স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা

স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা

১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর মহারাজা ভারতে যোগ দিলেন শর্তসাপেক্ষে। ভারতীয় সেনাবাহিনী শ্রীনগরে পৌছল পরের দিন। উপজাতীয় লোকেরা পিছু হটল। পাকিস্তান পাঠালো সৈন্যবাহিনী। বরামুলা পর্যন্ত ভারত ফের নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হলো। মুজাফফারাবাদ রইল পাকিস্তানের অধীনে। যুদ্ধ চলল ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর মাস নাগাদ। তারপর যুদ্ধবন্ধের চুক্তি (Cease fire) হলো ১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে। ভারতের অধীনেই রইল সিংহভাগ অংশ। কিন্তু, মহারাজা আর শাসনের কেন্দ্রে থাকতে পারলেন না। শেখ আবদুল্লাহকে বানানো হলো রাজ্যের ডিফ্যাক্টো রুলার।

মহারাজা হলেন গভর্নর (সদর-এ-রিয়াসাত)। এরপর শুরু হলো শেখ আবদুল্লাহর সঙ্গে মহারাজার দেনদরবার। শেখ আবদুল্লাহর নেতৃত্বে জনগণের আন্দোলনের মূল দাবি ছিল, মহারাজার শোষণের বিরুদ্ধে একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক শাসন। মহারাজার শোষণ শেষ হলো। কিন্তু, স্বাধীনতার সুযোগ হলো না রাজ্যটির। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের বিশেষ অংশ হলো জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর। এই বিশেষত্ব নির্ধারণের জন্য বহু দেনদরবার, দরকষাকষি হয়েছে। ভারতীয় সংবিধানে আর্টিকেল-৩৭০ যুক্ত করে তাতে জম্মু-কাশ্মীরকে বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হলো। ভারতীয় সংবিধানের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে।

The Constitution applies to the State of Jamma and Kasmir with cartain exceptions and modifications as praided in atrticle 370 and the Constitutions (Application to Jammu and Kashmir) Order, 1954.

রাজ্যসভাকে সরদার-এ-রিয়াসাত’ বা গভর্নর নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হলো। অন্যান্য রাজ্যের ক্ষেত্রে যার নিয়োগ হয় ভারতের রাষ্ট্রপতির হাতে। জম্মুকাশ্মীরকে দেওয়া হলো আলাদা পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত। একারণেই, ভারতীয় পার্লামেন্টে গৃহিত সকল আইনও উল্লেখ থাকে, এই আইনটি জম্মু ও কাশ্মীরে প্রযোজ্য নয়, যতক্ষণ এটি সেখানকার রাজ্যসভায় পাশ না হয়। ভারতীয় তিন রঙা পতাকার পরই শোভা পেতে শুরু করল রাজ্যের স্বতন্ত্র পতাকা। ভারতের সংবিধানে এই ধারা যুক্ত করার জন্য আবদুল্লাহ ও নেহরুর মধ্যে দেনদরবার চলেছে দীর্ঘ পাঁচ

মাসব্যাপী। ১৯৪৯ সালের ১৫ মে থেকে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত। এরপর সাংবিধানিক এসেম্বলি ১৯৪৯-এর অক্টোবরে এই ধারাটি ভারতীয় সংবিধানে যুক্ত করে।

স্বায়ত্তশাসনের শর্তে ভারতের ওপর, সম্ভবত ব্যক্তি নেহরুর ওপর বিশ্বাস করলেন শেখ আবদুল্লাহ। হলেন প্রধানমন্ত্রী। ভারতের সব রাজ্যের গণতান্ত্রিক প্রধানের নাম মুখ্যমন্ত্রী (সিএম)। কিন্তু জেঅ্যাভকের প্রধান হলেন প্রধানমন্ত্রী (পিএম)। আলাদা মর্যাদা, আলাদা পোর্টফোলিও নিয়ে তিনি ভারতের সঙ্গে ভালই শুরু করেছিলেন। এই শুরু হয়েছিল ২৪শে জুলাই ১৯৫২ সালের ‘দিল্লি এগ্রিমেন্টের মাধ্যমে। মহারাজার ভারতে যোগদানের শর্ত ছিল বিদেশনীতি, যোগাযোগ ও প্রতিরক্ষা ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব।

সেই সার্বভৌমত্বের সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নির্ধারিত হলো ‘দিল্লি এগ্রিমেন্টে’। তাতে জেঅ্যান্ডকে ভারতের অংশ হলেও উচ্চমাত্রার স্বায়ত্তশাসনের নিশ্চয়তা দেওয়া হলো। কিন্তু, ব্যাপক স্বায়ত্তশাসনের সেই স্বচ্ছ কাচের দেয়াল বছরান্তেই ভেঙে খান খান হয়ে গেল। ৯ই আগস্ট ১৯৫৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহকে গ্রেপ্তার করা হলো। তার দল ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি) ওই দিনটিকে জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরের কালো দিবস হিসেবে স্মরণ করে থাকে। দলটির বক্তব্য অনুসারে, জনপ্রিয় সরকারকে অবৈধভাবে ভেঙে দেয় করণ সিং (সরদার এ রিয়াসাত)। প্রধানমন্ত্রী আবদুল্লাহকে গ্রেপ্তার করে সেনাবাহিনী। একটি গভীর রাজনৈতিক চক্রান্ত হিসেবে বকসি গোলাম মোহাম্মদকে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বসানো হয়।

দিল্লি সরকার আর্টিকেল ৩৭০ বাতিল চেষ্টার বিরোধিতা করার কারণেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এনসির দাবি, বকসিকে পুতুল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বসিয়েই ৩৭০ ধারাকে বাতিলের চক্রান্ত করা হয়। বকসি তার প্রথম বক্তব্যেও বলেছিলেন, ‘শেখ সাহেব একটি মুক্ত (free) রাষ্ট্র গঠন করতে চান যা তিনি কোনোভাবেই হতে দেবেন না। বিএন মল্লিকের বক্তব্যের বরাতে এনসির পক্ষ থেকে আরও উল্লেখ করা হয়, জওহরলাল নেহরুও শেখ আবদুল্লাহকে গ্রেপ্তারের সমর্থন দিয়েছিলেন, কারণ, তিনি (আবদুল্লাহ) কাশ্মীরিদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুসারে তাদের অধিকার ও মর্যাদা ফিরিয়ে আনার জন্য একটি বিদ্রোহের পরিকল্পনা করছিলেন। তাদের দাবি, ১৯৫২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যেই ৩৭০ ধারাকে শক্তিহীন করা হয়েছে।”

‘দিল্লি এগ্রিমেন্ট’ কাগজে কলমে কাশ্মীরকে স্বায়ত্তশাসন দিলেও কাশ্মীরের প্রতি দিল্লির মনোভাব কখনোই বিশ্বস্ত হয়নি। শেখ আবদুল্লাহ-ই কাশ্মীরকে নেহরুর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন নেহরুর বিশ্বস্ত। কিন্তু, সেই বিশ্বাস বারবারই ভেঙেছে। দিল্লি এগ্রিমেন্টের আগে শেখ আবদুল্লাহ বিভিন্ন সময় দেশি-বিদেশি পক্ষের কাছে স্বাধীনতার কথা প্রকাশ্যে বলেছেন। স্বাধীন জম্মু-কাশ্মীর প্রতিষ্ঠা তার

কাছে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প হিসেবে ছিল। বিধানসভার প্রথম বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন,

আমাদের (কাশ্মীরকে) প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বিকল্প চিন্তা করতে হবে। উভয় (ভারত ও পাকিস্তান) দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেই তাদের থেকে দূরে থাকতে হবে। বর্তমানের অচলাবস্থায় এমন কৌশল পথপ্রদর্শক হতে পারে। এই পন্থা আকর্ষণীয়ও মনে হতে পারে। একটা পর্যটনভিত্তিক রাজ্য হিসেবে আমাদের জন্য, এটা আরও কিছু সুবিধা দিতে পারে। কিন্তু, স্বাধীনতার কথা ভাবতে গিয়ে আমাদের বাস্তবতা বিস্মৃত হলে চলবে না। প্রথমত, আমাদের রাজ্যের সুদীর্ঘ ও জটিল সীমান্ত এলাকা রয়েছে অনেক দেশের সঙ্গে, যা পাহারা দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত শক্তি আমাদের নেই। ফলে স্বাধীনতা রক্ষা করা এতটা সহজ নয়। দ্বিতীয়ত, আমরা ওই সব প্রতিবেশীর মধ্যে কোনো শক্তিশালী পক্ষ দেখি না যে আমাদের স্বাধীন থাকার নিশ্চয়তা দেবে।)

অর্থাৎ, শেখ আবদুল্লাহ স্বাধীনতার আশা রাখলেও দুটি কারণে তা কঠিন বলে মানতেন। তথা: প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং শক্তিশালী গ্যারান্টারের অভাব। এই দুই নিশ্চয়তা তার ছিল না বলেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটা বিকল্প বেছে নেওয়ার পক্ষে ছিলেন। সেক্ষেত্রে তিনি ভারতকে বাছাই করেছেন ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থার আশায়। কিন্তু, ভারতে যোগদানের পরও তিনি ‘শক্তিশালী’ গ্যারান্টার খোজার চেষ্টায় রত ছিলেন। ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৫০ সালে তিনি ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাকে তিনি বলেন, শুধু তিনি নিজে নন।

রাজ্যের অধিকাংশ জনগণ স্বাধীনতা চায়। এমনকি আজাদ কাশ্মীরও স্বাধীন কাশ্মীরে যোগ দেবে। ১৯৫২ সালে তিনি অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনারের সঙ্গেও দেখা করেন। আবদুল্লাহর এই স্বাধীনতার প্রত্যাশা এবং তৎপরতার খবর দিল্লির জানা ছিল। ১৯৫২ সালের জুলাই মাসে দিল্লি এগ্রিমেন্টের পর ভারত মনে করেছিল সেই স্বাধীনতার প্রত্যাশার মুখে স্থায়ীভাবে কুলুপ আঁটা হয়েছে। কারণ, তখন আইনিভাবে ৩৭০ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে যথেষ্ট স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়েছে রাজ্যটিকে। কিন্তু, বছর যেতে না যেতেই আবদুল্লাহ ফের স্বাধীনতার কথা বলতে শুরু করেছিলেন। ১৯৫৩ সালের মে মাসে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী আদলাই স্টিভেনশনের সঙ্গে সাক্ষাতে সেকথা বলেন। ভারতের জন্য এটা একটা মাথাব্যথার কারণ হয়।

অপরদিকে, দিল্লি এগ্রিমেন্টে দেওয়া স্বায়ত্তশাসনের সীমারেখা অনেকক্ষেত্রেই লঙ্গন করেছিল ভারত। অর্থাৎ, দিল্লি এগ্রিমেন্ট’ এর শর্ত কোনো পক্ষই মেনে চলেনি। এটাই ধীরে ধীরে আস্থার সংকট সৃষ্টি করেছে নেহরু ও আবদুল্লাহর মধ্যে। এরই মধ্যে জম্মুতে কিছু হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতা ‘প্রজা পরিষদসহ বিভিন্ন ব্যানারে

আর্টিকেল ৩৭০ বাতিল করে জম্মু-কাশ্মীরকে সম্পূর্ণভাবে ভারতের সঙ্গে সংযুক্তির দাবি শুরু করে। এই দাবির পক্ষে শক্ত সমর্থন দেয় ভারতের হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ‘জনসংঘ’ (প্রতিষ্ঠা ১৯৫১)। ১৯৫২ সালে প্রজা পরিষদের দুই নেতাকে আটক করে শেখ আবদুল্লাহর সরকার। ১৯৫৩ সালের ৮ মে জনসংঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী জম্মু-কাশ্মীরে ঢুকতে গেলে তাকেও আটক করা হয়। ওই হিন্দু নেতা কারাগারে মারা যান। এই ঘটনাগুলো স্বায়ত্তশাসন (আর্টিকেল ৩৭০) বিরোধী আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে। এসব ঘটনার ধারাবাহিকতা হলো, ১৯৫৩ সালের অগাস্টে শেখ আবদুল্লাহকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া এবং কারাগারে পাঠানো।

শেখ আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে, তিনি পাকিস্তানের গুপ্তচরের সঙ্গে গোপনে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছেন যা রাজ্যের জন্য ক্ষতির কারণ। ভারতীয় ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহকে এই লেখকের প্রশ্ন ছিল, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীর পাকিস্তানে না গিয়ে সেকুলার ভারতে আসল। তারপরই ১৯৫৩ সালে শেখ আবদুল্লাহর গ্রেপ্তারের মাধ্যমে সেই সেকুলার আস্থার পরাজয় হলো কি না? তিনি বলেছিলেন, এটা সেকুলারিজমের পরাজয় না হলেও আইনের শাসনের পরাজয়।

নেহরু জম্মু-কাশ্মীরে আইনের শাসন দিতে ব্যর্থ হয়েছেন’। এভাবেই শেখ আবদুল্লাহ স্বায়ত্তশাসনের প্রলোভনে ভারতের প্রতি আস্থা রেখেছিলেন। কিন্তু, সেই আস্থার অপমৃত্যু হয়। ন্যাশনাল কনফারেন্সসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল কখনও দিল্লির পক্ষ থেকে যতটুকু ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তাতেই সন্তুষ্ট থেকেছে। কখনও আবার অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। তবে, ঘাড় ফুলিয়ে দাবি। করতে পারেনি যে আর থাকবো না তোমাদের সঙ্গে। যেসব রাজনৈতিক দল স্বায়ত্তশাসনের চুক্তির অংশীদার ছিল না তারা সেই সময়ে (১৯৪৭) ছিল অজনপ্রিয়। ক্রমে তারাই জনপ্রিয় হয়। জাতিসংঘসহ নানা প্রতিষ্ঠান থেকে দেওয়া প্রস্তাব ও মন্তব্যগুলো তাদের জন্য দালিলিক সুযোগ বৃদ্ধি করে। ১৯৪৮ – ৪৯ সালের জাতিসংঘের প্রস্তাবে লেখা হয়েছিল,

Accession of the state of Jammu and Kashmir to India or Pakistan will be decided through the democratic method of a free and impartial plebiscite’.

অর্থাৎ, সেখানে স্বাধীনতার কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু, ১৯৫০ – ৫১ সালের প্রস্তাবে লেখা হয়, “The final disposition of the state’ যার মাধ্যমে সেলফ ডিটারমিনেশনের বা স্বাধীনতার সুযোগ উন্মুক্ত করা হয়। এভাবে ক্রমান্বয়ে স্বায়ত্তশাসনের দাবি ম্রিয়মাণ হয়ে আজাদির দাবি হয়ে ওঠে জনপ্রিয়। মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে ধ্বনিত হতে শুরু করে শ্লোগান-‘হাম কেয়া চাতেহে?

আজাদি?হিক হামারা, আজাদি/ছিনকে লেঙ্গে, আজাদি’। তবে, ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি) ও পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টিসহ (পিডিপি; এনসি থেকেই গড়ে ওঠা) প্রো-ইন্ডিয়ান দলগুলো এখনও অটোনমি বা সেলফ রুলেই সন্তুষ্ট। তারা ভারতীয় বিধানের অধীনে রাজনীতি করছে। নির্বাচন করছে। ক্ষমতায় আসছে। আর কেন্দ্রের সঙ্গে দেনদরবার করছে স্বায়ত্তশাসন কিংবা সেলফ রুলের জন্য।

কাশ্মীরিরা ভারতবিরোধী কেন একটা বিষয় প্রশ্ন আসতে পারে। শেখ আবদুল্লাহ মুসলিম নেতা হয়েও ভারতে যোগ দিতে রাজি হলেন কেন? প্রথমত, শেখ ছিলেন নেহরুর রাজনৈতিক বন্ধু। জিন্নাহর সঙ্গে ছিল তার আড়ি। কাশ্মীরকে তিনি আলাদা জাতিসত্তা মনে করতেন। মুসলমান সত্ত্বেও কাশ্মীরকে দ্বিজাতিতত্ত্বের অধীন বলে তিনি স্বীকার করেননি। দ্বিতীয়ত, কাশ্মীরে মহারাজার শোষণের বিরুদ্ধে ১৯৩১ সালে গণআন্দোলন শুরু হয়। তার মাধ্যমেই শেখ নেতা হয়ে ওঠেন। শেখের রাজনৈতিক দল মুসলিম কনফারেন্স জমিদারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের শাসনের দাবিতে আন্দোলন করে আসছিল।

১৯৩৭ সালে নেহরু, গান্ধীসহ বিভিন্ন নেতার সঙ্গে যোগাযোগ হয় শেখের। তিনি উপলব্ধি করেন, মুসলিম কনফারেন্স নামে নেহরু-গান্ধীসহ ভারতীয় নেতাদের সমর্থন পাওয়া যাবে না। তিনি দলের কাউন্সিলে বিষয়টি তোলেন। ১৯৩৯ সালে দলের নাম বদলে রাখা হয় জেঅ্যান্ডকে ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি)। তখনও মুসলমানদের জন্য আলাদা ভূ-খণ্ডের দাবিতে পাকিস্তান প্রস্তাবই (লাহোর) হয়নি। এনসি হওয়ার পর ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস সেই আন্দোলনে বরাবরই সমর্থন দিয়েছে।

নেহরুসহ ভারতীয় নেতারা মহারাজার স্বৈরতন্ত্রের বিপরীতে গণতন্ত্রের দাবি করেছেন সবসময়। মহারাজার জমিদারির বিরুদ্ধে আন্দোলনের কারণে শেখ আবদুল্লাহ ও তার দল এনসি কাশ্মীরে জনপ্রিয় হয়। শেখ আবদুল্লাহ ছিলেন বাগ্মী। তিনি ছিলেন আলীগড়ের এমএ। দলে তার ছিল ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু, নাম পরিবর্তনের পরও সে অর্থে হিন্দুদের ব্যাপক সমর্থন পাননি শেখ আবদুল্লাহ।

লাহোরে পাকিস্তান প্রস্তাবিত হওয়ার পর উপমহাদেশের রাজনীতি বদলে যায়। কংগ্রেস বলে সর্বজনীন ভারত। মুসলিম লীগ বলে পাকিস্তান-পাকিস্তান। আবার কংগ্রেসের সর্বজনীনতার শ্লোগানের মধ্যেও সরদার প্যাটেলসহ একটা গ্রুপের মনে হিন্দু ভারতের স্বপ্নও বিকশিত হয়। প্রশ্ন ওঠে, জম্মু-কাশ্মীর কোথায় যাবে? ১. হিন্দুস্থান বনাম পাকিস্তান; ২. জমিদারি শোষণ থেকে মুক্তি- এই দুটি ইস্যু তখন একত্র হয়ে কাশ্মীরের রাজনীতিতে হাজির। শেখের শ্লোগান ছিল, যোগদানের আগে স্বাধীনতা (Freedom before Accession)। আগেই বলেছি, জিন্নাহ

আশাবাদী ছিলেন। তিনি কম সক্রিয় ছিলেন। নেহরু উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি ছিলেন সক্রিয়। একদিকে নেহরু ও গান্ধী মহারাজার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক শেখকে সমর্থন করেছেন। অন্যদিকে প্যাটেলসহ ভারতীয় কংগ্রেসের হিন্দুত্ববাদী নেতারা মহারাজার সঙ্গে নীরব যোগাযোগ রেখেছেন। প্রভাবিত করেছেন। ভারতে যোগদানপত্র যদিও সই করেন মহারাজা। কিন্তু, তার আগে শেখ আবদুল্লাহকে নেহরুর অনুরোধে মুক্তি দিতে হয়। ২৬শে অক্টোবর ১৯৪৭ মহারাজা যোগ দেন। আর ১৯৪৮ সালের ৫ই মার্চ মহারাজার ইতি ঘটে। নেহরু জেঅ্যান্ডকে’র ‘মুকুট পরান শেখ আবদুল্লাহকে।

বিশেষ মর্যাদার রাজ্য হিসেবে ঘোষিত জেকে প্রধানকে দেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রী পদ। নেহরুর ‘বৈচিত্র্যময় ভারতের ধারণার প্রতি আস্থা রেখেছিলেন শেখ আবদুল্লাহ। আবদুল্লাহ নিজেও ছিলেন বৈচিত্র্যময়। একদিকে তিনি উপমহাদেশের প্রথম নেতা যিনি মুসলিম রাজনৈতিক দলের নাম বদলেছিলেন অন্য ধর্মের অংশগ্রহণ পেতে। আবার তিনিই স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যাপকভাবে জড়িত ছিলেন। তার রাজনীতির শুরুই হয়েছিল খানকাহ-এ-মওলায়। সমাবেশে গিয়ে তিনি পড়তেন সুরা রাহমান মর্মভেদী সুরে। তবুও, শেখ ছিলেন নেহরুর দৃষ্টিতে ‘অ্যাসেট ফর ইন্ডিয়া। তখন, ১. প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখের শাসন অভ্যন্তরীণভাবে ছিল কর্তৃত্ববাদী। ১৯৫১ সালে রাজ্যে নির্বাচন হয়। তাতে ৭৫টি আসনের প্রত্যেকটিতেই নির্বাচন হয় প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন।

আবদুল্লাহর সমালোচক কেউ ছিল না। ২. ভারতে গান্ধীর প্রাণ গেল। হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা সহিংস হয়ে উঠল। হিন্দুত্ববাদ’ বিকশিত হচ্ছিল জম্মুতে। ৩. আবদুল্লাহ-নেহরুর মধ্যে দেখা দিল আস্থার সংকট। ভারত থেকে স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন শেখ, এমন সন্দেহ চাউর হলো। ওদিকে আবদুল্লাহও বুঝতে পারছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর পদাসীন হলেও কাঠি নাড়ে অন্য কেউ। ১৯৫৩’র ৯ আগস্ট নেহরুই কঠোর হস্তে আদর করে আবদুল্লাহকে পাঠালেন জেলে। আবদুল্লাহরই শিষ্য বকসি গোলাম মোহাম্মদকে বসালেন দিল্লির মর্জিতে উঠতে বসতে। ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ যাকে বলেছিলেন, আইনের শাসনের ব্যর্থতা। অনেকে আবার বলেছেন, বৈচিত্র্যময় সেকুলার ভারতই ব্যর্থ হয়েছে সেদিন।

ভারত বিরোধিতা মানেই কি পাকিস্তানপ্রীতি

ভারতের প্রতি নাখোশ কাশ্মীরিরা। তাহলে কি তারা পাকিস্তানের পক্ষে? এটা একটা বাইনারি। এই বাইনারির সৃষ্টি হয়েছে ব্রিটিশদের ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্ট অ্যাক্ট১৯৪৭ এর মাধ্যমে। সেখানে বলা আছে, ব্রিটিশ ভারতের প্রিন্সলি স্টেটগুলো দুটি ডমিনিয়নের (ভারত অথবা পাকিস্তান) যেকোনো একটিতে যেতে পারবে। সেখানে

তৃতীয় বিকল্প-স্বাধীনতার কথা ছিল না। বিতর্ক ছিল, যোগদানের প্রক্রিয়া নিয়ে। কেউ বলেছে, শাসক নিজে যোগ দেবেন। কেউ বলেছে না, জনগণকে গণভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্তের সুযোগ দিতে হবে। তবে, সেখানেও গণভোটের ক্ষেত্রে জনগণের সামনে বিকল্প থাকবে ২টা। ভারত অথবা পাকিস্তান। স্বাধীনতার কোনো সুযোগ জনগণকে দেওয়া হয়নি ওই আইনে। পরে জাতিসংঘ অন্তত ২৭টি রেজুলেশন পাস করেছে কাশ্মীর বিষয়ে। ওই সব রেজুলেশনে নানাভাবে বলা হয়েছে, ভাগ্য নির্ধারণের সুযোগ দেওয়া উচিত জনগণকে। কিন্তু, সেখানে জনগণের সামনে গণভোটে কয়টি বিকল্প থাকবে? এখনও প্রায় সব বিশেষজ্ঞ মনে করেন, আইন ও ইতিহাস অনুযায়ী বিকল্প দুটি: ভারত বা পাকিস্তান।

কিন্তু, জনগণের কাছে ‘আজাদি’র চেয়ে বেশি উচ্চারিত আর কোনো শব্দ এখন কাশ্মীরে শোনা যায় না। ভারত থেকে প্রায়ই অভিযোগ ওঠে, কাশ্মীরিরা আজাদির নামে পাকিস্তানের মদতে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। আজাদির শ্লোগানের পেছনে পাকিস্তানের ভূমিকা কতখানি তা আলোচনার আগে স্পষ্ট হওয়া দরকার পাকিস্তানের প্রতি মানুষের সমর্থন কেমন? আমার একাধিক বন্ধু বলেছিলেন, পাকিস্তান আমাদের কাছে দ্বিতীয় কাবার মতো। অপেক্ষাকৃত উদারপন্থী বন্ধুরা বলত, পাকিস্তান দেশ হিসেবে নানাভাবে সংকটাপন্ন। কিন্তু, সকল সমস্যা মাথায় নিয়েও পাকিস্তানই একমাত্র দেশ, কাশ্মীরিদের অধিকারের কথা বলে আসছে সবসময়।

পাকিস্তানই এখনও কাশ্মীরিদের জাতিসংঘ ঘোষিত ‘গণভোটের’ দাবি আন্তর্জাতিক ইস্যু হিসেবে বাঁচিয়ে রেখেছে। হোকনা সেটা বদ উদ্দেশ্যে! যদি বিশ্বের অন্যসব দেশের মতো পাকিস্তানও কাশ্মীরিদের ভুলে যেত তাহলে কী হতো? এমনকি ভারতপন্থী রাজনৈতিক দলও পাকিস্তানকে অস্বীকার করতে পারে না। এক রাজনীতিক একবার ঠাট্টা করে বলছিলেন, ‘আমরা ভারতে থাকতে চাইলেও তিনটি বিষয়ে আমাদের পাকিস্তানের পক্ষেই থাকতে হবে। এক, ক্রিকেট, দুই. ঈদের চাঁদ এবং তিন নারায়ে তাকবির শ্লোগান। আমরা ভারতকে বলি, এই তিন বিষয়ে আমরা পাকিস্তান। এতে তোমরা নাখোশ হয়ো না।

আগেই বলেছি, শেখ আবদুল্লাহর জনপ্রিয়তা ছিল অনেক। ভারতকেই নিজের দেশ মেনেছিলেন শেখ। পাঠানদের আক্রমণ ঠেকাতে শেখের অনুসারী কাশ্মীরিরাই প্রতিরোধ শুরু করেছিল প্রথম। প্রশ্ন হলো, তাহলে এই পাকিস্তানপ্রীতির জন্ম হলো কিভাবে। হঠাৎ করেই মানুষ পাকিস্তানের প্রতি ঝুঁকে পড়েনি। মনস্তাত্ত্বিকভাবে কাশ্মীরিদের পাকিস্তানাইজেশন হয়েছে ধাপে ধাপে। মুসলমানরা ভাই-ভাই’- এই শ্লোগান হলো পাকিস্তানাইজেশনের প্রথম ধাপ। ১৯৩৯ সালে যখন শেখ আবদুল্লাহ মহারাজার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার আন্দোলনকে ‘সার্বজনীন করার জন্য মুসলিম

কনফারেন্সের নাম বদলে ন্যাশনাল কনফারেন্স করেন তখন দলের সেক্রেটারি ছিলেন চৌধুরী গোলাম আব্বাস। তিনি ছিলেন জম্মুর মুসলমানদের প্রতিনিধি। মনে রাখতে হবে, মুসলমানরা কাশ্মীরে সংখ্যায় বেশি, জম্মুতে তারা কম। সংখ্যালঘু হিসেবে জম্মুর উত্তর দিকের জেলাগুলোর মুসলমানরা ছিল সবদিক থেকে সবসময় অবহেলিত। সেই বাস্তবতা মাথায় রেখে চৌধুরী আব্বাস ন্যাশনাল কনফারেন্স থেকে সরে যান। তিনি কাশ্মীরি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন না। ফলে, তার এই রাজনৈতিক অবস্থান কাশ্মীরের জনসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তিনি জম্মুর মুসলমানদের কাছেই মূল্যায়ন পেয়েছেন। বিপরীতক্রমে, শেখ আবদুল্লাহর অসাধারণ বাগ্মিতা এবং কাশ্মীরের বিভিন্ন খানকায় ইসলামী বক্তৃতা ও তেলাওয়াত তাকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রশ্নে জনগণ শেখ আবদুল্লাহর কথা অন্ধভাবে মেনেছে। আর যেহেতু রাজনীতির কেন্দ্রে ছিল কাশ্মীর সেহেতু আবদুল্লাহর ভারতে যোগদানে কাশ্মীরিরা নিমরাজি হয়েছে। জম্মুর মুসলমানদের মতামত সেখানে খুব একটা কাজে লাগেনি। তবে, লাহোর প্রস্তাবের পর চৌধুরী আব্বাসের উদ্যোগে মুসলিম কনফারেন্স পুনরায় উজ্জীবিত হয়। তারা দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রচারণায় যুক্ত হয়। কাশ্মীরেও মীরওয়াইজ (কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ ও ঈদগাহের ঐতিহ্যবাহী ইমাম) পরিবার সেই মতের সমর্থক ছিলেন। ব্যাপক জনপ্রিয় না হলেও মৌলিকভাবে মুসলিম জনসংখ্যার কাছে মীরওয়াইজ পরিবারের গ্রহণযোগ্যতা ছিল।

আবদুল্লাহ তখন ৮-১০ বছরের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের অধিকারী হঠাৎ জনপ্রিয় হয়ে ওঠা নেতা। আবদুল্লাহর এই নেতা হয়ে ওঠা মীরওয়াইজ’ পরিবারের সুপ্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় নেতৃত্বের অবস্থানকে দুর্বল করেছিল। এসব কারণে এখনও মীরওয়াইজ পরিবার কাশ্মীরের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর এবং তা ন্যাশনাল কনফারেন্সের বিরোধী। মোদ্দাকথা, নেহরুগান্ধীর রাজনৈতিক দর্শনের যেমন প্রতিনিধি ছিল এনসি, তেমনি মুসলিম লীগেরও উপস্থিতি খানিকটা ছিল এমসির মাধ্যমে। ফলে, কাশ্মীর যখন ভারতে যোগ দেয়, যাতে শেখ আবদুল্লাহ সমর্থন দেন, তখন খোদ এনসি’র অনেক নেতা দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছিলেন।

শেখ আবদুল্লাহকে তারা বোঝাতে চেয়েছেন বিপরীত ভাবনার জন্য। অর্থাৎ, ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান প্রশ্নে উপমহাদেশব্যাপী যে দ্বিধা ছিল তা কাশ্মীরকেও স্পর্শ করেছিল। কিন্তু, আবদুল্লাহর তেজস্বী নেতৃত্বের কারণে সেই দ্বিধা বিস্ফোরণ আকারে দেখা যায়নি। তবে, সেই দ্বিধাই পাকিস্তানাইজেশনের বীজ হিসেবে রয়ে গিয়েছিল। সেটিই ক্রমে বিকাশ লাভ করে নানাভাবে। দ্বিতীয় কারণটি হলো ভৌগোলিক। ভারতীয় আইনজীবী এ জে নূরানী লিখেছেন, সকল মৌসুমে শ্রীনগরের সঙ্গে বাকি বিশ্বের যোগাযোগের একমাত্র রাস্তা ছিল পুরাতন রাওয়ালপিন্ডি রোড। কাশ্মীরের নদীগুলো বয়ে গেছে পাকিস্তানে। সকল ভৌগোলিক ব্যবস্থায়

কাশ্মীর পাকিস্তানের সঙ্গে মেলে। কাশ্মীর থেকে বর্তমান রাস্তায় ভারতের মুম্বাই সমুদ্রবন্দরের দূরত্ব ৩৩০০ কিলোমিটার। আর করাচি বন্দরের দূরত্ব ছিল ১২০০ কি.মি.। ব্যবসা বাণিজ্যের জন্যও পাকিস্তানের রাস্তাই কাশ্মীরিদের জন্য ছিল সুবিধাজনক। এই রাজনৈতিক অর্থনীতিও কাশ্মীরিদের পাকিস্তানাইজেশনের অন্যতম কারণ। তৃতীয়ত, জম্মুর সংখ্যালঘু মুসলমানরা অনেকেই ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানি অংশে চলে গেছেন। জম্মুতে চৌধুরীর আব্বাসের কন্যাও নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন। চৌধুরী আব্বাস পরে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী হন। পাকিস্তানের অধিকৃত এলাকায় শেখ আবদুল্লাহর ব্যক্তিগত প্রভাবও ছিল কম।

মোটকথা, ওই এলাকায় পাকিস্তানাইজেশন সহজ হয়েছে। বিপরীতক্রমে, ভারতীয় অংশে ইন্ডিয়ানাইজেশন প্রক্রিয়া বারবার নানা কারণে ব্যর্থ হয়েছে। পরম বিশ্বস্ত শেখ আবদুল্লাহকেই বিশ্বাসঘাতক হিসেবে যখন জেলে পাঠানো হয়েছে তখন কাশ্মীরিরা আর ভারতের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পারেনি। ইন্ডিয়ানাইজেশনের ব্যর্থতা পাকিস্তানাইজেশনে গতি এনেছে। আর জম্মুর হিন্দু নাগরিকেরা আরও জোরে আওয়াজ তুলেছেন কাশ্মীরকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করতে। ফলে, জম্মু আর কাশ্মীরের মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্ব মাত্র একটি পাহাড় হলেও বাস্তবিক দূরত্ব হয়েছে।

অসীম। এতকিছুর পরও প্রশ্ন হচ্ছে, কী পরিমাণ কাশ্মীরি পাকিস্তানের পক্ষে? স্পষ্টতই, ভারতীয় গণমাধ্যমের একাট্টা প্রচারণা হলো, সব কাশ্মীরিই পাকিস্তানপন্থী। এই প্রচারের মাধ্যমে ভারতীয় অ্যাকশনের বৈধতা দেওয়া যায়। এমনকি শেখ আবদুল্লাহকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল পাকিস্তানের সঙ্গে গোপন বৈঠকের অভিযোগে। বিপরীতদিকে, পাকিস্তানি গণমাধ্যমও দাবি করে, সব কাশ্মীরিই তাদের। এই দ্বিধার মধ্যে, ২০১০ সালে লন্ডনভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উভয় পাশে চালানো জরিপ বলছে, ৪৩ শতাংশ কাশ্মীরি স্বাধীনতা চায়। ১৫ শতাংশ পাকিস্তান, ২১ শতাংশ ভারত এবং ৭ শতাংশ লোক চায় বর্তমান অবস্থা। আর, গণভোটের ব্যালটে স্বাধীনতার সুযোগ না থাকলে স্বাধীনতার প্রত্যাশীরা পাকিস্তানের পক্ষে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, গণভোট আদৌ হবে কিনা।

নোট/সূত্র

১. Srinath Raghavan (2013); 1971: Global History of the Bangladesh War, Pl.

২. Sajad Padder (2015), India-Pakistan Composite Dialogue Process; New Delhi: Kalpaz; P 22-23.

৩. A G Noorani; A Worked Compact; Greater Kashmir (Nov 1, 2015); P11. /পরিশষ্ট দ্রষ্টব্য: article 370 & India Constantia

৪. Greater Kashmir; August 9, 2015, Page 6.

৫. Sajad Padder (2015) reproduced from Ajit Bahttacharjea (1996)

৬. Sheikh Abdullah; Flames of The Chinar (1993)

৭. Khalid Bashir Ahmed; (2014); Circa-1947: A long story; http://www.kashmirlife.net.

৮. Mridu Rai; The Hindu Rulers Muslim Subjects; Permanent Black (2005)

৯. UK Chatham House Pole result taken from ‘Reality Check: Who actually cares about the Kashmiris?’ Mehdi Hasan’s Reality Check; Al Jajeera, August 6, 2016.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *