স্মৃতি যদি ফেরে
কমল গুহ আমার সহপাঠী ছিল আর প্রতিবেশী ছিল। সেই নরম বয়সে দিনের মধ্যে বেশ কয়েক ঘন্টা ওকে আটকাতে না পারলে দিনটাই জলো ঠেকত। উঁচু-মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। পড়াশুনায় আমাদের পাঁচজনের থেকে অন্তত ঢের ভালো। তবু ওর জ্ঞানগম্যি সম্পর্কে আমাদের বরাবরই একটা কৌতুককর সংশয় ছিল।
মিষ্টি পাগলাটে ধরণের ছেলে। ভয়ানক খামখেয়ালী। কিন্তু গো আছে–যা ধরবে, তা করবে। মফঃস্বল কলেজ ছেড়ে কলকাতায় পড়ার সময়ও ওর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। ও ডাক্তারী পাশ করার পর একে একে গুটিপাঁচেক বড় ডাক্তারের সাকরেদি করল বছর-দুই পর্যন্ত। কিন্তু কাউকেই পছন্দ হল না। শেষে চোখ-কান বুজে বেশ কেতাদুরস্ত বড়ঘরেই একটা বিয়ে করে বসল। আমরা নেমন্তন্ন খেলাম আর ঈর্ষান্বিত চোখে ওর চকচকে বউটাকে দেখলাম। তারও মাস-তিনেক বাদে গলায় মালা-টালা দিয়ে একদিন ওকে বোম্বাইয়ের ট্রেনে তুলে দিলাম। সেখান থেকে বিলেত যাবে। ও নিজেই এক ফাঁকে বলেছিল, সেখান থেকে আরো গোটাকয়েক চটকদার ছাপ ছোপ নিয়ে আসতে পারলে একসঙ্গে তিন কাজ হবে। নিজের হিল্লে হবে, বউয়ের। মান-মর্যাদা বাড়বে আর শ্বশুরের টাকার সদগতি হবে।
তারপর দীর্ঘ দুটো যুগ কেটে গেছে। গঙ্গায় অনেক রকমের ঘোলা জল বয়ে গেছে। জীবনের ঘাটে ঘাটে ছড়িয়ে আমরা এক-একটা বিচ্ছিন্ন অস্তিত্বের মহড়া দিয়ে চলেছি। আমাদের ভেতর-বার দুই-ই বদলেছে। দেহের কাঠমোয় বিদায়ী মধ্যাহ্নের। ছায়া বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
কমল রওনা হয়ে যাবার বছর-আষ্টেক বাদে এক বন্ধুর মুখে শুনেছিলাম, বিদেশ থেকে ও মস্ত পাগলের ডাক্তার হয়ে, ফিরেছে। লণ্ডনে ছিল, জার্মানীতে ছিল, আমেরিকায়ও নাকি কিছুকাল ছিল।
আমি মন্তব্য করেছিলাম, ও ওর যোগ্য লাইনই বেছে নিয়েছে, কিন্তু এরপর বউটাকে ধরে রাখতে পারলে হয়!
বন্ধু প্রতিবাদ করেছিল, এতবড় মনোবিজ্ঞানী–মন বুঝে এখন তো আরো বেশি কষে বাঁধতে পারবে হে!
যুক্তির কথাই বটে। ফস করে কেন ওই উক্তি মুখ দিয়ে বেরিয়েছিল নিজেই জানি না। শুনলাম, আট বছরের মধ্যে সেই প্রথম দেশে ফিরেছে সে। এই দীর্ঘকাল। অবশ্যই স্ত্রী-বিরহিত জীবনযাপন করেনি। বছর-তিনেকের মধ্যেই বউ আকাশপথে উড়ে গিয়ে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। অসুবিধে আর কী, শ্বশুরের টাকা ছিলই, তার ওপর বিদেশের কৃতী ডাক্তার হয়েছে জামাই, আর তার রোজগারের ভাগ্যও খুলে গেছে। সেই ভাগ্য দিনে দিনে নাকি আরো বিস্তারলাভ করেছে। বিদেশে অর্থাৎ লণ্ডনে আর জার্মানীতে বছর-তিনেক ঘরকন্না করেছে বউ। তারপর হাঁপ ধরে যেতে পালিয়ে এসেছে। কমল ফিরেছে তারও দুবছর বাদে।
বন্ধুর কাছ থেকে একটা বড় হোটেল-সুইটের ঠিকানা পেয়ে আমি কমলের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। দেখা হয়নি। সে তখন বম্বে না কোথায় চলে গেছে।
দেখা করতে গেছলাম বটে, কিন্তু ভেতর থেকে খুব একটা তাগিদ ছিল না। কারণ নিজের তখন লেখক-জীবনের বহু হতাশা আর অনিশ্চয়তায় ক্ষতবিক্ষত সংগ্রামী জীবন। এর মধ্যে পরিচিতজনের দুর্লভ কোনো সাফল্যের খবর কানে এলে নিজের ব্যর্থতার ছায়াটা যেন আরো বেশি ঘন হয়ে উঠতে চায়।
এর বছর-দশেক বাদে হঠাৎ আর এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা। সে মোটামুটি সফল অ্যাডভোকেট। আমারো তখন দুর্দিনের মেঘ অনেকটাই কেটেছে। অতএব পরিচিত সফল মুখ দেখলে আনন্দই হয়। দু-পাঁচ কথার পরেই সে জিজ্ঞাসা করল, আমাদের কমল গুহর খবর জানো?
বললাম, মস্ত মেন্টাল সার্জন হয়েছে, এই পর্যন্তই জানি। কেন?
–এখানেই তো ছিল কিছুদিন। আমাদের কোর্টেই ওর বউয়ের সঙ্গে মামলার নিষ্পত্তি হয়ে গেল। এ ভেরি পিসফুল ডাইভোর্স!
আমি হতভম্ব।–সে কি?
–হ্যাঁ। বউ স্যুট ফাইল করেছিল, ওর দিক থেকে কোনো বাধা আসেনি।
মস্ত পাগলের ডাক্তার হয়েছে শুনে আর এক বন্ধুর কাছে দশ বছর আগেই সেই ঠাট্টাটা বউটাকে ধরে রাখতে পারলে হয়,–এমন কাকতালীয় ভাবে ফলে যাবে। আর আমাকেই অপ্রস্তুত করবে, স্বপ্নেও ভাবিনি।
এই ঘটনা শোনার পর আরো ছবছর বাদে অর্থাৎ পাকা দুযুগ পরে কমল গুহর সঙ্গে আমার দেখা। আমাদের তখন ঠিক পঞ্চাশ চলছে।
দিন-কতকের অবকাশ পেয়ে বাংলাদেশের বাইরে এই ছিমছাম পাহাড়ী জায়গায় বেড়াতে এসেছিলাম। কমল গুহ এখানকার বিরাট পাগলের হাসপাতালের সর্বাধিনায়ক জানি–যাব যখন তার সঙ্গেও দেখা করার ইচ্ছে ছিলই।
হোটেলে উঠেছিলাম। ঠিক দুদিন বাদে বিকেলের দিকে তার রেসিডেনসিয়াল কোয়ার্টার্সের চত্বরে ঢুকে পড়লাম। বাড়ির গায়ে ওর নামের শৌখিন নেমপ্লেট, তার পিছনে একগাদা বিলিতি ডিগ্রী-ডিপ্লোমার মিছিল। দাঁড়িয়ে সেগুলো পড়ে নিলাম।
কিন্তু ওর কাছে যাবার পথ তেমন সুগম নয়। অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা নেই শুনে দরোয়ান প্রথমে আমাকে দরজার কাছেই এগোতে দেবে না। আপনারজন বলতে সে স্লিপ নিয়ে যেতে রাজি হল। ছাপানো স্লিপে নামের সঙ্গে ওমুক জায়গার পুরনো বন্ধু তাও লিখে দিলাম। শুধু নামে যদি চিনতে না পেরে দেখা না করে দরোয়ানের কাছে ইজ্জত যাবে।
এতটু পরেই ডাক এলো। দরোয়ান এবারে সেলাম ঠুকে ধুতি-চাদর-পরা এই খাঁটি বাঙালীকেই বলল, যাইয়ে সাব।
ঘরে ঢুকলাম। এটা ডাক্তারের আবাসিক আপিস-ঘর। মস্ত টেবিলের একদিকের রিভলভিং চেয়ারে বসে আছে কমল গুহ। তার মুখোমুখি চার-পাঁচটা চেয়ার অন্য ভদ্রলোকদের দখলে। কোণের দিকে আলাদা ছোট টেবিলে বসে মৃদু টুকটুক শব্দে টাইপ করে চলেছে সুশ্রী একটি ফিরিঙ্গি মেয়ে।
আমার দিকে এক-পলক চেয়ে থেকে একটু মাথা নাড়ল কমল গুহ। তারপর ইঙ্গিতে ভদ্রলোকদের পাশের একটা চেয়ার দেখিয়ে দিল। পাইপ দাঁতে চেপে অস্ফুট স্বরে বলল, বিজ-ই ফ ফাইভ মিনিটস ওনলি, উড ইউ মাই?
আমি বোকার মত মাথা নাড়ালাম। কিন্তু সে সেটা দেখলও না বোধহয়। কেতাদুরস্ত কথা কটা বলেই ভদ্রলোকদের সঙ্গে বাক্যালাপে মগ্ন হল। হাসপাতাল-সংক্রান্ত কথা। এঁরা সকলেই এখানকার ডাক্তার বা অফিসার হবেন।
আমি ঠিক এ-রকম অভ্যর্থনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। একটু হাসি, একটু উচ্ছ্বাস না। তাদের আলোচনায় পাঁচ মিনিটের জায়গায় দশ মিনিট গেল, তার মধ্যে চব্বিশ বছর বাদে এককালের অন্তরঙ্গ কেউ এসেছে বলেও আর একবার আমার দিকে ফিরে তাকালো না। হয়ত ভুলেই গেছে। আলোচনা যাদের সঙ্গে হচ্ছে। তাদের সকলেই হয়ত বাঙালী, কিন্তু বাংলা কথা একটাও শুনলাম না। হাব-ভাব ছেড়ে কমল গুহর কথাবার্তার আধো-আধো টানগুলোর মধ্যেও পুরোদস্তুর সাহেবিয়ানা।
হয়ত সীরিয়াস আলোচনাই কিছু, কারণ বাজেট ফাইন্যান্স ইত্যাদির বাধা অনেকবার কানে এলো। তবু আমার মনে হতে লাগল, চব্বিশ বছর যখন গেছে বাদবাকি জীবনটাও দেখা না হয়ে কেটে যেতে পারত। আবার সকৌতুকে ওকে দেখছি আমি। জেনে-শুনে এখানে ওর সামনে এসে না পড়লে কে বলবে সেই কমল গুহ। আধা-গম্ভীর ভারী মুখ, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, দাঁতে মোটা পাইপ, মাথার ঝাকড়া চুলের দু-পাশে খানিকটা করে পাকা চুলের বর্ডার।
ও কে!
সর্বাধিনায়কের ছাড়পত্র পেয়ে ভদ্রলোকদের সবিনয়ে প্রস্থান। আমার নিজের অবস্থানের মেয়াদও দশ-বিশ মিনিটের বেশি হবে আশা করছি না। পাশে যে ভদ্রলোকটি তখনো দাঁড়িয়ে সে বোধহয় সেক্রেটারি। প্রভুর ইঙ্গিতে সেও প্রস্থান করল।
–মিস জোনস্!
কোণের টাইপের টেবিল থেকে সুশ্রী মেয়েটি শশব্যস্তে এদিকে ফিরল।-ইয়েস সার?
উড ইউ প্লীজ…
– অসমাপ্ত বক্তব্য বুঝে সেও টাইপ ফেলে টক-টক দ্রুত শব্দে ঘর ছেড়ে চলে গেল। কমল গুহ ততক্ষণে উঠে টেবিল ঘুরে আমার সামনে চলে এসেছে।
–ওঠ!
সম্বোধন শুনে কান জুড়লো, তবু ঈষৎ বিস্ময়ে আমি উঠে দাঁড়ালাম। সঙ্গে সঙ্গে আচমকা দু হাতে ও আমাকে বেশ জোরেই জাপটে ধরল, আর তারপরেই আমার দুগালে সশব্দে দুটো চুমু।
–তুই একটা রাসকেল, তুই একটা হতভাগা, তুই একটা ওয়াণ্ডারফুল!
একটু আগে কী চিন্তা করছিলাম ভেবে নিজেই আমি অপ্রস্তুত। হেসে বললাম, তুই পাগলের ডাক্তার হয়েছিস বটে!
হা-হা শব্দে হেসে উঠে সজোরে আমার পিঠ চাপড়ে দিল। আর তার ফলে ওর ওই পুষ্ট দুটো হাতের খুব কাছে থাকাও নিরাপদ মনে হল না আমার।
এরপর মিনিট পনের ধরে খুশির আলাপ চলল। কবে এসেছি, কোথায় উঠেছি। জেনে নিল। হোটেলের নামটা শুনে কী ভাবল একটু।–চল, ওদিকে আমার কাজও আছে একটু।
গাড়ি ও নিজেই ড্রাইভ করে দেখলাম। পাশে বসে পুরনো গল্প করতে করতে চলেছি। একটা বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে মিনিট আট দশের জন্য ও ভিতরে ঢুকে গেল। ফিরে এসে এবারে ড্রাইভ করে সোজা চলে এলো আমার হোটেলে।
এতবড় হোটেলের মালিক তাকে দেখামাত্র হন্তদন্ত হয়ে অভ্যর্থনায় এগিয়ে এলো। তার দিকে একবার সৌজন্যসূচক মাথা ঝাঁকিয়ে কমল গুহ আমার সটকে বেডিং মালপত্র যা আছে সব লোক দিয়ে তার গাড়িতে নামিয়ে দিতে বলল। আমাকে বাধা দেবার অবকাশ না দিয়ে হোটেলের মালিক তক্ষুনি ছুটল।
আমি বললাম, এটা কী-রকম হল?
জবাবে ও চোখ পাকালো, তুই একটা হতভাগা বলেছি না?
এবারে–আমি নিঃসঙ্কোচ। ওর বাইরের খোলস একেবারে বদলেছে বটে, ভিতরটা সেই চব্বিশ বছর আগের মত তাজা আর কাঁচা আছে।
সন্ধ্যের অনেক আগেই ওর বাড়িতে স্থিতি হয়ে দুজনে মুখোমুখি চায়ের টেবিলে বসেছি। রসনা পরিতৃপ্তির অঢেল আয়োজন। প্রসন্ন মুখে কমল বলল, তোর একটু অসুবিধেই হবে হয়ত
আমি মন্তব্য করলাম, অসুবিধের লক্ষণ তো দেখতে পাচ্ছি!
–সে অসুবিধের কথা বলছি না। রমণীবর্জিত, আতিথেয়তা তো তোর ভালো–ও লাগতে পারে।…ভালো কথা, বউয়ের সঙ্গে আমার ডাইভোর্স হয়ে গেছে, জানিস তো?
বিব্রত মুখে মাথা নাড়লাম।
বললাম, হঠাৎ এ-রকম একটা কাণ্ড…
-নাথিং নিউ, যেতে দে। বলছিলাম এখানে একটিও সুন্দর মুখ না দেখে তোর নীরস লাগাই স্বাভাবিক। ফেমিনাইন কার্ভস লুব্রিকেট মনোটনি।
মুখের আগল আগের থেকেও ঢিলে হয়েছে দেখছি। হেসেই জবাব দিলাম, বয়সও তো পঞ্চাশ গড়িয়ে গেল।
মুখ থেকে পাইপটা নামিয়ে ও বলে উঠল, তুই কি-রকম ছারপোকা-মার্কা সাহিত্যিক রে!…তাই বা কেন, তোর দুই-একটা বইয়েতেও তো প্রেমের বেপরোয়া কাণ্ডকারখানা দেখি!
এই ব্যস্ততার মধ্যেও পৃথিবী-চষা হোমরাচোমরা ডাক্তার আমাদের বই পড়ে বা পড়ার সময় পায় ভেবে অবাকই লাগল।
দুটো দিন বেশ কেটে গেল। ও যখন ব্যস্ত, আমি তখন হাসপাতাল দেখে বেড়াই। জীবনের রসদ খুঁজি। খোদ-কর্তার অন্তরঙ্গ বন্ধু, বাধা দেবার কেউ নেই।
তৃতীয় দিন সন্ধ্যার পরে আবার লেখার কথা উঠল। কমল বলে বসল, এদেশে একালের লেখকদের মধ্যে চরিত্র খোঁজার অ্যাডভেঞ্চার নেই–দুনিয়ায় কত কাণ্ড যে ঘটে তারও খবর রাখ না তোমরা!
আমি প্রতিবাদ করলাম, যেটুকু অ্যাডভেঞ্চার করা হয়, তাইতেই তো সমালোচনা হয়–গল্পের গোরু গাছে তুলি আমরা।
ও জবাব দিল, গোরু তুললে আপত্তি কিন্তু মানুষ সত্যি সত্যি বাতাসেও ভাসে, পাতালেও ডোবে। হি অর সী হ্যাঁজ আ পেয়ার অভ ম্যাজিক উইংস-জাদু পাখা আছে দুটো করে, বুঝলে? দে ওয়ার্ক মিরাকল অ্যাণ্ড ডিভাসটেট ট্যু…বিশেষ করে মেয়েদের পাখা–দোর্জ ইন্টারন্যাল ইভস!
হেঁয়ালীর মত লাগলেও মনে মনে ধারণা, উক্তিটা এক মেয়ের প্রসঙ্গে,যে ওর ঘর ভেঙেছে। এ-কদিনে আভাসেও স্ত্রী-বিচ্ছেদের কোনো প্রসঙ্গ তোলেনি। নিরীহ মুখে বললাম, আরো একটু বিশদ না করলে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
অন্যমনস্ক একটু। তারপরেই ঘড়ি দেখে উঠে দাঁড়াল। মুচকি হেসে জবাব দিল, এক্ষুনি হাসপাতালে যেতে হবে, তাড়া আছে–কাল বলব–দেন ওয়ার্ক ইফ ইউ ক্যান!
আমি উদগ্রীব হয়ে সেই কালের প্রতীক্ষায় ছিলাম।
পরদিন সকাল দশটা নাগাদ হাসপাতালের একজন কর্মচারী এসে আমাকে ডেকে নিয়ে গেল, সাহেব সেলাম দিয়েছে।
গেলাম। কমল বলল, চলো একটি মহিলার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। সে বেশ মেজাজে আছে মনে হল, হাসছে অল্প অল্প। লিফটে উঠে আবার বলল, মহিলা যদি তোমাকে কিছু বলে, সায় দিয়ে যেও, নয়তো একটু মুশকিলে পড়তে পারো।
ওর গতকালের প্রসন্দ্রের সঙ্গে হাসপাতালের কোনো মহিলার যোগ আছে ভাবিনি। ওর স্ত্রী-বিচ্ছেদের ঘটনাই শুনব ধরে নিয়েছি। আমি লেখক, তাই কোনো বিকার বৈচিত্র্য দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে ভাবলাম। হাসপাতালের খোদকর্তা সঙ্গে আছে যখন, আমার ঘাবড়াবার কারণ নেই।
তিনতলার ওপর পাশাপাশি গোটাকতক সুইট। একটার সঙ্গে আর একটার যোগ নেই। মাঝে মাঝে কোলাপসিবল গেটে দরোয়ান মোতায়েন। মাস গেলে যারা মোটা টাকা ফেলে দিতে পারে তাদের রোগী বা রোগিণী ভিন্ন এখানে আর কারো আশ্রয় মেলা সম্ভব নয়।
আমাকে সঙ্গে করে কমল এমনি একটা সুইটে ঢুকে গেল।
ওদিক ফিরে জানালার গরাদ ধরে আকাশ দেখছিল মহিলা। একপিঠ খোলা চুল। দুখানা বাহু, কানের দুপাশ আর পায়ের পাতা দেখেই বোঝা গেল মহিলা রূপসী। কমলের গলাখাঁকারি শুনে এদিকে ফিরল, তারপরে হেসে অভ্যর্থনা জানাতে গিয়েও আমাকে দেখে সুচারুভাবে থমকালো একটু।
আমার অনুমান মিথ্যে নয়, রূপসীই বটে। কিন্তু ফর্সা মুখের দুদিকে কালচে ছোপ, আর সুন্দর টানা চোখের কোলে কালি। সুন্দর স্বাস্থ্য,-বয়েস মন হল আটত্রিশ উনচল্লিশ হবে। পরে শুনেছি ছেচল্লিশ।
তড়বড় করে কমল আমার যে পরিচয় দিল শুনে আমারই দুচোখ কপালে ওঠার দাখিল। বলল, আমার ছেলেবেলার বন্ধু ওমুক, মস্ত ইনডাসট্রিয়ালিস্ট, বাঙালীর গর্ব বলতে পারেন। তিন চার দিন হল এখানে বেড়াতে এসেছে। এসেই পালাই-পালাই করছে কেন, বুঝলেন?
মহিলার হাসি-হাসি মুখের সুচারু অভিব্যক্তি, আমার দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নাড়ল। কমল তেমনি তড়বড় করেই আবার বলে গেল, ওর স্ত্রী। সার্চ এ লাভলি লেডি, ওর টাকার জন্য নয়, এই জন্যেই ওকে আমার হিংসে হয়–কলকাতায় ওর বাড়ি গেলে ওই ভদ্রমহিলাকে দেখার লোভেই আর চলে আসতে ইচ্ছা করে না। ওদের দুটো ছেলে একটা মেয়ে; এখনো দুজনের টানে দুজন অন্ধ একেবারে–এই যে এখানে আছে কদিন, রোজ একটা করে মিসেসের ট্রাঙ্ক-কল, কেমন আছ, কবে আসবে।
আমারই ঘেমে ওঠার দাখিল। কিন্তু সবিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম মহিলার দুটি আয়ত নেত্র আমার মুখের ওপর ঘন হয়ে বসতে লাগল। এই প্রথম তার চাউনিও অস্বাভাবিক ঠেকছে।
এবারে কমল মহিলার পরিচয় দিল। স্মৃতি গুপ্ত। ইনিও এখানে বেড়াতে। এসেছিলেন, জায়গাটা ভালো লেগে গেছে তাই আরও কিছুদিন থাকবেন আশা করা যায়।…এই ফাইন অ্যাকমপ্লিসড লেডি, ওঁর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল তোমার ভাগ্য। ভালো।
আর এক দফা নমস্কার বিনিময় হল; লক্ষ্য করলাম মহিলার চোখ দুটো যেন অস্বাভাবিক চকচক করছে। কমল চট করে উঠে দাঁড়াল।–আচ্ছা আপনারা আলাপ করুন, আমি পাশের সুইট থেকে ঘুরে আসছি।
কথা শেষ করেই সে অদৃশ্য। সেই মুহূর্তেই একটা ভয় যেন আমাকে হেঁকে। ধরতে লাগল। স্মৃতি গুপ্তর চকচকে দুচোখ আরও ঘন হয়ে আমার মুখের ওপর বসছে। হঠাৎ একটু হাসল মহিলা, তার পরেই উঠে এসে অন্তরঙ্গ পরিচিতার মতই আমার গা ঘেঁষে বসল। চোখের মত সুন্দর দাঁতের সারিও ঝকঝক করে উঠল এবারে।–চারদিন হল এসেছেন, আর আজ এখানে আসার কথা মনে পড়ল?
অজ্ঞাত ত্রাসে বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে আমার। এ কি বিড়ম্বনা রে বাবা! সন্তর্পণে ব্যবধান রচনা করতে চেষ্টা করে আর সেই সঙ্গে শুকনো ঠোঁটে হাসি ফোঁটাতে চেষ্টা করে জবাব দিলাম, সময় পেয়ে উঠিনি…।
-বলবেনই তো, আপনারা সব এই রকমই! আছেন তো কিছুদিন এখন, না স্ত্রীর টানে পালাবেন?
-না..দিনকতক থাকব।
খুশি। সামনের চুলের গোছা সরাতে গিয়ে মহিলার বাহু আমার কাঁধে ঠেকল। তারপর আর একটু ঘুরে বসার ফলে ব্যবধান সঙ্কীর্ণতর হল। উৎফুল্ল মুখে মহিলা বলে গেল, ইনডাস্ট্রিয়ালিস্টদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার আমার কত লোভ আপনি জানেন না, সত্যিকারের পুরুষকার বলতে তো তারাই। আপনাকে দেখেই আমার মনে হয়েছিল। একজন মানুষের মত মানুষ আমার ঘরে এলো। আমার কত ভাগ্য আজ!
নিজের ভাগ্যের কথা ভেবে আমি কঁপছি। হন্তদন্ত হয়ে তক্ষুনি কমল ঘরে ঢুকতে ঘাম দিয়ে জ্বব ছাড়ল আমার। এগিয়ে এসে ও মহিলাকে জিজ্ঞাসা করল, কেমন লাগল আমার বন্ধুকে?
–ওয়াণ্ডারফুল!
-এই জন্যেই তো নিয়ে এলাম, চলো হে আজ আর সময় নেই। বলেই সে আবার দরজার দিকে পা বাড়ালো। আমি উঠে অনুসরণ করার জন্য ব্যস্ত।
দরজার কাছে আসার আগেই পিছন থেকে খপ একটা হাত ধরে ফেলল মহিলা। কমল ততক্ষণে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। খুব কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, কাল আবার আসবেন, আসবেন তো? একলা আসবেন, আমি আশায় বসে থাকব –ঠিক আসবেন?
মাথা নেড়ে রাজি হয়ে ঘরের বাইরে পা দিয়ে বাঁচলাম আমি। কমল গুহ আগে আগে চলেছে। এই মূহুর্তে আমার সব থেকে রাগ হচ্ছে ওর ওপর।
ওর আপিস-ঘরে আসার পর গম্ভীর মুখে হাসি দেখলাম। জিজ্ঞাসা করল, অক্ষত আছিস?
বললাম, তোর আসতে আর দুমিনিট দেরি হলে হার্টফেল করতাম। কী ব্যাপার?
নট এ ওয়ার্ড টু-ডে, আবার কাল।
সত্রাসে বলে উঠলাম, কাল আবার ওই ঘরে?
ও হাসতে লাগল, তুই একটা কাপুরুষ-ইজন্ট সী রিয়েলি চার্মিং?
পরদিন বিকেলে কমল আবার আমাকে ধরে নিয়ে গেল। কথা দিল, আজ আর আমাকে ফেলে ঘর ছেড়ে যাবে না। তাছাড়া আমারও কৌতূহল ছিলই।
আজ দ্বিতীয় প্রস্থ বিস্ময়। গতকালের পরিচয় মহিলার মনেও নেই। কমল বলল, আমার লেখক বন্ধু, আলাপ করাতে নিয়ে এলাম। স্মৃতি গুপ্ত স্বাভাবিক মুখেই দুটি হাত জুড়ে নমস্কার করল, কি ভাগ্য, বসুন।
গলা খাটো করে কমল যেন আমি শুনছি না এইভাবে মহিলাকে বলল, লিখে আরো কত নাম করতে পারত ঠিক নেই, বাড়িতে বড় অশান্তি, বউয়ের সঙ্গে এক মুহূর্তের বনিবনা নেই…হয়ত ছাড়াছাড়িই হয়ে যাবে। বড় দুঃখের জীবন…
গতকালের বিপরীত দৃশ্য দেখলাম আমি। আমার দিকে মহিলা তাকলো একবার। আয়ত চোখে বিমনা ব্যথার ছায়া। প্রায় ফিসফিস করে কমলকে বলল, আ-হা! আমার কাছে এ-সব লোককে কেন আনেন বলুন তো, বড় মন খারাপ হয়ে যায়।
আজকের আলাপের মেয়াদ পাঁচ মিনিটও নয়। লেখার প্রসঙ্গেই দু-এক কথা জিজ্ঞাসা করল স্মৃতি গুপ্ত। আসার সময় শান্ত দুচোখে আমার দিকে চেয়ে বলল, জীবনে শক্ত হয়ে যুদ্ধ করতে পারাটাও কম কথা নয়, বুঝলেন…তখন দেখবেন সব বাধাবিঘ্ন তুচ্ছ হয়ে গেছে। তারপর কমলের দিকে একটু চেয়ে থেকে বলল, শুকনো দেখছি কেন, খাওয়া-দাওয়া হয়েছে, না সে-সময়ও হয় নি?
হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে কমল আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো।
সন্ধ্যার পর এক পেয়ালা কফি নিয়ে বসে কমলকে বললাম, এবারে কী আমাকেই তুই পাগল করে ছাড়বি? কৌতূহল আর কত সহ্য হয়?
পাইপ ধরাবার ফাঁকে কমল হাসল একটু। আমি প্রসঙ্গ বিস্তারের আশায় আবার বললাম, মহিলাকে বেশ শিক্ষিতা মনে হলো?
–হ্যাঁ, এম-এ পাশ।…তা বয়েসকালে দেখতে কেমন ছিল মনে হয়?
জবাব দিলাম, বয়েসকাল তো এখনো মায়া কাটাতে পারে নি মনে হল।
খুশি মুখে কমল মাথা নাড়ল। তারপর খুব চাছাছোলাভাবে একেবারে সংক্ষেপে যে ঘটনাটা ব্যক্ত করল, তাই শুনে আমি স্তম্ভিত।
***
স্মৃতি গুপ্ত ইউ-পিতে থাকত। সেখান থেকেই এম-এ পাস করেছিল। তার বাবা সেখানকার ডাক্তার। ছেলেবেলায় দুই-একবার বাংলা দেশ, অর্থাৎ কলকাতা দেখেছে।
ভারী এক সুপুরুষ স্মার্ট ছেলের প্রেমে পড়ল সে। নাম পরাশর দত্ত। সেই ছেলেরও কলকাতায় ব্যবসা–ডাক্তারি সরঞ্জাম আর পঙ্গু মানুষদের সরঞ্জাম সরবরাহ করে। নিজের হেলথ ক্লিনিক আছে।
পরাশর দত্ত যখন সেখানকার কলেজের ছোকরা, স্মৃতি গুপ্তর দিকে তখন থেকেই চোখ ছিল তার। কিন্তু স্মৃতি তখন ফ্রক ছেড়ে শাড়িও ধরে নি। আলাপ ছিল, প্রেম বোঝার বয়েস তখনো সেটা নয়। কিন্তু খুব চৌকস মনে হত ছেলেটাকে তখন।
ভাগ্যের সন্ধানে পরাশর ইউ-পি ছাড়ল। আট বছর বাদে এই ইউ-পিতেই ব্যবসার কাজে এসে আবার যোগাযোগ। স্মৃতি তখন এম এ পড়ছে–সামনের বারে পরীক্ষা দেবে। আর পরাশর দত্তও তখন উঠতি অবস্থার মানুষ। দুজনে দুজনকে দেখে মুগ্ধ। স্মৃতিকে দেখে মুগ্ধ তখন অনেকেই। কিন্তু পরাশর আসাতে সকলে বরবাদ হয়ে গেল। ব্যবসার কাজে ঘন ঘন বার-দুই-তিন ইউ-পি আসার ফাঁকেই তাদের প্রেম জমাট বেঁধে গেল। তারপর বিয়ে।
স্মৃতির জীবনের সব থেকে সেরা কটা দিন কেটে গেল। পরাশর কলকাতায় ফিরল। স্মৃতি ছমাস বাদে এম-এ পাস করার পর তাকে নিয়ে যাবে। তখন পরাশর থাকে কলকাতার এক নামকরা হোটেলে। সেখানকার ঠিকানা হিসেবে একটা পোস্ট-অপিসের নাম লিখে দিল সে। তার চিঠিপত্র সব ওই পোস্ট-অফিসের কেয়ারে যায়। ব্যবসার তাগিদে প্রায় সমস্ত ভারতবর্ষেই ঘুরতে হয় তাকে–কখন থাকে না। থাকে ঠিক নেই। হোটেলের চিঠি মারা যায় বলে এই ব্যবস্থা।
এর পরের খানিকটা অংশ জানা গেছে পুলিশের রিপোর্ট থেকে।…অলক বিশ্বাস নামে একটা লোক সেই পোস্ট-অফিসে এসেছিল তাদের ব্যবসার অথবা সুধীর ঘোষের নামে চিঠিপত্র কী আছে সংগ্রহ করতে। পোস্ট-অফিসের লোক তাকে চেনে, সুধীর ঘোষের অনুপস্থিতিতে সেই এসে চিঠিপত্র নিয়ে যায়।
ব্যবসা এবং সুধীর ঘোষের নামে একগোছা চিঠিই ছিল। অলক বিশ্বাস দেখল তার সঙ্গে পরাশর দত্ত নামে একজনের একটা খাম ভুল করে এসে পেছৈ। খামের ওপরে মেয়েলি হাতের লেখাটা বড় সুন্দর মনে হল তার। বাইরে এসে খামটা খুলল। লিখেছে স্মৃতি নামে এক মেয়ে। বেশ চাপা উচ্ছ্বাসের ঝকঝকে চিঠি। বেশিদিন বিয়ে হয় নি বোঝা যায়।–নিজের এম-এ পাশের খবর দিয়েছে। তারপর লিখেছে, ওমুক দিন ওমুক গাড়িতে কলকাতা আসা স্থির করেছে। ছোট ভাইয়ের পরীক্ষা সামনে, তাই একলাই রওনা হতে হবে। চিঠির শেষ, পত্রপাঠ প্রাপ্তিসংবাদ পেলে আমি নিশ্চিন্ত মনে রওনা হব। তুমি অবশ্যই ঠিক সময়ে স্টেশনে থেকো। জ্ঞান-বয়সে তো কলকাতা দেখি নি, ট্রেন থেকে নেমেই তোমার মুখখানা না দেখতে পেলে তালকানা হয়ে যাব।
অলক বিশ্বাস তিন দিন বাদে স্মৃতি দত্তর ঠিকানায় একটা টেলিগ্রাম পাঠালো। পরাশর যখন দত্ত, স্মৃতিও তখন দত্তই হবে। টেলিগ্রামের বয়ান ও স্টার্ট-পরাশর।
ব্যবসার বারো আনার অংশীদার সুধীর ঘোষকে এ ব্যাপারে সে ঘুণাক্ষরেও কিছু জানালো না। তাদের ব্যবসায় কৃতিত্ব ভাগাভাগি করাটা রেওয়াজ নয়। তাছাড়া সুধীর ঘোষের সঙ্গে ভিতরে ভিতরে তার একটা চাপা বিরোধ চলেছে। জানলে ফোপরদালালী করবে। তারপর মেয়েটা যদি মনে ধরার মত না হয়, তাহলে ঠাট্টা-ঠিসারা করবে। কিন্তু কে জানে কেন, চিঠি পড়েই অলক বিশ্বাসের আশা, মনে ধরার মতই হবে মেয়েটা। তা যদি হয়, তাহলে সে-রকম শিকার ধরার বাড়তি প্রাপ্যও কম হবে না। অতএব পার্টনারের কাছে গোপন।
তারপরের ব্যাপারটা জল-ভাতের মত সহজে ঘটে গেল। উনিশশ সাতচল্লিশের শুরু সেটা। উদ্বাস্তুর চাপে শিয়ালদহ স্টেশন তখন নরক। কলকাতার বহু জায়গাই নরক।
ট্রেন থেকে নেমে স্মৃতি চেনা মুখ দেখল না। উদগ্রীব মুখে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। আর দূর থেকে অলক বিশ্বাসের মনে হল–এই হবে। কিন্তু রূপ দেখে সে নিজেই হকচকিয়ে গেল প্রথম; ভরসা করে তক্ষুনি সামনে এগোতে পারল না। আরো খানিক বাদে নিঃসংশয় হয়ে ব্যস্তসমস্তভাবে তার কাছে এলো।–এক্সকিউজ মি, আপনি কি মিসেস স্মৃতি দত্ত?
স্টেশনের সেই নরকের মধ্যে চেনামুখ না দেখে স্মৃতি ভয়ানক উতলা হয়ে পড়েছিল। সাগ্রহে মাথা নাড়ল।
– সরি, আমার একটু দেরি হয়ে গেল আসতে। মিস্টার দত্ত মানে পরাশর দত্ত আমাকে পাঠিয়েছেন। তিনি হঠাৎ বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তাই আসতে পারলেন না…চলুন।
বেশ অসুস্থ শুনে স্মৃতি ঘাবড়ে গেল–কী অসুখ?
–পেটের নিচের দিকে খুব যন্ত্রণা, চলাফেরা করতে পারছেন না। আপনি ঘাবড়াবেন না, আসুন।
চিন্তিত মুখে স্মৃতি তার সঙ্গে ট্যাক্সিতে উঠল।
অলক বিশ্বাসের জীবনে আজ ভাগ্যের সূর্যোদয় যেন। বারোআনার মালিক সুধীর ঘোষ রাত সাড়ে আটটার আগে আসবে না। সাড়ে আটটার পর বাবু এসে মালিকের আসনে জাঁকিয়ে বসে টাকা গোনেন। তার ওপর আজ কোনো টোপের আশায় চন্দননগর গেছে। আগে এসে হাজির হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। ভালোই হয়েছে। এ জিনিস দেখলে কিছুদিন অন্তত আর কাউকেই সে ধারে-কাছে ঘেঁষতে দিত না। ও নিজেই একটা রাঘব বোয়াল। আর একবার বেশ সুশ্রী এক শিকার ধরে আনার পর এক মাস পর্যন্ত নিজেই তাকে গিলে বসে থাকল। এভাবে ব্যবসা চলে!…জায়গায় গিয়েই অলক বিশ্বাস অচিন্ত্য সরখেলকে টেলিফোনে আমন্ত্রণ জানাবে। অঢেল টাকার মালিক অচিন্ত্য সরখেল। সরকারী-বেসরকারী মহলে তার প্রবল প্রতাপ। কখনো বিপদের গন্ধ নাকে এলে সে-ই তাদের ত্রাণকর্তা। মেয়েটাকে একবার তার কবলে ফেলে দিতে পারলে নিশ্চিন্তি। সুধীর ঘোষ তখন নো-বডি। অচিন্ত্য সরখেলের কাছ থেকে সে আজ মোটা কিছুই খসাতে পারবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
শৌখিন এলাকার অনেক ফ্ল্যাটের একটা বিশাল বাড়ির দোতলায় উঠে হেলথ ক্লিনিকের সাইন বোর্ড দেখল স্মৃতি। তাকে তিনতলায় নিয়ে এলো অলক বিশ্বাস। সুন্দর একটা সাজানো ঘরে এনে ঢোকালো। বাড়ির মধ্যে এটাই সাউণ্ড-প্রফ ঘর। বাইরে থেকে বা ভিতর থেকে গলা ফাটালেও দুদিকের কেউ শুনতে পাবে না।
তাকে বসতে বলে অলক বিশ্বাস বেরিয়ে গেল। পাঁচ মিনিট বাদেই এসে আবার খবর দিল, মিস্টার দত্ত গেছেন বেরিয়ামমিল এক্স-রে করাতে, তাই ফিরতে দেরি হবে। মিসেস দত্ত চা-টা খেয়ে রেস্ট নিন, চান-টান করুন, মিস্টার দত্ত ততক্ষণে এসে যাবেন।
বিভ্রাটের কথা শুনে স্মৃতির আবার মুখ শুকালো। বলল, আমাকে সেখানে নিয়ে চলুন।
অলক বিশ্বাস সবিনয়ে বলল, কোন ডাক্তারের চেম্বারে গেছেন তিনি তাদের জানা নেই।
একটু বাদে বেয়ারা চা ইত্যাদি দিয়ে গেল।–তার চাউনিটা কি-রকম বিশ্রী লাগল স্মৃতির। চা খেতে খেতে ঘরটা দেখেও অবাক লাগল একটু। সুন্দর শয্যা পাতা, বসার শৌখিন আসবাব, ড্রেসিং টেবিল, টয়লেট সেট–সবই আছে, কিন্তু ঘরে কোন বাক্স বা স্যুটকেস বা জামা-কাপড়ের চিহ্নও নেই।…ভাবল, কোথায় কোথায় ঘোরে লোকটা, তাই এ-সব রাখার জায়গারও হয়ত ঠিক নেই।
ঘরের সঙ্গে সুন্দর বাথরুম। ক্লান্তি দূর করার জন্য বেশ করে চান করে নিল। দুপুরের দিকে সত্যিই বিচলিত সে। একলাই খেয়ে নিতে হল, বেলা তিনটে বেজে। যায়–লোকটার পাত্তা নেই।
রাত হওয়া পর্যন্ত তার দুশ্চিন্তার বিবরণ বাদ দেওয়া যাক। বিকেলে বহুবার ঘর থেকে বেরুতে চেষ্টা করে দেখেছে–বাইরে থেকে বন্ধ। চিৎকার করেও সাড়া মেলে নি।
তারপর নরক। শক্তিশালী একটা জঘন্য পুরুষের সঙ্গে দিশেহারার মত ধস্তাধস্তি করতে হয়েছে তাকে। লোকটা আধঘণ্টার চেষ্টায় কাবুই করে ফেলেছিল তাকে, হঠাৎ দাঁতে করে তার বাহুর মাংস প্রায় ছিঁড়ে নেবার উপক্রম করে কয়েক মুহূর্তের জন্য মুক্তি পেয়েছিল সে। আর্তত্রাসে এবার ছুটে এসে হ্যাণ্ডেল ঘোরাতেই দরজা। খুলে গেছল। এস্ত-বসনে আলুথালু অবস্থায় পাগলের মত নিচে ছুটল।
নিচের সাজানো আপিস-ঘরে তখন সুধীর ঘোষ বসে। চার আনার পার্টনার অলক বিশ্বাস সন্ধ্যে থেকে মনের আনন্দে অঢেল মদ গিলে কোথায় নিপাত্তা হয়ে আছে জানে না। এসে অন্য লোকের মুখে শুনেছে বড় জবর শিকার ধরে এনেছে পার্টনার আজ। এবং খানিক আগে অচিন্ত সরখেল সে-ঘরে গেছে।
সিঁড়িতে অস্ফুট কাতর শব্দ শুনে কান খাড়া হল তার।
সামনে একটা আপিস-ঘর এবং আলো দেখে উদ্ধারের আসায় আত্রাসে প্রচণ্ড বেগে দরজা টেনে স্মৃতি ভিতরে ঢুকল, বাঁচান!
পরমূহুর্তে তড়িৎস্পৃষ্টের মত স্তব্ধ, পঙ্গু একেবারে। মালিকের চেয়ারে বসে আছে। পরাশর দত্ত, সহকর্মীরা সকলে যাকে জানে সুধীর ঘোষ বলে। তার সামনে মদের বোতল, মদের গেলাস–আর দুপাশে বসে দুটো মেয়ে হাসাহাসি করছে।
বিনা মেঘে বজ্রাঘাতে পরাশর দত্তও বিমূঢ়, হতচকিত। মদের নেশায় ভুল দেখছে। কিনা সেই বিভ্রম। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।–স্মৃতি তুমি! তুমি এখানে!
ভাবার অবকাশ পেলে স্মৃতি কী করত জানে না, কিন্তু সেই কয়েকটা মুহূর্তের মধ্যেই বুঝি তার মাথায় সর্বনাশা কিছু ঘটে গেল। অস্ফুট আর্তনাদ করে ছুটে বেরিয়ে সোজা আবার ওপরে উঠে গেল স্মৃতি। ঠাস করে সাউণ্ড-প্রফ ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল আবার। ঘরের মধ্যে সেই আহত বাঘ বসে তখনো।
তিনতলায় উঠে পাগলের মতই পরাশর দত্ত দরজা ধাক্কাতে লাগল। দরজা খোলার জন্য চিৎকার করে ডাকাডাকি করতে লাগল। ও-ঘরে কোন শব্দ ঢুকবে না নিজেই ভুলে গেছে।
..বেশি রাতে সেই ঘর থেকে, সেই নরককুণ্ড ছেড়ে স্মৃতি অচিন্ত্য সরখেলের সঙ্গেই বেরুতে পেরেছিল। দাঁতের কামড় খেয়ে হোক বা এমন এক দুর্লভ রত্ন লাভের আনন্দে হোক, এই বারোয়ারি জায়গায় তাকে ছেড়ে যেতে অচিন্ত্য সরখেলের মন সরে নি। যাবার আগে জিজ্ঞেস করেছে, তুমি যাবে আমার সঙ্গে? ..এখানে থাকলে তোমার ওপর বেশি অত্যাচার হবে, এর থেকে তোমাকে অনেক ভালো জায়গায় রাখতে পারি।
নির্জীব কলের পুতুলের মত স্মৃতি মাথা নেড়েছে, যাবে।
পরাশর দত্ত অন্যথায় সুধীর ঘোষের চোখের ওপর দিয়েই স্মৃতিকে নিজের গাড়িতে এনে তুলেছে অচিন্ত প্রখেল। বলেছে, একটু টু-টা করলে তাকে হাজতে গিয়ে পচতে হবে।
নিস্পন্দ পরাশর দত্ত টু-টা করে নি।
হতচেতনের মত চার রাত্রি এক নামকরা হোটেলে কাটিয়েছে স্মৃতি। প্রতি সন্ধ্যায়ই অচিন্ত্য সরখেল এসেছে। যাবার আগে মোটা টাকাও গুঁজে দিয়ে গেছে। সে এত খুশি যে সর্বস্ব দিতে পারে।
তারপর মাথায় খুন চেপেছে স্মৃতির। হোটেল থেকে বেরিয়ে থানায় এসেছে। কিন্তু সুধীর ঘোষ বা পরাশর দত্ত পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়েছে। ধরা পড়েছে অলক বিশ্বাস।
সেই থেকে দিনের পর দিন বছরের পর বছর আক্রোশের জ্বলন্ত আগুন মাথায় নিয়ে কলকাতার রাতের অভিসারে পা বাড়িয়েছে স্মৃতি দত্ত-না দত্ত নয়, তখন আগের পদবী ব্যবহার করে সে-স্মৃতি গুপ্ত। একটিমাত্র নেশা তার, সখের ঘর ভাঙাবে। অনেক ভেঙেছে–অনেক।
কিন্তু সেই সঙ্গে মাথার গোলযোগও বেড়েই চলল। শেষের দিকে এক শাসালো মাড়োয়ারীর কাছে ছিল। মস্তিষ্কের বিকৃতি অসহ্য হয়ে ওঠা সত্ত্বেও লোকটার নেশা ঘোচে নি। স্মৃতি ভালো হবে এই আশায় বহু পয়সা খরচ করে সে-ই তাকে এই হাসপাতালে রেখে যায়। কিন্তু চোখের বার হলে মনের বার, কতদিন সে আর পাগলের আশায় এই হাতির খরচ টানবে! দুবছর হয়ে গেল–সে আর খরচাপত্রও দেয় না, খবরও নেয় না।
***
কতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম জানি না। এক সময় জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে এখন খরচ চালাচ্ছে কে?
নতুন করে পাইপ ধরাতে ধরাতে কমল গুহ জবাব দিল, আমি।
আমি অবাক।-তুমি কেন?
–কে জানে! একটু বিমনা দেখলাম ওকে, বলল, পিকিউলিয়ার কেস, কিন্তু সারার আশা আছে। আগের থেকে এখন অনেক ভালো।…তাছাড়া, স্ত্রীর সঙ্গে আমার ডাইভোর্সের মামলা চলছে শোনার পর থেকে এক অদ্ভুত মায়া পড়ে গেছে মহিলার–একমাত্র আমি ছাড়া হাসপাতালের আর কোন লোককে সে সহ্য করতে পারে না। ডাইভোর্স হয়ে গেছে জানার পর মায়াটা আরও বেড়েছে-আমাকে একটা অসহায় শিশু ভাবে।
আমি নীরব। বার-কয়েক পাইপে টান দিয়ে কমল হঠাৎ আমার দিকে ফিরল। –কিন্তু তারপর?
আমি তারই প্রশ্নের পুনরুক্তি করলাম, তারপর কী?
উঠে ঘরের এ-মাথা ও-মাথা পায়চারি করল বার-দুই। তারপর দেশের নামজাদা। এক মনোবিজ্ঞানী ডাক্তার কমল গুহ আমার চেয়ারের সামনে ঝুঁকে দাঁড়াল।আমিও তো তাই জিজ্ঞেস করছি, তারপর কী? হোয়াট নেক্সট?