অধ্যায় ২৬
ইবিসু স্টেশন থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে একটা ছয়তলা ভবনে অবস্থিত ইকাই ল’ অফিস। পুরো চতুর্থ তলাটাই তাদের। ধূসর রঙের স্যুট পরা এক তরুণী রিসিপশনিস্ট কুসানাগিকে স্বাগত জানাতে উঠে এল ডেস্ক ছেড়ে ছোট একটা মিটিং রুমে নিয়ে বসালো তাকে। গোটা অফিসে এরকম আরো কয়েকটা রুম চোখে পড়লো কুসানাগির। মি. ইকাইয়ের অধীনে আরো কয়েকজন আইনজীবী কাজ করে বোধহয়।
সেজন্যেই ইয়োশিতাকা মাশিবার কোম্পানীতে কনসাল্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করার সময় পায় সে, ভাবলো কুসানাগি।
পনেরো মিনিট পর ইকাইয়ের দেখা পাওয়া গেল। বসিয়ে রাখার জন্যে কোন রকম দুঃখপ্রকাশ করল না আইনজীবী।
উনি নিশ্চয়ই ভেবেছেন কাজের সময় বিরক্ত করার জন্যে আমিই ক্ষমা চাইবো।
“তদন্তের উন্নতি কতদূর?” খালি একটা চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করল ইকাই। “আয়ানের সাথে অনেকদিন কথা হয় না।“
“উন্নতি হয়েছে কি না সেটা ঠিক বলতে পারবো না,” কুসানাগি জবাব দিল। “তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতে এসেছে। তবে আপনাকে সেগুলো সম্পর্কে এখনই অবহিত করতে পারছি না।
“হাসলো ইকাই। “আপনাদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য শোনার ইচ্ছে বা সময় কোনটাই নেই আমার। মাশিবাদের অফিস যেহেতু ঠিকঠাকই চলছে, কেসটা যত দ্রুত বন্ধ হবে তত ভালো। আমার সাথে হঠাৎ দেখা করতে চাইলেন যে? এতদিনে তো এটা নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন ওর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে খুব একটা ওয়াকিবহাল ছিলাম না আমি,” বলে হাতঘড়ির দিকে তাকালো সে।
“আসলে আজকে এমন একটা বিষয়ে কথা বলতে এসেছি, যেটা সম্পর্কে ভালো করেই জানেন আপনি,” কুসানাগি বলল। “কিংবা বলা যেতে পারে যে শুধুমাত্র আপনিই জানেন বিষয়টা।”
ভ্রুজোড়া উঁচিয়ে ডিটেক্টিভের দিকে তাকালো ইকাই। “যেটা শুধুমাত্র আমিই জানি? বুঝিয়ে বলুন।”
“মিস্টার এবং মিসেস মাশিবার প্রথম দেখা হবার ঘটনার কথা বলছি আপনি তো সেখানে ছিলেন?”
“আবার সেই পুরনো কাসুন্দি,” হতাশ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালো ইকাই।
“সেদিনের পুরো ঘটনাটা বিস্তারিত বললে সুবিধে হতো আমাদের। দেখা হবার পর একে অপরের সাথে কিরকম আচরণ করেছিল তারা, কিভাবে কথা বলছিল- এসব।”
“কেসের সাথে কি এটার কোন সম্পর্ক আছে?” সন্দিহান ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল ইকাই
জবাবে কেবল মৃদু হাসলো কুসানাগি।
“এটাও জানানো যাবে না তাহলে? আমরা কিন্তু অনেক আগে ঘটেছিল এমন একটা ঘটনা নিয়ে কথা বলছি। তাই স্বাভাবিকভাবেই কেসের সাথে এটার কি সম্পর্ক তা বোধগম্য হচ্ছে না আমার।”
“আসলেও সম্পর্ক আছে কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত নই আমরা। বলতে পারেন যে এ মুহূর্তে একদম ছোট ছোট সূত্রও কাজে দেবে। সেগুলো যোগাড়ের চেষ্টা করছি. এই আরকি।”
“আপনাকে প্রথমদিন দেখে আমার মনে হয়নি যে ছোট ছোট সূত্রের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাবেন। যাইহোক, ঠিক কী জানতে চাচ্ছেন সেটা বলুন।”
একটা ডেটিং পার্টিতে দেখা হয়েছিল তাদের দু’জনের, এটা আগেই বলেছিলেন। আমি যতদুর জানি এসব পার্টি আয়োজন করা হয় যাতে আগে দেখা হয়নি এরকম নারী এবং পুরুষেরা একে অপরকে জানার সুযোগ পায়। এই পার্টিতেও কি এরকমই ঘটেছিল? আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করে দেয়া হয়েছিল অংশগ্রহণকারীদের?”
“না, ওরকম কিছু ঘটেনি,” ইকাই মাথা ঝাঁকিয়ে বলল। “বরং বলতে পারেন একটা ককটেল পার্টি। ‘আপনার ভবিষ্যৎ জীবন-সঙ্গীর দেখা মিলবে এখানেই এসব ছাইপাশ হলে যেতাম না আমি।”
মাথা নাড়লো কুসানাগি। “আচ্ছা, আয়ানে একাই এসেছিল পার্টিতে?”
“যতদুর মনে পড়ছে, হ্যাঁ, একাই ছিল। বারের সামনে বসেছিল খুব সম্ভবত, ককটেল গ্লাস হাতে।”
“কে কথা বলেছিল প্ৰথমে?”
“মাশিবা,” দ্রুত জবাব দিল ইকাই।
“মি. মাশিবা তার দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন?”
“আমরাও বারের সামনে বসে ড্রিঙ্ক করছিলাম। আমাদের দু’টা সিট পাশে ছিল আয়ানে। এসময় হঠাৎ করেই তার মোবাইল ফোনের কভার নিয়ে মন্তব্য করে মাশিবা।”
নোটপ্যাডে লেখা বন্ধ করে মাথা উঁচু করে তাকায় কুসানাগি। “মোবাইল ফোনের কভার?”
“হ্যাঁ, ফোনটা বারের কাউন্টারের ওপরই রেখেছিল আয়ানে। সেলাইয়ের সুন্দর কাজ ছিল কভারটায়, মাঝে ডিসপ্লের জন্যে চারকোণা জায়গা। ‘সুন্দর তো বা ‘এরকমটা আগে দেখিনি গোছের কিছু বলেছিল মাশিবা, আমার ঠিক মনে নেই। কিন্তু ও-ই যে প্রথমে কথা বলেছিল এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। তখন আয়ানে বলে যে, কভারটা নিজেই তৈরি করেছে সে। এরপর গল্প করা শুরু করে দু’জন।“
“তাহলে এভাবেই দেখা হয়েছিল তাদের?”
“হ্যাঁ, আমি অবশ্য সেদিন কল্পনাও করিনি যে সম্পর্কটা বিয়ে পর্যন্ত গড়াবে।”
“সেবারই কি প্রথম মি. মাশিবার সাথে ওরকম কোন পার্টিতে গিয়েছিলেন আপনি?”
“একবারই যথেষ্ট আমার জন্যে।”
“এভাবে আগ বাড়িয়ে কথা বলাটা কি মি. মাশিবার স্বভাবের সাথে যায়? একটু ভেবে উত্তর দিন।”
ভ্রুকুটি করল ইকাই। “সেটা বলা কঠিন। মেয়েদের সাথে কথা বলতে কখনোই কোনরকম সমস্যা হতো না তার, তবে এভাবে বারে কারো সাথে ফ্লার্ট করতেও দেখিনি। ভার্সিটিতে পড়ার সময়েও না। ও বলতো যে চেহারার চাইতে ভেতরের মানুষটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
“তাহলে আমরা এটা বলতে পারি, সেদিন বারে ওভাবে আগ বাড়িয়ে আয়ানের সাথে তার কথা বলাটা একটু অস্বাভাবিক?”
“বলতে পারেন। আমিও অবাক হয়েছিলাম, কিন্তু সব কিছুরই প্রথমবার বলে একটা কথা আছে। হয়তো আয়ানেকে দেখে আসলেই ভালো লেগেছিল ওর। সেজন্যেই সম্পর্কটা দ্রুত পরিণতির দিকে এগিয়েছে।”
“আপনার কি কিছুই অস্বাভাবিক মনে হয়নি সেদিন? কিছুই না?’
এক মুহূর্ত ভাবলো ইকাই, এরপর মাথা নেড়ে বলল। ওরকম কিছু মনে পড়ছে না। ওরা যখন পরস্পরের সাথে কথা বলা শুরু করল, আমি একরকম অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলাম দৃশ্যপট থেকে। কিন্তু এসব কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন, ডিটেক্টিভ?”
হেসে নোটপ্যাডটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো কুসানাগি।
“একটু আভাসও দেবেন না?” ইকাই জিজ্ঞেস করল।
“সময় হলে আপনার সাথে খুশিমনেই সবকিছু নিয়ে আলাপ করবো। আজকে সময় দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ,” বলে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করল সে। বের হবার আগে পেছন দিকে ঘুরে বলল, “দয়া করে আমাদের আজকের সাক্ষাতের ব্যাপারে মিসেস মাশিবাকে কিছু বলবেন না।”
“তাহলে ওকে সন্দেহ করছেন আপনারা?” চোখজোড়া সরু করে বলল ইকাই।
“তা বলিনি আমি। না বললে…আমাদের তদন্তের কাজে সুবিধে হতো,” বলে দ্রুত রুমটা থেকে বেরিয়ে পড়লো কুসানাগি, যাতে আর কিছু জিজ্ঞেস করতে না পারে ইকাই।
ভবনের বাইরে পা রেখে লম্বা একটা শ্বাস ছাড়লো ডিটেক্টিভ। ইকাইয়ের কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে আয়ানে আগ বাড়িয়ে কথা বলেনি মাশিবার সাথে। পার্টিতে তাদের দেখা হবার ঘটনাটা ছিল কাকতালীয়।
আসলেই কি?
কুসানাগি যখন জুঞ্জি সুকুইকে চেনে কি না এ ব্যাপারে আয়ানেকে জিজ্ঞেস করে তখন সরাসরি মানা করে দেয় সে। এটাই খোঁচাচ্ছে তাকে। তাকে অবশ্যই চিনতো আয়ানে।
এটা ছাড়া জুঞ্জির বইয়ের ঐ ট্যাপেস্ট্রিটার কোন ব্যাখ্যা নেই। নকশাটা আয়ানে মিতার নিজস্ব। মাসের পর মাস বসে অন্য কারো নকশা অনুকরণ করার মত মানুষ নয় সে। অর্থাৎ জুঞ্জি সুকুই কোথাও না কোথাও কাজটা দেখেছিল।
কুসানাগি যতদুর শুনেছে, এই ট্যাপেস্ট্রিটার ছবি আয়ানে মাশিবার নকশার বইয়ে ছাপা হয়নি। তাহলে নিশ্চয়ই কোন না কোন গ্যালারিতে ওটা দেখেছিল সুকুই। এখানেও একটা ঝামেলা আছে। আর্ট গ্যালারিতে ছবি তোলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আর জুঞ্জি সুকুইয়ের আঁকার হাত খারাপ না হলেও শুধুমাত্র একবার দেখে হুবহু একটা জিনিস এঁকে ফেলার মত প্রতিভা তার ছিল বলে মনে হয় না। আয়ানে নিজেই ট্যাপেস্ট্রিটা দেখিয়েছিল তাকে। অর্থাৎ, জানাশোনা ছিল তাদের মধ্যে।
তাহলে আয়ানে সেদিন মিথ্যে বলল কেন? কুসানাগির কাছে মিস সুকুইয়ের ব্যাপারে চেপে গিয়ে কি লাভ হয়েছে তার? ইয়োশিতাকা যে তার বান্ধবীর প্রেমিক ছিল এটাই লুকোতে চাইছিল?
ঘড়ির দিকে তাকালো কুসানাগি। চারটা পাঁচ। আমার রওনা দেয়া উচিত। ইউকাওয়ার সাথে সাড়ে চারটায় দেখা করার কথা তার; কিন্তু কেন যেন গড়িমসি করছে ইচ্ছে করেই। এমনটা নয় যে বন্ধুর সাথে দেখা করার ইচ্ছে নেই। কিন্তু সে নিশ্চয়ই এমন সব উত্তর নিয়ে বসে আছে যেগুলো এ মুহূর্তে শুনতে চাচ্ছে না কুসানাগি। তবুও অন্য কাউকে নিজের জায়গায় পাঠানো সম্ভব নয়। ডিটেক্টিভ ইনচার্জ হিসেবে সব তথ্য ঠিকঠাক জোগাড় করা তার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তাছাড়া সে নিজেও এই বিহ্বলতা থেকে যত দ্রুত সম্ভব মুক্তি চায়।