হত্যা-হাহাকারে

হত্যা-হাহাকারে

কলকাতা হঠাৎ পাগলা হয়ে গিয়েছে৷ এক-একজন মানুষ যে পাগল হয়ে যায় এ কথা জানো তোমরা সবাই৷ কিন্তু একটা গোটা শহর হঠাৎ পাগলা হয়ে গিয়েছে শুনলে তোমাদের মনে খটকা লাগতে পারে নিশ্চয়ই৷

তবু কথাটা সত্য৷ ওই শোনো৷ হাজার হাজার কন্ঠে আকাশ-কাঁপানো ওই বিকট চিৎকার শোনো৷ ‘জয় হিন্দ!’ ‘বন্দে মাতরম!’ ‘আল্লা হো আকবর!’

ওই দেখো৷ নিকটে, সুদূরে বাড়ির পর বাড়ি জুড়ে দাউদাউ করে জ্বলছে সমুজ্জ্বল রক্তের মতো রাঙা টুকটুকে অগ্নিশিখার পর অগ্নিশিখা এবং অতিকায় কৃষ্ণ অজগরের মতো ধূম্রকুণ্ডলীর পর ধূম্রকুণ্ডলী সারে সারে উপরে উঠে যাচ্ছে যেন ছোবল মারতে বিপুল শূন্যের বুকে৷

শুনতে পাচ্ছ না সুতীব্র আর্তধ্বনি? শুনতে পাচ্ছ না ঘন ঘন বন্দুক ও বোমার ভয়াল গর্জন এবং পলাতকদের অতি দ্রুত পদশব্দ?

হ্যাঁ, কলকাতা শহর হঠাৎ পাগলা হয়ে গিয়েছে এবং অরণ্যচারী ব্যাঘ্র ও সিংহের নৃশংস আত্মা এসে আজ দখল করেছে নগরবাসী মানুষদের বক্ষ৷

অধিকতর ভয়াবহ রাত্রি নেমে এল শহরের ভিতরে, দিকে দিকে দুলিয়ে দিয়ে গাঢ় অন্ধকারের যবনিকা৷ পথে পথে গ্যাসপোস্টগুলোর আলোক চক্ষু আজ অন্ধ, ট্রাম, বাস ও ট্যাক্সির চলাচল বন্ধ, একেবারে বোবা ফেরিওয়ালাদের কন্ঠ, দোকানদাররা দোকানের ঝাঁপ তুলে দিয়ে পলায়ন করছে, সাধারণ পথিকরা আত্মগোপন করেছে আপন আপন ঘর-বাড়ির অন্তরালে এবং প্রত্যেক বাড়ির সদর দরজা ভিতর থেকে অর্গলবদ্ধ৷ কিন্তু তবু মৌন হল না কলকাতার মুখর পাগলামি, রাত্রির অন্ধকারকে দীর্ণ-বিদীর্ণ করে চতুর্দিক থেকে জেগে উঠছে তার প্রচণ্ড ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি! রাজপথ যেখানে জনশূন্য সেখানেও সেইসব বন্য চিৎকার শোনা যাচ্ছে, বদ্ধদ্বার বাড়িগুলোর ছাদের থেকে৷ মানুষদের সঙ্গে সঙ্গে উন্মত্ত হয়ে চিৎকার করছে হাজার হাজার শঙ্খও৷

‘জয় হিন্দ!’ ‘বন্দে মাতরম!’ ‘আল্লা হো আকবর!’

মানিক বললে, ‘জয়ন্ত আজ রাত্রে দেখছি ঘুমের দফা গয়া৷’

জয়ন্ত বললে, ‘সে কথা আর বলতে৷ কিন্তু হিন্দুরা কি নির্বোধ?’

-‘কেন?’

-‘তারা বন্দে মাতরম বলে চিৎকার করছে৷ কিন্তু বন্দে মাতরম কি নরহত্যার, ভ্রাতৃহত্যার মন্ত্র?’

-‘মুসলমানদের সম্বন্ধেও তুমি ওই প্রশ্ন করতে পারো৷ আল্লা হো আকবর বলতে কি বোঝায় হিন্দুর মুণ্ডচ্ছেদ করা?’

-‘ঠিক বলেছ মানিক৷ আজ একসঙ্গে হিন্দু আর মুসলমানের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে৷’

-‘হুঁ৷ আর সারারাত জেগে এইসব চিৎকার শুনলে সকালে আমাদেরও মাথা হয়তো ঠিক থাকবে না৷’

-‘তাহলে দুই কানে তুলো গোঁজবার চেষ্টা করব৷’

-‘না, ঠাট্টা নয় জয়ন্ত৷ এসো, জানলাগুলো বন্ধ করে শুয়ে পড়া যাক৷ তারপর সকালে উঠে দেখা যাবে, পথঘাটের অবস্থা কীরকম৷’

জয়ন্ত ও মানিক সকাল বেলায় যখন বাড়ির বাইরে গিয়ে দাঁড়াল, তখন রাত্রের সেই ভয়ংকর ও পৈশাচিক গণ্ডগোল বোধ করি শ্রান্ত হয়ে এসেছে৷ মাঝে মাঝে দু-চার জন এখনও জয় হিন্দ প্রভৃতি বলবার চেষ্টা করছে বটে, কিন্তু কন্ঠস্বরগুলো যথেষ্ট কাহিল হয়ে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে৷ তবে তরুণ সূর্যের সোনালি হাসির ভিতরেও চারিদিকে বিরাজ করছে কেমন একটা থমথমে অপার্থিব ভাব৷

আগে প্রতিদিনই যারা নরহত্যা করবার ব্রত নিয়ে জনবহুল পথে পথে দিকবিদিক জ্ঞানহারার মতো ছুটোছুটি করে বেড়াত, সেই ট্রাম-বাস-ট্যাক্সির দল এখনও সাহস সঞ্চয় করে আত্মপ্রকাশ করতে পারেনি৷ যে দু-একখানা মোটর দেখা যাচ্ছে, তা হয় ডাক্তার মার্কার আশ্রয় নিয়েছে, নয় বহন করছে পুলিশের লাল পাগড়িওয়ালাদের৷

জায়গায় জায়গায় দেখা যাচ্ছে ছোটো-বড়ো জনতা৷ সেখানে সবাই কথা কইছে উত্তেজিতভাবে এবং অনেকেরই হাতে রয়েছে ছোরা, ভোজালি, লোহার ডান্ডা, পাইপ বা শিক এবং এমন সব পলকা লাঠি বা বাঁখারি-একটা বিড়াল মারতে গেলেও যা ভেঙে টুকরো হয়ে যেতে পারে৷

মাঝে মাঝে হঠাৎ দলে দলে লোক উদভ্রান্তের মতো ছুটতে শুরু করছে ঊর্ধ্বশ্বাসে৷

মানিক একটা ছুটন্ত লোকের হাত ধরে ফেলে শুধোলে, ‘আরে মশাই, ব্যাপার কী?’

-‘জানি না মশাই, জানি না৷’

-‘তবে এত ছুটছেন কেন?’

-‘সবাই ছুটছে বলেই ছুটছি৷ ইচ্ছা করলে আপনিও ছুটতে পারেন৷’

-‘না, আমার সে ইচ্ছা নেই৷ আপনিই ছুটুন৷ যত পারেন ছুটুন- প্রাণপণে ছুটুন!’

মানিক হাত ছেড়ে দিলে৷ লোকটি আবার ছুটতে শুরু করলে৷

জয়ন্ত হাসলে, মানিকও হাসলে বটে, কিন্তু তাদের সে হাসির মধ্যে নেই কিছুমাত্র কৌতুকের আবেগ৷ রাজপথ হয়ে উঠেছে আজ ভীষণ৷ তার দিকে তাকালেও শিউরে ওঠে অন্তর ও আত্মা৷

রাজপথ হয়েছে আজ অসংখ্য মানুষের অন্তিমশয্যা৷ মৃতদেহ আর মৃতদেহ আর মৃতদেহ৷ কোথাও এক জন কি দু-জন এবং কোথাও বা চার-পাঁচ জন মানুষের মৃতদেহ৷ কোথাও বা রাশি রাশি মৃতদেহের উপরে মৃতদেহ পড়ে গঠন করেছে বীভৎস স্তূপের পর স্তূপ৷ প্রত্যেকেরই নিশ্চেষ্ট দেহের ভঙ্গি একান্ত অস্বাভাবিক, প্রত্যেক দেহই রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত৷ দেহহীন মুণ্ডু এবং মুণ্ডহীন দেহেরও অভাব নেই৷ কাটা হাত-পাও পড়ে রয়েছে এখানে-ওখানে৷ সর্বত্র রক্তের ছড়াছড়ি-রক্তধারায় পথ হয়েছে পিচ্ছল কর্দমাক্ত৷ ভয়ানক, সে সব দৃশ্য অসহনীয়৷ যেটুকু বললুম তাই যথেষ্ট, আরও বেশি বর্ণনা করে লাভ নেই৷ মানুষের প্রতি মানুষ যে কত নিষ্ঠুর হতে পারে, কলকাতার রাজপথে পাওয়া যায় তারই জ্বলন্ত প্রমাণ৷

হঠাৎ মানিক সচকিত কন্ঠে বলে উঠল, ‘জয়ন্ত দাঁড়াও!’

-‘কী হয়েছে মানিক?’

-‘এখানে একটি দেহ পড়ে রয়েছে৷ বরেনবাবুর মৃতদেহ৷ ইনি আমার পরিচিত৷ বন্ধু বললেও চলে৷’

-‘কে বরেনবাবু?’

-‘বরেন্দ্রসুন্দর রায়চৌধুরী! আমার কাছে তুমিও এর নাম শুনেছ৷’

-‘বরেন্দ্রসুন্দর রায়চৌধুরী? আনন্দপুরের জমিদার?’

-‘হ্যাঁ৷’

জয়ন্ত এগিয়ে এসে দাঁড়াল৷

একটি পরমসুন্দর মানুষের সুগঠিত দেহ৷ মুখ-চোখ সুশ্রী, বর্ণ গৌর৷ দেখলেই বোঝা যায়, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি! দেহের ভঙ্গি স্বাভাবিক৷ প্রথম দৃষ্টিতে মনে হয়, ভদ্রলোক যেন ঘুমিয়ে আছেন নিশ্চিন্ত আরামে৷ কিন্তু তাঁর বুকের উপর রয়েছে একটা কুৎসিত ক্ষতচিহ্ন৷

জয়ন্ত দেহের পাশে বসে পড়ল৷ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ধরে পরীক্ষা করলে ক্ষতচিহ্নটা৷ তারপর গম্ভীর স্বরে বললে, ‘মানিক আমার বিশ্বাস, এই ভদ্রলোক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামায় মারা পড়েননি৷ এ হচ্ছে সাধারণ হত্যাকাণ্ড৷ কেউ একে অন্য জায়গায় খুন করে পুলিশকে ঠকাবার জন্যে এখানে এনে ফেলে রেখে গেছে৷’

মড়ার উপরে খড়্গাঘাত

বরেনবাবুর মৃতদেহ নিয়ে আরও ভালো করে পরীক্ষায় নিযুক্ত হল জয়ন্ত৷ হঠাৎ পিছন থেকে উৎসাহিত কন্ঠে শোনা গেল, ‘আরে হুম৷ মানিক নাকি?’

ইন্সপেক্টর সুন্দরবাবুর কন্ঠস্বর৷ ফিরে দাঁড়িয়ে মানিক বললে, ‘এত সকালে সুন্দরবাবু রাস্তায় যে? প্রাঃতভ্রমণে বেরিয়েছেন বুঝি?’

সুন্দরবাবু এগিয়ে আসতে আসতে বললেন, ‘হেঁ:, প্রাঃতভ্রমণেই বেরিয়েছি বটে৷ পুলিশের চাকরি নিয়ে আমরা কি আর মনুষ্য-পদবাচ্য আছি? আমরা শকুনি হে, শকুনি? যেখানে মড়া সেইখানেই আমরা৷ রাজপথ হয়েছে আজ মড়াদের বিছানা, আমরা কি এখানে না এসে থাকতে পারি? আরে কে ও, জয়ন্ত যে৷ তোমার সামনে একটা মড়া৷ বাপ, তুমি তো আর পুলিশে চাকরি কর না, তবে শখ করে মড়া ঘাঁটতে বেরিয়েছ কেন?’

জয়ন্ত জবাব দিলে না, মুখও তুললে না৷

মানিক বললে, ‘সুন্দরবাবু এই মৃতদেহটি আমার এক বন্ধুর৷ ইনি আনন্দপুরের জমিদার, নাম বরেন্দ্রসুন্দর রায়চৌধুরী৷’

-‘শুনে দুঃখিত হলুম৷ কিন্তু উপায় কি আর আছে ভাই? দেশে সাংঘাতিক ভ্রাতৃঘাতী হানাহানি বেঁধেছে, তোমার আমার কত বন্ধুকেই যে আত্মদান করতে হবে তা কে জানে?’

মাণিক বললে, ‘না সুন্দরবাবু, জয়ন্ত বলে বরেন্দ্রবাবু সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামায় মারা পড়েননি৷’

-‘বটে, বটে৷ জয়ন্ত এমন কথা বলে কেন?’

-‘তার মতে কেউ এঁকে অন্য জায়গায় খুন করে এখানে এনে ফেলে রেখে গিয়েছে৷’

-‘খুনির এতটা পরিশ্রম করবার কারণ কী?’

-‘খুনি পুলিশকে ঠকাতে চায়৷ ব্যাপারটা সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ড বলে চালিয়ে দিতে পারলে পুলিশ জোর তদন্ত না করতেও পারে৷’

-‘লাশের গায়ে কি খুনির মনের কথা লেখা আছে?’

-‘আমি জানি না৷ জয়ন্তকে জিজ্ঞাসা করুন৷’

-‘কী হে জয়ন্ত, তুমি মিশরের মমির মতো চুপ মেরে আছ কেন? মানিকের কথা কি সত্য?’

জয়ন্ত উঠে দাঁড়িয়ে বললে, ‘হ্যাঁ৷’

-‘এই ভদ্রলোক এখানে মারা পড়েননি?’

-‘না৷’

-‘কেমন করে জানলে?’

জয়ন্ত বললে, ‘প্রথমত ইনি যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মারা পড়েননি, খুব সহজেই সে সন্দেহ হয়৷ ইনি হিন্দু আর এটা হচ্ছে একেবারে হিন্দু পাড়া৷ এখানে হঠাৎ কোনো মুসলমান এসে একে হত্যা করতে পারে না৷ অন্য কোথাও খুন করে মুসলমানরা যে হিন্দু পাড়ায় এসে লাশ ফেলে যেতে সাহস করবে, তাও মনে হয় না৷ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রাস্তায় কেউ যদি মারা যায়, তাকে নিয়ে বেশি মাথা ঘামাবার দরকার হয় না৷’

-‘এ কথা মানি৷’

-‘তারপর শুনুন৷ আমি মৃতদেহ ভালো করে পরীক্ষা করেছি৷ বাঁ-দিকের দ্বিতীয় আর তৃতীয় পাঁজরার মাঝখানে কেউ ছোরা দিয়ে আঘাত করেছে৷ ছোরা প্রবেশ করেছে স্টার্নাম বা বুকঅস্থির খুব কাছেই৷ ওই রকম আঘাতে মৃত্যু হয় প্রায় মুহূর্তের মধ্যেই৷ কিন্তু সে আঘাতে বরেন্দ্রবাবু মারা পড়েননি৷’

-‘তবে? মৃতদেহে তো আর কোনো আঘাতেরই চিহ্ন দেখছি না৷’

-‘আগে আমার সব কথা শুনুন৷ অস্ত্রে কেবল বাঁ-পাশের ফুসফুস জখম হয়নি, দেহের দুটো প্রধান ধমনীও-পালমনারি আর এওর্টা- আংশিকভাবে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে৷ অত তাড়াতাড়ি মৃত্যুর কারণ তাই-ই৷’

-‘এটা তো আত্মহত্যার মামলাও হতে পারে?’

-‘পারে৷ মৃত্যু হয় যেখানে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে, আত্মঘাতীর অস্ত্র সেখানে হয় ক্ষত স্থানে, নয় হাতের মুঠোর মধ্যে, নয়তো দেহের আশেপাশে কোথাও পাওয়া যায়৷ কিন্তু এখানে কোনো অস্ত্রই দেখতে পাচ্ছি না৷ সুতরাং এটা আত্মহত্যার মামলা হতে পারে না৷’

-‘মৃত্যু হয়েছে রাস্তায়৷ যদি কোনো পথিক ছোরাখানা কুড়িয়ে নিয়ে গিয়ে থাকে?’

-‘প্রশ্নটা যুক্তিসংগত৷ আদালতে এমন প্রশ্ন উঠতে পারে৷ কিন্তু বর্তমান ক্ষেত্রে এমন প্রশ্ন উঠবার সুযোগ নেই৷ কারণ বলছি৷ ক্ষতস্থানটা দেখুন৷ জীবন্ত দেহে অস্ত্রাঘাত করলে ক্ষতস্থানটা বেশি ফাঁক হয়ে যায়, কারণ সে ক্ষেত্রে জ্যান্ত চামড়া হয় সংকুচিত৷ মৃতদেহের ত্বক সংকুচিত হয় না, তাই ক্ষতস্থানের ফাঁকও বড়ো হতে পারে না৷ এই দেহটার ক্ষতস্থানের মুখ কীরকম সংকীর্ণ, দেখছেন তো? এর দ্বারা কী প্রমাণিত হয়?’

সুন্দরবাবু সন্দিগ্ধভাবে বললেন, ‘তুমি কি বলতে চাও জয়ন্ত, এই ভদ্রলোকের মৃত্যুর পর হত্যাকারী দেহের উপরে অস্ত্রাঘাত করেছে?’

-‘ঠিক তাই৷ আরও প্রমাণের অভাব নেই৷ জীবন্ত দেহের ক্ষতস্থান রক্তে পরিপূর্ণ হয়ে যায়, জামাকাপড়ও হয় রক্তে আরক্ত৷ কিন্তু এই ক্ষতটা দেখুন এর উপরে রক্ত জমাট হয়ে নেই৷ জামাকাপড়েও রক্তের দাগ নেই বললে চলে৷’

-‘তোমার আর কিছু বলবার আছে?’

-‘আছে৷ বলেছি, খুনির অস্ত্র দেহের দু-টি প্রধান ধমনী দুই ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছে৷ জীবন্ত অবস্থায় এই দু-টি নাড়ি পরিপূর্ণ হয়ে থাকে প্রবহমান রক্তধারায়৷ মৃত্যুর পর এই ধমনী দুটো প্রায় রক্তশূন্য হয়ে যায়৷ সুতরাং বরেনবাবু বেঁচে থাকতে যদি কেউ তাঁর বুকে অস্ত্রাঘাত করত তাহলে যে কোটরের ভিতর ওই দুটো ধমনী আছে, তা রক্তে পরিপূর্ণ হয়ে উঠত৷ কিন্তু এ ক্ষেত্রে দেখছি রক্ত আছে যৎসামান্য-যা নগন্য বললেও চলে৷’

সুন্দরবাবু তাঁর বিখ্যাত টাক চুলকোতে চুলকোতে, বললেন, ‘হুম! খুনি মড়ার উপরে করেছে খড়্গাঘাত?’

-‘নিশ্চয়!’

-‘কিন্তু কেন?’

-‘লোকের চোখে ধুলো দেবার জন্যে৷ বরেনবাবুর শবব্যবচ্ছেদ করলেই খুব সম্ভব জানা যাবে যে, আগে তাঁকে বিষপ্রয়োগ করে হত্যা করা হয়েছে৷ খুনি তারপর মড়ার উপরে ছোরা মেরে লাশটাকে রাস্তায় বহন করে এনে ফেলে রেখে গিয়েছে৷ এখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলছে বীভৎস সমারোহে-শহরের পথে পথে মৃতদেহের ছড়াছড়ি, পুলিশ বিশেষভাবে কোনো মৃতদেহ নিয়ে তদন্ত করে না, লাশগুলোকে গাদায় ফেলে শ্মশানে বা গোরস্থানে পাঠিয়ে দেয়, এ ক্ষেত্রেও হয়তো তা ছাড়া আর কিছুই হবে না৷ সুন্দরবাবু, এই খুনি বা খুনিরা অত্যন্ত সুচতুর, তাই-‘

জয়ন্তের কথা শেষ হতে-না-হতেই খানিক তফাতে উঠল বিষম গণ্ডগোল৷ দলে দলে লোক চারিদিকে প্রাণপণে ছুটোছুটি করে পালাতে লাগল পাগলের মতো৷ আবার আর একদল লোক লাঠি ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আস্ফালন করতে করতে বেগে ধাবমান হল একদিকে৷

সুন্দরবাবু তাঁর রিভলবার বার করে বললেন, ‘এসো জয়ন্ত, এসো মানিক, ব্যাপারটা কী দেখা যাক! এই সেপাইরা, তোমরাও এসো৷’

কিন্তু খানিকদূর অগ্রসর হয়েই দেখা গেল, ব্যাপারটা কিছুই নয়৷ দুটো ষাঁড় লড়াই করছে, তাই দেখে কয়েকজন ছুটে নিরাপদ ব্যবধানে সরে আসবার চেষ্টা করেছে, এবং সঙ্গে সঙ্গে রাজপথের বিপুল জনতা অকারণ আতঙ্কে অভিভূত হয়ে সৃষ্টি করছে এই মিথ্যা বিভীষিকা৷

জয়ন্ত, মানিক ও সুন্দরবাবু আবার ফিরে এলেন যথাস্থানে৷

মানিক সবিস্ময়ে বললে, ‘একী! বরেনবাবুর মৃতদেহ কোথায়?’

জয়ন্ত তিক্ত হাসি হেসে বললে, ‘তোমার প্রশ্নের উত্তর খুব সোজা৷’

-‘খুনিরা এইখানেই হাজির ছিল, তাদের হিসাবে ভুল হয়েছে দেখে প্রথম সুযোগেই লাশ তারা সরিয়ে ফেলেছে৷’

জিপ গাড়ি

সুন্দরবাবু হতভম্বের মতো বললেন, ‘দু-মিনিট পিছু ফিরতে-না-ফিরতেই সদর রাস্তা থেকে লাশ লোপাট৷ এমন আজব ব্যাপার আমি তো আর কখনো দেখিনি বাবা৷’

মানিক বললে, ‘আমরা যখন বরেনবাবুর মৃতদেহের কাছে দাঁড়িয়ে কথা কইছিলুম, তখন সেখানে বেশ একটি ছোটোখাটো জনতার সৃষ্টি হয়েছিল৷ লাশ যারা সরিয়েছে তারা সেই জনতার ভিতরেই ছিল বলে সন্দেহ হচ্ছে৷’

জয়ন্ত বললে, ‘সন্দেহ নয় মানিক, এইটেই হয়েছে সত্য৷ আচ্ছা, তুমি কি সেই ভিড়টা লক্ষ করেছিলে?’

-‘না৷ একজন বন্ধুর মৃতদেহ দেখে আমি এতটা অভিভূত হয়েছিলুম যে, অন্য কিছু লক্ষ করবার মতো মনের অবস্থা আমার ছিল না৷’

-‘আমি কিন্তু লক্ষ করেছিলুম৷ ভিড়ের ভিতরে ছিল তিন জন কালো চশমাপরা লোক৷’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘আরে হুম৷ কালো চশমাপরা লোক দেখলেই সন্দেহ করতে হবে, এমন কথার কোনোই মানে হয় না৷ এই তো আমি এখন কালো চশমা পরে আছি৷ কিন্তু তুমি কি বলতে চাও আমি হচ্ছি সন্দেহজনক ব্যক্তি?’

মানিক ভ্রূ নাচিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, আমি ঠিক ওই কথাই বলতে চাই৷’

-‘মানে?’

-‘পুলিশের লোক বললেই বুঝতে হবে পয়লা নম্বরের সন্দেহজনক ব্যক্তি৷’

সুন্দরবাবু হুংকার দিয়ে বলে উঠলেন, ‘চোপরাও মানিক, চোপরাও! খামোকা টিপ্পনি কেটে আমাকে চটাবার চেষ্টা কোরো না৷ বাজে ফাজলামি ভালো নয়, পারো তো কাজের কথা বলো৷’

জয়ন্ত বললে, ‘আমার সন্দেহের কারণ বলি শুনুন৷ প্রথমত, কোনো ছোটো ভিড়ে একখানা কালো চশমাই যথেষ্ট৷ কিন্তু একসঙ্গে তিনখানা কালো চশমা কি অল্পবিস্তর অসাধারণ নয়? দ্বিতীয়ত, ওই তিন জন কালো চশমাপরা লোকেরই সাজ ছিল একরকম-খাঁকি শার্ট, হাফ প্যান্ট আর বুট জুতো, দেখলেই মনে হয় যেন তারা ফৌজের সেপাই৷ এটাও আমি লক্ষ করেছিলুম যে তাদের একজন হচ্ছে অতিরিক্ত ঢ্যাঙা আর অতিরিক্ত রোগা৷তার মাথার চুল বেশ লম্বা, প্রায় কাঁধ পর্যন্ত এসে পড়েছিল৷’

মানিক চমৎকৃতভাবে বললে, ‘শবদেহ পরীক্ষা করতে করতেও তুমি এত ব্যাপার লক্ষ করেছিলে? তাকে দেখলে আবার চিনতে পারবে?’

-‘নিশ্চয়ই পারব! তুমি কি জানো না মানিক, সত্যিকার গোয়েন্দাদের থাকে সেইরকম চক্ষু-ইংরেজিতে যা ক্যামেরা আই নামে বিখ্যাত? এরকম চোখে পড়ে যেকোনো দৃশ্য, তা চিরস্থায়ী হয়ে যায়৷’

সুন্দরবাবু বিরক্তিভরে ভ্রূ-সংকোচ করে বললেন, ‘ওসব চোখ-টোখের কথা এখন থো করো বাপু৷ আমার কথা হচ্ছে, এই অদ্ভুত লাশ চুরির অর্থটা কী?’

জয়ন্ত বললে, ‘অর্থ স্পষ্ট৷ অপরাধীরা ভেবেছিল এই ব্যাপারটা সাম্প্রদায়িক খুনের মামলা বলে চালিয়ে দেবে৷ শেষ পর্যন্ত কোথাকার জল কোথায় গড়ায় তা দেখবার জন্যে তারা এখানে অপেক্ষা করছিল৷ তারা দেখল আমি তাদের অতি চালাকি ধরে ফেলেছি৷ সুতরাং লাশ যে শবব্যবচ্ছেদাগারে পাঠানো হবে আর পুলিশ যে শবব্যবচ্ছেদাগারের রিপোর্ট পেয়ে মামলার ভার গ্রহণ করবে এটা বুঝতে তাদের বিলম্ব হয়নি৷’

-‘শবব্যবচ্ছেদাগারের রিপোর্টে কী থাকত?’

-‘ঠিক কী থাকত তা আমি বলতে পারি না৷ তবে এটুকু নিশ্চয়ই জানা যেত যে বরেন্দ্রবাবুকে আগে বিষ খাইয়ে বা অন্য কোনো উপায় হত্যা করে পরে তাঁর মৃতদেহের উপরে অস্ত্রাঘাত করা হয়েছে৷’

মানিক বললে, ‘কিন্তু একটা গোটা মৃতদেহ হজম করা তো সহজ নয়৷’

জয়ন্ত বললে, ‘এই দাঙ্গার বাজারে সবই সহজ৷ কিন্তু আপাতত ও-সব কথা থাক৷ এখন দেখা যাক কী উপায়ে লাশটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে সেটা জানতে পারা যায় কি না!’

তখনও সেখানে কয়েক জন লোক দাঁড়িয়ে ছিল৷ দু-চার জনকে জিজ্ঞাসা করতেই জানা গেল যে ষাঁড়ের লড়াইয়ের জন্যে রাজপথে যখন মিথ্যা আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছিল, সেই সময়ে হঠাৎ একখানা জিপগাড়ি এসে মৃতদেহটা তুলে নিয়ে চলে গিয়েছে৷ খবরটা যে দিলে, সেই রাস্তার ধারে তার একখানা পানের দোকান আছে৷

সুন্দরবাবু বললেন, ‘তুমি কীরকম লোক হে বাপু? ওসব দেখেও চুপ করে রইলে?’

দোকানদার বললে, ‘কেমন করে বুঝব হুজুর? আমি ভেবেছিলুম তারা সেপাই৷’

-‘তাদের পরনে সেপাইয়ের পোশাক ছিল?’

-‘হ্যাঁ, হুজুর৷’

-‘তারা ক-জন ছিল?’

-‘তিন জন৷’

জয়ন্ত শুধোলে, ‘তাদের চোখে কি কালো চশমা ছিল?’

-‘হ্যাঁ হুজুর৷’

-‘একটা লোক খুব ঢ্যাঙা আর খুব রোগা?’

-‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷ আর তার মাথায় ছিল ঝাঁকড়া চুল৷’

জয়ন্ত ও মানিক অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করলে৷

সুন্দরবাবু বললেন, ‘তুমি জিপগাড়িখানার নম্বর দেখেছ? দেখনি? তুমি হচ্ছ একটি আস্ত গাধা৷’

-‘আজ্ঞে, আমি ইংরেজি পড়তে পারি না৷’

-‘পারো না? তাহলে তুমি যে-সে গাধা নও, একটি আস্ত মুখ্যু গাধা৷’

লোকটি হাতজোড় করে বললে, ‘আজ্ঞে হুজুর যা বলেন৷’

জয়ন্ত বললে, ‘জিপগাড়িখানা কোন দিকে গিয়েছে সেটা বলতে পারবে তো?’

-‘আজ্ঞে, সামনের ওই রাস্তা ধরে৷’

-‘মানিক, ওটা তো গঙ্গায় যাবার রাস্তা৷’

-‘হ্যাঁ৷’

-‘তাহলে আমার বিশ্বাস লাশটা তারা গঙ্গাজলে বিসর্জন দেবে৷ শিগগির চলো৷’

-‘কোথায়?’

-‘গঙ্গার ধারে৷’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘জয়ন্ত তুমি কি মনে কর আমাদের হাতে আত্মসমর্পণ করবার জন্যে তারা এখনও গঙ্গার ধারে বসে আছে?’

-‘বসে থাক না থাক, ওদিকে একবার যেতে দোষটা কী?’

মানিক অঙ্গুলিনির্দেশ করে বললে, ‘জয়ন্ত, জয়ন্ত! গঙ্গার দিক থেকে একখানা জিপগাড়ি খুব বেগে এই দিকেই আসছে না?’

-‘হুঁ৷ আরে আরে, গাড়ির ভিতরে বসে আছে যে আমাদের সেই কালো চশমাপরা বন্ধু লোকেরাই! বাহবা কি বাহবা!’

অগ্নিশিখার নাচ

সুন্দরবাবু চার জন পাহারাওয়ালা নিয়ে পথরোধ করে দাঁড়ালেন৷ এগিয়ে গেল জয়ন্ত ও মানিক৷

জিপগাড়িখানা কোনোরকম ইতস্তত না করেই ছুটে আসতে লাগল৷ গাড়ির আরোহীদের মধ্যেও কোনরকম চাঞ্চল্য দেখা গেল না৷ নির্ভয়ে তারা বসে আছে পাথরের মূর্তির মতো৷ তাদের ভাব দেখলে মনে হয়, পথ জোড়া, এই যেন তাদের দৃষ্টিগোচরই হয়নি৷

গাড়ি খুব কাছে এসে পড়তেই, সুন্দরবাবু দুই বাহু শূন্যে তুলে হুকুমের স্বরে বললেন, ‘গাড়ি থামাও৷ গাড়ি থামাও৷’

কোনোরকম জানান না দিয়েই গাড়ির গতি বেড়ে গেল৷ আচম্বিতে পাঞ্জাব মেলের ইঞ্জিনকে হার মানিয়ে গাড়িখানা এমন অপ্রত্যাশিতভাবে ভোঁ দৌড় মারলে যে, সুন্দরবাবু প্রাণ বাঁচাবার জন্য পিছনদিকে মস্ত এক লম্ফ ত্যাগ করে নিজের বিপুল ভুঁড়ির ভারে টাল খেয়ে দড়াম করে হলেন পপাত ধরণীতলে৷ জয়ন্ত, মানিক ও অন্যান্য লোকেরাও কোনো গতিকে গাড়ি চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে গেল এ যাত্রা৷

চোখের পলক না ফেলতে রিভলবার বার করে জয়ন্ত ফিরে দাঁড়াল এবং সেই উচ্চ গতিতে ধাবমান জিপগাড়ির টায়ার লক্ষ্য করে বার কয়েক গুলি ছুড়লে৷

কিন্তু জিপখানা এর মধ্যেই রিভলবারের নাগালের বাইরে গিয়ে পড়েছে এবং পর মুহূর্তেই মোড় ফিরে চলে গেল একেবারে চোখের আড়ালে৷

মানিক বললে, ‘আমি কিন্তু গাড়িখানার নম্বর দেখে নিয়েছি৷’

জয়ন্ত বললে, ‘নম্বর হয়তো কোনো কাজেই লাগবে না৷ খুব সম্ভব ওরা আসল নম্বর ব্যবহার করেনি৷’

সুন্দরবাবু তখন উঠে পথের উপরে দুই পা ছড়িয়ে বসে আছেন৷ কাতর মুখে তিনি মাথার পিছন দিকটায় হাত বুলিয়ে হাতখানা চোখের সামনে ধরে করুণ স্বরে বললেন, ‘ভেবেছিলাম মাথাটা ফেটে গিয়েছে, এখন দেখছি কাটেওনি, রক্তও পড়ছে না! হুম!’

মানিক বললে, ‘সুন্দরবাবু, আপনার পক্ষে মাথার চেয়ে প্রয়োজনীয় হচ্ছে আপনার স্ফীতোদরটি৷ মাথা ফাটলেও আপনি পটল তুলবেন না, কিন্তু ভুঁড়ি ফেঁসে গেলে একেবারেই সর্বনাশ৷ দেখুন দেখুন, সর্বাগ্রে ভুঁড়িটা পরীক্ষা করে দেখুন৷’

চেষ্টা করে রাগ সামলে সুন্দরবাবু বললেন, ‘থামো হে ফাজিল, থামো! আমার ভুঁড়ির ভাবনা ভেবে তোমাকে আর মস্তক ব্যথিত করতে হবে না! নিজের চরকায় তেল দাও৷’

মানিক বললে, ‘চরকা? আমার চরকা নেই৷ আমি গান্ধীজি মানি বটে কিন্তু তাঁর চরকা মানি না৷’

-‘হুম, তা মানবে কেন? তোমরা আজকালকার ছেলেরা যে কমিউনিস্ট৷’

-‘কমিউনিস্ট কাদের বলে সুন্দরবাবু? আমাদের নেতাদের বক্তৃতা শুনলে সন্দেহ হয় আগেকার টেররিস্টরাই এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে কমিউনিস্ট৷ একথা কি সত্য?’

-‘যাও ছোকরা, যাও৷ মরছি নিজের গায়ের ব্যথায়, এখন উনি এলেন কিনা রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতে৷’ বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালেন সুন্দরবাবু৷

জয়ন্ত বললে, ‘মানিক বাজে কথা ছাড়ো৷ আমার কথার জবাব দাও৷ তুমি বরেনবাবুর বাড়ি চেনো?’

-‘নিশ্চয় চিনি, তিনি যে আমার বন্ধু৷ চন্দ্রকান্ত রোডে জায়গা কিনে তিনি নতুন একখানা বাড়ি তৈরি করেছিলেন৷ বাড়িখানার কেবল একতলাই বাসযোগ্য হয়েছে৷ যুদ্ধের বাজারে মালপত্র দুষ্প্রাপ্য হওয়াতে দোতলা আর তেতলা এখনও সম্পূর্ণ হয়নি৷ বরেনবাবু আপাতত একতলাতেই বাস করতেন৷’

-‘তাঁর পরিবারবর্গ আছেন?’

-‘আছেন বই কী! কিন্তু অসম্পূর্ণ বাড়ি, স্থানাভাব বলে তাঁরা এখন দেশে আছেন৷’

-‘তাহলে কলকাতার এই বাড়িতে বরেনবাবু একলাই থাকতেন৷’

-‘না, ঠিক একলা নয়৷ ঠিকে ঝি আর পাচক কাজকর্ম সেরে চলে যেত৷ বাড়িতে সর্বদাই থাকত নিধিরাম৷ সে বরেনবাবুর পুরোনো বেয়ারা৷ খুব বিশ্বাসী৷’

-‘বরেনবাবু কি বেশ বড়ো জমিদার?’

-‘খুব বড়ো নন, খুব ছোটোও নন, মাঝারি৷’

-‘তাঁর আয় কত জানো?’

-‘ঠিক জানি না৷ তবে লোকের মুখে শুনেছি তাঁর মাসিক আয় বোধ হয় হাজার ছয় টাকার কম ছিল না৷’

জয়ন্ত মিনিট খানেক একেবারে চুপ৷ তারপর বললে, ‘আচ্ছা, বরেনবাবুর সম্বন্ধে বাকি কথা পরে জানলেও চলবে৷ আপাতত আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই, আমাকে বরেনবাবুর বাড়িতে নিয়ে চলো৷ সুন্দরবাবু, আমাদের সঙ্গে আসবেন নাকি?’

সুন্দরবাবু নাচারভাবে বললেন, ‘আছাড় খেয়ে বেদম হয়ে পড়েছি৷ এটা আমার মামলা নয়, যাবার খুব ইচ্ছা নেই৷ তবে তুমি যখন বলছ-‘

সকলে পা চালিয়ে দিলে৷ সেখান থেকে চন্দ্রকান্ত রোড বেশি দূর নয়৷

বরেনবাবুর নবনির্মিত অসম্পূর্ণ বাড়ি৷ একতলার কোনো কাজ বাকি নেই-এমনকী শার্সি-খড়খড়িতে রং পর্যন্ত লাগানো হয়েছে৷ দ্বিতলে ইঁট-চুন-সুরকির কাজ শেষ হয়েছে বটে, তবে রঙের মিস্ত্রি এখনও সেখানে হস্তার্পণ করেনি৷ কিন্তু ত্রিতলের অধিকাংশ কাজই অসমাপ্ত৷ বাড়ির সন্মুখে নীচে থেকে ত্রিতল পর্যন্ত দাঁড় করানো রয়েছে বাঁশের ভারা৷

সমস্তটার উপরে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে জয়ন্ত বললে, ‘দেখছি বাড়িখানা এখনও অত্যন্ত অরক্ষিত অবস্থায় আছে৷ ওই ভারা বেয়ে বাইরের যেকোনো লোক বাড়ির ভিতরে ঢুকতে পারে৷ এমন বাড়িতে বাস করা উচিত নয়৷’

সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মানিক হাঁকলে, ‘নিধিরাম? অ-নিধিরাম!’

একজন মাঝবয়েসি লোক বাইরে এসে দাঁড়াল৷ রং প্রায় কালো, হৃষ্টপুষ্ট গড়ন, খালি গা খালি পা৷ কিন্তু তার মুখের ভাব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত৷

মানিককে দেখেই সে ব্যগ্রভাবে বললে, ‘মানিকবাবু এসেছেন? আপনি বলতে পারেন, আমাদের বাবু কোথায় আছেন?’

মানিক বললে, ‘ব্যস্ত হোয়ো না নিধিরাম, সব কথা পরে বলছি৷ আগে তুমি সব কথা বলো দেখি৷’

নিধিরাম প্রথমে পাহারাওয়ালাদের দিকে সন্দেহপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে৷ তারপর বললে, ‘কাল রাত দশটার পর খাওয়া-দাওয়া সেরে বাবু তাঁর ঘরের ভিতরে শুতে যান, আমিও খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়ি৷ তারপর আজ ভোরে উঠে এসে দেখি, বাবুর ঘরের দরজা খোলা, বাবুও ঘরের ভিতরে নেই৷ বাবু তো বেলা আটটার আগে বিছানা ছেড়ে ওঠেন না, আজ সকালে তাঁর ঘুম ভেঙেছে দেখে অবাক হয়ে গেলুম৷ সদর দরজাটাও খোলা দেখে বুঝলুম, নিশ্চয়ই তিনি বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গিয়েছেন৷ কিন্তু মানিকবাবু, এখন বেলা বারোটা বেজে গিয়েছে এখনও বাবু বাড়িতে ফিরে আসেননি৷ আপনি কি বাবুর খবর জানেন? আপনার সঙ্গে পুলিশ কেন? বাবু কি কোনো বিপদে পড়েছেন?’

জয়ন্ত এগিয়ে গিয়ে বললে, ‘সেসব কথা পরে হবে নিধিরাম৷ এখন বাবুর শোবার ঘরে আমাদের নিয়ে চলো দেখি৷’

নিধিরাম রাস্তার ধারের একখানা ঘরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললে, ‘বাড়ির উপরটা তো এখনও তৈরি হয়নি, বাবু তাই ওই বৈঠকখানাতেই শুয়ে রাত কাটিয়ে দেন৷’

-‘বেশ, তাহলে ওই ঘরখানাই আমরা দেখতে চাই৷’

নিধিরামের পিছনে পিছনে সকলে সদর দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকে বৈঠকখানার ভিতরে প্রবেশ করলে৷

বেশ বড়োসড়ো ঘর৷ মেঝের উপরে কার্পেট পাতা৷ দিকে দিকে টেবিল, চেয়ার, সোফা, কোচ৷ দুটো কেতাবের আলমারি৷ দু-দিকের দেয়ালের গায়ে দুইখানা ফ্রেমে-বাঁধানো বড়ো আয়না৷ ঘরের এক কোণে একখানা ক্যাম্পখাট পাতা৷

জয়ন্ত শুধোলে, ‘তোমার বাবু কি ওই খাটেই শুতেন?’

নিধিরাম বললে, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷’

জয়ন্ত পায়ে পায়ে এগিয়ে চলল সেইদিকে৷

অকস্মাৎ সকলকে চমকে দিয়ে ঘরের ভিতর দুম করে একটা অদ্ভুত শব্দ হল এবং সঙ্গেসঙ্গে এখানে-ওখানে-সেখানে দেখা গেল অভাবিত অগ্নিশিখার আরক্ত নৃত্য৷

গ্যাসোলিন

প্রথমেই দাঁড়িয়েছিল জয়ন্ত৷ তার পিছনে নিধিরাম এবং তার পিছনে একসঙ্গে সুন্দরবাবু ও মানিক৷

বিদ্যুৎবেগে ফিরে দাঁড়িয়ে জয়ন্ত তার বলিষ্ঠ বাহুর দ্বারা প্রায় একসঙ্গেই তাদের তিন জনকে মারলে এমন প্রচণ্ড ধাক্কা যে, ঘরের দরজার ভিতর দিয়ে ঠিকরে তারা হুড়মুড় করে একেবারে বাইরে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়ল৷

পড়তে পড়তেই মানিকের সচকিত দৃষ্টি দেখলে, তার পাশে শূন্য পথে এসে হাজির হল জয়ন্তর দেহও৷

মাটিতে পড়েই জয়ন্ত ও মানিক আবার দাঁড়িয়ে উঠল চোখের নিমেষে৷

বরেনবাবুর বৈঠকখানার ভিতরটা তখন পরিণত হয়েছে একটা বিশাল চুল্লিতে৷ হু-হু রাঙা আগুন এবং কালো কুচকুচে ধোঁয়া ঘরের ভিতরটা একেবারে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে এবং দরজা ও জানলার ভিতর দিয়েও বাইরে বেরিয়ে আসছে ক্রুদ্ধ লকলকে অগ্নিশিখার পর অগ্নিশিখা, ধোঁয়াকুণ্ডলীর পর ধোঁয়াকুণ্ডলী৷ চারিদিকে এমনি ভীষণ উত্তাপ যে, সেই ভয়াবহ অগ্নিগৃহের বাইরে থেকেও সকলের দেহ যেন পুড়ে ঝলসে যাবার মতো৷

জয়ন্ত চিৎকার করে ডাকলে, ‘সুন্দরবাবু, সুন্দরবাবু! শিগগির বাড়ির বাইরে বেরিয়ে চলুন৷’

তখনও ভূতলশায়ী সুন্দরবাবু দুই-একবার ওঠবার জন্যে ব্যর্থ চেষ্টা করে যন্ত্রণাবিকৃত কন্ঠে বলে উঠলেন, ‘কোমর ভেঙে গিয়েছে-আমার কোমর ভেঙে গিয়েছে৷ আমি আর উঠতে পারছি না যে৷’

জয়ন্ত ও মানিক তখন সুন্দরবাবুকে চ্যাংদোলা করে বাড়ির বাইরে নিয়ে এল৷ নিধিরাম এর মধ্যেই পালিয়ে রাস্তায় গিয়ে হাজির হয়েছিল৷

জয়ন্ত বললে, ‘মানিক, দৌড়ে গিয়ে ফায়ার ব্রিগেডকে ফোন করে দাও৷’

দেখতে দেখতে রাস্তায় জমে উঠল প্রকাণ্ড জনতা৷ এমন হইচই শুরু হয়ে গেল যে কান পাতা দায়৷ ছুটোছুটি, হুড়োহুড়ি, ঠেলাঠেলি৷ সকলের ইচ্ছা আরও কাছে আসে, কিন্তু আগুনের তাতে আরও কাছে আসা অসম্ভব৷

ফোন করে এসে মানিক হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, ‘ভাই জয়ন্ত, ব্যাপার দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছি, কেমন করে কী হল, কিছুই বুঝতে পারছি না৷’

-‘প্রথমে আমিও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলুম৷ তবে অগ্নিকাণ্ডের এক মুহূর্ত আগেই আমার সজাগ চোখ দেখেছিল একটা দৃশ্য, আর আমার সজাগ কান শুনেছিল একটা শব্দ৷ সঙ্গেসঙ্গে আমিও সাবধান হতে পেরেছিলুম, নইলে এতক্ষণে আমরা কেউই প্রাণে বাঁচতুম না৷’

-‘আমি দেখতে কিছুই পাইনি৷ তবে একটা শব্দ শুনেছিলুম বটে৷’

-‘কীরকম শব্দ?’

-‘কাঁচের কোনো জিনিস ভাঙার শব্দ?’

-‘ঠিক৷ কিন্তু তুমি কিছুই দেখতে পাওনি, না মানিক? এতেই বোঝা যাচ্ছে, আমার সঙ্গে সঙ্গে থেকেও তুমি এখনও পুরোপুরি গোয়েন্দা হতে পারোনি৷ আদর্শ গোয়েন্দার প্রধান কর্তব্য হচ্ছে, সর্বদা সর্বদিকে পঞ্চেন্দ্রিয়কে সতর্ক জাগ্রত রাখা৷ আমি কী দেখেছিলুম জানো?’

-‘বলো৷’

-‘অতর্কিতে একটা মূর্তি দরজার সামনে আবির্ভ÷ত হল-সেই কালো চশমা আর খাকি পোশাকপরা মূর্তি৷ পর মূহূর্তে সে একটা কাচের জগ সজোরে ঘরের ভিতরে নিক্ষেপ করলে-জগটার মুখের কাছটা জ্বলন্ত৷’

-‘জ্বলন্ত কাচের জগ?’

-‘হ্যাঁ৷ আচ্ছা মানিক, তুমি কোনো গন্ধ পাওনি?’

-‘গন্ধ পাবার সময় দিলে কই? যে হাড়ভাঙা ধাক্কা মেরেছিলে৷’

-‘ধাক্কা না মারলে তোমরা যে বাঁচতে না ভাই৷’

-‘কিন্তু গন্ধের কথা কী বলছ?’

-‘আমি একটা গন্ধ পেয়েছি৷ গ্যাসোলিনের গন্ধ৷’

মানিক কী জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিল, এমন সময় ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি এসে পড়ল৷ বরেন্দ্রবাবুর বাড়ি তখন জ্বলছে দাউ-দাউ-দাউ৷ শত শত অগ্নিশিখা তখন রক্তসর্পের মতো সোঁ সোঁ করে উপরে উঠে যাচ্ছে, যেন আকাশকে ছোবল মারবার জন্যে৷

জয়ন্ত ডাকলে, ‘সুন্দরবাবু৷’

-‘হুম!’

-‘এখন আপনার অবস্থা কেমন?’

-‘প্রায় মারাত্মক৷ কোনোক্রমে উঠে দাঁড়িয়েছি বটে, কিন্তু শরীরে আর পদার্থ নেই৷ একটিমাত্র দিনে দুই-বার প্রচণ্ড আছাড় খাওয়া৷ এই বয়সে হজম করতে পারব কেন ভায়া৷’

-‘এ বাড়ির ভিতর থেকে কোনোরকম সূত্র আবিষ্কারের সম্ভাবনা নেই-অগ্নিদেব সমস্তই নিশ্চিহ্ন না করে ছাড়বেন না৷ ফায়ার ব্রিগেডের কাজের অসুবিধা হবে, আমরা খানিক তফাতে গিয়ে দাঁড়ালেই ভালো হয়৷’

ভিড় ঠেলে তারা অগ্রসর হল৷

সুন্দরবাবু বললেন, ‘কাচের জ্বলন্ত জগ, গ্যাসোলিন, এসব কী বলছ জয়ন্ত, আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না৷’

‘আমরা সাংঘাতিক শত্রুর পাল্লায় পড়েছি, তারা পদে পদে আমাদের অনুসরণ করছে৷ আসল ঘটনাস্থলে আমাদের আবির্ভাব দেখেই তারা কেবল ওই বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়নি, আমাদেরও পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেছে৷’

-‘কিন্তু কাচের জগ আর গ্যাসোলিনের গুপ্ত কথাটা কী?’

-‘মনে করুন, আপনি একটা কাচের জগের ভিতরটা গ্যাসোলিনে ভরতি করলেন৷ তারপর খালি ন্যাকড়া দিয়ে জগের মুখটা বন্ধ করলেন৷ ন্যাকড়ার কতক অংশ পলতের মতো বাইরে বের করে রেখে তাতেও ঢেলে দিলেন গ্যাসোলিন৷ তখন কাচের জগটা পরিণত হল মারাত্মক বোমায়৷’

সুন্দরবাবু সবিস্ময়ে বললেন, ‘বোমায়!’

-‘ঠিক তাই৷’

-‘তারপর?’

-‘এ বোমা যে ব্যবহার করবে তাকেও রীতিমতো হুঁশিয়ার হয়ে থাকতে হবে৷ পলতেয় অগ্নিসংযোগ করবার পর সময় পাওয়া যাবে মাত্র দুই সেকেন্ড৷ তার মধ্যে জগটা নিক্ষেপ করতে না পারলে নিক্ষেপকারীরও বিপদের সম্ভাবনা৷’

-‘হুম৷ এমন বিটকেল বোমার কথা তো জীবনে কখনো শুনিনি৷’

-‘শোনা উচিত ছিল৷ আবিসিনিয়ার অধিবাসীরা ইতালির সঙ্গে যুদ্ধ করবার সময়ে এইরকম বোমাই ব্যবহার করত৷ আমি ভাবছি আমাদের মারবার জন্যে যে লোকটা জগ ছুড়েছে, তার কোনো ক্ষতি হয়েছে কি না৷’

ভিড়ের ভিতরে দাঁড়িয়ে একটি ভদ্রলোক অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে জয়ন্তের কথা শুনছিলেন৷ তিনি এগিয়ে এসে বললেন, ‘মশাই ঠিক অনুমান করেছেন৷ একটু আগে একজন কালো চশমা আর খাকি পোশাক পরা লোক পাগলের মতন ছুটতে ছুটতে পথের উপরে বেহুঁশ হয়ে পড়ে যায়, তার সমস্ত পোশাকে আগুন লেগে গিয়েছিল৷ আমরা কয়জন মিলে তাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছি বটে, কিন্তু সে বাঁচবে বলে মনে হয় না৷ লোকটা যেখানে পড়ে গিয়েছিল সেইখান থেকে এই ভাঙা চশমা আর একখানা চশমার খাপ কুড়িয়ে পেয়েছি৷’

ক্ষিপ্র হস্তে জিনিস দুটো কুড়িয়ে জয়ন্ত সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করল, ‘তাকে কোন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে জানেন?’

-‘জানি৷ মেয়ো৷’

জয়ন্ত ফিরে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত স্বরে বললে, ‘জাগ্রত হোন সুন্দরবাবু, জাগ্রত হোন৷ আর এক মিনিট দেরি নয়, এখনি মেয়ো হাসপাতালে ছুটতে হবে৷’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘বাপরে বাপ, আজ আমার সব দম বেরিয়ে যাবে দেখছি৷ ঘটনার পর ঘটনা-এ যে ঘটনার মহাবন্যা!’

রামবাবুর লেন

গঙ্গার ধারে মেয়ো হাসপাতাল৷ প্রবেশপথ স্ট্রান্ড রোডের উপর৷

জয়ন্ত হাসপাতালের ভিতরে প্রবেশ করল সদলবলে৷ সেখানে তাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল নূতন বিস্ময়!

আগুনে-পোড়া কোনো লোককে নিয়ে সেদিন কেউ হাসপাতালে আসেনি৷

বোকার মতন মাথা চুলকাতে লাগল জয়ন্ত৷ কোনো হদিস খুঁজে না পেয়ে আর সকলেও অবাক৷

জয়ন্ত ভাবতে লাগল নীরবে৷

প্রথমেই মুখ খুলল মানিকের৷ সে বললে, ‘আমার কী সন্দেহ হচ্ছে জানো? অপরাধীর সঙ্গীরাও ছিল জনতার ভিতরে৷ তারাই আগুনে পোড়া লোকটাকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে দেবে বলে গাড়িতে উঠে চম্পট দিয়েছে৷ নইলে একটা মরো-মরো মানুষ এমনভাবে হঠাৎ উবে যেতে পারে না৷’

জয়ন্ত বললে, ‘আমারও মনে হচ্ছে মানিকের অনুমান সত্য! সুন্দরবাবু যারা বরেনবাবুকে খুন করেছে, তারা সাধারণ অপরাধী নয়৷ এমন করে বার বার আমাদের চোখে ধুলো দেবার শক্তি যার-তার হয় না৷ এ মামলাটার কিনারা করতে হলে আমাদের অনেক কাঠখড়ই পোড়াতে হবে দেখছি৷’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘কাঠই বল আর খড়ই বল, আজকে আমি আর কোনোকিছুই পোড়াতে রাজি নই বাবা৷ আমার গোটা দেহটাই পাকা ফোড়ার মতন টনটন করছে-এই আমি সবেগে ধাবমান হলুম নিজের বাসার দিকে৷ এখন সামনে চীনের প্রাচীর থাকলেও আমার গতিরোধ করতে পারবে না৷’

জয়ন্ত বললে, ‘একটু দাঁড়ান সুন্দরবাবু, একটা কথা৷’

-‘এখনও কথা? সকাল থেকে এত ঝুড়ি ঝুড়ি কথা কয়েও তোমার আশ মিটল না, আরও একটা কথা আছে? কী কথা বলো৷’

-‘কলকাতায় শ্মশান আছে তিনটে-কাশীমিত্রের ঘাট, নিমতলা আর কেওড়াতলা৷’

-‘এটা তোমার আবিষ্কার নয়, একথা সবাই জানে৷’

-‘শুনেছেন তো, যে লোকটা আজ আগুনে পুড়েছে তার বাঁচবার সম্ভাবনা কম? যদি সে মারা পড়ে তার দেহ যেকোনো একটা শ্মশানে নিয়ে যেতে পারে৷ ওই তিনটে শ্মশানে পাহারার ব্যবস্থা করলে ভালো হয়৷’

-‘হুম, দেখা যাবে৷ আর কোনো কথা নেই তো? আর কোনো কথাই আমি শুনব না কিন্তু৷’

-‘না সুন্দরবাবু, আপাতত আমার কথা ফুরোল৷’

সুন্দরবাবুর প্রস্থান৷ জয়ন্ত ও মানিক বাড়ির পথ ধরলে৷

সেইদিনই বিকেলের পর৷ জয়ন্তের বাড়ির একটি ঘর৷

চায়ের পেয়ালা খালি করে জয়ন্ত বললে, ‘মানিক এবারের মামলাটা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না৷’

-‘কেন?’

-‘কারণ প্রথমত, ঘটনাস্থল থেকে কোনো সূত্রই আবিষ্কার করবার সুযোগ আমরা পাইনি৷ দ্বিতীয়ত, কোন উদ্দেশ্যে বরেনবাবুকে খুন করা হয়েছে? তুমি কি তাঁর কোনো শত্রুর কথা জানো?’

-‘না৷’

-‘উদ্দেশ্যহীন হত্যা করে কেবল পাগল৷’

-‘কিন্তু আজ আমরা যাদের পাল্লায় পড়েছিলুম, তারা যে পাগল নয়, সে পরিচয় পেয়েছি পদে পদে৷’

-‘না, পাগল নয়৷ তারা অতি সুচতুর ব্যক্তি৷ কেন তারা বরেনবাবুকে খুন করল?’

-‘আমি কেমন করে বলব?’

-‘তুমি বরেনবাবুর পরিবারবর্গের কথা বলেছিলে৷ তাঁদের কথা আরও ভালো করে বলো৷’

-‘বরেনবাবুর দুই বিবাহ৷ প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর আবার তিনি বিবাহ করেন, তাঁর কোনো স্ত্রীরই সন্তান হয়নি৷’

-‘মানিক, বরেনবাবুর মাসিক আয় ছিল ছয় হাজার?’

-‘হ্যাঁ৷’

-‘অর্থাৎ বাৎসরিক বাহাত্তর হাজার টাকা৷ বড়ো সামান্য টাকা নয়৷ এর চেয়ে ঢের কম টাকার জন্যে পৃথিবীতে অনেক নরহত্যা আর রক্তপাত হয়েছে৷’

মানিক সচমকে বললে, ‘তুমি কি মনে কর, সম্পত্তির লোভেই কেউ বরেনবাবুকে খুন করেছে?’

-‘আপাতত আমি কিছুই মনে করি না৷ গোড়া থেকেই অন্ধের মতো যেকোনো একটা সন্দেহের পিছনে ছুটোছুটি করা আমার স্বভাব নয়৷ এখন আমার মন হচ্ছে নূতন খাতার মতো, যার উপরে সন্দেহজনক একটি লাইনও লেখা হয়নি৷ যাক সেকথা৷ বলো দেখি মানিক, বরেনবাবুর অবর্তমানে তাঁর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে কে?’

-‘খুব সম্ভব তাঁর ছোটো ভাই৷’

-‘বরেনবাবুর আর কোনো আত্মীয় নেই?’

-‘আছেন৷ দুই বোন৷ একজন সধবা, একজন বিধবা৷ তাঁরা দু-জনেই থাকেন শ্বশুরবাড়িতে৷’

-‘বরেনবাবুর ছোটো ভাইয়ের নাম কী?’

-‘নরেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী৷ বরেনবাবুর পৈতৃক সম্পত্তির বাকি অর্ধাংশ উত্তরাধিকার সূত্রে তিনিও পেয়েছিলেন৷’

-‘নরেনবাবুর বয়স কত?’

-‘ত্রিশের বেশি হবে না৷’

-‘স্বভাব-চরিত্র?’

-‘যতদূর জানি, আর সব দিক দিয়ে ভালোই৷ অত্যন্ত সরল সজ্জন, নম্র বিনয়ী, পরোপকারী৷ কিন্তু-‘

-‘থামলে কেন? কিন্তু কী?’

-‘ভীষণ তাঁর ঘোড়দৌড়ের নেশা৷ অধিকাংশ সম্পত্তি তিনি খুইয়েছেন ঘোড়ার পিছনেই৷ আগে তাঁর নিজেরও রেসের ঘোড়া ছিল৷’

-‘আমি নরেনবাবুর সঙ্গে আলাপ করতে চাই৷’

-‘তিনি এখন দেশে আছেন৷’

-‘দাদার মৃত্যুর খবর পেলেই নিশ্চয় তিনি কলকাতায় আসবেন৷’

-‘হ্যাঁ৷ তাঁদের দু-ভাইয়ের ভিতর অত্যন্ত সদ্ভাব ছিল৷ দু-জনেই দু-জনকে ভালোবাসতেন৷’

-‘আজ থাক এ প্রসঙ্গ৷ এখন অন্য একটা দরকারি কথা শোনো৷’

-‘বলো৷’

-‘যে লোকটা কাচের জ্বলন্ত জগ ছুড়েছিল, তার ভাঙা চশমা আর চশমার খাপখানা, আমার হস্তগত হয়েছে, জানো তো? চশমার খাপের ভিতরে একটুকরো চিঠি পেয়েছি৷ এই নাও, তুমিও পড়ে দেখো৷’

কাগজের ভাঁজ খুলে মানিক পড়লে:

‘বিজয়, আজ রাত ১০টার সময়ে ১০ নম্বর রামবাবু লেনে আমার সঙ্গে দেখা করতে ভুলো না৷’

মানিক শুধোলে, ‘রামবাবু লেন কোথায়?’

-‘বেহালায়৷ চিঠির তারিখ দেখেছ? বিজয়ের আজই রামবাবু লেনে যাবার কথা৷’

-‘চিঠি যে লিখেছে তার নাম নেই৷’

-‘নামটা আমাদেরই আজ আবিষ্কার করতে হবে৷ অর্থাৎ বিজয় এখন কুপোকাত, সুতরাং তার বদলে আমরা দু-জনে আজ সন্ধ্যার পরেই রামবাবু লেনে যাত্রা করব৷ কেমন রাজি?’

-‘নিশ্চয়৷ কিন্তু হুঁশিয়ার৷ সঙ্গে রিভলবার আনতে ভুলো না যেন৷’

দশ নম্বর বাড়ি

সন্ধ্যা এবং রাত্রির সন্ধিক্ষণ৷ কৃষ্ণপক্ষের একটি রাত৷ প্রথম দিকে খানিকটা ভাঙা চাঁদের আলো ছিল বটে, কিন্তু তারপরেই পৃথিবী ছেয়ে গেল অন্ধকারে৷ জয়ন্ত কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর আবিষ্কার করলে রামবাবু লেনের দশ নম্বরকে৷

খুব সম্ভব সেটা কোনো বাগানবাড়ি৷ চারিদিকে প্রাচীর, ফটকের রেলিংয়ের ভিতর দিয়ে ঝাপসা ঝাপসা দেখা যাচ্ছে, গাছপালার মাঝখানে একখানা বড়ো একতলা বাড়ি৷ কিন্তু ফটকে বাহির থেকে তালা দেওয়া৷ বাড়ির কোনো দরজা জানালার ফাঁক দিয়েও চোখে পড়ে না এতটুকু আলোর রেখা৷

জয়ন্ত বললে, ‘দেখে মনে হচ্ছে বাড়িখানা খালি৷ এখনও তো দশটা বাজতে অনেক দেরি, আপাতত আমাদের কী করা উচিত, মানিক?’

-‘হয় পাঁচিল টপকে ভিতরে যাওয়া, নয় রাস্তার ওপাশের গাছে চড়ে উপর থেকে চারিদিকে নজর রাখা৷’

-‘উত্তম৷ আমরা শেষোক্ত উপায়ই অবলম্বন করব৷ এসো ভায়া, খানিকক্ষণ শাখামৃগের ভূমিকায় অভিনয় করা যাক৷’

খানিকক্ষণ কাটল৷ দ্রুতবেগে অস্ত যাবার চেষ্টা করছে আজকের অনতি-উজ্জ্বল চাঁদ৷

জয়ন্ত বললে, ‘বাঁদরগুলো আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতালে না বটে, কিন্তু মশার দল কেমন সানন্দে ব্যান্ড বাজিয়ে আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানাচ্ছে দেখো৷’

মানিক নিজের দেহের উপরে ঘন ঘন চপেটাঘাত করে মশকদের অভ্যর্থনার উত্তর দিতে দিতে বললে, ‘এ সময়ে সুন্দরবাবুর অভাব অনুভব করছি৷ এখানে তিনি এখন থাকলে এই সব অনাহূত মশকের উদ্দেশ্যে যেসব চোখা চোখা বচন ঝাড়তেন, কোনো অভিধানেই তা খুঁজে পাওয়া যেত না৷’

আরও কিছুক্ষণ গেল৷ নীচের রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝে লোকজন যাচ্ছে বটে, কিন্তু তাদের কেউ সেই দশ নম্বরের বাগানের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না৷ বেজে গেল রাত দশটা, চাঁদ গেল অস্ত৷ পৃথিবীর নাট্যশালায় নিরন্ধ্র অন্ধকারের প্রবেশ৷

জয়ন্ত বললে, ‘অন্ধকার আজ আমাদের চোখ অন্ধ করতে পারবে না৷ বাগানবাড়ির ফটকের পাশেই একটা সরকারি আলো রয়েছে৷ আমাদের ফাঁকি দিয়ে কারুর পক্ষেই ফটকের ভিতরে ঢোকা সম্ভব হবে না৷’

মানিক বললে, ‘কিন্তু কেউ কি আজ ওই ফটক খুলতে আসবে? আমার তো মনে হয় বিজয়ের দুর্ঘটনার জন্যে আজ ওদের আড্ডা আর বসবে না৷’

-‘তা অসম্ভব নয়৷ তবু আরও কিছুক্ষণ পাহারা দেওয়া যাক৷’

রাত এগারোটা বাজল৷

মানিক বললে, ‘ভাই জয়ন্ত, আর নয়৷ খামোকা মশাদের রক্ততৃষ্ণা নিবারণ করে লাভ নেই৷ পুনর্বার ভূমিষ্ঠ হওয়া যাক৷’

-‘তথাস্তু, কিন্তু বাগানের ভিতরটায় একবার চোখ না বুলিয়ে এ স্থান আমি ত্যাগ করব না৷’ গাছ থেকে নামতে নামতে বললে জয়ন্ত৷

রাস্তায় আর পথিকদের পদশব্দ নেই৷ বোবা ও অন্ধ রাতে কালো চাদরে গা-ঢাকা দিয়ে শব্দ সৃষ্টি করছে খালি প্যাঁচার দল৷ বাদুড়দের ডানা নাড়াও শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝে৷

জয়ন্ত ও মানিক হাজির হল প্রাচীরের ওপারে, বাগানের ভিতরে৷

অন্ধকারে ছায়ার মতন খানিকক্ষণ এদিকে-ওদিকে ঘুরে জয়ন্ত বলল, ‘এত বড়ো বাগান, এত বড়ো বাড়ি এমন খালি পড়ে থাকা স্বাভাবিক নয়৷ মালির ঘর পর্যন্ত বাহির থেকে তালা বন্ধ৷ এ যেন কেমন কেমন মনে হচ্ছে৷ এসো মানিক, একবার বাড়ির ভিতরটা পরীক্ষা করা যাক৷’

দালান পার হয়েই সামনে যে দরজাটা পাওয়া গেল তা কুলুপ আঁটা ছিল না৷ জয়ন্ত ও মানিক ভিতরে প্রবেশ করে টর্চের আলোতে দেখলে, সেটা হচ্ছে হলঘরের মতো৷ বেশ সাজানো-গুছানো৷ বড়ো বড়ো ছবি, আরশি, মার্বেলের টেবিল, সোফা, কৌচ, শ্বেতপাথরের মূর্তি৷ একদিকে ঢালা বিছানা পাতা, তার উপরে তাকিয়ার ভিড়৷

জয়ন্ত বললে, ‘এ ঘর ব্যবহার করা হয়, দরজা পর্যন্ত খোলা, অথচ বাড়িতে মানুষ নেই৷ সন্দেহজনক! রিভলবার বার করো মানিক, রিভলবার বার করো!’ বাড়ির অন্য ঘরগুলো সাবধানে দেখতে হবে৷ টর্চের আলো নিবিয়ে তারা অগ্রসর হল বাইরের দিকে৷

আচম্বিতে সেই অন্ধকারে কোথা থেকে কেমন করে অনেকগুলো মূর্তি বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল জয়ন্ত ও মানিকের উপরে৷ এত হঠাৎ এই অভাবিত ঘটনাটা ঘটল যে, তারা বাধা দেবার বা একখানা হাত তোলবার সময়টুকু পর্যন্ত পেল না৷

তারপর শোনা গেল এক অর্ধকর্কশ এবং অর্ধকোমল আশ্চর্য কন্ঠস্বর৷ এক জন মানুষের গলা দিয়ে একসঙ্গেই কথা কইছে যেন দুই জন মানুষ৷

-‘বেঁধে ফেল, ওদের দু-জনেরই হাত পিছমোড়া করে বেঁধে ফেল৷’

কে বললে, ‘বড্ড অন্ধকার যে! আলো জ্বালব নাকি?’

-‘না, না, খবরদার! আমাদের শ্রীমুখগুলো দর্শনের সৌভাগ্য ওদের আমি দিতে রাজি নই৷’

-‘একটু পরেই তো ওদের প্রাণপাখি গাঁটছাড়া হবে৷ এখন আর ওদের ভয় করবার দরকার কী?’

-‘ভয়! আমি কি ভয় পাবার ছেলে? ভয় নয় রে, ভয় নয়, এ হচ্ছে সাবধানতা৷ জানিস তো, সাবধানের মার নেই!’

জয়ন্ত ও মানিকের হাতে পড়ল কঠিন বাঁধন৷ কারা তাদের টর্চ আর রিভলবার কেড়ে নিলে৷

সেই উদ্ভট কন্ঠস্বর বললে, ‘শোনো মহাগোয়েন্দা জয়ন্ত! ঘরের ভিতরে আমরা আছি দশ জন লোক, আর আমাদের চার জনের হাতে আছে গুলিভরা রিভলবার৷ তোমরা যদি চ্যাঁচাবার চেষ্টা কর, তাহলে সেই চিৎকারই হবে তোমাদের এ জীবনের সর্বশেষ চিৎকার৷ অতএব বোকা হয়ে কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকো৷’

দুরাগতশব্দানুকরণবিদ্যা

অর্ধকর্কশ ও অর্ধকোমল কন্ঠস্বর প্রশ্ন করলে, ‘জয়ন্ত, তুমি আমাদের বন্দি করতে চাও?’

জয়ন্ত বললে, ‘তুমি হুকুম দিয়েছ আমাদের বোবা হয়ে থাকতে৷ তবে আবার প্রশ্ন করছ কেন?’

-‘আচ্ছা, নতুন হুকুম দিচ্ছি, আস্তে আস্তে কথা কইতে পারো৷’

-‘কী অনুগ্রহ!’

-‘ব্যঙ্গ রাখো৷ বলো, তুমি এসেছিলে আমাদের বন্দি করতে?’

-‘তুমি যে কোন মহাপুরষ তা না জেনে কেমন করে বলি তোমাকে আমি বন্দি করতে চাই কি না?’

-‘আত্মপরিচয় দেবার ইচ্ছা আমার নেই৷’

-‘তাহলে তোমার প্রশ্নও হয়ে রইল উত্তরহীন৷’

-‘তবে কি তুমি এখানে এসেছিলে কেবলমাত্র নির্মল বায়ু ভক্ষণ করতে?’

-‘তাও না৷’

-‘তবে?’

-‘সত্য কথা বলব?’

-হ্যাঁ৷ আমি নিজে প্রায়ই সত্য কথা বলি না, কিন্তু আমি সত্য কথা শুনতে ভালোবাসি৷

-‘তোমার কথাগুলো রবি ঠাকুরের কবিতার মতো নয়৷’

-‘মানে?’

-‘তুমি ভারি স্পষ্ট ভাষায় কথা কইছ৷’

-‘হ্যাঁ, আমি স্পষ্ট কথাই বলতে চাই, আর শুনতে চাই৷’

-‘সাধু, সাধু!’

-‘আবার ব্যঙ্গ? বলো কেন তুমি এখানে এসেছিলে?’

-‘তোমার প্রশ্ন যে আর একটা নূতন হুকুমের মতন শোনাচ্ছে!’

-‘হ্যাঁ, তাই৷ কেন এখানে এসেছিলে?’

-‘যদি না বলি?’

-‘বধ করব!’

-‘যদি বলি?’

-‘তাহলেও তোমরা বাঁচবে না৷’

– ‘হরেদরে সেই হাঁটু জল?’

-‘হাঁটু জল নয় বাবা, গভীর জল!’

-‘বুঝলুম না৷’

-‘তোমাদের হাত-পা বেঁধে, থলেয় পুরে এই বাগানের পুকুরে গভীর জলে নিক্ষেপ করব৷’

-‘খাসা! মৃত্যুটা রোমান্টিক হবে বলে মনে হচ্ছে৷’

-‘শোনো মহাগোয়েন্দা জয়ন্ত!’

-‘কী হুকুম জনাব?’

-‘তোমরা এখানে কেন এসেছিলে আমার মুখেই শুনবে?’

-‘জনাব হাত গুনতে জানেন?’

-‘ওরে হাঁদারাম, আমি হাত গুনতে জানি না৷ আমি জানি দুইয়ের সঙ্গে দুই যোগ করলে চার ছাড়া কিছুই হতে পারে না৷’

-‘অপূর্ব আবিষ্কার৷’

-‘আবিষ্কার নয়রে, সহজ সত্য৷’

-‘সত্য কোনোদিনই সহজ নয়৷’

-‘তাই নাকি?’

-‘হ্যাঁ৷ সত্য সহজ হলে খ্রিস্টদেবকে ক্রসে বিদ্ধ হয়ে প্রাণ দিতে হত না৷’

-‘তুমি খালি মহাগোয়েন্দা নও, মহাদার্শনিকও৷’

-‘দর্শন-অর্থাৎ ভালো করে দর্শন করাই হচ্ছে গোয়েন্দার প্রধান আর প্রথম কর্তব্য৷’

-‘তাহলে শোনো৷ আজ সকালে তোমার চর্মচক্ষু যা দর্শন করেছিল, তা ঠিক নয়?’

-‘কথাটা ভালো করে বুঝিয়ে দাও৷’

-‘তুমি একখানা চিঠি পড়ে এখানে এসেছ তো?’

-‘হ্যাঁ৷’

-‘সেই চিঠিতে বিজয় নামে কোনো ব্যক্তিকে এই বাগানবাড়িতে আসতে বলা হয়েছিল?’

– ‘হুঁ৷’

-‘সেই চিঠিখানা লিখেছিলুম আমিই৷’

-‘তারপর?’

-‘কিন্তু বিজয় নামধারী কোনো ব্যক্তিকেই আমি চিনি না৷’

-‘বটে!’

-‘ওই চিঠির বিজয় হচ্ছে কাল্পনিক ব্যক্তি৷’

-‘এতখানি কল্পনাশক্তি প্রয়োগের কারণ কী?’

-‘আমি তোমাকে ভুলিয়ে এখানে আনতে চেয়েছিলুম৷’

-‘ভুলিয়ে?’

-‘হ্যাঁ৷ চিঠিসুদ্ধু চশমার খাপখানা আমরা ইচ্ছে করেই সেখানে ফেলে রেখে এসেছিলুম৷ কারণ আমি জানতাম, চিঠিখানা তোমাদের হস্তগত হবেই৷’

-‘তোমার কথা শুনে কবি মাইকেলের ভাষায় কথা বলতে সাধ হচ্ছে-তব বাক্যে ইচ্ছা মরিবারে৷ আমাকে এখন গাধা বললেও রাগ করব না৷’

-‘ফাঁদে পা দিয়েছ৷ এখন আর আত্মলাঞ্ছনা করে লাভ নেই৷’

-‘আমার মতন গাড়োলের বেঁচে থাকা উচিত নয়৷’

-‘তা তুমি বাঁচবেও না৷ তুমিও না, তোমার বন্ধুও নয়৷’

-‘কিন্তু তোমার এ আদেশ আমি শিরোধার্য করতে রাজি নই৷’

-‘দেখা যাবে৷ এই সঙ্গে ভুঁদো সুন্দর গোয়েন্দাকেও যমালয়ের পথে পাঠাতে পারলে সুখী হতুম৷ তার উপরে আমার অনেক দিনের রাগ৷’

-‘যাক, তোমার একটা পরিচয় পাওয়া গেল৷ সুন্দরবাবুর উপর তোমার অনেক দিনের রাগ, তাহলে তুমি একজন পুরোনো পাপী, তোমার নাম জানা আর অসম্ভব হবে না৷’

-‘মূর্খ, নাম জানবার সময় পাবে কখন? তুমি যে কালকে সূর্যোদয় পর্যন্ত দেখতে পাবে না৷’

-‘তোমার এ ধারণা ভ্রান্ত৷’

দু-রকম গলায় শোনা গেল একজনের অট্টহাস্য৷ তারপর হঠাৎ হাসি থামিয়ে সে বললে, ‘ধারণা ভ্রান্ত! মরবার ভয়ে তোর মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি রে?’

-‘মরব না আমি, মরবে তুমি৷’

-‘আমায় কে মারে?’

-‘সুন্দরবাবু৷’

-‘কোথায় সে?’

-‘এইখানে, এই বাগানে৷’

-‘আমি কি প্রলাপ শুনছি৷’

-‘মোটেই নয়৷ ওই শোনো সুন্দরবাবুর গলা৷ তিনি সদলবলে তোমাদের গ্রেপ্তার করতে আসছেন৷’

-‘কই, আমি কারুর গলাই শুনছি না৷’

জয়ন্ত চিৎকার করে ডাকলে, ‘সুন্দরবাবু, সুন্দরবাবু!’

দূর থেকে সাড়া এল, ‘যাচ্ছি ভায়া, কোনো ভয় নেই৷’

-‘সুন্দরবাবু শিগগির আসুন৷’

আরও কাছ থেকে সাড়া এল-‘এই যে আমরা এসে পড়েছি৷’

পর মূহূর্তে দ্রুত পদশব্দ তুলে ঘরের লোকগুলো বাইরে পলায়ন করলে দারুণ আতঙ্কে৷

মানিক সবিস্ময়ে বললে, ‘সুন্দরবাবুকে তুমি কখন খবর দিলে?’

অন্ধকারে মৃদু হাস্য করে জয়ন্ত বললে, ‘কোথায় সুন্দরবাবু? তুমি কি ভুলে গিয়েছ, আমি ভেন্ট্রিলোকুইজম জানি? এদেশি ভাষায় তার একটি গালভরা নাম আছে-দূরাগতশব্দানুকরণ বিদ্যা! দেখছ তো ভায়া, যথাসময়ে সব বিদ্যাই কাজে লাগে!’

সুন্দরবাবু নিদ্রাচর নন

জয়ন্তদের চায়ের আসর৷ তরল পানীয়ের সঙ্গে নিরেট খাবারেরও অভাব নেই-স্যান্ডউইচ, নিমকি, ডিম, কেক৷ জয়ন্ত ও মানিক চায়ের সঙ্গে দুই টুকরো টোস্ট পেলেই তৃপ্ত হত, কিন্তু এই প্রভাতি চায়ের বৈঠকটিকে প্রত্যহই অলংকৃত করতেন সুন্দরবাবু৷ তাঁর কথা স্বতন্ত্র৷ ভূরিভোজন ছাড়া তাঁর অসাধারণ উদরদেশটি পুলকিত হতে চাইত না কোনোদিন৷

যথাসময়ে সুন্দরবাবুর প্রবেশ৷ এসেই তিনি বলে উঠলেন, ‘হুম! চা-টা শুরু হয়ে গেছে দেখছি৷ যা কাজের ভিড়! ঘড়ির কাঁটা ধরে আসা অসম্ভব৷’

মানিক বললে, ‘সাধু সুন্দরবাবু, সাধু! কাল রাতে আমাদের জন্যে অত খাটুনি খেটেও আজ সকালেই আবার কাজের ভিড়ের ভিতরে গিয়ে ঢুকে পড়েছেন? ধন্য আপনার কর্তব্যনিষ্ঠা!’

সুন্দরবাবু দস্তুরমতো ভয় করতেন মানিকের মুখরতাকে৷ মনে মনে সে কী নতুন দুষ্টুমির ফন্দি আঁটছে বুঝতে না পেরে তিনি বললেন, ‘কাল রাতে আমি আবার তোমাদের জন্যে কখন খেটে মরেছি? তুমি কি সকালের কথা বলছ? হ্যাঁ, কাল সকালে আমি দু-দু-বার রামআছাড় খেয়েছি বটে৷ গায়ের ব্যথা এখনও মরেনি৷’

মানিক বললে, ‘না, না, আমি কালকের রাতের কথাই বলছি৷’

সুন্দরবাবু হতভম্বের মতন বললেন, ‘মানিক কী বলতে চায় জয়ন্ত? কাল রাতে আমি তো শয্যাশায়ী ছিলাম, গায়ের ব্যথা কমাবার জন্যে স্ত্রীকে বার বার ওষুধ মালিশ করে দিতে হয়েছিল৷’

জয়ন্ত হাসতে হাসতে বললে, ‘হ্যাঁ সুন্দরবাবু, কাল রাত্রে আমরা প্রাণে বেঁচেছি কেবল আপনার জন্যেই৷ তা সেকথা পরে হলেও চলবে, আগে আপনি চা খান, চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে!’

-‘হোক গে চা ঠান্ডা৷ তোমাদের আজব কথা শুনে এদিকে যে আমার মাথা গরম হয়ে উঠেছে৷ কাল রাত্রে আমি তোমাদের প্রাণ বাঁচাবার কোনো চেষ্টাই করিনি৷’

মানিক গদগদ কন্ঠে বললে, ‘আহা, আমাদের সুন্দরবাবু কি বিনয়ী!’

-‘বিনয়ের নিকুচি করেছে! আমি হলপ করে বলতে পারি, কাল সন্ধ্যা থেকে আজ সকাল পর্যন্ত বিছানা ছেড়ে একবারও নামিনি৷’

-‘সুন্দরবাবু, ভয়ে ভয়ে একটা কথা বলব?’

-‘কথা আবার কী?’

-‘আপনি সোমন্যামব্যুলিস্ট নন তো?’

-‘মানে?’

-‘আপনার নিদ্রাভ্রমণের ব্যাধি নেই তো?’

-‘ও ব্যাধি শত্রুর হোক৷ তোমার হলেও আমি দুঃখিত হব না৷’

-‘আমি কি আপনার শত্রু?’

-‘মাঝে মাঝে আমার সেই সন্দেহই হয়!’

-‘আচ্ছা সুন্দরবাবু, আপনি কি বলতে চান, কাল রাতে বেহালার এক বাগানবাড়িতে আপনারা পাহারা দিতে যাননি?’

-‘অসম্ভব মিথ্যা কথা!’

-‘সেই বাগানে একদল লোকের হাতে আমরা হয়েছিলাম বন্দি৷ আপনিই আমাদের উদ্ধার করে এনেছেন৷’

-‘আরব্য উপন্যাসের যেকোনো গল্প এর চেয়ে সত্য৷ তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে মানিক!’

-‘জয়ন্ত আমার সাক্ষী৷’

-‘শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল৷’

জয়ন্ত হো-হো করে হেসে উঠে বললে, ‘রাগ করবেন না সুন্দরবাবু৷ আসুন, এই চেয়ারে এসে বসুন৷ এই নিন স্যান্ডউইচ, এই নিন নিমকি, ডিম, কেক৷ এইবারে খেতে খেতে চুপ করে আমার কথা শুনুন৷ মানিক একেবারে অমূলক কথা বলছে না৷’

সুন্দরবাবু খাবারের থালার দিকে হাত বাড়িয়েছিলেন, কিন্তু আবার হাতখানা টেনে নিয়ে ক্রুদ্ধকন্ঠে বলে উঠলেন, ‘তোমারও মতে মানিক সত্য কথাই বলছে? তাহলে এই রইল তোমার চায়ের পেয়ালা, এই রইল স্যান্ডউইচ আর যত কিছু ঘোড়ার ডিম৷ হুম! এই পাগলগারদ ছেড়ে আমি এখন থানায় পলায়ন করতে চাই!’

-‘আরে শুনুন মশাই, শুনুন৷ আপনি ঘটনাস্থলে স্বশরীরে হাজির থেকে আমাদের বাঁচাননি বটে, কিন্তু আমরা প্রাণে বেঁচেছি আপনারই নামের জোরে৷’

-‘বটে! তাই নাকি? সুন্দরবাবু আবার বাহুবিস্তার করলেন, তারপর একখানা গোটা স্যান্ডউইচ বদনবিবরে নিক্ষেপ করে বললেন, ‘আচ্ছা, তাহলে তোমাদের কাহিনি শুনতে আমি নারাজ নই, বলো!’

জয়ন্তের কাহিনি শুনতে শুনতে সুন্দরবাবু দুই চক্ষু ক্রমেই বিস্ফারিত হয়ে উঠতে লাগল৷ তিনি আহার্য গ্রহণ করতেও ভুলে গেলেন, মুখব্যাদন করে অবাক হয়ে কেবল গল্পই শুনতে লাগলেন৷ তারপর জয়ন্তের গল্প ফুরোল এবং শুরু হল সুন্দরবাবুর হো-হো-হো-হো হাসির ঘটা৷ দুই হাতে ভুড়ি চেপে ধরেও তিনি মিনিট তিনেকের আগে দমন করতে পারলেন না সেই সর্বনেশে হাসির বিষম ধাক্কা৷

অনেক কষ্টে আত্মস্থ হয়ে সুন্দরবাবু বললেন, ‘জয়ন্ত আমি স্বীকার করছি, তুমি একটি জিনিয়াস৷ একেই বলে শূন্যহাতে কড়ি খেলা! তোমার প্রত্যুৎপন্নমতি হচ্ছে বিস্ময়কর৷ কিন্তু বড়োই দুর্ভাগ্যের বিষয় ভায়া, অপরাধীদের পালের গোদাকে একবারও তুমি দেখতে পেলে না৷’

-‘সে জন্যে দায়ী অন্ধকার৷’

-‘কী বললে? লোকটার গলার আওয়াজ আধাকর্কশ আধা-কোমল?’

-‘হ্যাঁ৷ শুনলে মনে হয়, এক জন মানুষ যেন দু-জনের গলায় কথা কইছে৷ এরকম কন্ঠস্বর আমি জীবনে আর কখনো শুনিনি৷ আপনি শুনেছেন?’

-‘কই মনে পড়ছে না তো!’

-‘ভালো করে মনে করে দেখুন৷ সে আপনাকে চেনে৷ আপনার উপরে তার ভারি আক্রোশ৷ আমার দৃঢ় বিশ্বাস সে হচ্ছে পুরাতন পাপী, কখনো-না-কখনো আপনার পাল্লায় গিয়ে পড়েছিল, আর আপনার কাছ থেকে জামাই আদর সে পায়নি৷’

সুন্দরবাবু স্মৃতিসাগরে নিজের মনকে ডুবিয়ে দিয়ে খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন৷ কিন্তু তাঁর মন স্মৃতিসাগর আলোড়িত করেও নূতন কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে পারলেন না৷

জয়ন্ত বললে, ‘বেশ, তাহলে আর এক কাজ করবেন৷ সেই বাগানবাড়িখানার আশেপাশে পুলিশের গুপ্তচর মোতায়েন রাখবেন৷’

-‘বেশ, পাহারার ব্যবস্থা করব৷’

হঠাৎ বেজে উঠল টেলিফোনের ঘণ্টা৷ জয়ন্ত ফোন ধরে বললে, ‘হ্যালো!’

মিনিট খানেক পরে ফোন ছেড়ে দিয়ে জয়ন্ত তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে পাশের দেয়াল আলনা থেকে জামাটা টেনে নিয়ে বললে, ‘সুন্দরবাবু উত্তিষ্ঠিত! জাগ্রত! নিমতলার শ্মশানে এইমাত্র একটা আগুনে-পোড়া মৃতদেহ এসেছে৷ চলো মানিক, জলদি৷’

কালো, রোগা, ঢ্যাঙা

নিমতলার শ্মশান৷ সুন্দরবাবুর সঙ্গে জয়ন্ত ও মানিক মোটর থেকে নেমে পড়ল৷ কিন্তু আবার ব্যর্থতা৷ একটা পুড়ে-মরা মানুষের লাশ পাওয়া গেল বটে, কিন্তু সেই মৃতদেহটা নিয়ে যারা এখানে এসেছিল, তাদের কোনোই পাত্তা পাওয়া গেল না৷

পুলিশের যে জমাদারকে শ্মশানের উপরে নজর রাখবার জন্যে নিযুক্ত করা হয়েছিল তার দিকে ফিরে সুন্দরবাবু বললেন, ‘তুমি কি বাপু সাক্ষী গোপালের মতো হাঁ করে তাকিয়ে বসে বসে গঙ্গার ঢেউ গুনছিলে?’

জমাদার বললে, ‘আমার কোনো দোষ নেই হুজুর৷ লাশ তো আমিই আটকেছিলুম৷’

-‘যারা লাশ এনেছিল তাদের আটকালে না কেন?’

-‘তারা ডাক্তারের সার্টিফিকেট দেখালে৷ আমি বললুম, ওতেও চলবে না৷ থানার বড়োবাবু এসে যদি হুকুম দেন, তবেই তোমরা লাশ পোড়াতে পারবে৷ তাদের একজন বললে, বেশ, লাশ এখানেই রইল, আমরা লরিতে বসে তোমাদের বড়োবাবুর জন্যে অপেক্ষা করছি৷’

-‘লরি?’

-‘হ্যাঁ হুজুর৷ মড়াটা এনেছিল তারা একখানা লরির উপরেই চাপিয়ে৷’

-‘তারপর?’

-‘তারা আবার লরির উপরে গিয়ে উঠল৷ তারপর লরিখানা হুস করে ছুটে চোখের আড়ালে চলে গেল৷’

-‘আর তুমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলে?’

-‘তা ছাড়া আর কী করব হুজুর? মানুষ তো লরির সঙ্গে ছুটতে পারে না৷’

-‘লরিতে ক-জন লোক ছিল?’

-‘চার জন৷’

-‘তাদের আবার দেখলে চিনতে পারবে?’

-‘সবাইকে ভালো করে দেখবার সময় পাইনি৷ তবে যে লোকটা আমার সঙ্গে কথা কইছিল, তার চেহারা আমার মনে আছে৷’

-‘সে কীরকম দেখতে?’

-‘খুব কালো, খুব রোগা আর খুব ঢ্যাঙা; চোখে কালো চশমা৷’

-‘হুম! জয়ন্ত, শুনছ?’

-‘শুনছি৷ কিন্তু শুনে কী হবে, তাকে তো ধরতে পারলুম না!’

-‘তারপর জমাদার, তুমি ডাক্তারের সার্টিফিকেটের কথা কী বলছিলে না?’

-‘হ্যাঁ হুজুর, এই নিন সেই সার্টিফিকেট৷’

জয়ন্ত বললে, ‘সুন্দরবাবু, ও নিয়ে মাথা ঘামিয়ে আর সময় নষ্ট করবেন না৷ আমি হলপ করে বলতে পারি ওখানা হচ্ছে জাল সার্টিফিকেট৷ তার চেয়ে লাশটাকে দেখবেন চলুন যদি কোনো সূত্র পাওয়া যায়৷’

শ্মশানের আঙিনার উপরে ছিল মৃতদেহটা৷ মড়াটাকে পাহারা দিচ্ছিল একজন জীবন্ত লালপাগড়ি৷ খাটের উপর থেকে নূতন কাপড়ের আবরণ সরিয়ে দেখা গেল একটা ভয়াবহভাবে অগ্নিদগ্ধ মানুষের বিকৃত দেহ৷

সুন্দরবাবু বললেন, ‘এখন এই লাশটাকে কী করা যায় জয়ন্ত?’

-‘মর্গে পাঠিয়ে দিন৷ এর ফটো তুলে কাগজে বিজ্ঞাপন দিন; দেখুন যদি কেউ শনাক্ত করতে পারে৷’

-‘তুমি নূতন কোন সূত্র-টুত্র আবিষ্কার করতে পারলে?’

-‘উঁহু৷’

-‘এখন কী করতে চাও?’

-‘সূত্র আবিষ্কারের জন্য অন্য কোথাও যাত্রা করতে চাই৷’

-‘সে কোথায়?’

-‘বরেনবাবুর বাড়িতে৷’

-‘সেখানকার সব সূত্র তো অগ্নিদেব গ্রাস করেছেন৷’

-‘আমি জানতে চাই, বরেনবাবুর ছোটো ভাই কলকাতায় এসেছেন কি না?’

-‘নরেন্দ্রসুন্দর রায়চৌধুরী?’

-‘হ্যাঁ৷’

-‘বেশ, চলো৷’

সকলে মোটরে গিয়ে উঠল৷ খানিক পরেই গাড়ি বরেনবাবুর বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল৷ তখনও সেখানে আগুন জ্বলছিল না বটে, কিন্তু সেই অসম্পূর্ণ বাড়িখানার চারিদিকেই বিরাজমান ক্রুদ্ধ অগ্নিশিখার কালো দংশনচিহ্ন৷

-‘সদর দরজার চৌকাঠের উপরে ম্রিয়মান মুখে উপুড় হয়ে বসেছিল বরেনবাবুর প্রিয় ভৃত্য৷’

মানিক শুধোলে, ‘কী হে, তোমাদের ছোটোবাবু খবর পেয়ে দেশ থেকে এসেছেন?’

-‘আজ্ঞে হ্যাঁ, আজ সকালেই এসেছেন৷’

-‘আর কে এসেছেন?’

-‘আর কেউ না৷ খবর শুনে গিন্নিমা পাগলের মতো হয়ে গিয়েছেন৷ তিনি আসতে পারেননি৷’

-‘আমরা নরেনবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি৷’

-‘তিনি তো এখানে নেই৷’

-‘তবে কোথায় আছেন?’

-‘বাবুর ছোটো বোনের বাড়িতে৷’

-‘অন্নপূর্ণা দেবীর বাড়িতে?’

-‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷’

মানিক ফিরে বললে, ‘জয়ন্ত অন্নপূর্ণা দেবীর বাড়ি আমি চিনি৷ সেখানে বার-দুয়েক নিমন্ত্রণ খেয়ে এসেছি৷’

-‘উত্তম৷ তুমিই আমাদের পথপদর্শক হও৷ আমাদের কোথায় যেতে হবে?’

-‘বারাণসী ঘোষ স্ট্রিট৷’

সুন্দরবাবু গজগজ করে বললেন, ‘আমরা যেন স্রোতের শ্যাওলা ক্রমাগতই ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছি৷ শেষ পর্যন্ত ভাসতে ভাসতে কোথায় গিয়ে যে ঠেকব বাবা, তা ভগবানও জানেন কি না সন্দেহ!’

মানিক বললে, ‘দুনিয়ার মালিক ভগবানের হাতে অনেক কাজ৷ আমরা কোথায় ঠেকব কি ঠেকব না, তা নিয়ে ভাববার সময় তাঁর নেই৷’

গাড়ি প্রবেশ করল বারাণসী ঘোষ স্ট্রিটের ভিতরে৷

মানিক বললে, ‘ওই বাড়িখানা, ওই যে সামনে একখানা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে৷’

অন্নপূর্ণা দেবীর বাড়ির ভিতর থেকে একজন লোক বেরিয়ে এসে ট্যাক্সির উপরে চড়ে বসল৷ ট্যাক্সিখানা সচল হয়ে জয়ন্তদের গাড়ির পাশ দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল৷

আচম্বিতে জয়ন্তও নিজের গাড়ির মোড় ফিরিয়ে নিলে৷

মানিক সবিস্ময়ে বললে, ‘ও কি, কোথা যাও?’

জয়ন্ত বললে, ‘ওই ট্যাক্সির পিছনে৷’

-‘কেন হে?’

-‘দেখতে পেলে না, সেই খুব কালো, খুব রোগা আর ঢ্যাঙা লোকটা৷’

ঘুঘুর চাতুরি

মোটরের মোড় ফিরিয়েই জয়ন্ত দেখল, ট্যাক্সিখানা হঠাৎ ডান দিকের একটা রাস্তা ধরে স্যাঁৎ করে অদৃশ্য হয়ে গেল৷ জয়ন্তও সেই রাস্তা ধরলে৷

ট্যাক্সির গতি তখন হয়ে উঠেছে দ্রুততর৷ জয়ন্তদের মোটরেরও গতি বেড়ে উঠল৷ দু-খানা গাড়ির সেই মারাত্মক দৌড় দেখে সচকিত পথিকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়ল দিকে দিকে৷

সুন্দরবাবু উত্তেজিত কন্ঠে বললেন, ‘হা-রে-রে-রে কালো চশমা, আজ তোকে খাপে না পুরে ছাড়ব না৷ বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান; এবার বধিব আমি তোমার পরাণ৷ হুম হুম হুম! আরও জোরে জয়ন্ত, আরও জোরে৷’

মানিক বললে, ‘না, আরও জোরে নয়৷ আরও জোরে গাড়ি ছোটালে ঘুঘু বধের আগেই পথের পথিক বধ হবে৷’

জয়ন্ত বললে, ‘ঠিক বলেছ মানিক৷ খুনি ধরতে গিয়ে আমরাও মানুষ খুন করব নাকি? তার চেয়ে তুমি এক কাজ করো, ট্যাক্সিখানা রিভলবারের নাগালের বাইরে যায়নি৷ তুমি গুলি ছুড়ে ওর টায়ার ফুটো করে দাও, পারবে?’

মানিক রিভলবার বার করে ঘোড়া টিপলে, এক বার, দুই বার, তিন বার৷ তৃতীয় গুলি বিদ্ধ করলে একখানা টায়ারকে৷ দুম করে জাগল এক আর্তনাদ৷ ট্যাক্সির দৌড় বন্ধ৷ তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল জয়ন্তদের মোটর৷

গাড়ি থেকে নেমে ট্যাক্সির হুডের তলায় মাথা চালিয়ে হতভম্ব সুন্দরবাবু বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠলেন, ‘আরে এ যে ভানুমতীর খেল! কোথায় সেই বেটা কালো চশমা?’

জয়ন্ত তিক্ত হাসি হেসে বললে, ‘আপনার ঘুঘু এবারেও ফাঁকি দিয়েছে ফাঁদকে৷’

-‘কিন্তু কেমন করে?’

-‘ট্যাক্সির ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করুন৷’

-‘এই উল্লুক, এই ড্রাইভার!’

-‘হুজুর!’

-‘আর হুজুর বলে আদিখ্যেতা করতে হবে না৷ সোজা জবাব দে৷ তোর বাবু বেটা গেল কোথায়?’

-‘ও রাস্তা থেকে মোড় ফিরতেই বাবু আমার দিকে তিনখানা দশ টাকার নোট ছুড়ে দিয়ে লাফিয়ে পড়ে বললেন, ‘ভাড়া আর বকশিস৷ জোরসে গাড়ি চালাও, থেমো না৷’

-‘আর তুমিও তার হুকুমে ভোঁ দৌড় মারলে?’

-‘দু-তিন টাকার জায়গায় ত্রিশ টাকা পেলে কে না শোনে হুজুর?কিন্তু আমার লাভের গুড় পিঁপড়েয় খেয়েছে, আপনারা আমার টায়ার ফাটিয়ে দিয়েছেন৷’

-‘বেশ করেছি, খুব করেছি৷ এখনও তোর মাথা ফাটাইনি এই তোর ভাগ্যি৷’

-‘আমার মাথা ফাটাবেন কেন হুজুর?’

-‘ডাঙায় এসে তুই নৌকা ডুবিয়ে দিলি বলে৷’

-‘আমি? আমি কিছুই জানি না হুজুর, ও বাবুকে এর আগে কখনো চোখেও দেখিনি৷’

-‘বেশ, থানায় গিয়ে ওকথা বলিস৷’

-‘আমি কেন থানায় যাব?’

সুন্দরবাবু জবাব দিলেন না৷ তখন গাড়ি ঘিরে ভিড় করে দাঁড়িয়ে ছিল অনেক কৌতূহলী লোক৷ একজন পাহারাওয়ালাও ছিল৷ সুন্দরবাবু তারই হাতে সঁপে দিলেন ট্যাক্সিওয়ালাকে৷

সুন্দরবাবু বললেন, ‘আমার কী মনে হচ্ছে জানো? খুনি আমাদের জয়ন্তের চেয়েও চালাক৷’

-‘খুনি জয়ন্তের চেয়েও চালাক কি না জানি না, কিন্তু আপনার চেয়ে যে চালাক, সে বিষয়ে আর একটুও সন্দেহ নেই৷’

-‘যা মুখে আসে বলো বাবা, বলো৷ তোমার কাছে আমি ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো ছাড়া তো আর কিছু নই৷’

-‘যা বললুম, সত্য৷’

-‘প্রমাণ দাও৷’

-‘যা স্বপ্রকাশ তার জন্যে প্রমাণের দরকার নেই৷’

-‘মানে?’

-‘দুপুর রৌদ্রেও আকাশে সূর্য আছে কি না জানবার জন্যে কেউ প্রমাণের খোঁজ করে না৷’

সুন্দরবাবু ক্রোধ কম্পিত কন্ঠে বললেন, ‘আরে রেখে দাও তোমার বাগাড়ম্বর, আমি খুনির মতো চালাক না হতে পারি, কিন্তু তোমার মতো নিরেট গর্দভ নই৷’

জয়ন্ত নিজের মনে কী চিন্তা করছিল৷ হঠাৎ সে প্রশ্ন করলে, ‘মানিক, তোমার কি বিশ্বাস, আমরা নতুন কোনো সূত্র পাইনি?’

-‘তাই তো আমার ধারণা৷’

-‘তোমার ধারণা ভ্রান্ত৷’

-‘কেন?’

-‘বুঝিয়ে দিচ্ছি৷ তার আগে বলো দেখি, অন্নপূর্ণা দেবী বরেনবাবুর কোন বোন৷’

-‘সধবা ছোটো বোন৷’

-‘তাঁর সন্তান আছে?’

-‘না৷’

-‘তুমি বলেছিলে বরেনবাবুর মৃত্যুর পরে তাঁর ভাই নরেনবাবুই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন৷’

-‘হ্যাঁ৷’

-‘নরেনবাবুর সন্তানাদি কী?’

-‘তিনি বিবাহই করেননি৷’

-‘জুয়া খেলে, তিনি সম্পত্তির অধিকাংশই উড়িয়ে দিয়েছেন৷’

-‘হ্যাঁ৷’

-‘তাহলে এখন তাঁর টাকার টানাটানি৷’

-‘খুব সম্ভব তাই৷’

-‘এখনও তাঁর জুয়ার নেশা আছে?’

-‘থাকতে পারে, আমি ঠিক জানি না৷ কিন্তু তুমি এসব প্রশ্ন করছ কেন?’

-‘মানিক একটু মাথা ঘামাও৷ ভালো করে ভেবে দেখো, নরেনবাবু যে বাড়িতে এসে উঠেছেন, সেখান থেকে ওই কালো চশমা পরা রোগা আর ঢ্যাঙা লোকটা বেরিয়ে এল কেন! ও যে খুনিদের দলের লোক, তাতে আর কোনোই সন্দেহ নেই৷ কিন্তু ওই বাড়ির সঙ্গে ওর কীসের সম্পর্ক? ও লোকটা অন্নপূর্ণা দেবীর স্বামী নয় তো?

-‘নিশ্চয়ই নয়! অন্নপূর্ণা দেবীর স্বামীকে আমি চিনি৷’

-‘তবে কি ও লোকটা নরেনবাবুর বন্ধু?’

-‘আমি জানি না৷’

-‘কিন্তু জানতে হবে মানিক, জানতেই হবে৷ সর্বাগ্রে ওইটাই জানা দরকার৷ আজ একটা বড়ো সূত্র পেলুম৷ চলো নরেনবাবুকে নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করে আসি৷ বন্ধু, মানুষ চেনা বড়ো কঠিন৷’

যা করেন মা কালী

পথে আসতে আসতে সুন্দরবাবু হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘ঠিক, ঠিক, ঠিক৷’

মানিক সচমকে বললে, ‘কী ব্যাপার? সুন্দরবাবুর মগজের ভিতরে ঝড় উঠল নাকি?’

-‘ঝড় নয় মূর্খ, ঝড় নয়৷’

-‘তবে?’

-‘আমি চিন্তা করছিলুম৷’

-‘চিৎকার করে কেউ চিন্তা করে নাকি?’

-‘চিৎকার করে কেউ চিন্তা করে না বটে, কিন্তু চিন্তা করবার পর লোকে অনায়াসেই চিৎকার করতে পারে৷’

-‘বেশ চিন্তামণি মশাই, আপনার মূল্যবান চিন্তাটা কী শুনি?’

-‘এ না হয়েই যায় না৷’

-‘কী না হয়ে যায় না?’

-‘ওই নরেনবাবু-‘

-‘হ্যাঁ, বলুন৷’

-‘ওই নরেনবাবুটির উপরে আমার ভীষণ সন্দেহ হচ্ছে৷’

-‘কেন?’

-‘জয়ন্ত ঠিক আন্দাজ করেছে৷ নরেনবাবু লোকটি বড়ো সহজ মানুষ নয়৷ খুনিদের দলের সঙ্গে যে সম্পর্ক পাতায়-‘

বাধা দিয়ে মানিক বললে, ‘থামুন৷ আপনার চিন্তার দৌড় বুঝতে পেরেছি৷ আপনার চিন্তাকে এত বেশি দৌড়াদৌড়ি করতে দেবেন না, হোঁচট খেয়ে শেষটা সে খোঁড়া হয়ে যেতে পারে৷’

-‘বাক্যবাণ ছোড়বার জন্যে তুমিও অত বেশি জিভ নেড়ো না বাপু, জিভখানা শেষে খসে পড়তে পারে৷’

দু-জনেরই মুখ বন্ধ হল৷ গাড়ি আবার এসে থামল অন্নপূর্ণা দেবীর বাড়ির দরজায়৷

বেয়ারা মানিককে চিনত৷ সকলকে বৈঠকখানায় বসিয়ে নরেনবাবুকে খবর দিতে গেল৷

কিছুক্ষণ পরে ঘরের ভিতরে নরেনবাবুর প্রবেশ৷

সুন্দর চেহারা৷ একহারা, কিন্তু মানানসই দেহ, টকটকে রং, চোখ-নাক-ঠোঁট যেন তুলি দিয়ে আঁকা৷ সূক্ষ্ম একটি গোঁফের রেখা৷ মুখখানি যেন সরলতার প্রতীক৷ কিন্তু তার ভাবভঙ্গি আজ বিষাদের দ্বারা আচ্ছন্ন৷

সকলের উপরে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে নরেন বললে, ‘এই যে মানিকবাবু, নমস্কার৷ এঁরা কারা?’

জয়ন্ত ও সুন্দরবাবুর পরিচয় দিলে মানিক৷ নরেনের দুই ভুরু সংকুচিত হল৷ সে বললে, ‘আমার মন আজ ভালো নয়, বেশিক্ষণ কথা কইতে পারব না, এজন্যে অপরাধ নেবেন না৷’

জয়ন্ত এতক্ষণ দেওয়ালের একখানা বড়ো আয়নার ভিতরে প্রতিবিম্বিত নরেনের মূর্তির দিকে তাকিয়ে ছিল তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে৷ সে ফিরে বললে, ‘আজ আপনাকে বেশিক্ষণ কষ্ট দেব না৷ আপনার কাছে এসেছি কেবল একটি কথা জানবার জন্যে৷’

-‘কী কথা বলুন৷’

-‘আজ এই বাড়িতে একটি লোক এসেছিল, তারই পরিচয় জানতে চাই৷’

-‘আমি কলকাতায় এসেছি শুনে, আজ সকাল থেকেই তো এখানে অনেক লোক আনাগোনা করছেন৷ আপনি কার কথা জানতে চান?’

-‘প্রায় ঘণ্টা খানেক আগে এখানে একটি লোক এসেছিল৷’

-‘ঘণ্টা খানেক আগে জন-তিনেক লোক আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল৷’

-‘আমি যার কথা বলছি সে একখানা ট্যাক্সিতে চড়ে এসেছিল৷ সে খুব কালো, খুব রোগা আর ঢ্যাঙা৷ তার চোখে কালো চশমা৷’

-‘ও, বুঝেছি৷ কিন্তু তাকে আমি চিনি না৷’

-‘চেনেন না?’

-‘না৷ সে কেবল একখানা চিঠি দিতে এসেছিল৷’

-‘চিঠি? কার চিঠি?’

-‘তাও বলতে পারব না৷’

-‘কেন?’

-‘পত্রলেখক পত্রে নিজের নাম সই করেনি৷ কিন্তু পত্রখানা রহস্যময়৷’

-‘চিঠিখানা একবার দেখতে পারি৷’

নরেন ইতস্তত করে বললে, ‘পত্রলেখক চিঠির কথা কারুর কাছে প্রকাশ করতে বারণ করেছে৷’

এইবার সুন্দরবাবু কথোপকথনে অংশগ্রহণ করলেন৷ বললেন, ‘মশাই আপনার দাদার হত্যাকারীকে আপনি শাস্তি দিতে চান?’

-‘নিশ্চয়!’

-‘বরেনবাবুর হত্যাকারীকে আমরা আবিষ্কার না করে ছাড়ব না৷ এই চিঠিখানার ভিতরে হয়তো কোনো সূত্র থাকতে পারে৷ সুতরাং-‘

-‘বেশ, চিঠিখানা দেখুন তাহলে৷ কিন্তু এর ভিতরে হত্যাকারীর নাম-ধাম কিছুই নেই৷’ নরেন পকেট থেকে একখানা কাগজ বার করে সমর্পণ করলে জয়ন্তের হাতে৷

চিঠিখানা খুলে দুই-তিন পংক্তি পাঠ করেই জয়ন্তের দৃষ্টি হয়ে উঠল সচকিত৷ নিজের পকেটের ভিতরে হাত চালিয়ে সেই কাগজখানা সে বার করলে, বরেনবাবুর বাড়িতে অগ্নিকাণ্ডের সময়ে যেখানা পাওয়া গিয়েছিল চশমার খাপের মধ্যে৷ দু-খানা কাগজের হাতের লেখা মিলিয়ে দেখে জয়ন্ত মৃদু হাস্য করলে যেন আপন মনেই৷ তারপরে সে উচ্চৈঃস্বরে পত্রখানা পাঠ করলে:

‘নরেনবাবু, আপনার দাদার হত্যাকারীর নাম শুনতে চান? তাহলে আজ রাত্রি সাড়ে নয়টা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে বরাহনগরের ২০ নম্বর রতন রায় রোডে আমার বাড়িতে এসে আমার সঙ্গে দেখা করবেন৷ একাই আসবেন৷ আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারতুম, কিন্তু বাড়ি ছেড়ে বেরুলেই আমার বিপদের সম্ভাবনা, কারণ হত্যাকারী আমারও গতিবিধির উপরে লক্ষ রেখেছে৷ সাবধান, পত্রের মর্ম কারুর কাছে প্রকাশ করবেন না৷ ইতি-‘

চিঠিখানা নরেনবাবুর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে জয়ন্ত বললে, ‘তাহলে রাত্রে আপনি পত্রলেখকের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন?’

-‘তাইতো স্থির করেছি৷’

-‘বেশ করেছেন৷ আপনার যাওয়াই উচিত আমার আর কিছু জিজ্ঞাস্য নেই৷ এসো মানিক, আসুন সুন্দরবাবু৷’ পথে এসে গাড়িতে উঠে মোটর চালিয়ে দিয়ে জয়ন্ত বললে, ‘সুন্দরবাবু, রহস্য ক্রমেই ঘনীভূত হয়ে উঠেছে৷’

-‘কীরকম?’

-‘আজকের চিঠি আর সেই চশমার খাপের চিঠি একই লোকের লেখা৷ তার উপরে পত্রবাহকও খুনিদের দলের লোক৷’

-‘আচ্ছা, নরেনবাবুকে তারা কোন উদ্দেশ্যে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে?’

-‘উদ্দেশ্য হয়তো ভালো নয়৷ কিন্তু আমরা ঘটনাস্থলের আশেপাশে লুকিয়ে থাকব৷ আপনি একদল সশস্ত্র পাহারাওয়ালা নিয়ে আসবেন৷ তারপর যা করেন মা কালী!’

রাত সাড়ে নয়টা

বরাহনগর৷ কুড়ি নম্বর রতন রায় রোড৷ একখানা পুরোনো দোতলা বাড়ি, তার চারিদিক ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে বড়ো বড়ো গাছ৷ জমির উপরে গাছগুলোর আশেপাশে ঝোপঝাড়৷ এক সময়ে এখানে বোধ হয় বাগানের অস্তিত্ব ছিল, কিন্তু ফুল গাছদের তাড়িয়ে এখন তাদের স্থান দখল করেছে বেশ একটি ছোটোখাটো জঙ্গল৷

বাড়ির দোতলা একখানা ঘরের ভিতর থেকে বাইরে এসে পড়েছে আলোর রেখা৷ বাড়িতে ঢোকবার পথ আর বড়ো রাস্তার সংযোগস্থলে হ্যারিকেন লন্ঠন হাতে করে দাঁড়িয়েছিল নিশ্চল একটা মূর্তি৷ রাত বোধ হয় তখন নয়টা বাজে৷

এতক্ষণ ঝিঁঝিঁদের একঘেয়ে গান ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছিল না, হঠাৎ স্তব্ধতাকে যেন ধাক্কা মেরে খানিক দূরে বেজে উঠল এক মোটরের ভেঁপু৷ লন্ঠন হাতে নিশ্চল মূর্তিটা চমকে উঠল৷ তারপরেই শোনা গেল একখানা চলন্ত গাড়ির শব্দ৷

ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে একখানা ট্যাক্সি৷ ভিতর থেকে মুখ বাড়িয়ে আছে একজন লোক৷

গাড়িখানা বাড়ির কাছে এসে থামল৷ তার আরোহী লন্ঠনধারী লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলে ‘মশাই, বলতে পারেন, এ বাড়িখানার নম্বর কত?’

-‘কুড়ি৷’

-‘বটে, এই বাড়িখানাই তো আমি খুঁজছি৷’

-‘আপনি কি নরেনবাবু?’

-‘হ্যাঁ, আপনি কী করে জানলেন?’

-‘আপনার জন্যেই তো আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি৷’

-‘আমার জন্যে?’

-‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷ বড়োবাবু আপনাকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যেতে বলেছেন৷’

-‘কে বড়োবাবু?’

-‘আমাদের কর্তা৷ আসুন, গাড়ি নিয়ে ভিতরে আসুন,’ বলেই লোকটা গাড়ির পাদানির উপরে উঠে দাঁড়াল৷

চালক লোকটার নির্দেশমতো গাড়ি চালিয়ে ভিতরে ঢুকে সেই পুরোনো বাড়িখানার সামনে গিয়ে দাঁড়াল৷

লোকটা নেমে পড়ে দরজার কাছে গিয়ে বললে, ‘আসুন নরেনবাবু৷’

নরেন একটু ইতস্তত করে গাড়ি থেকে নেমে বললে, ‘ড্রাইভার!’

-‘হুজুর!’

-‘গাড়ি নিয়ে তুমি অপেক্ষা করো৷ আমি এখনি ফিরে আসছি৷’

-‘যে আজ্ঞে৷’

লোকটার সঙ্গে নরেন বাড়ির ভিতরে ঢুকল৷ সঙ্গেসঙ্গে সদর দরজা বন্ধ হয়ে গেল৷

ট্যাক্সি চালক একবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল৷ তারপর গাড়িখানাকে পিছু হটিয়ে পথের এমন এক জায়গায় এনে দাঁড় করালে, যেখানে দু-পাশেই আছে দুটো বড়ো ঝোপ৷

মিনিট পাঁচেক যায়৷ দূরে কোথা থেকে ভেসে আসছে একটা কোকিলের কুহু স্বর৷ কাছে ঝিঁঝিঁদের গলার উপরে গলা তোলবার চেষ্টা করছে একটা কোলা ব্যাং৷ মাঝে মাঝে হঠাৎ জাগা বাতাসে সবুজ পাতাদের শিহরণ গান৷ তা ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই৷

লন্ঠন হাতে করে একটা লোক আসছে৷ গাড়ির কাছে এসে দাঁড়িয়ে সে চালককে ডেকে বললে, ‘তোমার মিটারে কত ভাড়া উঠেছে?’

-‘কেন?’

-‘নরেনবাবুর ফিরতে দেরি হবে৷ হয়তো আজ রাত্রে তিনি ফিরতে নাও পারেন৷ ভাড়া নিয়ে তিনি তোমাকে চলে যেতে বললেন৷’

-‘বেশ ভাড়া দিন পাঁচ টাকা৷’

লোকটা লন্ঠন তুলে হুমড়ি খেয়ে মিটারে কত ভাড়া উঠেছে দেখবার চেষ্টা করলে৷ কিন্তু পরমূহূর্তেই চালকের প্রচণ্ড ঘুসি গিয়ে পড়ল ঠিক তার চিবুকের উপরে৷ সঙ্গেসঙ্গে টুঁ শব্দ পর্যন্ত করবার সময় না পেয়ে লোকটা হল ধরাশায়ী৷ একেবারে অজ্ঞান!

চালক মৃদুকন্ঠে ডাকল, ‘মানিক!’

পাশের ঝোপ থেকে সাড়া এল, ‘উঁ!’

-‘বেরিয়ে এসো! সুন্দরবাবু!’

-‘হুম!’

-‘আপনিও বেরিয়ে আসুন৷’

-‘এই যে ভায়া৷’

-‘আগে ওই লোকটার হাত-পা মুখ বেঁধে ফেলুন৷ ওর এখনও জ্ঞান হয়নি৷’

‘লোকটাকে বন্দি করতে বেশিক্ষণ লাগল না৷’

চালকবেশী জয়ন্ত বললে, ‘এখানকার সব প্রস্তুত?’

-‘হ্যাঁ৷’

আচম্বিতে বাড়ির ভিতরে জেগে উঠল প্রচণ্ড হট্টগোল৷ একাধিক ব্যক্তির ক্রুদ্ধ চিৎকার৷ তারপরই উপর-উপরি দুই বার রিভলবারের গর্জন! আর্তনাদ! পরমুহূর্তে দোতলার ঘরের আলোটা গেল নিভে৷

জয়ন্ত বললে, ‘আর দেরি নয় সুন্দরবাবু৷ ডাকুন আপনার লোকজনদের৷’

পকেট থেকে বাঁশি বার করে সুন্দরবাবু খুব জোরে দিলেন তিন বার ফুঁ৷

জয়ন্ত দ্রুতপদে বাড়ির দিকে ছুটে গেল-পিছনে পিছনে মানিক৷

অদ্ভুত রহস্য

দু-জনেই দৌড়ে বাড়ির সদর দরজার কাছে হাজির হল৷ দু-জনেরই হাতে প্রস্তুত হয়ে আছে রিভলবার৷

জয়ন্ত বললে, ‘মানিক আমি এখানেই থাকি৷ চরের মুখে শুনেছি, বাড়ির পিছন দিকেও একটা খিড়কির দরজা আছে৷ তুমি সেইখানে গিয়ে পাহারা দাও৷’

-‘তারপর?’

-‘যদি কেহ বাড়ির বাইরে যাবার চেষ্টা করে গুলি করবে-অর্থাৎ প্রাণে মারবে না, কেবল রিভলবার ছুড়ে ভয় দেখাবে৷’

-‘বেশ৷’

-‘সুন্দরবাবু এখনি লোকজন নিয়ে এসে বাড়ি ঘেরাও করে ফেলবেন৷ আমাদের বেশিক্ষণ পাহারা দিতে হবে না৷’

মানিক ছুটে চলে গেল৷

হঠাৎ গুড়ুম শব্দে একটা বন্দুক গর্জন করে উঠল৷ গাছে গাছে কাক ও অন্যান্য পাখিদের ভীত চিৎকার৷

জয়ন্ত আপন মনেই বললে, ‘বন্দুক ছুড়লে কে? শব্দটা এল যেন বাড়ির উপর থেকে! মানিকের কোনো বিপদ হল না তো?’

ধুপ ধুপ করে ভারী ভারী পা ফেলে সুন্দরবাবু ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে এসে কেবল তিন বার বললেন, ‘হুম, হুম, হুম!’

-‘ব্যাপার কী?’

-‘কী কাণ্ড, বাপ!’

-‘কাণ্ড আবার কী?’

-‘মাথার ছ্যাঁদার ভিতর দিয়ে এখুনি প্রাণপক্ষী বর্হিগত হয়ে যেত৷’

-‘বুঝিয়ে বলুন৷’

-‘কোথা থেকে কোন বেটা ত্যাঁদোড় আমার মাথা টিপ করে বন্দুক ছুড়েছিল৷’

-‘গুলি লাগেনি তো৷’

-‘লাগেনি মানে৷ নিশ্চয় লেগেছে, আলবত লেগেছে৷’

জয়ন্ত সবিস্ময়ে বললে, ‘তবু আপনি মাটির উপরে লম্ববান হননি!’

-‘কেন লম্ববান হইনি দেখতে পাচ্ছ না৷ ইতিমধ্যে মাথায় আমি স্টিল হেলমেট পরে নিয়েছি যে৷ ঃউ, নইলে কী সর্বনাশই যে হত!’

-‘ও আলোচনা এখন থাক৷ আপাতত যে বন্দুক ছুড়েছে তাকে ধরতে হবে তো নিশ্চয়ই৷’

এমন সময়ে মানিক এসে বললে, ‘আমার আর খিড়কিতে থাকবার দরকার নেই জয়ন্ত৷ দ্বাররক্ষা করবার জন্যে পাহারাওয়ালারা এসে পড়েছে৷’

-‘খিড়কি দিয়ে কেউ বেরুবার চেষ্টা করেনি?’

-‘জনপ্রাণী না৷’

সুন্দরবাবু পরম আহ্লাদে বললেন, ‘বেটারা তাহলে বাড়ির ভিতরে আছে, এবারে আর আমাদের কলা দেখাতে পারবে না৷ চলো জয়ন্ত, আমার আর তর সইছে না৷’

‘আপনার মাথায় হেলমেট আছে, আপনিই পথ দেখান৷ কেউ যদি গুলি ছোড়ে, হেলমেট দিয়ে ঠেকাবেন৷’

কিন্তু কেউ আর বন্দুক ছুড়ল না, বাড়ির ভিতরটা মৃত্যুর মতো স্তব্ধ৷ একতলার সব ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেও একটা মিশকালো বিড়াল ছাড়া আর কারুর দেখা পাওয়া গেল না৷

জয়ন্ত বললে, ‘এইবারে দোতলা৷ বন্দুকের শব্দটা এসেছিল দোতলা থেকেই৷’

সুন্দরবাবু হলেন পশ্চাৎপদ৷ পাহারাওয়ালাদের ডেকে বললেন, ‘তোমরা আগে আগে যাও৷ যাকে দেখবে তাকে গ্রেপ্তার করবে৷ ভয় নেই আমি তোমাদের পিছনেই আছি৷’

দোতলায় চারখানা ঘর৷ সব ঘরই খাঁ খাঁ করছে৷ কিন্তু একখানা ঘরের রক্তপ্লাবিত মেঝের উপর পড়ে রয়েছে একটা রিভলবার৷

জয়ন্ত বললে, ‘সুন্দরবাবু, আপনারা বাড়ির ছাদটা একবার খুঁজে আসুন৷ আমি এই ঘরেই আছি৷’

ছাদও শূন্য৷ হতভম্ব সুন্দরবাবু হেলমেট খুলে টাক চুলকোতে চুলকোতে নেমে এসে দেখলেন, জয়ন্ত গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে, তার হাতে একটা রিভলবার৷

সুন্দরবাবু বললেন, ‘বেটারা মায়াবী৷ হাওয়া হয়ে হাওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে গিয়েছে৷’

জয়ন্ত বললে, ‘এই রিভলবারটাই আমি নরেনবাবুকে দিয়েছিলুম৷ কিন্তু অস্ত্রটা এখানে ফেলে নরেনবাবু গেলেন কোথায়?’

-‘হুম, সেই বন্দুকধারীই বা কোথায়?’

মানিক বললে, ‘ঘরের মেঝেয় এত রক্ত কার? নরেনবাবুর নয় তো?’

জয়ন্ত বললে, ‘সম্ভবত নয়৷ আমরা রিভলবার ছোড়বার শব্দ শুনেছি দুই বার৷ এই রিভলবারেও ছ-টা ঘরের ভিতরে দুটো ঘরে গুলি নেই৷ আমার বিশ্বাস আত্মরক্ষার জন্যে নরেনবাবুই গুলি ছুড়ে শত্রুদের কারুকে হত বা আহত করেছেন৷’

মানিক বললে, ‘কিন্তু নরেনবাবুই বা কোথায়, আর তাঁর হত কি আহত শত্রুর দেহটাই বা কোথায়? এই বাড়ির ভিতর থেকে সুন্দরবাবুর টাক ফাটাবার জন্যে যে লোকটা বন্দুক ছুড়েছিল, সেও তো তার বন্দুক নিয়ে অদৃশ্য হয়েছে!’

-‘মানিক, মেঝের রক্তের উপরে কতকগুলো পদচিহ্ন রয়েছে দেখো৷ আমি পরীক্ষা করে ছয় জন লোকের পদচিহ্ন পেয়েছি৷ এক জনের পা খুব বড়ো, বোধ হয় মাথাতেও সে খুব ঢ্যাঙা৷’

-‘কী আশ্চর্য! বাড়ির কোনো দরজা দিয়েই লোক বাইরে বেরুতে পারেনি, কিন্তু এতগুলো মানুষ কি শূন্যপথে পাখির মতো উড়ে পালিয়েছে!’

-‘মানিক, এ ঘরের দরজা দিয়েও কেউ বাইরে যায়নি৷’

-‘কেমন করে জানলে?’

-‘তাহলে রক্তাক্ত দেহটা থেকে নির্গত রক্তের ধারা ঘরের বাইরেও দেখতে পাওয়া যেত৷ কিন্তু বাইরে কোথাও এক ফোঁটাও রক্তের দাগ নেই৷’

সুন্দরবাবু মহা বিস্ময়ে দুই ভুরু কপালে তুলে বললে, ‘তাও তো বটে, তাও তো বটে! ঘরের ভিতরে অনেকগুলো লোক ছিল, কিন্তু তারা ঘরের ভিতরেও নেই আর ঘরের বাইরেও যায়নি! অবাক করলে বাবা!’

মানিক বললে, ‘প্রায় আসবাবহীন ঘর৷ চারিদিকে ইটের দেওয়াল৷ একটা টিকটিকিও এখানে লুকিয়ে থাকতে পারে না৷ এ কী সমস্যা?’

জয়ন্ত মুখ টিপে হাসতে হাসতে বললে, ‘এই সমস্যার সমাধান না করে আমি এখান থেকে নড়ব না৷’

ভৌতিক রহস্য

সুন্দরবাবু ঘুরে ঘুরে ঘরের চারিদিক দেখে নিলেন সন্দিগ্ধ চোখে৷ তারপর হেলমেটটা আবার মাথায় পরে ফেললেন৷

মানিক বললে, ‘ওকী মশাই, ওটা আবার মস্তকে ধারণ করলেন কেন?’

-‘এখানে আমরা ছাড়া আর কেউ তো নেই৷’

-‘এখন নেই, কিন্তু এখনি তারা দেখা দিতেও পারে৷ যেসব শত্রু ঘরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায় না, অথচ ঘরের ভিতরেও থাকে না, তাদের বিশ্বাস নেই৷ তারা মায়াধর, তারা সব করতে পারে৷’

মানিক নিজের রিভলবারের পিছন দিকটা দিয়ে ঘরের চারিদিকের দেওয়াল ঠুকে ঠুকে পরীক্ষা করতে লাগল৷

সুন্দরবাবু শুধোলেন, ‘কী দেখছ মানিক?’

-‘দেখছি দেওয়ালের কোনো জায়গা ফাঁপা কি না! কিন্তু না, এ নিরেট দেওয়াল, এর কোথাও গুপ্তদ্বার নেই৷’

জয়ন্ত বললে, ‘কিন্তু-‘ বলতে বলতে থেমে পড়ে সে পশ্চিম দিকের একটা জানলার কাছে ছুটে গেল৷

মানিক বললে, ‘কী হল জয়ন্ত?’

-‘এ দিকের জানালা দিয়ে গঙ্গা দেখা যায়৷’

-‘সেটা আমরা এখান থেকেই দেখতে পাচ্ছি৷ কিন্তু কথা কইতে কইতে তুমি হঠাৎ ছুটে গেলে কেন?’

-‘একটা শব্দ শুনছ না৷’

কান পেতে মানিক বললে, ‘শুনছি৷ একখানা মোটরবোটের শব্দ৷’

-‘হ্যাঁ৷ গঙ্গার উপর দিয়ে একখানা মোটরবোট যাচ্ছে৷’

-‘তার জন্যে তোমার মাথাব্যথা কেন?’

-‘মোটরবোটের শব্দটা আগে ছিল না, এইমাত্র জাগল, নিশ্চয় বোটখানা ছাড়া হয়েছে কাছাকাছি কোনো জায়গা থেকে৷ এতরাত্রে বোটে চড়ে গঙ্গায় হাওয়া খাবার শখ হল কোন মহাপুরুষের, সেই কথাই ভাবছি৷’

-‘সন্দেহজনক বটে৷’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘জনকয় সেপাইকে গঙ্গার ধারে পাঠাব নাকি?’

-‘এখন আর পাঠিয়ে লাভ হবে না৷ এতক্ষণে বোটখানা অনেক দূরে চলে গিয়েছে, আর তার নাগাল পাওয়া অসম্ভব৷’

-‘তুমি কি বলতে চাও যে-‘

বাধা দিয়ে জয়ন্ত বললে, ‘আমি কিছুই বলতে চাই না৷ আমি খালি আপনাকে একটা ব্যাপার দেখাতে চাই৷’

-‘কী?’

একটা লন্ঠন উঁচু করে তুলে ধরে জয়ন্ত বললে, ‘যে দেওয়ালে জানলাটা গাঁথা আছে তার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখুন৷’

সুন্দরবাবু বিপুল বিস্ময়ে বললেন, ‘ওরে বাবা, এত মোটা দেওয়াল তো আমি জীবনে কখনো দেখিনি!’

-‘ঘরের অন্য তিন দিকের দেওয়াল দেখুন৷ কোনো দেওয়ালই তত চওড়া নয়!’

-‘তাই তো হে৷ এর মানে কী?’

-‘সেইটেই বিবেচ্য৷’

-‘হুম, এ যেন চীনের প্রাচীরের নমুনা৷’

-‘এইবার মেঝের রক্তের দিকে তাকান৷ কী দেখছেন?’

-‘একটু অত্যুক্তি করলে বলা যায়, মেঝের উপর দিয়ে বইছে রক্তের ঢেউ৷’

-‘আর কিছু দেখছেন না?’

-‘রক্তের মাঝে মাঝে অনেকগুলো মানুষের পায়ের দাগ৷’

-‘আরও কিছু?’

-‘উঁহু৷’

-‘মানিক, তুমি কী বলো?’

-‘পশ্চিম দিকে রয়েছে একটা দেওয়াল আলমারি৷ একটা লম্বা রক্তের রেখা ওই আলমারির তলায় গিয়ে শেষ হয়েছে৷ যেন কোন আহত রক্তাক্ত লোক ওই আলমারির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল৷’

-‘সে আহত না হয়ে, মৃত হতেও পারে৷ হয়তো কারা তার রক্তাক্ত মৃতদেহ ওই পর্যন্ত বহন করে নিয়ে গিয়েছিল৷’

-‘কিন্তু কেন? দেহটাকে আলমারির ভিতরে রেখে দেবে বলে?’

-‘হতেও পারে, না হতেও পারে৷ আলমারিটা খুলেই দেখো না৷’

-‘কিন্তু আলমারিটা তো বাহির থেকে তালাবন্ধ৷’

-‘ভারি তো পুঁচকে তালা৷ ভেঙে ফেলো৷’

তালা ভাঙতে দেরি লাগল না৷ একটা বীভৎস দৃশ্য দেখবার জন্যে প্রস্তুত হলেন সুন্দরবাবু৷

কিন্তু আলমারির দরজা খুলে পাওয়া গেল কেবল চারটে তাক৷ সেগুলোর উপরে রয়েছে কয়েকটা আজেবাজে জিনিস৷

জয়ন্ত বললে, ‘আর একটা জিনিস লক্ষ করুন সুন্দরবাবু৷’

-‘ভায়া, বার বার লক্ষ করতে করতে আমি ক্রমেই লক্ষ্যহারা হয়ে পড়ছি যে৷’

-‘আলমারির ফ্রেমের উপরে রয়েছে একটা পিতলের মোটা হাতল৷’

-‘তাতে কী হয়েছে?’

-‘ওরকম জায়গায় অমন ধারা হাতল থাকার কোনো মানে হয় না৷’

-‘হুম!’

-‘হাতলটা ধরে জোরসে মারুন টান!’

-‘মারলুম টান-হেঁইয়ো৷ আরে একী!’

হড়হড় করে গোটা আলমারিটাই দরজার পাল্লার মতো দেওয়ালের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল বাইরের দিকে৷ জয়ন্ত ছাড়া আর সকলেরই দৃষ্টি বিস্মিত এবং চমকিত৷ জয়ন্ত সহজ কন্ঠেই বললে, ‘এসো মানিক, আলমারির ওপাশে কী আছে এইবারে সেটা দেখা যাক৷’

আলমারির ওপাশে আছে দুটো দেওয়ালের মাঝখানে হাত দেড়েক চওড়া আর অল্প একটু ফাঁকা জায়গা-সেখানে পাশাপাশি দু-জন মানুষ দাঁড়াতে পারে না৷ নীচে গাঢ় অন্ধকারের ভিতরে নেমে গিয়েছে একসার ছোটো ছোটো সিঁড়ি৷

জয়ন্ত অগ্রসর হল! এক হাতে টর্চ এবং আর এক হাতে রিভলবার নিয়ে সংকীর্ণ সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললে, ‘আমার বিশ্বাস শত্রুদের কেউ আর এ মুল্লুকে নেই৷ আপনারাও নির্ভয়ে আমার পিছনে আসুন৷’

মোট ত্রিশটা ধাপ তারপর সিঁড়ির শেষ৷

এদিকে-ওদিকে টর্চের আলো ফেলে জমাট অন্ধকার বিদীর্ণ করে জয়ন্ত বললে, ‘বাড়িখানা আছে আমাদের মাথার উপরে-এখন আমরা পাতালের গর্ভে৷ এখানটা দেখছি ছোটোখাটো ঘরের মতো, আর-‘

জয়ন্তের কথা ফুরোবার আগেই সেই অন্ধকূপের মধ্যে বিকট একটা ভৌতিক কন্ঠস্বর ধ্বনিত হয়ে উঠল-হুঁ-উ-উ-উ৷ হুঁ-উ-উ-উ৷ হুঁ-উ-উ-উ৷

মস্ত একটা লম্ফ ত্যাগ করে আবার সিঁড়ির উপরে গিয়ে পড়ে সুন্দরবাবু সভয়ে বলে উঠলেন, ‘এ কী রে বাবা, এ কী আওয়াজ! পালিয়ে এসো জয়ন্ত, পালিয়ে এসো মানিক৷’

পাতাল পুরে

যেদিক থেকে শব্দটা আসছিল, সেইদিকে জয়ন্ত ফিরে দাঁড়াল চোখের পলক পড়বার আগেই৷

টর্চের আলোতে দেখা গেল এককোণে মেঝের উপরে পড়ে রয়েছে একটা নিশ্চেষ্ট মনুষ্যমূর্তি-তার মুখে বন্ধন, তার হাতে বন্ধন, তার পায়ে বন্ধন৷

মানিক দুই পা এগিয়ে হেঁট হয়ে মূর্তিটাকে দেখে সবিস্ময়ে বলে উঠল, ‘নরেনবাবু না?’

নরেন নিঃসহায়ের মতো ঘাড় নেড়ে কেবল বলতে পারলে, ‘হুঁ-উ-উ-উ!’

জয়ন্ত ও মানিক তৎক্ষণাৎ তার বন্ধন খুলে দিলে৷

সিঁড়ির উপর থেকে আবার নীচে নামতে নামতে সুন্দরবাবু হাঁফ ছেড়ে বললে, ‘নরেনবাবু, এভাবে আমাদের ভয় দেখানো আপনার উচিত হয়নি৷ হুঁ-উ-উ-উ-উ কী রে বাবা!’

নরেন শ্রান্ত স্বরে বললে, ‘কী করব বলুন, ও ছাড়া আর কোনো শব্দ উচ্চারণ করবার উপায় আমার ছিল না৷’

জয়ন্ত বললে, ‘ব্যাপারটা সংক্ষেপে বর্ণনা করতে পারবেন?’

-‘পারব৷ বাড়ির উপরকার ঘরে ওঠবার পর একজন খুব রোগা আর ঢ্যাঙা লোক আমার সঙ্গে অল্পক্ষণ বাজে কথা কইলে৷ তারপরই অতর্কিতে পিছন থেকে আমাকে আক্রমণ করলে কয়েকজন লোক, কোনোক্রমে এক বার তাদের হাত ছাড়িয়ে আমি উপর-উপরি দুই বার রিভলবার ছুড়লুম-একটা লোক জখম হয়ে মাটির উপরে পড়ে গেল বটে, কিন্তু বাকি লোকগুলো আবার আমার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে বেঁধে ফেললে আমার হাত, পা, মুখ৷ তারপর তারা আমাকে নিয়ে কী করত জানি না, কিন্তু হঠাৎ বাইরে আপনাদের বাঁশি বেজে উঠল৷ রোগা আর ঢ্যাঙা লোকটা বললে, ‘পালাও, পালাও-পুলিশ এসেছে৷ তখনি আমার আর সেই আহত লোকটার দেহ মাটির উপর থেকে তুলে নিয়ে তারা দেওয়ালের একটা গুপ্তদ্বার খুলে সিঁড়ি দিয়ে এইখানে নেমে এল৷ আসবার সময়ে সেই রোগা ঢ্যাঙা লোকটা বোধ হয় আপনাদের লক্ষ্য করে একবার বন্দুকও ছুড়েছিল৷’

জয়ন্ত শুধোলে, ‘নরেনবাবু, সে লোকটার গলার আওয়াজ কেমন?’

-‘স্বাভাবিক৷’

-‘আধা-নরম আধা-কর্কশ নয়?’

-‘না৷’

-‘মানিক, তাহলে বোধ হচ্ছে বেহালার বাগানবাড়িতে যে আমাদের সঙ্গে কর্তৃত্বের স্বরে কথা কয়েছিল, সে আর এই রোগা ঢ্যাঙা লোকটা একই ব্যক্তি নয়৷ আচ্ছা নরেনবাবু, আপনাকে এখানে ফেলে রেখে লোকগুলি কোনদিকে গিয়েছে বলতে পারেন?’

-‘হ্যাঁ৷ তারা ওই দরজাটা খুলে বেরিয়ে গেল৷’ নরেন অঙ্গুলি নির্দেশ করলে৷

দেওয়ালের গায়ে রয়েছে ছোটো একটা দরজা, তার কপাট বন্ধ ছিল না৷

জয়ন্ত দরজার ওপাশটা টর্চের সাহায্যে আলোকিত করে বললে, ‘এ যে একটা সুড়ঙ্গ!’

সুন্দরবাবু চমৎকৃত হয়ে বললেন, ‘বাব্বা, এরা দেখছি জাত শয়তান৷ আয়োজনের কিছুই বাকি রাখেনি৷ কেবল স্থলপথে আর জলপথেই ওদের চলাচল নয় হে জয়ন্ত, ওরা হয়তো এরোপ্লেনে উঠেও আমাদের ফাঁকি দিতে পারে৷’

 জয়ন্ত ভাবতে ভাবতে বললে, ‘আমার বোধ হয়, এদের একজন বিচক্ষণ দলপতি আছে৷ সাধারণত সে নিজে থাকে আড়ালে নিরাপদ ব্যবধানে, আর তার হুকুম তামিল করে দলের অন্য সবাই৷ ওই রোগা আর ঢ্যাঙা লোকটা বোধ হয় তার ডান হাতের মতো৷

সুন্দরবাবু বললেন, ‘আমার মনে হয়, এই অদৃশ্য দলপতি কোনোদিনই দৃশ্যমান হবে না৷ ধরা পড়বে বড়োজোর তার চ্যালাচামুণ্ডারা৷’

-‘দলপতিকে চোখে না দেখলেও খুব সম্ভব আমরা তারই অর্ধকোমল আর অর্ধকর্কশ কন্ঠস্বর শুনেছি-সে স্বর আমি কোনোদিনই ভুলব না, কারণ সযত্নে তার রেকর্ড রেখেছি আমার স্মৃতির গ্রামাফোনে৷ তার স্বর আবার শুনলেই তাকে চিনতে পারব৷ আর এটাও জেনেছি, আপনার উপরে তার প্রচণ্ড ক্রোধ৷ নিশ্চয় সে পুরাতন পাপী, কখনো-না-কখনো আপনার পাল্লায় গিয়ে পড়েছিল, আর বোধ হয় আপনি তাকে জামাই আদর করেননি৷’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘তোমার ওই অর্ধকোমল আর অর্ধকর্কশ কন্ঠের অধিকারীকে আমি তো স্মৃতিসাগর মন্থন করেও আবিষ্কার করতে পারলুম না৷’

-‘আপাতত থাক ওকথা৷ নরেনবাবু, আপনি দুই জন পাহারাওয়ালার সঙ্গে আবার উপরে গিয়ে একটু বিশ্রাম গ্রহণ করুন৷ ততক্ষণে আমরা সুড়ঙ্গটার ভিতরে দৃষ্টি সঞ্চালন করে আসি৷’

সুড়ঙ্গটাও সংকীর্ণ তার ভিতরে পাশাপাশি চলতে পারে না দু-জন মানুষ৷ বেশ খানিকটা এগিয়ে যেখানে সুড়ঙ্গটা শেষ হয়েছে, সেখানেও রয়েছে আর একটা ছোটো দরজা৷ টানতেই খুলে গেল তার কপাট৷

বাহির থেকে দরজার উপরে ঝুলছে এত লতাপাতা যে সহজে তার অস্তিত্ব আবিষ্কার করা যায় না৷ তারপর প্রায় কাঠা-চারেক জমি জুড়ে বিরাজ করছে কাঁটা ঝোপের পর কাঁটা ঝোপ আর আগাছার নিবিড় জঙ্গল৷

জয়ন্ত স্তব্ধ মুখে সেই দিকে তাকিয়ে রইল যেখানে আঘাটাতেও গঙ্গার জলবাহু ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে চাঁদের আলোর হিরের টুকরো৷

খানিকক্ষণ পরে সে মুখ তুলে বললে, ‘মানিক পুলিশের সাড়া পেয়ে ওরা তাড়াতাড়িতে নরেনবাবুকেও নিয়ে পালাতে পারেনি৷ আমরা যে গুপ্তপথের সন্ধান পাব, সেটা ওরা আন্দাজ করতে পারবে না৷ নরেনবাবুর একটা ব্যবস্থা করবার জন্যে ওরা নিশ্চয়ই দু-এক দিনের মধ্যে লুকিয়ে আবার সুড়ঙ্গের ভিতরে প্রবেশ করবে৷’

-‘তোমার অনুমান অসংগত নয়৷’

-‘সে সুযোগ আমরা ছাড়ব না৷ তারা আসবে রাতের অন্ধকারেই৷ আমরাও কাল থেকে এইখানে রাত জেগে গঙ্গার গান শুনব৷ এবারে সুড়ঙ্গে ঢুকলে আর তারা বেরোতে পারবে না৷ আপাতত নরেনবাবুকে আমাদের বাড়িতে লুকিয়ে রাখব৷ তাঁকে যে আমরা উদ্ধার করেছি, সেটা ওদের জানতে দেওয়া হবে না৷’

-‘মন্দ ফন্দি নয়৷ এখন চলো, ঘুমে আমার চোখ জড়িয়ে আসছে৷’

বিজনবিহারী রায়

তারপর কেটে যায় এক, দুই, তিন দিন৷ জয়ন্ত সদলবলে রাত জাগে বরাহনগরের গঙ্গার ধারে৷ কেবল তারা নয়, সে মুল্লুকের মশাও সানন্দে ঐকতান বাজিয়ে রাত জাগে তাদের সঙ্গে৷ সুন্দরবাবুর অভিযোগের অন্ত নেই৷

তিন দিন পরে জয়ন্তও হাল ছেড়ে দিল৷ সে বুঝল, নরেনবাবুর জন্যে অপরাধীরা আর সুড়ঙ্গের মধ্যে পদার্পণ করবে না৷

সুন্দরবাবু বললেন, ‘আমি তো গোড়া থেকেই বলে আসছি ওরা আমাদের চেয়ে চালাক৷ এত সহজে ফাঁদে পা দেবার বান্দা ওরা নয়৷’

জয়ন্ত বললে, ‘আমার মত আলাদা৷ ওদের আসল উদ্দেশ্য এইবার বুঝতে পেরেছি৷’

-‘মানে?’

-‘ওদের ইচ্ছা, নরেনবাবু অন্ধকূপে বন্দি হয়ে তিলে তিলে দিনে দিনে মৃত্যুর কবলগত হোন৷ ওরা নরেনবাবুকে পথ থেকে সরাতে চেয়েছিল৷ ওরা ভাবছে ওদের সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে, কাজেই অকারণে সুড়ঙ্গের ভিতরে এসে ওরা আর পুলিশের নজরে পড়তে রাজি নয়৷’

-‘কিন্তু নরেনবাবুকে যমালয়ে পাঠাবার জন্যে ওদের এতটা আগ্রহ কেন?’

-‘এখনও এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর খুঁজে পাইনি৷ তবে যে কারণে বরেনবাবু মারা পড়েছেন, সেই কারণেই ওরা নরেনবাবুকে বধ করতে চায়, সে বিষয়ে আর কোনোই সন্দেহ নেই৷’

-‘এ আবার তোমার কীরকম হেঁয়ালি৷ এদিকে বলছ তুমি সঠিক উত্তর জানো না, আবার বলছ ওরা একই কারণে বরেনবাবুকে বধ করবার পরে নরেনবাবুকেও বধ করতে চায়!’

-‘সুন্দরবাবু, আপাতত এর বেশি আর কিছু বলতে পারব না৷ তবে এই মামলাটা হাতে নিয়েই আমার মনে যে সন্দেহ জেগেছিল, অবশেষে সেই সন্দেহ বোধ করি সত্যে পরিণত হবে৷ আপনি আজ সন্ধ্যার সময়ে আমার বাড়িতে একবার আসবেন?’

-‘আসব৷ কিন্তু কেন বলো দেখি?’

-‘আমাদের বরানগর অভিযান তো ব্যর্থ হল, আজ আর একটা নতুন সূত্রের সন্ধানে যাত্রা করব৷’

সেদিনের সন্ধ্যা৷

জয়ন্ত বৈঠকখানায় বসে বাঁশি বাজাচ্ছে এবং মানিক ধরেছে তবলা৷

সুন্দরবাবুর প্রবেশ৷ দুই বন্ধুর প্রতি বিরক্তিপূর্ণ দৃষ্টিপাত৷ একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে উপবেশন৷ অধীরভাবে একবার ‘হুম’ শব্দ উচ্চারণ৷ কিন্তু জয়ন্ত ও মানিক তাঁর দিকে ফিরেও তাকালে না৷ সমান তালে বাজাতে লাগল বাঁশি আর তবলা৷

সুন্দরবাবু আর পারলেন না, বললেন, ‘কী হে জয়ন্ত, বাঁশির প্যানপ্যানানি শোনবার জন্যেই কি আজ আমাকে এখানে আসতে বলেছ?’

উত্তর নেই৷ বাঁশি আর তবলা বোবা হল না৷

আরও মিনিট দুয়েক অপেক্ষা করে সুন্দরবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এসেছিলুম একটা জরুরি খবর দিতে৷ তা তোমরা যখন শুনবে না আমি আর কী করব বল? চললাম৷’

মানিকের তবলায় পড়ল তেহাই, জয়ন্তের বাঁশি হল স্তব্ধ৷

জয়ন্ত বললে, ‘আপনি জানেন তো সুন্দরবাবু, মাঝে মাঝে বাঁশি বাজাবার জন্যে আমার প্রাণ আনচান করে?’

মানিক বললে, ‘আর তবলা বাজাবার জন্যে আমার হাত নিশপিশ করে?’

-‘হুম!’

-জয়ন্ত বললে, ‘তবে সেতার শুনবেন?’

মানিক বললে, ‘কিংবা-‘

বাধা দিয়ে সুন্দরবাবু বললেন, ‘রক্ষা করো! আবার সেতারের প্রিং প্রিং? ওসব আমি বুঝি না, ভালোও লাগে না৷’

মানিক বললে, ‘তবে আপনার কী ভালো লাগে সুন্দরবাবু? আমাদের মধু যদি এখন চা আর ফাউলের স্যান্ডউইচ নিয়ে আসে?’

সুন্দরবাবু একগাল হেসে বললেন, ‘তাহলে মধুকে আমি একাধিক ধন্যবাদ দেব৷’

-‘বেশ, সেই ব্যবস্থাই হবে৷’

-‘তবে আমিও আবার বসলুম৷’

জয়ন্ত বললে, ‘একটা নতুন সূত্রের সন্ধানে যাত্রা করেছিলুম৷ কিন্তু বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারিনি!’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘আমারও বক্তব্য আছে৷ আগে তোমার কথাই শুনি৷’

-‘বেহালায় গিয়েছিলুম৷ আশেপাশের লোকের কাছে খবর নিয়ে জানলুম, দশ নম্বর রামবাবুর লেনের সেই বাগানবাড়ির মালিক হচ্ছেন বিজনবিহারী রায়৷ কিন্তু তিনি নাকি আর কলকাতায় বাস করেন না৷’

-‘বটে৷ তাহলে আমার খবর শুনবে? আমি তোমার চেয়ে অগ্রসর হয়েছি৷’

-‘সুসংবাদ৷’

-‘নিমতলার সেই আগুনে পোড়া মৃতদেহটার ছবি কাগজে ছাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, পুরস্কার ঘোষণা করে৷ আজ একজন লোক তাকে শনাক্ত করে গিয়েছে৷’

-‘কে শনাক্ত করেছে?’

-‘তার নাম হরিয়া৷ সে বেহালার ওই বাগানবাড়িতে আগে মালীর কাজ করত৷ হরিয়া বলে, আগুনে পুড়ে যে লোকটা মরেছে সে হচ্ছে বাগানবাড়ির মালিক বিজনবিহারী রায়ের মোটরচালক৷’

-‘তাহলে আপনি বিজনবাবুরও ঠিকানা পেয়েছেন?’

-‘উঁহু৷ হরিয়াও বলে বিজনবাবু কলকাতার বাসা তুলে দিয়ে কোথায় চলে গিয়েছে৷’

-‘কিন্তু কে এই বিজনবিহারী রায়?’

-‘তাও জেনেছি ভায়া, তাও জেনেছি৷ সেই জন্যেই তো বলছি আমি তোমার চেয়ে বেশি অগ্রসর হয়েছি৷’

জয়ন্ত সাগ্রহে বললে, ‘বলুন বলুন, সব কথা খুলে বলুন৷’

-‘বেহালার বাগানবাড়িতে তুমি একজনের আধাকোমল আধাকর্কশ গলার আওয়াজ শুনেছিলে না?’

-‘হ্যাঁ৷’

-‘বিজনবিহারীও ওইরকম অদ্ভুত কন্ঠস্বরের অধিকারী৷’

-‘কেমন করে জানলেন?’

-‘শোনো৷ হরিয়া মালীর মুখে বিজনবিহারী রায়ের নাম শুনেই সজাগ হয়ে উঠেছে আমার ঘুমন্ত স্মৃতি৷ তুমি বলেছিলে সেই আধা-কোমল আর আধা-কর্কশ কন্ঠের অধিকারীর নাকি আমার উপরে রাগ আছে৷ সেই যদি বিজন হয় তাহলে আমার উপরে তার রাগ থাকবার কথা৷ কারণ বছর পাঁচেক আগে তাকে একটা খুনের মামলায় গ্রেপ্তার করেছিলুম৷ মামলা অনেকদিন ধরে চলেছিল, তাকেও হাজতে আবদ্ধ থাকতে হয়৷ শেষটা যথেষ্ট প্রমাণ অভাবে সে খালাস পায় বটে, কিন্তু আসলে বিজনই যে হত্যাকারী, এ বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই৷ জয়ন্ত, আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, এই বরেনবাবুর হত্যাকাণ্ডেও সেই বিজনের হাত আছে৷’

-‘কিন্তু বিজন এখন কোথায় জানেন না তো?’

-‘তার ঠিকানা জানি না বটে, তবে মাস খানেক আগেও সে কলকাতায় ছিল বলেই শুনেছি৷’

-‘কার মুখে শুনেছেন?’

-‘ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের এক ইনস্পেকটরের মুখে৷ বিজনকে তিনি মোটরে চড়ে পথ দিয়ে যেতে দেখেছিলেন৷’

জয়ন্ত খানিকক্ষণ নীরবে থেকে বললে, ‘সুন্দরবাবু, আপনি মূল্যবান সংবাদ এনেছেন৷ আর আমাদের অন্ধকারে হাতড়ে মরতে হবে না৷ বিজন যখন কলকাতাতেই আত্মগোপন করে আছে, তখন তাকে আবিষ্কার করতে আমাদের আর বিশেষ বেগ পেতে হবে না৷ তারপরেই বোঝা যাবে বর্তমান মামলার সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে কতখানি৷’

ভাগনে

চা এবং খাবার এল-সঙ্গেসঙ্গে উৎফুল্ল হয়ে উঠল সুন্দরবাবুর বদনমণ্ডল৷ তাঁর জীবনের সেই সময়টাই সবচেয়ে উপভোগ্য হয়, যখন তাঁর ডান হাতখানি খাবারের থালার দিকে বার বার আনাগোনা করবার সুযোগ পায়৷

খেতে খেতে সুন্দরবাবু বললেন, ‘দেখো জয়ন্ত, বিজন কলকাতা ত্যাগ করেনি বলেই তুমি যে তাকে সহজে গ্রেপ্তার করতে পারবে, এটা আশা না করাই ভালো৷ কলকাতা হচ্ছে জনসমুদ্রের মতো, আর বিজন হচ্ছে তার মধ্যে এক ঘটি জলের মতো৷ ঘটির জল সমুদ্রে মিশে গেলে কেউ কি তাকে আবিষ্কার করতে পারে হে? বরং কলকাতার বাইরে গেলেই সে সহজে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে৷ এই দেখো না, বিজন আর আমি দু-জনেই কলকাতায় আছি, অথচ আজ পাঁচ বছরের মধ্যে তার চুলের টিকি পর্যন্ত আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি৷’

জয়ন্ত বললে, ‘খোঁজেননি, তাই তার দেখা পাননি৷ খুঁজলে ভগবানের দেখা পেতে দেরি লাগে বটে, কিন্তু শয়তান ধরা দেয় খুব সহজেই৷’

মানিক বললে, ‘কিন্তু জয়ন্ত, বিজন যে বরেনবাবুর হত্যাকারী আর সেই যে নরেনবাবুকেও হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল, এখন পর্যন্ত এমন কোনো প্রমাণই আমরা পাইনি৷ আমরা বড়োজোর তার অদ্ভুত কন্ঠস্বর শুনেছি; কিন্তু আদালতে সেটা ঠিক প্রমাণ বলে গ্রাহ্য হবে কি?’

সুন্দরবাবু ঘাড় নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘হুম! মানিক প্রায়ই বুদ্ধিমানের মতো কথা বলে না, কিন্তু তার আজকের কথার দাম লাখ টাকা৷’

মানিক মুখ টিপে হেসে বললে, ‘আমি কেমন করে বুদ্ধিমানের মতো কথা বলব সুন্দরবাবু? ষোলোআনা বুদ্ধিই যে আপনার মগজের ভিতরে বন্দি হয়ে আছে৷ বলছেন, আমার কথার দাম লাখ টাকা৷ এমন করে আমায় আর লজ্জা দেবেন না দাদা৷ আপনার কাছে আমি? শাখামৃগের কাছে নেংটি ইঁদুর৷’

সুন্দরবাবু ভুরু কুঁচকে সন্দিগ্ধ স্বরে বললেন, ‘শাখামৃগ মানে কী জয়ন্ত?’

-‘শুনলে কি খুশি হবেন?’

-‘কেন হব না?’

-‘মানেটা ভালো নয়৷’

-‘তবু আমি শুনব৷ শাখামৃগ মানে কী?’

-‘কপি৷’

-‘কী কপি, ফুলকপি?’

-‘ফুলকপিও নয়, বাঁধাকপিও নয়-শুধু কপি৷ অর্থাৎ বানর৷’

সুন্দরবাবু একটিমাত্র বাক্য উচ্চারণ না করে দাঁড়িয়ে উঠলেন৷ তারপর মানিকের ভাবহীন মুখের দিকে প্রজ্জ্বলিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হন-হন করে ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে গেলেন৷

জয়ন্ত হাসতে হাসতে বললে, ‘সুন্দরবাবুকে তাড়ালে মানিক?’

-‘উনি তাড়া খেয়ে চলেও যান, আবার তাড়াতাড়ি ফিরেও আসেন৷’

-‘যাক ওকথা৷ এখন বাড়ির ভিতর থেকে একবার নরেনবাবুকে ডেকে আনো দেখি৷ তাঁর সঙ্গে দুটো কথা কইব৷’

মানিক চলে গেল এবং মিনিট তিনেক পরে নরেনবাবুকে নিয়ে ফিরে এল৷

নরেন বললে, ‘আর অজ্ঞাতবাস ভালো লাগছে না জয়ন্তবাবু৷’

-‘বসুন৷ আর আপনাকে অজ্ঞাতবাস করতেও হবে না৷ যে উদ্দেশ্যে আপনাকে লুকিয়ে রেখেছি, আমাদের সে উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছে৷’

-‘শুনে বাঁচলুম!’

-‘আচ্ছা নরেনবাবু, আপনার দাদার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী কে?’

-‘আমি৷’

-‘বরেনবাবু উইল করে গেছেন?’

-‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷’

-‘আপনার সন্তান আছে?’

-‘না৷’

-‘স্ত্রী?’

-‘বিবাহ করিনি, কখনো করবও না৷’

-‘আপনার মৃত্যুর পর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে কে?’

-‘আমার ভাগনে৷’

-‘শুনেছি আপনার ভগ্নী বন্ধ্যা৷’

-‘সে আমার ছোটো বোন৷ আমার বিধবা দিদির ছেলে আছে৷’

-‘কয় ছেলে?’

-‘একটি মাত্র৷’

-‘বটে? তার বয়স কত?’

-‘সে প্রায় আমারই সমবয়সি৷’

-‘তিনি কী করেন?’

-‘জানি না৷’

-‘সে কী?’

-‘আশ্চর্য হচ্ছেন? আশ্চর্য হবার কথাই বটে৷ আসল কথা কী জানেন জয়ন্তবাবু? দিদির সঙ্গে আমাদের সদ্ভাব আছে বটে, কিন্তু আমার ভাগনের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক তুলে দিতে বাধ্য হয়েছি৷’

-‘কেন?’

-‘সে মানুষ নয়, একেবারেই লক্ষ্মীছাড়া৷ তার কথা স্মরণ করতেও লজ্জায় আমার মাথা কাটা যায়৷’

-‘দুঃখের কথা৷’

-‘লোক-ঠকানো তার ব্যাবসা৷ একবার খুনের মামলাতেও পড়েছিল৷’

জয়ন্ত চমকে উঠল৷ একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করলে, ‘তাঁর নাম কী?’

-‘বিজনবিহারী রায়৷’

জয়ন্ত ও মানিকের মধ্যে হল দৃষ্টি বিনিময়৷ জয়ন্ত বললে, ‘বিজনবাবুর কন্ঠস্বর কি অর্ধকোমল অর্ধকর্কশ?’

-‘আর একদিনও তার সম্বন্ধে আপনি এই প্রশ্ন করেছিলেন৷ হ্যাঁ, বিজনের গলার আওয়াজ ওই রকমই বটে কিন্তু আপনি জানলেন কেমন করে?’

-‘আমি শুনেছি৷’

-‘কোথায়?’

-‘পরে বলব৷ বিজনবাবুর চেহারা কেমন?’

-‘লোকে বলে নাকি অনেকটা আমার মতনই দেখতে৷’

-‘তার ঠিকানা কী?’

-‘তাও জানি না৷ সে আমার দিদির সঙ্গে থাকে না৷ তবে এত দোষের মধ্যেও তার একটি মস্ত গুণ আছে৷ অত্যন্ত মাতৃভক্ত৷ রোজ সকালে একবার করে আমার দিদির সঙ্গে দেখা করে যায়৷’

-‘আপনার দিদির ঠিকানা কী?’

-‘পাঁচ নম্বর চন্দ্র বসু স্ট্রিট৷’

-‘কাল সকালে সেখানে গেলে বিজনবাবুর সঙ্গে দেখা হবে তো?’

-‘হওয়াই তো উচিত৷ কিন্তু তার সঙ্গে আপনার কী দরকার?’

জয়ন্ত রহস্যময় হাসি হেসে বললে, ‘তাঁর সঙ্গে দেখা হবার পরে বলব৷ কিন্তু সাবধান নরেনবাবু, আমি যে কাল বিজনবাবুর সঙ্গে দেখা করতে যাব, একথা যেন ঘুণাক্ষরেও কারুর কাছে প্রকাশ করবেন না৷’

টেলিফোনের কীর্তি

পাঁচ নম্বর চন্দ্র বসু স্ট্রিট৷ নরেনবাবুর দিদির বাড়ি৷

তখনও ভালো করে ফরসা হয়নি কলকাতা৷ শেষ রাতের আঁধারের সঙ্গে উষার আলোর যুঝাযুঝি চলছে তখনও৷ শহরের ঘুম ভেঙেছে বটে, কিন্তু তার মুখরতা এখনও স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি৷

যথাসম্ভব আত্মগোপনের জন্যে একটা জায়গা বেছে নিয়ে জয়ন্ত বললে, ‘মানিক মাতৃভক্ত হত্যাকারীর জন্যে বোধকরি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে৷ তা হোক, একটু আগে আগে আসাই ভালো৷’

পাঁচ নম্বর চন্দ্র বসু স্ট্রিট৷ তার দরজায় এসে দাঁড়াল একখানা ট্যাক্সি৷ আরোহী নীচে নেমে ভাড়া দিলে৷ ট্যাক্সি চলে গেল৷

জয়ন্ত বললে, ‘ওই বিজিনবিহারী? লোকটাকে দেখতে অনেকটা নরেনবাবুর মতোই বটে-এমনকী গায়ের রং পর্যন্ত৷ দেখলে, বাড়িতে ঢোকবার আগে বিজন চারিদিকে কীরকম সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে গেল?’

মানিক বললে, ‘আমাদের দেখতে পায়নি তো?’

-‘আশা করি পায়নি৷’

আরও মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করে তারা দু-জনে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল বাড়ির দিকে৷ দরজার কড়া নাড়তেই একজন বেয়ারা বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলে, ‘কাকে চাই?’

-‘বিজনবাবুকে৷’

-‘তিনি তো এই সবে এলেন৷’

-‘তাঁকে গিয়ে বলো দু-জন ভদ্রলোক তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান৷’

বেয়ারার প্রস্থান৷

বেয়ারা ফিরে এসে বললে, ‘আপনারা বাইরের ঘরে বসুন৷ বাবু এখনি আসছেন৷’

বেয়ারা বৈঠকখানার দরজা খুলে দিলে৷ ঘরের ভিতরে ঢুকল জয়ন্ত ও মানিক৷ পরমুহূর্তেই দরজা বন্ধ হওয়ার ও বাহির থেকে শিকল তোলার শব্দ৷

জয়ন্ত চেঁচিয়ে বললে, ‘এই! দরজা খুলে দাও! কারুর সাড়া নেই৷’

মানিক বললে, ‘যা ভেবেছি! বিজন হয় সন্দেহ করেছে, নয় রাস্তায় আমাদের দেখে চিনে ফেলেছে৷ আমরা বন্দি৷’

জয়ন্ত বললে, ‘ভারি বোকা বানালে তো! দেখছি ঘর থেকে বেরোবার আর কোনো পথ নেই৷’ সে দরজা নিয়ে ধস্তাধস্তি করতে লাগল৷ লাথি ও ধাক্কা মারতে লাগল দরজার উপরে৷

মানিক বললে, ‘বৃথা চেষ্টা করছ কেন? তোমার গায়ে যত জোরই থাক, ঘরের ভিতর থেকে এই মজবুত দরজা কিছুতেই ভাঙতে পারবে না, অন্য উপায় দেখো৷’

-‘কী উপায় আছে আর? ঘরটা যদি রাস্তার ধারেও হত চেঁচিয়ে পথের লোক ডাকতে পারতুম৷’

ঘরের বাইরে জাগ্রত হল হা-হা-হা-হা করে অট্টহাস্য৷ তারপরেই সেই পরিচিত অর্ধকোমল ও অর্ধকর্কশ কন্ঠস্বরে শোনা গেল, ‘কী হে, শার্লক হোমস আর ওয়াটসনের বাংলা সংস্করণ! গোয়েন্দাগিরি ভারি সোজা না?’

জয়ন্ত বললে, ‘দরজা খুলে দাও বিজন৷ আমাদের বন্দি করে তুমি কিছুই সুবিধে করতে পারবে না৷ পুলিশ তোমার নাম জানতে পেরেছে৷’

-‘পুলিশকে আমি থোড়াই কেয়ার করি৷ তোদের কী হাল হয় দেখো-সেদিন বড়ো ফাঁকি দিয়েছিলি৷ এইসঙ্গে সেই ভুঁদো সুন্দর গোয়েন্দাটাকে পেলেই সোনায় সোহাগা হত৷ যত সব নেড়াবুনে, সব হল কীতুÍনে৷ সবাই মহা ডিটেকটিভ!’

মানিক চুপিচুপি বলল, ‘জয়ন্ত মুক্তির উপায় আবিষ্কার করেছি৷’

জয়ন্ত সবিস্ময়ে বললে, ‘কীরকম?’

-‘ওই দেখো৷ টেবিলের উপরে টেলিফোন৷ এবারে সত্য সত্যই সুন্দরবাবু এসে আমাদের উদ্ধার করতে পারবেন৷’

জয়ন্ত এক লাফে টেবিলের সামনে গিয়ে পড়ল৷ টেলিফোনের রিসিভারটা তুলে নিয়ে সুন্দরবাবুর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করলে৷ বললে, ‘সুন্দরবাবু, আমরা আবার বিজনের হাতে বন্দি হয়েছি৷ সদলবলে শীঘ্র পাঁচ নম্বর চন্দ্র বসু স্ট্রিটে এসে আমাদের উদ্ধার আর বিজনকে গ্রেপ্তার করুন৷’

বিজন বোধ হয় কান পেতে ছিল৷ হতাশ কন্ঠে বলে উঠল, ‘হায়রে, আবার আমার ভুল হয়ে গেল৷ ঘরে যে টেলিফোন আছে, সেটা আমার মনে ছিল না৷’

এবারে ঘরের ভিতর থেকে একসঙ্গে অট্টহাস্য করে উঠল জয়ন্ত এবং মানিক৷ ঘরের বাইরে আর কেউ হাসবার চেষ্টা করলে না৷

মিনিট দশের মধ্যে ঘটনাস্থলে সদলবলে সুন্দরবাবুর আবির্ভাব৷ জয়ন্ত ও মানিকের উদ্ধার লাভ৷ কিন্তু সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও বিজনের কোনো পাত্তা পাওয়া গেল না৷

সুন্দরবাবু আফশোস করে বললেন, ‘কী ঘ্যাচড়া মাছ রে বাবা! যতবার জাল ফেলি, জাল ছিঁড়ে পালিয়ে যায়৷’

জয়ন্ত বললে, ‘সুন্দরবাবু, আমার হাতের সব তাস এখনও ফুরোয়নি৷’

-‘ফুরোয়নি নাকি?’

-‘না৷ বরাহনগরের বাড়িতে বিজনের দলের যে লোকটা ধরা পড়েছিল, সে এখন কোথায়?’

-‘হাজতে৷’

-‘তাকে আজকেই ছেড়ে দিন৷’

-‘কী বলছ?’

-‘ঠিকই বলছি৷ চুনোপুঁটিকে ছেড়ে দিলে যদি রুই-কাতলা ধরা পড়ে, আপত্তি কী?’

-‘তোমার কথার মানে বোঝা যাচ্ছে না৷’

-‘মানে খুব সহজ৷ হাজতে সে একলা আছে?’

-‘হ্যাঁ৷’

-‘আরও ভালো৷ প্রহরী যদি হাজত ঘরের দরজা বন্ধ করতে ভুলে গিয়ে সরে দাঁড়ায় তাহলে নিশ্চয়ই সে চম্পট দেবে৷’

-‘দেবেই তো৷’

-‘সেও সন্দেহ করতে পারবে না যে, তাকে আমরা ইচ্ছা করেই ছেড়ে দিচ্ছি৷’

-‘তারপর?’

-‘তারপর তার পিছনে চর মোতায়েন রাখুন৷ সে কোথায় যায় দেখুন৷’

-‘তুমি কি ভাবছ, সে সোজা বিজনের কাছে গিয়েই হাজির হবে!’

-‘নিশ্চয়ই বিজনের কোনো গুপ্ত আস্তানা আছে৷ তার পক্ষে কলকাতা যখন বেশি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, তখন সেইখানেই গিয়ে সে গা-ঢাকা দেয়৷ বিজন এখন বেশ কিছুদিন বাইরে মুখ দেখাতে সাহস করবে বলে মনে হচ্ছে না৷ দলের লোকজন নিয়ে কোথাও গিয়ে লুকিয়ে থাকবে৷ আমাদের বন্দি নিশ্চয়ই তার গুপ্ত আস্তানার খবর রাখে৷ তার পক্ষে সেইখানে যাওয়াই স্বাভাবিক৷’

-‘হ্যাঁ জয়ন্ত, তোমার অনুমান সংগত৷’

-‘তাহলে এই উপায় অবলম্বন করুন৷’

-‘তথাস্তু৷’

অপচয়ে ঠ্যাং

পরদিন প্রভাতেই জয়ন্তের ঘরের টেলিফোন যন্ত্র বেজে উঠল টুং টুং টুং৷

রিসিভার ধরেই জয়ন্ত শুনলে সুন্দরবাবুর প্রফুল্ল কন্ঠের সম্বোধন- ‘ভো ভো জয়ন্ত!’

-‘গলা শুনেই বুঝেছি খবর শুভ৷’

-‘অত্যন্ত এবং আশাতীত৷ পরে পরে এই ব্যাপারগুলো ঘটেছে৷ বিজনের অনুচরের হাজত থেকে পলায়ন৷ আমাদের চরের তার পিছনে অনুসরণ৷ হাওড়ায় গিয়ে বিজনের অনুচরের ট্রেনে আরোহণ৷ পরে তার হরিপুরে অবতরণ৷ তারপর গ্রাম ছাড়িয়ে মাঠের মধ্যে একখানা বাড়িতে তার গমন৷’

-‘আপনার চর নিশ্চয়ই বিজনের দর্শন পায়নি?’

-‘বিজনকে সে চেনে না৷ তবে শুনলুম, সে বাড়িতে লোক আছে আট-দশ জন৷’

-‘হরিহরপুর এখান থেকে কতদূর?’

-‘পঁয়ত্রিশ মাইল৷’

-‘অঃতপর?’

-‘তিনখানা সেপাই-ভরতি বড়ো জিপগাড়ি নিয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে তোমার ওখানে যাচ্ছি৷ গাড়িতে তোমার আর মানিকের জন্যেও একটু জায়গা থাকবে৷ এর মধ্যে প্রস্তুত হতে পারবে তো?’

-‘আমি কোনো সময়েই অপ্রস্তুত নই৷’

-‘সোনার ছেলে, লক্ষ্মী ছেলে৷’

হরিহরপুর ছোটো গ্রাম৷ কিন্তু তার প্রান্তে আছে প্রকাণ্ড এক প্রান্তর এবং প্রান্তরের প্রান্ত গিয়ে মিশেছে দিক চক্রবাল রেখায়৷

প্রান্তরের মাঝখানে চারিদিকে কলাইশুঁটি খেত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একখানা প্রাচীরে ঘেরা নিঃসঙ্গ বাড়ি৷ তার পিছন দিকে গুটি আষ্টেক নারিকেল গাছ করেছে নিরালা একটি কুঞ্জ রচনা, তা ছাড়া আর কোনো গাছপালা নেই তার আশেপাশে৷

তীক্ষ্ণ চক্ষে সমস্ত পর্যবেক্ষণ করে জয়ন্ত বলল, ‘সুন্দরবাবু, বিজন আস্তানা নির্বাচন করেছে চমৎকার৷ পুলিশ যেকোনো দিক দিয়েই অগ্রসর হোক, লুকিয়ে তাকে আক্রমণ করতে পারবে না৷ সে এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে নিশ্চয়ই, দিনের আলোয় আমরা যদি ওদিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করি, তাহলে শেষ পর্যন্ত ওরা ধরা পড়লেও আমাদের লোকক্ষয় অনিবার্য, কারণ, ওরা বাধা দেবেই৷ আর ওদের সঙ্গেও আগ্নেয়াস্ত্র আছে, ওদের বাড়িটাও প্রায় কেল্লার মতো৷ রাত্রির অন্ধকারের জন্যে আমাদের অপেক্ষা করাই উচিত৷’

সন্ধ্যার ছায়ায় পৃথিবী হয়ে উঠল অস্পষ্ট৷ তারপর এল রাত্রি৷ চারিদিকে চাঁদের আলোর নীরব খেলা৷ ইতিমধ্যে একবার গলা সাধা হয়ে গেল শৃগাল সভ্যদের৷

উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম-চারিদিক থেকে অগ্রসর হল সশস্ত্র পুলিশবাহিনী, নিঃশব্দে-প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে৷ বাড়ির প্রাচীরের কাছে এসেও পাওয়া গেল না কারুর সাড়াশব্দ৷ বাড়ির ফটকের কাছে গিয়ে দেখা গেল, বাহির থেকে তালাবন্ধ৷

কয়েকজন লোক প্রাচীর লঙ্ঘন করে বাড়ির ভিতরে গিয়ে ঢুকল৷ অল্পক্ষণ পরে তারা ফিরে এসে বললে, ‘বাড়ির ভিতরে কেউ নেই৷’

মানিক বললে, ‘যা সন্দেহ করেছিলাম, তাই৷ আমাদের মতো ওরাও নিয়েছে রাত্রির সুযোগ৷ সবাই লম্বা দিয়েছে৷ আমাদের হল লাভে ব্যাং, অপচয়ে ঠ্যাং৷’

জয়ন্ত হাতঘড়ির দিকে দৃষ্টিপাত করে বললে, ‘এত সহজে হতাশ হোয়ো না মানিক৷ ওরা টের পেয়েছে আমাদের অস্তিত্ব৷ কিন্তু পালিয়ে ওরা যাবে কোথায়? বড়োজোর স্টেশনের দিকে৷ তিন ঘণ্টার মধ্যে স্টেশনে একখানা মাত্র স্লো প্যাসেঞ্জার আসবে সন্ধ্যার পর, সাড়ে আটটার সময়ে৷ এখন ঘড়িতে আটটা বেজে পঁচিশ মিনিট হয়েছে৷ স্টেশনে মোটরে চড়ে পৌঁছোতে আমাদের সাত-আট মিনিটের বেশি দেরি লাগবে না৷ এসব লোকাল ট্রেন প্রায়ই দেরি করে স্টেশনে আসে৷ হয়তো এখনও আমরা গিয়ে ট্রেন ধরতে পারব৷’

বায়ুবেগে ছুটল তিনখানা জিপ গাড়ি৷ কিন্তু তারা স্টেশনে গিয়ে পৌঁছেই দেখলে, একখানা ট্রেন ধূম উদ্গার করে দৌড় মারলে সশব্দে৷ তাদের দুর্ভাগ্যক্রমে ট্রেন এসেছিল আজ প্রায় যথাসময়েই৷

জয়ন্ত বললে, ‘সুন্দরবাবু, দৌড়ে স্টেশনে যান৷ পরের স্টেশনে খবর দিন, ট্রেন ওখানে গেলেই যেন আটকে রাখা হয়৷ ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গেই ছুটবে আমাদের গাড়ি তিনখানা৷ খুব সম্ভব পরের স্টেশনে আগে গিয়ে পৌঁছোব আমরাই৷’

সুন্দরবাবু স্টেশনে ছুটলেন৷ এবং কাজ সেরে ফিরে এসে আবার গাড়িতে উঠলেন৷ আকাশের গায়ে চলন্ত ট্রেনের ধোঁয়ার রেখা লক্ষ করে পুলিশের গাড়িগুলো হল ঝড়ের বেগে ধাবমান৷ তারপর চলল ট্রেনের সঙ্গে মোটরের দৌড় পাল্লা৷ খানিক পরে মোটরই এগিয়ে গেল ট্রেনকে পিছনে ফেলে৷

ধু-ধু মাঠের মধ্যে আচম্বিতে ট্রেনের গতি হয়ে গেল স্তব্ধ৷

মানিক বললে, ‘ব্যাপার কী?’

জয়ন্ত বললে, ‘বিজনের নতুন কীর্তি৷ অ্যালার্মের শিকল টেনে গাড়ি থামিয়ে ওরা এইখান থেকেই লম্বা দিতে চায়! ওরা বুঝে নিয়েছে পরের স্টেশন ওদের পক্ষে নিরাপদ হবে না৷ সুন্দরবাবু সবাইকে নিয়ে টপ করে নেমে পড়ুন৷ ওই দেখুন, অপরাধীরাও ট্রেন থেকে নেমে পড়ে মাঠের উপর দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে৷ ওই সেই রোগা ঢ্যাঙা লোকটা, আর ওই লোকটা বোধ হয় বিজন৷ ওরা দূরের ওই জঙ্গলটা লক্ষ করে ছুটছে৷ কিন্তু জঙ্গলে পৌঁছোবার আগেই ওদের গ্রেপ্তার করতে হবে, নইলে আবার ওরা পূর্বেকার মতো আমাদের কলা দেখাতে পারে৷’

এবারে গাড়ির সঙ্গে গাড়ির নয়, মানুষের সঙ্গে মানুষের দৌড় প্রতিযোগিতা৷ হঠাৎ রোগা ঢ্যাঙা লোকটা এবং বিজন দৌড় থামিয়ে ফিরে দাঁড়াল-তাদের দু-জনেরই হাতে বন্দুক৷

জয়ন্ত বললে, ‘হুঁশিয়ার!’

তারা বন্দুক ছুড়ছে৷ মানিক অস্ফুট আর্তনাদ করে মাঠের উপরে পড়ে গেল৷ তার ডান পায়ে লেগেছে বন্দুকের গুলি৷

সুন্দরবাবু সক্রোধে বললেন, ‘কী! আবার গুলি ছোড়া হচ্ছে৷ তবে দেখ মজাটা৷ এই সেপাই, চালাও গুলি-চালাও গুলি৷’

পুলিশের এক ডজন বন্দুক সগর্জনে অগ্নি ও ধূম উদ্গারণ করতে লাগল বারংবার৷ মাঠের মধ্যে এই অকল্পিত খণ্ডযুদ্ধ দেখে চারিদিক থেকে ছুটে আসতে লাগল কাতারে কাতারে লোকজন৷

জয়ন্ত বললে, ‘বিজন, আত্মসমর্পণ করো৷’

একটা মড়া গাছের কাটা গুঁড়ির আড়ালে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে বসে পড়ে বন্দুকে কার্তুজ ভরতে লাগল বিজন৷ সে কোনো জবাব দিলে না৷

জয়ন্ত বলল, ‘বিজন, শুনছ?’

বিজন বললে, ‘হ্যাঁ শুনেছি৷ তোমাদের কথার উত্তর হচ্ছে এই-‘ সে বন্দুক তুলে জয়ন্তের দিকে লক্ষ্য স্থির করতে লাগল৷

পাশেই ছিল একটা মস্ত উই ঢিপি৷ জয়ন্ত একলাফে তার আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল৷

হা-হা করে হেসে উঠে বিজন বললে, ‘কী হে বীরপুঙ্গব, ভয় পেয়ে লুকোলে কেন?’

জয়ন্ত শান্ত স্বরেই বললে, ‘বিজনবিহারী তুমিও তো লুকোতে কসুর করনি৷ আর কেন জাদু, লীলাখেলা বন্ধ করো৷ এগিয়ে এসো, দুই হাতে লোহার বালা পরো৷ আমরা তোমাকে গুলি করে মারতে চাই না, ফাঁসিকাঠে দোল খাওয়াতে চাই৷’

বিজন বন্দুকের নল ফেরালে সুন্দরবাবুর দিকে৷

সুন্দরবাবু বিনা বাক্যবায়ে করলেন প্রকাণ্ড একটি লম্ফত্যাগ৷ তিনি একেবারে সেপাইদের দলের ভিতর গিয়ে পড়লেন৷ তারপর দারুণ ক্রোধে চিৎকার করে বললেন, ‘কী, আবার আমাকে বধ করবার চেষ্টা? মেরে ফেলো, মেরে ফেলো ছোটোলোকটাকে, এখুনি গুলি করে মেরে ফেলো৷’

জয়ন্ত বললে, ‘বিজন, বন্দুক ছাড়ো৷’

-‘প্রাণ থাকতে নয়৷’

-‘তাহলে প্রাণ তোমার যাবেই৷ দলে আমরা ভারী৷’

-‘হোক৷ যতক্ষণ বাঁচব, যুদ্ধ করব৷’

-‘তবে মরো৷’

সেপাইরা গুলি বৃষ্টি বন্ধ করেছিল৷ তারা আবার বন্দুক ছুড়তে লাগল এবং গর্জন করতে লাগল বিজনেরও বন্দুক৷

কিন্তু যুদ্ধ বেশিক্ষণ চলল না৷ অধিকাংশ অপরাধীই একে একে ভূতলশায়ী হল-কেউ নিহত, কেউ আহত৷

সগর্বে মাথা তুলে এবং বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেবল বিজনবিহারী৷ গুলিহীন বন্দুকটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে হাতে নিলে সে রিভলবার৷ মুখে তার দৃঢ় প্রতিজ্ঞার ভাব৷

জয়ন্ত বললে, ‘আবার বলছি, এখনও আত্মসমর্পণ করো বিজন৷’

দুই চক্ষে অগ্নিবৃষ্টি করে কর্কশ কোমল কন্ঠে বিজন বললে, ‘পুঁচকে গোয়েন্দা, আমি আত্মসমর্পণ করব না, আমি করব জীবন সমর্পণ৷’ চোখের পলক না পড়তেই রিভলবারের নলটা নিজের কপালের পাশে রেখে সে ঘোড়া টিপে দিলে৷ আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জন-সঙ্গেসঙ্গে বিজনবিহারীর পতন৷

জয়ন্ত বললে, ‘ওকে বাধা দিতে পারলুম না৷ তুচ্ছ সম্পত্তির লোভে যে মাতুল হত্যা করে, তার মরা উচিত ছিল ফাঁসিকাঠেই দোল খেয়ে৷ যাক মানিক, তোমার কি বেশি লেগেছে ভাই?’

-‘না জয়ন্ত৷ কিন্তু যা বলেছিলাম৷ আমার হল অপচয়ে ঠ্যাং৷’

সুন্দরবাবু সহানুভূতি প্রকাশ করবার জন্যে দুঃখিতভাবে বললেন, ‘হুম৷’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *