স্বাহা
শরীরটা ক-দিন হল বড়োই খারাপ যাচ্ছে। আজ সকালে টেনিস খেলতে গিয়েই মাথা ঘুরে গেল। বাড়ি ফিরে ডাক্তার গুহকে ডাকতেই তিনি বললেন, প্রেশার ভীষণ নেমে গেছে। অফিস যাওয়া চলবে না দিনকতক। ভালো করে খাওয়া-দাওয়া করুন। কোনো চিন্তাভাবনা নয়। একেবারে চুপচাপ ঘুমোন। রিল্যাক্স করুন। লেখা-টেখাও ক-দিন একদম বন্ধ। মনে করবেন আপনি একটি নিটোল ভ্যাগাবণ্ড।
‘নিটোল ভ্যাগাবণ্ড’ কথাটা ডাক্তার বড়ো ভালো বলেছেন।
কিন্তু ডাক্তার বোধ হয় জানেন না যে, যাঁদের মস্তিষ্ক আছে এবং মস্তিষ্কে কিঞ্চিৎ পরিমাণ ধূসর পদার্থও আছে তারা শরীরের বিশ্রাম নিলেও নিতে পারে, কিন্তু মনের বিশ্রাম নেওয়া তাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়।
শিশুকাল থেকে মস্তিষ্ক চালু হবার পর তারমধ্যে নিরন্তর কত না কত ভাবনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ভাঙচুর। শরীর নিষ্কর্মা থাকলেও মনকে শরীরের সঙ্গে শবাসনে যুক্ত করা আমার মতো সাধারণ লোকের কর্ম নয়। বরং শরীর যখন কাজবিহীন মস্তিষ্ক তখনই সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। মস্তিষ্কের বিশ্রাম একমাত্র সেদিনই ঘটবে যেদিন চিতার আগুনে সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা দুঃখ-আনন্দের সমস্ত ভারসমেত মাথার খুলি একটা তীক্ষ্ণ সংক্ষিপ্ত আওয়াজ করে ফেটে যাবে।
তবু খাওয়া-দাওয়ার পর, ডাক্তারের পরামর্শানুযায়ী শুলাম একটু। শীতের দুপুর। নিস্তেজ রোদ বাঁকা হয়ে পড়েছে শিউলি আর চেরিগাছের চুল বেয়ে। একজোড়া ঘুঘু ডাকছে লনে। কেরালার নারকোল গাছের ডালে বসে দাঁড়কাক কা-কা করে ক খ শিখছে। ফিরিওয়ালা হেঁকে যাচ্ছে দূরের রাস্তায়। একটা দুটো গাড়ি যাচ্ছে যান্ত্রিক ঝর ঝর শব্দ করে।
ঘুম এসে গেছিল। এমন সময় ফোনটা বাজল।
টেলিফোনের আওয়াজকে বড়ো ঘেন্না করতে শুরু করেছি আমি আজকাল। বাথরুমে চান করতে গিয়ে, ঘুমের মধ্যে; গাড়ি চালাতে চালাতে, আমি আজকাল মাথার মধ্যে ফোন বাজছে শুনি সবসময়। এমন ধাতব, ন্যক্কারজনক, ঘৃণিত শব্দ আর দুটি নেই। শুধু কাজ; শুধু কর্তব্য; শুধু দাবির কথা শোনায় টেলিফোন।
একদিন ছিল, যেদিন টেলিফোনের আওয়াজ পথ দেখিয়ে আনত কত মিষ্টি সুখপ্রদ সব ঘটনা। কারো কারো গলার স্বরের রিনিরিনি শুনতে পেতাম ওই যান্ত্রিক শব্দেরই মধ্যে। এমনও সময় গেছে যখন ফোন করে দু-তিন ঘণ্টার আগে ফোন ছাড়িনি।
তখন আমি ছোটো ছিলাম, ভাবুক ছিলাম; প্রেমিক ছিলাম। তাবৎ জগৎ তখন আমার কাছে এক অনাবিল রহস্যভরা সুগন্ধময় অনুভূতির ছিল। পৃথিবীর হালচাল, দুঃখ-কষ্ট, ছল-চাতুরি কোনো কিছু সম্বন্ধেই অবহিত ছিলাম না তখন।
প্রত্যেক মানুষই বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে বদলায়। কাল যে-জানাকে অমোঘ বলে জানে আজ সেই জানাকে মিথ্যা অলীক বলে স্বীকার করতে বাধ্য হয়। আবার আজ যে-জানাকে জানল সে, যে-বিশ্বাসে ভর করে জীবনের পথে পা বাড়াল আগামী কালই নির্দ্বিধায় সেই জানা ও বিশ্বাসকে পদদলিত করে অন্য কোনো নতুন জানা ও বিশ্বাসকে আঁকড়ে এই অবিশ্বাসী, খল দুনিয়ার উথাল-পাথাল ঢেউয়ে কোনোক্রমে জীবনের হাল ধরে বেঁচে থাকতে চায়।
সব মানুষেরই মতো একজন লেখকও বদলান। তিনি বদলে যান, তাঁর লেখা বদলে যায়; প্রতিদিন নিজেকে নিজে অতিক্রম করে, নয়তো নিজের ফেলে-আসা পথ মাড়িয়ে পিছিয়ে যান। মাথা হেঁট করে। পেছন ফিরে তাঁর পুরোনো খোলসটার দিকে চেয়ে এক মিশ্র অনুভূতিভরা অনুকম্পায় ভরে ওঠেন। প্রত্যেক মানুষই বোধ হয় সাপের মতো। কখনো না কখনো, কোনো অস্থির অনির্দিষ্ট সময়ে, সে তার খোলস ছাড়েই। নতুন খোলস পরে। সাপের মতো বুকে হেঁটে জীবনের পথে এগোয়। ব্যাং খায়, ইঁদুর খায়, নেউলের সঙ্গে লড়াই করে, সুন্দরী ময়ূরের প্রেমে পড়ে, তার কাছে এগিয়ে গিয়ে তার তীক্ষ্ণ নখের ও চঞ্চুর আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়। কখনো বা মৃত।
এই প্রাপ্তবয়স্ক মানুষিবোধ প্রেমে কি অপ্রেমে, বন্ধুত্ব বা শত্রুতায় বড়োই বক্র ও জটিল। গভীর ছায়াচ্ছন্ন দুঃখশীতল মৃত্যুহিম পথে আমার মতো প্রাপ্তবয়স্ক, প্রাপ্তমনস্ক মানুষ চুপি চুপি পা ফেলে চলাফেরা করে। মাঝে মাঝে সে নিজের পায়ের শব্দে নিজেই চমকে ওঠে।
টেলিফোনটা বেজেই চলেছে। থামছে না।
বড়ো রাগ হল। তবুও হাত বাড়িয়ে রিসিভারটা নিলাম।
ওপাশ থেকে, যেন কতদূর, বহু যুগের ওপার থেকে এক কিশোরী বা সদ্যযুবতী দেবদূতীর কন্ঠস্বর ভেসে এল। বড়ো ক্ষীণ সে কন্ঠ। কিন্তু এত মিষ্টি, কোমল ও নরম যে মন বলছিল, সে কেন আরও জোরে কথা বলছে না?
আমি আমার নাম্বার বললাম যন্ত্রের মতো।
ঘুমভাঙানিয়া বলল, বুদ্ধদেব গুহ?
আমি বললাম, কে?
আমি সাহা।
সাহা কে?
সাহা আমি। তুমি বুদ্ধদেব গুহ?
আমি বললাম, বলছি।
অচেনা, অজানা মানুষ কে আমাকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করছে বুঝলাম না।
বললাম, কী চাই আপনার?
চাই না কিছু। তোমার বই পড়ে ভালো লেগেছে বলে ফোন করলাম।
একটা সময় ছিল, যখন এসব কথা ভালো লাগত শুনতে। আজকাল কি আমি দাম্ভিক হয়ে গেছি? না, না দম্ভ নয়, ক্লান্তি; একঘেয়েমি।
ভালোলাগার; ভালোবাসার; স্তুতির; প্রশংসার সব কিছুরই একটা ক্লান্তি আছে। কোনো কিছুই বাড়াবাড়ি হলে, বেশি হলে, তা মনের কোণ উপছে পড়ে যায়। তখন সেই প্রশস্তির যোগ্য সম্মান দেওয়া হয়ে ওঠে না। ধন্যবাদ দিতেও ক্লান্তি লাগে।
অথবা আমি কি ধরেই নিয়েছি যে অনেক স্তুতি, অনেক প্রশংসা আমার স্বাভাবিক পাওনা? ছি: ছি: কখনো কি এত দম্ভের বা মূর্খামির শিকার হব?
গলার স্বরে বয়েস অনুমান করে বললাম আমি, আমার কী বই পড়েছ তুমি?
বললাম, কারণ অনেকে ভালোলাগা জানান, বই না পড়েই। কেন, তা তাঁরাই জানেন। অনেকের বিখ্যাত লোকদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলাটা একটা রোগ। যাঁরা কিছুমাত্র না পড়েই শূন্যকুম্ভ ভালোলাগা জানান তাঁদের ওপর স্বভাবতই রাগ হয় লেখকমাত্ররই।
সেই স্বর বলল, আমি বাংলা ভাষা জানি না। মাত্র তিনটে বই পড়েছি।
আমি তবুও কঠিন গলায় বললাম, কী কী বই?
যেন পাঠিকাকে তার আন্তরিকতার পরীক্ষায় বসাচ্ছি আমি।
ও তিনটে বইয়ের নাম করল। দুটি বই পনেরো বছর আগে প্রকাশিত। একটি সাম্প্রতিক।
প্রথম পরীক্ষায় যখন সে পাস করল তখন বললাম, আমার এই টেলিফোন নাম্বার তো ডাইরেক্টরিতে নেই। এ তো আনলিস্টেড। তুমি আমার নম্বর পেলে কোথায়?
আমাকে আমার এক বন্ধু দিয়েছে। বন্ধু নয়, দিদি বলি; কিন্তু বন্ধুই।
নাম কী তার?
শিখা। শিখা রায়।
কী করে সে?
যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পড়ে।
শিখা বলে কাউকে আমি চিনি না। আমার এক বন্ধু-পত্নীর নাম শিখা। সে আর্কিটেক্ট। যাদবপুরে কখনোই পড়েনি।
আমি বুঝলাম না এই শিখা কে?
বললাম, তুমি কী পড়ো?
আমি? আমি কলেজে পড়ি। মুম্বাইতে। এখানে এসেছি আমার দিদার বাড়িতে।
তোমার দিদার বাড়ি কোথায়?
বালিগঞ্জে।
বালিগঞ্জে কোথায়?
কী জানি? আমাকে নিয়ে এসেছে। ছাদ থেকে মিলিটারি ক্যাম্প দেখা যায়। আমি এখানে থাকব না, চলে যাব; আমার ভালো লাগে না।
কোথায় চলে যাবে?
যেখানে হয়। আমি ওদের বাড়ির লিফটম্যানকে বলে রেখেছি যে, একদিন আমি একা-একা নেমে এসে হারিয়ে যাব।
কোথায় হারিয়ে যাবে?
যেখানে হয়। তুমি দেখো, ঠিক হারিয়ে যাব।
আমার মনে হল মেয়েটির মাথায় গোলমাল আছে। কিন্তু ওর গলার স্বর এমন পবিত্র, আন্তরিক, এত নির্ভরতার প্রত্যাশায় ভরা যে, ও যে পাগল একথা বিশ্বাস করতেও ইচ্ছে করছিল না।
বললাম, তোমার মা-বাবা কোথায় থাকেন?
বাবা এখন স্টেটস-এ গেছেন। আমার মা পোলিশ। বাবা বাঙালি।
তার পর আমাকে আর কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে বলল, জানো, আমি আর আমার মা যখন জুহুবিচের সামনে রোজ বিকেলে হাঁটি, যখন ফেনায় ভরে যায় সমুদ্র; তখন আমার মা বলেন আমি ওই ফেনা থেকে এসেছি।
জানো?
আমি অবাক হলাম। কলেজে পড়া মেয়ে, সারসের গল্প, ফেনার গল্প এখনও বিশ্বাস করে বলে। নাকি, কেউ বোকা লেখককে নিয়ে রসিকতা করছে?
ও আবার বলল, জানো, আমাদের মুম্বাইয়ের বাড়ির বসার ঘরে ইনগ্রেসের একটা ছবি আছে, কী সুন্দর! নিউড। মা বলেন, ওই যে ভগবান।
একটু চুপ করে থেকে বলল, ভগবান খুব সুন্দর, না?
আবার বলল, মা তো পোলিশ। মা আমাকে ডাকেন তানিয়া বলে। তানিয়া একটা পোলিশ ফুলের নাম। ভালো না?
আমি বললাম, ভালো।
ওর বাংলাটা একটু আড়ষ্ট। বাংলা যে খুব ভালো জানে না, বুঝতে পারছিলাম। কেন জানি না, এই আশ্চর্য অপরিণত অথচ অত্যন্ত সুরেলা কন্ঠের মেয়েটির প্রতি, ওর কথা বলার ধরন ও বক্তব্যতে ধীরে ধীরে আগ্রহী হয়ে উঠছিলাম। ওর গলার স্বরটি কোনো ফুলে ফুলে ভরা সবুজ উপত্যকার ছোট্ট চিকন পাখির মতো। শুধু গলার স্বর শুনেই মনে হচ্ছিল ও কোনো সাধারণ মেয়ে নয়; ও কোনো বিশেষ মেয়ে।
ও বলল জানো, আমি ফুল খুব ভালোবাসি। আমি আর আমার মা দুজনে মিলে গার্ডেনিং করি। মা বলেন, ‘আম্মো রোজাম।’ ল্যাটিন মানে জানো?
আমি বললাম, না।
মানে, আমি ফুল ভালোবাসি। তুমি ফুল ভালোবাসো? তোমাকে ফুল পাঠাব রোজ রোজ মুম্বই থেকে। আমি মায়ের সঙ্গে পোল্যাণ্ড চলে যাব। জানো, আমার মা আর বাবার ঝগড়া। তাই মা বলে, বাবাকে ছেড়ে আমাকে নিয়ে পোল্যাণ্ডে চলে যাবে।
একটু চুপ করে থেকে তার পর বলল ও, পোল্যাণ্ড থেকে তোমার জন্যে প্রেজেন্ট নিয়ে আসব।
তার পরই বলল, তুমি কত বড়ো?
আমি বললাম, আমি বুড়ো।
কক্ষনো না। তুমি বুড়ো হতেই পারো না। আমি বলছি, তুমি কক্ষনো বুড়ো হবে না। মা বলেন কেউ কোনোদিনই বুড়ো হয় না যদি যদি…
যদি কী?
যদি তুমি যখন খুব রেগে যাও তখন যদি খুব হেসে ওঠো, খুব হাসো; তাহলে তুমি কক্ষনো বুড়ো হবে না। তুমি তাই করবে তো? কক্ষনো রাগবে না। আর যদি রাগোও তাহলে খুব হাসবে। তুমি মোটেই বুড়ো নয়। বুড়ো হলে বুঝি আমি…
তুমি কী?
না থাক।
বলো না।
আমি কি তাহলে তোমাকে ফোন করি? তুমি আমার প্রিন্স চার্মিং।
লাইনটা হঠাৎ ক্রস কানেকশান হয়ে কেটে গেল। কেটে যাওয়ার আগে আমি ওকে শুধোলাম তোমার নাম বললে সাহা, সাহা তো সারনেম তোমার ইনিশিয়ালস কী?
ও বলল, আমার নাম স্বাহা।
তার পর আস্তে আস্তে, কেটে কেটে: ইংরিজিতে বানান করে বলল, SWAHA সংস্কৃত। মা আমাকে সংস্কৃত শিখতে বলেন।
লাইনটা কেটে গেল।
তন্দ্রাবিষ্ট যুবক—আমি যৌবনের ক্ষয়িষ্ণুতার কথা ভাবছিলাম অবচেতনে। সব যুবাই একদিন প্রৌঢ় হয়, সব প্রৌঢ়ই একদিন বৃদ্ধ। এই নিয়মে দুঃখজনকভাবে অভ্যস্ত হতে হবেই একদিন তাই-ই ভেবেছিলাম। ঠিক সেইমুহূর্তে কোন যৌবনের দেবদূতী এসে আমাকে জাগিয়ে গেল? কোন স্বরে, কানে আমার কোন মন্ত্র দিয়ে গেল সে?
বলল, রাগ হলে খুব হাসতে হবে। বলল, ‘আম্মো রোজাম’। বলল, ফুল পাঠাবে, ভালোবাসার ফুল। লাল গোলাপ। ইনগ্রেসের নিউড ছবির কথা বলল।
আমি খুব খারাপ হয়ে গেলাম মুহূর্তের জন্যে। আমি ভগবান নই; মানুষ। বিবসনা ইনগ্রেসের ছবির ওপর অদেখা স্বাহার কল্পিত চেহারাটা বসিয়ে ফেললাম মনে মনে।
যার গলার স্বর এত ভালো সে না জানি কত বিধুর সুন্দরী। কে জানে কেমন তার চোখ, তার ভুরু, তার চোখের পাতা, তার ঠোঁটের গড়ন? সে কি বেণী বাঁধে? না কোমর সমান চুল তার? চুলে কোন তেল মাখে সে? কেমন তার বাস? নাকি তার চুল বব করা? কেমন তার চুলের রং? হাসলে কি তার গালে টোল পড়ে? তার দাঁতের সারি কি সমান? উজ্জ্বল সাদা? কেমন সাদা?
আমার প্রেশার বেড়ে গেল। কিংবা জানি না, হয়তো নেমে গেল। আমি উঠে পড়ে জানলার পাশের ইজিচেয়ারে বসে পাইপ ধরালাম।
বাইরে শীতের দিন ছুটি নিচ্ছিল। বড়ো বিষণ্ণতা চারদিকে। কেমন এক ম্লান; ক্লিষ্ট সৌন্দর্য। একটা মৌটুসি পাখি এসে আঙুরের লতায় বসল। তার পর আঙুর ঠুকরে, টক দেখে উড়ে গেল। উড়ে যাবার আগে একবার সংক্ষিপ্তস্বরে রেশমি চাবুকের মতো হঠাৎ ডেকে গেল। স্বাহার গলার স্বরের মতো। উদাস করে গেল আমাকে। আমি ভাবছিলাম, কে এই স্বাহা? ও কি স্বপ্ন? না সত্যি?
ওর গলার স্বরে কী জানি কেমন এক অপার্থিবতা ছিল, এত ক্ষীণ গলায় ও কথা বলছিল কেন? যেন কত দূর থেকে—এমন কোথাও থেকে, যেখানে পৃথিবীর কোনো কলুষ পৌঁছোয়নি। ছল, চাতুরি, ভন্ডামি, ভড়ং, পরশ্রীকাতরতা, ঈর্ষা, ডিজেলের ধোঁয়া কিছুই যেখানে নেই এমন কোনো জায়গা থেকে। কী আন্তরিক, পবিত্র, গা-শিউরানো ওর গলার স্বর!
ভাবছিলাম, আমি কি পাগল হলাম? আমি কি এই শেষযৌবনে এসে অদেখা, অচেনা, অজানা এক দেবদূতীর কন্ঠস্বর শুনেই তার প্রেমে পড়লাম। ছি: ছি:।
কিন্তু ও যে বলে গেল আমি কোনোদিনও বুড়ো হব না। এমন করে কেউই বলেনি। ও যে বলে গেল শুধু হাসতে। রাগলেই হেসে উঠতে।
সেই আশ্চর্য, কোমল সজীব মধুর কন্ঠের পরি আমাকে বলে গেল একটু আগেই যে যৌবন বা বার্ধক্য কোনো বিশেষ শারীরিক অবস্থা নয়। ‘আম্মো রোজাম’ বলতে পারার মতো কোনো মানসিক অবস্থাকেই যৌবন বলে।
২
কাল রাতে জ্বর হয়েছে আমার। দুপুরবেলা একা ঘরে জ্বরের ঘোরে কোথায় যেন ভেসে চলেছি আমি। কারা যেন কথা কইছে কানের কাছে ফিসফিস করে। তাদের কথার মানে বুঝি না, কিন্তু তাদের ফিসফিসানি কত কী অস্পষ্ট স্মৃতি এবং কল্পনা বয়ে আনে মনে।
কিন্তু একা থাকলে, অসুস্থ থাকলে তো বটেই; জানলা দিয়ে যমদূত হাতছানি দেয়। আজকাল প্রায়ই আসে সে। সে খুব সুন্দর। সে মোটেই খারাপ দেখতে নয়। কী উজ্জ্বল তার চেহারা! কী শান্ত তার মুখের ও চোখের ভাব। সেই-ই শাশ্বত। সে-ই আদি এবং অনন্ত। জীবনের ক্ষণস্থায়ী ক্ষুদ্রতাকে সেই-ই তো অসীমতা দান করে, মুক্ত করে পাখিকে, উদার আকাশে। সে যে মুক্তির দূত। তার সঙ্গে আমার কথা হয়। কত কথা।
আমি বলি, তাড়াতাড়ি করো। যে-পারে আমার আসল আবাস নয়, সে-পারে বেশিদিন থেকে সময় নষ্ট করে লাভ কী? আমার ওই পারেই ভরসা বেশি। এই পারেতেই ভয়।
ও হাসে, আর বলে, জয়! অজানার জয়!
আমি নিরুচ্চারে গান গাই: ‘দু-দিন দিয়ে ঘেরা ঘরে, তাইতে যদি এতই ধরে! চিরদিনের আবাসখানা সেই কি শূন্যময়?’
ও হাসে, আর বলে, জয়! অজানার জয়!
ফোনটা আবার বাজল।
স্বাহা।
স্বাহা বলল, কী করছ তুমি?
বললাম, শুয়ে আছি, জ্বর।
খুব জ্বর?
দেখিনি কত জ্বর?
ও বলল, অসুখ মানে কী? তুমি জানো?
আমি বললাম, অসুখ।
তুমি বোকা। সুখের অভাবকেই অসুখ বলে।
বললাম, ঠিক বলেছ।
কী খেয়েছ? তুমি?
খাইনি কিছু। কিছু একটা খাব।
ওমা:, এখনও খাওনি? দুটো বাজে। তুমি কেমন মানুষ গো? তোমাকে দেখার কেউ নেই?
কাউকে দেখারই কি কেউ থাকে? নিজেকেই নিজের দেখতে হয়। আমরা সকলেই তো একা। একা আসা; একা যাওয়া। মিছিমিছি আমার অনেকে আছে বলে ভুল ভাবা কি ভালো? কারোরই কেউ থাকে না। এক ভগবান ছাড়া। আমরা সকলেই একা। বড়ো একা।
ও বলল, বেচারি! আমি যাই তোমার কাছে? ফুল নিয়ে যাই? আমি ফ্রায়েড এগস বানাতে পারি। জানো? তোমাকে খিচুড়ি আর ফ্রায়েড এগস বানিয়ে দেব। সামনে বসে খাওয়াব তোমাকে। কত যত্ন করে খাওয়াব। দেখো তুমি।
আমি বললাম, অন্য কথা বলো। তুমি কেমন আছ?
ও হঠাৎ বলল, লিউকোমিয়া কী গো?
আমার বুকটা ধ্বক করে উঠল। বললাম, জানি না।
ও বলল, আই হ্যাভ ওভারহার্ড মাই পেরেন্টস। বাবা আমার রক্ত নিয়ে স্টেটস-এ গেছে। ওটা কী অসুখ গো?
বললাম, যে অসুখই হোক, তোমার তা হয়নি।
আমার বুকের মধ্যে সেই অদেখা মেয়ের জন্যে কী যেন করে উঠল। আমি মনে মনে বার বার বলতে লাগলাম যে, তুমি তোমার সব অসুখ আমাকে দিয়ে দাও স্বাহা। আমি তোমার সব অসুখ শুষে নেব তোমার মুখ থেকে, রক্ত থেকে। তুমি এসব খারাপ অসুখের নাম মুখেও এনো না।
ও বলল, তুমি জানো কী করে? যে হয়নি?
আমি বললাম, নিশ্চয়ই জানি।
তুমি বলছ?
আমি বলছি।
তুমি কী ভালো গো। তুমি যেমন করে কথা বলো, তেমন করে সকলে বলে না কেন বলো তো? তোমার মতো যদি সকলে হত!
তার পরই বলল, আমি ভালো?
খু-উ-উব।
আমি বললাম।
তার পর বললাম, তুমি Sweety Pie!
তুমি পরি।
পরি কী গো?
পরি মানে Fairy!
তাই-ই!
তার পর একটু চুপ করে বলল থ্যাঙ্ক উ্য!
স্বাহা বলল, তুমি গান গাইতে পারো?
পারি। একটু একটু।
শোনাবে?
তুমি আগে বলো, তুমি নিজে গাইতে পারো কি না?
পারি। কিন্তু বাংলা গান আমি জানি না। সব ইংরিজি গান।
তাই-ই শোনাও।
আমি খুব আস্তে গাইব কিন্তু! আমার কথা বলতে কষ্ট হয়। হাঁফিয়ে যাই।
বললাম, ঠিক আছে। আস্তেই গাও।
তার পরই ও গাইতে আরম্ভ করল।
এমন গান কখনো শুনিনি। কী সুন্দর সুরে-বসা গলা। কী দরদ! আবেগ! কী আশ্চর্য অস্পষ্ট স্পষ্টতা।
মনে হল, স্বর্গ থেকে কোনো পরিই গাইছে বুঝি!
Why are the stars so bright
Why is my heart so light
Why is the sky so blue.
Since the hour I met you!
Flowers are smilling bright
Smiling for all delight
Smiling so tenderly
For the world, you and me!
বললাম, কার গাওয়া গান এটা?
ও বলল, তুমি কী গো? আমার!
না, না, কার গান?
ও বলল, পেটুলা ক্লার্ক!
আরেকবার গাও তো, লক্ষ্মীটি! আমি টেপ করব।
টেপ রেকর্ডারটা নিয়ে এলাম। রিসিভারের সঙ্গে মাউথপিসটাকে লাগিয়ে দিলাম। বললাম, গাও।
ও গাইতে লাগল। রিসিভারের কাছে কান নিয়ে ওর গান শুনতে লাগলাম আমি।
গান টেপ হয়ে গেলে ও রিনরিনে ফিসফিসে গলায় কত কথা বলতে লাগল। মোহাবিষ্টের মতো আমি ওর কথা শুনতে লাগলাম। কত সব শিশুসুলভ এলোমেলো অথচ কী আন্তরিক সব কথা।
একবার বলল, তুমি খাবে না?
আমি বললাম, তোমার কথা শুনে এত ভালো লেগেছে যে, খিদে নেই আর। জ্বরও বোধ হয় নেই।
ও বলল, জানো, এখানে কী ঝাল রান্না! আমি খেতে পারি না। আমার দিদা আমাকে খুব ভালোবাসে। দিদা আমাকে ডাকে ফুলটুসি বলে। ফুলটুসি মানে কী?
একটা পাখির নাম।
এরকম নাম কেন?
ফুলে টুসকি দিয়ে মধু খায় বলে।
ওঃ কী ভালো! বা:, আমিও তো ফুল ভালোবাসি।
তার পর বলল, আমি হাত দিয়ে খেতে পারি না তাই সকলে আমাকে বকে। আমি হাত দিয়ে খেলে ডান হাত বাঁ-হাত লাগাই তাতেই সকলে বকে। আজকে না, আমি আমার বাঁ-হাতটা পেছনে রেখে শুধু ডান হাত দিয়ে খেয়েছি।
তার পর বলল, আমার গলায় বোনস ফুটে গেছিল। জানো?
আমি বললাম, ইশশ! কাঁটা? এখন বেরিয়ে গেছে তো?
হ্যাঁ। কীরকম বাঁকা বাঁকা বোনস।
বোনস নয়। বলে কাঁটা।
ও বলল, তাই বুঝি? কাওয়াই মাছে এত কাঁটা?
কাওয়াই নয়; কই।
ও বলল, থ্যাঙ্ক ইউ। তুমি কত কী শেখালে আমাকে! তুমি ভীষণ ভালো।
হঠাৎ বলল, লিউকোমিয়া কী অসুখ গো?
আবার আমার বুকের মধ্যেটা ধ্বক করে উঠল।
বললাম, হবে কোনো অসুখ। অসুখের কথা এখন থাক। তার চেয়ে সুখের কথা বলো।
ও বলল, তোমার হলুদবসন্ত বইয়ের প্রথমে তুমি এই কবিতাটি লিখেছ?
কোন কবিতা?
সুখ নেইকো মনে,নাকছাবিটি হারিয়ে গেছেহলুদ বনে বনে
বললাম, আমার কবিতা না। ওটা কোটেশান।
যাই-ই হোক। কী ভালো কবিতাটা! আমার খুব ভালো লাগে।
তার পর বলল, তুমি গান শোনালে না?
আমি আমার প্রিয় গায়ক রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের একটা গানের দু-লাইন ওকে শোনালাম—
তুমি অবসর যদি পাওআমার দুয়ারে ক্ষণিকের তরেবারেক এসে দাঁড়াও।
ও বলল, লাভলি। কী ভালো গাও তুমি!
তুমি তো আমার সবই ভালো দেখছ!
দেখছিই তো!
তার পর বলল, জানো! আমি এখান থেকে পালিয়ে তোমার কাছে চলে যাব।
বললাম, বেশ তো!
তোমার তাহলে কী মজা হবে বলো? ফুলও তোমার, মালিও তোমার। আমি গার্ডেনিং করব, তোমাকে ফ্রায়েড এগস রেঁধে খাওয়াব।
তার পর একটু চুপ করে থেকে যেন অন্য জগৎ থেকে বলল, হঠাৎই; আমাকে ভালোবাসবে তো তুমি?
বললাম, খুব বাসব। খু-উ-ব।
সেদিন তুমি বলেছিলে, ভগবান চাঁদে আছে, পাখিতে আছে, ফুলে আছে, কথাটা খুউব ভালো লেগেছিল? আচ্ছা ফুলটুসি যদি পাখি হয় তাহলে আমি তানিয়া, ফুল আর পাখিও? ফুল আর পাখি দুই-ই আমি! কী মজা?
আমি বললাম, তুমি তাই-ই তো!
ও কিছুতেই ওর টেলিফোন নাম্বার ওর দাদু-দিদার নাম, বাড়ির ঠিকানা আমাকে দিল না। প্রথম দিনও দেয়নি। লিউকোমিয়ার কথা শুনেই আমার বুকে ওর জন্যে বড়ো আশঙ্কা আর ভয় জমে উঠেছিল। ও যে ইচ্ছে করে দিল না তা মনে হল না। মনে হল, ও জানে না, অথবা ওর দেওয়ার উপায় নেই। মনে হচ্ছিল ও যেন কোনো বন্দিনী পরি। মর্ত্যে এসে ওর ডানা গেছে কাটা। কোনো উঁচু বাড়ির কোনো বন্ধ ঘরে ওর পবিত্র মন-শরীর সমেত বন্দিদশায় ও যেন বড়োই কষ্ট পাচ্ছে।
ও বলল, কথা বললে আমার বড়ো কষ্ট হয় গো! হাঁফিয়ে যাই আমি। দিদা আর কাকিমা যদি জানে আমি তোমাকে ফোন করেছি, এত কথা বলেছি; তাহলে খুব বকবে আমাকে। কিন্তু তোমার সঙ্গে কথা বলতে কী ভালো লাগে আমার। যা কিছু ভালো লাগে, তা এত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায় কেন বলো তো?
আমি একটু চুপ করে থাকলাম।
ভারি খারাপ লাগছিল আমার।
ও বলল, চুপ করে আছ কেন? কথা বলো না?
তার পরই আবার বলল, যা কিছু ভালো লাগে তাই-ই এত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায় কেন গো?
না-ফুরোলে আবার ভালো লাগায় ভরবে কী করে?
ঠিক বলেছ। তুমি কী ভালো। বলেছি না, তুমি আমার প্রিন্স চার্মিং! তোমার বুদ্ধিই আলাদা!
ছাড়ছি। পরে ফোন করলে আমার সঙ্গে কথা বলবে তো? প্রমিস? প্রমিস করতে হবে কিন্তু!
আমি বললাম, প্রমিস।
স্বাহা ফোন ছেড়ে দেওয়ার পরই টেপ রেকর্ডারটাকে রি-ওয়াইণ্ড করে বাজালাম ওর সেই গানটা শুনব বলে। আশ্চর্য! ওর গান রেকর্ডই হয়নি? কীসব বিশ্রী আওয়াজ! কোনো কর্কশ পাখির ডাক। কত সব অজাগতিক শব্দ। পৃথিবীর অনেক পাখির ডাকই আমি চিনি কিন্তু এ কোনো পৃথিবীর পাখির ডাক নয়। পৃথিবীর কোনো পরিচিত আওয়াজের সঙ্গেই ওর গানের বদলে যা রেকর্ডেড হয়েছে তার সঙ্গে মেলানো যায় না একটুও; একটি কথাও ওঠেনি ওর গানের!
আমি কম্বল ফেলে দিয়ে বিছানাতে উঠে বসলাম। টেপটাতে চাইকোভস্কির একটা বিখ্যাত কম্পোজিশন ছিল। আগে পরে তা-ই আছে। শুধু যেখান থেকে স্বাহার গান টেপ করেছিলাম, সেইখান থেকে কিছুটা জায়গায় ওইসব শব্দ।
স্বাহা কি পৃথিবীর নয়? ওর গলার আশ্চর্য অপার্থিব মধুর স্বর, ওর ইনোসেন্ট, পিওর ব্যক্তিত্ব আমাকে মোহাবিষ্ট, আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। ও কি অশরীরী?
৩
আর কোনো দিনও স্বাহা ফোন করেনি। উদগ্রীব হয়েছিলাম, থাকতাম; প্রতিদিন। না: আর একদিনও ফোন এল না।
ওর শেষ ফোন আসার মাসখানেক বাদে অফিস থেকে ফিরছি একদিন, রাত সাড়ে সাতটা বাজে। পার্ক স্ট্রিট আর ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের মোড়ে ট্র্যাফিক সিগন্যালে গাড়ি থেমেছে, হঠাৎ আমার গাড়ির পাশের একটা সাদারঙা ভোক্সওয়ান গাড়ির পেছনের সিটে চোখ পড়ল। উজ্জ্বল চোখসম্পন্ন একটি অল্পবয়েসি মেয়ে কাঁধ এলিয়ে পেছনের সিটে বসে আছে। তার বব করা চুল, তার চোখের দৃষ্টির সমস্ত ঔজ্জ্বল্য সত্ত্বেও সে যেন কত দূরে পৃথিবীর সব দিগন্তরেখার ওপারে চেয়ে আছে।
আমি ভাবলাম, এই কি স্বাহা?
কে যেন আমার মাথার মধ্যে বলে উঠল, এই স্বাহা।
উর্দিপরা ড্রাইভার সেই গাড়ি চালাচ্ছিল।
আলো সবুজ হতেই গাড়িটার পেছন পেছন যেতে লাগলাম গাড়ি চালিয়ে। আমাকে যেন নিশিতে ডেকেছিল। গাড়িটা গুরুসদয় রোডের একটা মাল্টিস্টোরিড বাড়িতে ঢুকল। আমিও গাড়িকে ঢোকালাম। আমার গাড়ি ওই গাড়ির পাশে দাঁড় করালাম।
মেয়েটি নামল, নেমে ড্রাইভারকে হিন্দিতে কী যেন বলল।
আমি বুঝলাম এ স্বাহা নয়; হতেই পারে না। এ নিজেকে আবিষ্কার করে ফেলেছে। নিজের সৌন্দর্য সম্বন্ধেও সচেতন। ও সচেতন নিজের পরিবেশ সম্বন্ধে। ও এই পৃথিবীরই অন্য কোনো আবিল সাধারণ; সতর্ক মেয়ে। ও আমার স্বাহা কখনোই নয়!
বড়ো মনমরা হয়ে আমি ফিরে এলাম।
আরও মাসখানেক পরে রাসবিহারী অ্যাভিন্যু ধরে ছুটির দিন সকালে হেঁটে যাচ্ছি। একটা দোতলা বাড়ির চওড়া বারান্দায় শীতের রোদ পোয়াচ্ছিল শাড়ি পরা একটি অল্পবয়েসি মেয়ে, ইজিচেয়ারে বসে, তার কোলের ওপরে রাখা ছিল কোনো বই।
আমার বই কি?
মেয়েটির মুখ রাস্তা থেকে দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু তার বসার ভঙ্গির মধ্যে বড়ো একটা অসহায় আতুর ভাব ছিল। মনে হচ্ছিল এই পৃথিবীর ডিজেলের গন্ধ-ভরা নি:শ্বাস নিতে ওর কষ্ট হচ্ছে।
আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম।
মেয়েটি হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে রেলিং-এ ভর দিয়ে কাকে যেন কর্কশ গলায় চেঁচিয়ে বলল, ঠাকুর, বাজার থেকে ফেরার সময় আমার জন্যে গুপ্ত ব্রাদার্স থেকে দহি-কচুরি এনো।
আমি বুঝলাম, এও স্বাহা নয়। এ স্বাহা হতেই পারে না।
যদি স্বাহার সত্যিই লিউকোমিয়া হয়ে থাকে? আমার কি কিছুই করণীয় নেই?
স্বাহা যদি পৃথিবীর মেয়ে হয় তাহলে আমি কি রোজ অফিস-ফেরত ওর জন্যে লাল গোলাপ নিয়ে গিয়ে বসতে পারতাম না ওর পায়ের কাছে? ওকে বলতে পারতাম না যে, মৃত্যু তোমার জন্যে নয়, আমি থাকতে মৃত্যু তোমাকে নিতে পারবে না। ওর সব অসুখ শুষে নিয়ে আমি কি ওকে বাঁচাতে পারতাম না?
ওই-ই তো বলেছিল, অসুখ মানে জানো? সুখের অভাব।
ওর মা-বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে তাদের অসহায়তার ভার কি একটুও লাঘব করতে পারতাম না আমি? এই অসহায় লেখক?
কত কী যে বলার ছিল স্বাহাকে আমার। আমার ঘুমভাঙানিয়া, সুখজাগানিয়া; দুখজাগানিয়াকে কত যে গুন গুন গান শোনাবার ছিল। কিছুই তো হল না।
কাল মাঝরাতে ঘুম ভেঙে উঠে জানালার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। অন্ধকার আকাশে কত গ্রহনক্ষত্র। কত বিচিত্র তাদের অয়নপথ। কত বিচিত্র লীলাখেলা চলেছে সৃষ্টির আদি থেকে এই রহস্যময় পুরোনো কিন্তু চিরনতুন অসম ব্রহ্মান্ডে। কত কোটি যোজন দূরে মিটমিট করছে কত নাম-জানা ও নাম-না-জানা তারারা।
স্বাহা কি কোনো তারা? তারার নামেই তার নাম?
আমার বুকের মধ্যে বড়ো কষ্ট। আমি বললাম, স্বাহা!
ঠিক সেই মুহূর্তে কে যেন বলল, ফিসফিস করে, তোমাকে আমৃত্যু খুঁজেই বেড়াতে হবে তাকে। তুমি শান্তি পাবে না, বিশ্রাম পাবে না, ঘুম কেড়ে নেব আমি তোমার চোখ থেকে। পরির অভিশাপ লেগেছে তোমার।
আমি নিরুচ্চারে বললাম, তা লাগুক। শুধু আমি যদি জানতে পারতাম যে, স্বাহা ভালো আছে। তার লিউকোমিয়া হয়নি। এবং যদি কেউ একজনও আমাকে বলতে পারত যে, অনেক দূরের সুন্দর অধরা স্বর্গের পরি নয় সে কোনো। স্বাহা এই ধূলিধূসরিত ব্যবহারমলিন আমার পুরোনো পরিচিত পৃথিবীর দোষে-গুণে—মেশা একজন রক্তমাংসের মেয়ে! বড়ো ভালো মেয়ে!
আমি নিশ্চিতভাবে জানি যে, যতদিন বাঁচব, ততদিন ও আমার সঙ্গে সঙ্গেই থাকবে। আমি এও জানি যে, আমার নিজের রক্তেও এক সাংঘাতিক দুরারোগ্য অসুখ এসে বাসা বেঁধেছে।
আমার শ্বেত ও লোহিত রক্ত কণিকাগুলোর প্রত্যেকটির রং ডালিয়া ফুল আর ফুলটুসি পাখির রহস্যময় মিশ্ররঙে রাঙিয়ে দিয়ে গেছে সেই পরি।
আমার এই মৃত্যুবাহী অসুখের নামও স্বাহা।
লেখকের নিবেদন:
[যদি কোনো পাঠক-পাঠিকা স্বাহার খোঁজ বা খবর জানতে পারেন তো অত্যন্ত কৃতজ্ঞ থাকব। এই ঘটনাটি পুরোপুরিই সত্যি!]