স্মৃতিকাতর ছাইভস্ম

স্মৃতিকাতর ছাইভস্ম

রাজশাহীর থানাপাড়া নামের গ্রামটার অন্য নাম বিধবাদের গ্রাম শুনে জাফর সাদেক আগ্রহী হয়েছিলেন দুটো কারণে। নিজের চোখে দেখে আসার ব্যাপার তো ছিলই, সেই সাথে ছবি তোলা, সম্ভব হলে বিধবাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া। অ্যানমেরি বলেছিলেন, ‘এতদিন বাইরে থেকেছেন, যা শুনেছেন বা পড়েছেন সবই সেকেন্ডহ্যান্ড নলেজ, এবার ঘুরেফিরে দেখুন আসল অবস্থা।’ সেই সাথে তাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, তিনি যেন এ মুহূর্তে রেপ ভিকটিমদের না খোঁজেন, ব্যাপারটা তার ভাষায় ‘হাইলি সেনসিটিভ’। আরও বলেছিলেন, ‘আমি ও আমার মতো অনেকেই মেয়েদের নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছি। আপনি লেগে থাকুন, বাট ডোন্ট রাশ।

মাসখানেক হলো জাফর সাদেক অ্যানমেরির অফিসে যাওয়া-আসা করছেন। নতুন বাড়িতে চলে আসায় শাপলা-তে যারা জড়িত তাদের সুবিধা হয়েছে। বসার ব্যবস্থাসহ বই, কাগজ, দলিলপত্র গুছিয়ে রাখার জায়গাও পাওয়া গেছে। কয়েক দিন যেতে অ্যানমেরি হাসতে হাসতে জানতে চেয়েছিলেন তার সঙ্গে চুক্তিটা কেমন হবে? জাফর সাদেক পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কীসের চুক্তি? আমি যে এখানে আসছি, এত দলিল-দস্তাবেজ দেখার সুযোগ পাচ্ছি, আপনাদের অভিজ্ঞতার কথা জানতে পারছি, এই তো অনেক। আপনি কি টাকা-পয়সার কথা বলছেন?’ অ্যানমেরি তেমনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘এ ছাড়া কী! আপনাকে আমরা সম্মানী দেব, সেলারি না, অনারিয়াম—ঠিক আছে? ডোনাররা তো আমাদের পয়সা দেয়।’

এ কয়েক দিনে অ্যানমেরির সঙ্গীদের সাথে অনেক কথা হয়েছে। ফাহমিদা যার কথা প্রথম দিন অ্যানমেরি বলেছিলেন, তার সঙ্গে কথা বলে জাফর সাদেক ভরসা পেলেন। রেপ ভিকটিমদের নিয়ে গোড়া থেকেই মহিলা কাজ করছিলেন, অনেকটা নিজে নিজেই, পরে শাপলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। বয়স তার কাছাকাছিই হবে, মোটাঘেঁষা শরীর, গোল চশমায় শ্যামলা মুখটা বড় দেখায়। একটা কলেজে ফিজিক্স পড়াতেন, ছেড়ে দিয়ে এখন পুরো সময় শাপলাকে দিচ্ছেন। পড়ানো ছেড়ে দিলেও অ্যানমেরির মুখে ফাহমিদা প্রফেসর। ফাহমিদা এ নিয়ে হা হা হাসেন, হাসলে মুখটা ভেঙে ছোট হয়ে পড়ে।

আলাপ-পরিচয়ের পর ফাহমিদা জানতে চাইলেন, ‘আপনার কি একটাই এজেন্ডা?’

প্রশ্নটা ধরতে না পেরে কৌতূহলী চোখে তাকাতে ফাহমিদা বললেন, ‘পাক আর্মির ওয়ার ক্রিমিনালদের বিচার।’

‘এজেন্ডা কেন বলছেন? এটা তো নেসেসিটি।’

‘আপনার লেখাগুলো আমাকে অ্যানমেরি দিয়েছেন। আমি একটা লেখা বাংলায় অনুবাদও করেছি। দেখেছেন?’

‘না তো। কোন কাগজে?’

‘দৈনিক বাংলায়।’

‘এটা তো লিড নিউজপেপার। আমি একটা কপি পেতে পারি?’

‘অবশ্যই, আপনি বাংলা পড়তে পারেন?’

‘আপনার এমন ধারণা কেন হলো? পড়তেই না, লিখতে চেষ্টা করলে আর আপনি যদি ঠিকঠাক করে দেন, মন্দ হবে বলে মনে হয় না। অবশ্য অনেক দিন বাংলা লিখি না।’

‘আপনার আর্গুমেন্টগুলো ঠিকই আছে। জেনেভা কনভেনশনে ওয়ার প্রিজনারদের সুরক্ষার কথা থাকলেও ওয়ার ক্রিমিনালদের ছাড় দেওয়া হয়নি। কিন্তু যে চারটা আর্টিকেল আছে তাতে ওয়ার ক্রাইম হিসেবে মেয়েদের ওপর সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স গুরুত্ব পায়নি।’

‘সে কথাই আমি বলতে চেয়েছি। তারপরও আমরা তো কেস দাঁড় করাতে পারি, যদি সরকার চায়।’

‘আপনার লেখায় নুরেমবার্গ ট্রায়ালের রেফারেন্স আছে। কাজটা সোজা না, কারণ ওয়ার প্রিজনারদের কাস্টোডিয়ান ইন্ডিয়া। আমরা চাইলেই হবে না।’

‘কেন হবে না? জেনারেল নিয়াজি সারেন্ডার করেছিল ইন্ডিয়ান ইষ্টার্ন কমান্ড ও বাংলাদেশের জয়েন্ট ফোর্সের চিফ জেনারেল অরোরার কাছে। তার মানে যৌথ বাহিনী কথাটার লিগ্যাল বাইন্ডিং রয়েছে।’

‘তাহলে ইন্ডিয়া ওয়ার প্রিজনারদের সোল কাস্টোডিয়ান হলো কী করে?

‘সেটা আমারও প্রশ্ন।

জাফর সাদেক বুঝতে পারছিলেন ফাহমিদার সাথে এ নিয়ে আরো কথা বলতে হবে। বিশেষ করে মেয়েদের নির্যাতনের ব্যাপারটা কেন আন্তর্জাতিক কোর্টে দাঁড় করানো যাবে না।

রাজশাহীর থানাপাড়ার কথা ফাহমিদার মুখেই শুনেছিলেন জাফর সাদেক। প্রস্তুত ছিলেন একাই যাবেন। যাওয়ার আগের দিন অ্যানমেরি বললেন, ‘তারেককে নিয়ে যান, ওর বাড়ি রাজশাহী, আপনি তো কিছুই চিনবেন না।’ তারেক বছর চব্বিশ-পঁচিশের ছেলে, শাপলার হয়ে নানা ধরনের ফিল্ড ওয়ার্ক করে। সে সঙ্গে যেতে সানন্দে রাজি।

রাজশাহী দূরের, জাফর সাদেক দেশে থাকতে কোনো দিন পদ্মা পাড়ি দেননি। তারেক তাকে সত্যি সত্যি পথঘাট চিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। যাওয়ার পথে তারেক দেখাচ্ছিল কোথায় কোন জায়গায় বাজার ছিল, পুড়ে ছাই হওয়ার এত দিন পরও কয়েকটা ছাউনিই যা উঠেছে, কোথাও আগুনে ঝলসে গিয়েও টিনের বাড়িঘরে মরচে ধরার মতো লাল-কালচে দাগ।

থানাপাড়ায় পৌঁছে মনে হলো না এ জায়গায় কিছু হয়েছে। নিরুত্তাপ চরঘেঁষা গণ্ডগ্রাম। দুর্গম এলাকা, রাস্তাঘাট নেই, মিলিটারি এখানে এসেছিল কী করতে! কিছু পথ ভ্যান-রিকশায়, আর অনেকটা হেঁটে ক্লান্ত লাগছিল খুব। তারেক তাকে নিয়ে বসিয়েছিল একটা ছাপড়া একচালা দোকানের বাঁশের বেঞ্চিতে। আশপাশে মানুষজন নেই। দোকানে একজন বুড়ো লোক টিনের গেলাসে পানি দিয়েছিল। সেই পানি মুখে দিতে কষাটে স্বাদে শুকনো জিভ-টাকরা গুলিয়ে উঠতে জাফর সাদেক চমকে উঠেছিলেন, এ কি পানি, না বিধবাদের জমিয়ে রাখা তিতকুটে কান্না?

মাথার ওপর কড়া রোদ। দূরে ধু-ধু প্রান্তর, নিচু জমি, রোদে ঝলসে আকাশ-মাটি একাকার। ঘুরে ঘুরে দেখতে গিয়ে মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছিল। পরমুহূর্তে যখন মনে পড়েছিল এ গ্রামে হাজারের কাছাকাছি যুবক ও মাঝবয়সি পুরুষকে অদূরের চরে ব্রাশফায়ার করে মারা হয়েছিল, তখন হাঁটার বেগ বাড়িয়ে নিচু চরের জমিতে দাঁড়িয়ে মনে হলো কী দেখতে এসেছেন, কিছু নেই। শুধু রোদ আর ঘাসহীন, খটখটে মাটি। গ্রামের একজন লোক কী ভেবে পিছু নিয়েছিল, সম্ভবত কাঁধে ক্যামেরা দেখে। কথাবার্তায় মনে হলো লেখাপড়া জানে। সে জানাল সাতান ব্রিগেডের একটা ইনফেন্ট্রি দল এপ্রিলের তেরো তারিখে সভা করবে বলে লোকজনকে এখানে জড়ো করে ব্রাশফায়ারে সবাইকে মেরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। অল্প যে কজন পালিয়ে বেঁচেছিল তারা পোড়া লাশগুলোকে ওইখানে, বলে একটা বাঁধের মতো উঁচু জায়গা দেখিয়ে বলল, টানা গর্ত খুঁড়ে পুঁতেছিল। লম্বাটে বাঁধের মতো জায়গাটার বাঁকানো পিঠে পাতলা ঘাস। ছবি তুলতে গিয়ে জাফর সাদেকের মনে হলো কোনো এঙ্গেলই পাচ্ছেন না, কীসের ছবি তুলবেন! সঙ্গে আসা লোকটা অনেক কিছু বলছিল, কিভাবে কাকে প্রথম গুলি করা হয়েছিল, তার নিজের বড় ভাই, দুই চাচা মারা পড়েছিল। সে অনেক চেষ্টা করেছিল স্তূপ-স্তূপ পোড়া-আধপোড়া লাশের মধ্য থেকে তাদের চিনে বের করতে, পারেনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকারি লোকজন এসে আবার মাটি খুঁড়ে পোড়া খুলি, হাড়-গোড় গোনাগুনতি করে হিসাব বের করতে চেয়েছিল, পারেনি।

‘শুধু পুরুষদেরই মেরেছিল?’

লোকটা মাথা নাড়ল। ‘মেয়েদের কিছু করেনি।’

‘তা বুইলতি পারেন। চালান হইছিল।’

কথাটার মানে ধরতে তাকিয়ে থাকলে সে চোখ সরিয়ে নিয়েছিল, জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আপনে সাম্বাদিক?’ চালান হওয়ার মানে ধরা কঠিন না, তবে বোঝা যাচ্ছিল এ নিয়ে সে কথা বলতে চায় না। পরে অবশ্য জাফর সাদেক যা খবর পেয়েছিলেন তাতে জেনেছিলেন অন্তত জনাপঁচিশেক মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিল, যাদের বেশিরভাগেরই খোঁজ মেলেনি।

থানাপাড়ায় এসে নিজের কোনো পরিকল্পনা কাজ করছিল না, আর পরিকল্পনা বলতে হয়তো তেমন কিছু ছিলও না। কিছু ছবি তুলেছিলেন, এই পর্যন্ত তারেককে দেখছিলেন একটা নোটবইতে প্রায় সময়ই কী সব টুকছে।

‘কী লেখো?’

‘এই যা দেখছি, শুনছি।’

‘তোমাদের রিসার্চে লাগবে?’

‘আমাদের এলাকাভিত্তিক ডকুমেন্টেশন করতে হয়।’

বয়স কম হলেও তারেক গোছানো ছেলে। খুঁজে খুঁজে সে একজন প্রাইমারি স্কুলশিক্ষককে বের করল। গ্রামে কতজন বিধবা, বিধবাদের গ্রাম নামটা কার দেওয়া, কোন বাড়িতে সবচেয়ে বেশি পুরুষ মারা পড়েছে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এসব নিয়ে কথা বলার ফাঁকে টেপরেকর্ডার চালিয়ে দিতে জাফর সাদেকের মনে হয়েছিল ভিডিও ক্যামেরাটা যদি আনা যেত। স্টিল ফটোগ্রাফিতে এসব কাজ হয় না।

তারেক সত্যিই কাজের, সে সেই শিক্ষককে অনুরোধ করল কয়েকজন বিধবার সঙ্গে যদি কথা বলার সুযোগ করে দেওয়া যায়। প্রথমে গাঁইগুঁই করলেও পরে ‘চলেন দেখি যুদি কেউ কতা বুইলতি রাজি হয়’ বলতে ভিডিওগ্রাফি না করতে পারার দুঃখ জাফর সাদেককে আরও বেশি করে পেয়ে বসল।

ভাঙাচোরা ঘরবাড়ি, বেশিরভাগই বাঁশ-বেতের, ছন নয় খড়ের ছাউনি। এক বাড়ির উঠান দিয়ে অন্য বাড়ির পথ। বেলা তখন পড়তে শুরু করেছে, কিন্তু কোথাও তেমন সাড়া-শব্দ নেই, বাচ্চা-কাচ্চাদের শোরগোলও না। মোট চারজনের সঙ্গে কথা বলল তারেক। জাফর সাদেক পাশ থেকে শুনলেন, পড়ন্ত আলোর কারণে ক্যামেরার লেন্স ঠিকঠাক করতে যেটুকু নড়াচড়া না করলেই নয় এর বেশি কিছুই করলেন না। তারেকের প্রশ্ন বা মহিলাদের কথাবার্তাও যেন ঠিক ধরতে পারছিলেন না। তবে একজন মাঝবয়সি মহিলার কথা কানে বাড়ি মারল। মহিলা বললেন, বাড়ি ভরতি ছিল পুরুষে, পুকুরে মাছ বেশি হলে যেমন বেশি বেশি ঘাই মারে তার ছোট বাড়ির অবস্থা ছিল সে রকম—তার স্বামী, দুই জোয়ান ছেলে, দেবর, মেয়ের জামাই, ভাশুরের ছেলে মোট ছয়জন। পুকুর এখন ঠাণ্ডা, ঘাই নাই। ‘হিসাবমতো থাকার কথা দুইজন, আমি আর আমার বিটি। আছি একজন, বিটিরে মায়া করছে, মাইরে থুয়ে যায় নাই, লিয়ে গেছে।’

আলো অনেক কমে গিয়েছিল, ফ্ল্যাসও ঠিকমতো কাজ করছিল না, মহিলার নির্বিকার মুখটা ধরতে গিয়ে যা চাচ্ছিলেন পাচ্ছিলেন না। তবু বেশ কয়েকটা ছবি তোলার সময় মনে হচ্ছিল কোনো আলাদা এঙ্গেল নেই, সব এক। পরে তার মনে হয়েছে তিনি নিজেই জানতেন না মুখটাকে কিভাবে লেন্সে বসাবেন।

থানাপাড়ায় ভিডিওগ্রাফি না করার আফসোস ঘোচানো গিয়েছিল পরে। একের পর এক নতুন নতুন জায়গায় ঘুরতে গিয়ে জাফর সাদেকের মনে হতো না জায়গাগুলো নতুন। আগে আসেননি বটে, তবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় তফাত কিছু নাই, আছে যা মানুষের মুখের বুলিতে। জায়গাগুলোয় তারেক ছাড়া একা একাই গিয়েছেন, মনে হয়েছে এও এক অভিজ্ঞতা। প্রথম দফায় খুলনায়, পরে যশোরে, জয়পুরহাটে। খুলনার ডুমুরিয়ার চুকনগরের কথা জানা ছিল। যা জানতেন না, ওখানেই সবচেয়ে বেশি মানুষ মেরেছে, যাদের মধ্যে হিন্দু ছিল বেশি। জয়পুরহাটের পাগলাদেওয়ানেও মূল আক্রমণটা হয়েছে হিন্দুদের ওপর। জাফর সাদেক কথা বলেছেন অনেকের সাথে, ভিডিও করেছেন। পাগলাদেওয়ানে বৃন্দাবন হালদার নামে এক বৃদ্ধ ভিডিও করতে বা ছবি তুলতে মানা করে বলেছিলেন, দুই গাড়িভরতি মেয়ে নিয়ে গিয়েছিল গ্রাম থেকে। প্রায় সবাইকেই পরে মেরে ফেলেছিল। কিছু মেয়ে আছে যশোর, পাবনার পুনর্বাসনকেন্দ্রে। তার মেয়েকে মারেনি, তার স্ত্রী জানেন মেয়ে নেই, তবে তিনি জানেন মেয়ে কোথায়। এইটুকু বলে ভদ্রলোক কিছু সময় চুপ করে থেকে বলেছিলেন মেয়ে যে বেঁচে আছে কাউকে বলতে পারেন না, স্ত্রীকেও না। এমন কথার পিঠে জাফর সাদেক ভেবে পাচ্ছিলেন না কী বলা যায়। সেদিন রাতে যশোরে ফিরে একটা কথা ভেবে কিছুতেই খেই পাচ্ছিলেন না। একমাত্র মেয়ে, বাবা জানেন মেয়ে বেঁচে আছে, মা জানেন নেই, মেয়ের কথা মনে হলে তারা কি কেউ কোনো কথা বলেন না? কষ্ট কার বেশি—বাবার, না মায়ের?

যশোরে যাবেন শুনে অ্যানমেরি একজনের নাম-ঠিকানা দিয়েছিলেন। ব্রাদার রিকার্ডো, ইটালিয়ান ভদ্রলোক, এক সময় মিশনারিজ অব চ্যারিটির হয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামে কাজ করেছেন, কিছু দিন হলো যশোরে একটা দাতব্য সংস্থার সঙ্গে আছেন। অ্যানমেরি বলেছিলেন তিনি তার ব্যাপারে রিকার্ডোকে জানাবেন। ঠিকানা ধরে তার আস্তানা খুঁজে বের করতে মোটেও পরিশ্রম করতে হলো না। বছর চল্লিশের ব্রাদার রিকার্ডো একে বেজায় লম্বা আবার ভীষণ রোগাটে। ম্যালনিউট্রিশনের ওপর কাজ করেন, তবে তাকে দেখে না ভাবার কারণ নেই তিনি নিজেই চরম পুষ্টিহীনতার শিকার। জাফর সাদেকের মনে পড়ল কোথায় যেন কার সম্বন্ধে পড়েছিলেন—লাইক আ রিকেটি ট্রি—টল এন্ড উডেন।

তো এই কাঠ-কাঠ, শুষ্ক কাঠামোতে রসকষ যে একেবারে নেই তা না। জাফর সাদেকের ঘামেভেজা জামাকাপড়, ক্লান্ত চেহারা দেখে বিলেতে অনেক দিন থেকে দেশের গরমে-ধুলায় নাজেহাল হয়ে পড়েছেন বলে ঠাট্টা করে টিনের জগে পানি ও গ্লাস এগিয়ে খাস বাংলায় বললেন, ‘এ দেশে কেউ শুধু পানি খেতে দেয় না, মনে কিছু করবেন না।’ বলে হাসতে গিয়ে সরু মুখটাকে ভেঙে চুরচুর করে ইংরেজিতে যোগ করলেন, ‘আমার বাংলা লোকে বলে ভালো, আমি হাসি।’ রিকার্ডো জানালেন তিনি অনেক বছর ধরে ঢাকায় ও কলকাতায় আসা-যাওয়া করছেন, সত্তরের সাইক্লোনের পর ভোলায় ছিলেন বেশ কিছু দিন।

ছোট বসার ঘরে ফ্যান আছে, তবে ঘুরছে না, সম্ভবত কারেন্ট নেই। ব্রাদার রিকার্ডো একটা তালপাতার পাখা এনে বাতাস করতে করতে বললেন, ‘অ্যানমেরি আমাকে আপনার কথা লিখেছে, আপনার প্রজেক্টের কথাও। কালই ওর চিঠি পেলাম, আর আজ আপনার সঙ্গে মোলাকাত।’

জাফর সাদেক জবাবে বললেন প্রজেক্ট বলতে তেমন কিছু না, কয়েকটা জায়গা ঘুরেছেন, মানুষজনের সঙ্গে কথা বলেছেন, এই।

ব্রাদার রিকার্ডো মাথা ঝাঁকালেন, বললেন, ‘বললাম না অ্যানমেরি আমাকে আপনার ব্যাপারে লিখেছে, সো আই নো হোয়াট ইউ আর আপ টু। আসলে আপনাদের সরকার আর্নেস্ট হলে ওয়ার ক্রিমিনালদের ইন্ডিয়ার হাতে তুলে দিত না। আটকাতে না পারলেও অন্তত ক্রিমিনালদের লিস্ট ধরিয়ে দিলে পরে পারস্যু করতে পারত। অবশ্য অল্প সময়ে কাজটা করা কঠিন হতো।’

‘একটা লিস্ট তো করা হয়েছে, মানে পত্রিকায় দেখেছি। দুইশ জনের লিস্ট।’

‘তিরানব্বই হাজারের মধ্যে ওনলি টু হানড্রেড পারপেট্রেটারস! দুইশ বা দুই, যাই হোক, দেরি হয়ে গেছে, টু লেট। যাই হোক, আপনি আপনার কাজ করে যান, রেকর্ড তো থাকবে।’

আলাপ-আলোচনা যে অল্প সময়ে এত দূর এগোবে জাফর সাদেক ভাবতে পারেননি। আর অ্যানমেরি যে তার বিষয়ে এত কিছু ব্রাদার রিকার্ডোকে জানাবেন তা-ই বা কী করে আন্দাজ করবেন!

ব্রাদার রিকার্ডো বললেন, ‘আমি মিশনারি হলেও সাদা চামড়া, আমার যাওয়া উচিত হবে না। আমি একজনকে দিচ্ছি, আপনাকে দেখিয়ে আনবে।’

‘কোথায়?’

‘আপনি যা দেখতে চান। পাকিস্তান আর্মির রেপ ক্যাম্প।

শোনামাত্র চমকে উঠলেন। এতটা তার কল্পনায়ও ছিল না। ব্রাদার রিকার্ডো নিশ্চয়ই আগে বলে রেখেছিলেন, মার্টিন বলে ডাক দিতে খালি গায়ে বছর তিরিশের একজন ছুটে এলে বললেন, ‘শার্ট পরে নাও, আর এনাকে নিয়ে যাও। ইনি রাইটার।’

বিদায় নেওয়ার সময় ব্রাদার রিকার্ডো হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘আমি এখানে থেকেও আজও যাইনি, দেশের অন্য কোথাও কিছু দেখতে যাইনি। টু মাচ ফর মি টু স্ট্যান্ড।’ কাঁধের ব্যাগ থেকে জাফর সাদেক ক্যামেরা বের করছেন দেখে হাত নেড়ে বাধা দিলেন। স্থির চোখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে জাফর সাদেক ভাবলেন ছবি যখন তোলা হলো না, মুখটা যেন মাথা থেকে হারিয়ে না যায়।

প্রথমে যেখানে মার্টিনের সঙ্গে গেলেন সেটা একটা পরিত্যক্ত স্কুল। মাত্র একটাই টানা লম্বা ঘর, সামনে বারান্দা, ওপরে ঢেউটিনের ছাউনি। প্রাইমারি স্কুল হওয়াই স্বাভাবিক। ভেতরে বড় বড় তিনটা ঘর, একটার ভেতর দিয়ে অন্যটায় যাওয়ার পথ। চেয়ার-টেবিল-বেঞ্চ নেই, মেঝেতে আঁকাবাঁকা ফাটল। বলার কিছু নেই ভেবে মার্টিন চুপ করেছিল, কেবল এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাওয়ার সময় হাত ইশারায় দেখিয়ে দিচ্ছিল। দরজা-জানালাহীন খাঁ খাঁ ঘরগুলোয় দুপুরের তাতানো রোদ যেন ছায়া খুঁজতেই যেখানে-সেখানে এলিয়ে পড়েছিল। মার্টিনের এক সময় হয়তো মনে হলো কিছু বলা দরকার। বলল, এই স্কুলটা ছিল ট্রানজিট ক্যাম্পের মতো, নানা জায়গা থেকে মেয়েদের এনে এখানে রাখা হতো, কিছু দিন পর পর অন্য কোথাও পাঠানো হতো, অনেককে মেরেও ফেলা হতো। যুদ্ধের শেষদিকে ডিসেম্বরের বারো-তেরো তারিখে যশোরের পতনের পরে এখান থেকে পঞ্চাশজনের মতো মেয়েকে উদ্ধার করা হয়েছিল, শেষমাথার ঘরটা দেখিয়ে বলল, ওখানে চার-পাঁচটা লাশ পাওয়া গিয়েছিল, মারেনি ওদের, ওরা আত্মহত্যা করেছিল।

পরের জায়গাটা ফাঁকা ধু-ধু। রেলস্টেশন থেকে খানিকটা দূরে মূল লাইন থেকে বেশ তফাতে কয়েকটা রেলওয়ে ওয়াগন। মার্টিন হাত তুলে ওয়াগনগুলো দেখিয়ে জানাল, আরও ছিল, সরিয়ে ফেলা হয়েছে, এগুলোর পাহারায় থাকত রাজাকাররা, আর আর্মি ক্যাম্প ছিল কিছুটা দূরে রেলের একটা পাকা বাড়িতে। কাছে যাবেন কি না জানতে চাইলে জাফর সাদেক মাথা নেড়ে জানালেন, না।

ফেরার পথে মার্টিন বলল ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে মেয়েদের এনে রাখার জন্য অনেক বাংকার বানানো হয়েছিল। মুক্তিফৌজ ও ইন্ডিয়ান আর্মি শহরে ঢোকার পর কিছু মেয়েকে জীবিত বের করতে পেরেছিল, বাকিদের বিভিন্ন সময় মেরে ফেলেছিল। মেরে কোথায় কোথায় পুঁতে রেখেছিল, সেসব এখন বের হচ্ছে।

জাফর সাদেক টের পাচ্ছিলেন ব্রাদার রিকার্ডোর মুখে রেপ ক্যাম্পে যাওয়ার কথা শুনে মাথায় যে উত্তেজনা দাপাদাপি জুড়ে দিয়েছিল তা থিতিয়ে মরে গেছে। কী দেখতে এসেছেন এখানে?

গোলকধাঁধা

এক তাড়া হাতে লেখা কাগজ, সঙ্গে মোটাসোটা খামভরতি ছবি, সেলোফেনমোড়া ভিডিও টেপ দেখে অ্যানমেরি, ফাহমিদা দুজনেই অবাক। কুড়ি-পঁচিশ দিন ধরে গ্রাম-গ্রামান্তুরে ঘুরে ঝড়ো কাকের দশা জাফর সাদেকের। জানালেন যা দেখেছেন, শুনেছেন টুকে রেখেছেন, রেকর্ড করেছেন, কয়েকজনের সাক্ষাৎকারের ভিডিওগ্রাফিও রয়েছে। এখন এগুলোকে গুছিয়ে লেখা বাকি, শাপলা যেভাবে চায়। তাকে কে সাহায্য করবেন—অ্যানমেরি না ফাহমিদা?

শাপলার এ অফিসে জাফর সাদেকের জন্য টেবিল রয়েছে, টেবিলে তার ব্যক্তিগত টাইপরাইটার, কিছু বই, কাগজপত্র। একটা অ্যাশট্রে নিজেই কিনবেন ভেবেছিলেন, কেনা হয়নি। বাড়িতে মেঝেতে ছাই ফেললে বলার কেউ নেই, কিন্তু এটা অফিস। টেবিলে বসতে ফাহমিদা একটা র‍্যাপিং পেপার মোড়া প্যাকেট খুলতে খুলতে বললেন, ‘আপনাকে দেখেছি সিগারেট খেতে বাইরে যান, এখন থেকে এখানে বসেই খাবেন, মাঝে মাঝে আমাকেও দিতে পারেন, এই নিন’ বলে প্যাকেট থেকে একটা সাদামাটা কাচের অ্যাশট্রে বের করে টেবিলে রাখলেন।

‘তার পর কেমন হলো সফর?’

‘ঘুরে দেখা দরকার ছিল। তবে যে জিনিসটা আমাকে হন্ট করত তা আর দেখার ইচ্ছা নেই।’

‘রেপ ভিকটিমদের?’

‘তাদের কোথায় পাব? আর খোঁজাখুঁজিতেও যাইনি, অ্যানমেরির নিষেধ ছিল।’

‘নিষেধ ছিল?’

‘হ্যাঁ। বলেছিলেন এত সেনসিটিভ বিষয় নিয়ে যেন এখনই ঘাঁটাঘাঁটি না করি।’

‘তা হলে কী দেখার ইচ্ছা নেই?’

‘রেপ ক্যাম্প। যশোরে দুই জায়গায় গিয়েছিলাম, আর যাব না।’

ফাহমিদার দেওয়া অ্যাশট্রের দিতে তাকিয়ে জাফর সাদেক বললেন, ‘এটার ওপেনিং হয়ে যাক, ওপেন তো আপনিই করে ফেলেছেন, লন্‌চিং হোক।’

সিগারেট আগে বড় একটা খেতেন না, দেশে এসে খাওয়া বেড়ে গেছে। দশটার এক প্যাকেট ক্যাপস্টেনের দাম তিন টাকা। প্যাকেট খুলে ফাহমিদার দিকে বাড়িয়ে দিতে ফাহমিদা হা হা হেসে বললেন, ‘আরে না, আমি কদাচিৎ টানি। আপনিই লন্‌চ করেন।’

সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়াটা মুখ থেকে ছাড়তে ছাড়তে জাফর সাদেক বললেন, ‘আপনি কিন্তু আমার চিন্তা-ভাবনায় পানি ঢেলে দিয়েছেন।’

ফাহমিদা বিব্রত মুখে তাকালে, জাফর সাদেক আস্তে আস্তে বললেন, ‘আপনি সেদিন বলেছিলেন না, ইন্ডিয়া কী করে প্রিজনার্স অব ওয়ার বা পিওডব্লিউ-দের সোল কাস্টোডিয়ান হয়ে গেল? হয়তো সারেন্ডার ডকুমেন্টে তেমন শর্ত-টর্ত ছিল—যে কারণে ওদের ওপর বাংলাদেশ সরকারের কোনো কন্ট্রোল নেই।’

‘একই কারণে ওয়ার ক্রিমিনালদের ওপরও নেই।’

না, এখানে আমি একমত না। পাকিস্তান আর্মি সারেন্ডার করেছে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী, তারা এর সুফল পেয়েছে। দুই দেশই জেনেভা কনভেনশনের সিগনেটারি। ইন্ডিয়া সিগনেটারি হিসাবে নিজের দায়িত্ব পালন করেছে। কিন্তু ওয়ার ক্রাইমের ব্যাপার আলাদা, এর জন্য ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট রয়েছে। লন্ডনে থাকতে এখানকার কাগজে দেখেছি একটা লিস্ট করার কাজও নাকি হয়েছে। এটা তা হলে কীসের ভিত্তিতে করা হলো, একটা বেসিস নিশ্চয় আছে।’

‘এটা আমরাও দেখেছি। লিস্ট না, লিস্ট করা হচ্ছে সে খবর। ব্যস, আর তো খবর নাই।’

‘একটা বেসিস বা যৌক্তিকতা তো থাকতে হবে এমন লিস্ট করার, সেটা কী?’

‘মনে করতে পারেন স্রেফ ঝাল মেটানো।’

‘ঝাল মেটানো!’

‘এ ছাড়া কী! কাজের কাজ তো কিছু হয়নি। দেশে এতগুলো ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ছিল, রাইটস গ্রুপের লোকজন ছিল, এখনো আছে, তাদের সঙ্গে বসে একটা পথ বের করতে চাইলে হয়তো করা যেত। অন্তত একটা জোরালো ইস্যু দাঁড় করানো কঠিন হতো না।

‘যত দূর মনে পড়ে শেখ সাহেব দেশে ফেরার তিন-চার দিনের মাথায় প্রেস কনফারেন্স ডেকে একটা ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ওয়ার ক্রাইমের বিচারের ব্যবস্থা করার কথা বলেছিলেন।’

‘সেই ট্রাইব্যুনালে কাদের বিচারের কথা বলেছিলেন?’

‘আর কাদের—ক্রিমিনালদের, পারপেট্রেটারদের।’

‘হ্যাঁ, সেই ক্রিমিনালদের যারা জেনোসাইড ঘটিয়েছে। রেপিস্টদের কথা আলাদা করে বলা হয়নি।’

‘যে লিস্ট করার কথা সেখানে ক্রিমিনালদের কী ধরনের ক্রাইমের কথা বলা হয়েছে?’

‘সেটা তো বলতে পারব না, হতে পারে সব ধরনের ক্রাইমের কথা আছে- মাসকিলিং, আরসন, রেপ।’

‘তার মানে ধাপ্পা। রেপ আর আরসন এক না, মাসকিলিং যত ভয়াবহই হোক, রেপ তারও ওপরে—এজ ক্রাইম।’

‘ধাপ্পা আমি বলব না।’

‘কী বলবেন?’

‘ব্যাপারটাকে আপনি সিমপ্লিস্টিকেলি দেখছেন। কাজটা বলা যত সহজ, করা মোটেও তেমন না।’

জাফর সাদেক চুপ করে থাকলেন। হঠাৎ খুব হতাশ লাগল নিজেকে, সিগারেট অ্যাশট্রেতে গুঁজে অসহায় ভঙ্গিতে হাত দুটো টেবিলে ছেড়ে দিতে ফাহমিদা বলে উঠলেন, ‘একটা কথা বলি, আপনি হার্ট হবেন না। এ কয়েক মাস আমি ও অ্যানমেরি অনেক কাগজ, বইপত্র নাড়াচাড়া করেছি। একটা বিষয় আমাকে খুব অবাক করেছে—যুদ্ধে, এমনকি অনেক দেশের ভিতরেও বিদ্রোহ বা অরাজকতা থামাতে মিলিটারির রোলে মেয়েদের নির্যাতনের ব্যাপারটা ফোরফ্রন্টে আসে না। ভিয়েতনামের কথা চিন্তা করেন। এর কারণ কি জানেন? যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির পাশে মেয়েদের নির্যাতনের ব্যাপরটা সাইড শো হিসাবেই থাকে। অন্য কারণ হলো রেপ ইজ আ উইপন অব ওয়ার। যুদ্ধে কোন পক্ষ কী অস্ত্র ব্যবহার করবে এ নিয়ে কোনো প্রটোকল নেই। রাইফেল, না মেশিনগান, না নাপাম বোমা—কেউ প্রশ্ন তুলবে না। এখন রেপও যদি যুদ্ধের অস্ত্র হয়, তা হলে কে কী বলবে! আর রেপ তো গ্রাজ, মানুষ খুন করা যেমন।’

‘ফাহমিদা, আমাকে আপনি কী বোঝাতে চাচ্ছেন?’

‘আমি কিছুই বোঝাতে চাচ্ছি না। আমি একটা পরসেপশনের কথা বলছি।’

‘আমাকে সেটা মানতে হবে?’

‘দুনিয়া তো আপনার-আমার মানা না মানায় চলে না।’

‘তা হলে ওই কথাই ঠিক—ইউ রেপ দ্য উইমেন। কথাটা কে বলেছিল জানেন তো, একজন ওয়ার প্রিজনার, তাও কুমিল্লায় জেলে বসে।’

‘আপনি আমার ওপর রেগে যাচ্ছেন।’

‘আপনার ওপর রাগ করার প্রশ্নই ওঠে না। আপনি শুধু পানি ঢালছেন।’

জাফর সাদেক হাসলেন, বললেন, ‘আমার ধারণা ছিল দেশে এ নিয়ে অনেক কিছু হচ্ছে, কিন্তু গোড়ায় এত গলদ কী করে বুঝব! পুরোই গোলকধাঁধা।’

ফাহমিদা বললেন, ‘আপনি অনেক বেশি এক্সপেকটেশন নিয়ে এসেছিলেন, যে জন্য এখানকার রিয়েলিটি ধরতে কষ্ট হচ্ছে।’

‘আনরিয়েল চিন্তা-ভাবনা নিয়ে আপনাদের বিরক্ত করছি।’

‘কী বলেন! আপনার চিন্তা-ভাবনা মোটেও আনরিয়েল না। আমি চাই আপনি

আপনার মতো কাজ করে যান। আমার জানা-শোনা কারো সঙ্গে কথা বলতে চাইলে আপনাকে নিয়ে যাব। আলাপ-আলোচনায় অনেক জিনিস বেরিয়ে আসে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্লু।’

‘আচ্ছা এ নিয়ে পরে কথা হবে। শাপলা-য় এ সময় আপনারা কী করছেন?’

‘অ্যানমেরি আপনাকে বলেছেন নিশ্চয়, আমরা মেয়েদের নিয়ে কিছু কাজ করার চেষ্টা করছি। দেশে অনেক পুনর্বাসনকেন্দ্র মানে রিহেবিলিটেশন সেন্টার হয়েছে। প্রথমে শুধু ঢাকায় ছিল, এখন সারাদেশে প্রায় প্রতি জেলায়ই হয়েছে। এসব সেন্টারে রেপ ভিকটিমরা রয়েছে। অনেকের বাচ্চা হয়েছে, বাচ্চাসহ মেয়েরা আছে। সরকারের সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্ট এই সেন্টারগুলো মেনটেন করে, বেশ কিছু ভলান্টিয়ারও এসব সেন্টারে কাজ করে। অনেক মেয়ে এসব সেন্টার থেকে বাড়িঘরে ফিরে গেছে, কারো কারো বিয়েও হয়েছে, বিশেষ করে যাদের বাচ্চা নেই। যারা ফিরে গেছে, তারা কিন্তু শান্তিতে নেই। অনেকে সুইসাইড করেছে। আমরা এই মেয়েদের ট্র্যাক করে ওদের সাহায্য করার চেষ্টা করি। কাজটা বেশ কঠিন, মূল কাজ ট্র্যাক করা, সেটাই কঠিন, কেউ তো স্বেচ্ছায় আমাদের কাছে আসে না। পুনর্বাসনকেন্দ্রগুলো আমাদের সাহায্য করে। ওদের কাছে তো খবর থাকে কে কোথা থেকে এসেছে, কোথায় ফিরে গিয়েছে।’

‘পুনর্বাসনকেন্দ্র কবে শুরু হয়েছে?

‘একেবারে প্রথম থেকে, বলতে পারেন দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই যখন মেয়েদের নানা জায়গা থেকে বের করা হলো তখন থেকেই। গোড়াতে শুধু ঢাকায় ছিল।’

‘এখনো আছে?’

‘হ্যাঁ, অবশ্যই। মাত্র তো কয়েক মাস হলো।’

‘ঢাকায় কোথায়?’

‘যাবেন?’

‘যদি নিয়ে যান, একা তো আমাকে ঢুকতে দেবে না।’

‘নিয়ে যাব বা যোগাযোগ করিয়ে দেব।’

‘থ্যাংক ইউ।’

‘আবার পানি ঢাললাম?’

‘হ্যাঁ, ঢেলেছেন, তবে এ পানি অন্য।’

ফাহমিদা বললেন, ‘আমরা একটা জার্নাল বের করি, দুই মাস অন্তর। বাইলিংগুয়াল—ইংরেজি ও বাংলায়। এতে নানা ধরনের খবর, ফিচার, ছবি, সাক্ষাৎকার ছাপি। মূল বিষয় অবশ্যই মেয়েদের নিয়ে।’

ফাহমিদা উঠে নিজের টেবিলের পাশের র‍্যাক থেকে একটা কয়েক পাতার পাতলা পত্রিকা এনে দিতে জাফর সাদেক প্রায় বলেই ফেলছিলেন এর নাম জার্নাল! কমনওয়েল্থ সেক্রেটারিয়েটে থাকতে তিনি ও মালাকা মিলে যে নিউজ লেটার বের করতেন সেটারও পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল এর অন্তত দ্বিগুণ। পনেরো-ষোলো পৃষ্ঠার পত্রিকা বা ফাহমিদার ভাষায় জার্নাল নেড়েচেড়ে তার যে মোটেও মন ভরেনি সেটা লুকানোর চেষ্টা না করে বললেন, ‘এটাকে বড় করা যায় না?’

‘অবশ্যই যায়, আমরা চাই বড় করতে। মাত্র দুটো ইস্যু করেছি, এটা সেকেন্ড। আপনি লিখবেন, অনুবাদ করবেন। লিখবেন না?’

‘যা লিখতে চাই?’

‘হ্যাঁ, কোনো অসুবিধা নেই। আগামী ইস্যুর জন্য আমরা কাজ শুরু করে দিতে পারি। আপনি হবেন নতুন এডিটর।’

‘পাগল! এডিটর আপনি আছেন, আপনিই চালিয়ে যান। আমাকে কী করতে হবে বলবেন।’

‘এত লেখার মেটেরিয়েল আপনার! আর এই যে ঘুরে এলেন এ দিয়েই ভালো দুটো ইস্যু করা যাবে, অবশ্য আমার কাছে আরও আছে।’

‘এক কাজ করা যায়, এ কদিনে যা পেয়েছি, মানে টুকে এনেছি, তার থেকে মেটেরিয়েল সিলেক্ট করা যায়। ছবি, সাক্ষাৎকারসহ।’

‘সে কথাই বলছি।’

‘আজই বসি।’

‘আমার একটু কাজ আছে বাইরে। লাঞ্চের পরে বসি?’

‘পারফেক্ট।’

এক জীবনের এপিঠ ওপিঠ

‘তোর জীবন আর তোর মা-র জীবন এক না’–কতবার যে এ কথাটা চম্পা আম্মার মুখে শুনেছে! তিনি বলেছেন, সে শুনে গেছে, আপত্তি করেনি। যদিও জানত সুযোগ পাওয়ামাত্র শেফালি বেগমের জীবনটা তার পিঠে দুই পা ছড়িয়ে সওয়ার হয়েছে, সে নিজে থেকে কিছু করতে যায়নি। নিজেকে মায়ের জীবনের সাথে সে গুলিয়ে ফেলেনি, মাকে নকল করতেও যায়নি। চিটাগাংয়ে থাকতে সেই যেবার জাহাজ মালিকের বাড়িতে মা ধরা পড়ল, তখন তার বয়স কত—আট-নয়; সে দৃশ্যটা মনে পড়লে আজও গায়ে কাঁটা দেয়। নার্স শায়লা যখন মায়ের আঁটসাঁট ঘোমটা গায়ের জোরে টেনে-খামছে খুলে চিৎকার করে লোক জড়ো করেছিল, মা তখন উপুড় হয়ে পড়ে নাঙ্গা মুখটা দুই হাতে চেপে কী কান্নাই না কেঁদেছিল, আর তাকে মাফ করে দিতে বলেছিল। কাছে দাঁড়িয়ে মায়ের এ অবস্থা দেখে চম্পার এমনও মনে হয়েছিল বাড়ির লোকজন লাঠিসোঁটা নিয়ে মাকে পেটাবে। মনে আছে, ভয়ে সেও কেঁদেছিল। সবচেয়ে বেশি মনে গেঁথে আছে মায়ের মাফ চাওয়া। কেন মা ওভাবে মেঝেতে মাথা ঠুকে মাফ চেয়েছিল, সে বৃত্তান্ত তখনো জানা ছিল না বলে ভেবেছিল না জানি মা কী করেছে!

ঠিক একইভাবে না হলেও বহু দিন পর সেও যখন প্রথমবার ধরা পড়েছিল, সে অবশ্য মায়ের মতো মাফ চায়নি, কাঁদেওনি, শুধু জবাকে কোলে নিয়ে আজগরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল। সে তো মাকে নকল করতে যায়নি, যদিও আদতে দুটো ঘটনাই ছিল এক—ধরা পড়ার।

বিয়ের পর আজগরের গ্রামে চলে আসতে চম্পা ভাবত মা যে কারণে তাকে ছেড়ে হারিয়েই গেল, তার ফল সে পেতে শুরু করেছে। মা বলত সে সরে গেলে তার দুর্গতি চম্পাকে পাবে না। কষ্টে বুক ভারী হয়ে থাকলেও চম্পা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল মা-র কথাই ঠিক, মায়ের দুর্গতি তাকে পাবে না। আর বছরখানেকের মধ্যে ঘর-গেরস্তিতে এতই মেতে উঠেছিল, তার মনে হতো মায়ের দুর্গতি যে তাকে পায়নি, মা যদি একবার দেখে যেত! আজগর কোনো দিনই তার বাপ-মা, বাড়িঘর নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেনি। চম্পা যা বলেছে নিজে থেকে—মাকে নিয়ে তার কাঁচা গল্প বা বাপ ও বাড়িঘর সম্বন্ধে মা যেমন শিখিয়েছিল। শ্বশুরবাড়িতেও একই গল্প, কেউ খোঁচাখুঁচিতে যায়নি। আসলে বছর না ঘুরতেই সে সংসারের চেহারা যেভাবে বদলে দিতে শুরু করেছিল তাতে তার করিৎকর্মা স্বভাবই মানুষের চোখে পড়ত। এভাবে বছর তিনেক গেল। তার পর জবা হলো। চম্পা ভাবল আর কাঁচা গল্প ফাঁদতে হবে না। জবার পরিচয় জবা নিজে, তার বাপ আছে, দাদা-দাদি, বাড়িঘর কী নেই! জবার মা হিসাবে তারও পরিচয়ের গোঁজামিল মিটে গেছে।

কিন্তু শেফালি বেগম যতই অচিন মুল্লুকে হারিয়ে যাক, সেই যে সে বলত, ‘এট্টুন দ্যাশ, কই যাই’—চম্পার জন্যও তা সত্যি হলো। সেই কবে, চম্পার তখন বারো বছর হয় কি না, চিটাগাং ছেড়ে শেফালি বেগম ঢাকায় এক বাসায় শেষবারের মতো ধরা পড়ে ঠিক করল আর না—এবার চম্পাকে ছেড়ে যাবে, সে বাসার ড্রাইভার জসিম যে আজগরের দূরসম্পর্কের মামা চম্পা কী করে জানবে! তো আত্মীয় বাড়িতে জসিম বেড়াতে আসতেই পারে। বেশ কয়েক বছর হয়ে গেলেও জসিম যে তাকে দেখে ভুরু কুঁচকে ‘তুমি শেফালি বেগমের মাইয়া না’ বলে খুঁটিয়ে দেখবে বলে চোখ সরু করে তার মুখে তাকিয়েছে, চম্পা প্রথমে ভেবেছে চিনল কী করে এত বছর পর! পরপরই মাঝদুপুরে উঠানে আসমান ভেঙে পড়তে দেখার সে অভিজ্ঞতা মনে পড়লে এত দিন পরও চম্পা নাকে পোড়া গন্ধ পায়।

কে শেফালি বেগম, আর সে তার মেয়ে—বিষয়টা বাড়ির লোকজনের কাছে ধাঁধার মতো লাগলেও অল্প সময়েই যখন জটের পর জট খুলতে শুরু করেছিল, তখন আসমানভাঙা ধোঁয়া আর ছাই-তে গোটা বাড়ি নিথর। তার মায়ের সাথে প্রতিবার যা করা হতো, তেমন কিছু ঘটেনি। আজগর তাকে কিছু বলেনি, তবে সামনেও আসেনি। চম্পা বুঝতে সময় নেয়নি তার কী করা উচিত। সে সময় মায়ের মুখে শোনা কাউয়া আইসা পড়ছে শোরগোল তুলে, যেন ভেংচি কেটে কানে ঝাঁ ঝাঁ বাজছিল। আর কয়েক বছর না যেতে তার মুখেও কথাটা বসে গিয়েছিল। মা বলত তাকে, সে বলেছে জবাকে।

আম্মা ভেঙে পড়েছিলেন ঘটনা শুনে। বলেছিলেন সে যেন তার ওখানেই থাকে। মাস দুয়েক চোখ বুজে পড়েছিল। তার পর ভাবল এভাবে হবে না, নিজে যা পারে করবে। আর এও মনে হয়েছিল আম্মার কাছে থাকা বিপদের। পুনর্বাসনকেন্দ্রে এক সময় যারা ছিল, তাদের বয়স হয়ে গেলেও কেউ কেউ দূর-দূরান্ত থেকে হঠাৎ এসে হাজির হতো, দরজাবন্ধ ঘরে আম্মার সাথে ফিসফিসিয়ে কথা বলত, কেউ কেউ বলত ‘কানতে আসছি’। আম্মা তাদের কোনো দিন চম্পার পরিচয় না দিলেও চম্পার সন্দেহ হতো তারা হয়তো আন্দাজ করতে পারত সে কে। শেফালি বেগমের মেয়ে হিসেবে না চিনলেও কেন্দ্রে তাদের সঙ্গী কেউ তার মা এমন ধারণা করা অস্বাভাবিক ছিল না। এই মহিলাদের দেখে একটা কথা ভেবে অবাক হতো, এরা দুঃখ-কষ্টেও টিকে আছে, মায়ের মতো নিরুদ্দেশে যায়নি

নিজে কিছু করবে বলে জেদ ধরতে আম্মাই কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। রায়েরবাজারে মহিলাদের একটা সমিতি ছিল, যেখানে সস্তায় বাচ্চাদের জামা-কাপড় তৈরির ছোটখাটো কারখানা ছিল। বেশিরভাগ কাজ সুই-সুতা দিয়ে হাতে করা হতো, সেলাই মেশিন বলতে মাত্র কয়েকটা হাত-মেশিন। ভালো-মন্দের হিসাবে না গিয়ে চম্পা ভিড়ে গিয়েছিল, নিজের তার যেভাবে হোক চলে যাবে, শুধু বছর দুয়েকের জবাকে দুই বেলা খাওয়াতে পারলেই হলো।

কয়েক দিন যেতে কাছেই চেরাগি বস্তিতে গিয়ে উঠেছিল। কারখানা বলতে সব মিলিয়ে আট-দশজন, জবাকে নিয়েই কাজে যেত। জবা জ্বালাতন করত না, হাতে একটা কিছু দিয়ে এক জায়গায় বসিয়ে রাখলে চুপচাপ বসে থাকত নয়তো ঘুমিয়ে পড়ত। চেরাগি বস্তি জায়গাটা সুবিধার ছিল না, হেরোইনচিদের আখড়া ছিল, তখনো দেশে ইয়াবা আসেনি, নেশার জিনিস বলতে হেরোইন, নয় গাঁজা বা ফেনসিডিল। সকাল-সকাল জবাকে নিয়ে বেরিয়ে সন্ধ্যার পরে ঘরে দরজা আটকেও আশপাশের হৈ-হুলুস্থুল থেকে নিস্তার মিলত না। খুনাখুনির ঘটনাও ঘটেছে দুই-একবার। ধারেকাছে অল্প ভাড়ায় থাকার মতো জায়গা না পেয়ে দাঁত কামড়ে পড়েছিল তিন বছরের মতো। তবে গেল যখন, নিজের ইচ্ছায় না।

বিলকিস নামে একটা মেয়ে এলো কাজ করতে, থাকত তারই মতো চেরাগিতে। সময় পেলে তার ঘরেও আসত। চলনে-বলনে চম্পা বুঝত বিলকিস বেপরোয়া, মুখে লাগাম বলতে কিছু নাই। চম্পাকে প্রায়ই খোঁচাত, ‘তুমার দেমাগ ক্যান গো অত? কুনখানের নবাবজাদি কও তো, থাকো তো এই ছাতার বস্তিতে, কাম করো সমিতির ফকিন্নি কারখানায়?’ সে যে চম্পার চালচলন পছন্দ করত না, পরিষ্কার বোঝা যেত, আবার কখনো এমনও বলত, ‘আমি যে কই থাইক্যা আইছি তুমার জানতে মন চায় না?’ চম্পা হ্যাঁ-না কিছু বলত না, যদিও বুঝত বিলকিস কিছু বলতে চায়। একদিন এসে জানাল সাভারে এক গার্মেন্টে কাজ পেয়ে চলে যাচ্ছে, আর বস্তিও ছেড়ে দিচ্ছে। সমিতির কারখানায় কাজ করতে গিয়ে চম্পা দেখত মেয়েরা কিছু দিন পরই গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে চলে যাচ্ছে। দূরে দূরে— মিরপুর, সাভার, আশুলিয়ায়। বিলকিস অত দূরে সাভারে চলে যাচ্ছে শুনে চম্পা বলেছিল, ‘তুমার অনেক সাওস।’ বিলকিস চট করে বলেছিল, ‘ঠেকায় পড়লে তুমিও যাইবা। আর আমার সাওস অইব না ক্যান, আমি তো মেন্দা বাঙালির পয়দা না।’ বলেই মুখে হাত চাপা দিয়েছিল। চম্পা থতমত খেয়ে তার দিকে তাকাতে বিলকিস বলেছিল, ‘তাইলে কান খুইল্যা হুনো, আমি যে কুন বেজন্মা পাঞ্জাবি মিলিটারির পয়দা, আমি ক্যান, আমার মা-ও জানত না। আমারে তিন বছরের থুইয়া মা মরল, তার বাদে কয়েক বছর মাইনষ্যের বাড়ি পালা খাইছি, ছুটুকাল থাইক্যা জানি আমি জাউরা, কথায় কথায় মাইনষ্যেও জাউরা কইত। আমি পাত্তা দেই নাই, আছিলাম পাবনা, জন্ম হইছিল পাবনার পুনর্বাসনকেন্দ্রে, গণ্ডগোলের সময় যেসব মাইয়া পোয়াতি হইছিল তাগো থাকার জায়গা হইছিল ওইখানে। বারো বছর বয়সে ঢাকায় আইছি, কেউর লগে না, একলা। মাইনষ্যের বাড়ি-বাড়ি কাম করছি। অহন আমার কিয়ের ডর, কামাই করি, কাউর খাই না, পিন্দি না। বিয়া অইছিল এক কুইড়ার লগে, বউর রুজি খাইব এই ধান্দায় আছিল, ছাইড়া দিছি। তুমার ঘটনা কী? মুখে যে সিলি দিয়া থাকো।

চম্পা বলবে কী! ভয় করছিল বিলকিসের দিকে তাকাতে, যেন বিলকিসকে না, নিজেকেই দেখবে। বিলকিস কিছু সময় পর বলেছিল, ‘মনো কইরো না এই সব কথা দুইন্যার মাইষ্যেরে বইলা বেড়াই। তুমারে ক্যান কইলাম কও তো?’

চম্পা ভয়ে ভয়ে তাকাতে বিলকিস বলেছিল, ‘তুমি যতই লুকাও, তুমার ঘটনা আমি জানি।’

না বুঝেই হঠাৎ চম্পা ফুঁসে উঠেছিল, ‘কী জানো?’

বিলকিস গলার স্বর বদলে ফেলেছিল, ‘চেতো ক্যান? তুমি যা জানো, আমিও সেইটা জানি। সমিতির রেহানা আফা আমারে কামে লাগানোর সময় কানে কানে কইয়া গেছিল আমি আর তুমি এক জাতের, মিলামিশ্যা যেন থাকি। আমার ঘটনা তো জানত, সেই জইন্যই কইছিল। উনির দুষ নাই, তুমার ভালার জইন্য আমারে কইছিল। আমি কি কইছি কাউরে? অহন চইলা যামু হেই সাভার, আর দেখা অয় কি না কে কইতে পারে, সেই জইন্য মনো করলাম নিজের ঘটনা আগে কই, দেখি তুমি মুখ খুলো কি না। তুমি তো উল্টা চেইতা উঠলা। খামোখা চেতবা না, তুমি-আমি একই পয়দা — জাউরা।’

‘আমার ঘর থাইক্যা বাইরঅও।’

‘কী!’

‘কানে যায় নাই?’

‘জাউরা মাগির চেত দ্যাখো। মিছা কইছি কিছু!’

‘বাইরঅও।’

বিলকিস বেরিয়ে যেতে চম্পা কিছু সময় থম ধরে বসে ভেবে পাচ্ছিল না সমিতির রেহানা আপা বলে যার কথা বলল তিনি তার ব্যাপারে কী করে জানলেন। তবে কি আম্মা যখন সমিতির কারখানায় তাকে ঢুকিয়েছিলেন তখন তার কথা সেই মহিলাকে বলেছিলেন যাতে কাজটা হয়? বিশ্বাস হয়নি আম্মা এটা করতে পারেন। ইচ্ছা করছিল এক ছুটে আম্মার কাছে গিয়ে জানতে চায়। মনে মনে ঠিক করে ফেলেছিল বস্তি ছাড়তে হবে, সঙ্গে কাজও। বিলকিস তো চলেই যাচ্ছে, হয়তো আজই যাবে, যাওয়ার আগে তার সম্বন্ধে ঢোল পিটিয়ে যাবে। চম্পার চালচলন তো সে পছন্দ করত না, তবু হয়তো কাউকে কিছু বলত না, কিন্তু ঘর থেকে বের করে দেওয়ার পর মনের ঝাল মেটাতে ঢোল পেটাবে।

প্রমাণ পেয়েছিল পরদিনই। দরজার মুখে চেনা-অচেনা মুখ। মুখে ইতরামি হাসি। কাছ থেকে দূর থেকে নানা কথাবার্তা কানে আসছিল—কইছিলাম না ঘটনা আছে, অহন মিল পাইলা? বাপের নাই ঠিক, আর ভাবসাব কী ডাটের! আরে হের মায়ের পেট বান্দাইছিল পাঞ্জাবি মিলিটারি, দেশি অইলে কথা আছিল না।

আম্মার কাছে চম্পা যায়নি। কিছু জামাকাপড় পোঁটলা বেঁধে কোথায় যায় ভাবতে ভাবতে আগারগাঁও বিএনপি বস্তির কথা মনে হয়েছিল। বছরখানেক আগে চেরাগিতে একটা খুন হওয়ার পর কেউ কেউ অন্য জায়গায় চলে গিয়েছিল, তখন ওখানে একদিন গিয়েছিল ঘর দেখতে, কিন্তু আসা-যাওয়ার অসুবিধার কথা চিন্তা করে খালি ঘর পেয়েও ফিরে এসেছিল।

চোরের মতো সেই রাতেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল। হাতে বেতনের টাকাটা ছিল, আগের দিনে এসে একটা ভাগের ঘর পেয়ে ভাড়া নিয়ে দরদস্তুর না করেই ঠিক করে গিয়েছিল। যাওয়ার আগে সেই প্রথম জবাকে বলেছিল, কাউয়া আইসা পড়ছে, আমরা আরেকখানে যামু। জবার তখন পাঁচ বছর।

তার পর মিরপুর দশ নম্বরে এক গার্মেন্টে এলেবেলে, ছুটকা কাজ দিয়ে শুরু। আম্মার বাসায় এর পর অনেক দিন যায়নি। গেল শেষ পর্যন্ত, গিয়ে যা শুনল তাতে কে যে তার কথা বিলকিসকে বলেছিল এর সুরাহা করতে পারল না। আম্মা ধমকে উঠলেন, ‘তোর মাথা খারাপ, সংসারটা ভাঙল তোরে চিনতে পারার কারণে, আর আমি তোর কথা বলতে যাব আরেকজনকে! কেমন আক্কেল তোর, এমন কথা ভাবলি কেমনে!’

চম্পা জানত আম্মা কেন্দ্রের অনেককে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, এমনকি সরকারি অফিসের চাকরিও। তার মাকেও দিয়েছিলেন। তখন যাদের কাছে চাকরির তদবির করতেন, তাদের নিশ্চয়ই বলতেন কাদের জন্য চাকরি। সেসব কত আগের কথা! চম্পার জন্য যখন সমিতির মহিলাদের কাছে চাকরি চেয়েছিলেন, তখন হতে পারে বেখেয়ালে বলে ফেলেছিলেন আর তাতেই তাকে তারা কাজ দিয়েছিল। হতে পারে, বিলকিস যার কথা বলেছিল সেই রেহানা আপাকে বলেননি, বা তাকে চেনেনই না, বলেছেন অন্য কাউকে।

.

মা মাঝে মাঝে জানতে চায় এ ক-বছর চম্পা কী করেছে, কী করেই-বা জবাকে পালতে পারল। চম্পা বলেছে সে পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে নারাজ। কথাটা আগেও তাকে বলেছে। মুখ খোলাতে না পেরে মান্তু একই কথা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলেছে। কোনো দিন হতাশ গলায় বলেছে, ‘আমারে ঘিন্না করো আর যা-ই করো, আমি তুমার কষ্ট বুজি। একলা একলা পারলা ক্যামনে এইটাই ভাবি। আমার মতো তো তুমি না, সেই জইন্যই চিন্তা করি পারলা ক্যামনে—অত পথ ক্যামনে পার হইলা।’ কয়েক দিন আগে চম্পাকে চমকে দিয়ে বলল, ‘চলো তুমার মায়রে দেইখ্যা আসি। জায়গার নাম তো জানো, দুইজনে মিল্যা বিচরাইয়া বাইর করুম।’ চম্পা অবাক হয়েছে, এই পাগলি বুঝল কী করে মায়ের কথা মনে করে আজকাল তার ঠিকমতো ঘুম হয় না।

‘লও যাই।’

‘সত্যই যাইবি?’

তুমি কইলেই যামু। তয় ভালা অয় যুদি শাজাদারে লগে লই। তুমি একবার কইলেই রাজি অইব।’

‘কী কইলি! আমার মায় ইন্দুরের গাতা খুজতে অত দূরে যাইয়া জান বাচাইছে, তুই ওইখানেও তারে শান্তিতে থাকবার দিতে চাস না! শাজাদা তোর কী লাগে?’

‘তাইলে আমি আর তুমিই লও যাই।’

‘আগে ক শাজাদা কী লাগে?’

‘কী আর লাগব, আমারে ভালা পায়।

‘তর খবর ও জানে?’

‘কুনটা।’

‘আবার জিগায় কুনটা! ‘

‘ওইসব তুমারে কইছি, তারে কইতে যামু অত বেক্কল না।’

‘ও যে তর থাইক্যা ছোট এইডা ও জানে?’

‘এইটা কুনু বিষয় না।’

‘কুনটা বিষয়?’

‘বিষয় একটাই, আমি একলা জিন্দেগি পার করতে পারুম না। তুমি পারতেছো, তুমার কথা আলাদা। আর আসল কতা মাইয়া মাইনষ্যের একটা খুটি দরকার।’

‘ওই গুণ্ডা তর খুটি!’

‘কী কও, হের মতো একখান দেখাও। গুণ্ডা-বদমাইশ বাদে কে আমার খুটি অইব!’

‘তুই ওরে আমার ঘরো আর কুনুদিন আনবি না।’

‘ঠিক আছে। হের কতা থোও, অহন কও যাইবা কিনা, আমি আর তুমি, আর কেও না।’

‘না।’

তুমার মায়েরে কত দিন দেখো না, দেখতে মন চায় না?’

‘না।’

অসহিষ্ণু জাফর সাদেক

জাফর সাদেকের সঙ্গে প্রথম দেখা আমার বাসায়। আসার আগে ফোনে ওর ব্যাপারে বলেছিল ফাহমিদা নামে একজন। ফাহমিদাকে চিনতাম, আমার কাছাকাছি বয়সের, এক সময় সিদ্ধেশ্বরী কলেজে পড়াত, পরে শাপলা নামে নরওয়েজিয়ান না সুইডিশ এক এনজিওতে কাজ করত। জাফর সাদেকের পরিচয় দিয়ে বলেছিল ফ্রি-ল্যান্সার, সেও নাকি শাপলার সঙ্গে আছে, আমি যেন ওকে কিছুটা সময় দিই। পরে জাফর সাদেক নিজেও ফোন করেছিল, বলেছিল আমাদের কাজকর্ম নিয়ে সে জানতে আগ্রহী। আসতে চেয়েছিল ইস্কাটনে, কেন্দ্রে। আমি বলেছিলাম বাসায়। বাসার ঠিকানা দিয়েছিলাম।

রীতিমতো সুপুরুষ জাফর সাদেকের চোখ দুটো ধারালো। প্রথম দেখায় অল্প সময়েই মনে হয়েছিল যেখানে চোখ ফেলে চিরে চিরে দেখে। আমার দিকে যখন তাকাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল কী যেন খুঁজছে। আমার অস্বস্তি হচ্ছিল। টের পেয়েই হয়তো ঘরের এদেয়ালে ওদেয়ালে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বলেছিল আমার খোঁজ পেতে দেরি হয়েছে, না হলে আরও আগেই আসত। পত্র-পত্রিকায় ছাপা নিজের লেখার একটা ফাইল আমার হাতে দিতে নেড়েচেড়ে বলেছিলাম কিছু কিছু পড়েছি। নিজের সম্বন্ধে বেশি কিছু বলেনি, শুধু বলেছিল দেশে ছিল না বলে ভেতরের অনেক খবরই জানে না। আমার কাছে এসেছে আমাদের কাজ-কর্ম সম্পর্কে জানতে। সংক্ষেপে ছাড়া-ছাড়াভাবে পুনর্বাসনকেন্দ্র নিয়ে কিছু বলেছিলাম, কিন্তু তার চোখে অসহিষ্ণুতা লক্ষ করে বুঝতে পারছিলাম না কী শুনতে চায়।

কথাবার্তা তেমন এগোচ্ছিল না, আমার বলার ধরনও সম্ভবত গোছানো ছিল না। সে তখন বলেছিল গোড়া থেকে যেন বলি। আমি তখন জিজ্ঞেস করেছিলাম সে কি আমার ইন্টারভিউ নিতে চায়? মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিল, না। সে জানতে চায় কিভাবে পুনর্বাসনকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল, কিভাবে কাজ শুরু হয়েছিল, বর্তমানে কী অবস্থা—এক কথায় সব। আমি হেসে বলেছিলাম তবে কি বই লিখবে? আবারও সেই মাথা ঝাঁকানো — না।

সেদিন ওকে বেশি সময় দিতে পারিনি, ভাবিনি লম্বা কাহিনি শুনতে এসেছে। আমার বাইরে যাওয়ার তাড়া ছিল। তবে এর পরে ঘন ঘন কয়েকবার এসেছে। দীর্ঘ সময় এত মনোযোগ দিয়ে শুনেছে আমার মনে হয়েছিল আরও প্রস্তুতি নিয়ে ওর সামনে বসা উচিত ছিল। প্রথম দিন বলেছিল বাইরে থাকায় দেশের অনেক খবরই জানে না, কথা বলতে গিয়ে দেখলাম ওটা এমনি বলেছে, নিজে চোখে দেখেনি বটে, তবে প্রচুর তথ্য জোগাড় করেছে, কাজও অনেক করেছে, অনেক লেখালেখি। আর মাথায় যে জিনিস নিয়ে ঘুরছে তা যুদ্ধাপরাধী সৈন্যদের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে দাঁড় করানো। লেখালেখি মূলত এ বিষয়েই। সেজন্য প্রায় সব লেখাই লিখেছে ইংরেজিতে, সেসব নানা আন্তর্জাতিক সংস্থায় পাঠিয়েছে, কয়েকটা বিদেশি জার্নালেও রিপ্রিন্ট হয়েছে। এ নিয়ে নিজের অনেক আক্ষেপের কথাও বলেছিল—সরকারের তরফ থেকে কিছুই করা হয়নি বলে। বলতে বলতে একদিন হঠাৎ বেয়াড়া সব প্রশ্ন করতে শুরু করেছিল। আমরা পুনর্বাসনকেন্দ্ৰ করলাম, ভালো কথা, কিন্তু ট্রাইব্যুনালের কথা কেন বললাম না—এটা বলা তো আমাদের দায়িত্ব ছিল। দেশে জনমত গড়ে তুললে সরকার তো বটেই, বিদেশেও অনেকে এ নিয়ে আগ্রহী হতো। কেন করলাম না?

প্রশ্ন তো না, অভিযোগ, সেই সঙ্গে তীক্ষ্ণ চোখের খোঁচা। কী বলব চিন্তা করছিলাম। আমরা যারা গোড়া থেকে পুনর্বাসনকেন্দ্র নিয়ে ছিলাম, তারাই জানতাম কী পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে আমাদের দিন-রাত গেছে। কত মেয়ে ছিল যাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না, তাদের জন্য তেমন কোনো পরিকল্পনা তখনো আমাদের ছিল না, আর এই লোকটা কোথা থেকে এসে দোষ ধরছে! রাগ হচ্ছিল কথার ধরনে। সে কী করছিল বিদেশে বসে! বিদেশে এমন অনেকেই ছিল যারা সব ছেড়েছুড়ে সরাসরি যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। ভালো চাকরি, ক্যারিয়ার, পড়াশোনা ফেলে চলে এসেছিল। ও যেখানে ছিল, সেই ইংল্যান্ড থেকেও অনেকে এসেছিল। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কথা কি ও জানে? এফআরসিএস ফাইনাল পরীক্ষায় না বসে ফিল্ড হসপিটাল করতে ছুটে এসেছিল।

অভিযোগ আরও ছিল। আমরা পুনর্বাসনকেন্দ্রে মেয়েদের দেখাশোনা করতে গিয়ে মেয়েদের নির্যাতনের ব্যাপারটা লুকিয়ে রেখেছি। পৃথিবীর বর্বরতম ওয়ার ক্রাইমকে মানুষের নজরে আনতে দিইনি। ভুক্তভোগী পরিবারগুলো ছাড়া দেশের অনেকেই জানে না এত এত মেয়ে নির্যাতিত হয়েছে। বলে সে হিসাব দিতে লেগে গিয়েছিল সারাদেশে কোথায় কতটা ক্যাম্প ছিল, কোনটায় কত মেয়ে ছিল। মায়ের কাছে মাসির বাড়ির গল্প আর কি!

দেখতে পাচ্ছিলাম লোকটা গোঁয়ার। প্রশ্নগুলো যে করছে, ওর ধারণা নেই কাকে করছে, কাকে শোনাচ্ছে ক্যাম্পের হিসাব। সেদিন ওর কথায় মনে হয়েছিল, আমার কাজকর্ম সম্বন্ধে জানার চেয়ে ওর উদ্দেশ্য দোষ খুঁজে বেড়ানো। রেগেমেগে তখন ওকে কিছু বলে ফেলা আমার পক্ষে মোটেও অস্বাভাবিক হতো না। রাগ চেপে ওর কথার সূত্র ধরে বলেছিলাম কেন্দ্র যেদিন থেকে শুরু হলো—সেই অস্থায়ী অবস্থা থেকে, আমাদের কাজ বলতে ছিল একটাই—মেয়েদের দেখাশোনা করা, অন্যদিকে নজর দেওয়ার সময়-সুযোগ ছিল না। নির্যাতন যে হয়েছে, কত ভয়ানক হয়েছে, কত ক্যাম্প ছিল দেশে এসব আমাকে শোনানোর দরকার নাই। যুদ্ধাপরাধের ইস্যু নিয়ে জনমত তৈরি করা তখন আমাদের প্রায়োরিটিতে ছিল না। মেয়েদের উদ্ধার করা, চিকিৎসা করা, সারাক্ষণ তাদের সঙ্গ দেওয়াই ছিল বড় কাজ

কথাটা, বিশেষ করে প্রায়োরিটিতে ছিল না, শুনে সে যেন আকাশ থেকে পড়েছিল। বলেছিল, এ কথা কিছুতেই মানতে পারছে না। আমরা এক অর্থে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, তারপরও এটাকে প্রায়োরিটি বলতে অস্বীকার করছি।

আমি মাথা ঠান্ডা রেখে তর্ক করেছিলাম। বলেছিলাম, আমাদের প্রায়োরিটিতে ছিল না, কিন্তু দেশ বলতে তো আমরাই না, দেশে সরকার ছিল, শিক্ষিত লোকজন ছিল, দুর্বল হলেও মিডিয়া ছিল। ইস্যুটা যে কেউই তোলেনি তা তো ঠিক না। খবরের কাগজে উঠেছিল, আর কেউ কেউ এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায়ও লিখেছে। কী বুঝেছিল কে জানে, তার এক কথা—এ নিয়ে একটা অর্গানাইজড মুভমেন্ট কেন করা গেল না? প্রশ্নটা আমাকে করতে, মনে আছে গলা চড়িয়ে বলেছিলাম সে কথা আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছে? আর সময় তো শেষ হয়ে যায়নি, সে যখন এই নিয়েই আছে, আরও লোকজন মিলে একটা আন্দোলন শুরু করলে পারে।

আমার বলার ধরন ভদ্রোচিত ছিল না। জাফর সাদেক হয়তো তখনি বুঝতে পেরেছিল আমিও গোঁয়ার কম না, নিজের জায়গা ছেড়ে নড়ব না।

তার গুরুতর অভিযোগ ছিল—আমরা মেয়েদের ওপর নির্যাতনের বিষয়টা লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে রেখেছি। এর জবাবে আমার খেপে যাওয়াই মানাত। কী করে যে নিজেকে সামলেছিলাম বলতে পারব না। কেন আড়ালে রাখতে হয়েছিল বা তখনো আড়ালে রেখে চলছিলাম, এ প্রশ্ন কোনো সুস্থ মানুষের মুখ থেকে বেরোনোর কথা নয়। কত চুপেচাপে, সাবধানে আমাদের কাজ করতে হয়েছিল! যাক, এত বছর পরে সেসব মনে করে কী হবে! জাফর সাদেককে বলেছিলাম, ও কি মনে করে দেশটা ইংল্যান্ড না আমেরিকা? সে কি চেয়েছিল আমরা দেশি- বিদেশি সাংবাদিক ডেকে ঢাকঢোল পিটিয়ে মেয়েদের নির্যাতনের কাহিনি শোনাই, না কি তাতেও হতো না, খোদ মেয়েদেরই সাংবাদিকদের সামনে ঠেলে দিলে কাজের কাজ হতো! বলেছিলাম, তারপরও সাংবাদিকেরা অনেক কিছু খুঁজে বের করেছে, তবে আমরা নিজেরা ফলাও করে কিছু করতে যাইনি।

কথাগুলো কিভাবে বলেছিলাম মনে নাই। সে কিন্তু তার জায়গা থেকে সরেনি। একই কথা নানাভাবে বলে যাচ্ছিল। আমার তখন মনে হয়েছিল ওর মনমানসিকতা অন্য ধাঁচে গড়া। প্রতিশোধের পথ খুঁজছে ঠিকই, মনে-প্রাণে কিছু করতেও চায়, কিন্তু দেশের মানুষ, এমনকি আপনজনও একজন গণধর্ষিতাকে কী চোখে দেখতে পারে এ নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। কত মেয়ে আত্মহত্যা করেছে সে খবর রাখে!

জাফর সাদেকের সঙ্গে সম্পর্ক চুকেবুকে যেত সেদিনই। সে আরও বড় অভিযোগ করেছিল—অপরাধ করা আর অপরাধ আড়াল করায় বড় একটা পার্থক্য নেই। এর পরে তো তাকে বেরিয়ে যেতে বলা খুব অসঙ্গত হতো না। তা করিনি। তাকে কে বোঝাবে আমরা অপরাধকে না, মেয়েদের আড়ালে রাখতে চেয়েছি—যা আমাদের কর্তব্যের মধ্যে ছিল!

দিন কয়েক পরে তার একটা বড় লেখা বেরিয়েছিল পত্রিকায়, সেখানে আবার অন্য কথা। প্রায় হুবহু আমার কথাগুলোই লিখেছিল, এমনকি যে কথাগুলো তাকে বলিনি, তাও। বিশেষ করে আগামীতে পুনর্বাসনকেন্দ্রের মেয়েদের নিয়ে সরকারের যে একটা পাকাপোক্ত পরিকল্পনা দরকার সে বিষয়ে। এ ছাড়া আমি যে রাগের মাথায় তাকে খোঁচা দিয়ে বলেছিলাম যুদ্ধাপরাধ নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার সময় শেষ হয়ে যায়নি এ নিয়েও বিস্তারিত লিখেছিল। সরকারের কাছে কয়েকটা প্রস্তাবও ছিল ওতে। ঠাণ্ডা মাথার লেখা, অবাকই হয়েছিলাম।

লেখাটা এত ভালো ছিল, আমার রাগ পড়ে গিয়েছিল। তাকে ধন্যবাদ দিতে ফোন করেছিলাম। ফোন পেয়ে খুশি হয়েছিল কি না বলতে পারব না, আমাকে পাল্টা ধন্যবাদ দিয়ে একটা অনুরোধ করেছিল—সে কেন্দ্রে এসে মেয়েদের সাথে কথা বলতে চায়। জানত আমি কী বলব। তাই বলেছিল, খালি হাতে যাবে, কারো ছবিটবি তুলবে না, শুধু কথা বলবে, আমার সামনেই বলবে। তারপরও আমার কথা আমাকে বলতে হয়েছিল। খারাপ লেগেছিল বলতে।

জাফর সাদেকের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে এই একটা ব্যাপারে সাবধান ছিলাম। জানতাম, কেন্দ্রের মেয়েদের সাথে কথা বলতে চাইবে। সে তো ফটোগ্রাফারও, লন্ডনে ফটোগ্রাফি নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়েছিল। আবার গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে অনেক ভিডিওগ্রাফি করেছে, সাক্ষাৎকারও নিয়েছে। এ আপদকে কী করে কেন্দ্রে ঢোকাই! আর সত্যি যা, কেন্দ্রে আমরা সাংবাদিক এমনকি যারা মুক্তিযুদ্ধ গবেষণায় আগ্রহী তাদেরও বুঝিয়ে-সুজিয়ে ঢুকতে দিতাম না।

জাফর সাদেক একবার ফোন করেই হাল ছেড়ে দেয়নি। বুঝতে পারছিলাম সে সহজে পিছু হটবে না। এক পর্যায়ে পরিষ্কার বলেওছিল সে অন্তত এক-দুজন মেয়ের সাক্ষাৎকার নিতে চায়, ছবি তুলবে, ডকুমেন্টারি বানাবে। আমার এক কথা, না।

জাফর সাদেককে তখন যতই না বলি, আমি জানতাম সে যা করতে চায়, আজ হোক কাল হোক করে ছাড়বে। করেওছিল।

চল্লিশ বছর আগের কথা। লোকটা গেল কোথায়? শুনেছি দেশে নেই, কয়েক বছর পর বিদেশে চলে গিয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *