স্মৃতির আলোকে ড. অশোক দত্ত ও মোগলমারি – অতনু প্রধান
আমি তখন দশম শ্রেণিতে পড়ি। খ্রিস্টাব্দটা ২০০৪ হবে। শুনতে পেলাম আমাদের গ্রামের ঢিবিটি খোঁড়ার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপকরা এসেছেন। ঢিবিটি এবং তার পার্শ্ববর্তী জায়গা গ্রামের ক্লাব ‘মোগলমারি তরুণ সেবা সংঘ ও পাঠাগার’-এর সম্পত্তি। জানলাম ক্লাব কতৃপক্ষ খোঁড়ার অনুমতি প্রদান করেছেন। যদিও সেই সময় ক্লাবের সদস্য ছিলাম না। মনের মধ্যে কৌতূহল—এত বড়ো ঢিবি। কীভাবে খোঁড়া হবে? হাতের দ্বারা না মেশিনের দ্বারা? গিয়ে দেখলাম ঢিবির পশ্চিম পাশে (বর্তমানে ক্লাব গৃহের পেছনের দিক) বেশ কয়েকটি কাঠের খুঁটি পোতা এবং দড়ি দিয়ে বর্গক্ষেত্রের মতো ঘেরা। গাঁইতি, কোদাল প্রভৃতি দিয়ে গ্রামের কয়েকজন লোক খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করেছে। কয়েকজন ছেলেমেয়ে ঘোরাঘুরি করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী সেখানে উপস্থিত লম্বা, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা-পরা ব্যক্তিকে খুঁড়ে পাওয়া ইটের টুকরো, ভাঙা মাটির পাত্র দেখাচ্ছে এবং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে। পরে জেনেছিলাম ওই ব্যক্তি অধ্যাপক ড. অশোক দত্ত। কয়েকদিন ধরে খননকার্য চলল।
তার কয়েক বছর পরে ২০০৬-২০০৭ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় খননকার্য হয় ঢিবির পূর্ব ও দক্ষিণ কোণে। মাঝে মধ্যেই যেতাম খননকার্য দেখার জন্য। শুনতে পেলাম খুঁড়তে গিয়ে একটি ভাঙা বুদ্ধমূর্তি পাওয়া গেছে। ছুটে গেলাম দেখার জন্য। সিস্ট পাথরের ভাঙা বুদ্ধমূর্তি। মূর্তিটি নিয়ে গবেষকবৃন্দ নানান আলোচনা করেছেন। ক্লাবের মধ্যে দেখতে পেলাম উৎখননে পাওয়া নানান প্রত্নসামগ্রী। মনে মনে ভাবলাম যেভাবে মাটি খুঁড়ে হরপ্পার সুপ্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে, আমাদের গ্রামের এই ঢিবি নিশ্চয় কোনো প্রাচীন ইতিহাসের উত্তরাধিকার বহন করছে। যা আর কিছুদিন পরে সম্পূর্ণভাবে উন্মোচিত হবে।
২০০৭-২০০৮-এ তৃতীয় দফার খননকার্য হয়। ওই পর্যায়ে ASI-এর ডিরেক্টর ড. গোপাল চাওলে প্রত্নক্ষেত্র পরিদর্শনে এসেছিলেন। তিনি প্রত্নক্ষেত্রটিকে এই রাজ্যের অন্যতম বৌদ্ধবিহার বলে অভিমত প্রকাশ করেছিলেন। সেই বছরই ক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক রূপে আমি মনোনীত হই। সম্পাদক গৌরীশঙ্কর মিশ্র। গৌরীবাবুই প্রথম আলাপ করিয়ে দেন অশোকবাবুর সঙ্গে। সেই থেকে অশোকবাবুকে ‘স্যার’ বা ‘দত্ত স্যার’ বলে সম্বোধন করতাম।
প্রথম থেকেই দত্ত স্যারের স্নেহের পাত্র হয়ে উঠেছিলাম। তারপর একে একে ড. দুর্গা বসু, ড. রূপেন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায়, রজত সান্যাল প্রমুখ অধ্যাপকদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকনিক্যাল স্টাফেদের সঙ্গেও আলাপ হয়। এরপরই শুরু হয় প্রত্যহ সকালে নিত্য যাওয়া-আসা। হরপ্পা, মহেঞ্জোদরোর কথা ইতিহাসের পাতায় পড়েছি কিন্তু এভাবে চোখের সামনে খননকার্যের দ্বারা ইতিহাস আবিষ্কৃত হতে দেখিনি। তাই অনুভূতিটা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। তাও আবার নিজের গ্রামের ইতিহাস! তাই খুঁটিনাটি ভাবে জানার আগ্রহ ছিল। ফাঁকা পেলেই মাউণ্ডে স্যারের সঙ্গে সময় কাটাতাম এবং বিস্তারিত ভাবে জানার চেষ্টা করতাম। স্যারকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে অনেক তথ্য জানতে পেরেছিলাম। খননকার্য চলাকালীন তুমুল ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি আমার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিতেন এবং বিষয়টিকে যাতে সুন্দরভাবে অনুধাবন করতে পারি তার জন্য তিনি বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করতেন। কোনো সময় তাঁর চোখেমুখে বিরক্তি বা ক্লান্তির ছাপ লক্ষ করিনি। স্যারের থেকে জানতে পেরেছিলাম নালন্দার মতো এটিও একটি বৌদ্ধবিহার। সমগ্র গ্রাম জুড়ে রয়েছে বৌদ্ধ স্থাপত্যের নিদর্শন। আমাদের গ্রামের এই ঢিবিটি একটি নতুন পরিচয় লাভ করেছিল মহান এই প্রত্নতাত্ত্বিকের হাত ধরে। আমরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।
খননকার্য যে ক-টা দিন চলত স্যার সর্বদাই মাউণ্ডে উপস্থিত থাকতেন। প্রত্যেক দিন সকালে তিনি মাউণ্ডে উপস্থিত হতেন। মাউণ্ডের উত্তর-পূর্ব কোণ দিয়ে উপরে উঠতেন। খানিকক্ষণ কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, চারদিক লক্ষ করা, তারপর গুটি গুটি পায়ে খননস্থলের দিকে এগিয়ে আসা। এই ছিল প্রতিদিনের বৈশিষ্ট্য। মাঝে মধ্যেই সংবাদপত্রে মোগলমারি বৌদ্ধবিহারের খবর প্রকাশিত হত। উৎসাহী পর্যটকরা আসতেন দেখার জন্য। বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে মন্তব্য করতেন। কেউ বলতেন রাজপ্রাসাদ, কেউ বা আবার দুর্গ। স্যার প্রত্যেকের কাছে মোগলমারির বিশেষত্ব নিয়ে আলোচনা করতেন। তাঁদের ধারণাগুলিকে সংশোধন করার চেষ্টা করতেন।
স্যারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নিবিড় থেকে নিবিড়তর হতে থাকে। খননকার্য চলাকালীন গবেষক, অধ্যাপক, শিক্ষক থেকে শুরু করে অসংখ্য সাধারণ মানুষের সমাগম ঘটত। যে গ্রাম দাঁতন ১নং ব্লকের মধ্যে সাধারণ গ্রাম ছিল, সেই গ্রামের ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পর্কে জানার জন্য মানুষের আগ্রহ দেখে খুব আনন্দ লাগত। সংরক্ষণ না হওয়ার জন্য খনন করা সমস্ত গর্তগুলিকে বন্ধ করে দেওয়া হত। তাই আমরা স্যারের কাছে আবেদন করি খননের পর আগত পর্যটকদের দেখার জন্য একটি অংশ খোলা রাখতে। আবেদন অনুযায়ী পূর্বদিকের সীমানা প্রাচীর বরাবর দু-টি খাত খোলা ছিল। যার উপরে আমরা ক্লাব থেকে টিনের ছাউনি নির্মাণ করি। বিখ্যাত চিত্র পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ১৭/০২/২০০৮ তারিখে মোগলমারিতে এসেছিলেন তথ্যচিত্র নির্মাণের জন্য। এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে আগস্ট, ২০০৮-এ মোগলমারিকে নিয়ে প্রকাশিত হয় ড. অশোক দত্তের সম্পাদনায় Excavation at Moghalmari বইটি। ২০ নভেম্বর, ২০০৮-এ সংবাদপত্র ওলটাতে গিয়ে দেখি ‘ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ’ মোগলমারিকে হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করে সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ ৭ মার্চ, ২০০৯ মোগলমারিকে নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। দু-দিন দাঁতনে থেকে মোগলমারিসহ সুবর্ণরেখাকে তিনি ক্যামেরাবন্দি করেন।
এরপর ২০০৯-২০১০ খ্রিস্টাব্দে খননকার্য হয় ঢিবির উত্তর ভাগে। ক্লাবের কাছে অনুমতি চেয়ে চিঠি আসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তৎক্ষণাৎ আমরা ছুটে যাই ব্লকের সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিকের কাছে। সেই সময় আধিকারিকের ভূমিকায় মাননীয় তিলকমৌলি রক্ষিত। আমাদের কাছে বিস্তারিতভাবে তিনি সমস্ত ঘটনা শোনেন। খননে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং প্রত্নস্থলের সংরক্ষণ না হওয়ার জন্য স্থানটি নানাভাবে বিনষ্ট হচ্ছে। এছাড়াও খননে প্রাপ্ত সামগ্রীগুলি সাধারণ মানুষ দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আধিকারিক মহাশয় সংরক্ষণের ব্যাপারে ব্যবস্থাসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জানানোর আশ্বাস দেন। সেইসঙ্গে খননকার্যের সমাপ্তির পর মোগলমারি বৌদ্ধবিহারে জনসাধারণের জন্য প্রাপ্ত প্রত্ন নিদর্শনের প্রদর্শনী এবং আলোচনা সভা আয়োজনের আশ্বাস প্রদান করেন। খননকার্য চলে ২২ মার্চ, ২০১০ পর্যন্ত। আবিষ্কৃত হয় বৌদ্ধবিহারের মূল প্রবেশদ্বার। আশ্বাস মতোই সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক মহাশয় ২৩ মার্চ, ২০১০ মোগলমারি বৌদ্ধবিহারে প্রাপ্ত প্রত্ন নিদর্শনের প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। আলোচনা সভাটি অনুষ্ঠিত হয় দাঁতন ১নং পঞ্চায়েত সমিতির সভাকক্ষে। দাঁতন ১নং পঞ্চায়েত সমিতির সহযোগিতায় প্রবেশদ্বারের উপর একটি ছাউনি নির্মিত হয়। যদিও তা সময়সাপেক্ষ ছিল। নির্মাণের পূর্বেই প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রবেশদ্বারের প্রভূত ক্ষতিসাধন হয়।
সরকারিভাবে সংরক্ষণের জন্য কোনো উদ্যোগ তখনও গ্রহণ করা হয়নি। আমাদের চোখের সামনে প্রত্নসম্পদ দিনের পর দিন নষ্ট হতে থাকে। খসে পড়তে থাকে ইটের দেওয়াল, চুন-সুরকির (স্টাকো) পলেস্তারা। আমাদের কী করণীয় তা আমরা বুঝে উঠতে অসমর্থ হই। ক্লাব থেকে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে সংরক্ষণের জন্য আবেদন পাঠিয়েও কোনো সাড়া মেলেনি।
এমতাবস্থায় পরের বছর অর্থাৎ ২০১০-২০১১ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চম দফার খননের অনুমতি চেয়ে চিঠি আসে। কিন্তু এর পূর্বে ২.৫ইঞ্চি লম্বা এবং ৪ইঞ্চি চওড়া একটি বুদ্ধমূর্তি পাওয়া যায়। এটি সংগ্রহ করে বৌদ্ধবিহারের পার্শ্ববর্তী পাড়ার একজন ছেলে। পঞ্চম দফার খননের অনুমতির জন্য ক্লাবের সদস্য এবং গ্রামবাসীদের নিয়ে আলোচনা করা হয়। দীর্ঘদিন যাবৎ সরকারি দপ্তরগুলিতে আবেদন জানিয়েও সংরক্ষণের জন্য কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় খননকার্যের অনুমতি প্রদানে সকলেই আপত্তি করে। খননকার্যকে স্থগিত রাখার জন্য আদালতে ক্লাবের পক্ষ থেকে একটি মামলা রুজু করা হয়। মামলার বিষয়বস্তু ছিল পূর্বে খননের পর যথাযথ সংরক্ষণ না হওয়ায় প্রত্নক্ষেত্রটির ভীষণ ক্ষতি হয়েছে। সংরক্ষণবিহীন খননকার্য করলে বৌদ্ধবিহারের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। সেইসঙ্গে খননে পাওয়া প্রত্নসামগ্রীগুলি পর্যটকদের দেখার সুবিধার্থে একটি সংগ্রহশালা নির্মাণের প্রস্তাব। এই সংক্রান্ত বিষয়টি আমরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য ড. সুরঞ্জন দাস মহাশয়কে অবগত করি। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই ড. দত্ত মহাশয়ের কাজে বাধা দেওয়া বা তাঁর বিরোধিতা করার মানসিকতা আমাদের ছিল না। অবশেষে দাঁতন হাইস্কুলের শিক্ষক আমাদের প্রিয় সূর্য নন্দী মহাশয়ের উদ্যোগে দাঁতন ১নং ব্লকে ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১১ একটি প্রশাসনিক বৈঠকের আয়োজন করেন সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক তিলকমৌলি রক্ষিত মহাশয়। উপস্থিত ছিলেন ড. অশোক দত্ত, ক্লাবের কর্মকর্তাগণ ও আমাদের গ্রামের ভূমিপুত্র হাওড়ার তৎকালীন অতিরিক্ত জেলাশাসক অশোক দাস ও সূর্য নন্দী।
আলোচনায় ব্লক প্রশাসন ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সংরক্ষণের আশ্বাস দেওয়ায় আমরা মামলাটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি এবং ড. দত্ত মহাশয়কে খননকার্য শুরু করার জন্য বিনীত আবেদন জানাই। আমাদের সঙ্গে স্যারের কোনো অবস্থাতেই সম্পর্কের ফাটল ধরেনি। কারণ স্যার আমাদের সমস্যার কথা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। খননকার্য চলে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত। খননকার্য দাঁতন ১নং পঞ্চায়েত সমিতির আর্থিক অনুদানের মাধ্যমে ঘটে। খননকার্য চলাকালীন রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কয়েকজন সামান্য সংরক্ষণের কাজ করেন। সীমানা প্রাচীর বরাবর এবং জনবসতিপূর্ণ এলাকাতে খনন হয়। পাওয়া যায় গোলাকার পোড়ামাটির ‘ভোটিভ ট্যাবলেট’ বা ‘নিবেদনসামগ্রী’। এই সামগ্রীটিতে বুদ্ধ মাঝে রয়েছেন।ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় তাঁর অবস্থান। দু-পাশে দু-টি করে দাঁড়ানো মূর্তি। নীচে দু-সারিতে ৬টি করে মোট ১২টি বুদ্ধের মূর্তি। স্যারের থেকে জানতে পেরেছিলাম একটি বৌদ্ধবিহারে নির্দিষ্ট বৌদ্ধস্তূপের কাছে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা এই বস্তুটি নিবেদন করতেন। এছাড়াও ধূসর রঙের পোড়া মাটির হাঁড়ি। হাঁড়ির মধ্যে শতাধিক কড়ি। যেগুলি বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হত। সীমানা প্রাচীরের চারপাশে প্রদক্ষিণ পথ।
এই সময় স্যার আমাদেরকে উৎসাহিত করেন ক্লাবগৃহে একটি সংগ্রহশালা গড়ে তোলার জন্য। সরকারি ভাবে সংগ্রহশালা -গড়ে ওঠা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই তাঁর নির্দেশমতো ক্লাবের পাঠাগারগৃহে সংগ্রহশালা গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। গ্রামের বিভিন্ন ব্যক্তির থেকে সংগ্রহ করা প্রত্নসামগ্রী এবং বিভিন্ন দফায় উৎখননে তোলা ছবি দিয়ে সংগ্রহশালা সজ্জার কাজ শুরু হয়। স্যার নিজের হাতে এই সংগ্রহশালা সাজিয়েছিলেন। এই কাজে আমি সঞ্জয় দাস, গৌরগোপাল দে এবং দেবাশিস চন্দ স্যারকে সহযোগিতা করি। ড. রজত সান্যাল প্রত্নসামগ্রীগুলির নাম নির্ধারণ করেছিলেন। ১৫ মার্চ, ২০১১-তে এই সংগ্রহশালার উদবোধন করেন অধ্যাপক ড. অশোক দত্ত মহাশয়। বর্তমানে এই সংগ্রহশালা ব্যতীত সরকারি কোনো সংগ্রহশালা এ যাবৎ নির্মিত হয়নি। ১৮ মার্চ, ২০১১-তে মোগলমারি পরিদর্শনে এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব দপ্তরের সচিব নন্দন রায়। তিনিও যথাযথ ভাবে সংরক্ষণ করার আশ্বাস প্রদান করেন। ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশন’ ২১ মার্চ, ২০১১-তে মোগলমারি বৌদ্ধবিহারের উপর তথ্যচিত্র নির্মাণ করে। ২৪ মার্চ, ২০১১ দাঁতন ভট্টর কলেজের বৌদ্ধ বিদ্যাচর্চা কেন্দ্র এবং মোগলমারি তরুণ সেবা সংঘ ও পাঠাগারের যৌথ উদ্যোগে প্রদর্শনী ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় এই প্রত্নক্ষেত্রেই। তাছাড়াও ১৭ মে, ২০১১-তে পবিত্র বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন বুদ্ধ ও মোগলমারির প্রত্নপ্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। প্রত্যেকটি আলোচনা সভার মুখ্য বক্তা ছিলেন ড. অশোক দত্ত। এছাড়াও উপস্থিত থাকতেন মাননীয় সূর্য নন্দী, বিমলকুমার শীট, মৌসুমি মুখার্জী প্রমুখ। সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত থাকতেন।
সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ খননকার্য হয়েছিল ২০১১-২০১২ খ্রিস্টাব্দে। এটাই ছিল ষষ্ঠ দফার তথা স্যারের শেষ দফার খননকার্য, যা আমাদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। খননকার্য শুরু হয় ১৪ ফেব্রুয়ারি, চলে ২৫ মার্চ, ২০১২ পর্যন্ত। এক্ষেত্রে যে বিস্ময়কর আবিষ্কার ঘটেছিল তা এই ষষ্ঠ দফার প্রথম পর্যায়ের খননে। খননকার্য শেষ হওয়ার দু-দিন আগে খননস্থলে একটি মাটির ঢেলা হঠাৎ স্যারের হাতের উপর পড়ে যায়। হাত ফেটে গলগল করে রক্ত পড়তে থাকে। অন্যদিকে ইটের দেওয়ালে চুন-সুরকির (স্টাকো) মূর্তির মুখ দেখা যায়। স্যার হাতের দিকে লক্ষ না করে মূর্তিটিকে সম্পূর্ণ উন্মোচন করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ক্রমশ খুঁড়তে খুঁড়তে মোট ১৪টি স্টাকোর মূর্তি বেরিয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকদের ভিড়। সংবাদপত্র থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যম।
মোগলমারির আবিষ্কার দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আমরা স্যারের থেকে জানতে পারি সুয়ান জাং বর্ণিত তাম্রলিপ্ত রাজ্যে ১০টি বৌদ্ধবিহারের মধ্যে এটি একটি। এই বিহার পশ্চিমবঙ্গের সর্ববৃহৎ বৌদ্ধবিহার। যার আয়তন ৬০মি × ৬০মি। সময়কাল ষষ্ঠ শতাব্দীর এবং নালন্দার সমতুল্য। এই জায়গাটিতে তিনটি পর্যায়ে বিহারগুলি নির্মিত হয়েছে। কিন্তু বিহারের নাম সংক্রান্ত কোনো সিলমোহর পাওয়া যায়নি তাই এই বিস্ময়কর আবিষ্কারের মধ্যেও তিনি কোথাও যেন একটি অভাব লক্ষ করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি সহজ, সরল ও সাবলীল ভাবে প্রত্যেকটি বিষয় জানাতেন। মানুষকে কীভাবে ব্যাখ্যা দিতে হবে তাও তিনি আমাকে অবগত করিয়েছিলেন। খননশষের দিন আমরা স্যারকে পুনরায় খননের আবেদন জানাই। দাঁতন ভট্টর কলেজ খননকার্যে আর্থিক সাহায্যের আশ্বাস দেয়। দাঁতন ভট্টর কলেজ ও আমাদের ক্লাবের যৌথ উদ্যোগে ২৬ মার্চ, ২০১২-তে প্রদর্শনী ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় যেখানে মোগলমারির বুকে দাঁড়িয়ে শেষবারের জন্য স্যার বক্তব্য উপস্থাপন করেন। হাজার হাজার সাধারণ মানুষ, ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, অধ্যাপক-অধ্যাপিকা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন স্যারের বক্তব্য শোনার জন্য। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন দাঁতন ভট্টর কলেজের অধ্যক্ষ ড. পবিত্রকুমার মিশ্র, অধ্যাপক-অধ্যাপিকা ড. মনিকুন্তলা হালদার, অধ্যাপক ড. অমিত ভট্টাচার্য, সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক জ্যোতি ঘোষ প্রমুখ। দত্ত স্যার আমাদের জানিয়েছিলেন একটি বীজ সুপ্ত অবস্থায় থাকে। তাতে জল দিলে অঙ্কুরোদগম ঘটে। মোগলমারি তেমনি সুপ্ত অবস্থায় ছিল। আজ তার ইতিহাস প্রস্ফুটিত হয়েছে।
২৭ মার্চ, ২০১২-তে স্যার মোগলমারি থেকে ফিরে যান এবং ৩১ মার্চ, ২০১২-তে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। প্রত্যেকদিন সকাল থেকে প্রচুর পর্যটকের ভিড় উপচে পড়ত। ক্লাবের সদস্যরা বিশেষ করে গৌরগোপাল দে, সঞ্জয় দাস ও নিমাই দোলাই বিষয়গুলির ব্যাখ্যা করত। ৩১ মার্চ, ২০১২-তে মোগলমারি পরিদর্শনে এসেছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি মাননীয় সৌমি পাল। ভারত সরকারের কলকাতা দূরদর্শনের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর সন্দীপ রায় মোগলমারিতে তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন ১৬ থেকে ২০ এপ্রিল, ২০১২ খ্রিস্টাব্দে।
ষষ্ঠ দফার দ্বিতীয় পর্যায়ের খনন শুরু হয় ৬ মে, ২০১২-তে। চলে ২৩ মে, ২০১২ পর্যন্ত। প্রচন্ড গরম। চারদিকে দাবদাহ চলছে। তারই মধ্যে দত্ত স্যার অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। স্যারের একাগ্রতা ও পরিশ্রম করার ক্ষমতা ছিল সত্যিই প্রশংসনীয়। এই খননকার্য দাঁতন ভট্টর কলেজের ‘বৌদ্ধ বিদ্যাচর্চা কেন্দ্র’-এর আর্থিক অনুদানে হয়েছিল। খননকার্য চলাকালীন বিভিন্ন স্কুল, কলেজ থেকে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী আসত।
খননের সময় তিনি আমাদের সঙ্গে বসে নানান গল্প করতেন। হাতে সিগারেট, কখনো বা চায়ের গ্লাস। আমি স্যারকে বারণ করতাম সিগারেট সেবন না করতে। তিনি হেসে হেসে বলতেন, ‘বেঁচে থাক স্মৃতিসুধায় হৃদয়ের পাত্রখানি’। কখনো কখনো আবার আমার কাঁধে হাত দিয়ে বসে মোগলমারির ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করতেন। প্রসঙ্গক্রমে জানতে পেরেছিলাম আজকের মোগলমারিতে প্রথম জনবসতি শুরু হয় তাম্রপ্রস্তর যুগে। গ্রামের ভিতর মাটি খুঁড়ে তারও নিদর্শন পাওয়া গেছে। যথেষ্ট দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন দাঁতনের মধ্যে এত প্রাচীন প্রত্নস্থল আর কোথাও নেই। ষষ্ঠ দফার দ্বিতীয় পর্যায়ের খননকার্যের পূর্বে ‘ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ’ থেকে আমাদের ক্লাবে চিঠি আসে। চিঠি থেকে জানতে পারি তাঁরা মোগলমারি বৌদ্ধবিহারের উৎখনন করতে চাইছেন। কিন্তু সমস্ত কাজই বন্ধ হয়ে রয়েছে রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ছাড়পত্রের জন্য। মোগলমারি ‘জাতীয় সৌধ’-এর স্বীকৃতি পাক, স্যারও চেয়েছিলেন। কিন্তু ৩০/৪/১২ তারিখে রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ থেকে ব্লকের সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিকের কাছে চিঠি আসে যে, তাঁরা মোগলমারিতে কাজ করতে ইচ্ছুক। সেইজন্য ৫০ লক্ষ টাকা সংরক্ষণ ও ৩০ লক্ষ টাকা সংগ্রহশালা নির্মাণের জন্য রাজ্যের মুখ্যসচিবের ত্রয়োদশ অর্থ কমিশনের থেকে উচ্চ পর্যায়ের কমিটর অনুমোদনক্রমে তাঁরা বরাদ্দ করেছেন। ২২/১২/২০১২ তারিখে মোগলমারি প্রত্নক্ষেত্রের পরিদর্শনে এসেছিলেন রাজ্য পর্যটন দপ্তরের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি মাননীয় বিক্রম সেন। সঙ্গে ছিলেন জেলার অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) সুমন ঘোষ, দাঁতন ১নং ব্লকের সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক জ্যোতি ঘোষ প্রমুখ। মোগলমারির ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিচার করে বিক্রমবাবু পর্যটন মানচিত্রে স্থান দেওয়ার কথা বলে গেছেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে পরিদর্শনে এসেছেন ‘ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ’-এর কলকাতা মন্ডলের অধিকর্তা তপনজ্যোতি বৈদ্য, রাজ্যের ক্রীড়া দপ্তরের যুগ্মসচিব প্রদীপ জানা, খড়্গপুরের মহকুমা শাসক সুদত্ত চৌধুরী ও আর ভিমলা, মিরাজ খান্দে (আই পি এস), দীপক সরকার (এস ডি পি ও), প্রাক্তন মন্ত্রী নন্দগোপাল ভট্টাচার্য, সি বি আই-এর প্রাক্তন যুগ্ম অধিকর্তা ড. উপেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, সাংসদ প্রবোধ পান্ডা, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য মাননীয় ড. স্বপনকুমার প্রামাণিক এবং অগণিত আধিকারিক, সাহিত্যিক, গবেষক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ।
শেষ খননেও নামাঙ্কিত সিলমোহর পাওয়া যায়নি। যা পাওয়াই ছিল দত্ত স্যারের মূল লক্ষ্য। ২৩ মে, ২০১২ ছিল স্যারের জীবনের মোগলমারির বুকে শেষ খননের দিন। দুপুর ১টার সময় মাউণ্ড থেকে নীচে নেমে গেলেন। তবে তার পরের দিন তিনি এসেছিলেন। কিন্তু মাউণ্ডে আর ওঠেননি। নীচেই আমার হাত ধরে বলেছিলেন—‘আর হয়তো মোগলমারি কোনোদিন আসতে পারব না। তোদের মোগলমারি, আমার প্রাণপ্রিয় মোগলমারি তোদের কাছে রেখে গেলাম। তোরা এর রক্ষা করিস।’ আমরা বলেছিলাম—‘মোগলমারিতে আপনাকে আসতেই হবে। আপনি ছাড়া মোগলমারি অন্ধ।’ কিন্তু স্যারের কথাই সত্য ছিল। মোগলমারিতে আর স্যারের ফিরে আসা হয়নি। স্যারের দীর্ঘ ৯ বছরের খননে সেই প্রথম তাঁর চোখে জল দেখতে পেয়েছিলাম। স্যারকে সবাই প্রণাম জানিয়ে বিদায় দিয়েছিলাম।
তার কয়েকদিন পর মাউণ্ডে ঘুরতে যাই আমি ও সঞ্জয়দা। হঠাৎ একটি পোড়ামাটির টুকরো সঞ্জয়দা হাতে তুলে আমাকে দেখায়। আমরা সেটিকে নিয়ে জলে ধুতেই দেখি পোড়া মাটির টুকরোর মধ্যে কিছু লেখা রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সেটির ছবি তুলে স্যারকে E-mail করি এবং টেলিফোনের দ্বারাও জানাই। আবেগের সাথে স্যারকে বলি এটাই নামাঙ্কিত সিলমোহর। স্যার জানিয়েছিলেন পরীক্ষা করে জানাবেন। একদিন পরে স্যার জানান এটি নামাঙ্কিত সিল নয়, সিদ্ধমাতৃকায় লেখা একটি অভিলিখন ‘Ye Dharma hetu prabhaba…।’ আমরা হতাশ হলাম। স্যারও হতাশ হয়েছিলেন বলেই মনে হয়।
গত ২৪/০৬/২০১২ তারিখে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার জেলাশাসক সুরেন্দ্র গুপ্তা এবং পুলিশ সুপার সুনীল চৌধুরী মহাশয় এসেছিলেন। আমরা তাঁদের সামনে সমস্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করি। বৌদ্ধবিহারের উন্নয়নের জন্য আবেদন করি। দত্ত স্যারকে সমস্ত বিষয় জানাই। ৩০ জুলাই, ২০১২ তারিখে রাত্রে আমার সঙ্গে ফোনে কথা হয়। পরের দিন অর্থাৎ ৩১ জুলাই, সকালে আমি স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছি। ক্লাবের সদস্য দেবাশিস টেলিফোন করে জানায় স্যার প্রয়াত হয়েছেন। প্রথমে বিশ্বাস করতে না পারলেও এটাই ছিল সত্যি। আমি ফোন করে ক্লাবের সদস্যদের এবং মোগলমারির সঙ্গে যাদের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক সবাইকে জানাই। কিন্তু যানবাহনের সমস্যার জন্য আমরা কেউই স্যারের শেষ যাত্রার সঙ্গী হতে পারিনি। নিজেকে ভীষণভাবে অপরাধী মনে হয়। তাঁর আন্তরিকতা, ভালোবাসা আমরা কেউ ভুলতে পারিনা। আর ভুলে যাওয়াও সম্ভবপর নয়। তিনি শিশুর মতো মোগলমারিকে ও আমাদেরকে স্নেহ করতেন। তাঁর নাম আমাদের অন্তরে লেখা রয়েছে। তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।
১২ অক্টোবর মোগলমারি মাউণ্ডে ড. অশোক দত্তের স্মৃতিতে স্মরণ সভা! তাঁর অবর্তমানে তাঁকে নিয়ে আলোচনা। আলোচনা করলেন—জ্যোতি ঘোষ, মন্মথ প্রধান, সূর্য নন্দী, অখিলবন্ধু মহাপাত্র, গৌরীশঙ্কর মিশ্র প্রমুখ। আমি সঞ্চালনা করেছিলাম। মনে হল, আমাদের সকলের মতো মোগলমারির চোখেও জল!