স্বাধীনতা-উত্তর যুগের বাঙলা
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট তারিখে ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের শোচনীয় শর্ত হিসাবে বঙ্গদেশ দ্বিখণ্ডিত হয়—পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব-পাকিস্তান। যুক্ত বাঙলার মোট আয়তনের তিনভাগের একভাগ মাত্ৰ আসে পশ্চিমবঙ্গে, আর দুভাগ যায় পূর্ব-পাকিস্তানে। বিভক্ত হবার সময় পশ্চিম বঙ্গের আয়তন ছিল ৩০,৭৬২ বর্গমাইল। কিন্তু পরে যখন রাজ্যসমূহের পুনর্বিন্যাস করা হয়, তখন পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আরও ৩,১৬৬ বর্গামাইল ভূমি যুক্ত করা হয়। এর মধ্যে ২,৪০৭ বর্গমাইল আসে মানভূম থেকে, আর ৭৫৯ বর্গমাইল পূর্ণিয়া থেকে। আজ কিলোমিটারের হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের আয়তন ৮৭,৮৫৩ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা ৫,৪৪,৮৫,৫৬০। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভের পর তার নতুন নামকরণ হয়েছে ‘বাংলাদেশ’। বাংলাদেশের বর্তমান আয়তন ১,৪৩,৯৯৯ বর্গকিলোমিটার বা ৫৫,৫৯৮ বর্গমাইল। ১৯৮১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী বাঙলাদেশের মোট জনসংখ্যা ৮,৯৯,৪০,০০০। পশ্চিমবঙ্গ বর্তমানে ১৭টা জেলায় বিভক্ত যথা, বর্ধমান, হাওড়া, হুগলি, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, ২৪-পরগনা (১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারী থেকে ২৪-পরগনা দুভাগে বিভক্ত হয়েছে—উত্তর ও দক্ষিণ), নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদহ, পশ্চিম দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, কুচবিহার ও কলকাতা।
দুই
পশ্চিমবঙ্গ জন্মগ্রহণ করেছিল (১৯৪৭) অনেক সমস্যা নিয়ে। যুক্ত বাঙলার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে ছিল একটা ভারসাম্য। পূর্ব বাঙলা ছিল কৃষিপ্রধান। সেজন্য পূর্ব বাঙলা ছিল খাদ্যশস্য ও কাঁচামালের আড়ত। আর পশ্চিম বাঙলা ছিল শিল্পপ্রধান অংশ। পশ্চিম বাঙলাকে খাদ্যশস্য ও কাঁচামালের জন্য পূর্ব বাঙলার ওপর নির্ভর করতে হত। দ্বিখণ্ডিত হবার পর, এই আর্থিক ভারসাম্য ভেঙে পড়ে। তারপর পশ্চিম বাঙলা ছিল ঘনবসতিবহুল অংশ। তার মানে, আগে থাকতেই এখানে ছিল বাসস্থানের অভাব। সে অভাবকে ক্রমশই তীব্রতর করে তুলেছিল অন্যপ্রদেশ থেকে আগত জনসমুদ্র। এই সমস্যাকে উৎকট করে তুলল যখন নিরাপত্তার কারণে লক্ষ লক্ষ হিন্দু বাঙলা থেকে পশ্চিম বাঙলায় এল।
যখন পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্ট হল, তখন ড. প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে এক ‘ছায়া মন্ত্রীপরিষৎ’ এর শাসনভার গ্রহণ করল। কিন্তু চার-পাঁচ মাসের মধ্যেই সে মন্ত্রীসভা ভেঙে পড়ল। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারী মাসে ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় (১৮৮২-১৯৬২) নতুন মন্ত্রীসভা গঠন করলেন। স্বাভাবিকভাবে পশ্চিমবঙ্গ যে সকল উৎকট সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল, সেগুলির সমাধান এই নতুন মন্ত্রীসভার স্কন্ধে চেপে বসল। নিরবচ্ছিন্নভাবে তাঁর মৃত্যুকাল (১৯৬২) পর্যন্ত আঠারো বৎসর মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর সময়কালের মধ্যে বিধানচন্দ্র পশ্চিমবঙ্গের সমস্যাগুলি একে একে সমাধান করে ফেললেন।
তিন
প্রথম গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা বা পশ্চিমবঙ্গকে সমাধান করতে হল, তা হচ্ছে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত ৪১,১৭,০০০ শরণার্থীর পুনর্বাসন করা। নানা জায়গায় তাদের জন্য শিবির স্থাপন করা হল ও সরকারী ভাতায় (doles) তাদের পরিচর্যা করা হল। তা ছাড়া, তাদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য ও মেয়েদের বিবাহের জন্য সরকারী অনুদান দেওয়া হল। বহুক্ষেত্রে গৃহনির্মাণের জন্য সরকারী ঋণ দেওয়া হল। নিরাশ্রয়া মহিলা, শিশু, বৃদ্ধ ও অশক্ত ব্যক্তিদের বিশেষ আশ্রয়ে (Homes) যত্ন-সহকারে রাখা হল। কৃষিজীবী পরিবারদের প্রথম উত্তরপ্রদেশ ও আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হল। পরে ১৭,০০০ পরিবারকে এক সুগঠিত পরিকল্পনা অনুযায়ী দণ্ডকারণ্যে পাঠানো হল। অ-কৃষিজীবী শরণার্থীদের জন্য পেশা বা বৃত্তিগত ও কারিগরী শিক্ষা দেবার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হল। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ৪৪,৩০০ ব্যক্তিকে এরূপ প্রশিক্ষণ দেওয়া হল। এসবের জন্য ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় তাঁর মৃত্যুকাল পর্যন্ত, ১,৭৮,০১০ কোটি টাকা ব্যয় করলেন। এ ছাড়া, উদ্বাস্তু ছাত্রদের শিক্ষার সুযোগদানের জন্য আরও ১৬২০ কোটি টাকা ব্যয় করলেন। অনেক স্কুল-কলেজ বিশেষ করে উদ্বাস্তু ছাত্রদের জন্য স্থাপন করলেন। এ ব্যতিরেকে, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্ত পাঁচ কোটি টাকা সাহায্যে উদ্বাস্তুদের কর্মসংস্থানের জন্য সরকারী ও বেসরকারী যৌথ উদ্যোগে শিল্প স্থাপনের জন্য ‘রিহ্যাবিলিটেশন অব ইনডাস্ট্রিজ, করপোরেশন’ নামে এক সংস্থা স্থাপন করলেন। অসাধারণ প্রতিভাশালী ব্যক্তি ছিলেন বলেই উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের মত দুরূহ সমস্যা তাঁর পক্ষে এরূপ দ্রুততার সঙ্গে অল্প সময়ের মধ্যে সমাধান করা সম্ভবপর হয়েছিল।
চার
অন্যান্য সমস্যাও তিনি অনুরূপ ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সমাধান করলেন। খাদ্য ও কাঁচামালের সমস্যা সমাধানের জন্য, কৃষির উন্নতির নিমিত্ত বহুমুখী পরিকল্পনাসমূহ রচনা করলেন। কৃষকদের উন্নত ধরনের ভূমিস্বত্ব দেবার জন্য জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত করা হল এবং ক্ষতিপূরণ স্বরূপ জমিদারদের সরকারী ঋণপত্র দেওয়া হল। সেচের ব্যবস্থা এবং জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ‘দামোদর ভ্যালী করপোরেশন’ গঠিত করা হল। ময়ূরাক্ষী ও কংসাবতী পরিকল্পনাসমূহ কার্যকর করা হল। নদী ও খালসমূহ থেকে কৃষির সেচের জন্য যাতে জল পাওয়া যায়, তার ব্যবস্থা করা হল। এ ছাড়া, নানা স্থানে গভীর ও অগভীর নলকূপ বসানো হল। এসব করার ফলে কৃষির উৎপাদন অভূতপূর্বভাবে বেড়ে গেল। বিশেষ করে পাটের ক্ষেত্রে সামান্য পাঁচ লক্ষ গাঁট থেকে উৎপাদন পরিমাণ প্রায় ৫০ লক্ষ গাঁটে বৃদ্ধি পেল।
সঙ্গে সঙ্গে দুগ্ধ সরবরাহের জন্য হরিণঘাটা ও বেলাগাছিয়ায় ‘ডেয়ারি’ স্থাপন করা হল। কলকাতা ও কলকাতা থেকে অন্যত্র যাবার জন্য পরিবহণের ভার ‘স্টেট ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন’-এর হাতে ন্যস্ত করা হল। কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সড়কও নির্মিত হল।
রাস্তাঘাটের উন্নয়ন ও পতিত জমির পুনরুদ্ধার করা হল। বহু জায়গায় প্রশস্ত রাস্তা তৈরি করে রেলস্টেশনের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হল। লবণ হ্রদ বুজিয়ে কলকাতার সংলগ্ন এক উপনগরী সৃষ্টি করা হল। বস্তীবাসী ও শিল্পে নিযুক্ত কর্মীদের জন্য সরকারী ‘হাউসিং এস্টেট’ বা আবাস ভবনসমূহ তৈরি করা হল। অনুরূপ আবাস-ভবন নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যম মধ্যবিত্তদের জন্যও তৈরি করা হল। বৃহত্তর কলকাতা নির্মাণের জন্য CMPO-কে পরিকল্পনা রচনা করতে বলা হল। যে পরিকল্পনাকে রূপায়িত করবার জন্য পরবর্তীকালে গঠিত হল CMDA.
দুর্গাপুরে এক ইস্পাত কারখানা প্রতিষ্ঠা করা হল। দুর্গাপুর উপনগরী নির্মিত হল। সঙ্গে সঙ্গে চিত্তরঞ্জর লোকোমোটিভ কারখানা, হিন্দুস্থান কেবল ওয়ার্কস্ ও কোক ওভেন প্ল্যান্ট ও গ্যাস গ্রিড সিস্টেম চালু করা হল।
স্বাস্থ্য উন্নয়ন, দূষিত জল নিষ্কাশন ও আবর্জনা দূরীকরণের জন্যও বিশেষ চেষ্টা চলতে লাগল। এসবই ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের আমলে ঘটল।
পাঁচ
১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের ১ জুলাই তারিখে ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের মৃত্যুর পর কংগ্রেস নেতা প্রফুল্লচন্দ্র সেন নতুন মন্ত্রীসভা গঠন করেন। কিন্তু তাঁর অনুসৃত খাদ্যনীতি জনমতের বিরুদ্ধে যাওয়ায়, ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন ও অজয় মূখার্জির নেতৃত্বে এক যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়। কিন্তু তা ক্ষণস্থায়ী হওয়ায় ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ এক মন্ত্রীসভা গঠন করেন। কিন্তু তাও স্বল্পকাল স্থায়ী হওয়ায় ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারী তারিখে রাষ্ট্রপতির শাসন প্রবর্তিত হয়। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারী মাসে অজয় মুখার্জির অধিনায়কত্বে এক বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়। কিন্তু মাত্র এক বৎসরের (ফেব্রুয়ারী ১৯৭০) বেশি এ সরকার স্থায়ী হয় না। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মার্চ তারিখে আবার রাষ্ট্রপতির শাসন প্রবর্তিত হয়। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে অজয় মুখার্জির নেতৃত্বে এক ডেমোক্রেটিক কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয় কিন্তু দু’মাস (জুন ১৯৭১) পরে তা-ও ভেঙে পড়ে। তখন (৩০ জুন ১৯৭১) আবার রাষ্ট্রপতির শাসন প্রবর্তিত হয়। ১৯৭২-এর মার্চ মাসে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে এক কংগ্রেস সরকার গঠিত হয়। ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে ‘বামফ্রন্ট’ দল সাফল্য অর্জন করাতে জ্যোতি বসু ‘বামফ্রন্ট সরকার’ গঠন করেন। ‘বামফ্রন্ট সরকারই এখনও পর্যন্ত ক্ষমতাসীন আছে।
ছয়
ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের আমল থেকেই বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আওতায় শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অগ্রগতি হয়েছিল। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ১০,৪৪, ১১১ পাঠরত ছাত্র সমেত ১৩,৯৫০ সংখ্যক প্রাইমারী স্কুল ছিল। ১৯৬০-৬১ খ্রিস্টাব্দে ওই সংখ্যা বেড়ে ২৮,৮৬,১৪২ পাঠরত ছাত্র সমেত ২৮,০১৬ প্রাইমারী স্কুলে দাঁড়ায়। ১৯৮০-৮১ খ্রিস্টাব্দে ৬৮ লক্ষ পাঠরত ছাত্র-ছাত্রী সমেত প্রাইমারী স্কুলের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৬,৯৯৩। অনুরূপভাবে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ৪,৫৭,৬৩৪ পাঠরত ছাত্র-বিশিষ্ট ছেলেদের জন্য ১,৬৬৩ স্কুল ৬৪,৮৬৬ পাঠরত ছাত্রী সমেত ২৪০টি মেয়ে স্কুল ছিল। ১৯৬০-৬১ খ্রিস্টাব্দে স্কুলের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩,৪৯৭ ও ছাত্রীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৭,৪৮,৬৯২ ও ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ২৩ লক্ষ। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গে মাত্র একটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যা নয়টি যথা (বন্ধনীর মধ্যে প্রতিষ্ঠার তারিখ)—কলিকাতা (১৮৫৭), বিশ্বভারতী (১৯৫১), যাদবপুর (১৯৫৫), বর্ধমান (১৯৬০), কল্যাণী (১৯৬০), নর্থবেঙ্গল (১৯৬২), রবীন্দ্রভারতী (১৯৬২), বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৭৪) ও বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৮৪)। এছাড়াও, ইণ্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা পেয়েছে। পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চাপ হ্রাসের জন্য ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে মাধ্যমিক শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়। পরিষদই এখন মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা গ্রহণ করে। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ মাত্র স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষা গ্রহণ করে।
সাত
বামফ্রন্ট সরকারের আমলে গ্রামীণ স্বায়ত্ত-শাসনকে আবার সঞ্জীবিত করা হয়েছে। বর্তমানে ১৫টি জিলা পরিষদ, ৩২৫টি পঞ্চায়েত সমিতি ও ৩,২৪২ টি গ্রাম পঞ্চায়েত আছে। শহরাঞ্চলে আছে ১১২টি মিউনিসিপ্যালিটি।
সেচের উন্নতির জন্য বামফ্রন্ট সরকার তিস্তা পরিকল্প (১৯৮২) গ্রহণ করেন। এছাড়া, সেচের জন্য নদী থেকে জল-উত্তোলনের জন্য ২,৬৯৭টি স্কীম হাতে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া, আছে ৫,৭০১টি নলকূপ ও ৮,৫১,১৮২ হেক্টর পরিমিত জমিতে জলসেচের জন্য সরকারী খাল। তড়িৎ-শক্তি উৎপাদনের জন্য সাঁওতালডিহি, ব্যাণ্ডেল, দুর্গাপুর ও টিটাগড়ে নতুন তড়িৎ-শক্তি উৎপাদন কেন্দ্রসমূহ স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু তড়িৎশক্তির পূর্ণ সক্রিয়তার অভাবে তার সুফল কৃষক বা জনগণ কেউই পাচ্ছে না। হলদিয়ায় নতুন বন্দর নির্মিত হয়েছে। কিন্তু কলকাতা বন্দরের হাল ক্রমশই খারাপ হচ্ছে। হুগলি নদীর ওপর দ্বিতীয় সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। কলকাতাকে বেষ্টন করে চক্র-রেল চালু করা হয়েছে। পাতাল রেলেও লোক চলাচল শুরু হয়ে গিয়েছে। এসব ছাড়াও, ক্রীড়ামোদীদের সুবিধার্থে ইডেন গার্ডেন ও সণ্ট লেকে স্টেডিয়াম নির্মিত হয়েছে।
সরকারী ও বে-সরকারী উদ্যোগে বহু শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে, বেকারদের কর্মনিযুক্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে, যদিও ক্রমবর্ধমান বেকার সংখ্যার অনুপাতে তা নগণ্য। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গে ছিল, ৬,৪২১টি রেজিস্টার্ড ফ্যাক্টরী। সেগুলিতে প্রতিদিন নিযুক্ত শ্রমিক সংখ্যার গড় ছিল ১,২,৭,০০০ জন।
আট
কিন্তু এত বৈষয়িক সম্পদ বৃদ্ধির অন্তরালে ঘটেছে শান্তি-শৃঙ্খলার অবনতি, রাজনৈতিক দলাদলি, সন্ত্রাস, দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা ও নারী নির্যাতন, মধ্যবিত্ত সমাজের অবলুপ্তি, শিক্ষার সংকটক, (ক্রমাবৰ্ধমান লোডশের্ডি, টেলিফোনের অচলতা, বাঙলায় অবাঙালীর অবারিত আগমন ও কর্ম-সংস্থানের ওপর তার প্রতিঘাত, বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি, জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলতা ও নৈতিক শৈথিল্য প্রকাশ। রাজনীতি থেকে শুরু করে সাহিত্যক্ষেত্র পর্যন্ত সর্বত্র নির্লজ্জ গোষ্ঠী তোষণের অব্যাহত লীলা চলেছে। চতুর্দিকে দেখা যাচ্ছে ভণ্ডামির চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত। তাছাড়া, বাঙালীর মানবিক সত্তা ক্রমশই হ্রাস পাচ্ছে। নারীধর্ষণ ও বধূ-নির্যাতনের ক্রমবৃদ্ধি- হার তার দৃষ্টান্ত। বস্তুত সমকালীন সামাজিক বিশৃঙ্খলতা, মানবিক সত্তার হ্রাস ও নৈতিক শৈথিল্যের প্রতি দৃষ্টি রেখে মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে যে বাঙালীর জীবনচর্যা ও সংস্কৃতির স্বকীয়তা অবক্ষয়ের পথে চলেছে কিনা? অশন-বসনে, আচার-ব্যবহারে বাঙালী আজ যেমন নিজেকে বহুরূপী করে তুলেছে, তেমনই বর্ণচোরা করেছে তার সংস্কৃতিকে। অতীতের গৌরবময় সংস্কৃতির পরিবর্তে এক জারজ সংস্কৃতির প্রাবল্যই লক্ষিত হচ্ছে।