হত ভৃত্য

হত ভৃত্য

প্রথম পরিচ্ছেদ 

একে শীতকাল, তাহার উপর সমস্ত দিন টিপ্ টিপ্‌ করিয়া বৃষ্টি হইতেছে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন কনকনে শীত। কাহার সাধ্য এ দুর্যোগে ঘরের বাহির হয়। পথ কদমাক্ত – কিন্তু তাহা হইলেও পথে লোকের অভাব ছিল না। 

রাত্রি প্রায় দুইটা। সর্ব্বাঙ্গ গরম কাপড়ে আবৃত করিয়া আমি সুখে নিদ্রা যাইতেছি। কিন্তু এ অদৃষ্টে সে সুখ থাকিবে কেন? সহসা কে আমার দেহে ধাক্কা দিল, আমার নিদ্রা ভঙ্গ হইল। ঘরে আলো জ্বলিতেছিল, দেখিলাম, সম্মুখেই আমার স্ত্রী দণ্ডায়মান। ঘড়ীর দিকে চাহিয়া দেখিলাম, দুইটা বাজিতে পাঁচ মিনিট বাকি। 

অসময়ে অকস্মাৎ আমার নিদ্রাভঙ্গ করায়, আমি গৃহিণীর উপর বিরক্ত হইলাম। মুখের ভাব দেখিয়াই, বোধ হয়, গৃহিণী আমার মনের কথা বুঝিতে পারিয়াছিলেন। তিনি ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন “রামদীন এইমাত্র আমায় বলিয়া গেল, সাহেবের আরদালি বাহিরে তোমার অপেক্ষা করিতেছে। আমার অপরাধ নাই—আমার উপর বিরক্ত হইলে কি করিব?” 

সাহেবের আরদালি বাহিরে অপেক্ষা করিতেছে শুনিয়া, আমি বিনা বাক্যব্যয়ে শয্যাত্যাগ করিলাম এবং তখনই বাহিরে আসিয়া তাহার সহিত দেখা করিলাম। সে বলিল “শিয়ালদহের ত্রৈলোক্য চৌধুরীর বাড়ীতে একজন চাকর খুন হইয়াছে, আপনাকে এখনই তাহার অনুসন্ধানে যাইতে হইবে। সাহেব গিয়াছেন। এই বলিয়া সে আমার হাতে একখানি পত্র দিল। পত্রখানি স্বয়ং সাহেবের লেখা, আরদালি আমায় যে কথা বলিল, পত্রেও ঠিক সেই কথা লেখা ছিল। 

আরদালি সেলাম করিয়া চলিয়া গেল। আমি একজন কনেষ্টবলকে একখানি গাড়ি ভাড়া করিয়া আনিতে বলিলাম। গাড়ী আনীত হইল, আমি ত্রৈলোক্যবাবুর বাড়ীর দিকে যাত্রা করিলাম। লক্ষপতি ত্রৈলোক্য চৌধুরী একজন বিখ্যাত সম্ভ্রান্ত লোক। শুনিয়াছি, তাঁহাদের আদি নিবাস কলিকাতায় নহে। ত্রৈলোক্যনাথের পিতামহ কলিকাতায় আসিয়া মধ্যে মধ্যে বাস করিতেন। তাঁহার পিতার জন্ম কলিকাতায়, তিনি জন্মাবধি কলিকাতাতেই বাস করিয়াছিলেন। ত্রৈলোক্যনাথও কলিকাতায় বাস করেন। তাঁহার অগাধ সম্পত্তি। প্রকাণ্ড বাড়ী, নাম যশ যথেষ্ট। এ হেন লক্ষপতির বাড়ীতে খুন! কি ভয়ানক! 

ত্রৈলোক্যনাথের বাড়ী আমাদের সকলেরই পরিচিত। অর্দ্ধ ঘণ্টার মধ্যেই আমরা সেখানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। বাড়ীর সম্মুখে একটা প্রকাণ্ড মাঠ; প্রতিদিন বৈকালে সেখানে ফুটবল, টেনিস, ক্রিকেট প্রভৃতি সময়োচিত খেলা হইয়া থাকে। বাড়ীখানি প্রকাণ্ড ও দ্বিতল-চারিদিকে অনুচ্চ প্রাচীরে বেষ্টিত বাড়ীর ফটক প্রায়ই খোলা থাকে। ফটক পার হইয়া আমরা বাড়ীর বাহিরের প্রাঙ্গণে উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, ইতিপূৰ্ব্বেই সেখানে কয়েকজন কর্মচারী ও সাহেব উপস্থিত হইয়াছেন। 

উঠান পার হইয়া বাড়ীর সদর দরজায় উপস্থিত হইবামাত্র স্থানীয় থানার দারোগাবাবু, বাড়ীর কর্তা ত্রৈলোক্যবাবু ও তাঁহার একমাত্র পুত্র রজনীকান্ত আমাদের নিকট আসিলেন। 

অন্যান্য দুই একটি কথাবার্তার পর, দারোগা বাবু আমাকে কাৰ্য্যস্থানে লইয়া গেলেন। যেখানে ভৃত্যটির মৃতদেহ পড়িয়াছিল, আমি সেইখানে গেলাম। দেখিলাম, একজন বলিষ্ঠ গৌরবর্ণ যুবক চিৎ হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে, তাহার বক্ষঃস্থল দিয়া রক্তস্রোত নির্গত হইতেছে, যে স্থানে সে পড়িয়াছিল, তাহা রক্তে রক্তাক্ত হইয়াছে। আমি নিকটে গিয়া ভৃত্যের দেহ পরীক্ষা করিলাম, দেখিলাম, তাহার বক্ষে একটি ক্ষুদ্র ছিদ্র। সম্ভবতঃ, বন্দুকের গুলি তাহার বক্ষ ও হৃদয় ভেদ করিয়াছিল এবং তদ্দণ্ডেই তাহার মৃত্যু হইয়াছিল। 

ত্রৈলোক্যবাবু ও তাঁহার পুত্র আমার নিকটেই ছিলেন, কিন্তু তাঁহাদিগকে আমার কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে হয় নাই। দারোগা বাবু ইতিপূৰ্ব্বেই সেই লোমহর্ষণ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইয়াছিলেন, সুতরাং তাঁহারই নিকট হইতে আবশ্যকীয় সংবাদ গ্রহণ করিলাম। 

ত্রৈলোক্যবাবু ও তাঁহার পুত্র রজনীকান্ত আমাকে বারবার সেই খুনের বিষয় বিশেষ করিয়া অনুসন্ধান করিতে অনুরোধ করিয়া, বাড়ীর ভিতর গমন করিলেন। আমি তখন দারোগাবাবুকে বলিলাম “মহাশয়, আমার শরীর বড় ভাল নয়, তিন চারি দিন কঠোর পরিশ্রম করিয়া বড়ই ক্লান্ত হইয়াছি। আপনি এই ভয়ানক হত্যাকাণ্ডের কতদূর কি করিয়াছেন বলুন?” 

দারোগাবাবু অতি গম্ভীরভাবে উত্তর করিলেন “এখনও কিছুই করিতে পারি নাই। কিন্তু যখন আপনি আসিয়াছেন, তখন শীঘ্রই এ রহস্য ভেদ হইবে বলিয়া আমার বিশ্বাস।” 

দারোগার কথা শুনিয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনি কতক্ষণ এখানে আসিয়াছেন?” 

দা। আপনার আসিবার প্রায় অর্দ্ধঘণ্টা পূর্ব্বে। 

আ। কোন সূত্র পাইয়াছেন? 

দা। শুনিয়াছি, হত্যাকারীকে না কি দেখা গিয়াছে। 

দারোগার কথায় আমি বিস্মিত হইলাম। বলিলাম “সত্য না কি? হত্যাকারী দেখা দিয়া কোথায় গেল? কে তাহাকে দেখিয়াছে?” 

দা। সে চাকরকে গুলি করিয়া কোথায় যে পলায়ন করিল, তাহা কেহই বলিতে পারিল না। স্বয়ং ত্রৈলোক্যবাবু ও তাঁহার পুত্র উভয়েই হত্যাকারীকে পলায়ন করিতে দেখিয়াছেন। 

আ। কত রাত্রে এই ব্যাপার সংঘটিত হয়? 

দা। দুপুর বাজিতে এক কোয়ার্টার পূর্ব্বে। 

আ। সেই রাত্রে ত্রৈলোক্য বাবু ও তাঁহার পুত্র জাগিয়াছিলেন কেন? 

দা। ত্রৈলোক্য বাবু প্রতিদিনই অধিক রাত্রি পর্য্যন্ত হিসাবপত্র করিয়া থাকেন। রাত্রি দুপুরের পূর্বে তিনি একদিনও বিশ্রাম করেন না। 

আ। কি রকমে তিনি হত্যকারীকে দেখিতে পান? 

দা। কার্য কৰ্ম্ম শেষ করিয়া তিনি বিশ্রাম করিতে যাইতেছিলেন, এমন সময় হঠাৎ একটা বন্দুকের শব্দ তাঁহার কর্ণ গোচর হয়। সেই শব্দ শুনিয়া তিনি যেমন জানালার নিকট গেলেন, অমনই একজন লোককে তীরের মত ছুটিয়া যাইতে দেখিতে পান। 

আ। চাকরের নাম কি? এ বাড়ীতে সে কতদিন চাকরী করিতেছে? 

দা। ভৃত্যের নাম দুর্গাচরণ, বাল্যকাল হইতে এখানে চাকরী করিতেছে বলিয়া, সে বাবুদের বড় বিশ্বাসী। 

আ। ত্রৈলোক্যবাবুর পুত্র কি দেখিয়াছিলেন? তিনিই বা কেন তত রাত্রি পর্য্যন্ত জাগিয়াছিলেন? 

দা। শুনিলাম, তিনি একখানি পুস্তক পাঠ করিতেছিলেন। পড়িতে পড়িতে হঠাৎ দুইজনের কথাবার্তা তাঁহার কর্ণ গোচর হয়। তিনি তখনই ঘরের জানালার নিকট গেলেন, দেখিলেন, দুর্গাচরণ আর একজন অপরিচিত লোকের সহিত বচসা করিতেছে। দুর্গাচরণ পুরাতন ভৃত্য-রজনীকান্ত জানালা হইতে ওই ব্যাপার অবলোকন করিয়া, তখনই নীচেয় আসিলেন। কিন্তু সেখানে উপস্থিত হইবার পূর্ব্বেই একটি বন্দুকের শব্দ তাঁহার কর্ণ গোচর হইল। তিনি দ্রুতগতি সেই ভৃত্যের নিকট আগমন করিলেন। দেখিলেন, দুর্গাচরণ চিৎ হইয়া নিশ্চল নিস্পন্দবৎ পড়িয়া রহিয়াছে। তাহার বক্ষঃস্থল হইতে অনর্গল রুধির স্রোত প্রবাহিত হইতেছে। 

আ। মৃত্যুর পূর্ব্বে ভৃত্য কোন কথা বলিয়াছিল? 

দা। কই, সে কথা ত শুনি নাই। 

আ। রাত্রি দুই প্রহরের সময় ভৃত্য বাহিরে ছিল কেন? বাড়ীর সদর দরজাই বা খুলিল কে? 

দা। আগেই বলিয়াছি, দুর্গাচরণ বড় বিশ্বাসী ভৃত্য। ত্রৈলোক্যবাবু, তাঁহার পুত্র ও বাড়ীর আর সকলেই তাহাকে অত্যন্ত বিশ্বাস করে। রাত্রে বাড়ীর সমস্ত দরজা ও জানালাগুলি বন্ধ করিবার ভার তাহারই উপর ছিল। সেদিন দরজা বন্ধ করিয়াছিল কি না সন্দেহ হওয়ায়, সে যেমন সেই দরজার নিকট আইসে, অমনি কোন লোক তাহাকে আক্রমণ করে। 

আ। ভৃত্যের নিকট কি এমন কোন জিনিষ পাওয়া যায় নাই, যাহাতে এই হত্যাকাণ্ডের সন্ধান করিতে পারা যায়? আমার কথা শেষ হইতে না হইতে দারোগাবাবু পকেটে হাত দিলেন এবং একখণ্ড ময়লা ছেঁড়া কাগজ বাহির করিয়া, বলিলেন “এই কাগজখানি দুর্গাচরণের হাতে পাওয়া গিয়াছে। দেখিয়া বোধ হয়, উহা একখানি পত্রের অংশ মাত্র। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, ইহাতে যে সময়ের কথা লেখা আছে, ঠিক সেই সময়েই সাংঘাতিক হত্যাকাণ্ড সম্পাদিত হইয়াছে।” 

দারোগাবাবুর হাত হইতে সেই কাগজ আমি গ্রহণ করিলাম। অনেকক্ষণ ধরিয়া উহা পরীক্ষা করিলাম। পরে দারোগাবাবুকে বলিলাম “আমার বোধ হয়, ভৃত্য যখন এই পত্রখানি পাঠ করিতেছিল, তখন কোন লোক বলপূর্ব্বক অবশিষ্ট অংশটুকু ছিঁড়িয়া লইয়া গিয়াছে। সময়ের মিল দেখিয়া, বোধ হয়, যেন পূর্ব্বেই এই বিষয়ের বন্দোবস্ত হইয়াছিল।” 

দা। আমিও সেইরূপ বিবেচনা করি। 

আ। ত্রৈলোক্য বাবু ও তাঁহার বাড়ীর লোকে ভৃত্যকে যতদূর বিশ্বাসী বলিয়া মনে করেন, সে বাস্তবিক তত বিশ্বাসী নহে। আমার বিশ্বাস, ওই দুর্গাচরণই দরজা খুলিয়া দিয়াছিল। তাহারা হত্যা করিতে আইসে নাই, ত্রৈলোক্যবাবুর বাড়ীতে চুরি করিতে আসিয়াছিল। শেষে কোন কারণ বশতঃ উভয়ের কলহ হইয়াছিল। সেই কলহের ফল ভৃত্যের মৃত্যু। 

দারোগাবাবু আমার কথায় সায় দিলেন। বলিলেন “আমারও বিশ্বাস সেইরূপ। দুর্গাচরণ যে দস্যুদলের পরিচিত এবং সেই যে তাহাদিগকে দরজা খুলিয়া দিয়াছিল, তাহাতে আমার কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।” 

কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “এদিকে সম্প্রতি আর কখন চুরি হইয়াছিল?” 

আমার প্রশ্ন শুনিয়া দারোগাবাবু গম্ভীর হইলেন। পরে বলিলেন “প্রায় একমাস পূর্ব্বে সরোজ চক্রবর্তীর বাড়ীতে চুরি হইয়া গিয়াছে।” 

আ। চোর ধরা পড়িয়াছে? 

দা। না। 

আ। কত টাকা চুরি গিয়াছিল? 

দা। সে বড় আশ্চর্য্য চুরি—একটিও নগদ পয়সা চুরি যায় নাই। যে সকল দ্রব্য চুরি গিয়াছে, তাহা শুনিলে আপনি বিস্ময়ান্বিত হইবেন। 

আ। সে কি? 

দা। একটা কাচের নল, খানিকটা সুতা, একখানা পুরাতন পঞ্জিকা আর একটা বাতিদান। 

আমি হাসিয়া উঠিলাম। বলিলাম “এ রকম অদ্ভুত চুরির কথা কখন শুনি নাই। তাহার কি ওই কয়েকটি দ্রব্য লইয়া যাইবার জন্য এই বাড়ীতে চুরি করিয়াছিল?” 

দারোগাবাবুও ঈষৎ হাসিলেন। পরে বলিলেন “আমার ত সে রকম বোধ হয় না।” 

আ। কেন? 

দা। তাহারা সরোজবাবুর বাড়ীর দুই তিনখানি ঘর তোলপাড় করিয়াছিল। কিন্তু আশ্চৰ্য্য এই যে, সেই সেই ঘরে যথেষ্ট মূল্যবান দ্রব্য থাকিতেও চোরেরা তাহার একটিও স্পর্শ করে নাই। 

আ। আপনারা ইহার কোন কারণ নির্দ্দেশ করিয়াছেন? 

দা। না। 

আ। সরোজবাবু কেমন লোক? তাঁহার সম্পত্তি কত? 

দা। সরোজবাবু অতি সজ্জন ও অমায়িক লোক। তাঁহারও যথেষ্ট সম্পত্তি আছে। এরূপ শোনা যায় যে, তাঁহার সম্পত্তির আয় ত্রৈলোক্যনাথের অপেক্ষা কোন অংশেই ন্যূন নহে। তবে সম্প্রতি ত্রৈলোক্যবাবুর সহিত এক মোকদ্দমায় উভয় পক্ষে অনেক অর্থব্যয় হইয়াছে। 

কিছুক্ষণ চিন্তার পর আমি সেই ছিন্ন পত্রাংশখানি বাহির করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “ইহার অপর অংশ কোথায় বলিতে পারেন?” 

দা। না। 

আ। অনুসন্ধান করিয়াছিলেন? 

দা। করিয়াছিলাম, কিন্তু কৃতকাৰ্য্য হই নাই। 

আ। কোথায় খুঁজিয়াছিলেন? 

দা। যেখানে দুর্গাচরণের মৃতদেহ পড়িয়াছিল; তাহার হাতে কাগজটুকু পাইবার পরই আমার বোধ হইল যে, নিশ্চয়ই উহার অবশিষ্ট অংশটুকু নিকটে কোথাও পড়িয়া থাকিবে। এই মনে করিয়া আমি জনকয়েক কনেষ্টবলকে উহার অন্বেষণে নিযুক্ত করি। কিন্তু অনেক চেষ্টা করিয়াও তাহারা বাহির করিতে পারিল না। তখন আমি স্বয়ং উহার যথেষ্ট অনুসন্ধান করিলাম কিন্তু আমিও সফল হইতে পারি নাই। 

আ। তাহাতে স্পষ্টই জানিতে পারা যাইতেছে যে, কোন লোক সেখানি লুকাইয়া রাখিয়াছে। আমার বোধ হয়, হত্যাকারী স্বয়ং এ কাজ করিয়াছে। সেই ওই অংশটুকু কোথায় সরাইয়া রাখিয়াছে। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

আমার কথা শুনিয়া দারোগা বাবুর বিশ্বাস হইল। তিনি বলিলেন “আপনার অনুমান সত্য হইতে পারে; কিন্তু সেখানি লুকাইবার বিশেষ প্রয়োজন কি, তাহা বুঝিতে পারিলাম না।” 

আমি ঈষৎ হাসিলাম। বলিলাম “সে যদি জানিত যে, পত্রখানির কিয়দংশ ভৃত্যের হস্তেই ছিল, তাহা হইলে কখনও এ কাজ করিত না। পত্রখানি এই হত্যাকাণ্ডের বিষয় লিখিত আছে। পাছে আর কেহ দেখিতে পায়, এই ভয়ে সে উহা হস্তগত করিয়াই কোন গোপনীয় স্থানে লুকাইয়া রাখিয়াছে। আর এক কথা, ওই কাগজ কোথা হইতে ভৃত্যের হাতে আসিল বলিতে পারেন?” 

দা। আজ্ঞে হ্যাঁ- সে সন্ধানও লইয়াছি। কাল দিনের বেলায় সে একখানি পত্র পায়। কাগজখানি নিশ্চয়ই সেই পত্রের অংশ। 

আ। ভৃত্যকে কে পত্র পাঠাইয়াছে? দূর্গাচরণ কোথা হইতে পত্র পাইল? 

দা। সে কথা বলিতে পারিলাম না। 

আ। ডাকে আসিয়াছিল কি? 

দা। এইরূপই শুনিয়াছিলাম, ঠিক বলিতে পারি না। 

আ। খামখানা কোথায়? 

দা। সম্ভবতঃ ভৃত্যই সেখানি নষ্ট করিয়া ফেলিয়াছে। 

আ। পিয়নের সহিত দেখা করিয়াছিলেন? 

দা। করিয়াছিলাম; কিন্তু সেও কিছু বলিতে পারিল না। সে বলিল, দুর্গাচরণের নামে একখানি পত্ৰ আসিয়াছিল, তাহাই জানে। কোথা হইতে যে সে পত্রখানি আসিয়াছিল, তাহা সে জানেও না, আর জিজ্ঞাসা করিতেও ইচ্ছা করে না। 

দারোগাবাবুকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না। একবার ত্রৈলোক্যবাবুর বাড়ীতে যাইবার ইচ্ছা হইল এবং সেই অভিপ্রায়ে আমি তাঁহাকে বলিলাম “বাহিরে আর কিছু জানিবার নাই; কিন্তু আমাকে একবার ভিতরে যাইতে হইবে।” 

আমার কথায় দারোগাবাবু সম্মত হইলেন এবং তখনই আমাকে সঙ্গে করিয়া ভিতরে লইয়া যাইতে ইচ্ছা করিলেন। আমরা বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিলাম। কিছুদূর যাইবামাত্র রজনীকান্ত আমাদের সম্মুখীন হইলেন। যখন প্রথমে দেখিয়াছিলাম, তখন তাঁহাকে ভাল করিয়া দেখিতে পাই নাই। এখন নিকটে আগমন করায় দেখিলাম, তাঁহার বয়স প্রায় বাইশ বৎসর। তাঁহাকে দেখিতে গৌরবর্ণ, হৃষ্টপুষ্ট ও বলিষ্ঠ। কিন্তু চালচলন দেখিয়া আমি আন্তরিক বিরক্ত হইলাম। তাঁহার প্রতি কথায় অহঙ্কার প্রকাশ পাইতেছিল। তাঁহার ন্যায় অহঙ্কারী লোক আর কখনও নয়ন গোচর হইয়াছে কি না সন্দেহ। 

আমাদিগকে ভিতরে প্রবেশ করিতে দেখিয়া তিনি আমার নিকট আসিলেন এবং বৃথা অহঙ্কারে স্ফীত হইয়া অবজ্ঞার হাসি হাসিতে হাসিতে জিজ্ঞাসা করিলেন “কি মহাশয়, এখনও কি করিতেছেন? ভাবিয়াছিলাম, আপনি শীঘ্রই একটা মীমাংসা করিয়া ফেলিবেন, কিন্তু এখন আর সে আশা নাই।” 

আমিও হাসিতে হাসিতে উত্তর করিলাম “আমিও মানুষ—দেবতা নহি। কিছু সময় না দিলে এই ভয়ানক জটিল রহস্য ভেদ করা সম্ভব নহে।” 

উচ্চহাসি হাসিয়া রজনীকান্ত উত্তর করিলেন “আরও সময়? রাত্রি পৌনে বারটার সময় এই ভয়ানক হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হয়, এখন রাত্রি প্রায় চারিটা। সময় যথেষ্ট দেওয়া হইয়াছে। এখনও বোধ হয়, কোন সূত্রও পান নাই। কেমন?” রজনীকান্তের কথায় আমার সর্ব্বশরীর যেন জ্বলিয়া উঠিল। কিন্তু মনের আগুন মনেই নির্ব্বাপিত করিয়া হাসিতে হাসিতে উত্তর করিলাম “যেমন করিয়াই হউক, সূত্র পাই ভাল, না পাই ভাল, আপনার কার্য্যের প্রয়োজন। শীঘ্রই এ রহস্য ভেদ করিব। ব্যস্ত হইলে চলিবে কেন?” 

আমার কথায় বাধা দিয়া রজনীকান্ত বলিয়া উঠিলেন “বলেন কি মহাশয়! ব্যস্ত হইব না? কোন অপরাধে আমাদের বহুকালের বিশ্বাসী চাকর খুন হইল? কে তাহাকে এমন করিয়া খুন করিল? যতক্ষণ না হত্যাকারী ধরা পড়িতেছে, যতক্ষণ না তাহার দেহ ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলিতেছে, ততক্ষণ আমার প্রাণের ক্ষোভ মিটিবে না। বিশেষ যখন আপনারা দুই দুইজন নামজাদা লোকে এখনও কোন সূত্র বাহির করিতে পারিলেন না, তখন যে আপনাদের দ্বারা আমাদের বিশেষ কোন উপকার হইবে, এমন বোধ হয় না।” 

দারোগাবাবু রাগান্বিত হইলেন। রজনীকান্তের কথা শুনিয়া তিনি চৈতন্য হারাইলেন, তাঁহার হিতাহিতজ্ঞান লুপ্ত হইল। রাগে কাঁপিতে কাঁপিতে তিনি রজনীকান্তের দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন। বলিলেন, “রজনীবাবু, এ আপনার অতি অন্যায় বিচার। আমরা নিশ্চিন্ত নহি, আর আমরা যে কোন সূত্র পাই নাই, তাহাও নহে।” 

দারোগাবাবুর দিকে চাহিয়া অতি গম্ভীরভাবে রজনীকান্ত জিজ্ঞাসা করিলেন “কি সূত্র পাইয়াছেন, বলুন?” দারোগাবাবুর বুদ্ধি তত প্রখর ছিল না। তিনি আপনার গৌরব বৃদ্ধির জন্য বলিয়া উঠিলেন, যদি আমরা জানিতে পারি—এই বলিয়াই দারোগা বাবু আমার দিকে চাহিলেন ও আমার ইসারায় তিনি মুখ বন্ধ করিলেন। 

আমি দারোগা বাবুকে বলিলাম “সদর দরজা ভগ্ন কেন, বুঝিতে পারিলাম না। যদি হত্যাকারী ভিতরে প্রবেশ করিত, তাহা হইলে বুঝিতাম, ভিতরে যাইবার জন্যই দরজা ভাঙ্গা হইয়াছে। কিন্তু বাহির হইতে বাটীর ভিতরে কোন লোকই প্রবেশ করে নাই দেখিতেছি।” 

দারোগাবাবু আমার কথায় আশ্চর্যান্বিত হইলেন, জিজ্ঞাসা করিলেন “কেমন করিয়া জানিলেন যে, বাহিরের লোক ভিতরে প্রবেশ করে নাই?” 

হাসিতে হাসিতে আমি উত্তর করিলাম “সে রকম পায়ের দাগ দেখিতে পাইতেছি না। আমি প্রথমেই আমার যন্ত্রের সাহায্যে ভাল করিয়া পরীক্ষা করিয়াছিলাম; পদচিহ্নগুলি উত্তমরূপে লক্ষ্য করিয়াছিলাম, তাহাতেই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি।” 

রজনীকান্ত এতক্ষণ আমাদের কথোপকথন শুনিতেছিলেন। তিনি আমার শেষ কথা শুনিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “তবে কেমন করিয়াই বা সে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল, আর তাহার দরজা ভাঙ্গিবারই বা কি প্রয়োজন ছিল?” আমি হাসি চাপিতে পারিলাম না। হাসিতে হাসিতে উত্তর করিলাম “আমি ত ওই কথাই জিজ্ঞাসা করিয়াছি। ওই কথাই ত আমি জানিতে চাই।” ‘ 

আমার কথা শুনিয়া এবং আমাকে হাসিতে দেখিয়া, তিন বিরক্ত হইলেন, রাগত ভাবে বলিলেন “যদি সকল কথাই আমরা বলিয়া দিব, তবে আপনাদের এখানে আসিবার প্রয়োজন কি ছিল?” 

রজনীকান্তের কথায় আমার সর্ব্বাঙ্গ জ্বলিয়া গেল। আমিও রাগিয়া উত্তর করিলাম “কথাটা আপনাকে জিজ্ঞাসা করা হয় নাই। আমি দারোগা বাবুর সহিত কথা কহিতেছিলাম এবং তাঁহাকেই ওই প্রশ্ন করা হইয়াছিল। আমাদিগের কার্য্যে আপনার কোনরূপ মন্তব্য প্রকাশ করা কর্ত্তব্য নহে। আমাদিগের কার্য্য আমরা ভাল বুঝি।” 

আমাকে রাগান্বিত দেখিয়া রজনীকান্ত অনেকটা শান্ত হইলেন। ত্রৈলোক্যবাবুও সেই সময় সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। 

আমি তখন হাসিলাম। বলিলাম “আপনি স্বচক্ষে কি দেখিয়াছেন বলুন?” 

ত্রৈ। আমি যখন কাৰ্য্য শেষ করিয়া জানালা বন্ধ করিতে যাই, ঠিক সেই সময় আমাদের বাড়ীর সম্মুখের মাঠ দিয়া দুইজন লোককে দৌড়িয়া পলায়ন করিতে দেখিতে পাই। লোক দুইজন চকিতের মধ্যে কোথায় যে অদৃশ্য হইয়া গেল, তাহা বুঝিতে পারিলাম না। নীচে চাহিয়া দেখি, রজনীকান্ত ও কয়েকজন লোক দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। আমার কেমন সন্দেহ হইল। আমি তখনই নীচে গেলাম, যাহা দেখিলাম, তাহাতে আমার অন্তরাত্মা শুকাইয়া গেল। তাহার পর পুত্রের মুখে সমস্ত কথা শুনিয়া স্থানীয় পুলিসে সংবাদ পাঠাইয়া দিলাম। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

ত্রৈলোক্যবাবুর কথা শেষ হইতে না হইতে চারিদিকে কাক কোকিল প্রভৃতি পক্ষী সকল প্রভাতী গান আরম্ভ করিল। পূর্ব্বাকাশ রক্তিমাভা ধারণ করিল। বুঝিলাম, প্রভাত হইয়াছে। 

ত্রৈলোক্যবাবুর কথায় আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। বলিলাম “আপনার ঘরে তখন নিশ্চয়ই আলোক জ্বলিতেছিল?” 

ত্রৈলোক্যবাবু বিরক্তির সহিত উত্তর করিলেন “হাঁ, আলোক জ্বলিতেছিল বই কি।” 

আ। আপনার পুত্রের গৃহে? 

ত্রৈ। সে ঘরেও আলো ছিল। 

আ। বাড়ীতে দুই দুইটী আলোক জ্বলিতেছিল, তবুও চোর প্রবেশ করিল, এ বড় আশ্চর্য্য কথা! তবে এ কথা স্থির জানিবেন যে, সেদিন সরোজ বাবুর বাড়ীতে যাহারা চুরি করিয়াছিল, তাহারাই আপনার ভৃত্যকে হত্যা করিয়াছে। 

আমার শেষ কথা শুনিয়া রজনীকান্ত ঘৃণার সহিত উত্তর করিলেন “অসম্ভব! ভুল ধারণা! আপনার কথা কথাই নয়।” 

আমি অতি বিনীতভাবে উত্তর করিলাম “তবে সে চুরির উদ্দেশ্য কি বলুন? শুনিয়াছি, কোন দামী জিনিষ চুরির যায় নাই। মূল্যবান জিনিসগুলি থাকিতে যে চোর দড়ির বাণ্ডিল, ভাঙ্গা বাতি, এই সকল অকিঞ্চিৎকর দ্রব্য লয়, সে চোর বড় সাধারণ চোর নয়!” 

আমার কথায় ত্রৈলোক্যবাবু অনেকটা শান্ত হইলেন। বলিলেন “আপনি যথার্থ বলিয়াছেন। আমরা সামান্য বুদ্ধির লোক, ওই সমস্ত রহস্যপূর্ণ কথা বুঝিব কেমন করিয়া? এখন বলুন, কি করিলে হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করিতে পারা যায়?” 

কিছুক্ষণ চিন্তার পর উত্তর করিলাম “এক কার্য্য করুন, তবে তাহাতে আপনার কিছু ব্যয় হইবে।” 

ত্রৈলোক্যবাবু আমাকে বাধা দিয়া উত্তর করিলেন “ব্যয় হইবে বলিলে কি করিব? আপনি খরচের জন্য সঙ্কুচিত হইবেন না। বলুন, আমাকে কি করিতে হইবে?” 

আ। আপনি সংবাদপত্রে পুরস্কার ঘোষণা করিয়া এই বিজ্ঞাপন প্রকাশ করুন—”যে ব্যক্তি সেই হত্যাকারীর সন্ধান দিতে পারিবেন, তাঁহাকে পাঁচ শত টাকা পুরস্কার দেওয়া যাইবে।” 

ত্রৈ। বেশ কথা, আপনি একটা মুসাবিদা করুন, আমি স্বাক্ষর করিয়া পাঠাইয়া দিতেছি। 

ত্রৈলোক্য বাবুর আদেশ পাইয়া আমি তখনই একখানা কাগজে ওই মৰ্ম্মে এক বিজ্ঞাপন লিখিলাম এবং স্বাক্ষরের জন্য ত্রৈলোক্যবাবুর হস্তে প্রদান করিলাম। 

তিনি কাগজখানি গ্রহণ করিয়া অতি মনোযোগের সহিত পাঠ করিলেন। পরে হাসিয়া বলিলেন “আর সব বেশ হইয়াছে বটে কিন্তু একটা ভয়ানক ভুল করিয়াছেন।” 

আমি তাঁহার মুখে আমার ভুলের কথা শুনিয়া আন্তরিক সন্তুষ্ট হইলাম, কিন্তু বাহ্যিক যেন অত্যন্ত আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “সে কি! ভুল কোথায় হইল? তবে তাড়াতাড়ি লিখিয়াছি, ভুল হওয়া আশ্চর্য্য নহে।” 

ত্রৈলোক্যবাবু গম্ভীর ভাবে বলিলেন, আপনি লিখিয়াছেন, রাত্রি একটা বাজিতে এক কোয়ার্টার পূর্ব্বে ত্রৈলোক্যনাথ—কিন্তু বাস্তবিক তাহা নহে। রাত্রি দুপুর বাজিতে এক কোয়ার্টার পূর্ব্বে; পৌনে বারটার সময়। 

ত্রৈলোক্যনাথের কথা শুনিয়া দারোগাবাবু আমার মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন। বোধ হইল, আমার এই সামান্য ভুলে তিনি অত্যন্ত বিস্মিত হইয়াছেন। রজনীকান্তও এ মহাসুযোগ ত্যাগ করিলেন না। তিনি আমায় উপহাস করিয়া নানা কথা কহিতে লাগিলেন 

ত্রৈলোক্যনাথ আমার হাত হইতে কলম লইয়া ভ্রম সংশোধন করিয়া দিলেন। পরে কাগজখানি আমায় দিয়া বলিলেন, “এই নিন্, যত শীঘ্র পারেন, ছাপাইয়া ফেলুন। পরে যে যে স্থানে পাঠাইলে ভাল হয়, সেই সেই স্থানে প্রেরণ করুন। আমাদের বিশ্বাসী ভৃত্যের হত্যাকারীকে যথোচিত শস্তি দিতে না পারিলে আমাদের মনস্কামনা সিদ্ধ হইবে না। ইহাতে যত টাকা ব্যয় হইবে, সমস্তই অকাতরে দিব।” 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

বেলা প্রায় সাতটা বাজিল। আকাশ বেশ পরিষ্কার ছিল। পূর্ব্বদিন যেমন সদাই মেঘাচ্ছন্ন ছিল, সেদিন আর মেঘের লেশমাত্র ছিল না। প্রবলবেগে উত্তরে বাতাস বহিতেছিল। একে সেই ভয়ানক শীত, তাহার উপর সেই কনকনে বাতাস, সকলকেই কাঁপিতে হইতেছে। 

ত্রৈলোক্যবাবুর হস্ত হইতে কাগজখানি গ্রহণ করিয়া অতি যত্নসহকারে আমি উহাকে পকেটে রাখিয়া দিলাম। পরে জিজ্ঞাসা করিলাম “দুর্গাচরণ কাল কত রাত্রে বিশ্রাম করিতে গিয়াছিল জানেন?” 

ত্রৈ। জানি–রাত্রি প্রায় এগারটার সময়। 

আ। প্রতিদিনই কি সে ওই সময়ে শুইতে যায়? 

ত্রৈ। সে কথা বলিতে পারি না। 

ত্রৈলোক্যনাথের শেষ কথায় বোধ হইল, তিনি ভয়ানক রাগান্বিত হইয়াছেন। কিন্তু সাহস করিয়া কোন কথা বলিতে পারিলেন না। আমি আর সে কথা উত্থাপন করিলাম না। পুনরায় ভাঙ্গা দরজাটি পরীক্ষা করিলাম। পরে ত্রৈলোক্যনাথকে বলিলাম “দেখুন, বাটালি কিম্বা ওই প্রকার অন্য কোন যন্ত্রের সাহায্যে দরজার হুড়কো খোলা হইয়াছে। কে এক কাজ করিল? আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, এত কষ্ট করিয়া যে দরজা খুলিল, সে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল না কেন?” 

কথাটা আমি যে তাঁহাকেই জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, তাহা নহে, শেষ কথাগুলি আমি দারোগাবাবুর দিকে চাহিয়াই বলিয়াছিলাম; সুতরাং ত্রৈলোক্যনাথ সে কথায় কোন উত্তর দিলেন না। কিন্তু তিনি যে আন্তরিক রাগান্বিত হইয়াছেন, তাহা তাঁহার মুখের ভঙ্গি দেখিয়াই বেশ জানিতে পারিয়াছিলাম। 

সে যাহা হউক, আমি আর কোন কথা না বলিয়া দারোগাবাবুকে জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনি কি ত্রৈলোক্যবাবু ও রজনীকান্তবাবুর শয়নগৃহগুলি দেখিয়াছিলেন?” 

দারোগাবাবু বিস্মিত হইলেন। বলিলেন “না!” 

আ। কেন? 

দা। দেখিবার কোন প্রয়োজন বুঝি নাই। 

আ। যেখান হইতে পিতাপুত্রে সেই হত্যাকারীকে পলায়ন করিতে দেখিয়াছিলেন, সে স্থান দুইটি একবার পরীক্ষা করিয়া দেখা অপ্রয়োজনীয় বিবেচনা করিলেন কেন? হয়ত সেখানে যাইলেই কোন নূতন সূত্র বাহির করিতে পারিতেন। ত্রৈলোক্যবাবু আর থাকিতে পারিলেন না। অবজ্ঞার হাসি হাসিয়া বলিলেন “আপনি যদি কেবল সময় নষ্ট করিতে আসিয়া থাকেন, তাহা হইলে এই পৰ্য্যন্তই ভাল। আর কিছু করিতে হইবে না। যদি ক্ষমতা না থাকে, স্বীকার করিয়া চলিয়া যান। এখানকার দারোগাবাবু যেমন, আপনিও সেইরূপ দেখিতেছি।” 

দারোগাবাবুও রাগান্বিত হইলেন। বলিলেন “আপনি বারম্বার আমাদিগকে এরূপ অপমানিত করিতেছেন কেন, বুঝিতে পারিতেছি না। আমরা আপনাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি না, বা আপনার কোন মতামত চাহিতেছি না। আমাদিগের কার্য্য আমরা জানি, এরূপ ভাবে আমাদিগের কার্য্যের প্রতিবন্ধকতা করিবেন না।” 

দারোগাবাবুর কথায় আমি হাসিয়া উঠিলাম। বলিলাম “ভাই, রাগের কাজ নয়। বিশেষতঃ যখন আমি বারবার ভুল করিতেছি, তখন উনিই বা আমাকে ছাড়িবেন কেন? এখন ও সকল কথায় প্রয়োজন নাই। যাহার জন্য রাত্রি জাগরণ করিয়া রহিয়াছি, যাহার জন্য এতখানি বেলা পৰ্য্যন্ত মুখে জল দিই নাই, আগে সেই কাজ করা যাউক। আমি একবার শয়নগৃহ দুইটি না দেখিয়া নিশ্চিত হইতে পারিতেছি না।” 

আমার কথায় রজনীকান্ত অট্টহাস্য করিলেন। কিন্তু তাঁহার পিতা কথঞ্চিৎ শান্তমূর্তি ধারণ করিয়া বলিলেন “যদি একান্তই না দেখিলে নয়, তবে আসুন।” 

ত্রৈলোক্যনাথ এই বলিয়া আমাদের অগ্রে অগ্রে চলিলেন, আমি ও দারোগাবাবু তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইতে লাগিলাম। রজনীকান্ত সকলের শেষে চলিলেন। 

ত্রৈলোক্যবাবুর শয়নগৃহ দ্বিতলে-ঘরে কোন স্ত্রীলোক ছিল না। অগ্রে তিনি তথায় প্রবেশ করিলেন। আমরা তাঁহার অনুসরণ করিলাম। 

ত্রৈলোক্যবাবুর শয়নগৃহটি নিতান্ত ক্ষুদ্র নয়; দৈর্ঘ্যে প্রায় দশ হাত, প্রস্থেও আট হাতের কম নহে। ঘরের মধ্যে তিনটা দেরাজ, একটা আলমারি, দুইটা লৌহের সিন্দুক ছিল। দেওয়ালে খানকয়েক ভাল ভাল ছবি, তিনটি দেয়ালগিরী ও একখানি প্রকাণ্ড আয়না ছিল। 

ঘরে প্রবেশ করিয়া ত্রৈলোক্যবাবু আমাকে একটি জানালার নিকট হইয়া গেলেন। বলিলেন, সেই স্থান হইতে তিনি হত্যাকারীকে দৌড়িয়া পলায়ন করিতে দেখিয়াছেন। আমি কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়াইয়া রহিলাম, একবার চারিদিক ভাল করিয়া দেখিলাম, পরে বলিলাম “এইবার রজনীবাবুর শয়নগৃহে চলুন।” 

ত্রৈলোক্যনাথ সেই গৃহ হইতে বহির্গত হইলেন। তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে আমরাও বাহির হইলাম। 

রজনীকান্তের শয়নগৃহ তাঁহার পিতার গৃহের কিছুদূরে ছিল। ত্রৈলোক্যনাথ আমাদিগকে লইয়া সেই গৃহে প্রবেশ করিলেন। ভিতরে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, পুত্রের ঘরখানি পিতার গৃহ অপেক্ষা আরও বড় ও উহার সংলগ্ন একটি চোরা কুঠরি আছে বুঝিতে পারিলাম। 

ঘরের এক পার্শ্বে একখানা প্রকাণ্ড পালঙ্ক, তাহার উপর দুগ্ধফেননিভ এক অতি সুকোমল শয্যা। দেওয়াগুলিতে নানাপ্রকার দেব-দেবীর ছবি। ঘরের মধ্যে একটা বড় গোল টেবিল—তাহার পার্শ্বে আর একটা ছোট টেবিল। 

আমি এ ঘরটি উত্তমরূপে দেখিয়া সেই চোরা কুঠরির ভিতর প্রবেশ করিলাম। ওই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিবার কালীন পিতা পুত্রে আমাকে বিশেষ করিয়া নিষেধ করিলেন, আমি তাঁহাদিগের নিষেধ না শুনিয়া উহার ভিতর প্রবেশ করিলাম, ও সেই কুঠরি অনুসন্ধান করিয়া যাহা প্রাপ্ত হইলাম, তাহার নিমিত্ত পিতা ও পুত্রকে সেই সময়ে গ্রেপ্তার করিলাম। ওই কুঠরির ভিতর আমি যে কি প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, তাহা পাঠকগণ সময়ে জানিতে পারিবেন। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

পিতা পুত্রে বন্দী হইবার পর আমি সকলের সমক্ষে একখানি ছেঁড়া কাগজ বাহির করিলাম। দারোগাবাবু প্রথমে কিছুই বুঝিতে পারিলেন না, আমার হস্তে একখানা ছেঁড়া কাগজ দেখিয়া আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলেন। আমি তাঁহার মনোভাব বুঝিতে পারিয়া বলিলাম “কাগজখানি সেই চিঠির অবশিষ্ট অংশ।” 

আমার কথা শুনিয়া দারোগাবাবু স্তম্ভিত হইলেন। বলিলেন “সত্য না কি, কাগজখানি পাইলেন কোথা?” আমি হাসিয়া উত্তর করিলাম “যেখানে কাগজখানি পাইব আশা করিয়াছিলাম। আমি এখনই সমস্ত কথা প্রকাশ করিতেছি।” 

দারোগাবাবু তখন অতি বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন “কোন্ সূত্র ধরিয়া, কোন্ উপায় অবলম্বন করিয়া, এই কার্য্যে সফল হইলেন, কিছুই বুঝিতে পারিলাম না।”

আমি হাসিতে হাসিতে উত্তর করিলাম “সমস্তই বলিতেছি, কিন্তু আপাততঃ বন্দীদ্বয়কে দুই একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি।” 

এই বলিয়া আমি ত্রৈলোক্যবাবুর দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “নীরদা কে?” 

আমার কথা শুনিয়া আমার সমভিব্যাহারী দারোগাবাবু স্তম্ভিত হইলেন, কিন্তু সাহস করিয়া আমাকে কোন প্রশ্ন করিলেন না। ত্রৈলোক্যবাবু আমার কথায় লজ্জায় মুখ অবনত করিলেন। তিনিও কোন উত্তর করিলেন না। 

আমি তাঁহাকে তদবস্থ দেখিয়া পুনরায় ওই কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। ত্রৈলোক্যবাবু তখন উত্তর করিলেন “যখন আপনি সমস্ত ব্যাপার বুঝিতে পারিয়াছেন, তখন আর আমায় প্রশ্ন করিতেছেন কেন?” 

আমি হাসিয়া বলিলাম “না মহাশয়, সত্যই আমি নীরদার কথা জানি না। যদি জানিতাম, তাহা হইলে এত লোকের সাক্ষাতে আপনাকে এ কথা জিজ্ঞাসা করিতাম না। আপনার কোন চিন্তা নাই, আমার সমস্ত লোকই বিশ্বাসী, ইহাদের দ্বারা আপনার কোনরূপ অনিষ্টের আশঙ্কা নাই। বিশেষতঃ, যখন আপনি শীঘ্রই ইহলীলা ত্যাগ করিবেন, তখন আমার জিজ্ঞাস্য বিষয় বলিতে দোষ কি?” 

ত্রৈ। নীরদা একটি ভদ্রমহিলা। 

আ। তাঁহার নিবাস কোথায়? 

ত্রৈ। আমাদেরই পাড়ায়- আমার বাড়ী হইতে পাঁচ ছয়খানি বাড়ীর পর নীরদার বাড়ী। 

আ। নীরদা সধবা কি বিধবা? 

ত্রৈ। বিধবা। 

আ। তাঁহার সহিত দুর্গাচরণের সম্বন্ধ কি? যে পত্রের কথা মত আপনার ভৃত্য রাত্রি দুপুরের কিছু পূর্ব্বে এ বাড়ীর সদর দরজায় আসিয়াছিল, সেই পত্র পাঠ করিয়া দেখিলাম, আপনার ভৃত্য নীরদার সংবাদ জানিতে ব্যস্ত। 

ত্রৈ। আপনার অনুমান সত্য। নীরদার সহিত দুর্গাচরণের অবৈধ প্রণয় ছিল। 

আ। কেবল দুর্গাচরণেরই সহিত যে প্রণয় ছিল তাহা বোধ হয় না। আপনিও নীরদাকে অত্যন্ত ভালবাসিতেন, পত্র পাঠে তাহাও জানিতে পারিয়াছি। কেমন, আমার এ অনুমান সত্য কি না? 

ত্রৈলোক্যনাথ কোন উত্তর করিলেন না। কিন্তু তাঁহার মুখের ভাব দেখিয়া সকলেরই প্রতীয়মান হইল যে, তিনিও নীরদাকে ভালবাসিতেন। 

সে যাহা হউক, ত্রৈলোক্যবাবু ও তাঁহার পুত্রকে আর কোন প্রশ্ন না করিয়া একখানি গাড়িভাড়া করিয়া আনিতে বলিলাম। গাড়ি আনীত হইলে বন্দীদ্বয়কে তাহাতে আরোহণ করাইয়া থানায় প্রেরণ করিলাম। 

দারোগাবাবু তখন আমাকে সমস্ত ব্যাপার প্রকাশ করিতে অনুরোধ করিলেন। আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনার সহিত সরোজবাবুর আলাপ আছে কি?” 

দা। হাঁ, আছে বৈ কি। কিন্তু আমি লজ্জায় তাঁহার নিকট মুখ দেখাইতে পারিতেছি না। 

আ। কেন? 

দা। তাঁহার বাড়ীতে যে চুরি হইয়াছিল, এখনও তাহার কোন কিনারা করিতে পারিলাম না, কোন্ লজ্জায় তাঁহার নিকট মুখ দেখাইব? 

আ। কেন? সে চোর ত ধরা পড়িয়াছে। 

দারোগাবাবু স্তম্ভিত হইলেন। বলিলেন “সে কি! কবে ধরা পড়িল? কোথায়, কাহার দ্বারা চোর ধৃত হইল?” আমি হাসিয়া উত্তর করিলাম “সমস্তই বলিতেছি। কিন্তু অগ্রে আমার দুই একটা প্রশ্নের উত্তর দিন। সরোজবাবুর সহিত ত্রৈলোক্যবাবুর কোন সম্বন্ধ আছে কি না? “ 

দা। বোধ হয় কোন সম্বন্ধ আছে। 

আ। বোধ হয় কেন? 

দা। বহুদিন হইতে উভয়ের মধ্যে মোকদ্দমা চলিতেছে। 

আ। তবে একবার সরোজবাবুকে এখানে ডাকাইয়া পাঠান। তিনি এখানে আসিলে, তাঁহার সমক্ষে এই অদ্ভুত রহস্য ভেদ করিব। 

দারোগা হাসিয়া বলিলেন “এখানে আর কাহাকেও দেখিতে পাইতেছি না। আপনি থানায় যান, আমি সরোজবাবুকে লইয়া শীঘ্রই সেখানে যাইতেছি।” 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

আমি যখন থানায় ফিরিয়া আসিলাম, তখন দশটা বাজিয়া গিয়াছে। একে পূৰ্ব্বরাত্রে ভালরূপ নিদ্রা হয় নাই, তাহার উপর সেদিন বেলা দশটা পর্যন্ত স্নানাহার না হওয়ায়, আমার শরীর অতিশয় দুর্ব্বল হইয়া পড়িয়াছিল। 

থানায় ফিরিয়া আসিয়া অগ্রে স্নানাহার সমাপন করিলাম। পরে আমার অফিস-ঘরে দারোগাবাবুর জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। 

বেলা প্রায় বারটার সময় একজন যুবককে সঙ্গে লইয়া দারোগাবাবু আমার নিকট উপস্থিত হইলেন; এবং সমভিব্যাহারী বাবুকে প্রদর্শন করিয়া বলিলেন “ইঁহারই নাম সরোজবাবু।” 

সরোজ বাবুর সহিত আমার পূর্ব্বে পরিচয় ছিল না। আমি তাঁহাকে হাসিতে হাসিতে কহিলাম “মহাশয়! এতদিন পরে চোর ধরা পড়িয়াছে।” 

সরোজবাবু স্তম্ভিত হইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “চোর ধরা পড়িয়াছে?” 

আ। হাঁ, তাঁহারা হাজতে রহিয়াছেন। 

স। তাঁহারা? চোরকে এত সম্মান কেন? 

আ। তাঁহারা যে সে চোর নহে সরোজবাবু! তাঁহারা নামজাদা লোক। অথচ চুরি, জাল, হত্যা প্রভৃতি ভয়ানক কার্য্য তাঁহাদের দৈনিক কার্য্যের মধ্যে পরিগণিত। 

দরোগাবাবু আর স্থির থাকিতে পারিলেন না। বলিলেন “এইবার সকল কথা খুলিয়া বলুন। কি করিয়া এই দুইটি ভয়ানক রহস্য ভেদ করিলেন, তাহা জানিবার জন্য আমার অত্যন্ত কৌতূহল জন্মিয়াছে।” 

আমি হাসিতে হাসিতে উত্তর করিলাম “যখনই এই ভয়ানক হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করিবার ভার আমার হস্তে পতিত হইল, তখনই আমি আপনার নিকট আসিয়া সমস্ত কথা শুনিলাম। পত্রাংশ আমাকে দিয়াছিলেন, সেখানি বিশেষ করিয়া পরীক্ষা করিলাম। দেখিলাম, উহা দুইজনের লেখা।” 

এই বলিয়া আমি সেই ছেঁড়া কাগজখানি দারোগাবাবু ও সরোজকুমারকে দেখাইলাম। তাঁহার আমার কথায় সায় দিলেন। বলিলেন “আপনার অনুমান সত্য।” 

আমি বলিলাম “দুই হাতের লেখা হইলেও সেই দুইজন যে একই পরিবারভুক্ত এবং তাহাদের একজন বৃদ্ধ ও অপরজন যুবক, তাহা বেশ বুঝিতে পারিলাম। আপনারা আশ্চর্যান্বিত হইতে পারেন; কিন্তু উভয়েরই ল গুলি এইরূপ। পুরাকালে লোকেরা ওইরূপেই ল লিখিত।” 

দারোগাবাবু তখন জিজ্ঞাসা করিলেন “লেখা দেখিয়া বৃদ্ধ কি যুবক জানিলেন কিরূপে?” 

আ। বৃদ্ধের লেখার জোর নাই, আলল্গা কলম ধরিয়া লেখা; যুবকের লেখার জোর আছে, যুবকেরা সচরাচর কলমে জোর দিয়া লিখিয়া থাকেন। সে যাহা হউক, যখন আমি এই সিদ্ধান্ত করিলাম, তখন ভাবিলাম, এরূপ দুইজন লোক কোথায়। মনে হইল, ত্রৈলোক্যবাবু ও তাঁহার গুণধর পুত্র রজনীকান্ত। 

দা। তাঁহারা আপনাদের বিশ্বাসী চাকরকে হত্যা করিলেন কেন? 

আ। সমস্তই জানিতে পারিবেন। যখন ত্রৈলোক্যবাবু ও তাঁহার পুত্রের উপর সন্দেহ হইল, তখন আমি তাঁহার বাড়ীর ভিতর দেখিতে ইচ্ছা করিলাম, কেন না, তাঁহারা উভয়েই হত্যাকারীকে পলায়ন করিতে দেখিয়াছিলেন। যেখানে তাঁহারা হত্যাকারীকে দেখিয়াছিলেন, আমি অগ্রে সেই স্থানে গিয়া উত্তমরূপে পরীক্ষা করিলাম, কিন্তু তথায় কাহারও পদচিহ্ন দেখিতে পাইলাম না। যদি হত্যাকারী বাস্তবিকই সেই পথে পলায়ন করিত, তাহা হইলে সেখানে নিশ্চয়ই পদচিহ্ন দেখিতে পাইতাম। সুতরাং ত্রৈলোক্যবাবু ও তাঁহার পুত্র যে মিথ্যা কথা বলিয়াছিলেন, তাহা বুঝিতে পারিলাম। আমার সন্দেহ আরও বাড়ীয়া গেল। তাহার পর আপনার স্মরণ আছে বোধ হয়, আমি পূৰ্ব্বেই আপনাকে বলিয়াছিলাম যে, হত্যকারীর নিকট অবশিষ্ট পত্রাংশ আছে। 

দা। হাঁ, বেশ স্মরণ আছে। 

আ। যখন ত্রৈলোক্যবাবু ও তাঁহার পুত্রের উপর সন্দেহ হইল, তখন আমি ভাবিলাম, উহাদেরই নিকটে সেই পত্রাংশ আছে। এই ভাবিয়া তাঁহাদের শয়নগৃহ দেখিবার অছিলা করিলাম। এই সময়ে আর একটি ব্যাপার হইল। রজনীকান্তের কথায় আপনি বলিতে যাইতেছিলেন যে, ওই পত্রাংশ যাহার নিকট আছে, সেই হত্যাকারী; এ কথা শুনিলে পাছে তাহারা পিতাপুত্রে সাবধান হয়, এই ভাবিয়া আমি আপনাকে ইসারা করিয়া অপর কথা পাড়িলাম। 

দারোগাবাবু আমার কথায় স্তম্ভিত হইলেন। 

আমি হাসিতে হাসিতে বলিলাম “তাহার পর হস্তাক্ষর মিলাইবার প্রয়োজন হইল। কি করিয়া ত্রৈলোক্যবাবুর হাতের লেখা দেখিতে পাইব, কি উপায় অবলম্বন করিলে আমি তাঁহাকে আমার সমক্ষে লেখাইতে পারিব, এইরূপ চিন্তা করিতে লাগিলাম। হঠাৎ আমার মনে এক উপায় উদ্ভাবিত হইল, আমি ত্রৈলোক্য বাবুকে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিতে অনুরোধ করিলাম। তিনি আমার মুসাবিদা করিতে বলিলেন। আমারও উদ্দেশ্য সফল হইল। আমি ভুল করিয়া একটা বাজিতে এক কোয়ার্টারের মধ্যে লিখিলাম।” 

আমায় বাধা দিয়া দারোগবাবু বলিয়া উঠিলেন “তবে কি আপনি ইচ্ছা করিয়া সেই ভুল করিয়াছিলেন?” 

আমি হাসিয়া উত্তর করিলাম, “তবে কি আপনি আমায় এতই মূর্খ মনে করেন যে, যাহা একবার শুনিব, তাহা ভুলিয়া যাইব? না দারোগাবাবু, আমার স্মরণশক্তি এত ক্ষীণ নহে। ইচ্ছা করিয়াই ভুলটি করিয়াছিলাম। ত্রৈলোক্যবাবু স্বহস্তে সেই ভ্রম সংশোধন করিলেন, আমারও উদ্দেশ্য সফল হইল। যে ছেঁড়া কাগজখানি আপনার নিকট হইতে লইয়াছিলাম, তাহাতেও ওই কথাগুলি লেখা ছিল। আমি দুই লেখা মিলাইলাম। দেখিলাম ওই লেখার মধ্যে যে যে অক্ষর বৃদ্ধে লেখা ভাবিয়াছিলাম, তাহার সহিত ত্রৈলোক্যবাবুর সেই সেই অক্ষরের বেশ সামঞ্জস্য আছে। বুঝিলাম, পত্রখানি পিতা পুত্রেরই লেখা। তাহার পর ভাবিলাম, সেই ছেঁড়া কাগজখানির অবশিষ্ট অংশ না পাইলে কিছুই করিতে পারিব না। কি করিয়া সেখানি পাইতে পারিব? অনেকক্ষণ ধরিয়া এই চিন্তা করিলাম। শেষে ত্রৈলোক্যবাবু ও তাঁহার পুত্রের শয়নগৃহ দেখিবার ইচ্ছা করিলাম। ভাবিলাম, সেই দুইটি ঘরের মধ্যে কোথাও না কোথাও কাগজখানির অংশ লুক্কায়িত আছে। সুতরাং তাঁহার ঘরে প্রবেশ করিলাম, কিন্তু সেখানে কোনরূপ সুবিধা করিতে পারিলাম না। সে ঘরে কাগজখানি ছিল না। তাহার পর আপনাদিগকে লইয়া রজনীকান্তের শয়নঘরে প্রবেশ করিলাম। 

দারোগাবাবু আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলেন। 

আমি বলিলাম “যখনই আমি রজনীকান্তের ঘরে প্রবেশ করিলাম, তখনই দূর হইতে উহার মধ্যে একটা চোরা কুঠরি দেখিতে পাইলাম। আমার কেমন সন্দেহ হইল; ভিতরে প্রবেশ করিলাম। দুইটি জামা ও খানকয়েক কাপড় রহিয়াছে দেখিলাম। সেগুলি পরীক্ষা করিবার ইচ্ছা হইল। বোধ হইল, জামার পকেটেই কাগজখানি আছে। সুতরাং আমি সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া অনুসন্ধান করিতেই সেই কাগজের অর্দ্ধাংশ আমার হস্তগত হইল। 

দা। দুর্গাচরণকে হত্যা করিবার কারণ কি? কি জন্যই বা তাঁহারা বিশ্বাসী ভৃত্যকে খুন করিলেন? আমি ত কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। 

আ। এ কথা এখনও বুঝিতে পারিলেন না? 

দা। না। 

আ। সরোজবাবুর বাড়ীতে সেদিন যাহারা চুরি করিয়াছিল, তাহারাই দুর্গাচরণকে খুন করিয়াছে। ত্রৈলোক্যবাবুর সহিত তাঁহার মোকদ্দমা চলিতেছে। একখানি আবশ্যকীয় দলিল চুরি করিবার জন্যই ত্রৈলোক্যবাবু পুত্রকে সঙ্গে লইয়া সরোজবাবুর বাড়ীতে চুরি করিতে আসিয়াছিলেন। প্রকৃত চোর হইলে, এত বহুমুল্য দ্রব্যগুলি না লইয়া সেই সকল সামান্য দ্রব্য চুরি যাইবে কেন? দুইজন ভদ্রলোকের চুরি করা অসম্ভব জানিয়া ত্রৈলোক্যবাবু তাঁহার বিশ্বাসী চাকর দুর্গাচরণকে সঙ্গে লইয়াছিলেন। পাছে সেই চাকরের দ্বারা ভবিষ্যতে এই কথা প্রকাশিত হয়, এই ভয়েই দুর্গাচরণ অকালে মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছে। 

দা। দুর্গাচরণ তাঁহাদের বিশ্বাসী ভৃত্য, তাহাকে খুন না করিয়া অন্য কোন উপায়ে ত বশীভূত করিতে পারিতেন?

আ। না—পারিতেন না। দুর্গাচরণ ইতিমধ্যেই তাঁহাদের উপর প্রভূত্ব করিতে আরম্ভ করিয়াছিল। 

দা। কিসে জানিতে পারিলেন? 

আ। সেই চিঠিখানি পাঠ করিয়া সমস্তই বুঝিতে পারিয়াছিলাম, তাহার উপর ত্রৈলোক্যবাবুকেও জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। উত্তরে তিনি যাহা বলিলেন, আমি পূৰ্ব্বেই তাহা অনুমান করিয়াছিলাম। 

দা। চিঠিখানিতে কি লেখা আছে? যদি বিরক্ত না হন, তাহা হইলে দয়া করিয়া বলুন? 

দারোগাবাবুর কথা শুনিয়া আমি হাসিয়া উঠিলাম। বলিলাম “যদি বিরক্ত হইব, তবে স্ব-ইচ্ছায় এ সকল কথা বলিব কেন? চিঠিখানি পাঠ করিয়া জানিতে পারি যে, দুর্গাচরণ নীরদা নাম্নী কোন ভদ্রমহিলার সহিত অবৈধ প্রেমে আবদ্ধ। অনেকদিন তাহার সহিত সাক্ষাৎ না হওয়ায়, সে নীরদাকে দেখিবার জন্য অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়া পড়ে, এমন কি, সকলের সাক্ষাতে তাহাদের বাড়ী গিয়া উৎপাত করিতে আরম্ভ করে। 

আমার কথা শেষ হইতে না হইতে সরোজবাবু বলিয়া উঠিলেন “নীরদা? সে যে আমাদেরই বাড়ীর নিকটে থাকে? শুনিয়াছি, তাহার চরিত্রদোষও আছে।” 

আমি হাসিতে হাসিতে বলিলাম “আপনি যথার্থ অনুমান করিয়াছেন। সেই নীরদাই দুর্গাচরণের প্রণয়িনী। কেবল তাহাই নহে; ত্রৈলোক্যবাবুও তাহার প্রণয়াকাঙ্ক্ষী; তবে নীরদা দুর্গাচরণকেই আন্তরিক ভালোবাসে এবং তাহাকে পাইবার জন্যই ব্যস্ত। দুর্গাচরণের উৎপাতে উৎপীড়িত হইয়া নীরদার অভিভাবক তাহাকে বাড়ীতেই লুকাইয়া রাখিয়াছেন। বাহিরে প্রকাশ করিয়াছেন যে, নীরদার শ্বশুর তাহাকে তাহাদের বাড়ীতে লইয়া গিয়াছেন।” 

আমাকে বাধা দিয়া দারোগাবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন “ত্রৈলোক্যবাবু দুর্গাচরণকে ওই প্রকার উৎপাত করিতে নিষেধ করেন নাই কেন?” 

আ। অনেকবার নিষেধ করিয়াছিলেন, কিন্তু দুর্গাচরণ সে কথায় কর্ণপাতও করে নাই; বরং চুরির কথা প্রকাশ করিয়া দিবে বলিয়া ভয় দেখাইয়াছিল। 

দা। নীরদার অভিভাবক পুলিসে এ সংবাদ দেয় নাই কেন? 

আ। নীরদা ভদ্রঘরের কন্যা, তাহার শ্বশুরও বড় লোক। এ অবস্থায় তিনি যদি দুর্গাচরণের দৌরাত্ম্যের কথা প্রকাশ করিতেন, তাহা হইলে নীরদার শ্বশুর ও তাহার অভিভাবকের মুখ দেখান ভার হইত। 

দা। পত্রে এমন কি ছিল, যাহাতে দুর্গাচরণ প্রলোভিত হইল? 

আ। পত্রে লেখা ছিল, যদি দুর্গাচরণ নীরদাকে দেখিতে ইচ্ছা করে, তাহা হইলে সেদিন রাত্রি দুপুর বাজিতে এক কোয়ার্টারের সময় দরজা খুলিয়া অপেক্ষা করিবে। দুর্গাচরণ সেই পত্রের কথামত সেই সময়ে দরজা খুলিয়া অপেক্ষা করিতেছিল, এমন সময়ে রজনীকান্ত সর্ব্বাঙ্গ আবৃত করিয়া তাহার নিকট গমন করেন এবং তাহার বক্ষ লক্ষ্য করিয়া গুলি করেন। 

দা। নিকট হইতে গুলি করিয়াছিলেন, আপনি জানিলেন কিরূপে? 

আ। নিকট হইতে গুলি না করিলে দুর্গাচরণের কাপড়ে বারুদের দাগ লাগিবে কেন? দূর হইতে বন্দুক ছুড়িলে বারুদের দাগ দেখা যাইবে কেন? 

দারোগাবাবু সমস্ত কথা শুনিয়া অতীব বিস্মিত হইলেন। বলিলেন, “পরিচারক দুর্গাচরণের হস্তে ওই পত্রখানি আসিল কি প্রকারে?” উত্তরে আমি কহিলাম “কোনরূপ উপায়ে উহা দুর্গাচরণের হস্তে প্রদান করা হইয়াছিল।” 

আমি তখন সরোজবাবুকে জিজ্ঞাসা করিলাম “সরোজবাবু! যে দলিলখানির জন্য আপনার বাড়ীতে চুরি হইয়াছিল, সে দলিলখানি কোথায়?” 

সরোজবাবু হাসিয়া উত্তর করিলেন “ সেখানি এমন স্থানে রাখিয়াছি যে, ত্রৈলোক্যবাবু সহস্র চেষ্টা করিলেও তাহা বাহির করিতে পারিতেন না। আমার উকীল মহাশয়ের নিকটই দলিলখানি আছে।” 

আমি হাসিতে হাসিতে বলিলাম “অতি উত্তম কার্য্যই করিয়াছেন।” 

স। ত্রৈলোক্যবাবু যে দলিলখানি আদায় করিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিবেন, তাহা পূর্ব্বেই জানিতে পারিয়াছিলাম। সেই জন্যই, উহাকে বাড়ীতে না রাখিয়া, উকীলবাবুর বাড়ীতে রাখা হইয়াছিল। 

আ। কেমন করিয়া জানিলেন যে, ত্রৈলোক্যবাবু দলিলখানি আদায়ের চেষ্টা করিবেন? 

স। তিনি মধ্যে মধ্যে ওই দলিলের জন্য আমার নিকট লোক পাঠাইতেন। কিন্তু তাহারা এরূপভাবে আসিত যে, কেহই জানিতে পারিত না, তাহারা ত্রৈলোক্যবাবুর নিকট হইতে আসিয়াছিল; পূর্ব্বে আমিও বুঝিতে পারি নাই। শেষে একজনকে কিছু অর্থ দিয়া, তাহার উদ্দেশ্য জানিয়া লইলাম। কিন্তু একটি কথা আমি এখনও বুঝিতে পারি নাই। রজনীকান্ত স্বহস্তে দুর্গাচরণকে খুন না করিয়া অপর কাহারও দ্বারা উহাকে হত্যা করিল না কেন? 

আমি হাসিয়া বলিলাম “তাহা হইলে ত্রৈলোক্যবাবু ও তাঁহার পুত্রকে সেই হত্যাকারীর বশীভূত হইতে হইত। যে কারণে দুর্গাচরণ হত্যা হইল, তাহার কোন প্রতিবিধান হইত না। একজনের হস্ত হইতে মুক্ত হইয়া অপরের হস্তে পড়িতে হইত।” 

দারোগাবাবু ও সরোজকুমার আমার কথায় সন্তুষ্ট হইলেন এবং আমার নিকট বিদায় লইয়া স্ব স্ব আলয়ে গমন করিলেন। 

পিতা পুত্র উভয়েই ক্রমে সমস্ত কথা স্বীকার করিলেন। সাক্ষীও পাওয়া গেল, রজনীকান্তের ঘর হইতে বন্দুকও বাহির হইল। বিচারে পিতা পুত্র দ্বীপান্তরিত হইলেন। 

সম্পূর্ণ 

[ আষাঢ়, ১৩১৫ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *