1 of 2

স্বর্ণলিপ্সা – ৬

ছয়

পরদিন।

রাতে একফোঁটা ঘুমাতে পারেনি পিটার। ভোরের দিকে ভাবল, আজও খুলবে না সার্ভেয়ার অফিস। মন ভাল লাগছে না ওর। রাতে যোগাযোগ করেনি চাচা।

কিছুক্ষণ বিছানায় গড়িয়ে পিটার স্থির করল, একবার ঘুরে আসবে গল্ফ কোর্সের ডেভেলাপার সাইট থেকে।

সিদ্ধান্ত হয়ে যেতেই পোশাক পাল্টে বাড়ির দরজায় তালা মেরে বেরিয়ে এল। দেরি না করে রওনা হলো ভ্যান নিয়ে। বুদ্ধিমানের মত এড়িয়ে গেল ডেভেলাপার সাইটের সদর দরজা। কোম্পানির বিপক্ষে লড়তে গেটের সামনে পৌছে গেছে বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারী।

ওদিকে না গিয়ে দূরের সরু সেই দরজার সামনে পৌঁছে গেল পিটার। এখানেই বেড়ার ধারে ছিল রবার্টের ভ্যান। গাড়ি থেকে নেমে দরজা খুলে বেড়ার ওদিকে ঢুকল ও। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করল পাইন জঙ্গলে। ভাল করেই জানে, রবার্টের মত হঠাৎ করেই সোনা পাবে, সে আশা নেই।

আসলে নিজেও জানে না পিটার, কেন এখানে এসেছে। তবে বাড়িতে কিছুই ভাল লাগছিল না। কিছুক্ষণ পর জঙ্গলের দক্ষিণ সীমানায় ঢালু জমিতে পৌঁছে গেল। এদিকটা ক্রমে নিচু হয়ে নেমে গেছে লকের তীরে। একবার চোখ তুলে ধূসর মেঘে ছাওয়া আকাশ দেখল পিটার। আজকে ঝিরঝির করে বইছে বরফ-ঠাণ্ডা হাওয়া। ওর নাকের ফুটো দিয়ে ভুসভুস করে বেরোচ্ছে ধোঁয়াটে নিঃশ্বাস। আরডাইক লক ঘিরে রেখেছে কুয়াশাভরা, প্রাচীন সব রুক্ষ পাহাড়। মাঝে মাঝে মেঘের ফাঁক গলে বরফ-ঢাকা মাটিতে এসে পড়ছে একচিলতে সোনালি রোদ। এই চিরকালের অদ্ভুত সুন্দর প্রকৃতি সবসময় ভাল লেগেছে পিটারের। কিন্তু প্রিয় বন্ধুর করুণ মৃত্যুর পর এখন সবই যেন কেমন অচেনা লাগছে।

কিছুক্ষণ জঙ্গলে কাটিয়ে লকের তীরে গিয়ে থামল পিটার। মনে সামান্য আশা, হয়তো দেখা হবে সেই পোচারের সঙ্গে। অবশ্য আরডাইক লক দৈর্ঘ্যে পুরো বারো মাইল। নিয়মিত লকে চোখ রাখে ফিশারির লোক। অন্য জায়গা ফেলে আবারও রবার্টের খুনের এলাকায় হাজির হবে পোচার, সে সম্ভাবনা খুবই কম। তা ছাড়া, ভেসে এদিক- ওদিক গিয়ে থাকতে পারে রবার্টের লাশ।

সময় নষ্ট করছে বুঝে দমে গেল পিটারের মন। আবারও জঙ্গলে ঢুকে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেল ভ্যানের কাছে। গাড়িতে উঠবে, এমনসময় ঝুপঝুপ করে ফের শুরু হলো বৃষ্টি। দেরি না করে দরজা খুলে সিটে বসল পিটার। ইঞ্জিন চালু করে গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে চলল গ্রামের দিকে। একটু পর রিয়ারভিউ মিররে দেখল, পিছন থেকে আসছে একটা গাড়ি।

আঁকাবাঁকা পথে অন্য কোনও যানবাহন নেই। হঠাৎ বাক্সের মত চারকোনা ফোর-হুইল-ড্রাইভ অডি গাড়িটা কোথা থেকে এল, ভেবে পেল না পিটার। অবশ্য ওদিকে বেশি মনোযোগও দিল না।

কিছুক্ষণ পর দেখল, পেছনের গাড়িটার গতি ঘণ্টায় অন্তত পঞ্চাশ মাইল। দেখতে না দেখতে চলে এল খুব কাছে। সরু, আঁকাবাঁকা পথে এত গতি খুব বিপজ্জনক। আগ্রাসী ভঙ্গিতে পিটারের ভ্যানের পেছনে পৌঁছে গেল ফোর- হুইল-ড্রাইভ।

ওটার ড্রাইভারটা আস্ত হারামজাদা, ভাবল পিটার। সে যেন পাশ কাটিয়ে যায়, তাই গতি কমাল ও। কয়েক মুহূর্ত পর বুঝল, পাশ কাটাতে চায় না ওই ড্রাইভার। সমান গতি তুলে যেন চোর-পুলিশ খেলা খেলতে চাইছে!

বিরক্ত হয়ে আবারও গতি বাড়াল পিটার।

এবারও পেছনে রয়ে গেল অডি।

সামনে পথ সর্পিল হতেই পেছনের গাড়ির কথা ভুলে সতর্ক হলো পিটার। রিয়ারভিউ মিররে দেখল, পেছনের গাড়িতে রয়েছে কমপক্ষে তিন-চারজন লোক।

‘কী, ওভারটেক করবি না?’ আনমনে বলল পিটার।

কয়েক মুহূর্ত পর গর্জন ছেড়ে ভ্যানের পাশে পৌঁছে গেল ফোর-হুইল-ড্রাইভ। তাতে খুশিই হলো পিটার। এবার বিদায় হোক শয়তানটা। কিন্তু ইচ্ছেপূরণ হলো না ওর। ভ্যানকে পেছনে ফেলে হঠাৎ এগিয়ে গেল অডি। পরক্ষণে ব্রেক কষে আড়াআড়িভাবে থেমে দাঁড়াল গোটা পথ জুড়ে। প্রবল বৃষ্টির ফোঁটার ভেতর ঝিলমিল করছে টকটকে লাল ব্রেক লাইট।

দুর্ঘটনার আশঙ্কায় আস্ত কলজেটা গলার কাছে উঠে এল পিটারের। সংঘর্ষ এড়াতে কড়া ব্রেক কষে থামতে চাইল। কিন্তু বরফে ঢাকা পিচ্ছিল পথে হড়কে গেল ভ্যানের চার চাকা। আঁৎকে উঠল পিটার। ঝড়ের বেগে ঘুরে গেছে ভ্যান। সামনের চাকাদুটো ধুম করে পড়ল নিচের ঘাস জমি পেরিয়ে গভীর এক নালায়। একটু দূরেই গ্রামের কারও খেতের পাথুরে সীমানা প্রাচীর। ধুপধাপ আওয়াজে নালা থেকে উঠে ওখানে গিয়ে নাক গুঁজল ভ্যান। দেয়ালে বাড়ি খেয়ে মুচড়ে গেছে বনেট।

জোর ঝাঁকি খেয়ে অবশ বোধ করছে পিটার। নাক-মুখ চেপে ধরেছে বিস্ফোরিত এয়ারব্যাগ। দিনের আলোয় চোখের সামনে দেখছে অজস্র রঙিন নক্ষত্র। মাথা পরিষ্কার হওয়ার আগেই শুনল পায়ের আওয়াজ। কয়েক মুহূর্ত পর টান দিয়ে খোলা হলো ভ্যানের দরজা। হু-হু করে শীতল হাওয়া ঢুকল ক্যাবে। আবছাভাবে পিটার দেখল ওর দিকে ঝুঁকল বিশালদেহী একলোক। ধাতব শব্দ হলো সিটবেল্ট খোলার।

পরমুহূর্তে কোটের কলার চেপে হ্যাঁচকা টানে পিটারকে নামিয়ে নেয়া হলো ড্রাইভিং সিট থেকে। এখনও ঠিক মত মাথা কাজ করছে না ওর। কোনও বাধা দিতে পারল না। তা ছাড়া, ওই দানব আকারে ওর প্রায় দেড়গুণ। ওকে ঘাসের ওপর দিয়ে ছেঁচড়ে নেয়া হলো সরু পথের ধারে। পিটার শুনল খুলে বন্ধ হয়েছে গাড়ির কয়েকটা দরজা। হতভম্বের মত শুয়ে থেকে দেখল, ওকে ঘিরে ধরেছে কয়েকজন লোক। হাঁ করে তাদের দিকে চেয়ে রইল বেচারা।

নিষ্ঠুর চোখে পিটারকে দেখছে চারজন লোক। তাদের পরনে কুইল্টেড জ্যাকেট, মাথায় কালো উলের বেনি হ্যাট, হাতে কালো গ্লাভ্স্। যে দু’জন ভ্যান থেকে ছেঁচড়ে ওকে নামিয়ে এনেছে, এরা একেবারেই অচেনা।

অন্য দু’জনকে চিনতে পেরেই আঁৎকে উঠল পিটারের অন্তরাত্মা।

ঠোঁটে বাঁকা হাসি নিয়ে তাদের একজন বলল, ‘কী খবর, দোস্তো, পিটার হ্যানন?‘

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *