হন্তারক

হন্তারক

পূর্বাভাস

তার কোনও নাম নেই। তার বাড়ি এক সূর্যের এক গ্রহে, পৃথিবী থেকে ৮০ আলোকবর্ষ দূরে, অ্যান্ড্রোমিডা নক্ষত্রপুঞ্জের কাছে, এত দূরে যে ওখানকার সূর্য পৃথিবী থেকে দেখা যায় না। তাই ওই গ্রহের নাম জানে না মানুষ।

যাকে নিয়ে আমাদের গল্পের শুরু সে তার গ্রহের এক ভয়ংকর অপরাধী। সে একদিন এমন একটি অপরাধ করে বসল, সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হলো নির্বাসনে। আর তার নির্বাসন ঘটল পৃথিবীতে। তবে স্পেসশিপে চড়ে আসেনি সে, তাকে পাঠানো হয়েছে প্রচণ্ড শক্তিশালী এক ফোর্স বিমের সাহায্যে। পৃথিবীতে পৌছুতে তার মাইক্রো সেকেন্ড সময় লেগেছে মাত্র। পৃথিবীর মানুষ জানে না কী নিষ্ঠুর এবং নির্দয় এক হন্তারক তাদের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে আছে। সময় হলেই স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করবে সে। শুরু হলো দুঃস্বপ্নকে হার মানানো এক হরর কাহিনি……

এক

তার নাম না থাকলেও রয়েছে অসাধারণ ‘উপলব্ধি’ ক্ষমতা। এই ক্ষমতার সাহায্যে সহজেই সে অচেনা এই গ্রহের অজানা পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারছে। তার নির্দিষ্ট কোনও আকার নেই, নেই চোখ বা কান। তবে উপলব্ধি করার ক্ষমতা এত প্রখর যে সহজেই আশপাশের সবকিছু ‘দেখতে’পায়, তার সীমানার মধ্যে পড়ে, এমন কোনও শব্দ তার অদৃশ্য ‘কান’ এড়িয়ে যেতে পারে না। মোটামুটি বিশ গজের মত জায়গা সে বেশ পরিষ্কার দেখার ক্ষমতা রাখে, আরও বিশ গজ দূরে তার নজর যায় বটে, তবে ঝাপসা দেখে। এই তো পাশের গাছের ছাল বাকল সে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, শুনতে পাচ্ছে মাটির নীচে পোকাদের নড়াচড়ার শব্দ। ব্যাপারটা তাকে অবাক করে তুলছে। কারণ, নিজের জগৎ ছাড়া অন্য কোথাও প্রাণের স্পন্দন থাকতে পারে তার জানা ছিল না। তবে উপলব্ধি ক্ষমতা বলছে পোকাগুলো তার জন্য বিপজ্জনক নয়। এমনকী মাথার ওপর, গাছের ডালে ছোট ছোট কয়েকটি পাখি বসে আছে, ওরাও কোন বিপদ ডেকে আনবে না।

এ গ্রহের বিশাল সব গাছ দেখে সে অভিভূত। আর অবাক লাগছে চারপেয়ে একটি প্রাণীকে দেখে। ওটা প্রাকৃতিক একটা গুহার গর্তে ঘুমাচ্ছে, তার থেকে দশ গজ দূরে।

প্রাণীটা যেহেতু ঘুমাচ্ছে, তাই সে জানে সহজেই সে ওটার মনের ভেতর ঢুকে যেতে পারবে। তারপর ওকে দিয়ে যা খুশি করানো তার জন্যে কোনও ব্যাপারই নয়। তবে এসব ছোটখাট প্রাণী দিয়ে নিজের উদ্দেশ্য কতটা সাধন করা যাবে, সে ব্যাপারে তার সন্দেহও রয়েছে।

সে ‘পারসেপটর সেন্স’ বা উপলব্ধি ক্ষমতার সাহায্যে স্ক্যানিং করে চলছিল চারপাশ। মনোযোগ কেড়ে নিল একটা ছুরি। জং ধরা, ভাঙা ব্লেডের একটা জ্যাকনাইফ। কেউ ফেলে দিয়েছে অনেক আগে। ওটাকে যে ছুরি বলে তাও জানে না সে। তার কাছে ওটা স্রেফ আর্টিফ্যাক্ট বা শিল্পকলা ছাড়া কিছু নয়। আর আর্টিফ্যাক্ট মানেই বুদ্ধিমান জীবন! তবে বুদ্ধিমান জীবন প্রতিকূল এবং বিপজ্জনকও হয়ে উঠতে পারে। কারণ সে ছোট এবং অসহায়। তাই তার উচিত বুদ্ধিমান জীবনের গঠনপ্রণালী সম্পর্কে আগে জেনে নেয়া, সেক্ষেত্রে ঘুমিয়ে থাকা প্রাণীটা হতে পারে পরীক্ষা করার সর্বোৎকৃষ্ট উপায়। ঘুমন্ত প্রাণীটার মনের ভেতর প্রবেশ করে বরং সে পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে আরও বেশি কিছু জানার সুযোগ পাবে, এভাবে স্ক্যানিং করার চেয়ে।

সে একটা মেঠো পথের মাঝখানে পড়ে রয়েছে, কয়েক হাত দূরে লম্বা ঘাসের জঙ্গল, ওখানে লুকালে কেউ তাকে দেখতে পাবে না। সে চেষ্টা করল এগোতে, পারল না। তবে অবাক হলো না। কারণ তার গ্রহের তুলনায় এ গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অনেক বেশি। তাদের গ্রহে চলাফেরার প্রয়োজন হলে, শূন্যে স্রেফ ভাসিয়ে তোলে নিজেদেরকে। কিন্তু এখানে সে এটা করতে পারছে না। কারণ এখানে কারও ওপর ভর করে তাকে চলতে হবে, কাউকে তার ‘হোস্ট’ বানাতে হবে। আর এমন ‘হোস্ট’ করার মত একজনকেই সে দেখতে পাচ্ছে-ঘুমিয়ে আছে গুহায়। তবে ওটা খুব ছোট, তার অর্ধেক ওজনও হবে না। তবু চেষ্টা করে দেখতে দোষ কী?

হঠাৎ তার পারসেপটর সেন্সে কী যেন ধরা পড়ল। সে ওদিকে পুরো মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করল। বিপদ হলে খামোকা ওই ছোট প্রাণীটাকে নিয়ে মেতে থাকার মানে হয় না। আগে বিপদের মোকাবেলা করতে হবে।

প্রথমে শুধু কম্পন টের পেল সে, মাটি কাঁপছে, হেঁটে আসছে কেউ, বড় কিছু একটা। তারপর বাতাসে আরেকটা কম্পন ভেসে এল। কথা বলছে কেউ। কোনও বুদ্ধিমান প্রাণী। তবে একজন নয়, দু’জন। একজন বেশ উঁচু গলায় কথা বলছে, অপরজন খানিক নিচু গলায়। কথা বুঝতে পারছে না সে, বোঝার কথাও নয়। সে ওদের চিন্তা-চেতনার মাঝে ঢুকতে পারল না, তার গ্রহের জীবরা শব্দ উচ্চারণ করে না, পরস্পরের মাঝে যোগাযোগ রক্ষা হয় টেলিপ্যাথির মাধ্যমে।

এক সময় ওরা দৃষ্টিসীমার মধ্যে চলে এল। দু’জনই বটে। একজন তার সঙ্গীর চেয়ে সামান্য লম্বা, তবে দু’জনেই পরিণত বয়স্ক। সন্দেহ নেই দু’জনেই বুদ্ধিমান প্রজাতির, ওদের পরনে পোশাক-শুধু বুদ্ধিমান প্রাণীরাই পোশাক পরে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা। দু’জোড়া হাত এবং দু’জোড়া পা দেখা যাচ্ছে। বাহ্, এরা তার চমৎকার ‘হোস্ট’ হতে পারবে। তবে এ মুহূর্তে এ নিয়ে ভাবার সময় নেই তার। তার এখন অস্তিত্বের প্রশ্ন নিজেকে বাঁচাতে হবে।

ওরা দু’জন দুই লিঙ্গের। একটি মেয়ে, অপরটি ছেলে। হাত ধরাধরি করে হেঁটে আসছে এদিকেই। সর্বনাশ! এখনই তো দেখে ফেলবে ওকে। তা হলেই কম্ম সারা।

মরিয়া হয়ে সে তার একমাত্র অবলম্বন ঘুমন্ত, চারপেয়ে প্রাণীটার ওপর সওয়ার হলো, তার মনের ভেতর ঢুকে তাকে হোস্ট বানিয়ে ফেলল। তারপর ওটাকে জাগিয়ে তুলে বেরিয়ে এল গর্ত থেকে। আপাতত এটার ওপরেই সে ভর করে থাকবে। সে ছেলে মেয়ে দুটোকে ভাল করে দেখতে চায়। ওদের সম্পর্কে জানতে চায়। অবশ্য তার ভয়ও আছে। সে যে প্রাণীটার শরীরে ঢুকে পড়েছে, ওটা যদি ওদের চোখে পড়ে যায় তা হলে বিপদ হতে পারে। ওরা তার হোস্টকে মেরে ফেলতে পারে। হোস্টকে মেরে ফেললেও তার অসুবিধে নেই। অসুবিধা হবে ঘুমন্ত কোনও প্রাণীর ওপর সওয়ার হবার আগেই সে যদি ধরা পড়ে যায়, তা হলে। অবশ্য সুযোগ বুঝে হোস্টকে নিজেই হত্যা করবে সে বা মরতে বাধ্য করবে। তা হলেই তার পক্ষে সম্ভব হবে অন্য কোনও ঘুমন্ত প্রাণীর শরীরে ঢুকে পড়ে তাকে হোস্ট বানিয়ে ফেলা। বর্তমান হোস্টটি এত ছোট এবং ভঙ্গুর যে, এর ওপর ভর করে থাকলে নিজের উদ্দেশ্য পূরণ করা কখনোই সম্ভব হয়ে উঠবে না তার পক্ষে।

ওই ছেলেটির নাম রনি বেরেট, মেয়েটি শার্লি রকফিল্ড। পরস্পরকে ভালবাসে ওরা, বিয়ে করবে শীঘ্রি। জঙ্গলে ঘুরতে বেরিয়েছে ওরা, ফুর্তি করবে।

রনির বাঁ হাত নিজের ডান হাতের মুঠোয় চেপে হাঁটছিল শার্লি, হঠাৎ ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল। ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিল রনি, দ্রুত সামলে নিল নিজেকে। অবাক দৃষ্টিতে তাকাল শার্লির দিকে। শার্লি উঁকি মেরে কী যেন দেখছে।

‘দেখ, রনি, বলল সে। ‘একটা মেঠো ইঁদুর। কী করছে দেখ!’

‘দূর, ইঁদুর দেখলেই গা ঘিনঘিন করে আমার।’ মুখ বাঁকাল রনি।

ইঁদুরটা, ওদের কাছ থেকে কয়েক হাত দূরে, রাস্তায় বসে আছে, প্রেইরি কুকুরের মত। সামনের ছোট ছোট পা দুটো দ্রুত নাড়ছে, যেন ওদের সঙ্কেত দিতে চাইছে। খুদে, তীক্ষ্ণ চোখজোড়া স্থির হয়ে আছে ওদের ওপর।

‘কোনও ইঁদুরকে এমন অদ্ভুত কাজ করতে দেখিনি কোনদিন,’ মন্তব্য করল শার্লি, ‘মোটেও ভয় পাচ্ছে না আমাদেরকে, লক্ষ করেছ? এটাকে বাড়ি নিয়ে গেলে কেমন হয়, বলো তো? পুষব!‘

রনি বাধা দেয়ার আগেই উবু হলো শার্লি, হাত বাড়িয়ে খপ করে ধরে ফেলল ইঁদুরটাকে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে খুদে প্রাণীটাকে দেখতে দেখতে বলল, ‘ইস, রনি। কী সুন্দর!’

‘মানলাম সুন্দর,’ বলল টমি, ‘এখন ওটাকে ছেড়ে দাও। বাড়ি নিয়ে যেতে হবে না।’

‘আচ্ছা বাবা, নেব না। এমনি দেখলাম ওকে ধরতে পারি কিনা। উহ্!’ ছুড়ে ফেলল সে ইঁদুরটাকে, যন্ত্রণায় মুখ বাঁকাল। ‘খুদে শয়তানটা আমাকে কামড়ে দিয়েছে।’

ইঁদুরটা ফুড়ৎ করে দৌড় দিল, খানিক দূরে গিয়ে থেমে দাঁড়াল, পেছন ফিরে দেখল ওরা ধাওয়া করেছে কি-না। না, ধাওয়া করছে না। ওরা এমনকী তার দিকে তাকাচ্ছেও না। ওরা ব্যস্ত রয়েছে নিজেদেরকে নিয়ে।

‘বেশি লেগেছে, সোনা?’ উদ্বিগ্ন দেখাল রনিকে।

‘না, তেমন না, আরে, দেখ!’ শার্লি তাকাল রাস্তায়।

দৌড়ে আসছে ইঁদুরটা রনির দিকে। ট্রাউজার বেয়ে উঠতে শুরু করল, এক ঝাপটা মেরে ওটাকে পাঁচ হাত দূরে পাঠিয়ে দিল রনি। আবার এল ওটা-প্রতিহিংসা নিয়ে হামলা চালাল। এবার প্রস্তুত ছিল রনি। সজোরে পা নামিয়ে আনল ছোট্ট, জ্যান্ত প্রাণীটার ওপর, পিষে ভর্তা করে ফেলল। তারপর ছিন্নভিন্ন দেহটা কিক মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিল দূরে।

‘রনি, তুমি ওটাকে—’

গম্ভীর চেহারা নিয়ে বান্ধবীর দিকে ফিরল রনি। শার্লি, ওটা আমার ওপর দু’বার হামলা চালিয়েছে। যাকগে, তোমাকে কোথায় কামড়েছে বল। রক্ত বের হলে ইঁদুরটাকে নিয়ে শহরে যেতে হবে, র‍্যাবিস আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখা দরকার। কোথায় কামড় দিয়েছে, শার্লি?’

‘বা-বাম বুকে, মুখের কাছে আনার সময় কামড় দিয়েছে। তবে রক্ত বের হয়নি। সোয়েটার আর ব্রা ছিল-‘

তবু চেক করে দেখতে হবে। তোমার জামা-না থাক এখানে খুলতে হবে না। লোকজন এসে পড়তে পারে, চলো, এগোই। অন্য কোথাও গিয়ে পরীক্ষা করে দেখব।

শার্লির হাত ধরে পা বাড়াল রনি। এত জোরে হাঁটা দিল, ওর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে প্রায় দৌড়াতে হলো শার্লিকে

‘দেখ একটা কচ্ছপ,’ কয়েক কদম যাবার পর বলে উঠল শার্লি।

হাঁটার গতি কমাল না রনি, ‘প্রাণী নিয়ে অনেক খেলা হয়েছে। এবার চলো তো!’

খানিকটা এগোবার পর মোড় ঘুরল ওরা, এখানে প্রচুর ঝোপঝাড়, তারপর টলটলে একটা পুকুর। বেশ নির্জন পরিবেশ। এখানে লোকজন আসে বলে মনে হয় না। ওরা এসেছে পুকুরে মজা করে সাঁতার কাটবে।

রনির বয়স আঠারো, শার্লি সতেরোয় পা দিয়েছে। ছোটবেলা থেকে দুটিতে বন্ধুত্ব। একই স্কুলে পড়ত ওরা, একই ক্লাসে। বছর দুই আগে হাইস্কুলের পড়া শেষ করেছে ওরা। পড়াশোনার প্রতি তেমন আগ্রহ নেই রনির। বাপের খামারে কাজ করে। বাপবেটা দু’জনের খেয়ে পরে চমৎকার চলে যায়। দু’পরিবারই ওদের সখ্যর কথা জানে। টমির বাবা, মি. বেরেট শার্লিকে পুত্রবধূ করে ঘরে নেয়ার জন্যে মুখিয়ে আছেন। শার্লির বাবা মারও আপত্তি নেই রনির মত সুদর্শন, স্বাস্থ্যবান এবং সৎ পাত্রের হাতে মেয়েকে তুলে দিতে। জানেন রনির ঘরে শার্লি সুখেই থাকবে। কারণ রনি খুবই ভালবাসে শার্লিকে।

রনি আর শার্লি মাঝে মাঝে ঘুরতে বেরোয়। রনির কাজই হলো নতুন জায়গা খুঁজে বের করা, যেখানে শার্লিকে নিয়ে মজা করে গল্প করা যাবে। সে সম্প্রতি এই জঙ্গলের মধ্যে চমৎকার এই পুকুরটির খোঁজ পেয়েছে। সাঁতারের কথা বলতেই লাফিয়ে উঠেছে শার্লি, তারপর দুজনে মিলে চলে এসেছে এখানে।

পুকুরে নামার আগে শার্লির ক্ষতস্থান পরীক্ষা করে দেখল রনি। সোয়েটার ভেদ করে ইঁদুরের দাঁত কামড় বসাতে পারেনি মাংসে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রনি। হাসল, ‘যাক, বাবা। বাঁচা গেল! চলো, সাঁতার কাটি।’

ওরা জামাকাপড় ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল কাকচক্ষু কালো দীঘির পানিতে। ঠাণ্ডা স্পর্শে জুড়িয়ে গেল গা। দু’জন পরস্পরের দিকে পানি ছুঁড়ছে, হাসছে, জানে না ঝোপের আড়াল থেকে কিছু একটা দেখছে ওদেরকে। এমন কিছু একটা যা শীঘ্রি ওদের জীবন নরকের চেয়েও দুঃস্বপ্নময় করে তুলবে।

দুই

ওটা সাঁতার কাটতে দেখছে রনি এবং শার্লিকে। অস্থির হয়ে আছে কখন ওরা ক্লান্ত হয়ে তীরে উঠবে, তারপর ঘুমিয়ে পড়বে। ওরা ঘুমুলেই ওদের যে কাউকে নিজের হোস্ট বানাতে পারবে সে। তবে ছেলেটাকেই প্রথম পছন্দ তার। কারণ মেয়েটার চেয়ে ছেলেটা লম্বায় বড়, গায়ে গতরেও শক্তিশালী মনে হচ্ছে এবং সম্ভবত বুদ্ধিমান। বুদ্ধিমান, শক্তিশালী প্রাণীই তার দরকার।

অনেকক্ষণ সাঁতার কাটার পর ওরা উঠে পড়ল তীরে, তোয়ালে দিয়ে গা মুছল। ছেলেটা কী যেন বলল মেয়েটাকে, মেয়েটা মাথা দুলিয়ে সায় দিল। ছেলেটা তোয়ালে বিছাল মাটিতে। তারপর দু’জনেই শুয়ে পড়ল। একটু পরেই নাক ডাকতে শুরু করল ছেলেটার। মেয়েটা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তার দিকে, আস্তে আস্তে চোখ বুজে এল তারও। সাঁতার কেটে বেজায় ক্লান্ত দু’জনেই। ঘুমিয়ে পড়েছে।

এতক্ষণ এ সুযোগের অপেক্ষায় ছিল ওটা। রনি গভীর ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেছে, সে ওর শরীরের ভেতর প্রবেশ করল। তবে ঢুকতে একটু কসরত করতে হলো। রনির অবচেতন মন তাকে ঢুকতে দিতে চাইছিল না। বুদ্ধিমান প্রাণীদের হোস্ট করতে গিয়ে এমন সমস্যায় আগেও পড়েছে সে। চার পেয়ে প্রাণীটার ভেতরে ঢুকতে তার মাইক্রো সেকেন্ড সময়ও লাগেনি। কিন্তু যে প্রজাতি যত বুদ্ধিমান তার কাছ থেকে প্রতিরোধটা আসে তত বেশি। তবে রনির অবচেতন মনকে অবশ করে ফেলতে তার সময় লাগল না। একবার ঘুমের গভীরে চলে গেলে যে কাউকে কাবু করে ফেলতে পারে সে। এবারও তাই করল। এখন রনির শরীরটা তার একান্ত নিজের, রনির মনকে সে নিজের ইচ্ছামত চালাতে পারবে, ওকে দিয়ে যা খুশি করানোর ক্ষমতা এখন সে রাখে। রনি তার কাছে সম্পূর্ণ অসহায় এক বন্দী। তার বন্দীত্বের অবসান ঘটবে একমাত্র মৃত্যুর মাধ্যমে।

রনির সমস্ত স্মৃতি বা জ্ঞান নিজের মধ্যে ধারণ করল সে। এই জ্ঞান কাজে লাগাবে সে নিজের প্রয়োজনে, তবে আস্তে ধীরে, রয়ে-সয়ে।

প্রথমেই যে কাজটা করা দরকার তা হলো নিজেকে বা নিজের শরীরটাকে নিরাপদ কোনও জায়গায় লুকিয়ে রাখতে হবে। যাতে কেউ এসে তাকে ধ্বংস করতে না পারে।

রনির জ্ঞান এবং স্মৃতির ভাণ্ডার এ কাজে ব্যয় করল সে। খুঁজতে লাগল লুকোবার ভাল জায়গা। এক সময় পেয়েও গেল। আধা মাইল দূরে, গভীর জঙ্গলে, পাহাড়ের ধারে একটা গুহা আছে। ছোট গুহা, তবে এটার কথা কেউ জানে না। নয় বছর বয়সে রনি এটা আবিষ্কার করছে। ধরেই নিয়েছে প্রথম আবিষ্কর্তা হিসেবে এ গুহার মালিকও সে। কাউকে এ গুহার কথা বলেনি সে। গুহার মেঝে খটখটে, পাথুরে নয়-বালুময়।

যেন জেগে না ওঠে, এভাবে আস্তে উঠে পড়ল সে শার্লির পাশ থেকে (ইচ্ছে করলে মেয়েটার গলা টিপে মেরে ফেলতে পারে সে। কিন্তু তাতে জটিলতা খামোকা বাড়বে; আর কম শক্তিসম্পন্ন প্রাণীর প্রতি তার তেমন আকর্ষণও নেই)। হাঁটা শুরু করল। রনির পরনে কিছু নেই। তার জুতো, শর্টস, ট্রাউজার, শার্ট সব পড়ে রইল যেখানে একটু আগে সে শুয়েছিল, সে জায়গায়। ওটা মনে করেছে জামাকাপড় পরার দরকার নেই। কারণ যে কেউ এখানে যে কোনও সময় চলে আসতে পারে। কাজেই যত দ্রুত সম্ভব কেটে পড়তে হবে।

ঝোপ ঠেলে রাস্তার ওপাশে যাবার আগ মুহূর্তে পেছন ফিরে তাকাল সে। মেয়েটা এখনও অঘোরে ঘুমাচ্ছে। ঘুরল সে। দুলকি চালে ছুটল গুহার দিকে।

রনির মনের ভেতর ঢুকে বসে আছে সে, ওর মনের কথা পড়তে পারছে। জেনে অবাক হয়েছে রনি এবং মেয়েটা তাকে রাস্তায় দেখেও কেন থেমে পড়েনি। তাদের দৃষ্টিতে সে সামান্য একটা কচ্ছপ ছাড়া কিছুই নয়। পাঁচ ইঞ্চি লম্বা একটা কচ্ছপের খোলসের মধ্যে তার বাস। কচ্ছপ সম্পর্কে সে জানে এটা ধীরগতি একটা প্রাণী, বোকাসোকা, কারও সাতে পাঁচে নেই। কচ্ছপটার ওজন আর তার ওজন প্রায় একই—দুই পাউন্ড। তার জানা আছে কচ্ছপ মানুষের কাছে একটি সুখাদ্য ‘বলে বিবেচিত। তবে সচরাচর ক্ষুধার্ত মানুষ ছাড়া কেউ কচ্ছপ ধরতে যায় না। ভাগ্যিস, ওরা ক্ষুধার্ত ছিল না। মেঠো ইঁদুরটাকে সে তার হোস্ট বানিয়েছিল। পরে প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে ওটাকে ত্যাগ করেছে। বলা যায় ইঁদুরটাকে বাধ্য করেছে সে রনির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে। জানত রনি তাকে মেরে ফেলবে এবং সে ইঁদুরের দেহের বন্ধন থেকে মুক্তি পাবে, ঢুকে যেতে পারবে নিজের খোলসে।

শুরুতে বলেছিলাম তার সুনির্দিষ্ট কোনও আকার নেই। কথাটি সম্পূর্ণ সত্যি নয়। তার আকার একটা আছে-অনেকটা কচ্ছপের মত দেখতে সে। তবে পৃথিবীর কচ্ছপের মত নয়। মেয়েটা যখন বলল, ‘দেখো, একটা কচ্ছপ!’ তার আত্মা উড়ে গিয়েছিল ভয়ে। ভাগ্যিস, ছেলেটা তার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি। তা হলেই সর্বনাশ হত। ওরা টের পেয়ে যেত আদৌ সে কচ্ছপ নয়। কচ্ছপের খোলসের নীচে হাত, পা, মাথা কিছুই নেই। ওরা যদি আরও বেশি কৌতূহলী হয়ে খোলটা ভেঙে ফেলত বা ফাটিয়ে ফেলত, ভেতরে কী আছে দেখার জন্যে, তা হলে কোনও হোস্টের ওপর আশ্রয় করেও বাঁচতে পারত না সে, মারা যেত সাথে সাথে। কারণ কাউকে মানসিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করার সময় সেই জিনিস বা প্রাণীর নিজস্ব অস্তিত্ব বা সত্তা বলে কিছু থাকে না।

ছুটতে ছুটতে রনির সেই গুহায় চলে এল সে। গুহাটা ছোট, ভেতরে ঢুকতে হয় হামাগুড়ি দিয়ে। চারপাশে ঝোপঝাড় এটাকে ঢেকে রেখেছে দেখে সন্তুষ্ট বোধ করল সে।

ভেতরটা প্রায় অন্ধকার, তবে রনির চোখ দিয়ে সে ভালই দেখতে পাচ্ছে। রনির স্মৃতি থেকে চমৎকার একটা’ ছবি পাচ্ছে সে জায়গাটার। (এখানে একটা কথা বলা দরকার, সে যখন কারও ওপর সিন্দবাদের ভূতের ওপর সওয়ার হয়, তখন হোস্টের উপলব্ধি ক্ষমতা দিয়েই সে সব কিছু দেখে এবং শোনে। কাজেই হোস্ট যদি ক্ষীণ দৃষ্টির হয় তারও দৃষ্টি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।) গুহাটা তেমন বড় নয়, ফুট বিশেক হবে লম্বায়, সবচেয়ে চওড়া জায়গা হচ্ছে মাঝখানটা, ছয় ফুটের মত। এখানে একজন মানুষ মোটামুটি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

গুহার মাঝখানে এসে ওটা রনিকে দিয়ে মাটি খোঁড়াল। মাটি মানে বালু। নয় ইঞ্চি মত গর্ত করার পর রনি কচ্ছপরূপী ভিনগ্রহের প্রাণীটাকে ওখানে কবর দিল। গর্তের বালু এমনভাবে বুজিয়ে দিল বোঝার উপায় থাকল না এখানে কিছু একটা আছে। তারপর রনি সাবধানে বেরিয়ে এল গুহা থেকে সমস্ত চিহ্ন মুছতে মুছতে। সবশেষে, গুহা মুখের বাইরে, ঝোপের আড়ালে বসে রইল চুপচাপ।

তাড়াহুড়ার কিছু নেই। নিজেকে নিরাপদেই লুকিয়ে রেখেছে সে। এখন রনির জ্ঞানভাণ্ডার শুষে নেবে সে। যদিও রনির আই কিউ তেমন প্রখর নয়, ইতিমধ্যে বুঝে গেছে সে, তারপরও রনি আশপাশের পরিবেশ সম্পর্কে যতটুকু জানে, ওটুকু জানলেও তার চলে যাবে। কারণ তার দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনায় রনির এই জ্ঞানটুকু অল্পসময়ের জন্য হলেও কাজে লাগানোর মত।

তিন

ঘুম ভেঙে শার্লি রকফিল্ড দেখল রোদের তেজ মরে গেছে, আবছা আঁধার নামছে জঙ্গলে। কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখল ছ’টা বাজে। তার মানে টানা তিন ঘণ্টা ঘুমিয়েছে সে। এখান থেকে ওর বাড়ি আধ-ঘণ্টার হাঁটা পথ। বাপ-মা হয়তো চিন্তায় পড়ে গেছে আদরের মেয়ে এখনও আসছে না কেন ভেবে।

পাশ ফিরল সে, রনিকে জাগাবে। কিন্তু রনি নেই পাশে। জামা-কাপড় এলোমেলো পড়ে আছে। হয়তো প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেছে কাছে কোথাও, ভাবল শার্লি। ওর ফেরার অপেক্ষায় বসে রইল সে।

কিন্তু আধ ঘণ্টা পরেও রনি ফিরল না দেখে উদ্বেগ বোধ করল শার্লি পায়ে স্যান্ডেল চাপিয়ে উঠে দাঁড়াল। নাম ধরে ডাকল, ‘রনি! কোথায় তুমি?’

কোনও সাড়া নেই। শুধু মাটিতে পাতা পড়ার খসখস শব্দ ছাড়া আশ্চর্য নীরব প্রকৃতি। আচ্ছা, রনি ওকে ভয় দেখাবার জন্যে কোথাও লুকিয়ে নেই তো? হঠাৎ, ‘হাউ’ করে বেরিয়ে আসবে ঝোপের আড়াল থেকে। নাহ্, রনি অমন করবে না।

কিন্তু ছেলেটা গেল কোথায়? জামা-কাপড় ছাড়া যাবেই বা কতদূর? নাকি কোনও দুর্ঘটনা ঘটেছে? কোনও কারণে অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে পড়ল না তো? রনির স্বাস্থ্য খুব ভাল। মৃগীরোগ নেই ওর। আর যদি অ্যাকসিডেন্ট হয়-তা হলে হয়তো অজ্ঞান হয়ে গেছে (মারাও যেতে পারে রনি, এ কথা ভাবলেও বুকে কাঁপন ধরে)। ওর যদি গোড়ালি মচকে যায় বা পা ভেঙে গিয়ে থাকে, তা হলেও তো শার্লির ডাকে সাড়া দেয়ার কথা। কিন্তু কোনও সাড়া নেই কেন?

টেনশনের চোটে মুখ শুকিয়ে গেল শার্লির, বুকের ভেতর পাঁজরের গায়ে দমাদম হাতুড়ির মত পিটছে হৃৎপিণ্ড। সে ঝোপঝাড় মারিয়ে বেরিয়ে এল চারপাশে তাকাতে তাকাতে। হাঁটছে, সেই সাথে উঁচু গলায় ডাকছে রনির নাম ধরে। আধ-ঘণ্টা পরে, আশপাশের প্রায় একশো গজ জায়গা খুব ভালভাবে খুঁজেও রনির টিকিটিও চোখে না পড়ায়, এবার সত্যি ভয় পেয়ে গেল শার্লি। এতদূরে রনি হয়তো আসেওনি।

ওর সাহায্য দরকার, বুঝতে পারল শার্লি। এবার বাড়ির পথ ধরে প্রায় দৌড় শুরু করল। তিন মাইল রাস্তা একটানা দৌড়াবার পর, পরিশ্রম এবং টেনশনে প্রায় নেতিয়ে পড়ল মেয়েটা। ওর চেহারা দেখে ভয় পেয়ে গেলেন ওর বাবা। ব্যগ্র কণ্ঠে জানতে চাইলেন, ‘কী হয়েছে, শার্লি?’

কেঁদে ফেলল শার্লি। ফোঁপাতে ফোঁপাতে পুরো ঘটনা খুলে বলল।

সব শুনে উঠে দাঁড়ালেন র‍্যালফ রকফিল্ড। বললেন, ‘কাঁদিস না, মা। দেখছি কী করা যায়।’

তিনি তখুনি ফোন করলেন রনির বাবা, তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু জন বেরেটকে। সবকথা শুনে মুখ অন্ধকার করে ফেললেন বেরেট। শুধু বললেন, ‘তুমি থাক বাড়িতে, আসছি আমি।’

ফোন ছেড়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন জন বেরেট। তারপর ওয়ারড্রোব খুলে রনির পুরানো একজোড়া মোজা বের করে পকেটে ঢোকালেন। তাঁর কুকুর টাইগারকে মোজার গন্ধ শুকিয়ে রনির খোঁজে বেরুবেন। তারপর লণ্ঠন, দেশলাই ইত্যাদি নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলেন।

ডগ হাউসের সামনে ঘুমাচ্ছে টাইগার। আস্তানাটা রনিই ওর জন্যে বানিয়ে দিয়েছিল। টাইগারের বয়স সাত, সাদায় কালোয় মেশানো রং, বিশাল আকারের এক হাউন্ড। সে শিকারের গায়ের গন্ধ শুঁকে তাকে খুঁজে বের করতে ওস্তাদ। তার সবই ভাল, শুধু গাড়িঘোড়া ভয় পায়। বলা যায়, যান্ত্রিক বাহনটার প্রতি তার প্রচুর অ্যালার্জি আছে।

‘চলরে, টাইগার,’ ডাক দিলেন জন। ‘কাজ আছে।’

লাফ মেরে উঠে দাঁড়াল হাউন্ড। তারপর মনিবের পিছু পিছু এগোল রকফিল্ডের খামার বাড়ির দিকে। ততক্ষণে সাঁঝ নেমে গেছে পুরোপুরি।

র‍্যালফ রকফিল্ড লণ্ঠন আর শটগান নিয়ে রেডি ছিলেন, বন্ধুকে দেখে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন। তাঁর সাথে শার্লিও আছে।

কোনও শুভেচ্ছা বিনিময় হলো না। জন জিজ্ঞেস করলেন শার্লিকে, ‘এই রাস্তাটা মোড় ঘুরে ব্রিজের পাশ দিয়ে উত্তর দিকে চলে গেছে না?’

‘জ্বী, আংকেল, আমি আপনাদের সঙ্গে যাব। দেখিয়ে দেব রনির জামা কাপড়গুলো কোথায় পড়ে আছে।

‘তোমাকে যেতে হবে না, শার্লি,’ শান্ত গলায় বললেন তার বাবা, তুমি ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও। টাইগারই আমাদের ওখানে নিয়ে যেতে পারবে।’

বাপের মুখের ওপর কথা বলার সাহস নেই শার্লির। সে বাধ্য মেয়ের মত ঘরে ঢুকল। ওঁরা দুজন কুকুরটাকে নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন।

ঝকঝকে চাঁদ উঠেছে আকাশে। দিনের আলোর মত পরিষ্কার চারদিক। লণ্ঠন না আনলেও চলত।

‘বন্দুক কেন, র‍্যালফ?’ প্রশ্ন করলেন জন। শটগান কী কাজে লাগবে?’

‘রাতের বেলা জঙ্গলে বন্দুক ছাড়া পথ চলতে আমি ভরসা পাই না,’ জবাব দিলেন র‍্যালফ। ‘কে বলতে পারে কখন কী ঝাঁপিয়ে পড়বে গায়ের ওপর। এক মুহূর্ত পরে আবার বললেন, ‘আমি রনির কথা ভাবছি, ওকে যদি খুঁজে পাই।’

‘অবশ্যই খুঁজে পাব।’

‘ভাবছি ওদের বিয়েটা দিয়ে দিলেই হয়। এভাবে লুকোচুরি করে বনে- বাদাড়ে দেখা-সাক্ষাতের ব্যাপারটা পছন্দ হচ্ছে না আমার। তুমি কী বল?’

‘আমার কোনও আপত্তি নেই,’ সায় দেয়ার ভঙ্গিতে বললেন জন। চুপচাপ হেঁটে চললেন তাঁরা। হঠাৎ দেখলেন দূর থেকে একজোড়া আলো দ্রুত এগিয়ে আসছে, গাড়ির হেড লাইট। জন চট করে টাইগারের কলার চেপে ধরলেন, রাস্তা থেকে টান মেরে সরিয়ে দিলেন। আড়ষ্ট হয়ে উঠেছে জানোয়ারটা, কাঁপছে থর থর করে। গাড়িটা চলে যাওয়া পর্যন্ত ওকে শক্ত হাতে ধরে রইলেন জন, তারপর আবার হাঁটা ধরলেন।

টাইগারকে আগেই রাস্তা বাতলে দিয়েছিল শার্লি, ওখানে পৌঁছুতে তেমন বেগ পেতে হলো না। শুধু জঙ্গলে ঢোকার পর লণ্ঠন জ্বালাতে হলো। এদিকে গাছপালা এত ঘন যে চাঁদের আলো ডালপালা আর পাতার প্রাচীর ভেদ করে ভেতরে ঢোকার সুযোগ পায় না। ফলে আঁধার হয়ে থাকে জঙ্গল।

রনির জামাকাপড় আগের জায়গাতেই আছে। ওগুলো দেখে মনে মনে হতাশ হয়ে উঠলেন জন। ভেবেছিলেন এসে দেখবেন রনি ফিরে এসেছে, পোশাক পরে বাড়ি ফিরে গেছে। ওকে আর খুঁজতে হবে না। এবার ভয় লাগল তাঁর। ছেলেটার কিছু হয়নি তো?

টাইগার রনির জামা-কাপড় শুঁকছে, তারপর এগিয়ে গেল রনি যেখানে শুয়ে ছিল, সেখানে। জায়গাটা এক চক্কর দিয়ে ছুটল ঝোপের দিকে। জন দ্রুত রনির জামা-কাপড় নিয়ে ওর পিছু পিছু দৌড় দিলেন। বুঝতে পেরেছেন তিনি, টাইগার রনির ট্রেইল খুঁজে পেয়েছে, সেদিকেই যাচ্ছে এখন।

চার

ভিনগ্রহের হন্তারক এখন বিশ্রাম নিচ্ছে। ইতিমধ্যে রনির জ্ঞানভাণ্ডার থেকে সব শুষে নিয়েছে। সে এখন জানে এ গ্রহের নাম পৃথিবী। পৃথিবী সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণাও পেয়ে গেছে সে। জানে এ গ্রহের বেশির ভাগ জুড়ে রয়েছে লবণ পানির সমুদ্র, তবে ডাঙাও কম নেই, সেগুলো সব দেশ আর মহাদেশ।

এ মুহূর্তে যেখানে সে আছে এ জায়গা সম্পর্কেও মোটামুটি একটা ধারণা তার হয়েছে। সে জানে সে একটা গ্রামে চলে এসেছে, সবচেয়ে কাছের শহর চার মাইল উত্তরে। তার জানা আছে জায়গাটির নাম বার্টলসভিল, সাকুল্যে হাজার তিনেক লোকের বাস। এটা উইসকনসিন নামে এক রাজ্যে অবস্থিত, রাজ্যটা আমেরিকা নামের একটি দেশের অংশ। এখান থেকে পঁয়তাল্লিশ মাইল দক্ষিণ পূর্বে বড় একটা শহর আছে, গ্রীনবে। গ্রীনবের একশো মাইল দক্ষিণে মিলওয়াকি, আরেকটি বড় শহর। মিলওয়াকির নব্বুই মাইল দূরে রয়েছে আরও একটি বড় শহর শিকাগো। এ সব শহরের নাম সে জানে, কারণ রনি ওই শহরগুলোতে গিয়েছিল। তবে বার্টলসভিল এবং তার আশপাশের এলাকা সে ভালই চেনে। এটা তার খুব কাজে লাগবে। তার মনের ছবিতে এ এলাকার বুনো এবং সব ধরনের প্রাণীর ছবি ফুটে আছে। প্রাণীগুলোর ক্ষমতা এবং সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও সে অজ্ঞাত নয়। আবার কাউকে হোস্ট হিসেবে ব্যবহার করতে হলে কার ওপর সওয়ার হতে হবে ভালই জানা আছে তার।

তবে সমস্যা হলো, যার ওপর সে এ মুহূর্তে ভর করে আছে বিজ্ঞান সম্পর্কে তার ধারণা বা পড়াশোনা নেই বললেই চলে। অথচ তার সবচেয়ে দরকার ইলেকট্রনিক্স ভাল জানে এমন কাউকে। তার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে কোনও ইলেকট্রনিক্সের ওপর ভর করা। তবে সে লোকের ইলেকট্রনিক্সের পুঁথিগত বিদ্যা থাকলেই চলবে না, জানতে হবে কী ভাবে এ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে নানা যন্ত্রপাতি তৈরি করা যায়। কাজটা কঠিন, হয়তো মূল লক্ষ্যে পৌঁছুতে তাকে অনেকগুলো পদক্ষেপ নিতে হবে, সওয়ার হতে হবে অনেকের ওপর। তবে প্ল্যান মাফিক এগোতে পারলে এ কাজে সফলও একশোভাগ। সে তাই করবে। কারণ তাকে বাড়ি ফিরতে হবে।

পৃথিবীতে তাকে পাঠানো হবে এমন ধারণাও তার ছিল না। আসলে কর্তৃপক্ষ তাঁদের মর্জি মত ভয়ংকর অপরাধীদের যেখানে খুশি পাঠিয়ে দেন। গ্যালাক্সিতে গ্রহের অভাব নেই। কিন্তু ভিনগ্রহের অপরাধীটির পৃথিবীতে থাকার কোনও ইচ্ছে নেই, সে নিজের বাসভূমে ফিরে যেতে চায়। এখান থেকে ফিরে যেতে পারলে তাকে ক্ষমা তো করা হবেই, বীরের মর্যাদা পাবে সে। কারণ, নির্বাসনে যারা যায়, তাদের একশোভাগের একভাগও বাড়ি ফিরতে পারে কিনা সন্দেহ। সে ফিরতে পারলে নতুন এই গ্রহ সম্পর্কে প্রচুর তথ্য দিতে পারবে তার লোকদের। তার অপরাধ ক্ষমা করে দেয়া হবে। সম্ভব হলে সে এখানকার কোনও মানুষ হোস্টকে নিয়ে যাবে সঙ্গে করে। তা হলে তার খাতির দেখে কে? অবশ্য নিজের দেশে ফেরা সম্ভব যদি কাজগুলো করা হয় সাবধানে। ধীরে এবং কোনও ভুল না হলে। অবশ্য ইতিমধ্যে সে একটা ভুল করে বসেছে। রনিকে ন্যাংটা অবস্থায় এখানে নিয়ে আসা উচিত হয়নি। রনিকে সাময়িকভাবে সম্মোহন করলেও চলত-লম্বা ঘাসের মধ্যে তাকে লুকিয়ে রেখে সে চলে যেত ঘুমন্ত মেয়েটার কাছে। তারপর ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকত তার পাশে। তারপর মেয়েটির ঘুম ভাঙলে ওরা চলে যেত যে যার বাড়িতে। পরদিন সকালে রনিকে আবার নিয়ে আসত সে এখানে। রনি তাকে ঘাসের জঙ্গল থেকে তুলে নিয়ে গুহার মধ্যে আরও ভাল কোনও জায়গায় রেখে দিত। তারপর সুবোধ ছেলের মত ফিরে যেত বাড়িতে, কারও মনে কোনও সন্দেহ না জাগিয়ে।

এ কাজটা করলেই ভাল হত। কিন্তু ‘ভাল’টা বুঝতে পেরেছে সে অনেক দেরিতে। অবশ্য কাজ একটা এখনও করা যায়। রনির স্মৃতি লোপ করে দিতে পারে সে। কাল সকালে রনিকে পাঠিয়ে দিতে পারে বাড়িতে। তার আত্মীয়স্বজন নিশ্চয়ই জানতে চাইবে কী হয়েছিল তার। রনির স্মৃতি সাময়িক ভাবে লোপ করে দেওয়ার কারণে সে কিছুই মনে করতে পারবে না। তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। ডাক্তার পরীক্ষা করলেই বুঝতে পারবেন ওটা অ্যামনেসিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ। হয়তো রনিকে নিয়ে দু’একদিন হৈচৈ হবে। তারপর সব থিতু হয়ে গেলে রনিকে সে আবার নিয়ে আসবে। নিজের কাছে। নিজের কাজ ফুরোলে রনিকে হত্যা করবে সে। তবে মৃত্যুটা এমনভাবে দেখাতে হবে যেন দুর্ঘটনায় মারা গেছে রনি। তাতে কারও মনে কোনও সন্দেহ জাগার অবকাশ থাকবে না।

ভিনগ্রহের প্রাণীটার পরিকল্পনায় ছেদ ঘটাল কুকুরের ডাক। রনির চোখ দিয়ে ঝোপের আড়াল থেকে সে তাকিয়ে দেখল দুটো আলো, হেলতে দুলতে আসছে এদিকেই, সেই সাথে শোনা যাচ্ছে ঘেউ ঘেউ। ডাক শুনেই বুঝে ফেলল সে ওটা টাইগার, রনির বাবার কুকুর।

দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে নিতে দেরি হলো না ভিনগ্রহের প্রাণীর। রনির বাবা ছেলের চিন্তায় কুকুর নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। নির্ঘাত সেই মেয়েটা বলে দিয়েছে রনিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ সে ভেবেছিল (বলা যায় রনি ভেবেছে) কাল সকালের আগে তার খোঁজ পড়বে না। বাবা যে কুকুর নিয়ে রাতের বেলাতেই হারানো ছেলের খোঁজে বেরিয়ে পড়বেন কে জানত?

আসছে ওরা, দু’জন পুরুষ, একটা কুকুর। একজন রনির বাবা, অপরজন সম্ভবত শার্লির বাবা। আর কুকুরটা সরাসরি গুহার দিকেই ছুটে আসছে!

ওদের এখান থেকে ভাগাতে হবে, সরিয়ে দিতে হবে। কোনওভাবেই গুহার ভেতর ঢুকতে দেয়া যাবে না। আর একশো গজ দূরে ওরাও নেই, সোজা এগিয়ে আসছে, কুকুরটা অনুসরণ করছে রনির ট্রেইল।

রনি, বা বলা যায় রনির শরীর, উঠে দাঁড়াল লাফ মেরে, ঝোপ ঘুরে ছুট দিল আলোকিত লণ্ঠনের দিকে।

ওকে দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন দুজনে। টাইগার আনন্দে গরগর করে উঠল, ঝাঁকি খেল শরীর, গলায় বাঁধা চামড়ার বেল্ট ছেড়ে দিতে বলছে মনিবকে। জন বেরেট চেঁচিয়ে উঠলেন-রনি! কী ব্যাপার?’

নাহ্! গুহার বড্ড কাছে ওরা। ঘুরে দাঁড়াল, রনি আবার দৌড়াতে লাগল, ক্রমে সরে যাচ্ছে গুহার কাছ থেকে, পেছন থেকে জন গলার রগ ফুলিয়ে চেঁচাতে লাগলেন, ‘রনি, রনি, দাঁড়াও।’

রকফিল্ড বললেন, ‘কুকুরটাকে ছেড়ে দাও। ওকে ধরে নিয়ে আসুক।’ বেরেটের গলা শুনল রনি, ‘হ্যাঁ, ছেড়ে দিই। আর দু’জনকেই এক সাথে হারাই আর কী!’

ঝড়ের বেগে দৌড়ে ওদের পেছনে ফেলে দিল রনি। আসলে তো আর ও দৌড়াচ্ছে না, ওকে দৌড় করাচ্ছে ভিনগ্রহের প্রাণীটা। নিজের ওপর কোনই নিয়ন্ত্রণ নেই রনির। ওর শরীরের ভেতর ঘাপটি মেরে বসে থাকা অদৃশ্য জিনিসটা ওকে দিয়ে যা খুশি করাচ্ছে।

দৌড়াতে দৌড়াতে রনি সেই আর্টিফ্যাক্ট বা ছুরিটার কাছে চলে এল। ঘন ঘাসের আড়াল থেকে ওটা খুঁজে বেরও করল। তারপর বিন্দুমাত্র ইতস্তত না করে ঘ্যাঁচ করে বসিয়ে দিল নিজের কব্জিতে। বাইরেটা জং ধরা হলেও ব্লেডটা যথেষ্ট ধারাল। ডান হাতের পর বাঁ হাতের কব্জিও কেটে ফেলল রনি। দু’হাতের শিরাই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে, স্রোতের বেগে রক্ত বেরুচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে দুনিয়া আঁধার হয়ে এল, দড়াম করে পড়ে গেল ও।

কুকুরটাকে নিয়ে ওরা দু’জন যখন রনির কাছে পৌঁছুলেন ততক্ষণে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে যাত্রা করেছে সে। আর ওদিকে মৃত রনিকে ছেড়ে গুহায়, নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে এল ভিনগ্রহের হন্তারক।

পাঁচ

রাতটা দুঃস্বপ্নের মত কাটল জন বেরেটের। পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ-এরচে’ করুণ ব্যাপার কী হতে পারে? আচ্ছন্নের মত বাড়ি ফিরেছেন তিনি। ফোন করে খবরটা দিয়েছেন শার্লিকে। শার্লি যেন মনে মনে প্রস্তুত হয়েই ছিল এরকম একটা দুঃসংবাদ শুনবে। তার মন বলছিল রনিকে আর কোনদিন জীবিত দেখতে পাবে না সে। খবরটা শোনার পর থেকে পাথর হয়ে গেছে শার্লি

এদিকে র‍্যালফ রকফিল্ড খবর দিয়েছেন উইলকক্সের শেরিফকে। বিশ মাইল দূর থেকে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এলেন তিনি, সাথে করোনার। ঝোপের আড়াল থেকে শেরিফের লোক রনির লাশ উদ্ধার করল, স্ট্রেচারে তুলে অ্যাম্বুলেন্সে ঢোকাল। শহরে আবার ছুটে চলল অ্যাম্বুলেন্স মরদেহ নিয়ে।

বার্টলসভিলের শবাগারে লাশ পরীক্ষা করে করোনার ঘোষণা করল-কাটা কব্জি থেকে অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের কারণেই মারা গেছে রনি। এটা স্পষ্ট আত্মহত্যা। কিন্তু প্রশ্ন হলো-রনির মত প্রাণ চঞ্চল, স্বাস্থ্যবান ছেলে আত্মহত্যা করবে কেন? আর অবাক ব্যাপার রনি আত্মহত্যা করেছে ভাঙা, জং ধরা পকেট নাইফ দিয়ে। শেরিফকে জন জানালেন তিনি জীবনেও রনির কাছে ভাঙা ছুরি দেখেননি। তা ছাড়া রনি যখন তাদের সামনে দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছিল, শপথ করে বললেন র‍্যালফ এবং জন, রনির হাতে কিছুই ছিল না। যেখানে বসে কাজটা করেছে ছুরিটা ওখান থেকেই নিয়েছিল রনি। কিন্তু ও কি আসলেই জানত যে ছুরিটা ওখানেই থাকবে। আর অন্ধকারে ওটার খোঁজই বা পেল কীভাবে সে?

‘ঠিক আছে,’ বললেন শেরিফ। ‘কাল দুটোর দিকে আমি অনুসন্ধান দল পাঠিয়ে দেব।’ র‍্যালফের দিকে ঘুরলেন তিনি। ‘ভালকথা র‍্যালফ। আপনার মেয়ের সাথে কথা বলতে হবে আমার। শুনলাম বিকেলে সে রনির সাথেই ছিল। ওরা একসাথে নাকি সাঁতারও কেটেছে। তার একটা সাক্ষ্য দরকার।’

র‍্যালফ মাথা চুলকে কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘আমার মনে হয় তার দরকার নেই, শেরিফ। সবার সামনে সেদিনের ঘটনা নিয়ে সাক্ষ্য দিতে বিব্রত বোধ করবে মেয়েটা। সবাই ব্যাপারটা নিয়ে এমনভাবে কথা বলছে যেন ঘটনাটার জন্যে শার্লি দায়ী। আমার মেয়েকে আদালতে হাজির করতে পারব না, শেরিফ। সে লজ্জায় মরে যাবে শত শত মানুষের সামনে। ঠিক করেছি এখানে আর নয়। খামার বাড়িটা বিক্রি করে দিয়ে ক্যালিফোর্নিয়া চলে যাব সপরিবারে।’

এসব ঝামেলা সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত একটা বেজে গেছে। বাড়িটাকে এত নির্জন আর নিজেকে কখনও এত একাকী, নিঃসঙ্গ এবং অসহায় মনে হয়নি জন বেরেটের। রনিকে নিয়েই ছিল তাঁর সমস্ত স্বপ্ন। ভেবেছিলেন ছেলেটার বিয়ে দেবেন, নাতি-নাতনীর দাদু হবেন, চাঁদের হাট হয়ে উঠবে তাঁর সংসার। হায়, মানুষ যা ভাবে, সবসময় উল্টোটা ঘটে কেন?

ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বেরেট। চোখ ছাপিয়ে কান্না আসছে। নাহ্, র‍্যালফের মত তিনিও আর থাকবেন না এখানে। রনি নেই। আপনজন বলতে আর কে রইল তাঁর? এত বড় খামার বাড়ি দিয়ে কী হবে? তিনিও চলে যাবেন সব বিক্রি করে, যেদিকে দু’চোখ যায়।

রাতটা নির্ঘুম কাটল তাঁর চেয়ারে ঠায় বসে। পরদিন সকালে হঠাৎ কী মনে পড়তে মুখ হাত কোনমতে ধুয়েই ছুটলেন র‍্যালফ রকফিল্ডের বাড়িতে। র‍্যালফ তাঁর বাড়ির পেছনে, ছোট্ট বাগানে মর্নিং ওয়াক করছিলেন, জনকে দেখে ছুটে গেলেন।

শার্লি কেমন আছে, র‍্যালফ?’ ম্লান হেসে জিজ্ঞেস করলেন জন।

‘কাল সারারাত ঘুমায়নি। দেখে এলাম ঘুমাচ্ছে। তোমারও দেখছি একই দশা। কিন্তু এত সকালে কী মনে করে?’

‘তোমাকে বলতে এসেছি আমি আবার ওখানে যাচ্ছি।’

‘কোথায়?’

কাল রাতে যেখানে গিয়েছিলাম।’

‘কেন?’

দিনের আলোতে জায়গাটাতে ভাল করে চোখ বুলাতে চাই। আমার মন বলছে আমরা কিছু একটা মিস করে এসেছি। জিনিসটা কী জানি না, তবে শেরিফ অনুসন্ধান চালাবার আগেই একবার ওখানে ঢুঁ মারতে চাই।’

‘চলো, আমিও তোমার সাথে যাব।’

টাইগারকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন জন। অপেক্ষা করলেন র‍্যালফ পোশাক বদলে আসা পর্যন্ত। তারপর তিনজনে মিলে আবার যাত্রা শুরু হলো।

.

নিজের ওপর বিরক্ত লাগছে ভিনগ্রহের হন্তারকের। হোস্টকে তার হত্যা না করলেও চলত। ওকে স্রেফ অজ্ঞান করে রাখলেই হত। জ্ঞান ফিরে আসার পর রনির কিছুই মনে পড়ত না। ওরা হয়তো তখন রনিকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেত। ডাক্তার রুনির আকস্মিক স্মৃতি ভ্রংশের ব্যাপারটা ধরতে না পারলে যেত মনোবিজ্ঞানীর কাছে। এতে ভিনগ্রহের হন্তারকের ভাল হত। সে জানে বার্টলসভিল বা উইলকক্সে কোনও সাইকিয়াট্রিস্ট নেই। রনিকে নিয়ে যেতে হবে গ্রীনবে বা মিলওয়াকিতে। তাতে ওসব জায়গা সম্পর্কে জানতে পারত ভিনগ্রহের প্রাণীটি। ওখানে নতুন, রনির চেয়ে বুদ্ধিমান হোস্ট পেয়ে যাওয়া বিচিত্র কিছু ছিল না।

তবে নিজেকে কৃতকর্মের জন্যে বেশি দোষ দেয়াও যায় না। কারণ পৃথিবী নামের এ গ্রহে একেবারেই নতুন সে। সবকিছু বুঝে উঠতেও তো সময়ের প্রয়োজন।

এখন যে জায়গায় আছে সে, এখানকার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এদিকে মানুষ হোস্ট পাওয়া তার জন্যে খুবই কষ্টের হবে। এসব জঙ্গলে লোকজন কদাচিৎ আসে শিকার করতে। তবে সে যেখানে আস্তানা গেড়েছে, তার রেঞ্জের চল্লিশ গজের মধ্যে তারা যে এসে সুখে নিদ্রা যাবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? কাজেই নতুন কোনও মানুষ হোস্ট পেতে হলে প্রথমে তাকে জানোয়ার হোস্ট ব্যবহার করতে হবে। সেই জানোয়ারটাকে পাঠাতে হবে ঘুমন্ত মানুষের কাছে। তবে এতে ঝুঁকি আছে। অবশ্য এ ধরনের ঝুঁকি নিতে সে অভ্যস্ত। রনির স্মৃতি ঘেঁটে সে দেখেছে এদিকে হরিণের আনাগোনা! প্রচুর। হোস্ট হিসেবে পাখিদেরকেও ব্যবহার করা যেতে পারে। হতে পারে সেটা চিকেন হক বা পেঁচা। তবে পেঁচা তার ওজন নিয়ে উড়তে পারবে কিনা সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই তার।

শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিল সে হোস্ট হিসেবে পাখিই হবে তার উপযুক্ত। হরিণ-টরিণ পথ চলতে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে পারে। কিন্তু পাখিদের এসব ঝামেলা কম। পাখি হয়ে উড়ে, সুযোগ বুঝে ঘুমন্ত মানুষের ওপর সওয়ার হবে সে, তারপর পাখিটাকে মেরে ফেলবে। আর নতুন হোস্টের কাজ হবে তাকে এখান থেকে নিরাপদ কোনও জায়গায় সরিয়ে ফেলা।

তবে তাড়াহুড়োর কিছু নেই। এবার সে আস্তে-ধীরে ভেবেচিন্তে কাজ করবে। যাতে আর কোনও ভুল করে না বলে। তার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। মোটামুটি দশ মাইল দূরত্ব থেকেও সে মানুষ বা যে কোনও প্রাণীর হাঁটা-চলা বা নড়াচড়া টের পায়। যেমন এই মুহূর্তে সে মাটিতে কম্পন টের পাচ্ছে বুঝতে পারছে বড় ধরনের কিছু একটা এগিয়ে আসছে তার আস্তানার দিকে। একটা নয়, দুটো। একটু পর সে বুঝতে পারল দুটোও নয়, আসলে তিনটে প্রাণী হেঁটে আসছে। সে তার উপলব্ধি ক্ষমতা প্রয়োগ করল। এরা সেই তিনজন, গত রাতে টমির খোঁজে যারা এসেছিল। রনির বাবা, সেই মেয়েটির বাবা আর কুকুরটা। সোজা এগিয়ে আসছে গুহার দিকে। ওদের কথা শুনে বোঝা গেল রনির ট্রেইল ধরে আসার কারণ। ওরা জানতে চায় রনি কালরাতে দৌড়ে আসার আগে আসলে কোথায় ছিল।

কিন্তু কেন? এটা জেনে ওদের কী লাভ? কিন্তু ওরা যেভাবে গন্ধ শুঁকে আসছে তাতে সে ধরা পড়ে যাবে। বিশেষ করে যদি গুহার মেঝে খুঁড়ে ফেলে। ভিনগ্রহের প্রাণী রীতিমত অসহায় বোধ করল দেখে কুকুরটা ওদেরকে টেনে নিয়ে এসেছে ঠিক গুহামুখে। সে শুনতে পেল মেয়েটার বাবা অর্থাৎ র‍্যালফ বলছে, ‘গুহাটা দেখে মনে হচ্ছে রনি এর মধ্যে ঢুকেছিল।

রনির বাবা জন বললেন, ‘আমারও তাই ধারণা। আমিও ঢুকে দেখতে চাই ভেতরে কী আছে।’

‘এক মিনিট, জন,’ বাধা দিলেন র‍্যালফ। ‘গুহার ভেতর কী আছে আমরা কেউ জানি না। আগে টাইগারকে পাঠাই। ভিতরে কিছু থাকলে ও আমাদের সাবধান করে দেবে।’

‘ঠিক বলেছ,’ সায় দিলেন জন। টাইগারের বাঁধন খুলে দিলেন। কুকুরটা এক লাফে ঢুকে পড়ল ভেতরে।

এক মিনিট পর, টাইগারের তরফ থেকে কোনও সাবধান বাণী এল না দেখে দুই বুড়ো হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়লেন গুহায়। গুহার মাঝামাঝি জায়গায় এসে থামলেন। এখানে শুয়ে আছে টাইগার। গুহার এ জায়গাটা বেশ প্রশস্ত এবং উঁচু, দাঁড়ানো যায়। আলো কম হলেও মোটামুটি দেখতে পাচ্ছেন তাঁরা।

‘বোঝাই যায় রনি এ গুহায় ঢুকেছিল,’ বললেন র‍্যালফ, ‘এ পর্যন্ত এসেও ছিল। কারণ টাইগার ওর গায়ের গন্ধেই এখানে এসেছে। জায়গাটা বেশ ঠাণ্ডা আর নীরব। এসো, দু’মিনিট জিরিয়ে নিই, তারপর ফিরব।’

ওরা বসে পড়লেন গুহার মেঝেতে, ভিনগ্রহের হন্তারক নজর দিল কুকুরটার ওপর। ক্লান্ত টাইগার আরাম পেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ওকে এবার কাজে লাগাতে হবে। তবে এখন না, একটু পরে।

‘ভাবছি, রনি এখানে এসেছিল কেন?’ নীরবতা ভেঙে বললেন জন।

‘এটা তো সহজ যুক্তি, জন। অবচেতন মনে এখানে চলে এসেছিল ও। হয়তো ছোটবেলায় এ গুহাটা আবিষ্কার করেছিল রনি, হঠাৎ কোনও কারণে লুকোতে এসে পড়েছিল। অবচেতন মনে মানুষ কত কিছুই তো করে।’

হয়তোবা। কিন্তু ওর লুকোবার দরকার পড়েছিল কেন? নাকি কোনও লুকানো জিনিস খুঁড়ে বের করতে এসেছিল রনি। কী জিনিস জানতে চেয়ো না, তবে এ গুহার নরম বালি কিন্তু হাত দিয়ে খোঁড়া যায়।’

‘কিন্তু লুকোবেটা কী সে? আর খুঁড়তেই বা যাবে কেন?’

‘জানি না আমি। তবে তেমন কিছু যদি আমাদের চোখে পড়ত-’

আর সময় নেই। লোকগুলো যেভাবে সন্দিহান হয়ে উঠেছে এখনই হয়তো মেঝে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে দেবে। তা হলেই সর্বনাশ। ভিনগ্রহের হন্তারক মনোযোগ দিল ঘুমন্ত টাইগারের ওপর। দুজনকে হয়তো খুন করা সম্ভব হবে না টাইগারের পক্ষে, তবে আকস্মিক হামলায় ওরা নিশ্চয়ই অপ্রস্তুত হয়ে যাবে, মেঝে খোঁড়ার কথা আর মনে থাকবে না। উল্টো দৌড়াতে হবে ডাক্তারের কাছে টাইগারের কামড়ের কারণে সৃষ্ট ক্ষতের চিকিৎসা করতে।

টাইগারের ওপর সওয়ার হলো ভিনগ্রহের প্রাণী। ঘুম থেকে জেগে উঠল জানোয়ারটা, মাথা তুলল। সেই মুহূর্তে র‍্যালফ বললেন, ‘এখন খোঁড়াখুঁড়িতে কাজ নেই, জন। মেঝে খুঁড়ে কিছু পাব বলেও মনে হয় না। আর পরিষ্কার কিছু দেখাও যাচ্ছে না। আমাদের না আছে ফ্লাশলাইট না কোদাল বা বেলচা! আর এখন মেঝে খুঁড়তে গেলে লাঞ্চের আগে বাড়ি ফিরতে পারব না। তারচে’ এখন বাড়ি যাই চলো। খোঁড়াখুঁড়ি যদি করতেই চাও, পরে রেডি হয়ে আসব’খন।’

বন্ধুর কথায় সায় দিলেন জন। টাইগার আবার মাথা নামিয়ে নিল। দু’বন্ধুর পেছন পেছন বেরিয়ে এল গুহা থেকে। ওদের সাথে বেশ খানিকটা পথ,এক সাথে হাঁটল, হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। পুবে, বাড়ি থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে ছুটতে শুরু করল সে। জন কত ডাকাডাকি করলেন, কিন্তু কান দিল না টাইগার। আপন মনে দৌড়াতে লাগল।

মনিবের দৃষ্টির আড়াল হতেই লাফ মেরে জঙ্গলে ঢুকে পড়ল টাইগার, তারপর এগোল গুহা অভিমুখে।

গুহায় ঢুকে নরম বালু খুঁড়ল টাইগার, কচ্ছপের খোলস বা ভিনগ্রহের হন্তারককে মুখে তুলে নিল। বেরিয়ে এল গুহা থেকে, খোলসটাকে সাবধানে নামিয়ে রাখল জমিনে। তারপর আবার গুহায় ঢুকল সে, একটু আগে খোঁড়া গতটাকে বুজিয়ে দিল সতর্কতার সঙ্গে। তারপর বোজানো গর্তের ওপর গড়াগড়ি খেল কয়েকবার। বোঝার উপায় রইল না এখানে কোনও গর্ত আছে। তারপর আবার কচ্ছপের খোলসটাকে মুখে তুলে নিল টাইগার। প্যাট্রিজ পাখির চেয়ে ভারি নয় ওটার শরীর, আর এত আলতোভাবে ধরে রেখেছে টাইগার যেন আহত পাখি মুখে করে নিয়ে চলেছে।

জঙ্গলে ঢুকল কুকুর, রাস্তা এমনকী গেম ট্রেইলও এড়িয়ে চলল, অত্যন্ত নির্জন জায়গা খুঁজছে। ঘন, লম্বা ঘাস, চারদিকে ঝোপের বেড়ার আড়ালে ছোট, ফাঁপা একটা কাঠের গুঁড়ি পেয়ে গেল। অন্তত কিছু সময়ের জন্যে এখানে লুকিয়ে থাকার কাজ চলবে। মুখ থেকে কচ্ছপের খোলটাকে ফাঁপা কাঠের গর্তে রাখল টাইগার, থাবা দিয়ে ধাক্কা মেরে ওটাকে ঝোপের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। কারও বোঝার সাধ্য নেই এখানে গুঁড়ি আছে।

তারপর যে পথে এসেছিল সে পথে ফিরে চলল টাইগার। একশো গজ যাবার পর বসে পড়ল। ভিনগ্রহের হন্তারক তখন ভাবছে কী করা যায়।

ভিনগ্রহের প্রাণী এখন নিরাপদেই আছে। ওই লোকগুলো এখন সমস্ত গুহা খুঁড়ে ফেললেও তার কিছু এসে যাবে না। কিন্তু কথা হলো, কুকুরটাকে সে কি আরও কিছুক্ষণের জন্যে নিজের হোস্ট করে রাখবে? ব্যাপারটা নিয়ে ভাবল সে। তারপর সিদ্ধান্তে পৌছল-জানোয়ারটা তার উদ্দেশ্য পূরণ করেছে। এখনও ওটাকে বাঁচিয়ে রাখলে সে অন্য কারও ওপর সওয়ার হতে পারবে না। এখন তার দরকার অন্য কোনও হোস্ট। হতে পারে সেটা বাজ, পেঁচা বা হরিণ। কিন্তু এগুলোকে ভালমত পর্যবেক্ষণ করার সময় সে পাবে না যতক্ষণ টাইগারের ওপর সওয়ার হয়ে থাকবে। কাজেই ওর মরে যাওয়াই ভাল।

টাইগার এবার রাস্তায় উঠে এল। দাঁড়িয়ে থাকল এক কোণে। দূর থেকে একটা গাড়ি আসছে। ড্রাইভার কিছু বুঝে ওঠার আগেই, গাড়িটা তার সামনে আসতেই, চাকা লক্ষ্য করে লাফ দিল টাইগার। সাথে সাথে পিষে ভর্তা হয়ে গেল কুকুরটা।

টাইগারের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ভিনগ্রহের হন্তারক, আশ্রয় নিল নিজের খোলের মধ্যে। ভেবে আমোদিত হলো এবার সে আর কোন ভুল করেনি

হ্যাঁ, ভুল তার হত না, যদি গাড়িটার আরোহী ড. সি. আর. আবরার না হয়ে অন্য কেউ হত। তার আসলে অপেক্ষা করা উচিত ছিল অন্য গাড়ির জন্য। কারণ, ভিনগ্রহের হন্তারকের জানা নেই টাইগারকে ড. সি. আর. আবরারের গাড়ির নীচে ফেলে দিয়ে আসলে সে’ নিজের নিয়তিকেই ডেকে এনেছে।

ছয়

ড. সি. আর. আবরার ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অভ টেকনোলজি’র পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালরে পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন। পিএইচডি করতে আমেরিকায় আসার পরে আর দেশে ফিরে যাননি। ডক্টরেট নেয়ার পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই থেকে গেছেন। সম্ভব মেধাবী, পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষটিকে বেঁটেই বলা যায়- টেনেটুনে পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি হবেন। তাঁর কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল রাতের মত কালো, মাঝেমধ্যে ঝিলিক দেয় দু’একটি রুপোলি কেশ। চিরকুমার এই ভদ্রলোকের চেহারার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো বুদ্ধিদীপ্ত চোখ জোড়া। কোনও কারণে রেগে গেলে বা অবাক হলে ও দুটো বাদামী হিরের মত ঝকঝক করে জ্বলতে থাকে।

এ মুহূর্তে তিনি ছুটিতে আছেন। তাঁর পরনে ঢিলেঢালা পোশাক, মুখে কয়েকদিনের না কামানো দাড়ি। দেখে বোঝার উপায় নেই এ মানুষটি দেশের সবচে’ পণ্ডিত ব্যক্তিদের একজন।

টাইগার যে তাঁর গাড়ির নীচে চাপা পড়ল, এ জন্যে আবরারকে মোটেই দোষ দেয়া যায় না। কুকুরটা যেন শূন্য থেকে উদয় হয়েছিল তাঁর সামনে। তিনি ব্রেকও কষেছিলেন। কিন্তু তাঁর আগেই দফারফা হয়ে গেল টাইগারের।

পশুপ্রেমী প্রফেসরের জানোয়ারটার দশা দেখে বেশ মন খারাপ হলো। কার কুকুর এটা? প্রফেসর ঠিক করলেন শহরে নিয়ে যাবেন লাশ। খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করবেন কুকুরের মালিকের। তারপুলিন দিয়ে টাইগারের লাশ ভালভাবে জড়িয়ে নিয়ে গাড়িতে আবার স্টার্ট দিলেন আবরার।

বার্টলসভিলে পৌঁছে দু’এক জায়গায় খোঁজ নেয়ার পর জানা গেল এটা জন বেরেটের কুকুর। তবে জন বাড়ি নেই। আদালতে গেছেন ইনকোয়েস্টে। আবরার ওখানেই রনির কথা জানতে পারলেন। শুনলেন’ জনের একমাত্র ছেলে রনি আত্মহত্যা করেছে।

আদালতে গিয়েও জনকে পাওয়া গেল না। শুনানি শেষে মরচুয়ারিতে গেছেন ছেলের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নিয়ে কথা বলতে। আবরার তখন শেরিফের সাথে কথা বললেন। কুকুরটা হঠাৎ আবরারের গাড়ির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, শুনে বিস্ময় প্রকাশ করলেন শেরিফ। বললেন, ‘যদ্দূর জানি জনের কুকুরটা ছিল কারশাই জাতের। গাড়ি দেখলে এক মাইল দূর থেকে ছুটে পালাত।

‘তাই নাকি?’ অবাক হলেন আবরারও। ‘তা হলে ককুরচীর নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। নইলে ওভাবে ছুটে আসবে কেন আমার গাড়ি লক্ষ্য করে। ভাল কথা- আপনাদের এলাকায় র্যাবিস রোগের কোনও কেস আছে?’

‘বহুদিন হলো আমরা ও রোগটার কবল থেকে মুক্ত, মি. আবরার,’ নীরস গলায় জবাব দিলেন শেরিফ। একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ডক্টর, তারপর বললেন, ‘শুনলাম রনি নামে একটা ছেলে মারা গেছে। এর কি অটোপসি করা হয়েছে?’

‘অটোপসি কেন, কীসের জন্য? ও তো আত্মহত্যা করেছে।’ শুরু কুঁচকে জবাব দিলেন শেরিফ।

‘এখানে আর কোনও অদ্ভূত মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, শেরিফ?’

কৌতুকের দৃষ্টিতে ডক্টরের দিকে তাকালেন শেরিফ!

‘অদ্ভূত বলতে কী বোঝাতে চাইছেন বুঝতে পারছি না। এখানে গত কয়েক বছরে কিছু হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। ওগুলো এখনও অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। তবে সেগুলো ছিল সেফ ডাকাতির জন্যে খুন। ওসবের মধ্যে অদ্ভুত কোনও ব্যাপার ছিল না। কিছু মনে করবেন না, মি. আবরার, আপনি কি ভার্সিটিতে অপরাধ বিজ্ঞান পড়ান?’

‘না,’ মৃদু হেসে জবাব দিলেন আবরার। ‘আমি পদার্থ বিজ্ঞান পড়াই। বিশেষ করে ইলেক্ট্রনিক্স নিয়ে নাড়াচাড়া করি। আমি স্যাটেলাইট প্রোগ্রামের ওপরেও কিছু কাজ করেছি।’

‘তার মানে রকেট?’ শেরিফের গলার স্বরে সম্ভ্রম ফুটল।

‘না, রকেট না। বেশিরভাগই স্যাটেলাইটের ডিটেকটর এবং ট্রান্সমিটিং সেট নিয়ে কাজকারবার। আমি প্যাডলহুইল স্যাটেলাইটের ডিজাইনও করে থাকি। তবে এ মুহূর্তে মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত।’

‘বেশ, বেশ! কোথায় উঠেছেন আপনি?’

‘এখান থেকে মাইল দশেক দূরে এক খামার বাড়িতে। জায়গাটার নাম ওল্ড বার্টন প্লেস….

‘হেস্টিংস-এর খামার বাড়ি তো? চিনেছি। হেস্টিংস-এর সাথে আগে দু’একবার মোলাকাত হয়েছে। তা একা নাকি স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন?’

‘বিয়ে-থা করিনি এখনও। একা থাকতেই ভাল লাগে। যাকগে, শেরিফ। আজ উঠি। জনের কুকুরের লাশটা নিয়ে গেলাম। ওকে বলবেন আমি লাশ কবর দিয়ে দেব।’

শেরিফের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের গাড়িতে উঠলেন ড. আবরার। মনটা খচখচ করছে। রনি আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু আত্মহত্যার ব্যাপারটা মেনে নিতে চাইছে না তাঁর যুক্তিবাদী মন। মানুষ প্রাথমিক কোনও লক্ষণ ছাড়াই হঠাৎ পাগল হয়ে যেতে পারে না বা আত্মহত্যাও করে না। আর কুকুরটা নিশ্চয়ই র‍্যাবিস আক্রান্ত ছিল। নইলে অমন উন্মাদের মত আচরণ করবে কেন? শেরিফ বললেন ওটা গাড়ি-ঘোড়া ভয় পেত। তা হলে, আবরারের গাড়ির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল কেন? ওটাও আত্মহত্যা? কিন্তু লেমিং ছাড়া অন্য কোনও পশু আত্মহত্যা করে বলে শোনেননি আবরার।

হঠাৎই সিদ্ধান্ত নিলেন ডক্টর গ্রীনবে-র গবেষণাগারে কুকুরটার লাশ পাঠাবেন পরীক্ষার জন্যে তা হলে জানা যাবে টাইগারের র‍্যাবিস ছিল কি না। গ্রীনবে এখান থেকে পঁয়তাল্লিশ মাইল দূরে। আর এখন বাজে মাত্র তিনটা। তিনি গ্রীনবের হাসপাতালে টাইগারের লাশ পরীক্ষার জন্যে রেখে আসার প্রচুর সময় পাচ্ছেন হাতে। সন্ধ্যেটা ভাল কোনও রেস্টুরেন্টে ডিনার খেয়ে, তারপর ছবি দেখে সকাল সকাল ফিরে আসা যাবে বাড়িতে।

তাই করলেন আবরার। গ্রীনবের হাসপাতালে গেলেন টাইগারের লাশ নিয়ে। ডিনার খেলেন, ব্রিজিত বার্দোর একটি সিনেমা দেখলেন, তারপর সাড়ে দশটা নাগাদ, উইলকক্সে, তাঁর বন্ধুর হেস্টিংস-এর খামার বাড়িতে ফিরে এলেন।

বাড়িটি বেশ বড়, ওপর তলায় তিনটি বেডরুম, যদিও দুটো রুম শুধু ফার্নিশড করা। একটা বাথ। নীচতলায়ও তিনটে ঘর, বড় একটা কিচেন, লিভিং রুমটাও বেশ বড়সড়, আর বাড়তি একটা কামরা আছে, স্টোররুম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এ ঘরে আবরার তাঁর বন্দুক এবং মাছ ধরার সরঞ্জাম রেখে দিয়েছেন। বেজমেন্টে ছোট গ্যাসোলিন ইঞ্জিনচালিত জেনারেটর আছে, বিরতিহীন বিদ্যুৎ উৎপাদন করে চলেছে। একই ইঞ্জিনের সাহায্যে পাম্প করে ছাদের ট্যাঙ্কিতে পানি তোলার ব্যবস্থা আছে। এ বাড়িতে ফোন নেই, তবে প্রফেসরের তাতে কোনও অসুবিধেও নেই। বরং তিনি খুশি ফোন নামের মূর্তিমান যন্ত্রণাটার হাত থেকে রেহাই পেয়ে। এ বাড়ির দক্ষিণ দিকে একসময় খামার ছিল, কোনও কারণে ওটা এখন পরিত্যক্ত। বাড়ির চারপাশে উঠোন, মিশেছে ঝোপঝাড় আর জঙ্গলের সাথে, জায়গাটাকে রহস্যময় এবং বুনো করে তুলেছে। উত্তর দিকে শুধু একটা রাস্তা, শহরের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। তবে ওদিকেও ঘন জঙ্গল।

সবমিলে জায়গাটা ডক্টরের এতদিন ভালই লাগছিল, শুধু আজকের রাতটা ছাড়া।

আবরার ফ্রিজ খুলে বিয়ারের ক্যান বের করে একটা রহস্য উপন্যাস নিয়ে বসলেন। কিন্তু পড়ায় মন দিতে পারলেন না। কেন জানি অস্বস্তি লাগছে তাঁর। এখানে আসার পর এই প্রথম খুব একা এবং নিঃসঙ্গ লাগছে। জানালার পর্দা নামিয়ে দেয়ার একটা দুরন্ত ইচ্ছে অনেক কষ্টে দমিয়ে রাখলেন তিনি। কারণ তাঁর মনে হচ্ছিল কেউ বুঝি তাঁকে বাইরে থেকে লক্ষ করছে। কিন্তু জানালায় দাঁড়িয়ে কে তাঁকে লক্ষ করবে? কোনও জানোয়ার? জানোয়ার হলেই বা কি এসে যায়? কেউ তাঁকে দেখছে, ভাবনাটা নিজের কাছেই এক সময় হাস্যকর ঠেকল। তিনি জোর করে পড়ায় মন দিলেন খানিক পর খেয়াল করলেন বইয়ের পাতায় চোখ বোলাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু একটা লাইনও পড়ছেন না। বারবার রনি আর কুকুরটার কথা মনে পড়ছে। শেষে নিজের ওপরই বিরক্ত হয়ে উঠলেন আবরার। কাল তো টাইগারের রিপোর্ট পাওয়াই যাবে। যদি দেখেন কুকুরটার সত্যি সত্যি র‍্যাবিস হয়েছিল, তা হলে ব্যাপারটা চুকে গেল। এ নিয়ে আর ভাববেন না। ছুটি কাটাতে এসেছেন। মজা করে ছুটি কাটিয়ে চলে যাবেন…কিন্তু টাইগারের যদি র‍্যাবিস ধরা না পড়ে…

আরও এক ক্যান বিয়ার গলায় ঢাললেন প্রফেসর, একসময় ঝিমুনি ভাব এল। বিছানায় গেলেন তিনি। খানিক পর ঘুমিয়েও পড়লেন।

সাত

ভিনগ্রহের হন্তারক এখনও সেই ফাঁপা কাঠের গুঁড়ির মধ্যেই ঘাপটি মেরে আছে। টাইগার তাকে এখানে রেখে যাবার পর থেকে সে আস্তানা ছেড়ে একপাও নড়েনি। শুধু একবারের জন্যে একটা কাকের ওপর ভর করেছিল। আশপাশের এলাকা দেখার ইচ্ছে জেগেছিল তার। রাতের বেলা ঘুমন্ত এক কাকের ওপর সওয়ার হয় সে। কিন্তু কাক রাতে ভাল দেখতে পায় না বলে ওই সময় আর বেরোয়নি সে। বেরিয়েছে সকালে। কাকের চোখ দিয়ে আশপাশের অনেকটা এলাকা মোটামুটি জরিপ করে এসেছে। দেখেছে কোন্ ধরনের লোকজনের বাস এখানে। রাস্তার একেবারে শেষ মাথায় উড়ে গিয়েছিল কাক। ওখানে একটা স্টেশন ওয়াগন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে সে। বার্টলসভিলের ওপরে চক্কর দিয়েছে বারকয়েক। তাকে সবচে’ আকর্ষণ করেছে রেডিও-টিভি মেরামতের একটি দোকান। এ দোকান যে লোক চালায় তার নিশ্চয়ই ইলেক্ট্রনিক্স সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান আছে। কাজেই এ লোক তার ভাল হোস্ট হতে পারবে। অন্তত কিছুক্ষণের জন্য হলেও। কিন্তু রনির স্মৃতি যেটুকু ধারণ করে আছে সে, তাতে রিপেয়ারম্যানের নাম পরিচয় নেই তার। এসব জানতে হলে আরও ব্যাপক অনুসন্ধানের প্রয়োজন।

বার্টলসভিল পরিক্রমা মোটামুটি শেষ হলে সে কাকটাকে পেভমেন্টের ওপর ডাইভ দিতে বাধ্য করে তাকে হত্যা করেছে। কাকের কাজ শেষ। কাজেই ওটাকে আর জঙ্গলে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার প্রয়োজন বোধ করেনি সে। কাকের মৃত্যুর সাথে সাথে ভিনগ্রহের হন্তারক ফিরে গেছে নিজের নিরাপদ আশ্রয়ে।

এই আশ্রয়স্থলটি আগেরটার চেয়ে ভাল জঙ্গলের একেবারে গভীরে বলে নানা পশুপাখি চেনার সুযোগ তার হয়েছে। প্রাণীগুলো প্রায়ই তার আস্তানার সামনে দিয়ে হাঁটা চলা করছে। হরিণ, ভালুক, ভোঁদর আরও কত কী। কত রকম পাখিও দেখেছে সে। এর মধ্যে দুটো পাখি পছন্দ হয়েছে তার হোস্ট হিসেবে-পেঁচা এবং চিকেন হক। এসব প্রাণীর যে কোনওটার ওপর যে কোনও সময় সে ভর করতে পারে। দশ মাইলের মধ্যে এগুলোর একটাকে ঘুমন্ত অবস্থায় পেলেই হলো।

ছোট ছোট প্রাণীও পরীক্ষা করে দেখেছে সে। যেমন সাগ। তবে হোস্ট হিসেবে সাপ পছন্দ হয়নি তার। এগুলোর গতি ধীর-আর মরতেও সময় নেয় বেশি। দেখা গেল রাস্তায় উঠেছে মরতে, গাড়ির জন্যে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর একটাতে চাপা পড়ে গেলেও সাপ যে সত্যি সত্যি মারা যাবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? পিঠ ভেঙে যাবার পরেও অনেকক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে সাপ।

কাজেই সে চুপচাপ বসে আছে। কাকে হোস্ট বানানো যায় তাই ভাবছে। এমন সময় তার খিদে পেল। ভিনগ্রহের এই প্রাণীটির খিদেও পায়। তারও পুষ্টির প্রয়োজন। সে যে গ্রহ থেকে এসেছে, ওখানকার অধিবাসীদের জন্ম মূলত পানি থেকে। পানি থেকে সরাসরি মাইক্রোঅর্গানিজম শুষে নিয়েছে নিজেদের মধ্যে। প্রটেকশন বা নিরাপত্তার জন্যে তারা শরীরের ওপর কচ্ছপের খোলের মত খোলস পেয়েছে। অন্যদের হোস্ট বানানো বা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তারা পেয়েছে অনেক পরে, নিজেদের বুদ্ধিমত্তার সমৃদ্ধি ঘটার সঙ্গে। তারপর তারা পানি ছেড়ে ডাঙায় উঠে এসেছে। ডাঙায় যে সব প্রাণী ঘুমাচ্ছিল, তাদের ওপর তারা সওয়ার হয়েছে। ডাঙার প্রাণীদের মেরে তারা একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার শুরু করে কয়েকশো কোটি বছর আগে, তাদের গ্রহে। মানুষের চেয়ে অনেক বুদ্ধিমান এবং শক্তিশালী হলেও এদের পুষ্টি প্রয়োজন হয় মানুষের মতই। তবে মোটামুটি একবার খাওয়ার পর কয়েকমাস না খেয়ে কাটিয়ে দিতে পারে তারা। পানির বাসিন্দা বলে তরল খাদ্যই এদের প্রিয়। আর খিদে পেলে, খাবার না জুটলে এরা দুর্বল হয়ে পড়ে। যেমন, ভিনগ্রহের হন্তারকের এখন খুব খিদে পেয়েছে। কীভাবে খাবার জোগাড় করা যায় তাই ভাবছে। সুপ বা দুধ পেলেই তার চলে যাবে। কিন্তু খাবারটা জোগাড় করে দেবে কে? এ ক্ষেত্রে মানুষ হোস্টকেই তার পছন্দ হলো। আর তার আশপাশে এরকম হোস্ট আছে এক বৃদ্ধ জার্মান দম্পতি হেলমুট এবং নিকোল কোহল। ওরা কাছের এক ফার্ম হাউজে থাকে। ওদের কাউকে ঘুমন্ত অবস্থায় পেলেই হলো। খাবার সমস্যা মিটে যাবে। কিন্তু আগে তো খামার বাড়িতে তাকে পৌঁছতে হবে।

ভিনগ্রহের প্রাণী খামার বাড়িতে যাবার জন্য বেছে নিল এক ঘুমন্ত পেঁচাকে। ওটাকে উড়িয়ে নিয়ে এল কোহলদের খামার বাড়ির ওপর।

পেঁচাটা ভিনগ্রহের হন্তারক অর্থাৎ কচ্ছপের খোলাটাকে নখে বাধিয়ে নিয়ে এসেছে। সে বাড়ি ঘিরে একবার চক্কর দিল। ফার্ম হাউজটা অন্ধকার, নীরব। সম্ভবত কুকুর-টুকুর নেই। ভিনগ্রহের অপরাধীর ইচ্ছে এ বাড়ির কোথাও লুকিয়ে থাকবে। লুকোবার চমৎকার জায়গাও পাওয়া গেল-কাঠের সিঁড়ির নীচে, যেটা মিশেছে ব্যাকডোরের সাথে। পাশেই খড়ের গাদা। এখানে আসার কারণ একটাই—এখন থেকে মানুষকে হোস্ট বানানো সহজ হবে তার জন্যে। তা ছাড়া খড়ের গাদার আশপাশে কী ধরনের প্রাণীর বাস তাও দেখা যাবে। প্রয়োজনে গৃহপালিত কোনও প্রাণীর ওপর সওয়ার হবে সে।

পেঁচাটা সিঁড়ির নীচে ভিনগ্রহের প্রাণীটাকে লুকিয়ে ফেলল। এখন আর ওকে প্রয়োজন নেই। পেঁচাটাকে ডাইভ দেওয়াল সে বাড়ির শক্ত দেয়াল লক্ষ্য করে। তবে ভুল হয়ে গেল। পেঁচাটা ডাইভ দেয়ার সময় চোখ বুজে ছিল। তাই দেয়ালে না লেগে আছড়ে পড়ল জানালার ওপর। ভেঙে গেল জানালার কাঁচ। ঝনঝন শব্দে জেগে উঠল কোল দম্পতি। তাড়াতাড়ি নেমে এল বাইরে। একটা পেঁচা মাটিতে পড়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে দেখে অবাক হয়ে গেল ওরা। বুড়ো হেলমুট বন্দুকের এক গুলিতে পেঁচাটাকে যন্ত্রণার হাত থেকে চিরতরে রেহাই দিয়ে দিল। বলল, ‘বেচারা বোধ হয় অন্ধ। দেখতে পায়নি। তাই ওড়ার সময় জানালায় ধাক্কা খেয়েছে।’

‘এটাকে নিয়ে কী করবে এখন?’ জানতে চাইল বুড়ি। ‘এভাবে ফেলে রাখবে?’

‘কাল সকালে কবর দেব,’ গরগর করল হেলমুট। ‘ব্যাটার জন্য কাল আবার আমাকে শহরে যেতে হবে গ্লাস কিনতে।

‘কাল যেতে হবে না,’ বলল তার স্ত্রী। শনিবার গেলেই চলবে। আমি ফাঁকা জায়গায় কাপড় টাঙিয়ে দেব। এখন চলো শোবে।’

বুড়ো-বুড়ি ঢুকে পড়ল নিজেদের বেডরুমে। খানিকপর আগের মত আবার নিস্তব্ধ হয়ে পড়ল গোটা বাড়ি। ভিনগ্রহের প্রাণী দেখল বুড়ো-বুড়ি এখনও ঘুমায়নি। সে অপেক্ষা করতে লাগল ওরা কখন ঘুমিয়ে পড়বে। এই ফাঁকে সে খামার বাড়ির গৃহপালিত প্রাণীগুলোর ওপর নজর বোলাতে লাগল। জানতে চায় হোস্ট হিসেবে কোনটাকে ভবিষ্যতে কাজে লাগানো যাবে।

এই বাড়িতে শুয়োর আছে একটা, একটা ঘোড়া, তিনটে গরু, কতগুলো ইঁদুর আর একটা বেড়াল। শুয়োর আর ইঁদুরগুলোকে প্রথমেই বাতিল করে দিল সে ওরা কোনও কাজে লাগবে না ভেবে। গরু বরং ওদের চেয়ে ভাল। গায়ে শক্তিও আছে বেশ। ধারাল শিং নিয়ে গরুগুলো যখন তখন কিলিং- মেশিনে পরিণত হতে পারে। ঘোড়াও তাই। গরুর চেয়েও এরা কাজের। দ্রুত দৌড়াতে পারে, সহজে টপকে যেতে পারে ছোটখাট বেড়া। আর ওদের খুরের লাথি শিং-এর গুঁতোর চেয়েও ভয়ঙ্কর।

সবশেষে রইল বেড়াল। এ প্রাণীটাকেই ভিনগ্রহের খুনের পছন্দ হয়ে গেল সবচে’ বেশি। রনির ধার করা স্মৃতি থেকে সে জানে চার পেয়ে এই প্রাণীটা বেশ বুদ্ধিমান, রাতের আঁধারে এদের চোখ জ্বলে। এরা গুপ্তচর বৃত্তিতে খুবই পটু, তা ছাড়া বেশিরভাগ সময় ওরা ঘুমিয়ে কাটায় বলে এদের হোস্ট বানানো ভারী সোজা। স্রেফ পরীক্ষা করার জন্য সে একটা ঘুমন্ত বেড়ালের ওপর সওয়ার হলো। জেগে উঠল বেড়াল। সম্মোহিত অবস্থায় হাঁটা দিল। নাহ্, আঁধারে সত্যি চোখ জ্বলে এই প্রাণীটার। সব কিছু দিনের মত দেখতে পাচ্ছে। সে বেড়ালটাকে বাড়ির চারপাশে কয়েকবার চক্কর দেওয়াল। নিঃশব্দে, সামান্য শব্দও না করে বেড়ালটার এই পরিভ্রমণ চমৎকৃত করে তুলল ভিনগ্রহের হন্তারককে। বেড়াল কেমন গাছ বাইতে পারে দেখার জন্য খড়ের গাদার পেছনে একটা গাছে ওটাকে তুলল সে। সরসর করে গাছের মাথায় উঠে গেল বেড়াল। মগডাল থেকে উঁকি দিল। আরেকটা খামার বাড়ি চোখে পড়ল, মুখ ফিরিয়ে আছে শহরের দিকে। এখন দেখা যাক বেড়াল কেমন গুপ্তচরের কাজ করতে পারে। গাছ থেকে বেড়ালটাকে নামাল সে, মাঠ ধরে ছোটাল পাশের খামার বাড়ির দিকে। রাতের আঁধারে ছায়ার মত ছুটে চলল বেড়াল।

ফার্ম হাউজে পৌছে দেখল দোতলার দুটো কাঁচের জানালায় আলো জ্বলছে। জানালার পাশে একটা গাছ। বেড়ালটা গাছে উঠল। তারপর উঁকি দিল জানালায়।

ঘরে, খাটের উপর একটা বাচ্চা শুয়ে আছে, কাশছে বেদম। বাথরোব পরা, স্লিপার পায়ে এক মহিলা করুণ মুখ করে ঝুঁকে আছে বাচ্চাটার ওপর। আর পাজামা পরা মোটা এক লোক দাঁড়িয়ে আছে দোরগোড়ায়। জানালা বন্ধ থাকলেও বেড়াল ওদের কথা পরিষ্কার শুনতে পেল। লোকটা মহিলার কাছে জানতে চাইছে ডাক্তারকে ফোন করবে কিনা।

দৃশ্যটা ভিনগ্রহের প্রাণীর মনে কোনও কৌতূহলের সৃষ্টি করল না। তবে সে সন্তুষ্ট হয়েছে বেড়ালের গুপ্তচর বৃত্তিতে। ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে সে বেড়ালকেই হোস্ট বানাবে। আপাতত এটার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাক।

রেহাই মিলল সহজেই। এ খামার বাড়িতে ভয়ানক হিংস্র স্বভাবের একটা কুকুর বাঁধা ছিল শিকল দিয়ে। সে সম্মোহিত বেড়ালটাকে গাছ থেকে নামিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে চলল গোলাবাড়ির কোণার দিকে, ওখানেই বাঁধা কুকুরটা, বেড়ালটাকে দেখেই দাঁতমুখ খিঁচিয়ে গর্জন ছাড়তে লাগল কুকুরটা। গোলাবাড়ির জানালায় এসে দাঁড়াল বেড়াল, ঘন অন্ধকারে চোখ সইয়ে নিল। তারপর লাফ দিল কুকুরটার হাঁ করা ধারাল চোয়াল লক্ষ্য করে।

আট

ভিনগ্রহের হন্তারক কোলদের গোলাবাড়ির সিঁড়ির নীচে, নিজের শরীরের মধ্যে আবার ফিরে এল। সতর্ক হয়ে লক্ষ করল বাড়িতে কোহল আর তার স্ত্রী ছাড়া অন্য কেউ আছে কিনা। কুকুর থাকলে ঘেউ ঘেউ করে উঠে ওদের জাগিয়ে দিতে পারে। নাহ্, কুকুর নেই, শুধু নীচের ঘরে, সম্ভবত লিভিংরুমে খাঁচায় পোরা একটা ক্যানারি পাখি আছে। ওই ঘরে তার হোস্টের যাবার প্রয়োজন হবে না।

দোতলার বেডরুমে হেলমুট এবং নিকল কোহল ইতোমধ্যে নাক ডাকার প্রতিযোগিতা শুরু করেছে।

হেলমুটের মনের ভেতর ঢুকে গেল ভিনগ্রহের প্রাণী। এক লহমায় জেনে ফেলল অনেক কিছুই।

হেলমুট ক্লাস সিক্স পাস, বাইরের জগৎ সম্পর্কে তার জ্ঞান খুবই কম। তবে দুটো জিনিস জেনে উপকার হলো ওটার। জানল, হেলমুটের স্ত্রী’র ঘুম অত্যন্ত গাঢ়, কানের পাশে বোমা ফাটলেও সে ঘুম থেকে জাগবে না। আর আসল ব্যাপার হলো-ভিনগ্রহের প্রাণী এতক্ষণ যা খুঁজছিল তা পেয়ে গেছে। ওদের বাড়ির ফ্রিজে অনেক খাবার আছে। বিশেষ করে সুপ আর গরুর ঝোলের কথা জেনে খিদেটা চাগিয়ে উঠল। ওর পুষ্টির অভাব ঘোঁচাতে পারবে দুটো জিনিসই। এই দম্পতি ওখানে না থাকলে হয়তো তাকে ফ্রিজ খুলে মাংস রেঁধে ঝোল খেতে হত। তবে সেটা কতটুকু পুষ্টিকর হত সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে ভিনগ্রহের খুনীর।

তার নির্দেশে বিছানা ছেড়ে নিঃশব্দে উঠে পড়ল হেলমুট। পা টিপে টিপে এগিয়ে চলল বেডরুমের দরজার দিকে। সাবধানে খুলল, তারপর সতর্কতার সাথে ভিজিয়ে দিল। এরপর এগোল কিচেনের দিকে।

ফ্রিজ খুলে সুপের জার আর মাংসের বাটি বের করল হেলমুট, দুটো একসাথে ঢালল একটা প্যানে, ভিনগ্রহের প্রাণীটা পেটপুরে যতটুকু খেতে পারে ততটুকু। দুটো তরল পদার্থ এক সাথে মিশিয়ে সে গ্যাসের স্টোভ জ্বালল। অল্প আঁচে গরম করল সুপ আর ঝোলের মিশ্রণটা। তারপর প্যান নিয়ে চলে এল বাইরে, গোলাবাড়ির সিঁড়ির সামনে। ঘন ঝোলের প্যান সিঁড়ির নীচে রেখে কচ্ছপের খোলটাকে বের করে আনল, ছেড়ে দিল তরলটার মধ্যে। তারপর দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ।

ঝোল খেতে খেতে ভিনগ্রহের প্রাণী হেলমুটের মনের আরও গভীরে ঢুকে তার সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য বের করে আনতে লাগল।

হেলমুটের বয়স পঁয়ষট্টি। সে একাচোরা স্বভাবের মানুষ। তার কোনও বন্ধু নেই। সে কাউকে পছন্দ করে না। অন্যরাও তাকে পছন্দ করে না। এমনকী তাঁর স্ত্রীও নয়। একে অন্যের প্রতি কারও বিন্দুমাত্র টান নেই। তারপরও দু’জনে একই ছাদের নীচে আছে স্রেফ ভিন্ন কারণে। নিকোল কোহলের যাবার কোন জায়গা নেই, নিজের রোজগার করার সামর্থ্যও নেই। আর হেলমুটের তাকে দরকার সংসারের যাবতীয় খুঁটিনাটি কাজ করে দেয়ার জন্যে।

তাদের দুই ছেলেমেয়ে। তবে কেউই তাদের সাথে থাকে না, হেলমুটের অত্যাচারে তারা বাড়ি ছেড়েছে অনেক আগেই। তারা শহরে থাকে। মাঝে মাঝে মাকে চিঠি লিখত। কিন্তু হেলমুট স্ত্রীকে কঠোরভাবে নিষেধ করে নিয়েছে চিঠির জবাব দিতে। তারপর থেকে দু’পক্ষের কারও সঙ্গেই কোনও যোগাযোগ নেই। নিকল কোল জানেও না তার ছেলেমেয়েরা এখন কোথায় আছে, কেমন আছে।

হেলমুট বাতের রোগী। দিন দিন রোগটা বেড়েই চলেছে। কিন্তু সে ডাক্তার দেখাবে না। কারণ ডাক্তারের ওপর তার বিশ্বাস নেই। কারও সঙ্গেই সে মেশে না। তার বাড়িতে ফোন নেই, সে কাউকে চিঠি লেখে না, কোনও ব্যক্তিগত চিঠিও আসে না তার নামে। বার্টলসভিলে হেলমুট যায় ঘোড়ায় টানা গাড়িতে শুধু শনিবার মুদি সদায় কিনতে। গাড়ি কেনেনি সে প্রয়োজন নেই বলে। দোকানে গেলেও কারও সাথে ‘হাই, হ্যালো’ বলার প্রয়োজন বোধ করে না হেলমুট, স্রেফ মাল কিনে চলে আসে। গত পনেরো বছরে নিজের খামার বাড়িতে থেকে বার্টলসভিলের বাইরে একপাও যায়নি সে। একেবারে নিঃসঙ্গচারী, অসামাজিক মানুষ বলতে যা বোঝায়, ঠিক তাই হেলমুট।

হেলমুটের মনের ভেতর ডুব দিয়ে কোনও লাভ হলো না ভিনগ্রহের হন্তারকের। এর কাছ থেকে কাজে লাগে, এমন কিছুই জানা গেল না। তথ্য সংগ্রহের জন্যে বরং বেড়ালের ওপর ভরসা করা চলে। কিন্তু হেলমুটের ওপর যতক্ষণ সে ভর করে আছে, ততক্ষণ অন্য কোনও প্রাণীর শরীরে প্রবেশ করতে পারছে না সে। কাজেই ওকে পথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু তার আগে দরকার ঝোলের বাটি থেকে উঠে পড়া এবং আগের আস্তানায় গর্ত খুঁড়ে লুকানো। কারণ ঝোল মেখে তার গায়ে গন্ধ হয়ে গেছে। কোনও প্রাণী গন্ধ শুঁকে অতি উৎসাহী হয়ে সিঁড়ির নীচে উঁকি মারলেই তাকে দেখতে পাবে। তখন তার বারোটা বেজে যাবে।

হেলমুট তাকে ঝোলের পাত্র থেকে তুলে নিয়ে সিঁড়ির গোড়ায় চলে এল। মোটামুটি গভীর একটা গর্ত খুঁড়ল সে, তারপর সাবধানে কচ্ছপের খোলটাকে ভেতরে রেখে মাটি চাপা দিল। এখন আর কারও চোখে পড়ার সম্ভাবনা রইল না।

হেলমুট এবার ঘরে ঢুকল। প্রথমেই প্যানের অবশিষ্ট ঝোলটুকু ঢেলে ফেলে দিল ড্রেনে। তারপর যে জিনিসগুলো সে ব্যবহার করেছে, প্রতিটি জিনিস ভাল করে ধুয়ে ফেলল। প্যান, বাটি, জার ইত্যাদি ঠিকঠাক জায়গায় রেখে দিল। সব কাজ শেষে বসে পড়ল রান্নাঘরের টেবিলে। ভিনগ্রহের হন্তারক ওকেও আত্মহত্যায় বাধ্য করবে। তবে এবারের হত্যাকাণ্ড যাতে কারও মনে সন্দেহ জাগাতে না পারে সে জন্য হেলমুটকে দিয়ে একটা চিরকুট লেখাবে বলে ঠিক করেছে সে। রনি’র মৃত্যু থেকে এ শিক্ষাটা পেয়েছে সে। রনি যদি লিখে যেতে পারত সে স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছে, তা হলে তাকে নিয়ে এত হৈ চৈ হত না। কাজেই হেলমুটের মৃত্যু এমনভাবে দেখাতে হবে যাতে কারও মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ না জাগে। সে হেলমুটকে দিয়ে লেখাল।

‘বাতের ব্যথার যন্ত্রণা আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। তাই আত্ম হননের পথ বেছে নিলাম।

হেলমুট

নিজের নাম সই করে কিচেন ক্লজিট খুলল হেলমুট, বের করল শটগান। বন্দুকে গুলি ভরে আবার টেবিলে এসে বসল। মুখের ভেতর মাজল ঢুকিয়ে টেনে দিল ট্রিগার। রক্ত আর মগজ ছিটকে পড়ল চিরকুটের ওপর, তবে লেখাগুলো চেনা গেল।

সিঁড়ির গর্তের নীচে, নিজের শরীরের ভেতর ফিরে আসা ভিনগ্রহের প্রাণী তার উপলব্ধি ক্ষমতা দিয়ে শুনতে পেল গুলির শব্দের সাথে সাথে জেগে উঠেছে নিকল কোহল, দোতলা থেকে চিৎকার করে ডাকছে স্বামীর নাম ধরে। দেখল বেডরুমের আলো জ্বলে উঠেছে, তারপর হলঘর, সবশেষে নীচতলার ঘরের আলো।

নয়

ঘুম থেকে ধীরে ধীরে জেগে উঠলেন ড. আবরার, চিৎ হলেন, চোখের সামনে হাত এনে ঘড়ি দেখলেন।

সাড়ে দশটা বাজে। বাজতেই পারে। কাল অনেক রাতে ঘুমিয়েছেন তিনি। যাক, এবার গ্রীনবে-তে ফোন করে জানা যাবে কুকুরটার সুরতহাল রিপোর্ট।

মুখ হাত ধুয়ে বার্টলসভিলের স্থানীয় একটা ড্রাগস্টোরে ঢুকে গ্রীনবে- হাসপাতালে ফোন করলেন আবরার। জানা গেল, কুকুরটার র‍্যাবিস হয়নি। আর তার শরীরে কোনও রোগও ধরা পড়েনি যার কারণে সে মাথা খারাপ হয়ে গাড়ির ওপর লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করতে পারে।

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন প্রফেসর। ঘটনাটা শেরিফকে জানানো দরকার। তিনি হয়তো ব্যাপারটাতে আগ্রহ প্রকাশ করতে পারেন। কফি খেয়ে, ড্রাগস্টোর থেকে ফোন করলেন উইলকক্সে, শেরিফকে। অফিসেই পাওয়া গেল তাঁকে।

‘ড. আবরার বলছি, শেরিফ,’ বললেন প্রফেসর। ‘জরুরী কিছু কথা আছে আপনার সাথে। এখানে আসতে পারবেন নাকি আমি যাব আপনার অফিসে?’

‘আমি এক্ষুণি বার্টলসভিলের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছিলাম, ডক্টর।’ জবাব দিলেন শেরিফ, ‘কোত্থেকে বলছেন আপনি।’

ড্রাগস্টোর থেকে। পাশের পাবে ঢুকছি আমি। আসুন, ড্রিঙ্ক খেতে খেতে কথা বলি।’

শেরিফ জানালেন আধ ঘণ্টার মধ্যে আসছেন তিনি।

এখানে প্রায়ই লাঞ্চ বা ডিনার করতে আসেন ডক্টর। হ্যানস উইস নামের এক মুদি দোকানদারের কাছ থেকে নিয়মিত গ্রোসারি কেনেন। পাবে মাঝে মাঝে পোকারও খেলেন। ফলে স্থানীয় লোকজনের সাথে দোস্তী হয়ে গেছে তাঁর। ড্রাগস্টোরের মালিকের সাথে গতরাতেও পোকার খেলেছেন তিনি। সে আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল, ‘শেরিফকে ফোন করলেন শুনলাম, ডক। কোনও সমস্যা নয় তো?’

‘আরে না! ওখানে কিছু খবর দেয়ার জন্যে ফোন করা।’

‘ভাল কথা, ডক। আপনি তো বাসকোম্ব রোডে থাকেন, তাই না?’ মাথা ঝাঁকালেন আবরার। ‘হ্যাঁ। রাস্তার শেষ বাড়িটাতে। ‘কেন?’

‘আপনাদের ওদিকে কালরাতে একটা আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। শুনেছেন?’

ডক্টরের ঘাড়ের পেছনে কী যেন একটা কিলবিল করে উঠল। ‘না, শুনিনি। এই মাত্র শহরে ঢুকেছি। কে মারা গেল?’

‘এক বুড়ো। হেলমুট। শহর থেকে পাঁচ মাইল দূরে থাকত লোকটা আপনার বাড়ি থেকে মাইল তিনেক দূরে। বুড়োর মৃত্যুতে কেউ তেমন মন খারাপ করেনি। কারণ কারও সাথেই সদ্ভাব ছিল না লোকটার।

ওষুধের দোকানদারকে জিজ্ঞেস করে শুধু এটুকুই জানা গেল, বুড়ো শটগান মুখে পুরে আত্মহত্যা করেছে। আর মরার আগে একটা চিরকুট লিখে গেছে।

চিন্তিত ভঙ্গিতে পাবে ফিরে এলেন ডক্টর আবরার। বিয়ারের অর্ডার দিলেন। খানিক পর শেরিফ এসে ঢুকলেন পাবে। আবরারকে বিয়ার খেতে দেখে বললেন, ‘টেনশনে আছি। শুধু বিয়ারে চলবে না। ডাবল বুরবনের অর্ডার দিন।

বারটেন্ডারকে ডাবল বুরবনের অর্ডার দিয়ে শেরিফের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালেন প্রফেসর।

‘হেলমুটের কথা বোধহয় শুনেছেন,’ বললেন শেরিফ। কাল অনেক রাতে ওখান থেকে বাসায় ফিরেছি। ঘুমাতেই পারিনি। গড়, ভয়ানক ক্লান্ত আমি। এখন আবার কোলের বাড়ি ছুটতে হবে।’

‘আমি যদি আপনার সাথে যাই অসুবিধা আছে?’ জানতে চাইলেন আবরার।

‘না, অসুবিধা নেই। ফোন করেছিলেন কেন? কোল সম্পর্কে কথা বলতে?’

‘না, ফোন করার আগেও আমি ব্যাপারটা জানতাম না। জনের কুকুরটাকে নিয়ে কথা বলতে চেয়েছি। ওটার র‍্যাবিস হয়নি।’

শেরিফ ঝোপের মত ভুরু তুলে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি চেক করেছেন নাকি? কুকুরটা কাউকে কামড়েছে?’

‘না। কাউকে কামড়ায়নি। তবে কুকুরটা কার-শাই ছিল জানার পর ওটার প্রতি আমি কৌতূহলী হয়ে উঠি। জানতে চাই জানোয়ারটা অন্ধের মত কেন আমার গাড়ির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। র‍্যাবিস থাকলে না হয় এর একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যেত।

‘আরে, একটা সামান্য কুকুর নিয়ে এত ভাবছেন কেন আপনি? এ ধরনের কুকুর প্রায়ই গাড়ি চাপা পড়ছে। হয়তো খরগোশ ধরতে গিয়ে ওটা আপনার গাড়ির নীচে পড়েছে। এ নিয়ে নিশ্চয়ই রাতের ঘুম হারাম করছেন না আপনি?’

‘না, তা নয়। তবে-আচ্ছা, শেরিফ, কোহলের আত্মহত্যার ঘটনায় অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েছে আপনার?’

‘তেমন অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েনি। তবে দৃশ্যটা দেখে গা গুলিয়ে উঠেছে। গড, রক্ত আর মগজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে যা-তা অবস্থা।

‘কোনও মামলা বা ইনকোয়েস্ট হবে না?

‘কীসের ভিত্তিতে? কোহল নিজের হাতে লিখে গেছে সে আত্মহত্যা করেছে।’

ড্রিংক খেতে খেতে টুকটাক আরও কথা হলো। শেরিফ পেঁচা এবং বেড়ালের কথাও জানালেন। পেঁচা এবং বেড়ালের মৃত্যুর কথা শুনে ডক্টর কেমন আড়ষ্ট হয়ে উঠলেন, লক্ষ করলেন না শেরিফ।

দশ

হেলমুট কোল আত্মহত্যা করার পর যে ঘটনাগুলো ঘটল, তা খুবই অবাক করে তুলল ভিনগ্রহের হন্তারককে। তার ধারণাতেও ছিল না একটা মানুষ, যে চিরকুট পর্যন্ত লিখে গেছে স্বইচ্ছায় আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে, তাকে নিয়ে এত হৈ চৈ হবে।

হেলমুট মুখে বন্দুক পুরে ট্রিগার টেপার পরের দৃশ্যগুলো ভিনগ্রহের প্রাণীর স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে। হেলমুটের স্ত্রী গুলির শব্দে জেগে যায়, নীচে নেমে স্বামীকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে তার সে কী চিৎকার। তখুনি দৌড়াতে দৌড়াতে চলে যায় সে প্রতিবেশী লুরসাটদের (যাদের বাড়িতে অসুস্থ বাচ্চা আছে) খবর দিতে। লুরসাট পরিবার সাথে সাথে শেরিফকে ফোন করে। ঘণ্টাখানেক পরে শেরিফ এসেছে। হেলমুটের স্ত্রীকে নানা জিজ্ঞাসাবাদও করেছে। নিকোল কোহল কাঁদতে কাঁদতে তাকে বলেছে স্বামী চিরকুটে আত্মহত্যার কথা লিখলেও তার মনে পড়ে না বাতরোগটা হেলমুটকে অত বেশি কি কাবু করেছিল যে নিজেকে এভাবে ধ্বংস করে দিতে হবে?

ভিনগ্রহের প্রাণী মানুষগুলোর আচরণ যত দেখেছে ততই অবাক হয়েছে। যে লোক আত্মহত্যা করেছে, আত্মহত্যার কারণও ব্যাখ্যা করে গেছে, তার মৃত্যুকে ঘিরে এত প্রশ্ন কেন সবার?

পরদিন দুপুরে শেরিফ আবার এলেন হেলমুটের বাড়িতে। এবার তাঁর সাথে আরও একজন আছেন। লোকটির সাথে বিধবা কোহলের পরিচয় করিয়ে দিলেন শেরিফ। লোকটির নাম আবরার, পেশায় বিজ্ঞানী, বার্টলসভিলে এসেছেন ছুটি কাটাতে। রনির রহস্যময় আত্মহত্যার ঘটনা তাঁকে কৌতূহলী করে তুলেছে। তিনি এ মৃত্যুর একটি সন্তোষজনক ব্যাখ্যা খুঁজছেন। আর হেলমুটের আকস্মিক আত্মহত্যার ঘটনা তাঁর কৌতূহল আরও বেশি বাড়িয়ে দেয়। কারণ এত অল্প সময়ে দুটো আত্মহত্যার ঘটনা সচরাচর দেখা যায় না। আবরার এ ব্যাপারে বিধবা নিকোল কোহলের সাথে দু’একটা কথা বলতে চান। অবশ্য তিনি যদি অনুমতি দেন তা হলে।

নিকোল কোহল কথা বলতে আপত্তি করল না! শুধু তাই নয় সে ওদের জন্যে কফিও বানিয়ে আনল।

ছোটখাটো আবরারের কৌতূহল অপরিসীম। কমপক্ষে একশো প্রশ্ন করলেন তিনি নিকোল কোহলকে। নিকোল কোহল সমস্ত প্রশ্নের জবাব দিল! লুরসাটদের বাড়িতে বেড়ালের মৃত্যু বা ফ্রিজ থেকে সুপ আর মাংসের ঝোল অদৃশ্য হবার ব্যাপারগুলো আবরারকে কৌতূহলী করে তুলল।

আনরার এবং কোহলের কথোপকথন সবই শুনতে পাচ্ছে ভিনগ্রহের প্রাণীটি। লোকটার ব্যাপারে সে আগ্রহ বোধ করছে। কী ধরনের বিজ্ঞানী এই লোক? একে হোস্ট বানালে কেমন হয়? এ নিশ্চয়ই বার্টলসভিলের টেলিভিশন মেকানিকের চেয়ে চৌকস হবে। সে সিদ্ধান্ত নিল এ লোকের ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে হবে। কোথায় থাকে জানা দরকার। তাকে হোস্ট বানালে কতটুকু উপকারে সে আসবে তাও জানা দরকার। তবে আবরার নামের লোকটিকে বিশ্লেষণ করার সুযোগ তার আর হলো না। কারণ সৈ প্রশ্নপর্ব শেষ করে উঠে পড়েছে, চলে যাচ্ছে শেরিফের সাথে নিজের গাড়িতে, ক্রমশ সরে যাচ্ছে রেঞ্জের বাইরে।

যাক, ক্ষতি নেই। সে এরকম হোস্ট বহু পাবে। শেরিফ এবং আবরার মিসেস কোহলের সাথে অনেক কথাই বলেছেন। ভিনগ্রহের হন্তারক জানতে পেরেছে মিসেস কোল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন খামার বাড়ি বিক্রি করে তার ছেলে বা মেয়ের কাছে চলে যাবে। তার মেয়ে মার্থা শেষ চিঠিটি মাকে লিখেছিল সিনসিনাটি থেকে, ছেলে ম্যাক্স থাকত মিলওয়াকিতে। শেরিফ মহিলাকে কথা দিয়েছেন তার ছেলে-মেয়েদের ঠিকানা খুঁজে বের করবেন। কাজটা তাঁর পক্ষে সহজ। কারণ ওই দুটি রাজ্যের পুলিশ শেরিফের বন্ধু মানুষ।

মিসেস কোহল খামার বাড়ি বিক্রি করতে চেয়েছে তার প্রতিবেশী লুরসাটদের কাছে। তা করুক। তাতে ভিনগ্রহের প্রাণীর কোনও অসুবিধে নেই। একবার ভেবেছিল মিসেস কোহলকে তার হোস্ট বানাবে। কিন্তু পরক্ষণে নাকচ করে দিয়েছে চিন্তাটা। কারণ মিসেস কোলকে হোস্ট করা মানে তাকে হত্যা করা। মিসেস কোহলের মৃত্যুও অ্যাক্সিডেন্টের আদলে ঘটানো যায়। কিন্তু তাতে সুবিধের চেয়ে অসুবিধেই হবে বেশি। কারণ খামার বাড়িতে পরপর দুটি মৃত্যু লোকজনের মনে সন্দেহ জাগিয়ে তুলবে।

তাড়াহুড়োর কিছু নেই। সে সবসময় অপেক্ষাকৃত ভাল হোস্ট খুঁজছে। শেরিফ নিকোল কোহলের চেয়ে হোস্ট হিসেবে অনেক ভাল। কিন্তু সে এখানে থাকে না, তাকে উইলকক্সে, অনেক দূরে, তার রেঞ্জের বাইরে। আপাতত এ শহরে তার রেঞ্জের মধ্যে আছে রেডিও টেলিভিশন রিপেয়ারম্যানটা। তবে ওর কাছে যেতে হরে অন্য হোস্টের ওপর নির্ভর করে, এমন একজন হোস্ট যে গুপ্তচরের কাজ করতে পারে চমৎকার। আর এ কাজে বেড়ালের তুলনা নেই।

কাজেই সে খামার বাড়ির ঘুমন্ত এক বেড়ালকে টার্গেট করল আবার।

এগারো

দুপুরের ঠিক আগে আগে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হলো বার্টলসভিল শহরে। রেডিও এবং টেলিভিশন রিপেয়ারম্যান বিলি র‍্যামন তার দোকানের জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখছিল। ভাগ্য ভাল খাবার নিয়ে এসেছে। লাঞ্চ করতে আর বৃষ্টিতে ভিজে রেস্টুরেন্টে ঢুকতে হবে।

বিলি র‍্যামনের ব্যবসার অবস্থা ভাল না। আকণ্ঠ ডুবে আছে দেনার বোঝায়। তিন বছর আগে ভুল একটা সিদ্ধান্তের খেসারত দিতে হচ্ছে এখন তাকে। ভেবেছিল বার্টলসভিলে রেডিও টিভি সারানোর দোকান দিলে খদ্দেরের অভাব হবে না। এ শহরের সবার বাড়িতেই রেডিও আছে, কিছু লোকের টিভি রেডিও দুটোই আছে। তবে সমস্যা হলো এ শহরের লোকের রেডিও নষ্ট হয় না বললেই চলে, আর যাদের টিভি আছে তারা সেটের সামনে বসে খুব কমই।

বিলি র‍্যামনের বয়স বত্রিশ, লম্বা, রোগাটে গড়নের এই যুবক সব সময় চোখে চশমা পরে। সর্বদা হাসি মুখ করে থাকার জন্যে শহরের লোক তাকে পছন্দ করে। কালে-ভদ্রে রেডিও বা টিভি নষ্ট হলে বিলি র‍্যামনকে দিয়েই সেটা মেরামত করায়। তবে ঘটনাগুলো যেহেতু সচরাচর ঘটে না তাই পক্ষাঘাতগ্রস্ত অসুস্থ মা এবং নিজের পেট চালাতে হিমশিম খেতে হয় বিলি র‍্যামনকে। হোলসেলারের কাছ থেকে টিউব আর নানা পার্টস বাকিতে নিতে নিতে এখন আর কেউ তাকে বাকি দিতে চায় না। অন্য কোথাও গিয়ে যে চাকরি করবে, সে রকম কাজও তো নেই। তা ছাড়া অসুস্থ মা বিলি র‍্যামনের ‘সাহায্য ছাড়া এক পা-ও চলতে পারে না। তাকে রেখে দূর দেশ যেতেও মন চায় না বিলি র‍্যামনের। সব মিলে খুব সমস্যায় আছে বেচারা।

জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখছিল আর নিজের পোড়া কপাল নিয়ে ভাবছিল বিলি র‍্যামন, ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়াল। বেঞ্চির ওপর বসে টেনে নিল র‍্যাপারে মোড়া গরম কফির থার্মোফ্লাস্ক আর এক জোড়া স্যান্ডউইচ। একটা পিনাট বাটার, অন্যটা জেলি মাখানো। পয়সা খরচের ভয়ে সে মাংসের পুর দেয়া স্যান্ডউইচ খায় না বহুদিন হলো। তিন মাস আগে, ওয়াল্টার শ্রোয়েডারের টিভি ঠিক করে দেয়ার পর লোকটা ওকে স্মোকড হ্যাম খাইয়েছিল। সে স্বাদ জিভে লেগে আছে এখনও।

পিনাট বাটার শেষ করে জেলি স্যান্ডউইচে কামড় বসাল বিলি র‍্যামন, একই সাথে কাপে ঢেলে নিল গরম কফি। ঠিক তখন জানালায় কিছু একটা আঁচড় কাটার শব্দ শুনে ওদিকে তাকাল সে। একটা বেড়াল। সাইড জানালার পাশে বসে একটা থাবা দিয়ে খচর-মচর আঁচড় কাটছে কাচে। বেড়ালটা আকারে বিশাল। কুচকুচে কালো। ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে, যেন সাঁতার কেটে এসেছে। জানালার কাছে গেল বিলি র‍্যামন, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল বেড়ালটার দিকে। এ বেড়ালটাকে আগে কখনও দেখেছে কিনা মনে করতে পারল না। ‘কীরে, কী চাস?’ জিজ্ঞেস করল বিলি র‍্যামন। বেড়াল তার পছন্দের প্রাণী।

বেড়ালটাকে মনে হলো অভুক্ত। বৃষ্টিতে ভিজে লোম সেঁটে গেছে গায়ে বিলি র‍্যামনের প্রশ্নের জবাবে মুখ হাঁ করল ওটা, সম্ভবত ম্যাও বলল, বন্ধ জানালা দিয়ে শোনা গেল না আওয়াজ। আবার থাবা আঁচড়াল সে জানালায়।

‘ভেতরে আসবি?’ বলে জানালা খুলে দিল বিলি র‍্যামন। এক লাফে ভেতরে চলে এল কালো বেড়াল। দরজা বন্ধ করে বিলি র‍্যামন আবার তাকাল বেড়ালটার দিকে। খিদে পিয়েছে?’ আপন মনে প্রশ্ন করল সে। ‘নে এটা খা।’ আধ খাওয়া, জেলি মাখানো স্যান্ডউইচটা ছুঁড়ে দিল সে বেড়ালকে। এক কামড়ে স্যান্ডউইচ গিলে ফেলল বেড়াল।

‘তেষ্টাও পেয়েছে বুঝি?’ বলে সিঙ্ক থেকে এক বাটি পানি এনে দিল ওকে বিলি র‍্যামন। বেড়ালটা চুকচুক করে পানি খেল। সিঙ্কে দুটো তোয়ালে ঝুলছে। একটাতে কালিঝুলি মাখা। ওটা দিয়ে বেড়ালটার গা মুছতে লাগল। আরামে চোখ বুজে এল বেড়ালের। কাজটা প্রায় শেষ করে এনেছে বিলি র‍্যামন, এমন সময় বেজে উঠল ফোন। জবাব দিল বিলি র‍্যামন, ‘ বিলি র‍্যামন বলছি, রেডিও এন্ড টিভি রিপেয়ারম্যান।’

‘ক্যাপ হেডেন বলছি, বিলি র‍্যামন, ক্যাপ হেডেন জেনারেল স্টোর চালায়, পাশাপাশি পোস্ট মাস্টারের দায়িত্বও পালন করছে। ‘শিকাগো থেকে একটা প্যাকেজ এলে ফোন করতে বলেছিলে। এসেছে ওটা।’

‘দারুণ, ক্যাপ। আসছি আমি এক্ষণি।

দাঁড়াও, দাঁড়াও। কিছু টাকাও নিয়ে এসো। ওটা ছাড়াতে আমার সাত ডলার লেগেছে।’

‘এইরে, সেরেছে। শোনো ভাই, ডলফ মার্শের টিভি’র জন্যে একটা টিউবের দরকার ছিল। সেটাই তোমার ঠিকানায় এসেছে। টিভি’র কাজ প্রায় শেষ করে এনেছি। শুধু টিউবটা লাগানো বাকি। ডলফ আমাকে নগদ পেমেন্ট করবে বলেছে। সমস্যা হলো আমার কাছে এ মুহূর্তে তিন ডলারের বেশি নেই। তুমি যদি বাকি টাকাটা ধার হিসেবে রাখো তা হলে বড় উপকার হয়, ভাই। কথা দিচ্ছি, ডলফ পেমেন্ট করা মাত্র তোমার টাকা দিয়ে দেব।’

‘কথাটা মনে থাকে যেন। নগদ চাই আমি।

মনে থাকবে। ধন্যবাদ, ক্যাপ। আসছি আমি।’

দেয়ালের হুক থেকে কোট আর হ্যাটটা নিতে নিতে বিলি বেড়ালকে বলল, ‘শোন, আমি একটু বেরুচ্ছি। চলে আসব এক্ষুণি। তুই ততক্ষণ থাকতে পারিস। বৃষ্টি কমলে চলে যাস। বলতে লজ্জা নেই তোকে রাখার মত সামর্থ্য আমার নেই। যখন রাখার ক্ষমতা হবে তোর মত বেড়াল আমি পুষব। এখন গেলাম রেঁ।’

বিলি র‍্যামনের বকবকানিতে কোনও ভাবান্তর ঘটল না বেড়ালের চেহারায়। বিলি র‍্যামন দরজা বন্ধ করে চলে যাবার পর সে কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে চারপাশ দেখতে লাগল। ঘরে খানদুয়েক টেলিভিশন, চেসিস, নানা বাজে পার্টস ছাড়া কিছু নেই। রদ্দি মাল দেখে যেন হতাশই হলো বেড়াল। মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল।

একটু পরেই মাল নিয়ে চলে এল বিলি র‍্যামন। এসে দেখে বেড়ালটা একটা খোলাপাতার দিকে মনোযোগ নিয়ে তাকিয়ে আছে। ওটা ইলেক্ট্রনিক সার্কিট বিষয়ক বইয়ের ছেঁড়া পাতা।

‘কীরে, ইলেক্ট্রনিক্সের ওপর খুব আগ্রহ দেখছি তোর।’ বেড়ালটার দিকে তাকিয়ে হাসল বিলি র‍্যামন, তারপর ব্যস্ত হয়ে পড়ল ডলফ মার্শের অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে।

কাজ করতে করতে বেড়ালটার সাথে আপন মনে কথা বলতে লাগল বিলি র‍্যামন। সবই তার ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে গল্প।

বেড়ালটা ভাল শ্রোতা। মনোযোগ দিয়ে বিলি র‍্যামনের দুঃখের পাঁচালি শুনে গেল। এদিকে বিলি র‍্যামনের কাজ শেষ। সে সেট রেখে উঠে দাঁড়াল।

বৃষ্টি থেমে গেছে। বেড়ালটা একবার ‘মিউ’ করে ডেকে ছুট দিল দরজার দিকে। বেড়ালটাকে ভালই লেগেছে বিলি র‍্যামনের। ওটাকে বিদায় দিতে খারাপ লাগছে এখন। সে দরজা খুলতে খুলতে বলল, ‘যখন মন চায় চলে আসবি। দরজা বন্ধ থাকলেও জানালা খোলা থাকবে। খিদে পেলেই চলে আসবি। একসাথে লাঞ্চ করব, কেমন?’

বেড়াল কিছু না বলে বেরিয়ে গেল, এক ছুটে অদৃশ্য হয়ে গেল রাস্তার ওপারে।

হয়তো কারও পোষা বেড়াল, ভাবল বিলি র‍্যামন। বাড়িতেই গেছে। ক্ষমতায় কুলোলে সে-ও একদিন অমন একটা নাদুস-নুদুস বেড়াল পুখবে।

কিন্তু বিলি র‍্যামন কোনদিনই জানবে না অল্পের জন্য অকাল মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে সে বেড়ালরূপী যমের তাকে হোস্ট হিসেবে পছন্দ হয়নি বলে ওটা তাকে ছেড়ে চলে গেছে।

বারো

বার্টলসভিলে পরপর দুটো আত্মহত্যার ঘটনার মধ্যে রীতিমত রহস্যের গন্ধ পাচ্ছেন ড. আবরার। সারাটা সকাল তাঁর গেছে এ ঘটনা দুটোর ওপর নোট তৈরি করতে। কিন্তু তিনি চান গল্পের আকারে স্টেটমেন্ট লিখতে। তিনি ডিকটেশন দেবেন, অন্য কেউ লিখে দেবে। সমস্যা হলো এ শহরে তাঁর পরিচিত এমন কোনও টাইপিস্ট নেই যে নির্ভুল ইংরেজিতে তাঁর ডিকটেশন লিখে নিতে পারে।

হঠাৎ এড হোলিসের কথা মনে পড়ে গেল প্রফেসরের। বার্টলসভিলের একমাত্র সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ক্ল্যারিয়ন’-এর সম্পাদক। আবরারের পুরানো বন্ধু। সাথে সাথে এড হোলিসের অফিসে চলে গেলেন আবরার। শর্টহ্যান্ড জানা একজন দক্ষ টাইপিস্টের কথা তাঁকে বলতে এড মিস শিলা রহমানের- কথা বললেন। জানালেন মিস শিলা এখানকার হাইস্কুলে ইংরেজি পড়ায়, টাইপ তার পার্ট টাইম জব। সে শর্টহ্যান্ড এবং টাইপিং-এ খুবই দক্ষ। আর ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী বলে তার ভাষাও চমৎকার। শিলার বাবা আমেরিকান, মা বাঙালি। রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন দুজনেই। সে একটি ছোট অ্যাপার্টমেন্টে একা থাকে। তার কোনও বয়ফ্রেন্ড নেই। গড়গড় করে তথ্যগুলো দিলেন এড। ছোট্ট এ শহরে একটি বাঙালি মেয়ে একা জীবন-যুদ্ধে টিকে আছে শুনে আবেগে আপ্লুত হলেন আবরার।

‘ঠিক এরকম একজনকে দরকার আমার।’ বললেন প্রফেসর। ‘কোথায় পাব তাকে?’

এড বললেন, ‘আচ্ছা, দেখছি।’

টেলিফোন ডাইরেক্টরি ঘেঁটে একটা নাম্বার বের করলেন তিনি। তারপর ওই নাম্বারে ফোন করলেন। ‘মিস রহমান? আমি এড হোরিস। শুনুন, আমার এক বন্ধুর কয়েকদিনের জন্যে আপনাকে দরকার। টাইপ আর শর্টহ্যান্ডের কাজ। পারবেন?… বেশ। এক সেকেন্ড ধরুন।’

মাউথপিসে হাত চাপা দিয়ে এড ফিরলেন বন্ধুর দিকে। ‘মিস রহমান বলছেন, যখন খুশি তুমি তাঁকে পেতে পার। ইচ্ছে করলে আজই কথা বলতে পার। একটার দিকে যেতে পারবে? ঠিকানা আমি বলে দেব।’

‘তা হলে তো ভালই।’

এড হোরিস আবার ফোনে কথা বলতে লাগলেন, ‘ঠিক আছে, মিস রহমান। আমার বন্ধু একটার দিকে আপনার সাথে দেখা করবে।… ওকে, বাই।’

ফোন নামিয়ে রাখলেন এড। প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে হাসলেন, ‘ভদ্রমহিলা তাঁর রেট তোমাকে মনে করিয়ে দিতে বলেছেন। দিনে দশ ডলার। অথবা ঘণ্টা প্রতি দেড় ডলার।

‘অসুবিধে নেই। এখন ঠিকানাটা বলো। আমি একটার মধ্যে পৌঁছে যাব তোমার মিস রহমানের কাছে।’

কাঁটায় কাঁটায় একটায় মিস শিলা রহমানের বাসায় এলেন আবরার। শিলা অপেক্ষা করছিল তার জন্যে। দরজা খুলেই বলল, ‘ড. আবরার?’

মাথা ঝাঁকালেন আবরার।

‘ভেতরে আসুন, প্লীজ,’ আহ্বান জানাল শিলা। মিস শিলা রহমানের বয়স ত্রিশের কোঠায়। আবরারের চেয়ে লম্বা সে, পাঁচ ফুট ছয়, হালকা- পাতলা গড়ন, চোখে স্টিলরিমের চশমা, পরনে পরিচ্ছন্ন ধূসর রঙের পোশাক। চুলের রঙ বাদামী, এক বেণীতে বাঁধা। ঘাড়ের পেছনে ঝুলছে।

এখন মাথায় একটা হ্যাট আর হাতে একটা ছাতা ধরিয়ে দিলেই স্টুয়ার্ট পামারের মহিলা গোয়েন্দা চরিত্র হয়ে উঠত শিলা রহমান।

‘বসুন, ডক্টর,’ বলল শিলা, ‘আমার নোটবুক নিয়ে আসি-‘

‘ইয়ে, মিস শিলা। এখানে ডিকটেট করতে পারলে ভালই হত। তবে মনে হয় আমার বাসায় বসে কাজটা আরও ভালভাবে করতে পারব। এখান থেকে মাইল আটেক দূরে আমার বাসা, শহরের শেষ মাথায়, বাসকো রোডে। আপনি ওখানে বসে ডিকটেশন নিয়ে এখানে এসে টাইপ করবেন; সমস্যা হবে কোনও? আমি অবশ্য একা থাকি—’ শেষ দিকে আমতা আমতা করতে লাগলেন তিনি।

মুচকি হাসল শিলা। ‘এ পৃথিবীতে আমরা সবাই একা, ডক্টর, ওতে কোনও সমস্যা হবে না। চলুন, যাওয়া যাক।’

শিলা নোটবই আর পেন্সিল নিয়ে ডক্টর আবরারের সাথে তাঁর স্টেশন ওয়াগনে উঠে বসল।

.

হোস্ট হিসেবে বেড়ালের তুলনা নেই, ভাবছে ভিনগ্রহের খুনী। ওরা নিঃশব্দে চলে, দ্রুত গতিসম্পন্ন, শ্রবণশক্তিও প্রখর, যেকোনও সময় যে কোনও জায়গায় যাবার ক্ষমতাও রাখে। তাই মার্জার শ্রেণীটাকে খুব পছন্দ হয়েছে তার।

বিলি র‍্যামনের দোকানে কালো বেড়ালটাকে সে-ই পাঠিয়েছিল চর হিসেবে। শেরিফ আর সেই ছোটখাট লোকটা, আবরার-ওরা বিশেষ আগ্রহ সৃষ্টি করেছে তার মনে। একটা চড়ইকে পাঠিয়েছিল সে আবরারের গাড়ির পিছু পিছু। কিন্তু চড়ুইটা গাড়িটাকে এক পর্যায়ে হারিয়ে ফেলে। তারপর সে একটা কালো বেড়ালকে হোস্ট করে। বেড়ালটাকে দিয়ে সারা শহর চক্কর দিয়েছে সে। কিন্তু অত্যধিক পরিশ্রম সহ্য করতে না পেরে মারা গেছে বেড়ালটা। তারপর সে একটা ধূসর রঙের ক্ষুদে বেড়ালকে হোস্ট বানিয়েছে। বেড়াল পেতে তার কষ্ট নেই। কারণ এদিকে খামার বাড়ির ছড়াছড়ি। আর ওসব খামার বাড়ি থেকে একটা দুটো বেড়াল নিয়ে আসা কোনও ব্যাপার নয়।

ধূসর বেড়ালটাকে সে কাজে লাগিয়েছে শহরের বাইরের খামার বাড়িগুলোতে অনুসন্ধানের জন্যে। তার ধারণা, আবরার নামের সেই লোকটি কোনও খামার বাড়িতে থাকে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ধূসর বেড়াল যখন হাল ছেড়ে দিয়ে দুটো ফার্ম হাউজের মাঝখানের একটা মাঠ দিয়ে আসছে সকাল এগারোটার পরে, হঠাৎ পুবদিক থেকে একটা গাড়ি আসার শব্দ শুনে সে তাকিয়ে দেখে, একটা পুরানো স্টেশন ওয়াগন শহরের দিকে যাচ্ছে। আর ড্রাইভিং সিটে বসে আছে আবরার স্বয়ং।

ভিনগ্রহের প্রাণী ততক্ষণে প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেছে আবরার নামের লোকটি শহরের শেষ মাথার খামার বাড়িতে বাস করে। ব্যাপারটা সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হবার জন্যে ধূসর বেড়ালকে সে পাঠিয়েছে বাড়ির হাল- হকিকত জানতে।

বেড়াল বেশ কয়েকবার চক্কর দিল গোটা বাড়ি। জেনারেটর চলছে দেখে বোঝা গেল আবরার আবার ফিরে আসবে এ বাড়িতে। সম্ভবত একাই থাকে সে এখানে; নাকি কাউকে রেখে গেছে সে তার অবর্তমানে?

বাড়িতে ঢোকার রাস্তা খুঁজল বেড়াল। নেই। নীচতলায় জানালা অনেক, তবে দু’এক ইঞ্চি মাত্র ফাঁক করা। ঢোকা যাবে না। শুধু ওপরের তলার একটা জানালা খোলা।

বেড়াল বাড়িটার গন্ধ শুঁকল, কান পাতল। কোনও সাড়াশব্দ নেই। তার মানে এখানে দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তি থাকে না।

ভিনগ্রহের হন্তারক এবার বেড়ালটাকে বিশ্রাম দিল। উঠোনের এক প্রান্তে, ঝোপে ঘুমিয়ে পড়ল বেড়াল। কোনও শব্দ কানে গেলেই জেগে উঠবে সাথে সাথে।

রেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। ঘণ্টাখানেক পর গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল। আবরার এসেছে তার স্টেশন ওয়াগন নিয়ে। তবে একা নয়, সাথে এক মহিলাও আছে।

মহিলাকে চিনতে পারল ভিনগ্রহের প্রাণী। রনির স্মৃতিতে এ মহিলার কথা ছিল। এর নাম শিলা রহমান, রনির হাইস্কুলের ইংরেজির টিচার। মহিলা আবরারের বান্ধবী নাকি? হাতে আবার শর্টহ্যান্ড নোটবুকও দেখা যাচ্ছে। মনে পড়ে গেল মিস শিলা অবসরে টাইপিং বা বুক কিপিং-এর কাজ করে বাড়তি দু’পয়সা কামায়। তার মানে ওকে এখানে নিয়ে আসার কোনও উদ্দেশ্য আছে আবরারের! বেশ তো, আররার যদি মহিলাকে চিঠি লেখার ডিকটেশন দেয় তাহলে চিঠির বিষয় শুনে আবরারের সম্পর্কে সে আরও বিস্তারিত জানতে পারবে।

ওরা ঘরে ঢোকামাত্র বেড়ালটা বাড়ির চারপাশ চক্কর দিতে শুরু করল। প্রতিটি জানালায় গিয়ে কান পাতল ওদের কথা শোনার আশার। কিন্তু শোনা যাচ্ছে না।

ভেতরে ঢোকারও উপায় নেই! জানালা বন্ধ। দোতলার জানালা খোলা থাকলেও অত উঁচুতে লাফ দিয়ে ওঠা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে দৌড়ে পেছনের দরজায় গেল। ওটা রান্নাঘরের দরজা। কান পাতল। কিন্তু দরজার পাল্লা এত ভারী যে ভেতরের লোকজনের কথা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না!

আরেকবার বাড়িটা চক্কর দিল বেড়ালটা। রীতিমত বেপরোয়া হয়ে উঠেছে সে আবরার মিস রহমানকে কী ডিকটেশন দেয় জানার জন্যে। হঠাৎ গাছটা চোখে পড়ল তার। আগে দেখেনি। এলম বৃক্ষ। গাছটার মগডাল গিয়ে ঠেকেছে দোতলার খোলা জানালার কাছে। বেড়াল চট করে উঠে পড়ল গাছে। ডাল বেয়ে সাবধানে এগোল জানালার দিকে। তারপর লাফ দিল

এটা বেডরুম। তবে আবরার ব্যবহার করে বলে মনে হলো না। সে জানালার দিকে তাকাল। জানালার কাছে নুয়ে পড়া ডালটার চারফুট ওপরে উঠে গেছে সে লাফ দিয়ে নামবার সময় ঝাঁকি খেয়ে। এখন আর ও রাস্তা দিয়ে বেরুনোর উপায় নেই। বেরুতে হলে নীচে যেতে হবে। আবরার নিশ্চয়ই নীচতলার জানালা চব্বিশ ঘণ্টা বন্ধ রাখে না।

বেড়াল একছুটে হলঘর পেরিয়ে, সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল নীচে। তারপর নিঃশব্দ পায়ে হলওয়ে ধরে এগোল। এটা সদর দরজা হয়ে মিশেছে রান্নাঘরে। প্যাসেজে মোড় ঘোরার মুহূর্তে দাঁড়িয়ে চুরি করে শোনার উপযুক্ত জায়গা এটা।

ফ্রিজের দরজা খোলার শব্দ পেল সে, তারপর পরিষ্কার শুনতে পেল ওদের গলা।

তেরো

‘আপনি বিয়ার খান না, মিস রহমান?’ জিজ্ঞেস করলেন ডক্টর। ‘ডিকটেটিং একটা নীরস কাজ। আর ডিকটেশন নেয়া তো আরও নীরস।’

মৃদু হাসল শিলা। ‘খাই। তবে বিয়ার খাওয়ার কথা কাউকে বলতে পারবেন না কিন্তু। এত ছোট শহরে শিক্ষকরা বিয়ার খায় না বা ধূমপান করে না।’

‘কথা দিলাম কাউকে বলব না,’ ফ্রিজ থেকে আরেকটা বিয়ারের ক্যান বের করতে করতে বললেন আবরার। ইতস্তত সুরে যোগ করলেন। ‘ইয়ে-ডিকটেটিং করার সময় ধূমপান করলে আপনার অসুবিধে হবে?’

‘মোটেই অসুবিধে হবে না।’

দু’গ্লাস বিয়ার নিয়ে শিলার সামনে বসলেন ডক্টর, একটা গ্লাস ঠেলে দিলেন মেয়েটার দিকে।

‘কাগজ-কলম আপাতত রাখুন, মিস শিলা। এক্ষুণি ডিকটেটিং শুরু করতে ইচ্ছে করছে না। ডিকটেটিং-এর চেয়ে আমার কথা শুনতেই বোধহয় আপনার ভাল লাগবে। মাঝে মাঝে ভাবি আমার ছাত্ররাও বোধহয় আমার ডিকটেশনের চেয়ে দ্রুত লিখতে পারে।’

‘আপনার ছাত্ররা? আপনি শিক্ষকতাও করেন নাকি, ডক্টর?’

‘হ্যাঁ, মিস শিলা, এম আই টি-তে ফিজিক্স পড়াই। ইলেক্ট্রনিক্সে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছি। নিউক্লিয়ার ফিজিক্সেও তাই।’

শিলা কাগজ-কলম নামিয়ে রাখল টেবিলে, অবাক দৃষ্টিতে তাকাল ডক্টরের দিকে। ‘আবরার! ড. সি. আর. আবরার? বড় বড় স্যাটেলাইট প্রজেক্ট নিয়ে আপনি কাজ করেছেন, তাই না?’

হাসলেন ডক্টর। ‘তেমন কিছু না। তবে আপনি আমার নামটা জানেন জেনে গর্ববোধ করছি। বিজ্ঞানের প্রতিও আগ্রহ আছে নাকি?’

‘অবশ্যই। বিশেষ করে গ্রহ-তারা ইত্যাদি বিষয়ে আমার আগ্রহ প্রবল। সায়েন্স ফিকশনের একনিষ্ঠ পাঠক বলতে পারেন আমাকে।’

‘আমি আবার রহস্য সাহিত্যে বেশি মজা পাই। রিলাক্সের প্রয়োজন হলে সায়েন্স থেকে যত দূরে সরে যেতে পারি ততই ভাল লাগে।’

‘তা বুঝতে পারছি,’ বলল শিলা রহমান। ‘আপনি কি সায়েন্টিফিক কোনও বিষয়ে আমাকে ডিকটেশন দিতে চান??

‘না ঠিক তা নয়। আসলে যে ব্যাপারে কথা বলতে চাইছি ওটার ব্যাখ্যা দেয়া মুশকিল। এখানে অদ্ভুত কিছু একটা ঘটছে, শিলা। আমি ব্যাপারটা নিয়ে কিছু তদন্তও চালিয়েছি। ভুলে যাবার আগে ওগুলো স্টেটমেন্টের মত করে লিখতে চাইছি।’

তারপর রনি, জন এবং হেলমুটের আত্মহত্যার বিষয়ে নিজের সন্দেহের কথা খুলে বললেন ড. আবরার। প্রসঙ্গত এল কুকুর, কাক, বেড়াল, পেঁচা ইত্যাদি সবার কথা। ডক্টরের ধারণা এরাও আত্মহত্যা করেছে।

‘কিন্তু কেন, মিস শিলা,’ পাইপে আগুন ধরাতে ধরাতে বললেন ডক্টর। ‘এই ছয়টি আত্মহত্যার ঘটনার মধ্যে কি কোনও কানেকশন বা সম্পর্ক রয়েছে? মিসেস কোহলের ফ্রিজ থেকেই বা সুপ আর মাংসের ঝোল অদৃশ্য হয়ে গেল কেন? এসব ছোটখাট ঘটনার মধ্যে কি আপনি রহস্যের গন্ধ পাচ্ছেন না?’

আবরারের কথা শুনতে শুনতে চোখ বড় বড় হয়ে গিয়েছিল শিলার, চেহারা বিবর্ণ। আবরার ধারণা করলেন ভয়ে নয়, উত্তেজনায়।

শিলা শান্ত গলায় বলল, ‘এবার আপনি ডিকটেশন শুরু করতে পারেন, ডক্টর।’

পাইপ ফুঁকতে ফুঁকতে ডিকটেশন শুরু করলেন আবরার। তবে ধারাবাহিকভাবে নয়; মাঝে মাঝে দু’এক মিনিটের জন্য চুপ করে থাকলেন, প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ করলেন বাছাই করে, কারণ ডক্টর চাইছেন পরিষ্কার, বিশদ একটি গল্প।

মোটামুটি ঘণ্টা দেড়েক ডিকটেশন চলল। প্রথম তিনটে আত্মহত্যার ঘটনা এবং টাইগারের র‍্যাবিস বিষয়ক নেতিবাচক রিপোর্ট পর্যন্ত এসে থামলেন ডক্টর। বললেন, ‘কোহলের ব্যাপারে পরে কথা বলব। আপনিও নিশ্চয়ই লিখতে লিখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। একটু রেস্ট নেয়া দরকার।’

‘আমার রেস্টের প্রয়োজন নেই,’ বলল শিলা। ‘নতুন আরেকটা অংশে ঢুকতে যাচ্ছি। রনির ব্যাপারটা সবই জানি আমি। তবে মি. কোহলের ব্যাপারে কিছুই জানি না। কাজেই আপনি শুরু করতে পারেন, ডক্টর।

‘দশ মিনিট সময় দিন আমাকে, শিলা, আরেক গ্লাস বিয়ার চলবে তো?’

শিলা ক্ষীণ আপত্তি জানালেও আমল দিলেন না ডক্টর। তার জন্যে বিয়ার নিয়ে এলেন।

গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে শিলা জানতে চাইল, ‘ক’ কপি দরকার আপনার?’

‘তিন কপি,’ বললেন ডক্টর। ‘একটা আমার জন্য আর দুটো পাঠাব আমার বন্ধুদেরকে তাদের মতামত জানতে। এদের একজন খুব বড় ডাক্তার। তাকে জিজ্ঞেস করব র‍্যাবিসের মত আর কোনও দুর্লভ রোগ আছে কিনা যে রোগ প্রাণী থেকে মানুষের দেহে ছড়িয়ে পড়ে এবং সবাই পাগল হয়ে যায়। আরেকজন অংকবিদ। সে সবকিছু যুক্তি দিয়ে বিচার করে। তার কাছে জানতে চাইব যে সব ঘটনা ঘটছে এখানে তার মধ্যে কোনও পারস্পরিক সম্পর্ক আছে নাকি স্রেফ কাকতালীয় বলে মনে করে সে এগুলোকে।’

‘আমি যদি নিজের জন্যে একটা কপি তৈরি করি, আপনার কোনও আপত্তি আছে, ডক্টর?’

‘কোনও আপত্তি নেই, শিলা।’

হাসল শিলা রহমান। ‘বেশ। আমি অবশ্য নিজের জন্যে একটা কপি তৈরি করতাম। তবে আপনার অনুমতি পেয়ে ভাল হলো।’

আবরারও হাসলেন। খোলামেলা স্বভাবের শিলাকে তাঁর ভাল লেগেছে। কোনও জটিলতা নেই তার ভেতরে। এ ধরনের সহজ সরল মানুষ পছন্দ করেন ডক্টর। ইতোমধ্যে ভাবতে শুরু করেছেন নিজের সেক্রেটারী হবার প্রস্তাব শিলাকে দেবেন কিনা। তাঁর ডিপার্টমেন্টের বাজেট আগামী বছর বৃদ্ধি করা হবে। তিনি এই প্রথম একজন ফুলটাইম সেক্রেটারী এবং রেকর্ড ক্লার্ক পাবেন। শিলা তার প্রস্তাবে রাজি হলে ভালই হবে। তিনি একজন দক্ষ সেক্রেটারী পাবেন আর শিলা এখানকার চেয়ে অনেক বেশি বেতন পাবে এম আই টি-তে। তবে প্রস্তাবটা পরে দিলেও চলবে। তাড়াহুড়োর কিছু নেই।

বিয়ার শেষ করে শিলা রহমান বলল, ‘আজ যে পর্যন্ত ডিকটেশন দিলেন তা টাইপ করতে আমার দু’দিন লাগবে। আজ মঙ্গলবার। বিষ্যুদবার দুপুরের মধ্যে আপনার জিনিস পেয়ে যাবেন, অবশ্য সন্ধ্যা বেলাতেও যদি কাজটা করি।’

‘আপনি সন্ধ্যাবেলাও কাজ করেন নাকি? ‘

‘সাধারণত করি না। তবে আপনারটা করব। কারণ এত মজার কাজ জীবনে পাইনি আমি। আর এ জন্যে কোনও পেমেন্ট নেব না। আপনি যদি টাকা নেয়ার জন্যে জোরাজুরি করেন তা হলে বলব আজকের বিকেলটা খামোকাই নষ্ট হলো আপনার।

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন ডক্টর। তিনি বুঝতে পেরেছেন মেয়েটার মনে যা, মুখেও তাই। কাজেই ওর সঙ্গে তর্ক করা বৃথা। তিনি বড়জোর একটা কাজই করতে পারবেন-বোস্টন ফেরার পর শিলার জন্য একটা উপহার কিনে পাঠিয়ে দেবেন। ওটা নিশ্চয়ই অগ্রাহ্য করতে পারবে না শিলা রহমান।

‘বেশ, শিলা। আপনার কথাই রইল। তা হলে আজ থেকে আপনাকে আমার পার্টনার হিসেবে কাজ করতে হবে। আমি কি আপনাকে এখন কিছু কথা বলতে পারি?’

‘অবশ্যই পারেন। বলুন না।’

‘আপনাকে এখন থেকে চোখ, কান খোলা রেখে চলতে হবে। আপনি শহরে থাকেন। কাজটা সহজ হবে আপনার জন্য। আমি শহরে যাই হপ্তায় একদিন। ফলে কোনও ঘটনা ঘটলে তা জানতে পারি দেরিতে। কাজেই এখন থেকে কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা যদি ঘটে, যা আমার মানে আমাদের তদন্তের সাথে মিলে যায়, আপনি সেসব সম্পর্কে ভালভাবে খোঁজ-খবর নিয়ে রাখবেন।‘

‘তাতে কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু আপনার সাথে আমার যোগাযোগ হবে কী করে? আপনার বাসায় বোধহয় ফোন নেই, নাকি আছে?’

‘না, নেই। এ জন্যে এখন বরং আফসোস হচ্ছে। তবে প্রায়ই আমি এ শহরের পোস্ট অফিসে যাই চিঠিপত্র এসেছে কিনা দেখতে। আপনি পোস্ট মাস্টারের কাছে কোনও মেসেজ রেখে গেলে আপনাকে ফোন করব। তা হলে কথা ওটাই রইল-বিষ্যুদবার আপনার সাথে দেখা হচ্ছে। চলুন, ওঠা যাক।’

হ্যান্ডব্যাগে নোটবই আর পেন্সিল ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়াল শিলা রহমান। সদর দরজা দিয়ে বেরুল ওরা, উঠল স্টেশন ওয়াগনে। ডক্টর স্টার্ট দিলেন ইঞ্জিন, গিয়ার ছাড়লেন; ক্লাচ রিলিজ করতে যাচ্ছেন এমন সময় শিলা বলল, ‘এই রে, আপনার বেড়ালটার সাথে তো পরিচয় করিয়ে দিলেন না। বলর ভাবছিলাম, ভুলে গেছি। অবশ্য অসুবিধা নেই।’

আবরার ক্লাচ পেডালে পা রেখে ঘুরে তাকালেন শিলার দিকে। ‘বেড়াল? আমি বেড়াল পুষি না, শিলা। আপনি আমার বাড়িতে বেড়াল দেখেছেন?’

‘আ-হ্যাঁ। দেখলাম বলেই তো মনে হলো। ওই সময়-’

আবরার লিভার নিউট্রালে এনে ইগনিশন সুইচ অফ করলেন। ‘বোধহয় রাস্তার কোনও বেড়াল ঢুকে পড়েছে। একটু বসুন। আমি চেক করে আসছি। বেড়াল ঢুকলে ওটাকে বের করে দেয়াই ভাল। কার না কার বেড়াল।’

গাড়ি থেকে নেমে আবার বাড়ির মধ্যে ঢুকলেন ডক্টর দরজা বন্ধ করে। দ্রুত নীচতুলা ঘুরে দেখলেন। প্রায় সবগুলো জানালাই বন্ধ। দু’একটা দু’এক ইঞ্চি ফাঁক হয়ে আছে। কিন্তু ওই ফাঁক দিয়ে বেড়াল ঢোকার উপায় নেই। ওপরে গেলেন তিনি। বেড়ালের টিকিটিও চোখে পড়ল না। বেডরুমে ঢুকলেন। এ রুমের একটা জানালা খোলা। গাছের ডাল ঝুলে আছে জানালা থেকে কয়েক ফুট ওপরে। ওখান থেকে লাফ দিয়ে নামা যায় বেডরুমে, কিন্তু বেরুনো সম্ভব নয়। কারণ নীচে নরম ঘাস নেই, আছে শক্ত পাথুরে মেঝে। ওখানে লাফ দিয়ে নামতে গেলে হয় বেড়াল মারা যাবে নয়তো মারাত্মক আহত হবে।

হঠাৎ ভাবনাটা মাথায় এল তাঁর। এ বাড়িতে যদি সত্যি কোনও বেড়াল ঢুকে থাকে, আর ওটার যদি মরার খায়েশ হয়, যেমন কোহলের বেড়ালটা মারা গেল, বা অন্যান্য প্রাণীগুলো-

আবরার বেডরুমের জানালা বন্ধ করে নেমে এলেন নীচে, দরজা খুলে বেরুলেন। বেড়াল থাকলে থাকুক, উনি এসে আবার খুঁজবেন। তখন এ নিয়ে মাথা ঘামালে চলবে।

গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিলেন আবরার। বললেন, ‘কোনও বেড়াল চোখে পড়েনি আমার, শিলা। আপনি সত্যি দেখেছিলেন তো? কোথায়, কখন?’

‘তখন তো দেখেছিলাম মনে হচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে দেখার ভুল হতে পারে। আপনি যখন ডিকটেশন দিয়ে এক মিনিটের জন্য থেমে কী যেন ভাবতে শুরু করলেন তখন বেড়ালটাকে দেখি আমি। হলওয়ে প্যাসেজের কোণায় দাঁড়িয়ে ছিল ওটা, রান্নাঘর লাগোয়া সিঁড়ির ধারে। আপনার মনোযোগ নষ্ট হবে ভেবে ওটাকে ডাকিনি আমি। আপনি আবার ডিকটেশন শুরু করলেন, তাকিয়ে দেখি চলে গেছে ওটা।’

এক মুহূর্ত চুপ করে রইল শিলা। তারপর বলল, ‘এখন মনে হচ্ছে ভুলই দেখেছি। অবশ্য ওই সময় ভুল কিছু দেখা অস্বাভাবিক ছিল না।

‘আমারও তাই ধারণা,’ তরল গলায় বললেন ডক্টর। যাহোক, আমার বাড়িতে বেড়ালের খোঁজ পেলে আপনাকে জানাব আমি।’

কিছুক্ষণ কোনও কথা হলো না দু’জনে। আপন মনে গাড়ি চালাচ্ছেন আবরার, নীরবতা ভেঙে শিলা বলল, ‘ডক্টর, আপনার কি মনে হয় এমন কোনও রোগ সত্যি আছে যা প্রাণী থেকে মানুষের দেহে ছড়িয়ে পড়ে সবাইকে আত্মহত্যা করতে প্ররোচনা যোগায়?

‘এমন কোনও রোগের কথা শুনিনি কখনও। এটা খুব বিরল কোনও রোগ হবে।’

‘খুবই বিরল। এমন কোনও রোগের অস্তিত্ব থাকলে নিশ্চয়ই শুনতে পেতাম।’

‘ঠিকই বলেছেন। তবে, শিলা, ওই রোগের কথা বাদ দিয়ে অন্য কোন সম্ভাবনার কথা মনে হয় না আপনার? অদ্ভুত কোনও কাকতালীয় ঘটনা-অন্য কোনও ব্যাখ্যা?’

‘হ্যাঁ, ব্যাখ্যা আমি একটা দিতে পারি। আপনি গাডারডিন সোয়াইনের কথা শুনেছেন, ডক্টর?’

চোদ্দ

‘গাডারডিন সোয়াইন…’ আনমনা গলায় বললেন ডক্টর। ‘কথাটা কোথায় যেন শুনেছি। কিন্তু মনে করতে পারছি না।’

‘বাইবেলে আছে,’ বলল শিলা। ‘বুক অভ লিউকে। একবার যীশুখৃষ্ট ভূতে পাওয়া এক লোককে দর্শন দিতে এলেন। কাছেই ছিল একদল রাজহাঁস। দাঁড়ান, বাইবেল থেকে উদ্ধৃতিটা তুলে ধরছি আমি তারপর শয়তান বা ভূতগুলো লোকটিকে ছাড়িয়া চলিয়া গেল এবং প্রবেশ করিল রাজহাঁসদের মধ্যে এবং রাজহাঁসের দল দ্রুত হ্রদের গভীরে নামিয়ে পড়িল এবং দম বন্ধ হইয়া মরিয়া গেল।’

ডক্টর আঁতকে উঠলেন। শিলা, আপনি নিশ্চয়ই বলতে চাইছেন না যে আপনি ভূত বা জিমে ধরা কোনও কিছুতে বিশ্বাস করেন।

‘অবশ্যই বিশ্বাস করি না। তবে কারও ওপর ভর করা-’

‘কে বা কী ভর করবে? আমি বাস্তববাদী মানুষ, শিলা। আমি টেলিপ্যাথি বা টেলিকাইনিসিসের সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিতে চাই না। এমনকী সম্মোহন বা পোস্ট হিপনোটিক সাজেশনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও মেনে নিতে রাজি। কিন্তু প্যারাসাইকোলজি যদি ব্যাখ্যাও দিতে চায় যে কেউ কারও ওপর ভর করতে পারে এবং তাকে ভেতর থেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে, আমি তা বিশ্বাস করব না কিছুতেই।’

‘কিন্তু এ কথা বিশ্বাস করেন, এ- ব্রহ্মাণ্ডে পৃথিবী ছাড়াও ছড়িয়ে আছে কোটি কোটি গ্রহ? এ সব গ্রহে যে অন্য কোনও প্রাণীর বাস নেই তা কী করে-কী করে জানব, ও সব গ্রহের কোনও প্রাণীর অন্যের ওপর ভর করে তাকে দিয়ে যা খুশি করানোর ক্ষমতা রাখে? আপনি কী করে নিশ্চিত হন এসব ঘটনার পেছনে ভিনগ্রহবাসীর হাত নেই?’

‘হুম্‌ম’ বললেন আবরার। ‘আমি নিশ্চিত হয়ে কিছু বলছি না। আর জানিও না সত্যি এরকম কিছু এখানে আছে কিনা। কিন্তু শুধু একজন ভিনগ্রহবাসী কেন, ভিনগ্রহবাসীরা নয় কেন?

‘কারণ আমার ধারণা একজনই এসব ঘটাচ্ছে। ভেবে দেখুন, মেঠো ইঁদুরটা মারা যাবার পর রনি মরে গেল। তারপর মরল রনিকে খুঁজতে যাওয়া কুকুরটা, তারপর পেঁচাটা, তারপর বেড়ালটা। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি কী বলতে চাইছি। দুটো মৃত্যুর ঘটনা কখনোই একসাথে ঘটছে না। যে এ ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে সে একজনকে মেরে তারপর আরেকজনকে তার হোস্ট বানাচ্ছে। অর্থাৎ হোস্টের মৃত্যু ঘটার পর সে মুক্ত হয়ে যাচ্ছে।

শোল্ডার ব্লেডে কী যেন সুড়সুড় করে উঠল ডক্টরের। কণ্ঠে জোর এনে বললেন, ‘এ সবই আসলে আপনার কল্পনা, আমারও মনে হয় রহস্য সাহিত্য ছেড়ে এখন থেকে সায়েন্স ফিকশন পড়তে হবে।’

‘তাই পড়ন। তবে যা ঘটছে, একটু খতিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন তা নিছক কল্পনা হয়তো নয়। আপনার বাড়িতে যে বেড়ালটাকে আমি দেখেছি, ওটা যদি সত্যি ওখানে থেকে থাকে, আমার ধারণা ওটা সেই ভিনগ্রহবাসীর হোস্ট। বেড়ালটাকে পাঠানো হয়েছে আমাদের ওপর নজর রাখার জন্য।’

হেসে উঠলেন আবরার। ‘তা হলে ওটাকে হত্যা করার পর ভিনগ্রহবাসী নিশ্চয়ই আমার ওপর ভর করবে? যদি এমন কিছু ঘটে, আপনাকে আমি জানাব, শিলা।’

ঠাট্টা করে কথাটা বললেও শিলাকে তার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে নিজের বাড়িতে ঢোকার সময় ব্যাপারটা আর ঠাট্টা মনে হলো না ডক্টর আবরারের কাছে। শিলা যা বলেছে তার কোনও যুক্তি নেই। কিন্তু ব্যাপারটা যদি সত্যি হয়?

দরজা সাবধানে বন্ধ করলেন ডক্টর। চারপাশে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। কিছুই চোখে পড়ল না, কিছু শুনতেও পেলেন না।

পাইপ ধরিয়ে লিভিংরুমে চলে এলেন তিনি, বসলেন গদি মোড়া চেয়ারে। একটা পেপার ব্যাক টেনে নিলেন। কিন্তু বইটা খুলতে ইচ্ছে করল না।

বাড়িটা সার্চ করে দেখবেন, নাকি একবার? কিন্তু বেড়াল খোঁজার কাজ বড় ক্লান্তিকর। আর এখানে বুদ্ধিমান কোনও বেড়াল লুকিয়ে থাকবে বলেও মনে হয় না। কারণ এখানে লুকোনোর জায়গাও নেই। আর কোথায় খুঁজবেন তিনি? হয়তো ওটা এখন কিচেনে বসে আছে। তাঁর আওয়াজ পেয়ে হলঘরে ঢুকে পড়বে। আর বেড়াল নিঃশব্দে চলাফেরায় ওস্তাদ। তিনি টেরও পাবেন না কোত্থেকে কোথায় যাচ্ছে ওটা

অবশ্য ওটা যদি সত্যি বেড়াল হয়ে থাকে। ওটা কি সত্যি বেড়াল? সাধারণ বেড়াল হলে তো লুকোচুরি খেলার কথা নয়। এতক্ষণ লুকিয়েও বা থাকবে কেন?

বেড়ালটাকে আবার খোঁজা শুরু করলেন ডক্টর কিন্তু বৃথাই খোঁজ চলল। ওটার টিকিটিও দেখা গেল না কোথাও। খুঁজতে খুঁজতে খিদে লেগে গেল আবরারের। তিনি দরজা ভাল করে বন্ধ করে খেতে গেলেন পাবে। ওখানে ডিনার সেরে, পোকার খেলে বাড়ি ফিরতে ফিরতে মাঝরাত হয়ে গেল।

বাড়ি ফেরার পর আবার বেড়ালের চিন্তায় পেয়ে বসল তাঁকে। চাঁদের আলোয় ফক ফক করছে সারা বাড়ি। ইঁদুর দৌড়ে গেলেও চোখে পড়বে আবরারের। তিনি কিচেনে ঢুকে আলো জ্বাললেন। যাবার আগে ময়দা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন মেঝেতে। যদি সত্যি বাড়িতে বেড়াল থাকে, ময়দা খাওয়ার লোভে ওটা আসতে পারে ওখানে।

ময়দার ওপর বেড়ালের পায়ের ছাপ! উঁচু স্বরে ডাকলেন ডক্টর। ঠিক আছে, বেড়াল, তোমার চেহারাটা এবার দয়া করে দেখাও বাপু। কোনও কিছু খেতে চাইলে বলো। আমি তোমাকে মারব না। তবে তোমার চেহারা না দেখা পর্যন্ত তোমাকে আমি এখান থেকে যেতেও দেব না।’

ফ্রিজ খুলে বিয়ারের ক্যান বের করলেন আবরার, বসলেন টেবিলে। এই প্রথম তাঁর ভয় ভয় লাগছে। ভয়টা কী নিয়ে বুঝতে পারছেন না, তবে জানেন কিচেনের আলো নিভিয়ে অন্ধকারে দোতলার বেডরুমে যাওয়া সম্ভব হবে না তাঁর পক্ষে!

বিয়ার শেষ করে কাপ বোর্ডের ড্রয়ার খুলে একটা ফ্লাশলাইট বের করলেন আবরার, তারপর কিচেনের বাতি নিভিয়ে দিলেন।

ফ্লাশলাইট জ্বেলে সিঁড়ি বাইতে শুরু করলেন ডক্টর। কাজটা হাস্যকর হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ফ্লাশলাইট নেভাতে সাহস হলো না তাঁর।

হলঘরে বা সিঁড়িতে কেউ নেই। বেডরুম তন্নতন্ন করে খুঁজেও কাউকে দেখতে পেলেন না। এমনকী খাটের নীচেও লুকিয়ে নেই বেড়ালটা। তা হলে কই গেল? বাড়ির ভেতরেই কোথাও আছে নিশ্চয়। ঘুমের মধ্যে ওটা যাতে তাঁর রুমে ঢুকে পড়তে না পারে সে জন্যে বেডরুমের দরজা বন্ধ করে দিলেন ডক্টর। বিছানায় শুয়ে মনে হলো ওপরে ওঠার সময় বন্দুক নিয়ে এলে বোধহয় ভাল হত।

পনেরো

ডক্টর আবরার যখন বলছেন ‘ঠিক আছে, বেড়াল,’ কথাটা শুনে রীতিমত আতঙ্ক বোধ করছিল ভিনগ্রহের হন্তারক। ভয় পাবার কারণ আবরার কিছু একটা সন্দেহ করে বসেছেন যা তাঁর অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলতে পারে। তবে আবরারকে তার যথার্থ হোস্ট মনে হয়েছে-একজন টপ ইলেকট্রনিক্স, পয়সাওয়ালা, সর্বত্র অবাধ বিচরণ, বিয়ে থা করেননি। আবরারের সঙ্গে শিলা ডিকটেশন পর্বের কোনও কিছুই তার কান এড়িয়ে যায়নি। আবরারকে তার হোস্ট হিসেবে খুবই নির্ভরযোগ্য মনে হয়েছে। মনে হয়েছে এই লোকের ওপর ভর করলে অল্প কদিনের মধ্যে সে নিজের গ্রহে ফিরে যেতে পারবে।

তবে সে একটা ভুল করে বসেছে। তার উচিত ছিল সাধারণ বেড়ালের মত আচরণ করা। সে যদি ওদের সামনে ঘুরঘুর করত তা হলে ওরা বরং তাকে আদরই করত। হয়তো দুধ খেতে দিত। তারপর বাড়ির বাইরেও যেতে দিত। তা হলে অনেক আগেই সে মুক্ত হয়ে যেতে পারত। ফিরতে পারত কোহ্‌লদের খামার বাড়িতে, নিজের নিরাপদ খোলের মধ্যে। তারপর সুযোগ বুঝে, কাউকে হোস্ট বানিয়ে আবরারের বাড়িতে আসত সে, ঘুমন্ত আবরারের ওপর নিয়ন্ত্রণ-আরোপ করা সহজ হত তখন।

তবে ভুল যখন হয়ে গেছে, এখন তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে। লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে। পালাবার রাস্তা নেই। আবরারটা যা চালাক! সমস্ত দরজা- জানালা বন্ধ করে রেখেছে। আর ময়দার ওপর তার পায়ের ছাপ দেখার পর আবরার তো এখন জানেই সে এখানে আছে।

প্রশ্ন হলো আবরার তার সম্পর্কে কতটুকু কী ধারণা করতে পেরেছে? কিন্তু একটা সন্দেহ সে করে বসেছে তা তো বোঝাই যায়। আবরারের ময়দার ফাঁদে পা দেয়াটাও ভুল হয়েছে। তবে নিজের পায়ের ছাপ মোছার উপায় ছিল না তার ক্ষুদ্র শরীর নিয়ে।

তার আতংক হচ্ছে আবরারের সাম্প্রতিক আচার-আচরণ দেখে। বুদ্ধিমান আবরাব কি দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নিয়েছে? বুঝে ফেলেছে তার বাড়িতে যে বেড়ালটা আটকা পড়েছে আদৌ সেটা বেড়াল নয়? হয়তো বা। নইলে সে ওভাবে বেড়ালটাকে সম্বোধন করবে কেন? বোঝাই যাচ্ছে আবরার ঘটে অঢেল বুদ্ধি রাখে। কিন্তু কতটা বুদ্ধি রাখে জানতে হলে লোকটার ওপর তাকে ভর করতে হবে। আর সেটা করতে হলে এই বেড়ালের শরীর থেকে তাকে বেরিয়ে আসতে হবে। সে কি আবার আত্মহত্যার রাস্তা ধরবে? কিন্তু এই বেড়ালটাকে দিয়েও আত্মহত্যা করালে আবরারের কাছে সমস্ত রহস্য ফাঁস হয়ে যাবে। সে ঠিক বুঝে নেবে ভিনগ্রহের কোনও প্রাণীই শুরু থেকে একের পর একজনকে আত্মহত্যায় বাধ্য করেছে।

এখন তার এ বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার আপাতত উপায় একটাই—কাল সকালে লুকানো জায়গা থেকে বেরিয়ে নিজের চেহারা দেখানো এবং সাধারণ বেড়ালের মত আচরণ করা। কাজটা ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু এ ছাড়া বিকল্পও নেই তবে বিপদ ওটা নয় যে আবরার তাকে দেখা মাত্র গুলি করে মেরে ফেলবে। তা হলে তো সে বেঁচেই যায়। আর আবরার যদি তার হোস্টদের সম্পর্কে জেনে থাকে, খুনখারাবীর দিকে সে যাবে সব শেষে। কারণ সে বুঝতে পারবে হোস্টকে হত্যা করা মানে যে ওটার ওপর ভর করে আছে তাকে মুক্ত করে দেয়া। সমস্যা হলো, আবরার ব্যাপারটা টের পেয়ে গেলে তাকে ধরে হয়তো খাঁচায় পুরে রাখবে। এরচে’ বাজে ব্যাপার আর কী হতে পারে? বেড়ালটার স্বাভাবিক মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত সে মুক্ত হতেও পারবে না। আর আবরার বিজ্ঞানী। তাকে নিয়ে হয়তো অনেক অসহ্য পরীক্ষা নিরীক্ষা সে চালাবে। তারচেয়েও ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো সে হয়তো পুষ্টির অভাবে বেড়ালের শরীরের মধ্যেই একসময় মরে যাবে। কোহলদের বাড়িতে পুষ্টিকর যে সলিউশন সে খেয়েছে তাতে এক মাস টিকে থাকা যাবে, একবছর নয়। আর বন্দী অবস্থায় সে যদি যথার্থ পুষ্টি না পায় তা হলে মৃত্যু তার অনিবার্য।

সারারাত সে এসব নিয়ে ভাবল। একবার ভাবল জানালা ভেঙে লাফিয়ে পড়ে নীচে। কিন্তু সেটা সেই আত্মহত্যাই হবে, লাভ হবে না কিছু।

সে এখন এটুকুই আশা করতে পারে, আবরার যা সন্দেহ করেছে তা স্রেফ সন্দেহই মনে হবে তার কাছে এবং কাল সকালে আবরার তাকে বেরুতে দেবে। তাকে এখন প্রমাণ করতে হবে সাধারণ একটা বেড়াল ছাড়া অন্য কিছু নয় সে।

.

আগের রাতে ঘুমুতে ঘুমুতে রাত একটা বেজে গিয়েছিল, সকালে ঘুম ভেঙে ড. আবরার দেখেন ঘড়ির কাঁটা দশটা ছাড়িয়ে গেছে। ঘুমের মধ্যে বিশ্রী সব স্বপ্ন দেখেছেন তিনি। অনেকক্ষণ চুপচাপ শুয়ে রইলেন বিছানায়। হঠাৎ বেড়ালটার কথা মনে পড়ে গেল তাঁর।

বেড়াল বিষয়ক ভীতি এ মুহূর্তে তেমন কাজ করছে না তাঁর মধ্যে, দিনের আলোয় অনেকটাই দূর হয়ে গেছে ভয়। মনে হচ্ছে গত দশদিনের অদ্ভুত মৃত্যুগুলোর একটার সাথে আরেকটাকে সম্পর্কযুক্ত করে ব্যাপারটাকে অতিরঞ্জিত করে ফেলেছেন তিনি।

…হয়তো বা। তারপরও কিছু জিনিস অব্যাখ্যাত থেকে যাচ্ছে। তাঁর বাড়িতে লুকিয়ে থাকা বেড়ালটার গতিবিধি এত রহস্যময় কেন? ওটা কেন শুধু লুকিয়ে থাকছে? তবে কি ওই বেড়ালটা মানুষজন ভয় পায়? বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে ওটা, রাস্তার ছেলেরা ঢিল মেরে মানুষ সম্বন্ধে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে ওটার মধ্যে?

সে যাহোক, আবরার সিদ্ধান্ত নিলেন আজ বেড়ালটাকে খুঁজে বের করবেনই।

তবে আজ আর ওটাকে খুঁজতে হলো না। নীচে নামতেই আবরার দেখতে পেলেন সামনের দরজায় নিতান্ত নিরীহ চেহারা নিয়ে বসে আছে বেড়ালটা।

বেড়ালটাকে তাঁর মোটেই বিপজ্জনক মনে হলো না। ছোট, ধূসর রঙের বেড়াল। দেখে মনে হচ্ছে না ক্ষুধার্ত বা আবরারকে দেখে ভয় পেয়েছে। বরং চাউনিতে যেন বন্ধুত্বের আভাস। মিউ করে ডেকে উঠল বেড়াল, দরজায় থাবা দিয়ে আঁচড়াল। বেরুতে চায়। ওটার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন আবরার। ‘এখন নয়, বেড়াল। পরে। আগে তোমার সাথে কিছু কথা বলা দরকার। এসো, নাস্তা খেয়ে নিই।’

রান্নাঘরে ঢুকলেন ডক্টর, পিছু পিছু বেড়ালও। তবে এত কাছে নয় যে আবরার ওটার গায়ে লাথি মারতে পারবেন। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে মেঝের ওপর বসল ওটা, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ডক্টরের দিকে। যেন বলতে চাইছে, ‘আমাকে বেরুতে দাও, প্লীজ।’

এদিক-ওদিক মাথা নাড়লেন ডক্টর, কঠিন গলায় বললেন, ‘না বেড়াল। এখন কোথাও যেতে দেয়া যাবে না তোমাকে। আগে আমাকে ভাবতে দাও।’ ফ্রিজ খুলে দুধ বের করলেন তিনি, একটা বাটিতে ঢেলে এগিয়ে দিলেন বেড়ালটার দিকে। বেড়ালটা ফিরেও তাকাল না ওদিকে। আবরার নিজের জন্যে নাস্তা তৈরি করছেন, সে আগের জায়গায় ঠায় বসে রইল। ডিমভাজা আর কফি নিয়ে টেবিলে বসলেন ডক্টর, নড়ে উঠল বেড়াল, ঝাঁপিয়ে পড়ল দুধের বাটিতে, চুকচুক করে খেতে লাগল।

‘সুন্দর বিল্লি,’ ডিম ভাজায় কামড় দিয়ে বললেন ডক্টর। ‘আমি এখন একটু বেরুব। তুমি বাড়িতেই থেকো কেমন?’

বেড়াল কোনও জবাব দিল না, শুধু একবার মুখ তুলে তাকাল আবরারের দিকে।

আবরার বেরুবেন বেড়ালটার ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিতে। যদি এটা কারও হারানো বেড়াল হয়, তাঁকে তিনি ফেরত দিয়ে দেবেন। আর সেই লোক যদি তাঁকে বেড়ালটা বিক্রি করতে চায়, সানন্দে কিনে নেবেন তিনি। কারণ বেড়ালটাকে ভারী পছন্দ হয়েছে তাঁর। সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছেন গোটা বাড়িতে নেট লাগাবেন। এখানে মাছির বড় উৎপাত। বেড়ালটাকে জ্বালিয়ে মারবে।

কফির কাপে চুমুক দিয়ে আবরার বেড়ালটাকে বললেন, ‘সিরিয়াসলি বলছি এখানে কটা দিন থাকতে কেমন লাগবে তোমার? আর ভাল কথা, কী নাম তোমার?’

বেড়াল দুধ খাচ্ছিল, খেতেই লাগল।

‘বুঝলাম। বলবে না। ঠিক আছে, তোমাকে আজ থেকে বিল্লি বলে ডাকব, কি রাজি?’

দুধের বাটি প্রায় শেষ, বেড়াল দরজার ধারে গিয়ে বসে বলল, ‘ম্যাও।’

‘বুঝলাম রাজি,’ বললেন আবরার। ‘তবে তোমার আচরণ দেখে বুঝতে পারছি তুমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছ। ঠিক আছে, আমি দেখছি কার বাড়ির পোষা মিনি তুমি।’

.

হারানো বেড়ালের খোঁজে শহরে এলেন ড. আবরার! ক্লারিয়ন পত্রিকার সম্পাদককে বললেন তাঁর বাড়ির ধূসর বেড়ালের কথা। জানতে চাইলেন কোথায় খোঁজ নিলে জানা যাবে কারও ধূসর রঙের বেড়াল হারানো গেছে কিনা। ক্রামারদের বাড়িতে খোঁজ নিতে বললেন এড হোলিস। ওদের বাড়িতে অনেক বেড়াল আছে। কোলদের প্রতিবেশী ওরা।

ক্রামারদের বাড়ি যাবার আগে শিলাকে ফোন করলেন আবরার। শিলা জানাল বিষ্যুদবারের মধ্যে সে কাজ শেষ করতে পারবে। এরপর জানতে চাইল আবরার বেড়ালের খোঁজ পেয়েছেন কিনা। আবরার বেড়াল বিষয়ক সমস্ত ঘটনা তাকে বললেন। তারপর রওনা হয়ে গেলেন ক্রামারদের বাড়ির উদ্দেশে।

মিসেস ক্রামারের সাথে দেখা হলো আবরারের। কথা শুনে বোঝা গেল আবরারকে চেনেন তিনি, এর আগেও দেখেছেন। ‘ভেতরে আসুন,’ আমন্ত্রণ জানাল মিসেস ক্রামার।

‘আজ থাক, মিসেস ক্রামার, বিনয়ের সুরে বললেন ডক্টর! ‘ছুটকো একটা কাজে আপনাকে বিরক্ত করছি। শুনলাম আপনার একটা ধূসর বেড়াল আছে। আমার বাড়িতেও ধূসর রঙের একটা বেড়াল হঠাৎ ঢুকে পড়েছে। ভাবলাম-’

জ্বী, আমার ধূসর রঙের একটা বেড়াল ছিল। দুদিন ধরে ওটা লাপাত্তা।’

‘তা হলে ও বেড়ালটাই আপনার হবে। আমি ওটাকে পুষব ভাবছি। অবশ্য আপনি যদি বিক্রি করতে রাজি হন—’

হেসে উঠলেন মহিলা। ‘বিক্রি করার প্রশ্নই ওঠে না। তবে আপনি পুষতে চাইলে রেখে দিতে পারেন! আমার বাড়িতে বেড়ালের অভাব নেই।’

‘ধন্যবাদ। মিসেস ক্রামার। আপনার ধূসর বেড়ালটার নাম কী?’

‘জেরী।’

‘আমি ওর নাম দিয়েছি বিল্লি। কেমন হয়েছে বলুন তো।’

জবাবে হাসিতে ফেটে পড়লেন মিসেস ক্রামার।

.

বেড়ালটা নিশ্চয়ই শুনতে পেয়েছে ডক্টর আবরার আসছেন, সে তাড়াতাড়ি দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। আবরার দরজা খুলতেই বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করল, চট করে ওটাকে ধরে ফেললেন আবরার। ‘উঁহু, তোমার কোথাও যাওয়া চলবে না, বিল্লি। আমার সাথে কয়েকদিন তোমাকে থাকতে হবে। তারপর সিদ্ধান্ত নেবে বিল্লি হয়ে আমার কাছে থাকবে নাকি জেরী হয়ে ফিরে যাবে ক্রামারদের কাছে।

ষোলো

মশা-মাছি প্রতিরোধের জন্যে বাড়িতে নেট টাঙানো দরকার! তাই ডক্টর আবরার পরদিন শহরে গেলেন ছুতোর মিস্ত্রি হ্যাঙ্ক পার্ডির সাথে কথা বলতে। পার্ডি বলল এখন সে খুব ব্যস্ত, আগামী হপ্তার আগে সময় দিতে পারবে না। ‘ঠিক আছে’ বলে ওখান থেকে সোজা শিলা রহমানের বাসায় গেলেন আবরার।

আজ বিষ্যুদবার। শিলা অপেক্ষা করছিল ডক্টরের জন্যে। তাঁর গাড়ির আওয়াজ শুনেই দরজা খুলে দিল।

‘আসুন, ডক্টর। সব রেডিই আছে। বসুন, আমি নোটবই আর ম্যানুস্ক্রিপ্ট নিয়ে আসছি।’

‘ধন্যবাদ, মিস শিলা। তবে আমার বন্ধুদের যে চিঠি লেখার কথা বলেছিলাম আজ জার আপনাকে দিয়ে তা লেখাব না। চিঠি এবং স্টেটমেন্ট পাঠাবার আগে আরও দু’একটা দিন একটু ভেবে নিই। এর মধ্যে কোনও ঘটনা ঘটলে ওর মধ্যে যোগ করতে পারব।’

ঠিক আছে। আপনার যেমন ইচ্ছা,’ একটা বড়, বাদামী খাম এগিয়ে দিল শিলা আবরারকে। ‘পড়ে শোনাব এখন?’

মাথা নাড়লেন আবরার। ‘বাসায় বসে পড়ব। আপনার সময় থাকলে বরং দু’চারটে কথা বলি।’

শিলা রহমানের সময় আছে। ডক্টর বেড়ালটার কথা বললেন ওকে। ‘ওটাকে নিয়ে যে ভয় কাজ করছিল মনে তা অনেকটাই কেটে গেছে,’ হাসলেন তিনি। ‘আসলে আপনার ভূতে ধরা বা ওই ধরনের কথা শুনে আমার মনেও ভয় ধরে গিয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে বেড়ালটাকে ভয় পাবার কিছু নেই। নিতান্তই সাধারণ একটা বেড়াল ওটা, মিস শিলা।’

‘আর টাইগারও সাধারণ একটা কুকুর ছিল, অন্তত আপনার গাড়ির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত। তবে আপনি যা-ই বলুন, ডক্টর, আমি কিন্তু পুরোপুরি দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারছি না। ব্যাপারটা যদিও হাস্যকর শোনাচ্ছে- কিন্তু আপনাকে নিয়ে আমি চিন্তায় আছি।’

‘আমার কিছু হবে না, মিস শিলা। আসলে আমরা দু’জনেই ব্যাপারটাকে অতিরঞ্জিত করে ফেলেছি।

‘হয়তো ডক্টর…আপনি চিঠি আর রিপোর্টগুলো আপনার বন্ধুদের পাঠাবেন তো?’

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আবরার। ‘আচ্ছা, পাঠাব। তবে ক’টা দিন সময় দিন।

‘আচ্ছা, সময় নিন। আমি এ হপ্তাটা বাড়িতেই আছি। কাজেই যে কোনও সময় এলেই আমাকে পাবেন।

সে রাতে, খাওয়া-দাওয়া শেষে, লিভিংরুমের সোফায় এসে বসেছেন আবরার, বেড়ালটা তাঁর পাশে বসল। তিনি ওর নরম, রেশমি লোমে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আরামে গরগর করল বেড়াল।

‘তারপর, খবর কী তোমার, বিল্লি?’ বললেন তিনি। ‘ভাল লাগছে এখানে থাকতে? পছন্দ হচ্ছে আমাকে? বন্দী বন্দী লাগছে না তো? ঠিক আছে তোমাকে আমি কাল-পরশুর মধ্যে একবার বাইরে যেতে দেব। এখন আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দাও দেখি।’

উঠে দাঁড়ালেন আবরার, একটা চেয়ার টেনে মুখোমুখি বসলেন বেড়ালটার। আবার শুরু করলেন, ‘বিল্লি, তুমি লুকিয়েছিলে কেন? দোতলার জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকেছ কেন? জান না, বেড়ালরা অমন কাজ করে না, এখনকার মত স্বাভাবিক আচরণ কেন করনি তুমি আগে?’

থাবা দুটো টানটান করল বেড়াল, তারপর আবার কুণ্ডলী পাকিয়ে বন্ধ করল চোখ।

‘বিল্লি,’ কঠিন গলায় তাকালেন আবরার। চোখ খুলে গেল ওটার, তাকাল ডক্টরের দিকে।

‘বিল্লি, আমি কথা বলার সময় ঘুমানো চলবে না, তুমি তো কোলদের প্রতিবেশীদের বাড়িতে থাকতে। জানো, হেলমুট যেদিন আত্মহত্যা করেছে, সে রাতে তাদের একটা বেড়ালও একই কাজ করেছে? সোজা একটা হিংস কুকুরের মুখে গিয়ে পড়েছে। কিন্তু কেন আত্মহত্যা করবে?’

বেড়ালটা আবার চোখ বুজল, তবে আবরারের মনে হলো ঘুমায়নি ওটা।

‘একই রাতে একটা পেঁচাও আত্মহত্যা করেছে, সে কথা জানো? তার আগে রনি মারা গেল, মারা গেল ওদের কুকুরটাও, আমারই গাড়ির নীচে চাপা পড়ে। কুকুরটা লুকিয়ে ছিল রাস্তার পাশে, আমার গাড়ি লক্ষ্য করে লাফ দিয়েছে। ইচ্ছে করে।

‘দুটো মানুষ। চারটে প্রাণী-এরা সবাই আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু কেন? নাকি ওদের আত্মহত্যায় বাধ্য করা হয়েছে কারও স্বার্থ হাসিল হবার পর? কেউ কি ওদের ব্যবহার করেছে?’

বাইরে হাজার হাজার ঝিঁঝিঁ ডাকছে, জানালা দিয়ে তাকালেন আবরার। নিকষ অন্ধকার। তার মনে পড়ছে লেমিংদের কথা। এরা দল বেঁধে সাগরে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। ওরা কি সবাই পাগল? নাকি লেমিংরা এমন কিছু জানে যার কথা আমরা জানি না। তিনি আবার ঘুরলেন বেড়ালের দিকে

‘বিল্লি, ওই প্রাণীগুলো কেন আত্মহত্যা করেছে, বলো তো? তুমি যদি ওদের একজন হও তা হলে তুমি কেন কাজটা করছ না? নাকি এখানে বদ্ধ অবস্থায় থেকে আত্মহত্যার সুযোগ পাচ্ছ না? ঠিক আছে, ব্যাপারটা আমি এখুনি পরীক্ষা করে দেখছি।’

লিভিংরুম থেকে বেরিয়ে নীচতলার স্টোররুমে ঢুকলেন ডক্টর, এখানে তিনি মাছ ধরার সরঞ্জামের সাথে কিছু আর্মসও রেখেছেন। গরমের সময় উইসকনসিনে শিকার তেমন কিছু মেলে না জেনেও আবরার একটা পিস্তল আর রাইফেল নিয়ে এসেছেন টার্গেট প্রাকটিসের জন্যে। সেই সাথে ব্রান্ড নিউ শটগানও রয়েছে। নতুন অস্ত্রটা যদি কোনও কাজ লাগানো যায়, এই ভেবে আনা।

পিস্তলটা নিলেন তিনি, একটা .৩৮ ক্যালিবারের স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন স্পেশালের সাথে একটা কার্ডবোর্ড রাইফেল টার্গেটও বের করলেন। তারপর বন্দুক নিয়ে চৌকোনা কার্ডবোর্ডটা লিভিংরুম এবং হলঘরের মাঝামাঝি মেঝের ওপর দাঁড় করিয়ে ফিরে গেলেন নিজের আসনে। বন্দুক কক করার শব্দে মাথা তুলল বেড়াল।

‘শোনো, বিল্লি,’ বললেন তিনি, ‘এসো, ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখ। তুমি যদি বাইরে যেতে চাও আত্মহত্যা করতে তা হলে কাজটা সহজ করে দিচ্ছি তোমার জন্যে। ওই দরজার কাছে যাও, টার্গেটের ওপর বসো, আমি তোমাকে গুলি করে মেরে ফেলি।’

বেড়ালটা ঘুমঘুম চোখে একবার পিটপিট করে তাকাল আবরারের দিকে, তারপর মাথা নামিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল-নাকি ঘুমের ভান করল?

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন ডক্টর। তিনিও ধরে নিয়েছিলেন বেড়ালটা টার্গেটে গিয়ে বসবে না। তিনি পিস্তল আর টার্গেট আগের জায়গায় রেখে কিচেনে ঢুকলেন। ঘুমাবার আগে এক গ্লাস বিয়ার খাওয়া দরকার।

পরদিন শুক্রবার। শহরে গেলেন আবরার আড্ডা দিতে। বেরুবার আগে বেড়ালটার আচরণে কোনও অস্বাভাবিকতা লক্ষ না করে খুশিই হয়েছেন তিনি। ওকে নাস্তা দিয়েছেন তিনি। বেড়ালটা চেটেপুটে সব খেয়েছে। যেন এ বাড়ির পরিবেশের সাথে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে সে। নাকি এটা আবরারকে পটানোর জন্য করছে? জানে, আবরার তাকে সোমবার বাইরে যেতে দেবেন। তবে ব্যাপারটা নিয়ে বিশেষ চিন্তা করেননি আবরার। শহরে এসে তার সম্পাদক বন্ধুর সাথে আড্ডা দিলেন। তারপর লেকে গেলেন মাছ ধরতে। তিনটে মাছ ধরা পড়ল বড়শিতে। দুটো তিনি রান্না করে খেলেন, বাকিটা বেড়ালকে দিলেন। বেড়াল গোগ্রাসে গলাধঃকরণ করল ওটা। আবরার বললেন, ‘যদি আমার সাথে থাকো তা হলে তিনদিন অন্তর মাছ খেতে দেব তোমাকে।

বেড়াল কিছু বলল না। চোখ বুজে পরম আয়েশে কাঁটা চিবোচ্ছে।

সোমবার সকাল থেকে ঝিরঝির বৃষ্টি শুরু হলো। আজ বেড়ালটাকে বাইরে যেতে দেয়ার দিন। আবরার পরীক্ষা করে দেখতে চান বেড়ালটা তার আগের আস্তানায় ফিরে যায় নাকি তাঁর কাছেই ফিরে আসে।

কাঁটায় কাঁটায় দশটার সময় দরজা খুলে দিলেন আবরার। বেড়ালটা লাফঝাঁপ দিল না, হালকা পায়ে বেরিয়ে গেল খোলা দরজা দিয়ে।

বিনকিউলার রেডিই ছিল, আবরার দ্রুত উঠে এলেন দোতলায়। বেড়ালটা কোন দিকে যায় দেখবেন। বেড়ালটা হেলেদুলে হাঁটছে রাস্তা দিয়ে, কোনও তাড়া নেই। আস্তে হেঁটে ওটা পৌঁছল রাস্তার শেষ মাথায়, দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল আবরারের বাড়ির দিকে। চট করে জানালার পাশ দিয়ে সরে গেলেন আবরার। ওটা কি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে যাবে কি যাবে না? নাকি দেখছে কেউ ওকে লক্ষ করছে কিনা।

রাস্তার শেষ মাথায় কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল বেড়াল! তারপর আবার হাঁটা দিল। এবার আগের চেয়ে দ্রুত। তবে যে রাস্তাটা ক্রামারদের বাড়ির দিকে গেছে সেদিকে নয়, জঙ্গলের দিকে! খানিক পরে অদৃশ্য হয়ে গেল জঙ্গলের মধ্যে।

বিনকিউলার চোখ থেকে নামিয়ে চাঁদি চুলকালেন ডক্টর আবরার। ওটার আচরণ তো এ পর্যন্ত স্বাভাবিকই মনে হলো। তবে-

আবরার সিদ্ধান্ত নিলেন বেড়ালটার খোঁজে জঙ্গলে যাবেন। বৃষ্টি থেমেছে আধা ঘণ্টা আগে। ভেজা মাটিতে বেড়ালের পায়ের ছাপ ফুটে থাকবে। তিনি দেখতে চান বেড়ালটা কোথায় গেল। এই ফাঁকে একটু বেরিয়ে আসাও হবে।

মাথায় হ্যাট চাপিয়ে, বগলে রেইনকোট নিয়ে (হঠাৎ যদি আবার বৃষ্টি নামে) বেরিয়ে পড়লেন আবরার। মাটিতে বেড়ালটার পায়ের ছাপ ফুটে আছে স্পষ্ট। তবে জঙ্গলের মধ্যে ছাপ খুঁজে পেতে কষ্ট হলো। কারণ এদিকের বেশির ভাগ রাস্তায় ঘাস জন্মেছে। তবে বাঁচোয়া এটাই যে, বেড়ালটা দিক বদল না করে সোজা রাস্তায় এগিয়েছে।

প্রায় দেড় মাইল হাঁটার পর ট্রেইল শেষ হয়ে গেল। সামনে হাত চারেক প্রশস্ত ছোট প্রস্রবণ। বেড়াল কি লাফ মেরে এটার ওপর দিয়ে চলে গেছে? তিনি লাফ দিয়ে অপর পাড়ে চলে এলেন। প্রস্রবণটার দুই তীরের মাটিই ভেজা। কিন্তু এ পাড়ে বেড়ালের পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে না। বোঝা যায় বেড়ালটা এ পাড়ে আসেনি। তা হলে কোথায় গেল? তিনি ঢাল লক্ষ্য করে এগোতে লাগলেন। বিশ গজ যাবার পর যে দৃশ্যটা দেখলেন, ঘাড়ের পেছনের সমস্ত চুল দাঁড়িয়ে গেল সরসর করে।

পানিতে ভাসছে ধূসর রঙের বেড়ালটা।

এবার আর মনে সন্দেহ রইল না ডক্টর আবরারের আগে যে সব ঘটনা ঘটেছে, তা আসলে ঘটানো হয়েছে। আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়েছে সবাইকে। বুঝে গেছেন ডক্টর বেড়ালের ওপর যে জিনিসটা এতদিন ভর করেছিল তাঁর বাড়িতে, এতদিন শুধু সুযোগ খুঁজছিল বেরিয়ে আসার। স্বাভাবিক আচরণ করেছে সে আবরারের সাথে যাতে ডক্টরের মনে কোনও সন্দেহ জাগতে না পারে। সে এতদূর এসে আত্মহত্যা করেছে যাতে তার লাশ খুঁজে না পাওয়া যায়, যাতে ভেসে যায় স্রোতের সাথে। কিন্তু আত্মহত্যাই এটার শেষ উদ্দেশ্য নয়। গভীর কোনও উদ্দেশ্য আছে এর। কী সেটা?

ওটা যে-ই হোক বা যা-ই হোক তার ভিক্টিমদের যে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে তা বোঝাই যাচ্ছে। একের পর এক খুন করে চলেছে। কিন্তু কেন? ভয়ঙ্কর কোনও উদ্দেশ্য আছে অদৃশ্য আততায়ীর?

গা শিরশির করে উঠল ডক্টর আবরারের। তিনি একটা ডাল দিয়ে বেড়ালটার লাশ তুলে নিলেন পানি থেকে। একটা কাপড়ে মুড়ে গাড়ির পেছনে রাখলেন। লাশটাকে কি তিনি গ্রীনবে-তে পাঠাবেন অটোপসি’র জন্যে? কিন্তু কী পরীক্ষা করতে বলবেন তিনি ডাক্তারদের? তিনি ভাল করেই জানেন ওটার র‍্যাবিস নেই। এক ঘণ্টা আগেও বেড়ালটাকে একদম সুস্থ এবং স্বাভাবিক দেখেছেন আবরার।

বাড়ি ফিরে পাইপ ধরিয়ে সোফায় বসলেন আবরার। ভাবছেন। অনেকক্ষণ পর সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁর প্রথম কাজ হবে স্টেটমেন্টের কপি বন্ধুদের পাঠিয়ে দেয়া। তবে বেড়ালের ঘটনাটাও এর সাথে যোগ করতে হবে। তিনি শিলার সাথে দেখা করতে চললেন শহরে।

শিলা বাসায় নেই। দরজায় চিরকুট রেখে গেছে।

‘তিনটার সময় ফিরব।’ এদিকে লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে। আবরার ডাউন টাউনের রেস্টুরেন্টে ঢুকে লাঞ্চ করলেন, গল্প করার লোক ছিল অনেক। কিন্তু গল্প করতে মন চাইল না। বিয়ার খেয়ে সময় পার করতে লাগলেন। তিনটার খানিক আগে উঠে পড়লেন তিনি।

শিলাকে এবার বাসায় পাওয়া গেল।

‘আরে, ডক্টর,’ উদ্বেগ ফুটে উঠল শিলার কণ্ঠে আবরারের চেহারা দেখে। ‘আসুন, ভেতরে আসুন। কী হয়েছে?’

গম্ভীর চেহারা নিয়ে পুরো ঘটনা শিলাকে খুলে বললেন ডক্টর। তাকে কিছু ডিকটেশনও দিলেন। ঘণ্টাখানেক লাগল কাজটা শেষ করতে।

শিলা মুখ তুলে চাইল। ‘ডক্টর! এ স্টেটমেন্ট দুটো আপনার বন্ধুদের পাঠানোর পাশাপাশি শেরিফকেও ঘটনাটা জানানো উচিত নয় কি? আর শেরিফ ঘটনাটা সিরিয়াসভাবে না নিতে চাইলে এফ বি আইকে-ও বলতে পারেন।’

মাথা ঝাঁকালেন আবরার। ‘তাই করব ভাবছি। নিন, এবার চিঠি দুটো লিখে ফেলুন।

আবার ডিকটেশন শুরু হলো। শেষ হতে প্রায় পাঁচটা বেজে গেল। আবরার জানতে চাইলেন। টাইপ করতে কতক্ষণ লাগবে আপনার?’

‘ঘণ্টা চারেক। তবে এখুনি শুরু করব। আপনি এই ফাঁকে শেরিফের সাথে দেখা করে আসুন না—’

‘না, আমি তাঁকে ফুল স্টেটমেন্ট পড়ে শোনাতে চাই। আর আপনাকে না খেয়ে কাজ করতে হবে না। আমার সাথে চলুন। ডিনার করে আসবেন। আপনাকে আমি পৌঁছে দিয়ে যাব। রাতের মধ্যে কাজটা শেষ করতে পারলেই হলো। কাল সকালে আমি শেরিফের সাথে কথা বলব। আর চিঠি দুটো স্পেশাল এয়ারমেইল ডেলিভারিতে পাঠিয়ে দেব।’

‘কিন্তু আপনি আজ রাতে আবার ওই বাড়িতে যাবেন? আমার কেমন ভয় লাগছে।’

হাসলেন আবরার। ‘ভয় পেতে হবে না। আজ রাতে আমার কিছু হবে না, শিলা।’

ঠিকই বলেছেন ডক্টর। কারণ ভিনগ্রহের হন্তারক তখন অন্য কাজে ব্যস্ত।

সতেরো

বিরক্তিকর বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে ভিনগ্রহের প্রাণী অবশেষে কোলদের খামার বাড়িতে নিজের নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে গেছে। এবার নিজের ওপর পুরোপুরি সন্তুষ্ট সে। বেড়াল হোস্টকে সে এতদূরে নিয়ে এসে ডুবিয়ে দিয়েছে যে কেউ হয়তো কোনদিন তার খোঁজ পাবে না। আবরার যদি শোনে বেড়াল তার আগের আস্তানায় ফিরে যায়নি, সামান্য অবাক হতে পারে। তবে সে কোনদিনই জানতে পারবে না আজ রাতে, যখন আবরার ঘুমিয়ে থাকবে তার ওপর ভর করতে চলেছে ভিনগ্রহের হন্তারক।

তার পরিকল্পনাটি সরল। বেড়াল হয়ে ঘুরঘুর করা ছাড়া তার আর কোনও কাজ ছিল না আবরারের বাড়িতে। তবে সে ভয় পেয়ে গিয়েছিল যখন আবরার তাকে গুলি করবে বলেছিল। ফাঁদটা অবশ্য ঠিকই টের পেয়েছে সে। তাই ধরা দেয়নি ফাঁদে। সে টার্গেটে গিয়ে বসলে আবরারের মনে সন্দেহ জাগত। আবরার তাকে গুলি না করে যদি খাঁচায় পুরে রাখত তা হলে সর্বনাশের পোয়াবারো হত। না খাইয়েই হয়তো তাকে মেরে ফেলত আবরার।

যাক, সব ভালয় ভালয় গেছে। আজ রাতের পর সে পুরোপুরি বিপদমুক্ত হতে পারবে। সে এমন একজনকে তার হোস্ট বানাবে যে ছিল তার শত্রু কিন্তু হোস্ট হিসেবে অসাধারণ। এখন সবার আগে দরকার আবরারের বাড়িতে পৌঁছানো। তার তো আর নিজের চলাফেরা করার ক্ষমতা নেই। কাজেই একজনকে হোস্ট বানাতে হবে। সে-ই আবরারের বাড়িতে তাকে পৌঁছে দেবে।

হোস্টের খোঁজ করতে হলো না ভিনগ্রহের খুনীকে। জিম ব্রামার নিজেই হাজির হয়ে গেল হোস্ট হিসেবে। ছেলেটা রনির বয়সী, আগামী বছর কলেজে ঢুকবে। ইচ্ছে আছে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ার। আপাতত ছুটিতে বাড়ি এসেছে। তার বাবা, মি. ব্রামার ছেলেকে বলেছেন তাদের প্রতিবেশী মিসেস কোহলের বাড়িতে ফুট ফরমাশ খাটতে। মিসেস কোহলের ব্রামারদের কাছে তার বাড়ি বিক্রি করে দেয়ার একটা সম্ভাবনা আছে।

জিম মিসেস কোহলের বাড়িতে এসেছে তাকে কী করতে হবে জানাতে। মিসেস কোল ওকে ক্ষেত থেকে কিছু ভুট্টা আর শসা নিয়ে আসতে বললেন। লাঞ্চে রান্না করবেন।

ক্ষেত থেকে জিনিসগুলো এনে জিম মিসেস কোহলের হাতে দিল। বেরিয়ে যাচ্ছে, মিসেস কোহল ডাক দিলেন। ‘দাঁড়াও, জিম। লাঞ্চের সময় তো হয়েই গেল। একটু জিরিয়ে নাও। তারপর আমার সাথে খাবে।’

আপত্তি করল না জিম। গোলাঘরে বিশ্রাম নেয়ার কথা বলে সে একটা খড়ের গাদায় শুয়ে পড়ল। মাঠে অনেক কাজ করেছে সে। একটু পরেই নাক ডাকতে লাগল। আর ওই সুযোগটাই কাজে লাগাল ভিনগ্রহের হন্তারক। ভর করল সে জিম ব্রামারের ওপর।

.

সেই রাতের ঘটনা। জিম ব্রামারদের নিজেদের বাড়ি। ডিনার শেষে নিজের ঘরে বসে খানিকক্ষণ ‘পপুলার মেকানিক্স’-এর পাতা উল্টাল জিম, রেডিও শুনল। রাত দশটার দিকে ওর বাবা-মা যখন ঘুমাতে যাচ্ছে, চট করে রেডিও বন্ধ করে ফেলল জিম। বাবা-মাকে জানতে দিতে চায় না সে জেগে আছে।

ঘণ্টাখানেক পরে, বাবা-মা ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে পেরে জামা-কাপড় পরল জিম, পায়ে জুতো গলিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়ল ঘর ছেড়ে।

ঝলমলে চাঁদনী রাত। জিম দ্রুত হাঁটা দিল মিসেস কোহলের বাড়ির দিকে। সরাসরি চলে এল কিচেনে, সিঁড়ির তলা থেকে বের করল কচ্ছপের খোলটাকে। শার্টের ভেতর পুরে সাবধানে বুজিয়ে দিল গর্ত। তারপর হনহন করে এগোল আবরারের বাড়ির দিকে

আবরারের বাড়ি অন্ধকার। সম্ভবত ঘুমুচ্ছে সে। তবে সাবধানের মার নেই, ভেবে জুতো খুলে ফেলল জিম। পা টিপে টিপে চলে এল রান্নাঘরে। রান্নাঘরের সিঁড়ির নীচে কচ্ছপের খোলটাকে লুকোবার চমৎকার জায়গা আছে। জিম খুবই সাবধানে সিঁড়ির নীচে গর্ত খুঁড়ে কচ্ছপ আকারের জিনিসটাকে কবর দিল। তারপর সতর্কতার সাথে বুজিয়ে দিল কবর। বোঝার উপায় থাকল না এখানে খোঁড়াখুঁড়ি হয়েছে। তারপর বাড়ি ফিরে চলল জিম।

জিমকে ইচ্ছে করলে আজ রাতেই মেরে ফেলতে পারত হন্তারক। কিন্তু লোকের মনে আর সন্দেহ জাগিয়ে তুলতে চায় না সে। সিদ্ধান্ত নিয়েছে জিমকে কাল সকালে রোড অ্যাক্সিডেন্টে মেরে ফেলবে। ঘটনাটা এমনভাবে ঘটাবে, কারও মনে সন্দেহ জাগার অবকাশ থাকবে না। সে জানে কাল সকালে জিম পাঁচ বুশেল শস্যসহ ট্রাক নিয়ে গ্রীনবে-তে যাবে। ট্রাক চালাবে জিম নিজে। ওর বাবার সাথে সেই কথাই হয়েছে। জিমের স্মৃতি ঘেঁটে সে দেখেছে গ্রীনবে-তে যাবার রাস্তায় একটা কংক্রিটের ব্রিজ পড়বে। ব্রিজে ওঠার পর জিমকে দিয়ে ঘণ্টায় ষাট মাইল বেগে গাড়ি ছোটাবে ভিনগ্রহের প্রাণীটি। ধাক্কা খাওয়াবে পিলারের সাথে। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িসুদ্ধ ছাতু হয়ে যাবে জিম। লোকে ভাববে ব্রেক ফেল করে অ্যাক্সিডেন্ট ঘটিয়েছে জিম ব্যস, তারপর শুরু হবে আসল খেলা।

আঠারো

রাতে ভাল ঘুম হয়নি ডক্টর আবরারের। সকালে উঠে নাস্তা বানালেন তারপর ভাবতে বসলেন আজ কী কী কাজ আছে। শহরে যাবার কথা তাঁর শিলা হয়তো কালরাতেই চিঠি আর স্টেটমেন্ট টাইপ করে রেখেছে। সকাল ন’টায় তাকে ফোন করবেন বলেছেন। এখন বাজে সাড়ে আটটা। তিনি স্টেশন ওয়াগন নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।

শহরে পৌঁছে প্রথমেই শেরিফকে ফোন করলেন আবরার। শেরিফ বললেন, ‘ডক্টর, আবার পরে করুন। এইমাত্র স্টেট পুলিশ রেডিও কার থেকে একটা খবর পেয়েছি; বার্টলসভিল আর গ্রীনবে-র মাঝামাঝি জায়গায় অ্যাক্সিডেন্ট ঘটেছে। ওখানে যেতে হবে এখুনি, সরি।’ লাইন কেটে গেল।

রিসিভার রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন আবরার। ভাবছেন আবার কে অ্যাক্সিডেন্ট করল। তাঁর পরিচিত কেউ নয়তো? হলে শেরিফ হয়তো বলতেন।

একটু পরে আবার শেরিফের অফিসে ফোন করলেন ডক্টর। এবার ফোন ধরল তাঁর ডেপুটি। ডক্টর নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন একটু আগে শেরিফের কাছে তিনি ফোন করেছিলেন। শেরিফ একটা অ্যাক্সিডেন্টের কথা বলে ফোন রেখে দিয়েছেন ভাড়া ছিল বলে। ডেপুটি কি বলতে পারবেন কে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে?

ডেপুটি সজ্জন মানুষ। বলল জেমস ব্রামার নামে হাইস্কুলের এক ছাত্র মারা গেছে। বার্টলসভিলে তার বাড়ি। সে ট্রাক চালিয়ে গ্রীনবে-তে যাচ্ছিল, গাড়ি চালাতে চালাতে সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছিল। সোজা ব্রিজের পিলারের সাথে ধাক্কা খেয়েছে ট্রাক। সাথে সাথে মারা গেছে ব্রামার।

জেমস ব্রামারকে চিনতে পেরেছেন আবরার। ছেলেটার কথা আগেও শুনেছেন মিসেস কোহলের মুখে। তার বাড়িতে কাজ করছিল ব্রামার। আর এই ব্রামারদের বাড়ির ধূসর বেড়ালই গতকাল পর্যন্ত আবরারের সাথে ছিল।

এখন ব্রামার বেচারা মারা গেছে। সন্দেহ নেই তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল তিন, প্রাণীদের আত্মহত্যার সাথে ব্রামারের মৃত্যুর সম্পর্ক রয়েছে বলে দৃঢ় বিশ্বাস ডক্টরের।

এবার আর ভয় লাগছে না আবরারের। বরং আশ্চর্য শান্ত হয়ে গেছেন, কর্তব্যকর্ম স্থির করে ফেলেছেন তিনি এইমাত্র। অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। আর নষ্ট করার মানে হয় না।

ওই জিনিসটা, ওটা যাই হোক, একজন কাউন্টি শেরিফের একে সামাল দেয়া সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে অনুসন্ধানের দায়িত্ব নিতে হবে এফবিআই এবং পদস্থ বিজ্ঞানীদের। তবে শেরিফের সাথে যে তিনি কথাটা বলবেন না তা নয়, বলবেন। এফবিআই, সেই সাথে আর্মিকেও ব্যাপার জানানো দরকার।

সৌভাগ্যক্রমে দু’টি বিভাগেই হোমরা-চোমরা ব্যক্তিদের সাথে পরিচয় আছে ড. আবরারের। শিলার কাছ থেকে স্টেটমেন্টের কপি আসার পরপরই তিনি এদের সাথে কথা বলা শুরু করবেন। তবে সবার আগে যা করা দরকার তা হলো বিপজ্জনক ওই বাড়ি ছেড়ে চলে আসা। আবরার ঠিক করলেন তিনি আবার নিজের আস্তানায় ফিরে যাবেন, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে কেটে পড়বেন ওখান থেকে। শিলার কাছ থেকে স্টেটমেন্ট নিয়ে সোজা চলে যাবেন গ্রীনবে-তে, ওখানকার কোনও হোটেলে উঠবেন এবং ফোনে সবার সাথে যোগাযোগ শুরু করবেন। নিজের ওপর বিশ্বাস আছে তাঁর এফবিআই এবং আর্মির লোকজনদের ব্যাপারটা বোঝাতে সমর্থ হবেন। তারা বার্টলসভিলে আসবে তদন্ত করতে।

.

ভিনগ্রহের হন্তারক তার ‘পারসেপ্টর সেন্স’ প্রয়োগ করে দেখল ড. আবরার বাড়িতে নেই। আবরার তো প্রায়ই সকালে শহরে যায়। তবে সে মাছ ধরতে যায়নি বা হাঁটতে বেরোয়নি। কারণ গাড়িটা নেই।

ড. আবরারের জিনিসপত্র চেক করল সে। ব্যক্তিগত সমস্ত জিনিসই যথাস্থানে আছে। শুধু কাপড়-চোপড় বাদে। সিঙ্কে ধোয়া ডিশ দেখে বোঝা যায় নাস্তা খেয়েই সে বেরিয়েছে। এত সকালে তার শহরে যাবার কথা নয়। কোনও কারণে তড়িঘড়ি করে বেরিয়েছে। তবে চিন্তার কিছু নেই; ফিরে আসবে সে। তারপর রাতে যখন ঘুমিয়ে পড়বে-

বেড়াল হয়ে সে যে কটা দিন এ বাড়িতে ছিল, তার পারসেপটর সেন্স তেমনভাবে কাজ করেনি। তার পক্ষে বন্ধ ঘর বা ক্লজিটের ভেতরে উঁকি মারা সম্ভব হয়নি। পারেনি বন্ধ বই বা ভাঁজ করা চিঠি পড়তে। এখন, অবসরে, সে তার হারানো শক্তি আবার ফিরে পেতে শুরু করেছে।

হঠাৎ মাটিতে কম্পন অনুভব করল সে, গাড়ি আসছে। আবরারের স্টেশন ওয়াগন। একাই আসছে সে। ঘড়িতে দশটা বাজে।

আবরার সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন, হন্তারক তার ‘পারসেপশন সেন্স’ প্রয়োগ করল গাড়ির ওপর এবং এই প্রথম বুঝতে পারল কিছু একটা ভজকট হয়ে গেছে। গাড়িতে পুরানো তারপুলিন দিয়ে সযত্নে মুড়ে রাখা হয়েছে ধূসর বেড়ালটার লাশ। ভিনগ্রহের খুনীর দ্বিতীয় শেষ হোস্ট। একে আবরার কোথায় পেল, এটাকে গাড়িতেই বা রেখেছে কেন? আবরার কি তা হলে জঙ্গলে সেই প্রস্রবণের কাছে গিয়েছিল? সে এই সম্ভাবনার কথা কল্পনাও করেনি। সে শুধু পেছনে, বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেছিল কেউ তাকে অনুসরণ করছে কিনা। কেউ পিছু নেয়নি বলে সন্তুষ্টবোধ করছিল সে। কিন্তু ওই ঝিরঝিরে বৃষ্টি-সন্দেহ নেই, মাটিতে তার পায়ের ছাপ অনুসরণ করেছে আবরার। ইস, আবার সে ধরা খেল।

অসুবিধে নেই, আবরার বাড়ি ফিরেছে। এখন হোক আর পরে হোক, নিশ্চয়ই সে ঘুমাবে। তারপর সে কী সন্দেহ করেছে তাতে কিছু আসবে যাবে না।

কিন্তু আবরার এটা কী করছে? সে স্টোররুম থেকে সুটকেস বের করে দোতলায় যাচ্ছে কেন? সুটকেসে জামা-কাপড়সহ নিত্য-ব্যবহার্য সমস্ত জিনিসপত্র ঢোকাচ্ছে। তার মানে এখান থেকেও চিরতরে চলে যাবার পরিকল্পনা করেছে।

উঁহু, এ কিছুতেই হতে দেয়া যায় না। তাকে যেভাবেই হোক ঠেকাতে হবে।

.

ড. আবরার সুটকেস দুটো এনে স্টেশন ওয়াগনের পেছনে রাখলেন। তারপর আবার বাড়িতে ঢুকলেন। দ্রুত একবার চক্কর দিলেন সারা বাড়ি, দরজা- জানালা বন্ধ করলেন। রান্নাঘরে ঢুকে ইতস্তত করলেন সুইচ অফ করবেন কিনা। তা হলে বেযমেন্টের গ্যাসোলিন ইঞ্জিন এবং জেনারেটর বন্ধ হয়ে যাবে। যাক, বন্ধ করার দরকার নেই। ফ্রিজে খাবার আছে। নষ্ট হয়ে যাবে। তিনি আবার আসবেন। তবে একা অবশ্যই নয়।

ফিশিং ইকুইপমেন্ট, পিস্তল বন্দুক ইত্যাদি নিয়ে স্টেশন ওয়াগনে উঠে বসলেন আবরার। স্টার্ট দিলেন ইঞ্জিন। ঠিক তখন ওটাকে চোখে পড়ল তাঁর।

একটা হরিণ। বিশালদেহী। গাড়ি থেকে পঞ্চাশ হাত দূরে, জঙ্গলের কিনারে, যেখান থেকে তার বাড়ির সীমানা শেষ এবং রাস্তার শুরু, ঠিক সেখানটায়। কটমট করে তাকিয়ে আছে হরিণটা আবরারের দিকে। তারপর নিচু করল মাথা, খুর দিয়ে ধুলো ওড়াল, হামলার জন্য প্রস্তুত।

ওটা কী করতে যাচ্ছে বুঝে ফেললেন ডক্টর। দ্রুত গিয়ার দিলেন তিনি 1 তাঁর ইচ্ছে হরিণটাকে পাশ কাটিয়ে যাবেন। কিন্তু সে সুযোগ তাঁকে দিল না হরিণ। গাড়ি চলতে শুরু করেছে, ওটাও শিং বাগিয়ে তেড়ে এল। গাড়ি পিছিয়ে আনার সুযোগও পেলেন না আবরার। দুশো পাউন্ড ওজনের শরীর নিয়ে চলন্ত মিসাইলের মত হরিণটা গোত্তা খেল রেডিয়টরের কেন্দ্রে, দুই হেডলাইটের মাঝখানে। প্রচণ্ড সংঘর্ষে খুলি ফেটে চুরচুর হয়ে গেল হরিণের, ঘাড় ভেঙে মাটিতে পড়ে গেল লাশ হয়ে। ভয়ানক ঝাঁকি খেলেন আবরার, ড্যাশবোর্ডের সাথে ভীষণভাবে ঠুকে গেল মাথা, চোখের সামনে জ্বলে উঠল লাল-নীল হরেক রঙের তারা।

থেমে গেছে ইঞ্জিন। আবরার ইগনিশন অফ করলেন, আবার স্টার্ট দেয়ার চেষ্টা থেকে বিরত থাকলেন। জানেন এ গাড়ি গ্যারেজে না নিয়ে গেলে আর চলবে না।

তাঁর কাছে অস্ত্র আছে .২২ বোরের রাইফেল, পিস্তল আর শটগান। এ নিয়ে পায়ে হেঁটে শহরে যাবার ঝুঁকি নেয়া সম্ভব নয়। এক পাল জানোয়ার যদি তাঁর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া হয়, কী করতে পারবেন তিনি? মাঠ বা আল ধরে যাবার উপায় নেই। ওখানে ষাঁড় আর গরুর দল ঘাস খাচ্ছে। আর জঙ্গলের মধ্য দিয়েও যাবার প্রশ্ন নেই। ওখানে প্রচুর হরিণ আছে। একটা দুটো ভালুক বা ওয়াইল্ড ক্যাট থাকাও বিচিত্র নয়। এগুলোর চেয়েও ভয়াবহ বিপদ আসতে পারে তাঁর শত্রু যদি ভাত-ঘুম দেয়া কোনও লোকের ওপর ভর করে বসে। যদি মিসেস কোহ্ বা মিসেস ব্রামার শটগান বা রাইফেল নিয়ে হাজির হয়ে যায়, তাঁকে গুলি করতে শুরু করে তখন? উল্টো তিনিও কি গুলি করবেন? মহিলাদের গায়ে হাত তুলতে পারবেন না, ভাল করেই জানেন আবরার, আর রাস্তায় হেঁটে গেলে জানোয়ার বা মানুষ যে-ই আসুক, কতজনকে হত্যা করবেন তিনি? কেউ না কেউ তাঁকে ঠিকই পেড়ে ফেলবে। তাঁর অজানা শত্রু একের পর এক হামলাকারীকে পাঠাবে। সবাইকে সামাল দেয়া কিছুতেই সম্ভব হবে না তাঁর পক্ষে।

তবে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেছে-ঠাণ্ডা যুদ্ধের অবসান ঘটেছে। তাঁর শত্রু-ওটা যাই হোক-আর ভান করার প্রয়োজন বোধ করছে না। ওটা ড. আবরারকে এখানে আটকে রাখতে চাইছে, হয়তো সফলও হবে। পেছনের সিটে হাত বাড়িয়ে শটগান আর পিস্তল তুলে নিলেন ডক্টর। লোড করে রাখলেন।

অদ্ভুতই বলতে হবে, তাঁর একটুও ভয় করছে না, আগের চেয়ে অনেক শান্ত লাগছে নিজেকে। এ যুদ্ধে জিততে হলে উত্তেজিত হওয়া বা মাথা গরম করা চলবে না। এ যুদ্ধে প্রধান অস্ত্র হিসেবে কাজে লাগাতে হবে মনের শক্তি। ফায়ার আর্মস দিয়ে লড়াই জেতা যায়, যুদ্ধ নয়।

প্রথম প্রশ্ন হলো- সারভাইভাল। তিনি এখানে বেশি নিরাপদ থাকবেন নাকি বাড়িতে? হয়তো বাড়িতে। শত্রু চায় না তাঁর কাছে কোনও সাহায্য আসুক। আচ্ছা, তিনি যদি চুপচাপ বসে থাকেন এবং পালাবার চেষ্টা না করেন তা হলেও কি তাঁর শত্রু তাঁকে খুন করবে? মনে হয় না। শত্রু চাইলে অনেক আগেই তিনি মরে ভূত হয়ে যেতেন। গাড়িতে ওঠার আগেই হরিণটা তাঁকে শুঁড়িয়ে দফারফা করে দিতে পারত। তিনি তো ওটাকে আগে লক্ষই করেননি।

ডক্টর আবরার সিদ্ধান্ত নিলেন বাড়িতে ঢুকবেন তিনি। পিস্তল পকেটে রেখে, শটগান রেডি করে সাবধানে গাড়ি থেকে নামলেন তিনি। চারপাশে সতর্ক নজর বোলালেন। জ্যান্ত কিছু দেখা যাচ্ছে না।

তবে-

মুখ তুলে আকাশের দিকে চাইলেন আবরার। একশ’ ফুট উঁচুতে বাতাসে ধীর গতিতে বৃত্ত রচনা করে উড়ছে একটা ওয়াইল্ড ডাক। বুনো হাঁস ওভাবে ওড়ে না। তার মানে কি পরবর্তী হামলা আসছে আকাশ থেকে? এটা তো আরও বিপজ্জনক। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় শূন্য থেকে মিসাইলের মত কোনও শক্তিশালী, ওজনদার পাখি যদি ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘাড়ের ওপর তা হলে আর দেখতে হবে না।

আবরার বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছেন, ‘ডাইভ দিল ওয়াইল্ড ডাক। ঝট করে বন্দুক তুললেন ডক্টর, দ্রুত সরে গেলেন এক পাশে। না, পাখিটা তাঁর ওপর হামলা করার জন্য ডাইভ দেয়নি। তাঁর কাছ থেকে হাত দশেক দূরে, মাটিতে আছড়ে পড়ল ধুলোর মেঘ উড়িয়ে।

চিন্তিত ভঙ্গিতে বাড়িতে ঢুকলেন ডক্টর, বন্ধ করে দিলেন দরজা। না, শত্রু তাকে হত্যা করতে চায় না, এখানে বন্দী করে রাখতে চায়। ওয়াইল্ড ডাকটা তাঁকে ইচ্ছে করে মিস করেছে। শত্রু বুঝিয়ে দিল বাইরে গেলে কী দশা হবে তার।

শটগানের ওপরের ব্যারেল রিলোড করে অস্ত্রটা সদর দরজার পাশের জানালার সাথে হেলান দিয়ে রাখলেন আবরার। পকেট খালি করে অতিরিক্ত শেল আর কার্তুজগুলো সোফায়, হাতের নাগালে রেখে দিলেন। তারপর সোফার হাতলে বসে তাকিয়ে রইলেন জানালা দিয়ে।

জীবনের কোনও চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না বাইরে। তা হলে কি সবই তাঁর কল্পনা? তিনি কি পায়ে হেঁটে রওয়ানা হবেন শহরের উদ্দেশে? নাহ্, তা উচিত হবে না। হরিণ আর ওয়াইল্ড ডাকের চেহারা ভেসে উঠল চোখে।

আচ্ছা, তার শত্রুর প্রকৃতি কী? ওটা কি মানুষ, দানব নাকি ভিনগ্রহবাসী? হয়তো শেষেরটাই ঠিক।

শিলা বলেছিল না পৃথিবী ছাড়াও ব্রহ্মাণ্ডের কোটি কোটি গ্রহে বুদ্ধিমান প্রাণী বাস করতে পারে।

কিন্তু ভিনগ্রহবাসীর তাঁর ওপর এত আক্রোশ কেন? এর কারণ কি এই-তিনি তার শত্রুর যে সব তথ্য জেনে গেছেন বা সন্দেহ করেছেন সেটা ভিনগ্রহবাসীর অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলতে পারে? হ্যাঁ, তাই হবে।

তাঁর ধূসর বেড়ালটার কথা মনে পড়ল। বেড়ালটা বন্দী অবস্থায় তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ লক্ষ করেছে। শিলার সাথে তাঁর আলাপচারিতা, স্টেটমেন্টের বিষয় কোনকিছুই হয়তো তার অজানা নেই। শত্রু তাঁকে বিপজ্জনক বলে ধরে নিয়েছে। তবে তাঁকে মারার সুযোগ পেয়েও সে মারেনি, বাঁচিয়ে রাখতে চায়। কোথাও যেতেও দিচ্ছে না। এখানেই আটকে রাখতে চায় সে। কিন্তু কেন?

তা হলে কি সে আবরারকে হোস্ট বানাতে চায়? হতে পারে। কিন্তু আগে কেন হোস্ট বানায়নি। এখন চাইছে কেন?

বাইরের পরিবেশ একেবারে শান্ত। আবরার রান্নাঘরে ঢুকে স্টোভে পানি বসালেন। কফি বানাবেন। তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে তাকে হোস্ট বানাবার জন্য শত্রুর কি বিশেষ কোনও প্রস্তুতি দরকার?

হঠাৎ প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেলেন তিনি। ব্যাপারটা নিয়ে যত মাথা খেলালেন ততই পরিষ্কার হয়ে এল বিষয়টা, রনিকে হোস্ট বানানো হয়েছে ঘুমের মধ্যে। একই কাণ্ড ঘটেছে হেলমুট কোহলের ক্ষেত্রেও। জিম ব্রামারও নিশ্চয়ই ঘুমের মধ্যে অজানা শত্রুর শিকার হয়েছে। আর জানোয়ার হোস্টগুলো বিশেষ করে কুকুর এবং বেড়ালরা এরা তো দিনে-রাতে যখন- তখন ঘুমিয়ে পড়ে।

কিন্তু শত্রু যদি তাকে হোস্ট বানাতে চায় তা হলে কাল রাতে ভর করল না কেন? হতে পারে, কাল রাতে আবরারের ভাল ঘুম হয়নি, একটু ঘুমিয়েছেন; আবার জেগে উঠেছেন। আবার এমনও হতে পারে জেমস ব্রামারকে হোস্ট বানাবার কাজে তাঁর শত্রু ব্যস্ত ছিল বলে এদিকে নজর দিতে পারেনি। তবে এ থেকে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে আসে। আর তা হলো—শত্রু দু’জন নয়, একজন এবং সে একবারে একজনকেই হোস্ট করার ক্ষমতা রাখে। তবে ব্যাপারটা সম্পর্কে যদি নিশ্চিত হওয়া যেত-

ডক্টর হঠাৎ শটগান নিয়ে দরজা খুললেন, সতর্ক ভঙ্গিতে কয়েক পা বাড়ালেন সামনে, তাকালেন ওপরের দিকে।

পাখি, বড় বড় পাখি, ছ’সাতটা হবে, আকাশে পাক খাচ্ছে। তা হলে কি ডক্টরের ধারণা ভুল?

পরক্ষণে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে। ওগুলো অদৃশ্য শত্রুর হোস্ট নয়, কতগুলো শকুন, মৃত হরিণের লোভে এসেছে। একেবারে সাধারণ পাখি। শকুন দেখে এত আনন্দ কখনও হয়নি আবরারের, এখন যেমন আনন্দ হচ্ছে।

হঠাৎ জঙ্গলের ভেতর থেকে আরেকটা পাখি উড়ে আসতে দেখলেন তিনি, মনে হলো বুনো হাঁস। পাখিটা অনেক উঁচুতে উঠে গেল, তারপর ডাইভ দিল ডক্টরকে লক্ষ্য করে। তিনি গুলি করতে পারতেন, কিন্তু বেশি ঝুঁকি হয়ে যায় উপলব্ধি করে চট করে পিছিয়ে এলেন, বন্ধ করে দিলেন দরজা। এক সেকেন্ড পর বিকট শব্দে পাখিটা আছড়ে পড়ল বারান্দায়। চেহারা অন্ধকার হয়ে গেল আবরারের। বাইরে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয় বুঝতে পেরেছেন। তবে তাঁর শত্রুর একটি সীমাবদ্ধতার কথাও জেনে ফেলেছেন। শত্রু শুধু ঘুমন্ত প্রাণীদেরকেই কব্জা করতে পারে, জেগে থাকা কাউকে নয়। আর ওটাকে ঘুমন্ত প্রাণী, খুঁজে বের করতে হয়। এতেও নিশ্চয়ই সময় নষ্ট হয়।

ভয়ঙ্কর এই বিপদের হাত থেকে রক্ষা পাবার সম্ভাবনা যে একেবারে নেই, তা নয়। আশার কথা, শিলা জানে তিনি তার সাথে দেখা করবেন। যথাসময়ে তাঁর দেখা না পেলে সে নিশ্চয়ই চিন্তিত হয়ে ফোন করবে শেরিফকে। শেরিফ হয়তো খবর পেয়ে আসবেন। তাঁকে যদি অদৃশ্য শত্ৰুটা মেরেও ফেলে, তাঁর লোকবল আছে অনেক। সশস্ত্র লোকগুলোর বিরুদ্ধে ক’টা প্রতিরোধ পাঠাবে শত্রু? শেষ পর্যন্ত ওদেরই জয় হবে।

হ্যাঁ, সাহায্য আসবে। তবে ডক্টর আবরারের কাজ কাজ এখন একটাই—কিছুতেই ঘুমিয়ে পড়া চলবে না।

উনিশ

এ যেন অনন্ত সময়, সীমাহীন, স্থির, `কাটতে চায় না কিছুতেই। তবু প্রাকৃতিক নিয়মে দিন গড়িয়ে রাত এল, এল ঘুমাবার সময়। ডক্টর আবরার সারা বাড়ি ঘুরছেন, ওপরে যাচ্ছেন, নীচে যাচ্ছেন, আলো জ্বালছেন, নিভাচ্ছেন, অস্থির লাগছে তাঁকে।

হঠাৎ সবগুলো আলো নিভে গেল একসাথে। জেনারেটর? হ্যাঁ, জেনারেটরের কারণেই বাতি নিভে গেছে। কিন্তু গ্যাসোলিন মটরে যে পরিমাণ ফুয়েল আছে তা দিয়ে আরও কয়েকদিন হেসে খেলে চলার কথা। হয় জেনারেটর নতুবা মোটর, দুটোর যে কোনও একটা নষ্ট হয়ে গেছে।

শত্রু আবার আরেক হোস্টকে ব্যবহার করেছে। সম্ভবত ইঁদুর-সেলারে ইঁদুরের অভাব নেই। ইঞ্জিন বা মোটরের তার কেটে ফেলেছে ইঁদুরকে দিয়ে। জেনারেটর চালিয়ে লাভ হবে না। শত্রু আবার ওটা নষ্ট করে দেবে।

অন্ধকার। গাঢ় অন্ধকার।

নিকষ আঁধারে ঘুম পেতে লাগল আবরারের। আর ঘুমালেই সব শেষ। একটু পরে আকাশে চাঁদ উঠল। মোট আয়তনের তিন ভাগের এক ভাগ। তবে আলোটা ঝকঝকে, আকাশ ঝলমল করছে অগুনতি তারায়। বাইরেটা দিনের আলোর মত ফকফকা, সব কিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলোয় ঘরের আঁধারও অনেকখানি দূর হয়ে গেছে। লিভিং রুমটা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল চোখের সামনে। হাঁটার সময় অন্তত হোঁচট খেতে হবে না আবরারকে। তাঁর একটা ফ্ল্যাশলাইট আছে, কিন্তু অতিরিক্ত ব্যাটারি থাকলেও সারারাত জ্বালিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। অল্প অল্প জ্বালাতে হবে।

কতক্ষণ জেগে থাকতে পারবেন তিনি? কাল রাতে ভাল ঘুম হয়নি, ক্লান্তও লাগছে, তারপরও আরও চব্বিশ ঘণ্টা না ঘুমিয়ে থাকতে পারবেন আবরার।

খিদে পেয়েছে। কিন্তু ডক্টর ঠিক করেছেন কিছু খাবেন না। খাবার পেটে গেলে ঘুম পেয়ে বসবে তাঁকে। ক্ষুধার্ত মানুষ খিদে নিয়ে জেগে থাকতে পারে, কারণ খিদের চোটে ঘুম পালাতে বাধ্য।

পায়চারি শুরু করলেন আবরার। পাল্টা হামলা করার কথা ভাবছেন। কিন্তু কীভাবে?

যে শত্রুর চেহারাই তিনি এখন পর্যন্ত দেখেননি তাকে আঘাত করবেন কীভাবে? ওটা কি অদৃশ্য নাকি ওকে দেখা যায়? শরীর আছে? তাঁর মনে হচ্ছে এ বাড়ির কোথাও লুকিয়ে আছে শত্রু। কাল সকাল বেলা শত্রু নিধন অভিযানে নেমে পড়বেন তিনি, জীবিত কিছু চোখে পড়া মাত্র গুলি করবেন।

লম্বা, দীর্ঘতম রাতটার এক সময় অবসান ঘটল। ফুটল ভোরের আলো। আবরার নেমে পড়লেন শত্রুর খোঁজে। প্রতিটি ঘর, বেযমেন্ট কিছুই বাদ দিলেন না। তিনি জানেন না আসলে কী খুঁজছেন, ওটা ছোট না বড় কিছুই জানা নেই তাঁর। বেযমেন্টে গিয়ে দেখলেন জেনারেটরের তার কাটা। শত্রু ইঁদুর টিদুর দিয়ে কাজটা করিয়েছে। ঠিক করে লাভ হবে কোনও? তিনি ওপরে যাওয়া মাত্র কাউকে দিয়ে আবার তার কেটে দেয়া হবে।

হঠাৎ ছাদের দিকে তাকাতে বুক ধক্ করে উঠল। একটা মথ উড়ছে ওখানে। শত্রু মথের ছদ্মবেশে তার ওপর নজরদারী করছে না তো?

স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন আবরার, স্টোর রুমে ঢুকে বন্ধ করে দিলেন দরজা। দ্রুত নেমে পড়লেন কাজে। কোট হ্যাঙার বাঁকিয়ে, স্লিপিংব্যাগ ছিঁড়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রজাপতি ধরার জাল বানিয়ে ফেললেন। খুবই বাজে এবং হাস্যকর দেখতে হলো জিনিসটা। তবে কাজ চলে যাবে।

মথটা এখনও ছাদের নীচে উড়ে বেড়াচ্ছে। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পর ফাঁদে আটকানো গেল ওটাকে। তারপর সাবধানে পতঙ্গটাকে একটা খালি দেশলাই বক্সের মধ্যে ঢোকালেন আবরার। মথটা খুব সহজে মরবে না, এর মধ্যে এখান থেকে তিনি পালাতে পারবেন। অবশ্য মথটা যদি সত্যি-

শটগান নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লেন ডক্টর। চারপাশে নজর বুলালেন। ভীতিকর কিছু চোখে পড়ল না। আকাশেও কোনও পাখি উড়তে দেখা যাচ্ছে না।

গভীর দম নিলেন আবরার, হাঁটা শুরু করলেন। মাত্র দশ কদম এগিয়েছেন, হঠাৎ মাথার ওপর পতপত শব্দ হতে ‘মুখ তুলে চাইলেন। বুক হিম হয়ে গেল বিশাল আকারের একটা চিকেন হককে তাঁকে ঘিরে বৃত্তাকারে উড়তে দেখে। ওটা আবরারকে লক্ষ্য করে ডাইভ দিল, হত্যার উদ্দেশে নয়, ভয় দেখিয়ে ঘরে ফেরাতে।

ভয়ঙ্কর মিসাইলের মত ছুটে আসছে চিকেন হক, আবরারের কাছ থেকে যখন আট/দশ হাত দূরে, ডক্টরের হাতের শটগান গর্জে উঠল বিকট শব্দে। ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল পাখিটা শক্তিশালী বুলেটের আঘাতে। রক্ত আর পালক লাগল আবরারের মুখে। তাঁর কাছ থেকে দু’হাত দূরে এসে ছিটকে পড়ল ওটা।

দৌড়ে ঘরে ঢুকে পড়লেন ডক্টর। মুখ ধুলেন, পোশাক ঠিকঠাক করে কিচেনে ঢুকলেন। দেশলাইয়ের বাক্স খুলে মথটাকে বের করলেন আবরার, ছেড়ে দিলেন। ভুল ভেবেছেন তিনি। ওটা স্রেফ সাধারণ একটা মথ, তার শত্রুর হোস্ট নয়। তাঁর পরিকল্পনাটা ভালই ছিল, কিন্তু শত্রু তাঁকে কোনও সুযোগ দিতে রাজি নয়।

বিশ

কিছুই ঘটল না।

মিনিটগুলো যেন ঘণ্টা। গত চব্বিশ ঘণ্টায় ড. আবরার অল্পক্ষণ মাত্র ঘুমাতে পেরেছেন। বেশিরভাগ সময় পায়চারি করে কাটিয়ে দিচ্ছেন এই জানালা থেকে ওই জানালায়, শূন্য দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন বাইরে। পা দুটো ব্যথায় বিষ হয়ে গেছে, আরাম করে বসার সাহস পর্যন্ত পাচ্ছেন না। যদি ঘুমিয়ে পড়েন! প্রায়ই কফি পান করছেন, তবে এখন ঠাণ্ডা খাচ্ছেন, ঠাণ্ডা কফিতে ঘুম কম আসে।

সকাল হয়েছে। তবে বড় ধীর গতিতে বয়ে যাচ্ছে সময়। আবরার আশায় আছেন শেরিফ অথবা স্টেট পুলিশ এসে পড়বে, না হলে শিলা তো আসবেই। সে হয়তো বুঝতে পারবে আবরার বিপদে পড়েছেন। না হলে মিস শিলার সাথে তিনি দেখা করতেন।

আর বেশিক্ষণ হয়তো জেগে থাকা সম্ভব হবে না। আগে সোফার হাতলে একটু বসতেন, এখন তাও সাহস হচ্ছে না। বার বার বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে চোখ, জোর করে মেলে রাখতে হচ্ছে। পাইপ টানতে টানতে তেতো হয়ে গেছে মুখ। এ মুহূর্তে ঘুম তাড়ানোর মহৌষধ বেনজেড্রিন ট্যাবলেট বড় দরকার ছিল। কিন্তু সাথে আনেননি তিনি। ছুটি কাটাতে এসে কি কেউ ঘুম তাড়াবার ওষুধ খায়? সকাল গড়িয়ে দুপুর আসছে, জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ডক্টর, তবে কাঁচের গায়ে মাথা ঠেকাতেও সাহস পাঁচ্ছে না। হঠাৎ গাড়ির শব্দ শুনতে পেলেন।

চট করে শটগানটা নিয়ে সদর দরজা খুললেন আবরার। তবে দাঁড়িয়ে রইলেন ভেতরে, শেরিফ বা যে-ই হোক, বাইরে থেকে হামলা এলে তাকে কাভার দিতে প্রস্তুত।

উঠোনে চলে এল গাড়ি। ছোট গাড়ি, ভক্সওয়াগন, ভেতরের যাত্রী মাত্ৰ একজন-শিলা রহমান।

দ্রুত হাত নাড়তে শুরু করলেন আবরার, চলে যেতে বলছেন শিলাকে। কিন্তু শিলা ডক্টরকে দেখতে পেল না, সে তাকিয়ে আছে স্টেশন ওয়াগন আর মরা হরিণের দিকে। গাড়ি দেখে শকুনের দল অলস ভঙ্গিতে উঠে গেল লাশ ফেলে। ইঞ্জিন বন্ধ করার আগে শিলা মুখ তুলে চাঁইল দরজার দিকে, দেখতে পেল ডক্টরকে।

‘শিলা!’ গলা ছেড়ে চেঁচালেন তিনি। ‘শিগগির শহরে চলে যান। পুলিশকে খবর দিন, আর-’

চেঁচিয়ে লাভ হলো না। খুরের শব্দ শুনতে পেয়েছেন আবরার-একটা ষাঁড় প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসছে, মাত্র একশ হাত দূরে। আবরার কাছ থেকে ভক্সওয়াগনের দূরত্ব ১২ ফুট, হঠাৎ জিতে যাবার একটা সম্ভাবনা দেখতে পেলেন তিনি। যদিও কাজটা বিপজ্জনক। ষাঁড়টাকে গুলি করে ঠ্যাং খোঁড়া করে দিলে ওটা মরবে না, আর শত্রু অন্য হোস্ট নেয়ার সুযোগও পাবে না।

শিলাকে গাড়িতে থাকতে বলে এক দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি, তাক করলেন শটগান; দূরত্বটা মাপছেন, সামনের পা জোড়ায় যদি গুলি করা যায়-

আবরারের লক্ষ্য মন্দ নয়, তবে উত্তেজনার চোটে একটু তাড়াতাড়ি গুলি করে ফেললেন। ষাঁড়ের গায়ে গুলি লাগল, তবে থামল না ওটা। প্রচণ্ড রাগে উন্মাদ হয়ে উঠল আহত জানোয়ার, দিক বদল করে এবার সোজা ছুটে আসতে লাগল আবরারকে লক্ষ্য করে। মাত্র দশ হাত দূরে থাকতে দ্বিতীয় ব্যারেল বিস্ফোরিত হলো, একেবারে মোক্ষম জায়গায় লেগেছে গুলি, হৃৎপিণ্ড ফুটো করে দিয়েছে ষাঁড়ের, দড়াম করে মাটিতে আছড়ে পড়ল ওটা। আর নড়ল না।

ভক্সওয়াগনের দরজা মেলে ধরলেন ড. আবরার, ‘তাড়াতাড়ি বাড়িতে ঢুকুন, শিলা। ওটা আবার যে কোনও সময় হামলা চালিয়ে বসতে পারে। সময় নষ্ট করবেন না।’

শিলাকে নিয়ে দ্রুত দরজার দিকে এগোলেন। শটগানে গুলি নেই, আর অতিরিক্ত কার্তুজগুলো রয়ে গেছে ভেতরে। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে মুখ তুলে চাইলেন তিনি। বড় একটা পাখি, শকুন নয়, উড়ে আসছে। তবে ওটা হামলা চালাতে চাইলেও দেরি হয়ে গেছে। চট করে ভেতরে ঢুকে পড়লেন তিনি, বন্ধ করে দিলেন দরজা।

দ্রুত শটগানে গুলি ভরতে ভরতে গতকাল আর আজকের ঘটনা সংক্ষেপে খুলে বললেন ডক্টর শিলাকে। ‘ইস, ডক্টর,’ বলল শিলা। ‘শেরিফকে যে কেন নিয়ে এলাম না আমার সঙ্গে! কাল বিকেলে ওঁর সাথে আমার কথা হয়েছে। আপনার কথা উনি বিশ্বাস করেননি। তবে বলেছেন আসবেন। আজ সকালে আবার কথা বলেছি। বললেন কাল সকালের আগে আসতে পারবেন না। শেরিফের কথা শুনে মনে হলো উনি ভেবেছেন পুরোটাই আমাদের কল্পনা। তাই গা ছাড়া ভাব দেখেছি তাঁর মধ্যে।’

‘কাল সকালে…’ চেহারা গম্ভীর হয়ে গেল আবরারের। এদিক ওদিক মাথা নাড়লেন। উঁহুঁ, অতক্ষণ জেগে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। আর আমি যদি ঘুমিয়ে পড়ি…নাহ্, শিলা আপনার আসলে উচিত হয়নি এখানে আসা। এখন আপনিও খামোকা বিপদে জড়িয়ে পড়লেন।’

‘আমার গাড়িতে চড়ে শহরে যাবার কোন চান্স নেই? ধরুন, আমি গাড়ি চালালাম আর আপনি বন্দুক নিয়ে প্রস্তুত থাকলেন।’

‘সে চান্স একশ’ভাগের এক ভাগ, শিলা, জঙ্গলে শুধু ষাঁড় নয় প্রচুর গরুও আছে। আর শিংঅলা প্রকাণ্ড হরিণগুলোর কথা না হয় বাদই দিলাম। আর বিরাট আকারের কোনও পাখি শূন্য থেকে আপনার হালকা গাড়ির ওপর আছড়ে পড়লে ওটার দফারফা হয়ে যাবে। আচ্ছা, ফিরতে দেরি দেখলে আপনার প্রতিবেশীরা খোঁজ-খবর নেবে না?’

‘মনে হয় না। কারণ প্রায়ই গ্রীনবেতে আমি সিনেমা বা নাটক দেখতে যাই, তখন এক কাজিনের বাসায় থাকি। কাজেই আজ রাতে বাসায় না ফিরলে আমার প্রতিবেশীরা ভাববে আমি গ্রীনবেতে গেছি। ইস, আমি না এসে যদি পুলিশে খবর দিতাম! বুদ্ধিটা মাথাতেই আসেনি।’

ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাত তুলে ওকে থামালেন আবরার। ‘নিজের ওপর দোষ চাপাতে হবে না। ভুলটা আমারই। দুটো ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে এখন। ধূসর বেড়ালটা মারা যাবার পর আমার এখানে রাত কাটানোই উচিত হয়নি। আর গতকাল সকালে জিম ব্রামারের মৃত্যুর ঘটনা শোনার পর জিনিসপত্র নিতে বাড়ি ফেরা মস্ত বোকামি হয়ে গেছে। আর ধরাটা তখনই খেলাম।’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।

‘চলুন, কফি খাওয়া যাক,’ বললেন আবরার। ‘এতক্ষণ শুধু ঠাণ্ডা কফি গিলেছি এখন এক কাপ গরম কফি খাওয়ার ঝুঁকি নেয়া যায়। আপনি কথা বলুন। দু’জনে মিলে একটা কিছু বুদ্ধি নিশ্চয়ই বের করা যাবে।’

কফির জন্যে পানি চড়িয়েছে শিলা, আবরার দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। বেশিরভাগ কথা তিনিই বললেন, ঘুম তাড়াতে হলে কথা বলতেই হবে। অনবরত কথা বলে গেলেন তিনি। এক পর্যায়ে শিলা রহমানকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনাকে আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি বলুন তো?’

‘এই যে আমার সাথে এ ভাবে কথা বলে আমাকে জাগিয়ে রাখবেন। আমি ঘুম তাড়াবার জন্যে হাঙ্গার স্ট্রাইক করেছি। কিন্তু আপনার খিদে লাগলে খেয়ে নিতে কসুর করবেন না। ফ্রিজ গত সন্ধ্যা থেকে চলছে না। তবে টিন বোঝাই খাবার আছে প্রচুর।’

কফি বানানো শেষ, দুটো কাপে কফি ঢেলে টেবিলে রাখল শিলা। ‘ধন্যবাদ। তবে আমার খিদে পায়নি। ভাবছি আরও দু’তিন পট কফি বানিয়ে রাখব কি না।‘

‘ইচ্ছে হলে রাখুন। কিন্তু কেন?’

‘কারণ আপনার মানে আমাদের শত্রু ইলেকট্রিসিটি বন্ধ করে দিয়েছে, যে কোনও সময় গ্যাস সাপ্লাইও বন্ধ করে দিতে পারে। আর কফি না খেয়ে আপনি জেগে থাকতে পারবেন না। সে ঠাণ্ডা-গরম, যাই হোক।’

‘মনে হয় এ কাজ করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। কারণ বুটেন ট্যাঙ্কের বালব্ খুলতে রেঞ্জ লাগবে। আর মানুষ ছাড়া কারও পক্ষে ওটা মোচড় দিয়ে খোলা সম্ভব নয়। সে এখানে মানুষ হোস্ট পাবে কোথায়? তবু সাবধানের মার নেই। আচ্ছা, কফি বানান।’

স্টোভে পানি ঢেলে শিলা ডক্টরের মুখোমুখি বসল।

‘পানি সাপ্লাইয়ের কী অবস্থা? ওটা বন্ধ করে দেয়ার কোনও সম্ভাবনা আছে? তা হলে কয়েক কলসি পানি ভরে রেখে দিই।’

‘তার দরকার আছে বলে মনে হয় না,’ বললেন আবরার, ‘আমাদের শত্রু পানি তোলার পাম্প নষ্ট করে ফেললেও ক্ষতি নেই। কারণ ভারী ট্যাঙ্কির সে কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। আর ওটা ভরা আছে। দুশো গ্যালনের কম হবে না। আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট।’

কফি খেয়ে বাথরুমে ঢুকলেন আবরার ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করতে। এতে ঝিমুনির ভাব অনেকটাই কেটে গেল। এই ফাঁকে শিলা নীচ তলার জানালা দিয়ে বাইরের অবস্থা দেখে এল। হরিণটাকে ঘিরে আছে শকুনের দল। ষাঁড়ের কাছে যায়নি, সম্ভবত হরিণের মাংস তাদের কাছে বেশি সুস্বাদু মনে হয়েছে।

গোসল সেরে দু’জনে আবার নানা বিষয় নিয়ে আলাপচারিতা শুরু করে দিলেন। ডক্টর বললেন, ‘খুব শীঘ্রি কিছু ঘটবে বলে মনে হয় না। এটা আসলে ধৈর্য পরীক্ষার খেলা। আমরা কেউ বেরুবার চেষ্টা করলেই সে হামলা চালাবে। তবে ঘরের ভেতর থেকে কোনও হামলা আসবে বলে মনে হয় না। তা হলে অনেক আগেই ঘটতে পারত। প্রকাণ্ডদেহী যে কোনও জানোয়ার দরজা বা জানালা ভেঙে ঢুকতে পারত।’

‘অবাক লাগছে ভেবে,’ বলল শিলা, ‘আপনার বিরুদ্ধে কোনও মানুষ হোস্ট পাঠায়নি কেন সে?’

‘কারণ আমাকে খুন করা তার উদ্দেশ্য নয়। তবে পাঠালেই ভাল হত। ধাবমান ষাঁড়কে হত্যা ছাড়া ঠ্যাং খোঁড়া করা বিপজ্জনক কাজ, মানুষকে নয়।’

‘ডক্টর, আমি যখন এলাম-আপনি কী করে বুঝলেন আমি আপনার শত্রু নই? আপনি সহজেই আমাকে গুলি করতে পারতেন।’

হেসে উঠলেন আবরার। ‘ওই চিন্তা মাথাতেই আসেনি আমার। যদি তাই হত, তা হলে ধরে নিতাম, শত্রু একবারে একাধিক মানুষ বা প্রাণীকে হোস্ট করার ক্ষমতা রাখে। উঠে দাঁড়ালেন তিনি, দু’দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে হাই তাড়াতে তাড়াতে বললেন, ‘গোসল করে ভালই হয়েছে। আমি একটু ওপরে গেলাম। এই ফাঁকে আপনি খেয়ে নিন।’

ওরা পালাক্রমে ওপর আর নীচের জানালা দিয়ে বাইরের পরিস্থিতি পরীক্ষা করে দেখছে। তবে ডক্টর শিলাকে বিশ্রাম নিতে বলে একাই রাউন্ড দেয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। কারণ এটা ঘুম তাড়ানোর ওষুধ হিসেবে কাজ করবে।

সময় বয়ে চলল ধীর গতিতে। দু’জনে কত পরিকল্পনা করল এখান থেকে কেটে পড়ার।; কিন্তু কোনওটাই কারও মনঃপূত হলো না। অবাস্তব এবং বিপজ্জনক ঠেকল সবগুলো প্ল্যান। ইতিমধ্যে ডক্টর আরেকবার ঠাণ্ডা পানিতে গোসল সেরেছেন। তবে এবার গোসল করেও খুব একটা লাভ হলো না। বাথটাবের মধ্যে শুয়ে তিনি তো প্রায় ঘুমিয়েই পড়ছিলেন। তখন একটা বুদ্ধি বের করলেন ডক্টর। শিলাকে পানি ভরা গ্লাস দিয়ে বললেন, শিলা যখনই দেখবে ঘুমে ডক্টরের চক্ষু মুদে আসছে, সাথে সাথে সে পানির ছিটা দেবে।

পরবর্তী এক ঘণ্টায় দু’দু’বার পানির ছিটা দিতে হলো আবরারের মুখে। দু’বারই কথা বলার সময় মাঝপথে ঘুমিয়ে পড়ছিলেন তিনি। সন্ধ্যা ছ’টার দিকে দ্বিতীয়বার একই ঘটনা ঘটল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে রাত হয়ে যাবে। সন্দেহ হলো অতক্ষণ জেগে থাকতে পারবেন কিনা।

তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে উঠে দাঁড়ালেন আবরার, বললেন, ‘শিলা, এতে কাজ হবে না। আমাকে পেরেক মারা চেয়ারের ওপর বসিয়ে দিলেও আমি ঘুমিয়ে পড়ব। বিপদ যেহেতু দুজনেরই কাজেই আপনাকে বলে দিচ্ছি কী করতে হবে।

‘এক-এখনও যেটুকু শক্তি আছে শরীরে, পায়ে হেঁটে শহরে পৌঁছুতে পারব আমি-নিদেন কাছের কোনও ফার্ম হাউজে যেখানে টেলিফোন আছে। আমি শটগান নিয়ে যাব, পিস্তলটা আপনার কাছে থাকবে। হয়তো কাজটা করতে পারব আমি। হয়তো বিপদটাকে আমরা বেশি বড় করে দেখছি, শত্রুর সীমানা নির্ধারণের ক্ষমতাও হয়তো বড় করে দেখছি। যাই হোক, শহরে পৌঁছুতে পারলে আমি আপনাকে রক্ষার ব্যবস্থা করব। স্টেট পুলিশ আসবে শটগান আর টমিগানে সুসজ্জিত হয়ে। আর যদি যেতে না পারি-’

‘না,’ দৃঢ় গলায় বলল শিলা। ‘আপনি গেলে আমিও যাব আপনার সাথে। তবে গাড়িতে। আর আমি গাড়ি ড্রাইভ করব। আর পায়ে হেঁটে যে যেতে চান তাতে কী লাভ হবে?

‘আমি জেগে থাকতে পারব। তা ছাড়া আকাশের দিকে নজর রেখে চলাও সম্ভব হবে। আগেই বলেছি ওপর থেকে কোনও শক্তিশালী পাখি ডাইভ দিয়ে পড়লে আপনার হালকা গাড়ি তা সামাল দিতে পারবে না। আমাদের যে কেউ ওই হামলায় মারা যেতে পারি।’

আর দ্বিতীয় বিকল্প হলো-আমি যদি এ ঘরে বসে ঘুমিয়ে পড়ি আপনি আমাকে বেঁধে রাখবেন। আমি বাঁধা অবস্থায় থাকলে শত্রু আমার ওপর ভর করলেও কোনও ফায়দা করতে পারবে না। যেমন আমাকে দিয়ে আপনার ওপর হামলা করাতে পারবে না। আর আমাকে খুন করতে না পারলে তখন আরেক হোস্টের ওপর নির্ভর করতে সে বাধ্য হবে। এতে সুবিধে হবে আপনি গাড়ি নিয়ে শহরে গিয়ে সাহায্য নিয়ে আসতে পারবেন।

‘কিন্তু–কী ধরনের সাহায্য, আপনি যদি–‘

‘কী ঘটবে না দেখা পর্যন্ত বলা মুশকিল। তবে আপনি শহরে পৌঁছুতে পারলে আর চিন্তা নেই। আপনি আপনার স্টেটমেন্ট নিয়ে হাইয়েস্ট অথরিটির সাথে দেখা করবেন। এফ.বি.আইতে ফোন করবেন। রজার প্রাইস বা বিল কেলারম্যান, যাকেই পান গল্পটা খুলে বলবেন। ওরা দু’জনেই আমার বন্ধু। আপনার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবে ওরা। নাম দুটো মনে থাকবে নাকি লিখে দেব?’

‘রজার প্রাইস বা বিল কেলারম্যান। মনে থাকবে। কিন্তু আমি শহরে যেতে পারব তো? আমি কী করে জানব আপনি ঘুম থেকে উঠে রশি মুক্ত হতে চাইবেন না?’

‘ওই কাজ করলে আপনি অবশ্যই জানতে পারবেন। আর যদি না করি তা হলে আপনি শটগান নিয়ে বারান্দায় নেমে পড়বেন। খেয়াল রাখবেন কেউ আপনাকে হামলা করতে আসে কি না। যদি না আসে তা হলে শহরে যাবার সুযোগ নেবেন। আচ্ছা, দাঁড়ান আরেকটা কাজও করতে পারেন। আপনাকে শহরে যাবার ঝুঁকিই নিতে হবে না। কাল সকালে তো শেরিফ আসবেনই। আমাকে ততক্ষণ স্রেফ বেঁধে রাখুন। আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। পরিষ্কারভাবে কিছুই চিন্তা করতে পারছি না।’

‘ঠিক আছে, আপনাকে বেঁধে রাখাটাই ভাল।’

‘তা হলে রশি নিয়ে আসুন।’

রান্নাঘরে ঢুকল শিলা রশি আনতে। ড. আবরার লিভিংরুমে ফিরে এলেন। পকেট থেকে পিস্তল বের করে টেবিলে রাখলেন, শটগান থাকল সদর দরজার পাশে, দেয়ালে হেলানো।

‘এসব জিনিস যেন আমার হাতের নাগালে না আসে,’ শিলা কিচেন থেকে রশি নিয়ে ফেরার পর তিনি বললেন, ‘ছুরিটাও। আগে পিছমোড়া করে আমার হাত বাঁধুন, তারপর পা। আর শুনুন, যদি আমি পাগলের মত আচরণ করতে থাকি, কোনও সুযোগ আমাকে দেবেন না। পিস্তলের বাঁট দিয়ে মাথায় বাড়ি মেরে অজ্ঞান করে ফেলবেন। তবে মেরে ফেলবেন না। আমাকে মেরে ফেললে আমার শত্রু নতুন হোস্টের ওপর ভর করবে। এমনকী হোস্ট হিসেবে সে আপনাকেও বেছে নিতে পারে। যদি শেরিফ কাল সকালে পৌছার আগেই আপনি ঘুমিয়ে পড়েন।

দ্রুত হাতে আবরারকে রশি দিয়ে বাঁধছে শিলা, জিজ্ঞেস করল, ‘শহরে যাবার চেষ্টা করার চেয়ে এটা কি বেশি বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে না?’

‘ঠিক বলতে পারছি না। তবে আপনি এতে বিপদমুক্ত থাকবেন। আর আমার জন্যও এটা আর বিপজ্জনক হয়ে উঠবে না।‘

‘ঠিক আছে। আপনি যা বলেন। বাঁধনটা বেশি টাইট হয়ে গেল?’

‘না, ঠিক আছে। ইচ্ছে করলেও এ বাঁধন খুলতে পারব না। আমি শুয়ে পড়লাম। যতক্ষণ পারি জেগে থাকার চেষ্টা করব।’

কিন্তু পারলেন না আবরার। তিনি শুয়েছেন, শিলা তাঁর পায়ে রশি বেঁধেছে, প্রায় সাথে সাথে গভীর ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলেন ডক্টর আবরার।

শিলা কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল তাঁর পাশে। তারপর শটগানটা নিয়ে দরজা খুলল, তাকাল ওপর পানে। বিশাল এবং কালো আকারের কী যেন ভয়ঙ্কর গতিতে ছুটে এল তার দিকে, আঁতকে উঠল সে, একলাফে পিছিয়ে এল, বন্ধ করে দিল দরজা। ঠিক তখন ভারী কিছু একটা সজোরে ধাক্কা দিতে শুরু করল বন্ধ দরজায়।

.

দরজায় ধাক্কা মারছে একটা শকুন। মরা হরিণটাকে খেতে ব্যস্ত এক দল শকুনের ওটা একটা, ভিনগ্রহের হন্তারক এ মুহূর্তে এই পাখিটাকে তার স্বার্থ হাসিলের জন্যে ব্যবহার করছে।

শিলার আগমনে বিরক্ত হয়েছে সে। তার ইচ্ছে ছিল ষাঁড়টাকে দিয়ে মেয়েটার গাড়িটাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করবে। কিন্তু আবরার তাকে গুলি করল, সে বুঝতে পারল ডক্টর ষাঁড়টাকে প্রাণে মারতে চাইছে না, পঙ্গু করে ফেলতে চাইছে। তখন নিজের জান বাঁচাতে আবরারের দিকে ছুটে যায় সে, আবরার মারমুখী ষাঁড়ের হাত থেকে বাঁচতে আবার গুলি করতে বাধ্য হয়।

ষাঁড়ের অপমৃত্যুর পরপর হন্তারক বাড়ির পেছন দিকের সিঁড়ির নীচে তার কচ্ছপের খোলে এসে আশ্রয় নিয়েছে। মহিলা এবং পুরুষটার সমস্ত কথাই সে মনোযোগ দিয়ে শুনেছে। গাড়িতে বা পায়ে হেঁটে শহরে যাওয়া যে তাদের জন্যে বিপজ্জনক এবং সে কারণে সে চেষ্টাও তারা করেনি বোঝার পর স্বস্তিবোধ করেছে ভিনগ্রহের প্রাণী, স্কুল শিক্ষিকার গাড়িটা আর নষ্ট করার প্রয়োজনবোধ করেনি।

শেরিফ কাল সকালে আসতে পারে শুনেও সে উদ্বিগ্ন হয়নি। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার মত ক্ষমতা সে যথেষ্টই রাখে।’ যে-ই আসুক, সে প্রথম সুযোগেই গাড়ি ধ্বংস করে ফেলবে, হত্যা করবে গাড়ির মালিককে। কোনও সাহায্য সে আসতে দেবে না এ বাড়িতে।

সত্যি বাইরে থেকে কোনও সাহায্য আসছে কিনা দেখার জন্যে উড়ন্ত হোস্ট ব্যবহার করল হন্তারক। একটা চিকেন হককে এ কাজে লাগাল সে। রাস্তার ওপর চক্কর দিতে শুরু করল পাখিটা, তীক্ষ্ণ নজর রাখল বাড়ির ওপর। এতে অবশ্য একটা অসুবিধে হলো। উড়ন্ত হোস্টের সাথে ব্যস্ত থাকায় সে তার পারসেপটিভ সেন্স বাড়ির ভেতরে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হলো। ফলে ভেতরে কী ঘটছে অনেক সময় জানা হলো না তার। আবরার যখন বলছেন তাঁর পক্ষে আর জেগে থাকা সম্ভব হবে না, ভিনগ্রহের ভয়ঙ্কর ওই সময় আরেকটি ‘ফ্লাইং হোস্ট ব্যবহার করল চারপাশে নজর বুলাতে। সে ধরে নিয়েছে এরপর আর কোনও উড়ন্ত হোস্টের তার প্রয়োজন হবে না, তাই শেষবারের মত রাস্তা-ঘাট চেক করে দেখছিল সে। ফলে আবরার আর শিলার মধ্যে সর্বশেষ কী কথা হলো জানতে পারল না সে, জানা হলো না আবরারকে বেঁধে রাখার ব্যাপারটিও।

কাজেই, ভিনগ্রহের খুনী অবাক হয়ে গিয়েছিল শিলাকে একা শটগান হাতে বেরিয়ে আসতে দেখে। মহিলাকে লক্ষ্য করে শকুনটাকে ঝাঁপ দিতে বাধ্য করে সে, তবে শিলা দ্রুত ঘরে চলে যাওয়ায় টার্গেট মিস হয়ে যায়। শকুনটাকে মেরে ফেলে ভিনগ্রহের হন্তারক আবার ফিরে এসেছে ‘নিজের খোলসে।

সে খুবই অবাক হয়েছে তার চূড়ান্ত হোস্ট আবরারকে দড়ি বাঁধা অবস্থায় ঘুমাতে দেখে। ঘুমাচ্ছে ঠিক আছে। কিন্তু দড়ি বাঁধা অবস্থায় কেন? এখন আবরারের শরীরে ঢুকলেও লাভ হবে না কিছু। বাঁধন না খুলে আবরার কিছুই করতে পারবে না। তবে মেয়েটা নিশ্চয়ই সারা জীবন দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতে পারবে না। এক সময় দড়ি খুলতেই হবে। সে সিদ্ধান্ত – নিল আবরারের ভেতরে ঢুকবে। যেহেতু আবরার ঘুমাচ্ছে, সময়ের সদ্ব্যবহার করতে পারবে সে, আবরারের একান্ত গোপন ভাবনা এবং স্মৃতিগুলোর কথা জেনে নিতে পারবে ভিনগ্রহের হন্তারক। তারপর মাঝরাতের দিকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলবে আবরারকে। ডক্টরকে দিয়ে এমন স্বাভাবিক আচরণ সে করাবে যাতে মেয়েটার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ না জাগে এবং তার বাঁধন খুলে দেয়। তারপর-তারপর কী করবে সেটা পরে দেখা যাবে। আপাতত ডক্টর আবরারকে কব্জা করা যাক।

ভিনগ্রহের হন্তারক ঢুকে পড়ল আবরারের শরীরে।

শরীরের ভেতরে ঢোকার পরপরই কেমন অস্বস্তি হতে লাগল তার। এ পর্যন্ত যতগুলো প্রাণী বা মানুষের মনের ভেতর ঢুকেছে সে, প্রতিটি মন অন্তত এক মুহূর্তের জন্যে হলেও প্রতিরোধের চেষ্টা করেছে। তবে ওটাকে কোন বাধাই মনে করেনি ভিনগ্রহের হত্যাকারী।

কিন্তু এবারের প্রতিরোধটা যেন অন্যরকম। কয়েক সেকেন্ড ধরে আবরারের মন তার বিরুদ্ধে লড়াই করে চলল। সে পুরোপুরি দখল করতে পারছে না আবরারকে। হঠাৎ ঝাঁকি খেয়ে উঠে বসলেন আবরার, হাঁপিয়ে উঠে বললেন, ‘সিঁড়ির নীচে। জিনিসটা হলো-’

আর বলতে পারলেন না আবরার। কারণ হন্তারক তাকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছে।

.

ডক্টর আবরার আবার শুয়ে পড়লেন, বার দুয়েক দম নিলেন গভীর করে, তারপর চোখ মেলে তাকালেন। শিলার সাথে চোখাচোখি হলো তাঁর, কাউচের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল সে। স্বাভাবিক গলায় আবরার বললেন; ‘মনে হচ্ছিল দুঃস্বপ্ন দেখছি, শিলা। অতিরিক্ত ক্লান্তির কারণেই হয়তো। ঘুমের মধ্যে আমি কি কিছু বলেছি?’

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল শিলা। তারপর খুব আস্তে বলল, ‘বলেছেন ডক্টর-সত্যি যদি আপনি ডক্টর আবরার হয়ে থাকেন। বলেছেন, ‘সিঁড়ির নীচে-জিনিসটা হলো-’ তারপর চুপ হয়ে গেছেন।

‘গুড লর্ড, শিলা, সব মনে নেই আমার। শুধু মনে পড়ছে একটা ষাঁড় আমাকে গুঁতো দিতে আসছে আর-ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আমি দৌড়াচ্ছিলাম। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করলাম সামনের দরজায় সিঁড়ির নীচে-স্বপ্নে আমার হাতে কোনও বন্দুক ছিল না। এখন আমার ঘুম পাচ্ছে। তবে আশা করি এবার আর দুঃস্বপ্ন দেখতে হবে না।’ তিনি চোখ বুজলেন।

‘ড. আবরার, আপনি বলেছিলেন আপনার শত্রু কাছে পিঠেই আছে এবং ঘরের মধ্যে কোথাও লুকিয়ে থাকতে পারে। সেটা সিঁড়ির নীচেও হতে, পারে। সামনের দরজায় তিন থাক সিঁড়ি নেমে মিশেছে বারান্দার সাথে। আরও তিন থাক সিঁড়ি রয়েছে পেছনের দরজায়। আমি পরীক্ষা করে দেখব

ওখানে কিছু আছে কিনা।

শিলা, ব্যাপারটা হাস্যকর হবে। স্রেফ একটা দুঃস্বপ্নের কথা শুনে—’

কিন্তু তাঁর কথা শিলার কানে গেল না, সে তক্ষণে সদর দরজা খুলে বেরিয়ে পড়েছে, হাতে শটগান আর পিস্তল। বাইরে আলো আছে। তবু ফ্লাশলাইট নিয়েছে শিলা, সিঁড়ির নীচেটা অন্ধকার হতে পারে।

চারপাশে সতর্ক নজর বোলাল শিলা রহমান। তার ওপর হামলা করার মত কিছু বা কাউকে চোখে পড়ল না। সামনের সিঁড়িতে ফ্লাশলাইটের আলো ফেলল। কিছুই দেখতে পেল না। ঠিক করল আরও খোঁজ চালাবে। বাড়ির পেছন দিকটায় প্রয়োজনে মাটি খুঁড়ে দেখবে। পেছনে চলে এল শিলা

প্রথম দেখায় মনে হলো এদিকের সিঁড়ির নীচে কিছু নেই। তারপর আলো নিয়ে একটু সামনে এগিয়ে সদ্য বোজানো একটা গর্ত চোখে পড়ে গেল শিলার। ওখানকার মাটি খুঁড়ে আবার গর্তটা বুজিয়ে দিয়েছে কেউ। হ্যাঁ, মানুষের হাতের ছাপও ফুটে আছে নরম মাটিতে।

জামা-কাপড় ময়লা হয়ে যাবে, সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল শিলা, হাত বাড়িয়ে দিল সিঁড়ির নীচে। মাটি এখানে আলগা, সহজেই তোলা গেল। হাতে কী যেন একটা ঠেকল। কচ্ছপের খোলের মত লাগল-কিন্তু কচ্ছপ গর্ত করে না, শক্ত মাটিতে তো নয়ই। টান মেরে ওটাকে তুলে আনল শিলা। কচ্ছপের মত দেখতে জিনিসটা, তবে এটার হাত-পা লেজ কিছুই নেই-এক পলক দেখেই বুঝতে পারল শিলা-এটা ভিনগ্রহবাসী।

গা ঘিনঘিন করে উঠল শিলার, ছুঁড়ে ফেলে দিল জিনিসটা। তারপর খোলার মাঝখানে পিস্তলের নল ঠেকাল এবং গুলি করল।

ঠিক সেই সময়, ঘরের ভেতর যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলেন ড. আবরার। এক দৌড়ে সামনের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকল শিলা, হাতে প্রস্তুত্ শটগান।

মেঝের ওপর পড়ে আছেন ডক্টর, তবে হাসছেন তিনি। প্রশান্ত, সুন্দর হাসি। শিলাকে দেখে বললেন, ‘তুমি পেরেছ, শিলা। ভিনগ্রহের হন্তারককে হত্যা করতে পেরেছ। তবে আমার বাঁধন এখনই খুলে দিতে হবে না। কারণ পুরোপুরি বিপদমুক্ত হতে পেরেছি কিনা এখনও জানি না।’

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডক্টর। ‘বেচারা ভিনগ্রহবাসী। স্রেফ নিজের গ্রহে ফিরে যেতে চেয়েছিল সে-কিন্তু পারল না। আমি কয়েক মুহূর্তের জন্যে ওর নিয়ন্ত্রণ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছিলাম বলে রক্ষা কয়েকটা শব্দও উচ্চারণ করার সুযোগ পেলাম। তোমাকে ধন্যবাদ কথাগুলো বুঝতে পারার জন্যে-স্মৃতি মনে পড়তে শিউরে উঠলেন তিনি-’আমিও ওর মনের মধ্যে ছিলাম। ও যা জানত সবই আমার জানা হয়ে গিয়েছিল। সে এক লম্বা গল্প। কীভাবে সে হোস্ট ব্যবহার করত, কী উদ্দেশে ইত্যাদি সব।’

‘কোত্থেকে এসেছিল ওটা-সৌরজগতের কোনও গ্রহ থেকে?’

‘না, বহু দূরের নক্ষত্রের এক গ্রহ থেকে। সেখানে পৌছুবার কথা হয়তো আমরা কল্পনাও করতে পারব না। সে গ্রহের কথা তুমি শুনতে চাও, শিলা?’

শিলা রহমানের চেহারা দেখেই বোঝা গেল সে কত আগ্রহ নিয়ে আবরারের গল্প শুনছে, হ্যাঁ, বলার দরকার হলো না।

মৃদু গলায় বলে যেতে লাগলেন আবরার। ‘সে গ্রহের বিজ্ঞান আমাদের কাছে অচেনা। আমরা কল্পনাও করতে পারব না সেই বিজ্ঞান নিয়ে। তবে আমি দূর গ্রহে যাবার স্বপ্ন দেখি, শিলা। স্যাটেলাইট নিয়ে অনেক বড় বড় কাজ করতে চাই। সে সব কাজে তোমার মত একজন মানুষ বড় প্রয়োজন, শিলা, তুমি আসবে আমার সাথে? তোমাকে নিয়ে আমি অজানা গ্রহ আবিষ্কার করব। হয়তো যাব মঙ্গল বা শুক্রগ্রহে, হয়তো মনুষ্য বসবাসের গ্রহও আমরা খুঁজে পাব এক সময়। বলো তুমি যাবে আমার সঙ্গে?’

অভিভূতের মত মাথা দোলাল শিলা। ডক্টর আবরারকে সে বিশ্বাস করে, এরকম একজন মানুষের পাশে থেকে কাজ করতে তার ভালই লাগবে। সে শুধু অস্ফুটে বলল, ‘যাব।’

হাসিতে উদ্ভাসিত হলো আবরারের চেহারা। ইতিমধ্যে তাঁর বাঁধন খুলে দেয়া হয়েছে। তিনি একটা হাত বাড়িয়ে দিলেন শিলার দিকে, বললেন, ‘তা হলে ওই কথাই রইল, শিলা।’

আবরারের হাতটা নিজের নরম হাতে নিয়ে ছোট্ট করে মাথা দোলাল শিলা রহমান। মিষ্টি হেসে বলল, ‘জ্বী, ওই কথাই রইল।’

আর কিছু বললেন না মি. সি. আর. আবরার। হাত-পা টানটান করে শুয়ে পড়লেন। প্রায় সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঠোঁটের কোনায় মৃদু হাসি।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *