হত্যারহস্য – দীনেন্দ্রকুমার রায়
১২৮০ সালের ১৭ই ভাদ্র আমার জীবনে একটি ভয়ানক ঘটনা ঘটিয়াছিল; অনেক দিন অতীত হইয়াছে, কিন্তু এখনো সে কথা মনে হইলে আমার প্রাণ কাঁপিয়া উঠে। রমণী হইয়াও সেদিন কি দুঃসাহসের কাজই না করিয়াছিলাম। আমাদের দেশে রমণীর দ্বারা এমন কঠিন কাজ আর কখন হইয়াছে কি না জানি না, কিন্তু আমি ইহা করিতে পারিয়াছিলাম শুধু প্রেমের বলে, প্রিয়তমকে কঠোর রাজদণ্ড এবং তদপেক্ষাও কঠোরতর মিথ্যা কলঙ্ক হইতে রক্ষা করিবার জন্যই আমি পুরুষোচিত কার্যে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম। আজ সেই কথা বলিব, কিন্তু সে কথা বলিবার পূর্বে আমার এই অকিঞ্চিকর জীবনের কাহিনী আপনাদিগকে ধৈর্য ধারণ পূর্বক শুনিতে হইবে।
আমার পিতার বাসস্থান শান্তিপুর। পিতা তাঁহার প্রতিবাসী জমিদার উমাচরণ বাবুর নায়েব ছিলেন। আমার সাত বৎসর বয়সের সময় মায়ের মৃত্যু হয়, কিন্তু পিতার স্নেহে কোনদিন মাতার অভাব জানিতে পারি নাই। কাজকর্মের অনুরোধে পিতাকে সর্বদাই উমাচরণ বাবুর বাড়ি থাকিতে হইত, আমি একাকী বাড়ি থাকিতে পারিতাম না, আমিও জমিদারদের বাড়িতে থাকিতাম; ক্রমে উমাচরণবাবুর বাড়িই আমার বাড়ি হইয়া উঠিল। উমাচরণ বাবুর দুইটি মাত্র কন্যা, বড়টির নাম বসন্ত, বিবাহের অল্পকাল পরেই বিধবা হইয়া তিনি এখন তাঁহার খুড়শাশুড়ির সহিত কাশীবাস করিতেছেন। আমি তাঁহাকে কখনো দেখি নাই, অথবা নিতান্ত শৈশবকালে দেখিয়া থাকিব মনে নাই, শুনিয়াছি তাঁহার খুড়শ্বশুর কলিকাতার একজন প্রসিদ্ধ দালাল ছিলেন এবং প্রচুর অর্থ সঞ্চয় করিয়াছিলেন।
উমাচরণ বাবুর কনিষ্ঠা কন্যার নাম শরৎ। আমা অপেক্ষা তিনি পাঁচ বৎসরের বড়। কলিকাতার কোন সম্রান্ত যুবকের সহিত বিবাহ হইয়াছে, নাম শ্রীশচন্দ্র, তিনি ডিপুটী ম্যাজিস্ট্রেটী করেন। শরৎকে আমি দিদি বলিয়া ডাকি এবং দিদির মত ভক্তি করি, তিনিও আমাকে ছোট ভগিনীর মত স্নেহ করেন; আমাদের মধ্যে কখনো প্রভু ভৃত্যের আচরণ লক্ষিত হইত না। দিদিকে পড়াইতে পণ্ডিত আসিতেন, আমিও তাঁহার কাছে পড়িতাম। দিদির বিবাহের পর পণ্ডিত আসিতেন না, আমরা দুজনেই পড়াশুনা করিতাম।
আমার বার বৎসর বয়সের সময়ে বাবার মৃত্যু হইল। মৃত্যুকালে বাবা দিদিকে বলিলেন, ‘শরৎ, কুসুমকে তোমার হাতেই দিয়া যাইতেছি, তুমি ভিন্ন তাহাকে স্নেহ করিবার এ সংসারে আর কেহ থাকিল না।’ পরে উমাচরণ বাবুর দিকে চাহিয়া বলিলেন, ‘দেখিয়া শুনিয়া কুসুমের একটা বিবাহ দিবেন, নিতান্ত লক্ষ্মীছাড়ার হাতে না পড়ে; আপনাকে আর বেশি কি বলিব, যতদিন বাঁচিয়াছিলাম আমার ভার লইয়াছিলেন, আমার অনাথ কন্যাটির ভারও আপনি ভিন্ন আর কে গ্রহণ করিবে?’
উমাচরণ বাবু অশ্রুপূর্ণলোচনে পিতার অন্তিম প্রার্থনা স্বীকার করিলেন।
সেই সময় হইতে আমি কায়েমী রকমে উমাচরণ বাবুর পরিবারভুক্ত হইলাম। একটা কথা বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি, সেইটি আমার জীবনের সর্বপ্রধান কথা। নগেন্দ্রনাথ নামে একটি বালক উমাচরণ বাবুর বাড়ি সর্বদা আসিতেন, উমাচরণ বাবুর সহিত তাঁহার অন্য সম্বন্ধও ছিল, বসন্তের শ্বশুর নগেন্দ্রের মামা হইতেন। নগেন্দ্রের পিতা অত্যন্ত দরিদ্র ছিলেন, পৌরহিত্য করিয়া কোন প্রকারে দিন যাপন করিতেন। আমার পিতার মৃত্যুর এক বৎসর পরে, নগেন্দ্রও পিতৃহীন হইলেন; তখন তাঁহার বয়স উনিশ বৎসর।
একদিন সন্ধ্যাকালে গা ধুইয়া নদীতীর হইতে বাড়ি আসিতেছি, উমাচরণ বাবুর আম বাগানের নিকট নগেন্দ্রের সহিত দেখা হইল। তাঁহার মুখ বিষণ্ণ, অশ্রুপূর্ণ লোচনে আমাকে বলিলেন, ‘কুসুম, আমি আর এখানে থাকিয়া কি করিব? ভগবান জানেন তোমাকে দিনান্তে একবার দেখিলেও আমি কত সুখী হইতাম, কিন্তু এখানে বসিয়া আলস্যে এ জীবন বৃথা ক্ষেপণ করিব না। সংসারে সকলেই কিছু না কিছু কাজ করিতেছে, সংসারস্রোতে তৃণের ন্যায় না ভাসিয়া আমিও যাহাতে কিছু করিতে পারি তাহারই চেষ্টায় যাইব, কিন্তু যাইবার আগে তোমার নিকট একটা কথা শুনিবার ইচ্ছা আছে, আমার ভবিষ্যতের চেষ্টা, উদ্যম, সুখ সমস্ত তাহারই উপর নির্ভর করিতেছে। যতদিন তোমাকে বিবাহ করিবার যোগ্য না হই, ততদিন কি তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করিবে?’
আমি কি উত্তর দিব? আমার চক্ষু দিয়া জল পড়িতে লাগিল। আমি সে কথার কোন উত্তর না করিয়া বলিলাম, ‘আবার কবে আসিবে, আবার আমাদের কবে দেখা হইবে?’
বোধ করি আর বেশী কিছু বলার আবশ্যক ছিল না; নগেন্দ্র আমার মনের ভাব বুঝিলেন।
সন্ধ্যার অন্ধকারে নগেন্দ্র আমার অশ্রু দেখিতে পান নাই; আমার কম্পিত কথা শুনিয়া কাতরভাবে বলিলেন, ‘কুসুম কাঁদিতেছ? কাঁদিও না। ঈশ্বর যদি মুখ তুলিয়া চান, তোমাকে সুখী করিয়া সুখী হওয়া ভিন্ন আমি আর অধিক কিছু চাহি না। আবার দেখা হইবে; যখন যেখানে থাকি পত্র লিখিব, তুমি ভাই উত্তর লিখিতে ভুলিও না।’
সেই সন্ধ্যার অন্ধকারে নগেন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে চলিয়া গেলেন, আমি অশ্রুপূর্ণ নেত্রে কাতর দৃষ্টিতে তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিলাম। অনেকক্ষণ পর্যন্ত তাহাঁর পদধ্বনি শুনিতে পাওয়া গেল, আমি উৎকর্ণ হইয়া শুনিতে লাগিলাম। বসন্তের মৃদু সান্ধ্য সমীরণ হিল্লোলে বৃক্ষপত্র কাঁপিতেছে, আম্রবাগানে অন্ধকার নিবিড়তর হইয়াছে, ঝিঁঝিঁ অবিরাম ঝঙ্কারে চতুর্দিক পূর্ণ করিয়াছে এবং বৃক্ষপত্রে শত শত জোনাকি মিট্মিট্ করিয়া জ্বলিতেছে। কতক্ষণ আমি বিহ্বল হৃদয়ে সেখানে দাঁড়াইয়া রহিলাম। অনেকক্ষণ পরে উজ্জ্বল নক্ষত্রপূর্ণ অনন্ত আকাশের দিকে চাহিয়া যুক্ত করে বলিলাম, ‘ভগবান, নগেন্দ্রকে কুশলে রাখিও, যেন তাঁহার কোন বিপদ না ঘটে।’
নগেন্দ্র আমাকে যেরূপ বলিয়াছিলেন,উমাচরণ বাবুর নিকট গিয়া সেইরূপ প্রস্তাব করিলেন। কিন্তু উমাচরণ বাবু তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত না হইয়া বলিলেন, ‘তোমার কবে কাজকর্ম হইবে তাহার অপেক্ষায় আমি কুসুমকে অবিবাহিত রাখিতে পারিব না। সে বড় হইয়াছে, ভাল পাত্রের অপেক্ষায় মাত্র এতদিন তাহার বিবাহ দিই নাই। তাহাকে যদি বিবাহ করিতে চাও তো বিবাহ করিয়া তুমি কার্যের জন্য যাও। কুসুম আপাতত আমাদের ঘরে থাক। তাহার পর যখন সুবিধা করিতে পারিবে তখন ইহাকে লইয়া যাইও।’
উমাচরণ বাবুর এই দৃঢ় সংকল্প কিছুতেই বিচলিত হইল না। নগেন্দ্রনাথ আমাকে বিবাহ করিয়া রাখিয়া গেলেন।
স্বামী শান্তিপুর ত্যাগ করিয়া প্রথমে তাঁহার মামীর কাছে কাশীতে গমন করিলেন। সেখানে একজন ভদ্রলোকের সহিত বিশেষ পরিচয় হওয়ায় তাঁহার সাহায্যে বর্ধমানে ইঞ্জিনিয়ারের অফিসে একটি কেরানিগিরি পদ প্রাপ্ত হইলেন। তাঁহার বেতন সামান্য, সুতরাং আমাকে তখন সেখানে লইয়া যাওয়া তাঁহার পক্ষে সুবিধা হইল না, আমি শান্তিপুরেই রহিলাম। কিছুদিন পরে দিদি তাঁহার স্বামীর কর্মস্থান হুগলিতে আগমন করায় আমিও তাঁহার সঙ্গী হইলাম। স্বামী অবসর পাইলেই মাঝে মাঝে বর্ধমান হইতে হুগলি আসেন।
সুখে দুঃখে দুই বৎসর কাটিল। ১২৮—সালের ভাদ্র মাস আসিল। ৪ঠা ভাদ্র স্বামী আমাদের সঙ্গে দেখা করিতে আসিবেন কথা ছিল; সেইদিন সকাল বেলা তাঁহার একখানি পত্র পাইলাম, তিনি লিখিয়াছেন, ‘কুসুম হুগলিতে যাইতে পারিলাম না। কাশী হইতে মামীমা টেলিগ্রাম করিয়াছেন। বিশেষ প্রয়োজন। এই ট্রেনেই যাইতেছি। দেখা হইল না বলিয়া দুঃখিত হইও না। ফিরিয়া আসিয়া দেখা করিব।’
পূর্বেই বলিয়াছি, বসন্ত দিদির শ্বাশুড়ি আমার স্বামীর মামী, বসন্ত দিদি ও তিনি অনেক দিন হইতেই কাশী বাস করিতেছেন, পুরুষ অভিভাবক সেখানে কেহ ছিল না, পুরুষের মধ্যে বসন্ত দিদির এক খুড়তুতো দেবর গোপালচন্দ্র; শুনিয়াছি তিনি কলিকাতায় থাকিতেন, এদানি তাঁহার চরিত্র ও ব্যবহার নিতান্দ মন্দ হইয়াছিল বলিয়া তাঁহার পিতৃব্য-পত্নী তাঁহাকে দেখিতে পারিতেন না। কত্রীর বয়স অনেক হইয়াছিল। তাঁহার নগদ টাকাকড়ি প্রচুর, সদ্ব্যয়ও যথেষ্ট। স্বামী তাঁহার সম্পত্তি স্ত্রীকে সমস্ত দান করিয়া গিয়াছিলেন, সুতরাং এ সম্পত্তিতে তাঁহার দান বিক্রয়ের অধিকার ছিল। স্বামীকে হঠাৎ টেলিগ্রাম করায় মনে হইল হয়তো তাঁহার অন্তিমকাল নিকটবর্তী হইয়া আসিয়াছে, বৈষয়িক কোন বন্দোবস্তের জন্যেই তাঁহাকে ডাকিয়াছেন।
স্বামীর কাশী রওনার পর পাঁচদিন কাটিয়া গেল। কোন পত্রাদি না পাওয়ায় মনে বড়ই দুর্ভাবনা হইল; আবার ভাবিলাম, নানাকাজে ব্যস্ত আছেন বলিয়া হয়তো তিনি পত্র লিখিবার অবসর পান নাই; কিন্তু ইচ্ছা থাকিলে কি এই কয়দিনে একখানি পত্র লেখা যায় না? আমরা স্ত্রীলোক, সকল সময়েই আমাদের ভাবনা, কিন্তু যাহারা পুরুষ, সর্বদা কাজে ব্যস্ত থাকেন, আমাদের দুর্ভাবনায় তাহাদের কেন মাথাব্যথা করিবে?
আরও দুই তিন দিন পরে ঝি দিদির হাতে একখানি ডাকের চিঠি আনিয়া দিল, দিদি খুলিয়া পড়িতে লাগিলেন, কোথাকার পত্র জানিবার জন্য আমি দিদির নিকটে আসিয়া দাঁড়াইলাম, পত্র পড়িতে পড়িতে দিদি একবার আমার দিকে চাহিয়াই আবার মুখ নামাইলেন, দেখিলাম তাঁহার চক্ষু ছলছল করিতেছে, পত্র পড়িয়া মুখখানি শুকাইয়া গিয়াছে; আমি সোদ্বেগে বলিলাম, ‘দিদি কোথাকার পত্র?’
দিদি কাতরদৃষ্টিতে আমার দিকে চাহিয়া মৃদুস্বরে বলিলেন, ‘কাশীর।’
‘কাশীর পত্র, তাঁহার তো কোন অমঙ্গল সংবাদ নাই?’ মনের মধ্যে হঠাৎ এই কথার উদয় হইল, ব্যগ্রভাবে দিদিকে বলিলাম, ‘কাশীর পত্র? কে লিখিয়াছেন? দিদি তুমি ওরকম করিতেছ কেন? কিছু খারাপ খবর আছে? মাথা খাও, শীঘ্র বল।’
দিদি কিছু উত্তর না করিয়া পত্রখানি আমার হাতে দিলেন। আমি অত্যন্ত ব্যগ্রভাবে পড়িতে লাগিলাম, আমার সর্বশরীর বাতাহত কদলী পত্রের ন্যায় কাঁপিতে লাগিল। বসন্তদিদির পত্র, শরৎ দিদিকে লিখিয়াছেন, ‘শরৎ, আমাদের সর্বনাশ হইয়া গিয়াছে। কর্ত্রীঠাকুরাণী খুন হইয়াছেন। আজ কয়দিন হইল তাঁহার ভাগিনেয় নগেন্দ্রনাথ বর্ধমান হইতে তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছিলেন, আমার দুর্বুদ্ধি সেদিন সন্ধ্যার পূর্বে আমি বিন্দু ঠাকুরমার সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিলাম, ফিরিয়া আসিতে একটু রাত্রি হইয়াছিল, আসিয়া দেখি ঠাকুরাণীর প্রাণহীন দেহ বিছানায় পড়িয়া আছে, রক্তে সমস্ত শয্যা প্লাবিত। তাঁহার হাতবাক্সে নগদ ও নোটে পাঁচশত টাকা ছিল, তাহাও নাই, নগেন্দ্রনাথও সেই রাত্রি হইতে নিরুদ্দেশ। সকলেরই বিশ্বাস একাজ নগেন্দ্রনাথ ভিন্ন অন্য কাহারও নহে।’ আর পড়িতে পারিলাম না, মাথা ঘুরিয়া উঠিল। এ কি স্বপ্ন, না ইন্দ্রজাল? কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। সেই সত্যনিষ্ঠ, ধার্মিক, সরল, সুন্দর পুরুষ—তাঁহার এই কাজ? ইহা কি কখনো সম্ভব হইতে পারে?
অনেক চিন্তার পর মন সংযত করিলাম। বুঝিলাম দারুণ আঘাতে ভাঙিয়া পড়িবার এ সময় নহে। এই ভীষণ পৈশাচিক কার্য কখনোই তাঁহার দ্বারা সংঘটিত হয় নাই; ইহার ভিতর নিশ্চয়ই কোন গভীর রহস্য লুক্কায়িত আছে। যে কলঙ্ক সাগরে তাঁহার সুনাম ডুবিয়াছে, যে রহস্যময় গুপ্তহত্যার জন্য তাঁহার জীবন বিপন্ন হইয়াছে, সেই কলঙ্ক সাগর হইতে, সেই বিষম বিপদ হইতে তাঁহাকে নিষ্কলঙ্কভাবে উদ্ধার করিব, এই গুপ্ত রহস্য ভেদ করিব; না হয় এ জীবন যাহার জন্য রাখিয়াছি তাঁহারই কাজে বিসর্জন দিব।
বৈকালবেলা শরৎ দিদিকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘দিদি, তুমি কি তাঁহাকে দোষী বলিয়া মনে কর?’
ম্লান হাসি হাসিয়া দিদি উত্তর দিলেন, ‘কখনো না, নগেন্দ্র এরকম কাজ করিতে পারে দেখিলেও বিশ্বাস হয় না। নিশ্চয়ই ইহার মধ্যে কোন রহস্য আছে।’
আমি নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলাম, ‘দিদি বাঁচাইলে, তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক। এই ঘটনার মধ্যে যে একটি গুপ্তরহস্য রহিয়াছে আমিও তাহা বুঝিতে পারিতেছি। আমি সেই রহস্য ভেদ করিব। তাঁহাকে উদ্ধার করিব।’
দিদি বোধ করি আমার কথার অর্থ বুঝিতে পারিলেন না; শূন্য দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। আমি আবার বলিলাম, ‘দিদি, আমার এই শেষ অনুরোধ তোমাকে রক্ষা করিতে হইবে, বসন্ত দিদি এই পত্রে তোমাকে একজন ঝি পাঠাইতে লিখিয়াছেন, বেণীর সঙ্গে আজই আমাকে পাঠাইয়া দাও, আমি সেখানে দাসীগিরিতে নিযুক্ত হইব।’
দিদি অবাক হইয়া গেলেন, আমাকে বলিলেন, ‘তই বলিস্ কি, পাগল হলি নাকি?’
আমি বলিলাম, ‘না দিদি, পাগল হইনি, কিন্তু এখন আমাকে পাগলের অপেক্ষা দুঃসাহসের কাজ করিতে হইবে, তুমি তাহাতে বাধা দিও না।’
দিদি উত্তর দিলেন, ‘তুই যে অসম্ভব কথা বলিস, এখন সেখানে কি রকম অবস্থা ভেবে দেখ দেখি, এখন কি তোকে সেখানে পাঠান উচিত? চারিদিকে পুলিস ঘুরচে, বাড়িঘর হোটেলের মতো হয়েছে, কখন কার কি বিপদ ঘটে ঠিক নেই, চাকর বাকর পর্যন্ত ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে, তাই দিদি একজন বিশ্বাসী বাঙালী ঝি পাঠাতে লিখেছে, আর সেই জায়গায় তোকে পাঠাব? দিদিই বা কি মনে করবে? আর তুই যে দাসীগিরি করবি তা আমার প্রাণে সহ্য হবে না।’
আমি বলিলাম, ‘বসন্তদিদি আমাকে কখন দেখেন নাই, সুতরাং ঝি বলিয়া পরিচয় দিলে তাঁর কোন সন্দেহ হবে না, বিশেষ যে জন্য এ দাসীগিরি নিতে চাই, মনে কর দেখি সেটি কত বড় গুরুতর কাজ। তোমার কিছু ভাবনা নেই, আমার যাবার বন্দোবস্ত ঠিক করে দাও, আমার জন্যে অনেক করেছ, এই উপকারটুকু করে আমাকে বাঁচাও।’ আমি কাঁদিতে লাগিলাম।
দিদি অনেকক্ষণ চিন্তা করিলেন, অবশেষে বলিলেন, ‘কুসুম তোর বড় সাহস, জানি না তোর মনে কি আছে, যাই থাক, ভগবান তোর মনস্কামনা পূর্ণ করুন।’
বাড়ির পুরাতন বিশ্বাসী ভৃত্য বেণী ঘোষের সঙ্গে সেই রাত্রেই কাশীযাত্রা করিলাম।
নির্দিষ্ট সময়ে বারাণসীধামে উপস্থিত হইলাম। আজ সমস্তদিন ধরিয়া ঝুপ্ঝাপ্ করিয়া বৃষ্টি হইয়াছে, বাহ্য প্রকৃতি বিমর্ষ ও অন্ধকারপূর্ণ, ঠিক আমার মানসিক অবস্থার অনুরূপ। দীর্ঘ-পর্যটনে সর্বশরীর ঘুরিতেছে। কুলনারী—কখনো বাধাবিঘ্নহীন মুক্ত পৃথিবীতে এরূপভাবে পদক্ষেপ করি নাই; চারিদিকে এত লোক, এমন ব্যস্তভাব, কার্যক্ষেত্রের কল্লোল,—দুর্বল, অনাথিনী, অনভিজ্ঞ বালিকা নিজের ক্ষমতা না বুঝিয়া তাহারই মধ্যে ঝাঁপাইয়া পড়িলাম। এখন একমাত্র অনাথনাথ ভিন্ন আমার আর সহায় কে?
স্টেশন হইতে একখানি গাড়ি ভাড়া করিয়া বসন্ত দিদিদের বাড়ি আসিতে আসিতে এই সকল কথা ভাবিতে লাগিলাম। দুর্গন্ধময়, অপরিসর, আঁকা-বাঁকা পাথরের রাস্তা দিয়া গাড়ি চলিতে লাগিল। দুইপাশে ছোট ছোট দ্বিতল ও ত্রিতল গৃহ, দুই একটি গৃহকক্ষ হইতে ক্কচিৎ দীপালোক আসিয়া রাস্তায় পড়িয়াছে এবং পথের স্থানে স্থানে দুই চারিজন লোক একত্র হইয়া আমার দুর্বোধ্য ভাষায় উচ্চস্বরে কথাবার্তা কহিতেছে।
বাড়ি পৌঁছিতে রাত্রি নয়টা বাজিল। শুনিলাম এই স্থানটির নাম ‘গঙ্গামহল্লা’। অনেকদিনের পুরাতন প্রকাণ্ড বাড়ি; গাড়ি হইতে নামিয়া ভিতরে প্রবেশ করিতেই গাটা ছম্ছম্ করিয়া উঠিল, চারিদিকে অন্ধকার, লোকজনেরও অত্যন্ত অভাব, তাহার উপর অতি অল্পদিন হইল বাড়িতে একটি দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে। বেণী আমার আগে আগে একটি বাতি ধরিয়া চলিতে লাগিল; আমি যাই আর চারিদিকে চাহিয়া দেখি। অল্প আলোকে চারিদিক আরো অন্ধকার, সমস্ত বাড়িটা যেন এক বিরাট শ্মশানপুরীর মত বোধ হইতে লাগিল।
একটি অপরিসর ভগ্নপ্রায় সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিলাম। বসন্ত দিদি এক কক্ষে বসিয়া গালে হাত দিয়া কি ভাবিতেছিলেন, যদিও তাঁহাকে কখনো দেখি নাই, তথাপি দেখিয়া চিনিতে পারিলাম। বেণী ঘরে প্রবেশ করিয়াই তাঁহাকে প্রণাম করিল, আমিও প্রণাম করিলাম। বেণীর সহিত কথা কহিতে কহিতে তিনি সবিস্ময়ে দুই একবার আমার দিকে চাহিলেন। বেণী যখন বলিল আমি ঝি, তখন তাঁহার বিস্ময় আরও বাড়িয়া উঠিল। আমার কাছে শরৎ দিদির পত্র ছিল, বাহির করিয়া তাঁহাকে দিলাম, দেখিলাম পত্র পড়িতে পড়িতে তাঁহার মুখের নানাপ্রকার ভাব হইতেছে, না জানি শরৎ দিদি তাঁহাকে কি কথাই লিখিয়াছেন।
অল্পক্ষণ পরে একটি স্ত্রীলোক সেই কক্ষে প্রবেশ করিল; সে ঘরে প্রবেশ করিয়াই আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাহিতে লাগিল। তাহার বয়স অল্প এবং আকার ইঙ্গিতে বোধ হইল সে পবিত্ৰচরিত্রা নহে। তাহাকে দেখিয়াই আমার মন বড় অপ্রসন্ন হইয়া উঠিল। এমন দুই একটি লোক থাকে, যাহাদের উপর প্রথম দৃষ্টিতেই কেমন একটা খারাপভাব দাঁড়াইয়া যায়, এ স্ত্রীলোকটি সম্বন্ধেও আমার সেইরূপ হইল।
বসন্ত দিদি তাহাকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, ‘বামা, আমাদের নতুন ঝি এসেছে, এর নাম অন্নপূর্ণা, কিছু জলখাবার যোগাড় করে দে দেখি, দুজনের মত খাবার আনিস।’
আহারান্তে বসন্ত দিদির গৃহপ্রান্তে একটি ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে আমার শয়নের স্থান নির্দিষ্ট হইল। দ্বার বন্ধ করিয়া শয়ন করিলাম, পথশ্রান্ত হইয়াছিলাম, শীঘ্রই ঘুমাইয়া পড়িতাম।
অনেকরাত্রে হঠাৎ টক্ টক্ শব্দ শুনিয়া নিদ্রাভঙ্গ হইল। প্রথমে ভাবিলাম বাতাসে দ্বার নড়িতেছে কিন্তু বাতাসে সে দিকের দ্বার নড়িবার কোন সম্ভাবনা ছিল না। প্রদীপটা প্রায় নিবু নিবু হইয়া আসিয়াছিল, তাড়াতাড়ি উঠিয়া উস্কাইয়া দিলাম এবং অন্য কোন শব্দ শুনিতে পাওয়া যায় কি না জানিবার জন্য উৎকর্ণ হইয়া রহিলাম।
মৃদুস্বরে কে বলিল, ‘দোরটা একবার খোল।’
দ্বারের নিকট আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘আপনি কে?’
‘ভয় নাই, দ্বার খোল, আমি বসন্ত।’
নিঃশব্দে দ্বার খুলিয়া দিয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম। বসন্ত দিদি আমার বিছানায় আসিয়া বসিলেন, বলিলেন, ‘শরতের পত্রে আমি সমস্ত জানিয়াছি। তোমাকে কখনো দেখি নাই, কিন্তু তোমার সম্বন্ধে সর্বদাই সকল কথা শুনিতে পাইতাম। বড় দুঃখ যে আজ তোমাকে ঝির মত লইতে হইল, ভগিনীর মত সম্ভাষণ করিয়া লইতে পারিলাম না; কিন্তু ভগিনী, তুমি কেন এ বিদেশে এমন দুঃসাহসের কাজে হস্তক্ষেপ করিতে আসিলে? পুলিশের দক্ষ কর্মচারীরা যে রহস্য ভেদ করিতে অক্ষম তুমি তাহার কি করিবে? তুমি ছেলেমানুষ,তাই মনে করিয়াছ হৃদয় ব্যগ্র হইলেই অসম্ভব সম্ভব হইয়া পড়ে।
আমি কিয়ৎক্ষণ নীরব রহিলাম। তাহার পর বলিলাম, ‘দিদি,আমার ক্ষমতা অতি যৎসামান্য, কিন্তু আমার ক্ষমতা বুঝিলে কখনো এতদূর অগ্রসর হইতাম না। এই কার্যে হস্তক্ষেপ করিবার পূর্বেও অনেক চিন্তা করিয়া তবে এই ব্রত গ্রহণ করিয়াছি। আপনাকে আমার একটিমাত্র প্রশ্ন আছে, আপনি অবশ্য দুই তিনবার তাঁহাকে দেখিয়াছেন, এই ভীষণ কর্ম তাঁহার কৃত বলিয়া কি আপনার সন্দেহ হয়?’
‘কখনো না। নগেন্দ্রনাথের চরিত্র অনিন্দ্যনীয়, যতদূর দেখিয়াছি, বুঝিয়াছি এই ভয়ানক দুষ্কর্ম দূরের কথা, কোন অন্যায় কাজই তাঁহার দ্বারা হওয়া অসম্ভব। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের মধ্যে যে কি রহস্য আছে তাহা আমি কিছুতেই বুঝিতে পারিতেছি না। সকলের সন্দেহ নগেন্দ্রই এ কর্ম করিয়াছেন, যা কিছু প্রমাণ তাহাও তাঁহার বিরুদ্ধেই পাওয়া যাইতেছে অথচ বেশ বুঝিতেছি এ কাজ তাঁহার নহে।’
আমি ব্যগ্রভাবে বলিলাম, ‘দিদি, তাহা হইলে এই দুঃসাহসে প্রবৃত্ত হইয়া আমি অন্যায় করি নাই, যদি তাঁহাকে বাঁচাইতে গিয়া প্রাণও যায় তবে বুঝিব একজন নিরপরাধীকে রক্ষা করিতে গিয়াই বিপদে পড়িয়াছি। আমি দুর্বল রমণী, আমার চেষ্টা সামান্য হইতে পারে কিন্তু সামান্য চেষ্টা হইতেই কত সময় কত মহৎ ফল লাভ হইয়াছে।’
দিদি স্নেহ-কোমল স্বরে বলিলেন, ‘ভগিনী, তোমার চেষ্টা সফল হউক। ঘটনাবৈচিত্র্যে নগেন্দ্রের চরিত্রে যে কলঙ্ক আরোপিত হইয়াছে, তাহা হইতে তাহাকে মুক্ত দেখিলে বড় আনন্দিত হইব; এজন্য অর্থব্যয় করিতেও আমি কুণ্ঠিত নহি।’
আমি সানুনয়ে বলিলাম, ‘দিদি, আপনার কথা শুনিয়া প্রাণ জুড়াইল; কিন্তু আপনাকে একটি কথা জিজ্ঞাসা করিব, কাহারো উপর কি আপনার সন্দেহ হয়!’
দিদি সঙ্কুচিত স্বরে বলিলেন, ‘সন্দেহ—কাহাকে সন্দেহ করিব! কিছুই ভাবিয়া ঠিক করিতে পারিতেছি না; মনের মধ্যে একটা সন্দেহ জাগিয়া উঠে, আবার তখনি তাহা দূর হইয়া নূতন সন্দেহ হৃদয় অধিকার করে।’ দিদি কিয়ৎক্ষণের জন্য নিস্তব্ধ হইলেন, তাহার পর বলিলেন, ‘রাত্রি বেশি হইতেছে, শয়ন কর, যতটুকু সম্ভব তোমাকে সাহায্য করিব!’
আমি বলিলাম, ‘কেহ যেন আপনার ব্যবহারে সন্দেহ না করে যে আমি ঝি নই।’
‘পাগল, তাহা হইলে আর এত রাত্রে চুপে চুপে তোমাকে এ সমস্ত কথা বলিতে আসিব কেন! সকলে তোমাকে নূতন ঝি বলিয়াই জানিবে।’ এই কথা বলিয়া দিদি উঠিলেন, আমি দ্বার বন্ধ করিয়া আবার শয়ন করিলাম।
পরদিন দুই প্রহরের পর বসন্ত দিদিকে একাকী পাইয়া এই হত্যা সম্বন্ধে নানা কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম। পুলিশের কাছে কে কিরূপ জবানবন্দী দিয়াছে ইহাই জানিতে আমার সর্বাপেক্ষা অধিক কৌতূহল হইল। বসন্ত দিদি বলিলেন, ‘তিনজন ঝির মধ্যে কামিনীর অসুখ করায় সে এই দুর্ঘটনার দিন এ বাড়িতে ছিল না, ফুলেশ্বরী বাহিরের কাজে ছিল, শুধু বামাই কর্ত্রীর নিকটে ছিল।’
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কর্ত্রীর কাছে ছিল কেন!’
দিদি বলিলেন, ‘তাহার শরীর খারাপ হইয়াছিল, কখন কি দরকার হয়, সেইজন্য সেখানে ছিল।’
আমি। ‘পুলিশের কাছে সে কি সাক্ষী দিয়েছে? আপনার ঠিক মনে আছে কি?’
দিদি। ‘আছে বৈকি। সে বলিল, বেলা চারিটা পর্যন্ত তিনি ভাল ছিলেন, তাহার পর তাঁহার অল্প শরীর খারাপ হওয়ায় তিনি শয়ন করেন; অল্পক্ষণ পরে নগেন্দ্রবাবু তাঁহার ঘরে আসিলেন, তাহাকে দেখিয়া গিন্নি আমাকে দোয়াত কলম আনিতে বলিলেন, গিন্নি উঠিয়া হাতবাক্স খুলিয়া একখানি কাগজ নগেন্দ্রবাবুর হাতে দিলেন, আমি দোয়াত কলম আনিয়া দেখিলাম বাক্স খোলা রহিয়াছে, একটা কাঁসার বাটিতে টাকা ও নোট রহিয়াছে, টাকা ও নোটে কত টাকা হইবে ঠিক বলিতে পারি না, চারি পাঁচ শত হইতে পারে। আমি দোয়াত কলম আনিয়া দিলে গিন্নি আমাকে নিচে যাইতে বলিলেন, আমি নিচে না গিয়া দ্বারের আড়ালে দাঁড়াইয়া রহিলাম, তাঁহাদের কি কথাবার্তা হয় জানিবার জন্য আমার বড় ইচ্ছা হইয়াছিল, কিন্তু তাঁহাদের কথা শুনিতে পাই নাই, দুই একবার ‘উইল’ এই কথাটি শুনিয়াছিলাম, নগেন্দ্রবাবুর মুখেই শুনিয়াছিলাম। নগেন্দ্রবাবুর মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলাম তাঁহার মুখ কিছু ভার হইয়াছে। তাহার পর অনেকক্ষণ আর তাঁহাদের মধ্যে কোন কথা হইল না, আমি নিচে আসিলাম। প্রায় আধঘণ্টা পরে নগেন্দ্রবাবু নিচে আসিলেন, তাঁহার কাপড়ে রক্তের দাগ ছিল কি না অন্ধকারে দেখিতে পাই নাই, তিনি আমাকে ধরা ধরা আওয়াজে বলিলেন, ‘বামা, মামীমা এখন একটু ঘুমিয়েছেন, তিনি না ডাকিলে তোমার উপরে যাইবার দরকার নাই।’ এই বলিয়া তিনি চলিয়া গেলেন, বৌদিদি রাত্রে ফিরিয়া আসিয়া উপরে উঠিলেন এবং হঠাৎ চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন, আমরা দৌড়িয়া যাইয়া দেখিলাম বিছানা রক্তে ভাসিয়া যাইতেছে, গিন্নির প্রাণ বাহির হইয়া গিয়াছে।’
কথাগুলি দুই তিনবার মনের মধ্যে তোলপাড় করিলাম, তাহার পর বসন্তদিদিকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘বামা কি পুলিশ কর্তৃক জিজ্ঞাসিত হইয়া প্রত্যেক কথার উত্তর দিয়াছে, না নিজেই পর পর সকল কথা বলিয়া গিয়াছে।’
দিদি। ‘পুলিশে জিজ্ঞাসা করিলেই উত্তর দিয়াছে, তবে নিজেও দুই একটি কথা বলিয়াছে।’
আমি ঔৎসুক্যের সহিত বলিলাম, ‘কোন্ কোন্ কথা?’
দিদি। ‘নগেন্দ্রের মুখ ভার হইয়াছিল কি না এ সম্বন্ধে তাহাকে পুলিশে কিছু জিজ্ঞাসা করে নাই। তাহার পর যখন তাহাকে জিজ্ঞাসা করা হয় সে নগেন্দ্রের কাপড়ে রক্তের দাগ দেখিয়াছে কি না, তখন সে ‘অন্ধকারে তাহা দেখিতে পাই নাই, তিনি আমাকে ধরা ধরা আওয়াজে বলিলেন,’ ইত্যাদি কথা নিজেই বলিয়া গেল।
অল্পক্ষণ চিন্তা করিলাম, অনন্তর দিদিকে বলিলাম, ‘আপনি কিরূপ সাক্ষী দিয়াছেন?’
দিদি বিষণ্ণভাবে বলিলেন, ‘আমি যতটকুকু জানি ঠিক ততটুকুই বলিয়াছি, নগেন্দ্রনাথের এখানে আসিবার কারণ জিজ্ঞাসা করিলে সত্যের অনুরোধে আমাকে বলিতে হইল যে কর্ত্রী ঠাকুরাণী আমাকে একদিন বলিয়াছিলেন ‘উইলখানি নগেন্দ্রের সাক্ষাতেই পরিবর্তন করিব বলিয়াই তাহাকে এখানে আনাইয়াছি, কবে মরিয়া যাইব, গোপালের স্বভাব চরিত্র ভাল নয়, তাই আগে রাগ করিয়া তাহাকে কিছু দিই নাই, এখন ভাবিয়াছি সে যেমনই হোক, তাহাকে পথের ভিখারি করা উচিত নহে, দুই ভাইকেই কিছু কিছু দিয়া যাইব।’ পুলিশে পুনর্বার আমাকে প্রশ্ন করিল, ‘নগেন্দ্রের হঠাৎ চলিয়া যাইবার আপনি কোন কারণ জানেন কি না?’ আমি তাহার উত্তরে বলিয়াছি, ‘না, আমি এমন কোন কারণ জানি না যাহাতে নগেন্দ্র হঠাৎ চলিয়া যাইতে পারেন। দুর্ঘটনার দিন বৈকালে বিন্দুঠাকুরমার সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিলাম, রাত্রে ফিরিয়া আসিয়া আর নগেন্দ্রকে দেখিতে পাই নাই।’ এই কথায় বোধ হয় তাঁহার উপর অনেক দোষ পড়িয়াছে, কিন্তু যাহা সত্য তাহাই আমাকে বলিতে হইয়াছে, কি কুক্ষণেই যে সেদিন বাড়ির বাহিরে পা দিয়াছিলাম। বাড়ি থাকিলে হয়তো এ বিপদ ঘটিত না। বুঝিতেছি নগেন্দ্র নির্দোষ, কিন্তু সমস্ত প্রমাণ তাঁহার প্রতিকূলে দাঁড়াইতেছে, এ অবস্থায় সকলে তাঁহাকে নির্দোষ মনে করিবে কেন?’
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘তাহাঁর বিরুদ্ধে কি আর কোন প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে?’
দিদি বলিলেন, ‘গিয়াছে। কর্ত্রীঠাকুরাণীর বাক্সে যে উইল পাওয়া গিয়াছে তাহাতে লিখিত ছিল ‘তাঁহার দেবরপুত্র গোপালচন্দ্র বিশেষ কোন কারণে তাঁহার অপ্রীতিভাজন হওয়ায় তিনি তাহাকে তাঁহার সমস্ত সম্পত্তি হইতে বঞ্চিত করিলেন। তাঁহার স্বামীর নামে একটি অনাথ আশ্রম স্থাপন ও তাহার ব্যয় নির্বাহের জন্য বার হাজার টাকা ব্যতীত সমস্ত সম্পত্তি তাঁহার ভাগিনেয় নগেন্দ্রনাথকে প্রদান করিলেন। তাঁহার মৃত্যুর পর নগেন্দ্রনাথ সমস্ত সম্পত্তির অধিকারী হইবেন, তবে তিনি ইচ্ছা করিলে এই উইলের পরিবর্তন বা সংশোধন করিতে পারিবেন।’ উইলের উপরোক্ত মর্ম পাঠ করিয়া নগেন্দ্রনাথের উপর পুলিশ-কর্মচারীগণের সন্দেহ আরও বাড়িয়া উঠিল। এমন কি তাহারা বলাবলি করিতে লাগিল, ‘উইল পাঠ করিয়া নগেন্দ্রনাথ আর স্থির থাকিতে পারে নাই, পাছে কর্ত্রীর মত পরিবর্তিত হয় এবং গোপালকে তিনি বিষয়ের কিয়দংশ দান করিয়া যান এই আশঙ্কায় নগেন্দ্র তাঁহাকে খুন করিয়া পলাইয়াছে, বিশেষ বামা ঝির জবানবন্দীতে প্রকাশ পাইয়াছে যে সে কর্ত্রীর সহিত নগেন্দ্রনাথকে যখন কথা কহিতে শুনিয়াছিল সে নগেন্দ্রর মুখে দুই একবার উইলের কথাও শুনিয়াছে এবং তাহার মুখ যে অপ্রসন্ন হইয়াছিল তাহাও দেখিয়াছে। এখন এ কথার অর্থ কিছু কিছু বুঝিতে পারা যাইতেছে বোধ হয় কর্ত্রী তাঁহার দেবরপুত্রকে ক্ষমা করিয়া তাহাকে তাঁহার সম্পত্তির কিয়দংশ প্রদান করিবার প্রস্তাব করিয়াছিলেন। কিন্তু নগেন্দ্রর সে প্রস্তাব পছন্দ হয় নাই, কর্ত্রীকে জীবিত রাখা নিরাপদ নহে বুঝিয়া তাঁহার বুকে ছুরি মারিয়া চলিয়া গিয়াছে এবং যাইবার সময় নিচে বামাকে বলিয়া গিয়াছে, ‘মামীমা না ডাকিলে উপরে যাইও না।’ অর্থাৎ গোলযোগ হইবার পূর্বেই সে অনেকদূর সরিয়া পড়িতে পারিবে। বাস্তবিক সকলদিক হইতে সকল প্রমাণই নগেন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে দাঁড়াইতেছে। তাঁহার অনুসন্ধানে আগ্রা, এলাহাবাদ প্রভৃতি স্থানে পুলিশ ছুটিয়াছে, তাঁহার সন্ধানের জন্য কলিকাতায় পর্যন্ত টেলিগ্রাম করা হইয়াছে। জানি না এই সকল প্রমাণের বিরুদ্ধে তোমার অপরিণত বুদ্ধি ও বালিকাহৃদয়ের আগ্রহ কতটুকু কাজ করিতে সক্ষম হইবে? ভগবান যাহার প্রতি বিমুখ, ভগিনী, তুমি তাহার জন্য চেষ্টা করিয়া কি কবিবে?’
অনেকক্ষণ আমি কোন কথা কহিতে পারিলাম না। চারিদিকেই অন্ধকার, এই প্রতিকূল ঘটনাস্রোতে এমন ক্ষুদ্র তৃণটিও দেখিলাম না যাহা অবলম্বন করিয়া উদ্ধারের চেষ্টা হইতে পারে। অবশেষে নিতান্ত অবসন্নভাবে বলিলাম, ‘দিদি, সত্যের আলোকের সম্মুখে মিথ্যার অন্ধকার অধিকক্ষণ তিষ্ঠিতে পারে না। তাই সত্য লুক্কায়িত থাকিলেও আপনি প্রকাশ হইয়া পড়ে এবং যেখানে মিথ্যার অন্ধকার যত গাঢ়, সত্যের সতেজ দীপ্তি সেখানে তত উজ্জ্বলরূপে প্রকাশ পায়। আমি তাঁহার হৃদয় জানি, তিনি নির্দোষ, নিদোষকে ভগবান নিশ্চয়ই কলঙ্ক ও বিপদ হইতে মুক্ত করিবেন।’
দুইদিন পর্যন্ত কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না; কিন্তু একটি কথা আমার মনে অনেকবার উদয় হইয়াছিল, পুলিশের কাছে বামা ও বসন্তদিদি দুজনেই জবানবন্দী দিয়াছেন, যাহা সত্য বসন্তদিদি সরলভাবে তাহাই বলিয়াছেন, কিন্তু বামার কোন কোন কথা শুনিয়া মনে হয় যেন নগেন্দ্রকে ফাঁদে ফেলিবার তাহার ইচ্ছা ছিল। নগেন্দ্রের সঙ্গে কর্ত্রীর যখন কথা হয় তখন সে স্ত্রীজাতি সুলভ চাপল্যের বশবর্তী হইয়াই যেন গোপন হইতে শুনিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু নগেন্দ্রর মুখ ভার দেখিয়াছে পুলিশে একথা বলিবার কি বিশেষ আবশ্যক ছিল? তাহার পর নগেন্দ্র হত্যাকাণ্ডের দিন কোন কারণে হঠাৎ সন্ধ্যার পর চলিয়া যাইতে পারেন এবং সে কারণ তাঁহার ও কর্ত্রীঠাকুরাণী ভিন্ন আর কাহারও জানিবার সম্ভাবনা না থাকাও আশ্চর্য নহে, কিন্তু ‘মামীমা এখন একটু ঘুমাইতেছেন, তিনি না ডাকিলে তোমার উপরে যাইবার দরকার নাই’ একথা নগেন্দ্র যদিই বা বলিয়া থাকেন তথাপি বামা পুলিশ কর্তৃক জিজ্ঞাসিত না হইয়াও তাহা কেন বলিল?—ইহার দুইটি কারণ থাকিতে পারে। প্রথম, হয় বামা অতি সত্যবাদিনী, কোন কথা গোপন করা উচিত মনে করে নাই, না হয় নগেন্দ্রকে বিপদে ফেলিয়া তাহার কিছু স্বার্থ আছে।
প্রথম কারণ আমার সঙ্গত মনে হয় নাই, অতএব আমার বিশ্বাস হইল যে জন্যই হউক সে নগেন্দ্রর শত্রু, সুতরাং তাহার গতিবিধির প্রতি একটু বিশেষ দৃষ্টি রাখা উচিত।
দুই-তিনদিন ধরিয়া তাহার প্রতি প্রখর দৃষ্টি রাখিলাম, কিন্তু তাহার প্রতি যে আমার লক্ষ্য আছে ইহা যাহাতে সে বুঝিতে না পারে সে বিষয়েও সাবধান হইলাম। দেখিতাম, দুই প্রহরের পর কোনদিকে কাহাকেও না দেখিলেই সে দ্বিতলস্থিত তাহার শয়নকক্ষে প্রবেশ করিয়া অতি সাবধানে দ্বার বন্ধ করিয়া দিত এবং অল্পক্ষণ পরে বাহির হইয়া আসিত।
একদিন বসন্তদিদিকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘দক্ষিণদিকের সর্বশেষ কুঠুরীতে কি আছে?’
বসন্তদিদি বলিলেন, ‘ওঘরে কর্ত্রীঠাকুরানী তাঁহার বাক্স, আলমারি, তৈজসপত্র ইত্যাদি রাখিতেন, তাঁহার মৃত্যুর পর হইতে এখন বামা ওই ঘরে শোয়।’
আমি। ‘কর্ত্রীঠাকুরাণী যখন জীবিত ছিলেন তখনও কি বামা ওই ঘরে শুইয়া থাকিত?’
বসন্তদিদি। ‘না, তিনি ওই ঘরে কাহাকেও প্রায় যাইতে দিতেন না। তিনি পাশের ঘরে থাকিতেন, সুতরাং তখন ওঘরে কেহ না থাকিলেও চলিত, কিন্তু তাঁহার মৃত্যুর পর ওঘরে একজন লোক রাখা উচিত মনে করিয়াছিলাম। বামার বড় সাহস, সে ছাড়া অন্য কেহ ওঘরে রাত্রে একলা থাকিতে পারে বোধ হয় না।’
আমি। ‘কিসে জানিলেন?’
বসন্তদিদি। ‘ফুলেশ্বরী একদিন আমার কথামত ওঘরে শুইয়াছিল কিন্তু রাত্রে ভয় পাইয়া চিৎকার করিয়া উঠে, জিজ্ঞাসা করিলে বলে সে ভূতের কথা শুনিয়াছে, আর এক দিনও সে বাড়িতে থাকিবে না। পরদিন সকালে সে বাড়ি ছাড়িয়া চলিয়া গেল, কামিনীও চলিয়া যাইতে চায়, তাই শরৎকে একজন ভাল ঝির জন্য লিখিয়াছিলাম। ফুলেশ্বরী চলিয়া যাওয়ার পর বামাকেই ওঘরে শুইবার জন্য বলিয়া দিয়াছি, সেও দুই একদিন ভয় পাইয়াছে। পাশের কুঠুরীতে কর্ত্রীঠাকুরাণীর অপমৃত্যু হইয়াছে, এরূপ অবস্থায় ভয় পাওয়ার আশ্চর্য কি?’
পরদিন সকালে বামা গঙ্গাস্নান করিতে গেল। আমি বসন্তদিদির সহিত তাহার শয়নকক্ষে প্রবেশ করিলাম; দেখিলাম ঘরটি তেমন বড় নহে, উত্তরদিকের কুঠুরী (যে কুঠুরীতে কর্ত্রী নিহত হন)। আর এই কক্ষের মধ্যে একটিমাত্র দ্বার। দক্ষিণের দেওয়ালে এই দ্বারের ঠিক সম্মুখে আর একটি দ্বার। এই শেষের দ্বারটির শিকল নিচের দিকে, চৌকাঠের সঙ্গে সেই শিকল লাগান এবং তাহাতে একটি পিতলের কুলুপ লাগান রহিয়াছে। ঘরের মধ্যে অন্য দ্বার বা জানালা নাই,কেবল উত্তরের দেওয়ালে একটি বড় রকম কোলঙ্গা রহিয়াছে, তাহার উপর একটি পিতলের অপরিষ্কার পিলসুজে তদপেক্ষা অপরিষ্কার একটি পিতলের প্রদীপ এবং পাশে একটি বৃহদাকার ময়লা তেলের ভাঁড়। কোলঙ্গাটি তেলে তেলে ভিজিয়া তাহার উপর দুই তিন ইঞ্চি ময়লা জমিয়া গিয়াছে।
কক্ষমধ্যে পূর্বধারে দুইটি বড় বড় আলমারি পাশাপাশি রহিয়াছে। তাহার পরই একখানি ছতরী আঁটা বড় খাট, গদি পাতা, তাহার উপর স্তূপাকারে কতকগুলি বালিশ সজ্জিত। ছতরীতে মশারি খাটানো আছে। খাটের নিচে খানিক খালি জায়গা, অনুমান হইল বামা এইখানে বিছানা পাতিয়া রাত্রে শুইয়া থাকে। পশ্চিমধারে দুইটি প্রকাণ্ড কাঠের সিন্দুক।
বসন্তদিদিকে জিজ্ঞাসা করিলাম, কর্ত্রীঠাকুরাণীর টাকাকড়ি সমস্ত কি এই ঘরে থাকে?’ তিনি উত্তর করিলেন, ‘না, তাহা তাঁহার শয়নকক্ষে লোহার সিন্দুকে থাকে।’
আমি। ‘তাহার চাবি?’
দিদি। ‘সিন্দুকের গা-চাবি কর্ত্রীর কাছেই থাকিত, কুলুপের চাবি আমি রাখিতাম। সিন্দুক খুলিবার দরকার হইলে আমার সাহায্য ব্যতীত তিনি খুলিতে পারিতেন না।’
একটু চিন্তা করিয়া পুনর্বার জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘তাহা হইলে সম্ভবত এঘরে টাকাকড়ি গহনাপত্র কিছু থাকিত না। বাক্স ও আলমারিতে কি আছে, উহাদের চাবি কাহার কাছে?’
‘শাল, বনাত, বানারসী কাপড়, আসাসোটা, ছাতি, ইত্যাদি; চাবি অবশ্য আমার কাছেই আছে।’—দিদি এই উত্তর দিলেন।
হঠাৎ দক্ষিণ দিকের দ্বারলগ্ন পিতলের তালার দিকে চক্ষু পড়িল। দিদিকে বলিলাম, ‘আমি একবার দক্ষিণ দিকের বারান্দায় যাইতে চাই, চাবি কি আপনার কাছে আছে?’
‘এই সকল কুলুপের দুইটি করিয়া চাবি থাকে, একটি বামাকে দিয়াছি, অন্যটি আমার কাছেই আছে।’ এই বলিয়া দিদি রিং হইতে একটি চাবি খুলিয়া আমাকে দিয়া বলিলেন, আমি একটু কাজে নিচে যাইতেছি, তুমি তালা খুলিয়া বারান্দায় যাও।’
বারান্দায় আসিয়া দেখিলাম দক্ষিণ দিকটি বেশ নির্জন, বারান্দার নিচেই একটি ছোট বাগান, আম, লিচু, গোলাপজাম ও পেয়ারার অনেকগুলি গাছ, সেই সকল গাছের ভিতর দিয়া অদূরবর্তী রাজপথ দেখা যাইতেছে। আরও দেখিলাম রান্নাঘরের ছাদ এই বারান্দার পশ্চিম দিকের ভিতে আসিয়া লাগিয়াছে, একটু চেষ্টাতেই সেই ছাদ হইতে এ বারান্দায় আসিতে পারা যায়। চারিদিক ভাল করিয়া দেখিয়া দ্বারে শিকল টানিয়া চাবি লাগাইলাম এবং পূর্ববৎ দ্বার বন্ধ করিয়া নিচে নামিয়া আসিলাম।
এই দারুণ বর্ষার মধ্যেও প্রত্যহ সন্ধ্যাকালে বামার গা ধুইতে যাওয়া অভ্যাস ছিল। তাহার হাতে যে বেশি কিছু কাজ থাকিত তাহা নহে, তথাপি সে বেলা কাটাইয়া সন্ধ্যা বেশ ঘোর হইয়া আসিলে একটি কলসী লইয়া বাড়ি হইতে বাহির হইত। সন্ধ্যার পূর্বেই যখন সে অনায়াসে গা ধুইয়া আসিতে পারে তখন সন্ধ্যার পরে অন্ধকারে তাহার এ কর্ম ভোগ কেন? তাহার অন্য কোন মতলব আছে কি না দেখিতে হইবে। আজ সন্ধ্যার সময় হইতে তাহার দিকে নজর রাখিলাম।
বৈকাল, হইতেই টিপটিপ করিয়া বৃষ্টি পড়িতেছে, সন্ধ্যার সময়ও সে বৃষ্টির বিরাম নাই, আকাশে ভয়ানক মেঘ করিয়াছে। সন্ধ্যার পর হইতেই বেশ জোরে বাতাস বহিতে লাগিল। বসন্তদিদি তাঁহার ঘরে একটি প্রদীপের সম্মুখে বসিয়া মালা জপ করিতেছিলেন, আমি তাঁহার কাছে আসিয়া বসিলাম, বামা ঘরে আসিয়া প্রদীপে দুইটি সলিতা ও তেল দিয়া চলিয়া গেল। প্রদীপে তেল ও সলিতার অভাব ছিল না।
বসন্তদিদিকে ধীরে ধীরে বলিলাম, ‘খানিক পরে আসিতেছি, আমার খোঁজ করিবেন না।’ তাঁহাকে কথা কহিবার অবসর না দিয়াই নিচে আসিলাম এবং অতি সন্তর্পণে বামার অনুসরণ করিলাম। দেখিলাম আমার সন্দেহ অমূলক নহে, সে একটি কলসী লইয়া বাড়ির বাহির হইয়া গেল। আমি অতি সাবধানে, অল্পদূরে থাকিয়া তাহার পশ্চাদগমন করিতে লাগিলাম।
কড়কড় করিয়া মেঘ ডাকিতেছে, সনসন করিয়া বাতাস বহিতেছে, পথ ভয়ানক কর্দমপূর্ণ, অন্ধকারে দুই হস্ত দূরের বস্তুও দেখা যায় না। ভয়ে আমার বুকের মধ্যে কাঁপিতে লাগিল, কিন্তু যে কার্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছি তাহা শেষ করিতে হইবে। সাহসে বুক বাঁধিয়া চলিতে লাগিলাম, মধ্যে মধ্যে বিদ্যুতালোকে দেখি বামা ত্রস্তপদে, অসঙ্কোচে চলিয়াছে, যাহাতে সে আমার দৃষ্টি অতিক্রম করিয়া যাইতে না পারে, সে জন্য যথা সম্ভব দ্রুত চলিতে লাগিলাম।
অনেকক্ষণ পর্যন্ত, বিদ্যুৎস্ফূরণ হইল না। চলিতে চলিতে যখন আবার বিদ্যুৎ আলো দেখিলাম, তখন সম্মুখে চাহিয়া দেখি বামা নাই, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাহিলাম, রাজপথ নির্জন, কেবল বাতাস হু-হু স্বরে বহিয়া যাইতেছে, বামা কোথায়! আরও দ্রুত চলিতে লাগিলাম।
মোড় ফিরিতেই বিদ্যুতালোকে দেখিলাম সম্মুখে একটি মন্দির, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, পরিত্যক্ত বলিয়া বোধ হইল। বামা তো এই মন্দিরে প্রবেশ করে নাই?
অতি সাবধানে মন্দিরের অত্যন্ত নিকটে আসিয়া দাঁড়াইলাম, বোধ হইল মন্দিরের মধ্যে দুইজন লোক ধীরে ধীরে কথা কহিতেছে। মন্দিরে কর্ণ সংলগ্ন করিয়া স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া শুনিতে লাগিলাম।
একজন বলিতেছে, ‘বামা, যাহাই বল না কেন, কাজ ভাল হইতেছে না। আমার তো মনে হইতেছে কোনদিক দিয়া হয়তো আমরা বিপদে পড়িব। আর একদিনও এখানে থাকিতে সাহস হয় না।’
অন্য একজন অপেক্ষাকৃত মৃদুস্বরে উত্তর করিল, ‘গোপাল, আমিই কি থাকিতে বলিতেছি, আমারও ইচ্ছা শীঘ্র এস্থান পরিত্যাগ করিয়া যাই, আমিও চারিদিকেই বিপদের ছায়া দেখিতেছি—’
এ কি, এ যে বামার কণ্ঠস্বর! আর গোপাল কে? কর্ত্রীঠাকুরাণীর দেবরপুত্র নহে তো? আমার বুকের মধ্যে কাঁপিয়া উঠিল; আরও অধিক মনোযোগের সহিত তাহাদের কথা শুনিতে লাগিলাম। বামা বলিতেছিল, ‘বাড়িতে একজনের উপর আমার বিশেষ সন্দেহ হইয়াছে, সে যেন গোপনে থাকিয়া আমার কার্যকলাপ লক্ষ্য করে, কি জানি যদি ঘূণাক্ষরে কোন কথা প্রকাশ হয় তবে উভয়েই মারা যাইব।’
উত্তর হইল, ‘তবে আর কেন বিলম্ব করা?’
বামা বলিল, ‘না, আর বিলম্ব নয়; আজ রাত্রেই চল, যাহা কিছু হস্তগত হইয়াছে তাহাতেই সুখে অনেকদিন কাটিবে।’
দ্বিতীয় ব্যক্তি একটু উত্তেজিত স্বরে বলিল, ‘সেই ভাল, চল,আজই পালানো যাক।’
বামা বলিতে লাগিল, ‘যাহা সংগ্রহ করিয়াছি দেখিলে বিস্মিত হইবে, তাহার পর যদি বুড়ির হত্যাপরাধে নগেনের প্রাণদণ্ড বা দীপান্তর হয়, তখন তাহার সর্বস্ব তোমারই হইবে, কিন্তু এখন আর কোন কথা নয়। আজ রাত্রের ট্রেনেই কলিকাতা যাওয়া স্থির, তুমি কুলির মত পোশাক করিয়া স্টেশনে অপেক্ষা করিও, রাত্রি দশটার মধ্যেই বাড়ির সকলে শয়ন করে, আমি জিনিসপত্র লইয়া ১১টার মধ্যে তোমার কাছে উপস্থিত হইব।’
বুঝিলাম বামার কথা শেষ হইয়া আসিয়াছে, অতি সাবধানে সেখান হইতে সরিয়া আসিলাম।
চিন্তাকুল হৃদয়ে কিয়দ্দূর আসিয়া দেখিলাম একখানি ঘোড়ার গাড়ি আসিতেছে, কোচম্যানকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম সে ভাড়ায় যাইতে প্রস্তুত আছে, তাহাকে বলিলাম, ‘তুমি থানা চেনো?’
কোচম্যান। ‘কোন থানা মায়ি, দশাশ্বমেধ?’
ভাবিলাম দশাশ্বমেধ থানাই হয়তো নিকটে হইবে, সুতরাং প্রকাশ্যে বলিলাম, ‘হ্যাঁ।’
কোচম্যান নামিয়া গাড়ির দরজা খুলিয়া দিল, আমি চড়িয়া বসিলাম। ঘোড়ার পিঠে চাবুক পড়িতেই খনখন ছনছন শব্দে নির্জন পথ প্রতিধ্বনিত করিয়া গাড়ি দক্ষিণ দিকে ছুটিয়া চলিল।
অতি অল্প সময়ের মধ্যেই থানায় উপস্থিত হইলাম। কোচম্যানকে বিদায় দিয়া ফটকে প্রবেশ করিতেই দেখিলাম একজন বৃদ্ধ কনেস্টেবল একটি ছোট কুঠুরীতে একখানি খাটিয়ার উপর বসিয়া ম্লান দীপালোকে তুলসীদাস পড়িতেছে। বৃদ্ধেরা প্রায়ই সহৃদয় হয়, অন্য দিকে না গিয়া তাহার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলাম, বৃদ্ধ পাঠ বন্ধ করিয়া আমার দিকে চাহিল এবং আশ্চর্য হইয়া আমাকে দেখিতে লাগিল। আমি কি বলিব ভাবিতেছি, এমন সময়ে সে জিজ্ঞাসা করিল, ‘হিঁয়া তুমহারা কোন্ কাম হ্যায়, বেটি?’—আমি কতক বাঙলায় কতক বা আমাদের হুগলির বাসায় মেড়ুয়াবাদী খানসামা রামফলের সঙ্গে যে রকম হিন্দুস্থানীতে কথা কহিতাম সেইরূপ হিন্দুস্থানীতে বলিলাম, ‘কোন বিশেষ দরকারের জন্য একবার ইনেসপেক্টর সাহেবের সঙ্গে দেখা করিতে চাই।’
বুড়া পুস্তক রাখিয়া উঠিল, খড়ম পায়ে দিয়া দোদুল্যমান দীর্ঘ টিকিতে গ্রন্থ দিতে দিতে ঘরের বাহিরে আসিয়া হাঁকিল, ‘সুজন সিং।’
গুম গুম স্বরে ভজন গাহিতে গাহিতে সুজন সিং আসিয়া উপস্থিত হইল, বৃদ্ধ তাহাকে আমার দুর্বোধ্য ভাষায় কি বলিয়া দিল এবং আমাকে তাহার অনুসরণ করিতে বলিল।
আমরা অদূরবর্তী একটি অনতিদীর্ঘ অট্টালিকার দ্বারদেশে উপস্থিত হইলাম। সুজন সিং গৃহ প্রবেশপূর্বক ইনেস্পেক্টরকে আমার প্রার্থনা জ্ঞাপন করিলে, তাঁহার অনুমতিক্রমে গৃহে প্রবেশ করিলাম। একটি উজ্জ্বল আলোকের সম্মুখে বসিয়া তিনি কি লিখিতেছিলেন। আমার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়াই তিনি যেন অত্যন্ত বিস্মিত হইলেন, অনন্তর আমাকে আমার বক্তব্য বলিবার জন্য অনুমতি করিলেন।
সেই গম্ভীর, প্রাচীন এবং উদার মুখমণ্ডলবিশিষ্ট হিন্দুস্থানী ইনেস্পেক্টরের সাক্ষাতে যে যে কথা বলা প্রয়োজন মনে করিলাম সমস্ত বলিলাম।
তিনি কিয়ৎকাল চিন্তা করিয়া তিনজন কনেস্টবলকে ডাকিলেন, এবং তাহাদিগকে চুপে চুপে কি উপদেশ দিয়া আমার সঙ্গে পাঠাইলেন। আমি তাহাদিগকে সঙ্গে করিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিলাম।
বামা তখন পর্যন্ত ফিরিয়া আসে নাই। একজন কনেস্টবলকে সদর দরজার পাশে অপেক্ষা করিতে বলিলাম, আর একজনকে রান্নাঘরের ছাদে বামার শয়ন কক্ষের নিকটে বসাইয়া রাখিলাম, তৃতীয় ব্যক্তিকে এই ছাদের উপর দিয়া বামার শয়ন কক্ষের দক্ষিণের বারান্দার উপর উঠিয়া নিঃশব্দে অপেক্ষা করিতে বলিলাম। অনন্তর নিচে নামিয়া আসিলাম।
অল্পক্ষণ পরে বামা ফিরিয়া আসিল, আসিয়াই সে কৈফিয়ৎ দিল একজন সঙ্গী তাহাকে কিছুতেই ছাড়িল না, বিশ্বেশ্বরের আরতি দেখিবার জন্য টানিয়া লইয়া গেল, সেইজন্য বিলম্ব হইয়া গিয়াছে। এদিক ওদিক ঘুরিয়া বামা অঞ্চল বিছাইয়া রান্নাঘরের বারান্দায় শয়ন করিল।
রাঁধুনীকে বলিলাম, ‘আমার অসুখ হইয়াছে আজ কিছু খাই না।’ উপরে আসিয়া আমার শয়ন ঘরে প্রবেশ করিলাম, সম্মুখদ্বারের খিল বন্ধ করিয়া খিড়কি দ্বার দিয়া অতি সাবধানে বাহির হইলাম এবং একটি বাতি জ্বালিয়া ধীরে ধীরে বামার শয়নকক্ষে প্রবেশ করিলাম।
বসন্তদিদি সকালে আমাকে যে চাবিটি দিয়াছিলেন তাহা আমার কাছেই ছিল। তদ্বারা দক্ষিণ দিকের দ্বার-সংলগ্ন কুলুপ খুলিয়া শিকলটা আল্গা করিয়া রাখিলাম। তাহার পর বাতি নিভাইয়া এক বৃহৎ আলমারির পশ্চাতে গুপ্তভাবে দাঁড়াইয়া রহিলাম।
প্রায় এক ঘণ্টা পরে একটি সলিতা হস্তে বামা গৃহে প্রবেশ করিয়াই দ্বারের অর্গল বন্ধ করিয়া দিল। যদি সে হঠাৎ দেখিতে পায় আমি দক্ষিণদিকের দ্বার খুলিয়া রাখিয়াছি, যদি আমার অভিপ্রায় বুঝিয়া তাড়াতাড়ি সেই দ্বারও বন্ধ করিয়া আমাকে আক্রমণ করে! আমার বুকের মধ্যে কাঁপিয়া উঠিল; এখন আমি জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিস্থলে দণ্ডায়মান, পিশাচী যে ছুরিকায় গৃহকর্ত্রীর প্রাণ সংহার করিয়াছে, হয়ত অবিলম্বে সেই ছুরিকাই আমার বক্ষে পতিত হইতে পারে, আমার এত চেষ্টা, যত্ন ও ষড়যন্ত্র সমস্তই এক মুহুর্তে ব্যর্থ হইয়া যাইতে পারে। যাহাই হউক, নগেন্দ্রনাথের নির্দোষিতা প্রমাণ করা আমার একমাত্র ব্রত, সাহসে ভর করিয়া প্রতিমুহূর্ত অতিবাহিত করিতে লাগিলাম।
বামা পূর্ববর্ণিত কোলঙ্গাস্থিত প্রদীপটি জ্বালিয়া দিল। তেলের ভাঁড় ও পিলসুজ নিচে নামাইয়া ফেলিল। সবিস্ময়ে দেখিলাম তাহার পর সে তৈলাক্ত এবং ময়লালুপ্ত একখানি তক্তা ধীরে ধীরে কোলঙ্গা হইতে টানিয়া লইল। আমি দিনের বেলা যখন কোলঙ্গাটি দেখিয়াছিলাম তখন বুঝিতে পারি নাই এখানে আবার এইরকম একখানা তক্তা আঁটা আছে।
তক্তাখানি টানিয়া নিচে রাখিয়াই সে চাবি দিয়া একটি দেরাজ খুলিল, এবং দেরাজের ডালাখানি ভিতের মধ্যে ঠেলিয়া দিয়া, দেরাজের ভিতর হইতে প্রথমে একটি কালো ব্যাগ বাহির করিল, তাহার পর দেখিলাম কতকগুলি টাকা, নোট এবং মোহর ধীরে ধীরে মেজের উপর রাখিয়া দিল, অবশেষে পনেরো ষোলখানি মণিমুক্তাখচিত স্বর্ণাভরণ বাহির করিয়া লুব্ধদৃষ্টিতে সেগুলির দিকে চাহিয়া দেখিতে লাগিল, দীপালোকে সেগুলি জ্বলিতেছিল।
গহনা, নোট, মোহর সমস্ত সে ধীরে ধীরে ব্যাগের মধ্যে পুরিয়া ফেলিল।
দেখিলাম আর সময় নষ্ট করা যাইতে পারে না। কিন্তু কনেস্টবলকে কিরূপে খবর দিই? ধীরে ধীরে অগ্রসর হইলাম, অতি ধীরে, অতি সন্তর্পণে দক্ষিণের দ্বারের নিকটে যাইতেই প্রদীপের আলোকে বিপরীত দিকের প্রাচীরে আমার দীর্ঘ ছায়া পড়িল। আর লুক্কায়িত থাকা অসম্ভব। আমি অন্তরালে থাকিয়া সমস্ত কার্য দেখিয়াছি, বামা মুহূর্তমধ্যে তাহা বুঝিতে পারিল।
ব্যাগটা সজোরে মেজের উপর ফেলিয়া, উত্তেজিত স্বরে বলিল, ‘সর্বনাশি, কুক্ষণে তুই হুগলি হ’তে পেয়দাগিরি করতে এসেছিলি, তোর মতলব আমি অনেক আগেই টের পেয়েছি। আজ তার প্রতিফল ভোগ কর।’ তীক্ষ্ণধার, বৃহৎ ছুরিকা দীপালোকে চকচক করিয়া উঠিল, পিশাচী ক্ষুধিতা রাক্ষসীর ন্যায় আমার দিকে ছুটিয়া আসিল—মনে হইল মুহূর্ত মধ্যেই তাহার ছুরিকা আমার বক্ষে প্রোথিত হইবে।
চিৎকার শব্দে আমি দক্ষিণের দরজার উপর লাফাইয়া পড়িলাম। পূর্ব হইতেই পথ পরিষ্কার ছিল, ঝন ঝন শব্দে দরজা খুলিয়া গেল। দরজার বাহিরে যে কনেস্টবল দাঁড়াইয়াছিল সে একলক্ষে আমার ও বামার মধ্যে আসিয়া পড়িয়া ত্রস্তে তাহার উদ্যত মুষ্টি ধরিয়া ফেলিল।
বামা বোধ হয় একবার স্বপ্নেও ভাবে নাই, আমি এই দ্বার পূর্ব হইতেই খুলিয়া পলায়নের পথ পরিষ্কার করিয়া রাখিয়াছি, অথবা অন্তঃপুরের এই দুর্গম বারান্দায় পুলিশ আনিয়া দাঁড় করাইয়াছি; সুতরাং হঠাৎ এইরূপে আক্রান্ত হওয়ায় সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়িল। স্ত্রীলোক যতই নষ্টবুদ্ধি, ধূর্ত কিম্বা কৌশলসম্পন্ন হউক না কেন, এইখানেই তাহাদের দুর্বলতা। পাহারাওয়ালা বামার হাত ধরিয়া ছুরিকা কাড়িয়া লইবামাত্র সে হতাশভাবে বলিয়া উঠিল, ‘আমি ধরা পড়িয়াছি, আর পলাইব না, পলাইয়া রক্ষা নাই, আমার হাত ছাড়িয়া দাও।’—তাহার হাত ছাড়িয়া দিতেই সে কাপড়ের ভিতর হইতে কি একটা জিনিস বাহির করিয়া তাড়াতাড়ি মুখের মধ্যে ফেলিয়া দিল। বুঝিলাম বামা বিষ খাইল, সকলে অবাক হইয়া গেল। একটু পরেই ‘আমি আর দাঁড়াইতে পারি না’ বলিয়া বামা সেই বারান্দার উপর আছড়াইয়া পড়িল। দেখিতে দেখিতে লোকজন ও লাল পাগড়ীতে সেই স্থান পূর্ণ হইয়া গেল। দেখিলাম বসন্ত দিদি এক পাশে দাঁড়াইয়া আছেন, আমি তাঁহার দিকে অগ্রসর হইতেই, জনতা ভেদ করিয়া একজন ভদ্রলোক সেখানে প্রবেশ করিলেন, তাঁহার দিকে চাহিতে লজ্জা ও হর্ষে আমার হৃদয় পরিপূর্ণ হইয়া গেল। আমি মুখ অবনত করিলাম।
স্বামী মুগ্ধ, বাক্যহীন, যেন সমস্তই তাঁহার নিকট ইন্দ্রজালের ন্যায় অসম্ভব ও অসংলগ্ন বলিয়া বোধ হইতে লাগিল।
বামার স্বর নাসিকায় আসিয়াছিল; পুলিশের প্রশ্নে সে অতি কষ্টে, বিজড়িত কণ্ঠে বলিল, ‘আমি খুন করিয়াছি! করিব না! অত টাকা সব ভোগ করিবে পাষণ্ড নগেন্দ্রনাথ, আর গোপাল, আসল ধন যার সে হবে পথের ভিখারি?’
একটু থামিয়া আবার বলিল, ‘গোপাল আমায় ভালবাসে তা তার প্রাণে সহ্য হয় না! কথায় কথায় বলে কিনা ওকে ত্যাগ কর, নইলে তোমায় কিছু দেব না! কেমন দেবে না তা দেখব। এই হাতে খুন করেছি হা হা!’
বামার সেই মৃত্যুচ্ছায়া সমাচ্ছন্ন, কালিমা পরিব্যাপ্ত মুখ বিকটহাস্যে বিকট আকার ধারণ করিল।
এতক্ষণ পরে নগেন্দ্রর কথা ফুটিল, তিনি বলিলেন, ‘গোপাল দাদাকে বিষয় দিবেন বলিয়া কর্ত্রী আমাকে গোপাল দাদার সন্ধানে এলাহাবাদ পাঠাইয়াছিলেন। তিনি বলিলেন, গোপাল দাদাকে কিছুই দেন নাই, এখন তাহার ও আমার সাক্ষাতে নূতন উইল করিয়া আমাদের দুজনকে বিষয় ভাগ করিয়া দিবেন। আমি তাঁহার অনুমতিক্রমে গোপাল দাদাকে আনিতে সেই সন্ধ্যাবেলাই এলাহাবাদ যাত্রা করিলাম, এমন কি বৌদিদির ফিরিয়া আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করিতে পারিলাম না, কারণ তাহা হইলে আর সে দিনের ট্রেন পাই না!’
বামা নগেন্দ্রনাথের কথা শুনিল, তাহার মুহূর্ত পূর্বের পৈশাচিক হাসি তীব্র যন্ত্রণার চিৎকারে পরিবর্তিত হইল। তাহার সেই নৈরাশ্যব্যঞ্জক আর্তনাদ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমার মনে থাকিবে।
ডাক্তার ডাকিবার জন্য পূর্বেই লোক ছুটিয়াছিল। ডাক্তার গৃহে প্রবেশ করিয়া একবার তাহার নিষ্প্রভ, শুষ্ক মুখের দিকে চাহিলেন, পরক্ষণেই তাহার বিবর্ণ ঘর্মাক্ত কলেবর পরীক্ষা করিয়া বলিলেন, ‘সকল শেষ হইয়াছে।’
প্রায় এক ঘণ্টা পরে থানা হইতে সংবাদ পাওয়া গেল, গোপালচন্দ্র একটি সামান্য কুলির বেশে তৃতীয় শ্রেণীর টিকিট কিনিবার চেষ্টায় ছিল। পুলিশের লোক তাহাকে গ্রেপ্তার করিয়াছে।
হঠাৎ ধৃত হওয়ায় এবং বামার এইরূপ আকস্মিক মৃত্যুসংবাদে সে মুহ্যমান হইয়া সকল কথা স্বীকার করিয়াছে।
বামা পলাইবার উদ্যোগে ব্যাগের মধ্যে যে অলঙ্কারগুলি লইতেছিল, তাহা দেখিয়া বসন্তদিদিরও অত্যন্ত বিস্ময় বোধ হইয়াছিল, সকলে অনুমান করিল নোট ও মোহর বাদে শুধু মণিমুক্তাখচিত অলঙ্কারগুলির মূল্য অন্যূন পঁচিশ হাজার টাকা হইবে। বসন্ত দিদি বলিলেন সেগুলির অস্তিত্ব তিনিও জ্ঞাত ছিলেন না, কোলঙ্গার সেই গুপ্ত আলমারির কথাও তিনি জানিতেন না, পাছে কেহ এই আলমারির সন্ধান পায় বোধ হয় এই ভয়ে কর্ত্রী কাহাকেও এই কক্ষে প্রবেশ করিতে দিতেন না। কিন্তু তিনি বুদ্ধিমতী বামার চক্ষে ধূলি নিক্ষেপ করিতে পারেন নাই। পরে জানিতে পারা গিয়াছিল, একসময়ে কাশীরাজের কিছু অর্থের প্রয়োজন হওয়ায় তাঁহার জনৈক বিশ্বস্ত কর্মচারী কর্ত্রীর নিকট এই সকল অলঙ্কার আবদ্ধ রাখিয়া টাকা কর্জ লইয়াছিলেন।
গোপালের কোন দোষ প্রমাণ না হওয়ায়, বিশেষ বামা কর্ত্রীর হত্যা করিয়াছে মৃত্যুর পূর্বে এ কথা স্বীকার করায় তিনি অব্যাহতি পাইলেন, কিন্তু মুক্তিলাভ করিয়াই কোথায় চলিয়া গেলেন কেহ জানিতে পারিল না; স্বামী তাঁহাকে বিষয়ার্ধ প্রদানের জন্য তাঁহার বিস্তর অনুসন্ধান করিয়াছিলেন, কিন্তু চেষ্টা সফল হয় নাই।
দরিদ্রের কন্যা, আশৈশব পরগৃহে প্রতিপালিতা, আমি এখন অতুল ঐশ্বর্যের অধিকারিণী! কিন্তু এখনও সেই ভয়ানক দিনের সেই নিদারুণ হত্যারহস্যের কথা মনে হইলে আমার সর্বশরীর অবসন্ন হইয়া পড়ে। মনে হয় ভীরুপ্রকৃতি, অনাথা বঙ্গবালিকা কিরপে সেই দুঃসাহসিক কার্যে প্রবৃত্ত হইয়া বিবিধ প্রতিকূল ঘটনার মধ্যেও প্রিয়তমকে বিপদ ও কলঙ্ক হইতে মুক্ত করিতে সক্ষম হইয়াছিল! পাঠক পাঠিকার নিকট এই বিস্ময়কর ঘটনা অসম্ভব বোধ হইতে পারে, কিন্তু প্রেম দুর্বলকে সবল ও ক্ষুদ্রকে মহৎ করিয়া তুলে, ইহা অন্ধকারময়, কণ্টকাকীর্ণ পথ আলোকিত ও পুষ্প সমাচ্ছন্ন করিয়া দেয় এবং কৃষ্ণবর্ণ, উন্মত্ত মৃত্যু-স্রোতের ঊর্ধ্বে অমর মহিমায় বিরাজিত থাকে।