হবু-গবুর মুল্লুকে

হবু-গবুর মুল্লুকে

এক যে ছিল মেয়ে-নামটি তার খুদি৷ সে যে রাজার মেয়ে নয়, নাম শুনেই সেটা বোধ হয় তোমরা ধরে ফেলেছ৷ রাজা তো দূরের কথা, সে ধনীর মেয়েও নয়৷ তার বাপ হচ্ছে সামান্য এক চাষা৷

এখন, খুদি সেদিন খেলার সাথি না পেয়ে, ঘরের দাওয়ায় একলাটি পা ছড়িয়ে বসে, আকাশ-পাতাল নানান কথা ভাবছিল৷ কী ভাবছিল সেটাও তোমাদের বলছি, শোনো৷

খুদি ভাবছিল, ‘আমি যখন বড়ো হব, তখন নিশ্চয়ই রূপকথার এক পরমসুন্দর রাজপুত্তুরের সঙ্গে ধুমধাম করে আমার বিয়ে হবে৷ আর বিয়ে হলেই আমার ক্ষীরের পুতুলের মতো একটি সুন্দর ফুটফুটে খোকাও হবে তো! খোকনের নামটি রাখব মানিক৷ যদি হঠাৎ কোনো অসুখে মারা পড়ে,-যেমনি এই কথা মনে হওয়া, অমনি খুদুমণির নাকি সুরে কান্না শুরু৷ ‘ওমা, কী হবে গো-ওমা, কী হবে গো!’

খুদির মা রান্নাঘরে উনুনের উপরে ভাতের হাঁড়ি চড়াতে যাচ্ছিল, মেয়ের কান্না শুনে তাড়াতাড়ি দাওয়ায় বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী লা খুদি, সক্কালবেলায় কান্না ধরলি কেন?’

খুদি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ‘বিয়ের পরে যদি আমার খোকা হয়, আর সে যদি মারা যায়? তাই কাঁদছি!’

যেমনি এই কথা শোনা, অমনি খুদির মাও মাথায় হাত দিয়ে ধপাস করে বসে পড়ে, কান্না জুড়ে দিল, ‘ওরে আমার খুদুর খোকা! ওরে আমার নাতি! ওরে আমার স্বর্গের বাতি! তুই যদি মারা যাস রে বাছা-‘ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মায়ে-ঝিয়ে এমনি কান্নাটা কাঁদলে যে, রান্নাবান্না কিছু সেদিন আর হল না৷

দুপুর বেলায় খেতে লাঙল ঠেলে, রোদ্দুরের তাতে ধুঁকতে ধুঁকতে তেষ্টায় টা টা করতে করতে, খুদির বাপ বুদ্ধু বাড়ি ফিরে এল৷

বাড়িতে ঢুকেই মড়া-কান্না শুনে তার পিলে চমকে গেল৷ তারপর এদিক-ওদিক দেখে সে বলল, ‘একী, তোরা কাঁদচিস ক্যান রে? আর আমার খাবারই-বা কোথায়?’

খুদির মা তখন সব কথা খুলে বলল৷ শুনেই বুদ্ধু রেগে তিনটে হয়ে বলল, ‘অ্যাঁ: ! আমার খেতের গোরু দুটোর বুদ্ধিও যে তোদের চেয়ে বেশি৷ কোথায় বিয়ে, কোথায় খোকা তার ঠিক নেই, এখুনি উদ্দেশেই কান্না! দুৎতোরি, নিকুচি করেচে-এমন নিরেট বোকার সঙ্গে ঘরকন্না করা আমার পোষাবে না৷’ এই না বলে রাগে গসগস করতে করতে চাষা বাড়ি থেকে সোজা বেরিয়ে গেল৷

একটা, দুটো, তিনটে-এমনই অনেকগুলো গ্রাম, মাঠ, নদী পার হয়ে, বুদ্ধু, শেষটায় এক অচেনা দেশে এসে হাজির৷

হঠাৎ দেখল একজায়গায় একটা ঝুপসি বট গাছের তলায় কীসের জটলা হচ্ছে৷ কাছে গিয়ে দেখে, প্রায় দুশো-তিনশো লোক মিলে একখানা তক্তার দু-দিক ধরে ক্রমাগত টানাটানি করছে আর গলদঘর্ম হয়ে হাঁপিয়ে মরছে৷

বুদ্ধু বলল, ‘তোমাদের এ কী হচ্ছে বাপু?’

তারা বলল, ‘এই তক্তা দিয়ে আমরা ওই নদীর একটা সাঁকো তৈরি করতে চাই৷ কিন্তু কাঠখানা এত ছোটো যে, নদীর ওপার পর্যন্ত পৌঁছোচ্ছে না৷ তাই আমরা সবাই মিলে টেনে টেনে তক্তাখানাকে লম্বা করার চেষ্টায় আছি, কিন্তু কিছুতেই পারছি না৷’

বুদ্ধু বলল, ‘আচ্ছা, আমি যদি এখুনি তক্তাখানাকে লম্বা করে দিতে পারি?’

সে দেশের যিনি রাজা, তাঁর নাম হবুচন্দ্র৷ তিনি তাঁর মন্ত্রী গবুচন্দ্রের দিকে ফিরে গোঁফে মোচড় দিতে দিতে বললেন, ‘ওহে মন্ত্রী, লোকটা পাগল নাকি?’

মন্ত্রী তাঁর গণেশদাদার মতো নাদা পেটে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, ‘সে-কথা আর দু-বার বলতে মহারাজ! এ রাজ্যের গণ্ডা গণ্ডা ষণ্ডা লোক মিলে যা করতে পারল না, ও কিনা একলা সেই কাজ হাসিল করতে চায়? লোকটা নিশ্চয়ই কোনো চোরের স্যাঙাত৷’

রাজা হবুচন্দ্র তখন বুদ্ধুর দিকে ফিরে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, ‘আচ্ছা, তুমিও না-হয় একবার চেষ্টা করে দেখো! কাঠখানাকে লম্বা করতে পারলে, তোমাকে আমি বিশ মোহর বকশিশ দেব, নইলে কান দুটি করাত দিয়ে কুচ করে কেটে নেব৷’

বুদ্ধু তখন করল কী জানো? আর একখানা কাঠ নিয়ে এসে, সেই কাঠখানার সঙ্গে পেরেক মেরে শক্ত করে লম্বালম্বি জুড়ে দিল৷ কাজেই আকারটা দু-গুণ হয়ে গেল বলে, তখন সেই কাঠ দিয়ে সাঁকো তৈরি করতে আর কোনোই বেগ পেতে হল না৷ রাজা হবুচন্দ্রও খুশি হয়ে বুদ্ধুর কান আর কেটে নিল না, উলটে নগদ বিশ মোহর বকশিশ দিলেন৷

বুদ্ধু মোহরগুলো সাবধানে কাছায় বেঁধে রেখে আবার হাঁটতে শুরু করল৷ খানিকক্ষণ পরে একটা গাঁয়ে এসে দেখল, একজায়গায় একটা নতুন বাড়ি তৈরি হয়েছে, কিন্তু তার উপরে-নীচে কোথাও একটা জানলা নেই৷ সেই বাড়ির সামনের সবুজ মাঠের উপরে একদল লোক কেবলই জাল গুটুচ্ছে আর ফেলছে৷

বুদ্ধু আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘ওহে মাঠের ওপরে জাল ফেলে তোমরা সবাই ব্যাং ধরছ না গঙ্গাফড়িং ধরছ?’

তারা বলল, ‘ওই নতুন বাড়ির ভেতর আলো ঢোকে না৷ তাই আমরা জাল ফেলে সূর্যের আলো ধরে ওই বাড়ির ভেতরে নিয়ে যাবার চেষ্টায় আছি, কিন্তু কিছুতেই পারছি না৷’

বুদ্ধু বলল, ‘আচ্ছা, আমি যদি ওই বাড়ির ভেতরে আলো যাবার বন্দোবস্ত করে দিই, তাহলে তোমরা আমাকে কী দেবে?’

বাড়ির কর্তা বললেন, ‘নগদ একশো টাকা৷’

বুদ্ধু তখন ছুতোর মিস্ত্রি ডাকিয়ে, সেই বাড়ির চারিদিকে গোটাকতক জানলা ফুটিয়ে দিল, আর দেখতে দেখতে সমস্ত ঘরেই সোনার জলের মতো চিকমিকে রোদের আলো এসে পড়ল৷

বাড়ির কর্তার কাছ থেকে নগদ একশোটা টাকা নিয়ে ট্যাঁকে গুঁজে, বুদ্ধু আবার পথ চলতে লাগল৷

খানিকদূর গিয়েই দেখল, একজায়গায় দুজন স্ত্রীলোক একটা রামছাগলের শিং আর ল্যাজ ধরে টানাটানি করছে, কিন্তু ছাগলটা কিছুতেই এক পাও এগোতে রাজি হচ্ছে না৷

বুদ্ধু বলল, ‘ওগো বাছারা, শ্রীরামছাগল কেন যে তোমাদের সঙ্গে যেতে চাইছে না, তার খবর কিছু রাখো?’

তারা বলল, ‘না৷’

বুদ্ধু বলল, ‘ওই রামছাগলের মামাতো ভাই শ্যামছাগলের আজ যে বিয়ে৷ আর সেই বিয়েতে ওর যে নীতবর হবার কথা৷’

তারা বলল, ‘ওমা, তাই নাকি৷’

বুদ্ধু বলল, ‘হ্যাঁ, সেইজন্যেই তো ওকে বিয়েবাড়িতে নিয়ে যাব বলে আমি এসেছি৷’

শুনেই তারা রামছাগলকে বুদ্ধুর হাতে ছেড়ে দিল৷ বিয়েবাড়িতে নীতবর হয়ে যাচ্ছে- কিছু সাজগোছ চাই তো! কাজেই তাদের একজন নিজের গলা থেকে একছড়া সোনার হার খুলে নিয়ে রামছাগলের গলায় পরিয়ে দিল৷

বুদ্ধু ছাগল নিয়ে চলে গেল৷ তার পর একটু আড়ালে গিয়েই ছাগলের গলা থেকে হারছড়া খুলে নিয়ে, ছাগলটাকে দমাস করে এক লাথি মেরে ‘ভাগো হিঁয়াসে’ বলে বিদায় করে দিল৷

এদিকে সেই স্ত্রীলোক দুটি বাড়িতে এসে সকলের কাছে শ্যামছাগলের বিয়েতে রামছাগলের নীতবর হওয়ার গল্প করল৷ শুনেই বাড়ির বুদ্ধিমান কর্তা লাফিয়ে উঠে বললেন, ‘সর্বনাশ! নিশ্চয়ই একটা জোচ্চোর এসে তোমাদের হাঁদা মেয়েমানুষ পেয়ে ডাহা ঠকিয়ে গেছে৷’

কর্তা তখনই একটা ঘোড়ায় চড়ে বুদ্ধুর খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন৷ খানিকদূর গিয়েই দেখেন, একটা লোক মনের খুশিতে তুড়ি দিয়ে গলা ছেড়ে টপ্পা গান গাইতে গাইতে পথ চলছে৷ সে বুদ্ধু৷

কর্তা ঘোড়া থামিয়ে বললেন, ‘ওহে ভাই, এ পথ দিয়ে রামছাগল নিয়ে একটা লোককে যেতে দেখেছ?’

বুদ্ধু তখনই ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে চটপট বলল, ‘হুঁ, দেখেছি বই কী! সে লোকটা এইমাত্র ওই মাঠ পার হয়ে চলে গেছে৷ আপনি যদি তাকে ধরতে চান, তবে এইবেলা শিগগির দৌড়ে গিয়ে ধরুন৷’

কর্তা বললেন, ‘ঠিক বলেছ, না দৌড়োলে তাকে ধরতে পারব না বটে৷ কিন্তু ঘোড়ায় চড়ে আমি নিজে দৌড়োব কেমন করে?’

বুদ্ধু বলল, ‘বেশ তো, তার জন্যে আর ভাবনা কী! ঘোড়াটাকে ধরে আমিই না হয় এইখানে দাঁড়িয়ে আছি-আপনি শিগগির দৌড়ে যান৷’

বুদ্ধুর হাতে ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে কর্তা ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়োতে লাগলেন৷

বুদ্ধুও অমনি একলাফে ঘোড়ায় চড়ে বাড়ির দিকে রওনা হল৷

বাড়ি ফিরে এসে বুদ্ধু হাসতে হাসতে তার বউকে বলল, ‘বুঝেছিস বউ, দুনিয়ায় তোদের চেয়েও বোকা লোক ঢের আছে৷ তাই আমি বাড়ি ফিরে এলাম,-নইলে এতক্ষণে হয়তো ভস্ম মেখে সন্ন্যাসী হয়ে হিমালয় পাহাড়ে চলে যেতাম৷’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *