স্বামী বিবেকানন্দ
স্বামী বিবেকানন্দ একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি দার্শনিক। তবে তিনি ঠিক অরবিন্দ ঘোষের (১৮৭২-১৯৫০) মতো আশ্রমবাসী সন্ন্যাসী অথবা ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের (১৮৬৪-১৯৩৮) মতো প্রাতিষ্ঠানিক দার্শনিক ছিলেন না। বিবেকানন্দ ছিলেন একাধারে বৈদান্তিক, গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী, ধর্মীয় নেতা ও মহান মানবতাবাদী সমাজসংস্কারক। আধুনিক ভারতের তিনি অন্যতম নির্মাতা।
১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি কলকাতার শিমুলিয়া অঞ্চলের দত্ত-পরিবারে বিবেকানন্দ জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পর তাঁর মা তাঁর নাম রেখেছিলেন বীরেশ্বর। বাড়িতে প্রিয়জনরা ডাকতো বিলে’ বলে। অন্নপ্রাশনের সময় তাঁর নামকরণ হয় নরেন্দ্রনাথ। সন্ন্যাসব্রত গ্রহণের পর তিনি হলেন বিবেকানন্দ। পৃথিবীতে স্বামী বিবেকানন্দ বলেই তাঁর পরিচয়। ভক্তদের কাছে তিনি শুধুই স্বামীজী।
তাঁর বাবা বিশ্বনাথ দত্ত ছিলেন একজন সচ্ছল আইনজীবী। তিনি ছিলেন বিদ্যোৎসাহী ও প্রগতিপন্থী। বিবেকানন্দের মা ভুবনেশ্বরী দেবী ছিলেন প্রাচীনপন্থী, কিন্তু অসামান্য ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মহিলা। কথিত আছে, ইস্টদেবতার কাছে তিনি একটি পুত্রসন্তানের জন্য প্রার্থনা করেন। দেবতার ইচ্ছেতেই নাকি শেষ পর্যন্ত তাঁর গর্ভে আসেন নরেন্দ্রনাথ। তাঁরা ছিলেন জাতিতে কায়স্থ অর্থাৎ ক্ষত্রিয় বা সৈনিকশ্রেণীর অন্তর্গত। নরেন্দ্রনাথের শৈশব ছিলো সুখের, কিন্তু যৌবনে পিতার মৃত্যুর পর তিনি প্রচণ্ড দারিদ্র্যের মুখোমুখি হন।
নরেন্দ্রনাথের পরিবারে ত্যাগ ও ভোগ—দু’রকমের ঐতিহ্যই ছিলো। তাঁর পিতামহ দুর্গাচরণ দত্ত তাঁর প্রথম সন্তানের জন্মের পরপরই সন্ন্যাসী হয়ে গৃহত্যাগ করেন। দীর্ঘ বারো বছর পর তিনি একবার মাত্র তিন দিনের জন্য নিজের বাড়িতে এসেছিলেন। বিশ্বনাথ দত্ত ছিলেন কলকাতার উচ্চ- আদালতের এটর্নি। তিনি প্রচুর অর্থ উপার্জন করতেন। ছিলেন সংসার বিবাগী বাবার চরিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত। ভোগবিলাস পছন্দ করতেন। ছিলেন অমিতাচারী। তবে এলাকার হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলের সঙ্গেই ছিলো তাঁর হৃদ্যতা।
শৈশবে নরেন্দ্রের খেলাধুলো আর শরীরচর্চার প্রতি ছিলো বিশেষ উৎসাহ। তিনি ছিলেন তাঁর খেলার সাথীদের দলনেতা। সমবয়েসীদের মধ্যে বিরোধ বাধলে তিনি তা সহজে মিটিয়ে দিতেন। পড়াশোনাতেও তিনি ছিলেন মোটামুটি ভালো। তবে পাঠ্যপুস্তকের চাইতে অন্যান্য গ্রন্থ পাঠের দিকেই ছিলো তাঁর সমধিক আগ্রহ। তাই প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় অনন্যসাধারণ মেধার পরিচয় দিতে পারেন নি। ১৮৭৯ সালে তিনি মেট্রোপলিটান স্কুল থেকে এনট্রেন্স বা প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তারপর ভর্তি হন জেনারেল এসেমব্রিজ ইন্সটিটিউশনে (পরবর্তীকালে স্কটিশ চার্চ কলেজ) এফ.এ ক্লাসে। এখান থেকেই তিনি ১৮৮৩ সালে বি.এ পাশ করেন। স্কুলে পড়ার সময়ই তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রধান গ্রন্থাবলি পড়ে শেষ করেছিলেন। উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময় তিনি পাশ্চাত্যসাহিত্য ও দর্শনের প্রতি মনোযোগ দেন। জন স্টুয়ার্ট মিলের ‘থ্রি এসেজ অব রিলিজিয়ন’ পড়ে বিশেষভাবে মুগ্ধ হন তিনি। ভারতীয় দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, পুরাণ প্রভৃতি ছাড়াও তিনি পড়েন দেকার্ত, স্পিনোজা, হিউম, কান্ট, ফিটে, হেগেল, কোৎ, শোপেনহাওয়ার, ডারুইন প্রমুখ দার্শনিকের রচনাবলি। তাঁর কলেজের অধ্যক্ষ হেস্টি মন্তব্য করেছেন : ‘সে এক শ্রেষ্ঠ দর্শনের ছাত্র। জার্মানি ও ইংল্যান্ডের সকল বিশ্ববিদ্যালয়েও তাঁর মতো একজন মেধাবী শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া যাবে না।’ ১৮৮৪-৮৬ সালে তিনি মেট্রোপলিটান ইনস্টটিউশনে (বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ) আইন অধ্যয়ন করেন। এখান থেকেই তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
নরেন্দ্র ছিলেন অসামান্য সুপুরুষ আর শারীরিক শক্তিরও অধিকারী। যদিও যৌবনেই তিনি বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত হন। এই রোগেই তাঁর অকালমৃত্যুও ঘটে। তাঁর দৈহিক উচ্চতা ছিলো পাঁচ ফুট সাড়ে আট ইঞ্চি। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে প্রথমবার যখন তিনি আমেরিকা যান, তখন তাঁর ওজন ছিলো ১৭০ পাউন্ড। নায়কোচিত শারীরিক সৌষ্ঠবের অধিকারী ছিলেন বিবেকানন্দ।
স্বামী বিবেকানন্দের জীবন আলোচনা করতে গেলে রামকৃষ্ণ পরম হংসদেবের (১৮৩৬-১৮৮৬) কথা বলতেই হয়। কলেজে পড়ার সময়ই একটি ঘটনাযোগে নরেন্দ্রের জীবনের মোড় ঘুরে যায়। ১৮৮১ সালের নভেম্বরে দক্ষিণেশ্বরের রামকৃষ্ণদেব কলকাতায় তাঁর এক ভক্তের বাড়িতে এসে কিছুদিন অবস্থান করেন। তাঁকে গান শোনানোর জন্যে গৃহস্বামী নরেন্দ্রকে তাঁর সামনে হাজির করেন। নরেন্দ্রের চমৎকার কণ্ঠে ভজন শুনে রামকৃষ্ণদেব মুগ্ধ হন। তিনি তাঁকে দক্ষিণেশ্বরে তাঁর কাছে আহ্বান করেন। তখন সামনেই ছিলো তাঁর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। তাই সঙ্গে সঙ্গেই যাওয়া সম্ভব না হলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নরেন্দ্র দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে রামকৃষ্ণদেবের সঙ্গে দেখা করেন।
ভারতীয় ও পাশ্চাত্যদর্শন পড়ে নরেন্দ্র অচিরেই উপলব্ধি করতে পারেন যে, শুধু বুদ্ধি দিয়ে পরম সত্যকে জানা সম্ভব নয়। সত্যের সন্ধানে তিনি বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির কাছে যেতে থাকেন। এই আগ্রহ থেকেই তিনি ব্রাহ্মসমাজেরও অন্তর্ভুক্ত হন। একদিন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জিগ্যেসও করেছিলেন, ‘আপনি ঈশ্বরকে দেখেছেন?’ এ প্রশ্নে সকলের মতোই মহর্ষিও নিরুত্তর থাকেন। নরেন্দ্র পরমহংসদেবকেও একই প্রশ্ন করেছিলেন। উত্তরে পরমহংসদেব বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ আমি ঈশ্বরকে দেখেছি। তোমাকে যেমন দেখছি তার চেয়েও স্পষ্টভাবে তাঁকে আমি দেখেছি।’ কিন্তু এ জবাবে সন্তুষ্ট হতে পারেন নি নরেন্দ্র। যাইহোক, দীর্ঘদিন পরমহংসদেবের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ অব্যাহত থাকে। এই যোগাযোগসূত্রেই ধীরে ধীরে তিনি তাঁকে তাঁর গুরু আর পথপ্রদর্শকবন্ধু হিশেবে গ্রহণ করেন। পরে এমন একটা সময় আসে, যখন সংসারজীবনের সঙ্গে তাঁর সবধরনের সম্পর্কের পুরোপুরি অবসান ঘটে।
নরেন্দ্রের বি.এ পরীক্ষার ফল বেরুবার আগেই ১৮৮৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তাঁর বাবা বিশ্বনাথ আকস্মিকভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর তাঁদের সংসার বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। বিশ্বনাথ আয়ের চেয়ে ব্যয় করতেন বেশি। পরিবারের সদস্যসংখ্যা পাঁচজন। এর মধ্যে তাঁর আত্মীয়স্বজনের কেউ কেউ বিষয়সম্পত্তি নিয়ে মামলা-মকদ্দমা শুরু করে দেয়। তাঁর পিতা বেশ কিছু ঋণের বোঝাও রেখে যান। সেই ঋণ নরেন্দ্র পরিশোধ করেন খুবই কষ্টেসৃষ্টে। তারপর জীবিকার খোঁজে বেরিয়ে পড়তে হয় তাঁকে। অনেক দিন তাঁকে ঘুরতে হয়েছে এ অফিস থেকে সে- অফিসে। পায়ে তাঁর জুতো পর্যন্ত নেই, পেটে নেই ভাত। পরিচিতদের কাছ থেকে কোনো সহানুভূতিও তিনি পেলেন না। তাঁর কয়েকজন ধনী বন্ধুবান্ধব ছিলো, তবে তাদের কাছেও তিনি কোনো সাহায্য চাইলেন না। একপর্যায়ে ঈশ্বরের ওপরও আস্থা হারিয়ে ফেলার জো হয়েছিলো তাঁর। এই রকম অবস্থায় একদিন তাঁর বিদ্রোহী মন বলে উঠলো, “ঈশ্বর যদি দয়াময় মঙ্গলময়ই হবেন তা হলে দুর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ লোক মারা যায় কেন?” তবে প্রশ্ন জাগলে কি হবে, কোনো অবস্থাতেই তিনি আত্মবিশ্বাস হারান নি। একসময় তিনি ‘ঈশ্বর বলে কেউ নেই’ এ কথাও প্রচার করতে লাগলেন। লোকে তাঁকে নাস্তিক বলে অপবাদ দিলো। তাতে তিনি আরো কঠোর হলেন। হলেন আরো বাস্তববাদী। তাঁর ব্যক্তিত্ব আর কর্মকাণ্ডের কথা রামকৃষ্ণের কানে গেলো। কিন্তু তিনি নরেন্দ্র সম্বন্ধে কোনো বাজে কথাই বিশ্বাস করলেন না। কারণ এই অসামান্য তরুণের প্রতি ছিলো তাঁর অপার আস্থা। তিনি বরং সবাইকে বকুনি দিলেন এই বলে, ‘নরেন্দ্র খারাপ হতেই পারে না।’
ধীরে ধীরে নরেন্দ্রর অন্তর্জীবনে পরিবর্তন আসতে থাকে। তিনি উপলব্ধি করলেন, ভীরু আর দুর্বলের কোনো জায়গা নেই এই পৃথিবীতে। অবশ্য এটাও তিনি বুঝতে পারলেন যে, জীবিকার জন্য অর্থ উপার্জন করা তেমন কোনো কঠিন কাজ নয়। তিনি নিজে জানতেন, তিনি জন্মেছেন অপরিমেয় শক্তি নিয়ে। সেই শক্তি তিনি অর্থ উপার্জনের মতো সামান্য ব্যাপারে ব্যয় করতে চান না। তিনি স্থির করলেন, সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে বৃহত্তর মানবসমাজে বেরিয়ে পড়বেন, স্বজাতি ও মানবজাতির কল্যাণে করবেন আত্মনিয়োগ।
১৮৮৫ সালের মাঝামাঝি রামকৃষ্ণদেবের গলায় ক্ষত ধরা পড়ে। ডাক্তাররা পরীক্ষা করে বললেন, ওখানে ক্যান্সার হয়েছে। তাঁকে চিকিৎসার জন্য ভক্তেরা কলকাতায় নিয়ে এলেন। তাঁর সঙ্গে এলেন সারদা দেবীও। তখন নরেন্দ্র আইন পড়ছেন। একই সঙ্গে করছেন বিদ্যাসাগরের বিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও। তিনি তাঁর কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে রামকৃষ্ণদেবের সেবায় নিয়োজিত হলেন। কিন্তু পরমহংসদেবের অবস্থার ক্রমেই অবনতি ঘটতে থাকে। তা ছাড়া শহরের বদ্ধ পরিবেশ তাঁর সহ্য হচ্ছিলো না। ১৮৮৫ সালের ডিসেম্বরে তাঁকে কাশীপুরের একটা নির্জন বাগানবাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও নরেন্দ্র আর তাঁর বন্ধুবান্ধব সারাক্ষণ তাঁর সেবায় নিয়োজিত থাকেন।
ওই সময়ই নরেন্দ্রের বৈরাগ্যের ভাব তীব্রতর হতে থাকে। ফলে শুরু করেন কঠোর আধ্যাত্মিক সাধনার কাজ। কারণ ক্রমে ক্রমে তিনি নিজের ভেতরে উপলব্ধি করেন এক মহাশক্তির উপস্থিতি। জীবনের শেষ দিনগুলোয় রামকৃষ্ণদেব তাঁর আধ্যাত্মিক সম্পদ নরেন্দ্রকে উজাড় করে দেন। একদিন রামকৃষ্ণদেবের দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে দেখে নরেন্দ্র জিগ্যেস করলেন, তিনি কাঁদছেন কেন? পরমহংসদেব বললেন, ‘বাবা, আজ থেকে আমি ফকির হলুম। আমার যা কিছু ছিলো সব তোকে দিয়ে দিয়েছি। এই শক্তির বলে তুই মা’র কাজ করবি। তোকে দিয়ে অনেক বড় বড় কাজ হবে।’
১৮৮৬ সালের ১৬ আগস্ট রামকৃষ্ণদেব পরলোকগমন করেন। তাঁর একজন গৃহী-ভক্ত সুরেশ মিত্রের আর্থিক সাহায্যে বরাহনগরে একটি বাড়ি ভাড়া নেয়া হয়। নরেন্দ্রসহ রামকৃষ্ণদেবের শিষ্যেরা সেখানে একটি আশ্রমের মতো খুলে বসলেন। ওখানে যে তাঁরা শুধু আধ্যাত্মিক সাধনা করতেন, তাই নয়, ইংরেজি, বাংলা, সংস্কৃত প্রভৃতি ভাষায় রচিত ধর্ম আর দর্শনের গ্রন্থ পাঠ করতেন। তারপর পঠিত বিষয় নিয়ে তাঁরা গভীর আলোচনা করতেন।
বরাহনগর আশ্রমে নরেন্দ্র বছর দুয়েক ছিলেন। তারপর ১৮৮৮ সালে তিনি বেরিয়ে পড়েন দেশ আর তীর্থভ্রমণে। অযোধ্যা, লক্ষ্ণৌ, আগ্রা, বৃন্দাবন, হিমালয় প্রভৃতি দর্শনীয় জায়গা ঘোরা শেষে ওই বছরই তিনি বরাহনগরে ফিরে আসেন। ফিরে এসেই তার মন আন্দোলিত হয়ে ওঠে। বর্তমান ভারতের দুর্দশাই ছিলো এর মূলে। প্রাণহীন আচার, জাতিভেদ প্রথা, মানুষে মানুষে বৈষম্য, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সবলের হাতে দুর্বলের নিপীড়িত হওয়ার বাস্তব ঘটনা তার মনকে ব্যাকুল ব্যথিত করে তোলে। ১৮৯১ সালের জানুয়ারি মাসে আবারো তিনি বেরিয়ে পড়েন সুদূরের আহ্বানে। এই সময় নানা ধর্মের, নানা বর্ণের, উঁচুনিচু, ধনীদরিদ্র নানা শ্রেণীর মানুষের সংস্পর্শে এসে আমূল বদলে যান তিনি। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের সঙ্গে তিনি ধর্ম নিয়ে মতবিনিময়ও করেন। সাধারণ মানুষজনকে ধর্ম সাধনার ব্যাপারেও উৎসাহ দেন। তাঁর এবারের ভ্রমণসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিলো ক্ষেত্রী, জয়পুর, আজমির, আহমেদাবাদ, লিমন্ডী, জুনাগড়, মহীশূর, কোচিন, ত্রিবাঙ্কুর, রামেশ্বর, কুমারিকা অন্তরীপ, পোরবন্দর, দ্বারকা, বরোদা, খান্ডোয়া, বোম্বাই, পুনে, বেলগাঁওসহ বিভিন্ন জায়গা। পোরবন্দরে অবস্থান করার সময় তিনি জানতে পারলেন যে, আমেরিকার শিকাগো নগরীতে এক মহাধর্মসম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। খবরটা শোনা মাত্র ভক্তদের কাছে তিনি ওই সম্মেলনে যোগদানের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। যেহেতু তিনি ছিলেন কপর্দকহীন, সহায়সম্বলহীন আর নিরাশ্রয়, তাই অন্যের অর্থসাহায্যই ছিলো তাঁর ভরসা।
১৮৯৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হায়দ্রাবাদে ‘মাই মিশন টু দ্য ওয়েস্ট’ শীর্ষক একটি বক্তৃতা দেন নরেন্দ্র। বছর দুই আগে তরুণ সন্ন্যাসী নরেন্দ্রের আশীর্বাদে ক্ষেত্রীর নিঃসন্তান মহারাজা পুত্রসন্তান লাভ করেন। ক্ষেত্রীর এই মহারাজাই তাঁকে ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ নামে ভূষিত করেন। তিনিই বিবেকানন্দের জন্যে জাহাজে প্রথম শ্রেণীর টিকিট আর দামি রেশমী পোশাক, গেরুয়া পাগড়ি ইত্যাদি কিনে দেন। ১৮৯৩ সালের ৩১ মে তিনি জাহাজে করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে বোম্বাই ত্যাগ করেন।
কলম্বো, পেনাং, সিঙ্গাপুর, হংকং হয়ে বিবেকানন্দের জাহাজ কানাডার ভ্যাঙ্কুভার গিয়ে পৌঁছোয়। ওখান থেকেই ৩০ জুলাই তিনি শিকাগো এসে পৌঁছোন। পশ্চিমের শীত সম্পর্কে তাঁর তেমন ধারণা ছিলো না। সঙ্গে গরম কাপড় না থাকায় সেখানে গিয়ে তাঁর খুবই কষ্ট হতে থাকে। তা ছাড়া নতুন জায়গার রীতিনীতি সম্পর্কেও তাঁর বিশেষ ধারণা ছিলো না। শুধু তাই নয়, পৌঁছেই জানতে পারেন যে, সম্মেলন হবে সেপ্টেম্বরে। পড়ে গেলেন ভীষণ চিন্তায়—এই দু’মাস থাকাখাওয়ার মতো অর্থ কই তাঁর? নানা ধরনের বিড়ম্বনার মধ্যে তাঁর কাটে কয়েকটি সপ্তাহ। বিবেকানন্দের এই সময়কার মানসিক অবস্থা ধরা পড়েছে তাঁর একটি চিঠিতে : ‘এখানে পৌঁছবার আগে মনে যে-সব মধুর স্বপ্ন ছিলো তা ঘুচে গেছে। এখন আমাকে অসম্ভবের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে। হাজারবার মনে হয়েছে দেশে ফিরে যাই। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা।…‘
শিকাগোর পথেঘাটে যত্রতত্র তাঁকে নানা ঠাট্টাবিদ্রূপ আর অপমান সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু অদম্য ছিলো তাঁর মনোবল। তাই কোনো কিছুই তাঁকে শেষ পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারে নি।
১৮৯৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর শিকাগো আর্ট ইনটিটিউটে ধর্মসম্মেলন শুরু হয়। নানা দেশের প্রায় সাত হাজার খৃস্টান, বৌদ্ধ, হিন্দু, জৈন, ইহুদিসহ বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতা ও প্রতিনিধি সেই সম্মেলনে যোগদান করেন। ভারতবর্ষের বেশ কয়েকজন ধর্মীয় নেতা যোগ দিয়েছিলেন তাতে। তাঁদের মধ্যেই একজন রবাহুত অজ্ঞাতপরিচয় তরুণ সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ। সকলেই তাঁদের বক্তৃতা লিখে এনেছিলেন। বিবেকানন্দ দিলেন ইংরেজিতে উপস্থিত- বক্তৃতা। খুবই সমাদৃত হলো তাঁর সেই ভাষণ। মার্কিন পত্রপত্রিকায় উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয় তাঁর। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন কবি হ্যারিয়েট মরো। তিনি লিখেছেন : গৈরিক বসনধারী, সুদর্শন স্বামীজী বিশুদ্ধ ইংরেজিতে আমাদের সামনে তাঁর অনুপম বাণী উপস্থিত করলেন। তাঁর বিরাট ব্যক্তিত্বের আকর্ষণীয় শক্তি, সুরেলা, গম্ভীর কণ্ঠস্বর, সংযত ভাবাবেগ—সবকিছুর সমন্বয়ে আমরা অপূর্ব এক আবেগে অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম।’
কয়েকদিনব্যাপী সম্মেলনে তিনি প্রধানত যে-সব বিষয়ে ভাষণ দেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য—’আমাদের মতবিরোধ কেন?’ [তার ফলেই ধর্মান্ধতা, ‘ধর্মসাধনই ভারতের আশু প্রয়োজন নহে’ [আশু প্রয়োজন রুটি], ‘গোঁড়া হিন্দুধর্ম ও বেদান্ত দর্শন’, ‘ভারতের বর্তমান বিভিন্ন ধর্ম’, ‘হিন্দুধর্মের সারকথা’, ‘বৌদ্ধধর্ম—হিন্দুধর্মের পরিণত রূপ’ এবং ‘হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে আলোচনা’। ২৭ সেপ্টেম্বর সম্মেলন শেষ হয়।
হিন্দু ধর্মতত্ত্ব আলোচনা করে একদিনের বক্তৃতায় তিনি একটি বিশ্বজনীন ধর্মের রূপরেখা প্রচার করেন। তাঁর ভাষায় :
‘সেই ধর্ম শুধু ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বা বৌদ্ধ ধর্ম বা ক্রিশ্চানের ধর্ম বা মুসলমানের ধর্ম হবে না। তা হবে সকলেরই সমষ্টিস্বরূপ অথচ তাতে ভবিষ্যৎ বিকাশের অনন্ত পথ খোলা থাকবে। সেই ধর্ম এতদূর ব্যাপক হবে যে, অসংখ্য হাত বাড়িয়ে জগতের সমস্ত নরনারীকে সাদরে আলিঙ্গন করবে। যাদের বুদ্ধি পশুর মতো বললেও অন্যায় বলা হয় না, এ-রকম মানুষ থেকে যাঁরা নিজেদের হৃদয় ও মস্তিষ্কের মহান শক্তিতে পৃথিবীর মানবগোষ্ঠীর পূজার আসন পেয়েছেন; সমাজ যাঁদের ভিড়ের মানুষ বলে গণ্য না করে দেবতার মতো সম্মান করে, সেই পুরুষসিংহদের পর্যন্ত সকলকে নিজের বুকে আশ্রয় দেবে। সে-ধর্ম এমন হবে যে, তাতে কারো ওপর বিদ্বেষ বা পীড়নের সুযোগ থাকবে না। তা প্রত্যেক নরনারীর হৃদয়ে যে-দেবতা রয়েছেন, তাঁকে স্বীকার করবে, আর মানুষ যাতে সেই দেবভাব উপলব্ধি করতে পারে, তার জন্য তার সমস্ত শক্তি নিয়ত নিয়োগ করবে।’
তাঁর এই সর্বধর্মসমন্বয়ের ব্যাপারটিতে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থাকতে পারে সেটা বিবেচনা করে বিবেকানন্দ শেষ দিনের বক্তৃতায় বলেন : “যদি এখানে কেউ এমন আশা করেন যে, ওই সমন্বয় হবে পৃথিবীর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে একটির প্রাধান্য আর অপরগুলোর ধ্বংসের মধ্য দিয়ে, তা হলে আমি তাঁকে বলবো, ভাই, তোমার আশা সফল হওয়া অসম্ভব।… ক্রিশ্চানকে হিন্দু বা বৌদ্ধ হতে হবে না। হিন্দু বা বৌদ্ধকে ক্রিশ্চান হতে হবে না। কিন্তু প্রত্যেক ধর্মই অপর অপর ধর্মপথের শ্রেষ্ঠ তত্ত্বগুলো নিজের মধ্যে গ্রহণ করে শক্তিলাভ করবে—নিজের বিশেষত্ব বর্জন না করে আপন আপন প্রকৃতি অনুযায়ী বিকশিত হয়ে উঠবে।
‘যদি এই মহাধর্মসম্মেলন জগতে কিছু প্রমাণ করে থাকে, তা হচ্ছে এই : পবিত্রতা, চিত্তশুদ্ধি, দাক্ষিণ্য পৃথিবীর কোনো একটি সম্প্রদায়বিশেষের একার সম্পত্তি নয়—প্রত্যেক সাধনাপ্রণালীতেই মহা মহা নরনারীর সৃষ্টি রয়েছে। … অনতিবিলম্বে জগতের প্রত্যেক সম্প্রদায়ের পতাকার ওপর লেখা থাকবে : বিবাদ করো না, পরস্পরকে সাহায্য করো, কারো ধ্বংসের চেষ্টা না করে অপরের ভাব নিজের মধ্যে সমীকরণের চেষ্টা করো। দ্বন্দ্ব নয়,—সম্প্রীতি ও শান্তি মানুষের চরম লক্ষ্য।’
ধর্মসম্মেলনের পরেও বিবেকানন্দের বিশ্রাম বা অবসর ছিলো না। তিনি শিকাগো, ডেট্রয়েট, বাল্টিমোর, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, বোস্টন, গ্রিন একার, ব্রুকলিন প্রভৃতি শহরে নানা সমাবেশে বেদান্তের বাণী প্রচার করে বেড়ান।
১৮৯৬ সালে তিনি ইংলণ্ড সফরে যান। সেখানে স্থাপন করেন জ্ঞানযোগ কেন্দ্র। অবিলম্বে সেখানে অসংখ্য ভক্ত জুটে গেলো তাঁর। বেদান্ত, ভক্তিযোগ, জ্ঞানযোগ সম্পর্কে মূল্যবান ভাষণ দিলেন নানা সমাবেশে। তাঁর বিদেশী ভক্তদের মধ্যে মার্গারেট নোবল, গ্রিন স্টিভেল, এস.ই. ওয়াললো, জে.জে. গুডউইন, সোভিয়ার দম্পতি প্রমুখ খ্যাতি অর্জন করেছেন। মার্গারেট নোবলই পরবর্তীকালের ভগিনী নিবেদিতা। ভক্ত ছাড়াও পাশ্চাত্যের যে-সকল মনীষীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ স্থাপিত হয় তাঁদের মধ্যে জার্মানির ভারততত্ত্ববিদ ফ্রিডরিক ম্যাক্স মূল্যার এবং পল ডয়সন উল্লেখযোগ্য।
পশ্চিমের হৃদয় জয় করে ১৮৯৭ সালে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলে বিবেকানন্দকে বীরোচিত সংবর্ধনা দেয়া হয়। অকুণ্ঠ অভিনন্দন জানালো তাঁকে দেশবাসী। তিনি ১৮৯৭ সালের ১ মে প্রতিষ্ঠা করেন ‘রামকৃষ্ণ মিশন’। ১৮৯৮ সালে বেলুড় মাঠে জমি কেনা হলো। সেখানে স্থাপিত হলো মঠ। শুরু হলো এই মহান ভাবযোগীর কর্মযজ্ঞ। রামকৃষ্ণ মিশনের আদর্শ : ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা।’ এই মিশনের উদ্দেশ্য শুধু ধর্মপ্রচার বা ধর্মালোচনা নয়, ব্যাপক ত্রাণকাজ পরিচালনা, যেখানেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, মহামারী, দুর্ভিক্ষ আর খরা, সেখানেই মিশনের সেবাকাজ চালানোর জন্য কর্মীরা ছুটে যান। মানবসেবার অনন্যসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন স্বামীজী। অবশ্য তাঁর সৌভাগ্য, তিনি পেয়েছিলেন বহু যোগ্য শিষ্য, অনুরাগী আর গুণগ্রাহী। যে-জন্য তাঁর ধনবল আর জনবলের কোনো অভাব হয় নি কোনোদিন।
ভারতবর্ষের অবস্থা দেখে বিবেকানন্দের অন্তরে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। তাই তাঁর কণ্ঠে শোনা গেলো : ‘মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমরা সবাই ভাই।’ তাদের সকলের উন্নতিই তাঁর কাম্য। শুধু পারমার্থিক উন্নতি নয়, ইহজাগতিক উন্নতির জন্যও ভাবলেন তিনি। ভারতীয় সমাজের অস্পৃশ্যতা তাঁকে কষ্ট দিলো। যারা পদানত, যারা ব্রাত্য, যাদের দিকে কেউ তাকায় না, তাদের তিনি যথাযথ মর্যাদা দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বললেন :
বুদ্ধ থেকে শুরু করে রামমোহন রায় পর্যন্ত সকলেই জাতিভেদ প্রথাকে ধর্মবিধান বলে ভুল করেছিলেন। তাই তাঁরা জাতিপ্রথা ও ধর্ম দুই-ই ভাঙার চেষ্টা করেছিলেন। অবশ্য কেউই সফল হতে পারেন নি। পুরুতরা যতই চেঁচান না কেন, জাতিভেদ একটা নির্দিষ্টভাবে গড়ে ওঠা সামাজিক-ব্যবস্থা! সেই ব্যবস্থা তার কাজ শেষ করে এখন ভারতবর্ষের আকাশকে দুর্গন্ধে ভরে দিয়েছে। তা দূর হবে একমাত্র যদি জনসাধারণের মধ্যে লোপ পাওয়া স্বাধিকারবোধকে আবার জাগানো যায়।’
ইউরোপ আমেরিকা পরিভ্রমণ শেষে তিনি ১৮৯৭ সালের কয়েক মাস অমৃতসর, আম্বালা, শ্রীনগর, মারী, রাওয়ালপিন্ডি, জম্মু, শিয়ালকোট, লাহোর, দেবাদুন, দিল্লি, জয়পুর, ক্ষেত্রী প্রভৃতি জায়গায় তাঁর বাণী প্রচার করলেন। ঘুরলেন বাংলাদেশেরও নানা জায়গা। স্বদেশের নানা ধর্মের-বর্ণের মানুষের সঙ্গে তিনি মিশলেন। কঠোর পরিশ্রমে তাঁর শরীর এই সময় প্রায় ভেঙে পড়বার দশা। ১৮৯৯ সাল নাগাদ তিনি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কিন্ত একটু সুস্থ হওয়া মাত্র দুর্বল শরীরেই তিনি ১৮৯৯ সালে আবারো যাত্রা করেন আমেরিকা। এবার তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্বামী তুরীয়ানন্দ আর ভগিনী নিবেদিতা। বছরখানেক আমেরিকায় বেদান্ত প্রচারের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। প্রতিষ্ঠা করেন ক্যালিফোর্নিয়া, ওল্যান্ড, সানফ্র্যানসিসকো প্রভৃতি জায়গায় বেদান্ত প্রচারকেন্দ্র। ১৯০০ সালে আমেরিকা থেকে স্বদেশের পথে প্যারিসে পৌঁছোন তিনি। সেখানে যোগ দেন ‘ধর্ম-ইতিহাস-সম্মেলনে’। ওই বছরেরই ডিসেম্বর মাসে ইউরোপের আরো কয়েকটি দেশ ঘুরে তিনি বেলুড় মঠে ফিরে আসেন। আর এসেই ঘোষণা করেন :
‘অসীম শক্তির অধিকারই ধর্ম। শক্তিমত্তাই পুণ্য, দুর্বলতাই পাপ। দুর্বলতা-এই একটি শব্দের মধ্যেই সমূহ পাপ এবং মন্দ নিহিত আছে। সকল দুষ্কর্মের মূল হচ্ছে দুর্বলতা। সকল স্বার্থপরতার উৎস হচ্ছে দুর্বলতা। দুর্বলতাবশেই মানুষ অপরের ক্ষতি করে বসে। …
‘তরুণ বন্ধুগণ, বীর্যবান হও। এই তোমাদের প্রতি আমার প্রথম বাণী। গীতাপাঠের চেয়ে ফুটবল খেললে তোমরা স্বর্গের বেশি কাছে গিয়ে পৌঁছবে। তোমাদের পেশিগুলো কিছু জোরালো হলে তার ফলে তোমরা গীতার মম বেশি বুঝতে পারবে। তোমাদের রক্ত একটু সতেজ হলে তোমরা কৃষ্ণের অপূর্ব প্রতিভা এবং অদম্য শক্তির কথা ভালভাবে উপলব্ধি করতে পারবে। যখন নিজেকে মানুষ বলে মনে হবে এবং দু’ পায়ে ভর দিয়ে সোজাভাবে দাঁড়াতে পারবে, তখনই উপনিষদের তাৎপর্য এবং মানবআত্মার মাহাত্ম্য যথার্থরূপে অনুভব করতে পারবে। বীর্য—বীর্যই উপনিষদের বাণী। এই বাণীই তার পাতায় পাতায় ঘোষণা করা হয়েছে।’
অতি পরিশ্রমে শরীর ভেঙে পড়েছিলো স্বামীজীর। শেষ দুটি বছর তিনি অতিবাহিত করেন বেলুড় মঠে ভক্তদের মধ্যে। তবে বহুমূত্র, হাঁপানি – এই রকম কঠিন অসুখের মধ্যেই তিনি তপস্যা আর সেবাকর্ম দুই-ই অব্যাহত রাখেন। ১৯০২ সালের ৪ জুলাই বিবেকানন্দ বেলুড় মঠেই পরলোকগমণ করেন। পরদিন অপরাহ্ণে মঠের কাছেই গঙ্গার তীরে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন হয়। পুরো চল্লিশ বছরের জীবনও নয়, এর মধ্যেই তিনি দেশকে যা দান করেন, অপরিমেয় তার মূল্য। এই মহান ধার্মিক বললেন : ‘অন্য দেবতাদের ভুলে যাও। দেশই মাতা। তার উপাসনা করো।’
বিবেকানন্দের রচনাবলির পরিমাণও প্রচুর। ভক্তি আর উদ্দীপনামূলক কিছু কবিতাও তিনি লিখেছেন, যেমন ‘সুপ্ত দেবদূত’, ‘প্রবুদ্ধ ভারতের প্রতি’, ধৈর্য ধরো সাহসী হৃদয়’, ‘সন্ন্যাসীর সঙ্গীত’, ‘৪ঠা জুলাই’, ‘হয়েছে খেলার অবসান’, ‘নাচুক তাহাতে শ্যামা’ প্রভৃতি। আশাবাদী এই দার্শনিক-ঋষি লিখেছেন :
মেঘের আড়ালে সূর্য ক্ষণিক ঢাকলে
আকাশে ঘনায় সহসা অন্ধকার,
সাহসী হৃদয়, হারায়ো না তবু ধৈর্য,
সন্দেহ নাই, খুলবে জয়ের দ্বার।
তাঁর গ্রন্থাবলির মধ্যে রয়েছে : চিকাগো বক্তৃতা, কবিতা, ভাববার কথা, পরিব্রাজক, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, বর্তমান ভারত, কর্মযোগ, কর্মযোগ প্রসঙ্গ, জ্ঞানযোগ, জ্ঞানযোগ প্রসঙ্গে, ধর্মবিজ্ঞান, কর্মসমীক্ষা, ধর্মদর্শন ও সাধনা, ভক্তিযোগ, পরাভক্তি, ভক্তি রহস্য, রাজযোগ, রাজযোগ ষড়পাঠ, পাতঞ্জল যোগসূত্র, যোগ ও মনোযোগ, মহাপুরুষ প্রসঙ্গ, বিবিধ, ভক্তি প্রসঙ্গে, বৌদ্ধ ভারত, বেদান্ত দর্শন এবং ভারত প্রসঙ্গে ও ভারতে বিবেকানন্দ।
বিবেকানন্দের রচনাবলির একটি প্রধান অংশ প্রথমত ইংরেজিতে লেখা, পরে সেগুলো বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে। যেমন বিদেশেই বেরোয় তাঁর Karmayaga, Rajayaga, Jnanayaga, Bhaktiyaga প্রভৃতি। ইংরেজিতে লেখার কারণ সেগুলো মূলত তাঁর বক্তৃতা, যার শ্রোতা ছিলেন অবাঙালি। বিবেকানন্দের বাংলা রচনাগুলোর ভাষা খুবই সরল, কঠিন ভাষায় ভাব প্রকাশ করা তিনি অপছন্দ করতেন। ‘বাঙালা ভাষা’ শীর্ষক এক রচনায় তিনি বলেন : “ভাষা ভাবের বাহন। ভাবই প্রধান; ভাষা পরে।’
তিনি আরো বলেছেন :
‘পান্ডিত্য অবশ্য উৎকৃষ্ট; কিন্তু কটমট ভাষা—যা অপ্রাকৃতিক, কল্পিত মাত্ৰ, তাতে ছাড়া কি আর পাণ্ডিত্য হয় না? চলতি ভাষায় কি আর শিল্পনৈপূণ্য হয় না? স্বাভাবিক ভাষা ছেড়ে একটা অস্বাভাবিক ভাষা তয়ের [তৈরি] করে কি হবে?’
বিবেকানন্দ তাঁর ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনবিষয়ক রচনাগুলোও খুবই প্রাঞ্জল ভাষায় লিখেছেন। বোঝা যায় তিনি শুধু বিশেষজ্ঞদের জন্য লেখেন নি, তাঁর রচনার পাঠক যাতে সকলেই হতে পারে লক্ষ্য রেখেছেন তিনি সে বিষয়েও।
ভারতীয় সমাজের অস্পৃশ্যতা ও বৈষম্য বিবেকানন্দকে পীড়া দিয়েছিলো সব থেকে বেশি। যারা পদানত, যারা ব্রাত্য, তিনি তাদেরকে যথাযথ মর্যাদা দেয়ার আহ্বান জানান। নারীস্বাধীনতার প্রতিও ছিলো তাঁর অকুণ্ঠ সমর্থন। পশ্চিমে নারীর যে-স্বাধীনতা দেখেছিলেন, তাতে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। তাদের সঙ্গে আমাদের দেশের মেয়েদের তুলনা করে তিনি কষ্ট পেতেন।
বিবেকানন্দের দৃষ্টিভঙ্গিটি ছিলো মোটামুটি বৈষম্যহীন ও সমাজবাদী। ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ গ্রন্থে বলেছেন :
‘তিনি পৃথিবীর মধ্যে সর্বপ্রথম ব্যক্তি, যিনি শ্রমজীবী জনসাধারণের রাষ্ট পরিকল্পনা করেছিলেন এবং ভবিষ্যতে এক বিত্তহীন সর্বহারা শ্রমজীবী সংস্কৃতির সপ্নও দেখেছিলেন।
তবে তিনি সমাজবাদ মার্কসবাদীদের মতো শ্রেণীসংগ্রামের মাধ্যমে নয় শ্রেণীসমন্বয়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। পাশাপাশি জোর দিয়েছেন আত্মিক ও আত্মউন্নতির ওপরও। রাজনীতির কোলাহল দিয়ে যাবতীয় সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় বলেও তিনি বিশ্বাস করতেন। তাই মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা আগে তিনি তাঁর শিষ্যদের বলেছিলেন :
‘ভারত যদি তাঁর ভগবৎ সন্ধান চালিয়ে যেতে পারে, তবে তার মৃত্যু নাই। তবে সে যদি রাজনীতি করে, সামাজিক দ্বন্দ্বে নামে, তবে সে মরবে।’
বিবেকানন্দের প্রধান বৈশিষ্ট্য তাঁর অবিচল দেশপ্রেম, দেশের মানুষের প্রতি তাঁর অপার ভালোবাসা। তাঁর চিন্তাচেতনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলো দেশের কল্যাণ। সব ধরনের গোঁড়ামি আর কুসংস্কার মুক্ত হয়ে ভারতবাসীকে এক নতুন জীবনে প্রবেশ করার আহ্বান জানিয়ে তাই তিনি বলেছিলেন :
‘ভারতবর্ষে যে-কোনো প্রকার সংস্কার বা উন্নতি করবার চেষ্টা করা হোক, তার জন্য প্রথমত চাই ধর্মপ্রচার। ভারতকে সামাজিক বা রাজনৈতিক ভাবের বন্যায় ভাসাতে গেলে প্রথমে তাকে আধ্যাত্মিক ভাবের বন্যায় ভাসাতে হবে। প্রথমেই এ কাজটি করা চাই। আমাদের উপনিষদে, আমাদের পুরাণে, আমাদের অন্যান্য শাস্ত্রে যে-সকল অপূর্বসত্য নিহিত আছে, তা ওই বইগুলো থেকে বার করে, মঠগুলো থেকে, বনজঙ্গল থেকে, সম্প্রদায়বিশেষের অধিকার থেকে উদ্ধার করে সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে দিতে হবে।’
বিবেকানন্দের দর্শন ও চিন্তাধারা আলোচনা করতে গেলে তাঁর যোগ চতুষ্টয়ের কথা আসে, যেমন—কর্মযোগ, ভক্তিযোগ, রাজযোগ ও জ্ঞানযোগ। এগুলো হলো, তাঁর মতে, মানবমুক্তির মহান পথ। তাঁর চারটি যোগের মধ্যে কর্মযোগই সবচেয়ে গভীর। ‘কর্মযোগ’ সম্পর্কে তিনি বলেছেন :
‘যদি আমরা ইন্দ্রিয় ও মনের দ্বারা সীমাবদ্ধ এই ক্ষুদ্র জগৎকে ত্যাগ করিতে পারি, তবে আমরা তৎক্ষণাৎ মুক্ত হইব। বন্ধন হইতে মুক্ত হইবার একমাত্র উপায়—সমুদয় নিয়মের বাইরে যাওয়া; আর যেখানেই জগৎ আছে, সেখানেই কার্যকারণ শৃঙ্খল আছে। কিন্তু এই জগৎকে ত্যাগ করা বড়ই কঠিন ব্যাপার। অতি অল্প লোকেই সংসার ত্যাগ করিতে পারেন। …
‘অন্য পথটি ত্যাগের পথ নহে, গ্রহণের পথ।… উহাতে জগতের মধ্যে ঝাঁপাইয়া পড়িতে হয় এবং কর্মের গোপন কৌশলটিকে আয়ত্ত করিতে হয়।… বিশ্বযন্ত্রের চক্র হইতে পালাইও না, উহার মধ্যে দাঁড়াও এবং কর্মের গোপন কৌশল আয়ত্ত কর। আর ইহাই হইল কর্মযোগ।…
‘আমরা দেখি, সমস্ত দুনিয়াই কাজ করিতেছে। কিসের জন্য করিতেছে?… মুক্তির জন্য। অনু-পরমাণু হইতে উচ্চতম সত্তা পর্যন্ত সমস্ত কিছুই ওই একই উদ্দেশ্যে—মানসিক মুক্তি, দৈহিক মুক্তি, আধ্যাত্মিক মুক্তির উদ্দেশ্যে—কাজ করিতেছে।… আমরা কর্মযোগ হইতে কর্মের সেই গূঢ় কৌশল, কর্মের সংগঠনী শক্তিকে শিক্ষা করি।… কর্ম অপরিহার্য… তবে উচ্চতম উদ্দেশ্যেই আমাদিগকে কর্ম করিতে হইবে।…’
গীতায়ও বলা হয়েছে : ‘আমাদের কর্মে অধিকার আছে, কিন্তু ফলে কখনো অধিকার নাই।’ অর্থাৎ নিরাসক্ত চিত্তে কাজ করে যাওয়া জীবের ধর্ম হওয়া উচিত। গীতায় আরো উল্লেখ করা হয়েছে : নির্বোধেরা কর্মে আসক্ত হইয়া কাজ করে; জ্ঞানীরাও কাজ করেন, তবে সকল প্রকার আসক্তিকে অতিক্রম করিয়া, কেবল জগতের কল্যাণের জন্যেই করেন।’
‘কর্মযোগ’-এর পঞ্চম অধ্যায়ে বিবেকানন্দ বলেছেন : ‘অনাসক্ত হইয়া কি ভাবে কাজ করিতে হয়, তাহা সর্বপ্রথমে শিক্ষা করা প্রয়োজন, তাহা হইলে আর ধর্মান্ধতা থাকিবে না।… জগতে যদি ধর্মান্ধতা না থাকিত, তবে জগৎ এখনকার অপেক্ষা অনেকখানি আগাইয়া যাইতে পারিত।… ধর্মান্ধতা [জগৎকে] পিছনে টানিয়া রাখে।…তুমি যখন ধর্মান্ধতাকে এড়াইবে, কেবল তখনই তুমি ভালভাবে কাজ করিতে পারিবে।’
বিবেকানন্দ বলেছেন, মুক্তির আরেক উপায় ‘ভক্তিযোগ’। তিনি বলেছেন : ‘মানুষের আদর্শ হইল সকল কিছুর মধ্যে ভগবানকে প্রত্যক্ষ করা। যদি সকল কিছুর মধ্যে তুমি ভগবানকে প্রত্যক্ষ করিতে না পার, তবে যে জিনিশটিকে তুমি সর্বাপেক্ষা অধিক ভালোবাসো, তাহার মধ্যেই ভগবানকে প্রত্যক্ষ করো, তারপর আবার অন্যকিছুর মধ্যে ভগবানকে প্রত্যক্ষ করো। এইভাবেই আগাইতে থাকো। আত্মার সম্মুখে অসীম জীবন পড়িয়া আছে। সময়ের সদ্ব্যবহার করো, তুমি তোমার লক্ষ্যে গিয়া উপনীত হইবে।’
‘রাজযোগ’কে বিবেকানন্দ বলেছেন যোগের রাজা, লিখেছেন : ‘রাজযোগ বিজ্ঞান সত্যে উপনীত হইবার পক্ষে কার্যত প্রয়োগশীল এবং বৈজ্ঞানিক উপায়ে উদ্ভাবিত একটি রীতিকে মানুষের সম্মুখে মেলিয়া ধরিয়াছে।
মানবাত্মার মুক্তির জন্যে বিবেকানন্দ ভক্তির কথা বলেছেন, নিঃস্বার্থ কর্মের কথা বলেছেন, অভ্যন্তরীণ অবস্থা বা যন্ত্র নিয়ন্ত্রণের বিজ্ঞান “রাজযোগে’র কথাও বলেছেন, কিন্তু সবশেষে তিনি জোর দিয়েছেন ‘জ্ঞানযোগে’র ওপর। দার্শনিক বিচার-বিশ্লেষণের জন্যে জ্ঞানযোগ অতি প্রয়োজনীয়। তিনি বলেছেন, ‘অভিজ্ঞতাই জ্ঞানের একমাত্র উৎস।’ [যুক্তি ও ধর্ম] জ্ঞানযোগে যুক্তি ও বিজ্ঞানের ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হয়েছে। ‘জ্ঞানযোগ’ প্রবন্ধে বিবেকানন্দ স্পষ্ট ভাষায়ই বলেছেন : ‘বিজ্ঞান বা বহির্জাগতিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে আমরা যে-সকল অনুসন্ধান রীতির প্রয়োগ করিয়া থাকি, ধর্মীয় বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও কি সেগুলোকে ব্যবহার করা চলিবে? আমি বলিব, ‘চলিবে’। এবং সেইসঙ্গে আমি ইহাও বলিব যে, ‘এবং তাহা যতো সত্বর হয় ততোই মঙ্গল।’ এইরূপ অনুসন্ধানের দ্বারা ধর্ম যদি বিনষ্ট হয়, তবে বুঝিতে হইবে, ধর্ম অর্থহীন, মূল্যহীন কুসংস্কার মাত্র। সে ক্ষেত্রে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই যে, উহার ধ্বংসই সর্বাপেক্ষা শ্রেয়—উহা হইতে কোনো শুভ হইতে পারে না। এইরূপ অনুসন্ধানের ফলে ভেজাল ও মেকি যাহা কিছু আছে, তাহা দূর করিতে হইবে এবং যাহা কিছু খাঁটি, তাহা সগৌরবে আত্মপ্রকাশ করিবে।’
যেখানে যা-কিছু ভালো তা দ্বিধাহীনচিত্তে গ্রহণ করতে বিবেকানন্দের বিলম্ব হতো না। ১৯০০ সালে প্যারিসে সমাজতন্ত্রী বিপ্লবীদের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিলো। এই আজন্ম মানবতাবাদী তাঁদের চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়ে থাকবেন। তাই তিনি তাঁদের কর্মতৎপরতাকে সমর্থন করে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয়দের দিন শেষ হয়েছে। এখন বৈশ্যের অর্থাৎ পুঁজিবাদী ব্যবস্থা চলছে। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে সমাজের নেতৃত্বে আসবে শূদ্র অর্থাৎ নিচুতলার নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষ। এই অদ্বৈতবাদী দার্শনিকের সঙ্গে বস্তুবাদী কার্ল মার্কসের চিন্তার এখানেই অনেকখানি মিল। বিবেকানন্দ ঘোষণা করেছেন : ‘এমন দিন আসবে যখন প্রত্যেকটি দেশেই শূদ্র শ্রেণীর [নিচ শ্রেণীর অবহেলিত] মানুষেরা তাদের সহজাত প্রকৃতি ও আচরণাদি সমেত… পূর্ণ আধিপত্য লাভ করবে।’
বিবেকানন্দ ধর্মপ্রচার, দর্শনালোচনা ও সমাজসেবার ক্ষেত্রে যে ভূমিকা রাখেন এ দেশে তা অতুলনীয়। বেদান্তদর্শনে গভীর জ্ঞান ছিলো তাঁর যা তাঁর সমসাময়িক আরো অনেকেরই হয়তো ছিলো, কিন্তু পরাধীন মাতৃভূমির রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাগুলো সম্পর্কে তাঁর উদ্বেগ ছিলো যে-কারো চাইতে বেশি। তাই তাঁর বাণী অবিলম্বে দেশবাসীর মর্মে মর্মে পৌঁছে যায়। তাঁর বাণী ও কাজের ধারা জাতিপ্রথার বৈষম্যে জর্জরিত, অনাহার, অশিক্ষা ও কুসংস্কারে বিপর্যস্ত পরাধীন ভারতবাসীকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে সাহায্য করেছিলো। ধর্মকে তিনি পারলৌকিক ব্যাপারে নয়, ব্যবহার করেছিলেন সমাজের অগ্রগতি অর্জনের অস্ত্র হিশেবে। রামকৃষ্ণদেবের আদর্শে উজ্জীবিত বিবেকানন্দ বৃহত্তর জনসাধারণের কাছে পৌঁছেছিলেন, যা অন্য আর কোনো বাঙালি দার্শনিকের পক্ষে সম্ভব হয় নি। ফলে অবিলম্বেই তিনি সমাজের অবহেলিত ও বঞ্চিতদের আশার উৎস হয়ে ওঠেন। বেদান্তের ও ধর্মের তিনি যে-ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তার সঙ্গে অন্য দার্শনিকদের দ্বিমত থাকতে পারে, কিন্তু তাঁর সেই ব্যাখ্যায় তাঁর নিজস্ব কর্মপ্রচেষ্টার তাত্ত্বিক সমর্থন ছিলো।