হবগবলিন – হর্ষ দত্ত
অনলরা এ-পাড়ায় এসেছে গত মে মাসে। ঘোর গ্রীষ্মের এক সকালে। রাজশেখরবাবুর বাড়ির একতলায় তিনটে ঘর খালি ছিল। অনলরা এখন ও-বাড়ির ভাড়াটে। বিরাট দুটো লরি থেকে ওদের জিনিসপত্তর যখন একের পর এক নামছিল, সে-সময় হবা, গবা আর লীনা একটু দূরে দাঁড়িয়ে সব লক্ষ করেছে। অনল ওদেরই বয়সি। ভালো ছেলেদের মতো গম্ভীর মুখ, ফরসা, চোখে চশমা। চশমার ফ্রেমে খয়েরি দড়ি। ওরা তিনজন তখনই স্পষ্ট বুঝতে পারছিল অনলের সঙ্গে ভাব জমানো কঠিন হবে। তার চেয়েও কঠিন, ওকে ওদের দলে টানা।
এ-পাড়ার সবাই ওদের দুষ্টু বলে দাগিয়ে দিয়েছে। হ্যাঁ, দুষ্টু ওরা ঠিকই, তবে লোকে যতটা চেঁচিয়ে-ফাটিয়ে-নাটক করে বলে, ততটা দুষ্টু ওরা মোটেই নয়।
হবার ভালো নাম হেমন্ত। গবার দেবপ্রিয়। বেঁটেখাটো লীনার নামটা কিন্তু লম্বা—আকাশলীনা। ওরা তিনজন আলাদা আলাদা স্কুলে পড়ে। কিন্তু পাড়ায় সবসময় এককাট্টা। অন্য ছেলে-মেয়েরা ওদের ভয় খায়। হবা, গবা আর লীনার মাথায় নাকি সবসময় বদবুদ্ধি ঘোরাফেরা করছে। অথচ একথা বলার সময় কেউ মনেই রাখে না যে, এখন দুষ্টুমি করার সময়ই বা কই! আষ্টেপৃষ্ঠে স্কুলের পড়া আর এটা করো-ওটা করো-র ঠেলায় হবাদের নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়।
তবে তারই মধ্যে ওরা রামলাল ফুচকাওয়ালার নোংরা গামছা বেমালুম সরিয়ে ফেলে। হরিজেঠুর ঘুগনির ডেকচিতে নুনগোলা জল ঢেলে দিয়ে পালায়। শুচিবাই বুড়ি দিদিমা যখন মন্দিরে পুজো দিতে যান, তখন ওরা বুড়িকে কেবলই ছুঁয়ে দেয়। রাস্তার ধারে ব্যাটারির বাক্স লাগিয়ে চুল-দাড়ি কাটার রোডসাইড সেলুন খুলেছেন কালাচাঁদদা। কালাচাঁদদা একটু অসতর্ক হলেই ওরা শেভিং ক্রিমের টিউব সরিয়ে ফেলে। তার জায়গায় দিয়ে আসে টুথপেস্ট। ব্যস, খদ্দেরদের দাড়ি কাটতে গিয়ে কালাচাঁদদার সে কী হেনস্থা!
এইসব দুষ্টুমির জন্য হবা, গবা এবং লীনা ওদের বাবা-মা আর গার্জেনদের কাছে ভীষণ বকা খায়, এক-একদিন মারধোরও কপালে জোটে। কিন্তু ওরা মোটেই নিজেদের বদলে ফেলতে পারে না। আসলে ওরা কিছুতেই ভালোছেলে, ভালোমেয়ে হতে রাজি নয়। দুষ্টুমির মধ্যে যে-আনন্দ, তা ওরা কোথায় পাবে?
আর কে না-জানে, আনন্দ কেবল খুঁজে নিতে হয়, কেউ হাতে তুলে দেয় না।
এই ক-মাসে অনলের সঙ্গে ওদের দেখা হয়েছে পার্কে, রাস্তায়, এখানে-ওখানে। কিন্তু ছেলেটা একবারও ওদের সঙ্গে আলাপ করেনি। উৎসাহ দেখায়নি এতটুকু। ওর হাঁটা-চলা-তাকানোয় কী ডাঁট/ যেন হবা-গবা-লীনারা আরশোলা টিকটিকি ছারপোকা/ অনলের মুখটা একদিন হাসি-হাসি দেখে গবা ওর দিকে এগিয়ে এসেছিল কিছু বলবে বলে।
অনল পাত্তাই দেয়নি। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। লীনা তো রেগে আগুন। গবার মাথায় চাঁটি মেরে বলেছে, ”তোর কী দরকার ছিল ওর সঙ্গে আলাপ করতে যাওয়ার? দেখছিস, চশমার ওপার থেকে হেডসারের মতো তাকাচ্ছে/ ভালো হয়েছে, তুই আচ্ছা জব্দ হয়েছিস!”
ব্যর্থ গবা অপমান লুকোনোর চেষ্টা করে বলেছিল, ”ওর সঙ্গে মোটেই ভাব জমাতে যাইনি। দেখছিলাম, আমাকে সামনে দেখে ভড়কে যায় কিনা!”
“কেন, তুই কে? তোকে দেখে ভড়কাবে কেন?” হবা দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে জিজ্ঞেস করেছে।
“তুই ডাব্বলদা নাকি?” লীনার গলার স্বর সপ্তমে চড়ে গেছে।
এখানে ডাব্বলদার একটু পরিচয় দিতে হবে। বড়ো রাস্তায় ‘মা তারা স্ন্যাকস’ নামে একটা রোলের গাড়ি-দোকান আছে। বিকেলে খোলে, রাত দশটায় বন্ধ হয়। ওই দোকানের পাশে ডাব্বলদার আড্ডা। ওর দুটো কাঁধ হাওড়া ব্রিজের মতো উঁচু। কোমরটা সরু। মাথার চুল সবসময় কপালে লুটিয়ে পড়ছে। কালো-কালো রঙের এমন টাইট গেঞ্জি পরে ডাব্বলদা যে,ওর বুকের ছাতি আর হাতের গুলি যেন ফেটে বেরিয়ে আসতে চায়।
লোকটা কিন্তু ওদের পাড়ায় থাকে না। কোথায় থাকে কে জানে? কিন্তু বড়ো রাস্তায় এমনভাবে দাঁড়িয়ে গল্প করে, লোকজনদের দিকে তাকায়, যেন এই এলাকাটা ডাব্বলদার রাজত্ব। অন্তত লীনা ওর মাকে বলতে শুনেছে, ”বীণা তুমি কিন্তু রাত আটটার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসবে। সে তুমি যেখানেই যাও। ডাব্বল আর ওর দলবল রাস্তার মোড়ে আড্ডা দেয়। আমার ভালো ঠেকে না বাপু।” বীণা ওর দিদি। ক্লাস ইলেভেনে পড়ে। বীণার পুরো নাম অগ্নিবীণা। বীণার চেহারা বেশ বড়োসড়ো, লীনার মতো গুড়গুড়ি নয়। তবু দিদিকে নিয়ে মা ভয় পান।
তা, লীনার ধারণা মা যখন ডাব্বলদাকে চমকান তখন নিশ্চয়ই লোকটা ভয়ানক কেউ।
হবা-গবাও তো বলে, ইচ্ছে করলে ডাব্বলদা হেভি কিচাইন করতে পারে। আর রেগে গেলে তো কথাই নেই।
ডাব্বলদার নাম শুনে গবা জিভ কেটে বলেছে, ”কী যে বলিস!ণ্ঠযার নাম করলি তার মতন হতে পারলে অনলকে কবে সিধে করে দিতাম!”
“ওকে আমরা কিছুতেই ছাড়ব না। আমাদের বেপাত্তা করে দিয়ে ও এ-পাড়ায় থাকবে, এ হতেই পারে না।” হাওয়ায় ঘুসি ছুড়ে হবা বলেছে।
হবার কথায়, লীনা মাথা নেড়ে সায় দিয়েছে, গবা ঝলসে উঠেছে অপমানে, জ্বালায়।
ওরা ঠিক করল, পুজোর ছুটিতে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেই অনলকে ঢিট করার জন্য একটা ফন্দি বের করবে।
এখন জাঁকিয়ে বর্ষা নেমেছে। গত দু-তিন সপ্তাহ জুড়ে কেবলই বৃষ্টি পড়ছে। যখন-তখন। বড়ো রাস্তায় আর ওদের গলিতে জল জমছে বিস্তর। সেই ছোট্ট বয়স থেকে ওরা দেখছে, তোড়ে বৃষ্টি হলেই চারপাশের এলাকা জুড়ে জল দাঁড়িয়ে যায়।
পাড়ার বড়োরা নাকি সরকারকে প্রতি বছর চিঠি লেখে জল দাঁড়ানোর ব্যাপারে। কিন্তু এখনও সেই একই জলছবি। হবা, গবা, লীনা অবশ্য মনে মনে ভাবে, জল জমার মজা কেন যে বড়োরা মুছে ফেলতে চায়! রাস্তার জল একটু নোংরা হয় ঠিকই, কিন্তু তার মধ্যে ঝপাং করে নেমে পড়তে পারলে ফুচকা আর আলুকাবলি খাওয়ার মতো আনন্দ। একপ্রস্থ হুটোপাটি, ন্যাকা সেজে একে-তাকে ভিজিয়ে দেওয়া। তারই মধ্যে কারও ধমক, কেউ বা জল ভেঙে এগিয়ে আসতে চেষ্টা করেন কান মলে দেওয়ার জন্য। তখন আরও খুশির প্লাবন। দুলতে থাকা জলের মতো ওদের মনও দুলে ওঠে।
হবা, গবা, লীনা যেসব স্কুলে পড়ে সেগুলো তেমন কিছু বিখ্যাত নয়। বরং অনেকের মতে মাঝারি মানের। ওরা অতশত বোঝে না, তবে অনল যে-স্কুলে পড়ে সেটি যে মস্ত নামিদামি স্কুল তা ওরা জানে। ছাই রঙের ট্রাউজার, সাদা ফুলশার্ট আর কালো নেকটাই পরে অনল যখন ওর স্কুলের বাস ধরার জন্য গলির মোড়ে এসে দাঁড়ায়, তখন ওর দিকে না-তাকিয়ে উপায় নেই। ওদের খুব হিংসে হয় ঠিকই, কিন্তু সেইসঙ্গে ভালোও লাগে। মনে হয়, অনল ওদের পাড়ার নাম রেখেছে।
ছুটির পরে ওরা তিনজন একসঙ্গে বাড়ি ফেরে। লীনার স্কুলে ছুটির ঘন্টা পড়ে চারটে পনেরো মিনিটে, গবার সাড়ে চারটে, হবার পৌনে পাঁচটা। লীনা চলে যায় স্কুলের সামনে। তারপর গবাকে নিয়ে পৌঁছে যায় হবার স্কুলে।
রাস্তায় এটা-ওটা খেতে-খেতে ওরা বাড়ির পথে পা রাখে।
আজও ওরা তেমনভাবেই ফিরছিল। লাইট পোস্টে, টেলিফোনের তারের খুঁটিতে লাগানো কিয়স্কগুলোতে একটা নতুন হিন্দি সিনেমার পোস্টার পড়েছে। ওরা মনোযোগ দিয়ে দেখছে আর কত কী কল্পনা করছে। হিন্দি সিনেমায় সব ঝুটঝামেলার কী সুন্দর সমাধান হয়ে যায়। গান আর ঝাড়পিট প্রায় সব কিছুর মুশকিল আসান। উঁচু ক্লাসে উঠে ওরা টাকা জমিয়ে একবার টুক করে মুম্বই ঘুরে আসবে।
পাড়ার কাছাকাছি আসতে এখনও প্রায় সাত-আট মিনিট বাকি। হঠাৎ বৃষ্টি এল। প্রথম থেকেই বড়ো-বড়ো ফোঁটা। লীনা ওদের টিম লিডার গোছের। হবা-গবা-দৌড়োতে শুরু করতেই লীনা চেঁচিয়ে উঠল, ”কী রে, পালাচ্ছিস কেন? বৃষ্টিতে ভিজবি বললি যে!”
কে শোনে কার কথা— হবা দৌড়োচ্ছে, কোনও শেডের তলায় দাঁড়িয়ে মাথা বাঁচাবে। গবা পালাচ্ছে, ঘুংরি কাশির ভয়ে। ক-দিন বর্ষার জলের সঙ্গে মস্তানি করে ওর বুকে কফ বসেছে। লীনার কিন্তু হেলদোল নেই। স্কুলের ব্যাগটাকে রেনকোটে মুড়ে নিয়ে দিব্যি হাঁটছে।
সামান্য পরেই চারদিক অন্ধকার করে বৃষ্টি নামল। সেইসঙ্গে আকাশে বিদ্যুতের চমক, বাজ পড়ার শব্দ। সামনে-পেছনে কিছু দেখা যাচ্ছে না। আর হেঁটে যাওয়া দুষ্কর। লীনা হার মানল। হবা-গবা চওড়া গেটওয়ালা একটা বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। লীনাকে ওরা ডাকল, “আর ভিজিস না, বিছানায় পটকে যাবি। এখানে চলে আয়।”
খানিকটা দিশেহারা হয়ে লীনা ওদের কাছে চলে এল। কিন্তু ওর সে কী রাগ, “তোরা দিন-দিন ভিতু হয়ে যাচ্ছিস কেন বল তো!”
ওরা দুই মক্কেল কোনও উত্তর দিল না। বৃষ্টির সঙ্গে দমকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে দক্ষিণ থেকে উত্তরে। ভিজে জামা-প্যান্টে শীত-শীত করছে। দেখতে দেখতে রাস্তায় জল জমে গেল। যত রাজ্যের পলিথিন শালপাতা কাগজ কাঠকুটরো আবর্জনা টেনে আনছে জল। একসময় সেগুলোও জলের তোড়ে কোথায় তলিয়ে গেল।
এবার শুধুই মাটি-মাটি ছাই-ছাই রঙের জল। হু হু করে জল বাড়ছে। ওদের গোড়ালি ভিজে গেল, একসময় হাঁটুও।
মাত্র আধঘন্টা, পঁয়তাল্লিশ মিনিটের বৃষ্টি। তাতেই কামাল। বাড়ির আশ্রয় থেকে রাস্তায় নামতেই প্রায় কোমরের কাছে জল। আর জল ভেঙে একটু-একটু করে হেঁটে এসে ওরা যখন গলির মুখে, তখন জলের মাপ প্রায় ওদের কোমরের কাছাকাছি উঠে এল।
উল্লাসে লীনা চিৎকার করে উঠতেই হবা ঠোঁটের ওপর নিষেধের তর্জনী তুলে চোখের ইঙ্গিতে বলল, “ওই দ্যাখ!”
ওদের সামনে কয়েক হাত এগিয়ে জল কেটে ধীরে ধীরে চলেছে অনল। গায়ে রেনকোট, পিঠে অভেজা সুদৃশ্য স্কুলব্যাগ। ওই ব্যাগটা দেখেই হবা চিনতে পেরেছে। অনল এতক্ষণ কোথায় ছিল? বলতে গেলে একদমই ভেজেনি। হয়তো বৃষ্টি শুরু হওয়ার সামান্য পরে স্কুলবাস থেকে নেমে ও কোথাও শেল্টার নিয়েছিল। তাই ওদের মতো কাকভিজে হতে হয়নি।
অনলকে দেখতে পেয়েই গবার চোখ চকচক করে উঠল, “এবার ব্যাটাকে বাগে পেয়েছি। দে ভিজিয়ে দে।”
বলতে-বলতেই গবা দু-হাতে আঁচলা ভরে জল তুলে ছুড়ে দিল।
স্কুলব্যাগে আর গায়ে-মাথায় জলের ছিটে পড়তেই মুখ ঘুরিয়ে তাকাল অনল। ওর চশমার কাচটা কেমন যেন ঝাপসা হয়ে গেছে।
তিন দুষ্টু অনলকে বুঝতেই দিল না যে, ওরা জল ছিটিয়েছে।
অনল ঘাড় ফিরিয়ে নিল ঠিকই, কিন্তু সন্দেহ করল ওদেরই।
আবার একটু হেঁটে যাওয়া ভালোমানুষের মতো। তবে তা কয়েক মুহূর্তের জন্য। জলের ছলাৎ ছলাৎ আর জল গরিয়ে যাওয়ার শব্দের মধ্যে নিজেদের লুকিয়ে, এবার গবা এবং লীনা জল ছুড়ল। অনেকটা জল।
সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়াল অনল। ভুরু কুঁচকে বিস্ময় ঝরিয়ে বলল, ”এ কী, তোমরা আমার গায়ে জল ছিটিয়ে দিচ্ছ কেন?”
ওরা কোনও উত্তরই দিল না। উলটে বৃষ্টি ভেজা কাঁপা কাঁপা হাসির হিল্লোলে ছ-হাতে জল তুলে তিরের মতো পাঠিয়ে দিল অনলের দিকে।
অনলের মুখ রাগে লাল হয়ে গেল। চশমার কাচে জল লেগে যাওয়ার ও সম্ভবত কিছু দেখতে পাচ্ছে না। হাত তুলে মুখ আড়াল করার চেষ্টা করে ক্রুদ্ধ গলায় বলল, ”ইডিয়েট কোথাকার/শুধুমুধু আমাকে ভিজিয়ে দিয়ে ইয়ার্কি করতে লজ্জা করছে না! ছোটোলোক! ছোটোলোক!”
জল ভেঙে ওরা আরও এগিয়ে এল অনলের দিকে।
গলার স্বর বদলে লীনা বলল, ”আমরা ইডিয়েট, তাই না!” বলেই চোখের পলকে জলের পাহাড় ছুড়ে দিল।
“তোর সঙ্গে ইয়ার্কি করতে যাব কেন রে!” বলতে বলতে হবা হয়ে উঠল এক জলদানব।
“আমাদের ছোটোলোক বললি! তোর এতবড়ো আস্পর্ধা/ দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা!” দাঁতে দাঁতে ঘষে বলল গবা। তারপর নিজের চোপসানো স্কুলব্যাগটা পিঠ থেকে ঝড়ের বেগে ছাড়িয়ে এনে গবা তুলে দিল লীনার হাতে। চেঁচিয়ে বলল, “ধর তো!”
ওদের আশপাশ দিয়ে যাঁরা যাচ্ছেন তাঁরা বৃষ্টির জমা জলে ছোটো ছেলে-মেয়েদের এইসব হুটোপুটি ঝগড়া দেখতে অভ্যস্ত। তাঁরা ওদের দিকে তাকাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু দারুণ কিছু ঘটতে চলেছে এটা ভাবছেনই না।
গবা জলের তলায় ডুব দিয়েছে। ওদের তিনজনের মধ্যে গবাই একমাত্র সাঁতার জানে। চকিতে ও অনলের দুটো পা খামচে ধরে টেনে স্প্রিংয়ের মতো ছেড়ে দিল। অনল বেচারি আর টাল সামলাতে পারল না। অর্ধেক থেকে পুরোপুরি ডুবে গেল নোংরা জলের নদীতে। ভয়ে, ত্রাসে জল খেল খানিকটা। অনল মাথা তুলতেই হবা এবার ওকে মারল এক ধাক্কা। পুনরায় অনলের পতন। ওর চোখ থেকে চশমা খুলে এসে বুকের ওপর ঝুলছে।
লীনার একটু মায়া হল ঠিকই, কিন্তু ওর মাথাতেও আগুন জ্বলছে। তবু লীনা বলল, ”আজকের মতো ছেড়ে দে। পরে আবার দেখা যাবে— পালিয়ে চল/”
জলশয্যা থেকে উঠে আহত বিধবস্ত আপাদসিক্ত ভালো ছেলেটি কোনওরকমে বলল, “আমি তোমাদের সবাইকে চিনি। আই উইল টিচ ইউ আ গুড লেসন।”
হুড়মুড় করে জল ভেঙে যেতে যেতে গবারা বলল, “যা যা। সব করবি, ও আমাদের দেখা আছে।”
জমা জল নেমে গেল ঘন্টাদুয়েক বাদে। একচোট লোডশেডিংও হল সন্ধের পর। হবা, গবা, লীনা যে-যার বাড়িতে আগামীকাল কী-কী দুষ্টুমি করবে তার তালিকা তৈরি করছে মনে মনে। চোখের সামনে অবশ্য পাঠ্যবই যথারীতি খুলে রাখা আছে। অনলকে জলে চোবানোর ঘটনাটা মনে পড়লেই ওরা নীরবে হাসছে। ডাঁটিয়ালটাকে আজ আচ্ছা টাইট দেওয়া গেছে। ওদের পাত্তা না-দেওয়ার শাস্তি ওকে পেতেই হত। আজ সুযোগ বুঝে হবারা সুদে-আসলে বুঝিয়ে দিয়েছে।
রাত সাড়ে দশটার সময় হঠাৎ লীনাদের বাড়ির কলিং বেল বাজাল কেউ। লীনার বাবা সূর্যসারথিবাবু দরজা খুলেই অবাক। ডাব্বল-মস্তান আর একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।
“আপনারা—” সূর্যসারথিবাবু চমকে গেলেন।
“আপনার মেয়ে কি ঘুমিয়ে পড়েছে?”
ডাব্বলের গলা থমথমে এবং রুক্ষ।
“না, হ্যাঁ মনে… কিন্তু কেন বলুন তো?”
“আপনি কি জানেন, আপনার মেয়ে আর দুটো তেএঁটে বদমাশ ছেলে মিলে অবনীবাবুর ছেলে অনলকে মারধোর করেছে, রাস্তার জলে ফেলে দিয়েছে? ছেলেদুটোকে অনল খুব ভালো চিনতে পারেনি। কিন্তু আপনার মেয়ের নাম বলেছে। জানেন কিছু?”
“কই না তো— কিন্তু আমার মেয়ে…” সূর্যসারথিবাবু অসহায় স্বরে বললেন, “কখনও মারপিট করেছে বলে শুনিনি/”
“অনেক কিছুই শুনবেন না/” ধমকে উঠল ডাব্বল, “যুগ পালটে গেছে, সেটা তো জানেন/ ডাকুন আপনার মেয়েকে।”
খুব ঝুঁকি নিয়ে একটু মিথ্যে বললেন সূর্যসারথিবাবু, “লীনা তো ঘুমিয়ে পড়েছে। বৃষ্টিতে খুব ভিজেছে, ফলে শরীরটাও ভালো নেই।”
“অ।” কী যেন ভাবল ডাব্বল। তারপর বলল, “ঠিক আছে, আমি কাল সকালে আসব।” ডাব্বল আর ওর শাগরেদ চলে গেল।
সদর থেকে ভেতরে এসে সূর্যসারথিবাবু মেয়ের ওপর রাগারাগি করলেন, মা আর দিদি চোটপাট করল। ওদের সবার সঙ্গে লড়াই করতে করতে লীনা ক্লান্ত। একসময় আর সহ্য করতে না-পেরে কেঁদেই ফেলল।
এরপর বাড়ির সবাই চুপ করে গেল বটে, কিন্তু সারারাত কেউ স্বস্তিতে ঘুমোতে পারল না। কেননা ডাব্বল-মস্তান আবার সকালে আসবে।
সকাল হল। আর পাঁচটা দিনের মতনই সকাল। আকাশে বর্ষার ছেঁড়াছেঁড়া মেঘ। একবার রোদ উঠছে, আবার হারিয়ে যাচ্ছে কালো মেঘের আড়ালে।
ছেলে-মেয়েরা মর্নিং স্কুলে যাচ্ছে দ্রুত পা চালিয়ে। কারও-কারও খুব দেরি হয়ে গেছে। মাদার ডেয়ারির দুধের ডিপোয় এসময় প্রতিদিন ওদের প্রথম দেখা হয়।
লীনার মুখ থেকে ওদের বাড়িতে ডাব্বলদার আসার কাহিনি শুনে হবা-গবা বেশ ঘাবড়ে গেল। তার মানে অনলের বাবার সঙ্গে ডাব্বলদার কোনও যোগাযোগ আছে।
ভয়ে-ভয়ে গবা বলল, “কী হবে বল তো/”
“কী আবার হবে?” ঠোঁট ওলটাল লীনা, “আমরা যে অনলকে মেরেছি তার প্রমাণ কোথায়? বরং আমি উলটে বলব, অনল আমার গায়ে হাত তুলেছে, তোরা সাক্ষী দিবি।”
হবা-গবা মাথা নাড়ল ঠিকই, কিন্তু কোনও ভরসা পেল না। ডাব্বলদার হাতে ঝাড় খেলে হাড়গোড় আস্ত থাকবে না।
ন-টা দশ-পনেরো নাগাদ অনল স্কুল বাস ধরতে বড়ো রাস্তায় আসে। আজ আর এল না।
কী হল অনলের? নিশ্চয়ই খুব ভয় পেয়েছে। ওরা ভাবল। তবে এটাও ঠিক, ছেলেটাকে ঢিট করতে গিয়ে ডোজটা একটু বেশি পড়ে গেছে। পুজোর ছুটিতে অনলের পেছনে লাগার ফন্দি ওরা আপাতত মুলতুবি করে দিল। কালকের রিঅ্যাকশন কতদূর গড়ায়, আগে দেখতে হবে। তারপর পরের ব্যবস্থা। যদিও অনলকে আর দেখাই গেল না। ডাব্বলদাও আর এল না লীনাদের বাড়িতে।
তিনদিন বাদে সন্ধেবেলায় দীপাঞ্জন-মামাকে অনলদের বাড়ি থেকে বেরোতে দেখে লীনা একটু অবাক হয়ে গেল। দীপাঞ্জন-মামা সদ্য এম বি বি এস পাস করে ডাক্তারি শুরু করেছেন। লীনাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। দীপাঞ্জন-মামা ওর চেম্বারে গিয়ে বসতেই লীনা সটান ঢুকে এল।
“কী রে তুই/ বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে অসুখ বাধিয়েছিস নাকি/” দীপাঞ্জন-মামা জিজ্ঞেস করলেন।
“কই না তো—” লীনা মিষ্টি হেসেবলল, “বর্ষা আমাকে কাবু করতে পারে না। কিন্তু তুমি কেন রাজশেখরবাবুর বাড়িতে গিয়েছিলে?”
“ও হো। ওখানে একতলায় যাঁরা ভাড়া থাকেন তাঁদের ছেলেটি বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাধিয়েছে। চিনিস ছেলেটাকে?”
একটু জোরেই লীনা বলল, “না। পাড়ায় কত লোক আছে। সবাইকে চেনা কি সম্ভব/”
“তা যা বলেছিস।” দীপাঞ্জন-মামা হাসলেন, “ছেলেটার নাম অনল। ভারি ভালো ছেলে। তবে একটু অদ্ভুত। একবার বলছে বর্ষার তোড়ে ভিজেছে। আবার নালিশ করছে, তিনটে পাজি ছেলে-মেয়ে নাকি ওকে জলে চুবিয়েছে, ফলে ও আর সামলে উঠতে পারেনি। জ্বর, সর্দি, কাশি। অনল দুষ্টু মেয়েটার নাম দিয়েছে হবগবলিন। আবার তিনজনকেই নাকি ওই নামে ডাকা যায়।”
“হবগবলিন মানে/” চমকে গেল লীনা।
“বলতে পারব না রে/ তবে শব্দটা ইংরেজি।”
“ঠিক আছে।। আমি আসছি।”
কপালে ভাঁজ ফেলে লীনা বাড়ি ফিরে এল। বাবা খাটে শুয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন। যেন কিছু হয়নি এমন গলায় লীনা জিজ্ঞেস করল, “বাবা, হবগবলিন মানে কী?”
চোখ তুলে মেয়ের দিকে তাকিয়ে সূর্যসারথিবাবু বললেন, “ডিকশনারিটা দেখে নে। মানেটা মোটেই সুবিধের নয়।”
অভিধান খুঁজে শব্দটা দেখে লীনা হেসে কুটিপাটি। কিন্তু একটু পরেই ওর মন খারাপ হয়ে গেল। অনলের করুণ মুখ মনে পড়ছে।
না, এবার ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতে হবে।