স্মাইল
প্রায় আধ মিনিটব্যাপী দীর্ঘ হাততালির শব্দ মিলিয়ে আসতেই সঞ্চালক ছেলেটি আবার নড়েচড়ে বসল৷ কানে গোঁজা ইয়ারফোনে কনট্রোলরুম থেকে কিছু একটা নির্দেশ আসছে৷ হ্যাঁ, এতক্ষণে বেশ মুড সেট হয়েছে দর্শকদের৷ একপ্রস্থ হাসাহাসিও হয়েছে, মোক্ষম ট্যুইস্ট দিয়ে লাইভ অনুষ্ঠানের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া মানেই একলাফে টিআরপি বৃদ্ধি৷ ক্যামেরার পেছনে কনট্রোলরুমের দিকে চেয়ে একবার ঘাড় নাড়ায় ছেলেটি৷ তারপর গলা বেশ কিছুটা নামিয়ে এনে পারমিতার দিকে চেয়ে বলে, ‘ম্যাম, এবার একটা পারসোনাল প্রশ্ন করতে পারি আপনাকে? অবশ্য আপনি চাইলে উত্তর না-ও দিতে পারেন৷’
‘আমার আবার পারসোনাল কী আছে ভাই? যা করি, সবই তোমাদের চোখের সামনে…’
একটা কৃত্রিম হাসি দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায় ছেলেটির মুখ থেকে৷
‘নির্ভয়ে করো৷’
‘আমরা শুনেছি, আপনি নাকি একসময় সুইসাইড করতে গিয়েছিলেন?’
পিন ড্রপ সাইলেন্স নেমে আসে সমস্ত ফ্লোরে৷ দর্শকাসনে বসে-থাকা শ-খানেক মানুষের নিঃশ্বাসের শব্দে ভারী হয়ে ওঠে ভিতরের বাতাস৷
একবার চারপাশটা চেয়ে দেখে নেয় পারমিতা৷ ছাদের দিক থেকে অন্তত এক ডজন ফ্ল্যাশলাইট একমনে চেয়ে আছে ওর দিকে৷ তারাও থমথমে মুখে উত্তরের অপেক্ষা করছে৷ মুখে চড়া মেকআপের প্রলেপও গালে খেলে-যাওয়া লালচে রেখাগুলোকে ঢাকতে পারছে না৷
‘কী শুনতে চাইছ, ভাই?’ জোর করেই ঠোঁটের কোণে একটা হাসি টেনে আনে পারমিতা, ‘আমি হেজিটেট করব? বা হাসিঠাট্টা করে এড়িয়ে যাব?’ দু-দিকে ঘাড় নেড়ে বলে, ‘জীবন আমাকে একটাই শিক্ষা দিয়েছে৷ এড়িয়ে যাওয়ার কোনও উপায় নেই, দুর্ভাগ্যকে মেনে নাও, তাকে কাঁধে চাপিয়েই সামনে এগিয়ে যাও৷ একসময় পিছন ফিরে দেখবে তোমার সেই দুর্ভাগ্যই তোমার অস্ত্র হয়ে গিয়েছে৷ হ্যাঁ… ফ্যানের ব্লেডে দড়ি বেঁধেছিলাম আমি৷ ও আমার সামনেই বসে ছিল৷ চেয়েছিল আমার দিকে… যদি ও বসে না থাকত তাহলে হয়তো সেদিনই শেষ করে ফেলতাম নিজেকে… কিন্তু চেয়ারটা লাথি মেরে ফেলার আগে ওর চোখের দিকে শেষবার তাকাতেই ভিতরে কী একটা হয়ে গেল, জানো?’
সজল চোখে পারমিতার দিকে চেয়ে আছে ছেলেটি৷ আজকালকার এই অ্যাঙ্কার ছেলেগুলো দিব্যি অভিনয় করতে পারে৷ হলের মাঝের ফাঁকা জায়গাটায় যেন একরাশ কালো মেঘ জমাট বেঁধেছে৷ এক্ষুনি একটা বাজ পড়বে সেটা ভেদ করে৷ মিহি করুণ সুর খেলিয়ে দিয়েছে সাউন্ড ডিজাইনাররা৷
‘ভাবলাম, ও তো এখনও চেয়ে থাকতে পারে আমার দিকে, সাড়া দিতে পারে না, কিন্তু দেখতে পায়, বুঝতে পারে৷ আর আমি যা করতে চলেছি, তাতে সেটুকুও তো ওকে দিয়ে যেতে পারব না… পারলাম না, ভাই৷ ওই একটা ভাবনাই আমার গলা থেকে ফাঁস খুলে নিল৷ নীচে নেমে ওকে জড়িয়ে ধরলাম আমি৷’
‘তারপর?’ ছেলেটির গলা প্রশ্নটা করার সময় কেঁপে গেল কি? ভিতরের কনট্রোলরুম থেকে আবার কোনও ইন্সট্রাকশন এসেছে বুঝি৷
‘তারপর আর কী…’ একটা করুণ হাসি ভেসে উঠল পারমিতার মুখে, ‘ওর সামনে বসে থাকতাম দিনরাত৷ কত কথা বলতাম… গল্প করতাম৷ খালি মনে হত, ও শুনছে, সব শুনছে মন দিয়ে… দু-জনে টিভি দেখতাম একসঙ্গে৷ একদিন আমি সোফায় ওর পাশে বসে ঘুমিয়ে পড়েছি… হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে ওর মুখের দিকে চেয়ে দেখি ও ঠায় তাকিয়ে আছে টিভি-র দিকে৷ ঠোঁটের কোণে একটা মিষ্টি হাসি লেগে, মানে অদৃশ্য হাসি যেমন হয়, অনেকটা সেইরকম… ও হাসছে… আমার যে কী আনন্দ হল, কী বলব… কিছুক্ষণ খেয়াল করতে একটা ব্যাপার বুঝতে পারলাম৷ মুখে বলা কথা ততটা বুঝতে না পারলেও এই সুর জিনিসটা চিনতে পারে ওর ব্রেইন৷ আমি… আমি…’
এবার সত্যি একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল পারমিতার চোখের কোল বেয়ে৷ এ অশ্রু আনন্দের৷ এই বিশেষ মূহূর্তের অনুভূতি ঠিক কেমন তা হয়তো কোনওদিন প্রকাশ করতে পারবে না পারমিতা কারও কাছে৷
‘আপনি জল খাবেন?’ টেবিলের উপরে রাখা জলের গ্লাসটা তুলে ধরে ছেলেটি৷
পারমিতার ঠোঁট দুটো অস্থির হয়ে কাঁপছে৷ খানিকটা জল গলায় ঢেলে রুমালে চোখের জলটা মুছে নেয়৷ চড়া মেকআপ অক্ষতই থাকে তাতে৷
‘স্কুলে পড়তে আমি ভায়োলিন বাজাতে পারতাম খানিকটা৷ সেই সঙ্গে একটু-আধটু পিয়ানো৷ তবে বড়োলোকের মেয়ে বা বউ কোনওটাই ছিলাম না তো, তাই পিয়ানোটা বাড়িতে ছিল না কোনওদিন৷ রাতে শোয়ার আগে ঠিক করলাম ওকে ভায়োলিন বাজিয়ে শোনাব৷ বিছানায় ওকে শুইয়ে ভায়োলিন নিয়ে বসতেই জানি না কেন ওই গানটা…’
‘এক পেয়ার কা নগমা…’
‘কী অদ্ভুত কথা দেখেছ ভাই? জিন্দগি অউর কুছ ভি নহি, তেরি মেরি কহানি… সত্যি, আমি সেদিন…’
‘আজ একবার যদি… না করতে পারবেন না কিন্তু…’
ছেলেটি উঠে দাঁড়িয়ে, হাসিমুখে দেয় প্রস্তাবটা৷ ফ্লোরের একদিক থেকে একটা লোক একটা ভায়োলিন এনে ধরিয়ে দেয় ছেলেটির হাতে৷
খোলা হাসি হেসে ভায়োলিনটা কাঁধের উপরে ধরে পারমিতা৷ তারপর ছড়টা অন্য হাতে ধরে চোখ বোজে৷ পিছনের জায়ান্ট স্ক্রিনে ভেসে ওঠে প্রবীরের মুখটা৷ তার কলেজ লাইফের ছবি৷ বিয়ের আগে পারমিতার সঙ্গে তোলা ছবি৷ দু’জনের একসঙ্গে সাদাকালো ছবি৷ ধীরে ধীরে সময় ফুটে উঠতে থাকে ছবিগুলোতে৷ তার ঠিক নিচে হলের একেবারে মাঝামাঝি সরু একটা চেয়ারের উপরে বসে ছড় টানতে থাকে পারমিতা —তু মেরা সহারা হ্যায়, ম্যায় তেরা সহারা হুঁ৷
ওর মাথার ভিতরে ওই জায়ান্ট স্ক্রিনের মতোই ফুটে উঠতে থাকে পুরোনো স্মৃতিগুলো৷ আজ থেকে ঠিক সাত বছর আগে কলেজের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে-থাকা একটা ছেলেকে প্রথমবার দ্যাখে ও৷ ক্যানটিনে আলাপ হয় তার সঙ্গে৷ অন্য চেয়ার না-থাকায় প্লেট হাতে পারমিতার পাশে ফাঁকা চেয়ারটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে প্রবীর, ‘এটায় বসব ম্যাম?’
খানিকটা বিরক্ত হয়েই তাকিয়েছিল পারমিতা, ‘ফাঁকা আছে যখন, বসতে অসুবিধাটা কোথায়? তা ছাড়া আমি এখানে স্টুডেন্ট৷ ম্যাম নই?’
‘না, আসলে আমি ঠিক আপনার সার্কলের নই তো, তাই ভাবলাম…’
‘আমার কোনও সার্কল নেই৷ ইচ্ছা হলে বসুন, না হলে পথ দেখুন৷’
‘আচ্ছা বেশ৷’
পারমিতাকে আর না ঘাঁটিয়ে বসে পড়ল প্রবীর৷ কয়েক সেকেন্ড পরে পারমিতার মনে হল, অচেনা ভালোমানুষ ছেলেটির সঙ্গে খানিকটা খারাপ ব্যবহারই করে ফেলেছে ও৷ কলেজের কাউকেই ওর তেমন একটা পছন্দ নয়, ফলে কলেজে এলেই মাথাটা গরম হয়ে থাকে৷ গলার ভিতরে একটা শব্দ করে নরম গলায় ও বলল, ‘তোমার কোন ডিপার্টমেন্ট?’
‘ইয়ে… জার্নালিজম অ্যান্ড মাস কম্যুনিকেশন৷ আপনার?’
‘সাইকোলজি৷’
‘আরিব্বাস!’ ছেলেটার মুখ উত্তেজিত দেখাল, ‘মানে মানুষের মন খারাপ থেকে শুরু করে প্রেম-ভালোবাসা সব পড়ে ফেলতে পারেন!’
‘সাইকোলজি বলেছি৷ উইচক্রা� তো বলিনি৷ আর তা ছাড়া তোমাদের এই সাইকোলজিস্ট দেখলেই ডিপ্রেশনের ডাক্তার কিংবা লাভ গুরু মনে হওয়াটা এক ধরনের আদিখ্যেতা, বুঝলে?’
‘আপনি বেশ তাড়াতাড়ি রেগে যান কিন্তু৷’
‘হ্যাঁ… যাই৷ তাতে কী হয়েছে?’
ছেলেটি চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলে, ‘না, মানে আপনার প্রফেশনে রোগ ও রুগি দুটোই ভালো হতে পারবেন৷’
‘ফক্কড় কোথাকার, এক্ষুনি তুলে দেব চেয়ার থেকে৷’
সেই থেকে শুরু৷ তারপর রোজই ক্লাসের পর কলেজের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে অন্যজনের অপেক্ষা করত দু-জনেই৷ নিজের মধ্যে ধীরে ধীরে কিছু বদল লক্ষ করছিল পারমিতা৷ সে ছোটো থেকেই রাফ-অ্যান্ড-টাফ টমবয় গোছের৷ প্রবীরের সঙ্গে মেলামেশার পর থেকেই ওর ভিতর থেকে একটা নরম সখী-সখী ভাব ক্ষীরকদম্বের মতো বেরিয়ে আসছিল৷ ব্যাপারটা কি ভীষণ ন্যাকা-ন্যাকা হয়ে যাচ্ছে? উঁহুঁ… ও তো কোনওকালেই তেমন ন্যাকা নয়৷ প্রেম আগেও করেছে৷ কিন্তু ওর মধ্যে এমন আহ্লাদে ভাব ছিল না কোনওদিন৷
কোনও কোনওদিন গঙ্গার উপর দিয়ে লঞ্চে করে পার হতে হতে টলটল জলের দিকে চেয়ে থেকেছে দু-জনে৷ জলের উপর দিয়ে ভেসে-যাওয়া লতাপাতার মতো মনে হয়েছে নিজেদের৷ ভাসন্ত জলের মাঝে একটা ছিন্নলতা জড়িয়ে ধরেছে অপরটিকে৷ ওদের হাত দুটোও রেলিং-এর উপরে সরতে সরতে এক হয়ে গিয়েছে৷
একটা খবরের কাগজের অফিসে চাকরি পায় প্রবীর৷ ফিল্ড রিপোর্টার৷ কোথাও দাঙ্গাহাঙ্গামা হল, কি ভোটের দিন মারপিট হল, আগে প্রবীরকেই একজন ক্যামেরাম্যান আর-একজন ড্রাইভার নিয়ে ছুটতে হয় অকুস্থলে৷ পারমিতা বহুবার বারণ করেছে ওকে৷ এই চাকরি ছেড়ে দিলে আর যে চাকরি পাবে না তা তো নয়৷ হোক এর থেকে কম পয়সার চাকরি৷ এমন প্রাণ হাতে করে তো পয়সা রোজগার করতে হবে না৷
‘তুমি বুঝছ না পারমিতা, পয়সাটা বড়ো কথা না, এটা আমার প্যাশন৷ ছোটো থেকে এই লাইফটাই চেয়েছি আমি৷’
‘কিন্তু বাড়িতে আমার অবস্থা কী হয়, ভাবো না একবারও…’ পারমিতার দুটো কাঁধ চেপে ধরেছে প্রবীর, আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়েছে ওর কপালে, ‘তোমাকে আগে বলিনি আমি? বলো?’
‘বলেছিলে… কিন্তু…’
‘কিচ্ছু হবে না আমার, দেখো৷ আরে, তোমার মতো বউ যার বাড়িতে আছে৷ আচ্ছা, এক কাজ করো… তুমি বলেছিলে না, ভায়োলিন বাজালে তোমার অ্যাংজাইটি কেটে যায়… আমার জন্য টেনশন হলে জানলাটার ধারে বসে বাজিয়ো, কেমন?’
পারমিতার কথা কোনওদিন শোনেনি প্রবীর৷ শেষ সেই কলেজের ক্যান্টিনে চেয়ারটায় বসার জন্য অনুমতি চেয়েছিল, তারপর থেকে চলেছে নিজের ইচ্ছামতো৷
কিন্তু পারমিতা জানত, স্ত্রী-র প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা আছে তার৷ নিজের কাজ আর পারমিতা ছাড়া অন্য কিছু চেনে না প্রবীর৷ এটুকু দোহাইয়ের জন্যেই কোনওদিন আর তেমন আপত্তি করেনি পারমিতা৷ আজ এই আফশোসটুকু সর্বক্ষণ কুরে কুরে খায় ওকে৷
যদি সত্যি কোনওভাবে আটকে দিতে পারত ওকে… যদি একদিন ও মাঝরাতে কল পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে তেমন করে রুখে দাঁড়াত…
মাঝরাতে দুঃস্বপ্নের মতো আচমকাই বেজে উঠেছিল প্রবীরের ফোনটা৷ ফোন সাইলেন্ট করার বিধান নেই ওর৷ বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে সেটা কানে ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে এসেছিল এডিটর-ইন-চিফের গলা, ভাই এক্ষুনি বেরিয়ে পড়৷ কুইক৷
বাকি কথা পারমিতাও শুনেছিল৷ ঢাকুরিয়ার কাছে একটা বহুতল অ্যাপার্টমেন্টের আটতলায় একটা ড্রাগ মাফিয়া গ্যাং ঘাঁটি গেড়েছে বলে সন্ধান পায় পুলিশ৷ মাঝরাতেই অপারেশন চালায় তারা৷
অপারেশন যতটা সহজ হবে বলে পুলিশ ভেবেছিল, পরিস্থিতি তার থেকে ঢের বেশি ঘোরতর হয়ে দাঁড়ায়৷ গ্যাং-এর সবার কাছেই আর্মস ছিল৷ পুলিশ ফ্ল্যাটে হামলা করতেই তারা রুখে দাঁড়ায়৷ দু-পক্ষেরই জনা তিনেক লোক মারা যায়৷ দু-জন পুলিশকে হোস্টেজ নেয় তারা৷ দাবি জানায় এক্ষুনি পুলিশ এলাকা ছেড়ে না গেলে দু-জন অফিসারকেই শুট করবে৷
খানিকক্ষণ নেগোশিয়েশন চলে৷ কিন্তু কোনও লাভ হয় না৷ খবর পেয়েই মিডিয়ার দৌড় শুরু হয় ফ্ল্যাটের আশপাশে৷ প্রবীরের দায়িত্ব পড়েছে ফিল্ড রিপোর্টার হিসেবে এই খবরটা কভার করার৷
খবর পাওয়ামাত্র ও আর দাঁড়ায় না৷ কোনওরকমে জামাকাপড় পরে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায় ঘর থেকে৷ বাইরে গাড়ি অপেক্ষা করছিল৷ তাতে উঠতেই হাই স্পিডে ঢাকুরিয়ার দিকে ছুটে যায় গাড়িটা৷
সারারাত আর ঘুম আসে না পারমিতার৷ টিভি-টা খুলে ঠায় তাকিয়ে থাকে সেটার দিকে৷ পুলিশের সাইরেন, লোকজনের চিৎকার, আর হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরায় বারবার বাড়ির আটতলায় জুম ইন-জুম আউট দেখতে দেখতে দুশ্চিন্তায় মাথাটা ভার হয়ে আসে ওর৷
প্রবীরের সঙ্গের ড্রাইভারটিকে বারবার ফোন করতে থাকে পারমিতা৷ ফোন বেজে বেজে কেটে যায়৷ পুলিশের অ্যানাউন্সমেন্টগুলো টিভি স্পিকার থেকে বেরিয়ে বারবার আছড়ে পড়তে থাকে ওর কানে৷ ক্যামেরায় বেশ কয়েকবার দেখা যায় প্রবীরকে৷ হাতে মাইক নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে ও৷ যেন তার উপরেই সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়েছে৷
পরের আধ ঘণ্টা পরিস্থিতি একই জায়গায় থেমে থাকে৷ পুলিশ ঠিক কী করতে চাইছে বোঝা যায় না৷ দেখে মনে হয় যেন ধীরে ধীরে হাল ছেড়ে দিচ্ছে তারা৷ পারমিতার অস্থির চোখ বারবার টিভি স্ক্রিনে প্রবীরকে খুঁজতে থাকে৷ ও উধাও হয়েছে৷
ঘণ্টাখানেক পরে আচমকাই বেজে ওঠে পারমিতার ফোনটা৷ ওপাশ থেকে একটা উত্তেজিত গলা শোনা যায়…
গানের সুর শেষ হয়ে আসতেই আবার হাততালির স্রোতে ফেটে পড়ে গোটা ফ্লোর৷ যন্ত্রটা পাশে রেখে হাত জোড় করে পারমিতা৷ ছেলেটি উঠে দাঁড়িয়ে ক্যামেরার সামনে এসে বলে, ‘আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, আমাদের সঙ্গে আজ আছেন ইউটিউব সেনসেশন পারমিতা মিত্র৷ আজ ওঁর সঙ্গে কথা বলে একটাই কথা জানতে পেরেছি আমরা৷ জীবন আমাদের যত কঠিন পরিস্থিতির সামনেই দাঁড় করাক-না কেন, আমাদের হেরে গেলে চলবে না৷ ভেঙে পড়লে চলবে না… ভালোবাসার ভিতর এমন এক শক্তি লুকিয়ে আছে, যা সমস্যার পাহাড়কেও সুরের মূর্ছনায়…’
এসব আর কানে ঢুকছে না পারমিতার৷ ওর মনের ভিতরে ফিরে ফিরে আসছে ডাক্তার শাসমলের কথাগুলো৷ সেদিন ডাক্তারের চেম্বারের ভিতরে উজ্জ্বল আলো জ্বলছিল৷ ঠান্ডা হয়েছিল ঘরটা৷ পারমিতার ঠিক পাশেই বসে ছিল প্রবীর৷ একটা হুইলচেয়ারে৷ আর চোখদুটো খোলা ছিল৷ আর কোনও স্পন্দন ছিল না শরীরে৷
‘আয়াম এফ্রেইড মিসেস মিত্র, আমাদের পক্ষে যতটা করা সম্ভব, আমরা করেছি৷ ওনার ব্রেনের ভিতরে যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তাতে রেস্ট অফ দ্যা লাইফ হয়তো এভাবেই প্যারালাইজড হয়ে কাটাতে হবে ওঁকে৷ আমরা আপনাকে কোনও ফলস হোপ দিতে চাই না৷ নাও ইউ হ্যাভ টু বি স্ট্রং ফর দ্য সেক অফ…’
প্যারালাইজড! একটা মৃতদেহের সঙ্গে কী পার্থক্য আছে এই মানুষটার? সেদিনের সেই উচ্ছল মানুষটা আজ নিজে থেকে উঠে দাঁড়াতেও পারে না৷ পারমিতার মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাতেও পারে না৷ জোর করে মাথাটা তুলে নিজের চোখের দিকে তাকাতে বাধ্য করেছে পারমিতা, কিন্তু তা-ও মনে হয়েছে, ও যেন অজ্ঞাত কোনও শূন্যে চেয়ে রয়েছে৷ ঝরঝর করে কান্নায় ভেঙে পড়েছে পারমিতা৷ বুকের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে কে বারবার ছিঁড়ে নিয়েছে সমস্ত শিরা-উপশিরা৷
নিরপেক্ষ থেকে নেগোশিয়েট করতে পুলিশের তরফ থেকে একজন সাংবাদিককে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়৷ গ্যাং মেম্বাররাও এতে সম্মতি জানায়৷ রেপুটেড সাংবাদিক তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না৷ তবে অন্য কোনও সাংবাদিক রাজি না হওয়াতে শেষে অপেক্ষাকৃত নবীন আর প্যাশনেট প্রবীরকে অনুরোধ করে পুলিশ৷ প্রবীর দ্যাখে ওর নিজের সাংবাদিক জীবনের এক মাহেন্দ্রক্ষণ এসে পড়েছে৷ আজ এই ঘটনায় সাহস করে ও এগিয়ে যেতে পারলে সাংবাদিক হিসেবে ওর নাম কাল সমস্ত খবরের কাগজে ফলাও করে বেরোবে৷ আর পিছনে ফিরে তাকাতে হবে না৷
সে ক্যামেরা রেখে পৌঁছে যায় আটতলায়৷ উপরে গিয়ে ঠিক কী হয়, পুলিশ বুঝতে পারে না৷ কিন্তু মিনিটখানেকের মধ্যে রিপোর্টারের দেহটা আটতলার ব্যালকনি দিয়ে সটান এসে পড়ে নীচে৷ রক্তে ভরে যায় জায়গাটা৷ জনতার চিৎকারের গতিপথ পালটে যায়৷ পুলিশের সাইরেন আরও দ্বিগুণ শব্দে বাজতে থাকে৷ পারমিতার কান বন্ধ হয়ে আসে৷
‘হি ওয়াজ আ ব্রেভ রিপোর্টার… হ্যাড আ ব্রাইট কেরিয়ার৷’
পারমিতার বাবা পেশায় ডাক্তার৷ তিনি নিজে এসে পরীক্ষা করে যান প্রবীরকে৷ ছোটো হাতুড়ি দিয়ে হাঁটুতে, হাতের আঙুলে ঘা দেন বারবার৷ কোনও স্পন্দন নেই৷
প্রায় এক বছর ধরে চিকিৎসা চলে প্রবীরের৷ ভালো হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখা যায় না ওর মধ্যে৷ কেবল ওর শরীরটুকুনি জেগে আছে৷ অঙ্গপ্রতঙ্গ সজাগ৷ মস্তিষ্কের অবহেলা তাদের নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে৷
‘ওঠো প্লিজ প্রবীর, উঠতেই হবে তোমাকে৷ আমার কী হবে বলো? সারাজীবন কী নিয়ে থাকব আমি… তোমাকে ছাড়া…’
‘মিসেস মিত্র…’ ফ্লোরের উপরে ছেলেটি এখনও উঁচু গলায় কী যেন বলে চলেছে, পারমিতা খেয়াল করে, প্রশস্তি গাইছে ছেলেটা, ‘এই মুহূর্তে তাঁর ইউটিউবে সাবস্ক্রাইবার দুই মিলিয়নের বেশি৷ প্রায় দেড়শো ভিডিয়োর মধ্যে থেকে একটা রইল আপনাদের জন্যে…’
মাসখানেক ধরেই রাতে ঘুমোনোর আগে প্রবীরের মাথার পাশে বসে ভায়োলিন বাজাত পারমিতা৷ একমনে বাজিয়ে যেত৷ এক-একদিন এক-একটা সুর উঠত ওর যন্ত্রে৷ বাজাতে বাজাতে প্রবীরের মুখের দিকে খেয়াল রাখা যায় না৷ ওর ঠোঁটের কোণে ফুটে-ওঠা আলগা হাসিটা রেকর্ড করবে বলেই টেবিলের উপরে মোবাইল ফোন রেখে ভিডিয়ো রেকর্ডিংটা অন করে ও৷ একটা ভিডিয়ো ডাক্তারকে পাঠায় পারমিতা৷ তাহলে কি সুর শুনলে এখনও সাড়া দেয় প্রবীরের অসাড় হয়ে-যাওয়া ব্রেন? ডাক্তার অবশ্য মানতে চাননি ব্যাপারটা৷ মনের অদম্য ইচ্ছা থেকে অনেক সময় এমন ভুল দেখি আমরা৷ পারমিতার তা-ই হয়েছে৷
পারমিতার কিন্তু ডাক্তারের কথা বিশ্বাস হয় না৷ হ্যাঁ, হাসছে প্রবীর৷ ওই তো একটা পাতলা হাসি খেলা করছে ঠোঁটে৷ নিশ্চিত হতে ভিডিয়োটা ইউটিউবে আপলোড করে পারমিতা, টাইটেল দেয়, Is My Paralyzed Husband Smiling?
এরপরেই গোটা সোশ্যাল মিডিয়ায় হইচই পড়ে যায়৷ এক অসাড়, চিরকালের মতো স্থবির হয়ে-যাওয়া স্বামীর বিছানার পাশে বসে ক্রমাগত ভায়োলিন বাজিয়েছে চলেছে তার স্ত্রী৷ কেবলমাত্র একটুখানি সাড়া পাওয়ার আশায়, ঠোঁট ফাঁক হয়ে একটুখানি অদৃশ্য হাসি ফুটে ওঠবার বাসনায়৷
তার ভায়োলিনের ছড় যেন সুর নয়, এক দুর্দম নিয়তির বুক চিরে আশার আলো জাগিয়ে তুলতে চাইছে৷
পারমিতা মিত্রর চ্যানেলের নাম ‘স্মাইল’৷ সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা দু’মিলিয়ন ছাড়িয়েছে৷ আপলোড হয়েছে অন্তত দেড়শো ভিডিয়ো৷ সবেতেই স্বামীর পাশে বসে চোখ বন্ধ করে ভায়োলিন বাজাচ্ছে পারমিতা৷ বাজানো শেষ হয়ে গেলে নামিয়ে রাখছে ছড়৷ তারপর ঝুঁকে পড়ে আলতো একটা চুমু খাচ্ছে স্বামীর কপালে৷ মৃদুস্বরে কী একটা বলছে যেন…
উপরের জায়ান্ট স্ক্রিনে ভিডিয়োটা শেষ হয়েছে এতক্ষণে৷ আজ থেকে কয়েক বছর আগে আপলোড করা প্রথম ভিডিয়ো৷
‘আপনাকে একটা শেষ প্রশ্ন করতে চাই, ম্যাম, ভিডিয়োর শেষে ওঁর কানে কানে কী বলেন আপনি?’
খিলখিল করে হেসে ওঠে পারমিতা৷ সেই সঙ্গে জনতাও৷ হাসতে হাসতেই জবাব দেয় পারমিতা, ‘আমার স্বামী অথর্ব বলে তার সঙ্গে প্রাইভেট কিছু থাকবে না নাকি, অ্যাঁ?’
ছেলেটি আবার ইয়ারফোনে নির্দেশ পেয়ে ঘুরে তাকায় ক্যামেরার দিকে, ‘এভাবেই হয়তো বেঁচে থাকে মানুষের ভালোবাসা৷ পারমিতা মিত্রর মতো মানুষের যত্নে শেষ হয়ে যেতে যেতে সে আবার ফিরে আসে৷ জীবন যদি আপনাকেও এমন অবস্থায় এনে ফ্যালে তবে বারবার মনে করবেন এই মানুষটির কথা৷ মনে রাখবেন, জীবন একদিন ওঁর গলাতেও তুলে দিয়েছিল দড়ির ফাঁস৷ উনি নিজের ভায়োলিন আর স্বামীর এক টুকরো হাসিকে সম্বল করে আবার চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন জীবনকে… কারণ…’ মখমলের মতো হাসি হাসে ছেলেটি, ‘ভালোবাসার থেকে বড়ো শক্তি আর কিছুতে নেই হয়তো…’ বাড়ি ফিরতে সেদিন একটু দেরি হয় পারমিতার৷ হাতঘড়ির দিকে চেয়ে দ্যাখে রাত প্রায় বারোটা বাজতে চলেছে৷ ফ্যানেদের উৎপাত আর সেলফির ঠেলায় স্টুডিয়ো থেকে বেরোতে দেরি হয়েছে বিস্তর৷ সেই সঙ্গে নানারকম গানের অনুরোধ৷
‘দিদি, পরের ভিডিয়ো কবে আসছে…’
‘দিদি, অপেক্ষা করে আছি৷’
‘আপনার ভিডিয়ো দেখলে অনেক শক্তি পাই দিদি…’
‘আশীর্বাদ করবেন যেন আপনার মতো করে ভালোবাসতে পারি…’ বাবাকে আজ প্রবীরের দেখাশোনা করতে রেখে গিয়েছিল পারমিতা৷ মুখ হাঁ করিয়ে খাইয়ে দিতে হয়৷ ডাইপার চেঞ্জ করতে হয়৷ অন্যদিন পারমিতা নিজেই করে৷
বিছানার পাশে বসেই অপেক্ষা করছিলেন তিনি৷ ধবধবে চাদরের উপরে শুয়ে আছে প্রবীর মিত্র৷ তার কপালে একবার হাত বুলিয়ে দিল পারমিতা৷ ওকে না দেখে বেশিক্ষণ থাকতে হলেই বুকের ভিতরটা হু হু করতে থাকে তার৷
‘কেমন আছ গো আজ সারাদিন? বাবার কাছে অসুবিধা হয়নি তো?’
প্রবীরের স্থির চোখের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বাবার দিকে তাকায় পারমিতা, ‘তুমি আর দেরি কোরো না, রাত হয়ে গিয়েছে৷’
আধ ঘণ্টার মধ্যেই নিজের ব্যাগপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে যান ভদ্রলোক৷ আজ রাতে হসপিটালে একটা কল আছে ওঁর৷
স্নান করে জামাকাপড় বদলে আয়নার সামনে গিয়ে বসে পারমিতা৷ সিঁদুরের কৌটো খুলে নতুন করে রাঙিয়ে নেয় সিঁথিটা৷ বেশ খানিকক্ষণ চেয়ে থাকে আয়নার দিকে৷ আচ্ছা, এত কিছু সব ন্যাকামো নয় তো? এই আয়নার সামনে এসে বসা, অথর্ব স্বামীর জন্য রোজ সাজগোজ৷ আর কী আছে ওর জীবনে? এত ফ্যান, এত প্রশংসা—এসব কিছুই তো চায়নি ও… শুধু চেয়েছিল…
আচমকা চাপা শব্দে চমক ভাঙে পারমিতার৷
ফ্রিজ খুলে কী একটা বের করে নিয়ে ধীরে ধীরে গিয়ে ঢোকে স্বামীর ঘরে৷
খাটের উপরে উঠে বসেছে প্রবীর৷ ক্লান্ত, হলদে চোখে তাকিয়েছে পারমিতার দিকে৷ দু-চোখে অনুনয় ফুটে ওঠে ওর৷ গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না৷ তা-ও কোনওরকমে কয়েকটা শব্দ ফুটিয়ে তোলে ও, ‘আ… আর পা… পারছি না… আমাকে এভাবে শেষ করে…’ হিংস্র বাঘিনির মতো ছুটে গিয়ে ওর শরীরটাকে এক ধাক্কায় বিছানার উপরে ফেলে দেয় পারমিতা৷ মুখটা একহাতের মুঠোয় চেপে ধরে হাতের ইঞ্জেকশনটা সজোরে বসিয়ে দেয় গলার পাশে৷ ভিতর থেকে স্বচ্ছ জলের মতো দেখতে অথচ ভারী একটা তরল প্রবেশ করে প্রবীর মিত্রর শরীরে৷ শরীরে বাধা দেওয়ার মতো জোর নেই ওর৷ অবশ যন্ত্রণাক্লিষ্ট শরীরটা খসে পড়ে বিছানার উপরে৷ পারমিতার মুখ থেকে লাল রং সরে যায়৷ উত্তেজনাটা কমে আসতে আবার স্মৃতি ভিড় করে আসে ওর মাথার ভিতরে৷
সেদিন ভায়োলিনের সুর শুনতে শুনতে সত্যি ঠোঁট নড়েছিল প্রবীরের৷ ওর সজাগ মাথা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঠিক হয়ে উঠছিল৷
ডাক্তার বিশ্বাস করতে চাননি পারমিতার কথা৷ মাসখানেক পরে দায়সারা করে একটা ডেট দিয়ে দেখা করতে বলেন তিনি৷ কিন্তু সেই এক মাসেই এক নতুন ভালোবাসার সন্ধান পায় পারমিতা, প্যাশন৷ ওর ছোটোবেলায় হারিয়ে-যাওয়া স্বপ্নের প্যাশন, ভায়োলিন৷
অথর্ব প্রাণহীন স্বামীর সামনে বসে ভায়োলিন বাজিয়ে চলেছে এক মহিলা৷ মুহূর্তে ভাইরাল হয় তার ভিডিয়ো৷ কমেন্ট, শেয়ার, লাইকের বন্যা বয়ে যেতে থাকে৷ সেই নেশায় মেতে ওঠে পারমিতা৷ আরও হাজারটা লোক ভায়োলিন বাজাতে পারে৷ পারমিতা মিত্রর থেকে ভালো বাজাতে পারে৷ কিন্তু পারমিতা মিত্রর এক্স-ফ্যাক্টর ওর অথর্ব স্বামী৷ ওকে কিছুতেই জেগে উঠতে দেওয়া যাবে না৷ যে জিনিস দ্রুত গড়ে ওঠে তা ভেঙে ছড়িয়ে যেতেও বেশি সময় লাগে না৷
ইঞ্জেকশনের ডোজ বাবার কাছ থেকেই জোগাড় করে পারমিতা৷ মেয়েকে আর বাধা দেননি তিনি৷ তাঁর মেয়েটাকে তো কম জ্বালায়নি প্রবীর৷ আজ লক্ষ লক্ষ টাকার মালিক তাঁর মেয়ে৷
স্মৃতি ছাপিয়ে আজ সন্ধ্যায় ছেলেটার বলা কথাটা মনে পড়ে পারমিতার, ‘ভালোবাসার থেকে বড়ো শক্তি আর কিছুতে নেই হয়তো…’
পারমিতা মৃদু হাসে৷ ভালোবাসা যে কেবল মানুষের সঙ্গে হবে, তার তো মানে নেই৷ নিজের হারিয়ে-যাওয়া স্বপ্নটাকে ভালোবাসা কি ভালোবাসা নয়?
‘দিদি, কখন আসবে ভিডিয়ো? অপেক্ষা করে আছি তো…’,
‘না দেখলে ঘুম আসবে না… প্লিজ এবার দিন…’, ‘ইউ আর অ্যান ইন্সপিরেশন, প্লিজ আজ মহম্মদ রফির…’
মোবাইলে আসা নোটিফিকেশনগুলো প্রাণ ঢেলে দেয় পারমিতার শরীরে৷ অতীত আগলে পড়ে থাকলে চলবে না৷ কুড়ি লক্ষ মানুষ অপেক্ষা করে আছে ফোনের ওপারে৷ ওর নিজের সামান্য ন্যাকা-ন্যাকা আবেগ, অনুভূতির কী দাম আছে তার কাছে?
প্রবীরের শরীরটা আবার স্থির হয়ে গিয়েছে৷ হয়তো এখনও সব অনুভব করছে ও৷ শুনছে প্রতিটা শব্দ৷ কেবল সাড়া দিতে পারছে না৷ নড়াচড়া করছে পারছে না৷
ইউটিউবের লাইভ অপশনটা চালু করতেই লক্ষ লক্ষ স্ক্রিন জুড়ে ফুটে ওঠে ওদের বেডরুমটা৷ আবার লাইক-কমেন্টের বন্যা বইতে শুরু করে৷ এসবের দিকে দৃষ্টি দেয় না পারমিতা মিত্র৷ একবার শুধু প্রথামাফিক হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে, ‘ভালো আছেন তো? ভালোবাসছেন তো?’
প্রবীরের স্থির-হয়ে যাওয়া দেহের পাশে বসে কাঁধের উপরে ভায়োলিন তুলে নেয় পারমিতা৷ নরম হাতে ছড় টানতে থাকে তার উপরে৷ আভে মারিয়ার মোলায়েম সুর খেলা করতে থাকে ঘরময়৷ চোখ বুজে পারমিতা কল্পনা করে, ওর দু-পাশে ছোটো এক কামরার ঘর মুছে গিয়ে একটা তেপান্তরের মাঠ তৈরি হয়েছে৷ মাঠের মাঝে একা বসে বাজিয়ে চলেছে ও৷ সম্রাজ্ঞীর মতো… গোটা আকাশ জুড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সেই সুর৷ আকাশটাও কান পেতেছে ওর মূর্ছনায়৷ লক্ষ লক্ষ মানুষের চোখ চেয়ে আছে ওর দিকে…. ভাবতে ভাবতে ওর ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে এক টুকরো হাসি৷ বাজানো শেষ হতে ভায়োলিন নামিয়ে রাখে পারমিতা৷ চোখ থেকে মুছে নেয় জলটা৷ জলটা মিথ্যে নয়৷ আজও প্রতিটা সুর কাঁদিয়ে দেয় ওকে৷
‘আজ আসি তবে… যাওয়ার আগে শুধু আশীর্বাদ করবেন আমাদের দু-জনকে৷ কাল আবার আসবে পারমিতা আর প্রবীর৷ কী তা-ই না গো?’
শেষ প্রশ্নটা প্রবীরের দিকে চেয়ে করেছে পারমিতা৷ সেখানে কোনও অনুভূতি খেলছে না৷
ক্যামেরাটা বন্ধ করার আগেই প্রবীরের মুখের উপরে ঝুঁকে পড়ে ও৷ কপালে আলতো করে চুমু খায় একটা৷ তারপর নিচু, চাপা গলায় কয়েকটা চেনা শব্দ উচ্চারণ করে, ‘জানি, এভাবে থাকতে কষ্ট হয় তোমার কিন্তু তুমি বুঝছ না প্রবীর, পয়সাটা বড়ো কথা না, এটা আমার প্যাশন৷ ছোটো থেকে এই লাইফটাই চেয়েছিলাম আমি…’
ক্যামেরাটা বন্ধ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় পারমিতা৷ যাবার আগে ঘরের আলোটা নিবিয়ে দিয়ে যায়…