স্বীকারোক্তি

স্বীকারোক্তি

পাঁচজনেই কৃতবিদ্য। পাঁচজনেই কৃতী। পাঁচজনেই সম্পন্ন। পাঁচজনেই সুপ্রতিষ্ঠিত। পাঁচজনেই উচ্চশিক্ষিত। পাঁচজনেই সুদর্শনা। পাঁচজনেই বুদ্ধিমতী। পাঁচজনেই সপ্রতিভ এবং রুচিশীলা এবং সুগৃহণিী।

অতএব রাজযোটক। শুধু পতি-পত্নীতে নয়। পাঁচ পুরুষে, পাঁচ মহিলায়। পাঁচ জোড়ে। ছেলেমেয়েগুলি কারও কৈশোর-উত্তীর্ণ, কারও এখনও কিশোর, কারও যুবক। কিন্তু সকলেই যথাযথ বেড়ে উঠেছে, উঠছে। স্বাস্থ্য ভাল, পড়াশোনায় অবহেলা নেই, মা-বাবার সঙ্গে সহৃদয় যোগাযোগ আছে। কেউ এঞ্জিনিয়ারিং-এ, কেউ ডাক্তারিতে, কেউ ফিল্ম ইনস্টিট্যুট, কেউ গবেষণা করছে, কেউ কমার্শিয়াল আর্ট, কেউ ম্যানেজমেন্ট। কাউকে নিয়েই দুর্ভাবনা নেই। সুতরাং বিত্তের সঙ্গে স্বস্তি। স্বস্তির সঙ্গে শান্তি। শান্তি থেকে আনন্দ। এবং আনন্দ থেকে আত্মপ্রকাশের বহুবিধ নতুন নতুন পন্থা উদ্ভাবন। যাকে বলা হয় ‘ফাইন-এক্সেস।’ এই ‘গোলেমালে গো-লে-মা-লে’র তৃতীয় পৃথিবীর সমস্যা-শহরে ব্যাপারটা অকল্পনীয়। প্রায়। তাই নয়? সমস্ত ডেটাগুলো কম্পুটারে ভরে দিলে, মুহূর্তের মধ্যে আউটপুট বেরিয়ে আসবে, নহে। নহে। নহে। সম্ভব নয়। তবু হয়েছে। যন্ত্র সব জানে না। হয়, হয়ে থাকে, নানা অসম্ভব, ইতিবাচক অসম্ভব এবং নেতিবাচক। হয়। যন্ত্র জানতি পারে না। এইবারে যাঁরা এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন, বা বলা ভাল, যাঁদের জীবনে এটা সম্ভব হয়েছে, আপাত-অবাস্তব এই বাস্তব জগতেই যাঁদের অবস্থান, বিচরণ, জীবন-উদ্‌যাপন, তাঁদের সঙ্গে একে একে পরিচয় করিয়ে দিই। একনম্বর মহীতোষ মজুমদার, বিচারপতি কলিকাতা হাইকোর্ট। দু’ নম্বর অসীমাংশু গুপ্ত। পি-এইচ ডি, ডি এস সি, প্রজেক্ট ডিরেক্টর একটি নামকরা রিসার্চ সংস্থার, তিন নম্বর অমিতব্রত বসুমল্লিক—চিফ অ্যাডভাইজার মেহরা গ্রুপ অফ হসপিট্যাল্স্‌। চার নম্বর সীতাপতি সেনগুপ্ত—এম আর সি পি, এফ আর সি এস। পাঁচ নম্বর হিরন্ময় চট্টোপাধ্যায়, ডি লিট—একটি ইউনিভার্সিটির প্রোফেসর, হেড অব দা ডিপার্টমেন্ট, প্রায়ই ভিজিটিং প্রোফেসর হয়ে সমুদ্র পারের দেশগুলিতে যান। এঁর এবং দুই নং অর্থাৎ অসীমাংশু গুপ্তর পেপার স্বদেশ-বিদেশের বহু নাম করা জার্নালে বার হয়। এঁরা পাঁচজনেই এক স্কুলে পড়েছেন। শ্যামপুকুর স্ট্রিটের ওপর অবস্থিত শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয়ে। এঁরা যখন পড়েছেন তখন এর নাম ছিল সরস্বতী ইনস্টিট্যুশন। এই স্কুল থেকে প্রতি বছর সে সময়ে স্কুল-ফাইনাল পরীক্ষায় দশ জনের মধ্যে একজন কি দুজন, বিশ জনের মধ্যেও জনা কয়েক থাকতই। এই স্কুলের অঙ্কশিক্ষক, ইংরেজির শিক্ষক স্বয়ং হেডমাস্টার মশাই, ইতিহাস ও ভূগোলের শিক্ষকের কথা এঁরা কোনওদিন ভুলতে পারবেন না। নকশাল আন্দোলনের সময়ে উত্তর কলকাতার বহু রত্নগর্ভা স্কুলের মতো এটিও জীবন্মৃত হয়ে পড়ে। এবং এই স্কুলের ছাত্রবৎসল, দোর্দণ্ডপ্রতাপ, জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত হেডমাস্টার মশাই দীর্ঘ চল্লিশ পঁয়রাল্লিশ বছরের কর্মজীবনে বহু কৃতী ছাত্র তৈরি করার শেষ পুরস্কার স্বরূপ বৃদ্ধ মস্তকে ছাত্রদের লাঠির প্রহার খেয়ে খুব সম্ভব পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হন। তবে সে অন্য ইতিহাস। তার অনেক আগেই প্রথম কুড়ি-পঁচিশ জনের মধ্যে স্থান পেয়ে সদ্য প্রবর্তিত স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা পাশ করে বেরিয়ে এসেছেন এই পঞ্চনায়ক—মহীতোষ মজুমদার—দীর্ঘকায়। শ্যামবর্ণ, দোহারা, সামান্য পেছনে দিকে হটে-যাওয়া কাঁচা-পাকা কুঞ্চিত কেশ, অসীমাংশু গুপ্ত—বেঁটেখাটো, ফর্সা, পুলিশের মতো গোঁফ, গাঁট্টাগোঁট্টা, অতিরিক্ত মস্তিষ্ক চালনার ফলেই হয়তো মাথায় আয়না সদৃশ টাক। অমিতব্রত—মাঝারি দৈর্ঘ্য, স্বাস্থ্যবান, মনের ভাবের সঙ্গে মুখের রঙ বদলায়। কখনও কালো, কখনও ফর্সা, কখনও উজ্জ্বল শ্যাম। সীতাপতি—অতি সুপুরুষ, মাথার চুলগুলি প্রায় সাদা, ছ’ফুট লম্বা, মেদবর্জিত শরীর, আঙুলগুলি সুন্দরী মেয়েদের আঙুলের মতো লম্বা, ক্রমশ সরু হয়ে এসেছে, স্পর্শকাতর। এই আঙুল দিয়ে তিনি অত্যন্ত জটিল সব শল্য চিকিৎসা করেন। কখনও নিজে গাড়ি চালান না, বা আঙুলের অন্য কোনও অপব্যবহার করেন না। তাঁর মুখ পরিষ্কার কামানো। এবং হিরন্ময়—লম্বা, সাদা-কালো পর্যাপ্ত কেশ, আধা ফর্সা। সরু সোনালি ফ্রেমের ব্রাউন ডাঁটির চশমা ছাড়া তিনি পরেন না। বউবাজারের একটি নির্ভরযোগ্য দোকান তাঁকে এই পুরনো-স্টাইলের চশমা নিয়মিত সরবরাহ করে।

যদি ধৈৰ্য্যচ্যুতি না ঘটে, তাহলে পঞ্চ নায়িকার সঙ্গেও একবার দেখা করে আসা যাক। ঈষিতা মজুমদার, লম্বা, অতিশয় ফর্সা, চ্যাপ্টা চেহারা। এবং চ্যাপ্টা মুখ, চোখের ঠিক তলায় চোয়াল সামান্য উঁচু, চোখা নাক, চোখ ছোট ছোট ঈষৎ খয়েরি, প্রতিমার মতো বাঁকা। চুলও ঈষৎ তাম্রাভ। ব্যক্তিত্বই এঁর চেহারার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। ইনি শুধুমাত্র গ্র্যাজুয়েট, কিন্তু দেখলে মনে হয়, প্রোফেসর কিংবা এগজিকিউটিভ অফিসার, কিম্বা আই. এ. এস.। সুপ্রিয়া গুপ্ত, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, তন্বী, চুল ছাঁটা, লম্বাটে ছাঁদের চেহারা যে জন্য স্বামীর থেকে লম্বা না হলেও, তাঁকে স্বামীর থেকে অস্বস্তিকর রকম লম্বা দেখায়। তাই তিনি ফ্ল্যাট চটি ছাড়া পরেন না, এবং সুযোগ পেলেই স্বামীর পাশে গিয়ে দাঁড়ান চাক্ষুষ প্রমাণ করে দেখাতে যে সত্যি-সত্যি অসীমাংশু তাঁর থেকে বেঁটে নয়। ইনিও এম এস-সি, অসীমাংশুর সঙ্গে রিসার্চ-প্রেম। কিছুদিন একটি কলেজে পড়িয়েছেন, কিন্তু অসীমাংশুর বাইরে যাওয়ার সময়ে সর্বদা ছুটি পেতেন না বলে পড়ানো ছেড়ে দেন। মীনাক্ষী বসুমল্লিক, ছোটখাটো চেহারা, খুব চটপটে, শ্যামাঙ্গী, এঁদের মধ্যে সবচেয়ে স্মার্ট, মাথার চুল বয়-কাট, এই সব কারণে এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ হলেও তাঁকে সর্বকনিষ্ঠ দেখায়। ইনিও সাধারণ গ্র্যাজুয়েট। কিন্তু পার্সোনাল গ্রুমিং, ইকেবানা, ফ্রেঞ্চ ইত্যাদি বহু রকমের কোর্স করেছেন। ইনি এবং ডাক্তার সেনগুপ্তর স্ত্রী দুজনে মিলে একটি বুটিক চালান। ডক্টর সীতাপতি সেনগুপ্তর স্ত্রীর নাম অতি অদ্ভুত, কিন্তু সত্যিই— সীতা। ইনিও খুব সুন্দরী। ইনি গুর্জরী। এঁর চেহারার একমাত্র ত্রুটি এঁর ঘাড় নেই। সুন্দর ফর্সা, দিব্যি গোল মুখখানি কাঁধের ওপর সোজাসুজি বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। লম্বার থেকে চওড়ার দিকেই এঁর প্রবণতা বেশি। কিন্তু নিজেকে সংযমে রেখেছেন। ইনি শিক্ষায় ডাক্তার। কিন্তু ডাক্তারি করেন না। বুটিক চালান। হিরন্ময়ের স্ত্রীর নাম কমলা আয়ার চট্টোপাধ্যায়। ইনি কৃষ্ণা। বোঝাই যাচ্ছে দক্ষিণী, কৃষ্ণা কিন্তু রীতিমতো সুন্দরী। স্বল্পভাষী, গম্ভীর, সুদূর। চিরকাল বাংলায় কলকাতায় মানুষ, বাঙালিই প্রায় হয়ে গেছেন, তবে গুর্জরীর মতোই ইনিও কোনওক্রমেই মাছ-খাওয়া রপ্ত করতে পারেননি। অন্যান্য বাঙালি, সাহেবি, চিনা স-বই খেতে পারেন। খালি মাছের গন্ধ সহ্য করতে পারেন না। মাংস বিশেষত চিকেন কিন্তু খান। পৰ্ক-বেকন ইত্যাদিও তৃপ্তি সহকারেই খেয়ে থাকেন। খালি মাছ বাদ। পাঁচজনের মধ্যে একমাত্র ইনিই চাকরি করেন। ইনিও বিশ্ববিদ্যালয়ে রিডার। স্বামীর বিশ্ববিদ্যালয়ের নন, অন্যত্র। কিন্তু বিষয় একই। প্রত্যেকটি স্বামীই অত্যন্ত ব্যস্ত। মাঝে মাঝে এটা ওটা উপলক্ষে দেখা হয়। তবে স্ত্রীরা পরস্পরের খুব ঘনিষ্ঠ। কীভাবে কে জানে এই অদ্ভুতও এঁদের ক্ষেত্রে সম্ভব হয়েছে। স্ত্রীদের দেখাশোনা প্রায়ই হয়। কিন্তু স্বামীরাও কম ঘনিষ্ঠ নন। তাঁদের স্কুলের ঝালমুড়ি-ফুচকা-কানমলা-নিল ডাউনের ভাব এখন চিজ-স্যান্ডউইচ-হুইস্কি-রিভলভিং চেয়ার-লাল-নীল টেলিফোনের যুগেও একেবারে অবিকৃত আছে। অন্য সময়ে দেখা হোক না হোক, এঁরা প্রত্যেক বছর পরিকল্পনা করে সকলে একত্র হন। কখনও কলকাতার কাছাকাছি কোথাও। কখনও নিজেদের মধ্যেই কারও বাড়িতে। ওঁরা এটাকে আদর করে বলেন ‘মোলাকাত’। আসলে এটা ওঁদের বাৎসরিক পুনর্মিলন উৎসব বা রি-ইউনিয়ন। বাংলা ‘পুনঃ’ এবং ইংরেজি ‘রি’ উপসর্গ দুটি বন্ধুদের পছন্দ নয়। তাঁরা বলেন পুনঃ কেন পুনঃ পুনঃ এবং রি কেন আমরা রি-রি-রি ইউনাইটেড হচ্ছি, হচ্ছি না কি? তবে এটা একটা বিশেষ মিলন, স্পেশ্যাল ইউনিয়ন। ছেলেমেয়েরা যখন ছোট ছিল তখন এতে তারাও যোগ দিত। বেশ একটা পিকনিকের মতো হত ব্যাপারটা। কিন্তু এখন তাদের মধ্যে অনেকেই বড় এবং ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, নিজেদের একটা জগৎ তৈরি করে নিয়েছে। মা-বাবাদের হই-হল্লার মধ্যে আসতে চায় না। কাজেই ইদানীং, দু চার বছর ছেলেমেয়েদের বাদ দিয়েই এঁদের বার্ষিক মোলাকাত হচ্ছে।

এ বছরটা ওঁদের, অর্থাৎ স্বামীদের খুব বন্ধ্যা গেছে। মহীতোষ ছিলেন ব্যারিস্টার, সম্প্রতি জজ হওয়ার পর থেকে তাঁর দুঃখের দিন শুরু হয়েছে। তাঁকে সরকার এ কমিশন ও কমিশনে জুড়ে দিতে থাকছে। তার ফলে এত উল্টোপাল্টা পার্টির উৎপাত শুরু হয়েছে যে আজকাল ঘুমের মধ্যে তাঁকে বোবায় ধরতে শুরু করেছে। অসীমাংশুর সম্প্রতি একটি ল্যাবরেটরি-কমপ্লেক্স পুড়ে গেছে তাঁর এক ছাত্রীর ক্ষমার অযোগ্য অসাবধানতায়। ম্যানেজমেন্ট থেকে তাঁকে চাপ দিচ্ছে ছাত্রীটিকে অর্থাৎ রিসার্চ স্কলারটিকে বরখাস্ত করতে, এদিকে রিসার্চ স্কলাররা ইউনিয়ন করে তাঁকে শাসাচ্ছে এ রকম কিছু করলে তারা ইনস্টিট্যুটের কাজ-কর্ম বন্ধ করে দেবে। অমিতব্রতর সমস্যাটা অন্য ধরনের। মেহরা গ্রুপের হাসপাতালে যারা আসে তারা ধনী বা উচ্চ মধ্যবিত্ত। পান থেকে চুন খসলেই ডজন ডজনে অভিযোগ-পত্র এসে যায়, তাতে ওকালতি শাসানিও থাকে। তাই যখন তখন তাঁকে মিটিং-এ বসতে হয়। রবিবারে হয়তো একটা নিশ্চিন্ত বিশ্রামের দিন ঠিক করেছেন। আর পনেরো মিনিট পরেই মীনাক্ষী ক্যানটনিজ লাঞ্চ সার্ভ করবে জানিয়ে দিয়েছে। ফোন এল, জুনিয়র মেহরা ফোন করছেন। ‘মিঃ বাসু মালিক, ইউ মাস্ট রিচ দা ইনস্টিটুট উইদিন অ্যান আওয়ার। সাম ফ্রেশ প্রবলেম হ্যাজ ক্রপড আপ। ওহ ইয়েস,…দা কনফারেন্স রুম…।’ অমিতব্রতর মুখটা প্রথমে লাল, তারপরেই ফ্যাকাশে হয়ে যায়। প্রথম রঙটা রাগের কারণে, দ্বিতীয় রঙটা ‘প্রবলেম’-এর কারণে। সারা বছর এই চলেছে। সীতাপতির তো কথাই নেই। তিনি সম্প্রতি চন্দননগরেও তাঁর নার্সিংহোমের একটি শাখা খুলেছেন। তাঁর সময় বলে কিছু নেই। যখন সময় থাকে, অর্থাৎ নিজের স্বাস্থ্যের জন্য আবশ্যক যে সময়টুকু তিনি বার করতে পারছেন সে সময়ে তিনি একটি দোলনা-চেয়ারে বসে দুলতে দুলতে মিউজিক শোনেন। বাখ কিংবা মোৎজার্ট। দেবুসি কিংবা বিলায়েত। তাঁর সাদা মসৃণ ক্রমশ সরু হয়ে যাওয়া আঙুলগুলো কোলের ওপর আলতোভাবে ফেলা থাকে। হাতের কাছে থাকে কোনও সুগন্ধি মিশ্রিত দুধের পেয়ালা, শুনতে শুনতে তিনি দুধ খান। হিরন্ময়ের ব্যস্ততাটা যতটা শারীরিক, তার চেয়ে অনেক বেশি মানসিক। তাঁদের ইউনিভার্সিটিতে এখন প্রোফেসর শ্রেণীর মাস্টারমশাইদের পর্যায়ক্রমে বিভাগীয় প্রধান হবার নীতি চালু হয়েছে। আপাতত তিনিই প্রধান, কিন্তু তাঁর ওপরে দু’জন সিনিয়র রয়েছেন, এঁদের মধ্যে একজন আবার তাঁর মাস্টারমশাই। এঁরা দুজন বড়ই অসহযোগিতা করছেন। প্রতিদিন এই চাপা বিদ্বেষ ও অসহযোগিতার আবহাওয়ায় কাজ করতে তাঁকে প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে।

এই সমস্ত নানা কারণে পাঁচ বন্ধু সারা বছর পরস্পরের সঙ্গে মিলতে পারেননি। কমলাকে কিছুদিন সেনগুপ্তর নার্সিং হোমে থাকতে হয়েছিল। সেই সূত্রে সীতাপতির সঙ্গে হিরন্ময়ের সামান্য দেখাশোনা হয়েছে। কিন্তু বাকিদের পরস্পরের সঙ্গে সামান্য একটু ফোনাফুনি ছাড়া দেখা হয়ইনি বলতে গেলে। এবার জমায়েতের স্থান স্থির হয়েছে কলকাতার কাছেই গঙ্গার ধারে একটি চমৎকার বাংলোয়। বাংলোটি সীতাপতির এক চন্দননগরী রোগীর। খুব জটিল একটি শিরদাঁড়ার টিউমারের অপারেশন করে এঁকে বাঁচিয়েছেন সীতাপতি। ভদ্রলোক অতি-অল্পসংখ্যক ধনী এবং ব্যবসাদার বাঙালিদের অন্যতম। কৃতজ্ঞতায় কী করবেন ভেবে পান না। এই বাংলোটি তাঁর অনেক স্থাবর সম্পত্তির অন্যতম। একেবারে আগাগোড়া ঝকঝকে তকতকে কেয়ারটেকার এবং ফার্নিচারসমেত। এই বাংলোটিই এবারের জমায়েতের স্থান।

বাংলোটির মজা হচ্ছে ‘হুবহু’ অক্ষরের মতো এর গড়ন। অর্থাৎ সামনে পেছনে একরকম গড়ন। সামনেও পর্চের ওপর লাল টুকটুকে টালির ঢালু ছাত, তার ওপর মাধবীলতা। চার পাঁচ ভাঁজ মেহগনির দরজার ভেতর দিয়ে ঢুকলে অস্বচ্ছ কাচের ওই রকমই এক সেট দরজা চোখে পড়বে। তারপর প্রশস্ত বসবার ঘর। পেছন দিকটাও ঠিক একরকম। শুধু সামনে সিঁড়ি দিয়ে লনের মধ্যবর্তী সুরকির রাস্তায় নেমে যাওয়া যায়, পেছনের দরজার সিঁড়ি দিয়ে নেমে সামান্য এগিয়ে গেলেই গঙ্গা। বাঁধানো ঘাট। দুধারেও বাঁধানো পাড়ের ওপর পাঁচিল। পাঁচিলের জায়গায় জায়গায় কিছুটা অংশে চৌকোনা গর্ত, তার ভেতরে মাটি ফেলে নানারকম মরশুমি ফুলের সজ্জা। দুটো হল ঘিরে দুটো তিনটে শোবার ঘর, খাবার ঘর। টেবল টেনিস বোর্ড রয়েছে পেছনের হল ঘরে। তবে অন্যান্য বসবার এবং আরাম করবার মতো আসবাবেরও অভাব নেই। ঘুরে-ফিরে সমস্তটা দেখে সকলেই ভীষণ খুশি হলেন। সময়টা শীতের শেষ। চারদিক থেকে হু-হু করে হাওয়া আসছে। কিন্তু ধনী এবং উচ্চবিত্তরা সাধারণত এত প্রোটিন, ফ্যাট এবং শরীর গরম করবার তরল বস্তু খেয়ে থাকেন যে তাঁদের সহজে শীত করে না। সকাল নটার মধ্যেই সকলে যে যার গাড়িতে পৌঁছে গেলেন।

ঈষিতা বললেন—‘তুমি যে কেন ছাই ব্যারিস্টারি ছেড়ে জজ সাহেব হতে গেলে। তোমারও তা হলে এরকম ক্লায়েন্ট থাকত।’

মহীতোষ বললেন—‘কেন তোমার কি তাতে হিংসে হচ্ছে? ও সীতু, সীতু তোর বউঠানের হিংসে হচ্ছে রে, তোর ক্লায়েন্ট সম্পদ দেখে!’

সীতাপতি হেসে বললেন—‘বৌঠানদের হিংসে-ফিংসে হয় না মহী! বৌঠান মানেই এক একটি প্রচ্ছন্ন প্রেমিকা। রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন।’

মহীতোষ বললেন—‘ওঃ ওঃ, বুকটা ফেটে যাচ্ছে রে, সীতু, লাইফটা আমার আজ থেকে হেল হয়ে গেল। সন্দেহে সন্দেহে খাক হয়ে যাব।’

সীতা বললেন—‘আমার ওবস্থাটাই বা কী সুবিধার হোবে বলুন মহীদা।’

মীনাক্ষী এই সময়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন—‘তোমরা কি লনেই ব্রেকফাস্ট করবে? তাই যদি স্থির করে থাকো মনে রেখো, একমাত্র ছায়া-অলা জায়গা রয়েছে ওই পরশ গাছটার তলায়। কিন্তু ওপর থেকে পাখি-টাখি কিছু কম্মো করে দিতে পারে।’

হিরন্ময় মিটিমিটি হেসে বললেন—‘ইন দ্যাট কেস বউদি একটা বাটি আনবেন, বাটি চাপা দিয়ে দেব।’

অমিতব্রত বললেন—‘হিরু একটা গল্পের গন্ধ পাচ্ছি যেন?’

হিরন্ময় বললেন—‘গল্পটা বালজাকের। এক বেচারি মেয়ের নতুন বিয়ের পর তার স্বামীর তার কিছুই পছন্দ হয় না। রান্না-বান্না, ঘর-গেরস্থালি কিচ্ছু না। সে মেয়েটির বাপের বাড়ির লোককে বলে—কী গছিয়ে দিয়েছে আমাকে? কিস্যু জানে না। কিস্যু পারে না। এদিকে মেয়েটি কাঁচুমাচু মুখে বলছে—সব সময়ে গরম, সুস্বাদু খাবার দিচ্ছি, জামাকাপড় পরিষ্কার রাখছি, ঘর দোর ঝকঝকে তকতকে। তবু ওর কিছুতেই মন পাই না। তখন বাপের বাড়ির লোকেরা বলল—‘ঠিক আছে ও একদিন আমাদের সবাইকে নেমন্তন্ন করে বেশ কয়েক পদের ভোজ খাওয়াক। তাহলেই বোঝা যাবে।’ নির্দিষ্ট দিনে স্বামীদেবতা ঠিক করলেন বাগানে খাওয়া-দাওয়া হবে। তা তা-ই সই। মেয়েটি টেবিল সুন্দর করে সাজিয়ে খাবার-দাবার সব গুছিয়ে রাখল। নানারকম ভাল ভাল পদ। দেখলেই জিভে জল এসে যায়। সব যখন শেষ, তখন ওপরের গাছ থেকে পাখি কম্মো করল। অতিথিরা এসে বসে আছে। মেয়েটি কী করে? তখন সেই নোংরা জায়গাটার ওপর সে একটা ফুলশুদ্ধ ফুলদানি রেখে জায়গাটা চাপা দিল। এদিকে মেয়েটির স্বামীর সঙ্গে সব অতিথিরা খেতে এসেছেন। অতিথিরা বলতে লাগলেন—‘বাঃ এই তো কী সুন্দর টেবিল সাজানো হয়েছে। চমৎকার সব খাবার। গন্ধ বেরোচ্ছে সুন্দর। এতগুলো পদ। আর তুমি কী চাও হে?’

স্বামীর তখন খুব রাগ হয়ে যাচ্ছে, সে রেগে মেগে বললে—‘শিট!’ তার স্ত্রী তখন চটপট ফুলদানটা সরিয়ে বলল—‘এই তো, বিষ্ঠাও মজুত!’

গল্প শুনে সকলেই হো-হো, হো-হো, হি-হি করে হাসতে লাগলেন। সীতাপতি বললেন—‘মেয়েদের সামনে, মানে বউদের সামনে গল্পটা বলে তুই ভাল করলি না হিরু। হেনস্‌ফোর্থ আমাদের খাবার টেবিল কীভাবে সাজানো হবে কে জানে!’

আর এক দফা হাসি উঠল।

ততক্ষণে মীনাক্ষীর নির্দেশে লনের ওপরেই ব্রেকফাস্টের বন্দোবস্ত হল। ব্রেকফাস্টের পর গল্পগুজবের সময় পাওয়া যাবে অনেকটা। পাঁচ দম্পতি নানা রকম দলে ভাগ হয়ে কখনও এদিকের লনে কখনও পেছনের গঙ্গার ধারের জমিতে ঘাটটাতে বেড়িয়ে বেড়িয়ে নানা রকম গল্পসল্প করতে লাগলেন। তারপরে কেমন করে কে জানে পাঁচটি স্বামী ও স্ত্রী আলাদা হয়ে পড়ল। দেখা গেল পাঁচ পুরুষ সামনে হলে বসে কে সিগারেট, কে সিগার, কে পাইপ মুখে দিয়ে গল্প করতে বসে গেছেন। আজকে এঁদের অন্য মেজাজ। সীতাপতি হঠাৎ বললেন—‘টমোরি হোস্টেলটা উঠে গেল রে।’ তাঁর গলার স্বরে হতাশার মেজাজ। দীর্ঘশ্বাস।

মহীতোষ বলল—‘তাতে তোর কী? তোর নার্সিং হোমগুলো তো আর উঠে যায়নি!’

সীতাপতি বলল—‘তুই বুঝবি না, অসীম বুঝবে, অমুও বুঝবে। আমরা দুটো বছর কাটিয়েছি ওই হোস্টেলে। জীবনের অসীম মূল্যবান দুটো বছর। অমু তোর মনে আছে একটি গ্রাম থেকে আসা ছেলেকে নিয়ে আমরা কী রকম মজা করতুম! ’

হিরন্ময় বলল—‘তোরা এই তিনটে রাম গরুড়ের অবতার মজা করতিস? কী রকম? কী রকম?’ অমিতব্রত বলল—‘আরে ছেলেটাকে আমরা কী বলেছিলাম জানিস? খবরদার ভাই সেকেন্ড ক্লাস ট্র্যামে উঠো না। সেকেন্ড ক্লাস ট্র্যাম থামে না!’

‘বড় বড় চোখে চেয়ে ছেলেটা বলল—“আরে, ভাগ্যিস বললে, আমি তো খরচ বাঁচাতে সেকেন্ড ক্লাসেই চড়ব ঠিক করেছিলুম।”

‘ছেলেটার নির্ঘাত মাথার ছিট ছিল। বাবা গ্রামের বেশ মালদার পার্টি ; বুঝলি। মহা কিপ্পুস।’

হাসতে হাসতে অসীমাংশু বললে—‘আর সেই জুলি-বৃত্তান্ত?’

সীতাপতি বলল—‘ওঃ, জুলি বলে একটা মেয়ে পড়ত আমাদের সঙ্গে। দেখতে বেশ সুন্দর। তা ওই ছেলেটাকে আমরা সবাই মিলে গ্যাস দিতে লাগলুম—“জুলি তোমার প্রেমে পড়েছে।” তারপর সে ছেলেটার যদি অবস্থা দেখতিস, নাম ছিল বোধহয় কালীপদ। ছেলেটার কেমন ধারণা হয়েছিল জুলি ক্রিশ্চান। ওই নামটার জন্যেই বোধহয়। আর স্কার্ট টার্ট পরত। লিপস্টিক-টিক মাখত। শেষে একদিন কেলেঙ্কারি কাণ্ড। জুলিকে গিয়ে বলেছে—“জুলি দেবী আপনি আমায় ভালবাসেন, আমিও আপনাকে গভীর ভাবে ভালবাসি। কিন্তু আপনি যে খৃষ্টান! আমরা চাটুজ্যে বামুন। বাবা শুনতে পেলে খড়ম পেটা করবে যে!” বলে হাউ মাউ করে কান্না!’

হিরন্ময় হাসতে হাসতে বলল—‘তারপর? জুলির কী রি-অ্যাকশন?’

—‘জুলি? সে তো তক্ষুনি প্রিন্সিপালের কাছে যেতে চায়। প্রিন্সিপাল ছিলেন টেলর, অনেকে বলত টেরর। অনেক কষ্টে কালীর মাথা খারাপ টারাপ বলে জুলিকে আমরা থামাই!’

—‘তোরা মহা বিচ্ছু ছিলি তো? সীতু তুইও এর মধ্যে ছিলি?’ মহীতোষ বলল।

—‘আরে ও-ই তো পান্ডা!’ অমিতব্রত বলল।

অসীমাংশু বলল—‘সেই কালীপদ চাটুজ্জের লেটেস্ট খবর জানিস?’

—‘কী? কী?’

অসীমাংশু সিগারেটের ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে বলল—‘কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং প্রোফেসর হয়ে গেছি, দেখি ফিলসফির চেয়ার পেয়েছে। এবং ক্রিশ্চান তো ক্রিশ্চান এক্কেবারে খাস মার্কিন মেমসায়েব বিয়ে করেছে।’

—‘বলিস কী?’ হিরন্ময় বলল।

—‘লাইফ ইজ লাইক দ্যাট’—অসীমাংশু বলল, ‘আরও শুনবি টমোরির ব্রাইটেস্ট বয়, যে সেবার ম্যাথমেটিকসে ঈশান স্কলার হল, সীতু ডু ইউ নো হোয়াট হ্যাজ হ্যাপন্ড টু হিম!

—‘কী? রাইটার্সের কেরানি?

—‘আজ্ঞে না। প্রোফেসর ছিল। এক্সট্রীমিস্ট পলিটিক্স্‌…জেল, ডেড।’

হিরন্ময় বলল—‘তুই কি প্রমথেশের কথা বলছিস?’

—‘হ্যাঁ।’

সবাই কিছুক্ষণ চুপ। জীবনে সার্থকতা আর ব্যর্থতার মানেই বা কী? তার মূল্যায়নও কীভাবে সম্ভব। সবাইকার মনেই এই প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে।

মহীতোষ বলল—‘তোরা সব চুপ মেরে গেলি যে! আরে বাবা, নিজেরাই তো বলছিস লাইফ ইজ লাইক দ্যাট! টেক ইট ইজি, টেক ইট ইজি।’

হিরন্ময় একটু বিষন্ন হেসে বলল—‘তুই কতজনকে কত রকমের শাস্তি দিচ্ছিস মহী। তুই হয়তো কঠিন হয়ে যেতে পেরেছিস। কিন্তু এরা মানে অসীম আর অমু আমাকে ডক্টর প্রমথেশ সাহার মুখটা মনে পড়িয়ে দিল। কী আপনভোলা, ইনট্রোভার্ট ছিল, টিপিকাল ম্যাথমেটিশিয়ানদের মতো। ছাত্রদের মধ্যে প্রচণ্ড সুনাম, যখন তখন মফঃস্বলের কলেজে বদলি করে দিত। হেলদোল নেই। ভাল ছাত্র সেখানে পেত না। কুছ পরোয়া নেই। বলত—‘আরে বাবা অঙ্ক হচ্ছে রীজনের জিনিস। মাথার মধ্যে রীজনটুকু থাকলেই হল। তার পরেরটুকু টিচারের কাজ। সেই লোক, ওইরকম ডেডিকেটেড টু ম্যাথমেটিকস, রেভোলুশন করতে নেমে পড়বে, আমার আজও বিশ্বাস হয় না। আমার এখনও মনে হয় হি ওয়জ ফ্রেমড।’

মহীতোষ বলল—‘ফ্রেমড? কেন? কার স্বার্থ?’

—‘আরে বাবা। যে মাস্টার কলকাতার বেস্ট কলেজেও তার কাছ থেকে জিনিস নেবার মতো ছাত্র চট করে পেত না, তাকে মফঃস্বলে রাখবারই বা মানে কী? যেই প্রেসিডেন্সিতে এল, প্রোফেসর পোস্ট পেয়ে গেল, হঠাৎ সে প্রচ্ছন্ন বিপ্লবী হয়ে গেল! কোনও বিচার না। কিচ্ছু না। সোজা জেল! তার পরেই ডেড?’

—‘তোদের শিক্ষা-জগৎ এমনি নোংরা?’ মহীতোষ বলল।

—‘সবাইকার সব জগৎ-ই এখন নোংরা, করাপ্ট, মহী তুইও তার থেকে বাদ যাস না, আমরা কেউই যাই না। সবাই সিসটেমের দোহাই দিই। কিন্তু সিসটেমের ছোটখাটো অংশ হিসেবেও আমাদের যেটুকু করবার তা আমরা করি না,’ অসীমাংশু বলল।

অমিতব্রত হঠাৎ কী রকম—রোমন্থনের গলায় বলে উঠল—ওহ মহী সেই সরস্বতী ইনস্টিটুশনের দিনগুলোর কথা মনে কর। কতদিন আগে। কত দূরে। অসীমকে বাংলার মাস্টারমশাই কী নামে ডাকতেন মনে আছে!’ মহী বলল—‘মনে আবার থাকবে না? সরস্বতীর বরপুত্র। সংক্ষেপে সবস্বতী। যে প্রশ্নের জবাব কেউ দিতে পারবে না, সে প্রশ্ন অমনি রি-বাউন্ড হয়ে সরস্বতীর বরপুত্রর কাছে চলে যাবে। কী রে অসীম, এমন কোনও প্রশ্ন আছে যেটার উত্তর দিতে পারিসনি?

—অবিমৃশ্যকারী বানানটা ভুল লিখেছিলাম, এইট থেকে নাইনে উঠতে। সরোজশোভনবাবু মাথা নাড়তে-নাড়তে বলেছিলেন, নাঃ, বাংলায় লেটারটা তোর হল না।’

—‘হয়েছিল?’

—‘নাঃ, চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলুম, তা-ও হয়নি!’

মহীতোষ বলল—‘আমি কিন্তু একটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে সাকসেসফুল হতে পেরেছিলাম। তোদের মনে আছে ক্লাস নাইনে হেড স্যার আমার এসে’র খাতাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলে ছিলেন—“আই ডিডন’ট এক্সপেক্ট দিস ফ্রম ইউ।” এসেটা আমি চোদ্দবার লিখেছিলুম। ফোর্টিন টাইমস। আনটিল হি ওয়াজ স্যাটিসফায়েড। লেটারটা আমি পেয়েছিলুম। আই জাস্ট মেড ইট। ’

অমিতব্রত বলল—‘পন্ডিতমশাই আমাকে কী বলে ডাকতেন তোদের মনে আছে?’

হিরন্ময় বলল—‘অফ কোর্স। অহিতব্রত। সত্যি তুই ক্লাসে কী কাণ্ডটাই করতিস। ব্যাগ বদলাবদলি করে রাখা। এর তার টিফিন খেয়ে খালি টিফিন কৌটোয় ঢিল পুরে রাখা, পকেটের মধ্যে আরশোলা ভরে দেওয়া। কী করে করতিস রে ওগুলো? আবার বেশির ভাগই ওই দোর্দণ্ডপ্রতাপ পণ্ডিতমশায়ের ক্লাসে।’

অমিতব্রত বলল—‘আরে আমি তো পন্ডিতমশায়ের পড়া কিস্যু শুনতুম না। আর তোরা অখণ্ড মনোযোগ শুনতিস। বেশির ভাগই। তাইতেই আমার সুবিধে হয়ে যেত। তবে শুধু এই জন্যেই পণ্ডিতমশাই আমার নাম বদল করেননি। মনে আছে সেই উপসর্গের ছড়াটা?’

মহীতোষ বলল—‘ওহ ইয়েস। প্রপরাপসমন্বব নির্দুর ভিব্যধি…’

অমিতব্রত বলল—‘হ্যাঁ হ্যাঁ। আমি ইচ্ছে করে প্রপরাপসমন্বব বলে তোতলাতে থাকতুম নি… নি… নি, মনে পড়ছে?’

মহীতোষ হেসে বলল—‘দারুণ অ্যাকটিং করতিস তো? আমরা ভাবতুম বুঝি সত্যিই তোর মনে নেই।’

অমিতব্রত বলল, ‘বাস তাইতেই খেপে গিয়ে পণ্ডিতমশাই বললেন—‘দেবভাষাকে যে এমন তাচ্ছিল্য করে তার ব্রত অমিত হবে না ভস্ম হবে। যেমনি অহিত করে বেড়াচ্ছিস এমনিই সারাজীবন করে বেড়াবি।’

হিরন্ময় বলল—‘আহা পণ্ডিমতশাই যদি দেখতেন তুই এখন হসপিটাল পরিচালনা করছিস, তাহলে নামটা আবার পাল্টে দিতেন, নিশ্চয় আদর করে ডাকতেন হিতব্রত।’

—‘হিরুকে পণ্ডিতমশাই খুব ভালোবাসতেন। সবাই-ই ভালোবাসতেন। পড়াশোনায় আমরা সবাই মোটামুটি ভাল ছিলুম। কিন্তু হিরুর ওপর যেন পক্ষপাতটা একটু বেশি হয়ে যেত, কেন রে হিরু?’ মহী বলল।

হিরন্ময় বলল—‘অন্যদের কথা বলতে পারব না তবে পণ্ডিতমশায়ের কথাটা ভাল মনে আছে। একদিন ক্লাসে টাস্‌ক দিয়েছেন। টাস্‌ক শেষ করে চুপিচুপি একটা বই খুলে বসেছি। এদিকে পণ্ডিতমশাই তো সারা ক্লাস টহল দিতে আরম্ভ করেছেন। কখন আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। তারপরেই হুংকার—‘তাই বলি এ বৎসের এত মনোযোগ কেন? গল্পগ্রন্থ পড়া হচ্ছে? টাস্‌ক কী হল? ভাষান্তর করতে দিয়েছিলাম কী হল? আমি বললুম, ‘হয়ে গেছে সার’, বলে খাতাটা এগিয়ে দিলুম। তখন বললেন—‘দেখি গল্পগ্রন্থটি কী? নিশ্চয় ‘দস্যু মোহন’।

সীতাপতি বলল—‘হ্যাঁ হ্যাঁ ওই সিরিজের বইগুলো পকেটের মধ্যে দিব্যি ঢুকে যেত। অনেকেই ক্যারি করত। পণ্ডিতমশাই হাড়ে-চটা ছিলেন ওই সিরিজের ওপর। বলতেন, “একে অশ্লীল, তায় ভাষার উপর সামান্যতম দখলও নাই। এগুলি পড়লে তোরা গুষ্টির পিণ্ডি শিখবি। যা শিখেছিস তা-ও ভুলে যাবি।”—তা তারপর?’

হিরন্ময় বলল—‘তারপর আর কী? দেখলেন গীতা মানে শ্রীমদ্ভগবদগীতা দ্বিতীয় অধ্যায় খুলে বসে আছি। বললেন—“গীতা পড়ছিস তুই? গীতা পড়ছিস? বৎস?”

বললাম—‘হ্যাঁ সার বাড়িতে পড়ছিলাম, এতে ভাল লাগছিল তাই ছাড়তে পারছিলাম না। স্কুলে নিয়ে এলাম। অবসর সময়ে পড়ব বলে। পণ্ডিতমশাই বললেন—“বাষট্টি তেষট্টি শ্লোক পর্যন্ত তোর পড়া হয়ে গেছে? বুঝতে পারছিস?”

‘ধ্যায়তো বিষয়ান পুংসঃ সঙ্গস্তেযুপজায়তে।

সঙ্গাৎ সংজায়তে কামঃ কামাৎ

ক্রোধোহভিজায়তে!

ক্রোধাদ্ভবতি সম্মোহঃ সম্মোহাৎ স্মৃতিবিভ্রমঃ।

স্মৃতিভ্রংশাদ্‌ বুদ্ধিনাশ বুদ্ধিনাশাৎ প্রণশ্যতি!

বুঝলি? সম্মোহ মানেও কার্যাকার্য বিষয়ে বিভ্রম বুদ্ধিনাশ অর্থও তাই। দুটির পার্থক্য অনুধাবন করতে পেরেছিস?’

অমিত বলল—‘হ্যাঁ হ্যাঁ। তারপর শংকর, তিলক, পাতঞ্জল যোগসূত্র কত কী বলতে আরম্ভ করলেন, সে এক বিরাট লেকচার। আর আমরা তোকে অভিশাপ দিতে লাগলুম।’

সীতাপতি বলল—‘না, না, পুরোটা অভিশাপ মোটেই দিইনি। আমাদের ট্বানস্লেশন আর শেষ করতে হল না। এইটে লাভের দিক ছিল।’

মহী হঠাৎ চিন্তাকুল স্বরে বলল—‘হিরু, তোর মনে আছে “সম্মোহ” আর “বুদ্ধিনাশ” এর কী পার্থক্য পণ্ডিতমশাই করেছিলেন?’

হিরু বলল—‘মনে আছে। সম্মোহের অর্থ করেছিলেন কোনও বিষয়ে অত্যধিক ঝোঁক, আর বুদ্ধিনাশ মানে নিশ্চয়াত্মিকা মনোবৃত্তি, অর্ঘাৎ কোনও ঘটনা ঘটলে তাতে ঠিক কীভাবে রি-অ্যাক্ট করতে হবে এই জ্ঞান লোপ পাওয়া।’

মহীতোষ বলল—‘ঠিক বুঝলুম না।’

—‘ধর তোর খুব রাগ হল কারও ওপর, তাকে তোর খুন করতে ইচ্ছে হল, এই যে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য ঝোঁক এটাকেই উনি সম্মোহ বলেছিলেন। রাগের বশে খুন করবার ঝোঁক চাপল অমনি তোর কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেল, মহাজনরা এ বিষয়ে কে কী বলেছেন সব ভুলে গেলি, স্মৃতিবিভ্রম হল, তারপর বুদ্ধি যে তোকে কার্য অকার্য বিষয়ে জ্ঞান দেয় সেইটি লোপ পেল এই হল বুদ্ধিনাশ। খুনটা করে ফেললি। তারপর ফাঁসি অর্থাৎ প্রণশ্যতি।’

অমিত বলল—‘হিরু আর মহী তোরা দুজনে মিলে তো দেখছি পণ্ডিতমশায়ের টোলে গীতার ক্লাস আরম্ভ করে দিলি রে।’

মহীতোষ বলল—‘উই হ্যাভ রিচ্‌ড দ্যাট স্টেজ অমু, অস্বীকার করবার চেষ্টা করে তো লাভ নেই।’

মহীতোষের মেজাজ পাল্টে যাচ্ছে দেখে সীতাপতি তাড়াতাড়ি বলল—‘তা হিরু, এই-ই তোর ট্রেড সিক্রেট! এই করেই তুই পণ্ডিতমশায়ের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলি? পুরো ধাপ্পাবাজি?’

হিরন্ময় হেসে বলল—‘পুরোটা ধাপ্পা বলা কি ঠিক হবে? গীতাটা ক্লাসে নিয়ে গিয়ে খুলে বসাটা ধাপ্পা হতে পারে, কিন্তু তোরা তো জানিস আমাদের বাড়িতে সংস্কৃতর চর্চা ছিল, জ্যাঠামশাই সংস্কৃতের পণ্ডিত ছিলেন, বাবার অন্য পেশা হলেও সংস্কৃত কাব্য-শাস্ত্র এসবের ডিগ্রি বা উপাধি ছিল, দুজনের মধ্যে অনবরত এসব বিষয়ে আলোচনা তর্কাতর্কি হত, তার থেকেই অনেকটা তোতা পাখির মতো শেখা ছিল আমার। কাজ-চলা গোছের আর কি! কিন্তু সীতু তুইও তো মাস্টারমশাইদের খুব প্রিয়পাত্র ছিলি। তোর ট্রেড সিক্রেটটা কী? চেহারা? এখন অবশ্য তুই খুব সুপুরুষ হয়েছিস তখন কিন্তু স্কুলে নাটক হলেই তোকে মেয়ে সাজতে হত। প্রথম ক্লাসে এসেই পণ্ডিতমশাই বলেছিলেন—“কী বৎস ত্বকটি তো খুবই মসৃণ দেখছি, তুবরক হলেও হতে পাড়ো, দেখো আবার ফলম ফলে ফলানি নয় তো? ফল বলতে উনি কী মিন করতে চেয়েছিলেন বুঝেছিস তো?’

সীতাপতি বলল—‘কেন বুঝব না? মাকাল ফল।’

—‘আর তুবরকটা কী?’ —অমিত বলল

—‘তুঘলকের ভাই-টাই না কি?’ চারবন্ধুই হেসে উঠল। মহীতোষ বলল—‘আরে তুবরক মানে মাকুন্দ।’

সীতাপতি করুণ মুখ করে গালে হাত বুলিয়ে বলল—‘পণ্ডিতমশায়ের ভবিষ্যদ্বাণী পার্শিয়ালি ফলে গেছে মনে হচ্ছে। কত কামিয়ে কামিয়ে যে সামান্য একটু দাড়ি গোঁফ বার করতে পেরেছি, তা যদি জানতিস। স্কুল ফাইনাল হয়ে গেল, তখনও গোঁফ গজাচ্ছে না দেখে, রোজ ক্ষুর টানতে শুরু করলুম। না হলে কলেজেও সীতা-সাবিত্রী নামটা চালু হয়ে যেত।’

—‘তা সে যাই হোক, তুমি মাস্টারমশাইদের ব্লু-আইড-বয় হয়েছিলে কোন ধাপ্পা দিয়ে হে?’ অমিত বলল।

মিটিমিটি হেসে সীতাপতি বলল—‘তার সঙ্গে আমার পড়াশোনা বা স্কুল-সহবতের কোনও সম্পর্ক নেই।’

—‘তবে?’—অসীমাংশু বলল।

—আমার বাবা নাম করা কবিরাজ ছিলেন, মনে আছে? মাস্টারমশাইদের কারও অসুখ করলেই আমাকে এসে ধরতেন চুপিচুপি। আমিও তাঁদের বাবার কাছে নিয়ে যেতুম। দক্ষিণা দিতে গেলে, বাবা হাতজোড় করে জিভ কেটে বলতেন—‘আপনি আমার পুত্রের আচার্য। আপনার কাছ থেকে দক্ষিণা নিলে আমার নরকেও স্থান হবে না।’

—‘তাই বলো,’ অমিতব্রত বলল—‘তুমি ডুইব্যা ডুইব্যা জল খাও।’ সবাই হাসতে লাগল।

এই সময়ে মস্ত বড় ট্রেতে পাঁচ পাত্র সুদর্শন পানীয় এবং তার সঙ্গে প্রচুর বাগদা চিংড়ি ও চিকেন ভাজা নিয়ে বেয়ারা উপস্থিত হল।

‘হুর রে—’ অমিত বলে উঠল—‘বকেবকে গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, ঠিক সময়ে এসে হাজির হয়েছে।’

‘কী বস্তু দিয়েছে রে?’—সীতাপতি বলল। মহীতোষ বলল—‘চিন্তার কিছু নেই, আমার গিন্নি আর অমিতের গিন্নি মিলে নিশ্চয়ই এক দারুণ ককটেল বানিয়েছে। পরিতৃপ্ত করবে, কিন্তু হৃদয়কে উত্তেজিত করবে না, মস্তিষ্ককেও বিভ্রান্ত করবে না। অর্থাৎ নিদার সম্মোহ নর বুদ্ধিনাশ। চিয়ার্স।’ প্রথম গ্লাসটি তিনিই তুলে নিলেন।

এঁদের মধ্যে একমাত্র সীতাপতিই দুধের সঙ্গে ব্র্যান্ডি ছাড়া আর কোনও রকম মাদক স্পর্শ করেন না। অনেক জটিল, সূক্ষ্ম অপারেশন করতে হয়। যখন তখন নার্সিংহোমে ডাক পড়ে। তাঁর এসব খেলে চলে না। খান না বলে সহজেই তিনি কাতও হন। আজকের দিনটা বিশেষ দিন বলেই এই ব্যতিক্রম।

অমিত বলল—‘তুই জাস্ট আমাদের কমপ্যানি দে। নইলে বেহেড হয়ে যাবি।’

সীতাপতি বলল—‘তাহলে দাঁড়া আমাদের ইমপর্টাণ্ট কাজটা আগে সেরে ফেলি।’ সে উঠে গেল। কেয়ার-টেকারের সঙ্গে ফিসফিস করে কী সব আলোচনা করল, তারপর একটি বড় শোবার ঘরে তার হাত-ব্যাগ শুধু ঢুকে কিছুক্ষণ পরে বেরিয়ে এল। এসে সে একটু ইতস্তত করে, পড়ে থাকা গ্লাসটি তুলে নিল। প্রথম চুমুক দিয়েই সীতাপতি বলল—‘চমৎকার খেতে হয়েছে তো! এই ককটেলের কেমিস্ট্রিটা কী? হ্যাঁরে মহী!’

মহী বলল—‘বাব্বা। গিন্নিদের কেমিস্ট্রি! শালা, তুমিই ডাক্তার হয়ে বুঝতে পারছ না। অসীমও চুপ মেরে রয়েছে, আর আমি সায়েন্সের ধারে কাছেও কোনও দিন যাইনি, আমি বুঝতে পারব!’ সীতু দেখল মহীর গ্লাসের পানীয় অনেক কমে গেছে। সীতু বলল—‘এই মহী, খালি পেটে খাসনি, কিছু খা আগে!’

মহী বলল—‘আমার গিন্নি জানে, তুই ভী জানিস চিংড়িতে আমার অ্যালার্জি আছে। শেল অ্যালার্জি। কাঁকড়া, ডিম কিস্যু খেতে পারি না। তা সত্ত্বেও তোর পেশেন্ট আর আমার গিন্নি মিলে চিংড়ির চাট সাপ্লাই করেছে। ষড়যন্ত্রটা কি আমি ধরতে পারিনি ভাবছিস!’

এই সময়ে বেয়ারা আরেক ট্রে ভর্তি পানীয় নিয়ে এল। যাদের যাদের গ্লাস খালি হয়েছে, সেগুলো তুলে নিয়ে গেল।

সীতু বলল—‘চিকেনও তো রয়েছে। খা। না! খা!’

মহী বলল—‘ধুর। ও চিকেনও শালা ডিমে ডোবানো। তোদের সবার কথা ভাবল আমার বউ, খালি আমার কথাটাই ভাবল না।’

অসীম খান দুই চিংড়ি মুখের মধ্যে চালান দিয়ে গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে বলল—‘তোরা সারাক্ষণ সরস্বতী ইস্কুলের মাস্টারদের বদনাম করছিলি, আমি কিচ্ছুটি বলিনি, তোরা ছলে-বলে বললি আমার ওপর পার্শিয়ালিটি হত, তখনও কিছু বলিনি। দেখছিলুম শেষ পর্যন্ত কী হয়, হেড সার মহীর খাতা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন, বললি, তখনও কিছু বলিনি, পণ্ডিতমশাই অমিতের নাম বদলে অহিত দিয়েছিলেন, হিরু পণ্ডিতমশাইকে ধাপ্পা দিয়েছিল কনফেস করল, তো তখনও আমি শেষ পর্যন্ত শুনে যাচ্ছি, কিন্তু সীতুর কথাটা শুনে আমার মনে বড্ড দুঃখু হচ্ছে রে!’

সীতু বলল, ‘কেন? আমি এমন কী বলেছি যাতে তোর দুঃখ হবে?’

—‘তুই হিন্ট দিলি না গরিব মাস্টারমশাইদের বিনি পয়সায় চিকিৎসার লোভ দেখিয়ে তুই হাত করতিস! বেশি নম্বর আদায় করতিস?’

সীতু বলল, ‘বেশি নম্বর আদায় করতুম আবার কবে বললুম। ’

‘তুই বলিসনি কিন্তু আমি ধরে ফেলেছি। ফাইনাল পরীক্ষায় এমন গাব্বু খেলি কেন রে? ক্লাসে বরাবর সেকেন্ড প্লেস পেতিস। আমি ফার্স্ট, তুই সেকেন্ড, হিরু থার্ড, মহী ফোর্থ আর অমু ফিফথ্‌। প্রায় সব সময়েই এই অর্ডার আসত। অথচ ফাইনালে তুই স্কলারশিপ শুদ্ধু পেলি না। খালি সায়েন্সে লেটার।’

সীতু বলল—‘সে আমি আমার ঠিক লাইনটা পাইনি তাই। ডাক্তারিতে গিয়ে প্রথম থেকেই শাইন করেছি। তা ছাড়া শুধু সায়েন্স কেন, জোগ্রাফি আর সংস্কৃতেও আমার প্রায় লেটারই ছিল।’

—‘সে তুই পণ্ডিতমশাইকে বাড়িতে রেখে সব আনসার, সব ট্র্যাসস্লেশন করিয়ে নিতিস। মেমরিটা তোর বরাবরই ভাল। আর আঁকার হাতটাও ছিল, তাই কোনওক্রমে সংস্কৃত আর ভূগোলের মার্কস তুলেছিলি। বড়লোক কবরেজের ছেলে। তোর আর ভাবনা কী!’

সীতু হেসে বলল—‘তো ঠিক আছে। বড়লোকের ছেলে আমার কোনও ভাবনা ছিল না, তা অ্যাদ্দিন পরে তুই সেসব কথা মনে করে দুঃখু পাচ্ছিস কেন? তা ছাড়া তোর ফার্স্ট হওয়া তো আমি কোনদিনই আটকাতে পারিনি, অঙ্কের বনোয়ারিবাবুকে মাস্টারমশাই রেখেও।’

অসীম বলল—‘সে বনোয়ারিবাবু ছিলেন ইনকরাপ্টিবল। অসুখ করলেই নিজে নিজে হোমিওপ্যাথিক গুলি খেয়ে ভাল হয়ে যেতেন। নিজের জন্যে আমি কোনদিন কান্নাকাটি করিনি রে। হিরু, মহী এরাও তো আমার বন্ধু। তোর জন্যে ওরা কোনদিন স্কুলের প্রাইজগুলো পেল না। সেকেন্ড প্লেসের পর আর তো প্রাইজ দিত না! ওদের কথা মনে করে কান্না পায়, সত্যি বলছি রে মহী, তুই জজ হয়েছিল বটে। কত লোকের হাতে মাথা কাটচিস, কিন্তু তোর ইস্কুলের একটা প্রাইজ নেই। মাইরি তুই ছেলে-মেয়ে-বউয়ের কাছে মুখ দেখাবি কী করে?’

মহী হাতের একটা মাছি তাড়ানোর মতো ভঙ্গি করে বলল—‘ও সব যেতে দে। যেতে দে। পুরনো কাসুন্দি কে ঘাঁটে! এখন যদি সীতুর এগেনস্টে কোনও কেস আমার কোর্টে আসে তো দেখে নেব ব্যাটাকে। কথা দিচ্চি তোকে, অসীম, কথা দিচ্চি, এই তোর মাথায় হাত দিয়ে দিব্বি গাললুম। তুই মাইরি চোখ মুচে ফ্যাল।’

অসীম বলল ‘আরও দুক্ষু আচে রে। দুক্ষে আজ বুকখানা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্চে। তোর মনে আচে ওই সব মাস্টারমশাই প্রত্যেক বছর যাঁরা কমপিট করা স্কলারশিপ পাওয়া ছাত্তর বার করতেন তাঁরা সব কী গরিব ছিলেন! অকিঞ্চনধন ভট্টাচায্যি, প্রফুল্লকমল চম্পটি, অম্বিকাসাধন তরফদার, বিজনবিহারী চক্কোত্তি! সব সমাসবদ্ধ অদ্ভুত অদ্ভুত বড় বড় নাম। পড়াতেন দারুণ, খাটতেন কী! তারপর টুইশানি, টুইশানি, টুইশানি। জামাকাপড় আধময়লা, মুখে খামচা খামচা দাড়ি, আমরা সবাই আজ কত বড় হইচি। কিন্তু দ্যাখ, গুরু দক্ষিণা দিইনি। কেউ একবারও মনে করি না। অথচ গুরুকুলের যুগে যদি জন্মাতাম তাহলে গুরুদক্ষিণার জন্যে গুরুদেবকে সন্তুষ্ট করবার জন্যে কী না করতে হত। জলের পাশে আল হয়ে শুয়ে থাকা, উপোস করে গরু-চরানো, আকাশ-পাতাল ঢুঁড়ে গুরুর বউয়ের জন্যে কানবালা এনে দেওয়া…। বল!’

অমু এই সময়ে বলে উঠল—‘তা ছাড়া পাশ করে বেরোবার পরে আমাদের একটা সংবর্ধনা দিয়েছিলেন মাস্টারমশাইরা তোদের মনে আচে? সরোজশোভনবাবু ভাল বক্তৃতা দিতে পারতেন। উনি বললেন, পণ্ডিতমশাই বললেন, হেড স্যার বললেন। সবাই বললেন—“আমরা তোমাদের এতদিন যত তিরস্কার করেছি, গাঁট্টা মেরেছি, কু-বাক্য বলেছি—সবই ভুলে যাও বাবারা। সবই তোমাদের ভালর জন্য। মঙ্গলের জন্য। যাতে বিপথে না যাও। মন নিজের বিষয়ে স্থির রাখতে পারো। আরও পারদর্শিতা লাভ করো। সেই জন্য।” তোরা বলছিলি না এখন দেখলে পণ্ডিতমশাই আমায় হিতব্রত বলতেন, মনে পড়ে গেল, সত্যি সত্যিই মাথার টিকি দুলিয়ে, আমায় আদর করে উনি বললেন—“তোমাকে শান্ত করবার জন্যই ওরূপ নামকরণ করেছিলাম। দুরন্ত ছেলেরা সাধারণত অদ্ভুতকর্মা হয়, পৃথিবীর আপামর সাধারণের মঙ্গল করে, উদাহরণ শ্রীচৈতন্য। আজ থেকে তোমার নাম আমার কাছে হল হিতব্রত।”

এই সময়ে বেয়ারা তৃতীয়বার পানীয় রেখে গেল। হিরু খেলে একটু গুম মেরে যায়। সে এই সময়ে একটু জড়ানো স্বরে বলল—‘তাহলে তো অমু তোর অন্তত কোনও দুঃখু থাকতে পারে না। চৈতন্যের মতো না হলেও তুই মানুষের হিত সাধন করবার জন্যে কী দৌড়োদৌড়িটাই না করছিস! আমরা তো দেখতে পাচ্চি। তুই সত্যি-সত্যিই হিতব্রত হইচিস। পণ্ডিতমশাই কী প্রফেট ট্রফেট ছিলেন নাকি রে?’

এই সময়ে অমু হঠাৎ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

অসীম বলল—‘কাঁদিস নে অমু, কাঁদিস নে, তোরও বুকটা ফেটে যাচ্চে আমি টের পাচ্চি। আমি তোর সমবেথী। বিশ্বাস কর।’

অমু ফোঁপানির মাঝে মাঝে বললে—‘পণ্ডিতমশাই প্রফেট ছিলেন ঠিকই। কিন্তু ভাই ঝোঁকের মাথায়, আমার কাজ-কম্মো দেখে যে নাম দিয়েছিলেন, বোধহয় সেটাই আমার সম্পর্কে সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী রে—অহিতব্রত। আমি অহিতব্রত।’

—‘কেন এমন কথা বলছিস? এতক্ষণে সীতাপতির জিভও জড়িয়ে এসেছে। সে মাঝে মাঝে ভেতরের একটা অদম্য আবেগে খিলখিল করে হেসে উঠছে। কিন্তু অমুর ফোঁপানি যেন প্রায় কান্নায় পরিণত হয়েছে। সে বলল—‘পণ্ডিতমশায়ের পদবীটা কী ছিল যেন রে?’

মহী বলল—‘মিশ্র। ভবানীপ্রসাদ মিশ্র।’

—‘যাঃ, তাহলে হয়ে গেল’ বলে অমু হু হু করে কেঁদে ফেলল। বন্ধুদের সাধ্যসাধনায় সে মুখ খুলল, বলল—‘জানিস তো সাহানগরে একটা ফ্ল্যাট করেছি। প্রোমোটারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে গেল। জমিটা অনেক কাল ধরে পড়েছিল। প্রোমোটার বেটা মাটিতে ভাত খেত এমনি অবস্থা। কোথা থেকে সি এম ডি-এর কনট্র্যাক্ট যোগাড় করেছে, তো কী বলব ভাই সেই সি এম ডি এর মালেই পুরো মাল্টিস্টোরিডখানা উঠে গেল। আমার ফর্টি পার্সেন্ট শেয়ার। তো চল্লিশখানা ফ্ল্যাটের ষোলোআনাই আমার। বেচে মোটা লাভ করেচি ভাই, তা লাস্টখানা বেচলুম—এই মাস কয়েক আগে এক মাস্টারমশাইকে। নাম শিবানীপ্রসাদ মিশ্র।’

বলে অমু হু হু করে কেঁদে উঠল।

—‘তো কাঁদছিস কেন? ভাল করেচিস তো?’

—‘না রে এ নির্ঘাত সেই পণ্ডিতমশায়ের ছেলে। টিকিফিকি নেই বটে শার্ট-প্যান্ট পরা। কিন্তু নিপাট ভালমানুষ। কেমন নিরীহ-নিরীহ। নইলে ভাল করে না দেখে শুনেই ছ’ লাখ টাকা গ্যাঁট-খর্চা করে ওই ফ্ল্যাট কিনে নিলে?’

—‘কেন কী ফ্ল্যাট? কী ব্যাপার বল দিকিনি?’ সীতু ততক্ষণে চেপে ধরেছে।

অমু বলল—‘আরে তিনতলার বেশি তোলবার পার্মিশান ছিল না আমাদের। প্ল্যানও স্যাংশন হয়নি, তা পোদ্দার বলে ওই লোকটা বললে—সব ঠিক সামলে নেবে, আমিও রাজি হয়ে গেলুম। এখন দ্যাখ, ওই মিশ্রর ফ্ল্যাটটা পড়েছে চারতলায়। আমার খুড়তুত ভাইয়ের নামে জমি, সে তো কানাডায় সেটলড। জমি বিক্রির টাকা বলে তাকে থোক কিছু ধরিয়ে দিয়েছিলুম গতবার। আমাকে খুউব বিশ্বাস করে। পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি দিয়ে দিয়েছিল। আর বোধহয় আসবে না। এবারেই তো এসেছিল দশ বছর পর। উ হু হু হু। লোকটা আমাদেরই বয়সী হবে। বললে নবকৃষ্ণ স্ট্রিটের পৈতৃক বাড়ি-বেচা টাকা! সীতু তুই তো পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে পড়তিস। কোথায় থাকতেন জানিস?’

সীতু বললে—‘উনি তো আমার বাড়ি এসে পড়িয়ে যেতেন। কোনওদিন ওঁর বাড়ি যাইনি তো! তবে কাচাকাচি থাকতেন নিশ্চয়ই। হতেও পারে নবকেষ্ট স্ট্রিট! কিম্বা লাহা কলোনি!’

মহী বললে—‘কাঁদিস নে অমু কাঁদিস নে। দেখ চেষ্টা-চরিত্তির করে ওই মিশ্র না শর্মাকে টাকাটা ফিরিয়ে দিয়ে যদি এখনও বাঁচাতে পারিস। কিন্তু আমি যা করিচি তার আর চারা নেই রে অমু চারা নেই!’

—‘তুই আবার কী করলি? তুই বলে সাক্ষাৎ মহাধিকরণের লোক। দেশের জুডিশিয়ারি তোর হাতে!’ সীতু বলল।

মহী বলল—‘জুডিশিয়ারি! হায় হায় রে অমু, হায় রে সীতু আমরা হলুম গিয়ে মকিং বার্ড, জুডিশিয়ারির মকিং বার্ড। যখন ব্যারিস্টারি করতুম তখন সাংঘাতিক এক গৃহবধূ-হত্যার মামলায় আসামী পক্ষে ছিলুম মনে আচে?’

হিরু বলল—‘হ্যাঁ, হ্যাঁ বিখ্যাত, ইনফ্লুয়েনশিয়াল লোক, তুই তো কেস ড্রিবল করে করে ঠিক গোল মেরে দিলি। আমরা সবাই তাজ্জব হয়ে গেছিলাম।’

মহী বলল—‘আসল খুনির হাত থেকে বন্দুকের বারুদের দাগ আমি দাঁড়িয়ে থেকে তোলাই। খুনের দায়ে তার ভাই এখনও যাবজ্জীবন জেল খাটচে।’

—‘বারুদের দাগ তুলে ফেললি? সে সব করা যায়!’

—‘ফরেনসিক টেস্টে স-ব ধরা যায়। তুলে ফেলাও যায়।’

হিরু সংক্ষেপে বলল—‘তোদের ল’ এর লাইন বড় বেয়াড়া।’

—‘আরও আচে, আরও আচে’—মহী ডুকরে উঠল—এখন আর কাউকে প্রশ্ন করতে হচ্ছে না, মহী নিজের পেছনে সরে যাওয়া কোঁকড়ানো চুল আঁকড়ে ধরে রললে—‘ঘুষুড়িতে গণ ধষ্ষণ‌, হয়েচিল মনে আছে? এনকোয়ারি কমিশন বসাল গম্নেন্ট। বাস আমাকে বসিয়ে দিলে চেয়ারে। সব কটা বাঞ্চোৎকে আইডেনটিফাই কত্তে পেরেছিলুম, ছেড়ে দিলুম রে ছেড়ে দিলুম। অথচ মেয়েগুলো আমাকে ‘বাবা’ বলে ডেকেচিল। সে কী কান্না, অত্যেচারের চিন্ন। কী হতাশা আর ভয় মেয়েগুলোর। ধারণা করতে পারবি না। বললে—‘এই দেখুন বাবা মাটির দেয়াল, টিনের দরোজা আগড় লাগে না, এক লাতিতে খুলে যায়। একন যদি শাস্তি না হয়, আবার এমনি করবে। সারাদিন খেটেখুটে ভয়ে রাতে ঘুমোতে পারিনে। তাদের আশ্বাস দিয়েছিলুম—ধরবই, শাস্তি দেবোই। দিইনি। দিইনি রে…’ বলে মহী মুখখানাকে নিচু করে ফেলল।

—‘কেন? দিসনি কেন? পলিটিকাল প্রেশার নিশ্চয়ই।’—হিরু বলল।

—‘সোজাসুজি কেউ কিচু বলেনি। অ্যান্ড জুডিশিয়ারি শুড অলওয়েজ বি ইন্ডিপেন্ডেন্ট অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। কেউ কিচু বলেনি। খালি দু’দলের দুই মস্তান আমার দিকে চেয়েছিল। একজন চোখের কোণ দিয়ে, আর একজন সোজাসুজি। ওরে বাবা সে কী চাউনি রে! আমি সে চাউনি ফিরিয়ে দিতে পারিনি। জজ হয়েও।’ মহী সোফার ওপর দুদিকে দু’ঠ্যাঙ ছড়িয়ে সোফার পিঠে হেলান দিয়ে কান্নার স্বরে বলতে লাগল—‘আয়্যাম এ ফেইলিওর, এ ড্যামড্‌ লায়ার, ডরপোক কাঁহাকা,’—বলে সে নিজেই নিজের দুগালে থাপ্পড় মারতে লাগল।

সীতু বললে—‘তাহলে তোরা আমার গালেও চড় মার। আরে বাবা আমার নার্সিংহোম দাঁড়িয়ে আচে কীসের ওপর! বিলেত থেকে যখন ফিরলুম বাবাও গয়া। জ্যাঠাও গয়া। বোনেদের বিয়ে দিতে সংসার ফোঁপরা। বিধবা মা, জেঠি আর আমি। পসার জমচে না। খালি বিলিতি ডিগ্রি হলেই কি আর হয় ভাই। পেট্রল চাই। পয়সা চাই। সে সময়ে অ্যাবর্শন লিগালাইজড হয়নি। কত লোকের পাপ যে খালাস করেছি এই দু’হাতে কী বলব। সব শালা-শালিকে আমার চেনা হয়ে গেচে। বিরাট বিরাট বড়লোকের সব বউ মেয়ে, এক একজন যা অফার করত না শুনলে হাঁ হয়ে যাবি। কতগুলো মরেওচে এই হাতে। দুক্ষু হয় একটা মেয়ের জন্যে। ভদ্রঘরের মেয়ে। অবস্থার পাকে পড়ে কলগার্ল হয়েচে, তো গেচে ফেঁসে। আসামি তো তখন ভাগলবা। অন্য স্টেটে একেবারে। গরিব মেয়ে, কে তার খর্চা দেবে? অ্যাডভান্সড স্টেজ, আমার হাতে পায়ে ধরলে—দু’হাতে দু’গাছা সোনার চুড়ি ছিল, খুলে দিলে, তখন তাকে টেবিলে তুললুম। মেয়েটা মরে গেল। সে কী বিপদ। মার্ডার-কেসে পড়ে যাই আর কি! জোর করে ঠিকানাটা নিয়েছিলুম। শুদ্ধু বাপ-মা, আর ভাই, মা প্যারালিটিক, বাপ হেঁপো রুগি, চুন গরিব। গিয়ে খুব অ্যাগ্রেসিভ হয়ে গেলুম। নিজের গলদ থাকলে অফেন্সে খেলতে হয়। জানিস তো? তো দুজনে এইসা ভয় পেয়ে গেল যে চোখের জল গিলে মেয়ের লাশ নিয়ে এল। মেয়েটার মুখখানা এখনও মাঝে মাঝে মনে পড়ে। গরিব-গুরবোর ঘর কিন্তু আফটার অল প্রথম যৌবন, ভারি ডাঁশা ছিল, মুখে খুব সুন্দর একটা আলগা শ্ৰী। আরও কেউ কেউ মরেচে। কিন্তু এ মেয়েটার জন্যে আমার বড্ড কষ্ট হত!’

হিরু বলল—‘সোনার চুড়ি দুটো ফেরত দিয়েছিলি?’

—‘এই যাঃ। দেওয়া হয়নি তো!’ সীতু মাথায় হাত দিয়ে বসল। ‘কত মেয়ে ওরকম দিত। দামি দামি গয়নার পাহাড়ের সঙ্গে ওই ক্ষয়া চুড়িগুলোও বিক্‌কিরি হয়ে গেছে রে! উচিত ছিল ফেরত দেওয়া। উচিত ছিল, উচিত ছিল, উচিত ছিল’… বলতে বলতে সীতু হাসিকান্নার মাঝামাঝি একটা কীরকম অদ্ভুত আওয়াজ করে অবশেষে কেঁদে উঠল হাউহাউ করে।

—‘মাই সাকসেস-স্টোরি স্ট্যান্ডস অন ক্রাইম, অন সিন, মহী তুই ইচ্ছে হলে আমায় ফাঁসি দিতে পারিস।’

মহী অনেকক্ষণ পরে মুখ তুলে বলল—‘তাহলে তোরা দুটোতে অসীম আর হিরু তোরাই শেষ পর্যন্ত মাস্টারমশাইদের আশা পুন্ন করতে পাল্লি ভাই। আমরা হেরে গেছি। একদম গো-হারান হেরে গেছি। জীবনের আসল পরীক্ষাগুলোয়।’

অসীম শূন্য চোখে চারদিকে চেয়ে বলল—‘আমার অপরাধগুলো একটু টেকনিকাল। তোরা ঠিক বুঝতে পারবি না।’

—‘লে-ম্যানদের বোঝাবার মতো করেই বল।’ অমু বলল।

—‘তোরা তো জানিস কিছুদিন আই আই টি খড়গপুরে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে ছিলুম। সেই সময়ে ডিপার্টমেন্টাল হেড ছিলেন ডক্টর এ কে আচার্যি। উনি আমেরিকা থেকে নতুন কম্পুটার সায়েন্স শিখে এসেছেন। সেই জন্যেই ওঁকে পাঠানো হয়। ডিপার্টমেন্টে উনি কম্পুটার তো তৈরি করছিলেনই, সেইসঙ্গে কতকগুলো সাঙ্ঘাতিক ইমপ্রুভমেন্ট করার চিন্তা করছিলেন। আজ থেকে তিরিশ-বত্রিশ বছর আগেকার কথা। আপনভোলা টাইপের লোক ছিলেন। ফিজিক্স, ম্যাথমেটিকস-এ মাস্টার। কীভাবে কী করবার চেষ্টা করছেন কিছু কিছু বলতেন। অন্য কেউ ধরতে পারত না। আমি পারতুম। তারপর একদিন জানতে পারলুম—উনি পেপার লিখছেন। ল্যাবে ওঁর কেজের চাবি যোগাড় করলুম। নোটসগুলো বার করলুম। তারপর একটু খেটেখুটে পেপারটা তৈরি করে একেবারে জার্মানে ট্রানস্লেট করে পাঠিয়ে দিলুম। বেরিয়ে যাবার পরে ডক্টর আচার্যি যখন পেপারটার কথা জানতে পারলেন তখন বেশ হই-চই পড়ে গেছে—এত আলাভোলা যে বুঝতে পর্যন্ত পারেননি আমি ওঁর নোটসগুলো ব্যবহার করেই পেপারটা তৈরি করেছি। হি ওয়াজ দা ফার্স্ট ম্যান টু কংগ্রাচুলেট মি, উনি বললেন—‘আয়্যাম প্রাউড অফ ইউ মাই বয়। আমি এই ব্যাপারটাই ভাবছিলুম। তুমি আমার আগেই ভেবে ফেললে? বাঃ। অফ কোর্স আমি একটু ডিস্যাপয়েন্টেড। কিন্তু বিজ্ঞানের জগতে এ আখচার হচ্ছে, আফটার অল জগদীশচন্দ্রের মত তো আমার ডিস্যাপয়েন্টমেন্ট নয়, অ্যান্ড ইউ আর মাই কলিগ অ্যান্ড স্টুডেন্ট!’ তো তারপর থেকেই আমার ইন্টারন্যাশনাল স্বীকৃতি।’

মহী বলল—‘হিরু, তুই যে বড় চুপ মেরে আচিস তখন থেকে। তুই কী ব্যাটা ধোয়া তুলসীপাতা, নাকি?’

হিরু তরল জিনিস খেলেই গুম হয়ে যায়। মনের কথাগুলো মনের ওপর ভেসে ওঠে, সেগুলোই তাকে গুম করে দেয়। সে বলল—‘আমি কিচু করিনি বিশ্বাস কর। আমি ধোয়া তুলসীপাতা সত্যিই বলচি।’

তখন অসীম চোখ সরু করে বলল—‘তুই হঠাৎ প্রেসিডিন্সি থেকে ইউনিভার্সিটি কেন রে? এখানেও প্রোফেসর, ওখানেও প্রোফেসর। দেয়ার ইজ সাম মিস্ট্রি।’

হিরুর মুখটা কালো হয়ে গেল। সে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল, বলল—‘বলব, কিন্তু খবদ্দার তোরা কেউ আমার মুখ দেখতে পাবি না।’ বন্ধুদের দিকে পেছন ফিরে সে বলল—‘তোরা ভগবান, ভূত, তন্ত্র, মন্ত্র, জ্যোতিষ, সামুদ্রিক এসব বিশ্বাস করিস কি না জানি না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি। আমার মাথার ওপর বুড়ো প্রোফেসর দিনের পর দিন বসেই আচে, বসেই আছে। তাকে ট্রান্সফারও করবে না, কিছুই না। এক্সটেনশন নিয়ে চলেচে। বেড়াতে গিয়ে একবার দেখা হয় গেল এক তান্ত্রিকের সঙ্গে, তা তার কিছু ক্ষমতা নিজের চোখেই দেখলুম। বললে—“মনে কোনও দুক্ষু আচে মনে হচ্চে, যেন আশাটি মুকুল অবস্থা থেকেই ঝরে ঝরে যাচ্চে!” বললুম কী করে ধরলেন বাবা। ধরলেন যদি তো উপায় করে দিন। তান্ত্রিক বললে—“দুটো সাদা কালো কচি পাঁঠা লাগবে আর দশ হাজার টাকা। তখন আমি মরিয়া। দিলুম সব যোগাড় করে। বলব কী, বুড়ো প্রোফেসর মুখে রক্ত উঠে মরে গেল।’ মুখ ঢেকে সামনে ফিরল হিরু, বলল—‘তোরা এসব বিশ্বাস করিস? বল, প্লিজ বল করিস না, আমি একটু মনে বল পাব, ভাই, বল অসীম, সায়েন্স এসব বিশ্বাস করে?’

অসীম বলল—‘সায়েন্স এক ধরনের ভগবানে বিশ্বাস করে। কিন্তু তন্ত্র-মন্ত্রে নৈব নৈব চ। ওটা কাকতালীয়। লোকটা তোকে রাম ঠকান ঠকিয়েচে। তুই য়ুনিভার্সিটি গেলি কেন? গম্মেটের চাকরিতে কত সুবিদে!’

হিরু বলল—‘ওরা হার্ভার্ড থেকে লোক এনে আমার ওপর বসিয়ে দিলে। মনে ঘেন্না এল। নিজের ওপর, জীবনের ওপর, অথরিটির ওপর। সরকারের আওতা থেকে চলে গেলুম। বিশ্বাস কর আমি মানুষটার মৃত্যু চাইনি, শুধু সমস্যার সমাধান চেয়েছিলুম। অ্যামবিশন… ওনলি ভল্টিং অ্যামবিশন হুইচ ওভারলিপস ইটসেলফ অ্যান্ড ফলস অন দা আদার।’

হলের একধারে বাথরুম, হিরু হঠাৎ টলতে টলতে তার মধ্যে ঢুকে গেল, একটু পরেই প্রচণ্ড কষ্টে বমি করার আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল।

হলের শেষ প্রান্তে ভারী ভেলভেটের পর্দার ওধার থেকে খুব মুদূ খসখস আওয়াজ পাওয়া গেল। পাঁচ মহিলা শাড়ি সামলে, অলংকার সামলে পা টি পে টিপে পেছনের হলের দিকে চলে গেলেন। প্রত্যেকের মুখ বিবর্ণ। একে অপরের দিকে তাকাতে পারছেন না। গঙ্গার ধারে পাঁচজন নীরবে অনেকক্ষণ ঘুরে বেড়ালেন, বসলেন, আবার ঘুরতে লাগলেন, কখনও জোড়ে, কখনও একা। ভেতরে ভেতরে সবাই একা, আবার সবাই একসঙ্গে। অবশেষে ঈষিতা গলা পরিষ্কার করে বললেন : ‘দ্যাখ আমরা সবাই চল্লিশ পার হয়ে এসেছি। কিন্তু এখনও জানি না কতদিন আছে, হয়তো আরও চল্লিশ কিংবা তারও বেশি। আমাদের তো এই নিয়েই বাঁচতে হবে! এখনই এমন ভেঙে পড়লে চলবে কেন? আমরা সবাই এক নৌকায়!’

সুপ্রিয়া চোখের জল মুছে ধরা গলায় বললেন— ‘আমিও তো ওর ছাত্রীই ছিলুম। রিসার্চ করতুম। অনেস্টি, ইনটিগ্রিটি, ব্রিলিয়ান্স এই সবের জন্যেই আরও পছন্দ করেছিলুম!’ সবাই চুপ। কিছুক্ষণ পরে কমলা ধীরে ধীরে বললেন—‘ওরা সবাই অনুতপ্ত। এটুকুই…’ কেউ কিছু বলল না।

অনেকক্ষণ পরে গঙ্গায় স্টিমারের ভোঁ শোনা গেল। দু চারটে পাল তোলা নৌকা প্রাণপণে দাঁড় বাইতে বাইতে চলে গেল। মীনাক্ষী একটু ভাঙা ভাঙা ধরা-ধরা গলায় আস্তে আস্তে গান ধরলেন :

আরো আরো প্রভু আরো আরো,

এমনি করে এমনি করে আমায় মারো…।

তখন পঞ্চনায়ক হলের নানা আসনে নানারকম বিদঘুটে হাস্যকর ভঙ্গিতে ঘুমোচ্ছেন!

লাঞ্চ খেতে বেশ দেরি হয়ে গেল। আড়াইটে। কেউই ভাল করে খেতে পারলেন না, যদিও নানারকম লোভনীয় পদ এবং উৎকৃষ্ট রান্না হয়েছিল। খাওয়া হয়ে গেলে সীতাপতি বললেন—‘দেখো, এ বাংলোয় বড় বেডরুম দুটো আছে। ওই দুটোতেও এক্সট্রা খাট-টাট ঢুকিয়ে আমাদের ব্যবস্থা করে দিয়েছে কেয়ারটেকার। তোমরা ডান দিকেরটায় যাও, আমরা বাঁদিকেরটায় যাই। আমাদের আড্ডা এখনও শেষ হয়নি।’

অসীমাংশু বললেন—‘তোমাদের শাডির গল্প, লেটেস্ট ফ্যাশন, গয়না ইত্যাদির গল্পও নিশ্চয়ই শেষ হয়নি এখনও।’

মীনাক্ষী বললেন—‘ও, আমরা শুধু শাড়ি-গয়না আর ফ্যাশনের গল্প করি, এই তোমাদের ধারণা!’

—‘তা আর কী গল্প তোমরা করবে?’

মহীতোষ বললেন—‘শ্বশুর-শাশুড়ির পাট পর্যন্ত চুকে গেছে, তাদের যে পিণ্ডি চটকাবে তারও উপায় নেই।’

অমিতব্রত বললেন—‘ছেলে-মেয়েগুলো সবই প্রায় বড় হয়ে গেছে, যে যার কাজ করছে। কাকে কী টিফিন দেওয়া যায়, কার যখন-তখন হাঁচি হয়, কে বড্ড কনস্টিপেটেড সেসব নিয়েও গল্প করার সুযোগ বিশেষ নেই। তাহলে?’

ঈষিতার মুখ দেখে মনে হল খুব রেগে গেছেন। বললেন—‘ঠিক আছে, শাড়ি-গয়নার গল্পই করব, তবে শাস্ত্রে তো বলেছে স্বামীই স্ত্রীর অলংকার, সুতরাং সেই অলংকার নিয়েই আমরা চর্চা করব এখন। আয় তো রে সুপ্রিয়া, আয় সীতা আমরা ও ঘরে যাই।’ ঈষিতার মধ্যে একটা নেত্রী-নেত্রী ভাব আছে। তিনি আর চারজনকে প্রায় ঝেঁটিয়ে নিয়ে ডান দিকের শোবার ঘরে ঢুকে গেলেন। দরজাটা ঈষৎ শব্দ করে বন্ধ করে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সীতাপতি এদিক থেকে চার বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন—‘পার্ফেক্ট।’

হিরন্ময় মৃদুস্বরে বললেন—‘এখনও পার্ফেক্ট নয়, কে কোথায় বসবে, কী ভাবে তার ওপর সবটা নির্ভর করছে।’

সীতাপতি বললেন—‘আরে বাবা, লেটেস্ট অ্যামেরিকান প্রোডাক্ট, চারটে রেখে এসেছি।’ এখন তাঁদের অত্যধিক আবেগ, ক্রন্দন-প্রবণতা স্ল্যাং ব্যবহার করার ঝোঁক সমস্তই প্রায় চলে গেছে। তবে নিদ্রাকর্ষণ হচ্ছে। নিজেদের ঘরে ফিরে এক একজন দুটো তিনটে বালিশ বগলে শুয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পর সবাইকার নাক ডাকতে লাগল। মহীতোষ ঘুমোচ্ছে হাঁ করে, মুখের পাশ থেকে সামান্য লালা গড়াচ্ছে। অসীমাংশুর দু হাত বুকের ওপর ক্রস করা, চোখ দুটো চশমার তলায় বোজা। কিন্তু এমন শক্ত ভঙ্গিতে শুয়ে আছেন, মনে হচ্ছে মাড় দিয়ে ইস্ত্রি করা মানুষ, যে কোনও মুহূর্তে সটান উঠে ঢিসুম ঢিসুম শুরু করে দিতে পারেন। অমিতব্রত কেমন নেতিয়ে আছেন। তাঁর চুলগুলো খাড়া খাড়া। মুখের রঙ এখন বেশ কালো, ফুর ফুর ফুরুৎ করে নাক ডাকছে। সীতাপতি শুয়ে আছেন খুব সুন্দর একটি শবদেহের মতো। কিন্তু তাঁর অত সুন্দর নাকের ভেতর দিয়ে বাঘের গর্জন বেরোচ্ছে। হিরন্ময় কিছুক্ষণ পায়চারি করলেন, তারপরে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লেন। মুখ একদিকে কাত। সোনালি চশমা পাশে খুলে রাখা। হঠাৎ দেখলে মনে হবে তিনি মোটেই ঘুমোচ্ছেন না, মটকা মেরে পড়ে আছেন। কিন্তু আসলে তিনি সত্যিই ঘুমোচ্ছেন। বন্ধ ঘরের মধ্যে কোলে বালিশ নিয়ে মুখে মশলা ফেলতে ফেলতে ঈষিতা বলল—‘মীনাক্ষী ককটেলগুলো অত স্ট্রং না করলেই হত, ভেবেছিলুম যে যার লুকোনো প্রেমের গল্প বলে ফেলবে, এ যে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বার হল?’

সুপ্রিয়া সবাইকে মশলা বিতরণ করছিল, বলল—‘আমার তো এখন মনে হচ্ছে যা হয়েছে এর চেয়ে ভাল আর কিছু হতে পারে না। দ্যাখ ঈষিতা আমি ফ্র্যাংকলি বলছি। এখনও আমি ওর পেপার টাইপ করে দেওয়া, ক্যালকুলেশন করা, গ্রাফ করা—সব করে দিই। অর্থাৎ ওর সেক্রেটারির কাজ করি, সেক্রেটারি কেন, রিসার্চ অ্যাসিসট্যান্টের কাজ করে যাচ্ছি সমানে। বিদেশে বেড়াবার আমার খুব শখ, কিন্তু তোরাই বল, আমি যদি আমার থিসিসটা কমপ্লিট করতে পারতুম, কলেজের কেরিয়ারটা কনটিনিউ করতে পারতুম, আমিও ফিজিক্সের ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড ভাই, নিজের জোরেই নানা দেশে সেমিনার-টেমিনারে কি আমি যেতে পারতুম না! অথচ সংসারের কাজ এত বেড়ে গেল, দুটো ছেলের দেখাশোনা, পড়াশোনায় তাদের বাবা-মার উপযুক্ত করে তোলা, আর মিঃ অসীমাংশু গুপ্তর ওই নিত্যদিনের টাইপ, নোটস নেওয়া, ক্যালকুলেশন করা এতেই আমার সময় চলে যেতে লাগল। সি এস আই আর-এর কাজটা শেষ করতে পারলুম না। মাঝপথে ছেড়ে দিতে হল। ডক্টর ব্রহ্মচারী মুখ গম্ভীর করে বললেন—‘এইজন্যেই, এইজন্যেই আমি মেয়ে নেওয়া ডিসকারেজ করি, দেশের কতগুলো টাকা বাজে খরচ হয়ে গেল।’ সীতা, এই তিরস্কারই আমার পক্ষে যথেষ্ট। যথেষ্ট অপমান। ফিজিক্স অনার্স আর বি এস সি-তে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়ার জন্যে আমায় কম খাটতে হয়নি! যখন রিসার্চ ছেড়ে দিলুম, বাবা, কেমিস্ট্রির প্রোফেসর, আমায় নিয়ে খুব গর্বিত ছিলেন, মুখটা কালো করে বললেন— ‘তোর জীবন থেকে এত কষ্টার্জিত পঁচিশটা বছর জিরো হয়ে গেল রে বুলু!” তখন এগুলো মনে লাগলেও এগুলোকে গুরুত্ব দিইনি। আমার স্বামী একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক, আমি তার সঙ্গে দেশ-বিদেশের নানা কংগ্রেস, কনফারেন্স, সেমিনারে ঘুরতে পারছি, বড় বড় মানুষের সঙ্গে আলোচনাতেও কিছু কিছু যোগ দিতে পারছি, এই না কত ভাগ্য! কী লজ্জার কথা ভাই, ওর ওই কম্পুটারের ব্যাপারটা ও আমাকে এত রং চড়িয়ে বলেছে যে আমি মনে মনে ভাবতুম আমার অসীমাংশু হয়ত একদিন নোবেল প্রাইজ-ট্রাইজও পেয়ে যেতে পারে। এখন তো দেখছি সব ভাঁওতা, দাঁড়িয়েছিলুম চোরাবালির ওপর। আমার ক্লাস ফেলো একজন আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। মনে হচ্ছে, আমার বিয়ে, আমার কেরিয়ার ছাড়া কোনটাই কাকতালীয় নয়, সব অসীমাংশু গুপ্তর ক্যালকুলেশন। যে রকম শয়তানি করে ও ডক্টর আচার্যির কেজের চাবি চুরি করেছিল, ঠিক সেই ভাবেই আমাকে চুরি করেছে। অনেক রিসার্চ স্কলার তো ছিল, আমার চেয়ে সুন্দরী ছিল। আমাকেই বা বাছল কেন? বেছে বেছে আমার প্রেমে পড়েছে যাতে আমি ওর…’

সীতা বলল—‘বাস বাস বহুত হয়ে গেছে ভাই। তুমি ভীষণ একসাইটেড হয়ে গেছ। চুপ করো একটু সুপ্রিয়া।’

ঈষিতা বলল—‘সত্যি সুপ্রিয়া তোর মুখ লাল হয়ে গেছে। চুপ। এখন তো আর পঁচিশ বছরে ফিরে যেতে পারবি না! নতুন করে কেরিয়ার গড়তেও পারবি না। ছাড় ওসব।’

সুপ্রিয়ার গলা কান্নায় গদগদ হয়ে গেছে, বলল—‘দাঁড়াও না দেখাচ্ছি মজা। আর যদি ওর সেক্রেটারির কাজ করি তো…’

—সীতা বলল, ‘ছি, সুপ্রিয়া স্বামী আর স্ত্রী কি আলাদা! এভাবে ভাবতে নাই। আমরা ওদের পুণ্যের ফলও যেমন নিচ্ছি, পাপের ফলও তেমনি নেব। নিতে হবে। আমিও তো কেরিয়ার ছেড়েছি।’

—‘তোমার এ রকম মনে হয় না? মনে হয় না তোমার লাইফটা ওয়েস্টেজ? একটা হিউজ ওয়েস্টজ? তুমি একটা ডাক্তার, গাইনিতে স্পেশ্যালাইজ করেছ, এখন কি না বুটিক চালাচ্ছ?’

—‘টু স্পিক ফ্র্যাংকলি সুপ্রিয়া, আই ডোন্ট গ্রাজ হিম হিজ সাকসেস। আমার ইচ্ছা ছিল মেডিসিনে স্পেশ্যালাইজ করব। কিন্তু এদেশের লোক মেয়ে ডাক্তারের কাছে ফিমেল ডিজিজ কি বাচ্চাদের ডিজিজ-এর জন্যে ছাড়া যাবে না কভি না। আমি ভাই চেষ্টা করে দেখেছি। আর ওই গাইনি লাইন আমার একদম ভাল লাগে না। মাই গ্রাজ লাইজ এলস হোয়্যার।’ বলে সীতা চুপটি করে বসে রইল।

মীনাক্ষী বলল—‘কী তোমার দুঃখ, বলোই না। চুপ করে গেলে কেন?’ সীতা থেমে থেমে বলল—‘ফার্স্টলি, ও আমাকে একেবারে সময় দেয় না। হি ইজ সো বিজি। আমি নিজে ডাক্তার, বুঝি ডাক্তারের লাইফ এমনি হতে বাধ্য। স্পেশ্যালি যে দেশে দশ হাজার জন পিছু একটা ডাক্তার নেই। কিন্তু ও চোন্দননগরে নার্সিংহোম খুলতে গেল কেন? গরিবদের হেলপ করতে? কোখনওই না। বর্ধমানের ডাক্তারদের পসারের সঙ্গে কমপিট করতে…জরুর। আমি এসব বুঝি। অথচ, এতো টাকা, আড়াইশ ফি তো জানোই। অপারেশন করতে এখন কোতো নিচ্ছে ভোগোবান জানেন। তো ইনকাম-ট্যাক্স ইভেড করতে কী না করতে হচ্ছে! টাকা আরও বাড়ছে, সময় আরও কমছে। এই পুওর ওয়াইফের জন্যে আর টাইম নাই। এখন যেটুকু টাইম পায়, তাতে ওকে অ্যাবসল্যুট রেস্ট না দিলে ও মরে যাবে ভাই। সোবাইকে সময় দিচ্ছে, সোবার কথা শুনছে, শুধু আমি ওর লাইফ পার্টনার আমার কোথাই ওর শুনবার সোময় হয় না। তো আমি বুটিক খুলব না তো কী করব! মীনাক্ষী ডোন্ট মাইন্ড, আই হেট ইট, আই হেট টু কেটার টু দোজ স্নবিশ হাই-ব্রাও সোশ্যালাইট্‌স্‌‌। বাট ইট কিপস মি অক্যুপায়েড। আফটার অল কোর্টশিপের দিনগুলোর কোথা তো এখনও আমার মোনে আছে। হিজ ডিভাওয়ারিং কিসেস, দা ফিল অফ হিজ স্মুদ্‌ চিকস, এগেনস্ট মাইন।’

মীনাক্ষী বলল—‘তো আজ সীতুদার কনফেশন শুনে তোমার কী রি-অ্যাকশন?

সীতা তার ঘাড়হীন মাথা দুলিয়ে বলল—‘তোমরা মাইন্ড করবে, আমি বলব না।’

ঈষিতা বলল—‘সে আবার কী? বারবারই তো বলছি আমরা সব এক নৌকোয়। তোর সঙ্কোচ করার কোনও কারণ নেই। তুই বল, বলে হালকা হ’।

সীতা একটু ইতস্তত করে বলল—‘টু স্পিক ফ্র্যাঙ্কলি আমি এতে কুনও দোষ দেখি না। সাবসিকোয়েন্টলি অ্যাবর্শন তো লিগালাইজড হয়ে গেলই। মেয়েদের তো কিছু সুবিধা হল। পুরুষরা ওইরকম বিহেভ করবেই। তো মেয়েরা কেনো তার জন্য ভুগবে! যা ওনেক আগেই লিগাল হয়ে যাওয়া উচিত ছিল, সেটা পরে হল, একজন ডক্টর, ট্যালেন্টেড ডক্টর, দাঁড়াতে পারছিল না, দাঁড়িয়ে গেল। তো এতে দোষের কী হল?’

কমলা আস্তে বলল—‘কিন্তু ওই মেয়েটির ক্ষয়া সোনার চুড়ি?’

সীতা হঠাৎ তার দুটো ধবধবে ফর্সা হাত থেকে ষোলো গাছা সোনার চুড়ি খুলে ফেলতে লাগল।

ঈষিতা বললেন—‘করছিস কী?’ ততক্ষণে সীতা গলার হার এবং কানের দুলও খুলে ফেলেছে। সে বলল—‘এই সব দিয়ে দিচ্ছি, দোরকার হোলে আরও দেবো। ঠিকানা বার করে দিয়ে এসো, তার বাবা-মাকে।’

সুপ্রিয়া বলল—‘তারা কোথায় আছে, আছে কি না অ্যাট অল, জানব কী করে! তা ছাড়া একটা মানুষের জীবনের দাম কি টাকায় নির্ধারণ হয় সীতা?’

সীতা এইবারে দুঃখের হাসি হাসল, বলল—‘উল্টাপুলটা বোলছ সুপ্রিয়া। মানুষের জীবনের থেকে টাকার দাম ওনেক ওনেক বেশি। দেখো না কোথায় গ্যাস লিক হলো কী স্মাগলার ধোরতে গিয়ে কোনও পুলিশ অফিসার মারা গেলো, কী পুলিশ মোস্তানের লড়ালড়ির মাঝখানে কোতো বেচারা জান দিচ্ছে, ওমনি তার ফেমিলি টাকা পাচ্ছে, চাকরি পাচ্ছে, একজনের বোদোলে পাঁচজন বেঁচে যাচ্ছে। তো এবার বোলো ওই একটা মেয়ের জানের থেকে তার বাবা-মা-ভাই তিনজনের বেঁচে থাকা বেশি জরুরি কি না। আমার স্বামী তো ইচ্ছা করে মেয়েটাকে মেরে ফেলেনি! পুরুষরা ইচ্ছা করুক বা না করুক মেয়েদের জান ভাই ওদেরই হাতে। বী রিয়ালিস্টিক। আমি সিরিয়াসলি বোলছি, আমি আর গোয়না পোরব না, আনটিল দ্যাট ফ্যামিলি ইজ ফাউন্ড অ্যান্ড রিকমপেন্সড।যোদিও আসল রেসপনসিবিলিটি দ্যাট সন অফ এ বিচের যে মেয়েটাকে ইউজ করেছিল। তোবে আমার স্বামীর এগেনস্টে আরও কিছু গ্ৰাজ আছে।’

সীতা চুপ করে রয়েছে দেখে মীনাক্ষী বলল—‘কী হল সীতা, বল?’

—‘আমি বোলব না। তুমরা লাইটলি নেবে। বাট দা থিং ইজ ভেরি সিরিয়াস উইথ মি।’

ঈষিতা তার নেত্রী-নেত্রী বাচনভঙ্গি ব্যবহার করে বলল—‘এতটা বলেছ যখন ডিভাওয়ারিং কিসেস পর্যন্ত, তখন বাকিটাও বলতে হবে। আমরা লাইটলি নেব না। কথা দিচ্ছি।’

সীতা বলল—‘ম্যারেজ ইজ গিভ অ্যান্ড টেক মানো তো?’

ঈষিতা ঝুঁকে বসে বলল—‘নিশ্চয় মানি।’

—‘ইন এভরি স্ফিয়ার? সোব ক্ষেত্রে?’

—‘অফ কোর্স।’ মীনাক্ষী এগিয়েই ছিল। সুপ্রিয়া এগিয়ে বসে বলল।

সীতা বলল—‘তো আমি যদি স্ট্রিক্ট ভেজিটেরিয়ান হয়ে চিকেন খেতে পারি, হ্যাম-স্যান্ডউইচ খেতে পারি, ইলিশ মাছ, ভেটকিমাছ রান্না করে দিতে পারি, হোয়াই কান্ট হি টলারেট মাই কাইন্ড অফ ফুড?’

—‘সেটা দেখো রুচির ব্যাপার, জিভে যদি ভাল না লাগে তো কী করবে?’

—‘না না। খেতে আমি জোর করছি না, যদিও ও হ্যাম আমাকে জোর করে ধরিয়েছে। প্রথম প্রথম বোমি করে ফেলতুম। এনিওয়ে বাজ্‌রি রুটি আর টোকদই এই আমাদের ফুড। খুব সোস্তা। রুটি দেখতেও কালো কালো। বাট উই আর ফন্ড অফ ইট। বোছরের পর বোছর যায়, একটা দিনও খেতে পাই না। ধোক্‌লা করলেই বলে—‘ওঃ তোমার সেই ডালের কেক? সোনার পাথরবাটি?’ আমরা রুটিকে খুব কড়া করে সেঁকে টিনে ভরে রাখি, তাকে বলে খাকরা। মাখন, জ্যাম লাগিয়ে খেতে দারুণ লাগে। সোস্তার জলখাবার। ছেলেমেয়েদের ওগুলো দিলেই বলবে—‘আসলে কি জানো সীতা, গুজরাতিরা আসলে খু-উব গরিব জাত। এখন পোয়সা হলে কী হোবে, সেই চিপ্পুস অভ্যেস রয়ে গেছে।’ এসোব কোথায় আমি ইনসাল্টেড ফিল করি, হি ডাজ্‌ন্ট্ ‌‌‌সিম টু বদার। তা ছাড়া দেখো কেউ খুব বোড়ো লোক হোয়ে গেলেই যদি নিজেদের ফুড হ্যাবিট পাল্টে ফেলে বিদেশি খাওয়া ধোরে যেমোন তোমরা বাঙালিরা ওনেকেই কোরো, তো সেটা কি খুব ডিজায়রেবল? ইয়োর ফুড গিভস ইউ ইয়োর ফার্স্ট ন্যাশনাল আইডেনটিটি।’

—‘অ্যান্ড উইদাউট সাম কাইন্ড অফ ন্যাশন্যাল আইডেনটিটি ইন্টারন্যাশনালিজ্‌ম্‌ ইজ নট পসিবল। আই এগ্রি উইথ য়ু, সীতা’—কমলা খুব মৃদু কিন্তু দৃঢ় স্বরে বলল।

—‘তা তোরও কি ওইরকম কোনও অভিজ্ঞতা আছে নাকি?

—‘নাঃ’ কমলা হেসে বলল—‘প্রোফেসর এইচ সি ইডলি, ধোসা, উত্তপম, সবই খেতে ভালবাসেন।’

—‘তবে?’

—‘তবে আবার কী? কিছুই না।’ কমলা হাসল।

—‘ও্ঃ তুই না ইমপসিবল’—ঈষিতা বিরক্ত স্বরে বলল।

কমলা বলল—‘একটা গান শুনবে?’

—‘অফ কোর্স। গা কমলা গা। তুই যা গাস না! ফ্যানটাসটিক!’

কমলা গান ধরল—

‘আমি যখন ছিলেম অন্ধ

সুখের খেলায় বেলা গেল পাইনি তো আনন্দ ॥’

গান শেষ হলে তার রেশ রয়ে গেল ঘরের মধ্যে। সুরে ভারী হয়ে উঠেছে যেন হাওয়া অবশেষে ঈষিতা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘সুখের খেলায় বেলা গেলই বটে। সুখকে আনন্দ বলে চিনতে ভুল করে কী ভুলই করেছি।’

—‘কেন, এ কথা বলছো কেন, মহীদা ল-এর লোক। এরা কখনও কিছুতেই পুরো পরিষ্কার হতে পারে না ঈষিতা’,—মীনাক্ষী বলল।

—‘তাই বলে আসল ক্রিমিনালের হাত থেকে বারুদের দাগ তুলে তার ভাইকে বিনা দোষে যাবজ্জীবন জেল খাটাবে! তাই বলে কমিশনের চেয়ারম্যান হয়েও, আসামি ধরতে পেরেও স্রেফ ভয়ে ওই রকম জঘন্য নোংরা অপরাধীদের ছেড়ে দেবে? কাওয়ার্ড! মেয়েরা চিরকাল কাদের সবচেয়ে ঘেন্না করে এসেছে জানিস তো? কাওয়ার্ডদের…’ কেউই কোনও কথা বলছে না, ঈষিতা কিছুক্ষণ পরে স্বগতোক্তির মতো বলল—‘বাট আই অ্যাম রাইটলি সার্ভড। আমিও তো কাওয়ার্ডই। ছিঃ। আর কাউকে কাওয়ার্ড বলবার অধিকার আমার নেই। কাওয়ার্ডস ডিজার্ভ কাওয়ার্ডস।’

—‘এ কথা বলছো কেন গো?’ সুপ্রিয়া জিজ্ঞেস করল নরম সুরে।

ঈষিতা বলল—‘তোরা জানিস না, আমার বাপের বাড়ির অবস্থা ছিল খুব খারাপ।’

মীনাক্ষী বলল—‘সে কী রে? অত বড় বনেদি ফ্যামিলি তোদের? বিশাল রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি…’

—‘হুঃ’, ঈষিতা বিদ্রুপের ভঙ্গিতে বলল—‘ভেতরে ছুঁচোর কেত্তন, বাইরে কোঁচার নর্তন। আমার বাবা মা জ্যাঠা কাকা সব ওই এক দলে। মুশকিল হত আমাদের ভাইবোনদের। ওদিকে বাড়িতে যখন তখন ধার করে ভোজ হচ্ছে, শরিকরা পালা করে দুর্গোৎসব করছে। এদিকে আমাদের স্কুল কলেজের মাইনে জোটে না, বই কিনতে পারি না। চুপি চুপি এক বন্ধুকে বলে কয়ে একটা ট্যুইশান নিলুম। ছোট ছোট দুটো মেয়েকে পড়াতে হবে। সপ্তাহে তিনদিন। মাইনে সে বাজারে দেড়শ’ টাকা। পড়াতে পড়াতেই এই মেয়ে দুটোর কাকার সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। ক্রমশ দারুণ প্রেম। ছেলেটি লেখাপড়ায় সাধারণ। কিন্তু বাড়ির প্রচুর সম্পত্তি। দুই ভাই। নিজের অংশ তখনই পেয়ে গেছে। মার্কেনটাইল ফার্মে কাজ করে। কিন্তু নিজস্ব গাড়ি আছে। সেই গাড়িতে যে কত ঘুরে বেরিয়েছি! আমার লেখাপড়ার খরচ, এমনকি শাড়ি-টাড়ির খরচও সব ও দিত। আমার ভাইবোনদেরও দিত। এই সময়ে বনেদি বাড়ির কল্যাণে তোদের মহীদার সম্বন্ধটা এল। বাবা-মা তো আনন্দে ভেসে গেলেন একেবারে। ব্যারিস্টার, উঠতি, নাম করেছে। তাকে বললুম, সে বললে—‘সিদ্ধান্ত তোমার ঈষিতা। আমি তোমায় ভালবাসি। সুখে রাখতেও পারব। কিন্তু ব্যারিস্টারের স্ত্রীর মর্যাদা তো দিতে পারব না। কখনও মনে করবে না আমি কিছু উপহার দিয়েছি বলে তুমি আমার কাছে ঋণী। তুমি একদম মুক্ত। দুদিন সময় দিচ্ছি। তার মধ্যে যদি আমাকে বিয়ে করার ডিসীশন নাও, তো, আমি স্ট্রেট তোমার বাবার কাছে গিয়ে তোমার পাণিপ্রার্থী হবো। তিনি যদি রাজি না থাকেন, তক্ষুণি আমার সঙ্গে বেরিয়ে আসতে হবে। আমার এক বন্ধুর বাড়ি থাকবে। নোটিস দেব। তারপর সময় মতো রেজিষ্ট্রি বিয়ে হবে।

—‘তারপর?’ মীনাক্ষী উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞাসা করল।

—‘তারপর তো দেখছই!’ ঈষিতার কণ্ঠস্বর কেমন রুক্ষ হয়ে উঠেছে। —‘পারিনি, ব্যারিস্টার, বিলেত-ফেরত, খ্যাতি-নাম-যশ, পার্টি, পুরস্কার তুলে দিচ্ছি আমার চেয়ে অনেক কৃতী মানুষদের হাতে। মা রুগ্ন, হিস্টিরিক। বাবা চূড়ান্ত বিলাসী, মেজাজি, ভাইবোনেরা স্বার্থপর, পারিনি। ওরা জাতেও নিচু ছিল! তন্তুবায়।’

সুপ্রিয়া ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল—‘সে ভদ্রলোকের খবর জানো! কেমন আছেন? বিয়ে করেছেন কি না!’

—‘সব মেয়েদের এই এক ভয়ানক দোষ সুপ্রিয়া’, ঈষিতা বিরক্ত গলায় বলল—‘গল্প শেষ হয়ে গেলেও তারপর তারপর করতে থাকে।’

কেউ আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। একটু পরে ঈষিতা বলল—‘প্রতি মাসে একবার করে আমাকে ফোন করে। বলে—‘ঈষিতা, কেমন আছ?’

—‘সত্যি?’মীনাক্ষী বলল, ‘তুমি কী বলো?’

—‘আমি বলি, ভাল আছি। খু-উ-ব ভাল।’ বলে ফোনটা নামিয়ে রেখে দিই।’

—‘বিয়ে-টিয়ে করেছে কি না…’ এবার মীনাক্ষী ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল।

‘ওসব আমি কোনওদিন জিজ্ঞেস করিনি মীনাক্ষী। জানিস তো ন্যাকামি আমার আসে না’।

—কিন্তু আমি যে কী ন্যাকামির চূড়ান্ত করতে পারি, তা যদি জানতে!’ মীনাক্ষী বলল।

—‘তুমি পাবলিক রিলেশনস-এ ভীষণ ভাল পারো, আমি অনেকদিন আগেই সেটা অ্যাপ্রিশিয়েট করেছি, বুটিকে,’ সীতা বলল।

ঈষিতা হেসে বলল—‘সীতা তুই কি ওর পাবলিক রিলেশনস-এর ক্ষমতাকেই ন্যাকামি বলতে চাইছিস!’

সীতা জিভ কেটে বলল—“ছি ছি! আমি কি তাই বলতে পারি! আই অ্যাপ্রিশিয়েট, সিনসিয়ারলি অ্যাপ্রিশিয়েট হার এবিলিটিজ।’

সুপ্রিয়া বলল—‘কথার পিঠে কথায় কিন্তু ব্যাপারটা তাই দাঁড়াচ্ছে সীতা।

পাবলিক রিলেশনস এবিলিটি ইকোয়ালস ন্যাকামি।’

সীতার মুখ লাল হয়ে গেছে, সেদিকে তাকিয়ে মীনাক্ষী তার বয়কাট চুল দুলিয়ে বলল—‘সীতা না বলুক, আমি বলছি, ন্যাকামি ইজ এ ভাইটাল পার্ট অফ পাবলিক রিলেশনস। ঈষিতা তখন ন্যাকামি কথাটা ব্যবহার করে কী বোঝাতে চাইল! যে উপকারী প্রেমিককে ছেঁড়া কাপড়ের মতো ফেলে দিয়ে সে আরও অর্থবান খ্যাতিমান কাউকে বিয়ে করেছে, সেই পুরনো প্রেমিকের ভাল মন্দ জানতে চাওয়ার কোনও অধিকারই তার নেই, কোনও উৎসাহও থাকার কথা নয়, সে বিয়ে করল কি না করল তাতে ওর আর কী আসে যায়? আসে যায় না, অথচ ভাব দেখাচ্ছে কত দরদ, কত জানবার ইচ্ছা—এটাই ন্যাকামি। একদিক থেকে দেখতে গেলে পাবলিক রিলেশনের বেশ খানিকটা এইরকম প্রফেশনাল ন্যাকামি। তা সে ন্যাকামি আমি বুটিকে তো করেই থাকি, সীতা ঠিকই ধরেছে। কিন্তু আমার স্বামী অমিতব্রতর সহধর্মিণী হিসেবেও করেছি।’

—‘মানে?’ ঈষিতা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

—‘মানে আর কি ওই ষোলটা ফ্ল্যাট ও আমার সাহায্য ছাড়া বিক্রি করতে পারত কি না সন্দেহ। ও নিজে তো কাঠখোট্টা মানুষ। ক্ষণে ক্ষণে লাল হচ্ছে আর নীল হচ্ছে। তা আমাকে বললে—‘মীনা, এই ফ্ল্যাটগুলো তোমাতে আমাতে চটপট বেচে ফেলি এসো।’ আমি বললুম—‘কেন? তুমি পারবে না? আমাকে আবার টানছ কেন?’ তখন বলল—“তোমার মতো ডিপ্লোম্যাটের সাহায্য পেলে চটপট হয়ে যাবে। ঘাড়ের ওপর কতকগুলো ফ্ল্যাট বসে থাকাটা আমার মোটেই পছন্দ হচ্ছে না। ওরা যেন প্ল্যান স্যাংশন দেখতে না চায়, এটাই তুমি দেখবে। বেশি সার্চ-টার্চের মধ্যে যেন না যায়। জমির দাগ খতিয়ান সব আমার রেডি আছে।’ আমি বললুম—‘কেন? স্যাংশন করোনি, নাকি? ’বলল— কি জানিস? —“স্যাংশন তো এখনও শয়ে শয়ে প্রমোটারের বার হয়নি। ইনজাংশন আছে। ইনজাংশন উঠে গেলেই স্যাংশন অটোমেটিকালি হয়ে যাবে। কাগজে অ্যাড দিলুম। প্রত্যেক পার্টির কাছে যেতুম দুজনে কিংবা হোটেলে ডাকতুম আর আমি যত রাজ্যের ন্যাকামি করে ফ্ল্যাটটি গছাতুম। এই মাস্টারমশাইয়ের বেলা মানে মিঃ মিশ্রর বেলায় বললে—“লোকটা নিরীহ, ভালমানুষ, কিন্তু স্ত্রীটি খচ্‌রা।” তোদের অমিতব্রত লেবার অফিসার হয়ে জীবন আরম্ভ করেছিল তো, মদ না খেয়েই এই ভাষা ব্যবহার করতে অভ্যস্ত। বলে বলল, “স্ত্রীটিকে তোমায় সামলাতে হবে।” সেই মিসেস মিশ্রকে নিয়ে বুটিকে গিয়েছি, কী রঙ মানাবে বলে শাড়ি পছন্দ করে রিডাকশন-এ দিয়েছি, একেবারে উপহার দিয়ে বসলে মনে করতে পারে মতলব আছে। চুল ছাঁটবার পরামর্শ দিয়েছি। খাইয়েছি। বুদ্ধির, রূপের প্রশংসা করেছি। কয়েকটা নমুনা শুনবি?—জিজ্ঞেস করলুম, কিছু মনে করবেন না মিসেস মিশ্র, আপনি কি মানে মিঃ মিশ্রর দ্বিতীয় পক্ষ! প্লিজ ডোণ্ট মাইন্ড!’ ভদ্রমহিলা বললেন—“আপনি হাসালেন আমার পঁচিশ বছরের ছেলে আছে জানেন, আমার ছেচল্লিশ বছর বয়স।’ তখন আমি চোখ গোল গোল করে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলুম—“ছেচল্লিশ? আমি ভেবেছিলুম আপনার আর্লি থার্টিজ।’ এ টোপ খায় না এমন মহিলা আমি কম দেখেছি রে! তারপর দ্যাট রিমেনিং ফ্ল্যাট ওয়জ সোল্ড।’ তবে অন গড বলছি ওই ফ্ল্যাটের মধ্যে অত গোলমাল আমি জানতুম না। ওয়েল-বিল্ট, পূর্ব-দক্ষিণ খোলা, প্রধান দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলে ল্যান্ডিংটার ওপর থেকে অপূর্ব সূর্যাস্ত দেখা যায়, একদিক দিয়ে রাসবিহারী কাছে, আরেকদিক দিয়ে সাদার্ন মার্কেট। গুড পয়েন্টসগুলো দেখিয়ে দেখিয়ে, ব্যাড পয়েন্টসগুলো ভুলিয়ে দিয়েছি। লোভ লাগিয়ে দিয়েছি। বলেছি, আমি আপনাদের ইনটিরিয়র ডেকোরেশনে সাহায্য করব। অফ কোর্স, আই মেন্ট ইট। কিন্তু মিঃ এবং মিসেস মিশ্র বোধহয় এখন আমাকে ডাকিনী-যোগিনী বলে অভিশাপ দিচ্ছেন। দিলেও দোষ দেব না। কাজেই সীতা যা বলেছে ভাই ঠিকই বলেছে। আমাদের এই দস্যু রত্নাকরগুলোর পাপের ভাগ আমাদের নিতে হবে। নিতে হবে কেন? নিয়ে ফেলেছি। কিচ্ছু করার নেই।’

ঈষিতা এইবার কমলার দিকে ফিরে বলল, ‘এই কমলা আয়ার চ্যাটার্জি তুমি পার পাচ্ছো না। আমরা সবাই এক নৌকায়। তুমি কেন ভিন্ন নৌকায় যাবার চেষ্টা করে যাচ্ছ হে?’

কমলা হেসে ফেলে বলল—‘চেষ্টা করিনি তো!’

—‘তবে মুখ খুলছিস না কেন?’

কমলা বলল, ‘খুলব?’

—‘খোল’—দু-তিনজন একসঙ্গে বলে উঠল। তখন কমলা খোলা, উদাত্ত গলায়, গঙ্গায় জোয়ার আসার মতো গেয়ে উঠল—‘এ মোহ-আবরণ খুলে দাও, দাও হে।’ সে এমন গান, কারুর আর কিছু মনে রইল না। ঘর থেকে দেখা যায় গঙ্গার ওপর গোধূলি নামছে। নীরব, লাজুক মেয়ের গালের লালিমার মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে ভাটার গঙ্গায়। কিছু কিছু নৌকার পাল দেখা যাচ্ছে, তার তলায় প্রতিপদের চাঁদের আকারের নৌকোগুলো। একটা মন্দিরের চূড়োর ত্রিশূল চোখে পড়ে। কল-কারখানার চিমনি। কোনওটা কোনওটা থেকে কালো ধোঁয়া পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে। ঈষিতা ঘুম ভাঙা গলায় বললেন—‘চ’চ’ রেডি হয়ে নে। এখন আর ঘরে বসে থাকে না।’

ঘরের সঙ্গেই বিরাট বাথরুম। সকলে যে যার ব্যাগ খুলে, সাবান, পাউডার, লিপস্টিক, মাসকারা, ব্লাশার, টাটকা শাড়ি, ব্লাউজ, অন্তর্বাস, সুগন্ধ স্প্রে, পরিত্যক্ত জিনিসগুলো গুছিয়ে বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়, নবানি গৃহ্নাতি, হয়ে গেলেন। বেরোতেই, হলে, পঞ্চ স্বামীর সঙ্গে দেখা। প্রচুর ঘুমোনোর ফলে সবারই মুখটুখ ফোলা হয়ে গেছে। দাড়ি কামিয়েছেন সযত্নে। নানারকম আফটার-শেভের পুরুষালি সুগন্ধ বেরোচ্ছে। বেশ গর্বিত হবার মতো স্বামী সব। বেশ গর্বিত হবার মতো স্ত্রী সব।

সকলেই গঙ্গার ধারে বেড়াতে গেলেন। শুধু সীতাপতি টুক করে মেয়েদের শোবার ঘরে গিয়ে কী কতকগুলো জিনিস গুছিয়ে ব্যাগে ভরে নিলেন। চা খাওয়ার পর সন্ধে ঝপ করে নেমে পড়ল। বাইরে মশা কামড়াচ্ছে। তা ছাড়া নানারকম পোকা। বিরক্ত হয়ে, সবাই ভেতরের হলে এসে বসলেন। মাঝখানের ঝাড়লণ্ঠনটা জ্বলে উঠেছে। বিশাল শাখা-প্রশাখা যুক্ত ঝাড় লণ্ঠন। এ ছাড়াও দেয়ালে দেয়ালে মাঝে মাঝেই আলো। হিরন্ময় মুগ্ধ হয়ে বললেন—‘বাঃ চমৎকার তো!’ মহীতোষ বললেন, ‘এবার একটু হল্লা হোক।’ কৌচ-টৌচগুলো একটু সরিয়ে দিয়ে নাচের ফ্লোর তৈরি হল। ওয়ালজ-এর ক্যাসেট চাপানো হল। সীতাপতি ঈষিতার সঙ্গে, অসীমাংশু মীনাক্ষীর সঙ্গে, অমিতব্রত কমলার সঙ্গে, মহীতোষ সীতার সঙ্গে আর হিরন্ময় সুপ্রিয়ার সঙ্গে।

দু-তিন দফা নাচের পরেই ঈষিতা বললেন—‘আর পারি না বাবা হল্লা করতে। হল্লা করার কোনও ইন্ডিয়ান উপায় নেই?’

মহীতোষ বললেন—‘তাহলে ভারতীয় নাচ হোক, ফোকডান্স এবং গান।’ সীতাকেই সবাই ধরল—গরবা নাচবার জন্য।

সীতা বলল—‘গরবা একা একা নেচে মোজা নেই। তা ছাড়া বাঙালি দেখলেই যদি আমরা বলি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাও, গাইতে পারবে সোবাই?’

মহীতোষ বললেন—‘অন্তত মীনাক্ষী তো পারবে? কমলা বাঙালির চেয়েও ভাল পারবে।’

মীনাক্ষী গাইল—‘তুমি কিছু দিয়ে যাও মোর প্রাণে গোপনে…’

কমলা গাইল—‘এ কী লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ প্রাণেশ হে!’

মহীতোষ বললেন—‘সবাই মিলে একবার ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ হোক তাহলে?’

ঈষিতা বললেন—‘তুমি আর রসভঙ্গ কর না। এখন না হোক এক কালে তো মিড সামার নাইট’স ড্রিম-ট্রিম পড়েছিলে?’

মহীতোষ নত হয়ে বললেন—‘আই বেগ ইয়োর পাৰ্ডন ম্যাডাম।’

বেয়ারা এসে বলল—‘সাব ডিনার রেডি।’ লাঞ্চের থেকে ডিনারটা জমল ভাল। বেশ ভাল ওয়াইন পাঠিয়ে দিয়েছে সীতাপতির পেশেন্ট। মেয়েরাও একটু-আধটু খেল। তারপর চাঁদের আলোয় গঙ্গার ধারে একটু বেড়িয়ে সীতাপতি বললেন—‘আজ শুয়ে পড়া যাক। কাল আমায় ভোর ছ’টায় বেরিয়ে যেতে হবে। মনে রেখো সীতা।’ সীতা বললেন—‘রাখব।’ মহীতোষ বললেন—‘দুপুরের মতোই ব্যবস্থা শোয়ার, ডোন্ট মাইন্ড মীনাক্ষী।’ মীনাক্ষী হেসে বলল—‘সব ব্যাটাকে ছেড়ে দিয়ে এই বেঁড়ে ব্যাটাকে ধরলেন কেন মহীদা!’ মহীতোষ হেসে বললেন—‘আই মিন এভরিবডি।’ বলে যেন ট্রেন ধরবেন এমনিই তাড়ায় বাঁ দিকের শোবার ঘরটায় বোঁ করে ঢুকে গেলেন। নির্জন রাত। নির্জন বাংলো। ডান দিকের শোবার ঘরে নাইট ড্রেস পরিহিত মহিলারা হঠাৎ উৎকর্ণ হয়ে উঠে বসলেন—কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে ক্ষীণ স্বরে ঈষিতার গলা—‘মীনাক্ষী ককটেলগুলো অত স্ট্রং না করলেই হত। ভেবেছিলুম যে যার নিজের লুকোনো প্রেমের গল্প বলে ফেলবে, এ যে কেঁচো…’

সীতাপতি বলল—‘ভল্যুমটা লো করে দে, লো করে দে, বহুদূর পর্যন্ত শোনা যাবে।’

ঈষিতা বললেন—‘কী হল? এ কি ভূতুড়ে বাংলো না কি। এতক্ষণ পরে আমার কথার প্রতিধ্বনি ভেসে আসছে?’

কমলা মিষ্টি গলায় হেসে উঠল, বলল—‘ওরা এ ঘরে টেপ লুকিয়ে রেখেছিল।’

—‘ও মা। কী বদমাশ, কী বিচ্ছু, এখন কী হবে? কমলা, তুই আগে থেকে জানতিস বলিসনি আমাদের। তোর হেনপেকড হিরন্ময় তোকে বলে দিয়েছিল নির্ঘাত।’

কমলা বলল—‘সত্যি বলছি ঈষিতা, আমি একদম জানতুম না, আমরা যখন বিকেলে বেড়াতে বেরোলুম, সীতুদা হঠাৎ দেখি চোরের মতো পা টিপে টিপে বাংলোয় ঢুকে যাচ্ছেন। আমাদের ঘরের খোলা জানলা দিয়ে দেখলুম, টেপ-রেকর্ডার ব্যাগে পুরছেন।’

—‘হ্যাঁ, জানতিস না, একদম বাজে কথা, তুই একটা বিশ্বাসঘাতক!’

কমলা বলল—‘এটা কিন্তু সুবিচার হচ্ছে না ঈষিতা, আমরা চালাকি করে ওদের যত মনের কথা গলদের কথা জেনে নেব, অথচ ওরা নিলে মানতে পারব না! কেন?’

সুপ্রিয়া বলল—‘রাইট!’

মীনাক্ষী বলল—‘রাইট। তাছাড়া পতি-পত্নীর মধ্যে কোনও গোপনতা না থাকাই ভাল।’

ঈষিতা কমলাকে বলল—‘তাহলে নিজের কথা কেন কিছু বললি না—শুনি? আগে থেকে জানতিস বলেই সাবধান হয়ে গিয়েছিলি। পাজি, ছুঁচো!’

কমলা অবাক হয়ে অন্ধকারে তাকাল, তারপর বলল—‘কে বললে বলিনি? বলেছি তো!’

অনেক রাত্রে পত্নীদের মনের কথা শোনবার পর এবং তারাও তাঁদের স্বীকারোক্তি আগাগোড়া চালাকি করে শুনে ফেলেছে বোঝবার পর, পাঁচজনের বেশ কিছু আলোচনা হল। মহীতোষ বললেন—‘আমার যে টেলিফোন ভীতি হয়ে যাচ্ছে রে।’ অসীমাংশু গম্ভীরভাবে বললেন—‘আমি ইচ্ছে করে ওর কেরিয়ার নষ্ট করিনি, ওকে নিজের সুবিধের জন্য ব্যবহার করছি না, এটুকু অন্তত সুপ্রিয়াকে আমার বোঝাতেই হবে।’ সীতাপতি বললেন—‘হেনসফোর্থ আই’ল নেভার সে নো টু খাকরা। একটা হিঁচকোও এনে দেব, যাতে সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে করব, আই’ল অলসো রিমেমবার অ্যাবাউট দোজ ডিভাওয়ারিং কোর্টশিপ কিসেস।’ ‘চন্দননগরের নাসিংহোমটা…’ অমিতব্রত বললেন—‘মীনাক্ষীর রেসপেক্ট ফিরে পাবার জন্য আমি কী করতে পারি তোরা আমায় অ্যাডভইস দে।’ তিনি এখন একবার সবুজ, একবার বেগনি হয়ে যাচ্ছেন। ‘একা মিশ্রকে তার টাকা ফিরিয়ে দিলেই তো হবে না। দেয়ার আর আদার্স। সব রিফান্ড করব এদিকে, ডেমোলিশ করে দেবে, আমি তো ব্রোক হয়ে যাব রে!’ শুধু হিরন্ময় চুপ করে সিগারেট খেয়ে যেতে লাগলেন। অসীমাংশু তার দিকে তাকিয়ে বললেন—‘লাকি গাই, কমলার ওর এগেনস্টে কোনও গ্রাজ নেই। হিরন্ময় নিজের সিগারেটের ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে নীরবে ভাবতে লাগলেন—‘সত্যিই? সত্যিই কি কমলা কিছু বলেনি। প্রশ্নের উত্তরে সে শুধু গান গাইল। ‘সুখের খেলায় বেলা গেল, পাইনি তো আনন্দ।’ লাইনটা তাঁকে তাড়া করে ফিরতে লাগল। ‘এ মোহ আবরণ,’ কোন মোহ আবরণ খোলবার কথা কমলা কাকে জানাতে চাইছে—এ মোহ কি সেই গীতোক্ত সম্মোহ?

আস্তে আস্তে ঘুম এল। বহু বহুক্ষণ পরে। ঘুমিয়ে হিরন্ময় একটি স্বপ্ন দেখলেন। পৃথিবীটা যেন একটা বিরাট ডিউজ বল। সুতোটা তাকে উত্তর আর দক্ষিণ গোলার্ধে ভাগ করেছে। তিনি প্রাণপণে পৃথিবীর ঢাকনাটা খুলে ফেলবার চেষ্টা করছেন। অসীমাংশু দুই হাত তুলে লাফাচ্ছে। ‘করিস না হিরু করিস না!’ তারপর ঢাকনাটা খুলে গেল। ভেতর থেকে ভস ভস করে ধোঁয়া বার হচ্ছে, অন্ধ করে দেওয়া বিষাক্ত ধোঁয়া, তাঁর মুখ জ্বলে যাচ্ছে, সীতু বলছে—‘অসম্ভব এ আমি সারাতে পারব না।’ অমু বলছে—‘সর্বনাশ, এখন কী করে আমাদের আগেকার হিরুকে ফিরে পাই?’ এই সময়ে একটা উঁচু টিলার ওপর উঠে দাঁড়িয়ে মহী গর্জন করে উঠল—‘আই কনডেম ইউ।’ ঝট করে ঘুমটা ভেঙে গেল। হিরন্ময় বুঝতে পারলেন তাঁকে ভীষণ মশা কামড়াচ্ছে। মুখে। হাতে চাপড় মাড়তেই হাতটা মুখটা চিটচিটে রক্তে ভরে গেল। তাঁর নিজেরই রক্তে। অথচ ঘেন্না করছে। এত রক্ত খেয়েছে ডাঁশগুলো যে, যে যেখানে ভরা পেটে বসে ছিল সে সেখানেই থেঁতলে গেছে। বন্ধুরা সগর্জনে ঘুমোচ্ছে। জানলার বাইরে এখন পৃথিবীতে সেই দুর্লভ সময় যখন রাত্রি এবং উষা একত্রে অবস্থান করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *