হত্যাকারী কে? – হরিসাধন মুখোপাধ্যায়
প্রথম পরিচ্ছেদ
পাঁচ ছয় বৎসর পূর্বে যে সময় আমি পশ্চিমে ছিলাম একটি লোমহর্ষণ ঘটনা আমার চক্ষের উপর ঘটিয়াছিল। আজও তাহা স্মৃতিপথে জাগরূক হইলে শরীরের আমূল কম্পিত হয়, তাহার প্রত্যেক ঘটনা, প্রত্যেক কার্য—অতীতে কুক্ষিগত হইলেও আজও তাহা আমার নিকট জাগ্রত প্রত্যক্ষ বলিয়া বোধ হয়। সেই ভীষণ নিশীথে, সেই বন্ধুবান্ধবহীন বিদেশে; যে ভয়ানক ঘটনা আমার চক্ষের সম্মুখে অভিনীত হইয়াছিল তাহাই অদ্য বিবৃত করিব।
কোন কার্যোপলক্ষে ওই সময়ে আমরা পশ্চিমে বেড়াইতে গিয়াছিলাম, যে সময়ের কথা বলিতেছি সেই সময়ে আমরা এলাহাবাদে ছিলাম। এলাহাবাদে কীৰ্তিবাস চট্টোপাধ্যায় নামক এক ব্রাহ্মণের বাটীতে আমাদের বাসা হইয়াছিল। কীর্তিবাসের বাটী এই সময়ে এলাহাবাদে বিদেশী বাঙালীর নিকট বিশেষ পরিচিত ছিল। যাহাদের থাকিবার অন্য কোন আড্ডা নাই তাহারা স্বল্প মুদ্রা ব্যয় করিলে কীর্তিবাসের আশ্রমে সুখে কাটাইতে পারিত। কীর্তিবাস বিদেশে আশ্রয়হীন বাঙালীর জন্য এই আশ্রম স্থাপন করিয়া বিশেষ যশোপার্জন করিয়াছিলেন।
চট্টোপাধ্যায় মহাশয় প্রকৃতপক্ষে হোটেল-কিপার নহেন। তাঁহার একটু বিশেষ পরিচয় আবশ্যক। তিনি দেখিতে স্থূলকায়, শ্যামবর্ণ; মুখমণ্ডল বসন্ত চিহ্নে চিহ্নিত,ললাটটি ক্ষুদ্র—তাহার উপর ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল আসিয়া পড়িয়াছে। সেই ক্ষুদ্র ললাটের নিম্নে রক্তবর্ণ দুইটি চক্ষু সর্বদাই চঞ্চল ভাবে ঘুরিতেছে,—লোমরাজিপূর্ণ, বহ্বায়ত বক্ষের উপর শুভ্র পৈতার গোছা ও কটিদেশে একতাড়া চাবি সর্বদাই বিরাজমান। কিন্তু এই বাহ্য সৌন্দর্য দেখিয়া ইনি কি প্রকারের লোক ঠিক করা বড়ই দুরুহ। সহসা ইহাকে ভীমাকৃতি দুষ্ট লোক বলিয়া বোধ হইলেও, আলাপে সেই ভ্রম ঘুচিয়া যায়। কথায় ইনি মিষ্টভাষী, ব্যবহার ভারি সামাজিক—লোক বশীকরণ ক্ষমতায় অদ্বিতীয়। অনেকবার লোকের বাহ্য সৌন্দর্য দেখিয়া চরিত্র নির্ধারণ করিতে গিয়া আমি ঠকিয়াছি, এবারও তাহাই হইয়াছে।
চট্টোপাধ্যায় মহাশয় রাঢ়ী শ্রেণীর ব্রাহ্মণ, বিষ্ণুঠাকুরের সন্তান—সংসারে আর কেহ নাই—বাসস্থান হুগলী জেলা। বিষয় কর্মোপলক্ষে এলাহাবাদে অনেক দিন ধরিয়া বাস করিয়া আসিতেছেন। প্রায় দুই বৎসর ধরিয়া সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিয়া সঞ্চিত বিত্তের উপর নির্ভর করিয়া জীবিকা নির্বাহ করিতেছেন। তাঁহার বাটীতে তাঁহার একমাত্র প্রাপ্তবয়স্ক ভ্রাতুষ্পুত্র ভিন্ন আর কেহই ছিল না। এলাহাবাদে অনেক দিন থাকিয়া স্থানটার উপর তাঁহার বড়ই মায়া বসিয়াছিল। অন্য কোন উপজীবিকা নাই বলিয়া বিশেষ লাভকর না হইলেও তিনি বর্তমান উপজীবিকাকে লক্ষ্যভুক্ত করিয়াছিলেন। আগন্তুক বাঙালী ভদ্রলোক আসিলেই তাঁহার বাটীতে বাসা পাইত। বাঙালী ভিন্ন আর কোন আগন্তুক হইলে স্থান পাইত না। আর একটি কথা বলিয়া রাখি—চট্টোপাধ্যায় মহাশয় অতি নিষ্ঠাবৃত্তি-সম্পন্ন। প্রতিদিন সন্ধ্যাবন্দনাদি না করিয়া জল গ্রহণ করিতেন না।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
এলাহাবাদে আমাদের চারি পাঁচ দিন কাটিয়া গেল। গ্রীষ্মকাল, কার সাধ্য রৌদ্রের উত্তাপে গৃহের বাহির হয়? সন্ধ্যার প্রাক্কালে (আন্দাজ ঘণ্টাদেড়েক বেলা আছে) আমরা দুইজনে বাহিরের বারান্দায় পায়চারি করিতেছি এমন সময়ে একখানি গাড়ি আসিয়া দরজার কাছে থামিল। গাড়ির ভিতর হইতে মুখ বাড়াইয়া একটি বাঙালী ভদ্রলোক আমাকে লক্ষ্য করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘মহাশয়! এই কি কীর্তিবাস চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের বাসাবাড়ি—গৃহস্বামী কি বাড়িতে আছেন?’ আমি উপর হইতে চট্টোপাধ্যায় মহাশয়কে ডাকিয়া দিলাম। তিনি সেই বাবুটিকে সঙ্গে করিয়া বাটীর মধ্যে আনিলেন।
বাবুর সঙ্গে যে চাকর ছিল সে জিনিসপত্র সমস্ত নামাইয়া লইয়া গাড়োয়ানকে বিদায় করিয়া দিয়া বাটীর মধ্যে ঢুকিল; দুইজন আগন্তুক দেখিয়া আমরাও নিচে নামিয়া আসিলাম। বাবুটি চট্টোপাধ্যায় মহাশয়কে বলিতেছেন, ‘এখানে দুই একদিন থাকিবার উপযুক্ত বাসা পাইতে পারি? আমার নিজের জন্য একটি নির্জন কক্ষ চাই, তাহার নিকটে আর একটি গৃহে আমার এই চাকরটি থাকিবে।’
চট্টোপাধ্যায় মহাশয় বলিলেন, ‘এখানে আপনার সকল সুবিধাই হইবে, একদিন দুইদিন কেন, ছয় মাস ধরিয়া থাকুন না। অনেক স্বদেশীয় লোক আমার বাটীতে বাসা লইয়া থাকেন—এই দুইটি বাবু আজ পাঁচ ছয় দিন আসিয়াছেন। চলুন আপনাকে উপরে ঘর দেখাইয়া আনি।’
এই কথা বলিয়া কীর্তিবাস চট্টোপাধ্যায় মহাশয় নবাগত বাবুকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গেলেন এবং তাঁহার গৃহাদি সমস্ত ঠিক করিয়া দিলেন।
সন্ধ্যা হইয়াছে। সন্ধ্যার ছায়ার সঙ্গে সঙ্গে একটু শীতল হাওয়া বহিতে আরম্ভ করিয়াছে। আমরা দুইজনে ছাদের উপর বসিয়া নানাবিধ গল্প করিতেছিলাম, কিন্তু সহসা শৈত্যানুভব হওয়ায় নিচে নামিয়া আসিলাম। দেখিলাম, করালীবাবু একখানি সতরঞ্চের উপর বালিশ ঠেস দিয়াই আড় হইয়া তামাক টানিতেছেন; ভৃত্য গৃহমধ্যে জিনিসপত্র সাজাইয়া রাখিতেছে। করালীবাবু আমাদের আসিতে দেখিয়া—অতি সহৃদয়তার সহিত সম্ভাষণ করিলেন।
আমাদের পরস্পরের আলাপ পরিচয় হইল। তাঁহার পরিচয়ে জানিলাম, তিনি আমার অগ্রজের সহপাঠী ও বিশেষ বন্ধু। ভ্রাতৃবন্ধুর সহিত পরিচিত হইয়া বড়ই আপ্যায়িত বোধ করিয়াছিলাম; বিশেষত করালীবাবু অতি ভদ্র সামাজিক ও অতি মধুর প্রকৃতির লোক। আরও জানিলাম, তিনি সেই সময়ে কলিকাতার কোন আদালতে ওকালতি করেন—পশারও বিলক্ষণ, পশ্চিম বেড়াইতে সখ হইয়াছে—তাই এলাহাবাদে আসিয়াছেন—ইহার পূর্বে আর কখনো এখানে আসেন নাই। পঞ্জাব পর্যন্ত যাইবার ইচ্ছা আছে।
করালীবাবু দেখিতে অতি সুশ্রী পুরুষ; রূপ যেন ফাটিয়া পড়িতেছে—মুখে সরলতা বিরাজ করিতেছে—ওষ্ঠাধরে সর্বদাই মৃদুহাস্য বিরাজমান, উন্নত ললাট ও নেত্রদ্বয়ের তেজস্বিতা দেখিলে বিশেষ বুদ্ধিমান বলিয়াই বোধ হয়। মুখমণ্ডলে, মনের ভাব সকল স্ফূর্তি পায় শুনিয়াছি। একথা যদি সত্য হয়, তবে করালীবাবু অতি সরল প্রকৃতির লোক।
সেই রাত্রে আমরা তিনজনে একত্রে আহারাদি করিলাম। আহারান্তে আমরা দুইজনে করালীবাবুর নিকট বিদায় লইয়া শয়ন করিতে গেলাম।
বিছানায় শুইয়াই সহসা নিদ্রা সিল না। আমাদের ঘরের সম্মুখের দালানের পরই করালীবাবুর ঘর। বোধ হইল কে যেন দ্বার ঠেলিয়া তাঁহার গৃহে প্রবেশ করিল। তাহার কথার আওয়াজে বুঝিলাম—সে পরাণ, করালীবাবুর চাকর। পরাণ গৃহে প্রবেশ করিয়াই বলিল, ‘ব্রাহ্মণ ঠাকুর একটি টাকা চাহিতেছেন, এই রাত্রে তাঁহার বিশেষ দরকার, আমায় দিয়া বলিয়া পাঠাইলেন।’
করালীবাবু বলিলেন,‘ক্যাশ বাক্সের চাবি নাও—সঙ্গে খুচরা টাকা নাই—ক্যাশ বাক্স হইতে একটি টাকা বাহির করিয়া নাও।’ বাবু ঝনাৎ করিয়া চাবি ফেলিয়া দিলেন—শব্দে টের পাইলাম।
এই সময়ে সিঁড়িতে পদশব্দ হইতে লাগিল। কথার আওয়াজে বোধ হইল—কীর্তিবাস। কীর্তিবাস আসিয়া বাবুর গৃহে প্রবেশ করিলেন। কেননা আমি দ্বার ঠেলার শব্দ পাইলাম।
চট্টোপাধ্যায় মহাশয় বলিলেন, ‘এত রাত্রে আপনাকে ত্যক্ত করিতেছি, অপরাধ মার্জনা করিবেন। বিশেষ প্রয়োজন, নচেৎ—’
করালীবাবু বাধা দিয়া বলিলেন, ‘অত সঙ্কুচিত হইতেছেন কেন?—পরাণ, টাকাটি ঠাকুর মশায়কে দে?’ কিছু পরে আবার পদশব্দ হইল। বুঝিলাম তিনি টাকা লইয়া নিচে নামিয়া গেলেন।
পরাণ তখন বাবুকে সম্বোধন করিয়া বলিল, ‘বাবু! আজ রাত্রে ব্রাহ্মণকে টাকা না দিলেই হইত—একে বিদেশ বিভূঁই, তাহাতে রাত্রিকাল—এই অপরিচিত ব্রাহ্মণকে টাকাকড়ি সব দেখাইলেন—আর এত রাত্রে ইহারই বা এক টাকার এত কি প্রয়োজন হইয়া পড়িল—ইচ্ছা করিলে অপর কাহারও নিকট তো লইতে পারিত।’
করালীবাবু মৃদুস্বরে বলিলেন—‘চুপ, চুপ, পরাণ, ও কথা মুখে আনিস না। ব্রাহ্মণ এখনও বোধ হয় নিচে যায় নাই—আর বিশেষ প্রয়োজন না হইলেই বা আমার কাছে আসিবে কেন? তোর যদি এতই ভয় হইয়া থাকে—তবে টাকার বাক্সটা পোর্টমান্টো হইতে বাহির করিয়া আমার বালিসের নিচে রাখিয়া যা। আমার সজাগ ঘুম—এতে তো তোর ভয় ঘুচিবে।’
ইহার পর কড়াৎ করিয়া চাবি খোলার শব্দ হইল। অনুভবে বুঝিলাম পরাণ প্রভুর আদেশ মতে বাক্স বাহির করিল। নানা বিষয় ভাবিতে ভাবিতে ইহার পর আমার তন্দ্রা আসিল, আমি ঘুমাইয়া পড়িলাম।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
কতক্ষণ ঘুমাইয়াছিলাম বলিতে পারি না, কিন্তু নিদ্রা যে বড় ভাল হয় নাই এরূপ বোধ হইল। ঘরের জানালা খোলা ছিল, অনুভবে বুঝিলাম রাত্রি এক প্রহর হইয়াছে। এমন সময়ে আমার ঘরের পাশে, পূর্ব কথিত দালানে যেন কাহার ধীর বিক্ষিপ্ত পদশব্দ পাইলাম। এত রাত্রে পা টিপিয়া, এ প্রকার সর্ন্তপণে কে দালানে বেড়াইতেছে ভাবিয়া বড় সন্দেহ হইল। কিয়ৎকালের জন্য শব্দটা থামিল—মনে করিলাম আমার ভ্রম। এবার একটু অবশভাব আসিয়া আমার নেত্রদ্বয়কে বুজাইয়া দিল—আমি সুশুপ্তি ও সজাগভাব দুইয়ের মধ্যবর্তী হইয়া রহিলাম। কিয়ৎকাল পরে সহসা এক ঘোর যাতনাব্যঞ্জক, কঠোর গোঁয়ানী শব্দ আমার কানে লাগিল। সেই কাতর শব্দে আমার অন্তরাত্মা যেন কাঁপিয়া উঠিল—আমি তড়িৎবেগে বিছানায় উঠিয়া বসিলাম, আবার ভাল করিয়া কান পাতিয়া শুনিলাম, আবার সেই হৃদয়ভেদী, যাতনাব্যঞ্জক কঠোর গোঁয়ানি! কি সর্বনাশ! গতিক বড় ভাল বোধ হইল না। করালীবাবুর ঘর হইতে বোধ হইল যেন শব্দটা আসিতেছে। আমি তাড়াতাড়ি আমার সহচরকে জাগাইলাম। বালিশের নিচে দেশলাই ছিল—আলো জ্বালিয়া লইলাম, গৃহ মধ্যে একগাছি বৃহৎ যষ্ঠি ছিল—আবশ্যক বোধে তাহাও সঙ্গে লইলাম। দুইজনে ধীরে ধীরে পা টিপিয়া ঘরের বাহির হইলাম। দালান পার হইয়াই দেখি করালীবাবুর ঘরের দ্বার ঈষৎ খোলা রহিয়াছে, গৃহমধ্যে একটি ক্ষীণ বর্তিকা হস্তে তাঁহার শয্যার পার্শ্বে দাঁড়াইয়া এক ভীষণ যমদূতাকৃতি মূর্তি! আমি আমার সঙ্গীকে পশ্চাতে করিয়া দ্বারের দিকে পা বাড়াইলাম। যাহা দেখিলাম, তাহাতে আমার ব্রহ্মরন্ধ্র কাঁপিয়া উঠিল—শরীর রোমাঞ্চ হইল—কি ভয়ানক ব্যাপার! কি সর্বনাশ!
করালীবাবুর মশারির দ্বার সম্পূর্ণ রূপে খোলা—সেই দুগ্ধফেননিভ শয্যা প্লাবিত করিয়া প্রস্রবণ ধারার ন্যায় রক্তোচ্ছ্বাস মাটিতে পড়িতেছে, আর কাছে দাঁড়াইয়া এক যমদূতাকৃতি নরপিশাচ। তাহার এক হস্তে ক্ষীণ বর্তিকা, অন্য হস্তে সুশানিত তীক্ষ্ণাগ্রভাগ-বিশিষ্ট সুদীর্ঘ ছোরা। তাহার হাতের আলোতেই তাহার মুখ দেখিয়া চিনিতে পারিলাম—সেই নৃশংস নরঘাতী আর কেহই নহে স্বয়ং কীর্তিবাস চট্টোপাধ্যায়। সে পিশাচ সেই অর্ধোন্মোচিত মশারির ধারে দাঁড়াইয়া—ঈষৎ অবনত হইয়া শয্যাতলস্থ শোণিতোচ্ছ্বাস দেখিতেছে।
আমি করালীবাবুর এই শোচনীয় পরিণামে যৎপরোনাস্তি মর্মপীড়া পাইলাম। তাঁহার এই লোমহর্ষক পরিণামে আমার হৃদয়তন্ত্রী বড়ই আলোড়িত হইল। কিন্তু মুহূর্তমধ্যে আত্মসংযম করিয়া আমার সঙ্গীর হাত হইতে লাঠি কাড়িয়া লইলাম। উন্মত্ত ব্যাঘ্রবৎ বিদ্যুদ্বেগে এক লম্ফে সেই গৃহমধ্যাগত হইয়া সেই দুরাত্মার পৃষ্ঠে সজোরে আঘাত করিলাম। সেই আঘাতেই সে একবারে ভূপতিত হইল। তাহার হাত হইতে ছোরাখানা ঝনাৎ করিয়া ঠিক্রিয়া পড়িল—দুরাত্মা উঠিবার চেষ্টা করিতেছে এমন সময়ে আমার বন্ধু আসিয়া তাহার বুকের উপর চাপিয়া বসিলেন। তাঁহার ভয়ে সেই নরহন্তা বিকট শব্দ করিয়া সেই রক্তাক্ত মেঝের উপর পড়িয়া গেল। আমি আলনা হইতে একখানি চাদর লইয়া ত্বরিতে তাহার হাত-পা বাঁধিয়া ফেলিলাম। আমার হাত-পা থরথর করিয়া কাঁপিতেছিল, মাথা ঘুরিতেছিল, চারিদিক হরিৎবর্ণ দেখিতেছিলাম। সেই রাক্ষস বলধারী দুরাত্মাকে যে এত শীঘ্র এত অনায়াসে আয়ত্বাধীন করিব ইহা আদৌ ভাবি নাই।
বন্ধু সেই দুরাত্মার নিকট রহিলেন, আমি ‘পরাণ! পরাণ!’ করিয়া চেঁচাইতে লাগিলাম। হায়! হতভাগ্য পরাণ অকাতরে ঘুমাইতেছিল, সে জানে না দুরাত্মা কীর্তিবাস চট্টোপাধ্যায় তাহার কি সর্বনাশ করিয়াছে। আমার হাঁকাহাঁকিতে পরাণ চোক্ রগড়াইতে রগড়াইতে উঠিয়া আসিল—গৃহে প্রবেশ করিয়া সে যাহা দেখিল—তাহাতে তাহার মূর্ছা হইবার মত হইল—আমি তাহাকে সহসা ধরিয়া ফেলিলাম।
পরাণকে বলিলাম, ‘তোরা দুজনে এই দুরাত্মা ব্রাহ্মণকে চাপিয়া ধরিয়া রাখ্—আমি পুলিশে সংবাদ দিই।’
পরাণ এ সংবাদে মৃতের ন্যায় মলিন হইয়া গেল—থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিল। আমি বলিলাম, ‘এত ভয় পাইলে চলিবে না—তুই প্রাণপণে এই দুরাত্মাকে ধরিয়া থাক্—যে প্রকার বাঁধা হইয়াছে—উহার আর নড়িবার সামর্থ নাই—’ পরাণ সাহসাবলম্বনে কীর্তিবাসের বন্ধন রজ্জু সবলে ধারণ করিল।
আমার নিদারুণ আঘাতে বোধ হয় কীর্তিবাস মূৰ্ছিত হইয়াছিল। এক্ষণে বোধ হয় তাহার প্রথম সংজ্ঞা হইয়াছে—সে কাতর কণ্ঠে গোঁয়াইতে গোঁয়াইতে বলিল, ‘ওগো! আমায় তোমরা মারিও না—আমি নির্দোষ, আমায় ছাড়িয়া দাও, আমার প্রাণটা—’
আমার বন্ধু কীর্তিবাসের বুকের উপর চাপিয়া বসিয়াছিলেন—তিনি সেই দুরাত্মাকে এ প্রকার ভাবে কথা কহিতে দেখিয়া তাহার ভণ্ডামি সহিতে না পারিয়া তাঁহার মুখে সবলে মুষ্ট্যাঘাত করিলেন। আমি বলিলাম,নরঘাতক! বদ্মায়েস তুই নির্দোষী! তোমার যেন কিছু দোষ নাই। না, এই জন্যই তোমার এত রাত্রে একটি টাকার দরকার হইয়াছিল, না? ফাঁসিকাষ্ঠে তোমার নির্দোষিতা বাহির হইবে।’
কীর্তিবাস পুনরায় কথা কহিতে যাইতেছিল—আমার বন্ধু পুনরায় সবলে তাহার মস্তকে দৃঢ় মুষ্ট্যাঘাত করিয়া বলিলেন, ‘চুপ রওঁ!’
এবারকার দৃঢ় আঘাতে কীর্তিবাস চুপ করিল।
আমি একবার করালীবাবুর বিছানার দিকে গেলাম। ভীষণ ছুরিকার আঘাতে গলদেশ হইতে অজস্র রক্তস্রোত বাহির হইতেছে। দুরাত্মা বোধ হয় বক্ষস্থলেও ছুরিকা বসাইয়া দিয়াছিল। সেখান হইতেও তখন উৎসধারার ন্যায় রক্তস্রোত গড়াইয়া পড়িতেছে। গায়ে হাত দিয়া দেখিলাম গাত্র হিম—নেত্রদ্বয় উন্মীলিত, সেই সুন্দর মুখে তখনও প্রসন্নতা বিরাজমান, দেখিয়া বোধ হইল যেন শান্তি ও বিভীষিকা আসিয়া একত্রে ক্রীড়া করিতেছে।
করালীবাবুর রক্তাপ্লুত, নিস্পন্দ ও শোচনীয় ভাবপূর্ণ শরীর দেখিয়া আমি শিহরিয়া উঠিলাম—গলার কাছে প্রায় দুই ইঞ্চি পরিমাণে কাটা। আমার বন্ধুকে ও পরাণকে সেই গৃহে রাখিয়া আমি পুলিশে খবর দিতে দৌড়িলাম। নিকটেই কোতোয়ালি ছিল, ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়িয়া তথায় উপস্থিত হইয়া সমস্ত ঘটনা বিবৃত করিলাম।
এই সমস্ত কার্য করিতে আমার পাঁচ মিনিটের অধিক সময় লাগে নাই।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
আমি যখন কোতোয়ালিতে পৌঁছিলাম, তখন রাত্রি দুইটা বাজিয়াছে। পৌঁছিয়াই দেখিলাম ইন্সপেক্টর শিবসহায় সিংহ রোঁদে বাহির হইবার জন্য পোশাক পরিতেছেন। আমার মুখে আদ্যোপান্ত ঘটনা শুনিয়া তিনি প্রথমত শিহরিয়া উঠিলেন, পরে একটু বিমর্ষ হইলেন। বক্সী মিটু জমাদার কাছে বসিয়াছিল, তাহাকে বলিলেন, ‘বাবুর বয়নামা অনুযায়ী সমস্ত ঘটনা রিপোর্ট বহিতে লিখিয়া লও।’ ইহার পর আমরা চারিজনে কীর্তিবাসের বাটীতে উপস্থিত হইলাম।
আমরা চারিজনে একবারে উপরের ঘরে উঠিয়া গেলাম। গৃহমধ্যে আর একটি লোক দাঁড়াইয়া—তাহাকে পূর্বে দেখি নাই—পরে জানিলাম, সে কীর্তিবাস চট্টোপাধ্যায়ের পূর্বকথিত ভ্রাতুষ্পুত্র। সে জমাদার সাহেবকে দেখিয়াই সম্বোধন করিয়া বলিল, ‘দোহাই, জমাদার সাহেব—আমার খুড়াকে ইহারা মারিয়া ফেলিল।’
জমাদার ‘চুপ রও’ বলিয়া তাহাকে ধাক্কা দিলেন, সে, সেই ধাক্কা খাইয়া পলাইয়া গেল।
শিবসহায় সিংহ প্রথমে ঘরের দ্বার জানালা উত্তমরূপে পর্যবেক্ষণ করিলেন, পরে সিঁড়ির দ্বার দেখিলেন, শয্যার আশপাশ দেখিলেন, লাশের অবস্থা তদারক করিলেন, করিয়া জমাদারকে বলিলেন, ‘কীর্তিবাসকে হাতকড়ি লাগাও, ওকে উঠিয়া বসিতে দাও।’ তাহাই করা হইল।
কীর্তিবাস উঠিয়া বসিল, কাতরকণ্ঠে বলিল, ‘মাগো! প্রাণ যায়! আমায় একটু জল দাও।’
শিবসহায় সিংহ তাহাকে জল দিতে আদেশ করিলেন।
প্রথমত তাহার এজাহার লওয়া হইল। শিবসহায় জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘যা জিজ্ঞাসা করিব, যদি সমস্ত সত্য করিয়া বল, তোমার সুরাহা করিব, নচেৎ তোমার পরিণাম বড় শোচনীয়। বল এখন এ নৃশংস কার্য কেন করিলে।’
কীর্তিবাস দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়িয়া বলিল, ‘দোহাই পরমেশ্বর! আজ কার মুখ দেখিয়া উঠিয়াছিলাম জানি না, দোহাই জমাদার সাহেব! আমি ইহার কিছুই জানি না।’
বক্সী জমাদার আর সহ্য করিতে পারিল না। তাহার হাতে আর একটি হাতকড়ি ছিল, সে সেই হাতকড়ির বাড়ি কীর্তিবাসের মাথায় ঝনাৎ করিয়া আঘাত করিল। সেই আঘাতে সে হতভাগ্যের মাথা দিয়া রক্ত বহিতে লাগিল।
কীর্তিবাস বলিল, ‘প্রাণ যায়! জল দাও, সব কথা বলিতেছি।’ সে আবার জল খাইল।
শিবসহায় জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কেন, এ কার্য করিলি?’
কীর্তিবাস আবার দৃঢ়তার সহিত বলিল, ‘দোহাই সাহেব! আমি এর কিছুই জানি না, সত্য মিথ্যা পরমেশ্বর জানেন, তিনিই এর বিচার করিবেন।’ আমি মনে মনে ভাবিলাম, দুরাত্মা পবিত্রময় পরমেশ্বরের নাম পুনঃ পুনঃ গ্রহণে তাহা কলঙ্কিত করিতেছে।
কীর্তিবাস বলিতে লাগিল, ‘আহারাদি করিয়া ইহারা সকলে শুইয়া পড়িলেন। আমার একটি টাকার প্রয়োজন হইয়াছিল, আমি বাবুর চাকরকে দিয়া বলিয়া পাঠাইলাম—বিলম্ব দেখিয়া নিজে টাকাটি লইতে উপরে আসিলাম।’
শিবসহায় জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘এত রাত্রে তোমার এক টাকার কি প্রয়োজন?’
কীর্তিবাস বলিল, ‘তহবিলে একটি পয়সাও নাই, একজন পাওনাদার আসিয়া একটি টাকার জন্য বড় বিরক্ত করিতে লাগিল, বাবুর চাকর পরাণ তাহাকে দেখিয়াছে, সত্য-মিথ্যা তাহাকে জিজ্ঞাসা করুন।’
শিবসহায় বলিলেন, ‘তার পর বলিয়া যাও।’
কীর্তিবাস বলিল, ‘আমি টাকা লইয়া নিচে আসিলাম, তখন রাত্রি এগারটা হইবে। পাওনাদারকে বিদায় করিয়া দিলাম। আমার আহারাদি তখনও হয় নাই,আহারাদি করিতে দুই প্রহর হইল। উপরে সিঁড়ির পার্শ্বে আমার শয়ন ঘর, আমি আসিয়া শয়ন করিলাম।’
‘আসিবার সময় সিঁড়ির দ্বার বন্ধ করিয়াছিলে?’
‘হ্যাঁ।’
‘তারপর?’
‘তারপর আমি নিজের ঘরে আসিয়া শুইলাম। একটু তন্দ্রা আসিতেছে এমন সময়ে কঠোর গোঁয়ানী শব্দ আমার কর্ণগোচর হইল। আমি তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িলাম। রাত্রে শুইবার পরও প্রতিদিন আমার ঘরে আলো জ্বালা থাকে। আমি সেই আলোটি ও এই ছুরিকাখানি হাতে করিয়া ব্যাপারটা কি দেখিবার জন্য দ্বার খুলিয়া বাহির হইলাম। ইহার পূর্বে আর একবার এই প্রকারে একদল গুণ্ডা আসিয়া এ বাটীতে উপদ্রব করিয়াছিল। আমি গৃহের বাহির হইয়া করালীবাবুর ঘরের কাছে গেলাম, দেখি সেই ঘর হইতেই শব্দ আসিতেছে। আমার বড় ভয় হইল, আমি বাবুর চাকরকে দুইবার ‘পরাণ! পরাণ!’ করিয়া ডাকিলাম—পরাণ তখন অঘোরে ঘুমাইতেছে—আমি সুতরাং সাহসে ভর করিয়া ঘরের মধ্যে ঢুকিলাম।
ঘরের দ্বার খোলা দেখিয়া আমার মনে যে সন্দেহ হইয়াছিল, পরিশেষে তাহাই সত্য ঘটনা হইয়া দাঁড়াইল। আমি ঘরের মধ্যে যাহা দেখিলাম, তাহাতে অন্তরাত্মা কাঁপিয়া উঠিল। কি সর্বনাশ! করালীবাবুকে কে খুন করিয়াছে! দেখিয়া আমার শরীর থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিল। ছুরিখানি হাত হইতে হঠাৎ রক্তাপ্লুত মেঝের উপর পড়িয়া গেল।
এখনও বোধ হয় সেই হত্যাকারী গৃহমধ্যে লুক্কায়িত আছে, হয়তো সে এখনই আমারও এই দুর্দশা করিতে পারে, এই ভাবিয়া ছোরাখানি কুড়াইয়া লইলাম। ইহা যে রক্তমাখা হইয়াছিল লক্ষ্য করি নাই। আলো লইয়া বিছানার কাছে গিয়া দেখিলাম বাবুর কণ্ঠনালী সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন—বক্ষস্থলেও আঘাত চিহ্ন। আমি যেমন হেঁট হইয়া অর্ধ বক্রভাবে আহত ব্যক্তির আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করিতেছিলাম, সেই সময়ে ইঁহারা দুইজনে সহসা আসিয়া আমায় ভূপতিত করিলেন। পরমেশ্বর জানেন আমি নির্দোষী! আপনারা বিশ্বাস করুন আর নাই করুন—যদি উপরে এক জগদীশ্বর থাকেন তো আমার পক্ষে সুবিচার হইবেই হইবে।’
হতভাগ্য এই কথা বলিয়া নিস্তব্ধ হইয়া জল চাহিল, আমি জল দিলাম। কথাগুলি যেন তাহার প্রাণের ভিতর হইতে বাহির হইয়াছিল। আমার এক-একবার বোধ হইতে লাগিল হয়তো এ ব্যক্তি নির্দোষী। আবার মনে হইল স্বচক্ষে যাহা দেখিলাম, তাহার উপর ইহাকে নির্দোষী ভাবিতেছি! নিজের চক্ষুকে অবিশ্বাস? না, নিশ্চয়ই এ নরহত্যাকারী। প্রাণ বাঁচাইবার জন্য এরূপ.বলিতেছে।
সেই ক্ষেত্রে শিবসহায় সিংহ, আমাদের দুইজনের, পরাণ চাকরের ও কীর্তিবাসের ভ্রাতুষ্পত্রের জবানবন্দী লইল। আমরা যাহা প্রত্যক্ষ দেখিয়াছিলাম তাহাই জবানবন্দীতে বলিলাম। পরাণ চাকর বেশির মধ্যে বলিল, ‘আমি যখন ক্যাশবাক্স খুলিয়া ব্রাহ্মণকে টাকা বাহির করিয়া দিই, তখন সে লোলুপ দৃষ্টিতে নোটের তাড়ার প্রতি দৃষ্টিপাত করিতেছিল। শুইবার পূর্বে আমি বাবুকে একথা জানাইতেছিলাম, কিন্তু তিনি সরল লোক, সহসা বামুনকে অবিশ্বাস করিলেন না। কিন্তু তার ফল হাতে হাতে পাইলেন। নিশ্চয়ই এই ব্রাহ্মণ টাকার লোভে আমার মনিবকে খুন করিয়াছে।’
পরাণ এই বলিয়া মনিবের পূর্ব গুণকীর্তন করিয়া কাঁদিতে লাগিল।’
মোকদ্দমা মাজিস্ট্রেটের কাছে উঠিল। তিনি আদ্যোপান্ত প্রমাণ পাইয়া আসামীকে সেসন সোপরদ্দ করিলেন। কীর্তিবাসকে অনেকে চিনিত, অনেকে তাহাকে ভালওবাসিত। সকলেই তাহার অদৃষ্টে কি ঘটে দেখিতে আসিয়াছিল। আদালত লোকে লোকারণ্য। কীৰ্তিবাসের জবানবন্দী পূর্ববৎ। এবারেও সে খুন সম্বন্ধে সমস্ত কথা একেবারে অস্বীকার করিল। আমাদের সাক্ষ্য সর্বাপেক্ষা প্রধান দাঁড়াইল—মাজিস্ট্রেট আসামীকে হাজতে রাখিবার হুকুম দিলেন।
হাতকড়ি বন্ধ হইয়া পুলিশের ধাক্কা খাইতে খাইতে সেই জনস্রোতের মধ্য দিয়া কীর্তিবাস অশ্রুপূর্ণ নয়নে, নত মুখে ধীরে ধীরে চলিল। তাহার দশা দেখিয়া আমার বড় দুঃখ হইল। কেহ বলিতে লাগিল—বামুনের কিছুই হইবে না, খালাস পাইবে। তাহার বন্ধুরা তাহার প্রতিধ্বনি করিয়া বলিল, ‘তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক। আমি হলপ করিয়া বলিতে পারি চট্টোপাধ্যায় নির্দোষী।’ আর কেহ বলিল, ‘লোক চেনা ভার—এই চাটুয্যে বড় ভাল মানুষ, কিন্তু এর পেটে পেটে এত ছিল তাহা কে জানে বল? বাছাধন! এইবারে মজাটা টের পাবেন।’
হতভাগ্য কীর্তিবাস এই সব শুনিতে শুনিতে অবনত মস্তকে কয়েদীর গাড়িতে উঠিল। আমি সেই জনতার মধ্যে একটি মর্মভেদী শ্বাস শুনিতে পাইলাম—কীর্তিবাস দীঘশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিল, ‘হা পরমেশ্বর! নির্দোষীর এত দণ্ড কেন!’
এই শ্বাস ও এই কথা চিরকাল আমার মনে থাকিবে।
তাহার পরদিন আমি কীর্তিবাসের বাসা ত্যাগ করিলাম। ইহার পরের ঘটনা পুলিশের দারোগার মুখে আপনারা শুনিতে পাইবেন।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
(শিবসহায় সিংহের কথা)
পুলিশ লাইনে অনেক দিন দক্ষতার সহিত চাকরি করিয়া আসিতেছি—কত বড় বড় সঙ্গীন মোকদ্দমা জলের ন্যায় সরল করিয়াছি—কিন্তু করালীবাবুর খুনের মোকদ্দমা তদারক করিয়া আমার মনের খটকা ঘুচিল না—কি একটা সন্দেহের ঘন ছায়া আমার মনের মধ্যে ঘুরিতে লাগিল। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছারি ভাঙ্গিবা মাত্রই আমি বড় সাহেবের আফিসে গেলাম। বড় সাহেব উপরে বসিয়া বই পড়িতেছিলেন, আমি গিয়া দেখা দিলাম। সাহেব বলিলেন, ‘আজকের খুনের মোকদ্দমা কি হইল?’
আমি সে সম্বন্ধে যাহা বলিবার ছিল বলিয়া, কহিলাম, ‘সমস্ত দেখিয়া কীর্তিবাস অপেক্ষা পরাণ চাকরকে আমার অধিক সন্দেহ হয়।’
আরো বলিলাম, ‘খানাতল্লাসীতে কেবল করালীবাবুর জামার পকেট হইতে কয়েকখানি নম্বরী নোটের নম্বর পাইয়াছি। এ ভিন্ন আর তো কিছু সূত্র পাইতেছি না। খুচরা নোটের আশা ছাড়িয়া দিতেছি, একখানি নম্বরী নোট পাইলেই সকল বিষয় পরিষ্কার হয়। সেজন্য পরাণকে একবার খানাতল্লাসী করিতে চাই।’
সাহেব আমার মতে মত প্রদান করায় আমি সেই দিন হইতে তাহার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলাম। অল্প দিনের মধ্যেই জানিতে পারিলাম সে কাশীতে আছে।
সন্ধ্যা হইয়াছে, অল্প অল্প বৃষ্টি পড়িতেছে, চারিদিক অন্ধকারে ব্যাপিয়াছে, রাস্তা ঘাট সকলই কর্দমময়, রাস্তার ক্ষীণালোকে গলির অন্ধকার আরও ভয়ানক দেখাইতেছে, এমন সময়ে এক দিন আমি বেনারসে পরাণের বাটীর কাছে উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম পরাণ ও আর একটা লোক হনহন করিয়া সেই বাড়ি হইতে বাহির হইয়া কেদারেশ্বরের মন্দিরের দিকে চলিল। পরাণের পরিধানে ফিনফিনে ধুতি, পায়ে ইংরাজি জুতা, মাথায় টেরি, গায়ে ধোপদস্ত পিরান, কাঁধে কোঁচান চাদর, সঙ্গের লোকটির অপেক্ষাকৃত হীন বেশ। তাহারা দুজনে—সন্দিগ্ধ মনে এদিকে ওদিকে চাহিতে চাহিতে কেদারের মন্দিরের পার্শ্বে একটি বটগাছের তলায় গিয়া দাঁড়াইল। সঙ্গের লোকটি—তাহার কথাবাতার ভাবেই বুঝিলাম—হিন্দুস্থানী। প্রেমারার দালাল। পরাণ আবার প্রেমারায় মাতিয়াছে। আমার বড়ই আপশোষ হইল—মনে ভাবিলাম কি কষ্ট! এত প্রমাণ পাইতেছি তবু ইহাকে ধরিতে সাহস করিতেছি না!
তাহারা সেই নির্জন বটতলায় দাঁড়াইয়া যে সকল কথা কহিতে লাগিল, তাহার অনেক আমি শুনিতে পাইলাম। তাহাতে বুঝিলাম গত রাত্রে পরাণ, প্রেমারা খেলায় ১০০ টাকা হারিয়া আসিয়াছে। আজ সে আড্ডায় যাইতে চাহিতেছে না—এই ব্যক্তি নয় আড্ডাধারী, না হয় দালাল, সে তাহাকে প্রলোভন দেখাইয়া আড্ডায় লইয়া যাইবার জন্য আসিয়াছে।
তাহারা সেই বটবৃক্ষতল ত্যাগ করিল, আমিও সঙ্গে চলিলাম। তাহারা নিঃশব্দে পাঁচ সাতটি গলি পার হইল, আমিও তদ্রূপ করিলাম। এতক্ষণ তাহারা চওড়া গলিতে চলিতেছিল, সে সব গলিতে অনেক লোক চলে, কেহ কাহারও তথ্য লয় না। কিন্তু এক্ষণে একটা সরু গলিতে প্রবেশ করিল। গলিটি এত অপ্রশস্ত ও অপরিষ্কার যে দুই জন লোক পাশাপাশি চলিতে পারে না। আমার পদশব্দে তাহারা চমকিত হইল—ফিরিয়া দাঁড়াইল—সেই হিন্দুস্থানীটা কর্কশ স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, ‘কোন হ্যায় রে!’ আমি বাঙ্গালাভাষায় বলিলাম, ‘খেলোয়াড়’। সে নিকটে আসিয়া আমার হাত চাপিয়া ধরিল, বলিল, ‘কে তুই ঠিক্ বল, কিসের খেলা, আর আজকের সঙ্কেত কি।’
আমি হাতের চাপনে, সেই দুর্দান্তের পরাক্রম অনুভব করলাম। মনে ভাবিলাম একা আসিয়া বড়ই কুকর্ম করিয়াছি। হয়ত সবই পণ্ড হইবে। কিন্তু সে সময়ে ভাবিবার সময় পাইলাম না। মুহূর্তের মধ্যে নূতন বুদ্ধি যোগাইল, সেই ব্যক্তি অশ্বত্থ গাছের তলায় পরাণকে একটি কথা মুখস্থ করিতে বলিতেছিল, সে কথাটি আমি শুনিয়াছিলাম। আমি বলিয়া উঠিলাম, ‘জিমিয়া’। সে আর কথা কহিল না—আমায় সাদরে আলিঙ্গন করিয়া, আমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিল। আরো বলিল, ‘ভাই,আমরা এত সতর্ক কেন জানো? কেতোয়ালি আমাদের বড়ই উত্যক্ত করিয়াছে। তাই এ সঙ্কেত শব্দের সৃষ্টি। সেদিন দুটা পুলিশের লোক আড্ডায় আসিয়া ঢুকিয়াছিল, তার পরদিন আমরা আড্ডা বদল করিলাম।’
আমি বলিলাম, ‘ভাই,খেলোয়াড় দেখিলে চিনিতে পার না?’ কিয়ৎদূর অগ্রসর হইয়া সেই হিন্দুস্থানী একটি ক্ষুদ্র দ্বিতল বাটীর দ্বারে আঘাত করিল, একটি বৃদ্ধা আসিয়া দ্বার খুলিয়া দিল, আমরা বরাবর উপরে উঠিলাম।
আড্ডাটি বেশ জমকালো। একটি প্রশস্ত মেজে, তাহার উপর কয়েকখানি তাস ছড়ান। ঘরটি অতি পরিষ্কার, দেয়ালগুলি ঝুল ও পানের পিকে চিত্রিত। দুইটি প্রদীপ উজ্জলভাবে সেই মেজের উপর জ্বলিতেছে। আট দশ জন লোক সেই ঘরের মধ্যে বসিয়া হাস্য পরিহাস করিতেছে। কেহ বা মদ্যপানে উন্মত্ত হইয়া চিৎকার করিতেছে, কেহ বা ধুলায় পড়িয়া রহিয়াছে। কেহ বা গান ধরিয়াছে, আবার কোথাও বা খেলা দেখিতে সকলে ঝুঁকিতেছে। ইহাই প্রেমারার আড্ডাঘর।
খেলা আরম্ভ হইল, পরাণ এ দিন সত্য সত্যই বাজী জিতিল। পাঁচবার খেলা হইল, পরাণ চারিবার জিতিল, একবার হারিল, একবারের হারেই তাহার সমস্ত সম্বল নষ্ট হইল,উলটিয়া আরও তাহার ৫০ টাকা দেনা দাঁড়াইল। সে টাকার জন্য অপমানিত হয় দেখিয়া আমি তৎক্ষণাৎ পঞ্চাশ টাকা দিয়া তাহাকে রক্ষা করিলাম। পরাণ সেই মুহূর্ত অবধি আমার বন্ধু হইল। আমার সহিত তাহার আত্মীয়তা বাড়িয়া উঠিল।
এই আলাপের তৃতীয় দিনে আমি ও পরাণ একত্রে আড্ডায় গেলাম। খেলা আরম্ভ হইল—পরাণ প্রথমেই দশ টাকা বাজি হারিল। সে ব্যস্তসমস্ত হইয়া, আমায় একখানি ১০০ টাকার এক কেতা নোট দিয়া বলিল ‘ভাই! এই নোটখানি শীঘ্র ভাঙিয়ে আনো, খুচরো টাকা আমার কাছে নাই। এই গলির বাহিরে পূর্বধারের রাস্তা ধরিয়া গেলেই—মোড়ের মাথায় বেনিয়ার দোকান দেখিতে পাইবে। সেইখানে চারি আনা বাটা দিলেই টাকা পাইবে, যাও শীঘ্র যাও।’
আমি দ্বিরুক্তি না করিয়া নোট লইয়া বাহিরে আসিলাম। পূর্ব রাস্তা ধরিয়া সেই দোকানে গেলাম। নোট না ভাঙাইয়া আবার ফিরিলাম। নিকটে একটি আলো জ্বলিতেছিল, ত্বরিত গতিতে নোটের নম্বর পড়িয়া দেখিয়া আমার খাতার করালীবাবুর নোটের নম্বরের সহিত মিলাইলাম। একখানি মিলিয়া গেল। আমি ফিরিয়া আসিলাম; মনে স্থির নিশ্চয় হইল পরাণই করালীবাবুর সমস্ত টাকা আত্মসাৎ করিয়াছে। আজই তাহাকে ধরিব এই আশায় মন বড়ই উৎসাহিত হইল, আমি আড্ডায় ফিরিয়া আসিলাম।
দেখিলাম মদ্যপানে পরাণের চক্ষু রক্তবর্ণ হইয়াছে। আর এক পাত্র খাইবার জন্য ঢালিয়া রাখিয়াছে, আমায় দেখিয়া সে পাত্র ত্যাগ করিয়া ছুটিয়া আসিল—আমি চুপে চুপে বলিলাম, ‘তোমার সহিত বিশেষ কথা আছে। একটু নির্জনে আইস।’ পরাণ আমার সঙ্গে আসিতে উদ্যত হইল, আমি বলিলাম, ‘এ পাত্রটা শেষ করিয়া আইস।’ সে তাহাই করিল।
সেই দালানের পাশে একটি বারান্দা। সেখানে আর কেউ নাই দেখিয়া আমি সেইখানেই তাহাকে লইয়া গেলাম। বলিলাম, ‘সব্বনাশ ঘটেছে। এ নোট তুমি কোথায় পাইয়াছ বল দেখি?’
এই কথা শুনিয়া পরাণের মুখ শুকাইয়া শবাকৃতি হইল। কে যেন তাহার মুখে কালি ঢালিয়া দিল; কে যেন তাহার পূর্ব স্মৃতি জাগাইয়া দিয়া তাহাকে যাতনা দিতে লাগিল। পরাণ রুদ্ধ স্বরে আমার হাত ধরিয়া বলিতে লাগিল—‘কেন, কেন? কি হয়েছে, শীঘ্র বল। নোট ভাঙাতে দিলুম তাতে আবার হল কি?’
আমি বলিলাম, ‘হল কি নয়! ব্যাপার বড় সঙ্গীন, যেখানে নোটের টাকা আনিতে গেলাম, তাহারা তো কোন মতেই টাকা দিতে চায় না। বলে এ চোরাই নোট। তাহাদের বই খুলিয়া তোমার নোটের নম্বরের সঙ্গে মিলাইল। শেষে বলিল, ‘এ নোটের নম্বর আমাদের লেখা আছে। এলাহাবাদে করালীবাবু বলিয়া এক বাঙালী খুন হইয়াছে। তাহার কতকগুলি নোট খোয়া গিয়াছে। পুলিশ সাহেবের হুকুম অনুসারে আমরা সেই চোরাই নোটের নম্বর পাইয়াছি, চারিখানি ১০০ টাকা নোটের মধ্যে ইহাও একখানি।’ কথা শুনিয়া পরাণের মুখ আরও শুকাইয়া গেল। মদিরার তেজে তাহার মস্তিষ্ক উত্তেজিত হইয়াছিল, আমার কথায় সে আরও ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়া গেল। প্রকৃত গোপন করিয়া এই দম্ বাজির দ্বারা আমি যে এরূপ আশাতীত ফল পাইব, তাহা আমি জানিতাম না। আমি পুনরায় বলিলাম, ‘পরাণ কি করি বল দেখি? তারা তো সেখানে আমায় ছাড়িতে চাহে না—বলে তোমায় পুলিশে দিব। আমি বলিয়াছি এ নোট আমার নয়—যাহার নোট তাহাকে দেখাইয়া দিব আমার সঙ্গে লোক দাও। ওই দেখ তাদের লোক বাহিরে দাঁড়িয়ে। আমি তো বাঁচিলাম—এখন তোমাকে বাঁচাই কিরূপে? এখুনি পুলিশ আসিয়া ধরিয়া ফেলিবে।’
সুরাতেজ এইবার পূর্ণ প্রভাবে পরাণের মস্তিষ্কের বিকৃতি সম্পাদন করিয়াছিল। সে এই ঘটনায় ক্রমশ আত্মহারা হইতেছিল—তাহার মনের শক্তি কমিয়া গিয়া ঘটনা গোপনের ক্ষমতা লোপ হইতেছিল ইহা বেশ বুঝিতে পারিলাম। আমার কথায় উত্তর না দিয়া সহসা সে চিৎকার করিয়া উঠিল, ‘আমি খুনী, আমিই মনিবকে মারিয়াছি, আমিই নোট লইয়াছি। আমার নামই পরাণ চাকর, ধর আমায়, ফাঁসি দাও।’ কথা শেষ না হইতে হইতেই সে কাঁপিতে কাঁপিতে দড়াম করিয়া মেঝের উপর পড়িয়া গেল।
ইহার পর পাঁচদিন পরাণ অজ্ঞানাবস্থায় কাটাইল। ঘোরতর বিকারে প্রলাপ বকিতে লাগিল, প্রলাপের মধ্যে করালীবাবুর কথাই অধিক। সেই ভয়ানক রাত্রে সে যে নৃশংস লোমহর্ষক কাণ্ডের অভিনয় করিয়াছিল, অজ্ঞানাবস্থায় তাহারই পুনরাভিনয় দেখাইতে লাগিল। তাহার এই অজ্ঞানাবস্থায় তাহার পকেট হইতে করালীবাবুর দুই কেতা ১০০ টাকার নোটও পাওয়া গেল।
বলা বাহুল্য কীর্তিবাস চট্টোপাধ্যায় সেসনের বিচারে বিনা আপত্তিতে খালাস পাইল। কীর্তিবাসের মুখে আর আনন্দ ধরে না, সে আমায় দেখিয়া বলিল, ‘মহাশয়,কেন ব্রাহ্মণকে এত কষ্ট দিলেন, পরমেশ্বর নির্দোষীকে রক্ষা করিলেন কি না এখন দেখিলেন তো।’ আমি লজ্জায় মরিয়া গেলাম।
ইহার পর ব্রাহ্মণের নিকট ক্ষমা ভিক্ষা করিতে একদিন তাহার বাটীতে গিয়াছিলাম। তাহার আবাসবাটী জনশূন্য। একজন লোক বলিল, কীর্তিবাস চট্টোপাধ্যায় বাটী বিক্রয় করিয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে। সেই দিন হইতে এলাহাবাদে কীর্তিবাসের আশ্রমের নাম লোপ।