স্যালভেশন অফ আ সেইন্ট – ৩১

অধ্যায় ৩১

আয়ানের সেলাই স্কুলের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে উতসুমি। এই নিয়ে গত কয়েকদিনে বেশ ক’বার আসতে হলো তাকে এখানে। অবশ্য এখন জায়গাটাকে আয়ানের সেলাই স্কুল না বলে আয়ানের বাসা বললেই যথাযথ হবে। এখানে এসে ওঠার পর থেকে ক্লাস নেয়া বলতে গেলে বন্ধই করে দিয়েছে সে।

কুসানাগি দাঁড়িয়ে আছে তার পেছনে। সামনে এগিয়ে কলিংবেলে চাপ দিল জুনিয়র ডিটেক্টিভ।

ভেতর থেকে কোন সাড়া এল না তৎক্ষণাৎ। কিছুক্ষণ পর আবারো বেলে চাপ দিতে যাবে এমন সময় খড়খড় করে উঠল ইন্টারকমের স্পিকার।

“কে?” আয়ানের কন্ঠস্বর শুনতে পেল ওরা।

“আমি, ডিটেক্টিভ উতসুমি,” স্পিকারের সামনে গিয়ে নিচুস্বরে বলল সে, যাতে প্রতিবেশীরা কিছু শুনতে না পায়।

“ওহ, আপনি,” কিছুক্ষণের নীরবতার পর আবারো সরব হয়ে উঠল স্পিকার। “কিভাবে সাহায্য করতে পারি আপনাকে?”

“আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করার ছিল। যদি সময় দিতে পারেন, তাহলে খুব ভালো হবে।”

আবারো কিছুক্ষণের নীরবতা। আয়ানেকে ভেতরে ইন্টারকমের পাশে দাঁড়ানো অবস্থায় কল্পনা করল উতসুমি। নিশ্চয়ই চিন্তায় মগ্ন সে।

“দরজা খুলছি দাঁড়ান,” অবশেষে বলল আয়ানে।

একবার চোখাচোখি হলো উতসুমি আর কুসানাগির। ঢোঁক গিললো সিনিয়র ডিটেক্টিভ।

দরজাটা খুলে গেল এক মুহূর্ত পর। উতসুমির সাথে কুসানাগিকেও দেখতে পেয়ে অবাক হয়েছে আয়ানে, তার চেহারায় স্পষ্ট সেটা।

“এভাবে না বলে চলে আসার জন্যে দুঃখিত,” কুসানাগি মাথা নিচু করে বলল।

“আপনিও এসেছেন তা তো বুঝিনি,” হেসে বলল আয়ানে। “ভেতরে আসুন।”

“ইয়ে…মানে,” কুসানাগি বলল কিছুক্ষণের ইতস্ততার পর। “আপনি কি আমাদের সাথে মেগুরোতে আসতে পারবেন?”

হাসিটা উবে গেল আয়ানের ঠোঁট থেকে। “পুলিশ স্টেশনে?”

“হ্যাঁ। আপনার সাথে কিছু বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলতে হবে আমাদের। ব্যাপারটা একটু বেশিই জরুরি…

সিনিয়র ডিটেক্টিভের চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকলো আয়ানে। উতসুমিও তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো কুসানাগির দিকে। চেহারায় কষ্টের ছাপ স্পষ্ট তার, যেন অনুশোচনা বোধ করছে এখানে এসে।

আগে বুঝতে না পারলেও, এবারে নিশ্চয়ই আয়ানে বুঝে যাবেন যে কেন এসেছি আমরা, উতসুমি ভাবলো।

“আচ্ছা,” হঠাৎই একদম শান্তস্বরে বলল আয়ানে। “আপনাদের সাথে যেতে কোন সমস্যা নেই আমার। কিন্তু তৈরি হতে হবে আগে। আপনারা কি ভেতরে অপেক্ষা করবেন? মেহমানদের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখতে আমার ভালো লাগে না।”

“নিশ্চয়ই,” কুসানাগি জবাব দিল।

দরজা পুরোপুরি খুলে ওদের ভেতরে ঢোকার পথ করে দিল আয়ানে। ক্লাসরুমগুলো একদম পরিস্কার। বেশ কয়েকটা আসবাবপত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছে। মাঝখানের বড় টেবিলটাই কেবল আগের মত আছে।

“ট্যাপেস্ট্রিটা এখনও ঝোলাননি দেখছি,” একবার দেয়ালের দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করল কুসানাগি।

“আসলে, সময়ই পাইনি।”

“তাই? ওটা কিন্তু ঝোলানো উচিত আপনার। নকশাটা এত সুন্দর, যেন ছবির কোন বই থেকে তুলে আনা হয়েছে।”

“ধন্যবাদ,” আয়ানের মুখ থেকে হাসিটা পুরোপুরি মুছে গেল না। ব্যালকনিতে চোখ গেল কুসানাগির। “আপনার ফুলগাছগুলোও নিয়ে এসেছেন দেখছি।”

উতসুমিও তাকালো সেদিকে। রঙ বেরঙের ফুল গাছের সমারোহ সেখানে।

“খুব বেশি আনতে পারিনি,” আয়ানে বলল।

“আচ্ছা। গাছগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে নিয়মিত পানি দেয়া হয়, ‘ বাইরের বড় ওয়াটারিং ক্যানটার দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে বলল কুসানাগি।

“আপনার কেনা ক্যানটা আসলেও কাজে লেগেছে,” আয়ানে বলল। “আবারও ধন্যবাদ।”

“ব্যাপার না,” কুসানাগি বলল তার দিকে তাকিয়ে। “আমাদের কথা ভাবার দরকার নেই, আপনি তৈরি হয়ে নিন।”

মাথা নেড়ে পাশের রুমের দিকে হাঁটতে শুরু করল আয়ানে। কিন্তু দরজাটা খোলার আগে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “কিছু জানতে পেরেছেন আপনারা?”

“এক্সকিউজ মি?”

“কেসের ব্যাপারে কিছু জানতে পেরেছেন? কোন নতুন সূত্র বা আলামত? সেজন্যেই তো আমাকে স্টেশনে নিয়ে যাচ্ছেন তাই না? জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে?”

উতসুমির দিকে একবার তাকিয়ে আবার আয়ানের চোখে চোখ রাখলো কুসানাগি। “হ্যাঁ,” ক্ষীণকণ্ঠে বলল।

“কি জেনেছেন? না কি স্টেশনে যাবার আগে বলা যাবে না?” এমন ভাবে কথাগুলো বলল সে, যেন একদম সাধারণ কোন ব্যাপারে আলাপ করছে।

কথা বলার আগে কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে ভাবলো কুসানাগি। এরপর মুখ তুলে বলল, “আমরা জানতে পেরেছি যে বিষ কোথায় ছিল। বেশ কয়েকবার টেস্ট করতে হয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে যে আপনার রান্নাঘরের ফিল্টারেই বিষ ছিটিয়ে রাখা হয়েছিল।”

আয়ানেকে পর্যবেক্ষণ করছে উতসুমি। তার অভিব্যক্তির কোন পরিবর্তন হলো না কথাগুলো শুনে। শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কুসানাগির দিকে।

“ওহ আচ্ছা। ফিল্টারে,” বলল সে। বিস্ময়ের লেশমাত্রও নেই কন্ঠে। “ফিল্টারের ভেতরে কিভাবে বিষ প্রবেশ করানো হলো সেটা বের করতেই কষ্ট হয়েছে। ওখানে পাওয়া আলামতের ভিত্তিতে বোঝা গিয়েছে যে শুধুমাত্র একটা উপায়েই খুনির পক্ষে কাজটা করা সম্ভব। আর সেই উপায়টা কেবলমাত্র একজনের পক্ষেই অবলম্বন করা সম্ভব,” ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাচ্ছে কুসানাগি। “সেজন্যেই আপনাকে আসতে হবে আমাদের সাথে।”

ঈষৎ রক্তিম হয়ে উঠল আয়ানের চেহারা, তবে হাসিটা এখনও ঝুলছে ঠোঁটের কোণে। “আপনাদের কাছে এ ব্যাপারে কোন প্রমাণ আছে যে ফিল্টারেই বিষ ছিল?”

“টেস্টে ফিল্টারের ভেতরে আর্সেনাস এসিডের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু সেই প্রমাণটা যথেষ্ট নয়। তাছাড়া খুনি এক বছরেরও বেশি সময় আগে ভেতরের কলকব্জায় বিষ ছিটিয়ে রেখেছিল। আমাদের শুধু এটা প্রমাণ করতে হবে যে খুনের দিন ফিল্টারে একজন মানুষকে হত্যার জন্যে যথেষ্ট পরিমাণ বিষ মজুদ ছিল। অন্যভাবে বললে, ফিল্টারটা এক বছর ব্যবহার করা হয়নি, যাতে বিষটুকু ধুয়ে না যায়-এটা প্রমাণ করাই যথেষ্ট।”

কুসানাগি যখন ‘এক বছর’ কথাটা বলল ঠিক সে মুহূর্তে কিছুটা হলেও থমকে গেল আয়ানে, ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ালো না উতসুমির।

“প্রমাণ আছে আপনাদের কাছে?”

“প্রথমে যখন এই কৌশলটার কথা শুনেছিলাম, মানে এক বছর আগে বিষ জায়গামত ছিটিয়ে রাখার কথা বলছি-বিশ্বাসই হয়নি!” কুসানাগি বলল। “অন্য যারা শুনেছে তাদের অভিব্যক্তিও এরকমটাই ছিল। আপনাকে দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে না অবাক হয়েছেন, মিসেস মাশিবা।”

“যা বলছেন তা এতটাই অবিশ্বাস্য যে, কী প্রতিক্রিয়া দেখাবো বুঝতেই পারছি না।”

“তাই না কি?” বলে উতসুমির দিকে একবার তাকালো কুসানাগি। ইশারা বুঝতে পেরে হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ বের করল জুনিয়র ডিটেক্টিভ।

ব্যাগের ভেতরের জিনিসটা দেখে অবশেষে হাসিটা পুরোপুরি মুছে গেল আয়ানের চেহারা থেকে।

“আপনি নিশ্চয়ই চিনতে পারছেন এটা?” কুসানাগি বলল। “খালি ক্যানটার নিচে আপনি ফুটো করেছিলেন যাতে পানি ছিটাতে সুবিধে হয়।”

“আপনি তো বলেছিলেন যে ফেলে দিয়েছেন জিনিসটা…”

“না, ফেলিনি আসলে। একবার ধুইওনি,” চোখমুখ শক্ত করে বলল কুসানাগি। “আমার বন্ধুর কথা মনে আছে আপনার? প্রফেসর ইউকাওয়া? ক্যানটা ওর ল্যাবে পরীক্ষা করিয়েছি আমি। খুব বেশি লম্বা বৰ্ণনায় যাবো না। শুধু এটুকু শুনে রাখুন যে ওখানেও আর্সেনাস এসিডের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে। শেষবার ব্যবহারের জন্যে ফিল্টার থেকেই পানি নিয়েছিলেন

আপনি। তাছাড়া আপনি ঘটনার দিন বাড়ী ফেরার পর যখন ফুলগাছে পানি দিচ্ছিলেন, আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। মাঝপথে মিস হিরোমি এসে পড়াতে থামতে হয়েছিল আপনাকে। এরপর আর ক্যানটা ব্যবহৃত হয়নি, কারণ আমি নতুন একটা ক্যান কিনেছিলাম। আর এটা ঢুকিয়ে রাখি আমার ডেস্ক ড্রয়ারে।”

“আপনার ডেস্ক ড্রয়ারে? কেন?” এবারে খানিকটা বিস্ময় ভর করল আয়ানের কণ্ঠে।

জবাব দিল না কুসানাগি। বরং অনুভূতিহীন কন্ঠে বলল, “ফলে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে ঘটনার দিন ফিল্টারের পানিতে যথেষ্ট পরিমাণ আর্সেনাস এসিড উপস্থিত ছিল। আর সেই পানি দিয়ে কফি বানানোর কারণেই মি. মাশিবা মারা গেছেন। এছাড়া আমাদের কাছে প্রমাণ আছে যে এক বছর আগে ফিল্টারে বিষ প্রবেশ করানো হয়েছে। কাজটা যে করেছে তার জন্যে সবচেয়ে বড় বাঁধা ছিল অন্য কাউকে ফিল্টারটা এক বছর ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখা, আর সেটা একজনের পক্ষেই করা সম্ভব।”

ঢোঁক গিললো উতসুমি। এখনও আয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে সে। সদ্য বিধবার সুন্দর চেহারাটা কিছুটা মলিন হয়ে এসেছে। আগের আত্মবিশ্বাস আর নেই।

“থানায় বিস্তারিত কথা বলবো আমরা,” কুসানাগি বলল।

মাথা উঁচু করল আয়ানে। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক চিড়ে। “বেশ। একটু সময় লাগবে আমার,” সরাসরি কুসানাগির দিকে তাকিয়ে বলল সে।

“কোন তাড়া নেই। যত সময় দরকার, নিন।”

“আসলে ফুলগাছগুলোতে পানি দিচ্ছিলাম আমি, এখনও শেষ হয়নি।”

“শেষ করুন, আমরা অপেক্ষা করছি।”

মাথা নেড়ে ব্যালকনির দিকে এগিয়ে গেল আয়ানে। দু’হাতে বড় ক্যানটা তুলে নিয়ে একমনে পানি দেয়া শুরু করল গাছগুলোয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *