স্বাধীনতার জন্ম
আমাদের উত্তর পুবে করদ রাজ্য কোচবিহার ছিল ব্রিটিশ ভারতের বাইরে। কোচবিহার রাজ্য ছিল স্বাধীন রাজ্য, যদিও সামরিক ক্ষমতায় ব্রিটিশ ভারতের মুখাপেক্ষী। ভাল টাকা রাজস্ব দিতে হতো ব্রিটিশ সরকারকে। কোচবিহারের মহারাজার ১১১ গ্রাম ছিল ব্রিটিশ ভারত, রংপুর জেলার ভিতর, আর ব্রিটিশ ভারতের, রংপুর কালেক্টরের ৫১টি গ্রাম ছিল কোচবিহার রাজ্যের সীমানার ভিতরে। র্যাডক্লিফ সায়েবের বাউন্ডারি কমিশন এই নিয়ে মাথা ঘামায়নি ১৯৪৭-এ। কোচবিহার ভারতের অনুকূলে মত দেয় ১৯৪৯-এ এর সেপ্টেম্বরে, আর ১৯৫০-এর ১লা জানুয়ারি থেকে কোচবিহার ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়, পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা। আইনত কোচবিহারের সমস্ত ভূসম্পত্তি ভারত হয়ে যায় সেই দিন থেকে। সেই থেকেই মনুষ্যত্বের অপমান পোক্ত হয়ে বসে এপার ওপারে। দেশের ভিতরে বিদেশ এই স্বত্তের জন্ম হলো। রংপুর পাকিস্তানে গেল, তাই এপারে কোচবিহার রাজ্যের সীমানার ভিতরে থাকা রংপুর কালেক্টরের ৫৩ মৌজা পাকিস্তান হলো। কোচবিহার ভারত হলো, তাই ওপারে কোচবিহার রাজার ১১১টি মৌজা ভারত হলো। এক দেশের ভিতরে আর এক দেশ। আসলে এই ছিটমহলবাসীর সত্যিকারের কোনো দেশই ছিল না। গত ১লা আগস্ট ২০১৫ ভারতের ভিতরের ৫১টি গ্রাম, বাংলাদেশের ভিতরে ১১১টি গ্রাম সত্যিকারের দেশ পেল। আর দুটি ছিটমহল,ভারতের ভিতরের দুটি গ্রাম, মেখলিগঞ্জ মহকুমার অঙ্গারপোতা, দহগ্রাম ১৯৯২-এ করিডোরে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। সেই করিডোর তিনবিঘা যেমন ছিল তেমনই আছে। ১৯৭৪ সালে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও সদ্যজাত রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান চুক্তি করেছিলেন ছিটগুলির বাস্তব সম্মত বিনিময়ের। সেই চুক্তি এতকাল বাদে বাস্তবায়িত হলো। ৩১শে জুলাই মধ্যরাতে, রাত বারোটায়। আমি সেই বিরল মুহূর্তের সাক্ষী হলাম।
আমার জন্ম ১৯৪৭-এর পর। আমি ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইটের কথা শুনেছি, দেখিনি। ১৯৪৭-এর ১৪ই আগস্ট মধ্যরাতে দিল্লির লালকেল্লায় স্বাধীন ভারতের পতাকা তুলেছিলেন জওহরলাল নেহরু। আমার যৌবনকালে বাংলাদেশের জন্ম দেখে- ছিলাম। পাকিস্তান ভেঙে জন্ম হয়েছিল নতুন রাষ্ট্রের। সেও ছিল মুক্তি সংগ্রাম। স্বাধীনতার যুদ্ধ। বাংলাদেশ আমার পিতৃপুরুষের দেশ, তাই বাংলাদেশের জন্ম আমাকে উদ্বেলিত করেছিল সত্য। কিন্তু সে দেশ তো আমার দেশ নয়। আমার দেশ এই ভারত। ভারতের ভিতরে একট অংশ, সবর্মোট ৭০০০ একরের মতো টুকরো টুকরো ভূখণ্ড স্বাধীনতা পেল এই ২০১৫’র ৩১শে জুলাই মধ্যরাতে। সেই মহৎ ঘটনার দিন আমি মধ্য মশালডাঙা ছিটমহলে উপস্থিত ছিলাম। স্বাধীনতা কেমন, তা পরাধীন না থাকলে অনুভব করা যায় না। পরাধীনতা মানে মানে রাষ্ট্রের কাছে ব্যক্তির নাগরিকত্বর কোনো দাম নেই। রাষ্ট্র সেই ব্যক্তিকে ঘৃণার চোখে দ্যাখে। রাষ্ট্র তাকে ভিনদেশি বলে দাগিয়ে দিয়ে জেলখানায় ভরে দেয় কিংবা ঠেলে দেয় সীমান্তের ওপারে অচেনা বাংলাদেশে, পুশব্যাক যার আইনি নাম। ছিটমহলের বাসিন্দাদের সেই আতঙ্ক সেই ঘৃণাই সহ্য করতে হয়েছে এতকাল। সে কেমন ঘৃণা কেমন আতঙ্ক? মশালডাঙায় যে স্বাধীনতা উৎসব হলো ৩১শে জুলাই বিকেল থেকে, সেই উৎসবে সেই সব দিনগুলির কিছু কিছু ঘটনার কোলাজ প্রদর্শিত হয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতা বর্ণনার মধ্য দিয়ে। বলব তার কথা।
৩০শে জুলাই দুপুরে তিস্তা-তোরসা এক্সপ্রেস ট্রেনে রওনা দিয়েছিলাম আমি ও আমার তরুণ বন্ধু জয়জিৎ কোচবিহারের উদ্দেশে। কোচবিহার থেকে দিনহাটা। দিনহাটা একটি সীমান্তবর্তী মহকুমা শহর। এই মহকুমার ভিতরের ৫১টি ছিটের ১৯টি রয়েছে। আমি এর আগেও বেশ কয়েকবার এসেছি এখানে ছিটমহলের কৌতুহলেই। এক রাষ্ট্রের ভিতরে আর এক রাষ্ট্র কী ভাবে থাকে সেই কৌতুহলেই আসা বার বার। আসলে আরো স্পষ্ট করে বলতে হলে, এক রাষ্ট্রের ভিতরের কিছু মানুষ ভিনদেশি বলে পরিচিত হলে কী হয় তাদের, তা জেনে নিতেই বার বার আসা। স্বাধীনতা হলো সেই কিম্ভুত অবস্থার অবসান। সকালে দিনহাটা পৌঁছে ছিটমহল বিনিময় সমিতির দীপ্তিমান সেনগুপ্তকে ফোন করতে সে বলল, বিকেলে বের হতে হবে দাদা, ফিরতে রাত একটা হবে। আজ জাতীয় পতাকা তোলা হবে মশালডাঙায়। মশালডাঙাতেই কেন্দ্রীয় ভাবে স্বাধীনতা উদযাপন করা হচ্ছে। তা যে হচ্ছে সে আমি জানতাম, আমার ফেসবুকে মশালডাঙার জয়নাল আবেদিন মেসেজ করেছিল মশালডাঙাতে আসতে। উঠেছি মহকুমা শাসকের বাংলো অনন্যায়। পুরোন বন্ধু দমদমের শীতল বসু সেখানে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। ঘটনাচক্রে এবারই তা জানলাম। আগেও ছিলাম যখন, জানতাম না শীতল বসু সেখানে আছেন। অনন্যায় তরুণ সাংবাদিক অনমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং অনুপ চন্দের সঙ্গে দেখা। অনমিত্র ছিটমহলের এপার ওপার জানেন। বাংলাদেশ জানেন। আমি যাঁদের চিনি তাঁদের চেনেন। সকালটা গেল ছিটমহল চর্চায়। কেন ওপারের মানুষ এপারে আসছে না। কেন এপারের মানুষ ওপারে যাচ্ছে না। ওপার থেকে যদিও হাজার জনের মতো আসছে এপারে, এপার থেকে একটি মানুষও ওপারে যাচ্ছে না। অভিযোগ উঠেছে ওপারের মানুষকে নাকি আসতে দেওয়া হচ্ছে না। কেন আসতে দেওয়া হবে না তা অবোধ্য। মানুষ চলে আসবে, জমি পড়ে থাকবে, তাহলে না আসতে দেওয়ার কারণ? এমনিতেই জমি দখলের জন্য মানুষকে জমি থেকে উৎখাত করাই যখন স্বাভাবিক প্রবণতা, তাহলে এই সুযোগে তো একটু ভয় দেখিয়েই বহু সংখ্যালঘুকে আইন সম্মত উপায়েই ওপার থেকে এপারে পাঠিয়ে দেওয়া যেত। তা হতে দেননি ওদেশের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ। আর মানুষও চায়নি ছিন্নমূল হতে। যে সমাজ আর আত্মীয়স্বজন নিয়ে বসবাস করছে তারা এতকাল ধরে তা ত্যাগ করে অজানা দেশ ভারতে আসতে চায়নি। ঠিক ওই কারণেই এপারের মানুষ, যাঁদের বড় অংশ সংখ্যালঘু তাঁরা কেউ এদেশ ছেড়ে না গিয়ে আগের নাগরিকতা ত্যাগ করে ভারতীয় হয়ে গেছেন। এই স্বাধীনতায় ছিটমহলের মানুষকে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল কে কোন দেশের নাগরিক হবে তা জানাতে। প্রথমে ১লা জুলাই থেকে ১৬-ই জুলাই পর্যন্ত, পরে তা ৩১শে জুলাই অবধি বর্ধিত হয়েছিল। এই রক্তপাতহীন স্বাধীনতা, ছিট বিনিময় হয়েছে অহিংস আন্দোলনে। মানুষের নীরব প্রতিবাদে। হ্যাঁ, এই পতাকা তো এই প্রথম ওঠেনি। এপারের বাংলাদেশি ছিটমহল মশালডাঙা বা অন্য ছিটমহলে ভারতের পতাকা উঠেছে এর আগেও। গত ২৬শে জানুয়ারি, আগের বছর ১৫-ই আগস্ট। এইসব ছিটের মানুষ বিনিময় চুক্তি অনুসারে ভারত হতে চাইছে যে তা জানাতেই ওই পতাকা উত্তোলন। আর গত ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে, যেদিন ছিল বাংলা দেশের বিজয় দিবস, সেদিন বাংলাদেশের অভ্যন্তরের ১১১টি ছিটমহলে ছিটের মানুষ বাংলাদেশের পতাকা তুলেছিল ইন্দিরা গান্ধী ও শেখ মুজিবর রহমান স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুসারে ছিট বিনিময়ের দাবিতে। স্লোগান দিয়েছিল, “ইন্দিরা মুজিব চুক্তি, ছিটবাসীর মুক্তি”। আমি সেদিন তা প্রত্যক্ষ করেছিলাম বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলার (সাবেক রংপুর জেলার মহকুমা, এখন জেলা) ভুরুঙ্গামারী থানা সংলগ্ন দাশিয়ারছড়া মৌজায়। দেখেছিলাম,‘আমাদের একটি দেশ চাই’ এই আর্তিই ফুটে বের হচ্ছে সেই বাংলা দেশের ভিতরে ভারতের সেই গ্রামের মানুষের চোখে মুখে। স্ট্যাটাসে তখন সেই মস্ত গ্রাম বাংলাদেশের ভিতরে ভারত। তার থানা দিনহাটা।
ছিটমহল মশালডাঙা অনেক বড় মৌজা। ১৯টি জরিপের নকশা বা মৌজা মানচিত্রে বিভাজিত এই প্রাচীন গ্রাম। মধ্য মশালডাঙাতেই ৩১শে জুলাই মধ্যরাতে ত্রিবর্ণ রঞ্জিত ভারতের পতাকা উঠেছিল। স্বাধীনতার পতাকা। কেন্দ্রীয়ভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ছিটমহল বিনিময় সমিতি। এপারে মধ্য মশালডাঙা, ওপারে দাশিয়ারছড়া। দুপুরে এলেন আমার ওপারের বন্ধু, তরুণ আইনজীবী আব্রাহাম লিঙ্কন। যিনি বি.এস. এফ’এর গুলিতে কাঁটাতারে আটকে থাকা বালিকা ফেলানি হত্যা মামলায় বাংলা দেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। আব্রাহাম লিঙ্কন কুড়িগ্রাম শহরে বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের একটি মিউজিয়ম করেছেন। সেই মিউজিয়মে অমূল্য সব নথিপত্র আছে। আমি দেখেছিলাম গত ডিসেম্বরে। আমরা মশালডাঙার স্বাধীনতা বরণ উৎসব দেখতে রওনা হলাম বিকেলে। তখনো সূর্য ডোবেনি। উত্তরবঙ্গে তখন বৃষ্টি নেই, কিন্তু আকাশে মেঘ আসায় আবহাওয়া শীতল। আমাদের জন্য গাড়ি এনেছিল মশালডাঙার তরুণ আনোয়ার। আমরা চললাম সীমান্তের দিকে। দিনহাটা চৌমাথা ছাড়িয়ে বলরামপুর রোড ধরে গাড়ি ছুটল। বলরামপুরের সন্তানই মহৎ দুই ভাওয়াইয়া গায়ক আব্বাস উদ্দিন আহমদ ও প্যারীমোহন রায়। আব্বাসউদ্দীন আহমদ ১৯৪৭ এর স্বাধীনতা, দেশভাগের পর চলে গিয়েছিলেন তৎকালীন পাকিস্তানে। আল্লা মেঘ দে পানি দে…, আমাদের জন্যও তো তিনি ডেকেছেন তাঁর ঈশ্বরকে। ভাবতে ভাবতে আমার ভিতরে যেন অভিমান জেগে ওঠে। আব্বাসউদ্দীন আহমদ এখন আর পাকিস্তানের নন, বাংলাদেশের নন, আমাদের সকলের। ছিটের একটি মানুষও দেশত্যাগ করছে না। এ আমাদের গৌরব। নানা অসাম্যের ভিতরে আমরা এইটুকু বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছি ছিটের মানুষের। আব্বাসউদ্দীন ১৯৫৯-সালের ৩০শে ডিসেম্বর প্রয়াত হন। তখনো পাকিস্তান ভাঙেনি, কিন্তু সেই রাষ্ট্রের মোহ ভেঙেছিল ওদেশের মানুষের। ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা, দেশভাগই ছিটমহলের মানুষের জীবনে পরাধীনতা এনেছিল। বলরামপুর রোড ধরে গিয়ে বাসন্তীর হাট, তারপর বুড়ির হাট থেকে ডানদিকে ঘুরে নাজিরহাটের দিকে গাড়ি চলল। দুপাশে রোয়া ধানের মাঠ। সূর্যাস্ত হচ্ছে। ছিটমহলের শেষ সূর্যাস্ত। নাজিরহাট বন্দর পার হয়ে হসপিটাল মোড়, তা পেরিয়ে এগোতেই ওই দেখা যায় মানুষের মুখ। গাড়ির চালক আনোয়ার দেখাতে লাগল ঐ যে বাঁশবন, ঐ বন অবধি বাংলাদেশ, তারপর ঐ বাড়িটি ইন্ডিয়া, কাল থেকে সব ইন্ডিয়া, আমিও ইন্ডিয়ান, ভাবতেই কেমন লাগছে। এবার সে গাড়ি চালানোর লাইসেন্সের আবেদন করতে পারবে। প্রথমে এইটাই মনে হচ্ছে। স্বাধীনতার কাছে বড় কিছু আকাঙ্ক্ষা নয়। ছোট ছোট আশা নিয়েই তাদের জীবনের অলীক রাষ্ট্র বদল করে তারা ভারত হয়ে যাচ্ছে। গাড়ি পৌছল মশালডাঙার দুয়ারে। মস্ত তোরণে সদ্য প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ.পি.জে. আব্দুল কালামের মুখ। তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি জ্বলজ্বল করছে তোরণে…” স্বপ্ন সেটা নয় যেটা তুমি ঘুমিয়ে দ্যাখো, স্বপ্ন সেটাই যেটা তোমাকে ঘুমোতে দেয় না।” তোরণে গেরুয়া শাদা আর সবুজ রঙের বেলুন অগণিত। পিচ রাস্তার গায়েই দেড়শো মিটার দূরে মশালডাঙার বসতির আরম্ভ। এই একশো মিটার পথের দুপাশ বেলুনে রঙীন শিকলিতে সাজানো। পথে শাদা চট বিছানো যদি বর্ষায় কর্দমাক্ত হয়ে যায়। আমরা সকলে মিশে গেলাম অসংখ্য আনন্দময় মুখের সঙ্গে। বাড়িগুলি সব টিনের। সমুখে অনেকটা প্রশস্ত জায়গা। খেলার মাঠের মতো তার আয়তন। সেখানে মঞ্চ বাঁধা হয়েছে। সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। এসেছে এই দেশের বহু টেলিভিশন চ্যানেল। হিন্দি, ইংরিজি, বাংলা… সকলে উপযুক্ত লোক খুঁজে তাঁদের আনন্দের অভিব্যক্তিকে ধরে রাখছেন। পাঠিয়ে দিচ্ছেন বিন্ধ্য হিমাচল যমুনা গঙ্গায়। শহরের মানুষ, গঞ্জের মানুষ, গ্রামের মানুষ জেনে যাচ্ছে স্বাধীন দেশের ভিতরে আর এক স্বাধীনতার জন্ম হচ্ছে। এই গ্রামে গত ৬৮ বছরে কিছুই হয়নি। না জল, না আলো, না ইস্কুল, না স্বাস্থ্যকেন্দ্র। আজ জেনারেটরে আলো জ্বলেছে। ঝলমল করছে সব। একটু ভেতরের দিকে গেলাম। মশালডাঙার ভিতরে সাড়ে ছ’বিঘা একটি অংশ আছে, সেই সাড়ে ছ’বিঘা জমি ভারত। অদ্ভুত। জমি আর গ্রাম আর মানুষের জীবন নিয়ে যেন জুয়া খেলা হয়েছিল দূর কোনো অতীতে। মহাভারতের সেই পাশাখেলা যেন ঘটেছিল এই সব গ্রাম নিয়ে। আকাশে পূর্ণ চন্দ্র। অন্ধকারে সোনার থালার মতো চাঁদ উঠছে সকলের অজান্তে। চাঁদের আলোর ভিতরে পতাকা উঠবে, সব কিছু প্রস্তুত। আব্রাহাম লিঙ্কন ও আমি সেই পতাকা দণ্ডের নিচে দাঁড়িয়ে কিছু বললাম। সূচনা কথা। আবেগে কী আর বলব? জীবন ধন্য হলো। স্বাধীনতার জন্ম তো আমি আগে দেখিনি এই স্বাধীন ভারতের ভিতর। এখন আমি যেন তাকে ছুঁয়ে দেখতে পারছি। সে আসছে পায়ে পায়ে। অবগুন্ঠনবতী অবগুন্ঠন খুলছে। যে স্বাধীনতা জন্ম নেবে কয়েকঘন্টা বাদে তা যেন প্রকৃত মুক্তির স্বাদ নিয়ে আসে মানুষের কাছে। মূল মঞ্চের একদিকে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ.পি.জে আব্দুল কালামের ছবি আর সেই সেই স্বপ্ন দেখার বাণী। অন্যদিকে এই আন্দোলনে যিনি জীবন উৎসর্গ করেছিলেন সেই প্রয়াত নেতা দীপক সেনগুপ্ত। এই মঞ্চে এক অভিনব, অসামান্য অনুষ্ঠান করা হলো তারপর। যে লাঞ্ছনা, অপমান সয়েছে ছিটমহলবাসী এত বছর ধরে, সেই সমস্ত ঘটনায় জড়িত কিছু কিছু মানুষ মঞ্চে এলেন। তাঁদের অপমানের কথা স্মরণ করা হলো। সপুত্র আসমা বিবি আর তাঁর স্বামী এলেন। তাঁদের এই সন্তান জন্মের জন্য দিনহাটা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অনেক লড়াই করতে হয়েছিল। আসমা বিবি ভারতের ভিতরে বাংলাদেশি ছিটের বাসিন্দা হিসেবেই হাসপাতালে ভর্তি হতে চেয়েছিলেন। স্বামীর নাম ও ঠিকানা লুকোতে অস্বীকার করেছিলেন। শেষ অবধি হাসপাতালেই জন্ম হয় তাঁর সন্তানের। কত কথা শোনা গেল। কে ভিনদেশি অনুপ্রবেশকারী হয়ে ধরা পড়ে বাংলাদেশে চালান হয়ে গিয়েছিল। পুশব্যাক। কারা ছিট থেকে বেরিয়ে জেল খেটে বাড়ি ফিরেছিল। কত অসম্মান। ছিটের মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েও ভেঙে যায়। ছিটের মানুষ নামহীন গোত্রহীন যেন। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যাচ্ছিল। রাত দশটার পর জাভেদ শামিম নির্মিত একটি তথ্যচিত্র দেখান হলো ছিটমহল নিয়ে। তার ভিতরে ১০৫ বছরের আজগার আলির কথা শোনা গেল। সন্ধেয় সেই পিতৃপুরুষের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছিল। তিনি এই দিনটির জন্য বেঁচে আছেন। কী হাসি সেই একশো বছরের প্রাচীন মুখখানিতে! রাত বারোটার দিকে ঘড়ির কাঁটা হাঁটছে। ফানুস উড়ল আকাশে। একটু আগে ঝিরঝির করে বৃষ্টির কণা ঝরেছিল। আকাশের আনন্দাশ্রু। বাজি পুড়তে আরম্ভ করেছে। বাচ্চা কোলে মায়েরা, শাশুড়ি ননদ নিয়ে আসছেন তো আসছেন। আকাশে রঙিন আলোর ফুলঝুরি। ফানুশ উড়ে যাচ্ছে চাঁদের দিকে। চাঁদ তখন মাথায় মাথায়। পতাকা উঠল চাঁদের দিকে। এত উল্লাসের ভিতর স্বাধীন দেশের সদ্য প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির জন্য এক মিনিট নীরবতা। তা শেষ হলে জাতীয় সঙ্গীত। পতাকা উড়ে তা রাষ্ট্রীয় শোকের কারণে অর্ধনমিত হলো। হে স্বাধীনতা তোমাকে আমি স্পর্শ করলাম হয় তো। মাথা ছোঁয়ালাম তোমার মাটিতে।
স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল, ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা – ( শামসুর রাহমান )