হতেছে পাগলের মেলা
কী সাংঘাতিক মেজাজ হয়েছে এ-কালের মানুষজনের।
সাধারণ ভদ্রতা, জিগ্যেস করেছিলুম, ‘কেমন আছেন?’
উত্তর হল, ‘কেমন দেখছ?’ ভারী গম্ভীর গলা।
‘না শুনেছিলুম শরীর খারাপ যাচ্ছে।’
‘যার কাছে শুনেছিলে তাকে জিগ্যেস করো।’
‘আপনার ছেলের কাছে।’
‘সে নিজের বউ আর শ্বশুরবাড়ি ছাড়া আর কারুর খবর রাখে? বাবা অসুস্থ বলেছিল তো? সে এ-বাবা নয় ওই বাবা।’
মানুষের অনেক অভিযোগ। শুধু এ-কালে নয় সর্বকালে। শুধু টাকাপয়সা, মান-সন্মান, যশ খ্যাতিতে মানুষের মন ভরে না। খুব সামান্য, সামান্য জিনিসের অভাবে মনের ভারসাম্য টলে যায়। কেমন আছেন, জিগ্যেস করায় তিনি ক্ষিপ্ত হলেন, তিনি বেশ বুঝে গেছেন, তাঁর ভালো থাকা, মন্দ থাকায় কারুর কিছু যায়-আসে না। বেঁচে থাকাটা সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রয়াস। সেকালের বাসে দুটি কথা লেখা থাকত। একটি হল, ‘পাশেই পকেটমার।’ দ্বিতীয়টি হলে, ‘মাল নিজ দায়িত্বে রাখুন।’ জীবনও মাল। পয়লা নম্বরে মাল। ধরে বসে থাকো জীবনের রেল গাড়িতে।
শ্রদ্ধেয় অখিলবন্ধু ঘোষের অসাধারণ একটি গানের কয়েকটি লাইন স্মৃতিতে জাগছে, সারাটি জীবন ধরে শুধু, মায়া ভরা পৃথিবীতে পেয়েছি যত, তারও চেয়ে বেশি হয় তো হয়েছে দিতে।
সবাই নিচ্ছে। নিঙড়ে নিচ্ছে। কেউ কিছু দিচ্ছে না। এই ক্ষোভ থেকে যত বিক্ষোভ। যার ক্ষোভ তার প্রতিও এই তো একই ক্ষোভ আর একজনের। এই জগতে সবাই তো লেনেওয়ালা। দেনেওয়ালা কে?
খুব আনন্দ করে সব বিয়ে করে। ক্যাসেটের কাটা সানাই। আজকাল আবার নিমন্ত্রণ পত্র হয়েছে পেল্লায়। এক একটার সাইন বোর্ডের মতো সাইজ। বাড়ির সামনে ম্যাটাডর থামল। দুজন আসছে ধরাধরি করে আনছে। ‘দাদা, ছেলের বিয়ে। কোন দেয়ালে ঝোলাব?’
‘দেয়ালে ঝোলাবেন কেন? সে তো একটি মেয়ের গলায় ঝুলবে। গলা তো ঠিক হয়েই আছে।’
‘না, না এই নিমন্ত্রণ হোর্ডিংটা। আমরা একেবারে ফিক্স করে দিয়ে যাব। খুব দামি জিনিস। নামি আর্টিস্টের কাজ। এমনি বোঝা যাবে না। কাছে গেলে তো একেবারেই না। অ্যাবস্ট্রাকট বিয়ের দৃশ্য। অনেকটা দূর থেকে দেখলে দেখবেন, একটা বড় কলাগাছ। একটা বর আছে, একটা বউ আছে, টোপর আছে।’
আর এক বড়লোকের ছেলের বিয়ে। এল রিলিফের কাজ। সিমেন্ট ঢালাই। ওজন কুড়ি কেজি। পালকি, চার বেহারা, ভেতরে বর বউ। ইচ্ছে করলে এটা আপনি দেয়ালে গেঁথে রাখতে পারেন। ‘ওয়ার্ক অফ আর্ট, ভেরি কালারফুল।’ বাবা এসেছেন নিমন্ত্রণ করতে। তাঁর গাড়ির পিছনে পিছনে চলেছে মাঝারি মাপের লরি। লরিতে হাজার পিস কংক্রিট নিমন্ত্রণ পত্র।
পত্র ঢালাই করা যায়, সম্পর্ক যে ঢালাই হতে চায় না কিছুতেই। স্বামী-স্ত্রী যেন ‘সোর্ন এনিমি’। চিড় ধরা ফাউন্ডেশনে কেঁদে ওঠে নবজাতক, নবজাতিকারা। নামিদামি স্কুলে পড়তে যায়। ডিম খায়, ছানা খায়। আর বাবা-মায়ের ফাইটের সাক্ষী হয়।
‘কী সমস্যা আপনাদের?’
কর্তার একাক্ষরী উত্তর, ‘অসহ্য!’
স্ত্রীর একাক্ষরী উত্তর, ‘অমানুষ।’
উভয়ের মিলনে জন্মাল, ‘অসহ্য অমানুষ।’ বন মানুষের বাবা?