হনুমান
আমাদের পাড়ায় এখনও কিছু গাছপালা আছে। আর কতদিন থাকবে জানি না। পিলপিল করে মানুষ বাড়ছে। যেখানে যত পুকুর আর জলা-জমি ছিল সব ভরাট করে বাড়ির পর বাড়ি উঠছে। তাতেও বাসস্থানের অভাব ঘুচছে না। এই পল্লীর কিছু দূরেই দক্ষিণেশ্বর। দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে ছিল বিশাল বাগান। বিখ্যাত পঞ্চবটি। যুগ পালটে গেল। সে যুগেতে পঞ্চবটিতে সাধনা হত। এ যুগেও সাধনা হয়, প্রেমের সাধনা। ক্রমশ বাগানটি বড়ই বিপজ্জনক হয়ে পড়ায় এখন কেটেকুটে ফর্সা করে দেওয়া হয়েছে। সাধনার আর প্রয়োজন নেই। পঞ্চবটিতে বসবাস করত অসংখ্য হনুমান। তাদেরই দু-এক জোড়া বেড়াতে আসত আমাদের পাড়ায়।
সে এক দৃশ্য! নিমেষে সব ওলটপালট। তাদের মঞ্চে প্রবেশটা ছিল এইরকম, বীর আর বীরের ওয়াইফ জোড়ে লাফিয়ে এসে পড়ল অক্ষয়বাবুর টালির ছাদে। যেখানে পড়ল সে জায়গায় সব টালি চুরমার। মার-মার করে তেড়ে এলেন অক্ষয়বাবু সপরিবারে। বীর হনুমান দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে গেল। বীর অক্ষয়বাবুর পরিবার বললেন, ‘আ-মরণ, তেড়ে-তেড়ে আসছে, তেড়ে-তেড়ে আসছে। এক একটা টালির দাম দশ টাকা, মুখ-পোড়া কুড়িটা টালি ভেঙে দিলে গা।’ টালির চালে বীর তাল ঠুকছে, নিচে সপরিবারে অক্ষয়বাবুর পরিবার। বড় ছেলে আধলা একটা ইঁট ছুঁড়লে। ইঁট গিয়ে লাগল ভূতনাথবাবুর সিঁড়ির বাহারি কাঁচে! বীর এইবার ঝাঁপ মারল পাশের বাড়ির পেঁপে গাছে। দুটো গাছের মাথা ভেঙে অর্ধনমিত পতাকার মতো ফলন্ত পেঁপে সমেত ঝুলে গেল। সেই বাড়িতে হাহাকার উঠল। সেদিক থেকে ছুটে এল ঝাঁক-ঝাঁক ঢিল। রাস্তা দিয়ে সনাতনবাবু যাচ্ছিলেন নস্যি নিতে-নিতে, তাঁর টাক ফেটে গেল। হনুমান গিয়ে বসল তারকবাবুর কলমের পেয়ারা গাছে। পাড়ার বালখিল্যরা সবাই রণাঙ্গনে নেমে পড়েছে। চিৎকার, চেঁচামেচি, হইহই। দক্ষযজ্ঞ ব্যাপার। হনুমানযুগলে আপনমনে পেয়ারা ধ্বংস করে চলেছে। ওদিকে অক্ষয়বাবু আর ভূতনাথবাবুর পরিবারে লাঠালাঠি বেঁধে গেছে। সনাতনবাবুর টাকে আইডিন ভেজান একথাবা তুলো চেপে ধরেছে সোস্যাল ওয়ার্কার যমুনা।
হনুমান এইবার এক লাফ মেরে ভন্ডুলদের ছাদের এক জোড়া টিভি এন্টেনা ধরাশায়ী করে বীরদর্পে তিনবার হুপ শব্দ ছেড়ে ইংরিজি স্কুলের বিরাট অর্জুন গাছের মগডালে গিয়ে চড়ে বসল। ভালো মানুষের মতো মুখ, যেন কিছুই জানে না, একজোড়া লেজ ঝুলছে। এক ঝাঁক কাক কা কা করছে। এক পাল কুকুর ঘেউঘেউ করে পাড়া ফাটাচ্ছে। বীরের বউ স্বামীর মাথার উকুন মারছে। তারা যেমন হঠাৎ এসেছিল, সেইরকম হঠাৎ এক সময় অদৃশ্য হয়ে গেল। হনুমানের আগমন, হনুমানের নিষ্ক্রমণ যেন এক পর্ব।
হঠাৎ সেদিন আবার হনুমান এল। ইতিমধ্যে অক্ষয়বাবুর টালির ছাদ ঢালাই হয়ে গেছে। সুতরাং হইহইটা আর ওই তল্লাটে হল না। হনুমান যুগল আমাদের পাড়ার উঠতি বড়লোক শঙ্করবাবুর বিশাল ছাদে ল্যান্ড করে প্রথমে এক রাউন্ড পায়চারি করে নিল। একটি শিশু দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল, পাশেই তার বাবা, মেঝেতে বসে হাত আয়নায় দাড়ি কামাচ্ছিলেন। সারা মুখে সাবানের ফেনা। ছেলে আদো-আদো বুলিতে বলল, ‘বাবা, হুম্মান। বাবা হুম্মান।’ বাবার চোখ আয়নায়। তিনি ভাবলেন ছেলে তাকেই বলছে। ছেলেকে বললেন, ‘ছি: ছি:, পেট থেকে পড়তে না পড়তেই বাপকে হনুমান বলছিস বাবা। কালের কী প্রভাব।’ ছেলের সে-কথা কানে গেল না, সে আরও চিৎকার করে বলল, ওই যে হুম্মান।’
ছেলের মা বেরিয়ে এলেন বারান্দায়। সামনের বাড়ির ছাদের আলসেতে হনুমান। তিনি ছেলেকে বললেন, ‘নমো করো, নমো করো।’ স্বামীকে বললেন, ‘দাড়ি পাঁচ মিনিট পরে কামালেও চলবে। গেট আপ, গেট আপ, আগে নমস্কার করো।’
একগালে সাবান, স্বামী উঠে দাঁড়ালেন। একালের স্বামীরা স্ত্রীর বশীভূত। প্রশ্ন করলেন না, কেন নমো করব! এক বছর আগে তো পাটকেল মারা হত। পাল্লা দিয়ে দাঁত খিঁচনো হত। ছড়া কাটা হত, ‘এই হনুমান কলা খাবি, জয় জগন্নাথ দেখতে যাবি? বড় বউয়ের বাবা হবি?’ হঠাৎ কেন এই ভাবান্তর! কোনও দিক থেকেই ইট-পাটকেল এসে পড়ছে না। ছেলেরা হইহই করছে না। কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে না। ব্যাপারটা কি?
সামনের বাড়ির ছাদে এক মহিলার আবির্ভাব হল। তাঁর হাতে এক ডজন সিঙ্গাপুরী কলার পুরুষ্টু এক ছড়া। তিনি সসম্ভ্রমে নতজানু হয়ে ছড়াটি সেই বীর হনুমানকে নিবেদন করলেন। এক লাফে এগিয়ে এসে কলার ছড়া নিয়ে হনুমান উঠে গেল চিলের ছাদে। সেখানে আয়েস করে বসে একটি একটি করে কলা খেয়ে খোসাগুলি নিচে ফেলতে লাগল।
দেখা গেল শুধু ওই বাড়ি নয় আশেপাশের সব বাড়ির ছাদেই মেয়েরা উঠে পড়েছেন। যুবতী মেয়ের সংখ্যাই বেশি। হনুমানকে ভোগ নিবেদনের প্রতিযোগিতা পড়ে গেল। কারুর হাতে ফুলকপি, কারুর হাতে বাঁধাকপি, কারুর হাতে মুলো। কেউ এনেছেন এক চুবড়ি সিম। যাঁর হাতের কাছে কিছুই ছিল না, তিনি এনেছেন আলু। কেউ রোগির মাথার কাছ থেকে টেনে এনেছেন আপেল আর কমলালেবু। হনুমান লাফিয়ে-লাফিয়ে ছাদে-ছাদে ঘুরছে আর খেয়ে-খেয়ে বেড়াচ্ছে। একজন কিছু না পেয়ে আস্ত একটা মানকচু দিয়েছিল। হনুমান তাইতে এক কামড় মেরেই দাতাকে সপাটে এক চড়।
হনুমান শেষে একটা কেক খেয়ে লাফাতে-লাফাতে চলে গেল। ভদ্রলোক বাকি আধগালের দাড়ি কামাতে-কামাতে স্ত্রীকে জিগ্যেস করলেন, ‘কি ব্যাপার বল তো! হনুমানের হঠাৎ এত খাতির?’
‘খাতির হবে না! হনুমান যে একজন টিভি স্টার এখন। রামায়ণ দ্যাখ না!’
হনুমানের খাতির বেড়েছে। সেদিন বেপাড়ার এক মস্তান এসে এপাড়ার সেরা মস্তানের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তাল ঠুকছে—’এ বালু সুগ্রীব তেরে যুধ কে লিয়ে লড়কাতা, এ বালে!’
রামরাজত্ব সত্যই তাহলে এল! রামনাম সত্য হ্যায়। সরষের তেলে ক্যা হায়!