স্যুপ
ছোটোবেলায় আমার নিশ্চিত ধারণা ছিল সুপ সুপ করে পান করতে হয় বলে এই পানীয়ের নাম স্যুপ। ব্যাকরণে উৎসাহী পাঠকদের জানাই, সুপসুপা সমাস নামে একখানা সমাস আছে, যার সঙ্গে স্যুপের কোনও যোগ আছে বলে জানা যায়নি। স্যুপের ইতিহাস বহু পুরাতন। মানুষ যবে থেকে মাটির বা পাথরের পাত্র বানিয়ে জল ফোটাতে শিখল, প্রায় তবে থেকে স্যুপের শুরু। চিনের জিয়াংজি প্রদেশের জিয়ানরেনডং গুহায় ২০ হাজার বছর আগের একটি স্যুপ বোল পাওয়া গেছে। মাটির পাত্রটিতে পুড়ে যাওয়ার দাগ পাওয়া গেছে, যার অর্থ এতে গরম স্যুপ রাখা হয়েছিল। প্রাচীন মানুষ গর্ত খুঁড়েছিল প্রথমে। তারপর চকমকি পাথর দিয়ে আগুন জ্বেলেছিল। পাত্রটি জলে পূর্ণ করে তার মধ্যে শিকার করা পশুর নাড়িভুঁড়ি রেখেছিল। শেষে সেটি আগুনের ওপর ধরেছিল। তৈরি হয়ে গিয়েছিল প্রাচীন মানুষের স্যুপ।
অবশ্য তখন তাকে আদিম মানবেরা কী বলত জানা নেই, তবে অনেক পরে ফরাসি স্যুপা থেকে এই শব্দটা এসেছে। ফরাসি শব্দটাও এসেছে ল্যাটিন স্যুপা থেকে, যার মানে ঝোলে চোবানো পাউরুটি। জার্মানরা অবশ্য এখনও ঘন স্যুপে ডোবানো রুটিকে সপ বলেই ডাকেন। ৫০০ বছর ধরে রোমানরা বিশ্বের এদিক-ওদিক দাপিয়ে বেড়িয়েছে। স্যুপের ইতিহাসেও তারা দাগ রেখে গেছে। স্পেনে তারা নিয়ে গিয়েছিল গাজপাচো। বিয়ের আসরে বিশেষ রকমের স্যুপ তারা তৈরি করত। ৪৭৬ অব্দে পশ্চিমে রোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে স্যুপ বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যে টিকে গেল, বিশেষ করে কনস্টান্টিনোপলে স্যুপের ভালো চল ছিল। তারপর ১৪৫৪ সালে অটোমানরা কনস্টান্টিনোপল জয় করে নিলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের স্যুপের মিলন ঘটল। তুর্কিরা স্যুপে প্রচুর সবজি দিত আর ইউরোপীয়দের স্যুপে মাংস থাকত। তুর্কিদের স্যুপ খাওয়ার নির্দিষ্ট সময় ছিল না, দিনের যে-কোনো সময় খেত। এদিকে ইংল্যান্ড, জার্মানি আর গ্রিসের লোকেরা রুটির ওপর স্যুপ ঢেলে খেতে বেশি পছন্দ করত। রেনেসাঁর আমলে ইউরোপে একটা ফ্যাশন চালু হল— গলায় আলগা কলার পরার। এই কলার পরার কারণে লোকদের বোলে করে স্যুপ খেতে অসুবিধা হচ্ছিল। তাই এল স্যুপ স্পুন বা স্যুপের চামচ। ঠিকই ধরেছেন, তার আগে বাটি ধরে স্যুপ গলায় ঢালার প্রথাই ছিল, ডালে চুমুক দেবার মতো। আর আজকাল তো চামচ ছাড়া স্যুপ খাওয়ার কথা ভাবাই যায় না। ষোড়শ শতকে ফ্রান্সে প্রথম রেস্তোরাঁ চালু হলে (এই রেস্তোরাঁ শব্দটা এসেছে রেস্টোর বা গড়ে তোলা থেকে) প্রথমেই সবচেয়ে সস্তায় একমাত্র যে খাবার সরবরাহ করা হত, তা হল সবজির স্যুপ। ১৭৬৫ সাল অবধি রেস্তোরাঁ মানে স্যুপের দোকানই বুঝতেন জনগণ। ১৭৭২ সালের বিখ্যাত কুকবুক ‘The Frugal Housewife’-এ গোটা একটা অধ্যায় আছে স্যুপ রান্নার রেসিপি নিয়ে। শুধু ইউরোপে না, এশিয়াতেও স্যুপ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এশিয়ার সবচেয়ে পুরোনো স্যুপ হল ফো। এই ফো-এর উৎপত্তি হয় বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, উত্তর ভিয়েতনামে, হ্যানয়-এর দক্ষিণ-পূর্বে নাম ডিন প্রদেশে। ঐতিহ্যগতভাবে ফো-এর আঁতুড়ঘর ধরা হয় ভান চু এবং ডাম চু গ্রামকে। গ্রামবাসীদের মতে ভান চু গ্রামে ফরাসি ঔপনিবেশিক যুগের আগে থেকেই ফো খাওয়া হত। ফো-এর জনপ্রিয়তা আসে ফরাসি উপনিবেশ স্থাপনের পর, যখন গোরুর মাংসের আমদানি বৃদ্ধি পায়। চিনের ইউনান এবং কুয়াংতোং প্রদেশের শ্রমিকেরা একে জনপ্রিয় করে তোলে। ফো সাধারণত চিনে ফেরিওয়ালারা ভোরে এবং সন্ধ্যায় তাদের ভ্রাম্যমাণ চুলায় নিয়ে বিক্রি করত। তাদের ভ্রাম্যমাণ চুলার দুটো অংশ থাকত, এক অংশে কাঠ দিয়ে জ্বালানো আগুন এবং আর-এক অংশে ফোটানো জল, নুডলস, মশলা, ভেষজ এবং মাংস থাকত। এখন যত চাইনিজ স্যুপ খাই, সব এই ফো-এরই নাতিনাতনি।
তবে ফ্রান্সে স্যুপ নিয়ে যত বাড়াবাড়ি, তেমনটা আর কোথাও নেই। নানা দাঁতভাঙা নামের অদ্ভুত স্যুপ রয়েছে তাদের রেসিপিতে। এদের মধ্যে আবার সবচেয়ে জনপ্রিয় পেঁয়াজের স্যুপ। ক্যারামেলাইজড পেঁয়াজ মাখন আর চিজের সঙ্গে মিলে অদ্ভুত স্বাদ তৈরি করে।
অনেকদিন অবধি ধারণা ছিল, এ বুঝি ফরাসিদের নিজস্ব আবিষ্কার। পরে দেখা গেল ২৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারস্যের রাজা সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাবার সময় সৈন্যদের জন্য প্রচুর পরিমাণে এই স্যুপ বানিয়ে নিয়ে গেছিলেন। পারস্যে অবশ্য এর নাম আস-এ-নাজরি বা প্রার্থনার স্যুপ। বাড়িতে কোনও শিশু অসুস্থ হয়ে পড়লে বা কেউ দূরদেশে গেলে শিশুর রোগমুক্তি বা সেই যাত্রীর শুভ আগমনের কামনায় বাড়ির সবাই মিলে এই স্যুপ রান্না করতেন। রান্নার উপকরণ দিতেন সব আত্মীয় আর বন্ধুরা, সমান পরিমাণে। এতে কোনও গরিব বা বড়োলোক ভেদ থাকত না। সবাই মিলে প্রার্থনা করতেন সেই স্যুপ ঘিরে। আর যদি তাঁদের প্রার্থনাপূরণ হত, তবে প্রতি বছর সেই এক দিনে আবার সবাই মিলে এই স্যুপ বানাতেন।
খাঁটি ভারতীয় স্যুপ বলতে কি কিছুই নেই? আছে তো। মুল্লিগাটাওনি স্যুপ। চলে যাওয়া ব্রিটিশ রাজের স্মৃতি হিসেবে যে কটা খাদ্য রয়ে গেছে, তাদের অন্যতম এটি। তামিল মিলাগাউ-তান্নির মানে লংকা মেশানো জল। মাংসের টুকরো জলে ফুটিয়ে তার সঙ্গে লবণ, লংকা আর মশলা দেওয়া এই স্যুপ ব্রিটিশদের দারুণ পছন্দের ছিল। মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে পোস্টেড সব ইংরেজরা এই মুল্লি বলতে অজ্ঞান। ১৮৪৫ সালে এলিজা অ্যাক্টন তাঁর রেসিপির বই ‘Modern Cookeries for Private Families’-এ এই স্যুপের রেসিপি প্রথম ফাঁস করে দিলে ব্রিটেনে এই স্যুপের জয়যাত্রা শুরু হয়।
বহনযোগ্য বা পকেট স্যুপের প্রচলন হয় উনিশ শতকের শেষে। ব্রিটিশরা যখন তাঁদের উপনিবেশগুলোতে বেড়াতে যেতেন, তখন ব্যাগে স্যুপ বহন করতেন। এতে শুধু গরম জল মেশালেই হত। এরপরই ক্যানড স্যুপের চল হয়। ক্যাম্পবেল স্যুপ কোম্পানির ড. জন টি ডরেন্স ১৮৯৭ সালে এটি আবিষ্কার করেন। কাউবয় ও সৈনিকদের মধ্যে ক্যানড স্যুপের আদর ছিল বেশি। উজ্জ্বল লাল রঙের এই স্যুপ ক্যান এখন প্রায় আমেরিকান আইকনে পরিণত হয়েছে, বিশেষত অ্যান্ডি ওয়ারল একে নিয়ে ছবি আঁকার পর।
ব্যুফের ইতিবৃত্ত
ব্যুফে শুনলেই মনের খিদেটা চাগিয়ে ওঠে। যা খুশি খাও, যত খুশি খাও। উনিশ শতকে ফ্রান্সে প্রথম ভোজবাড়িতে এই ব্যুফের চল হয়। রান্নাঘরের একপাশে কাঠের তক্তায় স্টার্টার থেকে ডেজার্ট, সবকিছু সাজানো থাকত। সময় সুযোগ বুঝে যে যার মতো খেয়ে নিত। সুইডেনে স্মরগাসবোর্ড নামে ঠিক এই জিনিসই চলত। তক্তার তলায় ড্রয়ারে রাখা থাকত ছুরি, কাঁটা, প্লেট আর মদ।
ব্যুফের নাম ব্যুফে অবশ্য হয়েছে আলফাঁস ব্যুফের নামে। এই ভদ্রলোক ছিলেন খাঁটি প্যারিসের মানুষ আর তাই অসংযমী, জুয়ারি এবং মাতাল। লর্ড স্যান্ডউইচের মতো ইনিও তাস খেলায় বাধা পড়ুক, তা চাইতেন না। চাকরদের বলাই থাকত, যত খাবারদাবার আছে তা তাস খেলার টেবিলের পাশে এনে জড়ো করতে। তিনি সুযোগ বুঝে খেয়ে নেবেন। তাঁর সঙ্গীরাও খাওয়াতে অংশ নিতেন। মুশকিল হল, ইদানীং জানা গেছে এই গোটা গল্পটাই মিথ্যে, ফরাসি ঢপবাজি, ইংরেজদের স্যান্ডউইচের গল্পকে টেক্কা দিতে।
পুরোনো ফরাসি শব্দে ব্যুফে মানে কাঠের টুল বা বেঞ্চি। যে কাঠের বেঞ্চে এই খাবার রাখা থাকত, তার নামেই এই ব্যুফের নাম। কীভাবে যেন ইংরাজিতে শব্দটা চলে আসে, সঙ্গে গল্পটাও। আর স্যান্ডউইচে বিশ্বাস রাখা ইংরেজ এই ফরাসি চালাকিটা ধরার আগেই গল্পটা লোকমুখে সত্যি হয়ে গেছিল।