হত্যাকাণ্ডের আগে ও পরে – ১

অনন্যা আজ অফিস থেকে বিকেলেই বেরিয়ে পড়েছে। বেরিয়ে আসাটা সহজ হয়নি। একেই তো বসের সঙ্গে হালকা ঠোকাঠুকি হয়েছে, তারপর একটা মারাত্মক ভুল করে এসেছে। ভুল না বোকামি? বোকামির কারণে ভুল বলাটাই ঠিক হবে। মানুষ যখন অতিরিক্ত ইমোশনাল হয়ে যায় তখন সে যুক্তি বুদ্ধি হারাতে শুরু করে। সে বোকা হয়ে যায়। অনন্যা বুঝতে পারছে, সে বোকা হয়ে যাচ্ছে।

ভুলের কথা মনে পড়েছে খানিক আগে। তখন আর সামলানোর উপায় ছিল না। দেরি হয়ে গিয়েছে। তারপরেও বিক্রমকে ফোন করল অনন্যা। বিক্রম অফিসের কেয়ারটকোর। সন্ধের পর অফিস ফাঁকা হয়ে গেলে একজন লাকে আর গাদাখানকে চাবির গোছা নিয়ে ঘুরে-ঘুরে তালা দেয়। সবার আগে তালা পড়ে তিনতলায় অনন্যাদের কম্পিউটর ডিভিশনে। এই ডিপার্টমেন্টের সিকিউরিটি নিয়ে খুব কড়াকড়ি চলছে। আগে ছিল না, দু’বছর আগে চুরির ঘটনা ঘটার পর কড়াকড়ির নিয়ম হয়েছে। একবার বন্ধ করে দিলে, রাতে ডিপার্টমেন্ট আর খোলা যায় না। খুব জরুরি কোনও কাজে খুলতে গেলে স্পেশ্যাল পারমিশন লাগে। ডিপার্টমেন্টের হেড এবং অফিসের চিফ সিকিউরিটি অফিসার দু’জনকেই জানাতে হবে। চুরিটা ছিল ভয়ঙ্কর। চোর কম্পিউটর মেশিন থেকে হার্ড ডিস্ক খুলে নিয়ে যায়। বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায়নি। পরদিন অফিস খোলার পর জানা গেল। দু’জনের মেশিন খুলছিল না। বেলায়অফিসের কেয়ারটকোর ইঞ্জিনিয়ার আবিষ্কার করল, দুটো সিপিইউ-র ভিতরেই হার্ড ডিস্ক নেই! চোর মেশিনের কভার খুলে হার্ড ডিস্ক বের করেছে। আবার যত্ন করে কভার আটকে দিয়ে গিয়েছে। ঘটনাটা নিয়ে হইচই হয়েছিল খুব। হার্ড ডিস্ক চুরি মানে অনকে জরুরি এবং গোপন ডেটা চুরি। অফিসের কেয়ারটেকার, সিকিউরিটি স্টাফ সাসপেন্ডেড হল। পুলিশ এসে তিনজনকে ধরে নিয়ে গেল। কোনও লাভ হল না। তারা ছাড়া পেয়ে গেল। তখন ঘরে সিসিটিভি লাগানো ছিল না। ক্যামেরার ছবি দেখে যে চোর ধরবে এমন উপায় নেই। খবরের কাগজে খবরও বেরিয়েছিল। সেই খবরে লেখা হয়েছিল, চুরির নাটক। ইচ্ছে করেই নাকি হার্ড ডিস্ক খুলে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। যাতে পুরনো হিসেব না পাওয়া যায়। এরপর কড়াকড়ি না করে উপায় কী?

তারপরেও অনন্যা বিক্রমকে ফোনে ধরল, “একবার কি ডিপার্টমেন্ট খোলা যাবে বিক্রম?”

বিক্রম আমতা-আমতা করে বলল, “দিদি, ঘর তো অনেকেক্ষণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমি তো পারব না। আপনি চিফ সিকিউরিটি অফিসারকে ফোন করুন।”

অনন্যা অনুরোধের গলায় বলল, “একবার যদি টুক করে খুলে দেখতে। আমার টেবিলটা দেখলেই হবে।”

বিক্রম জানে এসব কাজে পরদিন বকশিশ মেলে। অনেকেই মোবাইল, ছাতা, এমনকি মানিব্যাগ পর্যন্ত অফিসে ফেলে যায়। হেল্‌থের সূর্যদারই এরকম অভ্যেস আছে। অফিসে ঢুকে আগে মানিব্যাগটা ড্রয়ারে রেখে কাজ শুরু করে। বাড়ি ফিরে মনে পড়লে সবাই বিক্রমকে ধরে। জিনিস মিললে পরদিন বকশিশ জোটে। জিনিস যেরকম দামি, বকশিশও সেরকম মোটা হয়। অনন্যাদির কথামতো কম্পিউটরের ঘর খুলে দেখতে বিক্রমের ইচ্ছে করে। কিন্তু উপায় নেই। জানাজানি হলে চাকরি চলে যাবে। অন্য ডিপার্টমেন্ট হলে নিশ্চিন্তে দরজা খুলে ফেলত। চাবি তার ঘরের দেওয়ালেই ঝোলানো থাকে।

“কী ফেলে গিয়েছেন দিদি? মোবাইল?”

অনন্যা অন্যমনস্কভাবে বলল, “না, মোবাইল নয়।”

বিক্রম আগ্রহ নিয়ে বলল, “ব্যাগ? টাকা ছিল? কাল সকালে সবার আগে দেখব। টেবিলে? ড্রয়ারে? বাথরুমে নয় তো? চিন্তা করবেন না। অন্য কেউ ঢোকার আগেই ঘরে ঢুকে পড়ব। জিনিস ঠিক পেয়ে যাবেন।”

অনন্যা খানিকটা আপনমনেই বলল, “ওসবের চেয়ে অনেকে জরুরি জিনিস বিক্রম।”

টাকার চেয়েও জরুরি! বিক্রম এবার খানিকটা ঘাবড়েই গেল। অনন্যা বলছে কী! সে চিন্তিত গলায় বলল, “গয়নাগাঁটি ফেলে গিয়েছেন নাকি? কানের দুল? আংটি?”

অনন্যা ম্লান হেসে বলল, “বিক্রম, এসবের চেয়ে অনকে দামি একটা জিনিস নিয়ে ভুল করেছি। থাক, তুমি চিন্তা করো না। আমি কাল গিয়ে দেখে নেব।”

ফোন ছেড়ে আবার চোখ বুজল অনন্যা। খানিক আগে পর্যন্ত মাথা ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছিল। এখন কমেছে। তবে দপদপানি রয়েছে। দুপুর পর্যন্ত ঠিক ছিল। লাঞ্চের একটু পর থেকে ব্যথাটা শুরু হল। লাঞ্চের সময়ই শরীরটা খারাপ লাগছিল। খেতে ইচ্ছে করছিল না। ক্যান্টিনে গিয়ে একটা দোসা নিয়েছিল। আধখানাও খেতে পারেনি। ব্যাগে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট থাকে। দরকারে খেয়ে নেয়। আজ অনকে হাতড়েও পাওয়া গেল না। এটাই হয়, কাজের সময় জিনিস পাওয়া যায় না। হয় হারিয়ে ফেলে, নয় ভুলে যায়। তিনমাস আগেও এরকম কাণ্ড হয়েছে। অফিসে হঠাৎ পিরিয়ড শুরু হল। ডেটের দু’দিন আগে। পিরিয়ডের সময় নিয়ে তার ঝামেলা নেই। এক-দু’দিনের বেশি এদিক-ওদিক হয় না। তারপরেও ব্যাগে সবসময় প্যাড থাকে। সেই ক্লাস এইট থেকে অভ্যেস। মায়ের শিখিয়ে দেওয়া। এই আটাশেও সেই অভ্যেস চলছে। সেদিন প্যাড বের করতে গিয়ে অনন্যা বুঝতে পারল ভুল হয়ে গিয়েছে। অফিসে আসার সময় ব্যাগ বদলেছে। ব্যাগ বদলানোর কারণ, সেদিন সালোয়ার বা জিন্‌স পরেনি, পরেছে শাড়ি। তাই ভ্যানিটি ব্যাগ না নিয়ে শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে শান্তিনিকেতনি ঝোলা ব্যাগ নিয়েছিল। শাড়ির আঁচলে খানিকটা হলুদের প্যাচ রয়েছে, তাই হলুদ কাপড়ের ব্যাগ। এই ব্যাগে প্যাড নেওয়া হয়নি। বিচ্ছিরি অবস্থা। শেষ পর্যন্ত সীমন্তিকাদি বাঁচাল। ওর কাছেও স্টক থাকে। আজও ব্যাগে ওষুধ নেই। রোজ এর- তার কাছে চাওয়া যায় না। নন্দকে দিয়ে দোকান থেকে আনিয়ে নিল। নন্দ আর এক কাঠি। এই ডিভিশনে নতুন এলেও দীর্ঘদিন সে অফিসে পিওনের কাজ করছে, তারপরেও কোনও জিনিস একবারে ঠিক করতে পারে না। তবে আজ পেরেছে। অফিসের উলটোদিকের মেডিসিন শপ থেকে ওষুধ এনে দিয়েছে। ট্যাবলেট খেয়ে অনন্যা ভেবেছিল, খানিকক্ষণের মধ্যে ব্যথা সামলে যাবে। গেল না, বরং আরও বাড়ল। কপালের ব্যথা গোটা মাথায় ছড়িয়ে পড়ল। কম্পিউটরের দিকে তাকাতে পারছে না, চোখ জ্বলছে।

সীমন্তিকাদি পাশের কিউবিকলে বসে। অনন্যাকে দু’হাত দিয়ে কপালের রগ টিপে বসে থাকতে দেখে বলল, “ইস, এত মাথা ব্যথা! বসকে বলে বাড়ি চলে যা।”

অনন্যা বলল, “ধুস। ওই মহিলার সামনে যেতে ইচ্ছে করে না। ছুটি নিতে গেল হাজারটা কথা বলবে।”

সীমন্তিকাদি ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, “বললে উত্তর দিবি না। বলবি, ‘মাথা ধরেছে, এখন কথা বলতে পারছি না ম্যাডাম।’ তোরা বেশি নরম বলে কর্ণফুলি সেন এত বেড়েছে। কড়া হবি, দেখবি চুপসে থাকবে।”

অনন্যা আরও খানিকক্ষণ অপেক্ষা করেছিল। যদি সুস্থ হয়ে যায়। হল না, বাধ্য হয়ে হাতের কাগজপত্র, ফাইল গুছিয়ে কর্ণফুলি সেনকে গিয়ে বলতে হল। এই মহিলা চট করে কারও কথা বিশ্বাস করতে চান না। নানারকম ধানাইপানাই করেন। অনকে প্রশ্ন। প্রশ্ন তো নয়, যেন জেরা। এটা যেন অফিস নয়, স্কুল। শুধু তাই নয়, মহিলার কৌতূহলও খুব। এটা আরও বিশ্রী। সবার ব্যক্তিগত খবরাখবরে নজর। কেচ্ছা-টেচ্ছা হলে তো কথাই নেই। কার শাশুড়ি বউমাকে শিক্ষা দিতে গায়ে কেরোসিন ঢালতে গিয়েছিল, কার স্বামী মেয়ের গানের দিদিমণিকে রাতে মোবাইল থেকে মেসেজ পাঠাতে গিয়ে বউয়ের হাতে ধরা পড়েছে, কার বিয়ে ভাঙছে, কার মেয়ে পাড়ার মস্তানের প্রেমে পড়েছে, কার ছেলে ক্লাসে ফলে করল। পেট থেকে খুঁচিয়ে বের করতে চাইবে। কথাও বলে একগাদা। একেই বস, তার উপর বয়সে বড়। মুখের উপর চট করে কিছু বলা যায় না। তাও সীমন্তিকাদি, তুর্ণা, সঞ্জয়রা মুখের উপর বলে দেয়। তুর্ণাটা বেশি বলে। বস ওকে ঘাটায় না। ওর কোন আত্মীয় যেন বড় অফিসার। হাতে বদলি- টদলির ক্ষমতা আছে। সেই কারণে ভয়। সীমন্তিকাদিকেও সমঝে চলে। ক্যাট-ক্যাট করে কথা শুনিয়ে দেয়। সঞ্জয়ের ডোন্ট কেয়ার ভাব। সে এখান থেকে ট্রান্সফার নিতে চায়। তাই মুখের উপর কথা বলতে তার আটকায় না। অনন্যা এই সব পারে না। সে বসকে ভয় পায় না ঠিকই, কিন্তু ঝগড়া-টগড়া করতে পারে না। সে সাহসী, কিন্তু এই সব ব্যাপারে সাহস দেখাতে চায় না।

আজকাল ‘বস’ হয় অন্যরকম। বন্ধুর মতো ব্যবহার করে। শান্তিতে থাকা যায়, আবার বেশি কাজও করিয়ে নেওয়া যায়। কর্ণফুলি সেন এসব জানে- বোঝে না। অন্য ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রোমোশন পেয়ে ‘বস’ হয়ে এসেছে, ব্যস এই পর্যন্ত। দেবরূপ বলে, “তোমাদের অফিসটাই তো মান্ধাতা আমলের অনন্যা। ফাইল, ধুলো, টাইপরাইটারের কারবার। ইঁদুর ফাইল খেয়ে যায়। মোটে কয়কে বছর হল একটা কম্পিউটর ডিভিশন হয়েছে। সেখানকার বস এই সময়ের মতো হবে কী করে? আধুনিক ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে তার না আছে লেখাপড়া, না আছে ধ্যান-ধারণা। খোঁজ নাও, দেখবে ধরে-করে প্রোমোশন পেয়েছে।”

“আমাদের অফিসে ধরে-করে প্রোমোশন হয় নাকি?”

দেবরূপ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, “কেন হবে না!খুব হয়। খুঁটি শক্ত থাকলেই হয়। তোমার বস একজন ধুরন্ধর মহিলা।”

কর্ণফুলি সেন ‘ধরে-করে’ বস হয়েছে কিনা জানে না অনন্যা, তবে ডিপার্টমেন্টে কেউ মহিলাকে পছন্দ করে না। কাজের বাইরে কথা বলতে চায় না। বললেও রুটিনের বাইরে কাজ করে না। এমনকী মাঝে-মাঝে ইচ্ছে করে ঝুলিয়ে দেয়। মহিলা কম্পিউটরটা যে খুব ভাল বোঝেন এমন নয়। অনন্যার ধারণা, ধুরন্ধর নয়, আসলে মহিলা বোকা। বোকা বলেই কর্মীদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারেন না। ডিপার্টমেন্টে তো বেশি লোক নেই। এই ক’জনকে ‘গুড বুক’-এ রাখা কী এমন কঠিন কাজ? নিজের বিচ্ছিরি স্বভাবের জন্যই এই হাল। মহিলা একদিন বড় ঝামলোয় না পড়ে।

মাথা ব্যথার কথা বলতে কর্ণফুলি খানিকক্ষণ ভুরু কুঁচকে অনন্যার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

“আজ তাহলে অফিসে এলে কেন? বাড়িতে রেস্ট নিতে পারতে।”

অনন্যা বিরক্তি চেপে বলল, “তখন তো ব্যথা ছিল না ম্যাডাম।”

কর্ণফুলি সেন চোখের ভারী চশমা নাকের উপর ঠেলা দিয়ে তুলে বললেন, “এখান থেকে সোজা বাড়ি যাবে?”

অনন্যার ইচ্ছে করল বলে, ‘না ম্যাডাম, বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে সিনেমা দেখতে যাব। সিনেমা দেখে রেস্তোরাঁয় খাব। তারপর বাড়ি ফিরব। বাড়ি ফেরার আগে ময়দানের পাশে গাড়ি রেখে বয়ফ্রেন্ডকে অনকেক্ষণ ধরে চুমু খাব৷’ একথা বলা যায় না, নিজেকে সামলে বিরক্ত গলায় বলল, “অবশ্যই বাড়ি যাব। ব্যথা নিয়ে আর কোথায় যাব?”

কর্ণফুলি সেন হাতের কলম টেবিলে ঠুকতে-ঠুকতে বললেন, “তুমি কোথাও যাবে সকেথা বলছি না। অনেকে যায়। এই তো সেদিন তোমাদের ডিপার্টমেন্টের একজন দু’দিনের জন্য ছুটি নিল। ছুটি কী জন্য, না মেয়ের ফাইনাল পরীক্ষা। বাড়িতে থেকে মেয়েকে পড়াবে। সেদিনই সন্ধেবলো গিয়েছিলাম সাউথের দিকের একটা শপিং মলে। ননদের অ্যানিভারসারি ছিল, গিফট নেব। ও মা! দেখি, তোমার কলিগ ঘুরছে। আমাকে দেখে তো আঁতকে উঠল। চোখ-মুখ শুকিয়ে এইটুকু। থতমত খেয়ে বলল, মেয়ের পেন-পেনসিল কিনতে এসেছে। বোঝো কাণ্ড! পরের দিন মেয়ের পরীক্ষা আর মা অফিসে ছুটি নিয়ে সেজেগুজে মলে পেন-পেনসিল কিনে বেড়াচ্ছে! আর কোথায় কিনছে, না কসমেটিক্সের দোকানে! ইচ্ছে হল বলি, ‘মেয়ে কি তোমার সেজেগুজে পরীক্ষা দিতে যাবে?”’

অনন্যা ক্লান্ত গলায় বলল, “আপনি তো জানেন ম্যাডাম, আমার ছেলেমেয়ের ব্যাপার নেই, তাদের পরীক্ষার জন্য পেন-পেনসিলও কিনতে হবে না।”

কর্ণফুলি বললেন, “তোমাকে আমি বলিনি অনন্যা। কে ছুটি নিয়ে মেয়েকে পড়াবে, কে ছুটি নিয়ে মলে কসমেটিক্স কিনবে, তাতে আমার কী? ছুটি তার পাওনা, সেই ছুটি নিয়ে সে যা খুশি করবে। আমার কথা হল, মিথ্যে বলবে কেন? আমি কি তার ছুটি আটকাতে গিয়েছি? তুমি বলো।”

অনন্যা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “না, আটকাতে যাননি।”

কর্ণফুলি সেন এবার হালকা গলায় বললেন, “বিয়েতে দেরি করছ কেন অনন্যা? লাগিয়ে দাও। সবাই মিলে হইচই করি। দেবরূপ কি রাজি হচ্ছে না? এখনকার ছেলেদের এই এক চিত্তির হয়েছে। ঘুরব ফিরব, সব করব, কিন্তু বিয়ের কথা শুনলেই পিছিয়ে যায়।”

অনন্যার এবার রাগ হল। মহিলা আবার ব্যক্তিগত বিষয়ে ঢুকছে। দেবরূপের কথা অফিসে সবাই জানে। তা বলে এসব প্রশ্ন করা যায় নাকি? অনন্যার ইচ্ছে করল বলে, ‘ম্যাডাম, বিয়ের ব্যাপারটা মনে হচ্ছে, আপনি বেশি জানেন। সেটাই স্বাভাবিক। দুটো ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে।’ আবার নিজেকে সামলে অনন্যা কাটা-কাটা ভাবে বলল, “আজ আর কথা বলতে পারছি না, মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। বমি-বমিও পাচ্ছে। পরে না হয় একদিন আমার বিয়ে নিয়ে আপনার সঙ্গে আলোচনা করব।”

বাঁকা উত্তর, বুঝতে পারলেন কর্ণফুলি। মুখটা থমথমে হয়ে গেল। তিনি চশমা ঠিক করে, মাথা নামিয়ে কাজে মন দিলেন।

অফিস থেকে বেরিয়ে দেবরূপকে ফোন করল অনন্যা। ফোন বেজে গেল। আইটি অফিসগুলোতে অফিস টাইমে মোবাইল ব্যবহারের চল নেই। তবে অনন্যা জানে, আজকের ফোন বেজে যাওয়ার কারণ এটা নয়। কারণ অন্য এবং সিরিয়াস। দেবরূপ যে ফোন না-ও ধরতে পারে সেটা জেনেই নম্বর টিপেছে। একটা সময় ছিল হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও দেবরূপ একটা মেসেজ পাঠাত, ‘আফটার টেন মিনিটস।’

দশ মিনিটের আগেই ফোন করত, “কী হয়েছে চট করে বলো। চাপে আছি।”

অনন্যা অভিমানী গলায় বলত, “আজকাল সবসময়ই তো চাপে থাকো।”

“আই লভ ইউ ডার্লিং। পরে কথা বলছি।”

অনন্যা বলত, “থাক, তোমার ‘লভ’ লাগবে না। তুমি কাজ করো।”

ইদানীং সত্যি খুব কাজের চাপে থাকে দেবরূপ। অনবরত মিটিং করতে হয়। ‘ইঞ্জিনিয়ার কাম ম্যানেজার’ হওয়ায় দায়িত্ব বেশি। ঝক্কিও বেশি। তবে দেবরূপ কাজ ভালবাসে। কেরিয়ার তৈরির দিকে ভীষণ মন। ‘ভীষণ’ বললে কম বলা হবে। চব্বিশ ঘণ্টাই অফিসের কাজ নিয়ে পড়ে আছে। বাইরে থাকলেও ল্যাপটপ খুলে বসবে। এমনকী প্রেম করার সময়ও মোবাইলে মলে চকে করবে। অনন্যা আপত্তি করলে বলবে, “প্লিজ, এক মিনিট। বাইরের মলে এসেছে। আমাদের নতুন প্রজক্টে মনে হয় কোনও গোলমাল হয়েছে। একবার চকে করে নিতে দাও।” আসল কথা হল, দেবরূপের সামনে প্রোমোশন ঝুলছে। বড় পোস্ট। তবে প্রোমোশনটা একেবারে ‘হাতের মোয়া’ হয়ে নেই। এই পোস্টের জন্য আরও তিনজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। দেবরূপের আত্মবিশ্বাস আছে। সে নিশ্চিত, বাকি দু’জনকে সে টপকাতে পারবে। তার সিদ্ধান্ত, প্রোমোশন পেয়ে গেল বিয়ে করবে। অনন্যার ব্যাপারটা পছন্দ নয়। কিছুদিন হল এটা নিয়ে দেবরূপের সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি হয়েছে।

“বাড়িতে কিন্তু চাপ দিচ্ছে। বয়স টোয়েন্টি এইট হতে চলল। মেয়েদের জন্য কম নয়। আমি বিয়ে করলে দাদার টার্ন আসবে। দাদাও চৌত্রিশ।”

দেবরূপ হালকা ভাবে হেসে বলেছে, “আর একটু অপেক্ষা করো। প্রোমোশনটা যে কোনওদিন অ্যানাউন্স করে দেবে। তারপরেই আমি তোমার বাড়িতে গিয়ে কথা বলব অনন্যা। তোমার দাদা যখন এতদিন ব্যাচেলর লাইফ এনজয় করল, আর ক’টাদিনও না হয় তাকে করতে দাও। সেই ফাঁকে আমি কেরিয়ারটা গুছিয়ে নিই।”

দিনের পর দিন দেবরূপের এই হালকা ভঙ্গিতে বিরক্ত হয়েছে অনন্যা। খানিকটা অপমানিতও। বলেছে, “আর যদি প্রোমোশন না হয়? বিয়ে করবে না?”

দেবরূপ গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, “কু ডাকছ কেন? প্রোমোশন কেন হবে না? এই পোস্টের জন্য আমি মোস্ট এফিশিয়েন্ট। আমার সিভি সবচেয়ে ব্রাইট। আমার এক্সপেরিয়েন্স বাকিদের চেয়ে বেশি। আমার হাত দিয়ে কখনও ক্লায়েন্ট স্লিপ করে না। আমার আন্ডারে ক’টা প্রজেক্ট সাকসেসফুলি রান করছে, জানো? এই প্রোমোশনটার জন্য লাস্ট ওয়ান ইয়ার অপেক্ষা করে আছি। তার জন্য আমি একসেসিভ পরিশ্রম করি। তুমি তো সেকথা ভাল করেই জানো অনন্যা। অফিসের কোনও অ্যাসাইনমেন্টে ‘না’ করি না। আমাদের কেরিয়ার ল্যাডারে এটা সবচেয়ে কঠিন জাম্প। এটা একবার পার হয়ে গেল বাকিটা সরসর করে উঠে যাওয়া যায়।”

অনন্যা বুঝতে পেরেছিল, তার কথায় দেবরূপ আহত হয়েছে। হোক, সে আহত করতেই চেয়েছে। বিয়ে আটাশের জায়গায় উনত্রিশে হলে তার জীবনে বিরাট কিছু বিপর্যয় নেমে আসবে না। সে বিয়ে করার জন্য উন্মুখ হয়েও নেই। কিন্তু যার সঙ্গে গোটা জীবনটা থাকবে বলে ঠিক করেছে, তার মনোভাবটা এমন হবে কেন?

“আমি সে কথা বলিনি। তোমার প্রোমোশন হলে আমি সবচেয়ে খুশি হব। তুমি সেটা ভাল করে জানো দেবরূপ। আমি বিয়ের সঙ্গে পোমোশন জড়ানোর কথা বলছি। অফিসের উপর আমাদের বিয়ে নির্ভর করবে! এটা আমার পছন্দ হচ্ছে না।”

দেবরূপ এবার উষ্মার সঙ্গে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেছিল, “অবভিয়াসলি করবে। বিয়ে মানে একটা সিরিয়াস অ্যাটাচমেন্ট। রেসপনসিবিলিটি বাড়বে, খরচ বাড়বে। তার সঙ্গে আমাদের সোশ্যাল স্টেটাসের ব্যাপার এসে যাবে। তুমি নিশ্চয়ই চাইবে না তোমার স্বামী কোনও কোম্পানির একজন হ্যা হ্যা ফ্যা ফ্যা এমপ্লয়ি হোক, অফিসে নীচের দিকে কাজ করুক। তুমি চাইবে কি?”

অনন্যা বলেছিল, “তা চাইব কেন? কিন্তু বিয়ে করলে যে প্রোমোশন হয় না, এমনও তো নয়।”

দেবরূপ একটু চুপ করে থেকে দৃঢ় গলায় বলল, “বিয়ে করলে প্রোমোশন হয় না এমন কথা বলিনি। অবশ্যই হয়। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি কনসেনট্রেশন অন্যদিকে ঘোরাতে চাইছি না। কেরিয়ার জীবনের একটা বড় পার্ট। আমি সেই কেরিয়ার গুছিয়ে, হিসেব কষে এগোতে চাই। বিয়ে ক’টা দিন পিছোলেও সেটা থাকবে আমাদের কন্ট্রোলে, কিন্তু প্রোমোশন ফসকালে কতদিন অপেক্ষা করতে হয় জানি না। হয়তো… হয়তো প্রেস্টিজের কারণে আমাকে জব চেঞ্জ করতে হবে। বাইরে চলে যেতে হতে পারে। কী হবে কিছুই আমি জানি না।”

অনন্যা সেদিন চুপ করে গিয়েছিল। যত দিন যাচ্ছে, দেবরূপ তত বেশি হিসেব কষা মানুষ হয়ে যাচ্ছে। শুধু কেরিয়ার নয়। ভালবাসাতেও সে হিসেব করে চলে। বছর দেড়কে আগেও রাত জেগে ফোনে গল্প করেছে। দেখা করতে চাইলে, হাজার ব্যস্ততার মধ্যে চলে এসেছে। গাঁইগুঁই করেও সিনেমা দেখা, শপিং মলে ঘোরার আবদার রেখেছে। এখন ফোনে অত লম্বা কথা হয়ই না। হলেও দুটো কথার পর তার অফিসের নীরস বিষয় ঢুকে পড়ে। দেখা করতে চাইলে আঁতকে উঠে বলে, “উরি বাবা! শনিবার বিকেলের পর বসের পার্টি আছে। মেয়ের জন্মদিন। অফিস থেকে মাত্র চারজনকে ডেকেছে। আমি তাদের একজন। ভাবতে পারছ! মাত্র চারজনের একজন!”

অনন্যা থমথমে গলায় বলে, “গত শনিবার বললে, অফিসে স্টে ব্যাক আছে। রাত পর্যন্ত থাকতে হবে। নতুন প্রজেক্ট এসেছে। আজ বলছ পার্টি। তা হলে আমরা কবে দেখা করব?”

“রাগ কোরো না ডার্লিং। বসের পার্টিতে না থাকা মানে পয়েন্ট কাটা। তুমি কি চাও আমার পয়েন্ট কাটা যাক?”

ফোন কেটে দেওয়ার আগে অনন্যা হতাশ গলায় বলেছিল, “না, আমি কিছুই চাই না। তুমি পয়েন্ট বাড়িয়ে যাও।”

মাসছয়কে ধরে দেবরূপের মধ্যে একটা নতুন ব্যাপার হয়েছে। শরীর নিয়ে উসখুস করছে। উসখুসের সীমাও ভাঙছে। অথচ ক’দিন আগে পর্যন্ত খুব সতর্ক থাকত। হাত ধরা, জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়ার পর এগোত না। এমনও হয়েছে, অনন্যা আরও চেয়েছে! দেবরূপই সরে এসেছে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলত, “ব্যস, এই পর্যন্ত থাক। জামা-কাপড় ঠিক করে নাও।”

অনন্যা গাঢ় স্বরে বলত, “কেন, এই পর্যন্ত কেন? আমরা তো ক’দিন পরে স্বামী-স্ত্রী হব। হব না?”

দেবরূপ শার্টের বোতাম লাগাতে-লাগাতে বলত, “সে তো হবই।”

অনন্যা ঘন হয়ে আসতে চাইত। বলত, “তা হলে সমস্যা কোথায়? আমি তো তোমাকে সবটা দিতে চাই।”

দেবরূপ উঠে দাঁড়িয়ে হেসে বলত, “বাঃ, ভবিষ্যতের জন্য কিছুটা তুলে রাখতে হবে না? সব যদি এখন হয়ে যায়, পরে কীসে ইন্টারেস্ট পাব?”

এখন অন্যরকম হয়ে গিয়েছে দেবরূপ। যেটুকু যা দেখা-সাক্ষাৎ হয়, তার মধ্যে অনন্যাকে শরীরে পাওয়ার জন্য ছটফটানি থাকে। এখন আর শুধু দু’জনে মুখোমুখি বসলাম, সিনেমা দেখলাম, রেস্তোরাঁয় খেলাম-এ সন্তুষ্ট নয়। অনন্যার শরীর দেবরূপকে হাতছানি দেয়।

পুরুষমানুষকে হাতছানি দেওয়ার মতোই অনন্যার সৌন্দর্য। লোকে বলে, মেয়েটার গায়ের রং কালোর দিকে। সেই রংয়ে যেমন জৌলুস আছে, তেমন একধরনের আদিমতাও আছে। যারা প্রশংসা করে তাদের অনন্যা বলে “ওসব কথা বাদ দাও। আমি কালো। এটা সরাসরি বলতে পারছ না। নানা উপমা সাজিয়ে মিথ্যে প্রশংসা করছ। কালোকে বাপু কালোই বলো না।”

অনন্যা মুখে যা-ই বলুক, সত্যি সে সুন্দরী। টিকলো নাক আর থুতনি। চোখে-মুখে এক ধরনের তীক্ষ্ণ ভাব। ঘাড় লম্বা। বড়-বড় চোখ দুটো বুদ্ধিদীপ্ত। সেখানে যৌন আবেদনও রয়েছে। সেই আবেদন উগ্র নয়, কিন্তু নজর এড়ায় না। চেহারা রোগা-পাতলা হলে কী হবে, বুক দুটো সেই তুলনায় বড়ই। সব মিলিয়ে আকর্ষক। সকলে তাই বলেও। আধুনিক মতে সুন্দরী মেয়ে ফর্সা হলে সাজগোজ করতে হয়, সুন্দরী মেয়ের গায়ের রং কালো হলে সেই হ্যাপা কম। এই তত্ত্ব কতটা সত্যি কে জানে, তবে অনন্যার বেলায় সত্যি। সে যা-ই পোশাক পরুক, তাকে মানিয়ে যায়। চোখে কাজল দিয়ে লম্বা বিনুনি করলে মনে হয় ইউনিভার্সিটি যাচ্ছে। আবার জিনস টপ, পনিটলেও ঝকঝকে লাগে। অফিসের পোশাকেও সে স্মার্ট, কনফিডেন্ট। শাড়ি পরে বিয়েবাড়ি গেলে অবিবাহিত ছেলেরা নড়েচড়ে বসে। তবে রূপ-সৌন্দর্য নিয়ে অনন্যার মাথাব্যথা নেই। যার রূপ থাকে তার বোধহয় এমনটাই হয়। পাত্তা না দেওয়াটাও একধরনের চাপা অহংকার হয়তো। যা আছে, তা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার কী? তবে শুধু অহংকার নয়, একধরনের শকোপোক্ত আত্মসম্মান আর সাহসও আছে অনন্যার। স্কুলজীবন থেকেই ছেলেদের প্রেমে ঢুলুঢুলু চোখ, গদগদ চিঠি, নাছোড়বান্দা ঘ্যানঘ্যানানি, ট্রামে-বাসে অসভ্যতা দেখে আসছে। এখনও হয়। খুব চেনা লাকে নোংরা কথা বলে মোবাইলে মেসেজ করে, বাসে কেউ অছিলায় গায়ে হাত দিতে যায়, অফিসে কেউ রেস্তোরাঁয় নিয়ে যেতে চায়। কীভাবে এসব এড়িয়ে চলতে হয়, আর পাঁচজন মেয়ের মতো অনন্যারও খুব ভাল করেই জানা আছে। কখনও কড়া চোখ, কখনও তাচ্ছিল্য, কখনও চাপা ধমক। তেমন হলে চড়ও কষিয়ে দিতে হতে পারে। সেই অভিজ্ঞতাও আছে। একবার নিউ মার্কেটে একজনকে চড় মেরেছিল। বয়স্ক মানুষ। বুকে হাত দিয়ে ভিড়ের মধ্যে মিশে যাচ্ছিল। বুকে হাতটা অনন্যার কাছে বড় ছিল না, বড় ছিল অত বড় একটা মানুষ মেয়ের বয়সির সঙ্গে এই অসভ্যতা কেন করবে? রূপ নিয়ে যেমন নির্লিপ্ত তেমন শরীর নিয়ে ছুঁৎমার্গও আছে অনন্যার। এই ব্যাপারে সে পুরনোপন্থী।

দেবরূপও সেটা জানে। দেবরূপকে সবটুকু দেওয়ার জন্য অনন্যা মাঝে- মাঝে উন্মুখ হলেও তার এই থমকে যাওয়াকে মনে-মনে পছন্দই করেছে। কিছুদিন হল অবস্থা বদলেছে। একমাস বা দু’মাস অন্তর একবার হলেও বন্ধুর গেস্টহাউজ়ে অনন্যাকে নিয়ে যেতে চায় দেবরূপ। প্রতিবার অনন্যা রাজি হয় এমন নয়, তারপরেও সব মিলিয়ে বার-তিন তো গিয়েছেই। দেবরূপের জোরাজুরি যেমন থাকে, এক-আধবার নিজেও টান বোধ করেছে। তবে সে প্রথম দিকে। পরে তার মনোভাব বদল হয়েছে। অনন্যার মনে হয়েছে, শুধু প্রেমিকার সঙ্গে শরীরী মিলন নয়, এই যৌনতার মধ্যে দিয়ে দেবরূপ একধরনের টেনশন রিলিজ করতে চায়। অনন্যার মায়াই হয়েছিল। বেচারি, কেরিয়ারের চাপে নাজেহাল হয়ে রয়েছে। ভালোবাসাবাসির একটা সময়ের পর খানিকটা যেন উন্মত্তের মতোই হয়ে ওঠে ছেলেটা। শরীর নিয়ে ধস্তাধস্তি করে। বুকে, পেটে, তলপেটে মুখ ঘষে। জোরে চেপে ধরে কোমর, কাঁধ। খামচাখামচিও করে অল্পবিস্তর। এই আদরে প্রেম যতটা না থাকে, স্বার্থপরতা থাকে বেশি। কখনও-সখনও তাকে খানিকটা নির্মমও মনে হয় অনন্যার। ভাল না লাগেলও সহ্য করে অনন্যা। দায়িত্ব ভেবেই করেছে। এতে যদি ছেলেটা কিছুটা হালকা হয়, হোক। তার কাছেই তো আসছে। সবকিছু নিজের মনমতো হবে এটাই বা কেমন কথা।

কিন্তু বিষয়টা বিশ্রী চেহারা নিল। এখন দেবরূপের ফোন না ধরার পিছনে সেটাই কারণ।

সতেরো দিন আগের ঘটনা। সেদিন অনন্যা দেবরূপের সঙ্গে শেষবার গেস্ট হাউজ়ে গিয়েছিল। শরীরের ভালবাসা সেদিন খুব খারাপ দিকে মোড় নেয়। দেবরূপের সঙ্গে কুৎসিত ভাবে কথা কাটাকাটি হয়। বিস্মিত ও ভয়ংকর ভাবে অপমানিত হয় অনন্যা। রাগ যতটা না হয়েছে, মানসিকভাবে আঘাত পেয়েছে বেশি। সেদিন নতুন একজন দেবরূপকে চিনতে পেরেছে যেন। তারপর থেকে অনন্যাই যোগাযোগ বন্ধ রেখেছে। দেবরূপও ডাকেনি। মাথা ঠান্ডা করে সময় নিয়েছিল অনন্যা। ভেবেছিল দেবরূপ ক্ষমা চাইবে। ছেলেদের এই এক মিথ্যে অহমিকা। সম্ভোগের তৃপ্তি পাওয়ার জন্য মেয়েদের পায়ে মুখ ঘষতে কোনও লজ্জা নেই, যত লজ্জা ভয়ংকর অপরাধের পর ক্ষমা চাইতে। অনন্যা অত সব ভাবেনি। সে ভেবেছিল হাতে-পায়ে ধরে ক্ষমা না চাক, দেবরূপ মুখে অন্তত বলবে, “খুব ভুল হয়ে গিয়েছে।” দেবরূপ তার মধ্যে যায়নি। তারপরেও ভেবেছে অনন্যা। এবার কী করা উচিত তার? সেই ভাবনা শেষ হয়েছে বলে, আজ ফোন করতে চেয়েছিল।

যেদিন গেস্ট হাউজ়ে যাওয়ার কথা ভাবে দেবরূপ, আগেই মেসেজ পাঠায়। পারলে সাত সকালে। ঘুম ভাঙতে না-ভাঙতেই।

“আজ তোমার ছুটির পর একবার আলিপুর যাব।”

অনন্যা উত্তর লিখত, “কিছুতেই না। আজ আমার সময় নেই।”

দেবরূপ লিখে পাঠাত, “প্লিজ, বেশিক্ষণ লাগবে না।”

অনন্যা জবাবে লিখত, “অসভ্য।”

তারপরে কোনও-কোনওদিন অফিস থেকে বেরিয়ে, খানিকটা এগিয়ে গিয়ে অনন্যা অপেক্ষা করেছে। দেবরূপ গাড়ি নিয়ে এসেছে।

প্রতিবারই অনন্যা প্রোটেকশন নিয়ে নেয়। নিজের জন্য তো বটেই, দেবরূপের জন্যও নিয়েছে। শেষবার কোনও রকম প্রস্তুতিই নেওয়া হয়নি। গেস্ট হাউজ় যাওয়ার ব্যাপারটা আগে থেকে জানতই না সে। ঠিক ছিল, দেবরূপের সঙ্গে গাড়ি নিয়ে কলকাতা ছাড়িয়ে অনকেটা চলে যাবে। লং ড্রাইভ। তারপর ফিরে এসে কোথাও বসে দু’জনে খাবে। দেবরূপ যখন আলিপুরের দিকে গাড়ি ঘোরাল তখনও অনন্যা বুঝতে পারেনি। বুঝতে পারল একেবারে গেস্ট হাউজ়ের মেন গেট দিয়ে গাড়ি ঢাকোর পর। অনন্যা অবাক হয়েছিল।

“এ কী! আজ আবার এখানে কেন?”

দেবরূপ হাসি চেপে গম্ভীর হয়ে বলেছিল, “ছোট একটা কাজ আছে।”

অনন্যা চোখ পাকিয়ে বলল, “কোনও কাজ নেই। তুমি আগে গাড়ি ঘোরাও।”

দেবরূপ হেসে বলল, “তোমাকে নামতে হবে না। আমি যাব আর আসব।”

অনন্যা এই কথা বিশ্বাস করেনি। সে জানত দেবরূপের মতলব আছে। সত্যি তাই হল। গাড়ি পার্ক করে, দরজা খুলে নাটুকে গলায় দেবরূপ বলেছিল, “একটু নামুন ম্যাডাম। এক কাপ চা খেয়ে নিই।”

এরপর আর জোর করে কীভাবে বসে থাকা সম্ভব? গেস্ট হাউজ়ের কর্মচারীরা দেখছে, তারা হাসাহাসি করবে।

আধো আলো আধো ছায়া মাখা ঘরে এসি চলছিল ফিসফিস করে। টপ, শার্ট খুলে শীত-শীতই করছিল অনন্যার। দেবরূপ যখন ছাড়ল অনন্যা চাদর হাতড়াতে-হাতড়াতে বলল, “ইস! আজ কিন্তু ভুল হয়ে গেল।”

দেবরূপ নগ্ন অনন্যাকে এক ঝটকায় নিজের উপর টেনে নিয়েছিল ফের। মুখের ওপর মুখ রেখে বলেছিল, “কীসের ভুল?”

অনন্যা দেবরূপের গায়ের চাদর টেনে নিয়ে আগে কোমরটুকু ঢাকল। বলল, “বুঝতে পারছ না কী ভুল? আজ প্রোটকেশন ছিল না। তুমি তো না বলে নিয়ে এলে, আমি তৈরি হয়ে আসতে পারিনি।”

“আবার কীসের তৈরি! জামা-টামা খুললেই তো তৈরি।”

অনন্যা হাত বাড়িয়ে দেবরূপের নাক নেড়ে দিয়ে বলল, “আবার খারাপ কথা? বলছি না, আজ প্রোটকেশন ছাড়াই ছিলাম দু’জনে।”

দেবরূপ হেসে বলল, “ইস, আমাকে বিশ্বাস করাই তোমার ভুল হয়েছে।”

অনন্যা কোমরের চাদর বুক পর্যন্ত টানতে গেল। পুরোটা পারল না। ডান স্তনের পাশটা দেখিয়ে বলল, “সত্যি তুমি কিন্তু খারাপ হয়ে যাচ্ছ দেব। দেখো, এখানটা কেমন লাল করে দিয়েছ। দেখো একবার। জ্বালা করছে। আগের দিন বাড়ি ফিরে তলপেটে আঁচড় পেয়েছিলাম।”

দেবরূপ অনন্যাকে নিজের বুকের উপর থেকে নামিয়ে বেডসাইডে টেবিল হাতড়ে সিগারেটের প্যাকেট নিল, দেশলাই নিল। সিগারেট ধরাতে-ধরাতে বলল, “ওসব লভ বাইটস। মেয়েদের শরীরে থাকা ভাল।”

অনন্যা আবার উঠে পড়ে দেবরূপের বুকে থুতনি রাখল। গাঢ় গলায় বলল, “আমার শরীর তোমার ভাল লাগে দেব?”

দেবরূপ ধোঁয়া ছেড়ে বলেছিল, “অদ্ভুত প্রশ্ন! ভাল না লাগেল বারবার আসি কেন? আর তোমার? তোমার ভাল লাগে না?”

অনন্যা একটু চুপ করে প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বলেছিল, “নিজেকে হালকা লাগে?”

দেবরূপ অনন্যার গাল টিপে বলল, “ফুরফুরে লাগে।”

অনন্যা বলল, “আমার কিন্তু সত্যি ভয় করছে। কিছু হয়ে গেল অনেক ফ্যাকড়া।”

দেবরূপ মিলনশেষের তৃপ্ত হাসি হেসে বলল, “দুর! কীসের ভয়? আমরা তো প্রেমিক-প্রেমিকা নই, আমরা হলাম স্বামী-স্ত্রী। আমাদের আবার ভুল- ঠিক কী?”

অনন্যা যেন এই সুযোগটার জন্যই অপেক্ষা করছিল। ভুরু কুঁচকে বলল, “বাবুমশাই, তাহলে বিয়েটা সেরে ফললেই তো হয়। পাকাপাকি স্বামী- স্ত্রী হয়ে গেল আর চিন্তা নেই।”

দেবরূপ এবার মাথার তলায় ডান হাতের তালু রেখে খানিকটা উঁচু হয়ে উঠল। চোখ সরু করে বলল, “কী ব্যাপার বলো তো অনন্যা? এক কথা বারবার বলো কেন? কেন আমাকে বিয়ের জন্য প্রেশার দাও? তোমার কি আমাকে সন্দেহ হয়? ভয় করে?”

দেবরূপের এই আকস্মিক আক্রমণে অনন্যা থতমত খেয়ে যায়। শুধু আক্রমণ নয়, বাজে ইঙ্গিতও রয়েছে। এত রেগে যাওয়ার মতো কী বলল সে? বিয়ের কথা বলা কি দোষের? সত্যি তো বাড়িতে চাপ হচ্ছে। আত্মীয়স্বজনরা টুকটাক করে পাত্রের খোঁজখবর আনছে। লেখাপড়া জানা, চাকরি করা, সুন্দরী মেয়ের জন্য ভাল পাত্রেরই খবর আসছে। আসছে বিদেশ থেকেও। কেউ না চাইতেই আসছে। আর একটা ব্যাপার আছে। অনেকে মনে করে, দাদার বিয়েটা যেন তার জন্য আটকে আছে। যদিও দাদা এসব বিষয়ে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কোনও কথাই বলে না। আলোচনা উঠলে হয় অন্য প্রসঙ্গ তোলে, নয় উঠে যায়। বাড়িতে সবাই দেবরূপের কথা জানে। এই ছেলে সম্পর্কে কোনও আপত্তি হওয়ার কারণ নেই। বরং কেরিয়ারমুখী ছেলে জেনে বাবা খুশি। তারপরেও মা মাঝে-মাঝে বলে, “হ্যাঁ রে, আর কত দিন?”

অনন্যা বিরক্ত হয়ে বলে, “ঠিক সময় বলব।”

মা গলায় ঝাঁঝ নিয়ে বলে, “সেই ঠিক সময়টা কখন হবে? গত তিনবছর ধরেই তো শুনছি। তোর তো বয়স হচ্ছে। আর ক’দিন পরেই উনত্রিশে পড়বি।”

অনন্যা বিরক্তি নিয়ে ভুরু তুলে বলে, “কেন, উনত্রিশে বিয়ে করা বারণ নাকি? আজকাল মেয়েরা বেশি বয়সেই বিয়ে করে মা।”

মা কেটে-কেটে বলে, “সে তুই বেশি বয়সে বিয়ে কর। উনত্রিশ কেন উনচল্লিশে করলেই বা আমার কী? তোর বিয়ে, তুই কখন করবি, তুই জানবি। কিন্তু আমাদেরও তো বয়স হচ্ছে। মেয়ের বিয়ে দিতে বাবা-মায়ের অনকে খাটাখাটনি, ছোটাছুটি থাকে। একটা বয়সের পর সেগুলো পারা যায় না। তোর বাবা তো কুটোটি নাড়বে না, সবই তো আমাকে করতে হবে। মনে রাখিস, তোর দাদাও আছে।”

অনন্যা বলে, “এক কাজ করো মা, দাদার বিয়েটা এখনই দিয়ে দাও।”

মা গজগজ করতে বলে, “তুই রাজি করা না।”

অনন্যা বলে, “আমি কেন করাব? বিয়ে নিয়ে তো তোমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। আমার তো হয়নি। মনে হয় না, দাদারও হয়েছে। যাও এখন, আমাকে কাজ করতে দাও।”

মায়ের সঙ্গে রাগারাগি করলেও চাপটা ভিতরে থেকেই যায়। দেবরূপের কাছে প্রকাশও করে ফেলে। এখন যেমন ফেলেছে। তার জন্য দেবরূপ এসব কী কথা বলছে!

অনন্যা বলল, “কীসের ভয়? কাকে ভয়?”

দেবরূপ কর্কশ গলায় বলল, “কীসের ভয় তুমি জানো। তোমার কি মনে হয়, আমি তোমাকে ফেলে পালাব?”

অনন্যা কিছু একটা বলতে গিয়ে থমকে গেল। সে বোঝার চেষ্টা করল, দেবরূপ কি রসিকতা করছে? তাই হবে। এসব কথা রসিকতা ছাড়া কী? মুহূর্তখানকে চুপ করে থেকে অনন্যা জোর করে হাসার চেষ্টা করল। বলল, “তুমি কি ঠাট্টা করছ দেব?”

দেবরূপ বিরক্ত গলায় বলল, “এটা ঠাট্টা করার মতো কোনও সাবজেক্ট বলে তোমার মনে হচ্ছে? তুমি এমন ভাবে বলছ যে আমি তোমাকে ডিচ করব। আমি একটা রাস্তার ছেলে। তোমার শরীরের জন্য তোমার সঙ্গে খেলি।”

অনন্যা ঠোঁট কামড়ে বলল, “তুমি এভাবে কথা বলছ কেন দেব! আমি কি এসব বলেছি?”

“তাহলে বারবার এক কথা কেন? দুটো কথার পরই বিয়ে কবে করব জানতে চাও কেন?”

অনন্যা দেবরূপের পাশ থেকে খানিকটা সরে গেল। থমথমে গলায় বলল, “দুটো কথার পর বলি, এটা ঠিক নয়। আজ প্রসঙ্গটা তুমিই তুলেছ। আর বিয়ে করতে চাওয়াটা ভয় পাওয়া নয়। তা ছাড়া… তা ছাড়া… কীসের ভয়? আমি কি অবলা নারী?

দেবরূপ সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলল, “মাঝে-মাঝে তো সেরকমই মনে হয়। এমন পিউরিটানদের মতো বিহেভ করো।”

অনন্যার মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। খাটের পাশে এসে পা ঝুলিয়ে বসল। দেবরূপের দিকে পিছন ফিরে ব্রা পরতে-পরতে ঝাঁঝালো গলায় বলল, “কেমন হলে পিউরিটান হতাম না? যখন-তখন হাসতে-হাসতে শুতে পারলে? তুমি চাইছ বলে, তা-ও তো করছি। আজকাল তো মনে হয় শোওয়ার জন্যই আমার কাছে আসো৷”

দেবরূপ সিগারেট টেবিলের অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে ব্যঙ্গের গলায় বলল, “চমৎকার বললে কিন্তু। শুধু আমি শুচ্ছি? আর তুমি? তুমি কী করছ? সবই আমার ইচ্ছে, আমার আরাম? তোমার কিছু নয়? তুমি মস্তি পাও না?”

অবাক হয়ে থমকে যায় অনন্যা। এসব কী নোংরা কথা বলছে দেবরূপ! এ তো রাস্তার ছেলেদের ভাষা! অনন্যা ঘাড় ঘুরিয়ে কঠিন গলায় বলে, “মাইন্ড ইয়োর ল্যাঙ্গোয়েজ দেবরূপ। তুমি জানো কী বলছ তুমি?”

“শাট আপ, আমাকে ল্যাঙ্গোয়েজ শেখাতে এসো না।”

দেবরূপ খাট থেকে নেমে পড়ে। উলটো মুখে বসে মাটিতে ফেলে রাখা ইনার, প্যান্ট তুলে নেয়। পরতে-পরতে রাগে গরগর করে ওঠে। বলে, “অবশ্যই জানি আমি কী বলছি। ঠিকই বলছি। নরমাল কথা।”

অনন্যা প্রাণপণে নিজেকে ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করল। একটু চুপ করে থেকে বলল, “আমাকে এভাবে অপমান করার কারণ জানতে পারি?”

দেবরূপ এবার সহজ ভাবে বলল, “একটা সত্যি কথাকে অপমান হিসেবে নিচ্ছ কেন? আর যদি তাই হয়, আমাকেও তো অপমান করেছ। শোওয়া-শুয়ির কথা তুমিই প্রথম তুললে। তুললে না?”

অনন্যা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “যা ঘটছে তাই বলেছি,”বসা অবস্থাতেই দ্রুত হাতে প্যান্টি পরতে থাকে অনন্যা। দেবরূপের সামনে নগ্ন থাকতে তার এবার শুধু লজ্জা নয়, গা ঘিনঘিন করছে। মানুষটাকে অচেনা লাগছে।

দেবরূপ ক্রুদ্ধ গলায় বলে, “কী ঘটছে জানতে পারি?”

“কী ঘটছে জানো না? আজকাল আমার সঙ্গে দেখা করা মানেই তো গেস্ট হাউজ়ে নিয়ে আসা। কখন জামাকাপড় খুলবে।”

দেবরূপ চাপা গলায় হিসহিস করে ওঠে, “হোয়াট ডু ইউ মিন? গেস্ট হাউজ়ে নিয়ে আসা মানে? তুমি ছেলেমানুষ? খুকি? এখানে কী হবে না বুঝে আসো? আমিই শুধু জামাকাপড় খুলি? তুমি সতী সেজে বসে থাকো?”

“ছিঃ! কী মুখের ভাষা করেছ। এ-ও কি তোমার কেরিয়ার তৈরির প্রস্তুতি?”

দু’জন নগ্ন নারী পুরুষ উলটোমুখে বসে যেন একে অপরকে বল্লম দিয়ে খোঁচাচ্ছে। পুরুষের আক্রমণ ধারালো, নির্মম। কে বলবে, খানিক আগেই এই দু’জন মানুষ আদরে, আশ্লেষে, সম্ভোগে মিশে ছিল? নাকি সে-ও ছিল আসলে আক্রমণই?

অনন্যা জিন্‌স পরে, গায়ে জামা দেয়। উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে যায় খাটের পাশে টাঙানো আয়নার সামনে। জামার বোতাম লাগায়। হাত বুলিয়ে এলোমোলে চুল ঠিক করে, টিপ ঠিক করে। বাইরে লোকজন আছে, ঘর থেকে স্বাভাবিক ভাবে বেরোতে হবে। তার কান্না পাচ্ছে। কিন্তু এই মানুষটার জন্য চোখে জল আনতে ঘেন্না করছে অনন্যার। সে দাঁতে দাঁত চেপে কান্না আটকাল।

দেবরূপ রাগে ফোঁস-ফোঁস করতে-করতে বলে, “কী হল, চুপ করে আছ কেন? জবাব দাও। তুমি খুকি?”

অনন্যা ঠান্ডা গলায় বলে, “গলা নামিয়ে কথা বলো। বাইরের লোকজন তোমার ছোটলোকি মার্কা কথা শুনতে পাবে।”

দেবরূপ মুখ দিয়ে আওয়াজ করে বলল, “উউ, আমি ছোটলোক আর উনি বিরাট ভদ্র এসেছেন রে। এখানে কোন ধরনের মেয়েরা ঘরে ঢেকে সবাই জানে।”

অনন্যার মাথা ঝনঝন করে ওঠে। দেবরূপ কী বলছে এসব! যে মেয়েকে সে দু’দিন বাদে বিয়ে করবে তার সম্পর্কে এই ধরনের নোংরা কথা বলতে তার মুখে বাধছে না! দেবরূপ তো এরকম ছিল না। তার ভদ্র মার্জিত ব্যবহারই তো তাকে মুগ্ধ করেছিল। একসময় কেন? আজ খানিক আগেও তো মানুষটা ছিল অন্যরকম। রেগে গেল পুরুষমানুষ এত খারাপ কথা বলতে পারে? নাকি ভিতরে এই নোংরা জিনিসটাই ছিল, আজ বেরিয়ে পড়ল? নাকি বের করল ইচ্ছে করে? অনন্যাকে জোর ধাক্কা দিতে? রাগে, অপমানে মাথা টলমল করছে।

“আমি ভেবেছিলাম, অফিসের চাপে নাজেহাল হয়ে আছ। আমার শরীর তোমাকে সেই টেনশন থেকে খানিকটা রিলিজ় দেয়। আমি সবসময় আপত্তি করিনি। নিজের কথা ভাবিনি। তুমি কীভাবে…”

অনন্যা ফের কান্না সামলাল। দেবরূপ ঘরের দরজার দিকে যেতে-যেতে ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, “ডোন্ট টক রাবিশ। সেই টেনশন রিলিজের জন্য বাজারে ভাড়াটে মেয়েমানুষ পাওয়া যায়। তোমাকে ডাকব কেন? আফটার অল, তারা কাজকর্ম শেষ হলে বিয়ের জন্য ন্যাগ করবে না।”

অনন্যার শরীর কেঁপে উঠল। তার মনে হল, হয় ছেলেটার সত্যি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে, নয় মাথা খারাপের ভান করছে।

আপাতত এই আলোচনা বন্ধ করতে হবে। সে শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “দরজা খোলো। ফিরতে হবে।”

গেস্ট হাউজের ভিতরে কোনও নাটকীয় পরিবেশ তৈরি করেনি অনন্যা। সহজ ভাবে গাড়িতে উঠে দেবরূপের পাশে বসেছিল। গেট থেকে বেরিয়ে গলির মুখ ঘুরতেই ঠান্ডা গলায় বলেছিল, “থামো। আমি এখান থেকে নিজে চলে যেতে পারব।”

ব্যস, তারপর থেকে আর দেবরূপের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি অনন্যা।

অফিস থেকে ফোন করে ক্যাব ডেকে নিয়েছে অনন্যা। কলকাতাটা খুব দ্রুত বদলে গিয়েছে। ক’দিন আগেও ট্যাক্সি পাওয়া ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। ট্যাক্সি ফ্লাইওভারে উঠেছে। অনন্যার ইচ্ছে করছে, সিটে মাথা রেখে চোখ বুজতে। থাক, ড্রাইভারের কৌতুহল হবে। ভাববে নেশা করেছে। পাশের চলন্ত গাড়ির যাত্রীরাও উঁকি মারবে। কলকাতা শহর অনলাইন ক্যাব, ফ্লাইওভারে আধুনিক হওয়ার চেষ্টা করলেও, মনের দিক থেকে এখনও পিছিয়ে। ট্যাক্সিতে একটা ছেলে মাথা এলিয়ে থাকলে সমস্যা নেই, একটা মেয়ে থাকলে কেউ সহজ ভাবে নেয় না। তারপর পোশাক যদি এলোমোলে হয় তা হলে তো পোয়াবারো। অনন্যা আবার মোবাইলে দেবরূপকে ধরতে যায়। এবার ফোন ঢুকেই কেটে গেল। একবার, দু’বার, তিনবার।

অনন্যা সিটের পিছনে মাথা রাখল। দেবরূপ তার মোবাইল নম্বর ব্লক করে দিয়েছে। সে ফোন ধরতে চায় না।

তিনতলা থেকে চাপা কান্নার শব্দ আসছে।

কান্না নয়, ফোঁপানি। ফোঁপানি একটানা চলছে। মনে হচ্ছে, এই কান্না কোনওদিন থামবে না। আওয়াজ জোরে না হলেও অনন্যার অসহ্য লাগছে। কিছু-কিছু আওয়াজ আছে যেগুলো জোরে না হলেও তীক্ষ্ণ। মনে হয়, মাথার ভিতরে কেউ সূচ ফোটাচ্ছে। একঘেয়ে ফোঁপানির মতো একটা আওয়াজ। মাথাটা ভারী হয়ে আছে বলে আরও খারাপ লাগছে। খানিক আগে যন্ত্রণা কমেছে, কিন্তু রেশ রয়ে গিয়েছে এখনও। এটাও কম কষ্টকর নয়।

সন্ধেবলো বাড়িতে এসব কী হচ্ছে! মা নিশ্চয়ই আবার মেয়েটাকে মারধর করেছে। উফ! অনন্যা মাথায় বালিশটা টেনে নিয়ে কানে চাপা দিল। ইদানীং মায়ের এই এক স্বভাব হয়েছে। রেগে গেলই দোপাটির গায়ে হাত তুলে ফেলেছে। নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছে না।

দোপাটি এই বাড়িতে এসেছে এক বছর হতে চলল। সবে ক্লাস ইলেভেনে ভর্তি হয়েছে। এই ক’দিনেই বাড়ির পরিবেশ বিশ্রী করে দিয়েছে। যা-ই হোকে, যোলো-সতেরো বছরের মেয়ের গায়ে হাত তোলা ঠিক নয়। যদিও মেয়েটা খুব পাজি। এতটাই পাজি যে নিজেকে সামলে রাখা কঠিন। মা বলে, “এই মেয়ে পাজি নয়। এই মেয়ে শয়তান।” অনন্যার মাঝে- মাঝে মনে হয়, তা-ই বোধ হয় ঠিক। নইলে এইটুকু মেয়ের মাথায় এত কুবুদ্ধি কীভাবে আসবে! দুষ্টু বুদ্ধি আর কুবুদ্ধি এক নয়। খুব প্যাঁচালো না হলে এই সব ভাবা যায় না। সঙ্গে একধরনের নিষ্ঠুরতা আছে। এ জিনিস বয়ঃসন্ধির সমস্যা নয়, অন্য কিছু। যোলো-সতেরো বয়স তো সে-ও পার হয়েছে। পার হয়েছে দাদা। বন্ধুদেরও দেখেছে। অনকে ‘অন্যায় করতে ইচ্ছে করেছে। আবার নিজেকেই নিজেই আটকেছে। এই মেয়ে অন্যরকম। সামান্য উদাহরণেই বোঝা যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *