হত্যাকাণ্ডের আগে ও পরে – ২

এক বিকেলে মায়ের বন্ধু নন্দিতামাসি সোদপুর থেকে বেড়াতে এসেছিলেন। সঙ্গে পাঁচবছরের নাতি। শান্তশিষ্ট ছেলে। সবাই খুব প্রশংসা করতে লাগল। করবে না কেন? সবাই যখন ঘরে বসে গল্প করছিল, ছেলে চুপচাপ বসে ছিল এককোণে। নন্দিতামাসি নাতিকে বললেন, “যাও বাবা, ছাদ থেকে ঘুরে এসো। বিকলেবলো ঘরে বসে কী করবে?” ছেলেটি প্রথমে রাজি হয়নি। তখন মা জোর করল। ছেলেটি ছাদে যায়। খানিকক্ষণ পরে ঝনঝন আওয়াজ। সবাই ছুটে গেল। দোতলার সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে গোল কাচের জারে ক’টা রঙিন মাছ ছিল। সেই জার ভেঙে সিঁড়িতে কাচের টুকরো আর জল ছড়িয়ে পড়েছে। মাছগুলো সিঁড়ির এক-একটা ধাপে ধড়ফড় করছে। নন্দিতামাসির নাতি সিঁড়ির একপাশে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছিল।

“কে ভাঙল?”

“আমি।”

নন্দিতামাসি আর্তনাদ করে উঠলেন, “সে কী, তুই! কী করে ভাঙলি?”

ছেলেটি বলে, “আমি ছুড়ে ফেলেছি।”

মা খুব অবাক হয়েছিলেন। এরকম একটা শান্ত ছেলে কাচের জার ছুড়ে ফেলল!

“কেন? জার ছুড়ে ফললি কেন?”

ছেলেটি আতঙ্কিত গলায় জানায়, মাছ কীভাবে সিঁড়ি দিয়ে নামে সেটা দেখার জন্যই নাকি সে এই ভয়ানক কাজটি করেছে। ঠাম্মার হাতে মার এবং সকলের কাছে বকুনি খেয়ে কাঁদতে-কাঁদতে সে বাড়ি চলে যায়। দোপাটি বাড়ি ছিল। নিজের ঘরে লেখাপড়া করছিল। বলে, “বাইরে থেকে যাদের শান্ত মনে হয়, তারা মোটেও শান্ত হয় না। নাও সরো। আমি কাচ পরিষ্কার করে দিচ্ছি। নইলে পায়ে ফুটে আর এক চিত্তির হবে।” গুনগুন করে গান করতে-করতে ঝাঁটা এনে কাজ শুরু করে। রাতে নন্দিতামাসি মাকে ফোন করেন। জানান, বাড়িতে ফিরে নাতি সব জানিয়েছে। তার নাতিকে কাচের জার ভাঙার পরামর্শ দিয়েছে দোপাটি। ওই ‘দিদি তাকে বলেছিল, রঙিন মাছগুলো সিঁড়িতে পড়ে গেল নাকি নিজেরাই উঠে আসে। জারটা সিঁড়িতে ফেলে ভাঙলেই এই মজার ঘটনাটা ঘটবে। তখন মাছগুলোকে অন্য একটা শিশিতে রাখা যাবে। শিশি নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই। এবাড়িতে অনকে খালি শিশি আছে।

মা দোপাটিকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে সে বলেছিল, “আমি তো জারটা ভাঙতে বলিনি। শুধু মাছগুলোকে ছেড়ে দিতে বলেছিলাম।”

মারাত্মক কাণ্ড করেছিল কাজের লাকে কনকচাঁপাকে নিয়ে। গরিব হলেও মহিলা ছিল ভাল এবং বিশ্বাসী। এই বাড়িকে নিজের বাড়ির মতো করে দেখত। সকলের প্রিয় ছিল। দোপাটি তাকে গোপনে তেল, নুন, সাবান দিতে শুরু করল। কনকচাঁপা প্রথম-প্রথম আপত্তি করত। দোপাটি তাকে বলত, “আহা! এ বাড়িতে তো অনকে আছে মাসি। তুমি একটু নিলে অসুবিধে কোথায়? চিন্তা কোরো না, আমি বলে রাখব। তুমি বরং ক’টা আলু নিয়ে যাও আজ। ব্যাগটা কই? দাও আমাকে, আমি ঢুকিয়ে দিচ্ছি।” দিন দশ-পনেরো এভাবে চলার পর কনকচাঁপা লোভে পড়ে যায়। সে নিজেই জিনিস নিতে শুরু করে। তখন দোপাটিই কমপ্লেন করে। একদিন স্কুল যাওয়ার সময় বলে যায়, “মাসির ব্যাগ সার্চ করলে এ বাড়ির চিনি, সাবানগুঁড়ো পাওয়া যাবে।”

“কী বলছিস তুই? তুই জানলি কী করে?”

দোপাটি বিনুনি সামনে থেকে পিছনে ছুড়ে দিয়ে বলেছিল, “অনকেদিন ধরে জানি। তোমাদের পেয়ারের বলে কিছু বলিনি। আমি কী জানি বাবা, তোমাদের বাড়ির লাকে, আমার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেবে হয়তো। অনেক যাচ্ছে, তাই এবার বললাম। যাই, স্কুলে যাই৷”

কনকচাঁপার ব্যাগ থেকে ‘জিনিস’ পাওয়া যায় এবং তার কাজ যায়। পরে সব জানিয়েছিল, কিন্তু তখন আর তাকে ফিরিয়ে নেওয়ার উপায় ছিল না।

মাসখানকে আগে স্কুল থেকে যে কমপ্লেনটা আসে সেটা মারাত্মক। কিন্তু সেই কমপ্লেন প্রমাণ করতে না পারায় দোপাটির বিরুদ্ধে স্কুল কোনও ব্যবস্থা নিতে পারেনি।

ক্লাসের সেকেন্ড গার্ল অনুলিপি শুধু লেখাপড়ায় ভাল নয়, সবদিক থেকেই ভাল। তার সুন্দর স্বভাবের জন্য তাকে সবাই পছন্দ করে। স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সে নাচ, গান, আবৃত্তি করে। সেখানেও প্রাইজ় পায়। এই নিয়ে মেয়েটির অহংকারও নেই। একদিন অঙ্কের মাধবীদি টিচার্সরুমে বসে মেয়েদের খাতা দেখছিলেন। অনুলিপির খাতার মধ্যে একটি খাম পান। খামের উপর অনুলিপির হাতের লেখায় তার নাম লেখা। একেবারে উপরে লেখা ‘পার্সোনাল’। মাধবীদি মনে-মনে হাসেন। গুডগার্ল আবার তাকে কী পাঠাল? মেয়েটা সত্যি লাজুক। দিদিমণি খাম খোলেন এবং আঁতকে ওঠেন। খামের ভিতর একটা ম্যাগাজ়িন কাটা বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনটি কন্ডোমের। অর্ধনগ্ন পুরুষ-নারী পরস্পরকে জড়িয়ে আছে। মাধবীদি হেডমিসট্রেসকে বিষয়টি জানান। অনুলিপিকে ডাকা হয়। খামের উপর হাতের লেখা তার, কিন্তু বাকিটা তার কিছুই জানা নেই। মেয়েটি তো কান্নাকাটি করে একশা। হেডমিসট্রেস তাকে ওয়ার্নিং দিয়ে ছেড়ে দেন। যতই হোক মেয়ে ভাল। একবার অন্যায় করে ফেলেছে। আর নিশ্চয়ই করবে না। স্কুলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। যারা অনুলিপিকে হিংসে করে তারা খুশি। দোপাটি সবচেয়ে গলা চড়িয়ে বলে, এমন হতেই পারে না। অনুলিপি এ কাজ করতেই পারে না। এমনকী সে মাধবীদিকে গিয়ে একথা বলেও এল।

“দিদি, অনুলিপি শুধু আমাদের ক্লাসের ভাল মেয়ে নয়, গোটা স্কুলের মধ্যে ভাল মেয়ে।”

সাতদিন পরে অনুলিপির আর একটা খাম পলেনে জিয়োগ্রাফি টিচার অর্চনা মাইতি। বইয়ের মধ্যে রাখা ছিল। এবার বিজ্ঞাপন নয়। ফুটপাথ থেকে কেনা পুরুষ মানুষের নগ্ন ফোটোগ্রাফ। পিছন ফিরে আছে।

স্কুলে তুলকালাম শুরু হল। অনুলিপির গার্জেন কল করা হল। মেয়ের বাবা-মা বলল, তারা মেয়েকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে। এই অসভ্যতা তাদের মেয়ে করতে পারে না। নিশ্চয়ই পিছনে কেউ আছে। হেডমিসট্রেস বলেছিলেন, তিনিও বিশ্বাস করেন এর মধ্যে কোনও গোলমাল রয়েছে। অনুলিপিকেই সবটা মাথা ঠান্ডা করে ভাবতে হবে। কাউকে সে সন্দেহ করে কিনা বলতে হবে তাকেই। তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করা হল। হাতে লেখা খামগুলো কোথা থেকে এল মনে করতে পারলে অনকেটা বোঝা যাবে। শেষ পর্যন্ত অনুলিপি খামগুলো চিনতে পারে। সেবছর টিচার্স ডে-তে সে দিদিমণিদের নিজের হাতে আঁকা কার্ড উপহার দিয়েছিল। সেই কার্ড ছিল খামের ভিতর। প্রত্যেকের আলাদা-আলাদা নাম লেখা। এবার ঘটনা স্পষ্ট হয়। সেই খাম কেউ জোগাড় করে রেখেছিল। রাখাটা অসম্ভব নয়। দিদিমণিরা প্রায় সকলেই এই ধরনের উপহার পেলে খাম থেকে কার্ড বের করে সবাইকে দেখান। খামটা হয়তো ক্লাসেই পড়ে থাকে। কিন্তু এতবড় অপরাধটা কে করল? এই ভয়ানক মাথা কার? কেনই বা সে এই কাজ করল? গোপনে খোঁজ শুরু করলেন হেডমিসট্রেস। অনুলিপির উপর ক্লাসের কার-কার রাগ আছে? সন্দেহের তালিকা ছোট হতে-হতে দোপাটিতে থেমেছিল। পরীক্ষায় অনুলিপি তার ঘাড়ের কাছে রেজাল্ট করে। যে-কোনওদিন ছুঁয়ে দেবে বা টপকে দেবে। দোপাটিকে জিজ্ঞেস করায় সে আকাশ থেকে পড়ল। প্রমাণের অভাবে তাকে কিছু করা গেল না।

গোটা ঘটনা অনন্যাকে বলেছিল স্কুলের কম্পিউটর টিচার। মেয়েটি অনন্যার ইউনিভার্সিটিতে দু’ক্লাস জুনিয়র ছিল।

“তুমি একবার বাড়িতে জিজ্ঞেস করবে তো।”

অনন্যা দোপাটিকে জিজ্ঞেস করেছিল। দোপাটি নির্লিপ্তভাবে বলেছিল, “পরীক্ষা একটা যুদ্ধ অনন্যাদি। কম্পিটিটরকে যে-কোনওভাবে ঘায়লে করাটাই কাজ। আর অত ভাল আমার সহ্য হয় না।”

অনন্যা অবাক হয়ে বলেছিল, “তা বলে এত বড় একটা অপরাধ করবি!”

দোপাটি হেসে বলল, “আমি তো কিছু করিনি। প্রমাণ আছে? ক্লাসে কত মেয়ে!”

বাড়িতে এই ঘটনা না জানালেও অনন্যা খুব চিন্তিত হয়েছিল। মেয়েটার মাথায় যে এত প্যাঁচ, প্রথম দিকে বোঝা যেত না। গোবেচারা ধরনের মুখ করে থাকত। যতদিন যাচ্ছে একটু-একটু করে স্পষ্ট হচ্ছে। অভিনয়েও ওস্তাদ। সামান্য চড়-চাপড়ে এমন ভান করে যেন খুব জোর পেটানো হয়েছে। একটু পরেই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। পরোটা দিয়ে টিফিন করতে- করতে বলবে, “একটু চাটনি দাও তো মামি। চাটনি নেই? ঠিক আছে, তা হলে একটু আচার দাও। টক-মিষ্টি ছাড়া পরোটা খাওয়া যায় না। ওই বাড়িতে আচার থাকত।” তখন কে বলবে এই মেয়ে খানিক আগেও ফোঁপাচ্ছিল? তবে সে অভিনয় হোক আর যা-ই হোক, মারধর ঠিক নয়। পরের মেয়েকে তো একেবারেই নয়। কিন্তু মাকে বলেও থামানো যাচ্ছে না। যতদিন যাচ্ছে, এই মেয়ের উপর মায়ের রাগ বাড়ছে। অনন্যারও বাড়ছে। সে-ও বুঝতে পারছে দোপাটি খুব দ্রুত এবাড়ির একটা সমস্যা হয়ে উঠেছে। তবে মারধর করে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে না। বরং সমস্যা জটিল হচ্ছে। মাকে সকেথা বলেছে। ক’দিন আগেও বলল। সেদিন দোপাটি মায়ের হাতে চড় খেয়ে ছাদে ওঠার সিঁড়িতে বসে ফোঁপাচ্ছিল। তিনতলার শেষে সিঁড়ির ঘুপচি এই জায়গাটা মেয়েটার পছন্দের। প্রায়ই বসে থাকে। অনকে সময় বই-টই এনে পড়ে। মোবাইল নিয়ে খুটুর-খুটুর করে। অফিস যাওয়ার আগে ছাদে কাপড় শুকোতে গিয়ে অনন্যার চোখে পড়ল।

“কী হয়েছে? কাঁদছিস কেন?”

দোপাটি হাত তুলে চোখের জল মুছতে-মুছতে বলল, “কিছু হয়নি।”

অনন্যা ভুরু কুঁচকে ধমক দিয়ে বলল, “কিছু তো হয়েছে। কী হয়েছে? পাড়া জানিয়ে কাঁদছিস কেন? ছাদের দরজা খোলা। পাশের বাড়িতে শুনতে পাচ্ছে না?”

দোপাটি গোঁ-ধরা গলায় বলল, “তুমি ছাদের দরজা বন্ধ করে দাও।”

অনন্যা বলল, “পাকামি করতে হবে না, কী হয়েছে?”

দোপাটি মুখ নামিয়ে বলল, “মামিকে কে কী বলে গিয়েছে, আর মামি আমাকে ধরে মার দিল,” কথা শেষ না করে আবার ফোঁপাতে শুরু করল মেয়েটা।

অনন্যা চাপা গলায় বলেছিল, “ঠিক হয়েছে। নিশ্চয়ই আবার কোনও অন্যায় করেছিস। তোর অন্যায়ের তো শেষ নেই। এবার চুপ কর। এমন ভাবে কাঁদছিস যে লোকে শুনলে ভাববে লাঠি দিয়ে পেটানো হয়েছে।”

বিরক্ত অনন্যা নীচে নেমে যায়। বাড়িটা বড় আর শক্তপোক্ত। তিনতলা জুড়ে ছড়ানো। নীচে বাবা-মায়ের বেডরুম, ড্রয়িংরুম, খাবার জায়গা, রান্নাঘরও নীচে। দোতলায় ভাই-বোন থাকে। অনন্যার ঘরটা বড়। কলেজ জীবনেই মালব্য বোনকে বড় ঘর ছেড়ে দিয়েছে। বড় ঘরে তার নাকি অসুবিধে হয়। বইপত্র হাতের কাছে থাকে না। সে মনে করে, ঘরের ইউটিলিটি আয়তনে মাপা যায় না, ঘর প্রয়োজন মেটাতে পারছে কিনা তার উপর ইউটিলিটি নির্ভর করে। তার হাতের কাছে বইপত্র চাই। বড় ঘর নিয়ে সে কী করবে? তিনতলায় ছাদের লাগোয়া একটা ছোট ঘর আছে। এক সময় বাড়ির ভাঁড়ার ছিল। পরে সেখানে খাট পেতে গেস্টরুম করা হল। পাশে ছোট মতো ঠাকুরঘরও আছে। অনন্যার ঠাকুরদা বাড়ি বানিয়ে গিয়েছেন। এখন শুধু রক্ষণাবেক্ষণ করে ঠিকঠাক রাখা। তা-ও বড় কোনও খরচ হয় না। খাঁটি মালমশলা দিয়ে বানানোর তো একটা সুবিধে আছে। গেস্টরুমে দোপাটির থাকার ব্যবস্থা। সেখানে একটা আলমারি আর পড়ার চেয়ার-টেবিল দেওয়া হয়েছে। যদিও মেয়েটা টেবিলে বসে পড়ে না, বেশিরভাগ সময়ই খাটে শুয়ে পড়ে। তাকে বারণ করা হয়েছে। সে শোনে না। বলে, “খাটে শুয়ে পড়লে কী হয়?”

“পড়া মাথায় ঢোকে না।”

“কে বলল?”

“সবাই জানে। আর এটা নিয়ে তর্ক করার তো কিছু নেই। তোমাকে টেবিল-চেয়ার দেওয়া হয়েছে, সেখানে বসে লেখাপড়া করবে।”

দোপাটি তর্ক থামায় না। বলে, “আমি তো ওই বাড়িতে শুয়ে পড়তাম।”

“এ-বাড়ি আর ও-বাড়ি এক নয়। এ বাড়ির নিয়ম আলাদা। এ বাড়িতে টেবিলে বসেই পড়তে হবে। তাতে ভাল হবে।”

“আচ্ছা তা-ই পড়ব। তবে আমি কিন্তু শুয়ে-শুয়ে লেখাপড়া করেও ক্লাসে ফার্স্ট হই অনন্যাদি। টেবিলে বসে পড়লে আমি ফার্স্টের থেকে বেশি কিছু হতে পারব?”

এই কথার পর মেয়েটাকে তারও একটা চড় মারা উচিত। মারা যায় না। কারণ, কথাটা সত্যি। হেলাফেলা করে পড়াশোনা করেও দোপাটি স্কুলের পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়। অঙ্কতে তো তুখোড়। কোনও-কোনও পরীক্ষায় একশোতে একশোও পায়। তারপরেও মেয়েটা নির্বিকার ভাবে একটার পর-একটা খারাপ কাজ করে যায়।

সেদিন ছাদ থেকে নেমে মাকে রান্নাঘরের বাইরে পেয়েছিল অনন্যা।

“মা, এসব বন্ধ করো।”

অঞ্জলি বলেন, “কীসব?”

অনন্যা বলে, “কী আবার? দোপাটিকে মারধর বন্ধ করো।”

অঞ্জলি অবাক হয়ে বলেন, “মারধর! কোথায় মারলাম? একটা চড় লাগিয়েছি শুধু।”

অনন্যা বিরক্ত গলায় বলে, “একটা চড় লাগানোরই বা দরকার কী? মেয়েটা বড় হয়েছে। একটা বয়সের পরে মেয়েদের গায়ে হাত তোলা ঠিক নয়।”

অঞ্জলি থমথমে মুখে বলেন, “কোনটা উচিত, আর কোনটা উচিত নয়, তোর কাছে শিখতে হবে? খারাপ কাজ করলে ছোট-বড় বিচার চলে না। খারাপ কাজটাকে বিচার করতে হয়।”

অনন্যা যুক্তি দিতে যায়। বলে, “কই আমার গায়ে তো কখনও হাত তোলোনি। দাদার গায়েও নয়। আমরা কি অন্যায় করতাম না?”

অঞ্জলি কঠিন গলায় বলেন, “কার সঙ্গে কার তুলনা করছ! তোমরা বকা-ঝকা, মারধরের ছেলেমেয়ে নও। তুমি তা-ও দুষ্টুমি করেছ, তোমার দাদা তো অতি শান্ত ছিল। বই মুখে বসে থাকত। আর এই মেয়ে হল বেঁধে মারবার মেয়ে। ওর ভিতরে ক্রিমিনাল আছে।”

অনন্যা বুঝতে পারছে মা খুব ভুল বলছে না। কিন্তু আপত্তি না করলে মাকে সামলানো যাবে না। সে বলে, “উফ্ মা, এভাবে বোলো না। শুনতে খারাপ লাগছে। জানি, দোপাটি গোলমাল করে। অপরাধও করেছে। তা বলে একেবারে ক্রিমিনাল! এটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? তুমি এসব ভাবছ আর তোমার প্রেশার বাড়াচ্ছ।”

অঞ্জলি এবার মেয়ের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলেন, “শুনবি, কেন আজ ওর গায়ে হাত তুলেছি? শুনবি?”

অনন্যা বলে, “দরকার নেই। আমি শুনে কী করব?”

অঞ্জলি রাগে গরগর করতে-করতে বলেন, “তা হলে চুপ করে থাক। আমাকে আমার মতো করে চলতে দে। শয়তান মেয়েকে কী করে শায়েস্তা করতে হয় জানি। ওকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া উচিত। সে উপায় তো নেই।”

অনন্যা বিরক্ত গলায় বলে, “বাড়িটা তো বস্তি হয়ে যাচ্ছে। আশেপাশের বাড়িতে শুনতে পাচ্ছে। তোমার বকুনি শুনছে, দোপাটির কান্না শুনছে।”

অঞ্জলি মুখ তুলে মেয়ের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন, তারপর ঝড়ের বেগে বলতে শুরু করেন, “বাড়িটাকে আমি বস্তিবাড়ি বানাইনি। বাড়িটাকে বস্তি বানিয়েছে তোমাদের বাবা। দোপাটিকে আমি এ-বাড়িতে আনিনি, সে এনে তুলেছে। শুধু তোলেনি, তাকে খাতির-যত্ন করে রাখার ব্যবস্থা করেছে। আমি আপত্তি করেছিলাম। তোমরা তো সেদিন কিছু বলোনি। উলটে বাবাকেই সাপোর্ট করেছিলে। তোমার দাদা কখনওই বাড়ির বিষয়ে কথা বলে না। সে নিজেকে নিয়ে থাকে। বাড়িতে যে থাকে তা-ই মনে হয় না। মনে হয় হোটেলে এসে উঠেছে। তার তো বারণ করা উচিত ছিল। বাড়ির বড় ছেলে সে। হাবিজাবি ছেলে নয়, কলেজে পড়ানো মাস্টার। তোমার বাবার কাছে তার কথার একটা দাম আছে। হুট বলতে অত বড় একটা মেয়েকে বাড়িতে এনে তুললে সে বারণ করবে না? সে-ও তো দেখলাম ঠারেঠোরে বাবাকে সাপোর্ট করল। তোমার দাদা সংসারের অন্য কোনও কাজে নেই, কোনও ব্যাপারে টু শব্দটি করবে না, কিন্তু বাবার কথায় ঘাড় কাত করতে খুব শিখেছে। ওই মেয়ের সঙ্গে এই বাড়ির কী সম্পর্ক? বলো, কী সম্পর্ক? কোনও সম্পর্কই নেই। তোমার বাবার খুড়তুতো বোনের মেয়ে। যে কাকার সঙ্গে তোমার ঠাকুরদার বনিবনা ছিল না। বাড়িঘর, সম্পত্তি নিয়ে কম ঝামেলা করেনি। কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছিল।”

অনন্যা বলে, “উফ্! মা, একটা বাচ্চা মেয়ের জন্য তুমি একেবারে ফ্যামিলি হিস্ট্রি খুলে বসলে দেখছি?”

অঞ্জলি মেয়ের কথায় পাত্তা না দিয়ে বললেন, “এই বাড়ি নিয়ে যে লোক কম ঝামেলা করেনি তার মেয়ের সঙ্গে এই পরিবারের কী যোগাযোগ? আমি তোমার সেই বাবার বোনকে ক’বার দেখেছি? বিয়ের সময় দেখেছিলাম, ব্যস। তোমরা তাকে ক’বার দেখেছ? মাকে দেখোনি, তার আবার মেয়ে! সেই মেয়েকে বাড়িতে এনে তোলার জন্য বাবাকে একেবারে সাপোর্ট করে বসেছিলে কোন আক্কেলে!”

মায়ের রাগের কারণ বুঝতে পারে অনন্যা। রাগ হওয়াই উচিত। আরও অনকে বেশি রাগ হওয়া উচিত। অন্য যে-কোনও বাড়িতে হলে তা-ই হত। আয়োজন করে শুরু করলেও একটা পর্যায়ের পর মা বাবার উপর রাগারাগি নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে না। চুপ করে যায়। বাবার যে ভীষণ কিছু ব্যক্তিত্ব, একেবারে বাড়িসুদ্ধ সবাই থরহরি কম্পমান, এমন নয়। মানুষটা যে খুব চেঁচামেচি করেন, তা-ও নয়। বরং কোনও-কোনও সময় চুপ করেই থাকেন। তারপরেও মা বেশি দূর এগোয় না। কিছু একটা কারণ আছে নিশ্চয়ই। এই স্বভাবটা ছেলেমেয়ের মধ্যেও পড়েছে। তারা বাবার সঙ্গে তর্কে খুব একটা যায় না। তবে বাবার প্রতি দাদার দুর্বলতা বেশি। এই বিষয়ে মায়ের খোঁচাটাও ঠিক। বাবাও তার ছেলেকে বেশি পছন্দ করে। ছেলে লেখাপড়া নিয়ে থাকে বলে চাপা গর্ব রয়েছে। লেখাপড়ায় রেজ়াল্ট সবসময় ভাল হলেও অনন্যা ওইদিকে বেশিদূর এগোয়নি। ইউনিভার্সিটি শেষ করে সরে এসেছে। ভাল রেজাল্ট আর লেখাপড়া নিয়ে চিরকাল থাকা এক ব্যাপার নয়। এটা একটা বিশেষ ধরনের টান। দুঃখের বিষয় আজকাল অনেকেই এই টান ছাড়াই লেখাপড়ার জগতে ঢুকে বসে আছে। দাদার লেখাপড়ার দিকেই মন। যদিও কখনওই সে মারাত্মক রেজ়াল্ট করেনি। এমনকী গ্র্যাজুয়েশনে অনন্যার রেজ়াল্ট একটু হলেও বেশি ভাল। তারপরেও অনন্যা জানে দাদা-ই লেখাপড়ার জগতের মানুষ।

অনন্যা নিচু গলায় বলল, “বাবাকে আমি সেদিন সাপোর্ট করিনি। কিন্তু কী বলব? বাবা নিজের বাড়িতে কাকে এনে রাখবে, আমি বলার কে? শুনবেই বা কেন? তা ছাড়া, বাবা তো সেদিন আমার মতামত চায়নি।”

কথাটা সত্যি। বিশ্বনাথ বসু সেদিন কারও মতামত চাননি। দোপাটিকে এবাড়িতে নিয়ে আসার আগে, একদিন রাতে খেতে বসে শান্ত ভঙ্গিতে শুধু সিদ্ধান্তটুকু জানিয়েছিলেন।

“পর্ণার মেয়েটাকে এখানে এনে রাখব ঠিক করেছি। ক’টাদিন সে এখানেই থাকবে। তারপর একটা হস্টলে-টস্টেলে দিয়ে আসব ’খন।”

অঞ্জলি খাওয়া থামিয়ে স্বামীর মুখের দিকে তাকান। ভুরু কুঁচকে বলেন, “পর্ণার মেয়ে মানে? ওই যে দোপাটি নামের মেয়েটা? তাকে এবাড়িতে এনে রাখবে?”

বাবা খেতে-খেতেই গম্ভীর গলায় বলেন, “হ্যাঁ, সেরকমই ঠিক করেছি।”

অঞ্জলি এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, “হঠাৎ এই সিদ্ধান্তের কারণ জানতে পারি? তার বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে তো দোপাটি তার মায়ের কাছেই আছে। কই, তখন তো তাকে এখানে রাখার কথা ওঠেনি! নিশ্চয়ই ভাল আছে। আজ হঠাৎ তুমি এরকম অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিচ্ছ কেন?”

বিশ্বনাথ রাতে ভাত খান। যদিও ডাক্তার বারণ করেছে। বয়স বাড়ছে। সুগারের ঝোঁক আছে। ডাক্তার বলেছে, দু’বেলা ভাত না খেলেই ভাল। সেই পরামর্শ অনুযায়ী রুটি শুরু করলেন। দু-চারদিন পরে বন্ধ করে দিয়েছেন। দীর্ঘদিনের অভ্যেস। ভাত ছাড়া রাতে ঘুম হয় না। অত শরীর নিয়ে ভাবলে বেঁচে থেকে লাভ কী? থমকে গেলন বিশ্বনাথবাবু। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “না, ভাল নেই। তোমাকে আমি বলেছিলাম অঞ্জলি, তুমি সম্ভবত ভুলে গিয়েছ। পর্ণা আবার বিয়ে করতে চলেছে। সেই লোক পর্ণার মেয়েকে নিজের কাছে রাখতে রাজি নয়। ওদের বাড়ি কনজ়ারভেটিভ। বিধবা-বিয়ে মেনেছে, কিন্তু মেয়ে নিয়ে বাড়িতে ওঠা মানতে রাজি নয়। ওরা বিয়ে করে জয়পুরে চলে যাচ্ছে। ছেলে ওখানকার। তা ছাড়া… তা ছাড়া দুটো বছর পরেই মেয়েটার হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা। এই সময় স্কুল বদল করা ঠিক হবে না।”

অঞ্জলি অবাক হয়ে বললেন, “পর্ণা বিয়ে করছে! তাই নাকি?” তারপর ঠোঁট বেঁকিয়ে বললেন, “বাঃ, তোমার এই খুড়তুতো বোনটি তো বেশ গুণবতী দেখছি! বিতান মারা গিয়েছে কতদিন হল? বছরও তো ঘোরেনি। নাকি সবে একবছর হয়েছে? এর মধ্যেই আবার বিয়ে!”

অনন্যা মাথা নামিয়ে খাচ্ছিল। এবার মুখ তুলে বলল, “আহ্, মা! কে কবে বিয়ে করবে সে ঠিক করবে। তোমার কী সমস্যা হচ্ছে?”

অঞ্জলি গলায় ঝাঁঝ নিয়ে বললেন, “অবশ্যই হচ্ছে। কেউ যদি বর মরে যেতেই টক করে আবার বিয়ে করে আর তার ধেড়ে মেয়েকে আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয় তা হলে সমস্যা হবে না?”

বিশ্বনাথবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন, “কেউ ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়নি। আমি নিজে দোপাটিকে এখানে রাখার কথা বলেছি।”

এইটুকু বলে একটু চুপ করলেন বিশ্বনাথ। আবার বলতে শুরু করলেন, “পর্ণা খানিকটা অসহায় অবস্থায় পড়েছে। সময় কম। এর মধ্যে স্কুল, হস্টেল দেখে মেয়েকে ভর্তি করানো কঠিন। মেয়েটা লেখাপড়ায় ভাল।”

অঞ্জলি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, “তা হলে তো চমৎকার! ভাল মেয়ের ব্যবস্থা না করে, আগেই নিজের বিয়ের নহবতখানা বসিয়ে ফেলেছে! এই মেয়েটাকে কোনওদিনই আমি পছন্দ করি না। বাবা একরকম গোলেমলে ছিল, মেয়ে আর একরকম। পরিবারটির দেখছি গুণের ঘাট নেই।”

মালব্য অন্যমনস্ক ভাবে খাচ্ছিল। সে সবসময়ই অন্যমনস্ক থাকে। সবার মধ্যে থাকলেও সে কারও কথা খুব একটা শুনতে পায় না। আসলে শুনতে চায়ও না। চৌত্রিশ বছর বয়সেও সাংসারিক বিষয়ে তার কোনও আগ্রহ নেই। তার আগ্রহ লেখাপড়ায়। সাহিত্য, শিল্প, দর্শন, বিজ্ঞান নিয়ে আলাপ আলোচনা হলে সে উৎসাহ পায়। কলেজে যখন সময় পায় বই খুলে বসে। স্টাফরুমে তাকে নিয়ে অন্য অধ্যাপকরা হাসিঠাট্টা করে। নানারকম মন্তব্য হয়।

“এত পোড়ো না মালব্য। আগের লেখাপড়া সব ভুলে যাবে।”

“দেখবেন ক্লাসে গিয়ে আবার বই খুলে বসবেন না। মনে রাখবেন, অধ্যাপকের চাকরি কিন্তু নিজে পড়ার জন্য নয়, স্টুডেন্টদের পড়ানোর জন্য।”

“একেই বলে প্রপার ইন্টলেকেচুয়াল। বই ছাড়া অন্য কোনও বাই নেই। একমাত্র বউ এসে যদি বই ছাড়াতে পারে। ভাই, তুমি একটা বিয়ে করে ফলো দেখি। বই অসুখ সেরে যাবে।”

“বই থেকে মুক্ত হতে বৎস, বউকে গ্রহণ করো।”

স্টাফরুমে সবাই হেসে ওঠে। মালব্য গায়ে মাখে না। সে কলেজে কাজ শুরু করার পর থেকে লক্ষ করছে, তাদের স্টাফরুমে লেখাপড়া ছাড়া প্রায় সব বিষয়ে আলোচনা হয়। মাস্টারমশাই, দিদিমণিদের সবচেয়ে বেশি আগ্রহ বেতন বৃদ্ধি এবং নানা ধরনের বকেয়া কবে পাওয়া যাবে সেই প্রসঙ্গে। তারপর উৎসাহ রাজনীতিতে। কলেজের ভিতরের রাজনীতি এবং বাইরের রাজনীতি। কলেজের বাইরে কোন নেতা-মন্ত্রী কী করল আর কলেজের ভিতরে কোন অধ্যাপক, প্রিন্সিপাল, গভর্নিং বডির মেম্বার কী করল তাই নিয়ে সবাই ভীষণ চিন্তিত। এসব ব্যাপারেও মালব্যর কৌতূহল নেই। ক্লাস না থাকলে লাইব্রেরিতে চলে যায়। কলেজে যখন শিক্ষকরা সমস্যা, দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন করে, প্রিন্সিপালের কাছে যায়, এমনকী পথে নেমে মিছিল-টিছিলও করে, মালব্য গোড়ায় একটু থেকে টুক করে পালায়। হয়তো কোথাও একটা সেমিনার শুনতে চলে গেল বা নন্দনে সিনেমা দেখতে। বাড়িতেও তাই। সুযোগ পলে হাতে বই, নয়তো ল্যাপটপেই-বুক। এই নিয়ে অল্প বয়সে বকাবকিও শুনতে হয়েছে। দোকান- বাজার আনতে গিয়ে ভুল হয়েছে। মা কিছু বললে মনে রাখতে পারেনি। মা রেগে গিয়ে বলত, “পরীক্ষায় তো এমন কিছু রেজ়াল্ট করো না, সারাদিন মুখে বই নিয়ে কী হয়? ক্লাসে তো ফাস্টও হতে পারো না।” ছেলের উপর মায়ের চিরকালই হালকা রাগ। রাগ নয়, অভিমান। কে জানে ছেলের প্রতি বাবার একটু বেশি দুর্বলতার জন্যই এই অভিমান কিনা। অঞ্জলি মুখে কিছু বলেন না, তারপরেও অনন্যা মায়ের অভিমান বুঝতে পারে। তবে রেজ়াল্টের কথা তো ভুল না। শুধু স্কুলে নয়, কলেজ, ইউনিভার্সিটিতেও চমকে দেওয়ার মতো মার্কশিট দাদার হাতে আসেনি। এদেশে ভাল-মন্দ বিচার হয় পরীক্ষার মার্কশিটেই। কলেজে মাস্টার হওয়ার পরীক্ষা পাশ করে গেলও মালব্যের এটা একটা দুঃখ। তাকে কখনওই ‘খুব ভাল ছাত্র’ হিসেবে ধরা হয় না। সম্ভবত সেই কারণেই সে খানিকটা চুপচাপ।

সেদিন অবশ্য কথা বলেছিল। প্লেটের দিকে তাকিয়েই শান্ত ভাবে বলল, “ক’টা দিনের জন্য তো থাকবে। থাকুক না, ক্ষতি কী? বাবা নিশ্চয়ই ভেবেচিন্তে ডিসিশন নিয়েছে।”

অঞ্জলি এরপর আর কথা বাড়াননি। বুঝেছিলেন, কথা বাড়িয়ে লাভ হবে না। ছেলেমেয়েদেরই যখন আপত্তি নেই, তিনি একা বারণ করার কে? বাড়ি তো তাঁর নয়।

কথা ছিল, দোপাটি নামের মেয়েটি আসবে দু’দিন পরে। এসেছিল দশদিন পরে। হাতে একটা ঢাউস সুটকেস। পিঠে ব্যাগ। বয়সের তুলনায় বড়সড় চেহারার সেই কিশোরীকে দেখে অঞ্জলি ভুরু কোঁচকালেন। এই বয়সের একটা মেয়েকে দুম করে বাড়িতে রাখা আজকালকার দিনে চিন্তার বিষয়। সময়টা ভাল না। সর্বক্ষণ পাহারা দিতে হবে। কে দেবে? অনন্যার এই বয়স গিয়েছে। কিন্তু সে নিজের মেয়ে। তার শরীর-মন দুটোর খবরই তিনি জানতেন। অচেনা এই মেয়েটির সম্পর্কে তিনি তো কিছুই জানেন না। শুধু জানেন, দাদু ছিল মামলাবাজ আর মা প্রথম বর মরার পর আবার বিয়ে করে পালিয়েছে। এই মেয়ে কত ভাল হতে পারে? তবে অঞ্জলির ভুরু কোঁচকানো বেশিক্ষণ থাকে না। দোপাটি সুটকেস রেখে তাকে প্রণাম করল এবং ঝরঝর করে কেঁদে ফলল। অঞ্জলি নিজেকে সামলাতে পারেননি। দোপাটিকে জড়িয়ে ধরেন। তাঁর চোখেও জল এল। আহা রে! মেয়েটার তো কোনও দোষ নেই। মন নরম হয়ে গেল অঞ্জলির।

“কাঁদছ কেন মা? কেঁদো না। এই বাড়িকে নিজের বাড়ি মনে করবে। এখানে তোমার দিদি, দাদা আছে। চিন্তা কী? তা ছাড়া কয়কে মাস অন্তর-অন্তর মা তো কলকাতায় আসবে। তখন দেখা হবে। এখান থেকেই স্কুলে যাবে। তোমার স্কুলে এই পাড়ারও দু-একজন পড়ে। মন দিয়ে লেখাপড়া করবে। সব ঠিক হয়ে যাবে। যাও, উপরে যাও। তিনতলায় তোমার ঘর ঠিক করা আছে। পোশাক বদলে নীচে খেতে এসো। যাও মা, কাঁদে না।”

সেদিন অঞ্জলি নিজের হাতে দোপাটির চোখের জল মুছিয়ে দিয়েছিলেন। আর আজ নিজের হাতেই ওই মেয়েকে মেরে চোখে জল আনছেন। পরিস্থিতি এতটাই বদলেছে। পরিস্থিতি যে বদলেছে অনন্যা জানে। তারপরেও সে মায়ের কাছে গিয়ে আপত্তি করছে। অঞ্জলি সেই আপত্তি মানছেন না। মেয়েকেও রাগ দেখাচ্ছেন।

অনন্যা নিচু গলায় বলে, “উফ্ মা, আস্তে। দোপাটি শুনতে পাবে। তোমার নিজেকে শান্ত রাখা উচিত। খাতির না করো, বকা-ঝকা মারধর করে বাড়ির পরিবেশ অন্তত নষ্ট কোরো না। অন্যরা শুনলে ভাববে, আমরা বোধহয় দোপাটির উপর অত্যাচার করছি।”

অঞ্জলি বললেন, “তার আর বাকি কী আছে? ওই অসভ্য মেয়ে কাজলকে কী বলেছে, জানিস?”

অনন্যা অবাক গলায় বলল, “কাজল! সে আবার কে?”

রাগে অঞ্জলির চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল। বললেন, “ওই মোড়ের ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকে। দোপাটির স্কুলেই পড়ে মেয়েটা। এক ক্লাস নীচে। স্কুল বাসে একসঙ্গে যাতায়াত করে। দোপাটি ওই মেয়েটাকে বলেছে, আমরা নাকি তাকে একবলো খেতে দিই। যদি সকালে খাবার বাঁচে তা হলে রাতে খেতে পায়। কাজল বাড়িতে গিয়ে একথা বলেছে।”

অনন্যা থমথমে গলায় বলল, “তুমি জানলে কী করে?”

অঞ্জলি বললেন, “এসব কথা ছড়াতে দেরি হয়? আমাদের বিন্তির মা সকালে বাসন মাজতে এসে বলে গেল। ও শুনেছে। এই মেয়ে সব পারে।”

অনন্যার বিশ্রী লাগল। এটা নিয়ে কথা বলতেও খারাপ লাগে। বলল, “বানিয়ে বলছে না তো?”

“খামোখা কেন বানিয়ে বলবে? এই মেয়ে কনকচাঁপাকে চোর বানিয়েছিল, মনে নেই? এরপরেও চুপ করে, হাত গুটিয়ে থাকব? নাকি আমাদের নামে যা খুশি বলে বেড়াচ্ছে বলে তোর বাবার পেয়ারের ভাগনিকে নিয়ে মাথায় তুলে নাচব?”

অনন্যা সেদিন বলেছিল, “এবার চুপ করো। আর শুনতেও ভাল লাগছে না।”

অঞ্জলি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, “কেন ভাল লাগছে না? সত্যিটা শুনতে খারাপ লাগেল চলবে কেন? শয়তান না হলে এমন মিথ্যে কথা কেউ বলে? এরপরও তার গায়ে হাত তুলব না? তুই হলে কী করতিস? ইস, বাইরে আমাদের কত ছোট করল বল তো।”

অনন্যা চুপ করে চলে গিয়েছিল। সত্যি, মায়ের দোষ কী? এই কথা শুনলে মাথা ঠিক রাখা কঠিন। সেদিন অফিস থেকে ফিরে দোপাটিকে ডেকে কথা বলেছিল অনন্যা। বলে অবাক হয়েছিল। মেয়েটা কি পাগল? নাকি মা যা বলে সেটাই ঠিক? ডেঞ্জারাস!

অনন্যা কথা শুরু করেছিল শান্ত ভাবে। নিজের খাটে, পাশে বসিয়ে। পিঠে হাতও রেখেছিল। দোপাটির ভঙ্গিও ছিল সহজ।

“তুই তোর বন্ধুকে এসব কথা কেন বলেছিস?”

দোপাটি ঝোলানো পা দোলাতে-দোলাতে বলল, “কোন বন্ধুকে?”

অনন্যা বলল, “কাজল না কী নাম যেন, তোর সঙ্গে স্কুলে যায়।”

দোপাটি বুকের উপর পড়ে থাকা চুল আঙুল দিয়ে আঁচড়াতে-আঁচড়াতে বলল, “আমাকে ক’টা ক্লাচার দিয়ো তো। চুলগুলো খুব ঝামলো করে। আমার ক্লাচার আর ব্যান্ডগুলো পুরনো হয়ে গিয়েছে।”

দোপাটির চেহারা যেমন একটু বড়সড়, মুখটাও গোলগাল। চোখদুটোও বড়। গোল চোখে একধরনের সারল্য থাকে। গায়ের রং ফর্সা। হাসলে ভিতরের দিকে একটা গজ দাঁত অল্প দেখা যায়। ফ্রক পরে মাথায় দুটো বিনুনি বাঁধলে পুতুল-পুতুল লাগে। তবে আজকাল মেয়েরা তো ফ্রক-ট্রক বিশেষ পরে না, নানা রকম ড্রেস আছে। দোপাটিও সেদিন পাতলুন আর শার্ট পরে ছিল। কপালে একটা ছোট্ট কালো টিপ। সুন্দর লাগছিল। অনন্যা অবাক হচ্ছিল, এমন পরিপাটি একটা মেয়ে, কেন এমন করে!

“আচ্ছা সব দেব। এখন আমার কথার জবাব দে। আমাদের নামে এমন করে বলাটা কি তোর ঠিক হয়েছে? তুই তো ছোট খুকি নোস। বড় হয়েছিস। সবাই কী ভাবল বল তো! ভাবল, সত্যি বুঝি আমরা তোকে খেতে দিই না। এই বাড়ির প্রেস্টিজ থাকল?”

দোপাটি মুখ টিপে হাসল। অনন্যার হালকা রাগ হল। আচ্ছা নির্লজ্জ তো! হাসছে!

“হাসছিস কেন? এতে হাসির কী হল? বল, কেন বলেছিস।”

দোপাটি আবার একটু হেসে বলল, “বাইরে থেকে আসা একটা মেয়ে কী বাজে কথা বলেছে তার জন্য বাড়ির প্রেস্টিজ চলে যাবে কেন? আমার কথা বিশ্বাস না করলেই হয়।”

অনন্যা থমকে গেল। পাকামির মতো শোনালেও মেয়েটা একেবারে মিথ্যে বলেনি। সত্যি তো৷ পাড়ার লোক এই সব কথা বিশ্বাস করবে কেন! বিশ্বাস কি এতই ঠুনকো? মেয়েটার যুক্তি শুনে ভাল লাগছে। মেয়েটার বুদ্ধি আছে। এই বয়সে এতটা বুদ্ধি আশা করা যায় না। এরপরই একটা ভুল কথা ভেবে বসেছিল অনন্যা। ভালভাবে বোঝালে মেয়েটা নিশ্চয়ই বুঝবে, এসব করা উচিত নয়। শাসনটাও করতে হবে ভালবেসে। মারধর করে নয়।

“পাকামি না করে সত্যি কথাটা বল দোপাটি।”

দোপাটি বলল, “এমনই বলেছি। মজা দেখতে। মামির কেমন রাগ হয় সেইটা দেখতে।”

কথা শেষ করে অনন্যার হাত সরিয়ে খাট থেকে নেমে পড়ল দোপাটি। অনন্যা নরম গলায় বলল, “ছিঃ, যারা তোকে এত যত্ন করে রেখেছে তাদের সঙ্গে এই বিচ্ছিরি মজাটা করা কি তোর উচিত হল?”

দোপাটি বলল, “একেবারেই হয়নি।”

অনন্যা খুশি হল। মেয়েটা নিজের ভুল বুঝেছে। তার পদ্ধতি ঠিক আছে। বলল, “তা হলে তোমার এখন কী করা উচিত?”

দোপাটি ফট করে দু’হাত দিয়ে কান ধরল। হাসি-হাসি মুখে বলল, “আমি দশবার ওঠবোস করলে হবে অনন্যাদি? নাকি আরও বেশি করব?”

কথা শেষ করেই ওঠবোস শুরু করল মেয়েটা। অনন্যা তাড়াতাড়ি হাত ধরে বলল, “না-না, ওসব করতে হবে না। আমি কি বলেছি? তুমি মামির কাছে ক্ষমা চাইবে। বলবে, আমার ভুল হয়ে গিয়েছে, আর কখনও এসব বলব না। ঠিক আছে?”

দোপাটি কান ছেড়ে বলল, “অবশ্যই বলব। এখন যাব?”

অনন্যা বলল, “যাও, এখনই বলে এসো।”

দোপাটি ঘাড় কাত করে ঘরের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গেল। তারপর মুখ ঘুরিয়ে গজ দাঁত দেখিয়ে হাসল। বলল, “বিশ্রী জিনিস নিয়ে মজা করতে আমার ভাল লাগে অনন্যাদি। মামিমার কাছে ক্ষমা চাইলেও এরকম মজা আমি আরও করব। এখন যাই? কাল স্কুলে বায়োসায়েন্স পরীক্ষা। খুব কঠিন সাবজেক্ট, একদম মুখস্থ হতে চায় না।”

সেদিন স্তম্ভিত হয়ে বসেছিল অনন্যা। দোপাটি সম্পর্কে তার এতক্ষণের ধারণাটাই এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। বুঝতে পেরেছিল, এই মেয়েকে কন্ট্রোল করার ক্ষমতা তার নেই।

আজও নিশ্চয়ই সেরকম কোনও সমস্যা হয়েছে। অনন্যা মাথার উপর থেকে বালিশ সরিয়ে খাটে উঠে বসল। মাথাটার ভারটাও একটু কমেছে। স্নান করতে হবে। এককাপ চা খেলে অনকেটা ঠিক হবে। অনন্যা খাট থেকে নামার পরপরই দরজা ঠেলে অঞ্জলি ঘরে ঢুকলেন। পুরো ঢুকলেন না। দরজার সামনে দাঁড়ালেন।

“কী হয়েছে মা?”

অঞ্জলি থমথমে গলায় বললেন, “মাথা যন্ত্রণা কমেছে?”

অনন্যা বলল, “কমেছে। স্নান করব। তুমি চা করবে?”

অঞ্জলি এক পা ঘরে ঢুকলেন। বললেন, “একটা জরুরি কথা ছিল।”

মায়ের গলার স্বর শুনে এবার অনন্যার চিন্তা হল। শুধু থমথমে নয়, গলায় আতঙ্ক। সে বলল, “কী হয়েছে?”

“দোপাটি একটা মারাত্মক কাজ করেছে।”

ভাল লাগছে না। কিছু ভাল লাগছে না।

শুধু ভাল লাগছে না এমন নয়, ভিতরে একধরনের অস্থিরতা বোধ করছে অনন্যা। সেই সঙ্গে টেনশন। চট করে টেনশন করার মেয়ে অনন্যা নয়। বরং উলটো। সমস্যা কিছু হলে মাথা ঠান্ডা রাখতে পারে। ভাবনাচিন্তা করে সমস্যার সমাধান বের করার চেষ্টা করে। সবসময় যে সমাধান বের হয় এমন নয়। কিন্তু তাতে ভেঙে পড়ে না। অনন্যা জানে, জীবনে কিছু সমস্যা নিয়েই চলতে হয়।

আজ অন্যরকম হচ্ছে। দুশ্চিন্তার সঙ্গে নার্ভাস লাগছে। এই মুহূর্তে যে ঘটনাগুলোর মধ্যে দিয়ে সে চলেছে, সেগুলো একই সঙ্গে জটিল এবং বিশ্রী। এই সমস্যাগুলো নিয়ে চলা খুব কঠিন। আবার সামনে চটজলদি কোনও সমাধানও দেখতে পাচ্ছে না।

শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। কাল রাতে ঠিকমতো ঘুম হয়নি। তার উপর আজ খুব সকালে ঘুম ভেঙে গলে। ঘুম খুব অভিমানী একটা জিনিস। কোনও কারণে একবার রেগে গেলে বা বিরক্ত হলে সে পালায়। হাজার চেষ্টাতেও ডেকে আনা যায় না। অনন্যা বিছানায় উঠে বসল। তিনতলা থেকে চাপা গলায় পড়ার আওয়াজ আসছে। দোপাটি পড়ছে। মেয়েটা কোনও-কোনওদিন আবার নিচু গলায় গান করে। শুধু সকালে নয়, সন্ধেতেও দোপাটিকে ছাদে ঘুরে গান গাইতে দেখেছে অনন্যা। খানিকটা আপনমনে, খানিকটা অন্যমনস্ক। অনন্যা যে ছাদে এসেছে বুঝতেও পারেনি। এই বয়সের ছেলে-মেয়েদের মুখে চালু সিনেমার গান বেশি শোনা যায়। এই মেয়ের গান বাছাই অন্যরকম। বয়স্কদের মতো। সেদিন গাইছিল, ‘একা মোর গানের তরী ভাসিয়েছিলাম নয়ন জলে।’ কিছু শব্দ শোনা যাচ্ছিল, কিছু ছিল অস্ফুটে। আলো ও অন্ধকার মাখা ছাদে সেই স্পষ্ট অস্পষ্ট গান কেমন যেন মন খারাপ করা। অনন্যা থমকে দাঁড়ায়। কী মিষ্টি গলা! মেয়েটার এই গুণের কথা তো জানা ছিল না! সেদিন অনন্যাকে দেখে চুপ করে গিয়েছিল দোপাটি। পায়চারি বন্ধ করেছিল।

“থামলি কেন? গা না। খুব সুন্দর গাইছিলি।”

হালকা বিরক্ত গলায় দোপাটি বলল, “আমার নীচে কাজ আছে।”

হঠাৎ কী হল! অনন্যাকে খানিকটা থতমত খাইয়ে পাশ কাটিয়ে মেয়েটা নীচে নেমে গেল।

সেইদিনই রাতে মাকে বলেছিল অনন্যা। অঞ্জলি বললেন, “মায়ের গুণটা পেয়েছে। পর্ণার গানের গলা খুব সুন্দর ছিল।”

অনন্যা উৎসাহ নিয়ে বলেছিল, “তাই নাকি! তুমি কোথা থেকে শুনলে?”

অঞ্জলি বললেন, “পর্ণা আমার বিয়ের বাসরে গান গেয়েছিল। তখন বেশ ছোট। কিন্তু খুব সুন্দর গলা। এত সুন্দর যে ওকে কেউ থামতেই দিচ্ছিল না।”

অনন্যা বলল, “এই মেয়ের গান শুনেছ?”

অঞ্জলি বললেন, “সেভাবে শুনিনি। আড়াল থেকে শুনেছি, তাও একেবারে মনে-মনে, না-গাওয়ার মতো। অতুলপ্রসাদের গান করছিল, ‘কী আর চাহিব বলো হে প্রিয়…’ নিশ্চয়ই মায়ের কাছ থেকে শুনেছে। মনে হল মেয়ের গলা তার মায়ের চেয়েও সুন্দর।”

মেয়েটাকে যত দেখছে ততই গুলিয়ে যায় অনন্যার। মাথায় এত বদবুদ্ধি, তারপরেও এত ভাল গান করে! এরপর দোপাটিকে বেশ কয়কেবার গান করতে বলেছিল অনন্যা। দোপাটি গায়নি। প্রথমে হাসি-ঠাট্টা করেছে, তারপর গম্ভীর হয়ে গিয়েছে। একসময় কঠিন কথা বলে উঠে চলেও গিয়েছে।

“দোপাটি, একটা গান শোনা দেখি।”

“ধুস, আমি কি গাইতে জানি নাকি? কী যে বলো অনন্যাদি!”

“খুব জানিস। এই তো কাল সন্ধেবলো সিঁড়ির ওখানে বসে গাইছিলি।”

দোপাটি চোখ বড়-বড় করে বলল, “গাইছিলাম কই? ও তো মশা তাড়াচ্ছিলাম। গুনগুন করছিলাম। আমার গান শুনলে মশা পালায়। তোমাকে যদি কোনওদিন মশা কামড়ায় আমাকে বলবে। আমি এসে গান গেয়ে যাব।”

কথা শেষে মেয়েটা হেসে গড়িয়ে পড়ে। অনন্যা বলে, “ফাজলামি করলে মার খাবি। গাইতে বলেছি গাইবি। আচ্ছা, কাল যেটা গাইছিলি সেটাই দু’লাইন গা না বাবা। কী যেন কথা? ‘বসিয়া বিজনে কেন একা মনে…’ তাই না?”

দোপাটি একটু চুপ করে থাকে। হাসি মুছে, খানিকটা অন্যমনস্ক ভাবে বলে, “সত্যিই আমি গাইতে পারি না অনন্যাদি। আমাকে বোলো না।”

অনন্যা চোখ পাকিয়ে বলে, “এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে। তুই কী এমন বড় গায়িকা যে এতবার অনুরোধ করতে হচ্ছে?”

দোপাটি উঠে পড়ে। অনন্যাকে থতমত খাইয়ে ঠান্ডা গলায় বলে, “আমি কারও সামনে গাই না। আমাকে কখনও গাইতে বলবে না।”

অনন্যা আর কখনও বলেনি। যেটুকু কানে আসে তাই শুনতে পায়। অবাক লাগে। একই মেয়ে এত ভাল লেখাপড়া করছে, এত সুন্দর গান করছে, একই সঙ্গে ভয়ংকর অপরাধ করছে! এবার যা করেছে সেটা অপরাধ ছাড়া কী? শুধু অপরাধ নয়, চিন্তায় ফেলে দেওয়ার মতো অপরাধ। এই মেয়ের মনের কোনও গভীরে কি এইসব বীজ লুকিয়ে আছে? নাকি হঠাৎ মনে হচ্ছে, তাই করে? অনন্যার একবার মনে হল, এই সকালেই উপরে যায়। গিয়ে দোপাটির সঙ্গে কালকের বিষয়টা নিয়ে কথা বলে। জিজ্ঞেস করে, সে কেন এমন করছে। শুধু তো কাল করেনি, মা বলল, আগেও দেখেছে। একবার নয়, দু’বার। প্রথমবার গা করেনি, দ্বিতীয়দিন সন্দেহ হয়। কাল আর নিজেকে সামলাতে পারেনি। এগিয়ে গিয়ে দোপাটির চুলের মুঠি চেপে ধরেছে। উপরে যাবে ভেবেই থমকে গলে অনন্যা। মনে হল, কী জিজ্ঞেস করবে? এই জিনিস কি জিজ্ঞেস করার মতো? মারধর করার মতোও নয়। মা মারধর করে এবারও ঠিক করেনি। মা বুঝতে চাইছে না গায়ে হাত তোলার মতো বয়স আর এই মেয়ের নেই। অনন্যার মন বলছে, দোপাটির সঙ্গে এই ঘটনা নিয়ে কথা বলতে গেলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। তার চেয়ে বাবার সঙ্গে কথা বলার দরকার। দোপাটিকে এই বাড়ি থেকে সরাতে হবে। তাকে কোনও রেসিডেনশিয়াল স্কুলে পাঠাতে হবে। সেখানে থেকে লেখাপড়া করবে।

অনন্যা একতলায় নেমে চা করল। বাড়িতে জেগে আছে সে আর দোপাটি। দোপাটি চা খায় না। এক কাপ চা করা মুশকিল। টি-কেটলে দু’কাপ জল নিল অনন্যা। বড় মগে চা নিয়ে দোতলায় উঠে আসে ফের। তার ঘর দক্ষিণমুখী। ঘরের লাগোয়া ছোট একটা বারান্দা। একসময় চেয়ার নিয়ে সেখানে বসা যেত। অনন্যা কত দিন বারান্দায় বসে পড়াশোনা করেছে। বন্ধুরা কেউ এলে বারান্দায় নিয়ে গিয়েছে। বসে গল্প করেছে। বারান্দায় এসে মোবাইলে আড্ডাও দিয়েছে দেদার। একটুখানি হলেও বাড়ির থেকে জায়গাটা যেন আলাদা। তাই বাড়িতে থেকেও আড়ালে থাকা যেত। বারান্দার পিছনে পাঁচিলঘেরা খানিকটা জমি ছিল। অন্য কারও জমি। সেখানে গাছপালা ছিল। আগাছা ধরনের, কিন্তু গাছপালা তো। একটু সবুজ দেখা যেত। সব মিলিয়ে বারান্দা অনন্যার প্রিয় ছিল। সেই বারান্দায় এখন বসা তো দূরের কথা, যাওয়াও যায় না। ফাঁকা জমিতে ঢাউস ফ্ল্যাটবাড়ি উঠে গিয়েছে। বারান্দায় গেলে কারও না কারও চোখে পড়বেই। এমনকী কাপড়- জামাও শুকোতে দেওয়া মুশকিল। তা-ও বারান্দার দরজাটা খুলে পরদা টেনে দেয় অনন্যা। আজ সকালেও দিয়েছিল। ঠান্ডা বাতাসে যদি শরীর আর মন মেজাজ ভাল হয়। হয়নি। বরং সময় যত গিয়েছে, ভিতরে অস্বস্তি বেড়েছে। একসময় অন্যমনস্ক হওয়ার জন্য ল্যাপটপ টেনে ফেসবুক খুলে বসল। এলোমেলো ঘুরতে-ঘুরতে দেবরূপের অ্যাকাউন্টে ঢুকতে গলে। গত কয়েকদিনে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছে। কোনওবারই পারেনি। আজও পারল না। দেবরূপ তাকে আটকে দিয়েছে। অনন্যা সরে এল। সে জানত, আজও সে দেবরূপের ফেসবুকে যেতে পারবে না। দেবরূপ সবদিক থেকে যোগাযোগ বন্ধ করার চেষ্টা করছে। যোগাযোগ বন্ধের এই ঝগড়া আগে কখনও হয়নি। মান-অভিমানের কথা বন্ধ এক-দু’দিনেই ঠিক হয়ে যায়। গেস্ট হাউজ়র ঘটনার পর অনন্যার বিশ্বাসটাই ধাক্কা খেয়েছে। দেবরূপের কথাগুলো মাথার মধ্যে শুধু ঘুরছে। যত ঘুরছে, তত অনন্যার মনে হয়েছে, কথাগুলো শুধু কথা নয়, বিশ্বাসও। হয়তো কথাগুলো বলার জন্য দেবরূপ মনে-মনে তৈরি হচ্ছিল। সুযোগ পেয়ে বলে দিল। দেবরূপ যে তার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে, সেটা কি তার রাগ? নাকি সে সুযোগ নিল? যা-ই হোক, তাকে একটা জরুরি কথা জানানো দরকার। সেই কারণেই কাল অফিসে গিয়ে…

এত সকালেও ফেসবুকে তানিয়াকে অ্যাক্টিভ পাওয়া গলে। মেয়েটা ফেসবুক অ্যাডিক্ট।

অনন্যা খাপছাড়াভাবেই লিখল, “কী করছিস? ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে ফেসবুক?”

তানিয়া লিখল, “স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি। স্কুলের দিদিমণি হওয়ার জ্বালা তো বুঝলি না। তার আগে এদিক-সেদিক একটু প্রেম সেরে নিচ্ছি। আমার একজন বুড়ো বয়ফ্রেন্ড আছে। মালদার পার্টি। বউ জানে মর্নিং ওয়াকে গিয়েছে, আসলে পার্কে বসে আমার সঙ্গে ইন্টুমিন্টু করে।”

অনন্যা লিখল, “তুই মন দিয়ে প্রেম কর।”

তানিয়া লিখল, “তোর প্রেমের খবর কী? হাউ ইজ় দেবরূপ?”

অনন্যা লিখল, “জানি না। মনে হয় নাটক শেষ হওয়ার আগেই পরদা পড়ে গিয়েছে।”

তানিয়া লিখল, “সে কী! ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে নাকি?”

অনন্যা লিখল, “না, খোলাখুলি মত বিনিময় হয়েছে। যাক, তুই ইন্টুমিন্টু কর, আমি যাই।”

অনন্যা ল্যাপটপ বন্ধ করে দিল। তার মন খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে, একটু কাঁদতে পারলে হালকা লাগত।

সকাল-সকাল অফিস এসেছে অনন্যা। কালকের ‘ভুল’ যদি সামলানো যায়। সামলানো যায়নি। নিজের টেবিলে এসে দেখল ট্রে ফাঁকা। তার মানে নন্দ কালই রিপোর্টগুলো কর্ণফুলি সেনের কাছে জমা দিয়ে এসেছে। রোজ যেমন হয়। জরুরি কাগজপত্র সব বসের কাছে যায়। সেখান থেকে ডেসপ্যাচ হয়। এই রিপোর্টগুলো অতিরিক্ত জরুরি। কাল দুটো রিপোর্ট দেখতে পেরেছিল অনন্যা। দেখা মানে, হার্ড কপির সঙ্গে কম্পিউটরের ডেটা মিলিয়ে নেওয়া। মাসখানকে আগে কিছু অ্যানালিসিস নিয়ে উপরমহল থেকে সন্দেহ করা হয়েছে। ডিপার্টমেন্টে নোট এসেছে। যেসব প্রজেক্টের রিপোর্ট এখানে তৈরি হয়েছে তাদের পারফরম্যান্স এত খারাপ হওয়ার কথা নয়। ফিল্ড এক্সপেরিয়েন্স অন্য কথা বলছে। এরপরই ঠিক হয়, ডেটাগুলো আবার দেখা হবে। সবার সঙ্গে অনন্যাও খানিকটা দায়িত্ব পেয়েছে। রোজই কয়েকটা করে রিপোর্ট মিলিয়ে নিতে হচ্ছে। অনন্যা নিশ্চিত, কাল ওই রিপোর্টগুলোর মধ্যে সে চিঠিটা ফেলে গিয়েছে। এর অর্থ সেই চিঠি এখন কর্ণফুলি সেনের টেবিলে। তার টেবিল থেকে রিপোর্টগুলো নিয়ে এসে পাতা হাতড়ে চিঠিটা বের করা কঠিন কাজ। রিপোর্ট ফেরত নিতে গেলে মহিলা হাজার প্রশ্ন করবেন।

“ফেরত চাইছ কেন?”

“আর একবার চকে করে নিতাম।”

“কেন? প্রথমবার কি মন দিয়ে চকে করোনি?”

“তা নয় ম্যাডাম। দু’বার দেখলে ক্ষতি কী? হয়তো কোনও ফিগার মিস করে গিয়েছি।”

“অবশ্যই আছে। অনন্যা, আমি চাই না আমাদের অ্যানালিসিসে তেমন কোনও ভুল পাওয়া যাক। এতে আমাদের ডিপার্টমেন্টের নাম খারাপ হবে। আমরা প্রমাণ করতে চেষ্টা করব, আমাদের কাজ ঠিক ছিল। দু’-একটা ছোটখাটো ভুল থাকতে পারে কিন্তু মেজর কিছু নেই। তোমার আর চেক করার দরকার নেই। রিপোর্ট দুটো থাক।”

এরকমই যে কর্ণফুলি সেন বলবেন, তার কোনও মানে নেই। হয়তো অন্য কিছু বলবেন, তবে সহজে ছাড়বেন না। সুতরাং রিপোর্ট নিয়ে আসার কথা ভেবে লাভ নেই। কিন্তু চিঠিটা যে রিপোর্টের মধ্যেই কোথাও রয়ে গিয়েছে, এই বিষয়ে অনন্যা নিশ্চিত। হ্যাঁ, নিশ্চিত। কাল বাড়ি ফিরে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকার পর মাথার যন্ত্রণাটা কমে যায় আর তখনই চিঠিটার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে চিঠিটা ফেলে এসেছে রিপোর্টগুলোর মাঝখানে। ফেলে আসেনি, রেখে দিয়েছিল। অনন্যা ঠিক করেছিল খামে পুরে দেবরূপের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে আজই। সেরকম হলে নিজে দেবরূপের অফিসে যাবে। দেবরূপের সঙ্গে দেখা করে বলবে, “কথা বলতে আসিনি। একটা জরুরি খবর দিতে এসেছি। মুখে কথা বলে তোমার সময় নষ্ট করতে হবে না। খামের ভিতর চিঠি আছে, পড়ে নিয়ো,” আর যদি দেখা না হয় অফিসের রিসেপশনে জমা দিয়ে আসবে। চিঠি বেশি বড় নয়-

‘দেবরূপ,

হাতে লেখা চিঠি বোধ হয় বহুদিন পরে পেলে। তা-ই না? আমিও কতদিন পরে লিখলাম তার ঠিক নেই। কাল রাত পর্যন্ত ভেবেছিলাম, মেল করে দেব। আজ সকালে ঠিক করলাম, না, হাতে লিখব। মেল করলে পুরো চিঠিতে আমি থাকতে পারতাম না। ডিজিটাল জগতে মানুষ পুরোটা থাকতে পারে না। যা-ই হোক, মূল কথায় আসি। সেদিন তোমার সঙ্গে যে ঘটনাটা ঘটেছে সেটা নিয়ে আমি ভেবেছি। নিশ্চয়ই তুমিও ভেবেছ। মনে হচ্ছে, আমাদের সম্পর্কের বোঝাবুঝিতে কোথাও ফাঁক তৈরি হচ্ছে। আশা করেছিলাম, তুমি আমাকে ফোন করে ‘সরি’ বলবে। ভালই করেছ বলোনি৷ বললে আমি কি সেদিনের সব ভুলে যেতাম? ঠিক জানি না। তোমার বিশ্রী, অসম্মানজনক কথাগুলো হয়তো ভুলে যেতাম,কিন্তু তোমার কথার আড়ালে যে কথাগুলো ছিল, যা তুমি বলোনি, সেগুলোর কী হত? আমি তোমার কাছ থেকে সেই কথাগুলো শুনতে চাই। টেলিফোনে নয়, মুখোমুখি। আমার বিশ্বাস, তারপর আমরা একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারব। কবে তোমার সময় হবে জানিয়ো। তবে এটা জরুরি। কারণ সেদিন গেস্ট হাউজ়ে যে ভয়টা পাচ্ছিলাম মনে হয় সেটাই সত্যি হচ্ছে। এমাসে আমি ডেট মিস করেছি। আর কয়কেটা দিন দেখার পর আমাকে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।

ইতি,

অনন্যা

পুঃ টেলিফোন, ফেসবুকে ব্লক করে দিয়েছ কেন? চিন্তা নেই, তুমি না করলে আমি আর যোগাযোগ করব না।’

যদি কালই কর্ণফুলি সেন রিপোর্টগুলো নাড়াচাড়া করে থাকেন তাহলে এই চিঠি এখন তাঁর হাতে। সেটা শুধু বাজে হবে না, মারাত্মক একটা ঘটনা হবে। মহিলা সর্বত্র রটিয়ে বেড়াবেন। কেউ শুনলে ভাববে, এরকম একটা গোপন জিনিস কীভাবে অনন্যা ফেলে গিয়েছিল! সে যে ফেলে যায়নি, বরং সবথেকে জরুরি কাগজপত্রের সঙ্গে গুছিয়ে রেখেছিল, এটা বোঝানো কঠিন হবে। মাথার যন্ত্রণা, হঠাৎ বাড়ি চলে যাওয়ায় সবটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছে।

অফিসের টেবিলে বসেছে ঠিকই, কিন্তু কাজে মন বসাতে পারছে না অনন্যা। অন্যদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে ফলছে। অত্রি একটা ফাইল খুঁজে দিতে বলল। নিজের কম্পিউটর হাতড়ে পাচ্ছে না। ভুলে কোনও ড্রাইভে সেভ করেছে হয়তো। অত্রিকে প্রায় খিঁচিয়ে উঠল, “নিজের কাজ বাদ দিয়ে তোমার ফাইল খুঁজতে বসব এখন?”

অত্রি অবাক হয়। অনন্যাকে এরকম রূঢ় ব্যবহার মানায় না। সে বলে, “আমি তোমাকে নিজের কাজ বাদ দিতে বললাম? ঠিক আছে থাক, আমি দেখে নিচ্ছি।”

খারাপ ব্যবহার করল নন্দর সঙ্গেও। চা এনে দিয়েছিল। মুখে দিয়ে নন্দকে কড়া গলায় বলল, “ইচ্ছে না করলে আনবে না, কিন্তু এরকম বিশ্রী চা কখনও আমার টেবিলে দেবে না। এই তোমাকে শেষবার বলে দিলাম।”

নন্দ অনন্যার রুক্ষ ব্যবহারে থতমত খেয়ে যায়। রুক্ষ ব্যবহার আরও করে ফেলেছে। মোবাইলে কর্মাশিয়াল কল এসেছিল। যেমন সবার আসে। একটা মেয়ে ইনশিয়োরেন্স পলিসি বিক্রি করতে চায়। তাকে খারাপভাবে ধমক দিল অনন্যা। আশপাশের টেবিল থেকে সবাই মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। নিজেরই লজ্জা করল। এসবের মাঝখানে কর্ণফুলি সেন নিজের চেম্বার থেকে বেরিয়ে অনন্যার কাছে এলেন। কিছু কাগজপত্র বুঝিয়ে গেলেন। মহিলাকে দেখে অনন্যা অস্বস্তির মধ্যে পড়ে। ইস, নিশ্চয়ই এতক্ষণে চিঠিটা পড়েছে।

“আপনি এলেন কেন, আমাকে ডাকলেই তো পারতেন।”

কর্ণফুলি সেন এই কথায় পাত্তা না দিয়ে বললেন, “মাথার যন্ত্রণা কমেছে?”

“হ্যাঁ, ম্যাডাম।”

কর্ণফুলি সেন একটু ভুরু কুঁচকে বললেন, “চোখের পাওয়ারটা একবার চেক করিয়ে নিয়ো।”

মহিলা চিঠিটা পড়েছে? হঠাৎ এমন নরম-সরম ব্যবহার করছে কেন?

লাঞ্চে ক্যান্টিনের কোণে একটা ফাঁকা টেবিলে এসে বসল। বাড়ি থেকে স্যান্ডউইচ এনেছে। মা বানিয়ে দিয়েছে। দাদাকেও দেয়। দাদা নিতে চায় না। বলে, “কলেজপাড়ায় খাওয়ার জায়গা অনকে। স্টাফরুমে বসে টিফিনবক্স খোলার দরকার নেই।”

আসলে লজ্জা পায়। ছেলেদের এটা একটা সমস্যা। এই অফিসেও তাই। ছেলেরা বেশিরভাগই ক্যান্টিন থেকে কিনে খায়। অনন্যাও রোজ খাবার আনে না। অত্রি টেবিলের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল। অনন্যা ডাকল। অত্রি সহজ ভাবে এল।

“সরি অত্রি, কিছু মনে কোরো না। ওভাবে কথা বলা আমার উচিত হয়নি।”

অত্রি হেসে বলল, “ইট্‌স ওকে। আই নেভার মাইন্ড।”

অনন্যা শুকনো হেসে বলল, “আসলে শরীরটা ট্রাবল দিচ্ছে। মুডটা অফ হয়ে আছে।”

অত্রি বলল, “উফ বাবা, বলছি তো আমি কিছু মনে করিনি। তখনই বুঝেছি সফট স্পোকেন মেয়েটার আজ কোনও প্রবলেম হয়েছে। হতেই পারে। রোজ কি মন-মেজাজ একরকম থাকে? টেক কেয়ার। চলি, সামনের টেবিলে বসেছি।”

অনন্যার ভাল লাগল। বলল, “তুমি কি ফাইলটা পেয়েছ?”

অত্রি বলল, “না, পাইনি। মনে হচ্ছে করাপ্ট হয়ে গিয়েছে।”

অনন্যা বলল, “আচ্ছা। লাঞ্চের পরে গিয়ে দেখছি।”

“থ্যাঙ্ক ইউ। আমি ইঞ্জিনিয়ারকে খবর পাঠিয়েছি। এবার চললাম। বাই৷”

অনন্যা বলল, “আচ্ছা এসো। তবে যাওয়ার আগে আমার থেকে একটা স্যান্ডউইচ নিয়ে যাও। নইলে ভাবব, এখনও রাগ করে আছ।”

অত্রি একটু থমকে থেকে মুচকি হেসে বলল, “আচ্ছা হাফ দাও। এরপর থেকে তুমি রোজ মুড অফ করে অফিসে আসবে। আমাদের ধমকধামক দেবে। তা হলে স্যান্ডউইচ পাব।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *