স্বামী-স্ত্রী
ক্যাফেতে এয়ার কন্ডিশনিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। ১৮৭৪ সালে যখন ক্যাফেটা খোলা হয়, তখন অবশ্য এসবের বালাইও ছিল না। বাতির উৎস হিসেবে তেলের কুপিই চিনত মানুষজন। সময় গড়ানোর সাথে সাথে কয়েকবার সংস্কার করা হয়েছে অবশ্য, কিন্তু ভেতরের সাজসজ্জা মোটামুটি অপরিবর্ততই আছে একশো চল্লিশ বছর ধরে। প্রথম দিকে নিশ্চয়ই এই সাজসজ্জাই আধুনিক হিসেবে গণ্য হতো। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে জাপানে এই ধাঁচের ক্যাফে জনপ্রিয় হতে শুরু করে ১৮৮৮ সালে, পাক্কা চৌদ্দ বছর পরে।
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে কফির সন্ধান পায় এই অঞ্চলের লোকজন, এদো যুগ চলছিল তখন। প্রথম দিকে অবশ্য বেশি মানুষ নতুন ধাঁচের এই পানীয়ের প্রতি খুব একটা আকৃষ্ট হয়নি। এটাই স্বাভাবিক, কে চাইবে দিনশেষে বা দিনের শুরুতে ওরকম তেতো কিছু মুখে দিতে?
বিদ্যুৎ সহজলভ্য হবার পর ক্যাফের কুপিগুলো প্রতিস্থাপিত হয় বৈদ্যুতিক বাতির দ্বারা। কিন্তু এয়ার কন্ডিশনার বসানো হলে জায়গাটা তার ‘প্রাচীনত্ব’ এবং ‘ঐতিহ্য’ হারাবে-এমনটাই ধারণা ছিল তৎকালীন মালিকের। তার উত্তরপুরুষেরাও একই ধারণায় বিশ্বাসী বলে আজ অবধি এয়ার কন্ডিশনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়নি।
কিন্তু প্রতি বছর গ্রীষ্ম আসে তার দাপট নিয়ে। মাঝ দুপুরে তাপমাত্রা যখন ত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁইছুঁই, তখন এয়ার কন্ডিশনার ছাড়া যে- কোনো ক্যাফের পরিবেশই (হোক সেটা মাটির নীচে) জ্বলন্ত উনুনের মতোন হবার কথা। ফানিকুলি ফানিকুলায় অবশ্য একটা বড় সিলিং ফ্যান আছে (অনেক পরের সংযোজন)। তবে একটা মাত্র সিলিং ফ্যানের পক্ষে ভেতরের গরম দূর করাটা দুরূহই বটে।
জাপানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল কোচি প্রিফেকচারে, ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরকম তাপমাত্রায় সিলিং ফ্যান চলা আর না চলা একই কথা। কিন্তু গ্রীষ্মের প্রবল তাপদাহের সময়েও ক্যাফের ভেতরের পরিবেশ থাকে আশ্চর্যজনক রকমের শীতল। কীভাবে? সেটা বাইরের কেউ জানে না, জানবেও না।
গ্রীষ্মের এক পড়ন্ত বিকেল। ক্যাফের ভেতরে এক তরুণী কাউন্টারের উলটোদিকে বসে মনোযোগ দিয়ে কিছু লেখায় ব্যস্ত। গরমকাল শুরু হয়েছে খুব বেশিদিন হয়নি, কিন্তু তাপমাত্রা ত্রিশের আশপাশে। তরুণীর সামনে এক গ্লাস আইসড কফি। বরফ গলে কফির সাথে মিশে যেতে শুরু করেছে। তরুণীর পরনে গরমকালের পোশাক-একটা পাতলা সাদা টিশার্ট, ধূসর রঙের আঁটসাঁট মিনি স্কার্ট আর স্যান্ডেল। পিঠ সোজা করে গোলাপে রঙের কাগজে চিঠি লিখে চলেছে সে।
কাউন্টারের পেছনে দাঁড়িয়ে এক মাঝবয়সি মহিলা মুগ্ধ নয়নে তরুণীকে দেখছে। কেই তোকিতা, ক্যাফে মালিকের স্ত্রী। চিঠির বিষয়বস্তু কৌতূহলী করে তুলেছে তাকে। মাঝে মাঝেই বাচ্চাদের মতো আড়চোখে দেখে নিচ্ছে কী লিখছে তরুণী।
এই দু’জন বাদে ক্যাফেতে এখন আছে সাদা পোশাক পরিহিতা সেই ভদ্রমহিলা আর ফুসাগি। আজকেও দরজার কাছের টেবিলে বসেছে লোকটা। সামনে একটা ট্রাভেল ম্যাগাজিন।
চিঠি লিখতে লিখতে লম্বা একটা শ্বাস নিলো তরুণী। তার কিছুক্ষণ পর কেই নিজেও দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
“এতক্ষণ ধরে সিটটা দখল করে রাখার জন্য দুঃখিত,” সদ্য লেখা চিঠিটা খামে ঢুকিয়ে রাখতে রাখতে বললো তরুণী।
“আরে, এটা কোনো সমস্যাই না,” দ্রুত অন্যদিকে তাকিয়ে বললো কেই।
“ইয়ে…আপনি কী এই চিঠিটা আমার বোনকে দিতে পারবেন?”
চিঠি ভর্তি খামটা বিনয়ী ভঙ্গিতে কেইয়ের উদ্দেশ্যে বাড়িয়ে ধরলো তরুণী। তার নাম কুমি হিরাই। এই ক্যাফের নিয়মিত কাস্টমার ইয়েকো হিরাইয়ের ছোট বোন সে।
“আসলে, তোমার বোনকে যতটা চিনি…” বাক্যটা শেষ না করে ঠোঁট কামড়ে ধরলো কেই।
মাথা একদিকে কাত করে প্রশ্নাতুর দৃষ্টিতে কেইয়ের দিকে তাকালো কুমি।
জবাবে মাথা ঝাঁকিয়ে একবার হাসলো কেই। “আচ্ছা…আমি দিয়ে দিব,” চিঠির দিকে তাকিয়ে বললো কিছুক্ষণ পর।
“আমি জানি যে ও হয়তো এটা পড়বে না। কিন্তু আপনি যদি ওকে চিঠিটা দেন, আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো,” মাথা নিচু করে দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বললো কুমি।
“অবশ্যই দিব,” নিজেকে সামলে কোমল গলায় বললো কেই। দু’হাত বাড়িয়ে চিঠিটা এমনভাবে নিলো যেন মহা গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিচ্ছে। পালটা বাউ করতেও ভুললো না।
কলমটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ক্যাশ রেজিস্টারের কাছে চলে এলো কুমি। “বিল কত হয়েছে?”
চিঠিটা সাবধানে কাউন্টারের উপরে নামিয়ে রাখলো কেই। এরপর ক্যাশ রেজিস্টারের নির্দিষ্ট বাটনে চাপ দিলো।
ফানিকুলি ফানিকুলার ক্যাশ রেজিস্টার দেশের সবচেয়ে পুরানো ক্যাশ রেজিস্টারগুলোর একটা। টাইপরাইটার সদৃশ এই যন্ত্রটা ক্যাফেতে আনা হয়েছে ১৯২৫ সালে, শৌয়া আমলে। রেজিস্টারটা এমনভাবে বানানো যে কেউ চুরি করতে চাইলে সুবিধে করে উঠতে পারবে না। ওজন প্রায় চল্লিশ কেজি। কোনো একটা বাটন চাপ দিলে ‘ক্ল্যাঙ্ক’ করে শব্দ হয়।
“কফি…টোস্ট…কারি রাইস… মিক্সড পারফে…”
ক্ল্যাঙ্ক ক্ল্যাঙ্ক ক্ল্যাঙ্ক ক্ল্যাঙ্ক…ক্ল্যাঙ্ক ক্ল্যাঙ্ক। নির্দিষ্ট বিরতিতে বাটন চেপেই চলেছে কেই। “আইসক্রিম সোডা…পিজ্জা টোস্ট…”
একা হলেও কম খাবার খায়নি কুমি। দ্বিতীয় আরেকটা রসিদের কাগজ ব্যবহার করতে হচ্ছে কেই’কে। “কারি পিলাফ…বানানা ফ্লোট…কাটলেট কারি…” সাধারণত সব আইটেমের নাম মুখে না বললেও চলে, কিন্তু কেই কাজটা করে মজা পায়। তাকে ক্যাশ রেজিস্টারের বাটন চাপতে দেখলে মনে হবে কোনো বাচ্চা বুঝি তার প্রিয় খেলনা দিয়ে খেলছে।
“এর সাথে আপনি নিয়েছেন গরগনজোলা নচ্চি আর চিকেন ক্রিম পাস্তা…’”
“একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছি বোধহয় আমি, তাই না?” লজ্জিত কণ্ঠে বললো কুমি। সব আইটেমের নাম জোরে জোরে না বললেও চলবে, আসলে এরকম কিছু বলতে চেয়েছিল বোধহয়।
“তা খেয়েছেন।”
কেই নয়, ফুসাগি বললো কথাটা। সব আইটেমের নামই পরিষ্কার শুনতে পেয়েছে সে। বিড়বিড় করে কিছু একটা বলে আবারো ম্যাগাজিনের দিকে মনোযোগ দিলো সে।
কেই তার কথা আমলে না নিলেও কুমির কান লাল হয়ে গেল। “কত হয়েছে,” নিচু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো সে। কিন্তু কেইয়ের হিসেব তখনও শেষ হয়নি।
“আর একটু…একটা মিক্সড স্যান্ডউইচ, গ্রিলড ওনিগিরি…আরেকটা কারি রাইস…আইসড কফি…সব মিলিয়ে দশ হাজার দুইশ ত্রিশ ইয়েন,” মিষ্টি ভঙ্গিতে হেসে বললো কেই। তার দৃষ্টিতে খেলা করছে মমতা।
“আচ্ছা, এই নিন,” বলে পার্স থেকে দুটো নোট বের করলো কুমি।
নোট দু’টো নিয়ে উলটে পালটে দেখলো কেই, এরপর বললো, “এগারো হাজার ইয়েন দেওয়া হয়েছে।” নির্দিষ্ট বাটনে চেপে টাকার পরিমাণটা ইনপুট দিলো ক্যাশ রেজিস্টারে।
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে কুমি।
শব্দ করে খুলে গেল ক্যাশ ড্রয়ার। ভাংতি টাকা বের করে আনলো কেই। “এই যে আপনার সাতশো সত্তর ইয়েন,” আগের মতোনই হাসিমুখে টাকাটা কুমির দিকে বাড়িয়ে দিলো সে।
বিনয়ের সাথে একবার মাথা নোয়ালো কুমি। “ধন্যবাদ। খাবারগুলো দারুণ ছিল।” সব খাবারের নাম একটা একটা করে বলায় কিছুটা লজ্জাই পেয়ছে সে। যত দ্রুত সম্ভব পালাতে পারলে বাঁচে। দরজার কাছে পৌঁছে গেছে সে এমন সময় পেছন থেকে ডাক দিলো কেই।
“ইয়ে…কুমি।”
থেমে পেছনে ফিরে তাকালো মেয়েটা।
“আপনার বোনকে…মানে…” নীচের দিকে তাকিয়ে বললো কেই। “তাকে কী কিছু জানাতে হবে? চাইলে আমাকে বলতে পারেন।”
“নাহ, আমি চিঠিতেই সব লিখে দিয়েছি,” কোনো প্রকার দ্বিধা ছাড়াই বলে দিলো কুমি।
“ওহ…” কেইকে দেখে মনে হচ্ছে কিছুটা নিরাশই হয়েছে।
কেইয়ের এরকম হতাশ অভিব্যক্তি দেখে শেষ মুহূর্তে মতো পালটালো মেয়েটা। মুখে হাসি টেনে বললো, “একটা কথা অবশ্য ওকে বলতে পারেন আপনি…”
“জি, অবশ্যই,” সাথে সাথে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো কেইয়ের চেহারা।”
“ওকে বলবেন যে মা আর বাবা ওর উপরে রাগ করে নেই।”
“মা-বাবা রাগ করে নেই,” তার কথা পুনরাবৃত্তি করলো কেই।
“হ্যাঁ…দয়া করে এটা বলবেন।”
আগের সেই দ্যুতি ফিরে এসেছে কেইয়ের চেহারায়। দু’বার মাথা নাড়লো সে। “অবশ্যই বলবো।”
ক্যাফের চারপাশে একবার নজর বুলিয়ে কেইয়ের উদ্দেশ্যে শেষবারের মতোন বাউ করে বেরিয়ে গেল কুমি।
.
দরজার কাছে গিয়ে কেই একবার নিশ্চিত হয়ে নিলো যে কুমি আসলেও গিয়েছে কিনা, এরপর খালি কাউন্টারের দিকে তাকিয়ে বললো, “বাবা-মা’র সাথে ঝগড়া করেছিলে নাকি তুমি?”
“ওরা ত্যাজ্য করেছে আমাকে,” কাউন্টারের নিচ থেকে এলো কণ্ঠস্বরটা। এতক্ষণ সেখানেই বসে ছিল হিরাই।
“কিন্তু ওর শেষ কথাটা তো শুনেছো তুমি?”
“কী?”
“তোমার মা-বাবা যে আর রাগ করে নেই।”
“নিজের চোখে না দেখলে সেটা কখনো বিশ্বাস হবে না আমার…” কাউন্টারের নীচে কষ্ট করে অনেকক্ষণ বসে থাকায় পিঠে ব্যথা করছে হিরাইয়ের। বয়স্ক মহিলাদের মতোন কোমর বাকিয়ে হাঁটছে। কাস্টমারেরা যেদিকটায় বসে, সেদিকে চলে এলো সে। বরাবরের মতোনই চুলে কার্লার গোঁজা। আজকে একটা চিতা-প্রিন্ট ক্যামিজোল আর গোলাপি স্কার্ট তার পরনে। পায়ে বিচ স্যান্ডেল।
“তোমার বোন কিন্তু খুব ভদ্র,” কেই বললো।
“নদীর এক পাড় থেকে অন্য পাড়ের সবকিছু ভালোই মনে হয়।”
কুমি যেখানে বসে ছিল, সেই সিটটায় গিয়ে বসলো হিরাই। পাউচ থেকে সিগারেট বের করে ধরিয়ে মুখে দিলো। ধোঁয়ায় ছেয়ে গেল কাউন্টারের চারপাশ। একটা উদাসী ভাব ভর করেছে তার চেহারায়। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে কী যেন ভাবছে। শরীর এখানে থাকলেও মন উড়াল দিয়েছে সুদূরে।
ধীরে ধীরে কাউন্টারের পেছনে নিজের জায়গায় চলে এলো কেই। “কথা বলতে চাও এই বিষয়ে?” জিজ্ঞেস করলো সে।
সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লো হিরাই। “আমাকে ঘৃণা করে ও।”
“ঘৃণা করে মানে?” কেইয়ের কণ্ঠে বিস্ময়।
“ও আসলে দায়িত্ব নিতে চায়নি?”
“কী?” কেই আসলে বুঝতে পারছে না যে, কোন বিষয়ে কথা বলছে হিরাই।
“সরাই…”
হিরাইয়ের পরিবার একটা বিলাসবহুল সরাইখানা পরিচালনা করে মিয়াগি প্রিফেকচারে। ওর বাবা-মা’র ইচ্ছা ছিল যে বড় মেয়েই সব দায়িত্ব নেবে। কিন্তু তেরো বছর আগে একটা সমস্যার কারণে সিদ্ধান্ত হয় যে কুমির কাঁধে বর্তাবে সবকিছু। ওদের বাবা-মা’র বয়স এখনো খুব বেশি না, কিন্তু হবু ম্যানেজার হিসেবে কুমি ইতোমধ্যেই সরাইয়ের বিভিন্ন কাজে সাহায্য করা শুরু করেছে। সরাইয়ের দায়িত্ব নেবে, পাকাপোক্তভাবে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর থেকেই নিয়মিত টোকিও আসতে শুরু করেছে কুমি। হিরাইকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বাড়ি ফেরানোই তার মূল উদ্দেশ্য।
“আমি ওকে অনেকবার বলেছি যে বাড়ি ফিরতে চাই না। কিন্তু বারবার একই কথা বলে,” হিরাই হাতের আঙুলগুলো এমনভাবে একে একে বাকাচ্ছে যে দেখে মনে হবে কুমি কতবার এসেছে সেটা গুণছে বুঝি। যে সহজে হাল ছাড়ে না, তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো?”
“তাই বলে এভাবে লুকিয়ে থাকা কী আসলেও জরুরি?”
“আমি দেখতে চাই না।”
“কী?”
“ওর চেহারা।”
মুখটা একদিকে হেলিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে ওর দিকে তাকালো কেই।
“ও যে এই পরিস্থিতিতে আমার জন্যে ফেঁসে গেছে, সেটা ওর চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। সরাই পরিচালনার কোনো ইচ্ছাই নেই কুমির। বাধ্য হয়ে কাজটা করছে। আমি ফিরে গেলে নিজে মুক্ত হতে পারবে।”
“চেহারা দেখেই যে এত কিছু বোঝা যায় তা আগে জানতাম না,” সন্দিহান কণ্ঠে বললো কেই।
কেইকে অনেক দিন ধরে চেনে হিরাই। তাই বুঝতে পারছে যে কেন বিষয়টা বোধগম্য হচ্ছে না তার। মানুষটা বড্ড বেশি সহজসরল।
“মানে আমি বলতে চাইছি যে ওকে দেখলে মানসিক চাপের মধ্যে পড়ে যাই আমি,” কিছুক্ষণ পরে বললো বার হোস্টেস। ভ্রু কুঁচকে আবারো ধোঁয়া ছাড়লো সে।
কয়েকবার মাথা এদিক-সেদিক করলো কেই। ভাবছে বিষয়টা নিয়ে।
“ওহহো! সময় হয়ে গেছে!” নাটুকে ভঙ্গিতে বললো হিরাই। দ্রুত সিগারেট নিভিয়ে মাথাটা অ্যাশট্রেতে ফেলে দিলো সে। “বার খুলতে হবে,” বলে সিট থেকে নামলো দ্রুত। একবার আড়মোড়া ভেঙে বললো, “টানা তিন ঘণ্টা ওভাবে বসে থাকলে পিঠে আসলেও ব্যথা করে।’”
পিঠের নীচের দিকে একবার চাপড় মেরে দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করলো সে। স্যান্ডেলটায় বেশ শব্দ হচ্ছে মেঝেতে।
“দাঁড়াও! চিঠিটা,” কুমির চিঠিটা তুলে নিয়ে হিরাইয়ের দিকে এগিয়ে গেল কেই।
“ফেলে দাও ওটা!” একবারের বেশি দু’বার চিঠিটার দিকে তাকালো না হিরাই। হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করলো কেবল।
“তুমি চিঠিটা পড়বে না?
“আমি জানি ওখানে কী লেখা। একা একা সরাইখানার সব দায়িত্ব সামলানো আমার জন্য অনেক কঠিন। প্লিজ, বাড়ি ফিরে এসো। এখানে এসে কাজ করতে করতে সব শিখে যাবে। এরকম কথাবার্তা।
হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো কেই।
“ওহ বিলই তো দেইনি,” বলে ক্যাশ রেজিস্টারের কাছে এসে মোটা পার্সটা থেকে টাকা বের করে কাউন্টারের উপরে রাখলো হিরাই। “পরে দেখা হবে,” বলে দ্রুত এগিয়ে গেল দরজার দিকে। বোনের মতোই এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচে সে।
.
“চিঠিটা এভাবে ফেলে দিতে পারি না আমি,” কেইয়ের কণ্ঠে দ্বিধা।
.
সে চিঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই আবারো বেজে উঠলো বেলটা। কায়ু তোকিতা প্রবেশ করেছে ক্যাফেতে।
প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে আজ ক্যাফে মালিক, নাগারের সাথে বাইরে গিয়েছিল কাযু। বেশ কয়েকটা শপিং ব্যাগ হাতে নিয়ে ফিরেছে। বাম হাতের অনামিকায় ঝুলছে চাবির রিং। অন্যান্য চাবির সাথে গাড়ির চাবিও আছে সেখানে। ডিউটিতে না থাকায় ক্যাজুয়াল পোশাক তার পরনে। টিশার্ট এবং নীল রঙের জিন্স। অ্যাপ্রন আর ক্যাফের ইউনিফর্ম পুরোপুরি অন্যরকম লাগে মেয়েটাকে।
“এসে গেছ!” চিঠিটা হাতে ধরেই দরাজ হেসে বললো কেই।
“সরি, একটু দেরি হয়ে গেল।”
“ধুর, কোনো ব্যাপার না। ক্যাফেতে খুব বেশি লোক আসেনি।”
“আমি এখনই কাপড় বদলে নিচ্ছি,” কায়ুর মুখেও হাসি। গায়ে ইউনিফর্ম চাপানোর আগ অবধি চপলতার কোনো অভাব থাকে না মেয়েটার মধ্যে। একবার ভেংচি কেটে দ্রুত পেছনের রুমে চলে গেল সে।
কেই এখনো চিঠিটা হাত থেকে নামায়নি। “আমার স্বামী মহাশয় কোথায় গেলেন?” প্রবেশপথের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো ও।
কায়ু আর নাগারে একসাথেই কেনাকাটা করেছে। এমন নয় যে খুব বেশি জিনিস কেনার ছিল। আসলে ক্রেতা হিসেবে একটু বেশিই সচেতন নাগারে। বড্ড বাছবিচার করে কেনাকাটার সময়। মাঝে মাঝে অতিরিক্ত খরচও করে ফেলে। এজন্যেই কাযু সাথে গিয়েছিল ভাইকে চোখে চোখে রাখতে। আরাধ্য জিনিসটা খুঁজে না পেলে মেজাজ খারাপ হয়ে যায় নাগারের। তখন একা একাই ড্রিংক করতে বসে পড়ে বারে।
“ভাইয়ার আসতে একটু সময় লাগবে বললো,” কাযু জানায়।
“নিশ্চয়ই ওসব ছাইপাঁশ গিলতে গেছে।”
“তুমি বিশ্রাম নাও এখন, যাও,” মাথা বের করে বললো কায়ু।
“ওকে নিয়ে আর পারি না!” বাচ্চাদের মতো গাল ফুলিয়ে রেখেছে কাযু। চিঠিটা হাতে নিয়ে পেছনের ঘরে চলে গেল সে।
ক্যাফেতে এখন লোক বলতে ফুসাগি আর সাদা পোশাক পরিহিতা সেই ভদ্রমহিলা। গ্রীষ্মকাল হওয়া সত্ত্বেও দু’জনের সামনেই গরম কফির কাপ। এর পেছনে দু’টো কারণ আছে। প্রথম কারণ, গরম কফির ক্ষেত্রে ফানিকুলি ফানিকুলায় যতবার ইচ্ছা রিফিল নেওয়া যায়। আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে, বাইরের গরম নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই এই দু’জনের। ওয়েট্রেসের ইউনিফর্ম গায়ে চাপিয়ে একটু পরেই ফিরে এলো কায়ু।
গ্রীষ্মকাল শুরু হয়েছে খুব বেশিদিন হয়নি। কিন্তু আজকে তাপমাত্রা ত্রিশ ডিগ্রিরও বেশ খানিকটা উপরে। পার্কিং লট থেকে ক্যাফের দূরত্ব একশো মিটারও নয়। কিন্তু এটুকু আসতেই ঘেমে গেছে কায়ু। রুমাল বের করে মুখ মুছে নিলো সে।
“এক্সকিউজ মি,” ম্যাগাজিন থেকে মাথা তুলে ডাক দিলো ফুসাগি।
“জি?” কায়ুর চেহারা দেখে মনে হবে যেন বিস্মিত হয়েছে তার ডাকে।
“আমাকে আরেকটু কফি দেওয়া যাবে?”
“নিশ্চয়ই!” সাধারণত কাস্টমারদের সাথে যতটা সম্ভব নিরুত্তাপ কণ্ঠে কথা বলার চেষ্টা করে কায়ু, কিন্তু বাইরে থেকে আসার পর এখনো পুরোপুরি খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি। ফলে, ফুসাগির অনুরোধের জবাবে কিছুক্ষণ আগে কেইয়ের সাথে যেভাবে কথা বলছিল, সেই সুরেই উত্তর দিলো সে।
রান্নাঘরে হেঁটে যাওয়ার সময় কাযুকে অনুসরণ করলো ফুসাগির চোখজোড়া। ক্যাফেতে এলে সবসময় এই সিটটাতেই বসে ফুসাগি। অন্য কোনো কাস্টমার সিটটা আগে থেকেই দখল করে রাখলে অপেক্ষা না করে বের হয়ে যায় সে। প্রতিদিন না হলেও সপ্তাহে অন্তত দুই থেকে তিন দিন ক্যাফেতে পা পড়ে তার, লাঞ্চের পরপর। সবসময় একটা ট্রাভেল ম্যগাজিন সাথে থাকে। শুরুর পাতা থেকে শুরু করে একদম শেষ পাতা অবধি ওলটায়, মাঝে মাঝে কী যেন টুকে রাখে নোটবুকে। ম্যাগাজিনটা শেষ করতে যতক্ষণ সময় লাগে, সাধারণত ততক্ষণই ক্যাফেতে থাকে সে। গরম কফি ছাড়া আর কিছু অর্ডার দেয় না।
ফানিকুলি ফানিকুলায় যে কফি সার্ভ করা হয় তা আসে ইথিওপিয়া থেকে। ওখানকার মকা বিনগুলো সুঘ্রাণের জন্য বিখ্যাত। তবে সবার কাছে যে স্বাদটা ভালো লাগে, এমন নয়। অনেকের কাছে মনে হয় তেতো ভাবটা একটু বেশি। কিন্তু নাগারের নির্দেশে এই ক্যাফেতে সবসময় ইথিওপিয়ান মকা বিন থেকে তৈরি কফিই পরিবেশন করা হয়। ফুসাগির অবশ্য এই বিষয়ে কোনো অভিযোগ নেই। ম্যাগাজিন পড়তে পড়তে সময় কাটানোর জন্য জায়গাটা আদর্শ মনে হয় তার কাছে। কিছুক্ষণ পর রান্নাঘর থেকে একটা কাচের ক্যারাফে করে কফি নিয়ে বেরিয়ে এলো কায়ু। ফুসাগির টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে পিরিচ ধরে কাপটা উঠিয়ে নিলো। অন্যান্য দিন কফি রিফিলের সময়েও ম্যাগাজিন থেকে চোখ ওঠায় না ফুসাগি, কিন্তু আজকে ঘটনা ভিন্ন। অদ্ভুত একটা দৃষ্টিতে কায়ুর দিকে তাকিয়ে আছে সে।
পরিবর্তনটা কাযুর নজর এড়ায় না। সে ভাবে কফির পাশাপাশি হয়তো অন্য কিছু দরকার ফুসাগির। “আর কিছু লাগবে?”
জবাবে বিনয়ি ভঙ্গিতে হাসলো ফুসাগি। “আপনি কী এখানকার ওয়েট্রেস?” বিব্রত কণ্ঠে জানতে চাইলো সে।
কাপটা টেবিলে নামিয়ে রাখার সময়েও অভিব্যক্তির কোনো পরিবর্তন হলো না কাযুর। “জ্বি …” এটুকুই বললো সে।
“তাই নাকি?” লাজুক ভঙ্গিতে পালটা প্রশ্ন করলো ফুসাগি। ওয়েট্রেসের কাছে নিজেকে এখানকার একজন নিয়মিত কাস্টমার হিসেবে উপস্থাপন করতে পেরে বেশ সন্তুষ্ট মনে হলো তাকে। আর কথা না বাড়িয়ে পুনরায় ম্যাগাজিনে মনোযোগ দিলো।
এমন ভঙ্গিতে নিজের কাজে ফিরে গেল কায়ু যেন অস্বাভাবিক কিছু ঘটেনি। কাস্টমার না এলে অবশ্য কাজ বলতে সেরকম কিছু থাকে না। এই মুহূর্তে আগে ধুয়ে রাখা গ্লাস টি-টাওয়েল দিয়ে মুছে নির্দিষ্ট তাকে তুলে রাখছে সে। কিছুক্ষণ পর কাজের ফাঁকে ফাঁকে ফুসাগির সাথে কথা বলতে শুরু করলো। ক্যাফেটা ছোট হওয়াতে খুব বেশি জোরে কথা বলতে হয় না ভেতরে।
“আপনি এখানে নিয়মিত আসেন বুঝি?”
মাথা ওঠালো ফুসাগি। “হ্যাঁ।”
“এই ক্যাফে সম্পর্কে একটা কিংবদন্তি প্রচলিত আছে, জানেন?
“হ্যাঁ, জানি।’”
“ওই সিটটা সম্পর্কেও জানেন?”
“হ্যাঁ।”
“আপনিও কী অতীতে ফিরে যেতে চান নাকি?”
“হ্যাঁ,” কোনো প্রকার দ্বিধা ছাড়াই বললো ফুসাগি।”
এক মুহূর্তের জন্য খমকে গেল কায়ুর হাত। “অতীতে ফিরে কী করতে চান আপনি?” প্রশ্নটা করার পরপরই তার মনে হলো বিষয়টা অনধিকার চর্চার মতো হয়ে যাচ্ছে। সাধারণত কাউকে এমন কিছু জিজ্ঞেস করে না সে। দ্রুত নিজের ভুল শোধরানো জন্য বললো, “প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি আমার। দুঃখিত…।” একবার বাউ করে আবারো কাজে মন দেয় সে। ইচ্ছা করেই তাকাচ্ছে না লোকটার দিকে।
কাযুকে মাথা নিচু করে থাকতে দেখে নিজের পোর্টফলিও থেকে একটা বাদামি রঙের খাম বের করে আনলো ফুসাগি। চার মাথা কুঁচকে গেছে খামটার। দেখে বোঝাই যাচ্ছে যে অনেক দিন ধরে তার সাথে আছে জিনিসটা। খামের গায়ে কোনো ঠিকানা লেখা নেই, তবে দেখতে একটা চিঠির মতোন লাগছে।
দুই হাত দিয়ে ধরে খামটা বুকের সামনে নিয়ে এলো সে, যেন কাযু দেখতে পারে।
“ওটা কী?” আবারো কাজ থামিয়ে জিজ্ঞেস করে মেয়েটা।
“আমার স্ত্রী’র জন্য,” প্রায় ফিসফিসিয়ে বলে ফুসাগি। “আমার স্ত্রীর” জন্য।
“চিঠি নাকি?”
“হ্যাঁ।”
“আপনার স্ত্রী’র জন্য?”
“হ্যাঁ, ওকে অবশ্য এখনো দেওয়া হয়নি।”
“যেদিন চিঠিটা তাকে দেওয়ার কথা ছিল, সেই দিনটায় ফিরে যেতে চান আপনি?”
“হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন,” কণ্ঠে জড়তার কোনো ছোঁয়া নেই ফুসাগির।
“তো আপনার স্ত্রী এখন কোথায়?”
এবারে সাথে সাথে জবাব দিলো না ফুসাগি। অস্বস্তি ভর করলো চেহারায়। “ইয়ে…”
জবাবের আশায় লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে কায়ু।
“আমি জানি না,” মাথা চুলকোতে চুলকোতে ক্ষীণ কণ্ঠে বললো ফুসাগি। কথাটা বলার পরপরই চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল তার।
জবাবে কাযু কিছু বললো না।
“হুম, আমার কিন্তু একজন স্ত্রী আসলেই ছিল,” অজুহাত দেওয়ার ভঙ্গিতে অদ্ভুত কথাটা বললো ফুসাগি। “ওর নাম ছিল…” আঙুলগুলো উঠছে নামছে লোকটার। “আরে, অদ্ভুত তো,” মাথা এক দিকে কাত করলো সে। “ওর নাম যেন কী?” বলে আবারো চুপ হয়ে গেল।
এই ঘটনার মাঝে এক সময় পেছনের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে কেই। কাযু এবং ফুসাগির কথোপকথন পুরোটা শুনেছে বলেই হয়তো চেহারা ওরকম শুকনো লাগছে তার।
“আজব ব্যাপার। আমি দুঃখিত,” জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো ফুসাগি।
একসাথে অনেকগুলো সূক্ষ্ম অনুভূতি খেলা করছে কায়ুর চেহারায়। সচরাচর এমনটা হয় না তার সাথে।
“থাক, বেশি ভাবার দরকার নেই এই বিষয়ে…” বললো সে। কণ্ঠটা যে খুব বেশি সহানুভূতিশীল, তা বলা যাবে না।
.
নীরবে প্রবেশপথের দিকে তাকালো কায়ু।
“ওহ,” কোহতাকে’কে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো ও।
স্থানীয় একটা হাসপাতালের নার্স কোহতাকে। নিশ্চয়ই কাজ থেকে বাড়ি ফিরছিল সে। ইউনিফর্ম বদলে একটা নীল ক্যাপ্রি প্যান্ট আর জলপাই সবুজ টিউনিক গায়ে চাপিয়েছে। কাঁধে সাইডব্যাগ ঝোলানো। কিছুক্ষণ পরপর হাতের লাইল্যাক রুমালটা দিয়ে কপাল থেকে ঘাম মুছছে। কাউন্টারের পেছনে দাঁড়ানো কেই এবং কায়ুর উদ্দেশ্যে মাথা নেড়ে ফুসাগির টেবিলের কাছে চলে গেল কোহতাকে।
“হ্যালো, ফুসাগি। আবারো এখানে এসেছ তাহলে,” বললো সে।
নিজের নাম শুনে বিস্মিত ভঙ্গিতে মাথা তুলে তাকালো কোহতাকে। এরপর আবারো নীরবে মাথা নামিয়ে নিলো।
ফুসাগির মনমেজাজ যে আজ একটু অন্যরকম, তা বুঝতে সমস্যা হলো না কোহতাকের। ভাবলো হয়তো শরীর খারাপ লাগছে বেচারার। “ফুসাগি, তুমি ঠিক আছো তো?” শান্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো সে।
মাথা উঁচিয়ে এবারে সরাসরি কোহতাকের চোখের দিকে তাকালো ফুসাগি। “মাফ করবেন, আমাদের কী আগে কখনো দেখা হয়েছিল?” ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে জানতে চাইলো।
মুখ থেকে হাসি মুছে গেল কোহতাকের। চারপাশ হঠাৎই বড্ড বেশি নীরব মনে হচ্ছে। হাত থেকে লাইল্যাকের রুমালটাও মেঝেতে পড়ে গেল এক ফাঁকে।
আলঝেইমারে ভুগছে ফুসাগি, স্মৃতিগুলো সব ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে তার। এই রোগে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলো মারা যায়। ফলে ব্যাপক পরিবর্তন আসে আক্রান্ত ব্যক্তির বুদ্ধিমত্তা এবং আচার আচরণে। আলঝেইমারের প্রথম দিকে রোগীর কিছু স্মৃতি মনে থাকে, আবার কিছু স্মৃতি একদম ভুলে যায়। ফুসাগির ক্ষেত্রেও স্মৃতি হারিয়ে যেতে শুরু করেছে। তুলনামূলক সাম্প্রতিক স্মৃতিগুলো আগে হারাচ্ছে সে। সেই সাথে ব্যক্তিত্বেরও আমূল পরিবর্তন ঘটছে। আগে কোনো কিছুতেই সহজে খুশি হতো না, কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন।
এই মুহূর্তে ফুসাগির মনে হচ্ছে তার একজন স্ত্রী ছিল ঠিকই, কিন্তু টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কোহতাকেই যে তার স্ত্রী, এটা ভুলে গেছে।
“না বোধহয়,” বলে ধীর পদক্ষেপে দুই কদম পিছিয়ে এলো কোহতাকে।
তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফুসাগি। কেই অবশ্য চোখ নামিয়ে নিয়েছে আরো আগেই। ঘুরে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে কাউন্টারের উলটোদিকের একটা সিটে এসে বসলো কোহতাকে। ফুসাগির কাছ থেকে ক্যাফের এই আসনটার দূরত্বই সবচেয়ে বেশি।
বসার পর তার খেয়াল হলো যে রুমালটা হাত থেকে পড়ে গেছে। জিনিসটা তুলে আনার কোনো তাগিদ অনুভব করছে না ভেতরে। উলটো এমন ভাব করলো যেন সেটা অন্য কারো। ফুসাগি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো রুমালটার দিকে, এরপর উঠে কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়ালো। “আমাকে মাফ করবেন। কয়েকদিন ধরে সবকিছু কেমন যেন ভুলে যাচ্ছি।” মাথা নিচু করে রেখেছে সে।
মুখ তুললো না কোহতাকে। “ঠিক আছে,” বলে ফুসাগির কম্পমান হাত থেকে রুমালটা নিলো কেবল।
একবার বাউ করে অপ্রতিভ ভঙ্গিতে সিটে ফিরে গেল ফুসাগি। কিন্তু সিটে বসার পরেও শান্ত হলো না তার মন। ম্যাগাজিনের কয়েক পাতা ওলটানোর পর থেমে মাথা চুলকাতে লাগলো। কয়েক মুহূর্ত পর একবার চুমুক দিলো কফির কাপে। তার কাছে মনে হচ্ছে যে কিছুক্ষণ আগেই কফি ঢালা হয়েছে কাপে।
“কফি দেখি ঠান্ডা হয়ে গেছে,” বিড়বিড় করে বললো সে।
“রিফিল লাগবে?” কায়ু জানতে চাইলো।
তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়ালো ফুসাগি। “আমি চলে যাব এখন,” বলে ম্যাগাজিন বন্ধ করে সবকিছু গোছাতে শুরু করলো।
রুমালটা কোলের উপরে শক্ত করে চেপে ধরে নীচের দিকে তাকিয়ে আছে কোহতাকে।
ক্যাশ রেজিস্টারের সামনে চলে এলো ফুসাগি। “কত হয়েছে?”
“তিনশো আশি ইয়েন,” কোহতাকের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললো কাযু। ক্যাশ রেজিস্টারে নির্দিষ্ট বাটনগুলো চাপতে ভুললো না।
“তিনশো আশি ইয়েন,” বহুল ব্যবহৃত মানিব্যাগটা থেকে একটা এক হাজার ইয়েনের নোট বের করে আনলো ফুসাগি। “আচ্ছা, এই নিন এক হাজার,” বলে নোটটা কাযুকে দিলো সে।
“এক হাজার ইয়েন,” নোটটা হাতে নিয়ে বললো কায়ু।
ভাংতি টাকার জন্য অপেক্ষা করতে করতে অধৈর্য্য ভঙ্গিতে আশপাশে নজর বুলাচ্ছে ফুসাগি। উদ্দেশ্যহীনভাবে কয়েকবার কোহতাকের দিকেও তাকালো।
“এই নিন ছয়শো বিশ ইয়েন।”
দ্রুত হাত বাড়িয়ে ভাংতি টাকাগুলো নিলো ফুসাগি। “কফির জন্য ধন্যবাদ,” প্রায় মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে বেরিয়ে গেল সে।
.
“ধন্যবাদ, আবার আসবেন…”
ফুসাগির বিদায়ের পর এক অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এলো গোটা ক্যাফেতে। সাদা ড্রেস পরিহিতা মহিলার অবশ্য আগের ভঙ্গিতেই টেবিলে বসে আছে। এক মনে বই পড়ে চলেছে সে। ক্যাফেটায় কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের বালাই নেই বিধায় শব্দ বলতে তিনটে দেওয়ালঘড়ির নিরন্তর টিকটিক কিংবা ভদ্রমহিলার বইয়ে পাতা ওলটানোর আওয়াজ।
দীর্ঘ এই নীরবতা ভাঙার দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত নিজের কাঁধেই তুলে নিলো কাযু। “কোহতাকে…” এটুকু বলার পরে উপযুক্ত শব্দের অভাবে খাবি খেতে লাগলো সে।
“ব্যাপার না। এমনটা যে একদিন ঘটবে, তা তো জানাই ছিল, “ কেই এবং কাযুর দিকে তাকিয়ে কাষ্ঠ হেসে বললো কোহতাকে। “দুশ্চিন্তার কিছু নেই।”
কথা শেষে আবারো মেঝের দিকে দৃষ্টি ফেরালো সে।
কাযু আর কেইয়ের কাছে ফুসাগির অসুস্থতার বিষয়ে আগেই সবকিছু খুলে বলেছে সে। নাগারে আর হিরাইও জানে সবকিছু। তার স্বামী যে এক দিন তাকেও ভুলে যাবে এটা অনেক আগেই মেনে নিয়েছে। সেই লক্ষ্যে নিজেকে তৈরিও করেছে। যেদিন ঘটনাটা ঘটবে, সেদিন থেকে একজন নার্স হিসেবে ফুসাগির যত্ন নিব। আমি নার্সের চাকরিই করি, সুতরাং কাজটা কঠিন কিছু হবে না।
আলঝেইমার রোগীদের ক্ষেত্রে কারও রোগ অনেক তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি পায়, আবার কারও অনেক ধীরে। পুরো বিষয়টা নির্ভর করে রোগীর বয়স, অন্যান্য অসুস্থতা এবং চিকিৎসার উপরে। তার স্বামীর ক্ষেত্রে অবস্থা বেশ দ্রুত খারাপের দিকে গড়াচ্ছে।
ফুসাগি যে তাকে ভুলে গেছে এই ধাক্কাটা এখনো পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি কোহতাকে। নিজেকে সামলে নেবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কেইয়ের উদ্দেশ্যে কিছু বলার জন্য মাথা তুলে দেখলো সে রান্নাঘরে। কিছুক্ষণ পরেই এক বোতল সাকে হাতে বেরিয়ে এলো ক্যাফে মালিকের স্ত্রী।
“এক কাস্টমার উপহার দিয়েছিল,” বোতলটা কাউন্টারে নামিয়ে রেখে হেসে বললো সে। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে তার; এতক্ষণ মাথা নিচু করে কাঁদছিল। সাকের বোতলের গায়ে ‘সেভেন হ্যাপিনেস’ লেবেল সাঁটানো। “লাগবে নাকি কারো?”
কেইয়ের সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এলো এরপর।
কোহতাকে অবশ্য দ্বিধায় ভুগছে। কিন্তু সুযোগটা হাতছাড়া করতে ইচ্ছা করছে না তার। “আচ্ছা, অল্প একটু…” বললো সে।
গুমোট ভাবটা কেটে যাওয়ায় কেইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞ কোহতাকে। ক্যাফে মালিকের স্ত্রী আবেগের বশবর্তী হয়ে অনেক সময় অনেক কিছু করে বসে, এমনটা আগেও শুনেছে সে। কিন্তু এরকম গম্ভীর একটা পরিস্থিতি যে হালকা করে ফেলবে, সেটা আশা করেনি।
কেই সবসময় হাসিখুশি থাকে, কথাটা প্রায়ই বলে হিরাই। তার উজ্জ্বল মুখটা দেখে কে বলবে যে কিছুক্ষণ আগেও হতাশা খেলা করছিল তার চেহারায়! এখন বরং তার চোখের দিকে তাকিয়ে এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করছে কোহতাকে।
“সাথে খাওয়ার জন্য কিছু খুঁজে পাই কি না দেখি,” বলে রান্নাঘরে উধাও হয়ে গেল কাযু
“সাকেটা গরম করে নিব?”
“না, ঠিক আছে।”
“আচ্ছা, এভাবেই খাবেন নাহয়।”
দক্ষ হাতে ছিপি খুলে সামনে সাজিয়ে রাখা গ্লাসগুলোয় সাকে ঢাললো কেই।
সেখান থেকে একটা গ্লাস তুলে কোহতাকের সামনে নামিয়ে রাখার সময় হেসে উঠলো সে। “ধন্যবাদ।”
এক টিন আচার নিয়ে ফিরলো কায়ু। “এগুলোই খুঁজে পেলাম…” একটা ছোট বাটি বের করে সেখানে কিছুটা আচার ঢেলে নিলো সে। বাটিটা কাউন্টারের নামিয়ে রেখে তিনটা কাটা চামচ বের করে আনলো।
“ভালো জিনিস এনেছো তো!” কেই বললো। “আমার কিন্তু সাকে খাওয়া চলবে না,” বলে কাউন্টারের নীচের ফ্রিজ থেকে একটা কমলার জুসের কার্টন বের করলো সে।
কাউন্টারে উপস্থিত তিনজন নারীর মধ্যে কেউই খুব একটা সাকে ভক্ত না, বিশেষ করে কেই। মদ্যপানের অভ্যাস কখনোই ছিল না তার। সাকেটার নাম ‘সেভেন হ্যাপিনেস’, কারণ প্রস্তুতকারকের মতে, এটা খাওয়ার পর সাত ধরনের আনন্দ উপভোগ করে পানকারী। স্বচ্ছ, দানামুক্ত, সবচেয়ে দামি সাকে ব্র্যান্ডগুলোর একটা। দুই পানকারীর মধ্যে কেউই অবশ্য সাকেটার বিশেষত্ব সম্পর্কে অবগত নয়। তবে খাওয়ার পরে আনন্দের অনুভূতির কোনো কমতি হলো না।
.
সাকের মিষ্টি গন্ধটা পনেরো বছর আগের এক গ্রীষ্মের বিকেলে নিয়ে গেল কোহতাকে’কে। সেবার দেশজুড়ে প্রতিদিনই রেকর্ড পরিমাণ তাপমাত্রা নথিবদ্ধ করছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোয় দিনের পর দিন এই বিষয়ে আলাপ চলছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নকেই দায়ী করা হচ্ছিল এরকম অদ্ভুত আবহাওয়ার জন্য।
ফুসাগি কাজ থেকে ছুটি নিয়েছিল সেদিন। দুপুরের দিকে একসাথে কেনাকাটা করতে বের হয় ওরা। প্রচণ্ড গরমের কারণে এক পর্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে ফুসাগি বলে যে ঠান্ডা কোথাও বসা উচিত। কিন্তু অনেক খুঁজেও কোনো ক্যাফে বা ফ্যামিলি রেস্তোরাঁয় খালি জায়গা খুঁজে পায় না দু’জনে।
এসময় একটা সরু গলিতে হঠাৎই একটা ছোট্ট সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। ক্যাফেটার নাম ফানিকুলি ফানিকুলা। এই নামের একটা গান আছে বলে জানতো কোহতাকে। অনেক আগে শুনলেও সুরটা মনে ছিল। গানের কথাগুলো একটা আগ্নেয়গিরি বেয়ে ওঠা নিয়ে। ওরকম পরিবেশে গরম লাভার কথা মনে হতেই আরো বেশি গরম অনুভূত হয় কোহতাকের। তবে কাঠের দরজা খুলে ভেতরে ঢোকার পর বুঝতে পারে ক্যাফের পরিবেশ অনেকটাই শীতল। চৌকাঠে লাগানো বেলটার আওয়াজ শুনতেও খারাপ লাগে না। ভেতরে জায়গা কম হলেও কাস্টমার বলতে কেবল সাদা পোশাক পরিহিতা এক মহিলা। ক্যাফের একদম পেছন দিকে বসে আছে সে। বাকি আসনগুলো ফাঁকা। ভাগ্যজোরে ভালো একটা ক্যাফে খুঁজে পায় ওরা।
“বাঁচা গেল ভাই!” বলে দরজার সবচেয়ে কাছের টেবিলটায় বসে পড়ে ফুসাগি। ঠান্ডা পানি হাতে এগিয়ে আসা মহিলার কাছে আইসড কফি অর্ডার দিতে দেরি করে না। মহিলার চোখের দৃষ্টিতে ঝিকিমিকি করছিল উষ্ণতা। “আমাকেও আইসড কফি দেবেন,” ফুসাগির উলটো পাশে বসে বলে কোহতাকে।
টেবিলটায় বসতে বোধহয় অস্বস্তি হচ্ছিল ফুসাগির। কিছুক্ষণ পরেই উঠে গিয়ে কাউন্টারের উলটোদিকের সিটে বসে সে। ব্যাপারটায় মন খারাপ করে না কোহতাকে, স্বামীর এরকম আচরণের সাথে অনেক আগেই মানিয়ে নিয়েছে। হাসপাতালের একদম কাছেই এরকম সুন্দর একটা ক্যাফে খুঁজে পাওয়ায় মনে মনে খুশি হয় ও।
পুরু থাম আর সিলিংয়ের আড়াআড়ি খিলান—সবকিছুই কালচে বাদামি, অনেকটা চেস্টনাট রঙা। একপাশের দেওয়ালে তিনটা বড়সড় দেওয়ালঘড়ি। অ্যান্টিক জিনিসপত্র সম্পর্কে খুব একটা ধারণা নেই কোহতাকের, তবে ঘড়িগুলো যে অনেক আগের, তা বুঝতে সমস্যা হয় না। প্লাস্টার করা দেওয়ালগুলোয় বয়সের ছাপ স্পষ্ট; তবে খারাপ লাগে না দেখতে। বাইরে দিন হলেও ক্যাফেটায় কোনো জানালা না থাকায় সময় বোঝা যায় না। মৃদু আলোর কারণে চারপাশে একটা বাদামি বাদামি ভাব, পুরানো ছবির মতোন। সবকিছু মিলিয়ে একটা সেকেলে, স্নিগ্ধ পরিবেশ।
ক্যাফের ভেতরটা একদম ঠান্ডা হলেও কোনো এয়ার কন্ডিশনার চোখে পড়ে না ওদের। সিলিংয়ে ঝোলানো কাঠের ফ্যানটা ঘুরছে ধীরে ধীরে। বিষয়টা বেশ অদ্ভুত ঠেকে কোহতাকের কাছে। নাগারে এবং কেইয়ের কাছে জানতেও চায় যে কীভাবে ভেতরটা সবসময় এত ঠান্ডা থাকে। তবে কেউই সন্তোষজনক কোনো জবাব দিতে পারেনি। “অনেক আগে থেকেই এরকম,” কেবল এটুকুই বলে তারা।
ক্যাফেটা মনে ধরে যায় কোহতাকের। তাই কাজের ফাঁকে প্রায় প্রায়ই এখানে আসতে শুরু করে সে।
.
“চি-” চিয়ার্স বলতে গিয়েও থেমে গেল কায়ু। দেখে মনে হচ্ছে যেন মস্তবড় কোনো ভুল করে ফেলেছে।
“আমরা তো কোনো কিছু উদযাপন করছি না, তাই না?”
“আহ-হা, এভাবে বলো না তো,” কেইয়ের নিজের চেহারাও বিমর্ষ। কোহতাকের দিকে ফিরে সহানুভূতির ভঙ্গিতে হাসলো সে।
নিজের গ্লাসটা কাযুর সামনে উঁচিয়ে ধরেছে কোহতাকে। “সরি।”
“কোন সমস্যা নেই।”
আশ্বস্ত ভঙ্গিতে হেসে কায়ুর গ্লাসের সাথে নিজের গ্লাস ছোঁয়ালো কোহতাকে। পুরো ক্যাফেতে প্রতিধ্বনিত হলো সুরেলা শব্দটা। সেভেন হ্যাপিনেসে একবার চুমুক দিলো কোহতাকে। মিষ্টি একটা স্বাদে ছেয়ে গেল মুখের ভেতরটা। “গত ছয় মাস ধরে আমাকে আমার কুমারী নামে ডাকতো ও…” নরম সুরে কথাটা বললো সে। “নীরবে বেড়ে চলেছে রোগটা, ধীরে ধীরে সবকিছু ভুলে যাচ্ছে…আমাকেও।” শুকনো একটা হাসি ফুটলো কোহতাকের মুখে। “জানেন, আমি না নিজেকে অনেক বুঝিয়েছি। এই দিনটা একদিন না একদিন তো আসতোই।”
কোহতাকের কথা শুনতে শুনতে আবারও লাল হয়ে উঠছে কেইয়ের চোখ।
“আমি মানিয়ে নিতে পারবো…সত্যি,” হাত নেড়ে দ্রুত বললো কোহতাকে। “আমি একজন নার্স, এটা নিশ্চয়ই জানেন। ও যদি আমাকে পুরোপুরি ভুলেও যায়, একজন নার্স হিসেবে ওর যত্ন রাখবো। কখনো ওকে ছেড়ে যাব না।”
আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে কেই এবং কায়ুর উদ্দেশ্যে কথাগুলো বললো কোহতাকে। একদম মন থেকেই বলেছে। কেউ যদি ভাবে যে নিজেকে সাহসী প্রমাণের জন্য এসব বলছে সে, তাহলে ভুল ভাববে। তার সাহসিকতায় একটুও গলদ নেই। একজন নার্স হিসেবে ওর পাশে সবসময় থাকতে পারবো আমি।
স্বভাবসুলভ নিস্পৃহ ভঙ্গিতে সামনের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে আছে কায়ু
কেইয়ের চোখে টলমল করছে অশ্রু। একটা ফোঁটা গড়িয়েও পড়লো ডান গাল বেয়ে।
ফ্ল্যাপ।
কোহতাকের পেছন থেকে এসেছে শব্দটা। নিজের বইটা কেবলই বন্ধ করেছে সাদা পোশাক পরিহিতা মহিলা। পার্স থেকে একটা রুমাল বের করে নিয়ে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো একটু পর। বাথরুমের যাওয়ার সময় হয়েছে তার। যদি বইটা বন্ধ হবার শব্দ কানে না আসত, তাহলে ওরা হয়তো বুঝতেই পারতো না যে কখন আসন ছেড়ে উঠেছে সে।
কোহতাকে তাকিয়ে আছে ভদ্রমহিলার দিকে, কিন্তু কেই একবার তাকিয়েই মুখ ফিরিয়ে নিলো। কাযু সেটুকুও করলো না। সাকের গ্লাসে আয়েশ করে চুমুক দিচ্ছে সে। ওদের জন্য এটা একটা সাধারণ ঘটনা।
“আচ্ছা, ফুসাগি কেন অতীতে ফিরতে চেয়েছিল?” মহিলার খালি আসনটা দেখে আপনমনেই প্রশ্ন করলো কোহতাকে। সে জানে যে অতীতে যেতে চাইলে এই সিটটাতেই বসতে হয়।
আলঝেইমারে আক্রান্ত হওয়ার আগে ফুসাগি কখনো এসব ‘গালগল্পে’ বিশ্বাস করত না। কোহতাকে যখনই ক্যাফের কিংবদন্তিটার ব্যাপারে তাকে বলতো, একটা অবিশ্বাসের হাসি ফুটতো তার মুখে। ভূত কিংবা অলীক কোনো কিছুতে কখনোই বিশ্বাস করেনি সে।
কিন্তু স্মৃতি হারাতে শুরু করার পর থেকে ওই চেয়ারটায় বসার আশায় ক্যাফেতে নিয়মিত আসতে শুরু করে ফুসাগি। কোহতাকে প্রথম যখন কথাটা শোনে, বিশ্বাসই করতে পারেনি। কিন্তু আলঝেইমারে আক্রান্ত রোগীর ব্যক্তিত্বেও ব্যাপক পরিবর্তন আসে। গত কয়েক মাস ধরে বড্ড ভুলোমনা হয়ে গেছে ফুসাগি। এসব বদলের প্রেক্ষিতে কোহতাকে এক সময় মেনে নেয় যে তার স্বামীর ধ্যানধারণাও পালটে গেছে।
কিন্তু অতীতে ফিরতে চায় কেন ও?
উত্তরটা অনেক দিন ধরেই জানতে চায় কোহতাকে। বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেসও করেছে, কিন্তু প্রতিবারই ফুসাগি বলেছে যে ‘এটা আমার ব্যক্তিগত বিষয়’।
“উনি আসলে আপনাকে একটা চিঠি দিতে চান,” যেন কোহতাকের মনের কথা বুঝতে পেরে বললো কায়ু
“আমাকে?”
“হ্যাঁ।”
“একটা চিঠি?”
“আপনাকে নাকি কখনো চিঠিটা দেওয়ার সুযোগ হয়ে ওঠেনি তার।”
“আচ্ছা…” কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর সাধারণ কণ্ঠেই বললো কোহতাকে।
অনিশ্চয়তা ভর করলো কায়ুর চেহারায়। কোহতাকে যে বিষয়টা এত স্বাভাবিকভাবে নেবে, এটা ভাবেনি সে। কথাটা বলে কী ভুলে করেছে ও?
তবে কোহতাকের এরকম আচরণের সাথে কায়ুর কোনো সম্পর্ক নেই। বরং, ফুসাগি যে তাকে একটা চিঠি লিখেছে, এটা নিয়ে ভাবছে সে। কারণ কোনো কিছু লেখার অভ্যাস একদমই নেই ফুসাগির। সত্যি বলতে, খুব ভালো লিখতে বা পড়তে পারে না লোকটা।
.
উপকূলবর্তী দরিদ্র একটা শহরে জন্ম ফুসাগির। পারিবারিকভাবে সামুদ্রিক লতার ব্যাবসা ছিল তাদের। পরিবারের সব সদস্যকে কাজে হাত লাগাতে হতো। আর সেই কাজ করতে গিয়েই পড়াশোনাটা ঠিকমতো করা সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। হিরাগানা রপ্ত করতে পারলেও কানজির কয়েকটা মাত্র অক্ষর শিখেছে সে, কাজ চালানোর মতোন। এখনকার বাচ্চারা প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হবার আগেই এসব শিখে ফেলে।
কোহতাকে আর ফুসাগির পরিচয় হয় এক বন্ধুর মাধ্যমে। তখন ফুসাগির বয়স ছিল ছাব্বিশ আর কোহতাকের একুশ। মোবাইল ফোনের প্রচলন শুরু হয়নি সেই সময়, তাই ল্যান্ডলাইন আর চিঠিই ছিল যোগাযোগের একমাত্র ভরসা। ছোট থেকেই একজন ল্যান্ডস্কেপ গার্ডেনার হতে চেয়েছিল ফুসাগি। আর দশজন সাধারণ মালী থেকে ল্যান্ডস্কেপ গার্ডেনারের কাজের ধরণ বেশ আলাদা। সৌন্দর্যবর্ধনের পাশাপাশি বিভিন্ন শৈল্পিক বিষয়েও খেয়াল রাখতে হয়। সাধারণত যেখানে কাজ পেতো, সেখানেই থাকতো ফুসাগি। কোহতাকে তখন সবে নার্সিং কলেজে ভর্তি হয়েছে, ফলে খুব একটা দেখা সাক্ষাৎ হতো না। চিঠির মাধ্যমেই চলতো অনুরাগের আদানপ্রদান।
কোহতাকে তার চিঠিতে সব বিষয়ে বিস্তারিত লিখত। নিজের ব্যাপারে লিখতো, ক্লাসের ব্যাপারে লিখতো। নার্সিং কলেজে সবকিছু কেমন চলছে এসবও বাদ দিতো না। কোনো ভালো বই পড়লে সেটা জানাতো, মাঝে মাঝে ভবিষ্যৎ নিয়েও পাতার পর পাতা লিখতো সে। এক কথায়, তার চিঠিতে সাধারণ সব বিষয়-আশয়ের বিস্তারিত বর্ণনা থাকতো। ঘটনাটা তার মনে কেমন প্রভাব ফেলেছে, এই ব্যাপারগুলোও ব্যাখ্যা করত বিস্তারিত। কোনো কোনো চিঠি দশ পাতাও ছাড়িয়ে যেত।
অন্যদিকে ফুসাগির চিঠিগুলো হতো একদম ছোট। মাঝে মাঝে তো একবাক্যে কাজ সেরে ফেলত সে। ‘চিঠিটা আসলেও দারুণ ছিল, ধন্যবাদ’ কিংবা ‘আমি বুঝতে পেরেছি তোমার কথা’। প্রথম দিকে কোহতাকে ভাবতো যে ব্যস্ততার কারণে বড় চিঠি লেখার সময় পায় না ফুসাগি। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায় যে প্রতিবারই অল্প কথায় কাজ সেরে ফেলছে ওর প্রেমিক। কিছুদিন যাওয়ার পর কোহতাকের ধারণা হয় যে ফুসাগি ওর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। তাই ও চিঠিতে লিখে পাঠায় যে জোর করে কোনো জবাব দিতে হবে না ফুসাগিকে। এই চিঠির জবাবে সে যদি বড় কিছু না লেখে, তাহলে কোহতাকের পক্ষ থেকেও কোনো চিঠি আর পাবে না।
ফুসাগি সাধারণত এক সপ্তাহের মধ্যেই চিঠির জবাব দিতো, কিন্তু এবারে আর কোনো ফিরতি চিঠি আসে না। এমনকি এক মাস চলে যায়, তার কাছ থেকে কোনো বার্তা পায় না কোহতাকে। বিষয়টা ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে যায় ওকে। হ্যাঁ, চিঠির জবাবে কখনোই খুব বেশি কিছু লেখেনি ফুসাগি, তাই বলে নেতিবাচক কিছুও বলেনি কখনো। এমনটাও মনে হয়নি যে বাধ্য হয়ে লিখেছে। বরং, লেখাগুলো পড়ে তাকে স্পষ্টভাষীই ভাববে সবাই। তাই আড়াই মাস পরে যখন ফুসাগির চিঠিটা আসে, তখনও পুরোপুরি হাল ছেড়ে দেয়নি সে।
চিঠিটায় একটা বাক্যই লেখা ছিল, “চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি।”
এই সামান্য কয়েকটা শব্দই কোহতাকের মনকে এমনভাবে উদ্বেলিত করে তোলে, যা বিশাল বিশাল চিঠিও হয়তো কোনদিন করতে পারতো না। এরকম একটা চিঠির জবাবে কী লিখবে তা বুঝে উঠতে পারছিল না। ফুসাগির লিখে পাঠানো একটা বাক্যই বুঝিয়ে দিয়েছে তার হৃদয়ে কী চলছে। তাই শেষমেষ ও লেখে, “ঠিক আছে।”
পরবর্তীতে কোহতাকে শোনে যে ঠিকমতোন লিখতে বা পড়তে পারে না ফুসাগি। এটা জানার পর ও তাকে জিজ্ঞেস করে যে লম্বা লম্বা চিঠিগুলো তাহলে কীভাবে পড়তো? জবাবে ফুসাগি বলে যে চিঠিগুলোর উপরে চোখ বুলিয়ে একটা আবছা ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করত সে। এরপর সেখান থেকেই কিছু একটা আন্দাজ করে জবাব পাঠিয়ে দিতো। কিন্তু শেষ চিঠিটা পাওয়ার পর তার মনে হয় যে কিছু একটা ঠিক নেই। তখন একটা একটা অক্ষর ধরে পড়তে শুরু করে সে। বাইরের মানুষদের কাছ থেকেও সাহায্য নেয়। এজন্যেই জবাব পাঠাতে দেরি হয়েছে।
.
সেদিনের মতোন আজকেও অবিশ্বাস খেলা করছে কোহতাকের চেহারায়।
“একটা বাদামি রঙের খাম দেখিয়েছিলেন আমাকে। এই সাইজের,” বলে হাত দিয়ে এঁকে দেখায় কায়ু।
“বাদামি খাম?”
চিঠির জন্য বাদামি খাম ফুসাগির পক্ষেই ব্যবহার করা সম্ভব, কিন্তু এখনো বিষয়টা ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না কোহতাকের।
“প্রেমপত্র লিখেছে বোধহয়?” পাশ থেকে উৎসাহী কণ্ঠে বলে কেই।
শুকনো হাসি ফোটে কোহতাকের মুখে। “নাহ, অসম্ভব,” বলে হাত নেড়ে সম্ভাবনাটা নাকচ করে দেয় সে।
“কিন্তু ওটা যদি আসলেও প্রেমপত্র হয়ে থাকে, তাহলে কী করবেন?” লাজুক হেসে জানতে চায় কায়ু। সাধারণত অন্য কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলানো ওর স্বভাবের সাথে ঠিক যায় না। কিন্তু এখন প্রেমপত্রের কথাটা ইচ্ছা করেই উল্লেখ করেছে যাতে ক্যাফের বিমর্ষ পরিবেশের একটু উন্নতি ঘটে।
আর কথা না বাড়িয়ে কেই এবং কায়ুর প্রেমপত্রের তত্ত্বটা মেনে নেয় কোহতাকে। আসলে কথা ঘোরাতে চাইছিল সে। কাউন্টারের অপর পাশে থাকা মানুষ দু’জন জানে না যে লিখতে বা পড়তে কতটা অসুবিধা হয় ফুসাগির। “প্রেমপত্র পেলে তো পড়তেই হবে,” হেসে বলে কোহতাকে।
এটা বানিয়ে বলেনি। ফুসাগি যদি আসলেই একটা প্রেমপত্র লিখে থাকে, তাহলে সেটা অবশ্যই পড়তে হবে তাকে।
“চাইলে তো ফিরে গিয়ে দেখতে পারেন, তাই না?” কেই বললো হঠাৎ।
“কী?” কেইয়ের বলা কথাটা ঠিক বুঝতে পারছে না কোহতাকে।
“আপু, আসলেই?” কেই জবাব দেওয়ার আগেই তার কানের কাছে মুখ এনে বললো কায়ু। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না যে পরিকল্পনাটা তার বিশেষ মনে ধরেছে।
“ওর পড়া উচিত ওটা,” আগের তুলনায় জোর দিয়ে বললো কেই। “কেই, দাঁড়াও…” কেইকে শান্ত করার জন্য বলে কোহতাকে। কিন্তু ইতোমধ্যে দেরি হয়ে গেছে।
জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে কেই। কোহতাকের কথা আমলেই নিলো না সে। “ফুসাগি যদি তোমাকে আসলেও কোনো প্রেমপত্র লিখে থাকে, তাহলে সেটা অবশ্যই নেওয়া উচিত তোমার!”
কেই যেন ধরেই নিয়েছে যে যে ফুসাগি প্রেমপত্রই লিখেছে। আর একবার এই ধারণাটা পোক্ত হয়ে গেলে যে তাকে থামানো যাবে না, সেটা কোহতাকে ভালো করেই জানে।
পরিস্থিতি যেদিকে গড়াচ্ছে, তা বিশেষ পছন্দ হচ্ছে না কাযুর। তা সত্ত্বেও একবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হেসে উঠলো সে।
আবারো খালি চেয়ারটার দিকে তাকালো কোহতাকে। অতীতে ফিরে যাওয়ার গুজবটা সম্পর্কে জানা আছে তার। বিরক্তিকর নিয়মগুলোও জানে। কিন্তু তার কখনোই অতীতে ফিরে যেতে ইচ্ছা করেনি। সত্যি বলতে, সিটটায় বসে আসলেও অতীতে যাওয়া যায় কি না, এই বিষয়ে কিছুটা সন্দিহান সে। তবে কিংবদন্তিটা যদি আসলেও সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে এখন সে অবশ্যই আগ্রহী। চিঠিটায় কী লেখা সেটা জানতেই হবে। কায়ুর কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে ফুসাগি যেদিন তাকে চিঠিটা দিতে চেয়েছিল, সেদিন ফিরে গেলে ওটা পড়ার একটা সুযোগ পাবে।
তবে একটা কারণে দোটানায় ভুগছে কোহতাকে। এখন যেহেতু সে জানে যে ফুসাগি অতীতে গিয়ে তাকে চিঠিটা দিতে চেয়েছিল, তাহলে তার কী উচিত হবে ওটা পড়ার জন্য অতীতে পাড়ি জমানো? এভাবে চিঠিটা নেওয়া অনৈতিক হবে না কিছুটা? লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে লাগলো কোহতাকে।
তার এই নিয়মটা মনে আছে যে অতীতে ফিরে গিয়ে কেউ যতই চেষ্টা করুক না কেন, বর্তমানের কিছুই বদলাবে না। অর্থাৎ, সে যদি ওই নির্দিষ্ট দিনটায় ফিরে চিঠিটা পড়ে, তাহলে বর্তমানে সেটার কোনো প্রভাব পড়বে না।
তবুও নিশ্চিত হবার জন্য কায়ুকে একবার জিজ্ঞেস করলো কোহতাকে।
“না, বদলাবে না,” স্পষ্ট স্বরে বললো কায়ু
কোহতাকের বুক ধড়ফড় করছে। কোনো কিছুই বদলাবে না, অর্থাৎ, সে যদি অতীতে ফিরে গিয়ে চিঠিটা পড়ে, তবুও বর্তমানের ফুসাগি তাকে ওটা দেওয়ার জন্য সেই দিনটায় ফিরে যেতে চাইবে।
সাকের গ্লাস থেকে তরলটুকু এক ঢোকে শেষ করে ফেললো সে। ধাতস্থ হবার জন্য এই জিনিসটারই দরকার ছিল ওর। লম্বা শ্বাস ছেড়ে গ্লাসটা কাউন্টারের উপরে নামিয়ে রাখলো কোহতাকে। “ঠিকই বলেছে ওরা। একদম ঠিক,” বিড়বিড় করে নিজের উদ্দেশ্যেই বললো সে। “ফুসাগি যদি আসলেও আমাকে একটা প্রেমপত্র লিখে থাকে, তাহলে সেটা না পড়ে থাকবো কী করে?”
‘প্রেমপত্র’ শব্দটা উচ্চারণ করা মাত্র মন থেকে সমস্ত অপরাধবোধ দূর হয়ে গেল ওর।
সম্মতির ভঙ্গিতে দ্রুত কয়েকবার মাথা ওপর নিচ করলো কেই। একাত্মতা প্রকাশের জন্য এক গ্লাসের জুসটুকুও শেষ করে ফেললো।
কাযু অবশ্য অন্য দু’জনের মতো তাড়াহুড়ো করছে না। হাতের গ্লাসটা ধীরে-সুস্থে কাউন্টারের উপরে নামিয়ে রেখে রান্নাঘরে উধাও হয়ে গেল সে।
যে সিটটায় বসে অতীতে পাড়ি জমানো যায়, সেটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে কোহতাকে। পুরো শরীর উত্তেজনায় কাঁপছে তার। সাবধানে চেয়ার এবং টেবিলের ফাঁক গলে ভেতরে ঢুকে বসে পড়লো সে। ক্যাফের অন্য সবকিছুর মতো টেবিল-চেয়ারগুলোও অ্যান্টিক ধাঁচের। গদি এবং হেলান দেওয়ার জায়গাটুকু সবুজ মখমলে মোড়ানো। ক্যাবিরোল চেয়ারগুলো দেখলে মনেই হবে না যে এত দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সঠিক যত্ন নেওয়া হয়, সেটা বোঝাই যায়। ক্যাফেটা যদি মেইজি আমলে চালু হয়, তাহলে প্রায় একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও সবকিছু একদম ঠিকঠাক। পুরানো রেস্তোরাঁগুলোয় যেরকম গুমোট একটা ভাব থাকে, সেটাও নেই।
মনে মনে তারিফ না করে পারলো না কোহতাকে। সে জানে যে একটা পুরানো ক্যাফেকে এরকম ছিমছাম অবস্থায় রাখতে হলে প্রতিদিন কাউকে না কাউকে কষ্ট করে পরিষ্কার করতে হয় সবকিছু। হঠাৎই একটা শব্দে চিন্তার বাঁধন ছিঁড়ে গেল তার। কায়ু যে কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, তা টেরই পায়নি। একটা রুপালি রঙের ট্রে দেখা যাচ্ছে মেয়েটার হাতে। ওটার উপরে সাদা রঙের কফি কাপ। তবে কাঁচের তৈরি ক্যারাফের জায়গায় কাপটার পাশে রুপালি রঙের ছোট একটা কেতলি রাখা।
কাযুকে দেখে একটা ধাক্কা খেল কোহতাকে। ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। চেহারার ছেলেমানুষি ভাবটা নেই। বরং অনেক বেশি মার্জিত আর গম্ভীর মনে হচ্ছে তাকে।
“আপনি তো নিয়মগুলো জানেন বোধহয়?” শান্তভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো কায়ু। স্বভাবসুলভ সেই নির্লিপ্ততা আবারো ফিরে এসেছে তার মাঝে।
দ্রুত নিয়মগুলো একবার স্মরণ করে নিলো কোহতাকে।
প্রথম নিয়মটা হচ্ছে, অতীতে ফেরার পর কেবল সেই মানুষদের সাথেই দেখা হবে, যারা এই ক্যাফেতে পা রেখেছিল।
এটা আমার জন্য কোনো সমস্যা না, কোহতাকে ভাবে। এখানে অসংখ্যবার এসেছে ফুসাগি।
দ্বিতীয় নিয়মটা, অতীতে ফিরে যা-ই করা হোক না কেন, বর্তমানে কিছু বদলাবে না। কোহতাকে এই নিয়মটা জানে বলেই অতীতে ফেরার চেষ্টা করতে রাজি হয়েছে আসলে। তবে নিয়মটা যে শুধু চিঠি পড়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, এমন নয়। আজ যদি আলঝেইমার রোগের কোনো অত্যাধুনিক চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয় এবং অতীতে ফিরে গিয়ে ফুসাগিকে সেভাবে চিকিৎসা দেওয়া হয়, তবুও তার দশার কোনো উন্নতি হবে না।
এই নিয়মখানি কিছুটা ক্রুরই বটে।
তৃতীয় নিয়ম, অতীতে ফিরতে চাইলে একটা নির্দিষ্ট সিটে বসতে হবে। সৌভাগ্যবশত, সাদা পোশাক পরিহিতা ভদ্রমহিলা এই মুহূর্তে টয়লেটে থাকায় সিটটায় বসতে পেরেছে কোহতাকে। সে এমন গুজবও শুনেছে যে ভদ্রমহিলাকে জোর করে চেয়ার ছেড়ে ওঠাতে চাইলে, তার অভিশাপের সম্মুখীন হতে হয়।
নিয়মের তালিকা কিন্তু এখানেই শেষ নয়।
চতুর্থ নিয়মটা হচ্ছে, অতীতে ফেরার পর এই নির্দিষ্ট সিটটা ছেড়ে ওঠা যাবে না। এমনটা নয় যে কেউ চেয়ারে একদম আটকে যাবে। বরং চেয়ার ছেড়ে ওঠার সাথে সাথে আবারো বর্তমানে ফিরে আসবে সময় পরিভ্রমণকারী। ক্যাফেটা যেহেতু বেইজমেন্টে, এখানে মোবাইল ফোন সিগন্যাল কাজ করে না। ফলে অতীতে ফিরে কাউকে ফোন করা যাবে না। এছাড়াও, পরিভ্রমণকারী সিট ছেড়ে উঠতে পারবে না বিধায় বাইরেও যাওয়া যাবে না।
কোহতাকে শুনেছিল যে কয়েক বছর আগে ক্যাফেটা নিয়ে বেশ হইচই শুরু হয়। প্রতিদিন কয়েকশো কাস্টমার ভিড় জমাতো অতীতে ফেরার আশায়। এই পাগলাটে নিয়মগুলোর জন্য এখন আর কেউ আসে না, ভাবে সে।
.
কোহতাকে হঠাৎই বুঝতে পারে যে তার জবাবের জন্য ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করছে কায়ু।
“ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার আগেই কফিটা খেয়ে নিতে হবে আমাকে, তাই না?”
“হ্যাঁ।”
“আর কিছু?”
একটা প্রশ্ন ঘুরপাক কাচ্ছে তার মনে। সময় পরিভ্রমণকারী যদি নির্দিষ্ট কোনো দিনে ফিরতে চায়, সেটা কীভাবে সম্ভব হবে?
“আপনাকে মনে মনে সেই দিনটার কথা ভালোমতো কল্পনা করতে হবে,” যেন ওর মনের কথা বুঝতে পেরে বললো কায়ু।
“কল্পনা করলেই হবে?” কথাটা ঠিক মনে ধরলো না কোহতাকের।
“ফুসাগির স্মৃতি থেকে আপনি যেদিন বিদায় নিয়েছেন, তার আগে যে কোনো দিন। ধরুন সেদিন আপনাকে চিঠিটা দেওয়ার কথা ভাবছিলেন তিনি। আর হ্যাঁ, সেদিন তাকে এই ক্যাফেতে নিয়ে আসতে হবে চিঠিটা।”
যখন ওর কথা পুরোপুরি মনে ছিল ফুসাগির, এটা আন্দাজ করা একটু কঠিনই বটে। তবে তিন বছর আগেই হবে সেটা, তখনও আলঝেইমারের লক্ষণ দেখা যায়নি ফুসাগির মাঝে।
এমন একটা দিন, যেদিন চিঠিটা ওকে দেওয়ার ভাবছিল ফুসাগি, এটা কল্পনা করা আরো কঠিন। চিঠিটা তো ও পায়নি, তাহলে দিনক্ষণ জানবে কীভাবে? এমন যদি হয় যে চিঠিটা লেখার আগে চলে গেছে, তাহলে তো সমস্যা। বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পর কোহতাকে সিদ্ধান্ত নিলো যে মনের পর্দায় সে কল্পনা করবে যে ফুসাগি ওর উদ্দেশ্যে চিঠিটা লিখছে।
সেদিন তাকে ক্যাফেতে নিয়ে আসতে হবে চিঠিটা, এটা সবচেয়ে জরুরি। অতীতে ফিরে যাওয়ার পর যদি দেখা যায় সাথে করে চিঠি নিয়ে আসেনি ফুসাগি, তাহলে এসবের কোনো মানেই থাকবে না। তবে কোহতাকের এটা জানা আছে যে জরুরি সবকিছু সবসময় নিজের কালো রঙের পোর্টফলিওটায় বহন করে ফুসাগি। চিঠিটা যদি আসলেও প্রেমপত্র জাতীয় কিছু হয়ে থাকে, তাহলে ওটা নিশ্চয়ই বাসায় ফিরে আসবে না সে। পোর্টফলিওতে ভরে সাথে সাথে রাখবে সবসময়, যাতে ভুলক্রমে কোহতাকের হাতে না পড়ে।
চিঠিটা ঠিক কবে ওকে দিতে চেয়েছিল ফুসাগি, সেটা আন্দাজ করা সম্ভব নয়। তাই মনে মনে কোহতাকে কল্পনা করলো যে কালো পোর্টফলিওটা সাথে নিয়েই ক্যাফেতে এসেছে তার স্বামী।
“আপনি তৈরি?” নিরুত্তাপ কণ্ঠে জানতে চাইলো কায়ু।
“এক মিনিট,” বলে লম্বা শ্বাস নিলো কোহতাকে। “যখন আমাকে ঠিকঠাক মনে আছে ওর…চিঠি…যেদিন এখানে এসেছে…” আপন মনেই বললো কয়েকবার।
অনেক হয়েছে।
“হ্যাঁ, আমি তৈরি,” কায়ুর চোখে চোখ রেখে বললো সে।
জবাবে আলতো মাথা নাড়লো কায়ু। খালি কফির কাপটা কোহতাকের সামনে নামিয়ে রেখে ডান হাত দিয়ে কেতলিটা তুলে নিলো। প্রতিটা পদক্ষেপ একদম মাপা তার।
“শুধু মনে রাখবেন…” চোখ নামিয়ে বললো কায়ু, “ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার আগেই কফিটা খেয়ে নিতে হবে।”
কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হলো গোটা ক্যাফেতে। উত্তেজনাটুকু চোখেমুখে প্রায় অনুভব করতে পারছে কোহতাকে। ক্যাফের পরিবেশটাও যেন অকস্মাৎ বদলে গেছে।
মন্দিরে নৈবেদ্য দেওয়ার ভঙ্গিতে কাপে কফি ঢালতে শুরু করলো কাযু
কালচে বাদামি রঙের কফির ধারা বেরিয়ে এলো কেতলির নল থেকে। ক্যারাফগুলোর মুখ প্রশস্ত হওয়াতে কফি ঢালার সময় শব্দ হয়, কিন্তু এবারে কোনো শব্দ হলো না। নিঃশব্দে ভরে উঠতে লাগলো কাপটা।
এরকম কেতলি আগে কখনো দেখেনি কোহতাকে। ক্যাফেগুলোতে সাধারণত এর চেয়ে বড় কেতলি ব্যবহার করা হয়। এটা আকারে ছোট হলেও দেখতে রাজসিক। বোঝাই যাচ্ছে যে ভীষণ যত্ন নিয়ে বানানো। কফিটাও নিশ্চয়ই বিশেষ জাতের, ভাবলো সে।
কাপটা থেকে এখন ধোঁয়া উঠতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পালটে গেল দৃশ্যপট। কোহতাকের চারপাশের সব কিছু দুলছে ধোঁয়ার তালে তালে। দৃষ্টি ঘোলা হয়ে এসেছে কিছুটা। ওর মনে হলো যে কিছুক্ষণ আগে খাওয়া সাকের প্রভাবে এমনটা হচ্ছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য ভুলটা বুঝতে পারলো। সামান্য সাকের প্রভাবে এসব হওয়ার কথা নয়। এখন তো ওর নিজের শরীরও ধোঁয়ার মতোন কাঁপছে। এক পর্যায়ে পুরোপুরি ধোঁয়ার অংশ হয়ে গেল সে নিজেও।
চোখ বন্ধ করে ফেলল কোহতাকে। ভয়ের কারণে নয়, বরং মন শান্ত করার জন্য। সে যদি আসলেও ফিরে যেতে পারে, নিজেকে প্রস্তুত করে নেওয়া দরকার।
.
একদিন ফুসাগির সাথে কথা বলার সময় হঠাৎই কোহতাকের মনে হয় যে কিছু একটা ঠিক নেই। সারাদিন কী করেছে সেই বিষয়ে স্ত্রী’কে জানাচ্ছিল ফুসাগি। ল্যান্ডস্কেপ গার্ডেনারের কাজ মানেই সারাদিন ডাল কাটা বা পাতা ছাটা নয়। তাকে মাথায় রাখতে হয় যে বাগান এবং বাড়িটার মধ্যে সমন্বয় হচ্ছে কি না। ‘সমন্বয়ই হচ্ছে চাবিকাঠি’-সবসময় এই কথাটা বলে ফুসাগি। সাধারণত একদম ভোর থেকে শুরু করে সন্ধ্যা অবধি কাজ শেষে সরাসরি বাসায় ফেরে সে। কোহতাকের রাতের শিফটে ডিউটি না পড়লে একসাথেই খায় দু’জনে।
কিন্তু সেদিন সময়মতো বাড়ি ফেরেনি ফুসাগি। এরকমটা সাধারণত ঘটে না, কিন্তু কোহতাকে ধরে নেয় হয়তো বন্ধুদের সাথে ড্রিংক করতে গিয়েছে সে।
নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় দুই ঘন্টা পর অবশেষে বাড়ি আসে ফুসাগি। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তিনবার বেল বাজানো তার পুরানো অভ্যাস। কিন্তু সেই রাতে বেল বাজায় না সে। বরং দরজার হাতল নাড়াচাড়া করার শব্দ কানে আসে কোহতাকের। বাইরে থেকে কেউ একজন বলে ‘আমি’।
পরিচিত কণ্ঠস্বরটা চিনতে কোনো সমস্যা হয় না ওর। ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। ভেবেছিল, হয়তো কোথাও আঘাত পেয়েছে ফুসাগি, যে কারণে বেল চাপতে পারছে না। কিন্তু দরজা খোলার পর ভুল ভাঙে কোহতাকের। আর দশদিনের মতোনই ধূসর রঙের কাজের পোশাক পরে বাইরে দাড়িয়েছিল তার স্বামী। টুল ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে রেখেছে, চেহারায় লাজুক ভাব। “হারিয়ে গিয়েছিলাম,” কিছুক্ষণ পর স্বীকার করে সে।
এটা প্রায় দুই বছর আগের কথা।
একজন নার্স হিসেবে কোহতাকে অনেক রোগের উপসর্গ সম্পর্কে বেশ ভালো ধারণা রাখে। এই ব্যাপারটা যে স্বাভাবিক কিছু না, তা বুঝতেও সমস্যা হয়নি তার। এরপর প্রায়ই দেখা যায় যে সারাদিন কী করেছে, সেসবের অনেক কিছু ভুলে যাচ্ছে ফুসাগি। রোগটা আরেকটু বাড়ার পর রাতের বেলা ঘুম থেকে জেগে উঠে ‘জরুরি কিছু একটা ভুলে গেছি’—এই জাতীয় কথা বলতে শুরু করে সে। এরকমটা হবার পর তার সাথে কোনো তর্কে জড়াতো না কোহতাকে। বরং শান্তকণ্ঠে বুঝিয়ে বলতো যে এই বিষয়ে সকালবেলা আলাপ করবে তারা।
ফুসাগিকে না জানিয়ে একজন চিকিৎসকের সাথেও কথা বলে কোহতাকে। সে খুব করে চাইছিল যাতে রোগটা দ্রুত না বাড়ে।
কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে সাথে দ্রুত স্মৃতি হারানো শুরু করে ফুসাগি।
ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে সে। অবশ্য তার ঘুরে বেড়ানোর মূল কারণ ছিল নতুন নতুন সব বাগান দেখা। কোহতাকে সবসময় চেষ্টা করত বার্ষিক ছুটিটা একই সময় নিতে, যাতে দু’জনে একসাথে বেড়াতে যেতে পারে। ফুসাগি প্রতিবাদ করে বলতো যে সে কাজের জন্য যাচ্ছে, কোহতাকে ভালো লাগবে না। কিন্তু ও এই কথায় কান দিত না। দেখা যেত শহর ছেড়ে বাইরে যাওয়ার পর পুরোটা সময় ভ্রু কুঁচকে রেখেছে ফুসাগি। কোহতাকে ভালো করেই জানতো যে পছন্দের কোনো কাজের সময় মুখ এরকমই বানিয়ে রাখে তার স্বামী।
আলঝেইমারে আক্রান্ত হওয়ার পরেও দূরে কোথাও যাওয়ার অভ্যাস কমেনি ফুসাগির। তবে একই জায়গায় বারবার যাওয়া শুরু করে সে।
কিছুদিন পর ওদের দৈনন্দিন জীবনেও ব্যাঘাত ঘটাতে শুরু করে ফুসাগির অসুস্থতা। প্রায়ই সে ভুলে যেত যে আগে কী কিনে রেখেছে বাসায়। ‘এটা কী কিনেছে?’ এই প্রশ্নের সম্মুখীন প্রতিদিনই হতে হয় কোহতাকে’কে। এরপর বাকিটা দিন মুখ গোমড়া করে রাখতো ফুসাগি। বিয়ের পর একসাথে একটা অ্যাপার্টমেন্টে থাকতে শুরু করে ওরা। কিন্তু বাড়ির ঠিকানা প্রায় প্রায়ই ভুলে যেত ফুসাগি। বাসায় পুলিশের ফোন আসতে শুরু করে নিয়মিত। এরপর, ছয় মাস আগে একদিন প্রথমবার ওর কুমারী নাম ধরে ডাক দেয় সে। ‘কোহতাকে’।
.
ঝিমুনি ভাবটা কেটে গেল অবশেষে। এখন আর ধোঁয়ার মতো পাক খাচ্ছে না চারপাশ। চোখ খুলেছে কোহতাকে। মাথার ওপর নিঃশব্দে ঘুরছে সিলিং ফ্যানটা। অনুভূতি ফিরে এসেছে হাত পায়ে। এখন আর ধোঁয়ার অংশ নয় ও।
তবে এটা বোঝা যাচ্ছে না যে অতীতে ফিরতে পেরেছে কিনা। ক্যাফেটায় কোনো জানালা নেই বিধায় ভেতরটা সবসময়ই খানিকটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। হাতঘড়ির দিকে না তাকালে সময় বোঝাটা দুরূহই বটে। দেওয়ালে ঝোলানো ঘড়ি তিনটা ভিন্ন ভিন্ন সময় দেখাচ্ছে।
কিন্তু কিছু একটা অন্যরকম লাগছে। কায়ু নেই আশপাশে। কেইকেও চোখে পড়লো না। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো কোহতাকে, কিন্তু হৃৎপিণ্ডটা পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটতে শুরু করেছে যেন। আরো একবার ক্যাফের চারপাশে তাকালো ও।
“কেউ নেই দেখি,” বিড়বিড়িয়ে বললো। ফুসাগির এখানে না থাকাটা আসলেও হতাশাজনক।
সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে নিজের দুর্ভাগ্যের কথা ভাবতে লাগলো কোহতাকে।
খারাপ লাগছ ওর, এটা অস্বীকার করার জো নেই। কিন্তু একদিক দিয়ে বোধহয় ভালোও হয়েছে। বুকে চেপে থাকা ভাবটা কমে গেছে। চিঠিটা অবশ্যই পড়ার ইচ্ছা ছিল ওর, কিন্তু জোর করে হলেও অপরাধবোধটা দূর করতে পারছিল না মন থেকে। বারবার মনে হচ্ছিল যে ফুসাগির ব্যক্তিগত কোনো বিষয়ে নাক গলাচ্ছে। ফুসাগি যদি জানতে পারে যে ভবিষ্যৎ থেকে এসে কেউ তার চিঠিটা পড়ে গেছে, তাহলে নিশ্চয়ই খুশি হবে না।
তাছাড়া ও অতীতে এসে যা-ই করুক না কেন, বর্তমানে এর কোনো প্রভাব পড়বে না। সুতরাং চিঠিটা না পড়লেও কোনো অসুবিধে নেই। পড়ার পর যদি ফুসাগির অবস্থার কিছুটা উন্নতি হত, তাহলে অবশ্যই পড়তো। সেজন্যে দরকার হলে নিজের প্রাণটাও দিয়ে দিতে রাজি কোহতাকে। কিন্তু চিঠির সাথে ফুসাগির সমস্যাটার কোনো সম্পর্ক নেই। চিঠিটা পড়লেও সে কোহতাকেকে ভুলে যাবে, না পড়লেও যাবে।
ঠান্ডা মাথায় নিজেকে কথাগুলো বোঝালো কোহতাকে। কিছুক্ষণ আগেই ফুসাগি ওকে জিজ্ঞেস করেছিল যে ওদের আগে কখনো দেখা হয়েছে কি না। অবশ্যই কথাটা শোনার পর কষ্ট পেয়েছে ও, যে-কোনো স্বাভাবিক মানুষই পাবে। তবে এই দিনটা যে আসবে, সেটা তো জানাই ছিল। তবুও এমন কিছু ব্যাপার থাকে, যেগুলোর মুখোমুখি না হলে পরিণতিটা অনুমান করা যায় না।
কিছুটা হলেও প্রশান্তি ভর করেছে কোহতাকের মনে।
এটা যদি অতীত হয়েও থাকে, এখানে ওর কোনো কাজ নেই। আমার বর্তমানে ফিরে যাওয়া উচিত। ফুসাগি হয়তো আমাকে চিনতে পারবে না। কিন্তু নার্স হিসেবে ওর যত্ন নিতে তো কোনো সমস্যা নেই। আমার পক্ষে যা যা করা সম্ভব, করবো। আরো একবার নিজেকে মনে করালো সে।
“আর চিঠিটা আসলেও ভালোবাসার বয়ান কি না, এই বিষয়ে সন্দেহ আছে,” বিড়বিড় করে নিজের উদ্দেশ্যে বলে কফির কাপের দিকে হাত বাড়ালো ও।
.
কেউ একজন প্রবেশ করেছে ক্যাফেতে।
এই ক্যাফেটায় ঢুকতে হলে রাস্তা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে হয়। সেখানে প্রায় দুই মিটার লম্বা একটা পুরু কাঠের দরজা। দরজাটা খুললেই বেলের শব্দ হয়। কিন্তু আরো দু’টো সিঁড়ির ধাপের কারণে সাথে সাথে ক্যাফের ভেতরে পা রাখা যায় না। ফলে বেল বাজার কয়েক সেকেন্ড পরে দেখা যায় আগন্তুককে।
তাই এবারেও যখন বেল বাজলো, কোহতাকে সাথে সাথে বুঝতে পারলো না যে কে এসেছে। নাগারে? নাকি কেই? অপেক্ষাটা অসহ্যকর লাগছে ওর কাছে। এর আগে কখনো কোনো কিছুতে এতটা বিচলিত হয়নি। যদি কেই হয়ে থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই জানতে চাইবে যে কেন এসেছি। অবশ্য কায়ু হলে খুব বেশি আগ্রহ দেখাবে না…
মনে মনে বেশ কিছু দৃশ্য কল্পনা করলো কোহতাকে। কিন্তু ক্যাফেতে যে পা রাখলো সে কেই কিংবা কায়ু নয়। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে স্বয়ং ফুসাগি।
“ওহ…” কেবল এটুকুই বলতে পারলো কোহতাকে। ফুসাগির হঠাৎ আগমনে বোকা বনে গেছে ও। তার সাথে দেখা করার জন্যই অতীতে পাড়ি জমিয়েছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে সে চলে আসবে, এটা ভাবতে পারেনি।
একটা পোলো শার্ট আর হাঁটু অবধি লম্বা শর্টস পরে আছে ফুসাগি। কাজ না থাকলে সাধারণত এই পোশাকেই বাইরে বের হয় সে। বাইরে নিশ্চয়ই প্রচণ্ড গরম। পোর্টফলিওটা হাত পাখার মতোন ব্যবহার করছে বেচারা।
কোহতাকের এই সিট ছেড়ে ওঠা সম্ভব না। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে ফুসাগি।
“হ্যালো,” বলার মতোন কিছু খুঁজে পাচ্ছে না কোহতাকে।
এখানে আসার উদ্দেশ্যটা হড়বড় করে ফেলাটা উচিত হবে কি না, সেটাও বোধগম্য হচ্ছে না। আর বললেও কীভাবে বলবে? এর আগে কখনো এমন দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকায়নি ফুসাগি। লজ্জা লাগছে আবার ভালোও লাগছে কোহতাকের।
মনে মনে তিন বছর আগের এক দিনের কথা কল্পনা করেছিল ও। কোনো ভুল করে ফেলেনি তো? তিন বছরের জায়গায় হয়তো তিন দিন আগে চলে এসেছে?
এসব নিয়েই ভাবছে, এমন সময় মুখ খুললো ফুসাগি।
“হ্যালো। তোমাকে এখন এখানে আশা করিনি,” স্বাভাবিক কণ্ঠেই বললো সে।
অসুস্থতার আগে এভাবে কথা বলতো ফুসাগি। মনে মনে এরকমটাই কল্পনা করেছিল কোহতাকে।
“বাসায় তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, কিন্তু এলে না তো,” কিছুক্ষণ পর আবারো মুখ খুলল ফুসাগি। ওর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো ইচ্ছা করেই। নার্ভাস ভঙ্গিতে কেশে উঠলো একবার। মনে হচ্ছে কোনো কারণে অস্বস্তিতে ভুগছে সে।
“আসলেও এটা তুমি?” কোহতাকে বললো।
“কী?”
“তুমি জানো আমি কে?”
“কী?” বিস্ময় গাঢ় হলো ফুসাগির দৃষ্টিতে।
আসলে নিশ্চিত হয়ে নিতে চাইছে কোহতাকে। অতীতে ফিরে এসেছে এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সময়কালটা বুঝতে পারছে না। এটা কী ফুসাগির আলঝেইমারে আক্রান্ত হবার আগে না পরে?
“আমার নামটা বলো দেখি।”
“ঠাট্টা ছাড়ো তো,” এবারে কিছুটা রাগের সাথেই বললো ফুসাগি।
প্রশ্নের উত্তর না পেলেও মন থেকে সংশয়টুকু দূর হয়ে গেল কোহতাকের। মনে হচ্ছে ঠিকঠাক সময়েই ফিরেছে ও। ফুসাগি এখনো ওকে ভুলে যায়নি। ওর কল্পনা যদি ঠিকঠাক কাজ করে থাকে তাহলে এখন তিন বছর আগের ফুসাগি দাঁড়িয়ে আছে সামনে। হেসে কফির কাপটা একবার নাড়ালো কোহতাকে।
ওর এই অদ্ভুত আচরণ আগ্রহের সাথেই দেখছে ফুসাগি। “এরকম করছো কেন তুমি?” চারদিকে নজর বুলিয়ে কিছুক্ষণ পর বললো সে। ওরা বাদে কেউ যে ক্যাফেতে নেই, এই প্রথম সেটা খেয়াল হলো তার।
“নাগারে, আছো নাকি?” রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে হাঁক ছাড়লো একবার।
কোন জবাব না আসায় কাউন্টারের পেছনে গিয়ে অন্য রুমটায় উঁকি দিলো। পায়ের সেত্তা স্যান্ডেলগুলো মচমচ শব্দ করছে মেঝেতে।
“অদ্ভুত। কোথায় গেল সবাই,” মুখ গোমড়া করে বললো ফুসাগি। এরপর কাউন্টারের কোণার সিটটায় বসে পড়লো, কোহতাকে থেকে যতটা সম্ভব দূরে।
ইচ্ছা করে কেশে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো কোহতাকে। হতাশ চোখে ওর দিকে তাকালো ফুসাগি।
“কী হয়েছে?”
“ওখানে বসেছো কেন?”
“কেন, বসলে কী সমস্যা?”
“এখানে এসেও তো বসতে পারো।”
হাত দিয়ে সামনের ফাঁকা সিটটা দেখালো কোহতাকে। কিন্তু ভ্রু কুঁচকে অন্য দিকে তাকালো ফুসাগি।
“না, আমি এখানেই ঠিক আছি।”
“আরে আসো তো…কী সমস্যা?”
“আমরা কী কচি খোকা খুকি নাকি যে একসাথে বসতে হবে? বিবাহিত দম্পতিদের এত আদিখ্যেতা না করলেও চলে।” কপালে আরো কয়েকটা ভাঁজ যোগ হয়েছে ফুসাগির। তবে এমনটা কিন্তু নয় যে সে রাগ করেছে। বরং চেহারা দেখে বোঝাই যাচ্ছে মন মেজাজ আজ ভালো আছে তার। লজ্জা ঢাকার জন্য মুখ এমন করে রেখেছে।
“সেটা অবশ্য ঠিকই বলেছো। আমরা বিবাহিত দম্পতি, “ হেসে একমত প্রকাশ করলো ও। ফুসাগির মুখ থেকে দম্পতি শব্দটা শুনে খুব খুশি হয়েছে।
“আহ…..তুমি সবসময় একটু বেশি বেশি করো…”
ফুসাগির সব কথা এখন নস্টালজিয়ায় ভোগাচ্ছে কোহতাকে’কে। আনন্দে ভরে উঠছে মনটা। অমনোযোগী ভঙ্গিতে কফির কাপে একবার চুমুক দিলো ও। “আহ-হা,” একটু বেশিই জোরে বলে ফেললো। কফিটা বেশ ঠান্ডা হয়ে এসেছে। অর্থাৎ সময় আর খুব বেশি বাকি নেই। পুরোপুরি ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার আগেই ওকে নিজের কার্যসিদ্ধি করতে হবে।
“আচ্ছা শোনো, তোমাকে একটা কথা বলতে চাই আমি।”
“কী? কী বলবে?”
“তোমার কাছে কী এমন কিছু আছে যেটা আমাকে দিতে চাও?”
বুকের ধুকপুকানি আবারো বেড়ে গেছে কোহতাকের। এখন ওর মনে হচ্ছে যে ফুসাগি চিঠিটা আলঝেইমারে আক্রান্ত হবার আগে লিখেছিল। সুতরাং সেটা একটা প্রেমপত্র হতেও পারে। অসম্ভব… মনে মনে নিজেই নিজেকে বললো কোহতাকে, একই সাথে আশায় বুকও বাঁধলো। বলা তো যায় না, হয়তো চিঠিটা ভালোবাসার…। যে করেই হোক চিঠিটা পড়তে চায় ও, কারণ এখানে যা-ই ঘটুক না কেন, বর্তমান সময়ে কোনো কিছু বদলাবে না।
“কী?”
“জিনিসটা এরকম…” বলে দুই হাত দিয়ে খাম এঁকে দেখালো কোহতাকে, ঠিক যেভাবে কাযু এঁকেছিল। এভাবে সরাসরি কথাটা বলায় শঙ্কা ফুটলো ফুসাগির চেহারায়। সুযোগটা হারালাম, ফুসাগির অভিব্যক্তি দেখে ভাবলো কোহতাকে। বিয়ের পরে একবার এরকমটা হয়েছিল।
সেবার ওর জন্মদিন উপলক্ষ্যে আগে থেকেই উপহার কিনে রেখেছিল ফুসাগি। কিন্তু নির্দিষ্ট তারিখের ঠিক আগের দিন অনিচ্ছাকৃতভাবে উপহারটা দেখে ফেলে কোহতাকে। এর আগে কখনো ফুসাগির পক্ষ থেকে কোনো কিছু পায়নি ও। আগ্রহ দমাতে না পেরে জিজ্ঞেস করে বসে, “তোমার কী আজকে বিশেষ কিছু দেওয়ার আছে আমাকে?” কিন্তু প্রশ্নটা শোনার পরই কঠিন হয়ে যায় ফুসাগির চেহারা। “না, নেই,” কাটা কাটা স্বরে বলে সে। পরদিন উপহারটা ডাস্টবিনে খুঁজে পায় কোহতাকে। কিছুক্ষণ আগে মেঝেতে পড়ে যাওয়া সেই লাইল্যাকের রুমালটা।
এখন ওর মনে হচ্ছে একই ভুল আবার করে ফেলেছে। নিজ থেকেই করার ইচ্ছা ছিল, এমন কোনো কিছু আগ বাড়িয়ে ফুসাগিকে করতে বললে সাধারণত বেঁকে বসে সে। এখন খুব সম্ভবত চিঠিটা সাথে করে নিয়ে এলেও ওকে দেবে না ফুসাগি। বিশেষ করে ওটায় যদি প্রেম-ভালোবাসা সংক্রান্ত কিছু লেখা থাকে, তাহলে তো আরো না। বেখেয়ালিপনার জন্য আফসোস হচ্ছে কোহতাকের, হাতে আর সময় খুব বেশি নেই। চোখ বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে ফুসাগি।
“সরি,” কিছুক্ষণ পর মৃদু হেসে বললো কোহতাকে। “আমার কথায় কিছু মনে করো না। বাদ দাও,” হালকাভাবে বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো ও। “আচ্ছা, আজকে রাতে আমরা সুকিয়াকি খেলে কেমন হয়?”
এটা ফুসাগির সবচেয়ে পছন্দের খাবারগুলোর একটা। মেজাজ খারাপ থাকলেও সুকিয়াকির নাম শুনলে খুশি হয় সে।
সন্তর্পণে হাত বাড়িয়ে কাপটা এখনো কতটা গরম তা বোঝার চেষ্টা করলো ও। মোটামুটি গরম বলা চলে। কিছুটা সময় আছে। এই মুহূর্তগুলো ওর জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আপাতত চিঠিটার কথা ভুলে থাকার চেষ্টা করলো। ফুসাগির চেহারার অনিশ্চয়তা দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা আসলেও লিখেছে সে। “কীসের কথা বলছো তুমি?”
ও যদি এখন আগের ভঙ্গিতে কথা চালিয়ে যায়, তাহলে চিঠিটার ঠিকানা যে ডাস্টবিনেই হবে, সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাই কৌশল বদলানোর চেষ্টা করলো কোহতাকে। ফুসাগির মন ভালো হয় এমন কিছু করতে হবে।
চেহারা থেকে গম্ভীর ভাবটা এখনো দূর হয়নি তার। আসলে, মুখটা সবসময় এরকমই করে রাখে লোকটা। সুস্থ ফুসাগি কখনো ‘সুকিয়াকি’ নামটা শুনেই খুশি হয়ে উঠতো না। এই কাজটাও ভুল হয়েছে কোহতাকের। হুট করে প্রিয় খাবারের নাম বলে ঠিক করেনি। কিন্তু এসব নিয়ে এখন ভাবতে ইচ্ছা করছে না। এখনকার প্রতিটা মুহূর্তের মূল্য অনেক বেশি। এভাবে ফুসাগিকে আর কখনো পাবে না।
“ওহ বুঝতে পেরেছি,” ওকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎই মুখ খুলল ফুসাগি। বিরক্তি ভর করেছে তার চেহারায়।
“কী হয়েছে?”
“তুমি ভবিষ্যৎ থেকে এসেছো, তাই না?”
“কী?”
এই মুহূর্তে ফুসাগি যা বললো, তা অন্য কেউ শুনলে হয়তো তাকে পাগল ঠাউরাবে। কিন্তু ঠিকই ধারণা করেছে সে।
“আসলে হয়েছে কী…” ভবিষ্যৎ থেকে আসার কথা কাউকে বলা যাবে না, এই ধরনের কোনো নিয়ম ওকে বলে দেয়নি কায়ু, তবুও ইতস্ততবোধ করছে কোহতাকে। “খুলে বলছি দাঁড়াও…”
“এজন্যেই এরকম অদ্ভুত আচরণ করছো। আবারো বসেছও ওই বিশেষ সিটটায়।”
“হ্যাঁ…”
“অর্থাৎ, আমার অসুস্থতার ব্যাপারে জানো তুমি।”
হৃৎস্পন্দন আবারো দ্রুত হয়ে গেল কোহতাকের। এতক্ষণ ও ভাবছিল যে তিন বছর আগের কোনো সময়ে চলে এসেছে, যখন পুরোপুরি সুস্থ ছিল ফুসাগি-কিন্তু ধারণাটা ভুল। ওর সামনে বসা ফুসাগি নিজের অসুস্থতার ব্যাপারে জানে।
তার পরনের জামাকাপড় দেখে বোঝা যাচ্ছে যে এখন গ্রীষ্মকাল অর্থাৎ দুই বছর আগে পা রেখেছে কোহতাকে, যখন আলঝেইমারের লক্ষণগুলো সবে স্পষ্ট হতে শুরু করেছিল ফুসাগির আচরণে।
অবশ্য ও মনে মনে যা ভেবেছিল, তার সাথে সবকিছু মিলে গেছে। এমন কোনো সময় যখন কোহতাকে’কে ঠিকঠাক মনে আছে ফুসাগির এমন একটা দিন, যেদিন ওকে চিঠিটা দিতে চেয়েছিল সে…আর চিঠিটা সাথে করে নিয়ে এসেছিল ক্যাফেতে। অর্থাৎ, তিন বছর নয়, চিঠিটা ফুসাগি লেখে দুই বছর আগে।
এই ফুসাগি নিজের অসুস্থতা সম্পর্কে জানে, সুতরাং চিঠির বিষয়বস্তু ও রোগটা সম্পর্কিত কিছু হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাছাড়া, ও চিঠিটার কথা বলার পর তার চেহারা যেমন হয়েছিল…
“তুমি জানো, তাই না?” সত্যটা কোহতাকের মুখ থেকে বের করেই ছাড়বে ফুসাগি। এই পর্যায়ে মিথ্যে বলারও কোনো মানে হয় না। তাই ধীরে একবার মাথা নাড়লো ও।
“বেশ।”
নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো কোহতাকে। আমি এখানে যা-ই করি না কেন, ভবিষ্যতে সেটার কোনো প্রভাব পড়বে না। কিন্তু, ওর মন খারাপ হয়, এমন কিছুও করা যাবে না। এই উদ্দেশ্যে অতীতে আসিনি আমি। ওই ‘প্রেমপত্র’ কথাটা শুনেই মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমার!
অতীতে ফেরার জন্য এখন প্রচণ্ড আক্ষেপ হচ্ছে কোহতাকের। কিন্তু এসেই যখন পড়েছে, হা-হুতোশ করে সময় নষ্ট করাটাও মানায় না। এখন একদম চুপ করে আছে ওর স্বামী।
“ফুসাগি?” বিয়ের পর খুব কমই ফুসাগিকে নাম ধরে ডেকেছে কোহতাকে। কিন্তু যতবার নামটা উচ্চারণ করেছে, তার সাথে জড়িয়ে ছিল প্রগাঢ় মমতা। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না।
এর আগে কখনো এতটা ভেঙে পড়েনি ফুসাগি। দৃশ্যটা ওর বুকে শেলের মতো বিঁধছে।
হঠাৎই পেছন দিকে ফিরে কাউন্টারের উপরে রাখা পোর্টফলিওটা থেকে একটা বাদামি রঙের খাম বের করলো সে। এরপর ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে এল ওর দিকে। কিছুক্ষণ আগের হতাশা দূর হয়ে গেছে চেহারা থেকে, এখন সেখানে লজ্জার ছায়া।
“কথাগুলো যে কীভাবে বলবো…” একবার কেশে উঠলো ফুসাগি। “এই সময়ের ‘কোহতাকে’ আমার অসুখটা সম্পর্কে জানে না…”
ওর ধারণা ভুল। আমি অনেক আগেই আন্দাজ করেছিলাম।
বিব্রত ভঙ্গিতে খামটা ওকে দেখালো ফুসাগি। এই চিঠির মাধ্যমে আলঝেইমারের কথা জানাতে চেয়েছিল সে।
কিন্তু আমার চিঠিটা পড়ার দরকার নেই আমি ইতোমধ্যেই জানি। অতীতের ‘আমি’-কে অবশ্য দেওয়া যায়। কিন্তু তাকে তো ফুসাগি চিঠিটা দিতে পারছে না…তাহলে আমি যদি নেই, কোনো সমস্যা হবে বলে মনে হয় না। হেরফের হবে না কিছুই।
এই অবস্থাতেই বর্তমানে ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে কোহভাকের। ফুসাগি যদি তার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে বসে, তাহলে ব্যাপারটা ভালো হবে না। খুশি হবার মতোন কিছু তো বলতে পারবে না ও। প্রশ্ন করার আগেই ফিরে যাওয়া উচিত। এখনই…
কফিটা এখন যে অবস্থায় আছে, এক ঢোকেই খেয়ে ফেলতে পারবে ও।
“কফিটা ঠান্ডা হতে দেওয়া যাবে না,” বলে কাপটা মুখে কাছে নিয়ে এলো কোহতাকে।
“তাহলে, আমি ভুলে যাবো তোমাকে? পুরোপুরি?” মাথা নিচু করে জিজ্ঞেস করলো ফুসাগি।
প্রশ্নটা শোনার পর বিভ্রান্তি ভর করলো কোহতাকের চিত্তে। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। ভয় ভয় চোখে ফুসাগির দিকে তাকালো। বেচারার চেহারায় দুঃখী ভাবটা দেখে নিজেকে বড্ড বেশি অসহায় মনে হচ্ছে ওর। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সাহায্য করতে পারছে না। বলার মতো কিছু খুঁজে না পেয়ে চোখ নামিয়ে নিলো।
মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ।
“আচ্ছা, এটাই ভেবেছিলাম,” ক্ষীণস্বরে বললো ফুসাগি। মাথাটা নিচু করে রেখেছে। দেখে মনে হচ্ছে যেকোন সময় খুলে পড়ে যাবে।
চোখে অশ্রু টলমল করছে কোহতাকের। আলঝেইমারে আক্রান্ত হবার পর থেকে প্রতিটা দিন স্মৃতি হারানোর ভয়ে ভয়ে কাটছে ফুসাগির। আর ও তার স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও এই অনুভূতিগুলো ধরতেই পারেনি। ভবিষ্যৎ থেকে এসেছে, এটা শোনার পরপরই ফুসাগি প্রথমে জানতে চেয়েছে যে ওকে ভুলে গিয়েছে কি না। ভাবনাটা একই সাথে আনন্দ আর বেদনার ঝড় তুললো ওর হৃদয়ে।
চোখ না মুছেই মাথা তুলে তাকালো ফুসাগির দিকে। জোর করে হাসি ফোটালো মুখে, যাতে সে ভাবে যে এই অশ্রুগুলো আনন্দাশ্রু।
“আসলে, তোমার অবস্থার অনেক উন্নতি হয়”
(একজন নার্স হিসেবে আমার এখন নিজেকে শক্ত রাখতে হবে।)
“ভবিষ্যতের ফুসাগি আমাকে খুলে বলে যে…”
(এখন আমি যা-ই বলি না কেন, বর্তমানে কিছু বদলাবে না।)
“স্মৃতি হারিয়ে ফেলা নিয়ে বড্ড দুশ্চিন্তা হতো তার…”
(মিথ্যে বললে তো কোনো সমস্যা নেই। এতে যদি ওর মন কিছুটা শান্ত হয়, তাহলে আরো ভালো।)
এই মিথ্যেগুলো যদি সত্যি হতো, তাহলে ওর চেয়ে খুশি আর কেউ হতো না। দু’গাল বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরছে এখন। কিন্তু মুখের হাসি মুছে যায়নি।
“সব ঠিক হয়ে যাবে।”
(সব ঠিক হয়ে যাবে। )
“অসুখও ভালো হবে।”
(অসুখও ভালো হবে!)
“চিন্তা কোরো না।”
(ঠিক হয়ে যাবে…আসলেই!)
প্রতিটা কথা জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করলো ও। আসলে এগুলোকে মিথ্যে বলে আখ্যায়িত করা যাবে না। বরং এগুলো ওর মনের বাসনার বহিঃপ্রকাশ। ওদের দু’জনের মধ্যকার দূরত্ব এখন যতটুকু, চাইলেই চিঠিটা হাত বাড়িয়ে নেওয়া যায়।
“এই নাও,” বাচ্চারা বড়দের কোনো কিছু যেভাবে দেয়, সেভাবে খামটা বাড়িয়ে ধরলো ফুসাগি।
চিঠিটা দূরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো কোহতাকে। “কিন্তু তুমি তো ভালো হয়ে যাবে।”
“তাহলে ফেলে দিও,” একরকম জোর করেই ওর হাতে চিঠিটা গুঁজে দিতে চাইছে কোহতাকে। স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্যতা দূর হয়ে গেছে কণ্ঠ থেকে, সেখানে ভর করেছে আবেগ। এভাবে তাকে কখনো কথা বলতে শোনেনি কোহতাকে।
বাদামি খামটা আবারও ওর দিকে বাড়িয়ে ধরলো ফুসাগি। এবারে কাঁপা কাঁপা হাতে সেটা নিলো ও। চিঠিটা দেওয়ার উদ্দেশ্য ঠিক পরিষ্কার হচ্ছে না যদিও।
“কফিটা খেয়ে নাও। ঠান্ডা হয়ে গেছে অনেকটাই,” নিয়মের দিকে ঠিকই খেয়াল আছে ফুসাগির। তার মুখে মমতামাখা হাসিটা দেখে পেটের ভেতরে প্রজাপতির নাচন শুরু হয়ে গেল কোহতাকের। একবার কেবল মাথা নাড়লো সে, আলতো করে। বলার মতো কিছু বাকি নেই আর। ও কফির কাপের দিকে হাত বাড়ানো মাত্র ঘুরে দাঁড়ালো ফুসাগি। মনে হচ্ছে এই চূড়ান্ত কাজটার মাধ্যমে ওদের দাম্পত্য জীবনের সমাপ্তি ঘটলো। আবারো কোহতাকের চোখে দানা বাঁধছে অশ্রু।
“ফুসাগি!” নিজের অজান্তেই মমতামাখা নামটা বেরিয়ে এলো মুখ থেকে। তবে এবারে আর পেছনে ফিরলো না ফুসাগি। দেখে মনে হচ্ছে যেন ওর কাঁধ জোড়াও কাঁপছে, ক্রন্দনরত মানুষের মতোন। বাকি কফিটুকু এক ঢোকে শেষ করার আগে এটাই ছিল কোহতাকের দেখা শেষ দৃশ্য। এমনটা নয় যে ফেরার খুব তাড়াহুড়ো আছে তার। বরং, ফুসাগি যে ওর বিপদের কথা চিন্তা করেই আর ঘুরে তাকায়নি, এটা বুঝতে পেরেছে।
এতটাই গভীর ওদের ভালোবাসা।
“ফুসাগি।”
কিছুক্ষণ আগের সেই ঝিম ধরানো অনুভূতিটা ফিরে এলো। কাপটা পিরিচের উপরে নামিয়ে রাখলো ও। হাত ওঠানো মাত্র ধোঁয়ায় পরিণত হলো পুরো শরীর। দুলতে লাগলো ধোঁয়ার ছন্দে। কিছুক্ষণের জন্য আবারো আদর্শ স্বামী-স্ত্রী’র মতো কথা বলেছিল ওরা, সেটারও ইতি ঘটলো।
হঠাৎই পেছন ফিরে তাকালো ফুসাগি। হয়তো কাপ রাখার শব্দটা কানে গিয়েছে বলেই ঘুরেছে। এই অবস্থায় কোহতাকে’কে সে দেখতে পাচ্ছে কি না সন্দেহ। মনে হচ্ছে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে।
“ধন্যবাদ।” কোহতাকের যদি ভুল না হয়, তাহলে এটাই বলেছে ফুসাগি।
কোহতাকের সমস্ত চেতনা এখন ধোঁয়ার অংশ। অতীত থেকে ভবিষ্যতে ফিরে চলেছে। ট্রেনের জানালার বাইরে যেরকম দৃশ্য দেখা যায়, ঠিক সেভাবেই ঘুরছে ক্যাফের সবকিছু। অল্পক্ষণের মধ্যেই কায়ু আর কেইকে দেখতে পেল ও। বর্তমানে ফিরে এসেছে আবারো। এই দিনটাতেই ওকে পুরোপুরি ভুলে গেছে ফুসাগি। ওর চেহারার দিকে একবার তাকিয়েই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো কেই।
“চিঠিটা?” জিজ্ঞেস করলো সে। চিঠি বলেছে, প্রেমপত্র না।
নীচের দিকে তাকিয়ে ফুসাগির দেওয়া বাদামি খামটার দিকে তাকালো কোহতাকে। ধীরে ধীরে চিঠিটা বের করলো ভেতর থেকে।
একদম সাধারণ জাপানিজে লেখা কথাগুলো। বাচ্চাদের মতোন হাতের লেখাটা যে ফুসাগির, তা বুঝতে অসুবিধে হলো না কোন। চিঠিটা পড়ার এক পর্যায়ে নিজেকে সামলানোর জন্য হাত দিয়ে মুখ চাপা দিলো কোহতাকে। টপটপ করে অশ্রু ঝরছে দুই গাল বেয়ে। কিছুক্ষণ পর চিঠিটা কাযুর হাতে তুলে দিলো সে।
একবার চিঠির দিকে, আরেকবার কেইয়ের দিকে তাকালো কায়ু। যেন পড়ার অনুমতি চাইছে। গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো কেই।
ক্রন্দররত কোহতাকের দিকে তাকিয়ে পড়তে শুরু করলো কায়ু। তুমি পেশায় একজন নার্স। আমার ধারণা ইতোমধ্যেই তুমি বুঝে গেছো যে আমি সবকিছু আস্তে আস্তে ভুলে যাচ্ছি।
স্মৃতি হারাতে হারাতে যখন একদম খারাপ অবস্থা হবে আমার, তখন তুমি একজন নার্স হিসেবে আমার যত্ন নেবে, এটা জানি। আমি হয়তো তোমাকে ভুলে যাবো। তবুও তুমি আমার খেয়াল রাখবে নার্স হিসেবে।
তবে একটা বিষয় কখনো ভুলবে না। তুমি আমার স্ত্রী। আমি যদি তোমার জীবনে বেশি সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াই, তাহলে অবশ্যই আমাকে আমার মতোন রেখে চলে যাবে।
একজন নার্স হিসেবে আমার পাশে থাকার কোনো দরকার নেই। স্বামী হিসেবে আমার দায়িত্ব যদি পূরণ করতে না পারি, তাহলে আমাকে ছেড়ে যাবে। তোমার প্রতি আমার অনুরোধ, স্ত্রী হিসেবে যত দিন পাশে থাকা সম্ভব, ততদিনই থেকো। হাজার হোক, আমরা স্বামী-স্ত্রী। স্মৃতি হারিয়ে ফেললেও স্বামী-স্ত্রী হিসেবেই থাকতে চাই আমি। বিশ্বাস করো, শুধু সহানুভূতির খাতিরে তুমি আমার সাথে থাকবে, এটা মেনে নিতে পারবো না কখনো।
কথাগুলো সরাসরি তোমাকে বলা সম্ভব নয় আমার পক্ষে, তাই চিঠিটা লিখলাম।
কাযুর চিঠিটা পড়া শেষ হলে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠলো কোহতাকে আর কেই। কোহতাকে এখন বুঝতে পারছে যে কেন চিঠিটা ওকে দিয়েছে ফুসাগি। বিশেষ করে ও ভবিষ্যৎ থেকে গিয়েছে এটা জানার পরেও পিছপা হয়নি।
চিঠিটা থেকে এটা স্পষ্ট যে ফুসাগি জানতো ও অসুখের বিষয়টা ধরে ফেলছে। আর সে যখন বুঝতে পারে যে কোহতাকে ভবিষ্যৎ থেকে গিয়েছে, তখনই নিশ্চিত হয়ে যায় যে নার্স হিসেবেই তার সাথে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও।
সমস্ত স্মৃতি হারিয়ে ফেলার দুশ্চিন্তার মাঝেও ফুসাগি মনে মনে আশা করছিল যে স্ত্রী হিসেবেই তার সাথে থাকবে কোহতাকে। কারণ ওর জায়গা সবসময়ই তার হৃদয়ে।
এই যুক্তির পক্ষে আরো প্রমাণ আছে। স্মৃতিভ্রষ্ট হবার পরেও সবসময় ট্রাভেল ম্যাগাজিন আর নোটবুক নিয়ে ব্যস্ত থাকতো ফুসাগি। একবার কোহতাকে দেখার চেষ্টা করেছিল যে কী লিখে রাখছে সে। সবই হচ্ছে বিভিন্ন দূরবর্তী শহরের বাগানের ঠিকানা। প্রথমে ও ভেবে নিয়েছিল যে নিজের কাজের প্রতি দুর্বলতা থেকে এমনটা করছে সে। কিন্তু ভুল ভেবেছিল। যে জায়গাগুলোর কথা নোটবুকে লেখা, সেগুলোর প্রত্যেকটায় ফুসাগির সাথে ছিল কোহতাকে। এটা প্রথমে চোখে পড়েনি ওর। এই নোটগুলো ফুসাগির ওর স্মৃতিকে আঁকড়ে রাখার শেষ সম্বল।
ও যে এতদিন ধরে নার্স হিসেবে ফুসাগির খেয়াল রাখার কথা ভেবে আসছিল, সেটায় অবশ্য দোষের কিছু নেই। আর ফুসাগিও ওকে কোনো প্রকার দোষারোপ করেনি চিঠিতে। এখন মনে হচ্ছে যে শেষ মুহূর্তে ওর বলা কথাগুলো যে মিথ্যে ছিল, সেটা জানতো ফুসাগি। কিন্তু এই মিথ্যেগুলো নিজ থেকেই বিশ্বাস করতে চেয়েছিল সে, নতুবা ‘ধন্যবাদ’ বলতো না।
কোহতাকের কান্না সবে থেমেছে, এমন সময় বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো সাদা পোশাক পরিহিতা মহিলা। ওর সামনে এসে নিচুস্বরে কেবল একটা কথাই বললো সে। “উঠুন!”
“নিশ্চয়ই,” বলে লাফ দিয়ে সরে গেল কোহতাকে।
একদম ঠিক সময়েই ফিরে এসেছে ভদ্রমহিলা। যেন সে জানতো কখন কান্নাকাটি থামাবে ও। ফোলা চোখে কায়ু আর কেইয়ের দিকে তাকালো কোহতাকে। কায়ুর পড়া চিঠিটা হাতে তুলে নিয়ে দোলালো একবার।
“বুঝেছো তো সব?” হেসে বললো ও।
জবাবে মাথা নাড়লো কেই। ওর উজ্জ্বল দুই চোখ বেয়ে এখনো অশ্রু ঝরছে অঝোর ধারায়।
“কী যে করেছি এতদিন!” চিঠিটার দিকে তাকিয়ে আপনমনেই বিড়বিড় করে বললো কোহতাকে।
“কোহতাকে,” জোরে একবার নাক টান দিলো কেই, চেহারায় উদ্বিগ্নতা।
চিঠিটা সাবধানে ভাজ করে খামে ঢুকিয়ে রাখলো কোহতাকে। “বাসায় যাচ্ছি আমি,” আত্মবিশ্বাসী স্বরে বললো।
মাথা দোলালো কায়ু। কেই এখনো নাক টানছে। আসলেও বড্ড বেশি আবেগপ্রবণ ক্যাফে মালিকের স্ত্রী। হাসি ফুটলো কোহতাকের মুখে। ভেতরে ভেতরে নব উদ্যমে টগবগ করছে সে এখন। পার্স থেকে ৩৮০ ইয়েন বের করে কায়ুর হাতে দিলো
“ধন্যবাদ।’”
কাযুর শান্ত মুখেও একটা স্নিগ্ধ হাসি ফুটলো এবারে।
মাথা নেড়ে বিদায় জানিয়ে দরজার উদ্দেশ্যে পা চালালো সে। যত দ্রুত সম্ভব ফুসাগির কাছে ফিরতে হবে।
দরজার বাইরে কেবল পা রেখেছে এমন সময় একটা কথা মনে হওয়ায় আবারো ফিরে এলো কোহতাকে। কৌতূহল ফুটলো কায়ু আর কেইয়ের চেহারায়।
“আরেকটা ব্যাপার, কালকে থেকে আমাকে কিন্তু আমার কুমারী নামে ডাকলে চলবে না, ঠিক আছে?”
উজ্জ্বল একটা হাসি ফুটেছে কোহতাকের মুখে।
বেশ কিছুদিন আগে ও নিজেই এই নামে সবাইকে ডাকতে বলেছিল। তারও কয়েকদিন আগে ফুসাগি তাকে কোহতাকে নামে ডাকতে শুরু করে। বিভ্রান্তি এড়ানোর জন্য কাজটা করে ও। কিন্তু এখন আর এসব নিয়ে ভাবার দরকার নেই। কেইয়ের মুখেও দরাজ হাসি।
“ঠিক আছে,” খুশিমনে বললো সে।
“অন্য সবাইকেও বলে দিও,” বলে জবাবের অপেক্ষা না করেই বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে গেল কোহতাকে।
.
“ঠিক আছে,” অনেকটা নিজের উদ্দেশ্যেই বললো কায়ু। বিলের টাকাগুলো নির্দিষ্ট জায়গায় গুছিয়ে রাখলো।
কোহতাকের ব্যবহৃত কাপটা পরিষ্কার করে সাদা পোশাক পরিহিতা মহিলার জন্য কফি আনতে রান্নাঘরে চলে গেল কেই। গোটা ক্যাফেতে এখন কেবল পুরানো ক্যাশ রেজিস্টারের ক্ল্যাঙ্ক ক্ল্যাঙ্ক শব্দ। সিলিং ফ্যানটা আগের মতোনই নিঃশব্দে ঘুরে চলেছে অবিরাম।
রান্নাঘর থেকে ফিরে এসে ভদ্রমহিলার কাপে কফি ঢেলে দিলো কেই। “এই গ্রীষ্মেও আপনাকে আমাদের মাঝে পেয়ে আমরা আনন্দিত, “ মন্ত্রপাঠের ভঙ্গিতে ফিসফিস করে কথাটা বললো সে।
সাদা পোশাক পরিহিতা ভদ্রমহিলা অবশ্য বই থেকে মাথা উঠালো না। পেটের উপরে হাত রেখে একবার হাসলো কেই। গ্রীষ্মকাল তো সবে শুরু হয়েছে।