স্যালভেশন অফ আ সেইন্ট – ৫

অধ্যায় ৫

দীর্ঘ আলিঙ্গন শেষে সোজা হয়ে দাঁড়ালো আয়ানে। “দুঃখিত,” সবার উদ্দেশ্যে বলল সে। “ভেবেছিলাম নিজেকে ধরে রাখতে পারবো, কিন্তু হিরোমি…তোমাকে দেখার পর কি যে হলো,” এখনও ফোঁপাচ্ছে সে। “এখন ঠিক আছি আমি।”

কষ্ট করে মুখে একটা হাসি ফোটানোর চেষ্টা করল আয়ানে। দৃশ্যটা দেখে পেটে মোচড় দিয়ে উঠল কুসানাগির। এ মুহূর্তে একান্তে সময় কাটানো প্রয়োজন তার।

“আপনার কোন কিছুর দরকার হলে আমাকে বলবেন,” হিরোমি বলল।

“শুধু এখানে থাকো, আর কিছু চাই না আপাতত,” মাথা ঝাঁকিয়ে বলল আয়ানে। “মাথা ঠিক মত কাজ করছে না আমার। কিন্তু তোমার মুখ থেকে সবকিছু শুনতে চাই।”

“মাফ করবেন, মিসেস মাশিবা,” যতটা সম্ভব শান্ত স্বরে বলল কুসানাগি। “আমরা মিস ওয়াকাইয়ামার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলতে চাই। গতরাতে তাড়াহুড়োয় অনেক কিছুই জানা হয়নি।”

বিভ্রান্তি ভর করল হিরোমির চেহারায়।

“আপনারাও চাইলে থাকতে পারেন, আমার কোন সমস্যা নেই,” আয়ানে বলল।

মনে মনে নিজেকে গালি দিল কুসানাগি। কথাটা ঠিকভাবে বলতে পারেনি সে। “মানে… আমরা মিস ওয়াকাইয়ামার সাথে প্রথমে কথা বলতে চাই, যদি আপনি কিছু না মনে করেন।”

“কিন্তু আমিও ওর কাছ থেকে সব শুনতে চাই,” আয়ানে বলল, সেজন্যেই তো আসতে বললাম।”

“মিসেস মাশিবা, তদন্তের খাতিরে নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয় আমাদের। মিস ওয়াকাইয়ামার সাথে আমাদের কথা বলাটা জরুরি এ মুহূর্তে। আনুষ্ঠানিকতাও বলতে পারেন। খুব বেশি সময় লাগবে না।”

এই কথার পর কারো পক্ষে মানা করা সম্ভব হয় না, মনে মনে বলল কুসানাগি।

“ঠিক আছে,” ভ্রু কুঁচকে বলল আয়ানে। “কিন্তু আমি কোথায় থাকবো?”

“এখানেই। আমরা আপনার সাথে কথা বলতে চাই,” বলে উতসুমি আর কুসানাগির দিকে তাকালো মামিয়া। “তোমরা মিস ওয়াকাইয়ামার সাথে অন্য কোথাও গিয়ে কথা বলো নাহয়।”

“গাড়ী বের করছি আমি,” বলে দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল উতসুমি।

বিশ মিনিট পর হিরোমি আর উতসুমির সাথে নিজেকে একটা চব্বিশ ঘন্টা খোলা রেস্তোরাঁয় আবিষ্কার করল কুসানাগি। বেশ চুপচাপ জায়গাটা। টেবিলে মুখোমুখি বসেছে ওরা। একপাশে দুই ডিটেক্টিভ, অপর পাশে মিস ওয়াকাইয়ামা।

“কাল রাতে ঘুম হয়েছে আপনার?” কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল কুসানাগি।

“না, বারবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল।”

“এরকম একটা ঘটনার পর সেটাই স্বাভাবিক।” কাঁদছিলেন নিশ্চয়ই সারারাত। “প্রতিদিন তো আর দরজা খুলে একটা মৃতদেহ আবিষ্কার করে না কেউ।” বিশেষ করে প্রেমিকের।

মাথা নিচু করে বসে আছে হিরোমি।

“কয়েকটা প্রশ্ন করা বাকি ছিল গতকাল। সেগুলোই জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলাম আজকে। আশা করি আপনি কিছু মনে করবেন না।”

লম্বা করে শ্বাস নিল হিরোমি। “আসলে আমার বলার মত তো আর কিছু নেই। কি জিজ্ঞেস করবেন তা মাথায় আসছে না।”

“কঠিন কিছু জিজ্ঞেস করবো না। যদি আপনি সৎভাবে প্রশ্নগুলোর উত্তর দেন তাহলে খুব বেশি সময় লাগবে না।”

মাথা তুললো হিরোমি, দৃষ্টিতে ক্ষণিকের জন্যে ক্রোধ উঁকি দিয়ে মিলিয়ে গেল। “মিথ্যে কিছু বলিনি আমি।”

“তাহলে তো কোন সমস্যাই নেই। আপনি গতকাল ইয়োশিতাকা মাশিবার মৃতদেহ খুঁজে পান রাত আটটার দিকে। এর আগে শেষবারের মত মাশিবাদের বাসায় আপনি গিয়েছিলেন গত শুক্রবার, একটা দাওয়াতে। তাই তো?”

“জি।”

“ঠিকমতো ভেবে উত্তর দিন মিস ওয়াকাইয়ামা। পরিচিত কারো মৃতদেহ এরকম পরিস্থিতিতে আবিষ্কারের পর প্রায় ক্ষেত্রেই অনেক কিছু ভুলে যায় লোকে। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করুন একবার। আপনি কি আসলেও শুক্রবার রাতের পর মাশিবাদের বাসায় যাননি?” হিরোমির চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করল কুসানাগি।

পলক ফেলতেও যেন ভুলে গেছে হিরোমি। “এ কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন বারবার? আপনাদের তো সত্যটা বলেইছি আমি।”

“প্রশ্নগুলো আপাতত আমরাই করি নাহয়?” মৃদু হেসে বলল কুসানাগি। “আপনি কেবল উত্তর দিন।“

“কিন্তু”

“মনে করুন যে আপনার স্মৃতিশক্তি যাচাই করছি আমরা। বারবার প্রশ্ন করার কারণ হচ্ছে আমরা চাই যে আপনি ঠিক উত্তরটা দিন। পরে যদি দেখা যায় যে আপনি ভুল কিছু বলেছিলেন বা কিছু চেপে গিয়েছেন তাহলে আমাদের বা আপনার কারো জন্যেই ভালো হবে না ব্যাপারটা।”

এবারে আর কিছু বলল না হিরোমি। তার মাথায় যে চিন্তার ঝড় বইছে তা পরিষ্কার বুঝতে পারছে কুসানাগি। নিশ্চয়ই ভাবছে, খুব শিঘ্রই তার মিথ্যেটা ধরা পড়ে যাবে। এখনই সত্যটা স্বীকার করবে কি না সেটা নিয়ে দোটানায় ভুগছে।

মুখ বন্ধই রাখলো হিরোমি। সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, কী করবে। ক্রমেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে কুসানাগি।

“আমরা যখন কালকে ঘটনাস্থলে পৌঁছাই, সিঙ্কে একটা কফি কাপ আর দু’টা পিরিচ রাখা ছিল। আপনাকে প্রশ্ন করা হলে আপনি বলেন, এ ব্যাপারে কিছু জানেন না, কিন্তু পরবর্তীতে পরীক্ষা করে কাপের গায়ে আপনার হাতের ছাপ পেয়েছে ফরেনসিক ডিপার্টমেন্ট। তাই স্বভাবতই আমি ভাবছিলাম, কাপটা কখন ধরলেন আপনি।”

নিশ্বাসের সাথে উঠছে নামছে হিরোমির কাঁধ জোড়া।

“ইয়োশিতাকা মাশিবার সাথে দেখা করেছিলেন আপনি, তাই না? মিসেস মাশিবা স্যাপোরো যাবার পর।“

দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কিছুক্ষণ বসে রইলো হিরোমি। কুসানাগি মোটামুটি নিশ্চিত যে এবারে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে না সে, যতই চেষ্টা করুক না কেন।

দীর্ঘক্ষণ পর মাথা নাড়লো হিরোমি। “হ্যাঁ, দেখা করেছিলাম। সরি।”

“মি. মাশিবার সাথে দেখা করেছিলেন, এটা স্বীকার করছেন?”

“হ্যাঁ।”

“কখন?”

এবারও তৎক্ষণাৎ কোন জবাব দিল হিরোমি। আস্ত গাড়ল, মনে মনে বলল কুসানাগি। ধৈর্য্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে তার।

“আমাকে কি প্রশ্নটার উত্তর দিতেই হবে?” আবারো দুই ডিটেক্টিভের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল সে। “যা ঘটে গেছে তার সাথে এটার কোন সম্পর্ক নেই। একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।”

দেখে মনে হচ্ছে যেকোন মুহূর্তে কেঁদে দেবে মেয়েটা। তবে কথা ঝাঁঝালো ভাবটা ঠিকই ধরতে পারলো কুসানাগি। বয়স্ক এক সহকর্মীর বলা একটা উক্তি মনে পড়ে গেল কুসানাগির-দেখে যতই নরম মনে হোক না কেন, পরকীয়ায় লিপ্ত কোন মহিলাকে কখনো ছোট করে দেখবে না।

সময় নষ্ট করতে ইচ্ছে করছে না কুসানাগির। “আমরা জানতে পেরেছি, কী কারণে মৃত্যু হয়েছে মি. মাশিবার,” হিরোমির চাহনির পরোয়া না করে বলল সে, “বিষ মেশানো হয়েছিল কফিতে।”

“কি?” আদতেই চমকে উঠল হিরোমি।

“হ্যাঁ, মেঝেতে পড়ে থাকা কফিতে বিষের অস্তিত্ব পেয়েছি আমরা।“

চোখ যেন কোটর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসবে হিরোমির। “কী যা-তা বলছেন এসব। এটা অসম্ভব!”

কিছুটা সামনে ঝুঁকলো কুসানাগি। “কেন অসম্ভব?”

“কারণ…”

“সকালে যখন তার সাথে কফি খেয়েছিলেন আপনি, তখন কোন সমস্যা হয়নি, এই তো?”

ক্ষণিকের জন্যে ভাষা হারিয়ে ফেলল হিরোমি, এরপর মাথা নেড়ে সায় জানালো।

“আমাদের সমস্যাটা নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পারছেন, মিস ওয়াকাইয়ামা। মি. মাশিবা যদি নিজেই কফিতে বিষ মেশান—তাহলে সেটা আত্মহত্যা কিংবা দুর্ঘটনা হতে পারে। কিন্তু সেটার সম্ভাবনা খুবই কম। তাই এমনটা ভাবাই শ্রেয় যে, কেউ একজন ইচ্ছেকৃতভাবে তার অজান্তে কফিতে বিষ মিশিয়েছে। কফি ফিলটারেও বিষের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে। আমাদের ধারণা কফি বিনের সাথে মেশানো হয়েছিল বিষ।”

রক্তিম হয়ে উঠেছে হিরোমির চেহারা। মাথা ঝাঁকালো সে। “এ ব্যাপারে কিছু জানি না আমি।”

“আমাদের কিছু প্রশ্নের জবাব তো দিতে পারবেন? এটা জানা খুবই জরুরি, ঠিক কখন মি. মাশিবার সাথে কফি খেয়েছিলেন আপনি। তাহলে আমরা ধারণা করতে পারবো যে কখন বিষ মেশানো হয়েছিল কফিতে।”

সোজা হয়ে বসে হিরোমির চোখের দিকে তাকালো। দরকার হলে সারাদিন চুপচাপ বসে থাকতে পারবে সে।

এক পর্যায়ে দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কান্না চাপার চেষ্টা করল হিরোমি। “আমি করিনি কাজটা,” হঠাৎ করেই বলে বসলো এরপর।

“হুম?”

“আমি কফিতে বিষ মেশাইনি, বিশ্বাস করুন।”

মুখ চাওয়াচাওয়ি করল কুসানাগি আর উতসুমি।

হিরোমি ওয়াকাইয়ামা হচ্ছে এখন অবধি এই ঘটনার একমাত্র সন্দেহভাজন আসামী। কফিতে বিষ মেশানোর পর্যাপ্ত সুযোগ ছিল তার হাতে। হয়তো ইয়োশিতাকা মাশিবার সাথে সম্পর্কে ফাটল ধরেছিল তার কিংবা কোন অজ্ঞাত কারণে মনে মনে ক্ষোভ পুষে রেখেছিল। মাশিবার মারা যাবার পর ‘ঘটনাক্রমে তার মৃতদেহ আবিষ্কারের ঘটনার পুরোটাই নাটক হতে পারে।

অবশ্য কেসটার প্রাথমিক পর্যায়েই যদি হিরোমিকে খুনি হিসেবে ধরে নেয় ওরা, তাহলে অনেক কিছুই অজানা থেকে যেতে পারে। এ মুহূর্তে মিস ওয়াকাইয়ামার বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শোনাটা অত্যন্ত জরুরি। ইচ্ছে করেই তৎক্ষণাৎ কিছু বলা থেকে নিজেকে বিরত রাখলো কুসানাগি। সে শুধু জিজ্ঞেস করেছিল যে ইয়োশিতাকা মাশিবার সাথে কখন কফি খেয়েছিল হিরোমি। এই প্রশ্নের জবাবে হঠাৎ নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লাগলো কেন সে? নিশ্চয়ই ওদের মনোভাব আঁচ করতে পেরেছে কিছুটা।

“আপনাকে কিন্তু কোন প্রকার দোষারোপ করছি না আমরা,” কুসানাগি মৃদু হেসে বলল। “শুধু ঘটনার সঠিক সময়টা আন্দাজ করতে চাইছি। সেক্ষেত্রে আপনি যদি মি. মাশিবার সাথে দেখা করে তার সাথে কফি খেয়ে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই এটাও বলতে পারবেন, কফিটা কে বানিয়েছিল, কিভাবে বানিয়েছিল বা কখন বানিয়েছিল।”

চেহারায় ফ্যাকাসে ভাবটা আরো প্রকট হলো হিরোমির। কুসানাগি এখনও বুঝতে পারছে না, কেন দ্বিধাবোধ করছে সে। অন্য কোন কিছু লুকোচ্ছে না তো?

“মিস ওয়াকাইয়ামা?” হঠাৎই পাশ থেকে ডাক দিল উসুমি।

চমকে তার দিকে তাকালো হিরোমি।

“ইয়োশিতাকা মাশিবার সাথে আপনার কেমন সম্পর্ক ছিল তা কিছুটা আন্দাজ করেছি আমরা,” উতসুমি বলল নির্লিপ্ত সুরে। “চাইলে আপনি অস্বীকার করতে পারেন ব্যাপারটা। সেক্ষেত্রে আরো কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে হবে আমাদের,” ব্যক্তিগত কথাটার প্রতি জোর দিল সে। “যেভাবেই হোক, সত্যটা বের করে আনাই আমাদের কাজ। আর সেই কাজের অংশ হিসেবে তখন আরো অনেকের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে হতে পারে। আমি যা বললাম, তা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবুন। আপনি যদি প্রশ্নগুলোর ঠিকঠাক উত্তর দেন, তখন আমরাও সেভাবেই তদন্ত করবো। আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন না, কিছু তথ্য আমরা বাদে বাইরের কেউ জানুক।“

কুসানাগির দিকে তাকিয়ে একবার মাথা নাড়লো উতসুমি।

হিরোমি আসলেও ভাবছে, কী করবে। হয়তো এবারে একজন নারী কথাগুলো বলায় ব্যাপারটাকে আরো গুরুত্ব দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর মাথা উঠিয়ে ওদের দিকে তাকালো সে।

“আপনারা আসলেও কাউকে কিছু বলবেন না?”

“যদি তথ্যগুলো কেসের সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত না হয়, তাহলে আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার ব্যক্তিগতই থাকবে। সবসময় এমনটাই হয়, কুসানাগি বলল ব্যাখ্যার সুরে।

মাথা নাড়লো হিরোমি। “তাহলে…মানে… আপনাদের সন্দেহ ঠিক। মি. মাশিবার সাথে বিশেষ সম্পর্ক ছিল আমার। আর এই উইকেন্ডে তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম আমি।”

“সময়টা বলুন।”

“শনিবার রাতে। ন’টার একটু পরে।”

সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে তাহলে দু’জনে।

“আপনাদের সাক্ষাতের ব্যাপারটা কি পূর্ব পরিকল্পিত ছিল?”

“না। ক্লাসের মাঝে আমাকে কল দিয়েছিল ও, শেষের দিকে। বাসায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানায়।”

“আর আমন্ত্রণ রক্ষা করেছিলেন আপনি। এরপর?”

কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলো হিরোমি। “রাতটা ওখানে কাটিয়ে পরদিন সকালে চলে আসি,” কুসানাগির দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলে সে।

নোট নিতে শুরু করেছে উতসুমি। তার অভিব্যক্তি দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না এ মুহূর্তে। কিছু না কিছু তো চলছে ওর মাথায়, মনে মনে বলল কুসানাগি। পরে জিজ্ঞেস করা যাবে।

“একসাথে কখন কফি খেয়েছিলেন আপনারা?”

“সকাল বেলা। আমিই বানিয়েছিলাম কফি। এর আগের রাতেও খেয়েছিলাম অবশ্য।“

“শনিবার রাতে? মানে, দু-বার একসাথে কফি খেয়েছিলেন আপনারা?”

“হ্যা।”

“রাতের বেলায়ও আপনিই বানিয়েছিলেন কফি?”

“না। মি. মাশিবা বানিয়েই রেখেছিলেন। আমি পৌঁছুনোর পর কাপে ঢেলে দেন,” হিরোমি বলল। “এবারই প্রথম তাকে কফি বানাতে দেখি আমি।”

“কিন্তু আপনারা রাতের বেলা পিরিচ ব্যবহার করেননি?” উতসুমি তার নোটবুক থেকে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল।

“না।”

“পরদিন সকালে, মানে গতকাল আপনি বানিয়েছিলেন কফি?” কুসানাগি জিজ্ঞেস করল।

“মি. মাশিবা একটু কড়া কফি খেতেন, তাই আমাকেই বানাতে বলেন সকাল বেলা। পুরোটা সময় পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন,” উতসুমির দিকে তাকিয়ে বলল হিরোমি। “এবারে পিরিচ ব্যবহার করেছিলাম আমরা। সিঙ্কে ওগুলোই দেখেছেন আপনারা।”

মাথা নাড়লো কুসানাগি। উতসুমির ধারণা মিলে যাচ্ছে। “শনিবার রাতে আর রবিবার সকালে কি একই কফি বিন ব্যবহার করেছিলেন আপনারা?”

“তাই তো মনে হয়। আমি ফ্রিজ থেকে বের করে নিয়েছিলাম কফি। আগেরদিন মি. মাশিবাও বোধহয় একই জায়গা থেকেই কফি নিয়েছিলেন।”

“এর আগে কি কখনো মাশিবাদের বাসায় কফি বানিয়েছিলেন?”

“খুব কম। আয়ানে কয়েকবার বলেছিল আমাকে কফি বানাতে, তখন। তিনিই আমাকে শিখিয়েছিলেন যে কিভাবে কফিমেকার ছাড়া কফি বানাতে হয়। গতকাল সেভাবেই বানিয়েছিলাম।”

“কফি বানানোর সময় অন্যরকম কিছু চোখে পড়েছিল আপনার? ব্যাগটা কি সাধারণত যেখানে থাকে সেখান থেকে অন্য কোথাও নিয়ে রাখা হয়েছিল? ব্র্যান্ডও কি একই ছিল?”

চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ভাবলো হিরোমি। এরপর মাথা ঝাঁকিয়ে না করে দিল। “অন্যরকম কিছু চোখে পড়েনি। আচ্ছা আপনারা বারবার আমি যখন কফি বানিয়েছিলাম তখনকার কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন? এটার সাথে তো কেসের কোন সম্পর্ক থাকার কথা নয়।

“মানে?”

“মানে…” চোখ নামিয়ে নিল হিরোমি, “সকালের বানানো কফিতে তো কোন প্রকার বিষাক্ত কিছু ছিল না, তাই না? কেউ নিশ্চয়ই পরে মিশিয়েছে।”

“হতে পারে। কিংবা কোন বিশেষ কৌশলে আগেই মিশিয়ে রাখা হয়েছিল।“

“বিশেষ কৌশল?” হিরোমিকে দেখে মনে হলো না যে সে কথাটার সাথে একমত। “ভিন্ন কিছু চোখে পড়েনি আমার।“

“সকাল বেলা কফি খেলেন আপনারা। এরপর?”

“আমি বেরিয়ে যাই। ইকেবুকুরো আর্ট স্কুলে সেলাইয়ের ক্লাস নেই আমি।”

“ক্লাসের শিডিউল?”

“একটা সকালে, নয়টা থেকে এগারোটা। আরেকটা বিকেলে… .তিনটা থেকে ছয়টা।”

“দুই ক্লাসের মাঝের সময়টায় কি করেন আপনি?”

“প্রথম ক্লাস শেষে সবকিছু গুছিয়ে রেখে লাঞ্চ সেরে নেই। এরপর দ্বিতীয় ক্লাসের প্রস্তুতি নেয়া শুরু করি।”

“লাঞ্চ কি সাথে করে নিয়ে যান?”

“সাধারণত বাসা থেকে কিছু নেই না। গতকাল একটা নুডলস রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম…” বলে চোখজোড়া সরু করে তাকালো হিরোমি। “বড় জোর এক ঘন্টা স্কুলের বাইরে ছিলাম। এই সময়ের মধ্যে মাশিবাদের বাসায় গিয়ে আবার ফিরে আসা সম্ভব নয়।”

হাসলো কুসানাগি। “ভাববেন না, এখনই আপনার অ্যালিবাই যাচাই করতে যাচ্ছি না আমরা। আপনি বলেছেন, গতকাল আপনার ক্লাস শেষে মি. মাশিবাকে ফোন দেন। সেই বক্তব্যের কিছু কি বদলাবেন?

দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরালো হিরোমি। “ফোন দিয়েছিলাম, এটা ঠিক কিন্তু কারণটা যা বলেছিলাম তার চেয়ে ভিন্ন কিছু ছিল।”

“আমার যতদুর মনে আছে, আপনি বলেছিলেন যে স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে মি. মাশিবার কোন অসুবিধা হচ্ছে কি না তা জানার জন্যে ফোন দিয়েছিলেন।”

“আসলে…সকাল বেলা যখন বের হই তখন তিনি আমাকে ক্লাস শেষে ফোন দিতে বলেছিলেন,” মি. মাশিবাকে একবার আপনি, আরেকবার তুমি করে সম্বোধন করছে হিরোমি।

কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকলো কুসানাগি। “একসাথে ডিনারের পরিকল্পনা ছিল আপনাদের, তাই না?”

“হ্যাঁ।”

এবারে সব মিলে যাচ্ছে। সেলাই শিক্ষকের স্বামীর জন্যে সচরাচর কেউ এতটা চিন্তিত হয় না যে ফোন না ধরলে বাসায় ছুটে যাবে।”

কাঁধ ঝুলে পড়লো হিরোমির। “আমার মনে হচ্ছিল যে কথাটা হয়তো যুক্তিসংগত শোনাবে না। কিন্তু ঐ মুহূর্তে অন্য কিছু মাথায় আসেনি।”

“মি. মাশিবা ফোন না ধরায় তাদের বাসাতে গিয়েছিলেন আপনি-এই বক্তব্যে কিছু পরিবর্তন করবেন?”

“না। অন্য সব ব্যাপারে যা ঘটেছিল তা-ই বলেছি। আমি দুঃখিত, বাধ্য হয়ে মিথ্যে বলতে হয়েছিল আমাকে।”

কুসানাগির পাশে বসে এক নাগাড়ে নোট নিয়েই যাচ্ছে উতসুমি। হিরোমির দিকে তাকানোর আগে একবার তার দিকে তাকালো সে। এবারে সবকিছু খাপে খাপে বসে যাচ্ছে। গত রাতে যে সন্দেহগুলো ছিল ওদের মনে, সেগুলোও প্রশমিত হয়েছে কিছুটা। অবশ্য এখনই পুরোপুরি বিশ্বাস করা যাবে না হিরোমিকে।

“যেমনটা বলেছিলাম আপনাকে, আমাদের ধারণা এটা একটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড হতে পারে। এটাও জিজ্ঞেস করেছিলাম, কাউকে সন্দেহ হয় কি না আপনার। তখন জবাবে আপনি বলেছিলেন, মি. মাশিবার ব্যাপারে খুব বেশি কিছু জানেন না। এখন যেহেতু আমরা জানি, তার সাথে আপনার কেমন সম্পর্ক ছিল, সে ব্যাপারে কিছু বলবেন?”

ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ ভাবলো হিরোমি। “ইয়োশিতাকাকে হত্যা করতে পারে, এরকম কারো সম্বন্ধে আসলেও কোন ধারণা নেই আমার।”

এই প্রথম মি. মাশিবাকে ‘ইয়োশিতাকা’ বলে ডাকলো হিরোমি।

“একটু মনে করার চেষ্টা করুন। এটা যদি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড হয়ে থাকে, তাহলে কোন না কোন মোটিভ তো থাকবেই। হয়তো আপনাকে সরাসরি সে ব্যাপারে কিছু বলেননি তিনি।

কপাল চেপে ধরে কিছুক্ষণ ভাবলো হিরোমি। “কি বলবো বুঝতে পারছি না। ওর অফিসে সব তো ঠিকই ছিল। কারো সম্পর্কে কখনো কোন ধরণের মন্তব্যও করেনি।”

“একটু সময় নিয়ে ভাবুন।”

বিষণ্ন দৃষ্টিতে কুসানাগির দিকে তাকালো হিরোমি। “বিশ্বাস করুন, কাল সারারাত ভেবেছি। কিভাবে এমনটা হলো তা বুঝতেই পারছি না। ওর সাথে বলা প্রতিটা কথা মনে করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু লাভ হয়নি। আমিও জানতে চাই, কেন ওকে খুন করা হলো!”

কুসানাগি খেয়াল করল, এখনও খানিকটা লাল হয়ে আছে হিরোমির চোখজোড়া। সারারাত কাঁদার ফসল। লোকটাকে আসলেও ভালোবাসতো সে, কিংবা খুব ভালো অভিনয় করতে পারে।

“মি. মাশিবার সাথে আপনার সম্পর্কের শুরুটা কখন?”

প্রশ্নটা শুনে লাল চোখজোড়া বড় হয়ে গেল হিরোমির। “এর সাথে কি কেসের কোন সম্পর্ক আছে?”

“কোনটার সম্পর্ক আছে, কোনটার নেই-তা আমরা বুঝবো। আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন, এ ব্যাপারে অন্য কেউ কিছু জানবে না। আর একবার জরুরি সব তথ্য জানবার পর অতিরিক্ত কোন প্রশ্নও করবো না আমরা।”

ঠোঁটে ঠোঁট চেপে লম্বা একটা শ্বাস নিল হিরোমি। ঠাণ্ডা হয়ে আসা চায়ের কাপে চুমুক দিল একবার।

“তিন মাস আগে।“

ধন্যবাদ,” বলল কুসানাগি। সম্পর্কটা কিভাবে শুরু হলো তা কিভাবে জিজ্ঞেস করা যায় ভাবলো একবার। “অন্য কেউ জানে এ ব্যাপারে?”

“আমার জানামতে-না।”

“কিন্তু এর আগেও নিশ্চয়ই একসাথে বাইরে খেতে গিয়েছিলেন আপনারা। তখন হয়তো কেউ দেখেছিল?”

“এসব ব্যাপারে খুব সাবধানী ছিলাম আমরা। এক রেস্তোরাঁয় কখনো দু’বার যাইনি। তাছাড়া, ইয়োশিয়াতাকা প্রায়ই ব্যবসার খাতিরে পরিচিত অন্য নারীদের সাথেও রেস্তোরাঁয় যেতো। তাই কেউ যদি আমাদের দেখেও ফেলতো, সন্দেহের কিছু ছিল না।”

ইয়োশিতাকা মাশিবা তাহলে পাকা খেলোয়াড় দেখা যাচ্ছে, ভাবলো কুসানাগি। মিস ওয়াকাইয়ামা বাদেও তার অন্য প্রেমিকা থাকতে পারে। আর সেটাই হবে হিরোমির মোটিভ।

লেখা থামিয়ে মাথা উঁচু করল উতসুমি। “আপনারা কখনো কোন হোটেলে দেখা করেছেন?” জিজ্ঞেস করল সে। আড়চোখে তার দিকে তাকালো কুসানাগি। সে নিজেও এই প্রশ্নটা করতে চাচ্ছিলো অনেকক্ষণ ধরে, কিন্তু কিভাবে করবে বুঝে উঠতে পারছিল না।

এবারে খানিকটা বিরক্ত মনে হলো হিরোমিকে। “এর সাথে কি তদন্তের আসলেও কোন সম্পর্ক আছে?”

উতসুমির অভিব্যক্তিকে কোন পরিবর্তন আসলো না। “অবশ্যই আছে। তদন্তের জন্যে ইয়োশিয়াতাকা মাশিবার প্রাত্যাহিক জীবন সম্পর্কে যত বেশি সম্ভব তথ্য পাবো তত ভালো হবে আমাদের জন্যে। কখন কার সাথে দেখা করতেন তিনি, তা জানা দরকার। আমরা যদি তার পরিচিত সবাইকে প্রশ্ন করি তাহলে অনেক কিছুই জানতে পারবো, কিন্তু এমন কিছু তথ্য আপনার কাছে আছে, যা শুধু আপনিই দিতে পারবেন। হোটেলে গিয়ে আপনারা কি করেছিলেন সে ব্যাপারে কোন কৌতূহল নেই আমাদের। শুধু জানতে চাই যে হোটেলে গিয়েছিলেন কি না।”

“হ্যাঁ, গিয়েছিলাম” বেজার মুখে অবশেষে বলল হিরোমি। “কিন্তু ওস সস্তা হোটেলে নয়, যেখানে… যেখানে…” বাক্যটা শেষ করল না সে।

“আপনারা কি সবসময় একই হোটেলে যেতেন?”

“তিনটা হোটেলে গিয়েছি আমরা। তবে রেজিস্টারে খোঁজ নিলে আমাদের নাম পাবেন না। ছদ্মনাম ব্যবহার করেছিলাম।”

“তবুও, হোটেলের নামগুলো বলুন,” উতসুমি বলল।

মুখ ভার করে তিনটা হোটেলের নাম বলল হিরোমি। তিনটেই প্রথম সারির হোটেল। মাশিবা আর হিরোমি যদি প্রতিদিন ওগুলোয় না গিয়ে থাকে, তাহলে তাদের চেহারা সেখানকার কর্মচারীদের মনে থাকার কথা নয়।

“কোনদিন দেখা করবেন সেটা কি আগে থেকেই ঠিক করে রাখতেন আপনারা?”

“না-সাধারণত হাতের কাজ বুঝে সময় ঠিক করতাম।”

“কতদিন পরপর দেখা করতেন?”

“সপ্তাহে একবার, মাঝে মাঝে দু’বার।”

নোট নেয়া শেষ করে কুসানাগির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো উতসুমি।

“ধন্যবাদ। আপাতত আমাদের আর কোন প্রশ্ন নেই,” বলল কুসানাগি।

“আমার আর কিছু বলারও নেই,” গম্ভীর কন্ঠে বলল হিরোমি।

তার উদ্দেশ্যে একবার হেসে বিলের কাগজটা তুলে নিল কুসানাগি।

রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে তিনজন পার্কিং লটের দিকে হাঁটছে এমন সময়ে হঠাৎ থেমে গেল হিরোমি, “আচ্ছা…” বলল সে, “আমি কি বাসায় ফিরে যেতে পারি এখন?”

“কোন সমস্যা?” তার দিকে ঘুরলো কুসানাগি। “আপনার সাথে না মিসেস মাশিবা দেখা করবে বলেছেন।

“হ্যাঁ, কিন্তু এখন খুব একটা ভালো বোধ করছি না। আমার হয়ে তাকে কথাটা জানাতে পারবেন?”

“ঠিক আছে, বলবো।”

“আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবো?” উতসুমি জিজ্ঞেস করল। “না, ধন্যবাদ। আমি ক্যাব ডেকে নেব।”

ঘুরে বিপরীত দিকে হাঁটা দিল হিরোমি। রাস্তার একপাশে দাঁড়ানো একটা ক্যাবে উঠে পড়লো। মোড় না ঘোরা পর্যন্ত ট্যাক্সিটার দিকে তাকিয়ে রইলো কুসানাগি।

“আমাদের কি মিসেস মাশিবাকে তার স্বামীর পরকীয়ার ব্যাপারটা জানানো উচিত?”

“বুঝতে পারছি না,” জবাবে বলল উতসুমি। “আমাদের কাছে সব স্বীকার করার পর মিসেস মাশিবার মুখোমুখি হতে নিশ্চয়ই বিবেকে বাঁধছিল তার।”

“ঠিক বলেছো।”

“আসলেও কি তিনি কিছু খেয়াল করেননি?”

“কে কিছু খেয়াল করেননি?”

“মিসেস মাশিবা। আপনার কি আসলেই মনে হয়, কিছু জানতেন না তিনি?”

“মনে হয় না।”

“কেন?”

“মিস ওয়াকাইয়ামাকে দেখে কিভাবে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল, খেয়াল করেছো?”

“হ্যাঁ…কিন্তু,” চোখ নামিয়ে নিল উসুমি।

“কি? কিছু বলার থাকলে বলে ফেলো।”

সরাসরি কুসানাগির চোখের দিকে তাকালো উতসুমি। “তাদের দু’জনকে দরজার কাছে দেখে একটা কথা মাথায় এসেছিল আমার। এমন কি হতে পারে না, মিসেস মাশিবা চাইছিলেন যাতে আমরা দৃশ্যটা দেখি?”

“কি?”

“কিছু না, থাক, বাদ দিন। গাড়ি নিয়ে আসছি আমি।”

বিস্মিত দৃষ্টিতে উতসুমির দিকে তাকিয়ে থাকলো কুসানাগি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *