স্যমন্তক মণি
এক রাজা ছিলেন, তাঁহার নাম ছিল প্রসেন। প্রসেনের ভ্রাতার নাম ছিল সত্রাজিৎ। সূর্যের সহিত সত্রাজিতের বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল।
একদিন সত্রাজিৎ তোয়কূল নামক নদীতে নামিয়া সূর্যের উপাসনা করিতেছেন, এমন সময় সূর্য স্নেহবশত নিজেই তাঁহার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সত্রাজিৎ সূর্যের সেই আশ্চর্য উজ্জ্বল মূর্তি দেখিয়া নিতান্ত বিস্ময়ের সহিত তাঁহাকে বলিলেন, “ভগবন্, আকাশে আপনাকে যেমন উজ্জ্বল দেখি, এখনো তেমনি উজ্জ্বল দেখিতেছি। আপনি যে স্নেহ করিয়া আমার নিকট আসিলেন, তাহার দরুন তো আপনার রূপ কিছুমাত্র কোমল হয় নাই।”
সূর্য তখন একটু হাসিয়া নিজের কণ্ঠ হইতে একটি মণি খুলিয়া রাখিয়া দিলেন। তখন দেখা গেল যে তাঁহার মূর্তি অতি সুন্দর এবং স্নিগ্ধ।
সেই যে মণি, উহারই তেজে সূর্যকে এত উজ্জ্বল দেখা গিয়াছিল। সে মণির নাম স্যমন্তক। উহার এতই গুণ যে, যাহার গৃহে উহা থাকে, তাহার কোনো অসুখ বা অকল্যাণ হয় না। যে দেশে উহা থাকে তথা হইতে দুর্ভিক্ষ, অনাবৃষ্টি প্রভৃতি সকল উৎপাত দূর হইয়া যায়।
সেই মণিটি সত্রাজিতের বড়ই ভালো লাগিল, সুতরাং সূর্য যাইবার সময় তিনি তাঁহাকে বিনীতভাবে বলিলেন, “হে প্রভু! আপনি তো আমাকে কতই স্নেহ করেন, দয়া করিয়া এই মণিটি আমাকে দিয়া যান।”
সে কথায় সূর্য তখনই তাহাকে মণিটি দিয়া গেলেন।
সেই মণি লইয়া সত্রাজিৎ যখন নিজের নগরে ফিরিলেন, তখন নগরে সমস্ত লোক নিতান্ত ব্যস্তভাবে “ঐ সূর্য যাইতেছেন!” “ঐ সূর্য যাইতেছেন!” বলিয়া তাঁহার পিছু-পিছু ছুটিল। সে আশ্চর্য মণি যে দেখে সেই অবাক হইয়া যায়। তাঁহার গুণের কথা যে শোনে, সেই ছুটিয়া তাহা দেখিতে আসে।
সে মণি পাইবার জন্য কৃষ্ণের খুবই ইচ্ছা হইয়াছিল, সত্রাজিৎ তাঁহাকে তাহা দেন নাই। কৃষ্ণ ইচ্ছা করিলে উহা সত্রাজিতের নিকট হইতে কাড়িয়া লইতে পারিতেন, কিন্তু তাঁহার মতো মহৎ লোকে এমন কাজ কেন করিবেন?
সত্রাজিৎ সেই মণি তাহার ভাই প্রসেনকে দেন। প্রসেন প্রায়ই উহা পরিয়া চলাফেরা করিতেন। একদিন সেই মণি গলায় পরিয়া তিনি বনের ভিতর শিকার করিতে গিয়াছেন, এমন সময় ভয়ংকর এক সিংহ আসিয়া তাঁহাকে আক্রমণ করিল। সে ভীষণ সিংহের হাত হইতে আর তিনি রক্ষা পাইলেন না।
কিন্তু কি আশ্চর্য। সিংহ যে প্রসেনকে হত্যা করিল, সে তাঁহাকে খাইবার জন্য নহে, তাহার ঐ মণিটি পাইবার জন্য। সে তাঁহাকে মারিয়া মণিটি লইয়া চলিয়া গেল, তাঁহার দেহের দিকে ফিরিয়াও তাকাইল না।
যে বস্তুর প্রতি এক জন্তুর লোভ হয়, অন্য জন্তুরও তাহার প্রতি লোভ হইতে পারে! সিংহ সেই মণি লইয়া বেশিদূর যাইতে না যাইতেই পর্বতের গুহার ভিতর হইতে এক বিশাল ভল্লুক আসিয়া তাহার ঘাড় ভাঙ্গিয়া মণিটি কাড়িয়া নিল।
প্রসেন যখন আর ঘরে ফিরিলেন না, তখন তাঁহার আত্মীয়েরা মনে করিল যে নিশ্চয়ই কৃষ্ণ সেই মণির লোভে তাঁহাকে বধ করিয়াছে, নহিলে এমন কাজ আর কে করিবে? পুর্ব হইতেই কৃষ্ণের ঐ মণির প্রতি লোভ ছিল, তাঁহারই এই কাজ!
বাস্তবিক এ বিষয়ে কৃষ্ণের কোনো অপরাধই ছিল না, কাজেই এই মিথ্যা অপবাদের কথা শুনিয়া, তিনি অতিশয় দুঃখিত হইলেন। আর প্রতিজ্ঞা করিলেন যে যেমন করিয়াই হউক, এই মণি আনিয়া দিতে হইবে।
প্রসেন যখন শিকারে গিয়া প্রাণ হারাইয়াছিলেন, তখন সহজেই বুঝা যায় যে সেই শিকারের জায়গায় গিয়াই তাহাকে খুঁজিতে হইবে! কৃষ্ণ ও বলরাম কয়েকটি সাহসী, চতুর আর বিশ্বাসী লোক লইয়া চুপি চুপি সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলেন। সেখানে গিয়া প্রসেনের দেহ খুঁজিয়া বাহির করিতে তাহাদের অধিক বিলম্ব হইল না। প্রসেনেব ঘোড়াটিও সেইখানে মরিয়া পড়িয়াছিল। দুটি দেহের চারিধারে সিংহের পায়ের দাগ, সিংহের নখ, দাঁতে দেহ দুটি ক্ষতবিক্ষত!
সেই সিংহের পদচিহ্ন ধরিয়া কিছুদূর গেলেই দেখা গেল যে উহার দেহও ক্ষতবিক্ষত হইয়া পড়িয়া আছে। তাহাকে যে ভল্লুকে মারিয়াছে পায়ের চিহ্ন দেখিয়া আর, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ রহিল না। এখন এই ভল্লুককে খুঁজিয়া বাহির করিতে পারিলেই হয়। তাহারা অতি সাবধানে সেই ভল্লুকের পায়ের দাগ দেখিয়া চলিতে লাগিলেন। সে দাগ ক্রমে একটা গুহার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। সুতরাং বুঝা গেল, সেই গুহার ভিতরেই ভল্লুকের বাড়ি।
এই কথার আরো প্রমাণ তখনই পাওয়া গেল। গুহার ভিতর হইতে একটি স্ত্রীলোকের গলার শব্দ আসিতেছে, একটি ছেলেরও কান্না শুনা যাইতেছে। স্ত্রীলোকটি ছেলেটিকে শান্ত করিবার জন্য বলিতেছে, “কাঁদিয়ো না বাছা! সিংহ প্রসেনকে মারিয়াছিল, তোমার পিতা সেই সিংহকে মারিয়া স্যমন্তক মণি আনিয়াছেন। এখন সেই মণি লইয়া তুমি খেলা করিবে, আর কাঁদিয়ো না।”
কাজেই আর কিছু বুঝিতে বাকি রহিল না। তখন কৃষ্ণ, বলরাম আর সঙ্গের লোকদিগকে গুহার দরজায় রাখিয়া যেই একা ভিতরে প্রবেশ করিয়াছে, অমনি পর্বতপ্রমাণ এক বিশাল, বিকট ভল্লুক ভীষণ গর্জনে পাহাড় কাঁপাইয়া তাঁহাকে আক্রমণ করিল। তখন যে তাঁহাদের কি ঘোরতর যুদ্ধ হইয়াছিল, তাহা আর বলিয়া শেষ করা যায় না। একদিন, দুদিন করিয়া সপ্তাহের পর সপ্তাহ চলিয়া গেল, তথাপি সে যুদ্ধের বিরাম নাই।
এদিকে কৃষ্ণের বিলম্ব দেখিয়া আর ভল্লুকের ভয়ংকর গর্জন শুনিয়া, বলরাম আর সঙ্গের লোকেরা দ্বারকায় আসিয়া সকলকে বলিয়াছেন যে কৃষ্ণ আর নাই, তাঁহাকে ভল্পকে খাইয়াছে।
একুশ দিনের পর সেই যুদ্ধ শেষ হইল। একুশ দিন যুদ্ধ করিয়া ভল্লুক বুঝিতে পারিল যে কৃষ্ণের নিকট হার মানা ভিন্ন আর উপায় নাই। তখন সে অশেষ অনুনয়ের সহিত তাঁহার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিল। তারপর সে যেই জানিল যে তিনি এই মণির জন্য আসিয়াছেন, অমনি মণি তো তাঁহাকে দিলই সঙ্গে সঙ্গে নিজের কন্যাটিও দান করিল।
কৃষ্ণ সেই মণি আর কন্যা লইয়া মনের সুখে দ্বারকায় চলিয়া আসিলেন। দ্বারকার লোকেরা তাঁহাকে দেখিয়া কি বলিল, তাহা আমি জানি না, তবে সত্রাজিৎ যে মণি পাইয়া খুবই খুশি হইয়াছিলেন, এ কথা নিশ্চয় বলিতে পারি।
সেই ভল্লুকটি যে সে ভল্লুক ছিল না। সে সেই জাম্ববান্, রামায়ণে যাহার কথা তোমরা পড়িয়া নিশ্চয়ই খুব সন্তুষ্ট হইয়াছ। আর তাহার মেয়েটির নাম ছিল জাম্ববতী। সেও কি ভল্লুক ছিল?