হতভাগ্য কাছাড়
প্রশ্ন উঠতে পারে, কাছাড়ের ভাষা আন্দোলন যখন তার চরমে তখন সম্পূর্ণ নীরব থেকে আজ এতদিন পরে সেই পুরনো কাহিনী নিয়ে পড়ি কেন? কাছাড়িতেও আছে,
স্বামী মরল সন্ধ্যা রাত!
কেঁদে উঠল দুপুর রাত!!
(খাস কাছাড়িতে লিখলে পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হতে পারে বলে সংস্কৃত করা হল।)
আসলে তখন ভাষা আন্দোলন রাজনৈতিক রেষারেষি তিক্ততায় রূপান্তরিত হয়েছে, এমনকি কোনও কোনও স্থলে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির আশ্রয় নিয়েছে। অথচ কাছাড়ে কস্মিনকালেও কোনপ্রকারের সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। হিন্দু, মুসলমান, মণিপুরি (তাদের ভিতরেও হিন্দু-মুসলমান দুই-ই আছে), নাগা, লুসাই এবং আরও কত যে জাত-বেজাত কাছাড়ে সখ্যভাবে বসবাস করে সে সম্প্রীতি না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
তখন আমার জানা ছিল, এ আন্দোলন বেশিদিন চলবে না, একটা রফারফি হয়ে যাবেই, এবং তার পর কাছাড়বাসীরা ভাষার কথা বেবাক ভুলে গিয়ে আবার সুখ-নিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়বে। পারি যদি তখন তাকে জাগাবার চেষ্টা করব। সর্বত্রই দেখেছি, পাকা বনিয়াদ গঠনের কাজ আরম্ভ হয় তখনই।
***
কাছাড়ের উত্তর, পুব, দক্ষিণে পাহাড়। তার বেরোবার পথ মাত্র পশ্চিম দিকে পুব পাকিস্তানের সিলেটের ভিতর দিয়ে। সে পথ আজ বন্ধ। হিল সেকশন নামক যে রেলপথটি কাছাড়কে ব্ৰহ্মপুত্ৰ উপত্যকার সঙ্গে সংযুক্ত করেছে সেটি নির্মিত হয়েছিল ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার চা চট্টগ্রাম বন্দর তথা চাঁদপুর হয়ে কলিকাতার বন্দরে পাঠাবার জন্য। ওটা কখনও কাছাড়িদের বিশেষ কোনও কাজে লাগেনি।
এর পূর্বে বলে রাখা ভালো, কাছাড় ঐতিহ্যহীন দেশ নয়। সিলেট-কাছাড়ের ঐতিহ্য একসঙ্গে জড়িত ছিল বলে এতদিন ধরে সবাই সিলেট সিলেট করেছে এবং কাছাড় তারই তলায় চাপা পড়ে গিয়েছিল।
কাছাড়ের বৈশিষ্ট্য এই যে, সে আর্য-সভ্যতার শেষ পূর্বভূমি। এবং বাঙলা ভাষা ও সংস্কৃতির শেষ পূর্ব প্রত্যন্ত প্রদেশ। এর পরই মণিপুর–এরা বৈষ্ণব হলেও এদের রক্ত এবং ভাষা ভিন্ন। তার পর বর্মা। এবং আর্যসভ্যতা বাদ দিয়েও কাছাড়ের প্রাচীন আদিবাসীরাও আপন সভ্যতা নির্মাণ করে গিয়েছেন তার নিদর্শন আজও কাছাড়ে দেখতে পাওয়া যায়। কাছাড়ের রাজারা দীর্ঘকাল পূর্বেই বাঙলা ভাষা গ্রহণ করেন।(১) বস্তুত জয়ন্তিয়া (পাঠান-মোগল কেউই এ রাজ্য অধিকার করতে পারেননি), ত্রিপুরা, কাছাড় ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার আহম রাজারাই আসাম প্রদেশের চারিটি প্রধান রাজবংশ। আমার যতদূর জানা আছে, মণিপুরে বৈষ্ণবধর্ম প্রচার করার সময় কাছাড়কেই কেন্দ্রভূমি করে সে কর্ম করা সম্ভবপর হয়েছিল।
কাছাড়ের নৈসর্গিক দৃশ্য অপূর্ব। যারা হিল-সেকশন দিয়ে রেলেও গিয়েছেন মাত্র, তারাও এ বাবদে আমার মতে সায় দেবেন।
এবং সবচেয়ে বড় কথা, কাছাড়ে জমিদাররা কখনও দাবড়ে বেড়াননি বলে সেখানকার সমাজে অতি সুন্দর গণতন্ত্র প্রচলিত। জমিদার নেই বলে লেঠেলও ছিল না। তাই কাছাড়িরা। বড় শান্ত, নিরীহ। এমনকি সোনাই অঞ্চলে যেসব নাগারা বাস করে তারাও মাঝে-মধ্যে বাঙালি জনপদবাসীর কুকুর ধরে নিয়ে ভোজ-দাওয়াত করলেও এরা দা হাতে করে মানুষের মৃত্যুর সন্ধানে বেরোয় না।
দেশ বিভাগের ফলে কত সহস্র, কিংবা লক্ষাধিক শরণার্থীকে কাছাড় আশ্রয় দিয়েছে সে সম্বন্ধে কেউ উচ্চবাচ্য করে না। পূর্ববঙ্গের রেফুইজিদের আশ্রয় দেওয়ার প্রায় পুরো ক্রেডিট নেন পশ্চিম বাঙলা। শিলঙে অবস্থিত অহমিয়া সরকার বঙাল কাছাড়ের আত্মত্যাগ সম্বন্ধে যে অত্যধিক লম্ফঝম্প করবেন না সে তো বেদ থেকে পাঁচকড়ি দে তক্ স্বর্ণাক্ষরে লেখা আমিও দোষ দিইনে।
বস্তুত চৈতন্যভূমি শ্রীহট্টের শত শত ব্রাহ্মণকে কাছাড় আশ্রয় দিয়ে সংস্কৃত চর্চা যে কতখানি বাঁচিয়ে রাখল তার খতিয়ান হওয়া উচিত। অথচ দেশ বিভাগের ফলে কাছাড়ের সর্বনাশ হয়েছে। তার ধনদৌলত, ধান, কাঠ, ছন, বাঁশ, চা প্রাকৃতিক আরও নানা সম্পদ সবই পাঠানো হত সিলেটের মাঝখান দিয়ে। আজ সে পথ বন্ধ। পূর্বেই বলেছি, তার তিন দিকে পাহাড়। হিল সেকশন দিয়ে যে খর্চা পড়বে তার অর্ধেক মূল্যে এসব বস্তু ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় পাওয়া যায়।
***
দেশ বিভাগের পূর্বে কাহাড়-শ্রীহট্ট অর্থাৎ সুর্মা-উপত্যকার আসাম রাজ্যে প্রধান স্থান দখল করে ছিল। সিলেট পাকিস্তানে চলে যাওয়াতে কাছাড়ের বঙ্গভাষীগণ হয়ে গেল নগণ্যাধম মাইনরিটি এবং যেটুকু তার ন্যায্য প্রাপ্য ছিল তা-ও সে পেল না- সেনসাস নিয়ে কারসাজি করার ফলে।(২)
ইউনাইটেড নেশনস বলেন, তাদের প্রধান সমস্যা, পৃথিবীর সর্বত্র, মাইনরিটি নিয়ে। কাজেই আজ যদি অসমীয়ারা কাছাড়বাসীর মাতৃভাষা ভুলিয়ে সেখানে অসমীয়া চালাতে চান তবে কেউ আশ্চর্য হবেন না। অবশ্য সেটা যে অন্যায় সেকথা নিশ্চয়ই বলতে হবে।
কাছাড়িরা বাঙলা ভাষা ও তাদের বাঙালি ঐতিহ্য কখনও ছাড়তে পারবে না– অহমিয়া ঐতিহ্য অনেকগুণ শ্রেষ্ঠ হলেও পারবে না।
ভাষার ওপর এ অত্যাচার নতুন নয়।
এর বিরুদ্ধে ঔষধ কী?
অধম আকাশবাণীকে বার বার বোঝাবার চেষ্টা করেছে, শিলচরে একটি বেতার কেন্দ্র হওয়ার অত্যন্ত প্রয়োজন। কাছাড়ের লোক সচরাচর ঢাকা বেতার শোনে, কারণ কলকাতার আকাশবাণী সেখানে ভালো করে পৌঁছয় না। গৌহাটি কেন্দ্রের ভাষা অসমীয়া। ওদিকে আরেকটি মজার জিনিস। গৌহাটি কেন্দ্র নাগাকে শান্ত করার জন্য সেখান থেকে প্রচারকার্য করেন। আশ্চর্য হই, তারা আর্তি পান কোথায়? প্রথমত টেপ-রেকর্ডার নিয়ে নাগা অঞ্চলে ঢোকা অনেকখানি হিম্মতের কাজ, দ্বিতীয়ত শুধুমাত্র টেপ-রেকর্ডারের জোরে প্রচারকার্য চলে না। পক্ষান্তরে খাস কাছাড়েই মেলা নাগা রয়েছেন। মাঝখানে পাহাড় আছে বলে গৌহাটির বেতার-গলা, নাগা পাহাড়ে ভালো করে পৌঁছয় না। ওদিকে নাগা পাহাড় কাছাড়ের প্রতিবেশী।
কাছাড়ের দক্ষিণে লুসাই পাহাড়। লুসাইরা নিরীহ। কিন্তু অহমিয়ারা যেভাবে রাজত্ব চালাচ্ছেন তাতে কখন কী হয় বলা যায় না। এখন থেকেই সাবধান হওয়া উচিত। লুসাইদের সর্ব আমদানি-রপ্তানি একমাত্র কাছাড়ের সঙ্গে। লুসাইদের জন্য প্রচারকর্ম করার জন্য শিলচরই সর্বোত্তম কেন্দ্র গৌহাটি বা ব্ৰহ্মপুত্ৰ উপত্যকার অন্য কোনও স্থল নয়।
আরও নানা রাজনৈতিক এবং অন্যান্য কারণ আছে। স্থানাভাব।
শিলচরে এই বেতার কেন্দ্র নির্মাণের জন্য তীব্রকণ্ঠে দাবি জানাতে হবে। জনমত গড়ে তুলতে হবে। আসাম সরকার সাহায্য করবেন না। বাধা দিলে আমি আশ্চর্য হব না, দোষও দেব না।
কিন্তু এ তো বহুবিধ আশ্চর্য তথ্যের মধ্যে সামান্য জিনিস।
আমার মনে পড়ছে, অস্ট্রিয়ার রাজা হাঙ্গেরির ভাষা নিধন করতে চেয়েছিলেন। ফলে বুদাপেস্তের হাঙ্গেরীয় স্টেজ পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই বোধহয় রাজা আপন পায়ে কুড়োল মারলেন। অভিনেতা-অভিনেত্রীরা বেরিয়ে পড়ল জিপসি ক্যারাভানে–শহরে শহরে, গায়ে গায়ে তারা এমন ভাষার বান জাগিয়ে তুলল যে, সমস্ত দেশ মনেপ্রাণে অনুভব করল মাতৃভাষা মানুষের জীবনে কতখানি জায়গা জুড়ে আছে, তার আশা-আকাক্ষা প্রকাশ করার জন্য ওই তার একমাত্র গতি। যে সভ্যতা-সংস্কৃতি সে তার পিতা-পিতামহের কাছ থেকে পেয়েছে, যার কল্যাণে সে সভ্যজন বলে পৃথিবীতে স্বীকৃত হচ্ছে, যাকে সে পরিপুষ্ট করে পিতৃপুরুষের কাছ থেকে ঋণমুক্ত হতে চায় সে তার মাতৃভাষা।
এই তার সময়। ভাষা আন্দোলনের বিক্ষোভ-উচ্ছ্বাসের দুর্দিনে গড়ার কাজ করা যায় না। সে যেন আতসবাজি। সেটা শেষ হলে যে অন্ধকার সেই অন্ধকার। তার পূর্বেই ওরই ক্ষুদ্র শিখা দিয়ে গ্রামে গ্রামে সহস্র সহস্র প্রদীপ জ্বালিয়ে নিতে হয়।
***
এই তার সময়। রাজদরে ভয় নেই, রাজনৈতিক স্বার্থপ্রণোদিত কারসাজি নেই– শান্ত সমাহিত চিত্তে চিন্তা করতে হবে, পরিকল্পনা করতে হবে, অর্থ সঞ্চয় করতে হবে কী প্রকারে মাতৃভাষার গৌরব সম্বন্ধে সর্ব কাছাড়বাসীকে পরিপূর্ণ সচেতন করা যায়।
সেই চৈতন্যের উপরই মাতৃভাষার দৃঢ়ভূমি নির্মিত হবে।
তাই যখন আবার বিপদ আসবে তখন উন্মাদের মতো দিগ্বিদিক ছুটোছুটি করতে হবে না, ভ্যানে করে গ্রামে গ্রামে মাইকে চিৎকার করতে হবে না। গ্রামের লোক নিজের থেকেই সাড়া দেবে। শহরে সীমাবদ্ধ যে কোনও আন্দোলনই সহজে দমন করা যায়। কিন্তু সে যদি গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে তবে তাকে দমন করা অসম্ভব।
এই তার সময়। চিন্তা করুন, গ্রামে গ্রামে কী প্রকারে সে চৈতন্য উদ্দীপ্ত করতে পারি।
কিন্তু সাবধান! সাবধান!! সাবধান!!!
এ আন্দোলন শান্তিময়, গঠনমূলক। এতে কোনও প্রকারের রাজনৈতিক স্বার্থ নেই। এবং সবচেয়ে শেষের বড় কথা–গঠন-কর্ম অগ্রসর হবে অহমিয়া ভ্রাতা, তথা কাছাড়ের কোনও সম্প্রদায় কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতি বৈরীভাব না রেখে।(৩)
————
১. সৈয়দ মরতুজা আলী, A History of jaintia, ও এর লেখা ওই যুগের আসাম ও বাঙলার চার রাজবংশের মধ্যে বাঙলায় লেখা চিঠিপত্র, দলিলদস্তাবেজ সম্বন্ধে একাধিক প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য।
২. আমার অগ্রজ পূর্বোল্লিখিত সৈয়দ মরতুজা আলী আসামে রাজকর্মচারী ছিলেন। তিনি আমাকে ১৯৪১ সালেই(!) বলেন যে, সেনসাস নিয়ে কারসাজি আরম্ভ হয়ে গিয়েছে।
৩. অমিতাভ চৌধুরী, মুখের ভাষা বুকের রুধির।