স্বামীজী আসছেন
এই নাও তোমার ধর্ম। শুধু তোমার ধর্ম নয়, সারা বিশ্বের সমস্ত মানুষের ধর্ম। একশ বছর পরে যে টেকনোলজিক্যাল মানুষ আসছে—তারা সহজ, সরল, পরিচ্ছন্ন একটা মতবাদ চাইবে, যা সহজে হজম করা যায়। This is that religion. এইটি নিয়ে যাও; বিশ্বমানব, বিশ্বকালকে সমঝে দিয়ে এস—হিন্দুধর্ম শুধু একটা Religion নয়, that’s a way of life-মনের ঘোলা জলে ফেলার নির্মলী বিশেষ। পশুটা তলিয়ে যাবে, দেবতাটি জেগে উঠবে। ঘৃণাটা কুঁকড়ে যাবে, প্রেমটা ফলাও হবে। স্বার্থের চারটে দেওয়াল সরে যাবে, উদার অঙ্গনে সমস্ত মানুষকে সমবেত দেখবে। Go, and teach them this global religion. তুমি পারবে। তুমিই সেই ভবিষ্যমানুষ—যে অতীতে জন্মগ্রহণ করেছিল শাশ্বতকে চির বর্তমান করবে বলে। আমি ভক্তির শুঁড়ে জ্ঞান ধরেছি, তুমি কর্মের পথে ঠেলবে বলে। ওদের কর্মে তুমিই ধর্ম জুড়বে, আমাদের ধর্মে জুড়বে কর্ম। ধর্মে কোন ‘মিরাকল’ নেই। স্বচ্ছ, স্বাভাবিক প্রবাহ। এই বোধটা জাগানোই হলো মিরাকল। তুমি তো জান, সমাধি হলো extension of the self। তুমি আত্মস্বার্থে সমাধিতে বুঁদ হয়ে থাকতে চেয়েছিলে, তুমি চেয়েছিলে নুনের পুতুল হয়ে সমুদ্র মাপতে; আমি চেয়েছিলাম তোমাকে জীবরূপী শিলাখণ্ড করতে—”The Rock of Gibraltar’। যে-সে শিলামুড়ি কি টুকরো পাথর ‘নয়—’The Rock of Gibraltar’। পৃথিবীর অন্যতম বিস্ময়! ভূমধ্যসাগরে অচল অটল—
“Tons of water have beaten against it through the centuries. Storms have lashed at it, armies have assaulted it, civilisations have come and gone, but it just sits there. Nothing ever changes it, and nothing can make it move.” [Linda Goodman]
“ফেনময় গর্জি মহাকায়, ঊর্মি ধায় লঙ্ঘিতে পর্বতচূড়া”–তোমাকে কে টলাবে নরেন্দ্রনাথ! তোমার সর্বস্ব সমর্পণের সাধনায় তুমি—”আগুয়ান, সিন্ধুরোলে গান, অশ্রুজল পান, প্রাণপণ, যাক কায়া।” এই তোমার সমাধি Spirit eternal. “চূর্ণ হোক স্বার্থ সাধ মান, হৃদয় শ্মশান, নাচুক তাহাতে শ্যামা।” তোমার রচনা দিয়েই তোমাকে ব্যক্ত করি নরেন্দ্র-
“নরদেব দেব জয় জয় নরদেব
শক্তিসমুদ্রসমুখতরঙ্গং
দর্শিতপ্রেমবিকৃম্ভিতরঙ্গং
সংশয়রাক্ষসনাশমহাস্ত্রং
যামি গুরুং শরণং ভববৈদ্যম্।”
শিষ্য গুরুকে ছাপিয়ে গেলে গুরুর আনন্দ। পুত্র পিতাকে অতিক্রম করলে পিতার আনন্দ। যদি বল পরাজয়—এ জয়েরও অধিক। এই একটি ক্ষেত্র, যেখানে পরাজয়কেই বলা হয় জয়।
মনে আছে নরেন্দ্র, তোমার বিশ্ববিজয়ের অনেক আগে তোমাকে দক্ষিণেশ্বরে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলুম-”নরেন্দ্র! তুই কি বলিস? সংসারী লোকেরা কত কি বলে! কিন্তু দেখ, হাতি যখন চলে যায়, পেছনে কত জানোয়ার কতরকম চিৎকার করে। কিন্তু হাতি ফিরেও চায় না। তোকে যদি কেউ নিন্দা করে, তুই কি মনে করবি?”
কেন এমন প্রশ্ন করেছিলুম? তখন তো তোর নিন্দা, প্রশংসার কোন কারণ ঘটেনি! আমি অতীত, আমি বর্তমান, আমি ভবিষ্যৎ! আমি যে মহাকালী! আমি যে সেইক্ষণেই দেখেছিলুম—দক্ষিণেশ্বরের নরেন্দ্রনাথ, সিমুলিয়ার নরেন্দ্রনাথ, রামকৃষ্ণের নরেন্দ্রনাথ বিশ্ব-বিবেকানন্দ হবে। তখন তো সে নিস্তার পাবে না— আক্রমণে, আঘাতে জেরবার হবে। জগতে মহতের পূজার উপচার তো নিন্দা! কুৎসা!
তুমি সঙ্গে সঙ্গে বললে : “আমি মনে করব, কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে।”
আমি একটু সংশোধন করে দিয়েছিলুম—”নারে, অত দূর নয়। ঈশ্বর সর্বভূতে আছেন।”
কোন্ ধর্ম তুমি প্রচার করবে নরেন্দ্র! সন্ন্যাসীর ধর্ম, গুহার ধর্ম, পোঁটলা- পুঁটলির ধর্ম, অশিক্ষিত পুরোহিতের লোকঠকানোর ধর্ম, মৌলবাদীদের ধর্ম? না। আর কেনই বা তুমি দেশ ছেড়ে সাগরপারে ছুটবে ধর্মপ্রচারে! কারণ একটাই—ধর্ম মানে জীবনবিমুখতা নয়, আলস্য নয়, উদাসীনতা নয়; ধর্ম হলো সঞ্জীবনী মন্ত্র, ধর্ম হলো অন্তঃসলিল প্রবাহ, যা সব মানুষের ভিতরেই প্রবাহিত— সে এক প্রস্রবণ, সেইটার মুখ খুলে দেওয়ার পদ্ধতিই হলো ধর্ম। খেলাত ঘোষের বাড়িতে আমি এক বৈষ্ণব ভক্তকে যে ব্যাখ্যা করেছিলুম-
“আমার ধর্ম ঠিক, আর অপরের ধর্ম ভুল-এ-মত ভাল না। ঈশ্বর এক বই দুই নাই। তাঁকে ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন লোকে ডাকে। কেউ বলে ‘গড’, কেউ বলে ‘আল্লা’, কেউ বলে ‘কৃষ্ণ’, কেউ বলে ‘শিব’, কেউ বলে ‘ব্ৰহ্ম’। যেমন পুকুরে জল আছে—একঘাটের লোক বলছে ‘জল’, আরেক ঘাটের লোক বলছে ‘ওয়াটার’, আরেক ঘাটের লোক বলছে ‘পানি’–হিন্দু বলছে ‘জল’, খ্রীস্টান বলছে ‘ওয়াটার’, মুসলমান বলছে ‘পানি’–কিন্তু বস্তু এক। মত- পথ। এক-একটি ধর্মের মত এক-একটি পথ। ঈশ্বরের দিকে লয়ে যায়। যেমন নদী নানা দিক থেকে এসে সাগরসঙ্গমে মিলিত হয়।”
যাও নরেন্দ্র, বিশ্বমঞ্চে দাঁড়িয়ে হানাহানির পৃথিবীকে এই ধর্মটি দিয়ে এস; আর শিখে এসে শেখাও—জড়তা ধর্ম নয়, ক্লীবতা ধর্ম নয়, ভীরুতা ধর্ম নয়, আত্মার পরাধীনতা ধর্ম নয়, কূপমণ্ডুকতা ধর্ম নয়, অশিক্ষা ধর্ম নয়, কুসংস্কার ধর্ম নয়, সঙ্কীর্ণ গুরুবাদ ধর্ম নয়। ঝকঝকে, ঝলসিত জ্ঞানতরবারির নাম ধর্ম।
বুকে হাত রেখে দৃপ্তভঙ্গিতে বিশ্বসভার মঞ্চে গিয়ে দাঁড়াও, বল মেঘনাদে—
“I am proud to belong to a religion which has taught the world both tolerance and universal acceptance. We believe not only in universal toleration, but we accept all religions as true.”
বলতে থাক তুমি নরেন্দ্রনাথ—
“As the different streams having their sources in different places all mingle their water in the sea, so, O Lord…”
আমি আছি তোমার পাশে, তোমার বসনপ্রান্তটি ধরে আছি। আমি শুনছি, মনে মনে তুমি বলছ—প্রভু আমাকে শক্তি দাও। আমি সেই সত্যেরও প্রমাণ— “মূকং করোতি বাচালং…”। আরেকটু পরেই আমার নরেন হবে বিশ্ববরেণ্য স্বামী বিবেকানন্দ। এই তোমার সন্ন্যাস। গৈরিক গুহামানব, মোক্ষকামী এক নির্জন সাধক নও। বিশ্বমানবের প্রান্তরে এক গৈরিক ঝটিকা। ধর্ম ও সন্ন্যাসের প্রথাগত সমস্ত আড়ষ্টতা তুমি চুরমার করে দেবে। বিপ্লবের আমি বীজমন্ত্ৰ, তুমি প্রণব। আমি অক্ষর, তুমি পাঠ।
বিখ্যাত বিবেকানন্দ, বীর তুমি, এ কী অবস্থা তোমার! শিকাগোর ধনকুবেরের সুসজ্জিত গৃহের রাজোচিত শয্যা ছেড়ে এই মধ্যরাতে তুমি জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছ কেন?
একি, তুমি কাঁদছ নরেন!
হ্যাঁ কাঁদছি, প্রভু। আমার স্বদেশ যেকালে অবর্ণনীয় দারিদ্র্যে নিপীড়িত, সেকালে মানযশের আকাঙ্ক্ষা কে করে? গরিব ভারতবাসী আমরা এমনই দুঃখময় অবস্থায় পৌঁছেছি যে, লক্ষ লক্ষ মানুষ একমুষ্টি অন্নাভাবে প্রাণত্যাগ করি, আর এদেশের লোকেরা ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে। ভারতের জনতাকে কে ওঠাবে? কে তাদের মুখে অন্ন দেবে? মা দেখিয়ে দাও, আমি কি করে তাদের সেবা করতে পারি?
বুঝলে নরেন্দ্রনাথ, এইটি হলো আসল কথা! মোক্ষ-টোক্ষ কিছুই নয়। বলেছিলুম আমি—”খালি পেটে ধর্ম হয় না।” বৈদ্যনাথধামে মথুরকে বলেছিলুম—আগে এদের মাথায় তেল দাও, একখানা করে কাপড় দিয়ে এদের নগ্নতা ঢাকো। পেটপুরে খাওয়াও, তবে আমি তীর্থে যাব। তুমি যে আমার কণ্ঠস্বর, আমার অশ্রু! লোকে দেখছে তোমাকে–বিবেকানন্দকে। কিন্তু ‘বিবেকানন্দ’ কে? বিবেকানন্দের কণ্ঠে আমারই স্বর। বিবেকানন্দের চোখে আমারই অশ্রু। আমারই আকুতি। নিরুদ্ধ দীর্ঘ এক ক্রন্দনের নাম বিবেকানন্দ। সেই ক্রন্দন তোমার চালিকাশক্তি। এ এক হোমাগ্নি। এর ঘৃত হলো সন্ন্যাসীর হৃদয়দীর্ণ অশ্রুজল।
জুনাগড়ের দেওয়ানকে তুমি লিখেছিলে : “দেওয়ানজী সাহেব, আমি অলস পর্যটক নহি কিংবা দৃশ্য দেখিয়া বেড়ানোও আমার পেশা নহে। যদি বাঁচিয়া থাকেন তবে আমার কার্যকলাপ দেখিতে পাইবেন।”
মনে আছে তোমার সেই দর্শনের কথা? তুমি দেখছিলে সামনে উত্তাল অনন্ত সিন্ধু। আমি সেই জলরাশির ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়েছিলাম পশ্চিমে। তোমাকে ইশারায় ডেকেছিলুম। চারবছর পরে আজ দাঁড়িয়ে আমি কলম্বো বন্দরে। আমার নরেন আসছে। উত্তরের চিকঘেরা বারান্দায় যাকে মিছরি মাখন খাইয়েছিলুম—সেই নরেন আসছে বিশ্ববিজয়ী হয়ে। তখন আমি ছিলুম দেহবদ্ধ এক, আজ আমি দেহমুক্ত বহু। জনতার শতকণ্ঠে আমার জয়ধ্বনি। তুমি নামলে পাম্বানে। আমি সেখানেও দাঁড়িয়ে। যখন তুমি মাদ্রাজে বিস্ফোরণ ঘটালে— তখনো আমি তোমার পিছনে!
তুমি কি নিয়ে এলে নরেন্দ্রনাথ?
ফুটবল!
ফুটবল?
হ্যাঁ প্রভু! ওদের দিয়ে এসেছি হিন্দুর জীবনবেদ, রামকৃষ্ণ-গীতা, আর স্বদেশের জন্য এনেছি ফুটবল। এদেশে বলব—আগে দ্রঢ়িষ্ঠ হও, জীবনের মর্মটা আগে বোঝ আমার স্বদেশবাসী, তারপর হবে ধর্ম। দারিদ্র্য মোচন কর। শিক্ষার আলোকে উদ্ভাসিত হও। নারীর শৃঙ্খল মোচন কর। শ্রদ্ধা দাও, প্ৰেম দাও, শক্তি দাও, সেবা দাও, বিজ্ঞান দাও, প্রযুক্তি দাও। উদ্ভাসিত হও। ধর্ম, অর্থ, মোক্ষ, কাম। দাসের প্রভু দাসই হয়, হেগো গুরুর পেদো শিষ্য হয়। হে যুবকবৃন্দ! নতুন সমাজ গড়ে তোল, গড়ে তোল শৃঙ্খলমুক্ত উদার ভারত। ওদের অভাবে ভাব দিয়ে এসেছি, আমাদের স্বভাবে অভাবের বোধটি এইবার স্পষ্ট করতে হবে।
তাহলে এই হবে তোমার রামকৃষ্ণ মিশন?
হ্যাঁ প্রভু! যবে থেকে আপনি এসেছেন তবে থেকে সত্যযুগের শুরু হয়েছে। আচণ্ডালে প্রেম। আপনার প্রভাব অব্যাহত থাকবে আরো কম করে দেড়হাজার বছর
নেমে এস তুমি। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি। উদ্বেল জনসমুদ্র তোমাকে ফুলে ফুলে ঢেকে দিতে চায়। ভারতীর ভারতীয় এই উচ্ছ্বাস তোমাকে মেনে নিতে হবে। আসমুদ্রহিমাচল ভারতের জনগণের রাজা তুমি, গণহৃদয়সিংহাসনে তুমি মহারাজা!
নরেন! আমি এইবার যাই। উত্তরে। আমার সাধনভূমির অপর পাড়ে পশ্চিম তীরে। গঙ্গার পশ্চিমকুল বারাণসী সমতুল। তোমার খুব ক্ষোভ ছিল, আমার মরদেহের সাধকোচিত সৎকার তুমি করতে পারনি। অনিকেত মানুষের সাধারণ অগ্নিসংস্কারই তো ভাল! সেই স্মৃতিই স্মৃতি, যা আদর্শ হয়ে মানুষের মনে পাকা হয়ে যায়। তবু তুমি পুত্র আমার, বাসনা তোমার। পুঞ্জীভূত শক্তি হয়ে আমি অবস্থান করব তোমার মধ্যে। নিজের আয়ুকে সংক্ষিপ্ত করে তুমি যে-মঠ নির্মাণ করবে সেইটিই হবে আমার অধিষ্ঠান-কেন্দ্ৰ।
“এবার কেন্দ্র ভারতবর্ষ!”