হঠাৎ দেখা
এভাবে হঠাৎ মেয়ের বিয়ে দিতে হবে, তা সিদ্ধার্থ বা সোহিনী স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি।
একমাত্র সন্তান বিয়ের পর সংসার করার জন্য বরোদায় চলে যাবার পর ওরা দুজনেই নীরবে এক বিচিত্র নিঃসঙ্গতার জ্বালা সহ্য করেন। তারপর আস্তে আস্তে আবার অনেকটা স্বাভাবিক হন।
সিদ্ধার্থ ফ্যাক্টরি থেকে ফিরে ফ্ল্যাটে পা দিয়েই সোহিনীকে চিঠি পড়তে দেখে একটু হেসে জিজ্ঞেস করেন, সায়ন্তনীর চিঠি এসেছে?
উনি প্রায় না থেমেই ডান হাত এগিয়ে দিয়ে বলেন, দেখি, দেখি।
সোহিনী গম্ভীর হয়ে বলেন, এটা ওর পুরনো চিঠি।
ও!
সিদ্ধার্থ একটু হতাশ হয়েই নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যান।
সোহিনী মুখ না তুলেই একটু গলা চড়িয়ে বলেন, শ্রীধর, সাহেবকে চা দাও।
কিচেনের ভিতর থেকেই শ্রীধর জবাব দেয়, দিচ্ছি মেমসাহেব।
চা-সিগারেট খেয়ে সিদ্ধার্থ বাথরুমে যান, স্নান করেন। তারপর পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে আবার ড্রইংরুমে পা দিয়েই থমকে দাঁড়ান। জিজ্ঞেস করেন, কি হল সোহিনী? কি এত চিন্তা করছ?
সোহিনী আপনমনেই একটু হেসে বলেন, ভাবছি, কিভাবে মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেল।
সিদ্ধার্থ একটু হেসে আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে ওর উল্টো দিকের সোফায় বসে বলেন, সত্যি! কি আশ্চর্যভাবে মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেল, তা ভাবলে অবাক হয়ে যাই।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, সায়ন্তনীকে দেখে আমার কত বন্ধুবান্ধব আর সহকর্মী যে ভাই-ভাইপো বা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়েছে, তার ঠিকঠিকানা নেই।…
জানি।
কিন্তু আমি সবাইকে সাফ বলে দিয়েছি, মেয়ে এম. এ পাশ করুক। তারপর চিন্তা করে দেখব, কবে ওর বিয়ে দেওয়া যায়।
শ্রীধর ট্রলি-ট্রেতে হুইস্কীর বোতল, আইস বক্স, ঠাণ্ডা জলের বোতল, গেলাস আর এক প্লেট চীজ পাকৌড়া এনে সেন্টার টেবিলে সব সাজিয়ে রেখে চলে যায়। সিদ্ধার্থ গেলাসে হুইস্কি ঢেলে জল মিশিয়ে নেবার পর ঠিক দুটো আইস কিউব ফেলে এক চুমুক দিয়েই হাসতে হাসতে বলেন, প্রফেসর চিত্রা চৌধুরী এসে সব হিসেবনিকেশ উল্টেপাল্টে দিলেন।
সোহিনীও একটু হেসে বলেন, সব ব্যাপারটা ভাবলে আমার এখনও যেন মনে হয়, স্বপ্ন দেখছি।…
.
সিদ্ধার্থ ফ্যাক্টরিতে, শ্রীধর বাজারে গিয়েছিল আর সায়ন্তনী গিয়েছিল বাণীচক্রে দ্বিজেন মুখার্জীর কাছে গান শিখতে। তাইতো বেল বাজতেই সোহিনীই দরজা খুলে ভদ্রমহিলাকে দেখে অবাক হয়ে তাকায়।
ভদ্রমহিলা এক গাল হাসি হেসে হাত জোড় করে নমস্কার করে বলেন, আমি চিত্রা চৌধুরী। সায়ন্তনী আমার ছাত্রী।
সোহিনীও এক গাল হাসি হেসে বলেন, আসুন। মেমের কাছে আপনার প্রশংসা শুনি না, এমন দিন যায় না।
ঘরের মধ্যে পা দিয়েই মিসেস চৌধুরী বলেন, প্রশংসা করার তো কারণ দেখি না। তবে হ্যাঁ, আপনার মেয়েকে আমি একটু বেশি পছন্দ করি।
মিসেস চৌধুরী সোফায় বসতেই সোহিনী জিজ্ঞেস করেন, কি খাবেন বলুন। ঠাণ্ডা, নাকি গরম?
উনি একটু হেসে বলেন, আমার কথা শুনলে হয়তো আপনি আমাকে সন্দেশ রসগোল্লাও খাওয়াতে পারেন; আবার বাড়ি থেকে তাড়িয়েও দিতে পারেন।
প্লিজ, ও কথা বলবেন না।
সোহিনী মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, আপনি দয়া করে এসেছেন, এ তো আমার পরম সৌভাগ্য।
মিসেস চৌধুরী বলেন, ওসব কথা থাক। আমি কিন্তু এসেছি অনেক আশা নিয়ে। যদি দয়া করে আমার অনুরোধ রাখেন..
আপনাকে আমি দয়া করবো? কি বলছেন আপনি?
হ্যাঁ, ভাই, ঠিকই বলছি।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, সায়ন্তনীকে প্রথম দিন দেখেই মনে একটা স্বপ্ন উঁকি দিয়েছিল। তারপর গত তিন বছরে ওকে যত দেখেছি, আমার তত বেশি ভালো লেগেছে।
সোহিনীও একটু হেসে বলেন, আপনাকে ও যে কি শ্রদ্ধা করে, তা আপনি ভাবতে পারবেন না।
মিসেস চৌধুরী হাসতে হাসতে বলেন, আসল ব্যাপার হচ্ছে, আমরা দুজনেই দুজনকে ভালোবাসি।
ঠিক এই সময় শ্রীধর বাজার থেকে ফিরতেই সোহিনী বললেন, ইনি সায়ন্তনীর প্রফেসর। শিগগির চা-টা দাও।
চা-টা খেতে খেতেই মিসেস চৌধুরী বললেন, আপনি অনুমতি দিলে একটা কথা বলতাম।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলুন। এত দ্বিধা করছেন কেন?
মিসেস চৌধুরী আস্তে আস্তে শুরু করেন, আমার বাবা রিপন কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন; আবার ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতেও লেকচারার ছিলেন। ঠিক দশ বছর হল বাবা মারা গিয়েছেন।
মা বেঁচে আছেন?
না, না; মা অনেক দিন আগেই মারা গিয়েছেন।
উনি চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বলেন, আমরা তিন ভাইবোন। সব চাইতে বড় হচ্ছেন দাদা, তারপর আমি আর আমার ছোট ভাই।
সোহিনী কোনো প্রশ্ন না করে ওর কথা শুনে যান।
দাদা ব্যাঙ্গালোর থাকেন।
উনি কি করেন?
ইন্ডিয়ান ইনিস্টিটিউট অব সায়েন্সের সিনিয়ার সাইনটিফিক অফিসার আর বৌদি একটা কলেজে পল সায়েন্সের লেকচারার।
ওদের ছেলেমেয়েরা কত বড়?
ওদের দুটি মেয়ে। বড় মেয়েটি আমেদাবাদে ন্যাশনাল ইনিস্টিটিউট অব ডিজাইনে এই বছরই ভর্তি হয়েছে আর ছোট মেয়ে নাইন-এ পড়ছে।
সোহিনী বলেন, আমার এক বন্ধুর ছেলেও এনআইডিতে গত বছরই ভর্তি হয়েছে কিন্তু সায়ন্তনীর এক বন্ধু পর পর দুবছর পরীক্ষা দিয়েও ভর্তি হতে পারলো না।
এখানে ভর্তি হওয়া সত্যি খুব কঠিন; তবে একবার ওখানে ঢুকতে পারলে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আর চিন্তা করতে হয় না।
হ্যাঁ, জানি।
সোহিনী মূহুর্তের জন্য থেমে একটু হেসে জিজ্ঞেস করেন, আপনার স্বামীও কি অধ্যাপনা করেন?
মিসেস চৌধুরী একটু হেসে বলেন, না, না, ও ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ফাইনান্স ম্যানেজার।
ছেলেমেয়েরা কত বড়?
আমার দুটি ছেলে। বড়টি দশ বছরের আর ছোটটি নবছরের।
আপনার ছোট ভাই কী করেন?
প্রশ্নটা শুনেই মিসেস চৌধুরীর মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বলেন, ওর কথা বলতেই তো আপনার কাছে এসেছি।
সোহিনী কৌতূহলী দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাতেই উনি বলেন, আমার ছোট ভাই ম্যাসাচুসেটইনিস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে কেমিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিংএ মাস্টার্স করে মাস ছয়েক আগেই ইন্ডিয়ান পেট্রোকেমিক্যালএ জয়েন করেছে।
সোহিনী এক গাল হাসি হেসে বলেন, তার মানে সে তো দারুণ ছেলে।
হ্যাঁ, আমার ছোট ভাই সত্যি অসম্ভব ভালো।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, মাস্টার্সেও অসম্ভব ভালো রেজাল্ট করেছিল বলে এম আইটি ওকে রেখে দেবার জন্য খুব ভালো অফার দিয়েছিল কিন্তু ছোট মামা ওকে দেশে পাঠিয়ে দিলেন।
আপনার ছোট মামাও কি আমেরিকায় থাকেন?
উনি হার্ভার্ড স্কুল অব ম্যানেজমেন্টে আছেন বহুদিন ধরে। ওর জন্যই তো আমার ছোট ভাই এত বছর ধরে আমেরিকায় পড়াশুনা করতে পারল।
মিসেস চৌধুরী প্রায় এক নিঃশ্বাসেই বলেন, আমার এই ছোট মামা তো আমাকেও ওখানে নিয়ে যাবার সব ব্যবস্থা করেছিলেন কিন্তু ঠিক সেই সময় আমার ছেলে হল বলে আমি আর গেলাম না।
ও!
মিসেস চৌধুরী ব্যাগ থেকে একটা ফটো বের করে ওর হাতে দিয়ে বললেন, এই দেখুন আমার ছোট ভাই এর ছবি।
ছবির উপর চোখ রেখেই সোহিনী বললেন, বাবা! দারুণ হ্যান্ডসাম তো।
আমার দাদাকেও দেখতে খুব সুন্দর। তিন ভাইবোনের মধ্যে আমিই শুধু ওদের মত সুন্দর না।
সোহিনী চোখ দুটো বড় বড় করে একটু চাপা হাসি হেসে বলেন, গড়িয়াহাটের মোড়ে সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকলেও তো আপনার মতো একটা সুন্দরী চোখে পড়বেনা। আর আপনি বলছেন…
ওর কথার মাঝখানেই মিসেস চৌধুরী হাসতে হাসতে বলেন, আমার স্বামী তো যখন তখন ছেলেদের বলেন–হারে, তোদের কালো বুড়ি মাকে ডেকে দে তো।
শুনেছি, সুন্দরী চিরযৌবনা স্ত্রীর গর্বে গর্বিত স্বামীরা এইভাবেই কথা বলেন।
ব্যাস! সঙ্গে সঙ্গেই ওরা দুজনে হো হো করে হেসে ওঠেন। ঠিক সেই মুহূর্তে সায়ন্তনী ড্রইংরুমে ঢুকেই ওর পরমপ্রিয় অধ্যাপিকাকে দেখে বিস্ময়মুগ্ধ খুশিতে এক গাল হেসে বলে, আপনি!
মিসেস চৌধুরী হাসতে হাসতে বলেন, কি করবো বলো? তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করল বলেই চলে এলাম।
সায়ন্তনী সলজ্জ হাসি হেসে দৃষ্টি গুটিয়ে নিয়ে মার দিকে তাকিয়ে বলে, তোমাদের হাসি শুনে ভেবেছিলাম, নিশ্চয়ই রত্নামাসী এসেছে।
সায়ন্তনীর হাত ধরে কাছে টেনে নিয়ে পাশে বসিয়ে মিসেস চৌধুরী বলেন, তোমাদের মত ছাত্রীদের জন্য কলেজে হাসাহাসি করতে পারি না বলে কি তোমাদের বাড়িতে এসেও হাসতে পারব না?
মিসেস চৌধুরী দৃষ্টি ঘুরিয়ে সোহিনীর দিকে তাকিয়ে বলেন, আমার ছোট ভাইএর জন্য এই মেয়েটাকে আমার চাই।
সোহিনী অবাক হয়ে বলেন, কি বলছেন আপনি? অত হাইলি কোয়ালিফায়েড ভাই এর জন্য…
কিন্তু আমি যে তিন বছর ধরে স্বপ্ন দেখছি, এই মেয়েটাকে আমাদের চাই।…
.
সিদ্ধার্থ হুইস্কির গেলাসে চুমুক দিয়ে বলেন, যাই বলো সোহিনী, রামানুজের মতো জামাই পাওয়া সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার।
সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। মেয়ের চিঠিগুলো পড়েই তো বুঝতে পারি, ছেলেটা কত ভালো।
যে ছেলেটা এত বছর আমেরিকায় কাটিয়েছে, সে যে ড্রিঙ্ক করে না, তা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না।
চিত্রা তো বলছিল, রামানুজ ঠিক ওর ছোট মামার মতো চরিত্রবান আদর্শবান হয়েছে।
সিদ্ধার্থ হুইস্কির গেলাসে আবার চুমুক দিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলেন, ওরা তিন ভাই বোনই তো ছোট মামাকে দেবতার মতো ভক্তি করে।
ভদ্রলোক নিঃসন্দেহে ভালো। তা না হলে ওরা এভাবে ভক্তি করে?
হ্যাঁ, তা তো বটেই।
দুচার মিনিট দুজনেই চুপচাপ থাকেন।
একটু পরে সোহিনী বলেন, আমাদের মেয়ে তো জাস্ট অর্ডিনারী গ্রাজুয়েট আর মোটামুটি একটু গান জানে। ওর সঙ্গে যে এত গুণী ছেলের বিয়ে হবে, তা আমি ভাবতেই পারিনি।
কিন্তু সায়ন্তনীকে দেখতে তো ভারী সুন্দর।
মেয়ের রূপ থাকলেই যে তার কপালে ভালো বর জুটবে, তার তো কোনো মানে নেই।
সিদ্ধার্থ আবার একটু হুইস্কি খেয়েই সোহিনীর দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলেন, আনন্দদার সঙ্গে শুভশ্রীদির বিয়ের দিন তোমার রূপ দেখেই তো দিদি-জামাইবাবুর মাথা ঘুরে গিয়েছিল। তাই তো…
সোহিনী গম্ভীর হয়ে বলেন, আমার বিয়ের কথা বলো না।
কেন?
তখন আমার বিয়ে করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না।
উনি একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, তোমার বাবা-মা আর দিদি-জামাইবাবুর পাল্লায় পড়ে আমার বাবা-মা এমনই গলে গেলেন যে আমাকে প্রায় জোর করেই বিয়ে দেওয়া হল।
সিদ্ধার্থ সিগারেটে শেষ টান দিয়ে গম্ভীর হয়ে বলেন, আচ্ছা, তুমি কি সত্যি আগে থেকে কিছু জানতে না?
না, কিছুই জানতাম না।
তোমার বাবা-মা আগে থেকে তোমাকে কিছু বলেননি কেন?
বাবা-মা খুব ভালো করেই জানতেন, আমি রিসার্চ শেষ না করে কিছুতেই বিয়ে করবো না।
সোহিনী একটু থেমেই আবার বলেন, বাবা-মা আমার মতামত খুব ভালো করে জানতেন বলে আমাকে কিছু না জানিয়েই ছোট মামার চন্দনগরের বাড়িতে বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। বিয়ের দুদিন আগে ওখানে পৌঁছে দেখলাম, প্যান্ডেল বাঁধা হয়ে গেছে।
সিদ্ধার্থ একটু হেসে বলেন, আসলে তোমার বাবা-মা আমার মতো ছেলেকে হাত ছাড়া করতে চাননি।
তা ঠিক কিন্তু আমি তো তোমার মতো বিলেত থেকে পাশ করা এঞ্জিনিয়ারকে বিয়ে করতে চাইনি। আমি চিরকাল ভেবেছি, একজন অধ্যাপককে বিয়ে করব।
কিন্তু আমি তো তোমাকে ভালোবাসি, তোমাকে সুখেও রেখেছি।
নিশ্চয়ই ভালোবাসো, নিশ্চয়ই সুখে রেখেছ কিন্তু প্রত্যেক মেয়ের মতো আমিও স্বামী সম্পর্কে যে স্বপ্ন দেখেছি, তা তো সম্ভব হল না।
হুইস্কির গেলাসে শেষ চুমুক দিয়ে সিদ্ধার্থ একটু হেসে বলেন, কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় সব ছেলেমেয়েরাই অনেক অবাস্তব স্বপ্ন দেখে। বাস্তব জীবনে ওসব স্বপ্নের কোনো দামই নেই।
সোহিনী একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু ম্লান হাসি হেসে বলেন, যাকগে, ওসব আলোচনা বাদ দাও। এখন তুমিও আমাকে ফেলতে পারবে না, আমি তোমাকে ছাড়তে পারব না।
.
এইভাবেই দিনের পর দিন কেটে যায়। ঘুরে যায় মাসের পর মাস। গ্রীষ্মবর্ষার পর আসে শরৎ। এরই মধ্যে সায়ন্তনীর চিঠি এলে আনন্দে-খুশিতে ফেটে পড়েন ওরা দুজনে। সিদ্ধার্থ ড্রইংরুমে পা দিয়েই জিজ্ঞেস করেন, লেটার ফ্রম মাই বিলাভেড ডটার?
সোহিনী মূহুর্তের জন্য ওর দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলেন, ইয়েস, লেটার ফ্রম মাই বিলাভেড ডটার।
সিদ্ধার্থ সামনের সোফায় বসে জুতা-মোজা খুলতে খুলতে চাপা হাসি হেসে বলেন, তোমার প্রিয় মেয়ের চিঠি একটু পড়ে শোনাবে নাকি?
হ্যাঁ, শোনো।
সোহিনী সঙ্গে সঙ্গেই শুরু করেন শ্রদ্ধেয়া মা, তোমরা যখন হঠাৎ আমার বিয়ে দিলে, তখন মনে মনে একটু ভয়ই পেয়েছিলাম। সত্যি কথা বলতে কি, বিয়ে করার মতো আমার মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। তাছাড়া তখন আমার বয়সই বা কত! তাইতো অনেক শঙ্কা আশঙ্কা নিয়েই বিবাহিত জীবন শুরু করেছিলাম। নিজের মনেই নিজেকে বার বার প্রশ্ন করেছিপারব কি স্বামীকে সুখী করতে? স্বামী কি আমাকে সুখেশান্তিতে রাখবে? আমার দ্বারা কি সাংসারিকসামাজিক দায়দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হবে? আরো কত অসংখ্য প্রশ্ন প্রতি মুহূর্তে আমার মনের মধ্যে উঁকি দিয়েছে।
তারপর দেখতে দেখতে প্রায় একটা বছর কেটে গেল। সামনের বারোই আমাদের বিয়ের এক বছর পূর্ণ হবে। প্রথম বিবাহ বার্ষিকীর ঠিক আগে আজ আমি মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করব, আমাদের বিবাহিত জীবন সত্যি সুখের ও আনন্দের হয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই, আমি আমার স্বামীর জন্য যথেষ্ট গর্বিত। আমাকে নিয়েও তার খুশির সীমা নেই।
শুধু তাই না। দাদা বোম্বে এলেই আমাদের সঙ্গে দুদিন কাটাবার পরই উনি মেয়েকে দেখতে আমেদাবাদ যান! কখনও কখনও আমরাও দাদার সঙ্গে চলে যাই। ঐ দিনগুলো যে আমাদের কি আনন্দে কাটে, তা লেখার ক্ষমতা আমার নেই। শুধু বলবো, দাদা বোধহয় তার প্রাণপ্রিয় ছোট ভাইয়ের চাইতে আমাকেই বেশি স্নেহ করেন। দাদাকে আমি ঠিক তোমাদের মতোই শ্রদ্ধা করি। এই এগারো মাসের মধ্যে দিদি আসতে না পারলেও এরই মধ্যে আমাকে দুটো সুন্দর ব্যাঙ্গালোর সিল্কের শাড়ি পাঠিয়েছেন। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই দিদি আমাকে চিঠি লেখেন। যদি তোমাদের জামাই ছুটি পায়, তাহলে ডিসেম্বরের শেষে আমরা ব্যাঙ্গালোর যাব।
দিদি-জামাইবাবুর দু লাইনের চিঠি পেলাম। কি লিখেছেন জানো? লিখেছেন মাই ডিয়ার ডার্লিং সায়ন্তনী, চিত্রা কলেজে মাস্টারি করে যা আয় করছে, তার বারো আনাই ব্যয় করছে তোমাকে টেলিফোন করার জন্য। আজকাল আমাকে এক প্যাকেট সিগারেটও প্রেজেন্ট করে না। দিস ইজ ফর ইওর ইনফরমেশন ।ইওর বিলাভেড জামাইবাবু।..
এই ক লাইন শুনেই সিদ্ধার্থ হো হো করে হেসে ওঠে। সোহিনী বলেন, এবার চিঠির আসল অংশটা পড়ছি। হ্যাঁ, হ্যাঁ, পড়ো।
উনি এবার চিঠির শেষ অংশ পড়তে শুরু করেন। আমাদের দুজনের শুধু ইচ্ছা নয়, আমাদের দুজনের দাবি, আগামী বারোই আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকীর দিন তোমাদের দুজনকে এখানে আসতেই হবে। তোমাদের কোনো ওজরআপত্তি আমরা শুনব না। আর হ্যাঁ, ছোট মামা আমাদের বিয়ের সময় আসতে পারেননি বলে আগামী নয় বা দশ তারিখে এখানে আসছেন।…
হঠাৎ সিদ্ধার্থকে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখেই সোহিনী জিজ্ঞেস করেন, কি হল? মাথায় হাত দিয়ে বসলে কেন? মাথা ধরেছে?
সিদ্ধার্থ আস্তে আস্তে মাথা নাড়তে নাড়তে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আমি তো যেতে পারব না।
কেন? তোমার তো অনেক ছুটি পাওনা আছে।
উনি অত্যন্ত হতাশার সঙ্গে বলেন, দুবাইতে আমরা যে মেসিনটা পাঠিয়েছি, তার ট্রায়াল শুরু হবে দশ তারিখ। ঐ ট্রায়ালের জন্য এখান থেকে যে তিনজন এঞ্জিনিয়ারকে যেতে হবে, তার মধ্যে আমি একজন।
ইস! কি কাণ্ড! সোহিনী মুহূর্তের জন্যে থেমে জিজ্ঞেস করেন, এ খবর তুমি কবে জানতে পারলে?
দুবাই থেকে কালই ট্রায়ালের দিন জানিয়েছে। চীফ এঞ্জিনিয়ার আজই আমাদের তিন জনকে অফিসিয়ালি জানালেন।
তোমাদের কবে রওনা হতে হবে?
আট তারিখের মধ্যে আমাদের ওখানে পৌঁছতে হবে।
ফিরবে কবে?
ট্রায়াল সাকসেসফুল হলে সাতদশ দিন পরই ফিরতে পারব মনে হয়; যদি কোনো প্রবলেম দেখা দেয়, তাহলে আরো বেশি থাকতে হবে।
সিদ্ধার্থ একটু ম্লান হাসি হেসে বলেন, বারো তারিখে ওদের কাছে থাকতে পারব না ভেবে সত্যি খুব খারাপ লাগছে। তবে ফেরার পথে নিশ্চয়ই ওদের ওখানে যাবো।
তাহলে আমি তোমার সঙ্গেই ফিরব।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি ওখানেই থেকো। তারপর আমরা একসঙ্গে ফিরব।
সেদিন রাত্রে খেতে বসে সিদ্ধার্থ বললেন, সোহিনী, তুমি প্লেনেই যেও।
না, না প্লেনে যাব না; ট্রেনেই যাব।
একলা একলা এত লং জার্নি করা খুব বোরিং হবে।
না, না, বোরিং হবে না। সঙ্গে দুচারটে বই থাকলে সময় বেশ কেটে যাবে।
সোহিনী একটু থেমেই জিজ্ঞেস করেন, এখান থেকে তোমরা কবে রওনা হবে?
বোধহয় ছ তারিখ।
তাহলে ঐ দিনই আমিও রওনা হবো।
সেদিন রওনা হলে আমি তো তোমাকে ট্রেনেও চড়িয়ে দিতে পারব না। তুমি তার দু একদিন আগেই রওনা হবে।
ঠিক আছে তোমার যা ভালো মনে হয়, তাই করো।
পরের দিন অফিস থেকে ফিরেই সিদ্ধার্থ বললেন, সোহিনী, তোমার টিকিট হয়ে গেছে।
কোনো ট্রেনের টিকিট কাটলে?
তুমি পাঁচই এখান থেকে গীতাঞ্জলিতে যাবে। পরের দিন রাত্রে বোম্বে পৌঁছে আমাদের গেস্ট হাউসে থাকবে। তার পরদিন ভোরে গুজরাত এক্সপ্রেসে রওনা হয়ে সাড়ে বারোটায় বরোদা পৌঁছে যাবে।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, যোশী তোমাকে রিসিভ করে গেস্ট হাউসে পৌঁছে দেবে; উনিই আবার পরদিন ভোরে তোমাকে গুজরাত এক্সপ্রেসে চড়িয়ে দেবেন।
সোহিনী বললেন, ঠিক আছে কিন্তু মেয়ে-জামাইকে তো খবর দিতে হবে।
সেটা তো কোনো সমস্যা না। তুমি যদি চাও আজ রাত্রেই ওদের টেলিফোন করতে পারো; নয়তো কাল আমি অফিস থেকে..
না, না, আজই ওদের টেলিফোন করব। ওরা তো আমাদের খবর জানার জন্য হাঁ করে বসে আছে।
হ্যাঁ, সে রাত্রেই খাওয়াদাওয়ার পর সোহিনী মেয়েকে ফোন করেন। সায়ন্তনীই ফোন ধরে।
কে? মা? আমার চিঠি পেয়েছ?
হ্যাঁ, কালই পেয়েছি।
তোমরা আসছে তো?
আমি আসছি কিন্তু তোর বাবা আসতে পারছে না।…
কেন? বাবা আসবে না কেন?
তোর বাবাকে ঠিক ঐ সময় দুবাই যেতে হবে।…
দুচারদিন আগে পরে যেতে পারছে না?
তোর বাবাকে আট তারিখে দুবাই পৌঁছতেই হবে।
সোহিনী প্রায় না থেমেই বলেন, তবে দুবাই থেকে ফেরার সময় তোর বাবা তোদের ওখানে যাবে।
বাবা সত্যিই আসবে তো? নাকি আমাকে ভোলাচ্ছ?
সোহিনী একটু হেসে বলেন, নারে, সত্যি তোর বাবা আসবে। আমি তোর বাবার সঙ্গেই কলকাতা ফিরব।
সায়ন্তনী বেশ অভিমানের সঙ্গেই বলে, বাবা না এলে আমি কিন্তু তোমাকেও যেতে দেব না।
মেয়ের কথা শুনে সোহিনী না হেসে পারেন না। তারপর হাসি থামলে জিজ্ঞেস করেন, রামানুজ কি শুয়ে পড়েছে?
না, না; বাথরুমে স্নান করছে।
খাওয়াদাওয়া হয়েছে?
না, না, ও তো এই মাত্র ক্লাব থেকে ফিরল।
এতো রাত্রে ক্লাব থেকে…
মাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই সায়ন্তনী বলে, টেনিসের কম্পিটিশান চলছে তো! কোনোদিনই দশটাসাড়ে দশটার আগে খেলা শেষ হয় না।
সোহিনী এবার জিজ্ঞেস করেন, তোদের আর কি খবর?
সায়ন্তনী বেশ উত্তেজিত হয়েই বলে, জানো মা, একটু আগেই ছোট মামা কায়রো থেকে ফোন করেছিলেন।
কায়রো থেকে? ওখানে কি উনি বেড়াতে গিয়েছেন?
না, না, বেড়াতে যাননি। উনি একটা কনফারেন্স অ্যাটেন্ড করার জন্য কায়রো গিয়েছেন।
সায়ন্তনীয় মুহূর্তের জন্য থেমে বলে, জানো মা, ছোট মামা মাঝে মাঝেই আমাকে ফোন করেন। উনি এত সুন্দর কথা বলেন যে তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, মা। ওনার কথা শুনেই আমার প্রাণ জুড়িয়ে যায়।
উনি তো ন-দশ তারিখে তোদের ওখানে আসছেন?
ছোট মামা আজই আমাকে বললেন, ওনার পেপার নিয়ে আলোচনা শেষ হলেই ওখান থেকে রওনা হবেন।
তার মানে দুচারদিন আগে বা পরে উনি আসছেন।
না, না, পরে না; বরং দুচারদিন আগেই হতে পারে।
সোহিনী একটু হেসে বলেন, ভদ্রলোকের সম্পর্কে সবাই এত প্রশংসা করে যে ওর সঙ্গে আলাপ করার জন্য আমিও হাঁ করে বসে আছি।
আমি জোর করে বলতে পারি, ছোট মামার সঙ্গে আলাপ করে তোমার খুব ভালো লাগবে।
পরের দিন দুপুর বেলায় হঠাৎ চিত্রা ফোন করেন।
মাসীমা, আপনি বরোদা যাচ্ছেন?
হ্যাঁ।
আমি ঠিক কলেজে বেরুচ্ছি, সেই সময় আপনার জামাই ফোন করে খবর দিল। চিত্রা মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, আপনি আজ কোথাও বেরুবেন নাকি?
না, না, কোথাও বেরুব না। তুমি আসবে?
তিনটের সময় আমার ক্লাশ শেষ হবার পরই আসছি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, এসো।
চিত্রা এলেন প্রায় চারটে নাগাদ। চা-টা খেতে খেতেই কথা হয়।
মাসীমা, আমরা তো যেতে পারছি না। তাই ওদের প্রেজেনটেশনটা আপনার সঙ্গেই পাঠাবো।
হ্যাঁ, তা দিও কিন্তু তোমরা যেতে পারছে না কেন?
এখন আমাদের দুজনের কেউই ছুটি পাবো না।
সপ্তাহ খানেকের জন্যও ছুটি পাবে না?
না, মাসীমা, অসম্ভব। অনার্সের মেয়েদের এখনও কিছু কোর্স বাকি আছে। যেভাবেই হোক মাস দেড়েকের মধ্যে ওদের কোর্স কমপ্লিট করতেই হবে।
তারপর এ কথা-সে কথার পর চিত্রা বলেন, তবে ছোট মামার সঙ্গে আলাপ করে খুব আনন্দ পাবেন।
সোহিনী একটু হেসে বলেন, তোমাদের সবার কাছে ওর এত প্রশংসা শুনি যে ওর সঙ্গে আলাপ করার জন্য আমিও হাঁ করে বসে আছি।
বিশ্বাস করুন মামীমা, নিজের ছোট মামা বলে বলছি না। আজকালকার দিনে ওর মতো মানুষ সত্যি দুর্লভ।
চিত্রা মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, উনি এত বড় পণ্ডিত, বছরে লাখ লাখ টাকা আয় করেন, এত বছর ধরে আমেরিকায় আছেন অথচ ওর মতো সহজ সবল প্রাণবন্ত সাদাসিধে বাঙালি এই কলকাতা শহরেও বিশেষ দেখা যায় না।
উনি না থেমেই বেশ গম্ভীর হয়েই বলেন, তবে ছোট মামার জন্য আমরা সবাই খুব চিন্তিত।
কেন?
বছর চারেক আগে ছোট মামার বাই পাস সার্জারী হয়েছে। তারপর একলা একলা থাকেন। তাই…
সোহিনী অবাক হয়ে বলেন, আমার মেয়ে-জামাই তো এ খবর কোনোদিন জানায়নি।
ছোট মামাই চান না, ওর অসুখের খবর জানিয়ে কাউকে বিব্রত করা হোক। তাই বোধহয় আমার ভাই আপনাদের কিছু বলেনি।
যার বাই পাস সার্জারী হয়েছে, তার তো কখনই একলা থাকা উচিত না।
কিন্তু কি করা যাবে বলুন? উনি তো কিছুতেই বিয়ে করলেন না।
বিয়ে করলেন না কেন?
সোহিনী একবার নিঃশ্বাস নিয়েই আবার বলেন, ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে গেলে মা বাবার কাছে না থাকতে পারে কিন্তু বিয়ে করলে ওর স্ত্রী তো ওর দেখাশুনা করতে পারতেন।
এসব কথা আমরা জানি, উনিও জানেন কিন্তু উনি বিয়ে না করলে আমরা কি করতে পারি?
কিন্তু বিয়ে করলেন না কেন?
চিত্রা এবার একটু হেসে বলেন, ঠিক জানি না; তবে ছোট মামার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছে শুনেছি, উনি ওরই এক সহপাঠিনীকে ভালোবাসতেন কিন্তু ঐ ভদ্রমহিলা অন্য একজনকে বিয়ে করেন বলেই দুঃখে ও অভিমানে ছোট মামা সারাজীবনে বিয়েই করলেন না।
সোহিনীও একটু হেসে বলেন, এ ধরনের ঘটনা তো আকছার ঘটে কিন্তু তাই বলে কি সাধুসন্ন্যাসী হয়ে জীবন কাটাতে হবে?
কেনাকাটা গোছানো-গাছানো আর বাড়ি-ঘরদোরের ব্যাপারে শ্রীধরকে সব বুঝিয়ে দিতে দিতেই মাঝখানের কটা দিন যেন হাওয়ায় উড়ে যায়। তারপর সিদ্ধার্থ ওকে চড়িয়ে দেন গীতাঞ্জলিতে। ট্রেন ছাড়ার আগে সোহিনী বলেন, যদি পারো দুবাইতে পৌঁছে বরোদায় একটা ফোন করো।
হ্যাঁ, করবো
কবে তুমি বরোদায় পৌঁছবে, তাও জানিয়ে দিও।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই জানাবো।
পরের দিন ঘণ্টা খানেক লেটে গীতাঞ্জলি ভি. টি. পৌঁছয়। মিঃ যোশী হাসি মুখে অভ্যর্থনা করে সোহিনীকে গেস্ট হাউসে পৌঁছে দিয়েই বলেন, ভাবীজি, প্লীজ গেট রেডি বিফোর ফাইভ। উই মাস্ট লিভ ফর স্টেশন অ্যাট ফাইভ।
হ্যাঁ, যথা নির্দিষ্ট পৌনে ছটার গুজরাত এক্সপ্রেসে সোহিনী বরোদা রওনা হন। অনেক দিন পর মেয়ে-জামাইকে কাছে পাবার আনন্দে উত্তেজনায় কখন যে সুরাট ভারুচ পার হয়ে যায়, তা যেন উনি খেয়ালই করেন না।
বরোদা!
সোহিনী এক মুহূর্ত দেরি না করে নিজেই সুটকেশ হাতে করে প্ল্যাটফর্মে পা দিতে দিতেই সায়ন্তনী ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে। প্রণাম করে। রামানুজও ছুটে এসে প্রণাম করে। সোহিনী দুহাত দিয়ে দুজনকে একসঙ্গে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেন। আদর করেন।
স্টেশন থেকে গাড়িতে রওনা হবার সঙ্গে সঙ্গেই সায়ন্তনী বেশ উত্তেজিত হয়ে বলে, জানো মা, ছোট মামা এসে গিয়েছেন।
উনি কবে এলেন?
পরশু।
সায়ন্তনী মুহূর্তের জন্য না থেমেই বলে, মা, তুমি ভাবতে পারবে না, ছোট মামা কি দারুণ ভালো মানুষ। আমাকে উনি কি বলে ডাকেন জানো?
কি বলে?
মা আদরিণী!
বা! খুব সুন্দর নাম দিয়েছেন তো তোর।
সায়ন্তনী হাসতে হাসতে বলে, ছোট মামা, একটা বদ্ধ পাগল। উনি আমার জন্য একটা সুটকেশ কিনে সেটা ভর্তি করে শুধু আমারই জন্য কত কী এনেছেন।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
রামানুজের জন্য কিছু আনেননি?
ওর জন্য খুব সুন্দর একটা স্যুট আর দুটো পুলওভার এনেছেন।
দুএক মিনিট চুপ করে থাকার পরই সায়ন্তনী আবার হাসতে হাসতে বলে, জানো মা, ছোট মামা কাল রান্না করে খাওয়ালেন। উনি কি সুন্দর রান্না করেন, তাও তুমি ভাবতে পারবে না।
সোহিনী একটু হেসে বলেন, বেশিদিন বিদেশে থাকলে রান্না করা শিখতেই হয়।
কথায় কথায় রাস্তা ফুরিয়ে আসে। আইপিসিএল কমপ্লেক্সে গাড়ি ঢোকে। স্টাফ কোয়ার্টারগুলো বাঁ দিকে রেখে গাড়ি ডানদিকে ঢুকতেই রামানুজ বলে, মা, এই হচ্ছে আমাদের কলোনী।
সোহিনী একবার চারদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়েই বলেন, বাঃ! খুব সুন্দর কলোনী তো!
সায়ন্তনী সঙ্গে সঙ্গে বলে, হ্যাঁ, মা, আমাদের কলোনীটা রিয়েলী খুব সুন্দর।
গাড়িটা হঠাৎ থামতেই সায়ন্তনী ওর মার হাত ধরে আলতো করে একটু টান দিয়েই বলে, এসো, এসো; এই আমাদের কোয়ার্টার।
ও রামানুজকে বলে, তুমি মার সুটকেশটা নিয়ে এসো।
লনে পা দিয়েই সায়ন্তনী একটু গলা চড়িয়ে বলে, ছোট মামা, শিগগির দরজা খুলুন। মা এসে গিয়েছেন।
ভিতর থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে আসে–আসছি মা আদরিণী।
রামানুজ সুটকেশ নিয়ে পাশে এসে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই ওর ছোট মামা দরজা খুলেই সোহিনীকে দেখে অবাক হয়ে যান। ওকে দেখে সোহিনীও বিস্মিত! কয়েকটা সোনাঝরা মুহূর্তের জন্য দুজনেই দুজনকে মুগ্ধ বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখেন। তারপরই রামানুজের ছোট মামা হাসতে হাসতে বলেন, আরে সোহিনী, তুমি!
সোহিনীও হাসতে হাসতে বলেন, শান্তনু, তুমি রামানুজের ছোট মামা!
বিস্মিত রামানুজ আর সায়ন্তনীর দিকে তাকিয়ে উনি চাপা হাসি হেসে বলেন, আমরা দুজনে একসঙ্গে বি. এ আর এম. এ পড়েছি।
রামানুজ আর সায়ন্তনী আনন্দে খুশিতে হো হো করে হেসে ওঠে। দুজনেই প্রায় এক সঙ্গে বলে, মাই গড! হোয়াট এ প্লেজান্ট সারপ্রাইজ।
একটু পরে চারজনে মিলে কফি খেতে বসার সঙ্গে সঙ্গেই শান্তনু সোহিনীর দিকে তাকিয়ে বলেন, আমারই ভুল হয়েছে। আমারই বোঝা উচিত ছিল, আমার মা আদরিণী শুধু তোমার পেটেই জন্মাতে পারে।
রামানুজ কফির কাপে চুমুক দিয়েই চাপা হাসি হেসে বলে, ছোট মামা, ইউ রিয়েলী থিংক সো?
অব কোর্স।
শান্তনু মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, তোর শাশুড়ি কী অসাধারণ ভালো মেয়ে, তা আমি জানি বলেই…
ওর কথার মাঝখানেই সোহিনী বলেন, হঠাৎ এই বুড়িকে নিয়ে পড়লে কেন? আমি যে কত ভালো বা মন্দ, তা কি আমার মেয়ে জামাই জানে না?
শান্তনু ওর কথার কোনো জবাব না দিয়ে সায়নীর দিকে তাকিয়ে বলেন, মা আদরিণী, একটা গোপন খবর ফাঁস করে দেব?
হ্যাঁ, ছোট মামা, বলুন বলুন।
এই পৃথিবীতে শুধু সোহিনীই জানে, শ্রেয়া আমাকে বিয়ে করলো না বলেই আমি সারাজীবন একলা একলা কাটিয়ে দিলাম।
সোহিনী বলতে পারলেন না, কালিম্পং-এর সেই অবিস্মরণীয় রাত্রে শান্তনু ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, এই পৃথিবীতে তোমার চাইতে কেউ শ্রেয় নেই বলেই আজ থেকে তোমাকে শ্রেয়া বলে ডাকবো।
উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, শান্তনু, তুমি জানো না, বিয়ের পর পরই শ্রেয়া মারা গেছে?
শান্তনু এক গাল হেসে বললেন, না, না, সোহিনী, আমার শ্রেয়া মরতে পারে না। ‘রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে’।