হন্তারক – উল্লাস মল্লিক
আজ বিজুকে মার্ডার করব ৷ তারপর ওর মুণ্ডুটা ছিঁড়ে লম্বা একটা হাই কিক মেরে পাঠিয়ে দেব পার্কের ওদিকে ৷
আমার পকেটে ন’ইঞ্চি ফলার একটা ছুরি ৷ কোমরে গোঁজা ওয়ান শটার ৷ আগে কোনোদিন মেশিন চালাইনি ৷ ক্ষুর-টুর দু-একবার চালিয়েছি বটে, কিন্তু মেশিন এই প্রথম ৷ বিজুকে দিয়েই বউনি হবে ৷ ফার্স্ট বুকে নল ঠেকিয়ে দানা ভরে দেব ৷ দানা খেয়ে ওর চোখমুখ যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাবে, বুক ধরে ঝুঁকে পড়বে সামনে; তখন চকচকে ফলাটা পেটে ঢুকিয়ে এদিক থেকে ওদিকে টেনে দেব একবার ৷
পার্কের এই কোণে ক’টা ঝাঁকড়া ঝাউগাছ ৷ সামনে পোস্টের মাথায় একটা বাল্ব ঝুলছিল ৷ একটু আগেই ইট মেরে সেটার গতি করে দিয়েছি ৷ ফলে জায়গাটা অন্ধকার গুহার মতো ৷ সন্ধে থেকে সেই গুহার মধ্যে পজিশন নিয়ে বসে আছি ৷ সঙ্গে একটা ডাবল এক্সের নিপ আর কাগজে মোড়া চানাচুর ৷ চন্নোমেত্ত খাওয়ার মতো অল্প অল্প চুমুক দিচ্ছি ৷ নেশা লেগে গেলে চলবে না ৷ খুব বিউটিফুল একটা হাওয়া দিচ্ছে ৷ এইরকম হাওয়ায় চড়ে যাওয়ার চান্স থাকে ৷ আজ কিন্তু হাত পা মাথা ঠিক রাখা খুব দরকার ৷
সামনে একটা ফাঁকা ঘাস-জমি ৷ বাচ্চারা খেলে খেলে টাক ফেলে দিয়েছে ৷ শেষ প্রান্তে দুটো স্লিপ আর দোলনা ৷ ধারে ধারে ক’টা সিমেন্টের বেঞ্চ ধৈর্য ধরে ওয়েট করছে ৷ বাতিকগ্রস্ত কয়েকটা বুড়ো হাঁটাহাঁটি করছে ফাঁকা জমিটায় ৷ ওদের কেটে পড়ার সময় হয়ে গিয়েছে ৷ একটা, দুটো করে হাজির হচ্ছে রাধাকেষ্টর দল ৷ এরপর পার্কটা ওদের আন্ডারে চলে যাবে ৷ মোটামুটি শান্তিপূর্ণ বখরা ৷ বিকেলটা বাচ্চা আর মায়েদের, সন্ধেটা বুড়ো-বুড়িদের, সন্ধের পর থেকে রাত আটটা-সাড়ে আটটা পর্যন্ত কুঞ্জবন ৷ তারপর রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জুড়ে বসে আমার মতো কিছু হরিপদ মাল ৷ জলটল খায়, গাঁজা টানে ৷
আমাদের এই ছন্নছাড়া এলাকায় পার্কটা ঝি-এর নাকে হিরের নাকছাবির মতো ৷ অনেকদিন ভেস্টেড হয়ে পড়ে ছিল জমিটা ৷ বনতুলসী, গাবজ্যারেন্ডা আর কুলেকাঁটার জঙ্গল ৷ সেকেন্ড ব্রিজটা হতে কলকাতা শহর হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল আর সঙ্গদোষে বখে গেল আমাদের এলাকাটা ৷ বড় বড় বাড়ি উঠল আর ফ্যামিলিগুলো সব ছোট ছোট হয়ে গেল ৷ ঘরে ঘরে ঢুকে গেল হট ছবি আর কোল্ড ড্রিংক্স ৷ ফিরিওলার মতো চার পাশে ছোঁক ছোঁক করে প্রোমোটারের দল ৷ সবুজ মাঠগুলোয় এখন ঝকঝকে ফ্ল্যাটবাড়ি ৷ পাড়ার কয়েকপিস মাথা একটা মালদার প্রোমোটারকে ধরে এই পার্কটা বাগিয়ে নিয়েছে ৷
একটা ছেলে আমার সামনে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে ৷ এগুলো ফেকু পার্টি, এই সময় জোটে ৷ বেঞ্চে কোনো জোড়ের পাশে বসে উদাস মুখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে কিংবা বারবার ওদের সামনে দিয়ে হেঁটে যায় ৷ ভাবখানা এই, যেন হাওয়া খাচ্ছে ৷ বিজুও এই দলে ৷ শালা ভদ্দরলোক ৷ মাল খাই না, গাঁজা টানি না, কিন্তু কেউ প্রেম করলে লুকিয়ে কথা শুনি ৷ আমরা মালখোর, আমাদের মন পরিষ্কার ৷ কাউকে ঝাড়ার হলে সামনা সামনি ঝাড়ব ৷ আর বিজু হারামির বাচ্চা পিছন থেকে বাম্বু গুঁজবে ৷
আমার পিছন দিকে কিছুটা রেলিং কেউ হাওয়া করে দিয়েছে ৷ সেই ফাঁক গলে একটা কুকুর ঢুকে পড়েছে ৷ আমার সামনে দাঁড়িয়ে ল্যাজ নাড়ছে কুকুরটা ৷ বিজুও মানিকবাবুর সামনে দাঁড়িয়ে এমনি করে ল্যাজ নাড়ত ৷ আমি দুটো চানাচুর ছুড়ে দিই কুত্তাটার দিকে ৷
মানিকবাবুর মারুতি ভ্যান রোডে ভাড়া খাটে ৷ আমিই চালাতুম গাড়িটা ৷ মানিকবাবু সরল-সিধে আদমি ছিল ৷ হারামির বাচ্চাটা নাগাড়ে চুকলি কেটে বিষিয়ে দিয়েছে ওকে ৷ চাকা এক কিলোমিটার গড়ালে মালিকের সাত টাকা চাই ৷ কেউ পার্টির সঙ্গে বেশি রফা করলে সেটা তার ৷ মালিককে তার হক বুঝিয়ে দিলেই হল ৷ এটাই লাইনের নিয়ম ৷ বিজু শুয়ারটা প্রথম থেকে মানিকবাবুর কান ভারী করত ৷ এ লাইনে কোন শালা দু নম্বরি করে না, বুকে হাত দিয়ে বলুক দেখি৷
বিজুকে অনেকবার সাবধান করে দিয়েছি ৷ তবু শালা কথা শুনল না ৷ মরণ নেহাতই ওর কপালে আছে ৷ সবারই পয়সার দরকার ৷ তোর পেট আছে, আমার নেই? কবজির জোর থাকলে কাজ জুটিয়ে নে ৷ অপরের আহার ছিনিয়ে নিতে গেলে সে থাবা মারবেই ৷
দুটো বুড়ো সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ৷ একজন তেড়ে নিন্দে করছে ছেলের বউয়ের ৷ উল্টো দিক থেকে আসছে একজোড়া লায়লা-মজনু ৷ মেয়েটা মাথা হেঁট করে ওড়নার খুঁট আঙুলে জড়াচ্ছে ৷ ছেলেটা হাত-পা নেড়ে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে মেয়েটাকে ৷ দেখেই বোঝা যায় নতুন তুলেছে ৷ কাছে আসতে দেখি মেয়েটার সাইড ফেসটা অনেকটা চুমকির মতো ৷ চুমকির কথা মনে পড়তেই মাথার মধ্যে রাগটা চড়াক করে ওঠে ৷ বোতল থেকে একসঙ্গে অনেকটা গলায় ঢেলে দিই ৷
চুমকি ছিল আমার শান্তির জায়গা ৷ সারাদিন গাড়ি চালিয়ে, ইঞ্জিনের হিটে শরীর সেঁকে, প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে খিটিমিটি করে সন্ধেবেলা চুমকির কাছে যেতুম ৷ ব্যস, তখন সব কিছু ভ্যানিশ ৷ চুমকির কাছাকাছি থাকলে কী শান্তি! কিন্তু খুব বেশি কাছে যেতে দিত না ও ৷ আসলে হেভি নীতিবাগীশ তো ৷ তা ছাড়া ওকে তো আমার মনের কথাটা জানানোই হয়নি ৷ এই সিচুয়েশনে কোনো মেয়েই বেশি অ্যালাও করবে না ৷ ওরা ইনসিওরেন্সের মতো নিরাপত্তার গ্যারান্টি চায় ৷ চুমকিকে বহুবার বলতে গিয়েও খেই হারিয়ে ফেলেছি ৷ আসল কথাটা জানানো হয়নি ৷ কীভাবে শুরু করব? আমি তোমাকে ভালোবাসি ৷ পেয়ার করি ৷ লাভ করি! নাঃ, হচ্ছে না ৷ যাই বলি না কেন কেমন যেন পাতি হয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা৷ শালা, আমার মতো ছেলে, কত লোককে চমকাচ্ছে, কত খিস্তি ছোটাচ্ছে, সে এই সামান্য কথাটা বলতে পারছে না ৷
চুমকির বাবা-মা আমাকে ঠিক গিলতে পারছিল না ৷ আমি নেহাত মস্তান টাইপ, যেখানে- সেখানে ঝাড়পিট করে বেড়াই, তাই মুখের উপর কিছু বলতে পারেনি ৷ বাপটা তো হেঁপু রুগি, সারাদিন ফুসফুসে বাড়তি একটু বাতাস নেওয়ার জন্যে খাবি খাচ্ছে ৷ একদিন আমাকে ধরল,— তা তুমি কী ঠিক করলে, গাড়িই চালাবে? বলতে বলতে কাশির দমক এসে গেল ৷ একটু সামলে নিয়ে ফের শুরু করে,— আসলে লাইনটা তো ঠিক… ৷ এই পর্যন্ত বলে ফের কাশে ৷ মনে হল এবার ইচ্ছা করে কাশছে ৷ বলতে চাইছে— লাইন তো ঠিক ভদ্দরলোকের নয় ৷
আমি বললুম, দেখি কী করা যায় ৷
দেখো, দেখো ৷ এখন কত ভালো ভালো লাইন বেরোচ্ছে ৷ তা তুমি কম্পিউটার শেখো না কেন! চারদিকে তো দেখছি সবাই খুব কম্পিউটার শিখছে ৷
পার্কে এখন বুড়ো-বুড়ো কেউ আর নেই ৷ কংক্রিটের বেঞ্চগুলো নওজোয়ানদের পেয়ে চনমনে হয়ে উঠেছে ৷ ওদিকে ছাতিম গাছটার নীচে দু’পিস এসে বসেছে ৷ পুরনো পাপী ৷ প্রায়ই দেখি এখানে ৷ মনে হচ্ছে জোর খিচাইন লেগেছে ওদের ৷ কথা শুনতে পাচ্ছি না, কিন্তু হাত-পা নাড়া দেখে বুঝতে পারছি মেয়েটা খুব তোড় করছে ছেলেটাকে ৷ ছেলেটা একটু ভেবলু টাইপের ৷ কেসটা হ্যান্ডেল করতে পারছে না ৷ চুমকি একদিন একটা ব্যাপারে এমনই খচে গিয়েছিল আমার উপর ৷ কিন্তু আমিও শালা ওস্তাদ ড্রাইভার ৷ ঠিক পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলুম ৷ আধ ঘণ্টার মধ্যে চুমকি গলে জল৷ বলল, সরি ৷
আমি বললুম, ঠিক আছে, আমি কিছু মাইন্ড করিনি ৷
চুমকি বলল, সত্যি বলছ!
বললুম, মা কালীর দিব্যি ৷ তোমার উপর রাগ করতে পারি না ৷
কেন, রাগ করতে পারো না কেন?
নিখুঁত পাস দিয়েছে চুমকি ৷ বলটা শুধু ফাঁকা গোলে ঠেলে দেওয়া ৷ কিন্তু ক্যালাস স্ট্রাইকারের মতো অমন সুযোগটা উড়িয়ে দিলুম ৷ কোনওরকমে তুতলে মুতলে বললুম, আসলে আমি তোমাকে খুব…
চুমকি খুব আগ্রহ নিয়ে আমার মুখের দিকে তাকাল—আমাকে খুব কী!
তখন ঘাবড়ে গিয়ে আমি কথা হারিয়ে ফেলেছি ৷ এদিকে চুমকি বার বার তাগাদা দিচ্ছে, কী হল বলবে তো!
শেষে মরিয়া হয়ে বলে ফেলি, আমি তোমাকে একদিন গাড়ি করে বেড়াতে নিয়ে যাব ৷
চুমকি খানিকক্ষণ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে ৷ ক্রমশ থমথমে হয়ে ওঠে ওর চোখমুখ ৷ একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, যদি কোনোদিন তোমার নিজের গাড়ি কেনার মুরোদ হয় তো চাপব ৷
বিজু যে পিছনে লেগেছে বুঝতে পারি মাসখানেক আগে ৷ সেদিন হোল-ডে প্যাসেঞ্জার নেই ৷ সারাদিন গাড়ির মধ্যে বসে ভেপে যাচ্ছি ৷ এদিকে সন্ধেবেলা আমার চুমকির সঙ্গে প্রোগ্রাম; ‘ম্যায় হুঁ না’ দেখতে যাব ৷ তারপর ‘নিরালা’ রেস্টুরেন্টে মোগলাই চিকেন কষা খাব ৷ চুমকিকে বলে দিতে হবে কথাটা ৷ আর ফেলে রাখা ঠিক হবে না ৷ শুনছি দেবু লাইন লাগিয়েছে চুমকির পিছনে ৷ সত্যদা পার্টির ঘ্যাম নেতা ৷ সেই সত্যদার পাতা চাটে দেবু ৷ কোনো প্রোমোটারই সত্যদার পারমিশন ছাড়া এলাকায় ঢুকতে পারে না ৷ দিন দিন লাল হয়ে যাচ্ছে সত্যদা ৷ সেইসঙ্গে দেবুর গায়েও লাল না হোক গোলাপি আভা লাগছে ৷ দেবুর গায়ে পার্টির স্ট্যাম্প আছে, দেবুর বাড়িতে এক্সট্রা ঘর আছে, দেবুর ঝকঝকে মোটর সাইকেল আছে ৷ আমার বাড়িতে বাতের ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে ঠাকুরের নাম নেওয়া মা, সিন্থেটিক শাড়ি পরে পাড়ার কে জি ইস্কুলে ‘ব্যা ব্যা ব্ল্যাক শিপ’ শেখাতে যাওয়া বোন, আর পোলিও-পা নিয়ে ল্যাকপ্যাক করা ভাই ৷ এসব ভাবলেই টেনশন বাড়ে ৷ ঠিক করেছি, যা থাকে কপালে, বলেই দেব ৷ আর চুমকিকেও বলি, সবই তো বুঝিস! তবু মুখ দিয়ে বলাবে ৷ শুনে কী শান্তি কে জানে! তো সেদিন বসে বসে দু’বান্ডিল বিড়ির ছাদ্দ করে সন্ধেবেলা মানিকবাবুকে গিয়ে বললুম, টাকা দিন, ব্রেক-শুগুলো নষ্ট হয়ে গেসল, নতুন লাগিয়েছি ৷
মানিকবাবু বলল, দেখি পুরনোগুলো ৷
আন্দাজ করেছিলুম মানিকবাবু চাইতে পারে ৷ ব্যবস্থা করাই ছিল, গ্যারেজ থেকে জোগাড় করা পুরনো মাল গছিয়ে দিলুম ৷
মানিকবাবু ভুরু কুঁচকে একটু দেখল ৷ শালা বমকে গেছে ৷ কিন্তু টাকাও দিল না ৷ বলল, কাল টাকা নিয়ে যাস ৷
পরে শুনি বিজু রাত্তিরবেলা গ্যারেজে গাড়ি নিয়ে গিয়ে ব্রেক-শু-গুলো টেস্ট করিয়েছিল ৷
মানিকবাবুকে ভালো বলতে হয়; এর পরও আমাকে গাড়ি চালাতে দিয়েছে ৷ কিন্তু সেদিন পুরো প্ল্যানটা ধসে গেল৷ হেভি গোঁসা খেয়ে গেল চুমকি ৷ স্ট্রেট জানিয়ে দিল ঠ্যালাচালক, রিকশাচালক, মারুতিচালক সব একই ক্যাটাগরির ৷
হঠাৎ দেখি বিজু পার্কে ঢুকছে ৷ শিরদাঁড়া টান টান করে বসি ৷ কিন্তু সঙ্গে ওটা কে! হ্যাঁ ঠিকই দেখেছি; একটা মেয়ে ৷ শুনেছিলুম বটে বিজু নাকি একটা মাল তুলেছে ৷ খবরটা তাহলে সত্যি ৷ মেয়েটা না কি একটা উকিলের মেয়ে, পাড়ায় নতুন আমদানি ৷ মেয়েটাকে দেখে মাথার মধ্যে রাগটা ফের চড়াক করে ধাক্কা দেয় ৷ বোতল থেকে বেশ বড় একটা চুমুক মারি ৷
বিজু মেয়েটাকে নিয়ে পার্কের শেষ প্রান্তে একটা বেঞ্চের উপর বসেছে ৷ ওদের পিছনে দেবদারু গাছের সারি ৷ কচি কলাপাতা রঙের নতুন পাতায় আলো পড়ে ঝলমল করছে ৷ বিজু আজ খুব ফ্যাশান মেরে জিন্স আর গেঞ্জি পরেছে ৷ হাতে পয়সা এসেছে, এখন মাঞ্জা তো দেবেই ৷ দাঁড়া শালা, তোর ফ্যাশান ফুটিয়ে দিচ্ছি ৷ কিন্তু মেয়েটা জুটে তো মহা ফ্যাসাদ হল দেখছি! শালা হল্লা মচালেই কেস কেলো হয়ে যাবে ৷ যাকগে, ফার্স্ট চেষ্টা করব মেয়েটাকে ভাগিয়ে দিতে, গড়বড় করলে দুটোকেই ঝেড়ে দেব ৷
বিজুর সঙ্গে এক ক্লাসে পড়তুম ৷ খেলাধুলো, মেয়ে-ইস্কুলের সামনে জটলা করা, প্রথম সিগারেট টানা— সবই একসঙ্গে ৷ সেই বিজু এত বড় গদ্দারি করবে ভাবতে পারিনি ৷ সমানে পিন মেরে গিয়েছে মানিকবাবুকে ৷ হপ্তাখানেক আগে সেদিন দুটো লং ট্রিপ মেরেছি ৷ ভালোই কামানি হয়েছে ৷ চাঁদুর ঠেকে গিয়ে দু’পেগ চাপিয়েও নিয়েছি ৷ বাড়ি ফিরছিলুম বেশ মুড নিয়ে ৷ ক’দিন ধরেই ভাবছি চুমকিকে একটা সিটি গোল্ডের হার দেব ৷ চৌরাস্তার মোড়ে একটা ভাড়া পেলুম ৷ দুটো লোক, সঙ্গে একটা মেয়েছেলে; সন্তোষপুর যাবে ৷ তখন আমার পকেট গরম ৷ অন্য সময় হলে সিওর কাটিয়ে দিতুম ৷ কিন্তু এখন আমার পয়সার দরকার ৷ চুমকির ব্যাপারটা ফেলে রাখা যাবে না ৷ দেবু স্ট্রেট লাইনে ঢুকে পড়েছে ৷ কিন্তু আমি সিওর, চুমকিকে শুধু বলার অপেক্ষা ৷ বললেই ও রাজি হয়ে যাবে ৷ চুমকি শুধু আমার মুখ থেকে শুনতে চায় ৷ কিন্তু ওকে তুলব কোথায়! একটা ঘরে সাতজন মেম্বারের সঙ্গে পোলট্রির মুরগির মতো গাদাগাদি করে থাকি৷ ইমিডিয়েট একটা ঘর তুলতে হবে ৷ তো সেদিন মেয়েছেলে দেখে বুঝলুম ভালো খেঁচে নেওয়া যাবে ৷ বেশ চড়িয়ে রেট বললুম ৷ পার্টিও রাজি হয়ে গেল ৷
সন্তোষপুরের দিকে গাড়িটা ছুটছিল ৷ দু’পাশে অন্ধকার মাঠ ৷ হঠাৎ পিছন থেকে গলায় ছুরি ধরে গাড়ি থামাতে বলল ৷ তারপর আমাকে পুরো ছেঁকে নিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল তিনজন ৷ ফিরে এসে মানিকবাবুকে সব বললুম ৷ মানিকবাবু গম্ভীর মুখে শুনল ৷ শেষে বলল, ঠিক আছে দেখছি, তুই গাড়ি গ্যারেজ কর ৷
পরদিন সকালে গিয়ে দেখি গ্যারেজ ফাঁকা ৷ মানিকবাবু বলে দিল, তোকে আর গাড়ি চালাতে হবে না ৷
সেই গাড়ি এখন বিজু চালাচ্ছে ৷ বহুত স্ক্যানডাল ছড়িয়েছে আমার নামে ৷ আমি আর গাড়ি পাচ্ছি না ৷ মা আমার দিকে আজকাল কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায় ৷ বোন সেদিন বলল, দাদা তোর নামে কী সব বিচ্ছিরি কথা শুনছি ৷
চুমকির কাছে গেলুম একদিন ৷ ও সেজেগুজে কোথায় একটা যাচ্ছে ৷ খুব ব্যস্ত ৷ কথা বলার সময়ই হল না ৷
কাজের ধাক্কায় চারদিকে ঘুরি ৷ দেখি দেবুর মোটর সাইকেলের পিছনে চুমকি ৷ ঝড়ের মতো আমার পাশ দিয়ে চলে যায় ৷ চুমকিকে বলাই হল না কথাটা ৷ মনে মনে খিস্তি পাড়ি নিজেকে ৷
এখান থেকে দেখছি খুব লেকচার দিচ্ছে বিজু ৷ শালা কথার মাস্টার! মেয়ে পটাতে ওস্তাদ ৷ নে, যত পারিস বাতেলা ঝেড়ে নে, একটু পরেই তো ফুটে যাবি ৷
ফের একটা চুমুক মেরে নিজেকে চাঙ্গা করি ৷ চুমকির জন্য দুঃখটা বুকের মধ্যে ঘাই মারে ৷ চুমকিও আমাকে ভুল বুঝল ৷ চুমকি, তোমার দিব্যি, টাকাটা সেদিন সত্যিই চোট হয়ে গেসল ৷ আমাকে আর একটু সময় দিলে পারতে ৷ তোমাকে ছুঁয়ে বলছি, তোমাকে আমি খুব… ৷
যাঃ শালা, মাতাল হয়ে গেলুম নাকি! ফালতু চিন্তা ঝেড়ে ফেলে সোজা হয়ে বসি ৷ রাত বাড়ছে, একটা-দুটো করে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে বেঞ্চগুলো ৷
বিজু এখনও মেয়েটাকে নিয়ে বসে আছে ৷ অন্ধকার গুহা থেকে বেরিয়ে আসি আমি ৷ এখান থেকে সোজা দেখা যাচ্ছে ওদের ৷ ঝলমলে ঝাউপাতার ব্যাকগ্রাউন্ডে বসে আছে দুজন ৷ পকেটে হাত ঢুকিয়ে মেশিনটা একবার ছুঁয়ে দেখি ৷
আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি চিৎ হয়ে শুয়ে আছে বিজু ৷ মর্নিং ওয়াকে আসা মানুষজন ভিড় জমিয়েছে লাশটাকে ঘিরে ৷ চারপাশে চাপ চাপ রক্ত ৷ মুখটা হাঁ, চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে ৷ মুখের ওপর ভন ভন করছে মাছি ৷
নাহ, আর সময় নেওয়া ঠিক হবে না ৷ একটু পরেই রাজ্যের মাতাল আর গেঁজেল এসে জুটবে ৷ আমি কায়দা করে পাশ কাটিয়ে পিছনের দিকে চলে যাই ৷ তারপর বেড়ালের পায়ে এগোতে থাকি ওদের দিকে ৷ এখনও দুজনে খুব মুডে গল্প করে যাচ্ছে ৷
ওদের পিছনে একটা খুব মোটা গাছ আড়াল করে আমি এগোই ৷ তারপর গুঁড়িটার গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি৷
হঠাৎ শুনতে পাই বিজু বলছে, আমি তোমাকে খুব…
মেয়েটা খিলখিল করে হাসছে, খুব কী?
বিজু তোতলাচ্ছে, আসলে খুব… কী বলব…
আমি আর এগোতে পারি না ৷ পা দুটো পাথরের মতো ভারী হয়ে গেছে ৷ ছুরিটা শক্ত করে ধরে গাছের গুঁড়িতে ফলাটা ঠেকাই ৷ আমার ঠোঁটগুলো আর বশে নেই, বিড় বিড় করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে ৷
কানে আসছে মেয়েটার হাসি আর বিজুর তোতলামি, আমি তোমাকে…
প্রচণ্ড চাপে ছুরির ফলাটা বেঁকে যাচ্ছে আর আমার অবাধ্য ঠোঁটদুটো বলছে, বলে ফেল নারে শালা, বল, তাড়াতাড়ি বল, দেরি হয়ে যাচ্ছে ৷