

জবাবে আদম (আ)-এর উদ্দেশ্যে ধ্বনিত হলোঃ
“হাবীলের পিতা! দুইজনই আজ নিহতের পর্যায়ে
জীবিত হন্তা নিহতেরই মত মরিতেছে তড়পায়ে।
জিঘাংসা বশে হলো যেন কাজ তাহার হস্ত দিয়া
আর্ত কণ্ঠে ফুকারি ফিরিছে সাদা শঙ্কিত হিয়া”।

(তাবারী, তারীখুল উমাম ওয়ার রুসুল-ওয়াল-মুলুক, ১০, পৃ. ২২০; ইবন কাছীর, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৫৫, কায়রো ১৯৯৭ খৃ.)।

ইবন কাছীর (র) তদীয় গ্রন্থে পংক্তিগুলি উদ্ধৃত করিয়া মন্তব্য করেন : “উক্ত পংক্তিগুলি সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ রহিয়াছে। যতদূর মনে হয়, শোকার্ত আদম (আ) বিলাপ ছলে তাহার নিজের ভাষায় কিছু বলিয়াছিলেন। পরবর্তীতে কোন কবি তাহা এইভাবে কবিতায় রূপ দান করিয়াছেন। আল্লাহই সম্যক জ্ঞাত (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ. পৃ. ৮৮)। উর্দু দায়িরাতুল মাআরিফ গ্রন্থে ও ইসলামী বিশ্বকোষে উক্ত ঘটনার বিবরণ প্রদান ও উক্ত শোকগাথা উদ্ধৃত করার পর মন্তব্য করা হইয়াছে : উক্ত ঘটনার এই সকল বিবরণ হাদীছ ও যুক্তির মৌল নীতিমালা অনুযায়ী সত্য নহে (ইসলামী বিশ্বকোষ, ২৫খ, পৃ. ২৩৭)। মা হাওয়া (আ) সংক্রান্ত কিছু কথা

কুরআন মজীদে বলা হইয়াছে :

“হে মানব! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি হইতে সৃষ্টি করিয়াছেন এবং যিনি তাহা হইতে তাহার স্ত্রীকে সৃষ্টি করেন, যিনি তাহাদের দুইজন হইতে বহু নর-নারী ছড়াইয়া দেন” (৪:১)।

উক্ত আয়াত হইতে আমরা জানিতে পারিলামঃ (১) একটিমাত্র মানুষ অর্থাৎ হযরত আদম (আ) হইতে গোটা মানবজাতির সৃষ্টি; (২) হাওয়া (আ) তাহারই দেহপিঞ্জর হইতে নিৰ্গত; (৩) হাওয়া বিশ্বের গোটা মানবজাতির মহীয়সী জননী। মহানবী (স) বলেন, “স্ত্রীলোকদের সহিত উত্তম আচরণ করিবে, কেননা নারীকে পাঁজর হইতে সৃষ্টি করা হইয়াছে” (বুখারী ও মুসলিম)।

 ইবন ইসহাকের মতে ইহার অর্থ হইল, হাওয়াকে আদমের বাম পাঁজর হইতে সৃষ্টি করা হইয়াছে। কুরতুবী ইহার অর্থ করিয়াছেন, স্ত্রীলোককে মূলত পাঁজরের সাথে তুলনা করা হইয়াছে এবং বলা হইয়াছে, স্ত্রীলোকের সৃষ্টির সূচনা পাঁজর থেকেই হইয়াছে এবং ইহাদের অবস্থা পাজরের। মত যদি ইহাদের বক্রতাকে সোজা করিতে চাও তবে তাহা ভাঙ্গিয়া যাইবে। অতএব পাঁজরের বক্ৰতা সত্ত্বেও যেমন তাহা থেকে কাজ নেওয়া হয় এবং ত্রুটি (বক্রতা) দূর করার চেষ্টা করা হয় না, তেমনি স্ত্রীলোকদের সাথেও নম্র ও সহানুভূতিশীল আচরণ করিতে হইবে। যদি তাহাদের সাথে রূঢ় আচরণ করা হয় তবে তাহাদের সাথে সম্বন্ধ মধুর হওয়ার চাইতে বরং আরো তিক্ত হইবে (ফতুহুল বারী, ৬খ, পৃ. ২৮৩-এর বরাতে হিফযুর রহমান, কাসাসুল কুরআন, বাংলা অনু, ১খ, পৃ. ৩৩; ইফা প্রকাশিত, ১ম সং, ১৯৯০ খৃ.)। কুরতুবীর এই বর্ণনায় পাঁজর হইতে স্ত্রীলোক সৃষ্টিকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ না করিয়া যে রূপক অর্থ গ্রহণ করা হইয়াছে তাহা সুস্পষ্ট।

বাইবেলের বর্ণনায় রহিয়াছে : “পরে সদাপ্রভু বললেন, ‘মানুষটির পক্ষে একা থাকা ভাল নয়। আমি তার জন্যে একজন উপযুক্ত সঙ্গী তৈরী করব। সদাপ্রভু মাটি থেকে যেসব ডাঙ্গার জীবজন্তু ও আকাশের পাখি তৈরী করেছিলেন সেগুলো সেই মানুষটির কাছে আসলো। সদাপ্রভু দেখতে চাইলেন তিনি সেগুলোকে কি বলে ডাকেন। তিনি সেইসব জীবন্ত প্রাণীগুলোকে যেটির যে নামে ডাকলেন সেটির সেই নামই হল। তিনি প্রত্যেকটি পোষ মানা ও পোষ না মানা এবং আকাশের পাখির নাম দিলেন। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে সেই পুরুষ মানুষটির অর্থাৎ আদমের কোন উপযুক্ত সঙ্গী দেখা গেল na। সেইজন্য সদাপ্রভু আদমের উপর একটা গভীর ঘুমের ভাব আনলেন। আর তাতে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। তখন তিনি তার একটা পাঁজর তুলে নিয়ে সেই ফাঁকা জায়গাটা বন্ধ করে দিলেন। আদম থেকে তুলে নেওয়া সেই পাঁজরটা দিয়ে সদাপ্রভু একজন স্ত্রীলোক তৈরী করে তাকে আদমের কাছে নিয়ে গেলেন। তাকে দেখে আদম বললেন, এবার হয়েছে। এর হাড়-মাংস আমার হাড়-মাংস থেকেই তৈরী। পুরুষ লোকের দেহের মধ্য থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে বলে একে স্ত্রীলোক বলা হয়। এজন্যেই মানুষ মা-বাবাকে ছেড়ে তার স্ত্রীর সঙ্গে এক হয়ে থাকবে আর তারা দুজন একদেহ হবে” (আদি পুস্তক ২ : ১৮-২৫)।

কুরআন, হাদীছ ও বাইবেলের উক্ত বর্ণনা হইতে আক্ষরিক অর্থেই হাওয়া যে আদম (আ)-এর পাঁজর হইতে সৃষ্ট এবং মানবজাতির পরম সম্মানিত আদিমাতা তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়। বাইবেলের বর্ণনায় প্রতীয়মান হয় যে, মা হাওয়াই প্রথমে শয়তানের দ্বারা প্ররোচিত হইয়া নিষিদ্ধ গাছের ফল ভক্ষণ করেন এবং তিনিই আদম (আ)-কে নিষিদ্ধ ফল খাইতে প্রলুব্ধ করেন। পক্ষান্তরে আল-কুরআনের বর্ণনায় নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার ব্যাপারে শয়তানের প্ররোচনাকেই দায়ী করা হইয়াছে এবং এই ব্যাপারে আদম ও হাওয়া (আ) দুইজনকে সমপর্যায়ে রাখিয়া এমনভাবে ঘটনাটি বিবৃত করা হইয়াছে, যাহাতে এই অপরাধের জন্য কেহ কাহারও উপর নির্ভরশীল বা কেহ কাহারও অগ্রণী বা কেহ কাহারও চাইতে বেশী অপরাধী ছিলেন এমনটি বুঝা যায় না। যেমন আল্লাহ পাক বলিয়াছেন :

“কিন্তু শয়তান উহা হইতে তাহাদের পদস্খলন ঘটাইল এবং তাহারা যেখানে ছিল সেখান হইতে তাহাদেরকে বহিস্কৃত করিল” (২৪ ৩৬)।

“শয়তান তাহাদের উভয়কে কুমন্ত্রণা দিল” (৭-২০)। বরং শয়তানের কুমন্ত্রণা ছিল শিকাররূপে। অন্যত্র আদম (আ)-এর প্রতিই ইঙ্গিত করা হইয়াছেঃ

“অতঃপর শয়তান তাহাকে কুমন্ত্রণা দিল” (২০ : ১২০)। “ বরং আরও সুস্পষ্টভাবে আদম (আ)-এর প্রতিই বিস্মৃতি, দৃঢ়তার অভাব এবং বিচ্যুতি আরোপ করা হইয়াছে। যেমনঃ

“আমি তো ইতোপূর্বে আদমের প্রতি নির্দেশ দান করিয়াছিলাম, কিন্তু সে ভুলিয়া গিয়াছিল! আমি তাহাকে সংকল্পে দৃঢ় পাই নাই” (২০ ও ১১৫)।

“আদম তাহার প্রতিপালকের হুকুম অমান্য করিল, ফলে সে ভ্রমে পতিত হইল” (২০ : ১২১)। এমতাবস্থায় নিষিদ্ধ গাছের ফল খাইয়া জান্নাত হারানোর জন্য কেবল মা হাওয়াকে দায়ী করা বাস্তবসম্মত নহে।

আদম (আ)-এর বর্ণনা প্রসঙ্গে ময়ুর, সাপ প্রভৃতি বাইবেলীয় কাহিনী বহুল প্রচলিত। বলা হইয়া থাকে যে, সাপের মুখ গহবরে প্রবেশ করিয়া শয়তান বেহেশতে প্রবেশ করিয়া মা হাওয়াকে নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার জন্য প্ররোচিত করিয়াছিল। ওসওয়াসা বা প্ররোচনা দেওয়ার জন্য শয়তানের বেহেশতে প্রবেশের আদৌ কোন প্রয়োজন ছিল না। কেননা তাহার কিয়ামত পর্যন্ত দীর্ঘায়ু এবং প্ররোচনা দানের শক্তি তাহার প্রার্থনা অনুযায়ী স্বয়ং আল্লাহ তাআলা তাহার জন্য মঞ্জুর করিয়াছিলেন, যাহা কুরআন শরীফের উদ্ধৃতিসহ পূর্বেই উক্ত হইয়াছে। সুতরাং সে বেহেশতের বাহির হইতেও প্ররোচিত করিতে সক্ষম ছিল। উপরন্ত সাপের মুখে প্রবিষ্ট শয়তানকে দেখিতে মানব চক্ষু ব্যর্থ হইলেও আল্লাহর পক্ষ হইতে বেহেশতের জন্য নিযুক্ত ফেরেশতা প্রহরীগণের দৃষ্টি এভাবে এড়াইয়া যাওয়া সম্ভবপর ছিল না। মানবীয় দৃষ্টি সীমাবদ্ধতা ও অক্ষমতার দিকে লক্ষ্য রাখিয়াই যে এরূপ কল্প-কাহিনী গ্রীক ও ভারতীয় উপকথার মত করিয়া রচিত তাহা সহজেই বোধগম্য। তাই আল্লামা হিফযুর রহমান সিউহারভী (র) যথার্থই লিখিয়াছেন :

“তাওরাত ও ইঞ্জীলে সাপ-ময়ূরের কাহিনী বা এই জাতীয় অন্য যে সব উপাখ্যান বর্ণনা করা হয়েছে তার উল্লেখ পবিত্র কুরআন বা হাদীছের কোথাও নেই। এই সব ইসরাঈলী কাহিনী সম্পূর্ণ বানোয়াট ও মনগড়া। এগুলোর ভিত্তি না ইলমে সহীহ-এর উপর প্রতিষ্ঠিত আর না এগুলো বিবেক-বুদ্ধি ও ইতিহাস দ্বারা সমর্থিত। কোন কোন মুফাসসির অবাধে এ সব কাহিনী বর্ণনা করে থাকেন, যার মারাত্মক কুফল এই যে, শুধু সাধারণ মানুষই না, বরং বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও এ ধারণা, পোষণ করে বসে থাকেন যে, অন্যান্য ইসলামী রিওয়ায়াতের মত এগুলোরও বুঝি কোন সঠিক ভিত্তি রয়েছে” (কাসাসুল কুরআন, বাংলা অনু., ১খ, পৃ. ৪৫, ইফা প্রকাশিত ১ম সংস্করণ, ১৯৯০ ইং)।

আদম (আ)-এর ইনতিকাল

আদম (আ)-এর মৃত্যুর সময় ঘনাইয়া আসিলে তিনি তাঁহার পুত্রদের কাছে জান্নাতী ফলমূল খাওয়ার আগ্রহ ব্যক্ত করেন। পিতার অন্তিম বাসনা পূরণের মানসে তাহার পুত্রগণ ফলমূলের সন্ধানে বাহির হইয়া পড়েন। পথে তাহাদের এমন কতিপয় ফেরেশতার সহিত সাক্ষাত হয় যাহাদের সহিত আদম (আ)-এর কাফন, সুগন্ধি দ্রব্যাদি, কয়েকটি কুড়াল-কোদাল এবং মাটি বহনের ঝুড়ি ছিল। ফেরেশতাগণ আদম-সন্তানদের গন্তব্যস্থল ও যাত্রার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাহাদেরকে জিজ্ঞাসা করিল তাঁহারা জানান যে, তাঁহাদের অসুস্থ পিতা জান্নাতী ফল খাওয়ার আগ্রহ ব্যক্ত করিয়াছেন। তাই তাহারা সেই ফলমূলের সন্ধানে বাহির হইয়াছেন। ফেরেশতাগণ জানাইলেন যে, এখন আর সেই সময় নাই। আদম (আ)-এর মৃত্যু আসন্ন। সুতরাং তাঁহারা তাহাদেরকে ঘরে ফিরিয়া যাইতে বলিলেন। তারপর সত্যসত্যই ফেরেশতাগণ ঐ সমস্ত বস্ত্রসম্ভারসহ আদম (আ)-এর নিকট গিয়া উপস্থিত হন। ফেরেশতাদের এরূপ আগমনে মা হাওয়া (আ) তাহাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আঁচ করিতে পারিলেন। তিনি তাঁহার প্রিয় স্বামীকে জড়াইয়া ধরিলেন। আদম (আ) বলিলেন, তুমি সরিয়া যাও । কেননা, তোমার পূর্বেই আমার ডাক পড়িয়া গিয়াছে। সুতরাং আমাকে ও আমার পরোয়ারদিগার ফেরেশতাগণকে একান্তে মিলিত হইতে দাও।

এই সময় ফেরেশতাগণ তাহার রূহ কবয করেন। তারপর তাঁহাকে গোসল দেওয়াইয়া কাফন পরাইয়া, সুগন্ধি মাখাইয়া, কবর খনন করিয়া যথারীতি জানাযা পড়িয়া দাফন করা হয়। কবরের উপর মাটিচাপা দেওয়ার পর তাহারা আদম-সন্তানদেরকে লক্ষ্য করিয়া বলেন : “হে আদম-সন্তানগণ! ইহাই হইতেছে তোমাদের দাফনের রীতি” (আহমদ, ৫খ, পৃ. ১৩৬)। ইবন কাছীর (র) তদীয় ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে উবাই ইবন কাব (রা)-এর মুখে শ্রুত বিবরণ রূপে ঘটনাটি উদ্ধৃত করিয়া মন্তব্য করেন :এই বর্ণনাকে তাঁহার সহিত সম্পর্কিত করার ব্যাপারটি সহীহ ১খ, পৃ. ৯১)। ইবন আসাকির (র) বর্ণনা করেন ও ফেরেশতাগণ আদম (আ)-এর জানাযায় চারবার তাকবীর ধ্বনি উচ্চারণ করিয়াছিলেন (হাকেম, ১খ, ৩৮৫)।

আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত মারফু হাদীছ হইতে জানা যায় যে, লওহে মাহফুযে আদম (আ)-এর বয়স এক হাজার বৎসর লিপিবদ্ধ ছিল। অপরদিকে তাওরাতে আছে, আদম (আ) নয় শত ত্রিশ বৎসরকাল আয়ু লাভ করেন। ইবন কাছীর (র) বলেন : তওরাতের বর্ণনাকে যদি সংরক্ষিত ও বিশুদ্ধ বলিয়া মানিয়া লওয়া হয়, তাহা হইলে বুঝিতে হইবে যে, ইহা হইতেছে আদম (আ)-এর পৃথিবীতে অবতরণের পরবর্তী আয়ুর সৌর বৎসর। চান্দ্র হিসাবে উহার মেয়াদ হয় নয় শত সাতান্ন বৎসর। ইহার সহিত তৎপূর্বকার বেহেশতে অবস্থানকালীন তেতাল্লিশ বৎসর যোগ করিলে সর্ব সাকুল্যে এক হাজার বৎসরই হয়। ইবন জারীর (র) প্রমুখ এইরূপই বর্ণনা করিয়াছেন। আদম (আ)-এর মৃত্যুর ঐ দিনটি ছিল শুক্রবার (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, পৃ. ৯১-৯২)।

আদম (আ)-এর শবদেহ কোথায় দাফন করা হইয়াছিল সে সম্পর্কে মতভেদ রহিয়াছে। মশহুর হইল, ভারতবর্ষ তথা সরশীপের যে পাহাড়ে সর্বপ্রথম তাঁহাকে অবতরণ করান হইয়াছিল, সেখানেই তাঁহাকে দাফন করা হয়। কেহ কেহ মক্কা শরীফের জাবালে আবু কুবায়সকে তাঁহার দাফনস্থল বলিয়াছেন। আবার এরূপও কথিত আছে যে, নূহ (আ) মহাপ্লাবনকালে আদম (আ) ও মা হাওয়ার কফিন জাহাজে তাঁহার সহিত রাখিয়াছিলেন এবং মহাপ্লাবন শেষে তিনি বায়তুল মুকাদ্দাস তাঁহাদেরকে দাফন করেন (তারীখ তাবারী, ১খ, পৃ. ১৬১)।

আতা খুরাসানী বলেন, আদম (আ)-এর মৃত্যুতে গোটা বিশ্ব জগৎ তাঁহার শোকে সপ্তাহ ব্যাপী ক্রন্দন ও শোক পালন করে। ইবন ইসহাক বলেন, আদম (আ)-এর মৃত্যুতে এক সপ্তাহ পর্যন্ত চন্দ্র ও সূর্যের গ্রহণ লাগিয়াছিল (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১খ, পৃ. ৯১)।

তাঁহার মৃত্যুর এক বৎসর পরে মা-হাওয়াও (আ) ইনতিকাল করেন (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, পৃ. ৯২)।

হযরত শীছ (আ)-কে দায়িত্ব অর্পণ ও অন্তিম উপদেশ

আদম (আ)-এর অন্তিম শয্যায় তদীয় প্রিয়তম পুত্র শীছ (আ) তাঁহার সেবা-যত্নের জন্য সব সময় পিতার নিকটে অবস্থান করিতেন। তাঁহার অপর ভাইগণ যখন পিতার অন্তিম অভিলাষ পূরণের জন্য ফলমূল সংগ্রহের উদ্দেশে বাহির হইয়া পড়েন, তখনও তিনি পিতার নিকটই ছিলেন। পুত্রদের ফলমূল লইয়া আসিতে বিলম্ব হইলে তিনি শীছ (আ)-কে বলিলেন : সম্ভবত তাহারা আমার জন্য ফলমূল সংগ্রহ করিতে পারিতেছে না। এজন্য বিলম্ব ঘটিতেছে। তুমি বরং অমুক পাহাড়ে গিয়া আল্লাহর দরবারে দুআ কর, হয়তো বা তাহাতে মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবে।

শীছ (আ) বলিলেন, পিতা! আপনি মানবকূলের আদিপুরুষ। আমারও পিতা। আপনি আল্লাহর প্রিয়পাত্র ও মককূল বান্দা। আপনি নিজে যদি আল্লাহর দরবারে হাত তুলেন তাহা হইলে নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা আপনাকে ব্যর্থ মনোরথ করিবেন না। প্রত্যুত্তরে আদম (আ) বলিলেন : নিষিদ্ধ গাছের ফল খাইয়া আমি যে অপরাধ করিয়াছি, সেইজন্য আমি আল্লাহর দরবারে লজ্জিত, তুমিই বরং দুআ কর, আল্লাহ নিশ্চয়ই তাহা কবুল করিবেন।

সেমতে শীছ (আ) দুআ করিলেন। সত্য সত্যই সেই দুআ কবুল হইল। জিবরাঈল (আ) খাঞ্চা ভর্তি বেহেশতী ফলমূল এক অপূর্ব সুন্দরী বেহেশতী হুরের মাথায় চাপাইয়া লইয়া হাযির হইলেন। হুরটি যখন মুখের ঘোমটা খুলিয়া আদম (আ)-এর সম্মুখে আসিল তখন আদম (আ)-এর জিজ্ঞাসার জবাবে জিবরাঈল জানাইলেন ও একমাত্র শীছ ছাড়া আপনার অপর সকল পুত্র কন্যা যেহেতু জোড়ায় জোড়ায় জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তাই শীছের সহিত বিবাহের উদ্দেশে আল্লাহ তাআলা ইহাকে প্রেরণ করিয়াছেন। সেমতে শীছের সহিত ঐ বেহেশতী হুরের বিবাহ হয় এবং হরটি যেহেতু আরবীভাষী ছিলেন তাই তাঁহার বংশধরগণ বংশানুক্রমিকভাবে আরবীভাষী হন এবং শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা (স)-ও তাঁহার অধস্তন পুরুষ। এ হৃরের আনীত ফলমূল আদম (আ) তাহার উপস্থিত সন্তানদেরকেও খাইতে দেন। ঐ ফলমূল যাহারা খাইয়াছিলেন তাহাদের জ্ঞান-বুদ্ধি বৃদ্ধি পায়। অপর বর্ণনামতে, ঐ হুর তারপর বেহেশতে ফিরিয়া যায়।

ঐ সময় আদম (আ) পুত্রদের উদ্দেশ্য বলেন যে, তাঁহার অন্তিম সময় উপস্থিত। তাঁহার পরে শীহই হইবেন তাহার স্থলাভিষিক্ত। সুতরাং সকলে যেন তাঁহাকে অভিভাবকরূপে মান্য করেন এবং তাঁহার নির্দেশনা অনুসারে জীবন-যাপন করেন। অন্য কথায়, ইনতিকালের পূর্বেই আদম (আ) তদীয় পুত্র শীছ (আ)-এর অভিষেক সম্পন্ন করিলেন (দ্র. তর্জমা উর্দু কাসাসুল আম্বিয়া (বৃহৎ কলেবর), গোলাম নবী কুমিল্লায়ী, পৃ. ২০-২১)।

হাবীল ও কাবীলের পর শীছই ছিলেন আদম (আ)-এর সন্তানদের মধ্যে বয়োজ্যষ্ঠ। শীছ (আ)-এর জন্মগ্রহণের পর আদম ও হাওয়া (আ)-এর পুত্র বিরহ বেদনা অনেকটা লাঘব হইয়াছিল। এইজন্য জন্মের পর হইতেই তিনি পিতা-মাতার অতি আদরের সন্তান। শীছ শব্দের অর্থই হইতেছে ‘আল্লাহর দান। মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক বলেন, “আদম (আ)- এর মৃত্যুর সময় ঘনাইয়া আসিলে তিনি শীছকে তাঁহার স্থলাভিষিক্ত করেন এবং তাহাকে দিরারাত্রির প্রহরসমূহ সম্পর্কে জ্ঞানদান করেন এবং পরবর্তী কালে ঘটিতব্য মহাপ্লাবনের ব্যাপারে অবহিত করেন (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, পৃ. ৯১)।

নবুওয়তী ধারার একটি চিরাচরিত নিয়ম হইল, পূর্ববর্তী নবী ইনতিকালের পূর্বেই তাঁহার পরবর্তী নবী সম্পর্কে আপন উম্মতদেরকে অবহিত করিবেন। আদি মানব ও আদি নবী হযরত আদম (আ) তাহার মৃত্যুর পূর্বেই যোগ্যতম পুত্র শীছ (আ)-কে স্থলাভিষিক্ত করিয়া সেই ধারারই সূত্রপাত করিয়া যান।

আদম (আ)এর নবুওয়াত ও রিসালাত

নবী হিসাবে প্রত্যক্ষভাবে কুরআনুল করীমে আদম (আ)-এর উল্লেখ না থাকিলেও পরোক্ষভাবে তাঁহার উল্লেখ আছে।

“নিশ্চয়ই আল্লাহ্ আদমকে, নূহকে ও ইবরাহীমের বংশধর এবং ইমরানের বংশধরকে বিশ্বজগতে মনোনীত করিয়াছেন” (৩ : ৩৩)।

উক্ত আয়াতে নবী ও রাসূলরূপে নূহ ও ইরাহীম (আ)-এর সহিত সমপর্যায়ে আদম (আ)-এর উল্লেখ করা হইয়াছে। আল্লামা শাব্বীর আহমাদ উছমানী বলেন, “আল্লাহ তাআলার এই মনোনীতকরণ ও নির্বাচিতকরণ জনিত সম্মানদান, যাহাকে আমরা নবুওয়াত অভিধায় অভিহিত করিয়া থাকি” (তাফসীরে উছমানী, পৃ. ৬৯, পাদটীকা ৮)।

হযরত আবু যর গিফারী (রা) বর্ণিত হাদীছে আছে :

“আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! নবীগণের মধ্যে সর্বপ্রথম নবী কে? তিনি বলিলেন, আদম (আ)। আমি আবার জিজ্ঞাসা করিলাম, তিনি কি নবী ছিলেন? রাসূলুল্লাহ (স) বলিলেন : হাঁ, নবী ছিলেন। তাঁহার সাথে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা কথা বলিয়াছেন” (আহমাদ, ৫, ১৬৬, ১৭৮, ১৭৯)।

উক্ত হাদীছখানা উদ্ধৃত করিয়া আবু বকর জাবির আল-জাযাইরী লিখেন, উক্ত মরফু হাদীছে আদম (আ)-কে আল্লাহ তাআলার কালাম-ধন্য ও ওহীপ্রাপ্ত নবীরূপে বর্ণনা করা হইয়াছে (আবু বা আল-জাযাইয়ী, আকীদাতুল-মুমিন, পৃ. ২৬৬; মাকতাবাতুল কুল্লিয়াতিল আযহারিয়া, ১ম সং, কায়রো, ১৩৯৭ হি.)।

মুহাম্মাদ আলী আস-সাৰ্বনী এতসম্পর্কে আরও স্পষ্টভাবে লিখিয়াছেন ইহা নিশ্চিত যে, আদম (আ) নবীগণের অন্তর্ভুক্ত। ইহা জমহুর উলামার সর্বাণীসম্মত অভিমত। কোন আলেমই এই মতের বিরোধিতা করেন নাই। তবে তিনি রাসূল ছিলেন কিনা সে সম্পর্কে মতভেদ আছে। তাহার নবুওয়াত সম্পর্কে আল-কিতাব ও সুন্নাহতে বর্ণনা আসিয়াছে। তবে আল-কুরআনে উহার সুস্পষ্ট উল্লেখ নাই। তাই আদম (আ) সম্পর্কে ঠিক ঐভাবে নবুওয়াতের উল্লেখ করা হয় নাই যেমনটি অন্যদের ব্যাপারে, যেমন ইবরাহীম, ইসমাঈল, মূসা ও ঈসা (আ) প্রমুখ নবীগণের ব্যাপারে করা হইয়াছে। কিন্তু ইহা উল্লিখিত হইয়াছে যে, আল্লাহ তাআলা প্রত্যক্ষভাবে তাঁহাকে সম্বোধন করিয়াছেন এবং ঐ সম্বোধনের মাধ্যমে তাঁহাকে শরীআত দান করিয়াছেন। তাহাতে তিনি তাঁহার প্রতি আদেশ করিয়াছেন, নিষেধ করিয়াছেন। তাঁহার জন্য অনেক কিছুকে হালাল এবং অনেক কিছুকে হারাম করিয়াছেন। তাঁহার প্রতি কোন রাসূল বা বাইক না পাঠাইয়া তিনি এই সমস্ত করিয়াছেন। উহাই তাহার নবুওয়াত বা তিনি নবী হওয়ার অর্থ, যেমনটি আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করিয়াছি (আন-নবুওয়াতু ওয়াল আম্বিয়া, পৃ. ১২৪-১২৫, ২য় সংস্করণ, মক্কা ১৪০০/১৯৮০)।

আলিমগণের অনেকেই তাঁহাকে রাসূল বলিয়াছেন । তাহাদের মতে তিনি তদীয় সন্তান-সন্তুতি বংশধরগণের প্রতি প্রেরিত হইয়াছিলেন। অন্য আলিমগণ তাহাকে নবী বলিয়া থাকেন। তাহাদের দলীল হইতেছে সহীহ মুসলিমের বর্ণিত শাফাআত সংক্রান্ত হাদীছ যাহাতে উল্লিখিত হইছে, কিয়ামতে মহা পেরেশানীর দিনে ওষ্ঠাগতপ্রাণ হইয়া লোকজন নূহ (আ)-এর কাছে ছুটিয়া যাইবে এবং তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া বলিবে : “আপানিই পৃথিবী বক্ষে প্রেরিত প্রথম রাসূল”। আদম (আ) যদি রাসূলই হইতেন তাহা হইলে এরূপ বলা হইত না।

যাঁহারা তাহাকে রাসূল বলিয়া থাকেন তাঁহারা ইহার জবাব দেন এইভাবে, যে মহাপ্লাবনের পর মানবজাতির পৃথিবীতে লূতনভাবে পুনর্বাসনের পর তিনিই প্রথম রাসূল, উক্ত কথা দ্বারা সেদিকেই ইঙ্গিত করা হইয়াছে। এবম্বিধ যুক্তি প্রদর্শনের পর আল-জাযাইরী তাহার অভিমত ব্যক্ত করিয়াছেন এইভাবে : “তবে তিনি যে রাসূল ছিলেন এই অভিমতই অগ্রগণ্য” (আকীদাতুল মুমিন, পৃ. ১২৫)। এ ব্যাপারে আরও দলীল নিম্নে উক্ত হইল :

(১) আল্লাহ তাআলা আদম-হাওয়াকে পৃথিবীতে প্রেরণকালে বলিয়া দেন?

“পরে যখন আমার পক্ষ হইতে তোমাদের নিকট সৎপথের কোন নির্দেশ আসিবে, তখন যাহারা আমার সৎপথের নির্দেশ অনুসরণ করিবে তাহাদের কোন ভয় নাই এবং তাহারা দুঃখিতও হইবে না” (২ : ৩৮)।

উক্ত আয়াতে ১ বা নির্দেশনা প্রেরণের কথা বলিয়া আসলে তিনি যে নবুওয়াত বা রিসালাতের দায়িত্ব লাভ করিবেন সেই আশ্বাসই দেওয়া হইয়াছিল।

(২) অন্য আয়াতে সুস্পষ্টভাবে সেই কথাটিই বলা হইয়াছে এইভাবে :

“আদম তাহার প্রতিপালকের হুকুম অমান্য করিল, ফলে সে ভ্রমে পতিত হইল। ইহার পর তাহার প্রতিপালক তাহাকে মনোনীত করিলেন, তাহার তওবা কবুল করিলেন ও তাহাকে পথনির্দেশ করিলেন” (২০ : ১২১-১২২)।

মুহাম্মাদ আলী সাবুনীর ভাষায় : “এই মনোনীতকরণই ছিল তাঁহাকে নবুওয়াত ও রিসালাত দান করা (আন্-নুবুওয়াতু ওয়াল আম্বিয়া, পৃ. ১২৫)।

(৩) আবু সাঈদ খুদরী (রা) বর্ণিত হাদীছে আছে, রাসূলুল্লাহ (স) বলেন : “কিয়ামতের দিন আমিই হইব আদম-সন্তানদের তথা সমস্ত মানবজাতির সর্দার। ইহা আমার অহংকার নহে। আমার হাতেই থাকিবে আল্লাহর প্রশস্তির পতাকা। ইহা আমার অহংকার নহে। সেদিন আদমসহ সকল নবীই আমার পতাকাতলে থাকিবেন” (মুসনাদে আহমাদ, ৩, পৃ. ২)।

ইব্‌ন মাজা এবং তিরমিযীও হাদীছটি রিওয়ায়াত করিয়াছেন এবং তিরমিযী ইহাকে রীতিমত হাসান-সহীহ পর্যায়ের হাদীছ বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন (মাহমূদ মুহাম্মদ খাত্তাব সুবকী কৃত আদ-দীন আল-খালিস, ১খ, পৃ. ৭৪, ৪র্থ সং, কায়রো)।

তাবারীর বর্ণনায় সুস্পষ্টভাবে উল্লিখিত হইয়াছে : “আল্লাহ তাআলা যখন আদমকে পৃথিবীর রাজত্ব দান করিলেন তখন তিনি তাঁহাকে নবুওয়াতও দান করেন এবং তাঁহাকে তাঁহার সন্তানদের প্রতি রাসূল হিসাবে প্রেরণ করেন। তিনি তাহার প্রতি একুশখানা সহীফা (পুস্তিকা) অবতীর্ণ করেন। তিনি স্বহস্তে তাহা লিপিবদ্ধ করেন এবং জিব্রাঈল (আ) তাঁহাকে এগুলি শিক্ষা দান করেন” (দ্র. তাবারীর-তারীখ, ১খ, পৃ. ১৫০; আল-মুনতাসার, ১খ, পৃ. ২২১)।

কুরআন শরীফে যেমন নবী-রাসূলগণের সকলের নাম উল্লিখিত হয় নাই, তেমনি কোন্ কোন্ রাসূল বা নবীর প্রতি কোন্ কোন্ কিতাব অবতীর্ণ করা হইয়াছে তাহারও বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয় নাই এবং ইজমালীভাবে বলা হইয়াছে :

“নিশ্চয় আমি আমার রাসূলগণকে প্রেরণ করিয়াছি স্পষ্ট প্রমাণসহ এবং তাহাদের সঙ্গে দিয়াছি কিতাব ও ন্যায়নীতি, যাহাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে” (৫৭ :২৫)।

শরহ উমদা-এর বরাতে মওলানা আবদুল হক হক্কানী দেহলবী (র) লিখেন : মোট আসমানী কিতাবের সংখ্যা ১০৪। তন্মধ্যে ছোট ছোট ৫০টি হযরত শীছ (আ), ৩০টি হযরত ইদরীস (আ), ১০টি হযরত ইবরাহীম (আ) এবং ১০টি হযরত আদম (আ)-এর প্রতি অবতীর্ণ হইয়াছে। আর প্রধান প্রধান চারিখানা চারিজন নবীর প্রতি নাযিল হইয়াছে” (ইসলামী আকীদা, পৃ. ৯৭, অনুবাদ : মওলানা আবদুস সুবহান, ইফা প্রকাশিত, ১ম সং, ১৯৮১)।

আদম (আ)-এর শরীআত ও আমল।

সভ্যতার আদি যুগে আদম (আ)-এর সহীফাগুলি তো বটেই, পূর্ববর্তী যুগের তাবৎ নবী-রাসূলগণের প্রতি নাযিলকৃত আসমানী কিতাব ও সহীফাগুলি বিকৃতি, বিস্মৃতি ও বিলুপ্তির শিকার হইয়াছে। সায়্যিদ সুলায়মান নদভীর ভাষায় : “এ কথা আমরাও মানি, যুগে যুগে পয়গাম্বরগণের মাধ্যমে আল্লাহর পয়গাম দুনিয়ায় এসেছে, কিন্তু আমরা বারবার বলেছি এবং ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর আলোকে প্রমাণ করেও দেখিয়েছি যে, বিশেষ বিশেষ যুগ বা বিশেষ বিশেষ দেশের জন্যই তাঁদের আবির্ভাব ঘটেছিল। তারা ছিলেন সাময়িক প্রয়োজন মেটানোর তাগিদে সাময়িক পয়গাম্বর। আর এজন্যই তাঁদের পয়গামসমূহ চিরদিনের জন্য সুসংরক্ষণের ইন্তেজাম হয়ে উঠেনি, ছিন্ন হয়ে গেছে এগুলোর মূল সূত্র” (নবী চিরন্তন, অনুবাদ আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী, ২য় সং, বুক সোসাইটি, ঢাকা ১৯৭৯ খৃ.)।

বলা বাহুল্য, উপরিউক্ত বক্তব্যটি আদি মানব এবং সর্বপ্রথম নবী আদম (আ) এবং তাঁহার শরীআত ও সহীফাগুলির ব্যাপারে সর্বাধিক প্রযোজ্য। তাই তাহার শরীআতের কাঠামো কী ছিল বা তাঁহার ইবাদাত ও আমলের নমুনা কী ছিল তাহা সুনির্দিষ্টভাবে বলা এক সুকঠিন ব্যাপার। তবে এতদসংক্রান্ত রিওয়ায়াতসমূহ হইতে ইহার কিছু কিছু আঁচ করা যায়।

হামদ ও সালাম

আল্লামা ইব্‌ন কাছীর সহীহ ইব্‌ন হিব্বান হইতে হযরত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত একখানা হাদীছ উদ্ধৃত করিয়াছেন : “রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, আল্লাহ যখন আদমকে সৃষ্টি করেন এবং তাঁহার মধ্যে রূহ যুঁকিলেন তখন তিনি হাঁচি দিয়া উঠিলেন এবং বলিলেন : আলহামদু লিল্লাহ্ (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর)। তিনি তাহার আদেশক্রমেই হাহমদ বা আল্লাহর প্রশংসা করিলেন। তখন তাঁহার প্রতিপালক তাহার উদ্দেশে বলিলেন, তোমার প্রতিপালক তোমার প্রতি সদয় হউন হে আদম! ঐ পাশে উপবিষ্ট ফেরেশতামণ্ডলীর দিকে যাও এবং তাহাদেরকে সালাম দাও। তখন তিনি গিয়া তাহাদেরকে সালাম দিলেন। তিনি বলিলেন : আসোলামু আলায়কুম । তাহারা বলিলেন : ওয়া ‘আলায়কুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি। তারপর তিনি তাঁহার প্রতিপালকের নিকট ফিরিয়া গেলেন। তখন তিনি বলিলেন; ইহাই তোমার ও তোমার সন্তানদের মধ্যকার সম্ভাষণ” (কাসাসুল আম্বিয়া, ইবন কাছীর, পৃ. ৪৪ ও আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া)। বুখারীর রিওয়ায়াতেও অনুরূপ বক্তব্য রহিয়াছে।

উক্ত বর্ণনার দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হইল যে, সৃষ্টির প্রথম প্রভাতে আদম (আ)-এর সর্বপ্রথম ইবাদতটি ছিল ‘আলহামদু লিল্লাহ বলিয়া সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলার দরবারে হাম্দ বা স্তুতিবাদ।

আল্লামা ছালাবীর ভাষায় ও হাঁচি দেওয়া শেষ হইতে না হইতেই আদমের রূহ তাঁহার মুখ ও রসনায় সঞ্চারিত হইল এবং আল্লাহ তাআলা তাঁহাকে শিক্ষা দিলেন যেন তিনি বলেন, আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন। সুতরাং উহাই ছিল তাঁহার মুখ নিঃসৃত সর্বপ্রথম বাণী (আরাইস, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ২৯)।

পৃথিবী ব্যাপী মুসলমানদের মধ্যে বহুল প্রচলিত সালাম ও তাহার জবাব দানের শিষ্টাচার পূর্ণ বিধানটিও যে সৃষ্টির সূচনালগ্ন হইতেই চলিয়া আসিতেছে উপরিক্ত বর্ণনা দ্বারা তাহাও নিশ্চিতভাবে জানা গেল।

বিবাহ ও দেনমোহর

কোন কোন রিওয়ায়াতে আছে, হাওয়াকে সৃষ্টির পর আদম (আ) তাহার দিকে হস্ত প্রসারিত করিলে ফেরেশতাগণ বলিলেন, থামুন আদম, একটু থামুন। আদম (আ) বলিলেন, আবার থামিতে হইবে কেন? হাওয়াকে তো আল্লাহ তাআলা আমার জন্যই সৃষ্টি করিয়াছেন। ফেরেশতাগণ বলিলেন, তাহার মোহরানা আদায়ের পরই কেবল তিনি আপনার জন্য বৈধ হইবেন। আদম (আ) জিজ্ঞাসা করিলেন, তাহা কিভাবে আদায় করিতে হইবে। ফেরেশতাগণ বলিলেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের প্রতি তিনবার দুরূদ পাঠ করুন। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, মুহাম্মাদ কে? ফেরেশতাগণ তাঁহার পরিচয় দিলেন এইভাবে :আপনার সন্তানদের মধ্য হইতে তিনি হইতেছেন সর্বশেষ নবী, মুহাম্মাদের সৃষ্টি না হইলে আপনাকে সৃষ্টি করা হইত না (ছালাবী, আরাইস, পৃ. ৩১)।

বলা বাহুল্য, তিনি তখন তাঁহার সেই সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান আখেরী নবীর প্রতি দুরূদ পাঠ করিয়াই মোহরানা আদায় করেন। ইহার পর হাওয়াকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করিয়া তিনি দাম্পত্য জীবন শুরু করেন। এইভাবেই পৃথিবীতে সর্বপ্রথম দুরূদ উচ্চারিত হয় এবং মোহরানা আদায়ের মাধ্যমে বিবাহের সূচনা হয়। খুলাসাতুল আম্বিয়া (পৃ. ১৩) গ্রন্থে বলা হইয়াছে, আদম (আ)-এর সহিত হাওয়া (আ) বিবাহের মোহর ছিল মহান আল্লাহর প্রশংসা, তাসবীহ, তাহলীল, পবিত্রতা বর্ণনা ও কলেমা শাহাদাত।

তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা

পৃথিবীতে অবতরণের পর আদম (আ) একটি হাঁচি দিলে তাহার নাক হইতে টাটকা রক্ত ঝরিতে লাগিল। মাটিতে সেই রক্ত গড়াইয়া পড়িলে উহা কয়লার মত কালো বর্ণ ধারণ করে। উহা দেখিয়া আদম ভীত-বিহ্বল হইয়া পড়েন। কেননা এরূপ দৃশ্য ইতোপূর্বে তিনি কখনও দেখেন নাই। জান্নাতের সুখস্মৃতি তাহার স্মৃতিপটে জাগরূক হইয়া উঠিল। তখন তিনি মূর্ছা গেলেন। একাদিক্রমে চল্লিশটি বৎসর তাঁহার ক্রন্দনে ক্রন্দনে অতিবাহিত হইল। উহার পর আল্লাহ একজন ফেরেশতাকে প্রেরণ করিলেন। তিনি আসিয়া আদম (আ)-এর পৃষ্ঠদেশে ও পেটে হাত বুলাইয়া উহা তাহার বক্ষের উপর রাখিলেন। ইহাতে আদমের ভীতি-বিহ্বলতা দূর হইল এবং তিনি অনেকটা স্বস্তি বোধ করিলেন।

হযরত শাহর ইব্ন হাওশাব (রা) বলেন, আমার নিকট এই বিবরণ পৌঁছিয়াছে যে, পৃথিবীতে আগমনের পর আদম (আ) লজ্জায় তিন শত বৎসর পর্যন্ত মাথা উঠাইয়া তাকান নাই। ইবন আব্বাস (রা) বলেন, আদম-হাওয়া জান্নাতের নিয়ামতরাজি হারাইয়া দুই শত বৎসর পর্যন্ত কান্নাকাটি করিয়া কাটান। চল্লিশ বৎসর পর্যন্ত তাঁহারা কোনরূপ পানাহার করেন নাই। আদম ও হাওয়া এক শত বৎসর পরস্পর মিলিত হন নাই। তারপর যখন আল্লাহ তদীয় বান্দা আদমের প্রতি দয়া করিতে মনস্থ করেন তখন তাঁহাকে কতিপয় কলেমা শিক্ষা দেন (ছালাবী, আরাইস, পৃ. ৩৬)। আদম (আ) কর্তৃক মসজিদ নির্মাণ, সালাত ও হজ্জ আদায়

মসজিদ নির্মাণ ও উহা আবাদ করা একটি অতীব পূণ্য কাজ। কুরআন শরীফের আয়াতে মসজিদ আবাদ করাকে প্রকৃত ঈমানদার এবং হিদায়াতপ্রাপ্ত লোকদের কাজ বলিয়া (৯ :১৮) উল্লেখ করা হইয়াছে। হাদীছে আছে :

“যে ব্যক্তি কোন মসজিদ নির্মাণ করিবে আল্লাহ তাআলা তাহার জন্য বেহেশতে একটি ঘর নির্মাণ করিবেন।” এই পূণ্য কাজটিও সর্বপ্রথম আদি পিতা হযরত আদম (আ) স্বয়ং আল্লাহ তাআলার নির্দেশে করিয়াছিলেন। অবশ্য কাবার নির্মাণ সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা উল্লেখ আছে। আল-আরাকী তদীয় আখবার মাক্কা গ্রন্থে লিখেন : “ফেরেশতাগণ সর্বপ্রথম কাবা নির্মাণ করেন। হযরত আদম (আ)-এর জন্ম তখনও হয় নাই”। এই উক্তির স্বপক্ষে তিনি হযরত যায়নুল আবিদীন (র) বর্ণিত একটি রিওয়ায়াত উল্লেখ করিয়াছেন। হযরত আব্বাস (রা) হইতেও অনুরূপ একটি বর্ণনা আছে।

আন্-নাওয়াবী তদীয় ‘তাহযীবুল আসমা ওয়াল-লুগাত গ্রন্থে খণ্ড পৃ. উল্লেখ করেন যে, ফেরেশতাগণই সর্বপ্রথম কাবা নির্মাণ করিয়াছিলেন। তারপর হযরত আদম কাবা নির্মাণ করেন। ইহার সমর্থনে আল-বায়হাকী দালাইলুন্-নুবুওয়া গ্রন্থে মারফু হাদীছ পেশ করিয়াছেন। রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, আল্লাহ পাক জিবরাঈলকে হযরত আদম (আ) ও হাওয়া (আ)-এর নিকট প্রেরণ করিয়া কাবা নির্মাণ করার আদেশ দেন। তাঁহারা আল্লাহর আদেশ পালনার্থেই কাবা নির্মাণ করেন। নির্মাণ শেষে কাবা তাওয়াফ করার নির্দেশও তিনি দিয়াছিলেন। অতঃপর বহুকাল অতিবাহিত হইবার পর হযরত নূহ (আ) কাবায় হজ্জ পালন করেন।

আল-আযরাকী হইতে এরূপ আরেকটি মতও বর্ণিত হইয়াছে যে, হযরত আদম (আ) কাবা নির্মাণ করেন এবং তিনি তাঁহার বক্তব্যের অনুকূলে দুইটি রিওয়ায়াত উল্লেখ করেন। বিখ্যাত হাদীছবেত্তা আবদুর রাযযাক স্বীয় গ্রন্থ আল-মুসান্নাফ-এ লিপিবদ্ধ করিয়াছেন যে, হযরত আদম (আ) পাঁচটি পাহাড়ের দ্বারা কাবা নির্মাণ করেন। পাহাড়গুলি হইল লুবনান, ভূরে যীতা, দূরে সায়না, আল-জুদী ও হিরা।

আল-মুহিব্ব আত-তাবারীর ভাষ্য মুতাবিক কাবার ভিত্তি নির্মাণে হিরা পর্বতের পাথর ব্যবহার করা হয়। হযরত আদম (আ)-এর পর তদীয় পুত্র শীছ (আ) দ্বিতীয়বার কাবা নির্মাণে অংশগ্রহণ করেন (শিফাউল গিরাম, ১খ, পৃ. ৯২-৯৩; দ্র. ইসলামী বিশ্বকোষ, সপ্তম খণ্ড, পৃ. ৩১, কাবা শরীফ শীর্ষক নিবন্ধ)।

সূরা আল ইমরানের আয়াতে (৯৬) বলা হইয়াছে : “নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর যাহা মানবজাতির জন্য নির্ধারিত হইয়াছে, তাহাই হইতেছে ঐ ঘর যাহা মক্কায় অবস্থিত এবং সারা জাহানের মানুষের জন্য হিদায়াত ও বরকতময়।”

উহার তাফসীরের সারসংক্ষেপ বর্ণনা প্রসঙ্গে মুফতী মুহাম্মাদ শফী (র) বলেন, মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহটি আল্লাহর পক্ষ হইতে নির্ধারিত করা হয় তাহা ঐ গৃহ যাহা বাক্কা তথা মক্কায় অবস্থিত। অতএব কাবা গৃহই বিশ্বের সর্বপ্রথম ইবাদতগৃহ। উহার অর্থ ইহাও হইতে পারে যে, বিশ্বের সর্বপ্রথম ঘরটি ইবাদতগৃহরূপে নির্মিত হইয়াছিল। ইহার পূর্বে পৃথিবীর বুকে না কোন ইবাদতগৃহের অস্তিত্ব ছিল, না কোন বাসগৃহের অস্তিত্ব ছিল। হযরত আদম (আ) ছিলেন আল্লাহর নবী। তাঁহার ব্যাপারে ইহা অকল্পনীয় নহে যে, আপন বাসগৃহ নির্মাণের পূর্বেই তিনি আল্লাহর ইবাদতের জন্য গৃহ নির্মাণকে অগ্রাধিকার দিবেন। এই কারণে হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমার (রা), মুজাহিদ, কাতাদা, সুদ্দী প্রমুখ সাহাবী ও তাবিঈর মতে, কাবাই পৃথিবীর সর্বপ্রথম গৃহ। আবার ইহাও অসম্ভব নহে যে, মানুষের বসবাসের গৃহ পূর্বেই নির্মিত হইয়াছিল। কিন্তু ইবাদতের জন্য সর্বপ্রথম কাবা গৃহই নির্মিত হইয়াছিল। এই শেষোক্ত অভিমতটি হযরত আলী (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে।

বায়হাকী বর্ণিত এক হাদীছে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (স) বলেন : হযরত আদম ও বিবি হাওয়ার পৃথিবীতে আগমনের পর আল্লাহ তাআলা জিবরাঈল (আ)-এর মাধ্যমে তাহাদেরকে কাবা গৃহ নির্মাণের আদেশ দেন। গৃহ নির্মাণকার্য সম্পন্ন হইলে তাহাদেরকে উহার তাওয়াফ করার আদেশ দেওয়া হয় এবং বলা হয়, হে আদম! আপনিই পৃথিবী পৃষ্ঠে সর্বপ্রথম মানব এবং এই ঘরটিই পৃথিবীর সর্বপ্রথম ইবাদত গৃহ, যাহা মানবজাতির জন্য নির্ধারিত হইয়াছে (তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন, ২খ, পৃ. ১১৪; ইবন কাছীরের বরাতে)। কোন কোন হাদীছের ভাষ্য হইতে প্রতীয়মান হয় যে, হযরত নূহ (আ)-এর যুগে সংঘটিত মহাপ্লাবন পর্যন্ত হযরত আদম (আ) নির্মিত এ কাবা গৃহখানা অক্ষত ছিল (দ্র. ঐ)।

বুখারী ও মুসলিম বর্ণিত আরো একখানা হাদীছে আছে যে, হযরত আবু যার (রা) একদা হুযুর (স)-কে জিজ্ঞাসা করেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! পৃথিবীর সর্বপ্রথম মসজিদ কোনটি? হুযুর (স) বলিলেনঃ মসজিদুল হারাম (কাবা গৃহ)। আবু যার (রা) পুনরায় প্রশ্ন করেন, তারপর কোনটি? হুযুর (স) বলেন, বায়তুল মাকদিস। দুই মসজিদের নিমার্ণকালের ব্যবধান কত, এই মর্মে আবার প্রশ্ন করিলে তিনি জবাব দিলেন : চল্লিশ বৎসর পূর্বোক্ত, পৃ. ২১৫)।

এই ব্যাপারে ছালাবীর বর্ণনাটি এইরূপ : “(আদম (আ)-এর তওবা ও ক্ষমা লাভের পর) আল্লাহ্ তাআলা জান্নাত হইতে একটি ইয়াকৃত পাথর নাযিল করিলেন এবং উহা বায়তুল্লাহ তথা কাবা শরীফের স্থানে রাখিয়া কাবার স্থান নির্ধারণ করিয়া দিলেন। উহার দুইটি দরজা : পূর্বের দরজা এবং পশ্চিমের দরজা। ঐগুলিতে নূরের ফানুস স্থাপন করিলেন। তারপর আদম (আ)-এর প্রতি ওহীযোগে নির্দেশ দিলেন । আমার আরশের ঠিক নীচে আমার একটি ঘর রহিয়াছে। তুমি ঐখানে গিয়া উহা তাওয়াফ কর, যেমনটি তাওয়াফ করা হইয়া থাকে আমার আরশের চতুম্পার্শ্বে এবং সেখানে সালাত আদায় কর যেমনটি আমার আরশের চতুষ্পর্শ্বে সালাত আদায় করা হইয়া থাকে। সেখানেই তোমার দুআ কবুল হইবে।

সেইমতে আদম (আ) ভারতবর্ষ হইতে বায়তুল্লাহ যিয়ারতের জন্য মক্কা অভিমুখে যাত্রা করেন। আল্লাহ তাআলা তাঁহার পথ প্রদর্শনের জন্য একজন ফেরেশতা নিযুক্ত করিয়া দেন। ঐ যাত্রায় আদম (আ) যে সকল স্থানে পদার্পণ করিয়াছেন সেইগুলিতে জনপদ গড়িয়া উঠে আর যে সমস্ত স্থানে তাঁহার পদচিহ্ন পড়ে নাই সেগুলি অনাবাদ ও উষর ভূমিতে পরিণত হয়। তিনি যখন আরাফাত প্রান্তরে গিয়া উপনীত হন এবং অবস্থান করেন তখন হাওয়া আরাফাত দিবসে আরাফাত প্রান্তরে তাঁহার সঙ্গে মিলিত হন। সে দিন হইতে ঐ দিনটি আরাফাতের দিন এবং ঐ স্থানটি আরাফাত বলিয়া অভিহিত হয়। কেননা এ স্থানেই তাঁহাদের সাক্ষাত ও পুনর্মিলন হইয়াছিল। তারপর তাহারা উভয়ে মিনার দিকে যান। সেখানে আদম (আ-কে বলা হয় : তোমার যাহা চাহিবার তাহা চাহিয়া লও। তিনি বলিলেন :

“আমি মাগফিরাত (ক্ষমা) ও রহমত কামনা করি।” এই কামনা করা শব্দ হইতে মিনা শব্দটির উৎপত্তি এবং ঐ দিন হইতেই ঐ স্থানটি মিনা নামে পরিচিতি লাভ করে। রিওয়ায়াতে সুস্পষ্টভাবে উল্লিখিত আছে : তাঁহাদের গুনাহ মাফ হইল এবং তাঁহাদের তওবা কবুল করা হইল। সেখান হইতে তাহারা ভারতবর্ষে ফিরিয়া আসেন। মুজাহিদ (র) বলেন, তাহাদের গুনাহ মাফ করা বা তওবা কবুল করা হয়, অতঃপর তাহারা হিন্দ ভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেন। আদম (আ) ভারত ভূমি হইতে চল্লিশ বার পদব্রজে মক্কায় হজ্জ করিতে যান। তখন মুজাহিদকে প্রশ্ন করা হয়, হে আবুল হাজ্জাজ! তিনি বাহন ব্যবহার করিলেন না কেন? মুজাহিদ বলিলেন, কোন বাহনই বা তাঁহাকে বহন করিতে পারিত! তাহার এক একটি পদক্ষেপ তো তিন দিনের পথ ছিল?

হযরত আবদুল্লাহ ইব্‌ন উমার (রা) বলেন, আদম (আ) যখন হজ্জ ও আনুষঙ্গিক সমস্ত অনুষ্ঠান পালন করিলেন তখন ফেরেশতাগণ তাহার হজ্জ ও তওবা কবুলের জন্য অভিনন্দিত করিলেন। দয়া প্রবণতা ও সন্তান বাৎসল্য

কুরআন শরীফে মানব ও জিন সৃষ্টির উদ্দেশ্য বলা হইয়াছে :

“আমি জিন জাতি ও মানব জাতিতে সৃষ্টি করিয়াছি এইজন্য যে, তাহারা আমার ইবাদত করিবে” (৫১ : ৫৬)। এই আয়াতে আদম সৃষ্টির বিশেষ উদ্দেশ্য ব্যক্ত হইয়াছে। আদম দেহে আত্মা সঞ্চারের মুহূর্তে তিনি হাঁচির পর আলহামদু লিল্লাহ বলিলে আল্লাহ তাআলা বলেন : “তোমার প্রতি তোমার প্রতিপালক রহমত বর্ষণ করুন হে আদম! দয়া-প্রবণতার জন্যই আমি তোমাকে সৃষ্টি করিয়াছি” (আরাইস, পৃ. ২৯)।

সেই মুহূর্তে তাহার এই চেতনার উদ্ভব হয় যে, উদ্বেলিত অনুতপ্ত অন্তরে স্রষ্টার দরবারে কাকুতি-মিনতি করিয়া ক্ষমা চাহিতে হইবে। আদম (আ)-এর মধ্যে ঐ মুহূর্তে ঐ চেতনাটিও অনেকটা সহজাতভাবে জাগিয়া উঠে। আল্লামা ছালাবীর উদ্ধৃত বর্ণনায় ঐ কথাটি ফুটিয়া উঠিয়াছে? “কোন কোন বর্ণনায় আছে, যখন আদমকে তাঁহার প্রভু বলিলেন, তোমার প্রতিপালক তোমার প্রতি রহমত বর্ষণ করুন হে আদম! আদম ঊর্ধ্ব দিকে হস্ত উত্তোলিত করিয়া উহা তাঁহার মস্তকে রাখিলেন এবং আহ্ উহ্ বলিয়া উঠিলেন। আল্লাহ তাআলা বলিলেন : তোমার কী হইল হে আদম? তিনি বলিলেন, আমি তো ভুল করিয়া বসিয়াছি। আল্লাহ জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি তাহা কোথা হইতে জানিতে পারিলে? আদম বলিলেন, “রহমত তো কেবল অন্যায়কারী ও অপরাধীদের প্রতিই হইয়া থাকে। সেই দিন হইতে উহা তাঁহার সন্তানদের রীতিতে পরিণত হইয়া যায় যে, যখনই তাহাদের কাহারও উপর কোন আপদ-বিপদ আপতিত হয়, তখনই তাহারা মস্তকে হাত রাখিয়া আহ্ উহ করিয়া উঠে” (আরাইস, পৃ. ২৯)।

আদি মানব আদম (আ)-এর চরিত্রে এই মমত্ববোধ সেই সৃষ্টির আদিম প্রভাতেই মূর্ত হইয়া উঠিয়াছিল। রূহের জগতে (মতান্তরের আরাফাত প্রান্তরে) যখন তাঁহার সম্মুখে তাঁহার পুণ্যবান ও পাপী বান্দাদের আত্মাকে সৃষ্টি করিয়া তাহার ডানে-বামে উপস্থিত করা হয়, আর একটি অতি উজ্জ্বল আত্মার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিয়া তিনি জানিতে পারিলেন যে, উনি তাহারই এক ভাবী বংশধর দাউদ (আ), আর তাহার আয়ু মাত্রই ষাট বৎসর, তখন ঐ স্বল্পায়ু সন্তানটির জন্য তাঁহার অন্তরে দয়ার উদ্রেক হয়। তাঁহার নিজের জন্য নির্ধারিত আয়ু এক হাজার বৎসর জানিতে পারিয়া তিনি স্বেচ্ছায় চল্লিশটি বৎসর (বর্ণনান্তরে ষাট বৎসর) তাঁহার সেই ভাবী সন্তানকে দান করিয়া সৃষ্টির সূচনা লগ্নেই সন্তান বাৎসল্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন (দ্র. মুসনাদে আহমাদ, ১৩, ২৫২, ২৯৯; বায়হাকী, ১০খ, ১৪৬; ইব্‌ন কাছীর, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৪৬)।

কুরবানী

কন্যা আকলিমার বিবাহ লইয়া কাবীল যখন জিদ ধরে তখন আদম (আ) আল্লাহর নির্দেশ মুতাবিক হাবীল ও কাবীল উভয়কেই আল্লাহর দরবারে কুরবানী পেশ করিবার নির্দেশ দান করেন, যাহা ইতোপূর্বেই আলোচিত হইয়াছে। উহা হইতে প্রতীয়মান হয় যে, তাঁহার কাল হইতেই কুরবানী প্রথা চালু হয়।

সন্তানদের প্রতি ওসিয়াত

মৃত্যুর পূর্বেই পুত্র-পরিজনের প্রতি প্রয়োজনীয় ওসিয়তের গুরুত্বপূর্ণ বিধানটিও আদম (আ)-এর যুগেই প্রবর্তিত হইয়াছিল। আদম (আ) তাহার ইনতিকালের পূর্বেই তাহার সন্তান-সন্তুতিদের প্রতি তাঁহার পরবর্তী নবী শীছ (আ)-এর প্রতি অনুগত থাকিবার নির্দেশ দিয়া যান।

সাক্ষী রাখা ও দলীল লিখনের বিধান

সূরা আরাফের আয়াত উদ্ধৃত করিয়া ইতোপূর্বে আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১খ, ৮৩-তে উদ্ধৃত হাদীছসহ আদম (আ)-এর পুত্র দাউদকে তাঁহার নিজ আয়ু হইতে ৪০ বৎসর দানের ঘটনা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হইয়াছে। আয়াতে আছে :

“আল্লাহ তাআলা তাহাদেরকেই তাহাদের নিজ সত্তা সম্পর্কে সাক্ষী রাখেন” (৭ : ১৭২)। তারপর ঐ আয়াতের শেষভাগে স্পষ্টভাবে বলা আছে :

“তাহারা বলিল, হাঁ, অবশ্যই আমরা সাক্ষী রহিলাম । ইহা এইজন্য যে, তোমরা যেন কিয়ামতের দিন না বল, “আমরা তো এ বিষয়ে গাফিল ছিলাম” (৭:১৭২)।

মৃত জন্তু, রক্ত ও শূকর মাংস নিষিদ্ধ ও বর্ণমালার ব্যবহার

হযরত (আ)-এর রিসালাত ও শরীআতের কথা হযরত আবু যার (রা) বর্ণিত হাদীছের শেষ অংশে বর্ণিত ইহয়াছেঃ “এবং তাঁহার প্রতি নাযিল করিয়াছেন মৃত জন্তু, রক্ত ও শূকর মাংস ভক্ষণের নিষেধাজ্ঞা এবং বর্ণফল একুশটি পাতায়” (ইবনুল আছীর, আল-কামিল, ১খ, বৈরূত)। উক্ত রিওয়য়াত হইতে জানা গেল যে, বর্ণমালাও তাহার নিকট প্রত্যাদিষ্ট হইয়াছিল।

মৌনতা অবলম্বন

সাহাবী আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) হইতে সাঈদ ইব্‌ন জুবায়র বর্ণিত একটি রিওয়ায়াতে প্রতীয়মান হয় যে, মৌনতা অবলম্বন বা স্বল্পবাক থাকার নির্দেশও হযরত আদম (আ)-এর প্রতি অবতীর্ণ হইয়াছিল। সেই রিওয়ায়াতটি এইরূপ : “আল্লাহ তাআলা যখন আদম (আ)-কে পৃথিবীতে পাঠাইলেন, তখন (ক্রমে ক্রমে) তাঁহার সন্তান-সন্তুতির সংখ্যা বৃদ্ধি পাইল। একদা তাঁহার পুত্র, পৌত্র ও প্রপৌত্রগণ তাঁহাকে ঘিরিযা বসিল এবং তাঁহার নিকটেই নানারূপ আলাপ-আলোচনা করিতে লাগিল। আদম (আ) কিন্তু একটিও কথা না বলিয়া চুপচাপ বসিয়া রহিলেন। তখন তাহারা অনুযোগ করিয়া বলিল, হে আমাদের পিতা! আমরা কথাবার্তা বলিতেছি, অথচ আপনি একেবারে চুপচাপ, একটি কথাও বলিতেছেন না, ব্যাপার কী? জবাবে তিনি বলিলেন, হে আমার পুত্রগণ! আল্লাহ তাআলা যখন তাহার নৈকট্য হইতে অমাকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন, তখন তিনি আমাকে নির্দেশ দিতে গিয়া বলেন : হে আদম! আমার সকাশে প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত তুমি স্বল্পবাক থাকিবে” (ইবন জারীর তাবারী, তারীখ, ১৩, ১৫৮-১৫৯; ইব্‌ন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ৯৮; ইবনুল জাওযী, আল-মুনতাম, ১খ, ২২১)।

আদম সৃষ্টি ও বিবর্তনবাদ

হযরত আদম (আ) যেহেতু পৃথিবীর আদি মানব, তাই তাঁহার জীবনী আলোচনা প্রসঙ্গে মানব সৃষ্টির পূর্ণ বিবরণ আসমানী কিতাবসমূহের আলোকে ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হইয়াছে। কিন্তু প্রায় দেড় শত বৎসর পূর্বে ১৮৫৯ সালে লন্ডন হইতে প্রকাশিত বিজ্ঞানী ডারউইনের On the Origin of Species গ্রন্থের বক্তব্য আসমানী গ্রন্থসমূহের হিদায়াত বঞ্চিত বা তাহাদের অবিশ্বাসী শ্রেণীর লোকজনকে বিবর্তনবাদের এক লূতন ধূম্রজালে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছে। প্রাচীন যুগের বিভিন্ন প্রাণীর ফসিল পর্যালোচনা করিয়া ঐ তথাকথিত ‘বিবর্তনবাদ তত্ত্বে এমন একটি ধারণা দেওয়া হইয়াছে যে, ক্রমপরিবর্তনের মাধ্যমে মানবজাতি বর্তমান অবস্থায় উপনীত হইয়াছে, আদিতে এই মানুষ মানব আকারে ছিল না। বানর ও মানুষের অবয়বগত সামঞ্জস্য দর্শনে বিভ্রান্ত হইয়া এই তত্ত্বে বিশ্বাসিগণ উক্ত জাতি যে এক ও অভিন্ন পূর্ব প্রজন্ম হইতে সৃষ্ট এইরূপ একটি ধারণায় উপনীত হইয়াছেন। তাদের এই অনুমানসর্বস্ব তত্ত্বের বিস্তারিত আলোচনা, এখানে নিষ্প্রয়োজন। কেননা ওহী তথা আসমানী হিদায়াত বা পথনির্দেশই অভ্রান্ত সত্য। এতদসত্ত্বেও সত্যানুসন্ধানী মানুষকে বিভ্রান্তমুক্ত রাখার উদ্দেশে এ সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু আলোচনা প্রয়োজন।

উল্লেখ্য যে, ‘অন দি অরিজিন অব স্পেসিস’ গ্রন্থের জন্য ডারউইনকে বিবর্তনবাদের প্রবর্তকের মর্যাদা দিয়া বিশ্বজোড়া আলোড়ন সৃষ্টি করা হইয়াছিল। তিনি তাঁহার উক্ত পুস্তকটির যষ্ঠ সংস্করণ প্রকাশ পর্যন্ত ‘বিবর্তনবাদ বা ইস্যুলিউশন শব্দটির আদৌ ব্যবহার করেন নাই (মরিস বুকাইলী প্রণীত গ্রন্থের অনুবাদ মানুষের আদি উৎস, পৃ. ৩৫)।

ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্বের অসারতা সম্পর্কে আলোচনা করিতে গিয়া ফরাসী পণ্ডিত মরিস বুকাইলী (বুকাই) বলেন : “কোন একটা প্রাণীর মধ্যে কিছু পরিবর্তন বা পার্থক্য তিনি দেখতে পেয়েছিলেন, তারপর আর সব কিছুকেই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে সেই পার্থক্য বা পরিবর্তনকেই বড় করে তুলে ধরেছিলেন। অথচ কোন প্রাণী বিশেষের মধ্যকার কোন পরিবর্তন বা পার্থক্য কখনও সেই প্রাণীর নিজ প্রজাতিকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না। অন্য কথায়, কোন ধরনের পরিবর্তন এক প্রজাতিকে অন্য প্রজাতিতে পরিণত করতে পারে না” (মানুষের আদি উৎস, পৃ. ৬৬)।

উপরিউক্ত সত্যের দিকে ইঙ্গিত করা হইয়াছে বৃটিশ রাজকীয় ডাকঘরের ডারউইনের শত বার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত ডাক টিকেটের মধ্যে। তাহাতে ডারউইনের দাবির দুই পার্শ্বে দুইটি সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীর ছবিও স্থান পায়। ঐ দুইটি ডারউইনকে লক্ষ্য করিয়া বলিতেছিল : “ এই যে জনাব! মেহেরবানী করিয়া শুনুন, আপনার থিওরীকে এড়াইয়া গিয়া এই যে, আমরা কোটি কোটি বৎসর যাবৎ আদি কালের সেই একই প্রজাতিরূপে রহিয়া গিয়াছি” (মানুষের আদি উৎস, পৃ. ৭৮)।

মরিস বুকাইলী এই সত্যটিকে আরও স্পষ্টভাবে তুলিয়া ধরিয়াছেন, “বিবর্তনের এই বিষয়টাকে আরেকটা বাস্তবতার সাথেও তুলনা করে দেখতে হবে। সেই বাস্তবতাটা হচ্ছে নানা ধরনের ব্যাকটেরিয়া এবং তেলা পোকার মত এক শ্রেণীর পোকা-মাকড়ের অস্তিত্ব। ঐ শ্রেণীর ব্যাকটেরিয়া ও পোকা-মাকড় যে তাদের আদিম যুগের অবয়ব নিয়েই এ যাবৎ টিকে রয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নাই, যদিও এর মধ্যে একই প্রজাতিতে ভিন্নতা ঘটেছে এবং ঘটেছে প্রচণ্ডতর ব্যাপকতার সঙ্গেই। নব্য-ডারউইনবাদীরা প্রাণের এবং প্রজাতির বহুকরণের ব্যাপারটা শুধু লক্ষ্য করে গেছেন। কিন্তু একই প্রাণী প্রজাতির কমবেশি অভিন্ন থাকার মত সুস্পষ্ট অথচ অনড় একটি বিষয়কে তারা যে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছেন, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই। ফলে তাদের গোটা থিওরিটাই মাঠে মারা পড়েছে” (মানুষের আদি উৎস, পৃ. ৭৯)।

বিবর্তনবাদের আলোচনা করিতে গিয়া বিজ্ঞানী ও এইচ ক্লার্ক লিখেন : “মানুষ স্তন্যপায়ী এবং ইহাও সন্দেহাতীত যে, মানুষের সহিত বিশেষ আকারের বানরের অবয়বগত বিশেষ মিল রহিয়াছে। ইহা পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। কিন্তু মানুষের শুধুমাত্র অবয়বগত মিল দেখিয়া অন্যান্য প্রাণীর সহিত উহার যথার্থ সম্পর্ক নির্ণয় করা বা বর্তমান পৃথিবীতে তাহার যথার্থ স্থান নির্ধারণ করা যায় না। দুর্ভাগ্যক্রমে পৃথিবীতে মানুষের যথাযথ রূপ নির্ধারণে অনেক জীববিজ্ঞানীই উদারতার দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করিয়া শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাটিয়া সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করিয়াছেন। প্রত্যেকটি প্রাণীর দেহগঠন কাজ তাহার মানসিক গঠনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, যাহা ব্যাখ্যা করার মত কোন পদার্থবিদ্যা বা রাসায়নিক জ্ঞান আজ পর্যন্ত আমরা পাই নাই। প্রতিটি রকমের ও জাতির জীবের মধ্যে বিশেষ ধরনের জটিল মনোগঠন লক্ষ্য করা যায়, যাহা ঐ বিশেষ প্রকারের জীবের ক্ষেত্রে বিশিষ্ট। প্রত্যেক প্রকার জীবের এই যে মনোগঠন তাহা তাহার দৈহিক গঠনের মতই গুরুত্বপূর্ণ” (The New Evolution, by H. clerk পৃ. ২৩)।

বিবর্তনের জন্য ফসিলকেই বিশ্বস্ততর ও নির্ভরযোগ্য প্রমাণ বলিয়া স্বীকার করা হইয়া থাকে। সরল জীবন হইতে ক্রমশ জটিল জীবনের দিকে যে বিবর্তন তাহা কেবল ফসিলের ইতিহাস হইতেই জানা যাইতে পারে। তাই স্বয়ং ডারউইন তদীয় অরিজিন অব স্পেসিস গ্রন্থে বিজ্ঞানী Dundor-কে উদ্ধৃত করিয়াছেন এইভাবেঃ “সরল জীবন হইতে ক্রমশ জটিল হইতে জটিলতর জীবনের দিকে যে বিবর্তন তাহা শুধু ফসিলের ইতিহাস হইতেই জানা যাইতে পারে। জীবিত প্রাণী ও উদ্ভিদের তুলনামূলক বিচারের দ্বারা তাহা পারিপার্শ্বিক প্রমাণ মাত্র, ঐতিহাসিক দলীল নির্ভর প্রমাণ নহে (ওরিজিন অফ স্পেসিস, প্যারা ২, পৃ. ৫২)।

আবার জি, জি সিম্পসন (১৯৪৪ সালে) বলেন : বিভিন্ন প্রকার জীবের মধ্যে ক্রম সম্পর্কহীনতা এত বেশী এবং উচ্চ স্তরের জীবের মধ্যে এত প্রবল যে, এই সময়ে ক্রমসম্পর্ক পাওয়াই যায় না (দ্র. Tempo and mode in Evolution, P. 99)। এই বিভিন্ন জীবের মধ্যে অমিল থাকাই বিবর্তন তত্ত্বের পক্ষে একটি বিরাট বাধাস্বরূপ (অধ্যক্ষ আবুল কাসেম, বিজ্ঞান সমাজ ধর্ম, পৃ. ১৪১।

এক রকম পাখী আছে যাহার লেজ সরীসৃপের মত। ইহা হইতে ধরিয়া লওয়া হয় যে, সরীসৃপ হইতেই পাখি সৃষ্টি হইয়াছে। ইহা অনুমান মাত্র। ডাকবিল (duckbell) দুগ্ধপায়ী জীব ও সরীসৃপের মত। তাই বলিয়া কি ধরিয়া লইতে হইবে যে, সরীসৃপ হইতেই উহার উদ্ভব ঘটিয়াছে (দ্র. অধ্যক্ষ আবুল কাসেম, বিজ্ঞান সমাজ ধর্ম, বিবর্তনবাদ ও আল্লাহর অস্তিত্ব, পৃ. ১৪১)?

জীব বিজ্ঞানের বিখ্যাত পণ্ডিত ডব্লিউ জে টিংকলও বিবর্তনবাদের প্রমাণ যে নির্ভরযোগ্য নহে তাহা স্বীকার করিয়াছেন এইভাবে :“ইতোমধ্যেই আমরা দেখিয়াছি, কীভাবে অবস্থান বিবেচনার চাইতে স্তর মধ্যকার ফসিল দেখিয়া মাটিস্তরের বয়স নির্ণয় করা হয়। আমাদের দুর্ভাগ্যই বলিতে হইবে যে, এই কারণে বর্তমান গবেষণার জন্য এই ভূ-তাত্ত্বিক রেকর্ডের মূল্য নেহায়েত কম। কেননা যদি মাটি স্তরের বয়স নির্ণয়ের জন্য ফসিল ব্যবহার করা হয় তবে আমরা অমনি উল্টা ঘুরিয়া বলিতে পারি না যে, মাটির স্তরের বয়স নির্ধারণ করা যাইবে। বিবর্তনবাদী ভূ-তাত্ত্বিক বিবর্তন তত্ত্বকে সত্য ও নির্ভুল ধরিয়া লইয়াই উহার ভিত্তিতে তথ্যের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাইয়া থাকেন যদ্দরুণ এই রকম বিবর্তনবাদীর পাওয়া তথ্য দিয়া প্রমাণ করা যায় না যে, সরল আকার হইতেই প্রাণী জগতের বিকাশ ঘটিয়াছে” (Fundamental of Zoology, P. 43৪)।

বির্তনবাদী পণ্ডিত দবজানিস্কি (Dobzhanski) একটি চমঙ্কার চিত্রকল্পের অবতারণা করিয়া অনুমান-নির্ভর বিবর্তনবাদের অবাস্তবতার প্রমাণ দিয়াছেন। তিনি বলেন : “কল্পনা করুন যে, এই বাক্সের মধ্যে ছাপার টাইপ লইয়া একটি বানর ঝাঁকি দিতেছে। ঘটনাক্রমে কি ঐ টাইপগুলি দান্তের ‘ডিভাইব্‌ন কমেডি পুস্তকটি রচনা করিতে পারে? প্রথম দৃষ্টিতেই এই অসুবিধা, যাহা স্বয়ং ডারউইনকেও অপ্রতিভ করিয়া তুলিয়াছিল, জীববিজ্ঞানের ভিতরের ও বাহিরের বহু চিন্তাবিদের নিকট অগ্রহণযোগ্য প্রতিপন্ন হইয়াছে। ভান করিয়া লাভ নাই যে, (বানরের উদাহরণ দিয়া) সেই অসুবিধাটুকুর সন্তোষজনক সমাধান করা হইয়াছে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তল্কালীন পদার্থ বিজ্ঞানী অধ্যাপক আবুল কাসেম তদীয় আলোচনার উপসংহারে লিখেন : “উপরে যা বলা হয়, তাতে দেখা যাবে, বিশেষ সৃষ্টিতত্ত্বকে নস্যাৎ করবার শক্তি এখনও বিবর্তন তত্ত্ব পায়নি। বিশেষ সৃষ্টি তত্ত্বের সমর্থকরা বলেন, বিবর্তন যে হয় তা সত্য কিন্তু এটা হয় এক একটা প্রজাতির মধ্যে সীমাবদ্ধভাবে। এটা স্বীকার করে নিলে বিশেষ সৃষ্টিতত্ত্ব তথা আল্লাহর সৃষ্টিকে স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া গতি থাকে না। বিবর্তন তত্ত্বে যে বহু অলৌকিকতার অস্তিত্ব রয়েছে তাও আজ বৈজ্ঞানিকদের দ্বারা স্বীকৃত হয়েছে। বৃটিশ জীববিজ্ঞানী ডগলাস ডিওয়ার বলেন, বিবর্তন তত্ত্ব অলৌকিকতার অবসান কামনা করেছিল সত্য, কিন্তু তার দ্বারা তা সম্ভব হয়নি। এটা বিশেষ সৃষ্টিতত্ত্বের অলৌকিকতাকে নতুনভাবে পরিবেশন করেছে মাত্র” (আবুল কাসেম, বিজ্ঞান সমাজ ধর্ম, পৃ. ১৪৩)।

ডারউইনের স্বীকারোক্তি

বিবর্তনবাদ তত্ত্ব যে একটা অনুমান-নির্ভর তত্ত্বমাত্র, প্রমাণিত সত্য নহে, স্বয়ং ডারউইন তাহা স্বীকার করিয়া গিয়াছেন। প্যারিস হইতে প্রকাশিত এস ডারনেট লিখিত “ ইস্যুলিউশন অব দি লিভিং ওয়ার্ল্ড” পুস্তকে তাঁহার স্বলিখিত একটি স্বীকারোক্তিপত্রের ফটোকপিও মুদ্রিত হইয়াছে, যাহার মূল কপি বৃটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রহিয়াছে বলিয়া লেখক তথ্য প্রকাশ করিয়াছেন (সূত্র এ ডি এম এস, ৩৭৭২৫ এফ ৬)।

১৮৬১ সালে টমাস হটন স্কয়ারকে লিখিত উক্ত পত্রে ডারউইন স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করেন যে, বিবর্তনবাদের ব্যাখ্যায় সত্য সত্যই তিনি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়াছেন। অবশ্য উক্ত পত্রে ডারউইন ইহাও বলিয়াছেন, “তবে আমি নেচারাল সিলেকশন বা প্রকৃতির নির্বাচন তত্ত্বে বিশ্বাসী। যদিও এই থিওরী অনুযায়ী কোন প্রজাতি এ যাবৎ পরিবর্তিত হইয়া অন্য আরেকটি প্রজাতিতে পরিণত হইয়াছে এমন একটি প্রমাণও আমি দেখাইতে পারিব না, তথাপি আমি এই তত্ত্বে বিশ্বাস করি…..।”

উপরিউক্ত পত্রখানা উদ্ধৃত করিয়া ফরাসী বিজ্ঞানী মরিস বুকাইলী মন্তব্য করেন : “উপরিউক্ত পত্রের বক্তব্য থেকে একটা বিষয় সুস্পষ্ট। ডারউইন নেচারাল সিলেকশনের নামে যে থিওরীর কথা বলতেন তার দ্বারা একটি প্রজাতি পরিবর্তিত হয়ে পুরোপুরি অন্য একটা প্রাণীতে যে পরিণত হয় না, সে বিষয়ে তিনি সম্যক অবহিত ছিলেন। শুধু তাই নয়, নিজস্ব উদ্দেশ্যমূলক পর্যবেক্ষণের সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হিসাবে যখন তিনি নেচারাল সিলেকশনের আনুমানিক প্রভাবের কথা বলতেন, তখনও তিনি গোটা বিষয়টাকে নিছক একটা থিওরী বা তত্ত্ব হিসাবেই উপস্থাপন করতে চাইতেন। অথচ সংজ্ঞা হিসাবেই থিওরী বা তত্ত্ব হচ্ছে নিছক একটা ধারণা বা হাইপোথিসিস মাত্র, তার বেশী কিছু নয়। এই ধরনের থিওরী বা তত্ত্ব সময়ে সময়ে বিভিন্ন ধরনের ঘটনার ব্যাখ্যায় সূত্র হিসাবে কাজ করে থাকে। মানবজ্ঞানের অগ্রযাত্রার একটা পর্যায় বা সময়কাল পর্যন্ত এ ধরনের কোন থিওরী উপযোগী বলে প্রতীয়মানও হইতে পারে। তবে কোন্ থিওরী কতটা সঠিক, তার প্রমাণ সাব্যস্ত হয় সময়ের ধারায়। সময়ের সেই বিচারে ডারউইন থিওরী যে সঠিক তত্ত্ব হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে সে কথা এখন আর বলা চলে না” (মানুষের আদি উৎস, পৃ. ৬৪)।

ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্ব যতই সেকেলে ও অবান্তর হউক না কেন, এক শ্রেণীর লোক উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাহা আঁকড়াইয়া ধরিয়া আছে। এই কথাটি মরিস বুকাইলী ব্যক্ত করিয়াছেন এইভাবে :“দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এই ডারউইনবাদকে যতটা না জ্ঞান-বিজ্ঞানের সহায়ক হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে, তার চেয়ে অধিক মাত্রায় ব্যবহার করা হয়েছে আদর্শগত উদ্দেশ্য পূরণের নিমিত্ত হিসাবে। অধুনা আমরা বিবর্তনবাদের প্রক্রিয়া সম্পর্কে অনেক বেশী ওয়াকিফহাল। আর এটা সম্ভব হয়েছে জীবাশ্ম বিজ্ঞানসহ অপরাপর প্রকৃতি বিজ্ঞানের বহুবিধ সঠিক তথ্য ও প্রমাণ আবিস্কারের দরুন। শুধু তাই নয়, ডারউইনের পর থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত প্রাপ্ত বংশগতি (জেনেটিক) ও জীববিজ্ঞান (বিশেষত মলিকুলার বায়োলজি) সংক্রান্ত প্রচুর তথ্য জ্ঞান অর্জনে যে কারো পক্ষেই এখন একটা সহজ হয়ে পড়েছে। অথচ এখনও আমাদের কেউ কেউ শতাধিক বছর পূর্বেকার এই বিভ্রান্তিকর ডারউইন থিওরীকে নিয়েই বসে রয়েছে। শুধু তাই নয়, এখনো এই ডারউইন থিওরীর এমন সমর্থকও আছেন, যাহারা মনে করেন, এই থিওরী বাদ দেওয়া মানে তাদের আদর্শের পৃষ্ঠে ছুরিকাঘাত করা। সুতরাং ডারউইনের এই থিওরী আজকের যুগে যতই বাতিল বলে প্রমাণিত ও হাস্যকর বলে বর্জিত হোক না কেন, তারা যে কোন মূল্যেই যে তা আঁকড়ে ধরে থাকতে চাইবেন, সেটাই স্বাভাবিক” (মানুষের আদি উৎস, পৃ. ৬৪-৬৫)।

বিবর্তন সম্বন্ধে আধুনিক মতবাদ প্রসঙ্গে আলোচনা করিতে গিয়া অধ্যক্ষ আবুল কাসেম বৈজ্ঞানিক উদ্ধৃতিসহ যে মন্তব্য করিয়াছেন তাহা প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেন : “জীবদেহের কার্যপ্রকৃতি মূলত যন্ত্রের কার্য প্রকৃতি থেকে পৃথক। জীব প্রকৃতি মেসিনের স্বরূপ দ্বারা ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। মনে হয় জীবন একটি মৌলিক সত্তা। অধিকন্তু ইহা সৃষ্টিশীল । ইহা জীবদেহের স্বরূপগুলিকে এমনভাবে তৈরি ও ব্যবহার করে যাতে তার উদ্দেশ্য ও স্বার্থ সিদ্ধ হয়। এই কারণে সৃষ্টিধর্মী বিবর্তনবাদের উদ্ভব হয়েছে। এই তত্ত্ব এমন একটি উদ্দেশ্যশীল শক্তি বা নীতির প্রমাণ দেয় যা জীবদেহ থেকে একটি আপাত দুৰ্জেয় উদ্দেশ্যের দিকে পরিচালিত করার তাগিদে ক্রমশ উন্নততর জীবনের বিকাশ সাধন করছে। অতীতে জীব বিজ্ঞান ডারউইন তত্ত্বকে অবলম্বন করে নাস্তিক্যবাদী ভাবের বিস্তার করেছিল। আধুনিক জীববিজ্ঞান আজ নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করেছে, জীবন বস্তুধর্মী যন্ত্র নয়, জীবন একটি মৌলিক ব্যাপার। অধিকন্তু এটা সৃষ্টিশীল ও উদ্দেশ্যশীল।

“আধুনিক দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরা ভাবছেন বিবর্তন সত্য হলেও সেটা অন্ধভাবে ঘটছে না। এমন সুন্দর ও সুসমঞ্জস সৃষ্টি বিনা চিন্তায় বিনা পরিকল্পনায় সম্ভব নয়। প্রত্যেকটি বিবর্তন ধারার মধ্যে একটি মহামন master mind কাজ করছে। এই মহামনই প্রত্যেকটি বিবর্তনের ধারার মধ্য দিয়ে একটা উদ্দেশ্যের দিকে সৃষ্টিকে পরিচালিত করছে। সুতরাং জীববিজ্ঞান আজ একটি মহামনের দিকে একটি উদ্দেশ্যশীল সত্তার দিকে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে। অন্য কথায়, যে বিবর্তনবাদ নাস্তিকতার পোষক হিসাবে দেখা দিয়েছিল তারই আধুনিক রূপ আজ তাকে আস্তিকতার মাহাত্মে উন্নত করে তুলে ধরছে” (বিজ্ঞান সমাজ ধর্ম, পৃ. ১৪৩-৪৪)।

আল-কুরআনে এই সত্যটিই ঘোষিত হইয়াছে মুমিনের দুআরূপে :

“হে আমাদের প্রতি পালক! এই সৃষ্টিজগত তুমি অনর্থক সৃষ্টি কর নাই। তুমি পবিত্র, আমাদেরকে দোযখের শাস্তি হইতে রক্ষা করিও” (৩ : ১৯১)।

শেখ সাদী (র) সম্ভবত এই উপলব্ধি হইতেই বলিয়াছিলেন :

“বৃক্ষপত্রে কিশলয় দেখে তারে সজাগ সুজন
স্রষ্টার মহিমা কীর্তি প্রতিপত্রে রয়েছে লিখন।”

মহান স্রষ্টা আল্লাহ তাআলা যে একটা মহান উদ্দেশ্যে আসমান-যমীন সৃষ্টি করিয়াছেন, কুরআন শরীফের বহু স্থানে উহার উল্লেখ রহিয়াছে। যেমনঃ

“আমি আকাশ, পৃথিবী এবং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী কোন কিছুই অনর্থক সৃষ্টি করি নাই। অনর্থক সৃষ্টি করার ধারণা তাহাদের যাহারা কাফির। সুতরাং কাফিরদের জন্য রহিয়াছে জাহান্নামের দুর্ভোগ (৩৮: ২৭)।

অন্যত্র আল্লাহ তাআলা এই সম্পর্কে বলেন,

“আমি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং উহাদের মধ্যে কোন কিছুই ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করি নাই। আমি এই দুইটি অযথা সৃষ্টি করি নাই, কিন্তু উহাদের অধিকাংশই ইহা জানে না” (৪৪ ও ৩৮-৩৯)।

বিবর্তনবাদের আলোকে বৈজ্ঞানিকগণ যে সৃষ্টিতত্ত্বের আলোচনা-সমালোচনায় কুরআনের উক্ত সত্য উপলব্ধির পথে অগ্রসর হইতেছেন ইহা একটি শুভ লক্ষণ সন্দেহ নাই।

কয়েকটি প্রসঙ্গিক বিষয়

ফেরেশতা

বাংলা ভাষায় বহুল ব্যবহৃত ফিরিশতা বা ফেরেশতা শব্দটির মূল ফার্সী রূপ হইতেছে ফেরেশতা বা ফারিশতা। উহাও ফার্সীর ব্যবহৃত রূপ। আসলে ফার্সী [ ] ধাতু হইতে নিষ্পন্ন শব্দটি হইতে [ ] যাহার অর্থ প্রেরিত। তাঁহারা আল্লাহর নিকট হইতেই প্রেরিত এবং তাহার বার্তাবহনই তাঁহাদের প্রধান কাজ, সেই হেতু তাহাদের এইরূপ নামকরণ। ইহার আরবী প্রতিশব্দ : এক বচনে মালাক এবং বহু বচনে মালাইকা (লুগাতে কিশওয়ারী, পৃ. ৩৪৫) [ ] ধাতু হইতে নিষ্পন্ন। রাগিব ইস্পাহানীয় ভাষায়ঃ

উল্ক শব্দের অর্থ রিসালত বা বার্তা পৌঁছাইয়া দেওয়া। তাই আরবী বাক্যে যখন বলা হয় [ ] তখন ইহার অর্থ হয় “অমুককে আমার বার্তা পৌঁছাইয়া দাও”। আরবী [ ] শব্দটি আসলে [ ] অর্থাৎ বার্তা পৌঁছানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত (আল-মুফরাদাত ফী গারীবিল কুরআন, শিরো., পৃ. ২১)।

শব্দটি [ ] ধাতু হইতে নিষ্পন্ন ইহার অর্থ বার্তা পৌঁছানো (রূহুল মাআনী)।

কুরআন শরীফেও সূরা যুখরুফ (৩৪ নং সূরা) ৮০ নং আয়াতে ফেরেশতা অর্থে [ ] আমার রাসূলগণ শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে।

তাফসীরে বায়যাবীতে আছে : “যেহেতু তাঁহারা আল্লাহর ও মানুষের মধ্যে মাধ্যমস্বরূপ, সেই হিসাবে তাহারা আল্লাহর বার্তাবাহক অথবা মানুষের প্রতি তাঁহার দূতস্বরূপ”।

‘তাফসীরে কাবীর-এর বর্ণনামতে? ইহারা সূক্ষ্ম বায়বীয় দেহধারী, বিভিন্ন রূপ বা আকৃতি ধারণে সক্ষম, তাহাদের আবাসস্থল আসমান। ইহা অধিকাংশ মুসলমানের মত।

বায়যাভী শরীফে ঈষৎ শাব্দিক পরিবর্তনসহ তাহাদের এই পরিচয়ই দেওয়া হইয়াছে।

মওলানা আবদুল মাজেদ দরিয়াবাদী (র) তদীয় তাফসীরে লিখেন :

ফেরেশতাগণের উল্লেখ আল-কুরআনে

আসমানী কিতাব ও হিদায়াতে বিশ্বাসীদের জন্য ফেরেশতাদের অস্তিত্ব ও তাহাদের ভূমিকা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কুরআন শরীফের অসংখ্য স্থানে ইহাদের আলোচনা আসিয়াছে। কুরআন শরীফের ১০টি স্থানে ‘মালাকুন’, তিনটি স্থানে ‘মালাকান’, দুইটি স্থানে ‘মালাকায়ন’ (দ্বি-বচনে), ৬৮টি স্থানে ‘মালাইকা’ এবং ৫টি স্থানে ‘মালাইকাতুহু’-রূপে ইহার ব্যবহার পরিলক্ষিত হয় (মুহাম্মদ ফুওয়াদ আবদুল বাকী, আল-মুজাম আল-মুফাস, পৃ. ৬৭৪।)

কাসাসুল আম্বিয়া প্রণেতা আবদুল ওয়াহহাব আনাজ্জার কুরআন শরীফের ৮৬টি সূরায় উক্ত মালাকুন বা মালাইকা শব্দের উল্লেখ ৮৮ বার রহিয়াছে বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন-যাহার চিত্র নিম্নরূপঃ

সূরার ক্রমিক নং – সূরার নাম – আয়াত নম্বরসমূহ

(২) আল-বাকারা ৩০, ৩১, ৩৪, ৯ ১৬১, ১৭৭, ২১০, ২৪৮, ২৮৫

(৩) আলে ইমরান ১৮, ৩৯, ৪২, ৪৫, ৮০, ৮৭, ১২৪ ও

(৪) সূরা নিসা ৯৭, ১৩৬, ১৬৬, ১৭২

(৬) সূরা আনআম ৮, ৯, ৫০, ৯৩, ১১১, ১৯৮

(৭) সূরা আরাফ ১১, ২০

(৮) সূরা আনফাল ৯, ১২, ৫০

(১১) সূরা হূদ ১২, ৩১

(১২) সূরা ইউসুফ ৩১

(১৩) সূরা রাদ ১৩, ২৩

(১৫) আল-হিজর ৭, ৮, ২৮, ৩০

(১৬) সূরা নাহল ২, ২৮, ৩২, ৩৩, ৪৯

(১৭) সূরা কাহফ ৫০

উক্ত আয়াতসমূহ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, ফেরেশতা আল্লাহর অতি নৈকট্যপ্রাপ্ত সম্মানিত সৃষ্টি। আল্লাহ্ তাআলা নূরের দ্বারা তাহাদেরকে সৃষ্টি করিয়াছেন। বিভিন্ন আয়াতে তাহাদের বিবিধ বৈশিষ্ট্য ও দায়িত্বের কথা উল্লিখিত হইয়াছে। যেমন, সূরা ফাতিরে শুরুতেই আল্লাহ্ তাআলা বলেন :

“সকল প্রশংসা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা আল্লাহরই, যিনি বাণীবাহক করেন ফেরেশতাদেরকে, যাহারা দুই দুই, তিন তিন অথবা চার চার পক্ষবিশিষ্ট। তিনি সৃষ্টিতে যাহা ইচ্ছা বৃদ্ধি করেন। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান” (৩৫ : ১)।

বিভিন্ন স্তরের ফেরেশতাদের বিভিন্ন সংখ্যক পাখা বা ডানা বিশিষ্ট করিয়া সৃষ্টি করা হইয়াছে। কিন্তু ঐ ডানাসমূহের সংখ্যা চারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নহে, বরং কোন কোন ফেরেশতাকে আল্লাহ তাআলা অনেক বেশি সংখ্যক ডানাও দান করিয়াছেন। যেমন বুখারী, মুসলিম ও তিরমিযী শরীফের এক হাদীছে বর্ণিত আছে যে, হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন মাসউদ (রা) বর্ণনা করেন, একদা নবী করীম (সা) জিবরাঈল (আ)-কে ছয়শত ডানাবিশিষ্ট অবস্থায় প্রত্যক্ষ করিয়াছেন। তিরমিযী শরীফে উদ্ধৃত হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত হাদীছে আছে, জিবরাঈল (আ)-কে মহানবী (সা) দুইবার ছয়শত ডানাসহ এমন অবস্থায় দেখিয়াছেন যে, গোটা দিগন্ত তাহার ডানাসমূহে ঢাকা পড়িয়া গিয়াছিল [তাফহীমূল কুরআন, খ, ৪, পৃ. ২১৮ ও মুখতাসার, ইব্‌ন কাছীর (সানী), ৩খ, পৃ. ১৩৮)।

সূরা আস-সাফফাত-এর প্রারম্ভে উল্লিখিত হইয়াছে :

“শপথ তাহাদের যাহারা সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান ও যাহারা মেঘমালার কঠোর পরিচালক এবং যাহারা যিকির আবৃত্তিতে রত” (৩৭ :১-৩)।

উক্ত আয়াতসমূহের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আল্লামা ইবন কাছীর (র) বলেন :

ইব্‌ন মাসউদ (রা) বলেন : ইহারা হইতেছেন ফেরেশতাগণ। ইহা ইবন আব্বাস (রা), মাসরুক, সাঈদ ইবন জুবায়র, ইকরিমা, মুজাহিদ, সুদ্দী ও কাতাদা (র) প্রমুখেরও অভিমত।

কাতাদা (র) বলেন, ফেরেশতাগণ আকাশে সারিবদ্ধ অবস্থায় রহিয়াছে (মুহাম্মদ আলী সাবুনী, মুখতাসার তাফসীর ইব্‌ন কাছীর, ৩ খ, পৃ. ১৭৫, পাদটীকাসহ, চতুর্থ মুদ্রণ বৈরূত, ১৪০১ হি.)।

মক্কার মুশরিকগণ ফেরেশতাগণকে আল্লাহর কন্যা বলিয়া বিশ্বাস করিত। এই সূরায় তাই বিশেষভাবে ফেরেশতাদের আল্লাহর আনুগত্যের উপর জোর দেওয়া হইয়াছে।

মুসলিম শরীফে জাবির ইব্‌ন সামুরা (র) হইতে বর্ণিত হাদীছ উদ্ধৃত করা হইয়াছে। তিনি বলিয়াছেন,

রাসূল (সা) বলিলেনঃ তোমরা কি সেইরূপ সারিবদ্ধ হইবে না, যেমন ফেরেশতাগণ তাহাদের প্রভুর সম্মুখে সারিবদ্ধ হইয়া থাকেন? আমরা জিজ্ঞাসা করিলাম, ফেরেশতাগণ তাহাদের প্রভুর সম্মুখে কীভাবে সারিবদ্ধ হইয়া থাকেন? রাসূলুল্লাহ (সা) বলিলেন : তাঁহারা অগ্রবর্তী সারি পূর্ণ করেন এবং সারি ঘনভাবে সন্নিবেশিত করেন অর্থাৎ একজন অপরজনের সঙ্গে গায়ে গা মিলাইয়া দাঁড়াইয়া থাকেন (ইব্‌ন কাছীর)।

“মসীহ আল্লাহর বান্দা হওয়াকে কখনো হেয় জ্ঞান করে না এবং ঘনিষ্ঠ ফেরেশতাগণও না” (৪ : ১৭২)।

অন্যত্র আছে, তাহারা দিবারাত্রি আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমায় লিপ্ত থাকেন এবং তারপরও ক্লান্তি বোধ করেন না (দ্র. আল-কুরআন, ৪১ : ৩৮)।

আল্লাহর দরবারে তাহাদের উচ্চ মর্যাদার কারণে বিভ্রান্ত মানুষ যুগে যুগে তাহাদেরকে আল্লাহর কন্যা সন্তান বলিয়া ধারণা করিয়াছে, ঈসা মসীহ (আ)-কেও অভিহিত করিয়াছে তাহার পুত্র বলিয়া । এই প্রসঙ্গে আল্লাহ্ বলেন :

“উহারা দয়াময় আল্লাহর বান্দা ফেরেশতাদেরকে নারী বলিয়া গণ্য করিয়াছে। ইহাদের সৃষ্টি কি উহারা প্রত্যক্ষ করিয়াছিল? উহাদের উক্তি অবশ্যই লিপিবদ্ধ করা হইবে এবং উহাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হইবে” (৪৩ : ১৯)।

আসলে নূরের সৃষ্টি এই ফেরেশতাকূলের তো পুরুষ বা নারী হওয়ার কোন প্রশ্নই উঠে না। তাহারা আল্লাহর এক অনন্য সৃষ্টি। ফেরেশতাগণ যে আল্লাহর আনুগত্য ও নির্দেশ পালন ও প্রশংসার জন্য সদাপ্রস্তুত তাহার স্বীকৃতি ঐ সূরারই শেষ দিকে স্বয়ং তাহার ভাষায় বর্ণিত হইয়াছে এই ভাবে :

“আমাদের প্রত্যেকের জন্যই স্থান নির্ধারিত রহিয়াছে। আমরা তো সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান এবং আমরা অবশ্যই তাহার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণাকারী” (৩৭ : ১৬৪-১৬৬)।

ইহার ব্যাখ্যায় ইব্‌ন কাছীর (র) বলেন : অর্থাৎ প্রত্যেক ফেরেশতার জন্য আসমানে নির্ধারিত স্থান ও ইবাদত ক্ষেত্র রহিয়াছে। তিনি সেই গণ্ডীর বাহিরে যাইতে পারেন না। ঐ নির্দিষ্ট গণ্ডীর মধ্যেই তাহাকে অবস্থান করিতে হয়।

দাহহাক (র) বলেন, মাসরূক (র) হযরত আইশা (রা)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলিয়াছেন । পৃথিবী সন্নিহিত আকাশের এমন কোন স্থান নাই যেখানে কোন না কোন ফেরেশতা সিজদা অথবা দণ্ডায়মান অবস্থায় নাই (মুখতাসার তাফসীর ইবন কাছীর, ৩খ, পৃ. ১৯৩, সারূনী সম্পা.)।

“তোমাদের প্রতিপালক কি তোমাদেরকে পুত্র সন্তানের জন্য নির্বাচিত করিয়াছেন এবং তিনি কি নিজে ফেরেশতাগণকে কন্যারূপে গ্রহণ করিয়াছেনঃ তোমরা তো নিশ্চয়ই ভয়ানক কথা বলিয়া থাক” (১৭৪০)।

অন্যত্র ফেরেশতাগণ সম্পর্কে বলা হইয়াছে :

“তাহাদিগকে আল্লাহ যে আদেশ করেন তাহারা তাহা অমান্য করে না এবং তাহারা তাহাই করে যাহার আদেশ তাহাদেরকে দেওয়া হইয়া থাকে” (৬৬৬)।

“এবং তুমি ফেরেশতাদেরকে দেখিতে পাইবে যে, উহারা আরশের চতুম্পা ঘিরিয়া উহাদের প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করিতেছে” (৩৯ : ৭৫)।

ফেরেশতাকুলের মধ্যে চারজন সর্বশ্রেষ্ঠ

(১) জিবরাঈল আলায়হিস সালাম ও তাঁহাকে রূহুল কুদুস নামেও অভিহিত করা হইয়া থাকে। আল্লাহ তাআলা তাঁহার মর্যাদা, শক্তিমত্তা ও আমানতদারী বা বিশ্বস্ততার কথা উল্লেখ করিয়া বলেন :

“নিশ্চয় এই কুরআন সম্মানিত বার্তাবহর আনীত বাণী–যে সামর্থশালী, আরশের মালিকের নিকট মর্যাদাসম্পন্ন, যাহাকে সেথায় মান্য করা হয়, যে বিশ্বাসভাজন” (৮১ : ১৯-২১)।

আল্লাহ্ তাআলা তাঁহাকে সর্বোত্তম কাজ অর্থাৎ তাহার এবং তাঁহার সম্মানিত রাসূলগণের মধ্যে দৌত্যকর্মের জন্য বিশেষভাবে মনোনীত করিয়াছেন। তাই তিনি পৃথিবীতে উহা লইয়া আগমন করিতেন। আল্লাহ্ তাআলা বলেন :

“নিশ্চয় আল-কুরআন জগতসমূহের প্রতিপালক হইতে অবতীর্ণ। জিবরাঈল ইহা লইয়া অবতীর্ণ হইয়াছে তোমার হূদয়ে, যাহাতে তুমি সতর্ককারী হইতে পার” (২৬ : ১৯২-১৯৪)।

সহীহ হাদীছের বর্ণনামতে, তিনি সৃষ্টিজগতের ইতিহাসে সর্বদীর্ঘ ও সর্বোত্তম সফর অর্থাৎ ইসরা ও মিরাজে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সফরসঙ্গীরূপে প্রথমে মক্কা শরীফের মাসজিদুল হারাম হইতে বায়তুল মাকদিস পর্যন্ত এবং তারপর সেখান হইতে সিরাতুল মুন্তাহা পর্যন্ত সফর করেন, যাহা ঊর্ধ্ব জগতের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অবস্থিত (দ্র. আল-লুলু ও ওয়াল-মারজান (সহীহ বুখারী ও মুসলিমের হাদীছ চয়নিকা গ্রন্থ, ১খ, পৃ. ৩৫-৩৯; বুখারী, ১খ, ৯২-৯৪; মুসলিম, ১খ, ৯৯-১০১; আরও দ্র. তাফসীর গ্রন্থসমূহে সূরা ই-এর তাফসীর)।

(২) মীকাঈল (আ) : ‘আকীদাতুত তাহাবিয়া গ্রন্থে তাঁহার সম্পর্কে আছে, “তাহার উপর বৃষ্টিপাতের দায়িত্ব ন্যস্ত রহিয়াছে যদ্দ্বারা মর্তভূমি, বৃক্ষলতা এবং প্রাণী জগতের প্রাণ রক্ষা হয়” (শারহু আকীদাতিত-তাহাবিয়া, ২খ, পৃ. ৪০৮)।

(৩) আযরাঈল (আ) : তিনি সৃষ্টিকূলের রূহ কবয়ের দায়িত্বে নিযুক্ত। এই কাজে তাঁহার সহযোগীরূপে আরও অনেক ফেরেশতা নিয়োজিত রহিয়াছেন। কুরআন শরীফের নিম্নোক্ত আয়াতে উল্লিখিত হইয়াছে :

“অবশেষে যখন তোমাদের কাহারও মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন আমার প্রেরিতরা তাহার মৃত্যু ঘটায় এবং তাহারা কোন ত্রুটি করে না” (৬ : ৬১)।

ইহাদের মধ্যেও একজন রহমতের এবং অপরজন আযাব বা শাস্তির ফেরেশতা। নেককার বান্দাদের জান কবযের জন্য সৌম্যমূর্তিসম্পন্ন রহমতের ফেরেশতাগণ এবং বদকার বা পাপচারীদের জান কবযের জন্য বীভৎস রূপধারী কঠোর প্রকৃতির আযাবের ফেরেশতাগণ আগমন করিয়া থাকেন, যাহার বিস্তারিত বিবরণ হাদীছের বর্ণনায় পাওয়া যায় (দ্র. সহীহ, মুসলিম, ৮খ, পৃ. ১৬২, বৈরূত সং)। আয়াতে আমার প্রেরিতরা কোন ত্রুটি করে না বলিয়া এই সত্যের দিকেই ইঙ্গিত করা হইয়াছে যে, নেককার বান্দাদের জান কবযে সৌহার্দপূর্ণ আচরণ করিতে এবং পাপাচারীদের জান কবয়ে কঠোরতা অবলম্বনে ফেরেশতাগণ ক্রটি করেন না বলা হইয়াছে (দ্র. আকীদাতুল মুমিন, পৃ. ১৯৩, আবু বকর আল-জাযাইরী প্রণীত)।

(৪) ইসরাফীল (আ) ও কিয়ামতের সময় তিনি সিঙ্গায় ফুঁক দিবেন। তখন বিশ্ব ধ্বংস হইয়া যাইবে। পরে পুনরায় সিঙ্গায় ফুক দিবেন যাহাতে পুনরুত্থান বা হাশর সংঘটিত হইবে ও সৃষ্টিকূলের হিসাব-নিকাশ তথা বিচার সম্পন্ন হইবে।

কিরামান কাতিবীন বলিয়া ফেরেশতাগণের কথা কুরআন শরীফে উল্লিখিত হইয়াছে এইভাবে :

“অবশ্যই আছে তোমার জন্য তত্ত্বাবধায়কগণ, সম্মানিত লিপিকরবৃন্দ; তাহারা জানে তোমরা যাহা কর” (৮২ : ১১-১২)।

অন্যত্র তাহাদের প্রসঙ্গ বলা হইয়াছে এইভাবে :

“স্মরণ রাখিও, দুই গ্রহণকারী ফেরেশতা তাহার (মানুষের) দক্ষিণে ও বামে বসিয়া তাহার কর্ম লিপিবদ্ধ করে। মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তাহার জন্য তৎপর প্রহরী তাহার নিকটেই রহিয়াছে” (৫০ : ১৭-১৮)।

কিয়ামতের দিন বেহেশতীগণকে অভ্যর্থনা জানানো বা দোযখীদিগকে দোযখের দিকে হাঁকাইয়া লইয়া যাওয়ার কাজ বা নবী-রাসূলগণের আনুগত্য করিয়া পার্থিব জীবন সুন্দরভাবে পরিচালনা করিয়া চিরস্থায়ী শান্তির আবাসভূমি বেহেশত লাভে ব্যর্থতার জন্য তিরস্কারও করিবেন এই ফেরেশতাগণ।

আল্লাহ্ তাআলা বলেন,

‘কাফিরদেরকে জাহান্নামের দিকে দলে দলে হাঁকাইয়া লইয়া যাওয়া হইবে। যখন উহারা জাহান্নামের নিকট উপস্থিত হইবে তখন ইহার প্রবেশদ্বারগুলি খুলিয়া দেওয়া হইবে এবং জাহান্নামের রক্ষীরা উহাদেরকে বলিবে, “তোমাদের নিকট কি তোমাদের মধ্য হইতে রাসূল আসে নাই, যাহারা তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের আয়াতসমূহ আবৃত্তি করিত এবং এই দিনের সাক্ষাত সম্বন্ধে তোমাদেরকে সতর্ক করিত? উহারা বলিবে, অবশ্যই আসিয়াছিল; বস্তৃত কাফিরদের প্রতি শাস্তির কথা বাস্তবায়িত হইয়াছে। উহাদেরকে বলা হইবে, জাহান্নামের দ্বারসমূহে প্রবেশ কর উহাতে স্থায়ীভাবে অবস্থিতির জন্য। কত নিকৃষ্ট উদ্ধতদের আবাসস্থল! যাহারা তাহাদের প্রতিপালককে ভয় করিত তাহাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে লইয়া যাওয়া হইবে। যখন তাহারা জান্নাতের নিকট উপস্থিত হইবে, ইহার দ্বারসমূহ খুলিয়া দেওয়া হইবে এবং জান্নাতের রক্ষীরা তাহাদেরকে বলিবে, ‘তোমাদের প্রতি সালাম, তোমরা সুখী হও এবং জান্নাতে প্রবেশ কর স্থায়ীভাবে অবস্থিতির জন্য। তাহারা প্রবেশ করিয়া বলিবে, প্রশংসা আল্লাহর যিনি আমাদের প্রতি তাঁহার প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করিয়াছেন এবং আমাদেরকে অধিকারী করিয়াছেন এই ভূমির; আমরা জান্নাতে যেথায় ইচ্ছা বসবাস করি। সদাচারীদের পুরস্কার কত উত্তম! এবং তুমি ফেরেশতাদেরকে দেখিতে পাইবে যে, উহারা আরশের চতুম্পার্শ্ব ঘিরিয়া উহাদের প্রতিপালকের সপ্রশংসা পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করিতেছে। আর তাহাদের বিচার করা হইবে ন্যায়ের সহিত। বলা হইবে, সকল প্রশংসা জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর প্রাপ্য” (৩৯ : ৭১-৭৫)।

উক্ত আয়াতসমূহ হইতে জান্নাতের রক্ষী, জাহান্নামের রক্ষী এবং আরশবাহী ফেরেশতাকূলের অস্তিত্ব সম্পর্কেও স্পষ্টভাবে জানা গেল। জান্নাতের রক্ষীরূপে নিযুক্ত ফেরেশতাকূলের প্রধানের নাম রিদওয়ান এবং জাহান্নামের রক্ষীকূলের প্রধানের নাম মালিক (দ্র. আকীদাতুল-মুমিন, পৃ. ১৯৪)।

কবরে মুনকার-নাকীর কর্তৃক মৃত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের কথাও হাদীছে বিবৃত হইয়াছে।

মুফতী মুহাম্মাদ শফী (র) সূরা ইয়াসীন-এর ২৭ নং আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে সাহাবী হযরত বারাআ ইবন আযিব (রা) কর্তৃক বর্ণিত হাদীছ উদ্ধৃত করিয়াছেন। ইহাতে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, মুমিনকে কবরে প্রশ্ন করার ভয়ঙ্কর মুহূর্তেও সে আল্লাহর অনুগ্রহে কালেমা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু”র উপর প্রতিষ্ঠিত থাকিবে এবং উহার সাক্ষ্য দিবে। তারপর (১৪ : ২৭) আয়াতটি তিলাওয়াত করিয়া তিনি বলেন, এই আয়াতে উহার কথাই বলা হইয়াছে। হযরত বারাআ ইব্‌ন আযিব (রা) ছাড়াও প্রায় চল্লিশজন সাহাবী হইতে এই বিষয়ে বহু হাদীছ বর্ণিত হইয়াছে। ইবন কাছীর স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে এইগুলি সবিস্তারে বর্ণনা করিয়াছেন (দ্র. জালালুদ্দীন সুয়ূতী, আত-তাছবীত ইব্‌নদাত তারীত, শারহুস্-সুদূর)।

মৃত্যু ও দাফনের পর কবরে পুনর্জীবন লাভ, ফেরেশতাগণের প্রশ্নোত্তর এবং সেই পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে পুরস্কার বা শাস্তিলাভের ব্যাপারটি কুরআন পাকের দশটি আয়াতে ইঙ্গিতে এবং রাসূলুল্লাহ (সা) হইতে বর্ণিত ৭০ খানা প্রসিদ্ধ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত (দ্র. মাআরিফুল কুরআন, উক্ত আয়াতের তাফসীরে)।

মানবজাতির হেফাযতে ফেরেশতাকুল

কুরআন-হাদীছের বর্ণনা হইতে জানা যায় যে, ফেরেশতাগণ আল্লাহর পক্ষ হইতে মানবজাতির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও পালন করিয়া থাকেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ্ তাআলা বলেন :

“মানুষের জন্য তাহার সম্মুখে ও পশ্চাতে একের পর এক প্রহরী থাকে; উহারা আল্লাহর আদেশে তাহার রক্ষণাবেক্ষণ করে” (১৩ : ১১)।

সহীহ বুখারীর হাদীছে বলা হইয়াছে, ফেরেশতাগণের দুইটি জামাআত মানুষের হিফাযতের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত রহিয়াছেন। একদল রাত্রির বেলায় এবং অপরদল দিনের বেলায় হিফাযতের দায়িত্ব পালন করিয়া থাকেন। ফজরের ও আসরের সময় উভয় দল একত্র হইয়া থাকেন। ফজরের নামাযের পর রাত্রিকালের দায়িত্ব পালনকারিগণ বিদায় নেন এবং দিনের প্রহরিগণ দায়িত্বভার বুঝিয়া লন। আসরের নামাযের পর যখন ঐ দল বিদায় হইয়া যায় তখন রাত্রিবেলার প্রহরী ফেরেশতাগণ আসিয়া দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

আবু দাউদের বর্ণনায় হযরত আলী (রা) হইতে বর্ণিত আছে, প্রত্যেক মানুষের জন্য এমন হিফাযতকারী ফেরেশতা রহিয়াছেন যাহারা তাহার উপর প্রাচীর ভাঙিয়া পড়ারূপে নিপতিত হওয়া বা হিংস্র প্রাণী কর্তৃক আক্রান্ত হওয়া হইতে তাহাকে হিফাযত করিয়া থাকেন। তবে কাহারও নির্ধারিত ভাগ্য আসিয়া পড়িলে হিফাযতকারী ফেরেশতাগণ সরিয়া দাঁড়ান (রূহল মাআনী, ১৩খ, পৃ. ১১৩)।

হযরত উছমান (রা)-এর রিওয়ায়াতে ইবৃনে জারীর বর্ণিত হাদীছ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, ফেরেশতাগণ শুধু পার্থিব অনিষ্ট হইতেই নয়, পারলৌকিক ব্যাপারসমূহেও মানুষের হিফাযতের, তাহাদেরকে পাপকর্ম হইতে রক্ষার এবং পূণ্য কর্মে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করার কাজে নিয়োজিত থাকেন, এমনকি তাহার দ্বারা কোন পাপকর্ম সাধিত হইলে তাহারা তাহাকে তওবার জন্য অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করিয়া থাকেন। এতদসত্ত্বেও যদি সে পাপকর্মে লিপ্ত হয় এবং তওবা না করে তাহা হইলে তাহার পাপকর্ম লিপিবদ্ধ করেন (তু. পূ.গ্র.)।

আশবাহী ফেরেশতাকুল

ইহারা আল্লাহর আরশ বহনের সৌভাগ্যের অধিকারী অত্যন্ত সম্মানিত ফেরেশতা। তাহাদের সংখ্যা চারিজন। কিয়ামতের সময় আরও চারিজন তাহাদের সহিত যুক্ত হইবেন। কুরআন শরীফে তাহাদের কথা উল্লিখিত হইয়াছে এইভাবে :

“যাহারা আরশ ধারণ করিয়া আছে এবং যাহারা ইহার চতুম্পা ঘিরিয়া আছে তাহারা তাহাদের প্রতিপালকের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে প্রশংসার সহিত এবং তাহাতে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং মুমিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে” (৪০: ৭)।

কিয়ামতের দিন আশরবাহী ফেরেশতার সংখ্যা আটজন হওয়ার কথাটি এইভাবে উল্লিখিত হইয়াছে :

“এবং সেইদিন আটজন ফেরেশতা তোমার প্রতিপালকের আরশকে ধারণ করিবে তাহাদের ঊর্ধ্বে” (৬৯ ৪১৭)।

অনুরূপভাবে হাদীছে আত্মীয়তা সম্পর্ক রক্ষাকারী ও ছিন্নকারীদের সংক্রান্ত এবং পাহাড়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতাদের প্রসঙ্গও বর্ণিত হইয়াছে (দ্র. আল-লুলু ওয়াল-মারজান, ৩খ, পৃ. ২০৮ ও ২, পৃ. ২২৭-২৮)।

সুতরাং ফেরেশতাগণের প্রতি বিশ্বাস ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আল্লাহ তাআলা পূণ্যকর্মের তালিকায় ইহার উল্লেখ করিয়াছেন। তিনি বলেন:

“বরং পূণ্য আছে কেহ আল্লাহতে, পরকালে, ফেরেশতাকূলে, সমস্ত কিতাবে এবং নবীগণের প্রতি ঈমান আনয়ন করিলে” (২ : ১৭৭)।

“স্মরণ রাখিও! দুই গ্রহণকারী ফেরেশতা তাহার ডানে ও বামে বসিয়া তাহার কর্ম নিপিবদ্ধ করে। মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তাহার জন্য তৎপর প্রহরী তাহার নিকটেই রহিয়াছে” (৫০ ১৭-১৮)।

জিন জাতি

কুরআন শরীফের ৭টি স্থানে জান্নরূপে এবং ২২টি স্থানে জিন্নরূপে শব্দটি ব্যবহৃত হইয়াছে। মানব ও জিন্ন সৃষ্টির উপাদান সম্পর্কে বলা হইয়াছে :

“আমি তো মানুষ সৃষ্টি করিয়াছি ছাঁচে ঢালা শুষ্ক ঠনঠনা মৃত্তিকা হইতে এবং ইহার পূর্বে সৃষ্টি করিয়াছি জিন্ন অত্যুষ্ণ অগ্নি হইতে” (১৫ ও ২৬-২৭)।

লক্ষণীয়, উভয় স্থানেই মানুষ সৃষ্টির উপাদান শুষ্ক ঠনঠনা মাটি এবং জিন্ন সৃষ্টির উপাদান আগুন বলা হইয়াছে। দ্বিতীয় আয়াতে জিন্ন জাতিকে মানবজাতির পূর্বেই সৃষ্টি করার উল্লেখ রহিয়াছে।

হযরত আইশা (রা) হইতে বর্ণিত হাদীছে আছে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলিয়াছেন । ফেরেশতাগণ নূর হইতে সৃষ্টি, জিন্নজাতি আগুন হইতে সৃষ্টি এবং আদমকে সৃষ্টি করা হইয়াছে সেই উপাদান হইতে যাহা তোমাদেরকে বর্ণনা করা হইয়াছে (মুসলিম, খ, পৃ.)।

তাফসীর বিশারদগণ বলেন, জিন্ন জাতিকে আদম (আ)-এর পূর্বে সৃষ্টি করা হয়। তাহারও পূর্বে হিন্ ও বিন্ জাতির বাস ছিল এই পৃথিবীতে। আল্লাহ্ তাআলা জিন্ন জাতিকে তাহাদের উপর আধিপত্য দান করেন। তখন তাহারা পূর্বোক্ত জাতি দুইটিকে হত্যা করে এবং পৃথিবী বক্ষ হইতে উচ্ছেদ করিয়া নিজেরাই পৃথিবীতে বসবাস করিতে থাকে।

ইব্‌ন ‘আব্বাস, ইবন মাসউদ (রা) প্রমুখ সাহাবী হইতে বর্ণিত আছে যে, সৃষ্টিকর্ম সমাপ্ত করিয়া আল্লাহ্ তাআলা যখন আরশে সমাসীন হইলেন তখন তিনি ইবলীসকে পৃথিবীর ফেরেশতাদের প্রধান নিযুক্ত করেন। সে ছিল ফেরেশতাদেরই জিন্ন নামক গোত্রের একজন। তাহারা জান্নাতের রক্ষী ছিল বলিয়া তাহাদেরকে জিন্ন বলা হইত। ইবলীস তাহার সঙ্গী ফেরেশতাগণকে সঙ্গে লইয়া জান্নাতের এই রক্ষীর দায়িত্ব পালন করিত। তখন তাহার অন্তরে এই ভাবের উদ্রেক হয় যে, ফেরেশতাদের উপর তাহার প্রাধান্য থাকার কারণেই সে এই মর্যাদার অধিকারী হইতে পারিয়াছে। দাহ্হাক (র) ইব্‌ন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণনা করেন, জিন্ন জাতি যখন পৃথিবীতে ফিত্না-ফাসাদ ও রক্তপাত করিতে শুরু করে তখন আল্লাহ্ তাআলা তাহাদেরকে দমন করার উদ্দেশ্যে ইবলীসকে তাহার ফেরেশতা বাহিনীসহ প্রেরণ করিলেন। তাহারা আসিয়া উহাদিগকে হত্যা করে এবং পৃথিবীর মূল ভূখণ্ড হইতে সাগরের দ্বীপমালায় তাড়াইয়া দেয়। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ৩য় সংস্করণ, ১৯৭৯, ১৩, পৃ. ৫৫)।

ইবন আব্বাস (রা)-এর বর্ণনা হইতে জানা যায়, আল্লাহর অবাধ্য হওয়ার পূর্বে ইবলীসের নাম ছিল আযীল। সে ছিল পৃথিবীর অধিবাসী। চারি ডানা বিশিষ্ট ফেরেশতাদের সে সর্দার ছিল। পৃথিবী ও দুনিয়ার আকাশে তাহার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল। গোত্রবংশের দিক হইতে সে অন্যান্য ফেরেশতাদের চাইতে অগ্রগণ্য ছিল। জ্ঞান-গরিমা, উদ্যম ও অধ্যবসায়ে সে ছিল সকল ফেরেশতার অগ্রণী ।

হাসান বসরী (র) বলেন : ইবলীস এক মুহূর্তের জন্যও ফেরেশতা ছিল না, বরং সে ছিল জিন্নদের আদি পিতা, যেমনটি আদম (আ) মানবজাতির আদি পিতা। শাহর ইবন হাওশাব (র) ও অন্যরা বলেন, ফেরেশতাগণ যে জিন্ন জাতিকে পৃথিবী হইতে বিতাড়িত করিয়াছিলেন, তাহাদের মধ্য হইতে তাহাকে তাঁহারা বন্দী করিয়া আসমানে লইয়া গিয়াছিলেন। ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে সে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হইয়াছিল, কিন্তু আল্লাহর আদেশ মত আদম (আ)-কে সিজদা না করার কারণে মর্যাদাহারা ও বিতাড়িত হইয়াছিল।

জিন্নরা মানুষের মত পানাহার ও বংশ বিস্তার করিয়া থাকে। তাহাদের মধ্যেও মুমিন ও কাফির তথা বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী উভয় শ্রেণী রহিয়াছে। কেননা, কুরআন শরীফের সূরা জিন্ন-এ জিন্নদের ভাষ্যই উদ্ধৃত হইয়াছে এইভাবে :

“আমাদের কতক সর্মপরায়ণ এবং কতক ইহার ব্যতিক্রম। আমরা ছিলাম বিভিন্ন পথের অনুসারী। এখন আমরা বুঝিয়াছি যে, আমরা পৃথিবীতে আল্লাহকে পরাভূত করিতে পারিব না এবং পলায়ন করিয়াও তাঁহাকে ব্যর্থ করিতে পারিব না। আমরা যখন পথনির্দেশক বাণী শুনিলাম তাহাতে ঈমান আনিলাম। যে ব্যক্তি তাহার প্রতিপালকের প্রতি ঈমান আনে তাহার কোন ক্ষতি ও কোন অন্যায়ের আশঙ্কা থাকিবে না। আমাদের কতক আত্মসমর্পণকারী এবং কতক সীমালঙ্গনকারী; যাহারা আত্মসমর্পণ করে তাহারা সুচিন্তিতভাবে সত্য পথ বাছিয়া লয়। অপরপক্ষে সীমালঙ্গনকারীরা তো জাহান্নামেরই ইন্ধন” (৭২ : ১১-১৫)।

তাফসীরে মাযহারীতে আছে : কুরআন পাকে যাহাদেরকে শয়তান বলা হইয়াছে, বস্তুত তাহারা দুষ্ট শ্রেণীর জিন্ন। জিন্ন ও ফেরেশতাগণের অস্তিত্ব কুরআন ও সুন্নাহর অকাট্য বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত। তাই ইহা অস্বীকার করা কুফরী (তাফসীর মাআরিফুল কুরআন, ৮খ, পৃ. ৫৭৪; সূরা জিনের তাফসীর প্রসঙ্গ)।

মানব ও জিন্ন জাতির সৃষ্টির উদ্দেশ্য কুরআন শরীফের যে আয়াতে ব্যক্ত হইয়াছে তাহাতে যেমন জিন্ন ও মানব জাতিকে এক কাতারে এক সাথে রাখা হইয়াছে, তেমনি তাহাদের পুরস্কার-তিরস্কার সংক্রান্ত অন্য এক আয়াতেও তাহাদের কথা অভিন্নভাবে বর্ণিত হইয়াছে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন :

“ইহাদের পূর্বে যে জিন্ন ও মানব সম্প্রদায় গত হইয়াছে, তাহাদের মত ইহাদের প্রতিও আল্লাহর উক্তি সত্য হইয়াছে। ইহারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত। প্রত্যেকের মর্যাদা তাহার কর্মানুযায়ী; ইহা এই জন্য যে, আল্লাহ্ প্রত্যেকের কর্মের পূর্ণ প্রতিফল দিবেন এবং তাহাদের প্রতি অবিচার করা হইবে না” (৪৬ : ১৮-১৯)।

জিন্নদের আমলের প্রতিফল লাভ সম্পর্কে তাফসীরে মাযহারীতে বিস্তারিত আলোচনা রহিয়াছে। কাফির জিন্নদেরকে জান্নাত দ্বারা পুরস্কৃত করা হইবে, অথবা কেবল জাহান্নামের আগুন হইতে নিষ্কৃতি দিয়াই পুরস্কৃত করা হইবে, এই ব্যাপারে মতানৈক্য রহিয়াছে। কেননা আয়াতে আছে :

“হে আমাদের সম্প্রদায়! আল্লাহর দিকে আহ্বানকারীর প্রতি সাড়া দাও এবং তাহার প্রতি ঈমান আন। আল্লাহ্ তোমাদের পাপ ক্ষমা করিবেন এবং মর্মন্তুদ শাস্তি হইতে তোমাদেরকে রক্ষা করিবেন” (৪৬ : ৩১)।

এখানে জান্নাতের সুসংবাদ তাহাদেরকে দেওয়া হয় নাই। ইমাম আবু হানীফা (র) এই মত পোষণ করিতেন। আবার ইমাম মালিক ও ইবন আবী লায়লার মত অনেকেই মানুষের মত তাহাদেরকেও জান্নাত দ্বারা পুরস্কৃত করা হইবে বলিয়া মত প্রকাশ করিয়াছেন।

আবুশ শায়খকে জিজ্ঞাসা করা হইয়াছিল যে, জিন্ন জাতি কি জান্নাতের সুখভোগ করিবে? জবাবে তিনি বলেন, আল্লাহ্ তাআলা ইলহামস্বরূপ তাহাদের অন্তরে যিকর দান করিবেন, তাহারা উহা দ্বারা মানুষের জান্নাতভোগের মত সুখশান্তি লাভ করিবেন। এই ব্যাপারে আবুশ শায়খ যেন জিন্ন জাতিকে ফেরেশতাগণের দলভুক্ত করিয়া দিলেন।

ইবনুল মুনযির বলেন, আমি হামযা ইব্‌ন হাবীবকে জিজ্ঞাসা করিলাম, জিন্ন জাতি কি জান্নাতের সুখ-শান্তির অধিকারী হইবে? তিনি হাঁ-সূচক জবাব দেন এবং দলীলস্বরূপ তিলাওয়াত করেন :

“(বেহেশতের সুখ-সামগ্রীর) সেই সকলের মধ্যে রহিয়াছে বহু আনত-নয়না (হুর) যাহাদেরকে পূর্বে কোন মানুষ অথবা জিন্ন স্পর্শ করে নাই” (৫৫ : ৫৬)।

অর্থাৎ মানুষের জন্য মানুষের উপযোগী হুর এবং জিনের জন্য জিন্নের উপযোগী হুর থাকিবে (করাচীর দারুল ইশাআত মুদ্রিত তাফসীর মাযহারী, ১২, ১৩০-১৩১ সূরা জিন্নের তাফসীর প্রসঙ্গ)।

সূরা আর-রাহমানের নিম্নলিখিত আয়াত দ্বারাও জিন্নদের জান্নাত প্রাপ্তির দলীল দেওয়া হইয়া থাকে, যাহাতে আল্লাহ্ তাআলা বলেন।

“আর যে আত্মাহর সম্মুখে উপস্থিত হওয়ার ভয় রাখে, তাহার জন্য রহিয়াছে দুইটি উদ্যান। সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের প্রতিপালকের কোন্ অনুগ্রহ অ স্বীকার করিবে” (৫৫ ৪ ৪৫-৪৭)।

এখানে আল্লাহ্ তাআলা জান্নাতের কথা অনুগ্রহস্বরূপ উল্লেখ করিয়াছেন। তাহারা যদি জান্নাত লাভের সুযোগ না পাইত, তাহা হইলে আল্লাহ্ তাআলা অনুগ্রহস্বরূপ উহার উল্লেখ করিতেন না এবং উহা তাহাদের প্রতি অনুগ্রহ বলিয়া প্রকাশ করিতেন না। আল্লামা ইব্‌ন কাছীর (র) বলেন :

অর্থাৎ এই একটি দলীল প্রমাণ হিসাবে এই বিষয়ে যথেষ্ট (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, পৃ.৫২)।

ইবলীস শয়তান প্রসঙ্গ

ইমাম তাবারী (র) বলেন, ইবলীস শব্দটি আরবী শব্দ হইতে উদ্ভুত। ইহার শাব্দিক অর্থ কল্যাণ হইতে নিরাশ হওয়া, অনুতাপ, অনুশোচনা ও দুঃখ-দুশ্চিন্তা করা।

এই মর্মে আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত আছে, ইবলীসের এই নামকরণ করা হইয়াছে এই জন্য যে, আল্লাহ্ তাহাকে সর্বপ্রকার কল্যাণ হইতে নিরাশ করিয়াছেন এবং তাহাকে বিতাড়িত শয়তানে পরিণত করিয়াছেন। তাহার পাপাচারের শাস্তিস্বরূপ ইহা করা হইয়াছে।

সুদ্দী হইতে বর্ণিত, ইবলীসের প্রকৃত নাম ছিল হারিছ। সত্য হইতে নিরাশ হইয়া নিজেকে পরিবর্তিত করার জন্য তাহার নাম হয় ইবলীস। কুরআন শরীফেও এই অর্থে আয়াত আসিয়াছে?

“তাহাদেরকে যে উপদেশ দেওয়া হইয়াছিল তাহারা যখন তাহা বিস্মৃত হইল তখন আমি তাহাদের জন্য সমস্ত কিছুর দ্বার উন্মুক্ত করিয়া দিলাম। অবশেষে তাহাদেরকে যাহা দেওয়া হইল যখন তাহারা তাহাতে উল্লসিত হইল তখন অকস্মাৎ তাহাদেরকে ধরিলাম, ফলে তখনি তাহারা নিরাশ হইল” (৬ ৪ ৪৬)।

সূরা কাহফের আয়াতে তাহার পরিচয় এইভাবে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হইয়াছে :

“এবং স্মরণ কর, আমি যখন ফেরেশতাগণকে বলিয়াছিলাম আদমের প্রতি সিজদা কর, তখন তাহারা সকলেই সিজদা করিল ইসলীস ব্যতীত; সে জিন্নদের একজন ছিল। সে তাহার প্রতিপালকের আদেশ অমান্য করিল। তবে কি তোমরা আমার পরিবর্তে উহাকে এবং উহার বংশধরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করিতেছ? উহারা তো তোমাদের শত্রু। যালিমদের এই বিনিময় কত নিকৃষ্ট” (১৮ : ৫০)।

উক্ত আয়াত হইতে কয়েকটি বিষয় সুস্পষ্টভাবে জানা গেল :

(১) ইবলীস জিন্ন জাতির অন্তর্ভুক্ত। (২) উহার বংশবিস্তারও হইয়া থাকে, তাই জিন্ন জাতির মধ্যেও যৌন চেতনা, বিবাহশাদী প্রভৃতির প্রচলন রহিয়াছে। (৩) কোন কোন মানুষ জিন্নদিগকে ও তাহাদের প্রধান ইবলীসকে আল্লাহর স্থলে নিজেদের অভিভাবক ও কর্মবিধায়করূপে মান্য করিয়া থাকে। (৪) ইবলীস ও তাহার বংশধরদের অনুসারীরা যালিম-অনাচারী, তাহাদের মন্দ পরিণতি রহিয়াছে। (৫) শয়তান জিন্নরাও ইবলীস; মানুষের শত্রু।

ইবলীসকে আল্লাহ্ পৃথিবী ধ্বংস হওয়া পর্যন্ত অবকাশ দিয়া রাখিয়াছেন যেন সে তাহার সাধ্যমত মানুষকে পথভ্রষ্টকারী শয়তান বাহিনীকে দিক-দিগন্তে ছাড়িয়া দেয়। জাবির ইবন আবদুল্লাহ্ (রা) বর্ণিত হাদীছে আছে :

ইবলীসের সিংহাসন সমুদ্র বক্ষে, সে তাহার বাহিনী প্রতিদিন মানুষকে পথভ্রষ্ট করার জন্য প্রেরণ করে। সুতরাং তাহার কাছে সর্বাধিক ঘনিষ্ঠ হইতেছে, যে মানুষকে সর্বাধিক পথভ্রষ্ট করিতে পারে (মুসনাদ আহমাদ-এর বরাতে আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, পৃ. ৫৩)।

ইবলীস শব্দটি কুরআন শরীফের ১১টি স্থানে ব্যবহৃত হইয়াছে। যথা :

২ সূরা বাকারা ৩৪

৭ আল-আরাফ

১৫ আল-হিজর ৩১-৩২

১৭ আল-ইসরা ৬১

১৮ আল-কাহফ ৫০

২০ তা-হা ১১৬

২৬ শুআরা ৯৫

৩৪ সাবা ২০

৩৮ সাদ ৭৪-৭৫

বিভিন্ন হাদীছের দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহর নাম স্মরণ না করিয়া পানাহার করিলে বা ঘরে প্রবেশ করিলে, বাম হাতে দাঁড়ানো অবস্থায় পানাহার করিলে, ঘরে আল্লাহকে স্মরণ না করিলে এবং আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে শয়তান তাহার প্রভাব বিস্তার করিয়া থাকে। অনুরূপ ধর্মের নামে নব-আবিষ্কৃত রীতিনীতি তথা বেদাতী কার্যকলাপে লিপ্ত করিয়া তওবা হইতে বিমুখ রাখিয়া শয়তান শ্রেণীর জিন্নরা মানুষকে ভ্রষ্টতায় ডুবাইয়া রাখে। উহাদের কবল হইতে রক্ষা পাওয়ার বিভিন্ন ব্যবস্থার কথাও হাদীছে বিস্তারিত আলোচিত হইয়াছে।

নবুওয়াত ও রিসালাত

কুরআন শরীফে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হইয়াছে :

“এমন কোন সম্প্রদায় নাই, যাহার নিকট সতর্ককারী প্রেরণ করা হয় নাই” (৩৫ ও ২৪)। এই / (সতর্ককারী) শব্দের ব্যাখ্যা তাফসীরে জালালাইব্‌ন শরীফে করা হইয়াছে এইভাবে :

“নবী, যিনি সেই সম্প্রদায়কে সতর্ক করেন” (পৃ. ৫৭৭, আল-জামিয়াতুল ইসলামিয়া চীন কর্তৃক প্রকাশিত, পিকিং মুদ্রণ ১৪০২/১৯৮২)।

অন্যত্র বলা হইয়াছে :

“আল্লাহর ইবাদত করিবার ও তাগূতকে বর্জন করিবার নির্দেশ দিবার জন্য আমি তো প্রত্যেক জাতির মধ্যেই রাসূল পাঠাইয়াছি” (১৬ : ৩৬)।

মানবজাতিকে স্রষ্টার পক্ষ হইতে সতর্ককারী ও পথপ্রদর্শকরূপে আগমনকারী উক্ত মহামানবগণকে কুরআনুল কারীমে নবী ও রাসূলরূপে অভিহিত করা হইয়াছে। আদম (আ) নবী বা রাসূল ছিলেন কিনা সেই আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়ার পূর্বেই নবুওয়াত ও রিসালাতের অর্থ কী, নবী ও রাসূলের পার্থক্যই বা কী তাহা সুস্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন।

আল্লাহ তাআলা নবী-রাসূল প্রেরণের পটভূমি ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করেন এইভাবে :

‘সমস্ত মানুষ ছিল একই উম্মত। অতঃপর আল্লাহ নবীগণকে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেন। মানুষেরা যে বিষয়ে মতভেদ করিত তাহাদের মধ্যে সে বিষয়ে মীমাংসার জন্য তিনি তাহাদের সহিত সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেন এবং যাহাদিগকে তাহা দেওয়া হইয়াছিল, স্পষ্ট নিদর্শন তাহাদের নিকট আসিবার পরে, তাহারা শুধু পরস্পর বিদ্বেষবশত সেই বিষয়ে বিরোধিতা করিত। যাহারা বিশ্বাস করে, তাহারা যে বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করিত, আল্লাহ তাহাদিগকে সে বিষয়ে নিজ অনুগ্রহে সত্য পথে পরিচালিত করেন। আল্লাহ যাহাকে ইচ্ছা সরল পথে পরিচালিত করেন” (২: ২১৩)।

উক্ত আয়াত হইতে প্রতীয়মান হয় যে,

(ক) প্রথমে মানবজাতি এক অভিন্ন উম্মত ও সত্য পথের অনুসারী ছিল;

(খ) কালক্রমে তাহাদের মধ্যে মতবিরোধ শুরু হয়;

(গ) মানবজাতির মধ্যে সৃষ্ট কলহ ও হানাহানি বন্ধ করিয়া তাহাদিগকে বিবাদ-বিসংবাদ মিটাইয়া দিয়া সঠিক পথে পরিচালনার জন্য নবী-রাসূলগণের আগমন ঘটে।

(ঘ) তাহাদের সাথে হিদায়াতের গ্রন্থাদিও নাযিল করা হয়;

(ঙ) কিতাব অবতীর্ণ হওয়ার পরও একদল বিদ্বেষবশত কলহ-বিবাদ ও হানাহানিতে লিপ্ত থাকে;

(চ) ঈমানদার বান্দাগণ নবী-রাসূলগণের হিদায়াত গ্রহণ করিয়া ধন্য হইয়াছেন।

(ছ) নবী-রাসূলগণ পুণ্যবানদের জন্য সুসংবাদদাতা এবং পাপী-তাপী অবাধ্যদের জন্য সতর্ককারীরূপেই বিশ্বে আবির্ভূত হইয়াছেন। এই শেষোক্ত বক্তব্যটি অন্য আয়াতে আরও স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হইয়াছে :

“আমি সুসংবাদদাতা ও সাবধানকারী রাসূল প্রেরণ করিয়াছি, যাহাতে রাসূল আসার পর আল্লাহর বিরুদ্ধে মানুষের কোন অভিযোগ না থাকে। আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়” (৪ : ১৬৫)।

এই নবুওয়াত ও রিসালাত আল্লাহ তাআলার বিশেষ দান। আল্লাহ তাআলা বলেন :

“কিতাবীদের মধ্যে যাহারা কুফরী করিয়াছে তাহারা এবং মুশরিকরা ইহা চাহেনা যে, তোমাদের প্রতিপালকের নিকট হইতে তোমাদের প্রতি কোন কল্যাণ অবতীর্ণ হউক। অথচ আল্লাহ যাহাকে ইচ্ছা নিজ রহমতের জন্য বিশেষরূপে মনোনীত করেন এবং আল্লাহ মহা অনুগ্রহণকারী” (২: ১০৫)।

তাফসীরবিদগণ বলেন, আয়াতে উক্ত (কল্যাণ) বলিতে ওহী এবং বিশেষ রহমত বলিতে নবুওয়াত বুঝানো হইয়াছে (দ্র. তাফসীর জালালাইব্‌ন, পৃ. ২২, চীনা মুদ্রণ, ১৪০২/১৯৮২)। এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন :

“আল্লাহ ফেরেশতাদের মধ্য হইতে মনোনীত করেন বাণীবাহক এবং মানুষের মধ্য হইতেও; আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সম্যক দ্রষ্টা” (২২ : ৭৫)।

নবী ও রাসূলের পরিচয়

নবী শব্দটি আরবী [ ] ধাতু হইতে নির্গত, যাহার অর্থ সংবাদ। নবীগণ যেহেতু আল্লাহর পক্ষ হইতে সংবাদ বাহকের দায়িত্ব পালন করেন, এইজন্য তাহাদিগকে নবী (বহুবচনে আম্বিয়া) বলা হইয়া থাকে।

আল্লামা রাগিব ইসফাহানী বলেন : “নবুওয়াত হইতেছে আল্লাহ ও তদীয় বোধসম্পন্ন বান্দাদের মধ্যকার দৌতৗকর্ম, যাহাতে তাহাদের পরকাল ও ইহকালের জীবনের ব্যাধিসমূহ দূরীভূত হয়।”

কিন্তু নবী শব্দটি তিনি ১৯ বিহীনভাবে [ ]-রূপে লিখিয়াছেন এবং ইহার আলোচনায় লিখিয়াছেন : নবী শব্দটি [ [ বিহীন, তবে ব্যাকরণবিদগণ বলিয়াছেন মূলে ছিল, পরে তাহা পরিত্যক্ত হয়। কতক আলিম বলিয়াছেন, শব্দটি আরবী [ ] শব্দমূল হইতে উদ্ভূত, যাহার অর্থ সমগ্র মানব সমাজে উচ্চ মর্যাদার আসন। দলীল হইতেছে আল্লাহর বাণী :

“আমি তাহাকে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী করিয়াছি” (১৯ : ৫৭)।

সুতরাং [ ] বিহীন [ ] শব্দটি [ ] যুক্ত হইতে বলিষ্ঠতর। কেননা : যাহার সংবাদ দেওয়া হয় তাহার সবটাই মর্যাদাপূর্ণ বা গুরুত্বপূর্ণ হয় না। এইজন্যই নবী করমী (স) যখন লক্ষ্য করিলেন যে, এক ব্যক্তি তাঁহাদের প্রতি বিদ্বেষবশত তাঁহাকে । যোগ UI বলিয়া সম্বোধন করিল তখন সাথে সাথে তিনি বলিয়া উঠিলেন? ওহে, আমি [ ] নহি, আমি হইতেছি [ ] (আল-মুফরাদাত ফী গারীবিল কুরআন, পৃ. ৪৮২, বৈরূত সং)।

রাসূল শব্দটি আরবী [ ] শব্দমূল হইতে নির্গত, যাহার অর্থ দৌত্যকর্ম বা সংবাদ বহন করা। রাসূলগণ যেহেতু সৃষ্টিজগতের নিকট আল্লাহ তাআলার পয়গাম বহন করিয়া আনেন, তাই তাঁহাদিগকে রাসূল বলা হইয়া থাকে। মূলত নবী ও রাসূল শব্দ দুইটি প্রায় অভিন্ন অর্থ বহন কারিলেও উভয়ের মধ্যে পরিভাষাগত কিছুটা পার্থক্য বিদ্যমান। আল্লামা তাফতানী (র) বলেন :

“রাসূল হইতেছেন সেই সত্তা যাঁহাকে আল্লাহ তাআলা তাঁহার সৃষ্ট জগতের প্রতি তাঁহার বিধিবিধানের প্রচারের জন্য প্রেরণ করিয়াছেন। তাঁহার প্রতি কিতাব নাযিলের শর্ত আরোপ করা হইয়া থাকে অর্থাৎ তাঁহার প্রতি কোন কিতাব অবতীর্ণ হইলেই কেবল তাঁহাকে রাসূল বলা যায় । পক্ষান্তরে নবীর কিতাব লাভ শর্ত নহে। কেননা নবী শব্দটি ব্যাপকতর অর্থবোধক (শরহু আকাইদিন নাসাফী, পৃ. ২৪, চট্টগ্রাম মুদ্রণ)।

কিন্তু উক্ত সংজ্ঞা সম্পূর্ণ যথার্থ বলিয়া মনে হয় না। কেননা কুরআন শরীফে হযরত ইসমাঈল (আ) সম্পর্কেও উক্ত হইয়াছে :

“স্মরণ কর এই কিতাবে ইসমাঈলের কথা, সে তো ছিল প্রতিশ্রুতি পালনে সত্যাশ্রয়ী এবং সে ছিল রাসূল নবী”(১৯ : ৫৪)।

লক্ষণীয়, নাযিলকৃত আসমানী কিতাবের সংখ্যা সর্বসাকুল্যে ১০৪। প্রধান চারিখানা তাওরাত, যাবূর, ইনজীল ও আল-কুরআন যথাক্রমে হযরত মূসা (আ), হযরত দাউদ (আ), হযরত ঈসা (আ) ও নবীকুল শিরোমনি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (স)-এর প্রতি নাযিল হয় এবং বাকি এক শতখানা, যেগুলিকে সহীফা নামে অভিহিত করা হইয়াছে, যথাক্রমে নাযিল হয় :

আদম (আ)-এর প্রতি ১০খানা;

শীছ (আ)-এর প্রতি ৫০খানা;

ইদরীস (আ)-এর প্রতি ৩০খানা এবং

ইবরাহীম (আ)-এর প্রতি ১০খানা।

অথচ রাসূলের সংখ্যা হাদীছমতে ৩১৩। অন্য কথায় কিতাব ও সহীফাপ্রাপ্ত, রাসূলের সংখ্যা মাত্র ৮, অবশিষ্ট ৩০৫ জন রাসূলের প্রতি কোন কিতাবই অবতীর্ণ হয় নাই। এতদসত্ত্বেও আল্লাহর রাসূল (স) তাহাদিগকে রাসূল বলিয়া অতিহিত করিয়াছেন। উল্লিখিত ৩১৩ জনের মধ্যে ২৫ জন রাসূলের নাম কুরআনুল কারীমে উল্লেখ হইয়াছে।

মুফতী মুহাম্মাদ শফী (র) বলেন, নবী ও রাসূল-এর সংজ্ঞা সম্পর্কে বিভিন্ন অভিমত রহিয়াছে। বিভিন্ন আয়াত সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করিয়া আমি যাহা উপলব্ধি করিয়াছি তাহা এই যে, উক্ত দুইটি শব্দের মধ্যে ‘মানতিক’ শাস্ত্রের পরিভাষায় [ ] নামক সম্পর্ক বিদ্যমান। অর্থাৎ কোন কোন দিক হইতে নবী শব্দটিই অধিকতর ব্যাপক–আবার কোন কোন দিক হইতে রাসূল শব্দই অধিকতর ব্যাপক।

“রাসূল হইতেছেন সেই প্রেরিত পুরুষ যিনি তাঁহার সম্প্রদায়কে লূতন শরীআতের বার্তা পৌঁছাইয়া থাকেন। এই শরীআত তাহার নিজের জন্যও লূতন হইতে পারে, যেমন তাওরাত প্রভৃতি, আবার তাহার নিজের বেলায় লূতন না হইলেও কেবল তাহার উম্মতের বেলায়ও লূতন হইতে পারে। যেমন ইসমাঈল (আ)-এর শরীআত; উহা মূলত ইবরাহীম (আ)-এর পুরাতন শরীআতই ছিল, কিন্তু তিনি যে জ্বরহুম সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হইয়াছিলেন তাহাদের জন্য উহা লূতন শরীআত ছিল। কেননা পূর্বে তাহাদের কাছে এই শরীআতের বার্তা পৌঁছে নাই। হযরত ইসমাঈল (আ)-এর মাধ্যমেই উহা তাহাদের কাছে সর্বপ্রথম পৌঁছে। এই অর্থের দিক হইতে বিবেচনা করিলে রাসূলকে যে নবী হইতে হইবে এমন কোন কথা নাই। যেমন ফেরেশতাগণ, তাহাদের ক্ষেত্রে রাসূল শব্দটি প্রযোজ্য হইলেও তাঁহারা নবী নহেন। ঈসা (আ)-এর প্রেরিত বার্তাবাহকগণের ক্ষেত্রেও ঐ একই কথা প্রযোজ্য।

আয়াতে তাহাদিগকে রাসূল অভিধায় অভিহিত করা হইয়াছে, কিন্তু তাহারা নবী ছিলেন না। পক্ষান্তরে নবী হইতেছেন সেই প্রেরিত পুরুষ যিনি ওহী লাভ করিয়া থাকেন–তিনি লূতন শরীআতের তাবলীগ করুন অথবা পুরাতন শরীআতের। যেমন বনী ইসরাঈলের অধিকাংশ নবীই মূসা (আ)-এর শরীআতের তাবলীগ করিতেন। এই হিসাবে রাসূল শব্দের মধ্যে নবীর তুলনায় ব্যাপ্তি বেশি। আর অন্য হিসাবে নবী শব্দটিই রাসূল-এর তুলনায় ব্যাপকতর।;, শব্দ দুইটি যেখানে আয়াতে পাশাপাশি একত্রে ব্যবহৃত হইয়াছে সেখানে তো কোন সমস্যা নাই। কিন্তু যেখানে শব্দ দুইটি একটি আরেকটির মুকাবিলায় ভিন্ন ভিন্ন অর্থবোধকরূপে আসিয়াছে, যেমন, ১১ ও ১,, (২২ : ৫২) আয়াতে :

এখানে পূর্বাপর বিবেচনায় নবী শব্দটি বলিতে ঐ সত্তাই বুঝিতে হইবে যিনি তাঁহার পূর্ববর্তী শরীআতের তাবলীগ করেন (মাআরিফুল কুরআন, ৬খ, পৃ. ৪২; দারুল মাআরিফ, করাচী–১৪১৬ হি.)।

ইসমাত আম্বিয়া

নবীগণ যে নিষ্পাপ হইয়া থাকেন, ইহাও একটি সর্বসম্মত আকীদা। তারপরও আদম (আ) কী করিয়া আল্লাহ তাআলার নির্দেশ অমান্য করিতে পারিলেন, এই প্রশ্নটি কাহারও মনে উদিত হওয়া স্বাভাবিক।

এই প্রসঙ্গে আলোচনা করিতে যাইয়া আল্লামা ইদরীস কান্দলবী (র) ইসমত ও মাসিয়াত তথা নিষ্পপত্ব ও অবাধ্যতা শব্দদ্বয়ের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করিয়াছেন। চমৎকারভাবে তিনি লিখেন ।

“হকপন্থীগণের সর্ববাদীসম্মত আকীদা এই যে, নবী-রাসূলগণ (আ) আল্লাহ তাআলার অবাধ্যতা হইতে সর্বতোভাবে পবিত্র ও নিষ্পাপ । তাহারা সর্বপ্রকার গুনাহ হইতে মুক্ত । ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁহাদের দ্বারা আল্লাহ তাআলার অবাধ্যতা সংঘটিত হওয়া অসম্ভব। ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহর অবাধ্যতা যদি তাঁহাদের পক্ষে সম্ভবই হইত তাহা হইলে আল্লাহ তাআলা তদীয় মাখলুককে নিঃশর্তভাবে তাহাদের আনুগত্য করার নির্দেশ দিতেন না, তাহাদের আনুগত্যকে তাঁহার নিজের আনুগত্য বলিয়া অভিহিত করিতেন না এবং আম্বিয়া কিরামের হাতে আনুগত্যের শপথকে তাঁহার নিজের হাতে আনুগত্যের শপথ বলিয়া অভিহিত করিতেন না। আল্লাহ তাআলা বলিয়াছেন :

“যে রাসূলের আনুগত্য করিল সে আল্লাহরই আনুগত্য করিল” (৪৮ : ১০)।

“যাহারা তোমার হাতে আনুগত্যের শপথ করিল তাহারা আল্লাহরই হাতে আনুগত্যের শপথ করিল । আল্লাহর হাত তাহাদের হাতের উপর থাকে” (৪৮ : ১০)।

বলা বাহুল্য, কুরআন দ্বারাও প্রমাণিত যে, এই নিঃশর্ত আনুগত্যের আদেশ কোন বিশেষ ব্যাপারের মধ্যে সীমাদ্ধ নহে, বরং আকাইদ হইতে আমলসমূহ পর্যন্ত প্রতিটি আকীদা-আমলে ও আচরণে নবীর আনুগত্য অপরিহার্য। ইহার হেতু এই যে, আম্বিয়া কিরামের সত্তা ও তাঁহাদের স্বভাবচরিত্র অত্যন্ত পবিত্র হইয়া থাকে। আম্বিয়া কিরামের স্বভাব-চরিত্র ফেরেশতাকূলের অনুরূপ। ইসমত বা নিষ্পাপ হইতেছে ফেরেশতাগণের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য, আর আম্বিয়া কিরাম ফেরেশতাকুলের তুলনায় উত্তম ও অধিকতর বরণীয়। হযরত আদম (আ)-এর ঘটনাবলী ইহার জাজ্বল্যমান প্রমাণ। এই ঘটনা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, হযরত আদম (আ) মাসূম (নিষ্পপ), ফেরেশতাগণের তুলনায় উত্তম ও অধিকতর মর্যাদাশীল।

ইসমত বা নিষ্পাপ হওয়ার অর্থ

ইসমত হইতেছে বাহিরে ও অভ্যন্তরে নফস তথা রিপু ও শয়তানের হস্তক্ষেপ হইতে পবিত্র ও মুক্ত থাকা। নফস এবং শয়তানই হইতেছে মাসিয়াত বা পাপাচারের উৎস বা মূল হেতু। আর মাসিয়াত বা পাপাচার হইতে মুক্ত থাকার নামই হইতেছে ইস্মত। মাসূম ঐ সত্তা যাহার মন ও মনন, বিশ্বাস ও ইতিকাদ, ইচ্ছা-আকাঙ্খ, আচার-আচরণ, অভ্যাস-ইবাদত লেনদেন, কথাবার্তা, ক্রিয়াকর্ম সবকিছু নফস ও শয়তানের হস্তক্ষেপ হইতে সর্বতোভাবে মুক্ত। গায়বী হিফাযত দ্বারা তিনি সংরক্ষিত থাকেন। তাঁহার দ্বারা এমন কিছু সংঘটিত হইতে পারে না যদ্দ্বারা তাহার ইসমত কোনভাবে বিঘ্নিত ও ক্লেদাক্ত হইতে পারে। আল্লাহ তাআলা সদয় দৃষ্টি এবং ফেরেশতাগণের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান তাঁহাকে ঘিরিয়া থাকে যাহা তাহাকে পদে পদে সঠিক পথে পরিচালিত করে এবং হকের সামান্যতম পরিপন্থী প্রবণতা হইতেও তাঁহাকে ফিরাইয়া রাখে । আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমে আম্বিয়ায়ে কিরামকে “মুসতাফায়নাল আখয়ার” (মনোনীত উত্তম বান্দা; দ্র. ৩৮ : ৪৭) ও “ইবাদুল মুখলাসীন” (একনিষ্ঠ বান্দা; দ্র, ৩৮ ও ৮৩) বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন, যাহা তাঁহাদের প্রতি আল্লাহর সার্বিক সন্তুষ্টি এবং তাহাদের ঐকান্তিক নিষ্ঠার প্রমাণবহ। মুখলাস বা মুখলিস শব্দ কেবল তাহার জন্যই প্রযোজ্য যাহার মধ্যে গায়রুল্লাহর বিন্দুমাত্র প্রভাব নাই, পূর্ণ মাত্রায় আল্লাহর জন্য নিবেদিত। অর্থাৎ তাহারা শয়তানী উপাদান হইতে সর্বোতোভাবে মুক্ত, পবিত্র । সুতরাং নবী অবশ্যই সর্বপ্রকার সগীরা ও কবীরা গুনাহ হইতে মুক্ত ও সর্বপ্রকার ক্লেদ হইতে পবিত্র বা মাসূম হইবেন ইহাই স্বাভাবিক। আল্লাহ তাআলার বাণী :  (৭২ ২৭)-এর মধ্যে বর্ণনামূলক [ ] এবং [ ] শব্দটি অনির্দিষ্ট বাচক [ ]–রূপে আসিয়াছে। এই বর্ণনাভঙ্গি দ্বারা ইহা সুস্পষ্ট যে, নবী মাত্রই আল্লাহ তাআলার পসন্দনীয় এবং মনোনীত বান্দা। তাহার প্রত্যেকটি আমল-আখলাক, স্বভাব-চরিত্র, আচার-আচরণ, হাল-অবস্থা সর্বদিক হইতে আল্লাহ তাআলার নিকট পসন্দনীয় এবং তিনি সর্বতোভাবে একমাত্র আল্লাহরই বান্দা। উক্ত আয়াতে বর্ণিত সন্তুষ্টি কোনক্রমেই আংশিক সন্তুষ্টি নহে। কেননা কোন না কোন দিক দিয়া প্রত্যেক মুসলমানই আল্লাহর সার্বিক ও পূর্ণ মাত্রার সঙ্কুষ্টিপ্রাপ্ত হয়, আর পূর্ণ মাত্রায় এই সন্তুষ্টি কেবল ঐ বান্দাগণই লাভ করিতে পারেন যাহাদের যাহির-বাতিন নফস তথা রিপু এবং শয়তানের বন্দেগী ও আনুগত্য হইতে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র। মাসিয়াত তথা পাপ-পঙ্কিলতা হইতে এই সার্বিক মুক্ত থাকার নামই হইতেছে ইসমত, পাপ হইতে মুক্ত থাকা। আম্বিয়া কিরামের বিশেষণরূপে ইতিফা ও ইরতিদা শব্দ দুইটির প্রয়োগও প্রণিধান যোগ্য। শব্দ দুইটি [ ]–এর ১৯a বা ক্রিয়ামূল। নিজের জন্য নির্দিষ্ট কোন ব্যাপার বুঝাইতে ইহা ব্যবহৃত হইয়া থাকে। যেমন [ ] শব্দ দুইটি নিজের জন্য ওজন করিয়া লওয়া ও মাপিয়া লওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। পক্ষান্তরে [ ] ও [ ] শব্দ দুইটি নিজের-পরের সকলের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। যেমন আল্লাহ তাআলার বাণী :

ইহাতে নিজেদের জন্য মাপিয়া নেওয়াকে [ ] এবং অন্যদের জন্য মাপিয়া লওয়াকে [ ] অন্যদের জন্য ওজন করিয়া লওয়াকে [ ] বলা হইয়াছে (অর্থাৎ যাহারা নিজেদের জন্য মাপিয়া বা ওজন করিয়া লইতে পরিপূর্ণভাবে কড়ায়- গণ্ডায় আদায় করিয়া লয়, আর অন্যদের জন্য মাপিতে বা ওজন ঝরিতে কম করিয়া দেয়, উক্ত আয়াতে তাহাদের নিন্দা করা হইয়াছে)। ব্যকরণের এই নিয়ম অনুসারেই [ ] শব্দদ্বয়ের দ্বারা নিজের জন্য বাছিয়া লওয়া ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করা বুঝান হইয়াছে। অন্যত্র ঐ একই অর্থে বলা হইয়াছে।

“আমি তোমাকে নিজের জন্য পছন্দ করিয়া লইয়াছি (হে রাসূল)”

মোটকথা, আম্বিয়ায়ে কিরাম (আ) তাঁহাদের সকল আখলাক, আদাত, ইবাদাত, মুআমালাত, আচার-আচরণ ও কথায়-বার্তায় আপদমস্তক আল্লাহ তাআলার পসন্দনীয় এবং যাহিরে-বাতিনে শয়তানী হস্তক্ষেপ ও রিপুর তাড়না হইতে মুক্ত ও পবিত্র থাকেন। একটি মুহূর্তের জন্যও তাহারা আল্লাহর করুণা, সাহায্য ও তত্ত্বাবধান হইতে বিচ্ছিন্ন হন না। এইজন্যই বিনা প্রশ্নে শর্তহীনভাবে আম্বিয়ায়ে কিরামের আনুগত্য করা ফরয, তাহাদের প্রতিটি কথা ও কাজ গ্রহণীয় এবং তাহাদের আনুগত্য বর্জন চিরস্থায়ী দুর্ভাগ্যের এবং ইহলোকে-পরলোকে সমূহ ক্ষতির কারণ। মানবিক কারণে যদি নবী-রাসূলগণের দ্বারা কখনো কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটিয়াও যায়, তবে তাহা বাহির হইতে আসে, তাহাদের নিজেদের অভ্যন্তর হইতে নহে। যেমন পানির মধ্যে উষ্ণতা বাহির হইতে আসিয়া থাকে, স্বভাবগতভাবে উহাতে কেবল শীতলতাই থাকে, উষ্ণতার নামমাত্র থাকে না। এইজন্য পানি যতই গরম হউক না কেন, আগুনে উহা ঢালিয়া দেওয়া মাত্র তাহা নির্বাপিত হইয়া যায়। অনুরূপ আম্বিয়ায়ে কিরামের অন্তর্লোক পাপাচারের উৎস-উপাদান (নফস ও শয়তান) হইতে সর্বতোভাবে মুক্ত ও পবিত্র। বাহিরের আছরের ফলে কখনও তাঁহাদের দ্বারা কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি হইয়া গেলেও কুদরতের অদৃশ্য হাত তাঁহাদের ইসমতের চেহারা হইতে সেই বহিরাগত ধুলাবালি ঝাড়িয়া পরিষ্কার করিয়া দেয়। ফলে নবুওয়াতের চেহারা পূর্বের তুলনায় পরিচ্ছন্নতর ও উজ্জ্বলতর হইয়া ঝলমলাইয়া উঠে। ইউসুফ (আ)-এর ঘটনা বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন :

“এইভাবে আমি তাহাকে মন্দ কর্ম ও অশ্লীলতা হইতে বিরত রাখিবার জন্য নিদর্শন দেখাইয়াছিলাম। সে তো ছিল আমার বিশুদ্ধচিত্ত বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত” (১২ : ২৪)। উক্ত আয়াতে আমাদের পূর্ববর্তী বক্তব্যের যথার্থতাই প্রতীয়মান হয়। কেননা উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলিয়াছেন যে, তিনি গর্হিত কর্ম ও অশ্লীলতাকে ইউসুফ (আ) হইতে দূরে রাখিয়াছেন। তিনি বলেন নাই যে, তিনি ইউসুফকে গর্হিত কর্ম ও অশ্লীলতা হইতে দূরে রাখিয়াছেন। ফিরাইয়া রাখা, দূরে রাখা বা হটাইয়া দেওয়ার ব্যাপারটা তাহার জন্যই প্রযোজ্য হইতে পারে, যে নিজে সেদিকে অগ্রসর হইতে উদ্যত হয়। উক্ত আয়াতের বক্তব্য দ্বারা বুঝা গেল যে, গর্হিত কর্ম ও অশ্লীলতা ইউসুফ (আ)-এর দিকে ধাবিত হইতে চাহিতেছিল। আল্লাহ তাআলা তাহা ফিরাইয়া রাখিলেন। ইউসুফ (আ) সেদিকে অগ্রসর হইতে প্রয়াস পান নাই।

মোটকথা, বাহিরের প্রভাবে ভুলরশত আম্বিয়ায়ে কিরামের দ্বারা যেসব ত্রুটি-বিচ্যুক্তি হইয়া যায়, বাহ্যত আত্মাকে ইইয়ান বা মাসিয়াত (পাপ বা অপরাধ) বলিয়া অভিহিত করা যায় অথবা বলা যায়, তাহাদের উচ্চ মর্যাদার দিকে লক্ষ্য রাখিয়া ঐগুলিকেও পাপ বা অপরাধ বলিয়া অভিহিত করা হইয়া থাকে, যদিও বাস্তবিকপক্ষে উহা অপরাধ নহে।

মাসিয়াত বা পাপ কি?

আল্লাহর হুকুম পালন না করা মাত্রই মাসিয়ত বা গুনাহ নহে, বরং জ্ঞাতসারে ও ইচ্ছাকৃতভাবে যে বিরুদ্ধাচরণ করা হইয়া থাকে, ভুলক্রমে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে নহে, তাহাই পাপ বা গুনাহ। এইজন্যই ওরখাহী করিতে গিয়া বলা হইয়া থাকে, আমি ভুলিয়া গিয়াছিলাম অথবা আমি বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই। যদি ভুলক্রমে বা ভুল বুঝাবুঝির কারণে সংঘটিত ত্রুটি-বিচ্যুতিও পাপ বলিয়া অভিহিত হয়, তাহা হইলে ওযরশাহির ক্ষেত্রে আমি ভুলিয়া গিয়াছিলাম বা বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই বলার কোন অর্থই হয় না। যে ভুলত্রুটি ভুলক্রমে সংঘটিত হইয়া যায় তাহাকে মাসিয়াত বা গুনাহ বলিয়া উহাকে বলা হয় পদস্খলন। হযরত আদম (আ)-এর নিষিদ্ধ ফল খাওয়াও ছিল ভুলবশত । কুরআনুল কারীমে বলা হইয়াছে ।

“তারপর সে (আদম) ভুলিয়া গেল, আর আমি তাহার মধ্যে দৃঢ়তা পাইলাম না” (২ : ১১৫)।

হযরত আদম (আ) তখন আল্লাহ তাআলা “এ গাছের কাছেও তোমরা দুইজন ঘেষিও না” বলিয়া যে নিষেধাজ্ঞা জারী করিয়াছিলেন উহাও সেই সময় ভুলিয়া গিয়াছিলেন। শয়তান যে চিরশত্রু তাহাও তখন তাহার স্মরণ ছিল না। আল্লাহ তাআলা যে পূর্বাহ্নেই বলিয়া রাখিয়াছিলেন :

“তোমাদেরকে সে যেন বেহেশত হইতে বাহির করিয়া না দেয়, দিলে তোমরা দুর্ভোগে নিপতিত হইবে” (২: ১১৭), তাহাও তখন তাঁহার স্মরণ ছিল না। সুতরাং যাহা ঘটিয়াছে ভুলক্রমেই ঘটিয়াছে। উহাকে পাপ বা অপরাধ বলিয়া অভিহিত করাই ভুল । হযরত আদম ও হাওয়া (আ) উভয়ে জান্নাতের জন্যই আত্মহারা ছিলেন। এইজন্য ইবলীসের শপথ শুনিয়া তাঁহারা তাহার প্রতারণার শিকার হইয়া গেলেন এবং ভাবিলেন, স্বয়ং আল্লাহর নাম লইয়া কেহ মিথ্যা বলিতে পারে না। উপরন্তু আদম (আ)-এর নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ ছিল আল্লাহর প্রতি অনুরাগ-মহব্বতেই কারণে, জান্নাতে আল্লাহর নৈকট্য চিরস্থায়ী হইবার আকাঙ্খায়। কুরআন মজীদের আয়াতাংশ যেমন শয়তানের উক্তি হিসাবে বর্ণিত হইয়াছে :

“তোমরা দুইজনে ফেরেশতা হইয়া যাও অথবা স্থায়ী হইয়া যাও এইজন্যই তোমাদের প্রভু তোমাদেরকে এই বৃক্ষ হইতে নিষেধ করিয়াছেন” (৭ : ২০)।

আল্লাহর নামে শপথ করার কারণে আদম (আ) এই ভুলে নিপতিত হইয়াছিলেন?

“এবং সে (শয়তান) তাহাদের দুইজনের নিকট শপথ করিয়া বলিল, নিশ্চয় আমি তোমাদের দুইজনের হিতাকাঙ্খীদের একজন” (৭ : ২১)।

তখন হযরত আদম (আ)-এর মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ হইল না যে, মহান আল্লাহর পবিত্র নাম লইয়াও কেহ মিথ্যা শপথ করিতে পারে, মিথ্যা কথা বলিতে পারে। তিনি মনে করিলেন, আল্লাহর কোন বান্দাই তাহার পবিত্র ও মহান নাম লইয়া মিথ্যা শপথ করিতে পারে না। সুতরাং বুঝা গেল যে, হযরত আদম (আ)-এর উক্ত কাজ বিরুদ্ধাচরণের উদ্দেশ্যে বা রিপুর তাড়নায় ছিল না। তাই উহাকে গুনাহ বা অপরাধ বলা যাইবে না বরং উহাকে তাঁহার পদস্খলনই বলিতে হইবে। আল্লাহ তাআলার বাণী l এবং ১৬;i–এর উভয় ক্ষেত্রেই উহা যে তাঁহার পদত্থলন ও ভুলবশত ছিল, তাহার আল্লাহর নাফরমানীর ইচ্ছা ছিল না সেদিকেই ইঙ্গিত করা হইয়াছে।

সুতরাং কুরআনুল কারীমের যে সমস্ত আয়াতে উহাকে তাহার বিরুদ্ধাচরণ বা অপরাধ বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে উহা কেবল যাহেরী সুরত হিসাবেই বলা হইয়াছে, প্রকৃত অর্থে নহে অথবা তাহার উচ্চ মর্যাদার অনুপাতে উহাকে ইসয়ান বা অপরাধ বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে।

নবী-রাসূলগণের ক্ষেত্রে উত্তম কাজ ছাড়িয়া অনুত্তম বা তাহার চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের কাজ করাই এমন যেমনটি অন্যদের জন্য অপরাধমূলক কর্ম (দ্র. খিয়ালী–এর মোল্লা আবদুল হাকীমের লিখিত পাদটীকা)।

নবী-রাসূলগণের ক্রটির অর্থ হইতেছে উত্তম ও শ্রেষ্ঠতরটির স্থলে ভুলবশত তাহাদের অপেক্ষাকৃত অনুত্তমটি করিয়া বসা। আর অন্যদের ত্রুটির অর্থ হক ও হিদায়াতের স্থলে বাতিল বা গোমরাহীর মধ্যে লিপ্ত হইয়া পড়া। উম্মতের আলিমগণের সর্ববাদীসম্মত মতে আম্বিয়ায়ে কিরাম এই জাতীয় ত্রুটি বা অপরাধ হইতে মুক্ত, মাসূম। তাহাদের ইজতিহাদগত ত্রুটির অর্থ হইতেছে ভুলবশত উত্তম ও শ্রেষ্ঠতরটির স্থলে অপেক্ষাকৃত অনুত্তম তাঁহাদের দ্বারা সংঘটিত হইয়া যাওয়া।

হযরত আদম (আ)-এর পদস্খলন (;) ততটুকুই। তাহা না হইয়া (আল্লাহর আশ্রয় চাই) তাঁহারা যদি লোভের বশবর্তী ও রিপুর অনুবর্তী হইতেন, তাহা হইলে আল্লাহ তাআলা আমাদের উপর তাহাদের নিঃশর্ত ও অকুণ্ঠ আনুগত্য কখনও ফরয বা অপরিহার্য করিয়া দিতেন না আর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে তাঁহাদের অনুকরণের নির্দেশ দিয়া বলিতেন না?

“ইহারাই হইতেছে সেই সব ব্যক্তি যাহাদেরকে স্বয়ং আল্লাহ হিদায়াত দান করিয়াছেন, সুতরাং (তুমি ওহে রাসূল) তাহাদেরই অনুকরণ কর” (৬ : ৯০) (দ্র. আল-মুতামাদ ফিল-মুতাকাদ তাওরীশী প্রণীত)।

ইমাম আবু মানসূর মাতুরীদী (র) বলেন : চিন্তা-গবেষণায় ইহাই যৌক্তিক গ্রহণযোগ্য হইতে বাধ্য যে, আম্বিয়ায়ে কিরামের মাসূম হওয়ার বিশ্বাস ফেরেশতাদের মাসূম হওয়ার বিশ্বাসের চাইতে অধিকতর তাকিদপূর্ণ ও গুরুত্ববহ। এইজন্য যে, লোকজন আম্বিয়ায়ে কিরামের অনুসরণ করার জন্য আদিষ্ট, ফিরিশতাগণের অনুসরণের জন্য আদিষ্ট নহে (দ্র, আল-মুতামাদ ফিল-মুতাকাদ, পৃ. ৭৩)।

মাসূম বা নিষ্পাপ হওয়ার ক্ষেত্রেসমূহ

ইমাম রাযী (র) বলেন, ইসমতের সম্পর্ক চারটি ব্যাপারের সহিতঃ

(১) আকাইদ (বিশ্বাস)

(২) আহকাম (আদেশ-নিষেধের তাবলীগ)

(৩) ফাতওয়া ও ইজতিহাদ;

(৪) কার্যকলাপ, আচার-আচরণ, অভ্যাস ও স্বভাব-চরিত্র।

(১) আকাইদ সম্পর্কে গোটা মুসলিম উম্মাহর সর্ববাদীসম্মত মত এই যে, নবী-রাসূলগণ একেবারে গোড়া হইতেই সহজাতভাবে তাওহীদ ও ঈমানের অধিকারী হইয়া থাকেন। ভূমিষ্ঠ কাল হইতেই তাঁহাদের অন্তর কুফর ও শিরকের ক্লেদমুক্ত এবং ইয়াকীন ও বিশ্বাসে পরিপূর্ণ থাকে। তাঁহাদের মুবারক চেহারাসমূহ সর্বদা মারিফাত ও আল্লাহর নৈকট্যের জ্যোতিতে উদ্ভাসিত থাকে। আজ পর্যন্ত ইতিহাসে ইহার কোন প্রামণ পাওয়া যায় নাই যে, আল্লাহ তাআলা যে পবিত্র আত্মা মনীষিগণকে নবুওয়াত ও রিসালাত দানে ধন্য করিয়াছিলেন, তাহাদের মধ্যকার কোন একজনও জীবনের কোন পর্যায়ে শিরক ও কুফরের কলুষতায় নিপতিত হইয়াছেন। আল্লাহ তাআলার বাণী :

“ইবরাহীমকে আমি পূর্ব হইতেই হিদায়াত দান করিয়াছিলাম এবং আমি তাহার সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত ছিলাম” (২১ : ৫১)। ইহা দ্বারা সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, নবুওয়াত লাভের পূর্বে যদিও নবীগণ নবী পদবাচ্য হন না, তবুও তাহারা তখনও আল্লাহ কামিল ওলী এবং নৈকট্যধন্য অবশ্যই থাকেন। তাঁহাদের সেই বিলায়াত এত উচ্চ মানের হয় যে, অন্য ওলীগণ তাহাদের তুলনায় সমুদ্রের সম্মুখে বারি বিন্দুসমও গণ্য হন না। এইজন্য উম্মতে মুহাম্মাদীর আলিমগণ এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত যে, আম্বিয়ায়ে কিরামের অন্তরে কুফর ও গুমরাহির উপস্থিতি অসম্ভব।

(২) তাবলীগে আহকাম বা আদেশ-নিষেধের প্রচারে নবী-রাসূলগণ যে মাসূম এ ব্যাপারে গোটা উম্মত একমত। এই ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁহাদের কোন ভুলভ্রান্তির শিকার হওয়া বা মনের অজান্তে ভুলক্রমে তাবলীগের ক্ষেত্রে তাহাদের মিথ্যা বা বিকৃতির আশ্রয় লওয়া অসম্ভব। এই ব্যাপারে তাঁহারা সর্বতোভাবে মাসূম ও পবিত্র। তাঁহাদের সুস্থ বা অসুস্থ অবস্থায় অনুরাগ বা বিরাগের ক্ষেত্রে কোন অবস্থায়ই ওহী প্রচারের ব্যাপারে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় তাহাদের কোনরূপ মিথ্যা বা ছলচাতুরীর আশ্রয় লওয়া একটি অসম্ভব ব্যাপার। নচেৎ অকুণ্ঠচিত্তে ওহী অবতীর্ণ হওয়ার সময় ফেরেশতাগণের কঠোর প্রহরার ব্যবস্থা থাকিত, যাহাতে শয়তানের কোনরূপ হস্তক্ষেপ, ভেজাল বা মিথ্যার সংমিশ্রণ ওহীর সহিত না ঘটিতে পারে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলিয়াছেন :

“তিনি অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতা; তিনি তাঁহার অদৃশ্যের জ্ঞান কাহারও নিকট প্রকাশ করেন না তাঁহার মনোনীত রাসূল ব্যতীত। সেই ক্ষেত্রে আল্লাহ রাসূলের অগ্র ও পশ্চাতে প্রহরী নিয়োজিত করেন, রাসূলগণ তাহাদের প্রতিপালকের বাণী পৌঁছাইয়া দিয়াছেন কিনা জানিবার জন্য। রাসূলগণের নিকট যাহা আছে তাহা তাঁহার জ্ঞানগোচর এবং তিনি সমস্ত কিছুর বিস্তারিত হিসাব রাখেন” (৭২ : ২৬-২৮)।

(৩) ফাতওয়া ও ইজতিহাদের ব্যাপারে উলামায়ে ইসলামের মত হইতেছে, আম্বিয়ায়ে কিরাম যে সমস্ত ব্যাপারে ওহী অবতীর্ণ হয় নাই এমন ব্যাপারসমূহে কখনও কখনও ইজতিহাদও করিতেন। কখনও সেই সব ইজতিহাদে ভুলত্রুটি হইয়া গেলে সাথে সাথে ওহীর মাধ্যমে তাঁহাদিগকে সতর্ক করিয়া দেওয়া হইত। নবী-রাসূলের পক্ষ হইতে ইজতিহাদগত কোন ত্রুটি হইয়া যাইবে অথচ আল্লাহর পক্ষ হইতে তাঁহাকে এ ব্যাপারে সতর্ক করা হইবে না এমনটি হইতেই পারে না।

(৪) কার্যকলাপ ও আচার-আচরণের ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত-এর অভিমত এই যে, নবী-রাসূলগণ কবীরা গুনাহ হইতে সর্বতোভাবে মুক্ত ও পবিত্র, অবশ্য সগীরা বা অনুত্তম পর্যায়ের কাজ কখনো ভুলবশত বা অজ্ঞাতসারে হইয়া যাইতে পারে। বাহ্যিকভাবে তাহা অপরাধ বলিয়া মনে হইলেও ঐগুলির দ্বারাও শরীআতের কোন কোন হুকুম ব্যক্ত করাই উদ্দেশ্য। উদাহরণস্বরূপ বলা যাইতে পারে, যুহর বা আসরের নামাযে রাসূলুল্লাহ (স)-এর ভুল (সাহু) হইয়া যাওয়া। বাহ্যত উহা ভুল বলিয়া দেখা গেলেও ইহার দ্বারা প্রকৃতপক্ষে সিজদায়ে সহো শিক্ষা দেওয়াই উদ্দেশ্য ছিল । নবী করীম (স)-এর নামাযে সাহু না হইলে উম্মত সিজদায়ে সাহুর মাস্আলা কীভাবে শিক্ষা লাভ করিত। অনুরূপভাবে ‘লায়লাতুত তারীছ নামে মশহুর রাত্রিতে তাহার নামায কাযা

হইলে উম্মত কাযা নামায আদায়ের মাস্আলা কোথা হইতে লাভ করিত? এই হিসাবে ঐ সাহু বা ভুলিয়া যাওয়াটাও ছিল আল্লাহর দয়া ও সাক্ষাত রহমত। এইজন্য হযরত আবু বকর (রা) বলিতেনঃ “হায়, যদি আমি মুহাম্মাদের ভুলত্রুটিই হইতাম”! অর্থাৎ মহানবী (স)-এর ভুল ও আমার হাজার নির্ভুল হইতে উত্তম। আল্লাহ তাআলার বাণী :

“নিশ্চয় আমি তোমাকে পাঠ করাইব, ফলে তুমি বিস্মৃত হইবে না, আল্লাহ যাহা ইচ্ছা করেন তাহা ব্যতীত” (৮৭ ও ৬–৭)।

এই আয়াত দ্বারাও সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, নবীর তুলিয়া যাওয়ার মধ্যেও কোন না কোন তাৎপর্য নিহিত থাকে। মানুষ হিসাবে নবী-রাসূলগণেরও ভুলত্রুটি হইয়া থাকে। তাহা এইজন্য যে, তিনি যতক্ষণ পর্যন্ত মানবরূপে থাকিবেন, মানবীয় বৈশিষ্ট্যাবলী হইতে ততক্ষণ পর্যন্ত মুক্ত থাকা সম্ভব নহে ও ক্ষুধা-তৃষ্ণা আছে, আনন্দ-উফুল্লতাও আছে, হাসি-কান্না আছে, অনুরাগ-বিরাগও আছে। আল্লাহ তাআলা বাণী :

“বল আমি তোমাদেরই মত মানুষ” (১৮ : ১১০)। ইহার মধ্যে তাহার ইঙ্গিত রহিয়াছে অর্থাৎ নবী হওয়া সত্ত্বেও আমি মানুষই, ফেরেশতা নই। তোমাদেরই মত পানাহার করিয়া থাকি এবং মানবীয় প্রয়োজনাদি মিটাইবার উদ্দেশে হাট-বাজারেও গিয়া থাকি। এইসব কিছুই মানবীয় বৈশিষ্ট্য। এইগুলিও নবুওয়াত ও রিসালতের পরিপন্থী নহে। অবশ্য নবী-রাসূলগণের ভুল-ত্রুটি স্থায়ী হয় না, মানবীয় কারণে কখনও কোন ভুলচুক হইয়া গেলেও তাহা ঐ একবারই, জীবনে আর কোন দিন সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি হয় না। যেমন হাদীসে আছে :

“মুমিন কখনও একই গর্তে দুইবার পা দেয় না।”

অনুরূপ হযরত আদম (আ)-এর উক্ত নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণও ছিল মানবীয় ভুলের ফসল। তাই আল্লাহ তাআলা বলেন :

আদম (আ) বিস্মৃত হইলেন এবং আল্লাহর নিষেধ ও শয়তানের শত্রুতার কথা তাহার স্মরণে রহিল না। অবাধ্যতার ইচ্ছা তাঁহার মোটেও ছিল না। কেবল শয়তানের কসমের দ্বারাই তিনি প্রতারিত হন। হাদীছে আছে : (মুমিন প্রতারিত হইয়া পড়ে)। আল্লাহ তাআলা বলেন :

“তোমরা কোন ভুল করিলে তোমাদের কোন অপরাধ নাই, কিন্তু তোমাদের অন্তরে সঙ্কল্প থাকিলে অপরাধ হইবে “ (৩৩ : ৫)।

উক্ত আয়াত অনুসারে অনিচ্ছাকৃত ভুলত্রুটিতে যেখান গুনাহ নাই, সেখানে উহা ইসমতের পরিপন্থী নহে। এই কারণেই রোযা অবস্থায় ভুলক্রমে পানাহার করিয়া ফেলিলে উহাতে রোযা ভঙ্গ হয় না। হযরত আদম (আ)-এর অন্তর যেহেতু পবিত্র এবং আল্লাহ ভক্তিতে পরিপূর্ণ ছিল তাই শয়তান যখন বলিল : (নিশ্চিতভাবেই আমি তো তোমাদের হিতাকাঙ্খীদের একজন; ৭ : ২১), তখন তিনি কল্পনাও করিতে পারেন নাই যে, স্বয়ং আল্লাহ তাআলার নামে কেহ মিথ্যা কসম করিতে পারে। এই প্রতারণার মাধ্যমে শয়তান আদম (আ)-এর পদস্খলন ঘটায়। কুরআন শরীফের ভাষায়:

“শয়তান তাহাদের দুইজনকে ধোঁকা দিয়া অধঃপতিত করিল” (৭ : ২২)। [ ] শব্দটি ব্যবহারের দ্বারা সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, এই মাসিয়াত বা অপরাধটির মূলে রহিয়াছে ধোঁকা বা প্রতারণা। নতুবা আদমের তাহাতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না। তিনি বরং আল্লাহ তাআলার আরও ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভের আকাঙ্খী ও তজ্জন্য প্রয়াসী ছিলেন। আনুগত্যের বাহানায় শয়তান তাঁহাকে বিরুদ্ধাচরণের অপরাধে লিপ্ত করে। কিন্তু এই অপরাধটি কেবল বাহ্যিকভাবেই অপরাধ ছিল। প্রকৃতপক্ষে তাহা ছিল মহা নিমত ও অনন্ত রহমত। উহার উদ্দেশ্য ছিল গুনাহগারদেরকে তওবা ও ইস্তিগফার তথা ক্ষমা প্রার্থনার পদ্ধতি শিক্ষা দেওয়া। যেমন মহানবী (স)-এর নামাযে ভুলের দ্বারা সাহু সিজদা শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল, তেমনি আদম (আ)-এর ত্রুটির দ্বারা আদম সন্তানদেরকে তওবা-ইসতিগফার শিক্ষা দানই উদ্দেশ্য। যখন কোন আদম সন্তানের দ্বারা কোন পাপকার্য সংঘটিত হইয়া পড়ে, অমনি সে তাহার আধিপিতা আদম (আ)-এর ন্যায় কান্নাকাটি ও আহাজারির সহিত আল্লাহ তাআলার দরবারে লুটাইয়া পড়িবে। সে শয়তানের মত উল্টা তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হইবে না। যদি আদম (আ)-এর দ্বারা কোন ভুলই সংঘটিত না হইত, তাহা হইলে আদম-সন্তানগণ তওবা-ইস্তিগফারের শিক্ষা কেমন করিয়া লাভ করিত?

শায়খ আবদুল ওয়াহআব শারানী (র) বলেন, “আল্লাহ তাআলার ইম-এর মধ্যে সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য দুইটিই ছিল। তাঁহার হিকমত ছিল এই যে, দুইটিরই সূচনা হইয়া যাইবে। তাহা তিনি সৌভাগ্যের উদ্বোধন আদম (আ)-এর দ্বারাই করাইলেন এবং যুগপভাবে দুর্ভাগ্যের উদ্বোধন শয়তানের দ্বারা করাইলেন।”

হাদীছ শরীফে আসিয়াছে, যে ব্যক্তি কোন সুন্নাতে হাসানা বা শুভ রীতির সূচনা করে, উহার উপর আমলকারী সকলের সওয়াবের সমপরিমাণ ছওয়াব সেই সূচনাকারীও লাভ করিয়া থাকে। যতদিন পর্যন্ত সেই শুভ কর্মটি চালু থাকিবে, ততদিন পর্যন্ত সে ঐ ছওয়াব পাইতে থাকিবে। অনুরূপ হযরত আদম (আ) এই পৃথিবীতে তওবা ও ইস্তিগফার তথা আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করার ও ক্ষমা প্রার্থনার বরকতময় সুন্নাত বা রীতি প্রবর্তন করিয়াছেন। কিয়ামত পর্যন্ত যত লোক তওবা ও ইস্তিগফার করিয়া আল্লাহ তাআলার দরবারে কান্নাকাটি করিবে, তাহাদের সকলের সওয়াবের ভাগ তিনিও লাভ করিবেন এবং আল্লাহর দরবারে তাঁহার মর্যাদা বৃদ্ধি পাইতে থাকিবে।

পক্ষান্তরে ইবলীস অস্বীকৃতি জ্ঞাপন ও অহমিকা প্রকাশের (সুন্নাতে সায়্যিআ) বা অশুভ রীতির প্রবর্তন করে। কিয়ামত পর্যন্ত যত ব্যক্তি আল্লাহর আদেশের প্রতি বিমুখতা প্রদর্শন ও অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করিবে, ততই ইবলীসের প্রতি লানত বৃদ্ধি পাইতে থাকিবে। এইজন্য যে, সে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারি কাফির ও দাম্ভিভকদের পথপ্রদর্শক এবং আল্লাহ তাআলার বিধান হইতে বিমুখতা প্রদর্শনকারীদের অগ্রপথিক। শায়খ মহীউদ্দীন ইবনুল আরাবীর মুর্শিদ শায়খ আবুল আব্বাস আরীনী প্রায়ই বলিতেন, (আল্লাহ পানাহ) হযরত আদম (আ) আল্লাহ তাআলার অবাধ্যতা করেন নাই, বরং তাঁহার পৃষ্ঠদেশে সুপ্ত তাহার হতভাগা সন্তানরাই এই অবাধ্যতার কারণ। কেননা হযরত আদম (আ)-এর পৃষ্ঠদেশ সেই নৌযানের মত ছিল, যাহাতে তাহার সমস্ত পুণ্যবান ও পাপাচারী সন্তানরা সওয়ার ছিল।

হাফিয ইবন কায়্যিম (র) বলেন, আল্লাহ তাআলা কখনও কখনও তাহার কোন বান্দার মঙ্গলের উদ্দেশ্যে তাহাকে কোন পাপাচার ও মাসিয়াতে লিপ্ত করেন। প্রকৃত প্রস্তাবে উহা দ্বারা তিনি তাহার একটি বাতিনী রোগের চিকিৎসা করেন। সেই রোগটি হইতেছে আত্মশ্লাঘা বা অহমিকা। এমতাবস্থায় একটি ত্রুটি বা বিচ্যুতি হাজার ইবাদতের চাইতে অধিকতর উপকারী প্রমাণিত হয়।

ইহা সর্বজনবিদিত যে, কোন কোন সময় সুস্বাস্থ্য এতটা উপকারী প্রতিপন্ন হয় না, যতটা উপকারী প্রতিপন্ন হয় রোগ-ব্যাধি। এইজন্য যে, রোগের সূচনা হওয়ামাত্র তাহার চিকিৎসা ও প্রতিবিধানের প্রতি মনোযোগ আকৃষ্ট হয় এবং দক্ষ চিকিৎসকের মাধ্যমেই শরীর পূর্বের তুলনায় অধিকতর নিরোগ হইয়া যায়। তারপর নানা সুস্বাদু ও পুষ্টিকর বলবর্ধক ঔষধ, পথ্য সেবনে ও আহার্য-পানীয় গ্রহণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি পূর্বের তুলনায় অধিকতর সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হইয়া উঠে।

অনুরূপ হযরত আদম (আ)-এর উক্ত পদস্খলনের পর উপর্যুপরি তিন শত বৎসর পর্যন্ত তওবা-ইস্তিগফার ও আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটির মধ্যে কাটাইয়া দেওয়াটা তাঁহার মর্যাদা বৃদ্ধির কারণ হইয়া যায়। তাই আল্লাহ তাআলা বলেন :

“আদম তাহার প্রতিপালকের হুকুম অমান্য করিল, ফলে সে দুর্ভোগে পতিত হইল। ইহার পর তাহার প্রতিপালক তাহাকে মনোনীত করিলেন, তাহার তওবা কবুল করিলেন ও তাহাকে পথনির্দেশ করিলেন” (২০ ১২১-১২২)।

আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমে নবী-রাসূলগণের পদস্খলনের কথা এইজন্য বর্ণনা করিয়াছেন যাহাতে লোকে ধারণা করিতে পারে যে, তাঁহারা কত উচ্চ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন এবং আল্লাহ তাআলার কতই না নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দা ছিলেন যে সামান্য ব্যাপারে তাঁহাদের প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারিত হইয়াছে। তাহারও সর্বদা আল্লাহ তাআলার অসন্তুষ্টির ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত থাকিতেন। নবী-রাসূলগণের এই ভুলভ্রান্তিগুলিই প্রকৃতপক্ষে তাঁহাদের মাসূম হওয়ার প্রমাণবহ। নবীগণের মাসুম হওয়ার দলীলসমূহ

(১) আল্লাহ তাআলা বলেন :

“যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করিল, প্রকৃতপক্ষে সে আল্লাহরই আনুগত করিল” (৪ : ৮০)।

“তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য কর, যাহাতে তোমরা কৃপা লাভ করিতে পার” (৩ : ১৩২)।

প্রথমোক্ত আয়াতে রাসূলের আনুগত্যকে আল্লাহ তাআলা তাঁহার নিজের আনুগত্য বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। বলাবাহুল্য, কোন গায়ের মাসূম ব্যক্তির আনুগত্যকে স্বয়ং আল্লাহর আনুগত্য বলিয়া অভিহিত করা চলে না। আল্লাহর আনুগত্য ও রাসূলের আনুগত্যকে কেবল তখনই অভিন্ন বলা যাইতে পারে যখন রাসূল আল্লাহ তাআলার অবাধ্যতা হইতে সর্বতোভাবে মুক্ত থাকিবেন। আয়াতে তাগিদসূচক শব্দটি ব্যবহৃত হইয়াছে,যাহাতে কেহ আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যের মধ্যে পার্থক্য করে। অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা সুস্পষ্টভাবে বলেন :

“যাহারা আল্লাহকে অস্বীকার করে ও তাঁর রাসূলগণকেও এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের মধ্যে ঈমানের ব্যাপারে তারতম্য করিতে চাহে এবং বলে, আমরা কতককে বিশ্বাস করি এবং কতককে অবিশ্বাস করি, আর তাহারা মধ্যবর্তী কোন পথ অবলম্বন করিতে চাহে, ইহারাই প্রকৃত কাফির” (৪ ও ১৫০-১৫১)।

দ্বিতীয় আয়াতে নিঃশর্তভাবে রাসূলের আনুগত্যের হুকুম দেওয়া হইয়াছে এবং তজ্জন্য রহমতের ওয়াদা করা হইয়াছে। বলা বাহুল্য, কোন গায়ের মাসূম ব্যক্তির নিঃশর্ত আনুগত্যের নির্দেশ দেওয়া হয় নাই, বরং তাহাদের আনুগত্যের নির্দেশ প্রদানকালে আনুগত্যের মাপকাঠি দেওয়া হইয়াছে এইভাবে :

“আমীরের আনুগত্য ততক্ষণ পর্যন্ত জরুরী যতক্ষণ পর্যন্ত কোন পাপাচারের হুকুম আমীর না দেয়। কিন্তু আমীর যখন কোন পাপাচারের নির্দেশ দিবে তখন আর তাহার আনুগত্য করা চলিবে“ (বুখারী)।

পক্ষান্তরে যে সমস্ত আয়াতে নবীর আনুগত্যের নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে, কোথায়ও এরূপ বলা হয় নাই যে, যাবৎ না কোন পাপাচারের নির্দেশ দেওয়া হয়। ইহা দ্বারা সুস্পষ্টভাবে বুঝা গেল যে, নবীর কোন কাজ পাপাচার বা মাসিয়ত হইতেই পারে না, যাহাতে আমীর ও খলীফাগণের মত তাঁহাদের আনুগত্যের ব্যাপারেও শর্ত আরোপ করিতে হয়। অনুরূপভাবে বুঝা গেল যে, কোন গায়ের মাসূম ব্যক্তির নিঃশর্ত আনুগত্য রহমতের কারণও হইতে পারে না।

(২) নবীগণ যদি পাপাচার হইতে মাসূম না হইতেন তাহা হইলে তাঁহারা সাক্ষী হিসাবে গ্রহণযোগ্য হইতেন না। কেননা পাপাচারীরা ফাঁসিক হইয়া থাকে এবং ফাঁসিকের সাক্ষ্য অগ্রহণযোগ্য। আল্লাহ তাআলা বলেন :

“যদি কোন ফাসিক ব্যক্তি তোমাদের নিকট কোন সংবাদ লইয়া আসে তবে তোমরা উহা যাচাই করিয়া লইবে” (৪৯ : ৬)।

তাহা হইলে কিয়ামতের দিন অন্যান্য উম্মতের মুকাবিলায় নবীগণের সাক্ষ্য কিভাবে গ্রহণযোগ্য হইবে? অথচ কুরআন শরীফে আছে যে, প্রত্যেক নবী কিয়ামতের দিন নিজ নিজ উম্মতের সম্পর্কে সাক্ষ্য দিবেন। যেমন আল্লাহ বলেন :

“যখন আমি প্রত্যেক উম্মত হইতে একজন সাক্ষী উপস্থিত করিব এবং তোমাকে উহাদের বিরুদ্ধে সাক্ষীরূপে উপস্থিত করিব তখন কী অবস্থা হইবে” (৪ : ৪১)

(৩) নবীর কাজ হইল মানুষকে আল্লাহর আনুগত্যের দিকে আহবান করা। এখন তাহারা নিজেরাই যদি আল্লাহর বাধ্য-অনুগত বান্দা না হন তাহা হইলে তো তাহারা আল্লাহর ভর্ৎসনার উপযুক্ত হইবেন। যেমন কুরআন মজীদে বলা হইয়াছে :

“তোমরা কি মানুষকে সৎকার্যের নির্দেশ দাও আর নিজেদেরকে বিস্তৃত হও, অথচ তোমরা কিতাব অধ্যয়ন কর! তবে কি তোমরা বুঝ না” (২৪৪)?

“তোমরা যাহা কর না তাহা তোমরা কেন বল এবং তোমরা যাহা কর না তোমাদের তাহা বলা আল্লাহর নিকট অতিশয় অসন্তোষজনক” (৬১ : ২-৩)।

অথচ এরূপ আচরণ একজন সাধারণ বক্তা ও নিম্নমানের আলিমের পক্ষেও সমীচীন নহে। নবী-রাসূলগণের পক্ষে তাহা কী করিয়া শোভন হইতে পারে।

(৪) পাপাচার সংঘটিত হইয়া থাকে শয়তানের আনুগত্যের কারণে। নবীগণ যদি মাসূম না হন তাহা হইলে তাহাদেরকে শয়তানের আনুগত্যকারী সাব্যস্ত করিতে হয়। যেমন আল্লাহ বলিয়াছেন :

“উহাদের সম্পর্কে ইবলীস তাহার ধারণা সত্য প্রমাণ করিল, ফলে উহাদের মধ্যে একটি মুমিন দল ব্যতীত সকলেই তাহার অনুসরণ করিল” (৩৪ ও ২০)।

অথচ নবীগণকে প্রেরণের উদ্দেশ্যই হইল শয়তানের অনুসরণ হইতে লোকজনকে রক্ষা করা।

(৫) নবীগণ মাসূম না হইলে তাহাদের তুলনায় যাহারা নবী নন তাহাদের শ্রেষ্ঠতর হওয়া প্রমাণিত হয়। কেননা উক্ত আয়াতে মুমিনদের একটি দলকে উহার ব্যতিক্রম বলা হইয়াছে। সুতরাং তাঁহারা নবীগণের চাইতেও উত্তম প্রতিপন্ন হইবেন। কেননা ঐ মতে নবীগণ যেখানে শয়তানের অনুসরণ হইতে আত্মরক্ষা করিতে পারিবেন না, সেখানে তাহারা কঠোর তাকওয়া ও ঈমানের দৃঢ়তার পরিচয় দিয়াছেন। আর আল্লাহ তাআলা বলিয়াছেন :

“তোমাদের মধ্যকার অধিকতর তাকওয়ার অধিকারীরাই আল্লাহর নিকট অধিকতর মর্যাদার অধিকারী” (৪৯ : ১৩)

(৬) আল্লাহ তাআলা বান্দাদিগকে দুই ভাগে ভাগ করিয়াছেনঃ হিযবুল্লাহ বা আল্লাহর দল এবং হিযবুশ শয়তান বা শয়তানের দল। প্রথমোক্ত দল বলিয়া অভিহিত করিয়া আল্লাহ তাআলা বলেন : ।

“ওহে! আল্লাহর দলই সফলকাম দল” (৫৮ : ২২)।

“ওহে! আল্লাহর দলই বিজয়ী” (৫ : ৫৬)।

“ওহে! শয়তানের দলই ক্ষতিগ্রস্ত” (৫৮ : ১৯)।

সুতরাং নবীগণের পাপাচারে লিপ্ত হওয়া সম্ভব হইলে আল্লাহর দলের পরিবর্তে তাহাদেরকে শয়তানের দলবর্তী এবং ক্ষতিগ্রস্ত হইতে হয় (নাউযু বিল্লাহ)। ইহা তো কখনও হইতে পারে না।

(৭)। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে স্বয়ং ইবলীসের উক্তি উদ্ধৃত করিয়াছেন এইভাবে :

“আপনার ক্ষমতার শপথ! আমি উহাদের সকলকেই পথভ্রষ্ট করিব, তবে উহাদের মধ্যে আপনার একনিষ্ঠ বান্দাদিগকে নহে” (৩৮ : ৮২-৮৩)।

আর সর্বদিক দিয়া একনিষ্ঠ বান্দা কেবল নবী-রাসূলগণই, যেমন হযরত ইবরাহীম, হযরত ইসহাক ও হযরত ইয়াকূব (আ) সম্পর্কে বলা হইয়াছে :

এবং হযরত ইউসুফ (আ) সম্পর্কে বলা হইয়াছে :

(দ্র. ৩৮ : ৪৬ ও ১২ : ২৪)।

উক্ত আয়াতসমূহে এবং কুরআনুল করীমের আরও অনেক স্থানে নবী-রাসূলগণকে আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দা বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে।

(৮)। আল্লাহ তাআলা কুরআন শরীফের বিভিন্ন স্থানে নবী-রাসূলগণকে [ ] ও [ ] নির্বাচিত, মনোনীত, বাছাইকৃত ও বিশেষ মর্যাদাবান পুণ্যবান বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলিয়াছেন :

“নিঃসন্দেহে তাহারা ছিল আমার মনোনীত উত্তম বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত” (৩৮ :৪৭)।

“স্মরণ কর ইসমাঈল, আল-ইয়াসা ও যুল-কিফলের কথা, ইহারা প্রত্যেকেই ছিল সজ্জন” (৩৮ : ৪৮)। লক্ষণীয়, তাহাদের কোন বিশেষ গুণের কথা উল্লেখ করিয়া তাহাদেরকে মনোনীত ও মর্যাদাশীল বান্দা বলিয়া অভিহিত করা হয় নাই, বরং সামগ্রিকভাবে তাঁহাদেরকে মনোনীতরূপে ঘোষণা করা হইয়াছে। এহেন নির্বাচিত ও মনোনীত বান্দাগণ যে আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হইতে পারেন না, তাহা বলাই বাহুল্য।

(৯)। আল্লাহ তাআলা নবী-রাসূলগণ সম্পর্কে বলিয়াছেন :

“তাহারা কল্যাণকর কাজে ধাবিত হয়” (৩ :১১৪)।

লক্ষণীয় [ ] শব্দটিকে [ ] যোগে বর্ণনা করা হইয়াছে। এই [ ] ব্যাকরণে! [ ] বা সম্পূর্ণবোধক অব্যয় বলা হয়, যাহরা অর্থ হইতেছে তাহারা সর্বপ্রকার কল্যাণেরই আধার, অকল্যাণকর কিছু তাঁহাদের দ্বারা হইতে পারে না।

(১০) প্রত্যেক পাপীতাপীর ব্যাপারেই যালিম শব্দটি প্রযোজ্য। কুরআন শরীফের অনেক স্থানেই পাপীদিগকে যালিম বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে। সুতরাং কোন নবী যদি কোন অবাধ্যতায় লিপ্ত হইতেন, তাহা হইলে তাহার ব্যাপারেও উহা প্রযোজ্য হইত। কোন যালিম-এর পক্ষে নবী হওয়া কখনও সম্ভবপর নহে। কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেন :

“আমার প্রতিশ্রুতি যালিমদের প্রতি প্রযোজ্য নহে” (২: ১২৪)।

উক্ত আয়াতে : শব্দ দ্বারা যদি নবুওয়াত উদ্দিষ্ট হইয়া থাকে, তাহা হইলে পাপাচারী ও যালিম যে নবী হইতে পারে না তাহা তো স্পষ্ট কথা। আর যদি ইহার অর্থ “ইমামত বা নেতৃত্ব হইয়া থাকে, যেমনটি তাফসীর জালালায়নে উক্ত হইয়াছে, তবে ইহার দ্বারা যালিমের পক্ষে নবী হওয়া যে অসম্ভব তাহা আরও জোরদারভাবে প্রমাণিত হয়। কেননা ইমামতের তুলনায় নবুওয়াতের মর্যাদা এতই অধিক যে, বিন্দুর সাথে সিন্ধুর তুলনাও এখানে অচল। এমতাবস্থায় যালিম যদি ইমাম বা নেতাই হইতে না পারে, নবী হইবে কেমন করিয়া?

(১১) আল্লাহ তাআলা বলেন :

“আল্লাহ তাআলা সেই পবিত্র সত্তা যিনি নিরক্ষর সম্প্রদায়ের মধ্যে একজন রাসূল প্রেরণ করিয়াছেন তাহাদেরই মধ্য হইতে যিনি তাহাদেরকে তাহার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করিয়া শুনাইবেন এবং তাহাদেরকে পবিত্র করিবেন” (৬২ :২)।

নবী নিজেই যদি আত্মিকভাবে বিশুদ্ধ না হইয়া পাপাচারী হন তাহা হইলে তাহার দ্বারা অন্যদের শুদ্ধি কেমন করিয়া সাধিত হইতে পারে?

(১২) নবী আল্লাহর পক্ষ হইতে উম্মতের জন্য উসওয়ায়ে হাসানা (সুন্দরতম আদর্শ) এবং আল্লাহ তাআলার পসন্দসই চারিত্রিক গুণাবলীর আধার হইয়া থাকেন, যাহাতে লোকজন বিনা আপত্তিতে চোখ বুজিয়া তাঁহাকে অনুসরণ করিতে এবং তাহার প্রতিটি কথা ও কাজকে নিজেদের জন্য আদর্শরূপে গ্রহণ করিতে পারে। আল্লাহ তাআলা বলিয়াছেন ।

“তোমাদের মধ্যে যাহারা আল্লাহ ও শেষ বিচারের দিনকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক পরিমাণ স্মরণ করে তাহাদের জন্য অবশ্যই উত্তম আদর্শ রহিয়াছে রাসূলুল্লাহর মধ্যে” (৩৩ : ২১)।

বলা বাহুল্য, আল্লাহ তাআলা পছন্দনীয় স্বভাব-চরিত্র, তাঁহার আনুগত্যের নমুনা এবং আল্লাহর ভয় অন্তরে পোষণকারীদের আদর্শ কেবল এমন ব্যক্তিই হইতে পারেন যিনি আল্লাহ তাআলার নাফরমানী হইতে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র হইবেন।

(১৩) কোন ব্যক্তি যদি নবীর বর্তমানে কোন কাজ করে এবং নবী তাহা লক্ষ্য করিয়াও চুপ থাকেন বা মৌন সমর্থন দেন তবে তাহার ঐ মৌনতাই ঐ কাজটি বৈধ হওয়ার প্রমাণরূপে সকল দলমতের মুসলমানদের কাছে গ্রহণযোগ্য। ইহাতে প্রতীয়মান হয় যে, নবীর মৌন সমর্থনই কোন কাজকে আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণের সীমা হইতে বৈধতার গণ্ডীর মধ্যে নিয়া আসে। এমতাবস্থায় তাঁহার নিজের করা কাজ কেমন করিয়া আল্লাহ্ তাআলার অবাধ্যতা বলিয়া গণ্য হইতে পারে?

(১৪) কতক লোক যখন নিজেদের সম্পর্কে দাবি করিল যে, তাহারা আল্লাহর প্রিয়ভাজন, তখন আয়াত নাযিল হইল :

“তুমি বলিয়া দাও (হে রাসূল), যদি তোমরা প্রকৃতই আল্লাহকে ভালবাস তবে আমার অনুসরণ কর, তাহা হইলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসিবেন এবং তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করিয়া দিবেন” (৩ :৩১)।

উক্ত আয়াতে রাসূলুল্লাহ (স)-এর অনুসরণকে আল্লাহ নিজের ভালবাসার মাপকাঠি সাব্যস্ত করিয়াছেন। তারপর তাহার অনুসরণের বিনিময়ে দুইটি অঙ্গীকার করিয়াছেন। ইহার একটি হইল, যদি তোমরা আমার নবীর অনুসরণ কর, তাহা হইলে আমি তোমাদেরকে আমার প্রিয়পাত্ররূপে গ্রহণ করিব। দ্বিতীয়ত, তোমাদের গুনাহরাশিও মাফ করিয়া দিব।

বলা বাহুল্য, আল্লাহ তাআলার ভালবাসার মাপকাঠি এমন পুণ্যাত্মা ব্যক্তির অনুসরণই হইতে পারে যিনি মাসূম হইবেন। একজন গায়র মসূমের আনুগত্য মহান আল্লাহর ভালবাসা লাভের এবং গুনাহসমূহের ক্ষমার কারণ হইতে পারে না (দ্র. ইসমাতুল আম্বিয়া আরবী, পৃ. ৪-১০; ফখরুদ্দীন রাযী (৫৪৩-৬০৬হি); মাআরিফুল কুরআন (উর্দু),১খ,পৃ. ৯৯-১১৩; ইদরীস কান্দেহলভী প্রণীত মাকতাবায়ে উছমানীয়া বায়তুল হামদ, লাহোর, ২য় মুদ্রণ, ১৯৮২ খৃ.)।

গ্রন্থপঞ্জী ও বরাত নিবন্ধ গর্ভে প্রদত্ত হইয়াছে।

আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *