সৎ, গরিব, ব্রাহ্মণ: হাঁড়িতে মা ভবানী

সৎ, গরিব, ব্রাহ্মণ: হাঁড়িতে মা ভবানী

সৎ, গরিব এবং ব্রাহ্মণ— এই তিনটে কথা পরস্পরের অতি নিকট আত্মীয়। বামুনদের কোনও কালেই তেমন পয়সা ছিল না। তার ওপর সৎ হলে তো আরও চমৎকার। তার হাঁড়িতে মা ভবানীর আসন একেবারে পাকা। তার ওপর লোকটা যদি পূজারি বামুন হয় তো সোনায় সোহাগা।

সতীশ ভরদ্বাজকে নিয়ে আমি বিস্তর লিখেছি। গল্পে, কাহিনিতে তাঁর কথা প্রায়ই আমার কলমের ডগায় এসে পড়ে। তখন আমরা লামডিঙে। অসম রাজ্যের এক অপরূপ শহর। এক দিকে উঁচু টিলা আর জঙ্গল, ঝরনাও আছে। অন্য ধারে উচ্চাবচ ঢেউ খেলানো পরিসরে একমুঠো শহর। রেলের বড় অফিস ছিল সেখানে। আমরা সেখানে তিন দফায় থেকেছি। দু’দফায় টিলার ওপর নির্জন রেল বাংলোয়, তৃতীয় বা শেষ দফায় সমতলে আর একটি বড় রেল কোয়ার্টারে। এই বাসস্থানটি লোকালয়ের মধ্যবর্তী হওয়ায় আমাদের সকলেরই ভারী পছন্দ। বাজার-টাজার সবই কাছাকাছি, পাশেই খেলার মাঠ। আমাদের এই বাড়িতেই সতীশ ভরদ্বাজকে আমি প্রথম দেখি। টকটকে ফরসা রং, অতি সুপুরুষ, সত্তরোর্ধ্ব বয়সেও মজবুত দাঁতের সারি। ভারী প্রশান্ত তাঁর মুখ, হাসিটি ভারী সরল। ভারী ধীরে কথা বলেন। চমৎকার রসবোধ। ইনিই তিনি, যিনি সৎ, বামুন এবং ফলত গরিব। তদুপরি, পেশায় এক জন পুরোহিত, যাঁকে আমরা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে পুরুত বলে থাকি। তিনি উদ্বাস্তু। দেশছাড়া হয়ে কোন লতায়-পাতায় আত্মীয়তার সূত্র ধরে লামডিঙে এসে পড়েছেন। দেশেও যে খুব ভাল অবস্থায় ছিলেন, তা নয়। এ দেশে এসে বিপদ আরও বেড়েছে। তবে, মাথা ঠান্ডা এবং ঈশ্বরবিশ্বাস অতিশয় জোরালো হওয়ায় মানুষটিকে কখনও হাহাকার করতে শুনিনি। তিনি বিপত্নীক। দুই ছেলেকে নিয়েই তাঁর সংসার। এক জনের নাম সত্য, অন্য জনের নাম জ্ঞান। দুটির মধ্যে সত্য আবার পাগলাটে-খ্যাপা গোছের। তার লেখাপড়া বেশি এগোয়নি। জ্ঞান তখনও পড়াশোনা করছে।

ভারতবাসী এমন অনেকেই আছেন, যাঁদের সংসার কী ভাবে চলছে বা তাঁরা কী ভাবে বেঁচে আছেন, তা অতীব রহস্যময়। সতীশ ভরদ্বাজকেও আমার এই প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হত। তাঁর বড় ছেলে সত্য মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ি আসত। ‘কী দিয়ে ভাত খেয়েছিস রে’ জিজ্ঞেস করলে সে প্রতি দিন একই জবাব দিত, ‘ধুন্দুল বঠি’। অর্থাৎ, ধুঁধুলের তরকারি আর ভাত, এর বেশি কিছুই কোনও দিন জোটাতে পারতেন না তাঁরা। কিন্তু কখনও সতীশবাবুকে তা নিয়ে আক্ষেপ করতে শুনিনি। তিনি রোজই প্রশান্ত এবং প্রসন্ন বদনে কোনও বাড়ি বা মন্দিরে পুজো সেরে দুপুরের দিকে আমাদের বাড়িতে খবরের কাগজ পড়তে আসতেন। হাতে প্রসাদের পুঁটুলি থাকত। আমাদের ফল বা সন্দেশের টুকরো প্রসাদ দিতেন। মা তাঁকে যত্ন করে চা-বিস্কুট খাওয়াত।

তাঁর খবরের কাগজ পড়াটা ছিল ভারী মজার। বেশ গলা ছেড়ে পড়তেন, এবং দুলে দুলে, ফলে আমাদেরও খবর শোনা হয়ে যেত। টাইফয়েডের সময় শয্যাগত অবস্থায় ওই খবর শোনাটা ছিল আমার এন্টারটেনমেন্ট।

আমাদের বাড়িতেও লক্ষ্মীপুজো বা সরস্বতী পুজো সতীশবাবুই করতেন। কিন্তু দক্ষিণা, প্রণামী, ভোজ্যবস্তু নিয়ে কখনও একটি কথাও বলেননি। মাগুনে বামুন নন বলেই বোধহয় অনেকে একটু বেশি করেই দিত তাঁকে। কিন্তু সে আর কতই বা বেশি! মাঝে মাঝে গল্প করতেন, ‘বুঝলি রে! দ্যাশে থাকতে খুব খাইতে পারতাম। মাষকলাই ডাইল দিয়া এক পাতিল ভাত তল কইরা ফালাইছি। … আমার এক বিধবা পিসি আছিল বুঝলি, গ্রামসম্পর্কের পিসি। আমার খাওন দেইখ্যা এক দিন কইল, খাবি রে বাবা? তয় বেহানবেলা আহিছ, তরে সর খাওয়ামু। বুঝলি, গামলার মতো বড় একখান জামবাটি-ভরা সর মিছরির দানা দিয়া সেই যে খাইছিলাম, আইজও স্বাদখান মুখে লাইগ্যা রইছে।’

সোনালি দিন সোনার হরিণের মতোই উধাও। ১৯৪৯-এর লামডিঙে সতীশ ভরদ্বাজের বর্মার মোটা সস্তা চালের ভাত আর ধুঁধুলবঠি ছাড়া বিশেষ কিছু জুটত না, ক্বচিৎ কদাচিৎ ব্রাহ্মণভোজনের নিমন্ত্রণ ছাড়া। কিন্তু সত্তরোর্ধ্ব সতীশবাবুর পেটে তখন চড়া পড়ে গেছে।

লামডিঙের ঠাকুরমশাই হিসেবে তাঁকে প্রায় সবাই চিনত। রেলের বড় অফিসার থেকে মারওয়াড়ি ব্যবসায়ী, উকিল বা ডাক্তার বা দারোগা, সকলের বাড়িতেই অবারিত যাতায়াত ছিল তাঁর। ইচ্ছে করলে নিজের জন্য একটু-আধটু সুবিধে কি আদায় করতে পারতেন না তিনি? কিন্তু সে রকম কোনও উদ্যোগই তাঁর মধ্যে ছিল না। তাঁর ইষ্টদেবতা ছিলেন লক্ষ্মীনারায়ণ। কথায় কথায় বলতেন, লক্ষ্মীনারায়ণ যা করবেন। বাপের এই নিস্পৃহতা সত্যর বিশেষ পছন্দ ছিল না। রাগ করে সে ঘোর ঠাকুর-বিরোধী হয়ে উঠেছিল। উন্মার্গগামী ছেলেকে দিয়ে ঠাকুরের নাম উচ্চারণ করানোর জন্য সকালে উঠে সত্যকে ডেকে বলতেন, বাবা রে, এক বার একটু লক্ষ্মীনারায়ণের নাম ল’। সত্য চিড়বিড়িয়ে উঠে বলত, নিমু না তোমার লক্ষ্মীনারায়ণের নাম। সতীশবাবু সেই গল্প আমাদের শুনিয়ে বলতেন, আমার পোলাটা বলদ তো, তাই নিমু না কইয়াও নামটা তো মুখে লয়!

ইস্তিরি করা জামাকাপড় তাঁকে কখনও পরতে দেখিনি। নিজের এবং ছেলেদের জামাকাপড় নিজেই কেচে নিতেন। দুবেলা নিজেই রান্না করে ছেলেদের খাওয়াতেন, যে দিন জুটত। মাঝে মাঝে তাদের যে উপবাসেও থাকতে হত, তাও লোকমুখে শুনতে পেতাম। যে দিন খাওয়া জুটত না, তার পর দিনও তাঁর মুখে প্রসন্নতা ও প্রশান্তির অভাব ঘটত না। এক বার খিদের জ্বালায় সত্য তাঁর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল রাগ করে। উলটে তাকে কিছুই বলেননি সতীশবাবু। হাসপাতালে গিয়ে মাথায় একটু আয়োডিন আর তুলোর পট্টি লাগিয়ে এসেছিলেন মাত্র।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *