হত্যাকাণ্ডের আগে ও পরে – ৩

অত্রি চলে যাওয়ার একটুক্ষণের মধ্যে সীমন্তিকাদি হাতে চায়ের কাপ আর সিগারেট নিয়ে এসে ধপ করে টেবিলটার উলটোদিকে বসল।

এই অফিসে ধূমপানে আসক্ত মহিলার সংখ্যা বেশি নয়। কমবয়সি যারা জয়েন করেছে তাদের কেউ-কেউ সিগারেট খায়। চল্লিশ ছুঁই-ছুঁইদের মধ্যে একমাত্র সীমন্তিকাদি আছেন। অনন্যা কলেজ জীবনে এক-দু’বার সিগারেট খেয়ে দেখেছে, অভিজ্ঞতা অতি খারাপ৷ কেশে-টেশে একাকার কাণ্ড হয়েছিল। অন্য মেয়েরা জোর করেছিল বলে খাওয়া। তখন বলা হত, ক্যান্টিনে একবার সিগারেট আর পিকনিকে একবার চুমু না খেলে নারীজীবন সম্পূর্ণ হয় না। সিগারেটে টান দিলেও অনন্যা চুমু পর্যন্ত যেতে পারেনি, তবে প্রস্তাব কম পায়নি। প্রস্তাব কেন? প্রস্তাবের থেকেও বেশি হয়েছে। একবার তো বিশ্রী গোলমাল হয়েছিল। বিরাট রিঅ্যাক্ট করে বসেছিল। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় টাকিতে পিকনিক যাওয়া হল। নিশানদের বাগানবাড়ি। নিশান ইংরেজি পড়ত। ছেলেকে ব্রিলিয়ান্ট বললে কম বলা হবে। দুর্দান্ত রেজ়াল্ট করে এখন অক্সফোর্ড স্কলার। লেখাপড়ায় অমন ভাল হলেও ছেলে ছিল পাজি। মেয়েদের সঙ্গে ফস্টিনস্টিতে খুব সহজে সীমা ছাড়িয়ে যেত। সহপাঠিনী বলে ছাড় দিত না। কোনও-কোনও মেয়ে এতে গলেও যেত। নিশানের মতো লেখাপড়া জানা ছেলে যদি দুটো অশ্লীল কথা বলে, একটু গায়ে হাত দেয়, অন্যায় কী? বরং ভালই তো, একবার ঝুলে যেতে পারলে বরাত খুলে যাবে। এই ছেলে তো সাধারণ ছেলে নয়, অনেকদূর যাওয়ার ছেলে। অনন্যা পাত্তা দিত না। নিশানও জানত।

নিশানদের বাগানবাড়ি যাওয়া হচ্ছে শুনে প্রথমে নাক কুঁচকেছিল। পরে ভেবে দেখল এতে ছেলেটাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়ে যাবে। নিশান তাকে এড়িয়েই চলে। শেষ পর্যন্ত চলে গিয়েছিল অনন্যা। একটা সময় পুকুর ধারে বসে ছিপ ফেলে মাছ ধরছিল অনন্যা। বন্ধুরা ছিল দূরে। নিশানদের চমৎকার বাগানবাড়ির এটা ছিল যাকে বলে ‘স্পেশ্যাল অ্যাট্রাকশন’। শীতের রোদে পিঠ দিয়ে মাছ ধরো। এইসময় ঘটনাটা ঘটে। নিশান কোথা থেকে এসে হাজির হয়। অনন্যার পাশে বসে এবং মাছ টোপ গিললে কীভাবে সুতো ছাড়তে হয় সে বিষয়ে হাতে কলমে শিক্ষা দিতে চায়। অনন্যা সতর্ক হয়। অনন্যা বিদ্রুপ করে বলেছিল, “তোদের পুকুরে তো মাছই নেই, টোপ গিলবে কে? এক ঘণ্টা হয়ে গলে বসে আছি। মাছের টিকিও দেখতে পাচ্ছি না। তুই সুতো কার জন্য ছাড়বি? এটা কি তোদের ফল্‌স পুকুর নিশান?”

নিশান চোখ পাকিয়ে বলল, “ফল্‌স পুকুর! এই পুকুরে আমি কত সাঁতার কেটেছি, কত মাছ ধরেছি জানিস?”

অনন্যা মুখে চুক-চুক করে আওয়াজ করে বলে, “সাঁতার কেমন কেটেছিস জানি না। তবে মাছের হাল বুঝতেই পারছি।”

নিশান চোখ নাচিয়ে হেসে বলল, “আমার সঙ্গে একবার জলে নেমে দেখই না, কেমন সাঁতার কাটি দেখিয়ে দেব।”

অনন্যার রাগ হল কিন্তু সামলে নিল।

“আমি সাঁতার জানি না।”

নিশান মুচকি হেসে বলল, “সো হোয়াট? আমি শিখিয়ে দেব। এদিকটায় কেউ আসবে না। তার উপর গাছের আড়াল আছে। কতবার আমি কিছু না পরে জলে নেমেছি। তুইও চাইলে জামা-প্যান্ট খুলে নেমে যেতে পারিস।”

অনন্যা মনে-মনে তৈরি হল। ছেলেটাকে কড়া শিক্ষা দেওয়ার জন্য তৈরি।

“মন্দ বলিসনি। পিকনিকে শাওয়ার ন্যাচারাল ওয়াটারে হওয়াই উচিত। তার আগে তুই স্বীকার কর নিশান, এই পুকুরে মাছ নেই।”

নিশান অপমানিত হওয়ার ভান করে বলে, “আর যদি মাছ ধরে দেখাই? কী দিবি?”

অনন্যা হেসে বলে, “যা চাইবি।”

নিশান যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। চোখ বড় করে বলল, “সত্যি?”

অনন্যা আশকারার ভঙ্গিতে ঠোঁট কামড়ে বলে, “প্রমিস।”

খুব অল্প সময়ের মধ্যে জলে ভাসা ফাতনা নড়ে ওঠে। নিশান কান পর্যন্ত হেসে বলে, “হল তো? এই দ্যাখ। ওই দ্যাখ, মাছ টোপ গিলেছে। নে, এবার দে।”

অনন্যা শান্তভাবে বলে, “আগে মাছ তুলে দেখা।”

নিশান চোখ জ্বলজ্বল করে বলে, “আগে যা চাইব তাই দে। মাছ খেলিয়ে কীভাবে তুলতে হয়, সে কায়দা আমার জানা আছে।”

অনন্যা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে, “কী নিবি?”

নিশান ফিসফিস করে বলে, “তোকে একটা চুমু খেতে চাই।”

অনন্যা আরও সহজভাবে বলে, “আচ্ছা, নে খা। তবে গালে খাবি, অন্য কোথাও নয়।”

কথা শেষ করে গাল বাড়িয়ে দেয় অনন্যা। নিশান এগিয়ে আসে। মুখ এগিয়ে দেয়। জলে ফাতনা কাঁপতে থাকে থরথর করে। সুতোয় টান পড়ে। নিশান চোখ বোজে। অনন্যা হালকা ঠেলায় নিশানকে জলে ফেলে দেয়। তারপর ঘাট থেকে উঠে পড়ে জিনস থেকে ধুলো ঝাড়তে থাকে। গলা জলে হাঁকপাক করছে নিশান। ছিপ, সুতো, মাছ সব ভেসে গিয়েছে।

“এটা কী করলি! কী করলি এটা!”

নিশানের গলায় বিস্ময়। অনন্যা চিৎকার করে বলে, “জল থেকে উঠে চেঞ্জ করে আসবি। আমি জলে ফেলে দিয়েছি শুনলে সবাই হাসবে। কেন ফেলে দিয়েছি শুনলে আরও হাসবে। আর হ্যাঁ, পারলে ডুব দিয়ে মাছটা জল থেকে ধরে আনবি।”

এই ছিল অনন্যা। এখন বয়স বেড়েছে, ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সাহস কমেনি। তবে আজ যে ঝামেলায় পড়েছে তাতে সাহস দিয়ে কিছু হবে না। কী দিয়ে হবে তা-ই বুঝতে পারছে না। নিজের পিরিয়ড মিস করা, দেবরূপকে লেখা চিঠি বসের হাতে চলে যাওয়া, দোপাটির ভয়ংকর অপরাধ— কোনটা কীভাবে সামলাবে?

সীমন্তিকাদি একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “অনন্যা, তোর কী হয়েছে?”

অনন্যার খাওয়া হয়ে গিয়েছে। আজও পুরোটা খেতে পারেনি। লাঞ্চবক্স বন্ধ করে চায়ের কাপ নিয়েছে। কাপে চুমুক দিতে গিয়ে থমকে গলে। বলল, “কী আবার হবে! কিছু হয়নি তো?”

সীমন্তিকাদি টেবিলে রাখা দেশলাই বাক্সটা নাড়াচাড়া করতে-করতে বললেন, “কিছু তো হয়েছে বটেই। সেই সকাল থেকে মুখ শুকনো করে আছিস। মাথা ব্যথাটা কি আবার হচ্ছে?”

সত্যি মুখ শুকনো নাকি? অনন্যা জোর করে হাসার চেষ্টা করল। কপালের চুল ঠিক করতে-করতে বলল, “না, না, কিছু নয়। কাল রাতে ঘুমটা ডিস্টার্বড ছিল।”

সীমন্তিকা ভুরু কোঁচকালেন। ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি৷

“বলতে না চাইলে বলিস না। তবে বোঝা যাচ্ছে সামথিং হ্যাপেন্‌ড টু অনন্যা বোস। তুই তো কখনও এমন মেজাজ খিঁচিয়ে থাকিস না! যাক, যা-ই হোক, টেক কেয়ার।”

কথা শেষ করে সীমন্তিকা সিগারেটটা টেবিলে রাখা অ্যাশট্রে-তে গুঁজে দিলেন। এই মানুষটাকে অনন্যা পছন্দ করে। স্পষ্ট কথা বলতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা হল, মেয়ে বলে কোনওরকম করুণা, সান্ত্বনা বা অতিরিক্ত সুবিধে নেওয়া পছন্দ করে না। নারীবাদীদের সহ্য করতে পারে না। এখন নিজে গাড়ি চালিয়ে আসে, কলেজে পড়ার সময় কখনও নাকি বাস-ট্রামের লেডিজ় সিটে বসেনি। নিজেই এসব গল্প করেছে।

“মুখে বলব সমান, আর বাসে উঠে আলাদা সিটে গিয়ে বসব কেন?”

“আহা সীমন্তিকাদি, বাস-ট্রামের লেডিজ় সিট তো আর শুধু মেয়ে বলে নয়, ফিজ়িক্যাল একটা ব্যাপারও থাকে। ভিড় বাসে তারা পুরুষের সঙ্গে পারবে কেন?”

“চুপ কর। বাসে ওঠা অনেক পুরুষ মানুষও অসুস্থ হতে পারে। ভিড়ে তাদের মাথা ঘোরে। তাদের কী হয়? তাহলে যারা সিক তাদের জন্য ব্যবস্থা থাকুক।”

“এ তোমার ছেলেমানুষি যুক্তি সীমন্তিকাদি। লেডিজ় সিটে না বসে নিজেকে সমান প্রমাণ করা যায় না।”

“আমি তো কিছু প্রমাণ করতে চাইছি না। মেয়ে বলে কারও অনুকম্পাও নিতে চাই না। মেয়েদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা, তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, তোমরা সমান নও।”

“সীমন্তিকাদি, তুমি কিন্তু নারীবাদীদের মতো কথা বলছ।”

“নারীবাদী! খেপেছ? এদের আমি দু’চক্ষে দেখতে পারি না। বিরাট ভণ্ড। নারী হয়ে সুযোগ নেয়। যদি সত্যিকারের অ্যাকটিভিস্ট হত তা হলে সব অন্যায়ের প্রতিবাদ করত। নারী-পুরুষ ভাগাভাগি করত না।”

“তা বললে হবে কেন সীমন্তিকাদি? গোটা বিশ্বেই মেয়েদের উপর অত্যাচার বেশি এবং সেটা মেয়ে বলেই। তাই তাদের জন্য বেশি করে দাঁড়াতে হয়।”

“সারা বিশ্বে মেয়েরা অনকে বড়-বড় কাজ করছে। রোজই তো খবরের কাগজে পড়ি। অলিম্পিকে মেডলে আনছে, ফাইটার প্লেন চালাচ্ছে। নারীবাদীরা শুধু রেপ নিয়ে লাফায়, সাকসেস নিয়ে তো একটাও মিছিল দেখি না। হাতে প্রতিবাদের মোমবাতি জ্বলে, সাকসেসের মশাল কই? তা হলে তো মেয়েরা কনফিডেন্স পেত।”

এসব বিষয়ে একনাগাড়ে তর্ক চালাতে পারেন সীমন্তিকাদি। প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন। তিনবছরের মধ্যে ডিভোর্স। মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছেন। সে গল্পও অনন্যাদের বলেছেন। ডিভোর্সের কারণটা অন্যরকম। শ্বশুরবাড়িতে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ দিতে শুরু করে। সীমন্তিকাদি কিছুতেই কাজ ছাড়বেন না। দরকার হলে বাচ্চাকে ক্ৰেশে দিয়ে অফিসে যাবেন। অশান্তি চরমে ওঠে। স্বামীকে পাশে চান। পান না সীমন্তিকাদি। উলটে সেই লোকও ঝামলো শুরু করে। গায়েও হাত তোলে।

“সবটাই তোমার ইচ্ছে মতো হবে? সংসারে থাকলে সংসারের ডিমান্ড বুঝতে হবে। বাচ্চার জন্ম দিলে বাচ্চার ডিমান্ড বুঝতে হয়।”

সীমন্তিকাদি বলেছিলেন, “বাচ্চা তো তোমারও। তুমি কি কাজকর্ম ছেড়ে দিচ্ছ?”

“বাজে কথা বোলো না। আমি আর তুমি এক হলাম? শাসনের অভাবেই এমন স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছ। মেয়েমানুষের হাতে টাকা পড়লে এই হয়। নিজেকে মাতব্বর মনে করো। বাইরে বেরিয়ে কাজ করার কী প্রয়োজন? আমি কি কম রোজগার করে আনছি?”

সীমন্তিকাদি বললেন, “তাতে আমার কী? তোমার টাকা তোমার, আমি কি তোমার কাছে হাত পাতব?”

“এসব বাজে যুক্তি। নিশ্চয়ই অন্য কোনও কারণ আছে। মনে হচ্ছে, মা তার ছেলের বউ সম্পর্কে ঠিক সন্দেহই করেছে। একদিন কার সঙ্গে যেন তোমাকে রাস্তায় দেখেছেও।”

সীমন্তিকাদি ঠান্ডা গলায় বলেছিলেন, “তোমার মা যে একজন অতি নিম্নস্তরের মহিলা, আমি আগেই বুঝেছি, কিন্তু তুমিও যে একজন নিম্নস্তরের পুত্র সেটা বুঝতে সময় লাগল, থুঃ।”

এরপর সেই লোক চড় মারে। পরদিন সকালে মেয়ের হাত ধরে শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন সীমন্তিকাদি। পরে বলেছিলেন, “আমি ইচ্ছে করেই গায়ে থুতু দিয়েছিলাম। চেয়েছিলাম এমন একটা কিছু ঘটুক যাতে আমি বেরিয়ে আসতে পারি।”

এই মহিলাকে পছন্দ না করে উপায় আছে? অনন্যা দ্রুত ভাবল, আচ্ছা চিঠির ঘটনাটা সীমন্তিকাদিকে বললে কেমন হয়? কিছু একটা পরামর্শ তো দিতে পারবে। হয়তো বসের টেবিল থেকে রিপোর্টগুলো সরিয়ে আনতে পারবে। সেগুলো হাতড়ালেই চিঠিটা পাওয়া যাবে। বলে দেখাই যাক না। সীমন্তিকা টেবিল ছেড়ে উঠে পড়েছেন। অনন্যা বলল, “এক মিনিট বসবে? একটা সমস্যায় পড়েছি। তোমার হেল্‌প পেলে ভাল হত। যদিও জানি না সেটা সম্ভব কিনা।”

সমস্যা শুনে সীমন্তিকা মুচকি হাসলেন। চাপা গলায় বললেন, “ইন্টারেস্টিং কাণ্ড ঘটিয়েছিস। এই যুগে বয়ফ্রেন্ডকে হাতে চিঠি লিখেছিস এটাই একটা স্টোরি।”

অনন্যা গলা নামিয়ে বলল, “মজা কোরো না। আমি খুব চিন্তায় পড়েছি। মেজাজটাও খারাপ হয়ে আছে। এত বড় একটা বোকামি করলাম। এই চিঠি কর্ণফুলি পড়লে… খুব স্ক্যান্ডাল হবে।”

সীমন্তিকা একটু অবাক হয়ে বলেন, “তুই তো চিন্তা করার মেয়ে নোস অনন্যা। তুই তো ঠান্ডা মাথার মেয়ে।”

“নানা কারণে মাথা ঠান্ডা রাখতে পারছি না সীমন্তিকাদি। অনকেগুলো বিশ্রী সমস্যায় জড়িয়ে পড়েছি।”

সীমন্তিকা বললেন, “এত ভাবিস না। আমি দেখছি বসের ঘর থেকে রিপোর্টগুলো বের করা যায় কিনা, তুই ঘরে গিয়ে আমাকে ফোলিয়ো নম্বরগুলো বের করে দে। আর… যদি এর মধ্যে কর্ণফুলি ওই চিঠি পড়েই ফেলে, তাতেই বা কী? তোর বয়ফ্রেন্ডকে তুই চিঠি লিখেছিস, তাতে কার কী! এটা নিয়ে স্ক্যান্ডালই বা কেন হবে আমি বুঝতে পারছি না।”

অনন্যা বড় করে শ্বাস ফেলে চাপা গলায় বলল, “বোকামি যখন হয় তখন পরপর হতে থাকে। চিঠিটায় দেবরূপকে আমি এমন সব কথা লিখে ফেলেছি, যেগুলো ভীষণ পার্সোনাল। এমনকী… এমনকী আমাদের ফিজ়িক্যাল রিলেশন নিয়েও… আমি এবার আমার পিরিয়ডের ডেট মিস করেছি সেটাও বলেছি… না বলে উপায় ছিল না সীমন্তিকাদি, মনে হচ্ছে, আমরা একটা হার্ড রিলেশনের মধ্যে দিয়ে চলেছি। রিলেশনটা ব্রেকআপের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ওকে খবরটা জানানো দরকার। নট ওনলি ইমোশনাল রিজ়ন… কিছু অবভিয়াস ডিসিশন নিতে হবে।”

সীমন্তিকা সিগারেট ধরাতে গিয়ে থমকে গেলেন। অনন্যার টেবিলের উপর রাখা হাতটা ধরলেন। বললেন, “সরি অনন্যা। আমি না জেনে তোর সঙ্গে মজা করে ফেলেছি।”

“ইট্‌স ওকে। তোমাকে বলে খানিকটা হালকা হলাম।”

সীমন্তিকা খানিকটা বাধো-বাধো করে বললেন, “হঠাৎ এতদূর হল! একেবারে ব্রেকআপ?”

অনন্যা ম্লান হেসে বলে, “অনকেদিন ধরেই ভিতরে-ভিতরে চলছিল হয়তো। জানতে পারলাম হঠাৎ। যাক, তুমি একটু দেখো।”

সীমন্তিকা হাত ঘুরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “চল, লাঞ্চ টাইম ওভার হয়ে গিয়েছে। আমি ঘরে গিয়েই বসের ঘরে যাচ্ছি।”

অনন্যা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “কী বলবে?”

সীমন্তিকা বলল, “দেখা যাক, তুই এটা আমার উপর ছেড়ে দে।”

অনন্যা যেন একটু ভরসা পলে। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে-উঠতে সীমন্তিকা নিচু গলায় বললেন, “সম্পর্ক গড়া যেমন কঠিন, ভাঙাও। কঠিন কাজে মাথা ঠান্ডা রাখবি। ভুল না হয়ে যায়।”

সীমন্তিকাকে কিছু করতে হল না। ঘরে ঢুকে নিজের ঘরে বসার মিনিটপাঁচেকের মধ্যে অনন্যার টেবিলের ইন্টারকম বাজল। কর্ণফুলি সেন ডাকছেন।

ঘরে ঢুকতে কর্ণফুলি একটা ভাঁজ করা কাগজ এগিয়ে দিলেন।

“নাও তোমার কাগজ। রিপোর্টের মধ্যে ফেলে রেখেছ।”

কেঁপে উঠল অনন্যা। ছি ছি! যা ভয় পেয়েছিল, তা-ই হল। এইবার বদ মহিলা গোটা অফিসে খবরটা ছড়াবে। শুধু এই অফিসে কেন, হেডকোয়ার্টারেও যাবে। কম্পিউটর ডিভিশনে অনন্যা বোসকে চেনে না এমন কাউকে পাওয়া কঠিন। অবিবাহিত সুন্দরী কলিগের খবর জেলার অফিসগুলোও রাখে। তার নামে কেচ্ছা শুনতে কে না আগ্রহী হবে? পুরুষ, মহিলা সবাই। আধুনিক সময়ে মূল্যবোধ, বিশ্বাস, স্বাধীন জীবনযাপন অনেক বদলে গিয়েছে, কিন্তু কেচ্ছা কেলেঙ্কারি নিয়ে চর্চা করার স্পৃহা আজও সমান রয়েছে। তাতে যদি সেক্স থাকে তা হলে তো কথাই নেই। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করল অনন্যার। নিজের উপর এত রাগ হল যে মনে হচ্ছে নিজেই নিজের গালে চড় বসায়। অতিরিক্ত বুদ্ধিমানেরা যখন বোকামি করে তখন তারা কি এমন অতিরিক্ত বোকামিই করে? কর্ণফুলি আবার চিঠিটা ভাঁজ করে রেখেছেন! জ়েরক্সও করেছেন নিশ্চয়ই। কম্পিউটরের প্রিন্টারের সঙ্গে এই সুযোগ আছে। মুহূর্তের কাজ।

হাত বাড়িয়ে ভাঁজ করা চিঠিটা নিল অনন্যা।

কর্ণফুলি সেন চোখের চশমা নাকের উপর ঠিক করলেন। মুহূর্তখানকে চুপ করে রইলেন। তারপর নরম গলায় বলতে শুরু করলেন।

“অনন্যা, যদি বলি কাগজটা আমি পড়িনি, তুমি বিশ্বাস করবে না। তাই সত্যি বলাই ভাল। হ্যাঁ, আমি পড়েছি। পড়ে ভালই হয়েছে। জানতে পারলাম, আমার একজন সহকর্মী জীবনের খুব বড় একটা সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে চলেছে। একজন মেয়ের জীবনে সবচেয়ে বড় সঙ্কট। যার সঙ্গে রোজ দেখা হয়, একসঙ্গে কাজ করি তার এই সমস্যার কথা তোমার ভুল না হলে জানাই হত না অনন্যা। যাক, আমাকে বিশ্বাস করতে হবে না, নিজের উপর বিশ্বাস রাখো। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি জানি, তুমি মনের জোর হারানোর মেয়ে নও।”

বিস্মিত অনন্যা অস্ফুটে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম।”

কর্ণফুলি সেন স্মিত হাসলেন। গলা নামিয়ে বললেন, “যদি কোনও প্রয়োজন হয় আমাকে জানাবে। আমি যে গাইনোকলজিস্টকে কনসাল্ট করি তিনি একজন নাইস মহিলা। যেমন গুড ডক্টর, তেমনই সিক্রেটিভ। আমার মতো নয়। চাইলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দেব। আজকালকার দিনে এসব কোনও ঘটনাই নয়। ম্যাটার অফ মিনিটস।”

অনন্যা চুপ করে রইল। তার মনে হচ্ছে, বিপদের সময় কেউ পিঠে হাত রেখেছে। সেই হাত স্নেহের।

কর্ণফুলি বললেন, “তবে আমি তোমায় যতটা চিনেছি তাতে বলতে পারি, তোমার বেলায় এই সমস্যাটা শরীরের নয়, সমস্যাটা মনের। আর তার ডাক্তার তুমি নিজে। বেস্ট অফ লাক। আগ বাড়িয়ে অনেক উপদেশ দিলাম বলে কিছু মনে কোরো না। বয়স বাড়ার এই এক ঝামেলা, বেশি কথা বলতে ইচ্ছে করে।”

কথা শেষ করে এবার জোরে হাসলেন কর্ণফুলি সেন।

অনন্যার চট করে যা হয় না, তাই হল। চোখ ভিজে এল। একজন মানুষকে নতুন করে চিনতে পারলে বুঝি এমনটাই হয়! সে চাপা গলায় বলল, “আপনি তো ঠিক কথাই বলেছেন।”

কর্ণফুলি বললেন, “ঠিক ভুল নিয়ে অত ভাবি না। ইচ্ছে হলে হড়বড় করে বলে দিই। আর একটা কথা বলি ডটার, তোমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কে কী রটাল, স্ক্যান্ডাল করল তাই নিয়ে মাথা ঘামাবে না। আমি করলেও না। ডাঁটের সঙ্গে থাকবে। সবার কথা বন্ধ হয়ে যাবে। এই যে আমাকে নিয়ে তোমরা কত কী বলো, আমি পরোয়া করি? আমি তো আমার মতোই চলি। চলি কিনা?”

অনন্যা তাড়াতাড়ি বলল, “না ম্যাডাম, আমি…”

কর্ণফুলি হাত তুলে হেসে বললেন, “থাক। আজ আর এসব নিয়ে কথা নয়। তুমি ভাল থাকো। আশা করি এই ঘটনা আমার কাছ থেকে কেউ জানতে পারবে না, তারপরেও স্বভাবের কারণে যদি বলে ফেলি সেটা গ্রাহ্য করবে না। যাও, কাজে যাও।”

সীমন্তিকা সব শুনে চোখ বড়-বড় করে বললেন, “স্ট্রেঞ্জ! এত দরদ! হ্যাঁ রে, জেনুইন তো অনন্যা? তুই ভুল বুঝলি না তো?”

অনন্যা গাঢ় গলায় বলল, “ভুল বুঝলেই বা কী এসে যায় সীমন্তিকাদি? যা হওয়ার তা তো হয়ে গিয়েছে। বস চিঠিটা পড়ে ফেলেছে। তারপরও বলছি, ওর কথা জেনুইন। একটা বোকামি করে ফেলেছি, তা বলে এটুকু বোঝার মতো বুদ্ধি নেই? সবচেয়ে ভাল লাগল, সিমপ্যাথি নয়, মহিলার গলায় একধরনের ফাইটিং মেজাজ দেখলাম। আ ডিফারেন্ট কর্ণফুলি সেন। আমাদের অচেনা। আমি তো ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম।”

সীমন্তিকা বললেন, “গুড। এই জন্যই বোধহয় বলে সব মানুষের ভিতরে অন্য একটা মানুষ থাকে। কর্ণফুলি সেনের মতো মহিলাও যে এই সহজ প্রবাদটার মধ্যে পড়বেন বুঝতে পারিনি। যাক, ভালভাবে যখন মিটে গিয়েছে সেটাই ভাল। চিঠিটা নিয়ে এবার কী করবি? দেবরূপকে পৌঁছে দিবি?”

অনন্যা একটু চুপ করে থেকে অন্যমনস্কভাবে বলল, “তাই তো ঠিক করেছিলাম। এখন থমকে গলোম। মনে হচ্ছে, চিঠির ছেলেমানুষিটা আর করা উচিত হবে না। দেখি অন্যভাবে যদি যোগাযোগ করতে পারি।”

সীমন্তিকা বললেন, “যদি চাস, আমি একবার ট্রাই করতে পারি। ফোন করব?”

অনন্যা বলল, “এখনই নয় সীমন্তিকাদি, একটু ভেবে নিই। তুমি তো রইলে।”

অফিস শেষে বাড়ি ফেরার সময় ভিড় মেট্রোতে দাঁড়িয়েও নিজেকে অনেকটা হালকা লাগল। একটা সমস্যার শুধু সমাধান হল না, পাশে দু’জনকে পাওয়া গেল। সীমন্তিকাদি সবসময়ই এরকম, কিন্তু কর্ণফুলি সেন নিজের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। সমস্যা শুধু মন খারাপ করায় না, মন ভালও করতে জানে।

সন্ধেবেলা বাড়ি ঢোকার সময় আরও একটা ঘটনা ঘটল। এই ঘটনাও অনন্যার কাছে অপ্রত্যাশিত।

বিশ্বনাথ বসু নিজের ঘরে বসে একটা বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছেন। বইটির বিষয় গুরুগম্ভীর।

বই পড়ার মানুষ বিশ্বনাথবাবু নন। গুরুগম্ভীর বই তো একেবারেই নয়। পত্র-পত্রিকা হাতের কাছে পেলে দেখতে পারেন, এই পর্যন্ত। স্কুল কলেজের সময়ও সিলেবাসের বাইরের বইতে উৎসাহ ছিল না। খুব বেশি হলে রহস্য-রোমাঞ্চ আর সস্তার কমিকসের চটি বই পড়েছেন। বড় হওয়ার পর তা-ও বন্ধ। খবরের কাগজ আর অফিসের কাগজপত্র ছাড়া তিনি কিছুই পড়েন না। তারপরেও তিনি মাঝে-মাঝে এই ধরনের বই পড়েন। পড়েন না বলে বলা উচিত ‘উলটে-পালটে দেখেন’। বুঝতে পারেন না। তাতে বিশ্বনাথবাবুর কিছু আসে যায় না। এই স্বভাব তাঁর আগে ছিল না, ইদানীং হয়েছে। স্বাভাবিক কারণেই স্বভাবটি অদ্ভুত এবং হাস্যকর। অদ্ভুত, কারণ বইগুলো অধিকাংশ সময়ই অতি নীরস। জটিলও বটে। আর হাস্যকর, কারণ তিনি এসব বই নেড়েচেড়ে দেখেন ছেলের প্রতি গভীর গর্ববোধে। মালব্য এখানে-সেখানে বই ফেলে গেলে নিজের ঘরে নিয়ে যান। বাড়িতে এই নিয়ে চাপা হাসাহাসিও আছে। সেই হাসাহাসির খবর অঞ্জলি স্বামীকে জানিয়েছিলেন।

“মালব্যর বইতে তুমি কী পড়ো?”

চোখের চশমা ঠিক করে লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিকে আড়াল করতে-করতে বিশ্বনাথবাবু বলেছিলেন, “কী পড়ি আবার কী! বইতে যা লেখা থাকে তাই পড়ি।”

অঞ্জলি সেদিন রাতে শোওয়ার আগে বালিশের ওয়াড় বদলাচ্ছিলেন। ভুরু কুঁচকে বললেন, “এ তো দেখছি ফিজ়িক্স না কেমিস্ট্রির বই।”

বিশ্বনাথবাবু এবার আত্মরক্ষার জন্য খানিকটা আক্রমণাত্মক হন। বলেন, “ফিজ়িক্স না কেমিস্ট্রি আবার কী কথা! অশিক্ষিতদের মতো। ঠিক করে বলতে পারছ না? মলাটে তো নাম লেখা আছে। এই দেখো, ‘মিস্ট্রি অফ লাইট’। আলোর রহস্য। এর মধ্যে কেমিস্ট্রি আসবে কোথা থেকে? গোটাটাই ফিজ়িক্সের ব্যাপার। আলোর গতি, আলোর বর্ণ, আলোর জোর এই সব নিয়ে… অনকে অঙ্ক-টঙ্কও আছে।”

অঞ্জলি হাতের কাজ বন্ধ করে স্বামীর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বিস্মিত গলায় বলেন, “এসবের তুমি কী বোঝো? মালব্যর কলেজের পড়ানোর বই। তুমি গম্ভীর মুখে, চোখে চশমা লাগিয়ে পড়ো কী জন্য?”

বিশ্বনাথবাবু এবার একটু থতমত খেয়ে যান। বলেন, “কেন, ছেলের কলেজে পড়ানোর বই পড়তে কোনও নিষেধ আছে নাকি?”

অঞ্জলি চিন্তিত মুখে বলেছিলেন, “কী ব্যাপার বলো তো! তোমার কি কোনও সমস্যা হচ্ছে? আমি আগেও দেখেছি মালব্যর বই নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করছ! মেয়েও সেদিন বলল। সেদিন রাতে খাওয়ার পর, তোমাকে ঘরে জল দিতে গিয়ে দেখেছে, ফিলজ়ফির একটা বই হাতে নিয়ে বসে আছ। আমার কাছে এসে খুব হাসছিল। বলছিল, বাবার মাথাটা কি পুরো গিয়েছে মা? কাজের লোকেরাও হাসে।”

বিশ্বনাথবাবু এবার নড়েচড়ে বসেন৷ ক্রুদ্ধ গলায় বলেন, “কাজের লোকেরা হাসে মানে! আমার বই পড়ার বিষয় তাদের রসিকতা পর্যন্ত যায় কী করে?”

অঞ্জলি আবার কাজে মন দিলেন। বালিশের ওয়াড় বদলাতে-বদলাতে বললেন, “তুমি নিয়ে যাচ্ছ তাই গিয়েছে। তাদেরও খুব বুদ্ধি। বাড়ির কর্তা যদি ছেলের কঠিন বই পড়ে তা হলে সবাই আড়ালে হাসবে।”

বিশ্বনাথবাবু বইটা বন্ধ করে খাটের পাশে রেখে থমথমে গলায় বলেন, “পড়ি কোথায়? মালব্য এখানে-সেখানে বই-টই ফেলে যায় তো, হাতের কাছে পেলে নেড়েচেড়ে দেখি। ছেলেটা কী এত পড়ে জানতে কৌতূহল হয়। তোমার হয় না?”

অঞ্জলির তখন একটু মায়াই হচ্ছিল। ছেলের প্রতি অতিরিক্ত দুর্বলতার ফল। তবে সেই দুর্বলতা অন্যের হাসি-ঠাট্টারও কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তিনি নরম গলায় বললেন, “আমার তো অনকে বিষয়ে কৌতূহল হয়, সব কৌতূহল কি মেটাতে যাই, না যাওয়া সম্ভব? ছেলেকে তুমি খুবই পছন্দ করো। বেশিই করো। সবাই একথা জানেও। তার জন্য এমন কিছু কোরো না যেটা হাসির বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।”

বিশ্বনাথ কঠিন গলায় বলেন, “অন্যের হাসি-কান্নার উপর আমার ইচ্ছে-অনিচ্ছে নির্ভর করে না অঞ্জলি। তুমি নিশ্চয়ই ভাল করে জানো। যদি জানো এখন থেকে জেনে নাও। বাড়ির বাকিদেরও বলে দিয়ো।”

মুখে একথা বললেও বিশ্বনাথবাবু তারপর থেকে মালব্যর বই নাড়াচাড়া কমিয়েছেন। প্রকাশ্যে তো বটেই, তবে একেবারে ছাড়তে পারেননি। মাঝে- মাঝে ছেলের সঙ্গে তার লেখাপড়া নিয়ে আলোচনা করতে ইচ্ছে করে। তাকে ডেকে জানতে চান। এর পিছনে শুধু ছেলের প্রতি দুর্বলতা নয়, নিজে বেশি লেখাপড়া না করার আফসোসও খানিকটা কাজ করে। স্কুলজীবন পর্যন্ত মালব্যও বাবাকে অনেক কথা বলত। বড় হওয়ার পর থেকে এড়িয়ে যায়। এখনও তাই। তবে কখনওই খারাপভাবে কিছু বলেনি। কারও সঙ্গেই খারাপ ব্যবহার করা মালব্যর স্বভাবে নেই। ছোটবলোয় অনন্যার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কখনওই আর পাঁচটা ভাই-বোনের মতো সেই ঝগড়া মারপিট পর্যন্ত গড়ায়নি। মায়ের সঙ্গে রাগারাগিও মাত্রা ছাড়ায়নি। বাবার সঙ্গে সম্পর্কটা কেমন তা মালব্য ঠিক জানে না। মানুষটাকে তার কিছুটা জেদি, একগুঁয়ে আর স্বৈরতান্ত্রিক বলেই মনে হয়। ভদ্রলাকে এই যুগেও মনে করেন, পরিবারের কর্তাই শেষ কথা বলতে পারে। তার ইচ্ছেই ফাইনাল। সে যা বলবে, সবাই সেই মতো চলবে। স্ত্রীকে তাচ্ছিল্য করার দিকে ভদ্রলোকের ঝোঁক আছে। অনন্যা বড় হয়েছে। লেখাপড়া শিখে নিজের যোগ্যতায় ভাল চাকরি পেয়েছে। এখন আর তার মতের উপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়া মুশকিল। তারপরেও উনি চেষ্টা করেন না, এমন নয়। মাঝে-মাঝে চেষ্টা চালান। আবার মেয়ের যুক্তি-বুদ্ধির কাছে হার স্বীকারও করেন। বাবার এই স্বভাব— সবটা ভালর মধ্যে পড়ে না। এই নিয়ে মাথা ব্যথা না থাকলেও মালব্য জানে। তারপরেও বাবার জন্য তার আলাদা সম্মান রয়েছে। সম্মানের সঙ্গে মিশে আছে খানিকটা ভয়, খানিকটা সম্ভ্রম। কেন এরকম হয়েছে মালব্য বলতে পারবে না। হয়তো বাবা তার জন্য বেশি দুর্বল, তাই হয়েছে। হয়তো মানুষটার আপাত গম্ভীর, খানিকটা রাগী স্বভাবের আড়ালে একটা নরম মানুষকে সে অনুভব করে। হয়তো মনে হয়েছে, নিজে খুব লেখাপড়া না জানলেও মানুষটা ছেলেমেয়েদের যত্ন করে লেখাপড়া শিখিয়েছে। কোনওদিন চাকরিবাকরির জন্য চাপ দেয়নি। হয়তো এসব কিছুই নয়। একেবারে অন্য কোনও মায়া মমতা। যার কোনও ব্যাখ্যা হয় না। খোঁজাও অর্থহীন। যা-ই হোক, মানুষটাকে কোনওদিন খারাপ ভাবে কিছু বলে না মালব্য। বিরক্ত হলেও নয়। কোনওদিন সকালে হয়তো বাড়িতে গাদাখানকে পরীক্ষার খাতা নিয়ে বসেছে। একেবারে দিশেহারা অবস্থা। দু’দিনের মধ্যে সব খাতা দেখে জমা দিতে হবে। দম ফেলার সময় নেই। মা ঘরে চা পাঠিয়ে দিয়েছে। সেই চা-ও পড়ে-পড়ে ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। এমন সময় হয়তো বিশ্বনাথবাবু ঘরে ঢুকলেন। মাঝে- মাঝে তিনি এভাবে ছেলের ঘরে উপস্থিত হন।

“কী করছিস?”

“খাতা দেখছি বাবা।”

বিশ্বনাথবাবু অবাক গলায় বললেন, “বাপ রে! এত খাতা।”

মালব্য হেসে বলল, “অনকে স্টুডেন্ট যে। খাতা তো বেশি হবেই।”

মালব্য খাটের উপর খাতাপত্র, বই ছড়িয়ে কাজ করছিল। বিশ্বনাথবাবু খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে নিয়ে বসে পড়লেন। মালব্য সরে বসল।

“তোর অনেক ছাত্র বুঝি?” বিশ্বনাথবাবুর গলায় গর্ব স্পষ্ট।

মালব্যর অসুবিধে হচ্ছে। বাবার কথার জবাব দেওয়া মানে খাতা দেখা বন্ধ। ভদ্রলোক যেভাবে আয়োজন করে বসেছেন তাতে মনে হচ্ছে না চট করে উঠবেন।

“অনার্স ক্লাসে অত নয়, পাসে ছেলেমেয়ে বেশি। এই খাতা পাসের।”

বিশ্বনাথবাবু মাথা নাড়িয়ে বললেন, “ভেরি গুড। বেশি ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করছে মানে দেশটার উন্নতি হচ্ছে। এটা একটা সুখবর। আমাদের সময় এরকম ছিল না। কতজন যে পড়তে-পড়তে কলেজ ছেড়ে দিত! কী ব্যাপার? না, চাকরি পেয়ে গিয়েছে, সব বাদ দিয়ে চাকরি করতে হবে। লেখাপড়া চুলোয় যাক। আমার সময়ই কতজন চলে গেল। আমরা গুটিকতক ফাইনাল পরীক্ষা দিলাম। তারপর আমিও তো সেই কাজকর্মের চক্করে পড়ে গেলাম। আমার তো আরও লেখাপড়া করার ইচ্ছে ছিল। হল কই! যাক… এখনকার ছেলেমেয়েরা কিন্তু লেখাপড়া শেষ করতে চায়।”

মালব্য মৃদু হেসে বলল, “বাবা, একে লেখাপড়া বলে না। একে বলে ডিগ্রি জোগাড়। সেই ডিগ্রির দাম তেমন নেই। পকেটে নিয়ে কাজের জন্য এই দরজা থেকে ওই দরজা খালি ঘুরে বেড়াতে হয়। কাজ জোটে না।”

বিশ্বনাথবাবু লেখাপড়ার কোনও নিন্দে শুনতে চান না। লেখাপড়ার নিন্দে মানে যেন ছেলের নিন্দে। তিনি প্রায় ধমক দিয়ে ওঠেন। বলেন, “ছাড় ওসব কথা। লেখাপড়া ইজ় লেখাপড়া। লেখাপড়া শিখে কোন যোগ্য ছেলেমেয়ে ঘরে বসে থাকে বল দেখি? এই যে… এই যে আমার দুই ছেলেমেয়ের কথাই ধর না। তারা ভাল করে লেখাপড়া শিখেছে, সঙ্গে-সঙ্গে ভাল কাজও পেয়েছে।”

মালব্য কিছু না বলে হাসল। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। সে খাতায় মন দেয়। বিশ্বনাথ বসু খাটের উপর ছড়ানো একটা-দুটো বই উলটে পালটে দেখতে থাকেন। একটা ছোটখাটো বই তুলে বললেন, “এটা কী বই?”

মালব্য মুখ তুলে তাকাল। ছোটখাটো হলেও বাবা একটা কঠিন বই তুলেছে। খুবই কঠিন। বাবার বোঝার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। সে নিজেও বহু দিন ধরে পড়ছে আর হোঁচট খাচ্ছে।

“বাবা, এটা সর্বকালের অন্যতম সেরা পদার্থবিজ্ঞানী এরউইন শ্রডিঙ্গারের একটা লোকচারের কালেকশন। বইয়ের আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। খুবই জটিল বিষয়।”

ছেলের খাটে জটিল বিষয়ের বই দেখে আহ্লাদিত হলেন বিশ্বনাথ বসু। বইটা চোখের কাছে নিয়ে বললেন, “বাঃ, ইন্টারেস্টিং। ভাষণ যখন বই আকারে ছাপানো হয়েছে তখন নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ।”

মালব্য আগ্রহ নিয়ে বলল, “শ্রডিঙ্গারের মতো বৈজ্ঞানিকদের সব কথাই গুরুত্বপূর্ণ বাবা। উনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন। সম্ভবত ১৯৫৬ বা ’৫৭ হবে। সারা বিশ্বের পদার্থবিদ্যাচর্চার এক নতুন দিক খুলে গিয়েছিল। সেই ভাষণ পরে ‘মাইন্ড অ্যান্ড ম্যাটার’ নামে বই আকারে প্রকাশ পায়। এই বই সেটারই একটা অংশ বলতে পার।”

বিশ্বনাথবাবুর মুখ হাসি-হাসি হয়ে যায়। এতবড় একটা মানুষের বই তার ছেলের কাছে!

“ভাষণের বিষয় জানতে পারি? তুই কি বইটা পড়েছিস?”

লেখাপড়ার আলোচনা এসে পড়ায় মালব্য তার স্বভাব মতোই উৎসাহী হয়ে পড়ে। সে ভুলে যায় তার সামনে যে মানুষটা বসে রয়েছে তার পক্ষে এই বই এবং তার বিষয়ের বিন্দুমাত্র বোধগম্য হওয়ার কথা নয়।

“পড়েছি, তবে বুঝেছি বলা যাবে না। বুঝেছি না বলাটাই সত্য হবে। খুবই কমপ্লিকেটেড বিষয়। এখানে শ্রডিঙ্গার একটা মারাত্মক কাজ করতে চেয়েছেন। ফিজ়িক্স যেখানে থমকে গিয়েছে বা সীমারেখা টেনে দিয়েছে সেখান থেকেই তিনি টপকে গিয়েছেন। তিনি দেখতে চেয়েছেন বস্তুজগতের সঙ্গে মানুষের মনের কী সম্পর্ক। আদৌ কি কোনও সম্পর্ক আছে?”

বিশ্বনাথবাবু বিড়বিড় করে বলেন, “চমৎকার!”

‘চমৎকার’ অবশ্য তিনি বিজ্ঞানীর গবেষণাকে বলেননি, বলেছেন ছেলের বলার ভঙ্গিকে। এইরকম একটা দুর্বোধ্য বিষয়ে কথা বলতে পেরে সে যেন বিশেষভাবে আনন্দিত। মালব্য বলে যেতে থাকে।

“ভদ্রলোক আধুনিক পদার্থবিদ্যার একজন জনক। ‘মাইন্ড অ্যান্ড ম্যাটার’-কে আমরা বলতে পারি মন ও বস্তু। মন ও জড়বস্তু বলাই উপযুক্ত হবে। এই দুইয়ের মধ্যে যে সম্পর্ক সেটা নিয়েই এখানে আলোচনা হয়েছে।”

মালব্য থেমে যায়। সে খানিকটা লজ্জাই পেয়ে যায়। ক্লাসে পড়ানোর মতো বেশি বলা হয়ে গলে। বিশ্বনাথবাবু বই হাতে উঠে পড়েন। তাঁকে এবার কাজে বেরোতে হবে।

“আমি কি বইটা একটু নিতে পারি?”

মালব্য থতমত খায়। এই বই নিয়ে বাবা কী করবে? এক বর্ণও তো বুঝবে না। কিন্তু সেকথা বলা যায় না।

বিশ্বনাথবাবু ছেলেমানুষের মতো হেসে বলেন, “আমি মূর্খ মানুষ, এসবের কী বুঝব। পাতা উলটে কালই ফেরত দেব।”

মালব্য অস্ফুটে বলে, “আচ্ছা।”

বিশ্বনাথবাবু লাজুক হেসে বলেন, “জানিস মালব্য, বাড়িতে এখানে- সেখানে তুই বই-টই ফেলে এলে আমি নিয়ে দেখি। এই তো ক’দিন আগে সাউন্ড নিয়ে একটা বই দেখছিলাম। বাপ রে, শব্দে যে এত অঙ্ক আছে কে জানত। বই থেকেই প্রথম জানলাম। তার আগে… তার আগে দেখলাম থিয়োরি অফ রিলেটিভিটি। সে বই তো এক লাইন পড়তে গেলে দাঁত ভেঙে যাওয়ার জোগাড়। ইলেকট্রিসিটি যে ভীষণ ওজনদার বিষয় সে-ও তোর একটা ইয়া মোটা বই দেখে বুঝেছি। পড়তে হয়নি। এই ক’দিন আগে অফিসের একজনকে বলছিলাম, আমার ছেলেটা যেসব বই পড়ে তার আধখানা পড়তে হলেই গিয়েছিলাম আর কী। ভাগ্যিস লেখাপড়া শিখিনি।”

কথা শেষ করে বিশ্বনাথবাবু নিচু গলায় হাসলেন। বললেন, “নে, তুই কাজ কর, অনেকটা সময় নষ্ট করে দিলাম।”

সত্যি সময় নষ্ট হয়। কিন্তু মালব্যর কিছু করার নেই। বিশ্বনাথ বসু তো দূরের কথা, মালব্য বাড়ির বাইরের কারও সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করতে পারে না। কলিগদের সঙ্গে ঝগড়া-টগড়ায় নেই। ছাত্র-ছাত্রীদেরও বকা- ঝকা করতে পারে না। তার ক্লাসের বহু ছেলেমেয়ে রোল কলের পর বেরিয়ে যায়। মালব্য কখনও আপত্তি করেনি। অনিচ্ছুক ছেলেমেয়ে নিয়ে ক্লাস করতে মোটে ভাল লাগে না তার। প্রিন্সিপাল এই বিষয়টা নিয়ে তাকে প্রায়ই কড়া ভাবে বলেন।

“তোমার ক্লাসে নাকি ছেলেমেয়েরা থাকতে চায় না মালব্য?”

মালব্য বলে, “সবার ক্লাসেই কম-বেশি তা-ই হয় স্যার। শুধু আমার ক্লাস বলে আলাদা করে নয়।”

প্রিন্সিপাল বিরক্ত হয়ে বলেন, “সবারটা সবাইকে বলতে দাও, তোমারটা তুমি বলো।”

মালব্য বলে, “আমি কাউকে ক্লাসঘরে আটকে রাখায় বিশ্বাস করি না। আটকে রাখলে তার উপর অত্যাচার করা হবে। সে-ও ক্লাসকে বিরক্ত করবে। লেখাপড়াটা আনন্দের বিষয়।”

প্রিন্সিপাল কড়া ভাবে বলেন, “এই সব কথা আমরা না হয় কোনও সময় সেমিনার করে আলোচনা করব। তুমি সমস্যাটা বলো। তোমার পড়ানো বুঝতে কি ছেলেমেয়েদের অসুবিধে হয়? নাকি তারা বেয়াদপি করছে?”

মালব্য বলল, “এই দুটো প্রশ্নের উত্তর তারা দিতে পারবে। কারণ দুটো উত্তরই তাদের জানার কথা। আমার নয়। তবে এটুকু বলতে পারি স্যার, যে সামান্য ক’টা ছেলেমেয়ে শেষ পর্যন্ত আমার ক্লাসে বসে থাকে, তারা এবার ভাল রেজ়াল্ট করবে।”

প্রিন্সিপাল অসন্তুষ্ট মুখে মাথা নাড়তে-নাড়তে বলেন, “এসব কোনও যুক্তি নয়। ক্লাস ঠিকমতো ম্যানেজ করতে হবে। নইলে কলেজের বদনাম হয়ে যাচ্ছে মালব্য। এটা তোমাকে দেখতে হবে।”

অন্য যে-কোনও অধ্যাপক হলে সেদিন প্রিন্সিপালকে বলে আসত, “স্যার, ক্লাস ম্যানেজ করার জন্য আপনি একজন ম্যানেজার রাখুন। আমি ম্যানেজার নই, অধ্যাপক।”

মালব্য কিছুই বলে না। অপমান গায়ে মেখে, মাথা নেড়ে চলে আসে।

বিশ্বনাথবাবু আজ যে বইটি নিয়ে খাটে আধশোয়া হয়ে আছেন তার বিষয় চাঁদের নুড়ি-পাথর। শুনতে হালকা-পলকা মনে হলেও বইতে সেকথা জটিল করে লেখা। বিশ্বনাথবাবু প্রথমে অবাকই হয়েছিলেন। চাঁদের নুড়ি-পাথর কি মালব্যর সাবজেক্টের মধ্যে পড়ে? এই জিনিসও কি তাকে কলেজে পড়াতে হয়? মনে হয় না। ছেলেটার এইটাই গুণ। নানারকম বিষয়ের বই পড়ে। বিশ্বনাথবাবুও পড়ার চেষ্টা করেছেন। জটিলতা ভেঙে খানিকটা পড়েও ফেলেছেন। খুবই রোমাঞ্চকর।

চাঁদে পাওয়া পাথরকুচি থেকে সামান্য যে গ্যাস পাওয়া গিয়েছে, বৈজ্ঞানিকরা সেই গ্যাস পরীক্ষা করে দেখেছেন পাথরকুচিগুলির বয়স পৃথিবীর প্রাচীন পাথরগুলির সমান। কী আশ্চর্য! বিশ্বনাথবাবু মুগ্ধ হন। ছেলের জন্যই তো এসব জানা গেল। এই বই বলছে, পাথরকুচিগুলি যে বছরের পর-বছর মহাকাশ-রশ্মির মধ্যে কাটিয়ে এসেছে সেটাও নাকি বোঝা গিয়েছে। এমনকি মজার কথা, বিজ্ঞানীরা এই সব পাথরকুচি ঘেঁটে বুঝেছেন সেগুলো মাঝে-মাঝেই চাঁদের মাটিতে গড়াগড়ি খেয়েছে। উলটে পালটেও গিয়েছে। হিসেব-টিসেব করে দেখা গিয়েছে, এই সব পাথরের বয়স আড়াইশো কোটি বছর থেকে চারশো কোটি বছর।

চারশো কোটি বছর! বিশ্বনাথবাবু ধাক্কা মতো খেলেন। এসব ঠিকঠাক লেখা তো? মালব্যকে জিগ্যেস করতে হবে।

“বাবা, ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?”

তাড়াতাড়ি বই বন্ধ করে বালিশের তলায় লুকিয়ে ফললেন বিশ্বনাথ। পুরোটা লুকনো গেল না। মলাটের খানিকটা বেরিয়ে রইল। খাটের গায়ে ভর দিয়ে আরও খানিকটা সোজা হয়ে বসলেন বিশ্বনাথ। মেয়ে নিঃশব্দে ঘরে ঢুকেছে।

“না ঘুমোইনি। আয়।”

অনন্যা খাটের পাশে রাখা চেয়ারে বসে হেসে বলল, “বাবা, তুমি নিশ্চয়ই আবার দাদার বই নিয়ে বসেছ? আমাকে দেখে লুকোতে গেলে। তাই তো?”

বাবার সঙ্গে অল্পস্বল্প ঠাট্টা-রসিকতা করার অধিকার অনন্যার আছে। ছোটবলোয় ছিল না, বড় হওয়ার পর হয়েছে। অনন্যা নিজেই করে নিয়েছে। মা, দাদা যে কথা বলতে পারে না, সে অনায়াসে বলে দেয়। সব মেয়ের বেলাতেই বোধহয় এরকম হয়। বাবা যতই গুরুগম্ভীর, রাগী হোক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক সহজ হয়ে থাকে। তবে অনন্যা একটা সীমা রক্ষা করে। সীমার বেশি যায় না। ইচ্ছে করেই যায় না। গেলে বাবাও তার অনকে বিষয়ে ঢুকে পড়তে পারে। এটা তার পছন্দ নয়। সে মনে করে, এই ধরনের জেদি মানুষের সঙ্গে একটা দূরত্ব থাকা ভাল।

বিশ্বনাথবাবু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “না না, লুকোব কেন! কী যে বলিস। পাশে রেখে দিয়েছি। এই দেখ না, বইটা খুব ইন্টারেস্টিং,” বলতে- বলতে বইটা টেনে বের করলেন বিশ্বনাথবাবু। বললেন, “মালব্য কিন্তু নানা ধরনের বই পড়ে। এই যে বইটা, এটা কীসের উপর লেখা বলতে পারবি? এটা লেখা চাঁদের নুড়িপাথরের উপর। নে দেখ।” বিশ্বনাথবাবুর হড়বড় করে এত কথা বলার কারণ একটাই, বই লুকোতে গিয়ে তিনি মেয়ের হাতে ধরা পড়েছেন। অনন্যা সেটা বুঝতে পেরে মুখ টিপে হাসছে।

অনন্যা একটা সবুজ নীলে মেশানো কুর্তি পড়েছে। পায়জামাটা কালো। টেনে চুল বেঁধেছে। ঘরের নিয়ন আলোয় বেশ দেখাচ্ছে তাকে। বিশ্বনাথবাবু খুশি হলেন। তাঁর মেয়েটাকে সত্যি সুন্দর দেখতে। তবে এবার বিয়ে হওয়া দরকার। অঞ্জলি তাড়া দিয়ে ঠিকই করে। তিনিই বরং আশকারা দেন। আসলে তিনি যতদূর শুনেছেন, দেবরূপ ছেলেটা ভাল। ভাল ছেলেদের একটু ফ্যাচাং তো থাকবেই। তারা তো আর গড়পড়তাদের মতো হয় না। তার ছেলেরই ফ্যাচাং কম নাকি? সংসারে কোনও মনই নেই। সারাক্ষণ মুখে বই নিয়ে বসে থাকাটা বাড়ির জন্য একটা ফ্যাচাং তো বটেই। তার মা বিয়ে-থা-র কথা তুললেই উঠে যায়। হ্যাঁ, না কিছু বলে না। বোঝো কাণ্ড! না, এভাবে গা এলিয়ে থাকা উচিত নয়। ছেলেমেয়েকে সংসারী করে দেওয়াটা বাপ-মায়ের ডিউটি। অঞ্জলিকে বলতে হবে, সে যেন তার মতো চাপ দেওয়া শুরু করে।

“আচ্ছা, ঠিক আছে, দাদার বই খুব ইন্টারেস্টিং। তুমি রাত জেগে পড়ো। এখন আমার একটা জরুরি কথা শোনো।”

বিশ্বনাথবাবু ভুরু কোঁচকালেন। এত রাতে জরুরি কথা! তা-ও আবার মেয়ের!

“কী হয়েছে? কোনও সমস্যা?”

অনন্যা বলল, “সমস্যা যাতে না হয় তার জন্য কথা। তুমি মাথা ঠান্ডা করে শুনবে। এই রাতে যখন বলতে এসেছি, তখন নিশ্চয়ই ভেবেচিন্তে বলছি।”

বিশ্বনাথবাবু হালকা বিরক্ত হলেন। বললেন, “এত ভূমিকা করছিস কেন? আসল কথাটা বল।”

অনন্যা একটু চুপ করে থেকে শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “বাবা, অনেকদিন তো হল, এবার দোপাটির জন্য একটা হস্টেলের ব্যবস্থা করলে কেমন হয়? ভাল কোনও রেসিডেনশিয়াল স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেই হবে। এখন তো ভাল-ভাল সব প্রাইভেট স্কুলেই ছেলেমেয়েরা থেকে লেখাপড়া করে। দোপাটি লেখাপড়ায় ভাল। সে যেখানে চাইবে ভর্তি হতে পারবে।”

বিশ্বনাথবাবু থমথমে গলায় বললেন, “হঠাৎ একথার মানে?”

অনন্যা বলল, “হঠাৎ তো নয় বাবা, তুমিই বলেছিলে, ক’দিন এবাড়িতে থাকার পর মেয়েটার জন্য কোনও হস্টেলের ব্যবস্থা করবে। বলেছিলে না?”

বিশ্বনাথবাবু রুক্ষ গলায় বললেন, “হ্যাঁ, বলেছিলাম, তাতে কী হয়েছে? বলেছিলাম মানে কি নির্দিষ্ট কোনও সময় ঠিক করে দিয়েছিলাম? বলেছিলাম, অমুক দিনের পর মেয়ে বাড়িতে থাকবে না?”

অনন্যা সামান্য হেসে বলল, “এই তো বাবা, তুমি মাথা গরম করছ। আমি কি সেকথা বলেছি?”

বিশ্বনাথবাবু মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই প্রস্তাব নিশ্চয়ই তোমার মায়ের। তোমাকে দিয়ে বলাচ্ছে। তাই তো?”

অনন্যা একটা হাত বাড়িয়ে বাবার হাতের উপর রাখল। নরম গলায় বলল, “একেবারেই না। আচ্ছা, আমার কি নিজের কোনও বোধবুদ্ধি নেই? এই বয়সেও মায়ের কথা শুনে চলব? আমি নিজেই এটা ভেবেছি।”

বিশ্বনাথবাবু মেয়ের হাত সরিয়ে খাট থেকে নামলেন। কঠিন গলায় বললেন, “কেন ভেবেছ জানতে পারি? একটা বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে তোমাদের এত মাথা ব্যথা কীসের? এত বড় একটা বাড়িতে কাউকে রাখার অধিকার কি আমার নেই? কত ছেলেমেয়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে থেকে মানুষ হয়। আমি নিজেও তো একটা সময় কয়েকবছর দেওঘরে মামাবাড়িতে থেকে লেখাপড়া করেছি। কই, তাদের বাড়ির লোকজন তো প্রতিনিয়ত আমাকে তাড়ানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকত না! অথচ দোপাটিকে নিয়ে তোমরা অস্থির। এমন একটা ভঙ্গি করছ যে একটা প্রায় অনাথ মেয়েকে বাড়িতে থাকতে দিয়ে আমি বড় অন্যায় করে বসেছি। আজ তুমি বলছ, গত ছ’মাস ধরে তোমার মা আমাকে একই কথা বলে চলেছে। মালব্য তো একটা কথাও বলে না!”

অনন্যার এবার রাগ হচ্ছে। মানুষটা সমস্যা না শুনে একগুঁয়েমি করছে। দাদার প্রসঙ্গ এখানে আসছে কী করে? দাদা সংসারের কোন বিষয়টা নিয়ে মাথা ঘামায়? দোপাটির সঙ্গে তার দেখাই বা হয় কখন? কথাই বা হয় কতটুকু? দোপাটি তো বাড়ির সবার সঙ্গে রাতে খেতে বসে না। তার রাত ন’টা বাজতেই খিদে পায়। বেশি রাত করে খেলে নাকি সে রাত জেগে পড়তে পারবে না। সত্যি কথা বলতে কী, রাতে বাড়ির সবাই খাবার টেবিলে বসার রেওয়াজটাই উঠতে বসেছে। সুতরাং দোপাটির সঙ্গে দাদার দেখা হওয়ার প্রশ্নও ওঠে না। মেয়েটা এতদিনে কী-কী অপরাধ করেছে সে ব্যাপারে দাদাকে কখনও বলাও হয়নি। বাড়ির লোকের খবরেই যার উৎসাহ কম, বাইরের একটা মেয়ে কী বদ কাজ করছে তাই নিয়ে সে কোন দুঃখে মাথা ঘামাতে যাবে? সে নিজেও কি নাক গলাতে চেয়েছিল? একটার পর-একটা ঘটনা তাকে চিন্তিত করেছে। তার উপর মা যেভাবে অস্থির হয়ে পড়েছে তাতে মনে হচ্ছে এই মহিলাই না মাথা গরম করে ভয়ংকর কিছু করে বসে। মাকে দোষ দেওয়াও যায় না, কালকের ঘটনা তো মারাত্মক। বাধ্য হয়েই বিষয়টার মধ্যে সে ঢুকেছে। এখনই কিছু করতে না পারলে বাড়িতে যে-কোনও সময় বিচ্ছিরি কাণ্ড করে বসবে মেয়েটা। বাবা এসব কি জানে? জানতেও চায় না। খারাপ কিছু হলে, তখন তো গোটা পরিবার ঝামেলায় পড়বে। বিশ্বনাথ বসু কিছু না জেনে, ভবিষ্যৎ আঁচ করতে না পেরে জেদ করছে। তবে এখন রাগ করলে চলবে না। শান্ত ভাবে বোঝাতে হবে। মাকে সেকথাই বলে এসেছে।

আজ সন্ধেবলো অনন্যা বাড়ি ঢুকেছে মন হালকা করে। একেই তো অফিসে চিঠির সমস্যা মিটেছে, তার উপর বাড়ি ঢোকার মুখে অপ্রত্যাশিত ঘটনা। দেবরূপের ফোন। ফোন কানে নিতেই দেবরূপের ছেলেমানুষের মতো উচ্ছল গলা!

“সরি, সরি, সরি। হান্ড্রেড টাইমস সরি, থাউজ়্যান্ড টাইমস সরি ডার্লিং?”

যার একটা ‘সরি’-র জন্য অপেক্ষা করে ছিল তার এত ‘সরি’ শুনে খুব অবাক হল অনন্যা। তা ছাড়া গলার স্বরেও ফুর্তির ভাব!

“এত সরির কী হল?”

দেবরূপ হইহই করে বলল, “সরি হবে না! তোমাকে না জানিয়ে, ইন ফ্যাক্ট কাউকে না জানিয়ে বেঙ্গালুরু চলে যেতে হয়েছিল। বসের অ্যাসাইনমেন্ট। সিক্রেট বলতে পার। দু’জন ছাড়া অফিসে কেউ জানত না। মোবাইল, ফেসবুক সব অফ। শুধু বসের সঙ্গে যোগাযোগের সময়ে খুলতাম। ভেবেছিলাম, তোমাকে ওখান থেকে ফোন করে সারপ্রাইজ় দেব। কিন্তু তারপর এমন বিচ্ছিরি চাপে পড়লাম…”

দেবরূপ এমন খুশি-খুশি ভাবে বলছে যেন এই ‘বিচ্ছিরি চাপ’-এর জন্য সে খুবই আনন্দিত। দেবরূপের গলায় বা আচরণে গেস্ট হাউজ়ের ঘটনা নিয়ে কোনও গ্লানি নেই। মনে হচ্ছে, এমন কোনও ঘটনা ঘটেনি। অনন্যা নিচু গলায় বলল, “অফিসের কাজে গিয়েছ, সেটাই তো আসল। এতে সরি বলার কী আছে?”

“বাঃ, সে কী কথা! তোমাকে জানাতে পারলাম না যে।”

অনন্যা সামান্য হেসে বলল, “অফিসের কাজে বেঙ্গালুরু যাওয়াটা জানানোর মতো কিছু নয় দেব। ইট্‌স ওকে। কাজের চাপে অমন হতেই পারে।”

দেবরূপ ফের উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, “গুড নিউজ় কী জানো অনন্যা? আই হ্যাভ ডান মাই অ্যাসাইনমেন্ট সাকসেসফুলি। পার্টিকে কনভিন্স করিয়ে প্রজেক্ট নিয়ে এসেছি। বস ভীষণ খুশি। এর অর্থ হল, প্রোমোশনের দিকে আমি আরও এক পা এগিয়ে গেলাম।”

অনন্যা চুপ করে রইল। মজা লাগছে। যে মজায় খানিকটা বিস্ময়, খানিকটা মন খারাপও আছে। এই ছেলে কী সহজে আবার নিজের কেরিয়ারের মধ্যে ঢুকে পড়েছে! ক’দিন আগে প্রেমিকাকে প্রায় ‘বেশ্যা’-ই বলেছিল। প্রায় কেন? বলেছিল তো বটেই। শব্দটা উচ্চারণ করতে যা বাকি ছিল।

অনন্যা বলল, “কনগ্র্যাচুলেশন্‌স দেব।”

“থ্যাঙ্ক ইউ ডার্লিং,” এরপরেই গলা নামিয়ে ফেলে দেবরূপ। প্রায় ফিসফিসিয়ে বলে, “এবার আসল কথা বলো তো। কবে দেখা হবে? বহুদিন তোমাকে আদর করিনি।”

বুকের ভিতর ধক করে লাগে অনন্যার। একটু চুপ করে থেকে বলে, “দেব, তোমার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে। ঘাবড়িয়ো না, বিয়ের কথা নয়। কবে সময় দেবে বলো।”

দেবরূপ বলল, “কাম অন অনন্যা। তুমি কি আমাদের ঝগড়া এখনও মনে রেখেছ? উফ্! সত্যি তোমাদের হাতে সময় আছে বটে। ফরগেট ইট। ওসব বাদ দাও তো।”

অনন্যা কঠিন কথা বলতে গিয়ে সামলে নেয়। বলে, “না, ঝগড়া-টগড়া নয়। অন্য জরুরি কথা। খুব তাড়াতাড়ি বলতে হবে।”

“এখনই বলো।”

অনন্যা বলে, “সামনে বসে বলব। কাল সময় হবে?”

দেবরূপ একটু ভেবে বলল, “না, কাল হবে না। ক’টাদিন বাদ রাখো অনন্যা। পরে সময় করো। আচ্ছা, শনিবার হলে কেমন হয়? তোমার ছুটি, আমিও সেকেন্ড হাফে বেরিয়ে আসব। কাল বিকেলে তোমাকে ফাইনাল জানাচ্ছি।”

অনন্যা হেসে বলে, “কী জানাবে? মিটিংয়ে আটকে গিয়েছি?”

“ঠাট্টা করছ?”

অনন্যা বলল, “ও মা, ঠাট্টা করব কেন? যা সত্যি তাই বললাম।”

দেবরূপ বলল, “না, সত্যি তুমি এখনও রেগে আছ। আচ্ছা, অনেক আদর করে তোমার রাগ ভাঙিয়ে দেব। হল তো? এখন ফোন রাখলাম।”

ফোন কেটে দেওয়ার মুহুূর্তে চুমু খাওয়ার আওয়াজ করে দেবরূপ। অনন্যার মন কিছুটা হালকা হল। হওয়ার কারণ, চিঠির ঝামেলা আর রইল না। এখন মনে হচ্ছে ছেলেমানুষির সঙ্গে কাজটা বেশি নাটকীয় হয়ে যাচ্ছিল। তার থেকেও বড় কথা, দেবরূপের সঙ্গে কথা বলা যাবে টেনশন ছাড়াই। তার আগে একটা জরুরি কাজ করা দরকার। তাকে মোটামুটি নিশ্চিত হতে হবে শরীরের ব্যাপারটা কী হয়েছে। মেনস্ট্রুয়েশনের কোনও সমস্যা? নাকি প্রেগন্যান্সি? সবার আগে সে দোপাটির সমস্যাটা মেটাতে চায়। হাত গুটিয়ে বসে থাকা যাবে না। বাড়ি ফিরে চা জলখাবার খেতে-খেতে মায়ের সঙ্গে কথা বলেছে।

“মা, দোপাটির বিষয়টা তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও।”

অঞ্জলি বললেন, “কী করবি?”

অনন্যা বলল, “আর যা-ই করি, মারধর করব না। এই মেয়ের মানসিক সমস্যা আছে। মেরে-ধরে মানুষকে খানিকটা সহবত শেখানো যায়, মানসিক সমস্যা দূর করা যায় না।”

অঞ্জলি বললেন, “ওসব তোদের বড়-বড় কথা। আগাপাছতলা পেটালে ঠিক হয়ে যাবে। শয়তানি দূর হয়ে যাবে।”

অনন্যা বলল, “আঃ মা, তুমিও অনেকটা নেমে গিয়ে রাগ দেখাচ্ছ।”

অঞ্জলি ফোঁস করে উঠে বললেন, “এই মেয়েকে নেমে গিয়েই শায়েস্তা করা দরকার। ও যেরকম সেরকম। একটার পর একটা কী কাণ্ড করছে দেখছিস না? ক্রিমিনাল না হলে কেউ এমন করতে পারে? কাজের লোককে লোভ দেখিয়ে চোর বানাচ্ছে, শান্ত ছেলেকে দিয়ে কাচের জার ভাঙাচ্ছে, স্কুলে নোংরামি করছে। কাল যা করেছে সেটা তো মারাত্মক। ছি ছি! এতবড় মেয়ে, আগকোর দিন হলে ছেলে-মেয়ের মা হয়ে যেত।”

অনন্যা বলল, “বলছি তো, তোমার সঙ্গে আমি অনেকটাই একমত হয়েছি, কিন্তু তোমার শাসন নিতে পারছি না। এত ভাবছ কেন? ও কি তোমার নিজের মেয়ে? নাকি তোমার কাছের কেউ? তাকে ভাল করার দায়িত্ব তোমাকে কে দিল?”

“তা হলে কী করতে বলছিস? মুখ বুজে দেখে যাব?”

অনন্যা গলা নামিয়ে খানিকটা অন্যমনস্কভাবে বলল, “কালকের ঘটনাটা শোনার পর থেকে অনকে ভেবে দেখেছি মা, এই মেয়েকে বাড়িতে রাখা ঠিক হবে না।”

অঞ্জলির চোখ-মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মেয়ে যে তার চেয়েও বেশি বুঝতে পেরেছে এটাই শান্তি।

“কী করবি? তাড়িয়ে দিবি?”

অনন্যা বলল, “না না, ছি ছি। বাবা একজনকে এনে বাড়িতে রেখেছেন, তাকে আমি তাড়িয়ে দেব! দেবই বা কী করে? যা করার আমাকে ঠান্ডা মাথায় করতে হবে।”

অঞ্জলি উৎসুক ভাবে বললেন, “কী করবি?”

অনন্যা শেষ চুমুক দিয়ে চায়ের কাপটা নামিয়ে বলল, “বাবাকে বলব। বুঝিয়ে বলব, যাতে মেয়েটাকে কোনও হস্টেলে দিয়ে আসে।”

অঞ্জলি ঝাঁঝের সঙ্গে বললেন, “সেরকমই তো কথা ছিল। তোর বাবা তো প্রথমে তাই বলেছিল। কিন্তু করল কই! আমি কতবার বলেছি। দু’- একবার হাঁ-হুঁ করেছে, তারপর বিরক্ত হয়েছে। মেয়েটা কতরকম বদ কাজ করে চলেছে তা-ও বলেছি। উনি তো কিছু শুনতেই চান না।”

অনন্যা বলল, “মা, তোমার বলার ধরন আর আমার ধরন এক হবে না। তুমি মাথা গরম করে নালিশ করো, আমি শান্ত ভাবে বুঝিয়ে বলব।”

অঞ্জলি মেয়ের এই প্রস্তাবে মোটে সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি উঠে পড়লেন। মাথা নেড়ে বললেন, “ওতে কিস্যু হবে না। তোর বাবাকে তোদের আগে থেকে আমি চিনি। নিজে যা বুঝবে তাই করবে।”

অনন্যা চিন্তিত মুখেই বলেছিল, “দেখা যাক। আমাদেরও তো বয়স হয়েছে।”

অঞ্জলি গজগজ করে বললেন, “আমাদের বলছিস কেন? তোর দাদাকে বাড়ির মধ্যে ধরবি না। ওই মেয়ে যদি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় তা হলেও ও বুঝতে পারবে না। দোপাটিকে সে চেনেই না।”

অনন্যা উঠে পড়ল। মা এই কথাটা ঠিকই বলেছে। দাদা ওই মেয়েকে ভাল করে চেনেই না। দোপাটি নিজেই একদিন তাকে বলেছিল। এক রবিবার সকালে অনন্যা জলখাবারের প্লেট দিয়ে বলেছিল, “যা দোপাটি, উপরে দাদাকে দিয়ে আয় দেখি।”

দোপাটি ঠোঁট বেঁকিয়ে বলেছিল, “দাও, দিয়ে আসছি। তবে উনি আমাকে ঘর থেকে বের করে দিতে পারেন।”

“এ কী কথা! দাদা তোকে ঘর থেকে বের করে দেবে কেন?”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *