স্বাধীনতা
টেলিফোন বেজে উঠল।
বৃষ্টিটা এক নাগাড়ে ঝরছে কি না, ঘরের মধ্যে থেকে বোঝা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে বন্ধ জানালায় বৃষ্টির ছাট লাগছে। শব্দে বোঝা যাচ্ছে বৃষ্টি হচ্ছে। জানালায় শব্দ না হলে মনে হচ্ছে, বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। আসলে থামছে না হয়তো। বাতাসটা মাতালের মতো টাল খাচ্ছে। যখন যেদিকে হাওয়া বইছে, বৃষ্টির ছাট সেদিকেই ঝাপটা মারছে। একেই সম্ভবত ইলশেগুঁড়ি ছাট বলে। নাগাড় বৃষ্টি, বাতাসের ঝাপটা। মুষলধারে না, এ বৃষ্টিকে ঝিরঝিরে বৃষ্টিও বলা যায় না। এলোমেলো ঝোড়ো বাতাস তার সঙ্গে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। মাঝে মাঝে বিজলি হানাহানি। রীতিমতো খারাপ আবহাওয়া। কয়েকদিন ধরেই এই রকম দুর্যোগ চলছে।
টেলিফোনটা বাজছে। অফিস ঘর থেকে শব্দটা আসছে। দূর থেকে শব্দটাকে এক ধরনের মিষ্টি ঝংকারের মতো লাগছে। শীতলের অন্তত সেইরকমই মনে হল। আবার মনে হল, না, মিষ্টি ঝংকারের মতো না, মেয়েলি গলার আদুরে মিউ মিউ শব্দের মতো লাগছে। যত সব বাজে কল্পনা। কোনও মেয়ে আদুরে গলায় ওরকম যান্ত্রিকভাবে মিউ মিউ করে না। আদপে মেয়েরা ওরকম আদুরে গলায় মিউ মিউ করে কি না শীতল তাই জানে না। তথাপি কথাটা মনে হল। টেলিফোনটা এখনও বাজছে। বদরী বোধ হয় কাছেপিঠে নেই। থাকলে এতক্ষণ টেলিফোন ধরত। না-ই ধরুক। বাজুক। এখন অফিসের সময় না। বদরীর নিজের অনেক কাজ আছে। এখন হয়তো সে বাজারে গিয়েছে। অফিসের দরোয়ান বলে সব সময়ে তাকে অফিসের কাজ করতে হবে এমন কোনও কথা নেই। টেলিফোন ধরার তো প্রশ্নই নেই। অফিসের সময় দশটা পাঁচটা। সরকারি অফিস। পাঁচটার পরে অফিস খালি। তারপরে আর এ অফিসে টেলিফোন করার কোনও দরকার হয় না। সবাই জানে অফিসে কেউ থাকে না। এটা সরকারি অফিসের এমন একটা বিভাগও না, জরুরি প্রয়োজনে চব্বিশ ঘণ্টাই যোগাযোগের দরকার হতে পারে।
টেলিফোনটা বেজেই চলেছে। জানালায় আবার বৃষ্টির ঝাপটা এসে লাগল। শারসিতে শন শন বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টির ছাটের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঝোড়ো মাতাল বাতাসটা এবার এদিকে টাল খেয়েছে। বৃষ্টি ধরেনি, নাগাড়ে চলছেই। এ রকম অবস্থায় শীতলের মনে হয় মেঘ ঝড় বৃষ্টি একটা জেদের সঙ্গে লড়ে যাচ্ছে। থামব না, দেখি কে কী করতে পারে, এরকম একটা ভাব।
শীতল পাশ ফিরে শুল। মনে মনে বলল, থামার দরকার নেই। দেখা যাক কতক্ষণ চালিয়ে যেতে পারে। শীতল বিছানার মধ্যে শরীরটাকে আরও জোরে গুঁজে দিতে চাইল। পাশ ফিরে কুঁকড়ে বেঁকে নিজেকে ছোট করে ফেলল। গলার নীচে একবার হাত দিয়ে উত্তাপ দেখল। জ্বরটা কি বাড়ল নাকি।
বোধ হয় না, একরকমই মনে হচ্ছে। আধঘণ্টা আগেই থার্মোমিটারে জ্বর মেপেছে। জিভের নীচে নিরানব্বই। ডাক্তারি পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ওর লিভার খারাপ, দাঁত খারাপ, চোখ সুবিধার না, নাকের ভিতরে কী একটা গোলমাল। পেটটা তো নাকি একটা অসুখের আস্তাকুড় হয়ে আছে। তার ওপরে চামড়া খারাপ। পাঁজরার পাশে দু-তিনটে অদ্ভুত লালচে দাগ দেখা দিয়েছে। ডাক্তারকে সেটা দেখিয়েছে। ডাক্তার প্রথমে দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে সেখানে খুব আলতো করে বুলিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, কোনও স্পর্শ টের পাওয়া যাচ্ছে কি না। শীতল টের পাচ্ছিল। টের পাবে না কেন, ওর বেশ হালকা সুড়সুড়ি লাগছিল। ডাক্তারের তাতেও সন্দেহ ঘোচনি। একটা পায়রার পালক দিয়ে আরও আলতোভাবে বুলিয়েছিল। শীতল সেটাও টের পেয়েছিল। ডাক্তার দেখতে চাইছিল ওখানে কোনও সাড় আছে কি না। অসাড় হয়ে গেলে সন্দেহ করত, শীতলের কুষ্ঠ ধরেছে।
আশ্চর্য, টেলিফোনটা এখন বাজছে। বাজছিলই। জানালায় বৃষ্টি আর বাতাসের ঝাঁপটার জন্য চাপা পড়ে গিয়েছিল। জানালা এখন আবার শান্ত নিঃশব্দ। মাতাল বাতাস অন্যদিকে টাল খেয়েছে। টেলিফোন এখনও বাজছে। যেন জানা আছে, শীতল অফিস সংলগ্ন ফ্ল্যাটের ঘরেই আছে। ওর কানে শব্দটা ঢুকিয়ে টেনে নিয়ে যাবে। কিন্তু শীতল যাবে না। টেলিফোন বাজুক। বাজতে বাজতে টেলিফোনটা ফেটে চৌচির হয়ে যাক, ও বিছানা ছেড়ে উঠবে না। বদরী নিশ্চয়ই বাজারে গিয়েছে কেনাকাটা করতে। এখনও তার গাঁজা নিয়ে বসার সময় হয়নি। অবিশ্যি এই আবাহাওয়ায় এখন বদরী। কোথায় কী করছে, তা ঠিক করে বাল যায় না। এই ফ্ল্যাটে দত্তসুপারভাইজার নিখিল দত্ত সপরিবারে থাকে। সপরিবারে বলতে সে, তার স্ত্রী আর একটি বছর চারেকের মেয়ে। প্রায় ছ বছর এই মফঃস্বল অফিসে আছে। শীতলের থেকে পুরনো লোক। শীতলের আগে যে এরিয়া ম্যানেজার ছিল তার পরিবার অনেক বড় ছিল। এই ফ্ল্যাটে কুলোতো না বলে অন্য একটা বাসা ভাড়া করে থাকত। নিখিল দত্ত তখন একলাই এই ফ্ল্যাটটা ভোগ করত। বিয়ে করে বউ নিয়ে নিখিল দত্ত ফ্ল্যাটেই উঠেছিল। এখানেই বউভাত হয়েছিল। শীতল আসার আগে তার নিশ্চয়ই দুর্ভাবনা হয়েছিল, ফ্ল্যাটটা হয়তো ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু যখন দেখল তার চেয়ে বয়সে ছোট অবিবাহিত শীতল ম্যানেজার হয়ে এসেছে সে নিশ্চিন্ত হয়েছিল। ওপরের দেড়খানা ঘরই শীতলের একার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। নীচের তিনখানা ঘরে নিখিল দত্তর কোনও অসুবিধা হয়নি।
নিখিল দত্তর বউ গিয়ে কি টেলিফোনটা ধরতে পারছে না। কী করছে সে৷ রান্না? মেয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে? রাত মাত্র আটটা। তার মেয়ে তো এখন ঘুমোয় না। নিখিল দত্ত বাড়িতে নেই। থাকলে নিশ্চয়ই গিয়ে ধরত। এরকম আবহাওয়াতে দত্তই বা গেল কোথায়। সেও কি বাজারে গেল নাকি।
শীতলের হঠাৎ মনে হল, কলকাতা থেকে কেউ টেলিফোন করছে না তো? কলকাতার বাড়ি থেকে প্রায়ই ওর টেলিফোন আসে। বিশেষ কোনও সংবাদ না থাকলে অবিশ্যি ডাকাডাকি করে না। শীতল ছাড়া কলকাতার বাড়িতে সবাই আছে। কাজের জন্য ওকে ডাকা হয় না। কোনও সংবাদ থাকলে জানানো হয়। তা ছাড়া প্রতি শনিবারেই ও কলকাতায় যায়, সোমবার সকালের ট্রেনে চলে আসে। এমনিতে যাবার কোনও দরকার হয় না। মার জন্য যেতে হয়। সপ্তাহে একবার না গেলে…ভাবনাটা শেষ হবার আগেই মনে হল মায়ের শরীরটা খারাপ হল না তো? গত সপ্তাহে মায়ের শরীরটা তেমন ভাল ছিল না। বয়সও হয়েছে। কথাটা মনে হতেই শীতল উঠতে গেল। এই মুহূর্তেই টেলিফোনের শব্দটা থেমে গেল।
যাক বাঁচা গেল। শীতল অন্য পাশ ফিরে শরীরটাকে গোল পাকিয়ে প্রায় হাঁটু মুখ এক করে নিল। ফোনটা যে করেছিল, সে হয়তো বিরক্ত হয়ে ছেড়ে দিল। কিংবা বদরী গিয়ে ধরল না তো? অথবা শীলা, নিখিল দত্তর স্ত্রী। নিখিল দত্ত স্ত্রীকে ওই নামে ডাকে বলে শীতল নামটা জানে। কিন্তু এতক্ষণ যখন কেউ ধরেনি, তখন হতাশ আর বিরক্ত হয়ে কেউ টেলিফোনটা ছেড়েই দিয়েছে। শীতলের বাড়ি থেকেই ডাকছিল নাকি? ওর হাত-পা সোজা হল, উপুড় হল। দুহাত দিয়ে বেডকভারটা খামচে ধরল। হয়তো ওরই টেলিফোন এসেছিল। বড়দা বা মেজদা বা সেজদা বা নদা, কেউ হয়তো টেলিফোন করেছিল, কিংবা বউদিরা কেউ। হয়তো মায়ের শরীরটা খারাপ হয়েছে অথবা বউদিদের দিয়ে টেলিফোন করিয়ে মা কিছু বলতে চেয়েছিল। কথাটা মনে হতেই ভাবল, তা হলে ওকে এখন কলকাতায় টেলিফোন করতে হবে। ওকেই টেলিফোন করে জানতে হবে, বাড়ি থেকে টেলিফোন করেছিল কি না। সব থেকে খারাপ, যে কোনও সংবাদই ও চিন্তা করতে পারছে। সে জন্য ও তেমন উদ্বিগ্নবোধ করছে না। অথচ নির্বাকভাবে চুপচাপ শুয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। এরকম ক্ষেত্রে শীতলের মনে হয় যা কিছুই ভাবুক, ও যেন নিজের অধীনে নেই। ধরা যাক যদি মায়ের সম্পর্কে কোনও দুঃসংবাদ জানাবার জন্যই টেলিফোনটা এসে থাকে…।
ঠক ঠক ঠক, ভেজানো দরজায় শব্দ হল। শীতল উঠে বসতে বসতে বলল, হ্যাঁ, কে?
দরজাটা খুলে গেল। শীলা। সিনিয়র সুপারভাইজার নিখিল দত্তর স্ত্রী। কিছু বলবার আগে শীলা শীতলকে একবার দেখে নিল শীতলও একবার নিজেকে দেখল। চটকানো পায়জামা আর জামা সেই তুলনায় এরকম দুর্যোগের দিনেও শীলা যথেষ্ট ফিটফাট। কত বয়স হবে কে জানে। পঁচিশ থেকে তিরিশের মধ্যেই হবে। স্বাস্থ্য ভাল। তবে একটু ভারী হওয়ার দিকে ঝোঁক। বিশেষ করে কোমরের দিকে আর বুকে। তাতে খুব খারাপ দেখায় না। চোখ নাক ঠোঁট মিলিয়ে মুখের ছাঁদটা খারাপ না। চেহারায় একটা চটক আছে। এমন বর্ষার দিনেও কাজল পরেছে, পাউডার মেখেছে। বেশ ঝরঝরে আছে বলেই মনে হচ্ছে। তবে একটা ভঙ্গি শীলার খারাপ। নতুন ব্যায়াম শুরু করা ছেলেদের মতো একবার নিজের বুকের দিকে দেখে নেয়। শীতল এটা প্রায়ই লক্ষ করেছে। শীলা কেন এরকম করে কে জানে। তার বুক তো ভরাট। যাদের নেই তাদের এরকম করার কথা।
শীলা বলল, আপনার টেলিফোন।
শীলা তা হলে টেলিফোনটা ধরেছিল। শীতল ব্যস্ত হয়ে খাট থেকে নেমে এল। জিজ্ঞেস করল, কোথা থেকে? নাম বলল?
শীলা ঠোঁট দুটো টিপে কেমন একটা ভঙ্গি করল যেন। শীতলের দিকে চেয়ে বলল, কলকাতা থেকে। নাম বলল দুদু।
দুদু?
শীলা একটু হাসল। হয়তো বেশিই হাসত। ম্যানেজারের সম্মান বজায় রাখার জন্য বোধ হয় কম হাসল। বলল, হ্যাঁ, সেরকমই তো বললেন যেন। আপনার নাম করে বলতে বললেন, বলুন, বালিগঞ্জ থেকে দুদু বলছি, বিশেষ দরকার।
দুদু কেন টেলিফোন করছে? শীলা একটু অবাক হয়ে বলল, মহিলাকে আপনি চেনেন না?
শীতল বলল, মহিলা? হ্যাঁ, মানে দুদু, আচ্ছা আমি যাচ্ছি।
শীলা বেরিয়ে গেল। শীতলের মনে হল, শীলার ঠোঁটের কোণে একটা হাসি লেগে রয়েছে যেন। কিন্তু দুদু হঠাৎ এ সময়ে এতদিন পরে শীতলকে টেলিফোন করছে কেন। তাও এতক্ষণ ধৈর্য ধরে। ও সিঁড়ি দিয়ে নেমে নীচের ফ্ল্যাটের পাশ দিয়ে একটা ঢাকা বারান্দা পেরিয়ে অফিস ঘরে ঢুকল। টেলিফোনটা ম্যানেজারের ঘরে। কাঠের পার্টিশনে আলাদা চেম্বার। শীলা আলো জ্বালিয়েই রেখেছিল। শীতল গিয়ে রিসিভারটা তুলে নিল, হ্যালো।
ওপার থেকে মেয়ে গলায় প্রশ্ন এল, শীতলবাবু আছেন?
বলছি।
উহ্, বাব্বা বাব্বা! এতক্ষণে স্বর্গ থেকে ভগবানও বোধ হয় চলে আসত। কী করছিলে? ঘুমোচ্ছিলে নাকি?
দুদুর গলাটা স্পষ্টই চেনা যাচ্ছে, শীতল তথাপি সোজাসুজি কিছু বলতে পারল না। বলল, না, ঘুমোইনি, বৃষ্টি আর ঝড়ে কিছু শোনা যাচ্ছে না। আপনি
ওপার থেকে কথা ভেসে এল, আমি দুদু বলছি।
কেন, সেটাই তো শীতল ভেবে পাচ্ছে না। দুদুর চেহারাটা তো স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছে। দুদুও শীলার মতোই একটি বছর চারেকের সন্তানের জননী। তবে শীলার থেকে আর একটু লম্বা, রূপটাও বোধ হয় একটু বেশি। শ্যাম্পু করা চুল, খোলা। দুদুর গরম বেশি, তাই মাথার ওপরে বোধ হয় পাখাটা খোলা আছে। দুদুর চুল উড়ছে।
দুদুর স্বরে উদ্বেগ, চিনতে পারলে না?
শীতল তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আরে হ্যাঁ হ্যাঁ, চিনতে পারছি বই কী। অবাক লাগছে তুমি হঠাৎ এতদিন পরে
কথাটা শেষ করল না। মনে মনে ভাবল, কী কারণে দুদু ওকে টেলিফোন করতে পারে। বর্ষায় হঠাৎ শীতলকে মনে পড়ে গেল নাকি। সেরকম ভাবাবেগ তো দুদুর নেই। যত আবেগ তো শুধু দুদুর নামেই। ওপার থেকে দুদুর উদ্বিগ্ন স্বর শোনা গেল, শোনো শীতল, বিশেষ বিপদে পড়ে তোমাকে বিরক্ত করতে হচ্ছে।
দুদুর বিপদ, শীতলের শরণ, এ তো খুব আশ্চর্যের কথা। কিন্তু বিরক্ত করতে হচ্ছে কেন। জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার?
দুদু ওপার থেকে বলল, অসীমের শরীর খুব খারাপ হয়ে পড়েছে।
অসীম–মানে দুদুর স্বামী। অসীমের শরীর খারাপের সঙ্গে শীতলের বিরক্ত হওয়ার কী সম্পর্ক। ও জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
দুদু বলল, ডাক্তাররা অবিশ্যি বলেছে, তেমন কিছু না। তবে টেম্পারেচারটা খুবই হাই। জান তো, কী রকম অত্যাচারী, একটা কথা শোনে না…
দুদুর গলায় এখন যে সুর বাজছে, তাকে বোধ হয় মমতা ভালবাসা বলে। তার সঙ্গে উদ্বেগ। অত্যাচারী মানে অসীম অতিরিক্ত পানাসক্ত। সে কথাই বোধ হয়, বলতে চাইছে। কিন্তু তাতেও শীতলের কী করবার আছে।
দুদু বলেই চলেছে, এরকম অবস্থায় আমি চুপ করে থাকি কেমন করে বলো। ওদের বাড়িতে একবার জানানো দরকার।
শীতলের মনে পড়ে গেল, অসীমদের বাড়ি এ শহরেই, মাইল তিনেক দূরে। আর কিছু শোনবার নেই, এখন শীতল নিজেই বলে দিতে পারে, দুদু কী বলতে চায়। শীতলকে গিয়ে সেখানে খবর দিতে হবে। দুদুর গলা শোনা যাচ্ছে, তোমার কথা ছাড়া আর কার কথা মনে পড়বে। এও আমার ভাগ্যি, তুমি ওখানে আছ। বুঝলে শীতল–
বলো।
বিরক্ত হচ্ছ?
না না, তুমি বলো না।
কারণ শীতলের সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে, ও কিছুই করবে না। তবে সবই শুনতে হবে, কথাও দিতে হবে। এ অবস্থায় যা যা বলা উচিত, সবই বলবে। দুদু বলছে, ভেবেছিলাম, কাল সকালে তোমাকে টেলিফোন করে বলব। অসীমদের বাড়িতে তো টেলিফোন নেই, তুমি ছাড়া ওখানে আমার আর কেউ জানাশোনাও নেই। কিন্তু কাল সকাল পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করতে পারছি না। আজ রাত্রেই অসীমদের বাড়িতে খবরটা দেওয়া দরকার…।
যেটা একেবারেই অসম্ভব, শীতল মনে মনে ভাবল। দুদুর গলা, আমার শ্বশুর মশায়ের শরীর ভাল না। আমার শাশুড়ি যেন তাঁর এক ছেলেকে নিয়ে আজ রাত্রেই চলে আসেন, এ খবরটা দিতে হবে। তুমি তো দু একবার অসীমদের বাড়িতে গেছ, চেন। কোনওরকম ভাবে যদি একটু সংবাদটা পৌঁছে দেওয়া যায়…!
কোনওরকমভাবেই না। মনে মনে কথাটা বলে দুদুকে বলল, আমি দেখছি।
দুদু তাড়াতাড়ি বলে উঠল, মনের অবস্থা এমন ভোমার কথা জিজ্ঞেসই করলাম না। তুমি ভাল আছ। তো?
শীতল বলল, এই আছি একরকম।
কী হবে নিজের অসুস্থতার কথা বলে। দুদুর কথা শীতলকে আরও অসুস্থ করছে। সে কথা দুদুকে বলা যায় না। দুদু আবার বলল, নিরুপায় হয়ে তোমাকে বললাম খবরটা–
আমি দেখছি।
বিরক্ত হচ্ছ না তো?
আরে না না, এতে আবার বিরক্ত হওয়ার কী আছে।
দুদু টেলিফোন ছেড়ে দেবার আগে, শেষবার বলল, তা হলে আমি নিশ্চিন্ত রইলাম। বলবে ওদের বাড়ি থেকে কেউ যেন নিশ্চয়ই আসে, আজ রাত্রেই। আমি বড় ভয় পাচ্ছি।
শীতল বলল, ঠিক আছে।
দুদু তবু বলল, ছাড়ছি তা হলে। পরে তোমার সঙ্গে কথা বলব।
আচ্ছা।
দুদু বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে যেন রিসিভার নামিয়ে রাখল। শীতল নির্বিকারভাবে রিসিভার নামিয়ে আলো নিভিয়ে ওপরে নিজের ঘরে চলে এল। স্যান্ডেলটা খুলেই বিছানায়। খেয়ে দেয়ে আর কাজ নেই, এই। দুর্যোগের মধ্যে তিন মাইল ঠেঙিয়ে কোথায় সেই কোন গলিখুঁজিতে অসীমের খবর দিতে যেতে হবে। শীতলকে কে দেখে, তার ঠিক নেই, দুদুর স্বামী, অসীমের খবর দিতে যাবে ও। একমাত্র কারণ, এক সময়ে দুদুর সঙ্গে শীতলের খুবই বন্ধুত্ব ছিল। প্রেমও বলা যায় সেটাকে। শীতল অন্তত তাই বিশ্বাস করত। পরিণতি সম্পর্কে সঠিক কিছু আন্দাজ করে উঠতে পারেনি। কারণ দুদুকে বিয়ে করতে চায়, এরকম অনেক ছেলে ছিল। দুদু নিজেও যথেষ্ট সচেতন ছিল।
অসীম এই মফঃস্বল শহর থেকে কলকাতায় পড়তে যেত। তখন থেকে শীতলের সঙ্গে পরিচয়। তারপরে অসীমের সঙ্গে। সব ছেলেদের কাছেই দুদুর একটা বিশেষ আকর্ষণ ছিল। শীতলের ধারণা, অধিকাংশ মেয়েই মনে মনে বেশ ভাব এবং আবেগপ্রবণ। যে কোনও বিষয়েই। বিশেষ করে ছাত্রাবস্থায় কাব্যিক ভাবও অনেকেরই থাকে। দুদুর সে সব ছিল না। ও খুব সহজে স্বচ্ছন্দে ছেলেদের সঙ্গে মিশত। ছেলে বন্ধু ওর অনেক ছিল। ছেলেদের ও বেশ ভাল বুঝত। শীতলের সঙ্গে যে দুদুর প্রেম হয়েছিল এরকম ধারণার অনেক কারণ আছে, অনেক ঘটনা আছে। দুদু একটা কথা প্রায়ই বলত, তুমি এত নিরীহ ভাব কর কেন। এত নিরীহ হলে আমার মতো বউকে নিয়ে তুমি সামলাবে কেমন করে।
গোবেচারা আর নিরীহ এক কথা কি না, কে জানে। তবে শীতল কোনও সময়েই খুব কইয়ে বলিয়ে ছেলে না। দুদু ওকে বুঝেছিল ঠিকই। দুদুকে বিয়ে করার কথা মনে মনে ভাবত। কথাটা সেভাবে ও কখনও মুখ ফুটে বলেনি। যা বলবার দুদুই বলত। একটু হাসি ঠাট্টার ভঙ্গিতে বলত। সেটা দুদুর সব সময়েই ছিল। দুদু মেয়েটাই হাসিখুশি ছিল। দুদুকে শীতল বিয়ে করবে এ কথা ভেবে ওর মনটা ভিতরে ভিতরে টগবগ করত। দুদুর সাহসেরও শেষ ছিল না। শীতলের সঙ্গে এমন ভাব করত, মনে হত বিয়ের আগেই ও সব কিছুতে রাজি। যেমন একদিন…।
থাক গিয়ে কী হবে সে সব দিনের, সে সব ঘটনার কথা ভেবে। দুদু শেষ পর্যন্ত অসীমকেই বেছে নিয়েছিল। শীতল যখন জানতে পেরেছিল, তখন হঠাৎই যেন ওর ভিতরে একটা ঝাঁকুনি লেগেছিল, আর ওর মনটা অন্য একদিকে বাঁক নিয়েছিল। ভাবনা চিন্তাগুলো ভেঙেচুরে কেমন একটা অবসাদের মধ্যে ডুবে গিয়েছিল। ঠিক কষ্ট পেয়েছিল কিনা বুঝতে পারেনি। নিজের বিরুদ্ধে একটা ধিক্কার জেগে উঠেছিল। সেই সঙ্গে একটা ক্ষোভ আর অবিশ্বাস। কোনওটাই আজ অবধি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সেজন্যে দুদুকেই এ যাবৎকাল ধরে দায়ি করে আসছে, তা ঠিক না। দুদুর অসীমকে বিয়ে করা শীতলের জীবনে একটা মোড় ফেরা। তারপরেও শীতল অন্য মেয়ের সঙ্গে মেশবার চেষ্টা করেছে। মিশেছে, বন্ধুত্ব করেছে এবং এমন কী প্রেম পর্যন্ত করেছে, কিন্তু সব সময়েই দুদুর কথা মনে পড়েছে। দুদু পর্যন্ত ঠিক ছিল। দুদুর পরে আর যারা ওর এই ছত্রিশ বছরের জীবনে এসেছে, সবগুলোর পরিণতিই খানিকটা আধখ্যাচড়া, অস্পষ্ট, আবছা। কখনও কখনও তিক্ত অপমানকর।
শীতলের জীবনে অনেক কল্পনা ছিল। ও যত কম কথা বলেছে, ভেবেছে তার চেয়ে বেশি। ভেবে ভেবে, জীবনকে একটা সুখের আকর হিসাবে ধারণা করেছিল, আর সেই আকরের মধ্যে ও খুবই আবেগপ্রবণ আর প্রাণচঞ্চল ছিল। বাইরে থেকে সেটা কখনও বোঝা যেত না। এখনও অবিশ্যি কিছুই বোঝা যায় না। সুখের ধারণা গিয়েছে। দুঃখ বলতে যা বোঝায়, সেটাও ওর বোধের মধ্যে তেমন নেই। এখন ও নিজেকে নানা দিক দিয়ে আক্রান্ত মনে করে। অফিস, বাড়ি, অসুখ, মেয়ে, সব দিক দিয়েই। স্বাস্থ্যবতী সুন্দরী মেয়েদের দেখলে ওর মনে হয়, ও যেন একটা নির্জীব ঘেয়ো কুকুর, আর ওর নাকের ডগা দিয়ে সুপক্ক সুগন্ধ মাংস ঠেকিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
কী হবে এ সব কথা ভেবে। পেটের ডান দিকটা যেন ব্যথা করছে। জিভটা তো সব সময়েই ময়লা লাগে। পাঁজরার কাছে দাগের জন্য ডারমটোলজিস্ট-এর সঙ্গে যোগাযোগ করার উপদেশ আছে। ক্ষতের মতো জায়গাগুলো যখন অসাড় হয়ে যায়নি, তখন আর উপদেশ মানবার দরকার কী। কুষ্ঠ তো হয়নি। চর্মরোগের জন্য চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। কোনও রোগের জন্যই চিন্তা করে কিছু হয় না। কিন্তু পেটের ডান দিকে আর বুকের বাঁ দিকে দুটো জায়গায় ব্যথা করছে। এখন তো কোনও ওষুধ খাবার সময়ও না। জ্বরটা কি বাড়ল?
শীতল হাতের পিঠ দিয়ে গাল গলা ছুঁয়ে দেখল। গরম লাগছে। আবার থার্মোমিটার মুখে গুঁজবে কি না ভাবল। থার্মোমিটারটাও জেদি। এখন সে বাড়বে, তবু কমবে না। না হলে দেখা যাবে পারদের রেখা ঠিক এক জায়গায় ঠেকে আছে। দরকার নেই। জ্বর আছে, রাত্রে কোনও এক সময়ে ছেড়ে যাবে। সকালবেলা অফিসে গিয়ে বসবে। আবার বেলা গড়িয়ে যেতে যেতে, কাজ করতে করতে জ্বরটা আসবে। এ ব্যাপারে এখন মনে হয়, ডাক্তারও ফেড আপ। শীতলও ফেড আপ হতে চায়, কিন্তু…
দুদুর কথাগুলো আবার মনে পড়ে গেল। অসীম অসুস্থ। বোধ হয় দুদু খুব খারাপ একটা কিছু আশঙ্কা করেছে, তাই আজ রাত্রের মধ্যেই খবরটা পৌঁছে দিতে চায়। যেন আজই কেউ, অসীমের মা বা দাদারা কেউ যায়। অসম্ভব। খবর দেওয়া যাবে না।
শীতল পাশ ফিরে গুটিয়ে শুল। যেন খবর দেবার প্রসঙ্গটাকে পিছনে ফেলে রেখে, মনটাকে অন্য দিকে নিয়ে যেতে চাইল, এবং ভাবল বদরীকে অসীমদের বাড়িতে খবর দেবার জন্য কিছুতেই পাঠানো যায় না। এই দুর্যোগে তিন মাইল দূরে গিয়ে বদরীর পক্ষে অসীমদের সেকালের প্রকাণ্ড বাড়িটা খুঁজে বের করাই কঠিন। তারপরে বাইরের থেকে চেঁচিয়ে ডাকাডাকি করেও কারোর দেখা পাওয়া অসম্ভব। অনেকখানি ঢুকে না গেলে, ডাকাডাকি করলেও, বাড়ির কেউ শুনতে পাবে না। বদরীকে পাঠালে, শীতলকে আবার একটা চিঠি লিখে সব জানাতে হবে।
না না না, অসম্ভব। এটুকু স্বাধীনতা শীতলের আছে। দুদুর টেলিফোনে পাওয়া খবর অসীমদের বাড়িতে পৌঁছে না দেবার অধিকার ওর আছে। এখন খুবই খারাপ লাগছে ভেবে, কেন শীতল অসীমদের বাড়ি গিয়েছিল। কখনও না গেলে, চেনবার কোনও সুযোগ থাকত না। অতএব যাবারও। কোনও প্রশ্ন থাকত না। দুদুই এই গোলমালটা পাকিয়ে রেখেছে। দুদু শ্বশুরবাড়িতে আসবার আগেই জেনে এসেছিল, শীতল এখানকার ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হয়ে এসেছে। এসে দেখা করেছিল, জোর করেই অসীমদের বাড়িতে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। একদিন না, দু-তিন দিন। একদিন রাত্রে খেতেও হয়েছিল। তাও অনেক কাল হল, প্রায় দু বছর আগে। শীতল প্রথম যখন এখানে বদলি হয়ে এসেছিল।
কিন্তু তার মানে এই না, শীতলকে এখন যেতে হবে। দুদুর সঙ্গে সেই সব দিনের কথা মনে করেও না, যে সব দিনের কথা মনে করলে দুদুর গোটা শরীরটা ও দেখতে পায়। শীতল উপুড় হয়ে বিছানার মধ্যে নিজেকে আরও ঠেসে ধরল। যেন তা না হলে, কেউ ওকে জোর করে টেনে তুলবে। বদরী যদি বাজারে গিয়ে থাকে, এখন ফিরে এসে রান্না করবে। তা ছাড়া বদরীকে পাঠাবার কোনও কথাই আসে না, কারণ বদরীর পক্ষে অসীমদের বাড়ি খুঁজে বের করে, ডাকাডাকি করে সংবাদ দেওয়া সম্ভব না। দুদুর শীতলকে মনে পড়ে গেল, আর টেলিফোন করে উদ্বেগের সঙ্গে অনুরোধ করল, তাতেই শীতলের অধিকার শেষ হয়ে যায় না। তাতেই শীতল এখন এই দুর্যোগে, মফস্বল শহরের জঘন্য রাস্তা ধরে তিন মাইল ঠেঙিয়ে যাবে না। দুদু এটা আশা করে কী হবে। আর দুদু আশা করলেই বা কী যায় আসে। দুদু অনেক কিছুই আশা করতে পারে, তেমনি না যাবার স্বাধীনতা শীতলের নিজস্ব। ও যাবে না।
শীতল একটা পাক খেয়ে, আবার অন্য দিকে ফিরল। ব্যথা করছে, ঠিক পেটের ডান দিকে, যেখানে লিভার আছে, আর বুকে, বাঁ দিকের উঁচুতে। নিশ্বাস আরও গরম লাগছে। জ্বরটা নিশ্চয়ই বেড়েছে। এ অবস্থায় শীতলের কোথাও যাবার তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না। দুদু যে অসীমকে বিয়ে করেছিল, তার জন্য একদিনও শীতলের কাছে দুঃখ বা অন্যায় স্বীকার করেনি। বরং আলাদা চিঠিতে নিমন্ত্রণ জানিয়ে লিখেছিল, শীতল, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে তুমি ঘনিষ্ঠতম। বিয়েতে তুমি না এলে ভীষণ কষ্ট পাব। ইত্যাদি…। ঠিক দুদুর কথার মতোই, চিঠিটা সহজ সরল আর সচ্ছল। শীতল গিয়েছিল দুদুর বিয়েতে। দুদু কনের বেশে সকলের সামনে শীতলের হাত ধরে একটা খালি ঘরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, আমাকে কেমন দেখাচ্ছে বলো তো? শীতলের স্পষ্ট মনে আছে ওর গায়ে তখন জ্বর, আর নিজেকে কেমন বিভ্রান্ত মনে হচ্ছিল। ও দুদুকে বুঝতে পারছিল না। বলেছিল, ভাল। দুদু হেসে শীতলের গালে টোকা মেরে বলেছিল, সেই নিরীহ ভাব। তোমার দ্বারা কিছু হবে না। আমাকে যখন পিড়িতে করে ছাদনাতলায় ঘোরানো হবে, তখন তুমি পিড়ি ধরো, আমি তোমার কাঁধে হাত দিয়ে ব্যালান্স রাখব, কেমন? শুভদৃষ্টির সময়েও আমি তোমার কাঁধে হাত রাখব।…আরও অনেক কথা বলেছিল, শীতলের সব মনে নেই। শীতল দুদুকে কিছুই বুঝতে পারছিল না।
কিন্তু এ সব কথা এখন ভাববার কোনও কারণ নেই। দুদুর টেলিফোনের কাতর অনুরোধের সঙ্গে এর কোনও যোগ নেই। মনে পড়ল মাত্র। এ সব কথা মনে পড়ছে বলে যে শীতল খবর দিতে যাবে না, তা নয়। আবহাওয়া খারাপ। শীতলের শরীরে অসুখ, ও যাবে না, যেতে ইচ্ছে করছে না। এই ইচ্ছার স্বাধীনতা ওর আছে। দুদুর কথায় যদিও এরকম একটা আশঙ্কা যেন ফুটেছিল, অসীম মারা যেতে পারে। তা আর কী করা যাবে। শীতলও মারা যেতে পারে। শীতল অন্য পাশে ফিরল, মনে হল বুকের মধ্যে। বেশ জোরে ধকধক করে বাজছে। নিশ্বাস নিতে যেন কষ্ট হচ্ছে। মনে হল এভাবে পাশ ফিরে বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না। শীতল উঠে বসল, কাশল খুক খুক করে, জোরে জোরে নিশ্বাস নিল। শরীরটা আরও খারাপ লাগছে। আবহাওয়া ভাল থাকলে, লিভক অ্যান্ড হাচিনশের ক্লাবে যাওয়া যেত। একটু তাস খেলা যেত। সেখানে কয়েকজন ওর চেনাশোনা আছে। মনে পড়ল, বেশি অস্থির লাগলে, একটা বড়ির আধখানা ভেঙে খেতে দিয়েছে ডাক্তার।
শীতল উঠে ঘরের কোণে টেবিলের কাছে গিয়ে, সেই ট্যাবলেট খুঁজে বের করল। আধখানা ভেঙে জল দিয়ে খেল। থার্মোমিটারটা মুখের মধ্যে জিভের তলায় গুঁজে দিয়ে চেয়ারে বসল। নিখিল দত্তকে অবিশ্যি অসীমদের বাড়িতে পাঠানো যায়। কিন্তু সেটা ভাল দেখায় না। শীতলের আন্ডারে সিনিয়র সুপারভাইজারের কাজ করে বলে তাকে দিয়ে কোনও ব্যক্তিগত কাজ করানো যায় না। করানো যায়, অনেক কাজই করানো যায়, তা হলে নিখিল দত্তর ঘুষ খাওয়ার মাত্রা বাড়তে দিতে হবে, আর ক্রমেই সেটা প্রকাশ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। শীতল তা হতে দিতে পারে না। কারণ এ কথা কেউ বিশ্বাস করবে না, তার সাবরডিনেটসরা ঘুষ খাচ্ছে, তাকে বাদ দিয়ে। ঘুষের ব্যাপার নিয়ে অনেক কাণ্ড অতীতে হয়ে গিয়েছে। শীতলের আগে যে ভদ্রলোক এখানকার ম্যানেজার ছিল, তার চাকরি যায় ঘুষের জন্য। এ অফিসে ঘুষ খাওয়া যেমন সহজ, তেমনি ধরা পড়ার ভয় প্রতি পদে পদে। অথচ কেউ ধরা পড়লে, ম্যানেজারের ওপর দায়টা সব থেকে আগে আসে। শীতলকে এই জন্য সব সময়ে সাবধান থাকতে হয়। চাকরির ব্যাপারে এটা একটা কনটিয়াস লড়াই।
থার্মোমিটার নামিয়ে আলোর দিকে তুলে ধরে দেখল, আগের মতোই জ্বরটা এক জায়গায় ঠেকে আছে। অথচ শরীরটা খারাপ লাগছে বেশি। এ অবস্থায় অসীমের বাড়িতে খবর দিতে যাবার কোনও কথাই থাকতে পারে না। থার্মোমিটার রেখে, খাটের দিকে যেতে গিয়ে, দরজার দিকে তাকাল। এগিয়ে গিয়ে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিল। তারপর শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়ে, পা দুটো খাটের বাইরে রেখে দোলাতে লাগল। নিতান্তই যদি খবর দিতে হয়, কাল সকালে দেখা যাবে। দুদু অবিশ্যি বলেছে, আজ রাত্রেই যেন কেউ কলকাতায় গিয়ে পৌঁছোয়। রাত্রি দশটা সাড়ে দশটা পর্যন্ত কলকাতা যাবার গাড়ি আছে। সোয়া ঘন্টার জার্নি। দুদু কি খুব খারাপ কিছু সন্দেহ করেছে যে অসীম নাও বাঁচতে পারে। তা না হলে দুদুর মতো মেয়ে ওরকম করুণভাবে, উদ্বেগে…। শীতলের রাগ হতে লাগল। দুদুর ওপরে। রাগ হতে লাগল। দুদু কেন ওকে ডাকতে গেল। সোহাগ! শীতল এখানে আছে বলে, ওর অফিসে টেলিফোন আছে বলে, ওকে জানাতে হবে। শীতল যদি এখন ঘরে না থাকত, ক্লাবে চলে যেত? আগে খেয়াল থাকলে শীলাকে ও বলে দিত, বলে দিন ঘরে নেই। কিন্তু তখন বুঝতেই পারেনি দুদু কী বলতে পারে। যদিও বোঝা উচিত ছিল, এরকম দুর্যোগের রাত্রে সোহাগ জানাবার জন্য কেউ টেলিফোন করছে না। শীলার ভাবভঙ্গিও এমন ছিল, যেন উদ্বেগে উৎকণ্ঠায় কেউ কিছু বলেনি, নিতান্তই একটা হালকা ব্যাপার। তা না হলে শীলার ঠোঁটের কোণে টেপা টেপা হাসি ছিল কেন। যেন শীতলকে ওর কোনও প্রেমিকা টেলিফোন করেছে। শীলা দুদুর নাম বলার সময়ে শীতলের চোখের দিকে দেখেছিল, যদিও গলার স্বরে সম্ভ্রমের সুর ছিল। অবিশ্যি একজন অচেনা মেয়ের গলা শুনে দুদু হয়তো উদ্বেগ প্রকাশ করেনি। এমনকী, অন্যরকম কিছু সন্দেহ করে, শীতল যে তার নিকট সেটা বোঝাবার মতো করেই কিছু বলেছিল।
শীলা যে কী রকম মেয়ে সেটা একেবারে অজানা নেই। ওই যে ছেলেটা আসে, নিখিল দত্তর কী রকম ভাই হয়, কোথায় একটা চটকলে কাজ করে, নাম হীরেন। তার সঙ্গে যা ব্যাপারটা করে, মনে হয়। নীচে একটা ছোটাছুটি লুকোচুরি টানাটানি খেলা চলেছে। নিখিল বাড়ি না থাকলে বাড়াবাড়ি হয়। থাকলে তেমনি কিছু না। ওরকম খুকির মতো খেলা করার কী আছে। ঠাকুরপো ছেড়ে দাও। ঠাকুরপো ভাল হবে না বলছি, তোমার দাদা এলে বলে দেব, আমাকে কী করছ।এ রকম কথা প্রায়ই শোনা যায়। কী করে হীরেন? জড়িয়ে জাপটে ধরে চুমো খেতে যায় নাকি? নাকি আরও কিছু। কিন্তু তাতে চেঁচাবার কী আছে। শীলার কি মনে থাকে না শীতল ওপরের ঘরে আছে, সবই শুনতে পাচ্ছে। শীতল একদিন গম্ভীর হয়ে নিখিলকে বলেছিল, ও ছেলেটা কে আসে আপনার বাড়িতে হীরেন না কী নাম। ও এত চেঁচামেচি করে কেন? তারপর থেকে হাঁকডাক একটু কম।
শীতল যখন প্রথম এসেছিল শীলা তখন খুবই আলাপ জমাবার চেষ্টা করেছে। যখন তখন ওপরে আসা, নানা রকম খাবার নিয়ে দিয়ে যাওয়া। শীলার প্রস্তাব ছিল, শীতল ওদের কাছেই খাবে। শীতলের পক্ষে সেটা সম্ভব ছিল না। এখানকারই একটা হোটেলের সঙ্গে ব্যবস্থা আছে। যতটা সম্ভব মশলা কম খাবার। টিফিন ক্যারিয়ারে করে পৌঁছে দিয়ে যাবে। এই দেড়খানা ঘরের মধ্যে একটা চাকর, রান্নাবান্না করবে, ঘর গৃহস্থালি দেখবে, এ সব একেবারেই সহ্য হয় না। হোটেলের খাবার এলেও, শীলার খাবার দেবার কামাই ছিল না। তারপরে শীতল এমন ঠাণ্ডা আর বিরূপ ব্যবহার আরম্ভ করেছিল, শীলা নিজে থেকেই গুটিয়ে গিয়েছিল। শীলা কি রকমের একটা সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছিল, শীতল তা জানে। তার পিছনে যে নিখিল দত্তর প্ররোচনা ছিল, তাও স্পষ্ট ছিল। অফিসের দিক থেকে সে রকম ঘটতে দিতে পারে না শুধু নয়, কোনও দিক থেকেই ও ধরনের কিছু ভাল লাগে না।
শীলার প্রথম দিকের বাড়াবাড়িটাই সন্তোষজনক ছিল। শীতলকে ঠাকুরপো বলে ডাকবে, বা সে ওর বউদির মতো নানা রকমের কথা বলত। সব ব্যাপারগুলো নিখিল দত্তর সঙ্গে পরামর্শ করে করত কি না, শীতল জানে না। তবে একটা পরিকল্পনা ছিল সন্দেহ নেই। শীলা শীতলের কাঁধে হাত রেখে ওর জুলপির পাকা চুলেও টান দিয়েছে। হাত ধরে জানতে চেয়েছে, শীতলের হাত এরকম ঠাণ্ডা আর ভেজা ভেজা কেন। প্রথম দিকে শীতলের একটা ঘোরের ভাব ছিল। কাটিয়ে উঠতে বেশি সময় লাগেনি। দুদু কীভাবে কী বলেছিল, কে জানে। শীলা হয়তো ভেবেছে, শীতলের প্রেমিকা দুদু নামে কোনও মেয়ে টেলিফোন করেছিল।
বৃষ্টির ছাট লাগছে আবার জানালায়। বদরীকে পাঠানো সম্ভব না, নিখিল দত্তকেও না। শীতলের নিজের তো কোনও প্রশ্নই নেই। কিন্তু রাগে শীতলের যেন দাঁতে দাঁত চেপে বসতে লাগল। দুদু উৎকণ্ঠায় আর ভয়ে বলল, আর তাই শুনেই ছুটবে, এমন কোনও কথা নেই। নিজের একটা স্বাধীনতা বলে কথা আছে, নিজের ইচ্ছার স্বাধীনতা। বাড়ির লোকেরা গেলেই কি অসীমকে বাঁচাতে পারবে। যদি অসীমের মরণাপন্ন অবস্থাই হয়। শীতল হঠাৎ যেন আর্তস্বরে বলে উঠল, উহ, অসহ্য!
বিছানা ছেড়ে উঠে ও পায়জামার দড়িটা এক টানে খুলে ফেলল। আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে একটা ল্যাংটা পাগলের মতো মনে হল। সেই অবস্থায় টেবিলের কাছে গেল। ঘড়ির দিকে দেখে, ওয়ারডোবের কাছে এসে পাল্লা খুলল। প্যান্ট পরল, জামা গায়ে দিল। হাতে ঘড়ি বাঁধল। জুতো মোজা পরল। গায়ে হাত দিয়ে দেখল, গরম একই রকম। বলে উঠল, ইতর, নোংরা, শয়তানি।
হ্যাঙার স্ট্যান্ড থেকে রেন-কোটটা নামিয়ে নিল। মাথায় টুপিটা চেপে বসাল। ড্রয়ার থেকে পার্স নিয়ে পকেটে রাখল। আলোর সুইচটা অফ করতে গিয়ে করল না। ঘরে আলো জ্বলুক। টেবিলের ওপর থেকে তালা চাবি নিয়ে ছিটকিনি খুলে বাইরে গেল। কড়ার সঙ্গে তালা লাগিয়ে সিঁড়িতে শব্দ করে নামল। শীলাকে একবার আসতে হবে। ফ্ল্যাটের বাইরে যাওয়া আসার দরজাটা বন্ধ করতে হবে। কিন্তু এত জোরে শব্দ করে নামলেও শীলা এল না। শীতলের মুখটা এখন যন্ত্রণাকাতর অসহায় দেখাচ্ছে। সেই সঙ্গে একটা অস্থির ভাব। শীতল নীচের ফ্ল্যাটের খোলা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ডাকল, মিস্টার দত্ত।
একবারের বেশি দুবার ডাকতে হল না। শীলা এগিয়ে এল। আগে লক্ষ পড়েনি, এখন দেখল, শীলা দু দিকে দুটো বেণী দুলিয়েছে। খুকি সাজবার চেষ্টা। শীলা কী করছিল? শুয়েছিল নাকি। বুকের একদিকে কাপড় নেই। জামার গলা এত বড় করে কাটা, সোনার হার ছাড়িয়ে, বুকের অর্ধেকটা প্রায় দেখা যাচ্ছে যেন। শীলার কাজল টানা চোখে কৌতূহল। দুদুর টেলিফোন, তারপরে শীতলকে এরকম তৈরি হয়ে বেরোতে দেখে, বোধ হয় অবাক হয়ে কিছু ভাবছে। শীতল পিছন ফিরে যেতে যেতে বলল, দরজাটা বন্ধ করে দিতে হবে, আমি বেরোচ্ছি।
ফ্ল্যাটের যাওয়া আসার দরজা আর অফিসে যাবার দরজা দুদিকে। বদরী অফিসের দরজা আগলায়। ফ্ল্যাটের দরজা নিজেদেরই ভোলা বন্ধ করতে হয়। শীতল শীলার গলা শুনতে পেল, আপনি কি বেরিয়ে যাচ্ছেন?
শীলার গলায় যেন উদ্বেগের সুর। শীতল বলল, হ্যাঁ।
শীলা শীতলের পিছন পিছন এল। এবার স্পষ্ট উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করল, কখন ফিরবেন?
শীতল বলল, কেন বলুন তো?
শীতল ফিরে তাকাল। শুধু গলায় না, শীলার চোখে মুখেও উদ্বেগের ছায়া। সব মিলিয়ে শীলাকে এখন খানিকটা ভয় পাওয়া অল্পবয়সি মেয়ের মতো মনে হচ্ছে। বলল, উনি আজ কলকাতায় গেছেন। ওঁর বোনের খুব অসুখ, নাও ফিরতে পারেন। আমি একলা রয়েছি। উনি বলছিলেন, মিঃ মুখার্জি আছেন, তোমার ভয়ের কিছু নেই।
নিখিল দও সে কথা শীতলকে বলে যায়নি। অনেক সময় অনেক কথা যেমন বলে, তেমনি বলে যেতে পারত, স্যার কলকাতায় যাচ্ছি, আজ রাতে হয়তো নাও ফিরতে পারি। কোনও কথাই বলে যায়নি। শীলার কথার কোনও জবাব না দিয়ে ঢাকা বারান্দা দিয়ে এগিয়ে গিয়ে শীতল বাইরের দরজার ছিটকিনি খুলল। শীলার গলা আবার শোনা গেল, আপনি কি কলকাতায় যাচ্ছেন?
কলকাতা? শীতলের ভুরু কুঁচকে উঠল। কলকাতায় যাবে কেন শীতল। পরমুহূর্তেই মনে পড়ল, শীলার দুদুর টেলিফোনের কথা ভাবছে। দুদু কলকাতা থেকে টেলিফোন করেছিল। শীতল বলল, না, আমি কলকাতায় যাচ্ছি না।
শীতল দরজাটা খুলতে গিয়েও থামল, বলল, আমাকে একবার বেরোতে হচ্ছে। আমার খাবারটা নিয়ে আসবে।
শীলা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আমি নিয়ে রেখে দেব।
শীতল দরজাটা খুলতেই বাতাস আর বৃষ্টির ঝাঁপটা এসে গায়ে লাগল। ও তাড়াতাড়ি টুপিটা কপালের সামনে নামিয়ে দিয়ে কোমরের বেল্ট বাঁধল। রাস্তার ওপরে গিয়ে দাঁড়াল। শীতলের দাঁতে দাঁত চেপে বসল, অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠল, বিচ।
জিবে রক্তের স্বাদ লাগতে থুথু করে ফেলল।
নিঝুম ঝড়ো বৃষ্টির প্রলয় ক্ষেত্র রাস্তাটার ওপরে এসে যন্ত্রণাকাতর অসহায়তার বদলে শীতলের ভিতরে যেন একটা রাগের ঝড় বইতে লাগল। তার সঙ্গে যন্ত্রণাটাও আছে। যন্ত্রণার চেয়ে জ্বালা বলা যায়। হাত দুটো ভিজে যেতে তাড়াতাড়ি যেন কোটের পকেটে ঢোকাল। তবু মনে হচ্ছে গাটা যেন জলে ভিজে যাচ্ছে। চামড়ার জুতো মোজা পরা পা শুকনো রাখতে পারবে না। একটা রিকশা দরকার। খানিকটা হেঁটে গেলে সাইকেল রিকশার আজ্ঞা পাওয়া যাবে। কিন্তু রিকশাওয়ালারাও মানুষ। এ দুর্যোগে কেউ রিকশা চালাবে না বলেই মনে হয়। বলে কয়ে বেশি টাকার বিনিময়ে যদি রাজি করানো যায়। কী কুক্ষণে যে এই শহরে শীতলের পোস্টিং হয়েছিল। কথাটা এর আগে কোনওদিন মনে হয়নি। আজ ওই মুহূর্তে মনে হচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে কয়েকবারই থুথু ফেলল। অসীম মরে গেলেই বা শীতলের কী। অসীম, দুদু বা পৃথিবীতে আরও অনেকে, কারোর বাঁচা মরার জন্যই কি শীতলের কিছু যায় আসে৷ শীতল মরে গেলে কি দুদুর কিছু যায় আসে। এর পরে নিশ্চয় জ্বরটা বাড়বে। রেন কোটের নীচে প্যান্ট আর মোজা ভিজতে আরম্ভ করেছে। একটা কুকুরও রাস্তায় নেই। দুদু বলল বলেই কেন যাচ্ছে শীতল। ওর কি স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। অথচ শীতল কার বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। কিন্তু একটা ফুঁসে ওঠা রাগে যেন ও ভিতরে ভিতরে ফুলছে। মনে হচ্ছে, এত রাগে ওর চোখে জল এসে পড়বে।
কয়েকটা ঘিঞ্জি চালা ঘরের সামনে গোটা কয়েক রিকশা গায়ে জড়াজড়ি করে আছে। একটা ঘরে টিমটিমে আলো ছাড়াও উনুনের আগুন দেখা গেল যেন। ছায়া মূর্তির মতো দু একটা মানুষের অবয়বও। শীতল এগিয়ে গেল, জিজ্ঞেস করল, ভাড়া যাবে?
একটু পরে শোনা গেল, কোথায় যাবেন?
শীতল জায়গাটার নাম বলল। খানিকক্ষণ কোনও জবাবই পাওয়া গেল না। বেশ খানিকক্ষণ পরে একজন দরজায় দাঁড়াল। শীতলকে ভাগিয়ে দেবার জন্যই যেন সে বলল, পাঁচ টাকা লাগবে।
এক টাকা পাঁচসিকের জায়গায় পাঁচ টাকা চাইছে। না চাওয়াটাই আশ্চর্যের। তবু যাতে লোকটা পাঁচ টাকাতেই থাকে সেইজন্যই বলল, খুব বেশি বলছ।
রিকশাওয়ালা বলল, যেতামই না। দেখলাম আপনি বটতলা অফিসের ম্যানেজারবাবু, তাই বলছি। এই হাওয়ায় গাড়ি টানাই মুশকিল।
অফিসটাকে এরা বটতলার অফিস বলে। সামনে একটা বড় বট গাছও আছে। শীতল ইচ্ছা করেই খানিকটা অনিচ্ছার সুরে বলল, চলো।
জোয়ান একটা ছেলে, মাথায় টোকা বেঁধে খালি গায়ে একটা হাফ প্যান্ট পরে বেরিয়ে এল কোমরে একটা গামছা বাঁধা। ন্যাকড়া দিয়ে রিকশাটার ভিতরে মুছল। যদিও তাতে কিছুই আসে যায় না। এ বৃষ্টিতে রিকশার ভিতরে শুকনো রাখা যায় না। সিটটা ঘরের ভিতর থেকে এনে পেতে দিল। সামনে একটা পাতলা প্লাসটিকের পর্দা ঝুলিয়ে দিয়ে ডাকল, বসুন।
শীতল রেনকোটটা না খুলেই রিকশার মধ্যে জবুথবু হয়ে বসল। বলল, আমি কিন্তু আবার ফিরে আসব।
রিকশাওয়ালা বলল, সে যা হয় দেবেন। আমাকে তো ফিরে আসতেই হবে।
রিকশার ভিতরে যেন একটা আশ্রয় পাওয়া গেল। বাইরে এলোমেলো বাতাস, বৃষ্টির ঝাঁপটা, পর্দাটা উড়ে যেতে চাইছে। তবু মনে হচ্ছে একটা কিছুর মধ্যে আশ্রয় পাওয়া গিয়েছে। বাইরের খোলা বাতাসের থেকে একটু নিশ্চিন্ত। অসীম মরবে তাতে শীতলের কী। দুদু কি সারা জীবনটাই নিজের ইচ্ছাকে এভাবে কাজে লাগিয়ে যাবে। জঘন্য। এটা একটা ইতরতা, নোংরামি। কিন্তু সেই নিয়ামকটি কে, যে শীতলকে তার ইচ্ছা মতো চলতে দেয় না। কোনও কিছুতেই কি মানুষের স্বাধীনতা বলে কিছু থাকবে না। অফিস বাড়ি অসুখ মেয়েরা, এ সব তো আছেই, তার ওপরে এই কদর্য আক্রমণ সহ্য হয় না। এরকম অবস্থায় সব মানুষই নিজেকে আক্রান্ত ভাবে। শীতলও নিজেকে ভাবছে এবং এই আক্রমণের কাছে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত।
শীতল আহত আর পরাজিত একটা পশুর মতো রিকশার মধ্যে অন্ধ আক্রোশে যেন ফুলতে লাগল। রিকশাটা বেশ জোরে চেলেছে। ফাঁকা রাস্তা। শীতল টাল সামলাতে পারছে না। তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কোথা দিয়ে কীভাবে যাচ্ছে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। পর্দার ভিতরে সামনে জল আসছে। শীত করছে, দাঁতে দাঁত লেগে যাবার মতো।
.
অসীমদের বাড়ির কাছে এসে রিকশা থামল। পোড়ো বাড়ির মতো নিঝুম, সেকালের দেউড়ি পেরিয়ে ঠাকুর দালানওয়ালা বাড়ি। শীতল ভিতরে ঢুকল। দোতলায় আলো দেখা যাচ্ছে। ও গলা তুলে ডাকল, বাড়িতে কেউ আছেন? শুনছেন, বাড়িতে কেউ আছেন?
মনে মনে বলল, সবাই মরে গেলেও আমার কিছু যায় আসে না। কিন্তু ওপরের দরজা খুলল, আলো দেখা দিল, জীবিত মানুষের গলা শোনা গেল, কে?
আমি শীতল।
কে শীতল?
শীতল মনে মনে খেঁকিয়ে উঠল, তোর বাবা। মুখ তুলে বলল, আমি অসীমের বন্ধু (শুয়োরের বাচ্চা), কলকাতা থেকে টেলিফোনে একটা খবর এসেছে…।
শীতলের কথা শেষ হবার আগেই ওপর থেকে শোনা গেল, ও বুঝেছি। নীচে যাচ্ছি।
দোতলার বারান্দায় আরও কয়েকজন এসে দাঁড়াল, মহিলা মেয়ে এবং পুরুষ। নীচে আলো জ্বলে উঠল, চকমেলানো দালান ঘেঁষে ঘরের দরজা খোলা হল। অসীমের এক দাদা এগিয়ে এসে ডাকল, এসো এসো। কী খবর বলো তো?
ঘরে ঢুকে জবাব দেবার আগেই আরও দু-তিনজন নেমে এল। তার মধ্যে অসীমের বুড়ি মাও আছে। তার চোখে গভীর উদ্বেগের ছায়া। দাদা বউদিরা কিছুটা কৌতূহলিত, ত্রস্ত। শীতল ব্যাপারটা একটু হালকা করার জন্য বলল, অসীমের স্ত্রী ফোন করেছিল। এমন কিছু না, অসীম একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছে, সেই খবরটা দিতে বলল।
অসীমের মা উদ্বেগে যেন ভেঙে পড়ল, কী ধরনের অসুখ বাবা। কোনওরকম দুর্ঘটনা ঘটেনি তো?
শীতল বলল, না-না, সেরকম কিছু না। ওর স্ত্রী বলছিল, কলকাতায় কেউ গেলে ভাল হয়। মানে ও তো একলা, তাই আপনারা কেউ গেলে একটু বোধ হয় নিশ্চিন্ত হয়।
অসীমের মা বলে উঠল, আমি যাব, আমি যাব। এখন কি ট্রেন আছে?
সকলেই ব্যস্ত হয়ে উঠল। টাইমটেবল দেখতে ছুটল কে যেন। বাড়ির সবাই তখন নীচের বসবার ঘরে এসে ভিড় করেছে। সকলেরই খানিকটা চমকে যাওয়ার ভাব, মা ছাড়া।
অসীমের মা আবার জিজ্ঞেস করল, আমাকে ঠিক করে বলো বাবা, সেরকম কিছু নয় তো?
শীতল একটু হেসে যেন ভরসা দিতে চাইল, মনে মনে বলল, এর পরে অসীমটার মরাই উচিত। বলল, না না, সেরকম কিছু না। দুদু একলা, তাই একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছে। আজ রাত্রেই যাবার দরকার নেই, কাল সকালে গেলেও হবে।
অসীমের মা জিজ্ঞেস করল, বউমা কি তাই বলেছে?
ঠিক তা না, তবে ওই রকমই যেন বলল, কেউ গেলে ও একটু আশ্বস্ত হয়। অসীমের হাই টেম্পারেচারের কথা বলছিল।
এক দাদা বলল, হিপাটাইটিস না তো?
আর এক দাদা, হতে পারে, হিপাটাইটিস উইথ জন্ডিস। লিভারটার আর কিছু রাখেনি তো।
অসীমের মা বলল, না, আমি যাব। এ কথা শুনে আমি বাড়িতে বসে থাকতে পারব না। আমার সঙ্গে তোরা কেউ চল।
তার মানে? শীতল ভাবল, রিকশা তো একটাই। তার মধ্যেই সব যাবে নাকি? অসীমের মা বলে উঠল, তুমি যে বাবা এ দুর্যোগে এসেছ, এই যথেষ্ট।
এ সব কথা শুনতে আরও খারাপ লাগে। শীতল ইচ্ছা করে আসেনি। সে যদি বুঝতে পারত, কে ওকে ঘাড় ধরে নিয়ে এসেছে, তা হলে তার সঙ্গে একটা লড়াই বেধে যেত। অসীমের মা আবার বলে উঠল, মানুষের উন্নতি কি আর এমনি হয়। দায়িত্ববোধ না থাকলে–
শীতল পায়ের গোড়ালিতে আর দাঁতে দাঁত চাপল। কথাগুলো যেন দাঁতে পায়ে গুঁড়িয়ে দিতে চাইছে। বলল, আচ্ছা, আমি তা হলে চলি।
অসীমের মা হা হা করে উঠল, না না, শেতল বাবা, তুমি চলে গেলে হবে না। এখন কোথাও রিকশা পাওয়া যাবে না। তোমার রিকশাতেই আমরা যাব। তোমার একটু কষ্ট হবে জানি, কিন্তু বিপদের সময়ে।
শীতল ভাবতে পারছে না, একটা রিকশাতে তিনজন কেমন করে যাবে। কিন্তু মুখে বলল, তা তো বটেই। কষ্ট আর এমনকী।
অসীমের দাদা বলল, মানুষ এমনি বড় হয় না। এই দুর্যোগে এতখানি পথ এসে খবর দেওয়া কি কম কথা।
যেন শীতল ফোন পাওয়া মাত্রই খবর দেবার জন্য পা বাড়িয়েছিল। আর সেটা বড় মানুষ হবার জন্য। এই নোকটা বা লোকগুলো কী বলতে চায়। নিজেকে তো ওর কুকুরের চেয়ে বেশি কিছু মনে হচ্ছে না। সব সময়েই একজন মনিবের ইচ্ছায় ওকে চলতে হচ্ছে। আর সেই চলার জন্য তারিফ করার। ভাবগুলো কি এইরকম হয়। কিন্তু এ সব কথা ভাববার সময় নেই, রিকশার কথাটাই ভাববার। সবাই। মিলে শীতলের সঙ্গে ঠাট্টা করছে না নিশ্চয়ই। এই দুর্যোগে রিকশায় সেই খোলের মধ্যে তিনটে মানুষ। ধরবে কোথায়। একলা অসীমের মা-ই তো তার শরীরটা নিয়ে রিকশায় ধরবার মতো না। তার ওপরে। অসীমের যে কোনও দাদাই শীতলের ডবল। একমাত্র শুয়োরদেরই ওভাবে চার পা বেঁধে নিয়ে যাওয়া যায়।
অসীমের সেই দাদাটিই আবার বলল, আচ্ছা শেতল, ছোট বউমার কথা শুনে তোমার কী মনে হল। আজ রাত্রেই যেতে হবে?
শীতল লোকটার মুখের দিকে চেয়েই মনের ভাবটা বুঝতে পারল। এই সুযোগটা হারানো উচিত না। ও তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না না, সেরকম কিছু বলেনি। ও জাস্ট একটা সংবাদ দিয়েছে, একেবারে একলা তো, তাই একটু ভয় টয় পেয়েছে।
অসীমের মা বলে উঠল, ছোট বউমা সহজে ভয় পাবার মেয়েই না। নিশ্চয় সেরকম বুঝেছে, তাই কাউকে যেতে বলেছে। যাই আমি কাপড়টা ছেড়ে আসি। তোমরা একজন কেউ আমার সঙ্গে চলো৷
অসীমের মা ওপরে চলে গেল। অসীমের তিন দাদা চুপচাপ। বউদিরাও কথা বলতে পারছে না। একজন নিবিষ্ট হয়ে টাইমটেবল দেখছে। শীতল বেশ বুঝতে পারছে, কারোরই যাবার ইচ্ছা নেই। অথচ শীতলকে এই শরীর নিয়ে দুর্যোগে খবর দিতে আসতে হয়েছে। ইচ্ছা করে আসেনি। অনেকটা ঘাড় ধরে নিয়ে আসার মতো কেউ নিয়ে এসেছে।
অসীমের এক দাদা হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। বলে উঠল, জানি আমাকেই যেতে হবে। মা ঠিক আমাকেই যেতে বলবে।
বলেই সে দুপদাপ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সেই সঙ্গে একজন বউদিও। যে টাইমটেবল দেখছিল সে বলল, দশটা ঊনত্রিশে গাড়ি।
শীতল বুঝতে পারল, সকলেরই যেন একটা স্বস্তির নিশ্বাস পড়ছে। শীতল জানে ভাইদের মধ্যে অসীম সব থেকে বড় চাকরি করে। কলকাতায় মস্ত বড় ফ্ল্যাট নিয়ে থাকে। গাড়ি টেলিফোন ফ্রিজ সব নিয়ে তার আধুনিক জীবন। এই বাড়ির সঙ্গে কোথাও খাপ খায় না। সে যাই হোক গিয়ে, অসীম হয়তো এতক্ষণে ভবলীলা সাঙ্গ করেছে, যেন তাই করে থাকে। কিন্তু একটা রিকশায়…?
শীতলের ভাবনা শেষ হবার আগেই অসীমের মা আর এক দাদা নেমে এল। দাদার হাতে একটা ছাতা। অসীমের মা ব্যস্তভাবে বলল, আর দেরি না, চলো বেরিয়ে পড়া যাক। গিয়ে যে কী দেখব তা ভগবানই জানে।
এক দাদা বেশ অমায়িকভাবে বলল, এত ভাবছ কেন। ভালই দেখবে। কাল সকালে কিন্তু একটা খবর দেবার চেষ্টা কোরো, তা নইলে আমরা ভাবব। শেতলের কাছেই খবর দিয়ো।
লোকটা শয়তান না কী? কী বলতে চায়? তখন থেকে এক একটা কথা ছেড়ে যাচ্ছে। ইচ্ছা হচ্ছে টুটি চেপে ধরে চুপ করিয়ে দেয়। শীতল বলল, আপনারা দুজনে রিকশায় যান, আমি হেঁটেই চলে যেতে পারব।
অসীমের মা খপ করে শীতলের একটা হাত টেনে ধরে বলল, তা হয় না বাবা। তুমি আমার কোলে চেপে যাবে। মায়ের কোলে ছেলে যাবে, এতে আর লজ্জা কী।
কিন্তু শীতল তো কুকুরের বাচ্চা না। সব কিছুর একটা সীমা আছে। শেষ রক্ষার জন্য ও বলল, কিন্তু রিকশাওয়ালা যেতে চাইবে না।
অসীমের মা বলল, নিশ্চয়ই যাবে, তুমি এসো না।
রিকশাওয়ালাটা নিশ্চয়ইরাজি হয়ে গেল, কারণ সে ভাড়া পাবে এবং শীতল শুয়োর বা কুকুর যাই ভাবুক, সেই সেইভাবেই তাকে রিকশায় উঠতে হল। সমস্তটা একটা অমানুষিক অবস্থা। শেষ পর্যন্ত অসীমের দাদাই শীতলের কোলে চেপে বসল। রিকশার হুডটা খুলে দিতে হল। তা না হলে বসা সম্ভব না। ছাতা মেলে ধরা হল। ছাতা বাতাসে উড়ে যাবার মতো। বৃষ্টিতে ভেজা ছাড়া আর উপায় রইল না। রিকশাওয়ালাটা এই ওজন আর বাতাসের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে চালিয়ে নিয়ে চলল। অসীমের প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছে ওর দম বেরিয়ে যাবে। জীবনে কারোকে কোলে নেওয়া হল না, আর এমন দিনে অসীমের দাদা ওর কোলে। মনে হচ্ছে, কয়েক মন পাথর ওর কোলে আর বুকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ও প্রায় পা ছড়িয়ে দিয়ে চিত হয়ে পড়েছে। টুপিটা অনেকখানি নামিয়ে দিলেও বৃষ্টির ছাট মুখে লাগছে। মুখ থেকে গলা বেয়ে ভিতরে যাচ্ছে। তলপেটের কাছে ব্যথা, উরুটা ফেটে যাবার জোগাড়।
এলোমেলো বাতাস বৃষ্টির ঝাঁপটা একইরকম। রাস্তা তেমনি ফাঁকা। কোনও গাড়ি নেই। শীতল শুধু বেঁচে থাকবার চেষ্টায় সাবধানে নিশ্বাস নিতে লাগল।
.
শীতল অসীমের মাকে ও দাদাকে স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে যখন ফিরছে, তখন ওর চেতনা অনেকটা ক্রুদ্ধ মাতালের মতো। মাতাল না বলে একটু ক্রুদ্ধ খুনির মতো বলাই ভাল। মনে মনে স্থির করে ফেলেছে, এ সমস্ত কিছুর একটা প্রতিশোধ আজ এই রাত্রেই চাই। এখন আর ওর শরীরে জ্বর বা ব্যথা বলে কোনও অনুভূতি নেই। গরম রক্তের মধ্যে একটা তোলপাড় হচ্ছে। শক্ত মুঠি পাকিয়ে রেনকোটের পকেটের মধ্যে ঢুকিয়ে রিকশার একটা কোণে ঠেস দিয়ে রয়েছে। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। দাঁতে দাঁত, ঠোঁটে ঠোঁট টেপা। একটাই আশঙ্কা, নিখিল দত্ত এতক্ষণে ফিরে এসেছে কি না। শীলার ওপর দিয়ে শোধটা নেবার পরিকল্পনা ওর মাথায় জেগে উঠেছে। এই রকম একটা রাত্রে বাড়িতে স্বামী নেই। অসহায় শীলাকে ও আজ ছাড়বে না। সমস্ত রাগ ঘৃণা, শীলার শরীরে অভ্যন্তরে দাপিয়ে ছড়িয়ে দিতে হবে।
অফিসের কাছে নেমে রিকশাওয়ালাকে দশ টাকা দিল ও। রিকশাওয়ালাটা খুশি হয়েই সেলাম ঠুকে চলে গেল। নিখিল দত্ত কি কলকাতা থেকে ফিরেছে? তা হলে ওকে আবার বেরোতে হবে। বেরিয়ে গিয়ে এখানকার বেশ্যালয়ে ঢুকতে হবে। জীবনে যা কখনও করেনি সেইরকম একটা কিছু করতে হবে। আদ্যন্ত ক্ষ্যাপা পশুর মতো আক্রমণ আর অত্যাচার করবে। তার ওপরেই করতে হবে, যাকে ও সহজে যা কিছুর বিনিময়েই হোক,নত করতে পারবে। শীলা, শীলাকেই সম্ভব, যদি নিখিল দত্ত না এসে থাকে, আর তা না হলে কোনও বেশ্যাকে। এ শহরের বেশ্যালয়টা কোথায় জানা আছে। এই ছোট শহরে চলতে ফিরতে গেলেই পাড়াটা চোখে পড়ে।
শীতল কলিংবেলের বোতামে আঙুল দিতে গিয়ে থামল। এ অবস্থাতেও ওর খেয়াল হল, এই রকম। বৃষ্টিতে কলিংবেলের সুইচটা খারাপ হয়ে যেতে পারে, শক লাগতে পারে। দরজায় জোরে জোরে। আঘাত করল। বেশ খানিকক্ষণ ধাক্কা দেবার পরে দরজাটা খুলে গেল। শীলা দরজায় দাঁড়িয়ে। দেখলেই বোঝা যায় তার জামা কাপড়ের ঠিক নেই। ঘুম চোখে উঠে এসেছে। তা হলে নিখিল দত্ত আসেনি। অর্থাৎ, অর্থাৎ..শীতল ভিতরে ঢুকল। শীলা তাড়াতাড়ি বাড়ির ভিতর দিকে যেতে যেতে জামা কাপড় ঠিক করতে লাগল। শীতল দেখল। পিছন ফিরে ছিটকিনিটা আঁটল।
শীলা ততক্ষণে বাড়ির মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। শীতল ভিতরে ঢোকবার দরজার কাছে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল, মিস্টার দত্ত ফিরেছেন?
শীতল নিজের গলার স্বরটা নিজেই চিনতে পারল না। ঠিক যেন ভাঙা ভাঙা ব্যথায় ককিয়ে ওঠার মতো শোনাল। শীলা একটু ঠিকঠাক হয়ে ঘরের দরজার বাইরে এল। বলল, না।
শীতল শীলার দিকে দেখল। ঘুম ভাঙা টসটসে মুখ শীলার। বুকের আঁচলটা ভালভাবে টানতে পারেনি। ভিতরে কোনও অন্তর্বাস নেই। বিনুনি দুটো রুক্ষ, কপালের কাছে উড়ু উড়ু চুল। শীলা শীতলের সামনে এগিয়ে এল। জিজ্ঞেস করল, কলিংবেলটা বুঝি খারাপ হয়ে গেছে?
শীতল বলল, না, তবে এরকম ওয়েদারে অনেক সময় খারাপ হয়ে যায় বলে হাত দিইনি।
শীলার ঘুম ভাঙা চোখে একটু অবাক ভাব। বলল, ও। আপনার খাবারটা আমি রেখে দিয়েছি। আপনি ওপরে যান, আমি গরম করে দিয়ে আসছি।
শীতল ঢোক গিলল, ওপরে কেন, আমি নীচে বসেই খাব।
শীলার ফুলো ফুলো লাল ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে গেল। অবাক হয়ে শীতলের দিকে তাকাল। খলিত গলায় বলল, নীচে মানে আমাদের–
শীতল বাড়ির মধ্যে পদক্ষেপ করল। বলল, হ্যাঁ, আর ওপরে নিয়ে যাবার ঝামেলার কী দরকার।
বলতে বলতে ও প্রায় শীলার গায়ের কাছে চলে এল। ওর গলার স্বর তেমনি অস্বাভাবিক, যেন কষ্ট করে কথা বলতে হচ্ছে। শীলা যে ভয় পেয়েছে, তা মনে হল না। সে সরে গেল না। আস্তে আস্তে তার ঠোঁট দুটো বন্ধ হল, আর ঠোঁটের কোণে যেন একটু হাসির আভাস দেখা গেল। বলল, নীচে আপনার কষ্ট হবে না?
শীতলের মনে হল, ওর গলায় কথা আটকে যাচ্ছে। ও শীলার শরীরে দিকে দেখল, সমস্ত শরীরটা দেখতে লাগল। শীলা হঠাৎ শীতলের বোতাম খোলা রেনকোটের ভিতর দিয়ে হাত ঢুকিয়ে জামা ছুঁয়ে বলল, ভিজেও তো গেছেন। আপনি ওপরে গিয়ে এগুলো ছাড়ুন আমি খাবার গরম করে নিয়ে যাচ্ছি। আমি আপনাকে খাইয়ে একেবারে শুইয়ে দিয়ে আসব।
শীতলের মনে হল, ওর বুকের জামাটা যেন শীলা একবার মুঠো করে ধরল। কিন্তু ওর গলার স্বর যেন কেউ কেড়ে নিচ্ছে, আর স্বাধীনভাবে ও কিছু করতে পারছে না। তবু চেষ্টা করে ও পা চেপে দাঁড়িয়ে রইল, শীলার ঠোঁটের আর উঁচু বলিষ্ঠ বুকের দিকে তাকাল।
শীলা বলল, দত্ত বাড়ি আসবে বলে আপনার খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছিল বুঝি?
শীলা একটু হাসল, নাকি ওর শরীরটাই ঢেউ দিয়ে উঠল, বুঝতে পারা গেল না। আবার বলল, আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে ওপরে যান, আমি যাচ্ছি। আর না হয় তো আসুন, নীচেই বসবেন।
শীলা শীতলের হাত ধরে টানল। শীতল দেখল, ওর ইচ্ছা বা স্বাধীনতা কোনওটাই কাজে লাগছে না। ইতিমধ্যেই আর একজন ওর ভিতরে সব জবর দখল করে নিয়েছে। বলল না থাক, মানে আমি ওপরেই যাই। আমি খাব না।
শীতল দরজার দিকে পা বাড়াল। শীলা পিছন পিছন এল। বলল, কেন চলে যাচ্ছেন কেন? খাবেন না কেন?
শীতল বলল, না, খেতে ইচ্ছা করছে না। আমি এখন গিয়ে শুয়ে পড়ব।
শীলা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শীতল দরজা পেরিয়ে বাইরে গিয়ে বাঁদিকে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। সিঁড়িগুলো যেন ঝাপসা লাগছে, অস্পষ্ট কাঁপা কাঁপা। দাঁতে বোধহয় রক্ত ঝরছে, জিভে একটা কীরকম স্বাদ লাগছে। রক্তের স্বাদ অনেক সময় একটু নোতা মনে হয়। সিঁড়ির ওপরে দরজার কাছে। দাঁড়িয়ে পকেট হাতড়ে চাবিটা খুঁজতে লাগল।