হক-বিরোধী ষড়যন্ত্র

হক-বিরোধী ষড়যন্ত্র

১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ৫ ও ৬ এপ্রিল-এলাহাবাদে সারাভারত মুসলিম লিগের অধিবেশন বসে। এই অধিবেশনে একটি প্রস্তাবে ফজলুল হককে লিগ থেকে বিতাড়িত করার জন্য জিন্নার ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। ইতিপূর্বেই জিন্না ফজলুল হক পরিচালিত মন্ত্রীসভা খারিজ করে লিগ মন্ত্রীসভা কায়েম করার চেষ্টা করেন। কংগ্রেসের সক্রিয় সম্পাদনা পাওয়ায় ফজলুল হক নিজের অসুবিধা বুঝতে পারেন। আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও লিগের বিরোধিতার জন্য তিনি অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হন। বস্তুত লিগ তখন বাংলার মুসলমানদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় হয়। নানা কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বাংলার বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে হক-মন্ত্রীসভা কৃতকার্য হয়নি। খাদ্যদ্রব্যের মূল্য ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। গ্রামবাংলায় দুর্ভিক্ষের পদধবনি শোনা যায়। তা ছাড়া ফজলুল হকের পক্ষে ‘প্রোগ্রেসিভ মুসলিম লিগকে’ বাংলাদেশে সংগঠিত করাও সম্ভব হয়নি। কাগজে-কলমেই এই সংগঠনের অস্তিত্ব টিকে ছিল। এই অবস্থায় ফজলুল হক ভাবলেন যে, তিনি যদি মুসলিম লিগে প্রবেশ করেন তাহলে হয়তো জিন্না বাংলাদেশ ও বাঙালির ক্ষতিসাধন করতে সক্ষম হবেন না। তাই ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৩ নভেম্বর জিন্নার নিকট একটি চিঠিতে ফজলুল হক পুনরায় তাঁর সমর্থকদের নিয়ে লিগে যোগদান করবার বাসনা প্রকাশ করেন। এই বিষয় নিয়ে হক-জিন্না সাক্ষাৎকারও ঘটে। জিন্না কয়েকটি শর্ত আরোপ করেন। তা হল:

১ ফজলুল হক লিগের বিরুদ্ধে যেসব কাজ করেছেন তাঁর জন্য তাঁকে দুঃখ প্রকাশ করতে হবে।

২ প্রগ্রেসিভ কোয়ালিশন পার্টি ভেঙে দিতে হবে।

৩ মুখ্যমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করতে হবে। এই কয়েকটি শর্ত পূরণ করার পরই ফজলুল হক ও তাঁর সমর্থকদের মুসলিম লিগের সদস্য হবার অনুমতি দেওয়া হবে। তার পূর্বে নয়।

ফজলুল হক প্রথম শর্তটি সম্পর্কে জিন্নাকে লেখেন, গত পনেরো মাসের দুঃখজনক ঘটনার জন্য তিনি মোটেই দায়ী নন। বরঞ্চ তাঁর উপর অনেক অবিচার করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শর্ত মেনে নিতে তিনি রাজি আছেন যদি মুখ্যমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ও তাঁর সমর্থকদের উপর লিগে প্রবেশ করবার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। তিনি মুসলিম লিগে ফিরে আসার পর আইন সভার মুসলমান সদস্যরা দলীয় নেতা নির্বাচিত করবেন এবং মন্ত্রীসভা কী ধরনের হবে তাও ঠিক করবেন। তিনি আশা করেন, যতক্ষণ পর্যন্ত এই মন্ত্রীসভা জিন্না কর্তৃক নির্ধারিত নীতি মেনে চলবে ততক্ষণ পর্যন্ত জিন্না যেন কখনোই নিজের সিদ্ধান্ত বাংলার মন্ত্রীসভার উপর চাপিয়ে না দেন। কারণ তার ফলে সকল সম্প্রদায়ের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে। ফজলুল হক পরিষ্কার করে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি চিঠিতে জিন্নাকে লেখেন:

If I come back to the League, it will be a matter of party politics in Bengal for Muslim members and Muslim leaders to determine as to who should be the chief and what should be the composition of the Bengal Cabinet. So long as we do not contravene the rules and principles you have laid down, I hope you will not impose your decision on the steps we may take in Bengala for securing the best possible administration for all communities in the country.

সুতরাং, লিগে প্রবেশ করার আবেদন করেও ফজলুল হক বাংলার সকল সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষার কথা বলছেন। তাঁর এই মনোভাবের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন জিন্না। তাই ১০ ফেব্রুয়ারি জিন্না ফজলুল হককে একটি দীর্ঘ চিঠিতে পরিষ্কার করেই জানিয়ে দেন যে, লিগের প্রেসিডেন্ট অর্থাৎ তিনিই প্রাদেশিক কমিটি ও আইনসভার অভ্যন্তরে লিগ সদস্যদের পরিচালনার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ফেব্রুয়ারি সারাভারত মুসলিম লিগ কাউন্সিল ওয়ার্কিং কমিটির যে প্রস্তাবে সম্মতি জানায় তাও জিন্না এই পত্রে উদ্ধৃত করেন:

The Working Committee hereby empower the President to advise, guide and issue instructions to Muslim League Parties in the various provincial legislatures in the event of some sudden emergency arising. The Muslim League Parties shall give effect to or carry out such instructions as may be given by the President.

তা ছাড়া জিন্না ফজলুল হকের চিঠির ভাষা ও মনোভাবে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। উপরে উদ্ধৃত ফজলুল হকের চিঠির অংশ তাঁর কাছে বোধগম্য নয় বলেই জিন্না উল্লেখ করেন। জিন্না এই চিঠি দেবার পর একটি টেলিগ্রামও ফজলুল হককে পাঠান। তাতে অবিলম্বে তাঁর চিঠির উত্তর দাবি করেন এবং ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ যাতে না থাকে সেজন্য তিনি তাঁর সঙ্গে যেসব পত্রালাপ হয়েছে তাও প্রকাশ করে দিচ্ছেন, সে-কথা জানিয়ে দেন। ফজলুল হকের অনুমতি না নিয়ে এবং চিঠির উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে এই পত্রাবলি প্রকাশ করা যে দুরভিসন্ধিমূলক ছিল সে-বিষয়ে সন্দেহের কোন কারণ নেই। তখন বাংলাদেশের কাউন্সিলের (আইনসভার উচ্চ কক্ষ) ছয়টি আসন দখলের জন্য প্রগ্রেসিভ কোয়ালিশন পার্টি ও মুসলিম লিগ পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়। কাজেই ফজলুল হকের দলকে অসুবিধায় ফেলার জন্য এই চিঠিপত্র প্রকাশ করে দেওয়া হয়। ১৭ ফেব্রুয়ারি ফজলুল হক জিন্নার নিকট প্রেরিত এক চিঠিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং নিজের মতামত ব্যাখ্যা করেন। ফজলুল হক স্পষ্ট করেই লেখেন যে, তাঁকে ও তাঁর সহকর্মীদের লিগের ও লিগ পার্লামেন্টারি পাটির সদস্য করবার পরই তিনি মুখ্যমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করবেন এবং প্রগ্রেসিভ কোয়ালিশন পার্টি ভেঙে দেবেন। আর তিনি এইসব করবেন দুটি উদ্দেশ্য সফল করার কথা ভেবে:

১ বাংলাদেশের মুসলমানদের সংহত করা।

২ বাংলার এই সংকটময় মুহূর্তে সকল দল নিয়ে একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা।

কিন্তুু জিন্না এইসব শর্ত গ্রহণ না করে পত্রাবলি প্রকাশ করে আলোচনার দ্বার রুদ্ধ করে দেওয়ায় তিনি দুঃখিত হন। ফজলুল হক এই চিঠি প্রকাশের জন্য কাগজে পাঠিয়ে দেন।

ফজলুল হক যে জিন্নার সঙ্গে দেখা করেছিলেন এবং এইসব পত্র লিখেছিলেন সে বিষয়ে তিনি তাঁর দল নিখিল বঙ্গ কৃষক প্রজা সমিতিকে পর্যন্ত কিছু জানাননি। তাই এই সমিতির নেতৃবৃন্দ কাগজে হক-জিন্না পত্রাবলি দেখে বিস্মিত হন এবং তাঁরা ফজলুল হককে প্রকৃত অবস্থা ব্যাখ্যা করতে অনুরোধ করেন। এইভাবে জিন্নার সঙ্গে পত্রালাপ ও সাক্ষাৎ করায় ফজলুল হক নিজের ও দলের যথেষ্ট অসুবিধা করেন। জিন্না সহজেই ফজলুল হকের বিরুদ্ধে এই পত্রগুলি ব্যবহার করতে পারেন। বিশেষ করে নির্বাচনের সময় মুসলিম লিগে যোগদানের প্রস্তাব কার্যত জিন্নার প্রভাব বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে ও তাঁর দলের সমর্থকদের বিব্রত করে।’ পরে অবশ্য ফজলুল তাঁর মূল উদ্দেশ্য কৃষক প্রজা পাটিঁর নেতৃবৃন্দের নিকট বিশ্লেষণ করেন। এই প্রসঙ্গে হক চরিত্রের একটি অসংগতির কথাও মনে রাখা দরকার। তা না হলে তাঁর ভূমিকা যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। ফজলুল হক একজন বিরাট প্রতিভাধর ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও ‘অব্যবস্থিত চিত্তের’ লোক ছিলেন। এইজন্য তিনি নিজের অনেক ক্ষতি করেন। তাঁর সমর্থকেরাও অনেক সময় বিপন্নবোধ করেন। তাঁর চরিত্রের এই দুর্বলতার পূর্ণ সুযোগ জিন্না গ্রহণ করেন। যেসব তথ্য আমি সংগ্রহ করেছি তা থেকে ফজলুল হকের ‘অব্যবস্থিত চিত্ত’ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করতে পেরেছি। তিনি একই সঙ্গে নিজেকে খাঁটি বাঙালি ও খাঁটি মুসলমান মনে করতেন। আবার একই সঙ্গে পশ্চাৎপদ মুসলমান সমাজের উন্নতি ও সমগ্র বাঙালি জাতি তথা সমগ্র ভারতের উন্নতির কথা ভাবতেন। কিন্তু এক জটিল সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পরিবেশে তাঁর পক্ষে এই উদ্দেশ্য সফল করা খুবই কষ্টকর ছিল। তাই আজীবন তাঁকে আত্মিক দ্বন্দ্বে ভুগতে হয়। এই অবস্থায় অনেক সময় তিনি মানসিক অস্থিরতার পরিচয় দেন। আর সঠিক নেতৃত্ব দিতেও তিনি ব্যর্থ হন। মনে রাখা দরকার, নানা ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও ফজলুল হক কখনোই নিজেকে ধর্মের সীমাবদ্ধতার মধ্যে আবদ্ধ রাখেননি। ধর্মের মূল আদর্শ—মানুষে মানুষে সম্প্রীতি এবং সকলের সঙ্গে আনন্দময় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠাই ছিল তাঁর কাম্য। ধর্মের মৌলিক আদর্শ গ্রহণ করে তিনি নিজেকে বাঙালিভাবে আবিষ্কার করেছিলেন। তখনও বাংলাদেশের মুসলমান এই আত্ম-আবিষ্কারের সাধনায় মগ্ন হবার কথা ভাবতে পারেননি। নিঃসঙ্গ ফজলুল হক এই সাধনায় রত ছিলেন।

দ্বিতীয়বার ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রীরূপে দায়িত্ব গ্রহণ করার পরেই বিধানসভার ভিতরে ও বাইরে মুসলিম লিগের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল এই মন্ত্রীসভার পতন ঘটানো এবং লিগের নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রীসভা গঠন করা। এইজন্য লিগ ন্যায়নীতি বিরোধী পদ্ধতি অবলম্বন করতেও সংকোচ বোধ করেনি। লিগ কর্মীরা বিভিন্ন স্থানে ফজলুল হকের সভা পণ্ড করতে চেষ্টা করে, তাঁকে অপমানিত করে এবং কৃষক প্রজা পার্টির নেতা ও কর্মীদের আক্রমণ করে। এইভাবে তারা মুসলিম লিগ বিরোধী মুসলমানদের অস্তিত্ব বিনাশ করতে চেষ্টা করে। প্রতিটি বিধানসভা অধিবেশনে নাজিমুদ্দিন, সুরাবর্দি, তমিজুদ্দিন ও অন্যান্য মুসলিম লিগ সদস্যরা তীব্র ভাষায় ফজলুল হককে আক্রমণ করেন। তাঁর বিরুদ্ধে অনেক কুৎসা প্রচার করেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ ফেব্রুয়ারি বিধানসভায় সুরাবর্দি বলেন, ফজলুল হক তাঁর সহকর্মী, তাঁর পার্টি এবং তাঁর সম্প্রদায়ের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেন। তাই তাঁকে মুসলিম সমাজ পরিত্যাগ করেছে। মুসলিম বাংলা একদিন তাঁর এই আচরণের প্রতিশোধ নেবে। ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী সুরাবর্দির অভিযোগের উত্তরে বলেন, ফজলুল হক প্রদর্শিত পথেই বাংলা বা ভারতকে রক্ষা করা সম্ভব। তিনি সঠিক নেতৃত্ব দেবার জন্য যথেষ্ঠ বলিষ্ঠতার পরিচয় দেন। শ্যামাপ্রসাদ বলেন:

But I shall refer to the attacks–most filthy attacks–made on the Hon’ble Mr. A. K. Fazlul Huq. I do not hold any brief for him, but it is my duty to point this out because it does not concern him alone–it concerns us who have joined the same cabinet and have openly accepted his leadership; I shall say this, Sir– blame as much as you like Mr. Fazlul Huq ; we can appreciate the motives for the blame because he has ousted you from office and patronage. But forget not that what he has done, the courage that he has shown indicates the only line of solution if Bengal or India is to be saved. (Cries of ‘Hear! hear!’ from the Coalition Benches.) Whether we succeed or not is a different matter. It will depend on various factors, but he has given the correct lead which inspite of the criticisms which self-seekers in the opposition had levelled against him and against his Ministry was a lead of which he alone was capable.১০

প্রসঙ্গত তিনি সুরাবর্দি বা অন্যান্য লিগ মন্ত্রীরা যেসব দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাও উদঘাটিত করেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক জটিল পরিস্থিতির মধ্যে ফজলুল হককে মন্ত্রীসভা পরিচালনা করতে হয়। এই সময়ে ভারতের অর্থনীতি ও শাসনতন্ত্র যুদ্ধের প্রয়োজনে ঢেলে সাজানো হয়।১১ জাপানি আক্রমণের আশঙ্কায় বাংলাদেশে ব্রিটিশ সরকার যেসব ব্যবস্থা অবলম্বন করে তাতে খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌকা চলাচল প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই ‘Denial Policy’ যানবাহনের সমস্যাকে জটিল করে তোলে। খাদ্যদ্রব্যের ঘাটতি দেখা দেয় ও মূল্যও বৃদ্ধি পায়। যে ইংরেজ অফিসার (মি. পিনেল) সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টের দায়িত্বে ছিলেন তিনি দক্ষতার সঙ্গে এই বিভাগ পরিচালনা করতে না পারায় সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করে। ইংরেজ গভর্নর, মিলিটারি কর্তৃপক্ষ ও আমলাতন্ত্র মন্ত্রীসভাকে এড়িয়ে এমন কতকগুলি নীতি নির্ধারণ করেন যার ফলে মুনাফাখোরেরা ও মজুতদারেরা অবাধ লুণ্ঠনের সুযোগ পায়। উপরন্তু কংগ্রেস নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করার পরে বাংলাদেশের সর্বত্র বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে জনসাধারণ ক্ষোভ প্রকাশ করে। ভারত সরকারের নীতির ফলে ব্যক্তি স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়। ব্যক্তিগতভাবে ফজলুল হক সরকারের এইসব নীতি পছন্দ করেননি এবং কংগ্রেসের বিরুদ্ধে নিপীড়নমূলক আইন প্রয়োগেরও তিনি বিরোধী ছিলেন। অথচ প্রাদেশিক সরকারের বিরোধিতার দায়ে অভিযুক্ত হবেন। ফজলুল হকের এই উভয় সংকটের অবস্থা দেখে নাজিমুদ্দিন ২০ মার্চ (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ) অভিযোগ করেন, ‘দেশদ্রোহী’ সুভাষচন্দ্র বসুর ভারত সরকার বিরোধী ভাষণসমূহ অক্ষশক্তির রেডিয়ো মারফত নিয়মিত প্রচার করা হচ্ছে। সুভাষচন্দ্র বসুর অবর্তমানে শরৎচন্দ্র বসু ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতা মনোনীত হন। ফরওয়ার্ড ব্লক ধবংসাত্মক কার্যে লিপ্ত আছে। আর এই ফরওয়ার্ড ব্লক প্রোগ্রেসিভ কোয়ালিশন পার্টির অন্তর্ভুক্ত একটি দল এবং মন্ত্রীসভায় তাঁদের মন্ত্রীও আছেন। যে শরৎচন্দ্র বসু সুভাষচন্দ্র বসুর সহকর্মী এবং ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতা, যাঁকে ভারত সরকার নিরাপত্তার প্রয়োজনে গ্রেফতার করেছে, তাঁর মুক্তির জন্য হক মন্ত্রীসভা ভারত সরকারের নিকট আবেদন জানাচ্ছে। তাই নাজিমুদ্দিন দাবি করেন, এই মন্ত্রীসভা পরিষ্কার করে তাঁদের নীতি ব্যাখ্যা করুন। নাজিমুদ্দিনের মূল বক্তব্য বিষয় হল এই যে, এই মন্ত্রীসভা যথাযথভাবে ভারত সরকারের নীতি প্রয়োগ করতে অপারগ এবং দেশদ্রোহাত্মক কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের প্রতি সহানুভূতিশীল। এইভাবে হক মন্ত্রীসভা অক্ষশক্তির ভারত আক্রমণের পথ সুগম করে দিচ্ছে এবং যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে বানচাল করে দিচ্ছে। অনেক যুক্তি ও তথ্যের সাহায্যে ফজলুল হক এইসব অভিযোগ যে ভিত্তিহীন তা প্রমাণ করেন। তিনি শরৎচন্দ্র বসুর প্রতি অশ্রদ্ধাও প্রদর্শনের জন্য নাজিমুদ্দিনের সমালোচনা করেন। আর তিনি এমনভাবে সুভাষচন্দ্র বসু সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করেন যাতে তাঁর প্রতি অশ্রদ্ধাও প্রদর্শিত না হয়, আইনের পরিধি লঙ্ঘিত´ না হয়, আবার একই সঙ্গে মুসলিম লিগ নেতৃবৃন্দের মুখোশও খুলে দেওয়া যায়। ফজলুল হক নাজিমুদ্দিনকে স্মরণ করিয়ে দেন, মুসলিম লিগ নিজ স্বার্থে সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে কলকাতা করপোরেশনে মৈত্রী প্রতিষ্ঠা করে।১২ আর নাজিমুদ্দিন নিজেও শরৎচন্দ্র বসুর দ্বারা কি কম উপকৃত হন? আজ এইসব কথা এত সহজে তিনি ভুলে গেলেন। ফজলুল হক অভিযোগ করেন, ষ্টেটসম্যান কাগজের সম্পাদক আর্থার মূরের সঙ্গে পরামর্শ করে নাজিমুদ্দিন এইসব কুৎসা প্রচার করছেন। মনে রাখা দরকার, সেদিন হক মন্ত্রীসভাকে পর্যুদস্ত করার জন্য নাজিমুদ্দিন, সুরাবর্দি প্রভৃতি লিগ নেতৃবৃন্দ সুভাষচন্দ্র বসুর বিরুদ্ধে কুংসা প্রচার করতে বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ করেননি। শাসনতন্ত্রের সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও তাঁদের মর্যদা প্রতিষ্ঠায় ফজলুল হক যে বলিষ্ঠতা দেখান তা কেবলমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল। এই সময়ে দ্য ষ্টেটসম্যান কাগজ নানাভাবে মুসলিম লীগকে সাহায্য করে।১৩ এই কাগজে ফজলুল হককে আক্রমণ করে কয়েকটি আপত্তিকর প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়। আত্মমর্যাদা রক্ষার জন্য ফজলুল হককে দ্য স্টেটসম্যান কাগজের সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা পর্যন্ত দায়ের করতে হয়।১৪

এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে হক মন্ত্রীসভাকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। ফজলুল হক আন্তরিকতার সঙ্গে বাংলাদেশের দুরবস্থা লাঘবে চেষ্টা করলেও ব্রিটিশ সরকার প্রবর্তিত শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে থেকে তাঁর পক্ষে এইসব গুরুতর সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হয়নি। বাংলার গভর্নর, ইংরেজ অফিসারেরা এবং উচ্চপদস্থ ভারতীয় অফিসারেরা অর্থাৎ গোটা আমলাতন্ত্র বিভিন্ন বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে অসহযোগিতা করতে শুরু করেন।১৫ ইতিমধ্যে ব্রিটিশ সরকার ফজলুল হককে সরিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। মুসলিম লিগ ব্রিটিশ সরকারের আনুকূল্য লাভ করে। কলকাতার ইংরেজরা প্রকাশ্যে মুসলিম লিগকে সমর্থন করেন এবং লিগের নেতৃত্বে মন্ত্রীসভা গঠনের যাবতীয় ব্যবস্থা করার জন্য তাঁরা গভর্ণরকে অনুরোধ করেন। বিধানসভার অভ্যন্তরে ইউরোপীয়ান ব্লক মুসলিম লিগ পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়ে হক মন্ত্রীসভাকে আক্রমণ করে ও এই মন্ত্রীসভার পদত্যাগ দাবি করে। এই অবস্থায় ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে প্রত্যক্ষ নির্বাচনে বেঙ্গল কাউন্সিলের ছ-টি আসনই মুসলিম লিগ দখল করে। হক পন্থীরা পরাজিত হন। পরাজিতদের মধ্যে একজন মন্ত্রীও ছিলেন। কলকাতার শহর অঞ্চলে সংরক্ষিত মুসলিম আসনটি ছাড়া আর সব ক-টিই গ্রামাঞ্চলে ছিল। এরমধ্যে বেশির ভাগ আসন ছিল পূর্ব বঙ্গে। সুতরাং, লিগের এই সাফল্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলার মুসলিম লিগ দাবি করে যে, হক মন্ত্রীসভা মুসলমানদের সমর্থন হারিয়ে ফেলেছে।১৬ এমনকী তাঁর আচরণের জন্য হিন্দুরাও আর তাঁকে সমর্থন করতে পারছেন না। কারণ লিগে ফিরে আসবার অভিপ্রায় প্রকাশ করে ফজলুল হক জিন্নার নিকট পত্র লিখে যে মানসিক অস্থিরতার পরিচয় দেন তাতে তাঁরা আর তাঁর উপরে আস্থা রাখতে পারছেন না। অবশ্য মুসলিম লিগ নেতৃবৃন্দ উপলব্ধি করেন, বিধানসভায় তাঁদের পরিচালিত মন্ত্রীসভা গঠন করতে হলেও কিছু সংখ্যক হিন্দু সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন। তাই তাঁরা বলতে শুরু করেন, মুসলিম লিগ সবসময় হিন্দুদের সঙ্গে সহযোগিতা করে সাম্প্রদায়িক মৈত্রী বজায় রাখতে ইচ্ছুক। কিন্তু ফজলুল হককে বিতাড়িত না করে এই উদ্দেশ্য কখনও সফল করা যাবে না। কারণ হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের পথে তিনিই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন। সুরাবর্দি বলেন:

I regret to say that some Hindu leaders are utilising Mr. Fazlul Huq. They are behind him and are propping him up…Mr. Fazlul Huq relies solely upon the Hindu community. His Muslim party members know fully well that they are not being supported by their constituencies… I can declare on the floor of this House that wherever Hindu-Muslim co-operation has been spoken of wherever we have said that in this country we have got to live side by side, the Muslim community has applauded and supported it… We have tried and as I have said—I use the word in its fullest significance-desperately not because we want to get into power but because we feel that Hindus and Muslims must work together. We have tried desperately for it but we have failed. As long as Mr. Fazlul Huq stays there, as long as the Hindu parties think that they can use him as a puppet, as long as they can bolster him up and support him, there is very little chance of compromise and understanding between us. An honourable understanding will only come if this impediment in our way is removed… We cannot come to an agreement as long as one particular person is being propped up by one party. I wish to make this declaration on behalf of the Muslim League Party with the fullest sense of responsibility that should this impediment disappear, we shall sit down together and on our part there will be no stone left unturned to arrive at an agreement between the Hindus and Muslims.১৭

সুরাবর্দি এই ভাষণ দেন ২৭ মার্চ (১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ)। ২৯ মার্চ মন্ত্রীসভার পতন ঘটে। তারপরে কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি এই প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে যান।

একই দিনে (২৭ মার্চ) নাজিমুদ্দিন একটি বিবৃতিতে ফজলুল হককে সমর্থন করার পরিণতি সম্পর্কে হিন্দুদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন:

I would also like to urge the non-Muslim leaders who are supporting the Ministry to request Mr. Fazlul Huq to resign for the establishment of a better relation between the Hindus and Muslims. It is obvious that persons who have lost the confidence of the entire Muslim Bengal should not be upheld by them in office. The policy of propping up unrepresentative men has led to communal embitterment in the Congress provinces. It will be worse in a province where the Muslims are in the majority. If my Hindu friends desire communal harmony and sincerely wish it, they will I hope, change their present attitude and adopt a course which will lead to the desired object without delay.১৮

নাজিমুদ্দিন অ-মুসলমান নেতৃবৃন্দকে উদ্দেশ্য করে এই সাবধান বাণী উচ্চারণ করায় কিরণশঙ্কর রায় বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, এই বিবৃতি পাঠ করে এই কথাই মনে হবে, নাজিমুদ্দিন পরিচালিত মন্ত্রীসভা কী নীতি অনুসরণ করছেন বা কী পরিকল্পনা দেশবাসীর সামনে রাখছেন, তা দিয়ে এই মন্ত্রীসভাকে বিচার করে সমর্থন দেওয়া বা না-দেওয়া নির্ধারণ করলে চলবে না। যদি অ-মুসলমানেরা এই মন্ত্রীসভাবে সমর্থন না করেন তাহলে সাম্প্রদায়িক বিরোধ অনিবার্য।১৯

শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী গভর্নর স্যার জন হার্বাটকে বাংলার দুরবস্থার জন্য দায়ী করেন। তিনি বলেন, এই অবস্থার জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে অভিযুক্ত করা যায় না। শ্যামাপ্রসাদ বলেন:

What has happened during the last few months forebodes chaos and anarchy, but the responsibility does not rest on the head of the Chief Minister. The responsibility rests—and I say this with a full sense of responsibility myself,—on the head of the Governor of this province. (Cheers from Congress Benches.)… There have been occasions when officers had carried out the orders of the Governor as part and parcel of the Government of Bengal without the knowledge and concurrence of the Ministers of the province. These are facts. Such instances have happened.২০

অবশেষে ২৭ মার্চ (১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ) ফজলুল হক এক দীর্ঘ ভাষণে প্রকৃত অবস্থা বিশ্লেষণ করে নিজের মতামত ব্যক্ত করেন। মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন এই তাঁর শেষ ভাষণ। প্রথমেই তিনি বলেন, সুরাবর্দি সারাজীবন ধরেই তাঁর শত্রুতা করছেন। এই শত্রুতা বংশগত বলা চলে। তিনি কখনই তাঁর ক্ষতি করার সুযোগ নষ্ট করেননি। আজকের ভাষণেও তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করার জন্য তিনি অনেক বিষ উদিগরণ করেন। ফজলুল হক বলেন:

Sir, my esteemed friend, Mr. Shaheed Suhrawardy, concluded his remarks by saying that so long as that particular individual, namely, Mr. Fazlul Huq is alive, there will be no peace in Bengal and hardly any prospect of a stable and useful Government.

Sir, Mr. Suhrawardy was in a communicative mood this morning because he is apparently in high spirits that the dissolution of this cabinet is at hand and that he will soon have an opportunity once again of having command of the commerce portfolio. Sir, I do not know if the House is aware that Mr. Suhrawardy is a very near and dear kinsman of mine,’ but throughout his life his hostility to me has been definitely of a personal character… I may tell you, Sir, without going into details that his hostility to me has been traditional and hereditary. He has never missed an opportunity of doing me the greatest possible injury, and he has delivered a speech today which is full of venom of a personal character, and not as a public man or as a leader of a community or of a party.২১

তারপরে ফজলুল হক বলেন, বর্তমান জটিল অবস্থার কথা ভেবে মন্ত্রীসভাকে অভিযুক্ত করা খুবই সহজ। যদি সদস্যরা মনে করেন, এই মন্ত্রীসভাই বর্তমান ব্যর্থতার জন্য দায়ী, তাহলে তাঁরা যেকোন অভিমত ব্যক্ত করতে পারেন। তিনি নিজে মুখ্যমন্ত্রীর পদ আঁকড়ে থাকতে চান না। তা ছাড়া তিনি মনে করেন, বাংলাদেশকে সংকটমুক্ত করতে হলে বিধানসভার সমস্ত দলের প্রতিনিধি নিয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠন করা দরকার। গত কয়েক মাস ধরেই অবস্থার গভীরতা উপলব্ধি করে ফজলুল হক গভর্নরকে এই ব্যবস্থা অবলম্বন করতে অনুরোধ করেন। ২৬ মার্চ (১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ) তিনি গভর্নরকে বলেন, যদি মনে করা হয় যে ফজলুল হক জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান অন্তরায়, তাহলে যেকোন মুহূর্তে তিনি পদত্যাগ করতে প্রস্তুত। কারণ তিনি মনে করেন, দেশের সামগ্রিক স্বার্থে দলমত- নির্বিশেষে যোগ্য ব্যক্তিদের যুক্তভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করা উচিত। প্রকৃত অর্থে জাতীয় সরকার গঠন করা হলে ফজলুল হক এই সরকারকে সর্বপ্রকারের সাহায্য দেবার প্রতিশ্রুতি দেন। তাঁর মতে, কেবলমাত্র নির্দলীয় ক্যাবিনেটই বাংলার দুরবস্থা লাঘব করতে সক্ষম। তাঁর ভাষণের কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হল:

…I have never been anxious for office and during the last few months I have told His Excellency the Governor to take steps to constitute a National Government in Bengal composed of representatives of all sections of the House. Even day before yesterday I spoke to my friend the Leader of the European Group to use his influence with all sections of the House to form a National Government. Sir, I may tell the House that even yesterday I told His Excellency—I have written to him–that nothing is nearest my heart than to see a complete Government established in Bengal, and I have gone so far as to say that if at any moment it is found that I am a hindrance to the formation of a complete Government I will resign the very moment I am asked to do in order that such a Government may be formed… It is for His Excellency to call upon my resignation and it will be placed in his hands the moment he asks for it. I say this with a full sense of my responsibility that I agree entirely with Mr. Kiran Sankar Roy that the present state of things should not be allowed to continue. It is not a satisfactory state of things. At a time when the situation is so serious, when everything is passing to a crisis, it is not the proper method to govern by having a sort of party system of Government and bickerings and charges and counter-charges on the floor of the House.

This is the time, Sir, when the best talents of the country should be harnessed to the common cause of the country. The best talents should sit together, irrespective of party, irrespective of all other affiliations and apply their minds to find out what is the best remedy for the present state of affairs in the country. So far as that is concerned, as I have said, Sir, I am not saying this only now, but I have been saying this for months and months together that if at any time I am a hindrance I am prepared to walk out. I do not want to be a hindrance for a single moment for the formation of a complete cabinet in Bengal. If it means the consummation of the wish of Mr. Suhrawardy that I should be blotted completely out of existence, I am prepared to face my fate. I do not want to be anywhere where I am not wanted. If I have failed to take my failure with good grace, I want to say one last word. Wherever I am—in office or not–My services will always be at the disposal of my countrymen in any way that I may be called upon to do so. If there is a complete National Government, I will accept it most willingly, most gladly and most delightfully and give it the best possible assistance in my power.২২

এই পরিবেশে ২৭ মার্চ (১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ) দশ ভোটের ব্যবধানে হক মন্ত্রীসভা জয়ী হয়। হ্যামিল্টন কর্তৃক উত্থাপিত ছাঁটাই প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। ২৮ মার্চ গভর্নর স্যার জন হার্বাট ফজলুল হককে ডেকে পাঠান। রাত ৭-৩০ মিনিট থেকে ৯টা পর্যন্ত গভর্নরের সঙ্গে জাতীয় কেবিনেট গঠন করার বিষয়ে তিনি কথা বলেন। গভর্নর কয়েকটি প্রস্তাব তাঁর কাছে রাখেন। আত্মসম্মানে আঘাত লাগায় ফজলুল হক তা গ্রহণ করতে অক্ষম হন। গভর্নর তাঁকে পদত্যাগ পত্র দাখিল করতে বলেন। ফজলুল হক বলেন, নিজের দল ও সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার সময় না পেলে তা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু গভর্নর তাঁকে কোনো সময় দিতে চাননি। তখন গভর্নর একটি টাইপ করা পদত্যাগ পত্র ফজলুল হককে স্বাক্ষর দেবার জন্য দেন। আর এই কথা বলেন, তিনি যদি এই কাগজে স্বাক্ষর না দেন, তবে তিনি তাঁকে পদচ্যুত করবেন। ফজলুল হক অভিযোগ করেন, এক গভীর ষড়যন্ত্র করে গভর্নর তাঁকে এই পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য করেন। ওই দিন এই পদত্যাগপত্র গ্রহণের খবর রাত দশটায় ফজলুল হকের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়।২৩

২৯ মার্চ ফজলুল হক বিধানসভায় কংগ্রেস পার্টির নেতা কিরণশঙ্কর রায়ের প্রশ্নের উত্তরে তাঁর পদত্যাগের কথা ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, সব কথা এখন বলা যাচ্ছে না। ৩০ মার্চ তিনি দিল্লি যাচ্ছেন। সেখান থেকে ফিরে এসে তিনি সদস্যদের কাছে সব কিছু বিস্তারিতভাবে বলবেন। তিনি বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন যে তিনি এই সভার বেশির ভাগ সদস্যের আস্থাভাজন। তখনও ফজলুল হক বুঝতে পারেননি, এক গভীর শাসনতান্ত্রিক সংকট তাঁর মন্ত্রীসভার আয়ু সেদিনই নিঃশেষ করে দেবে। মুখ্যমন্ত্রী পদত্যাগ পত্র দেওয়ায় এবং তা গৃহীত হওয়ায় স্পীকার ঘোষণা করতে বাধ্য হন যে, হক মন্ত্রীসভার অস্তিত্ব শেষ হয়ে গেছে এবং নতুন মন্ত্রীসভা গঠিত না হওয়া পর্যন্ত বিধানসভার কোন কাজকর্ম চলতে পারে না।২৪ গভর্নর ৯৩ ধারার সাহায্যে সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতে গ্রহণ করেন। বাংলাদেশে এক শাসনতান্ত্রিক সংকট দেখা দেয়।২৫

কি অবস্থায় ফজলুল হক পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর করেন, তা তিনি নিজেই ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৫ জুলাই বিধানসভায় এক দীর্ঘ ভাষণে ব্যাখ্যা করেন।২৬ ২৮ মার্চ গভর্নরের সঙ্গে যখন তাঁর দীর্ঘ আলোচনা হয় তখন গভর্নর তাঁকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, তিনি সকল দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বলবেন এবং একটি ‘জাতীয় ক্যাবিনেট’ (National Cabinet) গঠনের জন্য চেষ্টা করবেন। তিনি ফজলুল হককেই মুখ্যমন্ত্রী রাখতে চান এবং ফজলুল হকের উপর এখনও তাঁর আস্থা আছে। তবে পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর দিয়ে রাখলে তাঁর পক্ষে সকল দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বলতে সুবিধা হবে। গভর্নর জানতেন যে, সর্বদলীয় কেবিনেট গঠন করার প্রয়োজনে হক স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে প্রস্তুত আছেন। এই সম্পর্কে অনেক তথ্য ফজলুল হক প্রকাশ করেন। কিন্তু গভর্নর পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর আদায় করার পর মুহূর্তেই উক্ত প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গেলেন এবং যে কোনো উপায়ে নাজিমুদ্দিনকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবার জন্য চেষ্টা করেন। অবশ্য এই ষড়যন্ত্র ফজলুল হক মন্ত্রীসভা গঠনের পর থেকেই শুরু হয়। ফজলুল হক মুসলিম লিগ বাদে সকল দল ও সম্প্রদায়ের সমর্থনে, দেশপ্রেম ও জাতীয় স্বার্থকে ভিত্তি করে নতুন মন্ত্রীসভা গঠন করেন। তিনি মুসলিম লিগকেও আমন্ত্রণ জানান এই মন্ত্রীসভায় যোগ দিতে। কিন্তু লিগ নেতৃবৃন্দ এই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেন। বাংলার গভর্নর এই ধরনের মন্ত্রীসভা দেখে খুশি হননি। কারণ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা হিন্দু ও মুসলমানের যে কোনো ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা যথেষ্ট সন্দেহ ও ভয়ের চোখে দেখে। আর বিভেদের রাজনীতির উদ্যোক্তা মুসলিম লিগ ও তার নেতৃবৃন্দকে সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করে। তাঁদের সাহায্যেই কংগ্রেস ও জাতীয়তাবাদী শক্তিকে দমনের চেষ্টা করে। ফজলুল হক বলেন:

It was for the first time that Moslems belonging to various points of view, Hindus belonging to the Congress and of other schools of thought, together with various small groups and scheduled caste groups all combined to co-operate in the administration on purely national and partriotic lines. I suspect that such a cabinet did not appeal to Sir John Herbert and he therefore hesitated to agree to the formation of such a cabinet and continued to evade its formation till at last he was compelled to give in. It is well known that the union of Hindus and Moslems and of other communities in a common endeavour for the political advancement of the country does not commend itself to Britishers with imperialistic views. Secondly the group represented by Sir Nazimuddin was at that time a great political asset in the hands of British Imperialists. It was through this school of politicians that British statesmen hoped to fight the Congress and indeed all nationalist activities.২৭

তাই হক মন্ত্রীসভা যাতে স্বাভাবিকভাবে কাজকর্ম করতে না পারে তার যাবতীয় ব্যবস্থা করা হয়। মন্ত্রীদের অগ্রাহ্য করে গভর্নর ও উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা নিজেরাই শাসনযন্ত্র পরিচালনা করেন। এইসব প্রতিবন্ধকতার জন্য জনসাধারণের দুরবস্থা লাঘবে মন্ত্রীসভা বিশেষ কিছু করতে পারেনি। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রকৃতপক্ষে ইংরেজ গভর্নরের শাসনে পর্যবসিত হয়। যে সাম্প্রদায়িক মৈত্রী ও জনকল্যাণের আদর্শ সামনে রেখে ফজলুল হক দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তাকে ব্যর্থ করে দেবার জন্য গভর্নর, উচ্চপদস্থ কর্মচারীবৃন্দ ও মুসলিম লিগ নেতৃবৃন্দ একজোট হন। আর ফজলুল হক এই ষড়যন্ত্রের বলি হন।২৮

২৪ এপ্রিল (১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ) মুসলিম লিগ নেতা স্যার খাজা নাজিমুদ্দিন নতুন মন্ত্রীসভা গঠন করেন। মুসলিম লিগ পরিচালিত মন্ত্রীসভায় তপশীল সম্প্রদায়ভুক্ত হিন্দুদের কয়েকজন মন্ত্রীও ছিলেন। কংগ্রেসের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে টি. সি. গোস্বামী ও বি. পি. পাইনও মন্ত্রীসভায় যোগ দেন। সবদিক থেকে একে লিগ মন্ত্রীসভা বলাই সংগত। একই দিনে দিল্লিতে মুসলিম লিগ অধিবেশনে জিন্না তিন ঘন্টা ব্যাপী দীর্ঘ ভাষণে ফজলুল হক, মহাত্মা গান্ধীও কংগ্রেসকে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেন। আর পাকিস্তান রাষ্ট্রের সীমানা নির্ধারিত করে একটি বড়ো মানচিত্রও এই সভায় টাঙানো হয়। এই প্রথম পাকিস্তান রাষ্ট্রের মানচিত্র জনসমক্ষে তুলে ধরা হল। ২৪ এপ্রিল বাংলায় নাজিমুদ্দিনের মুখ্যমন্ত্রীরূপে কার্যভার গ্রহণ আর দিল্লিতে জিন্না কর্তৃক পাকিস্তান রাষ্ট্রের মানচিত্র প্রদর্শন করা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এই সভায় জিন্না ফজলুল হককে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলেন। খবরের কাগজে যেভাবে জিন্নার মন্তব্য প্রকাশিত হয় তাই এখানে উদ্ধৃত করা হল, ‘Mr. Jinnah described Mr. Fazlul Huq as a traitor who has now met his Waterloo.’২৯ এতদিনে জিন্নার মনোবাসনা পূর্ণ হল।

নাজিমুদ্দিন মন্ত্রীসভা গঠন করবেন, এই খবর প্রকাশিত হবার পরই ২১ এপ্রিল (১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ) প্রোগ্রেসিভ অ্যাসেম্বলি পার্টির নেতা ফজলুল হক এবং কৃষক প্রজা পার্লামেন্টেরি পার্টির নেতা শামসুদ্দিন আহমেদ বড়োলাটের নিকট প্রেরিত একটি টেলিগ্রামে বলেন যে, রাজনৈতিক মতামতের জন্য যদি কয়েকটি দলকে শাস্তি দেওয়া হয় এবং তাদের বাদ দিয়ে যদি মন্ত্রীসভা গঠন করা হয়, তবে বাংলাদেশে অভাবনীয় বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে এবং যুদ্ধ প্রচেষ্টা ব্যাহত হবে। সমস্ত দল নিয়ে মন্ত্রীসভা গঠিত না হওয়া পর্যন্ত ৯৩ ধারা রহিত করা উচিত নয়। সকল দলের সঙ্গে কথা না বলে বিশেষ একদলকে মন্ত্রীসভা গঠনে সুযোগ দেওয়ায় তাঁরা প্রতিবাদ করেন। একই মর্মে বাংলার গভর্নরকেও তারা পত্র দেন। তবে বড়লাট ও গভর্নর তাঁদের অনুরোধ অগ্রাহ্য করেন।৩০

২৪ এপ্রিল লিগ মন্ত্রীসভা গঠিত হবার পর কলকাতার টাউন হলে এক জনাকীর্ণ প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। স্যার আবদুল হালিম গজনভী সভাপতিত্ব করেন। সভার প্রধানবক্তা ফজলুল হক বিস্তারিতভাবে তাঁর পদত্যাগের ঘটনা ব্যাখ্যা করেন। তিনি গভর্নরকে লিখিত দুইটি পত্র সভায় পাঠ করে শোনান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সমস্যা সমাধানে সকল দলের মন্ত্রীসভা গঠন করা একান্ত প্রয়োজন এবং এই উদ্দেশ্য সফল করার জন্য তিনি পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর করেন। কিন্তু নাজিমুদ্দিন পরিচালিত মন্ত্রীসভাকে সর্বদলীয় মন্ত্রীসভা কোনোমতেই বলা চলে না। তিনি এক গভীর ষড়যন্ত্রের বলি হন। তাই তিনি ন্যায় বিচার দাবি করেন।

এই সভায় সভাপতি গজনভী, সন্তোষকুমার বসু, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী, উপেন্দ্রনাথ বর্মন, সৈয়দ বদরুদ্দোজা ও মৃণালকান্তি বসু ভাষণ দেন। তাঁরা প্রত্যেকেই গভর্নরের অগণতান্ত্রিক আচরণের নিন্দা করেন। শ্যামাপ্রসাদ বলেন:

Mr. Fazlul Huq had been ousted because he roused the ire of Clive Street and the Governor by his independence. The fact that they, Hindus and Muslims, had gathered on the same platform in pursuance of a common cause augured well for the future of the province.

এই সভায় গৃহীত প্রস্তাবে অগণতান্ত্রিকভাবে ফজলুল হকের কাছ থেকে পদত্যাগ পত্র আদায় করায় এবং মুসলিম লিগের নেতৃত্বে ‘সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল মন্ত্রীসভা’ গঠিত হওয়ায় সরকারের সমালোচনা করা হয়। আইন সভার মুষ্টিমেয় কয়েকজন সদস্য নিজেদের দল ত্যাগ করে এই মন্ত্রীসভায় যোগ দেওয়ায় তাঁদেরও নিন্দা করা হয়।৩১ এই ঘটনায় কংগ্রেস, হিন্দুমহাসভা প্রভৃতি দল ক্ষুব্ধ হলেও শেষ পর্যন্ত ফজলুল হকের সঙ্গে মিলিত হয়ে কোনো কার্যকারী পন্থা তাঁরা উদ্ভাবন করতে পারেননি। তখন থেকে ফজলুল হক আইন সভার ভেতরে ও বাইরে লিগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে অবতীর্ণ হন। তিনি জিন্নার বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশ করেন। তিনি বিভিন্ন বত্তৃতায় পাকিস্তান প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন এবং ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন ভারত ও বাংলায় মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সচেষ্ট হন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এতটা জিন্না বিরোধী হয়ে ওঠেন যে, তাঁর সামনে কেউ জিন্নার প্রশংসা করলে তিনি ভয়ানক চটে যেতেন। তিনি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনদের জিন্নার সভায় যেতে নিষেধ করে দিলেন। এইভাবে ফজলুল হকের গোটা পরিবার জিন্না বিরোধী হয়ে ওঠে। আহত ব্যাঘ্রকে অনেক অপমান-নির্যাতন সহ্য করতে হয়। দিনের পর দিন মুসলিম লিগের গুন্ডাবাহিনী তাঁর বাড়ির মধ্যে নোংরা জিনিসপত্র ও ঢিল নিক্ষেপ করেছে। রাস্তায় বেরুলে তাঁকে অপমান করেছে। তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের রাস্তায় দেখতে পেলেই লিগপন্থীরা ‘গাদ্দার’ ‘গাদ্দার’ (অর্থাৎ বিশ্বাসঘাতক) বলে চিৎকার করে উঠেছে। এইসব সত্ত্বেও তিনি আজীবনের ধ্যানধারণা পরিত্যাগ করেননি।৩২

তথ্যসূত্র

Mansergh (Ed), Transfer, Vol. I. p. 685.

Letter of A. K. Fazlul Huq, dated 13 November, 1942. Vide The Statesman, 17 February, 1943.

Letter of M. A. Jinnah, dated 10 February, 1943. Vide Ibid.

Letter of A. K. Fazlul Huq, dated 5 February, 1943. Vide Ibid.

Letter of M. A. Jinnah, dated 10 February, 1943. Vide Ibid.

Letter of A. K. Fazlul Huq, dated 17 February, 1943. Vide Ibid, 18 February, 1943.

Statesman, 19 February, 1943.

Ahmad, Muzaffar, Qazi Nazrul Islam Smritikatha, (In Bengali), 1st Ed., Calcutta, 1965, p. 93.

Bengal Legislative Assembly Proceedings, Thirteenth Session, 1942, Vol. LXII–No. 2, pp. 213–218, 224–225.

১০ Ibid, Vol. LXII – No. 1, pp. 353–354.

১১ Ibid, p. 352.

১২ Ibid, Vol. LXII–No. 3, pp. 190–196.

১৩ Ibid, pp. 197–198; 380–385.

১৪ Ibid, Vol. LXII–No. 4, pp. 89–91.

১৫ Ibid, Fifteenth Session, 1943, Vol. LXIV–No. 3, pp. 569–572; 588–595; 744–748.

১৬ Statesman, 27 March, 1943.

১৭ Bengal Legislative Assembly Proceedings, Fifteenth Session, 1943, Vol. LXIV– No. 3, pp. 729–733.

১৮ Ibid, pp. 728–729.

১৯ Ibid.

২০ Ibid, p. 570.

২১ Ibid, p. 745.

২২ Ibid, p. 747.

২৩ Ibid, pp. 748–749; 753–754.

২৪ Ibid, p. 754.

২৫ The Statesman, 30 March and 1, 2 April, 1943.

২৬ Bengal Legislative Assembly Proceedings, Sixteenth Session, 1943, Vol.–LXV, pp. 39–44.

২৭ Ibid, pp. 43–44.

২৮ Biswas, Jukta Banglar, pp. 365–390.

২৯ The Statesman, 25 April, 1943.

৩০ Ibid, 22 April, 1943.

৩১ Ibid, 25 April, 1943.

৩২ Interview with Wazir Ali and Yusuf Ali.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *