স্বাধীন ভারত এবং তার সমস্যা

স্বাধীন ভারত এবং তার সমস্যা

নব জাগরণ

১৭৫৭ সালে একটি প্রদেশ—বাংলা—দখল করার পর ভারতে ব্রিটিশ আধিপত্য শুরু হয়। অধিকারের সীমা ধাপে ধাপে বিস্তৃত হয়ে ১৮৫৭ সালে মহাবিদ্রোহের ব্যর্থতার পর একেবারে সম্পূর্ণ হয়। ইংরেজ ঐতিহাসিকগণ এই বিদ্রোহকে বলেছেন ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ আর ভারতীয়দের মতে এই বিদ্রোহ হল আমাদের ‘প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম’। প্রথম দিকে খুব সফল হলেও শেষে ভারতীয় নেতাদের কৌশল এবং কূটনীতিতে কয়েকটি ত্রুটির জন্যে বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। অন্য দিকে যুদ্ধ কৌশলে এবং কূটনীতিতে ব্রিটিশদের জ্ঞান ছিল অনেক বেশি। তা সত্ত্বেও ব্রিটিশদের জয় খুব সহজসাধ্য ছিল না। বিদ্রোহ ব্যর্থ হবার পর সারা দেশ জুড়ে সন্ত্রাসের রাজত্ব শুরু হয়। ভারতীয়দের একেবারে নিরস্ত্র করা হয় এবং বর্তমান কাল পর্যন্ত তারা নিরস্ত্রই আছে। এখন তারা বুঝতে পারছে নিরস্ত্রীকরণের কাছে নতি স্বীকার করে তারা সবচেয়ে বড় ভুল করেছে, কারণ নিরস্ত্রীকরণ ভীষণভাবে মানুষকে দুর্বল এবং হীনবীর্য করে দেয়। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের ব্যর্থতার পর ভারতীয়রা কিছুকাল হতাশ হয়ে পড়ে। তারপর ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জন্মের পর রাজনৈতিক চেতনা দেখা দেয় এবং পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের বিদ্রোহ এই চেতনাকে বাড়িয়ে তোলে। বর্তমান শতাব্দী শুরু হলে জাতীয় আন্দোলন দুটি কর্মসূচী গ্রহণ করে—ব্রিটিশ পণ্যদ্রব্য বর্জন এবং গোপনে বিদ্রোহ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২০ সালে গান্ধী ‘আইন অমান্য আন্দোলন’ অর্থাৎ নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ নামে একটি নতুন কর্মপদ্ধতি চালু করলেন। এর লক্ষ্য ছিল সশস্ত্র আন্দোলন ছাড়া বিদেশী শাসনকে উৎখাত করা। এই সমস্ত আন্দোলনের ফলে ভারতে এখন এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে, দেশ থেকে ব্রিটিশদের বিতাড়িত করা ভারতীয়দের পক্ষে সম্ভব।

বর্তমান অবস্থা

এখন ভারতের অবস্থা এমনই যে প্রত্যেকে ব্রিটিশদের ঘৃণা করে থাকে। বর্তমান আন্তর্জাতিক সঙ্কটের সুযোগ নিয়ে বেশির ভাগ মানুষ যখন ব্রিটিশের দাসত্ব একেবারে দূর করতে চাইছে, একাংশের ধারণা এরকম করার মতো শক্তি এখন আমাদের নেই এবং সেজন্যে তারা ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে একটি আপস করতে চায়; উদ্দেশ্য তাদের কাছ থেকে যতটা সম্ভব আদায় করা যায়। নৈতিক বিশ্বাসের দিক থেকে কোনও ভারতীয় ব্রিটিশদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে চায় না। এজন্যে ব্রিটিশ শাসন ভারতীয়দের সদিচ্ছার উপর নির্ভর করে নেই, এ দাঁড়িয়ে আছে ব্রিটিশ বেয়নেটের উপর। অনেক লোক বুঝতে পারে না, অপেক্ষাকৃত অনেক ছোট এক সৈন্যদলের সাহায্যে ভারতের মতো একটি বৃহৎ দেশ কীভাবে ব্রিটিশদের শাসন করছে। এর রহস্য হল, ছোট কিন্তু আধুনিক একটি সৈন্যবাহিনীর পক্ষে বহুসংখ্যক কিন্তু নিরস্ত্র মানুষকে দমিয়ে রাখা সম্ভব। দখলদার এই আধুনিক সৈন্যবাহিনী যতক্ষণ না অন্য এক রাষ্ট্রের সঙ্গে কোনও যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তারা নিছক গায়ের জোরে দেশবাসীর সংগঠিত যে কোনও অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহকে দমন করতে পারে। এখন যেহেতু ব্রিটিশ অন্য দেশের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে এবং তার ফলে তাদের শক্তি বেশ হ্রাস পেয়েছে, এখন ভারতীয়দের পক্ষে বিদ্রোহ করা সম্ভব, যা চিরকালের জন্যে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটাবে। এই সংগ্রামে ভারতীয়দের উচিত অস্ত্রধারণ করা এবং অন্য যেসব শক্তি এখন ব্রিটেনের বিরুদ্ধে লড়ছে তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করা। এই দায়িত্ব গান্ধী পালন করতে পারবেন না। ভারতের দরকার এক নতুন নেতৃত্ব।

ভারত যখন স্বাধীন হবে

একটি প্রশ্ন অনেকেই করে থাকেন, ব্রিটিশরা বাধ্য হয়ে ভারত ছেড়ে গেলে ভারতের কী অবস্থা হবে। ব্রিটিশ প্রচারের ফলে অনেকের মনে এমন ধারণা জন্মেছে যে ব্রিটিশরা না থাকলে ভারতে অরাজকতা এবং বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। অনেকেই কেমন ভুলে যান যে, ব্রিটিশ অধিকার শুরু হয়েছে ১৭৫৭ সালে এবং শেষ হয়েছে ১৮৫৭ সালে, অথচ ভারত এমনই এক দেশ যার ইতিহাস গড়ে উঠেছে হাজার হাজার বছর ধরে। ব্রিটিশদের আসার পূর্বে যদি ভারতে সংস্কৃতি, সভ্যতা, শাসনপদ্ধতি এবং আর্থিক সমৃদ্ধি সম্ভব হয়ে থাকে তাহলে ব্রিটিশ শাসনের পরেও তা সম্ভব হবে। বস্তুত, ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে বিনষ্ট করা হয়, শাসনপদ্ধতি হয় জাতীয় স্বার্থের বিরোধী এবং যে দেশ পূর্বে ছিল ঐশ্বর্যশালী তা এখন পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশে পরিণত হয়েছে।

নতুন শাসন ব্যবস্থা

ভারত থেকে ব্রিটিশদের বিতাড়নের পর আমাদের প্রথম কাজ হবে একটি নতুন সরকার গঠন করা, শান্তি শৃঙ্খলা এবং জননিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। নতুন সরকার গঠনের অর্থ হল শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন এবং এক জাতীয় সৈন্যবাহিনী গঠন। শাসন ব্যবস্থার পুনর্গঠন কাজটি অপেক্ষাকৃত সহজ। পূর্বে ভারতীয়রাই অসামরিক শাসনকাজ চালাতেন, কেবলমাত্র মাথার উপরে ব্রিটিশরা থাকতেন। কিন্তু গত বিশ বছরে উচ্চপদ থেকে আস্তে আস্তে ভারতীয়দের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারে ভাইসরয়ের মন্ত্রিসভায় কয়েকজন ভারতীয় সদস্য আছেন। প্রাদেশিক সরকারে ১৯৩৭ সালের পর থেকে মন্ত্রীরা সকলেই ভারতীয় এবং ইংরেজ কর্মচারীরা তাঁদের অধীনে কাজ করেছেন। উচ্চপদে যেখানে ব্রিটিশদের বদলে ভারতীয়দের নিয়োগ করা হয়, সেক্ষেত্রে তারা যে বেশি দক্ষ তা তারা প্রমাণ করেছেন। ব্রিটিশারদের চেয়ে ভারতীয় মন্ত্রী এবং কর্মচারীরা এ দেশকে ভালভাবে চেনেন এবং দেশের হিতসাধনের বিষয়ে বেশি আগ্রহী। এজন্যে এটা খুবই স্বাভাবিক যে পূর্বে ব্রিটিশরা যা করেছে তার চেয়েও দক্ষতার সঙ্গে তারা কাজ করবে। এককথায় বলা যায়, এখন এত বেশি অভিজ্ঞ এবং দক্ষ ভারতীয় কর্মচারী আছেন যে শাসন ব্যবস্থার পুনর্গঠনের কাজটি আদৌ কঠিন হবে না। স্বাধীন ভারতের নতুন সরকারকে অসামরিক শাসনের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র একটি নতুন নীতি এবং কর্মসূচী নির্ধারিত করতে হবে এবং উচ্চস্তরে নতুন নেতৃত্ব দেবার ব্যবস্থা করতে হবে।

জাতীয় সৈন্যবাহিনী

একটি জাতীয় সৈন্যবাহিনী গঠন করা আরও কঠিন কাজ। ভারতের অবশ্য অনেক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং অভিজ্ঞ সৈন্য আছে এবং বর্তমান যুদ্ধের জন্যে তাদের সংখ্যা বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু তবুও কিছুকাল আগে পর্যন্ত ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর অফিসাররা বেশিরভাগই ছিলেন ব্রিটিশ এবং একেবারে উচ্চপদগুলিতে কেবলমাত্র ব্রিটিশরাই নিযুক্ত ছিলেন। যুদ্ধ চলার জন্যে ব্রিটিশরা বাধ্য হয়ে বহুসংখ্যক ভারতীয় অফিসারদের নিয়োগ করেছেন এবং উচ্চপদগুলিতে কয়েক জন ভারতীয়কে নিয়োগ করা হয়েছে। ট্যাঙ্ক, বিমান, ভারী কামান ইত্যাদি আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার পূর্বে কেবলমাত্র ব্রিটিশারদের জন্যে সংরক্ষিত ছিল, এখন অবস্থার চাপে ভারতীয়দের তা ব্যবহার করতে দেওয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও উচ্চপদে ভারতীয়দের সংখ্যা কম এবং এজন্যে এক জাতীয় সৈন্যবাহিনী গঠন করতে বেশ অসুবিধা হবে। এই অবস্থায় আমাদের প্রথম সমস্যা হবে অল্প সময়ের মধ্যে —ধরা যাক দশ বছরের মধ্যে—সব বিভাগের বহুসংখ্যক অফিসারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং তার ফলে জাতীয় সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলার কাজটি সম্পূর্ণ করা। স্থলবাহিনীর সঙ্গে নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীও গড়ে তুলতে হবে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তা করতে হবে। যদি ভারতে কিছুকাল শান্তি বিরাজ করে এবং বন্ধুভাবাপন্ন দেশগুলির সাহায্য লাভ করা যায় তাহলে জাতীয় রক্ষী বাহিনী গড়ে তোলার কাজটি ভালভাবেই নিষ্পত্তি করা যাবে।

নতুন রাষ্ট্র

ভারতের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের গঠন কী হবে সে বিষয়ে এখনই কিছু স্থির করা ভুল হবে। কেবল এইটুকু বলা যায় যে, কোন নীতি অনুসারে সেই রাষ্ট্র গড়ে উঠবে সেই নীতিই নির্দেশ করা যেতে পারে। অতীতে কয়েকটি সাম্রাজ্য গঠনের অভিজ্ঞতা ভারতের আছে এবং এই অভিজ্ঞতার পটভূমিতে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র গড়ে তুলব। উপরন্তু, আমাদের মনে রাখতে হবে আধুনিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি সম্পর্কে বর্তমান কালের ভারতীয় বুদ্ধিজীবিগণের খুব স্পষ্ট ধারণা আছে এবং তাঁরা এদের সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহী। ভার্সাই-পরবর্তী কালে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব রাজনৈতিক পরীক্ষা চলেছে সেগুলিও আমাদের বিচার করে দেখতে হবে। সবশেষে, ভারতের পরিস্থিতির জন্যে কী প্রয়োজন সেটি বিচার করে দেখতে হবে।

একটি ব্যাপার অবশ্য স্পষ্ট। কেন্দ্রে একটি শক্তিশালী সরকার থাকা দরকার। এরকম সরকার না থাকলে শান্তি এবং জননিরাপত্তা রক্ষা করা যাবে না। এর পিছনে থাকবে একটি সুসংগঠিত এবং শৃঙ্খলাপরায়ণ সর্বভারতীয় দল, প্রধানত যাদের মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐক্য বজায় রাখা চলবে।

রাষ্ট্রকে প্রত্যেক ব্যক্তির ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক আচরণের পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে এবং কোনও রাষ্ট্র-ধর্ম (State-religion) থাকবে না। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিষয়ে দেশের প্রত্যেকেই নিশ্চিতভাবে সমান অধিকার ভোগ করবে। প্রতিটি মানুষ যখন চাকরি, খাদ্য এবং শিক্ষা পাবে এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আচার পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে তখন ভারতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়জনিত কোনও সমস্যা থাকবে না।

নতুন সরকার একবার সুপ্রতিষ্ঠ হলে এবং স্বচ্ছন্দে কাজ শুরু করলে সরকারি ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে এবং প্রাদেশিক সরকারগুলিকে আরও দায়িত্বভার দেওয়া হবে।

জাতীয় ঐক্য

সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্যে সম্ভবত সবকিছু ব্যবস্থা রাষ্ট্রকে গ্রহণ করতে হবে এবং এই উদ্দেশ্যে সমস্ত প্রচার মাধ্যমকে—সংবাদপত্র, রেডিও, সিনেমা, থিয়েটার ইত্যাদি—ব্যবহার করতে হবে। ভারতে এখনও যেসব ব্রিটিশের দালাল গোপনে রয়েছে তাদের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয়তা-বিরোধী এবং ঐক্যনাশক শক্তিগুলিকে কঠোরভাবে দমন করতে হবে। এই উদেশ্যে প্রয়োজনীয় পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলতে হবে এবং আইনকানুন বদল করতে হবে যাতে জাতীয় ঐক্যবিরোধী অপরাধের কঠোর শাস্তি দেওয়া যায়। হিন্দী ভাষা যা ভারতের বেশির ভাগ অঞ্চলের মানুষ বুঝতে পারে, তাকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। অল্প বয়সে ছেলেমেয়েরা যাতে জাতীয় ঐক্যের ভাবটি আত্মগত করতে পারে সেজন্যে স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের প্রকৃত শিক্ষাদানের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

উদ্দেশ্যমূলক ব্রিটিশ প্রচারের ফলে এমন একটি ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, ভারতীয় মুসলমানেরা স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধী। কিন্তু এটা সর্বৈব মিথ্যা। আসল ঘটনা হল, জাতীয় আন্দোলনে মুসলমানদের একটি বড় অংশ যোগ দিয়েছে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বর্তমান সভাপতি আজাদ একজন মুসলমান। ভারতীয় মুসলমানদের বেশির ভাগ ব্রিটিশ-বিরোধী এবং তাঁরা ভারতের স্বাধীনতা চান। এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, মুসলমান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশ-অনুরাগী দলগুলি ধর্মীয় দল হিসাবে গড়ে উঠেছে। কিন্তু তাদিকে দেশের প্রতিনিধিরূপে স্বীকার করা উচিত হবে না।

১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ জাতীয় ঐক্যের এক মহৎ দৃষ্টান্ত। একজন মুসলমান, বাহাদুর শাহ’র নেতৃত্বে এই যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল এবং এতে সব সম্প্রদায়ের মানুষ যোগ দিয়েছিল। তারপর থেকে ভারতীয় মুসলমানেরা দেশের স্বাধীনতার জন্যে কাজ করে আসছেন। অন্যান্য ভারতীয়দের মতোই ভারতীয় মুসলমানেরা এই দেশের সন্তান এবং উভয়ের একই স্বার্থ। ভারতের বর্তমান মুসলিম সমস্যা ব্রিটিশরা কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করেছে, যেমন কৃত্রিম হল আয়ারল্যান্ডের উল্‌স্টার সমস্যা এবং প্যালেস্টাইনের ইহুদি সমস্যা। ব্রিটিশ শাসন অপসারিত হলে এই সমস্যা আর থাকবে না।

সামাজিক সমস্যা

নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার পর দেশের সামাজিক সমস্যাগুলির সমাধানের জন্যে ভারত একাগ্রচিত্তে মনোনিবেশ করতে পারবে। সবচেয়ে বড় সামাজিক সমস্যা হল দারিদ্র্য এবং বেকারত্ব। ব্রিটিশ শাসনে ভারতের দারিদ্রের প্রধান কারণ হল দু’টি—ব্রিটিশ সরকারের দ্বারা পরিকল্পিতভাবে ভারতীয় শিল্পের ধ্বংসসাধন এবং বিজ্ঞানসম্মতভাবে কৃষিকাজ না করা। ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে ভারত নিজের প্রয়োজনীয় খাদ্য ও শিল্পদ্রব্য সবই নিজে উৎপাদন করত এবং উদ্বৃত্ত কোনও কোনও তৈরি জিনিস, যেমন বস্ত্র ইউরোপে রপ্তানী করত। শিল্পবিপ্লব এবং ব্রিটিশের রাজনৈতিক আধিপত্যের জন্যে ভারতের পূর্বেকার শিল্পকাঠামো ধ্বংস হয় এবং নতুন শিল্প গড়তে তাকে অনুমতি দেওয়া হয়নি। ব্রিটেন ইচ্ছে করেই ভারতকে এমন একটি অবস্থায় রাখে যাতে ভারত কেবল ব্রিটিশ কলকারখানার জন্যে কাঁচামাল সরবরাহ করতে পারে। এর ফলে লক্ষ লক্ষ ভারতবাসী যারা পূর্বে শিল্পকর্মে নিযুক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করত তারা কর্মহীন হয়ে পড়ে। বিদেশী শাসনে কৃষকরা আরও দরিদ্র হয় এবং কোনও বিজ্ঞানসম্মত কৃষিব্যবস্থা চালু করা যায়নি। ফলে ভারতের একদা উর্বর জমিতে ফলন খুবই হ্রাস পায় এবং তাতে আর বর্তমান জনসংখ্যার খাদ্য সংস্থান হয় না। বছরে প্রায় সত্তর ভাগ কৃষকের প্রায় ছ’ মাস কোনও কাজ থাকে না। দারিদ্র্য এবং বেকারত্ব সমস্যা দূর করতে হলে ভারতের দরকার সরকারি আর্থিক সাহায্যে শিল্পায়ন ও বিজ্ঞানসম্মত কৃষিব্যবস্থা।

বিদেশী শাসনে ব্রিটিশরা কেবল শাসক ছিলেন না, তাঁরা শ্রমিকদেরও মালিক ছিলেন। এজন্যে শ্রমিকদের খুব দুর্দশার মধ্যে রাখা হয়েছে। শ্রমিকদের জীবিকার উপযোগী বেতন দান, অসুস্থতার জন্যে বীমা, দুর্ঘটনার জন্যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া ইত্যাদি ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে শ্রমিকদের মঙ্গলসাধনের চেষ্টা স্বাধীন ভারত রাষ্ট্রকে করতে হবে। অনুরূপভাবে অতিরিক্ত করভার এবং ভয়াবহ ঋণভার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে কৃষকদের সাহায্য দিতে হবে। এই প্রসঙ্গে ‘Arbeitsdienst’, ‘Winterhilfe’, ‘Kraft durch Freude’ প্রভৃতি শ্রমিক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলির সাহায্য ভারত ভালভাবে নিতে পারে। পরবর্তী উল্লেখযোগ্য সমস্যা হল জনস্বাস্থ্য। ব্রিটিশ শাসনে এই সমস্যাটিরও সমাধান করা হয়নি। ভাগ্যক্রমে এখন ভারতে বহুসংখ্যক যোগ্য ডাক্তার আছেন যাঁরা এমনকি ভারতে বসবাসকারী ইংরেজ ডাক্তারদের চেয়েও বেশি দক্ষ এবং তাঁরা জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি খুব ভালভাবে অবগত আছেন। সরকারি সমর্থন এবং প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য পেলে তাঁরা রোগদূরীকরণের জন্যে এক বড় ধরণের উদ্যোগ নিতে পারেন। এই কাজে ভারতের প্রাচীন চিকিৎসা ব্যবস্থা, আয়ুর্বেদ ও উনানী, আমাদের সাহায্য করতে পারে।

এরপরের সমস্যাটি হল ভয়াবহ নিরক্ষরতা দূরীকরণ। আমাদের দেশের অনেক জায়গায় প্রায় শতকরা নব্বই ভাগ মানুষ নিরক্ষর। রাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য পাওয়া গেলে এই সমস্যাটির মোকাবিলা করা আদৌ কঠিন নয়। আমাদের দেশে এখন অনেক শিক্ষিত নর-নারী আছেন যাঁরা বেকার। স্বাধীন ভারতে সারা দেশে স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে এইসব মানুষকে অবিলম্বে কাজে লাগানো যেতে পারে। এরই পাশাপাশি ভারতের মানুষের প্রয়োজনের কথা মনে রেখে একটি জাতীয় শিক্ষা-ব্যবস্থা স্থির করতে হবে। সৌভাগ্যক্রমে, ইতিমধ্যে কয়েকটি জায়গায় এ বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে। যেমন, শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিদ্যালয়, হরিদ্বারের গুরুকুল শিক্ষায়তন, বানারসের হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লীর জামিয়া মিলিয়া (জাতীয় মুসলিম) বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়ার্ধার কাছে গান্ধীর বিদ্যালয় ইত্যাদিতে। এ ছাড়া ব্রিটিশ শাসনের পূর্ব কাল থেকেই এদেশে কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু আছে যেগুলিও উল্লেখযোগ্য।

ভারতের ভবিষ্যৎ লিপি (script) সম্বন্ধে আমার নিজের মত হল, ভারতে এখন যেসব লিপির ব্যবহার চালু আছে সেগুলি উঠিয়ে না দিয়ে স্বাধীন ভারত রাষ্ট্রের উচিত হবে ল্যাটিন লিপি ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া এবং তা জনপ্রিয় করে তোলা।

আর্থিক ব্যবস্থা

বড় বড় পরিকল্পনা সফল করতে প্রয়োজনীয় অর্থ স্বাধীন ভারত কীভাবে সংগ্রহ করবে সেটি একটি প্রধান সমস্যা। ভারতের সোনা রুপো ব্রিটেন লুট করে নিয়েছে এবং সামান্য যেটুকু আছে তাও, এ দেশ ছেড়ে যাবার আগে তারা নিশ্চয়ই সরিয়ে ফেলবে। স্বভাবতই জাতীয় অর্থনীতির ক্ষেত্রে ভারতকে স্বর্ণমান (Gold Standard) পরিহার করতে হবে এবং এই নীতি গ্রহণ করতে হবে যে, জাতীয় সম্পদ নির্ভর করে শ্রম ও উপাদনের ওপর, সোনার ওপর নয়। বৈদেশিক বাণিজ্য রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীনে আনতে হবে এবং পণ্য বিনিময়নীতির ওপর তা গড়ে তুলতে হবে, যেমন ১৯৩৩ সালের পর জার্মানী করেছে।

প্ল্যানিং কমিটি

জাতীয় পুনর্গঠনের সমস্যা বিষয়ে একথা জেনে সবাই আনন্দিত হবেন যে, ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি যখন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি ছিলাম তখন জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে একটি পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্যে আমি একটি জাতীয় প্ল্যানিং কমিটি (National Planning Committee) গঠন করেছিলাম। এই কমিটি ইতিমধ্যেই অনেক মূল্যবান কাজ করেছে এবং এর প্রতিবেদন আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মসূচী প্রণয়নে খুব সহায়ক হবে।

দেশীয় রাজন্যবর্গ

দেশীয় রাজন্যবর্গ এবং তাঁদের রাজ্যগুলির অবস্থিতি বেমানান এবং এগুলিকে শীঘ্রই লোপ করা দরকার। ভারতের ঐক্যসাধনের পথে বাধা সৃষ্টির জন্যে যদি না ব্রিটিশ তাদের বাঁচিয়ে রাখত তাহলে বহু পূর্বেই এদের অবলুপ্তি ঘটত। বেশির ভাগ দেশীয় রাজা ব্রিটিশ সরকারের সক্রিয় সমর্থক এবং এমন একজনও রাজা নেই যিনি ইতালির Risorgimento আন্দোলনের সময় পিডমন্টের (Piedmont) ভূমিকার অনুরূপ ভূমিকা পালন করতে পারবেন। দেশীয় রাজ্যগুলির মানুষ যারা ভারতের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ তাদের মধ্যে এক গণ-আন্দোলন শুরু হয়েছে। ব্রিটিশ ভারতে কংগ্রেস আন্দোলনের সঙ্গে এই আন্দোলনের নিবিড় সম্পর্ক আছে। ব্রিটিশ শাসকের অবসানের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই দেশীয় রাজন্যবর্গেরও অবলুপ্তি ঘটবে, কারণ নিজেদের প্রজাদের কাছে তাঁরা খুবই অপ্রিয়। দেশীয় রাজারা স্বাধীন ভারতের পক্ষে কোনও অসুবিধার সৃষ্টি করতে পারবে না কারণ নিজেদের কোনও আধুনিক সৈন্যবাহিনী রাখার অনুমতি তাঁদের দেওয়া হয়নি। উল্টে বরং যদি দেশীয় রাজারা স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন তাহলে তাঁদের সঙ্গে একটা মীমাংসায় আসা যাবে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক

অতীত কালে ভারতের অধঃপতনের অন্যতম কারণ হল বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা। ভবিষ্যতে সেজন্যে ভারতের উচিত অন্য দেশের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করা। ভৌগোলিক দিক থেকে পূর্ব ও পাশ্চাত্য দেশের মাঝখানে অবস্থান করার জন্যে ভারত নিজস্ব এক সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করতে পেরেছে। কিন্তু যে Tripartite Powers এখন ভারতের শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, তাদের সঙ্গে ঘনষ্ঠিতম সম্পর্ক স্থাপন করাই হবে ভারতের পক্ষে স্বাভাবিক কাজ।

দেশের দ্রুত শিল্পায়ন এবং নিজস্ব স্থলসৈন্য, নৌ এবং বিমানবাহিনী সংগঠিত করার জন্যে বৈদেশিক সাহায্য ভারতের দরকার হবে। এজন্যে তার প্রয়োজন সব রকমের যন্ত্রপাতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে জ্ঞান ও সরঞ্জাম এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যায় বিশেষজ্ঞ। দেশরক্ষার ব্যবস্থার জন্যে সামরিক বিশেষজ্ঞ এবং সাজসরঞ্জামও তার দরকার হবে। এসব বিষয়ে Tripartite Powers অনেক সাহায্য করতে পারবে। স্বাধীন ভারতে জীবনযাত্রার মান দ্রুত বাড়বে এবং ফলে জিনিসপত্রের ব্যবহারও বাড়বে দ্রুত গতিতে। এভাবে ভারত পণ্যদ্রব্য বিক্রয়ের একটি বিস্তৃত বাজার হয়ে দাঁড়াবে। এই বিষয়টি শিল্পোন্নত সমস্ত দেশের মনে আগ্রহ সৃষ্টি করবে।

এর পরিবর্তে, মানুষের সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভারত কিছু দিতে পারে। ধর্ম ও সংস্কৃতি, ভাস্কর্য, চিত্রকলা, নৃত্য গীত এবং অন্যান্য শিল্পচর্চা ও হস্তশিল্পের ক্ষেত্রে ভারত পৃথিবীকে এমন কিছু উপহার দেবে যার তুলনা নেই। বিদেশী শাসনের বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও যেসব উন্নতি ঘটেছে তা বিচার করে আমার স্থির বিশ্বাস যে, বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং শিল্পের উন্নতির ক্ষেত্রে ভারত অতি শীঘ্র অনেক সাফল্য অর্জন করবে।

নবীন ভারতকে এক সুবৃহৎ দায়িত্ব পালন করতে হবে। সন্দেহ নেই, এজন্যে প্রচণ্ড বাধা বিপত্তি অতিক্রম করতে হবে কিন্তু সংগ্রাম তথা চূড়ান্ত জয়লাভের মধ্যে আনন্দ এবং গৌরবও আছে।

প্রবন্ধটি জার্মান সাময়িক পত্রিকা Willeund Macht, আগস্ট ১৯৪২ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত; বার্লিনের ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টার-এর মুখপত্র ‘আজাদ হিন্দ’-এ পুনর্মুদ্রিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *