হজরত সৈয়দ নিজাম উদ-দীন চিশতি

হজরত সৈয়দ নিজাম উদ-দীন চিশতি

সুলতান উল্-মশায়িখ (গুরু-সম্রাট), মহবুব-ই-ইলাহি (খুদার দোস্ত), হজরত সৈয়দ নিজাম উদ-দীন চিশতি, শেখ উল্-আওলিয়ার (গুরুপতি) ৬৪৬ পরলোকগমনোসব (উ) নিজাম উদ্-দীন দর্গায় মহা সমারোহের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়েছে।

রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ মহাশয় অনুষ্ঠানে সভাপতি হবেন বলে কথা ছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে তার শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ায় মৌলানা আবুল কালাম আজাদ সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি স্বহস্তে উর্দুভাষায় একখানি চিঠি লিখে তার অনুপস্থিতির জন্য দুঃখ জানান এবং শেখ নিজাম উদ-দীনের জীবনী সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আলোচনা করেন। রাষ্ট্রপতি সচরাচর হিন্দিতে চিঠিপত্র লিখে থাকেন বলে উর্দু-প্রেমী সভাস্থ হিন্দু-মুসলমান-শিখ-খ্রিস্টানগণ উর্দুর প্রতি তার এই সহৃদয়তা দেখে ঘন ঘন উল্লাস প্রকাশ করেন।

***

আফগান রাজদূত বলেন, শেখ নিজাম উদ-দীন আফগান এবং ভারতের সম্মিলিত আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতীক। খুরাসান-হিরাতে একদা সুফিতত্ত্বের যে চিশতি-সম্প্রদায় সৃষ্ট হয় নিজাম উদ-দীন সেই সম্প্রদায়ের অসাম্প্রদায়িক বাণী এদেশে প্রচারিত করেন। আফগান রাষ্ট্রদূত প্রদত্ত নিজাম উদ-দীনের পটভূমি এবং ইতিহাস বর্ণন পাণ্ডিত্যপূর্ণ এবং অতিশয় মনোরম হয়েছিল।

মিশরের রাজদূত বলেন, নিজাম উদ-দীনের বাণী সর্বসম্প্রদায়ের ভেদের অতীত ছিল বলেই তাঁর চতুর্দিকে হিন্দু-মুসলমান-শিখ সমবেত হয়েছিলেন।

আজকের দিনের ভারতীয় রাষ্ট্রও সেই ধর্ম-নিরপেক্ষ ভিত্তিতে গড়া বলে সে রাষ্ট্র ভারতের ভেতরে-বাইরে বিশেষ করে মিশরে এতখানি আদৃত হয়েছে। নানা সম্প্রদায়ের লোক সভাতে উপস্থিত ছিলেন বলে তারা মিশর-রাষ্ট্রদূতের এই উক্তিতে ঘন ঘন করতালি দেন।

ইরাকের রাজদূত বলেন, আজ পৃথিবী আরেক বিশ্বযুদ্ধের সামনে এসে পড়েছে। আজকের দিনে সবচেয়ে বেশি দরকার শান্তির বাণী প্রচার করা। খাজা নিজাম উদ-দীন ইসলামের শান্তির বাণী প্রচার করেছিলেন বলেই তিনি সব সমাজের এতখানি শ্রদ্ধা পেয়েছিলেন।

ইরাকি এবং মিশরি রাষ্ট্রদূত দুজনেরই মাতৃভাষা আরবি। তারা ইংরেজি ভাষণের ফাঁকে ফাঁকে বিশুদ্ধ উচ্চারণে কুরান থেকে কয়েকটি আয়াত উদ্ধৃত করেন। দিল্লির হিন্দু-মুসলমান শিখ অনেকেই আরবি জানেন, অন্তপক্ষে কুরান-তিলাওত (কুরান-পাঠ) শুনতে অভ্যস্ত। এদের কুরান উদ্ধৃতি ও মধুর আরবি উচ্চারণ শুনে সকলেই বড় আনন্দ লাভ করেন।

পাকিস্তানের রাজদূত যুক্তপ্রদেশবাসী- তাই তাঁর উর্দু উচ্চাঙ্গের। তিনি উর্দুতে বক্তৃতা দিলেন বলে জনসাধারণের সুবিধে হল। আর উর্দু সাহিত্যিক যারা ছিলেন, তাদের তো কথাই নেই। পাকিস্তানের রাজদূত বলেন, আমরা নিজাম উদ-দীনের বাণী জীবনে মেনে নিলে সাম্প্রদায়িক দ্বেষ-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত হতে পারব।

সর্বশেষে মৌলানা সাহেব বক্তৃতা দেন। মৌলানা সাহেবের উর্দু ভাষার ওপর যা দখল তার সঙ্গে আর কারও তুলনা হয় না। বক্তা হিসেবেও তার জুড়ি এ দুনিয়ায় আমি দু একজনের বেশি দেখিনি। উচ্চারণ, বলার ধরন, শব্দের বাছাই, গলা ওঠানো-নামানো, যুক্তিতর্ক উপমার সিঁড়ি তৈরি করে করে ধাপে ধাপে প্রতিপাদ্য বিষয়ের দিকে গুরুচণ্ডাল সবাইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এসব তাবৎ বাবদে তিনি ভারতবর্ষের যেকোনো বক্তার সঙ্গে অনায়াসে পাল্লা দিতে পারেন।

মৌলানা সাহেব বললেন, নিজাম উদ-দীনের বাণী যে কতখানি সফল হয়েছে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ চোখের সামনেই। এই যে হিন্দু-মুসলমান-শিখ-খ্রিস্টান এখানে আজ ভক্তিভরে সমবেত হয়েছে তার থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়, তাঁর বাণী সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে ছিল– তিনি ইসলামের সেই শিক্ষাই নিয়েছিলেন, যে শিক্ষা কোনও বিশেষ ব্যক্তি, সমাজ বা ধর্মের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট নয়, সে শিক্ষা সর্বধর্মের প্রতি সমান ঔদার্য দেখায়, তার নীতি এবং দণ্ড হিন্দু-মুসলমান-শিখ সকলের ওপর সমভাবে প্রযোজ্য।

***

অনুষ্ঠানটি হয়েছিল নিজাম সাহিত্যসভার আমন্ত্রণে। এক কাশ্মিরি ব্রাহ্মণ (পণ্ডিত) যুবক সভার সম্পাদক। তিনি বিশুদ্ধ উর্দুতে যে একখানা আমন্ত্রণরচনা পাঠ করলেন, তা শুনে মনে হল অতখানি বাংলা জানলে রায় পিথৌরা বাংলা দেশে নাম করে ফেলতে পারতেন।

***

নিজাম উদ-দীন বাঙলা দেশে বিখ্যাত হয়েছেন দৃষ্টিপাতের মারফতে। গিয়াস উদ-দীন তুগলুক শার সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্য আর দিল্লি দূর অস্ত গল্প এখন সকলেই জানেন।

৬৩৪ হিজরার (ইং ১২৩৬) সফর মাসে নিজাম উদ-দীন বুদায়ুনে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম মুহম্মদ, পিতার নাম আহমদ। তার পাঁচ বছর বয়সে বাপ মারা যান, মা তাকে মানুষ করেন। পঁচিশ বছর বয়সে তিনি দিল্লিতে এসে গিয়াসপুর গ্রামে আস্তানা গাড়েন (হুমায়ুনের কবরের পুব-উত্তর কোণে এখনও সে ঘরটি আছে: এবং পাক-পট্টনের সিদ্ধ-পুরুষ বাবা ফরিদ শকর-গঞ্জের কাছে দীক্ষা নিয়ে আবার দিল্লিতে ফিরে আসেন।

চিশতি সম্প্রদায়ের তিন মহাপুরুষ ভারতবর্ষে সুপরিচিত। আজমির শরিফের খাজা মুইন উদ-দীন চিশতি ভারতে চিশতি সম্প্রদায়ের প্রবর্তক। ভারতীয় মুসলমানের কাছে মক্কা-মদিনার পরই আজমির তৃতীয় তীর্থ, বহু হিন্দুর কাছে কাশী-বৃন্দাবনের পরই আজমির শরিফ।

মুইন উদ-দীনের পরেই তাঁর সখা কুত্ত্ব উদ-দীন বস্তৃতিয়ার কাকি। ইনি ম্রাট ইলতুৎমিসের (অলতমাশ) গুরু ছিলেন এবং দিল্লির অধিকাংশ পণ্ডিতের বিশ্বাস কুতুব মিনার দাসবংশের প্রতিষ্ঠাতা কুত্ত্ব উদ-দীন আইবকের নামে বানানো হয়নি বানানো হয়েছিল পীর কুত্ত্ব উদ-দীন বখতিয়ার কাকির নামে। এঁর দরগাহ কুতুবমিনারের কাছেই। সেখানে শেষ মুগল বাদশার অনেকেই দেহরক্ষা করেছেন। প্রতি বৎসর সেখানে দরগার চতুর্দিকে। ফুলের মেলা বসে।

তার পরই বাবা ফরিদ উদ-দীন শকর-গঞ্জ।

***

সুলতানা রিজিয়ার ভগ্নীপতি গিয়াস উদ-দীন বলবন থেকে আরম্ভ করে মুহম্মদ তুগলুক পর্যন্ত বহু বাদশাই নিজাম উদ-দীনের শিষ্য ছিলেন। রাজাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হৃদ্যতা তাঁর ছিল আলাউদ্দীন খিলজি, খিজুর খান (এই খিজর খান এবং দেবলা দেবীর প্রেমের কাহিনী সম-সাময়িক কবি আমির খুসরৌ ফারসি ভাষায় লেখেন একথা বাঙালির কাছে অজানা নয়– আকবর বাদশাহ প্রায় তিন শতাব্দী পরে বাঙলা দেশে জলবিহারের সময় এই কাব্য শুনে মুগ্ধ হন) এবং মুহম্মদ তুগলুকের সঙ্গে আলাউদ্দীন খিলজিকে পীর নিজাম উদ-দীন মঙ্গোল আক্রমণ থেকে বাঁচিয়ে দেন- মুহম্মদ তুগলুকের সঙ্গে তার হৃদ্যতার প্রধান কারণ ধর্মশাস্ত্রে উভয়ের গভীর পাণ্ডিত্য। মুহম্মদ তুগলুককে সাধারণত পাগলা রাজা বলা হয়, কিন্তু তার আর যে দোষই থাকুক তিনি সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্ত ছিলেন। মোল্লারা তাকে জেহাদের জন্য ওসকাতে চাইলে তিনি শাস্ত্ৰবিচারে তাদের ঘায়েল করে ঠাণ্ডা করে দিতেন।

কিন্তু পীরের সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিল তার মিত্র এবং শিষ্য কবি আমির খুসরৌর সঙ্গে। খুসরৌর পরিচয় এখানে ভালো করে দেবার প্রয়োজন নেই। ভারত-আফগানিস্তানের সুরসিক জনমাত্রই তাকে প্রাতঃস্মরণীয় কবিরূপে স্বীকার করে থাকেন।

পীর নিজাম উদ-দীনের সঙ্গে বরঞ্চ জলাল উদ-দীন খিলজি এবং গিয়াসউদ-দীন তুগলুকের প্রচুর মনোমালিন্য ছিল কিন্তু খুসরৌকে সম্মান এবং আদর করেছেন বব থেকে আরম্ভ করে মুহম্মদ তুগলক পর্যন্ত সব রাজাই। এমনকি যে গিয়াস উদ-দীন তুগলুক নিজাম উদ-দীনের কুয়োর কাজ বন্ধ করে দেবার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছিলেন তিনি পর্যন্ত খুসরৌকে সভাস্থলে বিস্তর ইনাম-খিলাত দেন।

মুহম্মদ তুগলুক পণ্ডিত ছিলেন, তাই তার লাইব্রেরিখানা ছিল বিশাল– মুহম্মদ সেই লাইব্রেরি দেখাশোনার ভার দেন খুসরৌকে। ঐতিহাসিক জিয়া উদ-দীন বরণী আর খুসরৌ সঙ্গে না থাকলে মুহম্মদ হাঁপিয়ে উঠতেন। বাঙলা দেশ যাবার সময় মুহম্মদ মিত্র খুসরৌকে সঙ্গে নিয়ে যান এবং সেখানে লেখনাবতীতে থাকাকালীন খবর পৌঁছল নিজাম উদ-দীন দেহরক্ষা করেছেন।

***

বজ্রাঘাত বললে কম বলা হয়। খুসরৌকে কোনওপ্রকারেই সান্ত্বনা দেওয়া গেল না। সর্ব বেচে দিয়ে উন্মাদের মতো দিল্লির দিকে রওনা হলেন। সেখানে তাঁর পৌঁছনোর খবর পেয়ে তাঁর অসংখ্য মিত্র ছুটে গেলেন তাঁকে সান্ত্বনা দেবার জন্য। নিজাম উদ-দীনের পরেই পীর হিসেবে দিল্লির আসন তখন নিয়েছেন খাজা নসির উদ-দীন চিরাগ দিল্লি অর্থাৎ দিল্লির প্রদীপ-কুত সাহেব আর নিজাম উদ-দীনের পরেই তার দর্গা দিল্লিতে প্রসিদ্ধ এবং ইনি ছিলেন খুসরৌর পরম মিত্র। তিনি পর্যন্ত খুসরৌকে তাঁর শোক ভুলিয়ে সংসারে আবার ফিরে নিয়ে যেতে পারলেন না।

আচ্ছন্নের মতো খুসরৌ দিবারাত্রি নিজাম উদ-দীনের কবরের পাশে বসে সেদিকে তাকিয়ে থাকতেন। দীর্ঘ ছয় মাস কাটানোর পর তাঁর প্রতি খুদার দয়া হল। ২৯ জুল কিদা ৭২৫ হিজরিতে (ইংরেজি ১৩২৫) মৃত্যু তাঁকে তাঁর গুরু এবং সখার কাছে নিয়ে গেল।

খুসরৌ বাণীর একনিষ্ঠ সেবক ছিলেন বলে হিন্দুর বসন্ত পঞ্চমী উৎসবে প্রতি বৎসর যোগ দিতেন।

এখনও প্রতি বৎসর দিল্লির হিন্দু-মুসলমান বসন্ত পঞ্চমী দিনে নিজাম উদ-দীনের দর্গায় সমবেত হয়ে খুসরৌকে স্মরণ করে।

***

দিল্লির বাদশা মুহম্মদ শা, দ্বিতীয় আকবরের (ইনিই রামমোহনকে বিলেত পাঠান) পুত্র মিরজা জাহাঙ্গির, ঐতিহাসিক বরণী, আকবরের প্রধানমন্ত্রী আগা খান (হুমায়ুন কৃতজ্ঞ হয়ে এঁর স্ত্রীকে আকবরের দুধ-মা নিযুক্ত করেছিলেন), আকবরের দুধ-ভাই আজিজ কোকতাশ, নাদির শার এক পুত্রবধূ যিনি দিল্লিতে মারা যান, এরকম বহু লোক তাদের দেহরক্ষা করেছেন পীর নিজাম উদ-দীনের গোরের আশেপাশে। স্থাপত্যের দিক দিয়ে এঁদের অনেকেরই কবর তুলনীয় সেকথা আরেকদিন হবে।

***

নিজাম উদ-দীনের দরগায় গোরের জায়গা যোগাড় করা সহজ নয়। সম্রাটনন্দিনী জাহানারার গোর এখানেই। দৈর্ঘ্যে ১৩ ফুট ৯ ইঞ্চি, প্রন্থে ১১ ফুট ৬ ইঞ্চি। এইটুকু জায়গায় জন্য তিনি তিন কোটি টাকা দাম হিসেবে রেখে দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেব শাস্ত্রবচন উদ্ধৃত করে প্রমাণ করলেন, ভ্রাতার হক দুই-তৃতীয়াংশ টাকার ওপর। তাই তিনি দাম দিলেন এক কোটি।

কবরের কাছে ফারসিতে লেখা :

বগৈরে সবজে ন পুশদ কসি মজার মরা,
 কে কর-পুশে গরিবা হমি গিয়া বস্ অন্তু।
বহুমূল্য আভরণে করিয়ো না সুসজ্জিত
কবর আমার
 তৃণ শ্রেষ্ঠ আভরণ দীনা আত্মা জাহানারা
সম্রাট-কন্যার।

[আনন্দবাজার পত্রিকা ২৩.০১.১৯৫২]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *