স্যুভেনির

স্যুভেনির

টুনি আর সালমা গল্প করতে করতে হেঁটে যাচ্ছে। দুজনেরই পরনে স্কুলের পোশাক, দুজনেরই পিঠে স্কুলের ব্যাগ–দেখে বোঝা যাচ্ছে দুজনেই স্কুল ছুটির পর বের হয়েছে। স্কুল ছুটির পর বাসায় না গিয়ে তাদের রাস্তাঘাটে হেঁটে বেড়ানোর কথা নয় কিন্তু আজকে তাদের স্কুল থেকে একটা দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছে। সেজন্য বাসায় দেরি করে যাওয়ার অনুমতি আছে।

তাদের স্কুলে একজন বাঘিনী ম্যাডাম আছে। তাকে দেখলেই মনে হয় এক্ষুনি বুঝি ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘাড়ের মাঝে দাঁত বসিয়ে রক্ত চুষে খেতে থাকবে। এই ম্যাডামকে ছোট বাচ্চাদের ক্লাসে দেওয়া হয় না, কারণ মাঝে মাঝেই এই ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে চোট বাচ্চাদের কাপড়ে হিস্যু হয়ে যায়। এই ম্যাডাম সায়েন্স টিচার তাই এই স্কুলে কেউ সায়েন্স পড়তে সাহস পায় না। শুধু যাদের জানের মায়া নেই সে রকম দুঃসাহসী দুই চারজন সায়েন্স পড়ে। মনে হয় সেইজন্য স্কুলের অন্য টিচাররা মিলে বাঘিনী ম্যাডামকে অন্য স্কুলে বদলি করে দিয়েছে। এখন ম্যাডামকে ফেয়ারওয়েল দেওয়া হবে, সেই অনুষ্ঠানে মৌটুসিকে বক্তৃতা দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সে বানিয়ে বানিয়ে বলবে বাঘিনী ম্যাডাম ছেলেমেয়েদের কত ভালোবাসেন। এই ম্যাডাম চলে গেলে সবার কত মন খারাপ হবে, এই সব। মনে হয় যেতে নাহি দিব সেই কবিতা থেকেও কয়েক লাইন বলতে হবে।

বাঘিনী ম্যাডামকে ক্লাসের পক্ষ থেকে একটা গিফট দিতে হবে। সেই গিফটটা কেনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে টুনি আর সালমাকে। সেই জন্য তারা বের হয়েছে। দুইজনে মিলে চিন্তা করে পাচ্ছে না কী গিফট কেনা যায়। এমন একটা গিফট কিনতে চাইছে যেটা পেলে ম্যাডামের যন্ত্রণা বেড়ে যায়।

টুনি বলল, “একটা জংলি বিড়াল কিনে দিলে কেমন হয়? আঁচড়ে কামড়ে যেন বারোটা বাজিয়ে দেয়।”

সালমা হি হি করে হেসে বলল, “আইডিয়াটা খারাপ না। কিন্তু জংলি বিড়াল তো কিনতে পাওয়া যায় না।”

টুনি বলল, “রাস্তা থেকে ধরে নিব।”

সালমা বলল, “রাস্তা থেকেই যদি ধরে নিবি তাহলে জংলি বিড়াল না নিয়ে একটা নেড়ি কুত্তা নিয়ে যাস না কেন?”

টুনি আর সালমা মিলে একটা নেড়ি কুকুরকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে দৃশ্যটা কল্পনা করে দুইজন হি হি করে হাসতে থাকে, একজন আরেকজনকে ধাক্কা দেয়, একজন আরেকজনের ওপর ঢলে পড়তে থাকে। রাস্তার মানুষেরা অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।

একটু পর টুনি নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “অনেক ঠাট্টা হয়েছে, এখন সিরিয়াসলি বল আমরা বাঘিনী ম্যাডামের জন্য কী গিফট কিনতে পারি?”

সালমা বলল, “একটা টবে একটা ছোট গাছ দিতে পারি। তাহলে প্রত্যেকদিন পানি দিতে হবে। বাঘিনী ম্যাডামের কাজ বাড়বে।”

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু। বাঘিনী ম্যাডাম নিজে পানি দিবে না, তার বাসার কাউকে দিতে বলবে।”

সালমা বলল, “তাহলে আমরা খুব সুন্দর মোটা একটা নোট বই দিতে পারি সাথে একটা দামি কলম। মৌটুসিকে বলব বক্তৃতা দেওয়ার সময় সে বাঘিনী ম্যাডামকে বলবে, ম্যাডাম এই বইয়ে তার জীবনী লিখবেন। স্কুল জীবনের তার কী কী অভিজ্ঞতা হয়েছে এইসব–”

টুনি বলল, “পরে সেটা বই মেলায় বই হিসাবে ছাপানো হবে।”

সালমা ভুরু কুঁচকে বলল, “সেই বই কে কিনবে?”

টুনি বলল, “বইটার নাম দেওয়া হবে, আমি কীভাবে বাচ্চাদের ঘাড় মটকে রক্ত খেয়ে বাঘিনী হয়েছি–তাহলে হাজার হাজার কপি বই বিক্রি হবে”

তখন সালমা আর টুনি আবার হি হি করে হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের ওপর গড়িয়ে পড়তে থাকে। হাসতে হাসতে টুনির চোখে পানি এসে যায়। হঠাৎ করে রাস্তার অন্য পাশে কিছু একটা দেখে টুনির হাসি বন্ধ হয়ে গেল। সে কেমন যেন কঠিন চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।

সালমা একটু অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে?”

টুনি কোনো কথা না বলে রাস্তার অন্য পাশে তাকিয়ে রইল। সালমা রাস্তার অন্য পাশে তাকালো, দোকানপাট অফিস মানুষজন হাঁটাহাঁটি করছে এছাড়া দেখার মতো কিছু নেই, কী দেখে টুনির হাসি বন্ধ হয়ে গেছে সালমা বুঝতে পারল না। সালমা আবার জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে টুনি?”

টুনি মুখ শক্ত করে বলল, “না কিছু না।”

“তুই হঠাৎ করে এত গম্ভীর হয়ে গেছিস কেন?”

টুনি একটা নিঃশ্বাস ফেলে হাত তুলে রাস্তার অন্য পাশে একটা অফিস বিল্ডিং দেখাল। সালমা দেখল বিল্ডিংয়ের নিচে একটা অফিস, তার গেটের উপরে একটা বড় সাইনবোর্ড সেখানে লেখা :

দি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সি

সালমা ঠিক বুঝতে পারল না এই সাইনবোর্ড দেখে টুনি হঠাৎ করে এত গম্ভীর হয়ে গেল কেন? জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে এই আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সিতে?”

টুনি বলল, “আমাকে জিজ্ঞেস করিস না। আমি এটা বলতে চাই না।”

“কেন? বললে কী হবে?”

“আমার মেজাজ খারাপ হবে।”

“আমাকে বল। মেজাজ খারাপের কথা অন্যদের বলে মেজাজ ভালো করতে হয়।”

টুনি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “এইটা আমার ছোটাচ্চু তৈরি করেছিল। অনেকে এখানে কাজ করত। তারপর একদিন”

টুনি থেমে গিয়ে হিংস্র চোখে আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির দিকে তাকিয়ে রইল।

সালমা অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, “একদিন কী?”

“একদিন সরফরাজ কাফী মামার কাছ থেকে এটা দখল করে নিয়েছে।”

“সরফরাজ কাফী কে?”

“একজন খারাপ মানুষ। চুলের ডগা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত খারাপ।”

“কেন?”

“মাথার মাঝখানে সিঁথি করে চুল দুই দিকে আঁচড়ায়। সালমা চোখ কপালে তুলে বলল, “সেই জন্য খারাপ?”

“না শুধু সেই জন্য না একটু পরে পরে সবুজ রঙের চিরুনি বের করে তার চুল আঁচড়ায়।”

“কিন্তু কিন্তু—” সালমা কীভাবে জিজ্ঞেস করবে বুঝতে পারল না, তাই একটু রাগ হয়ে বলল, “আমাকে ঠিক করে বলবি, কী ব্যাপার।”

“চিন্তা করলেই এত রাগ ওঠে যে বলতে ইচ্ছা করে না।”

“তবু বল। শুনি।”

“তোরা তো জানিস আমার ছোটাচ্চু ডিটেকটিভ। আমি ছোটাচ্চুর সাথে মাঝে মাঝে ডিটেকটিভ কাজ করেছি। আস্তে আস্তে ছোটাচ্চুর এত কেস আসতে লাগল যে ছোটাচ্চু আর বাসা থেকে সেগুলো চালাতে পারে না। তখন এই অফিসটা ভাড়া করেছে। ছোটাচ্চু অফিসে অনেককে কাজ দিয়েছে, তাদের ডিটেকটিভ কাজ করা শিখিয়েছে। পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে পুরস্কার পেয়েছে। টেলিভিশনে দেখিয়েছে–”

“তোকেও তো দেখিয়েছে।”

“হ্যাঁ। এক দুইবার আমাকেও দেখিয়েছে। যখন ছোটাচ্চুর আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সি খুব ভালো কাজ করছে তখন এই সরফরাজ কাফী ছোটাচ্চুর কাছে এসেছে। পাজি মানুষটা আমার ছোটাচ্চুকে বুঝিয়েছে যে সে এজেন্সিটাকে আরো ভালো করে দেবে-ছোটাচ্চ সোজা সরল মানুষ তাকে সাথে নিয়েছে। একদিন ছোটাচ্চুকে দিয়ে অনেকগুলো কাগজ সাইন করে নিয়েছে–ছোটাচ্চু ভালো করে পড়েও দেখে নাই সাইন করে দিয়েছে।”

টুনি দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “পরেরদিন ছোটাচ্চু অফিসে গিয়ে দেখে কাফী ব্যাটা ছোটাচ্চুর অফিস দখল করে নিয়েছে। তার চেয়ারে বসে ছোটাচ্চুকে অর্ডার দিচ্ছে”

সালমা বলল, “কী বলিস তুই? খোদার কসম?”

“খোদার কসম। ছোটাচ্চু তখন রেগেমেগে ওই পাজি কাফী মানুষটাকে ধরে আচ্ছা মতন পিটিয়েছে।”

সালমা হাতে কিল দিয়ে বলল, “একেবারে ঠিক কাজ করেছে তোর ছোটাচ্চু। তারপর কী হয়েছে?”

“কাফী ব্যাটা পুলিশ আনছে। ছোটাচ্চু হাজতে। বড় চাচা অনেক কষ্ট করে ছুটিয়ে এনেছে।”

“কী সর্বনাশ! তারপর?”

“তারপর আর কী! ছোটাচ্চু আর ঘাটাঘাটি করে নাই–তখন থেকে আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির মালিক সরফরাজ কাফী।”

সালমা আর টুনি হাঁটা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে গেছে। টুনি যতবার আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির দিকে তাকাচ্ছে ততবার দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। সালমা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তরপর বলল, “তোর ছোটাচ্চু ঘাটাঘাটি করতে চায় নাই ঠিক আছে। কিন্তু তুই কিছু করলি না কেন?”

টুনি ভুরু কুঁচকে বলল, “আমি?”

“হ্যাঁ। তুই।”

“আমি? আমি কী করব?”

“কেন, ওই কাফী না খাফী মানুষটাকে টাইট করে তোর ছোটাচ্চুর ডিটেকটিভ এজেন্সিটা আবার তাকে ফিরিয়ে দিলি না কেন?”

“আমি? আমি ফিরিয়ে দেব?”

“হ্যাঁ। তুই ফিরিয়ে দিবি। তুই ছাড়া আর কে পারবে?”

টুনি একটু হাসার চেষ্টা করল। বলল, “তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে! সরফরাজ কাফী হচ্ছে এক নম্বর ঘাঘু ক্রিমিনাল, দুনিয়ার সবার সাথে খাতির! তাকে আমি টাইট করব? আমি?”

সালমা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। তুই। কেউ যদি ফরফরাজ কাফী–”

“সরফরাজ। সরফরাজ কাফী।”

“একই কথা। ফরফরা কাফীকে কেউ যদি টাইট করতে পারে সেটা হচ্ছে তুই। তোর মাথায় যত বুদ্ধি দুনিয়ার কারো মাথায় এত বুদ্ধি নাই। তোর মাথায় শুধু যে বুদ্ধি তা না–তোর মনটা অনেক ভালো। তুই যদি না পারিস তাহলে দুনিয়ার কেউ পারবে না।”

টুনি একটু অবাক হয়ে সালমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “আমি পারব?”

“একশবার পারবি। দরকার হলে অন্যদের তোর দলে নিবি। সবাই মিলে করবি।”

টুনি অন্যমনস্কভাবে ছোটাচ্চুর ডিটেকটিভ এজেন্সির দিকে তাকিয়ে রইল। সালমা বলল, “কাজ শুরু করে দে। দেরি করে লাভ নাই। এখন থেকে শুরু করে দে।”

“এখন থেকে?”

“হ্যাঁ, বল কী করতে হবে। আমি তোর সাথে আছি।”

টুনি একটু হাসল, বলল, “কোনো কিছু করতে হলে সবার আগে সেটা সম্পর্কে সব খুঁটিনাটি জানতে হয়। আমি তো এখনকার কিছু জানি না।”

সালমা বলল, “তাতে সমস্যা কী? ভেতরে যাই দেখে আসি সেখানে কী হচ্ছে। চল।”

টুনি বলল, “এই ডিটেকটিভ এজেন্সির ভেতরে যাব? আমরা?”

“হ্যাঁ। আয় দেখে আসি ভেতরে কী অবস্থা।”

সালমা টুনির হাত ধরে রাস্তা পার হতে শুরু করে দিল।

সত্যি সত্যি সালমা টুনির হাত ধরে আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির অফিসে ঢুকে গেল। ঢুকতেই একটা রিসেপশন কাউন্টার, সেখানে সব সময় কেউ না কেউ থাকত। আজকে কেউ নেই। টুনি এদিক-সেদিক তাকালো, এক পাশে অনেকগুলো শেলফ, সেখানে নানা কিছু সাজানো, মনে হয় বিক্রি করার জন্য। এটা যদি ডিটেকটিভ অফিস হয় তাহলে জিনিসপত্র বিক্রি হয় কেন?

টুনি ভুরু কুঁচকে একটু এগিয়ে গেল। আগে এক পাশে ছোট একটা কিচেন ছিল, সেখানে চা কফি বানানো হতো। সেই কিচেনের ভেতর থেকে টুকটাক শব্দ আসছে, মনে হয় সেখানে কেউ কিছু ধোয়াধোয়ি করছে। সামনে একটা রুম, দরজা বন্ধ, ছোটাচ্চু আগে এখানে বসত, এখন সরফরাজ কাফী বসে। ভেতরে আছে কিনা কে জানে।

তারা কী করবে ঠিক বুঝতে পারছিল না, তখন কিচেনের ভেতর থেকে একজন মহিলা বের হয়ে এল। টুনি আর সালমাকে দেখে হাসি হাসি মুখে বলল, “কী খবর আপু তোমাদের? কী লাগবে?”

টুনি ইতস্তত করে বলল, “না, কিছু লাগবে না। বাইরে থেকে দেখলাম ডিটেকটিভ এজেন্সি, তাই ভেতরে এসেছি দেখার জন্য ডিটেকটিভ এজেন্সি কেমন হয়।”

“ও আচ্ছা!”

মহিলা মুখটা আরো হাসি হাসি করে বলল, “দেখো, দেখো। যত ইচ্ছা দেখো।”

এবারে সালমা কথা বলল, মহিলাটাকে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি ডিটেকটিভ?”

মহিলা চোখ কপালে তুলে বলল, “আমি? ডিটেকটিভ?”

তারপর জোরে মাথা নেড়ে বলল, “না, না–আমি মোটেও ডিটেকটিভ না!”

মহিলার কথা বলার ভঙ্গি দেখে মনে হলো ডিটেকটিভ হওয়াটা বুঝি খুবই খারাপ কোনো ব্যাপার!

সালমা জিজ্ঞেস করল, “তাহলে আপনি কী?”

মহিলাটা এবারে একটু থতমত খেয়ে গেল, তারপর মুখটা শক্ত করে বলল, “আমি ডিটেকটিভ ছাড়া অন্য সবকিছু।”

বোঝা গেল সে এই ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে চায় না। টুনি আর সালমাকে শেলফগুলো দেখিয়ে বলল, “এখানে নানা রকম স্যুভেনির আছে। তোমরা চাইলে দেখতে পার।”

টুনি বলল, “স্যুভেনির?”

“হ্যাঁ।”

“আমি ভেবেছিলাম আপনারা ডিটেকটিভের কাজ করেন।”

মহিলা বলল, “হ্যাঁ, যখন ডিটেকটিভের কাজ থাকে তখন আমরা ডিটেকটিভের কাজ করি।”

টুনি একটু অবাক হলো, কথা শুনে মনে হচ্ছে ডিটেকটিভের কাজ বেশি আসে না। সে জিজ্ঞেস করেই ফেলল, “ডিটেকটিভের কাজ বেশি আসে না?”

“নাহ্।” মহিলাটা মাথা নাড়ল, “সমস্যা হলে মানুষজন পুলিশের কাছে যায়। কে আর ডিটেকটিভের কাছে আসবে!”

সালমা জিজ্ঞেস করল, “আপনাদের তাহলে চলে কেমন করে? স্যুভেনির বিক্রি করে?”

মহিলাটির মুখটা কেমন যেন শক্ত হয়ে উঠল। বলল, “এই তো–” তারপর বলল, “তোমরা দেখো স্যুভেনির পছন্দ হয় কিনা।”

সালমা বলল, “আপনারা এইখানে একটা ক্যাফে খুলতে পারেন। কাফেতে অনেক পয়সা।”

মহিলা কেমন যেন অবাক হয়ে সালমার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর একটু ইতস্তত করে বলল, “ইয়ে–আসলে সামনের মাস থেকে এখানে একটা ক্যাফে খোলার প্রান হচ্ছে।”

সালমা খুশি হওয়ার ভান করে হাতে কিল দিয়ে বলল, “তাহলে কোনো চিন্তা নাই। আসলে ক্যাফে থেকে বেশি পয়সা হচ্ছে ভাতের হোটেলে। সবচেয়ে বেশি লাভ ভাত বেচলে।”

টুনি মোটামুটি অবাক হয়ে দুইজনের কথা শুনছিল। সালমার কথা শুনে তার হাসি উঠে যাচ্ছিল কিন্তু সে হাসল না। মুখ গম্ভীর করে বলল, “উঁহু সালমা। ভাত থেকে বেশি পয়সা কোচিং সেন্টারে।”

সালমা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। তুই ঠিকই বলেছিস, সবচেয়ে বেশি পয়সা কোচিং সেন্টারে। কিন্তু এইখানে তো কোচিং সেন্টার খোলা যাবে না।”

টুনি বলল, “কেন খোলা যাবে না? এইখানে তো আর স্কুলের কোচিং খুলবে না। এইখানে খুলতে হবে ডিটেকটিভ কোচিং। কীভাবে ডিটেকটিভ হওয়া যায় তার কোচিং। ভালো করে বিজ্ঞাপন দিলে ছেলেমেয়েদের বসার জায়গা দেওয়া যাবে না।”

সালমা টুনির কথা মেনে নেওয়ার ভঙ্গি করে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল। বলল, “ঠিকই বলেছিস। আমাদের ক্লাসেরই তো সব ছেলেমেয়ে কোচিং করতে চলে আসবে।”

মহিলাটা খুবই মনোযোগ দিয়ে দুইজনের কথা শুনছিল, এইবারে জিজ্ঞেস করল, “সত্যিই তোমাদের ধারণা ডিটেকটিভ কোচিং সেন্টার ভালো চলবে?”

টুনি আর সালমা দুইজনই মাথা নাড়ল, সালমা বলল, “একেবারে ফাটাফাটি চলবে।”

টুনি বলল, “আপনার বসকে বলে দেখবেন।”

“ঠিক আছে বলব।”

সালমা জিজ্ঞেস করল, “আপনার বসের নাম কী?”

“সরফরাজ কাফী।”

“কোন দেশি বস?”

মহিলা অবাক হলো, বলল, “কেন? এই দেশের মানুষ।”

“নামটা অনেক আজব। দেখতে কী রকম? আজব?”

টুনি সালমার হাত ধরে টেনে সরিয়ে আনল, বলল, “কী উল্টাপাল্টা কথা বলছিস? আয় স্যুভেনিরগুলো দেখে যাই।”

দুইজন মহিলার কাছ থেকে সরে শেলফগুলোর কাছে গেল। টুনি ফিসফিস করে বলল, “খুবই খারাপ অবস্থা মনে হচ্ছে!”

সালমা মাথা নাড়ল। চাপা গলায় বলল, “হ্যাঁ। স্যুভেনির বিক্রি করে দিন চালায়। কোনো কেস আসে না।”

টুনি বলল, “নড়বড়ে অবস্থা। মনে হচ্ছে ধাক্কা দিলেই পড়ে যাবে।”

সালমা বলল, “দে। ধাক্কা দে। দেরি করিস না।”

টুনি ভুরু কুঁচকে চিন্তা করতে থাকে।

শেলফে নানা রকম জিনিসপত্র। আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির নাম লেখা কফির মগ, টি শার্ট, চাবির রিং, কলম, ব্যাক প্যাক। নানা রকম ডিটেকটিভ বইও আছে। টুনি সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে সালমাকে ফিসফিস করে বলল, “আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।”

সালমা খুশি হয়ে গেল, হাতে কিল দিয়ে বলল, “ভেরি গুড। কী আইডিয়া?”

টুনি বলল, “এদের টাকা পয়সার টানাটানি। কাজেই টাকা পয়সার বড় একটা ক্ষতি করিয়ে দিলে কেমন হয়? তাহলে মনে হয় বিপদে পড়ে যাবে।”

“কীভাবে ক্ষতি করবি? আগুন লাগিয়ে দিবি?”

টুনি হাসল, বলল, “লাগাতে পারলে তো ভালোই হতো! সেটা তো আর করতে পারব না, অন্য কিছু করতে হবে।”

“কী করবি?”

“বলছি।” টুনি কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “তোর কাছে মোবাইল টেলিফোনটা আছে না?”

তাদের ক্লাসে সালমাকে তার বাসার সব খোঁজখবর রাখতে হয়, দেখে শুনে রাখতে হয় সেইজন্য একটা মোবাইল টেলিফোন থাকে। স্যার ম্যাডামরা তাকে ফোন রাখার পারমিশন দিয়েছেন। সালমা বলল, “হ্যাঁ। আছে। কাকে ফোন করবি?”

“কাউকে না, ভান করব ফোন করছি।”

সালমা মুখ টিপে হাসল। টুনি বলল, “তুই আমার সব কথায় তাল দিবি। ঠিক আছে?”

“ঠিক আছে।”

“আয় তাহলে।”

“কোনখানে যাবি?”

“ঐ মহিলার কাছে। তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে ফোনে কথা বলতে হবে।”

সালমা মাথা নাড়ল, বলল, “বুঝেছি।”

দুইজন হেঁটে হেঁটে অফিসের সামনে এল। মহিলাটি এখন রিসেপশন কাউন্টারে বসে তার নখে নেল পালিশ লাগাচ্ছে। টুনি আর সালমাকে দেখে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, “কোনো কিছু পছন্দ হয়েছে?”

টুনি মাথা নাড়ল, “মগগুলো খুবই সুন্দর।”

“হ্যাঁ। আমাদের এই আইটেমটা সবচেয়ে বেশি চলে।”

“কেউ যদি বেশি কিনে আপনারা কি ডিসকাউন্ট দেন?”

মহিলা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ দিই। কয়টা কিনবে?”

“চার থেকে পাঁচ হাজার।”

টুনির কথা শুনে মহিলা চমকে উঠে ধাক্কা দিয়ে নেল পালিশের শিশিটা ফেলে দিল। নেল পালিশে তার হাত আর টেবিল মাখামাখি হয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল, “ক-ক-কয়টা কিনবে?”

“আমাদের স্কুলে সাড়ে চার হাজার ছাত্রছাত্রী। সবার জন্য একটা করে হলে চার থেকে পাঁচ হাজার।”

মহিলাটি ভুরু কুঁচকে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “তু-তুমি বাচ্চা মেয়ে তোমার স্কুলের জন্য পাঁচ হাজার মগ কিনবে?”

টুনি হাসল, বলল, “না, আমি কিনব না। আমার স্কুল কিনবে। আমাদের স্যার ম্যাডামরা আমাদের পাঠিয়েছেন স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য কী গিফট কেনা যায় সেটা দেখার জন্য।”

“তোমাদের স্কুল সব ছেলেমেয়েকে গিফট দেবে?”

“হ্যাঁ। একশ বছর পূর্তি হয়েছে তো তাই।” পুরোপুরি বানানো কথা। তাদের স্কুলের বয়স পঁচিশও হয় নাই।

“ও।” মহিলা তারপরও ভুরু কুঁচকে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল।

টুনি আবার জিজ্ঞেস করল, “দেবেন ডিসকাউন্ট?”

মহিলা টিস্যু দিয়ে নেল পালিশ দিয়ে মাখামাখি হয়ে যাওয়া আঙুল মুছতে মুছতে বলল, “যদি চার পাঁচ হাজার মগ কেনা হয় তাহলে তো থার্টি পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট দিতেই পারি। আরও বেশিও হতে পারে কিন্তু স্যারের সাথে কথা না বলে তো আমি বলতে পারব না।”

টুনি বলল, “ঠিক আছে আমি একটু ম্যাডামের সাথে কথা বলে নিই।” তারপর সালমাকে বলল, “সালমা, টেলিফোনটা দিবি।”

সালমা গম্ভীর মুখে টেলিফোনটা বের করে দিল। টুনি সেখানে একটা নম্বর বের করে ডায়াল করার ভান করল, তারপর কানে লাগিয়ে অপেক্ষা করে। একটু পরে ম্যাডাম ফোনটা ধরেছেন এ রকম ভান করে বলল, “ম্যাডাম আমরা গিফট কমিটির মেম্বার–আমরা স্টুডেন্টদের দেওয়ার জন্য ভালো একটা গিফট পেয়েছি। দামও বেশি না–মাত্র আশি টাকা। যদি চার পাঁচ হাজার কিনি তাহলে থার্টি পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট।”

তারপর কিছুক্ষণ ম্যাডামের কথা শোনার ভান করল, মাথা নাড়ল, হু হ্যাঁ করল, তারপর বলল, “ঠিক আছে আমরা একটা স্যাম্পল নিয়ে আসব। যদি আপনার পছন্দ হয় আপনি অর্ডার দিতে পারবেন।”

টুনি তারপর আরো কিছুক্ষণ কথা শোনার ভান করে বলল, “ঠিক আছে ম্যাডাম। ঠিক আছে। না আমরা আর ঘোরাঘুরি করব না, এখন বাসায় চলে যাব।”

টুনি কথা শেষ করার ভান করে ফোনটা সালমার হাতে দেওয়ার সাথে সাথে দরজা খুলে একজন মানুষ ঢুকল। টুনি তাকে আগে দেখেছে, তাই সাথে সাথে চিনে গেল। মানুষটা সরফরাজ কাফী। সালমা তাকে আগে কখনো দেখে নাই কিন্তু তারপরেও মানুষটার তেলতেলে চেহারা, মাঝখানে সিঁথি করে চুল দুই ভাগ করা দেখে সেও চিনে গেল।

সরফরাজ কাফী তার অফিসে দুইজন বাচ্চা মেয়েকে দেখে একটু অবাক এবং বেশ খানিকটা বিরক্ত হলো। ভুরু কুঁচকে রিসেপশন কাউন্টারে বসে থাকা মহিলাটাকে জিজ্ঞেস করল, “এরা কারা? কী চায়?”

মহিলাটা উঠে দাঁড়িয়ে গলা নামিয়ে অল্প কথায় সরফরাজ কাফীকে পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে দিল। সাথে সাথে সরফরাজ কাফীর তেলতেলে মুখটা কেমন যেন নরম এবং হাসি হাসি হয়ে গেল। সে গলায় মধু ঢেলে টুনি আর সালমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা তোমাদের স্কুলের বন্ধুদের জন্য গিফট কিনবে? কী সুইট!”

সরফরাজ কাফীকে দেখে টুনির শরীর কেমন জানি শিরশির করতে থাকে, সে মানুষটার দিকে তাকাতেই পারছিল না। সরফরাজ কাফী যখন তার জিব বের করে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল তার মনে হলো একটা বড় গুইসাপ জিব বের করে ঠোঁট ভিজিয়েছে। সে কিছু বলল না, সালমা বলল, “আমরা কিনব না। আমরা গিফট পছন্দ করে দিব। আমাদের স্যার ম্যাডামরা কিনবেন।”

সরফরাজ কাফী বলল, “গিফট পছন্দ করে দেওয়াই তো আসল কাজ। কেনা তো সোজা। টাকা থাকলে যে কেউ কিনতে পাবে!”

তারপর ফ্যাক ফ্যাক করে হাসল।

কী ভয়ংকর হাসি, টুনির আর সহ্য হলো না, সে সালমার হাত ধরে বলল, “আয় যাই।”

সরফরাজ কাফী ব্যস্ত হয়ে বলল, “সেকি! এখনই যাবে কেন? একটু বসে চা কফি খাও। না হলে কোল্ড ড্রিংকস।”

টুনি বলল, “না আমরা যাব।”

“কিন্তু কী কিনবে কয়টা কিনবে সেটা নিয়ে একটু কথা বলি।”

সালমাও টের পাচ্ছিল টুনি আর এখানে এক সেকেন্ড থাকতে চাইছে না, তাই সে বলল, “আমাদের ম্যাডাম সেটা নিয়ে কথা বলবেন। আমরা যাই।”

রিসেপশনের মহিলা বলল, “দাঁড়াও। আমাদের মগের একটা স্যাম্পল নিয়ে যাও। তোমাদের ম্যাডামকে দেখাবে।”

সরফরাজ কাফী বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ বল যদি চার থেকে পাঁচ হাজার মগ কিনে তাহলে থার্টি ফাইভ পারসেন্ট ডিসকাউন্ট। ডেলিভারি কস্ট আমাদের।”

সালমা বলল, “ঠিক আছে।” তারপর আর কোনো কথা না বলে দরজার দিক হাঁটতে থাকে। পেছন থেকে সরফরাজ কাফী গলা উঁচিয়ে বলল, “যদি আসলে চার পাঁচ হাজার মগের অর্ডার দিতে পার তাহলে তোমাদের দুইজনকে আমরা একটা ভালো কমিশন দিতে পারি–”

টুনির শরীরটা ঘিনঘিন করতে থাকে, তারা আর কিছু না বলে দি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির অফিস থেকে বের হয়ে এল। কয়েক পা এগোতেই দেখল একটা ছোট বাচ্চা মেয়ে ফুল বিক্রি করছে। টুনি থেমে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার পানি খাবার জন্য মগ লাগবে?”

মেয়েটা অবাক হয়ে বলল, “মগ?”

“হ্যাঁ।” বলে টুনি তার দিকে মগটা এগিয়ে দিল।

মেয়েটা অবাক হয়ে মগটা হাতে নিল। টুনি তখন সালমাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি হাঁটতে শুরু করে। বেশ খানিক দূরে গিয়ে সে সালমাকে বলল, “মানুষটা কত খারাপ দেখেছিস? আমাদেরকে কমিশনের লোভ দেখায়!”

সালমা বলল, “চেহারাটাও কেমন জানি সাপের মতো।”

টুনি বলল, “কত লোভ দেখেছিস?”

“হ্যাঁ। অনেক লোভী।” আরও কয়েক পা হেঁটে বলল, “এখন কী করবি?”

টুনি বলল, “পাঁচ হাজার মগ অর্ডার দিব।”

“সত্যি? পরে বিপদে পড়বি না তো?”

“না। কোনো বেআইনি কাজ করব না। আমার আইডিয়া কাজ করবে কিনা জানি না-না করলে নাই। এমনিতে কাজ করার কথা না, কিন্তু মানুষটার যেহেতু লোভ অনেক বেশি কাজ করতেও পারে! চেষ্টা করতে তো ক্ষতি নাই!”

টুনি ভুরু কুঁচকে কিছু একটা চিন্তা করতে থাকে।

.

টুনি ঠিক জানত না তার বুদ্ধিটা কাজ করবে কিনা, কিন্তু সেটা কাজ করল। তাদের বাঘিনী ম্যাডামের ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠানে যখন মৌটুসি বাঘিনী ম্যাডাম কত মায়াময় সেটা গলা কাঁপিয়ে বলছে তখন টুনি দেখল কয়েকজন মানুষ মাথায় কার্টনে করে স্কুলের বারান্দায় এনে মগ রাখছে। শত শত নয়, হাজার হাজার মগ। যারা দেখতে পেয়েছে তারা বিষয়টা জানার জন্য উশখুশ করতে লাগল। টুনি তখন ফিসফিস করে জানিয়ে দিল এটা মগ, স্কুলের সব ছেলেমেয়ের জন্য আনা হয়েছে।

কিছুক্ষণের মাঝেই সবার কাছে খবরটা ছড়িয়ে পড়ে। ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠান থেকে প্রথমে এক-দুইজন তাদের ফ্রি মগ আনতে গেল। তাদের দেখাদেখি অন্যরা এবং কিছুক্ষণের ভেতর বাঘিনী ম্যাডামের ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠান খালি করে সবাই তাদের মগ নিয়ে ছোটাচ্চুটি করতে থাকে।

টুনি কিছুক্ষণের ভেতর সরফরাজ কাফীকে খুবই উদ্বিগ্ন মুখে ঘোরাঘুরি করতে দেখল এবং একসময় মঞ্চে বসে থাকা তাদের হেড ম্যাডামের কাছে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো। টুনি দূর থেকে সরফরাজ কাফী আর হেড ম্যাডামের কথা শুনতে পেল না কিন্তু দূরে বসে থেকেই কী কথাবার্তা হচ্ছে সেটা অনুমান করতে পারল। কথাগুলো নিশ্চয়ই এ রকম:

সরফরাজ কাফী : ম্যাডাম আপনাদের মগগুলো নিয়ে এসেছি।

ম্যাডাম : কিসের মগ?

সরফরাজ কাফী : যে মগ আপনি অর্ডার দিয়েছিলেন।

ম্যাডাম : আমি কোনো মগ অর্ডার দেই নাই।

সরফরাজ কাফী : দিয়েছেন ম্যাডাম। আমার কাছে চিঠি আছে।

ম্যাডাম : চিঠি? দেখি কী চিঠি।

সরফরাজ কাফী তার পকেট থেকে চিঠি বের করে দেখাল। ম্যাডাম চিঠি পড়ে দেখলেন তারপর মুখ গম্ভীর করে বললেন:

ম্যাডাম : এই চিঠি আমি লিখি নাই। এই প্যাড আমার স্কুলের না। নিচের সিগনেচার আমার না। আমার নাম মোটেও বুতরুন্নেসা না।

সরফরাজ কাফী : কী বলছেন আপনি? আমি এতগুলো মগ ডেলিভারি দিয়েছি।

ম্যাডাম : চিঠিটা ভালো করে পড়ে দেখেছেন এখানে কী লিখেছে?

সরফরাজ কাফী : কী লিখেছে?

ম্যাডাম : এই দেখেন দুই নম্বর প্যারাগ্রাফে লেখা, এটি একটি ভুয়া চিঠি। ভুয়া মানুষের কাছে ভুয়া চিঠি। এই ভুয়া চিঠির ফলাফলের জন্য কেউ দায়ী নয়।

সরফরাজ কাফী : সর্বনাশ! তাই লেখা?

ম্যাডাম : হ্যাঁ। কেউ একজন আপনার সাথে মজা করেছে।

সরফরাজ কাফী : এ্যাঁ? কী বলছেন আপনি?

ম্যাডাম : আপনার চিঠিটা ভালো করে পড়া দরকার ছিল। আপনার মগ নিয়ে আপনি বিদায় হন। আজকালকার বাচ্চারা অনেক দুষ্ট হয়।

সরফরাজ কাফী : কিন্তু ছেলেমেয়েরা আমার মগ নিয়ে চলে যাচ্ছে। আমার চার হাজার মগ! তিন লাখ টাকার মগ। আমার কী হবে?

ম্যাডাম : ঠিক আছে আমি বলে দিই ছেলেমেয়েরা যেন আপনার মগ ফিরিয়ে দেয়।

ম্যাডাম তখন বাঘিনী ম্যাডামের ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠানের মাইকে মুখ লাগিয়ে বললেন, “এই যে ছেলেমেয়েরা। তোমরা স্কুলের বারান্দায় রাখা মগগুলো নিয়ে যেয়ো না। ফিরিয়ে দিয়ে যাও।”

কেউ অবশ্যি ফিরিয়ে দিল না। যারা জানত না যে স্কুলের বারান্দায় মগ আছে এবার তারাও সেটা জেনে গেল এবং তারাও এসে মগ নিয়ে যেতে থাকল। আগে একটা করে নিয়েছিল এবারে তিন চারটা করে নিতে থাকল।

সরফরাজ কাফী যখন দৌড়ে গিয়ে নিজের মগ বাঁচানোর চেষ্টা করল তখন ছেলেমেয়েরা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। বাঘিনী ম্যাডামের ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠানে গোলমাল হচ্ছিল বলে স্কুলের দারোয়ান সরফরাজ কাফীকে স্কুল কম্পাউন্ড থেকে বের করে দিল।

পুরো ঘটনাটা দেখে টুনি আর সালমার মুখের হাসি আর বন্ধ হয় না।

বাঘিনী ম্যাডামের হাস্যকর ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠান শেষে টুনি আর সালমা যখন বের হয়ে এল তখন দেখল বারান্দায় অনেকগুলো খালি কার্টন এবং সেখানে হ্যাঁন্ডেল ভাঙা একটা মগ পড়ে আছে।

সালমা সেই মগটা তুলে নিল, টুনি জিজ্ঞেস করল, “এই উঁটি ভাঙা মগ দিয়ে কী করবি?”

সালমা দাঁত বের করে হাসল, বলল, “স্যুভেনির হিসেবে রেখে দিব!”

তারপর দুইজনে মিলে হাসতে শুরু করে। হাসি আর থামতে চায় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *