একান্ন
শুরু হয়েছে রন স্টুয়ার্টের দুর্গে রানা ও বেনের আচমকা হামলা। গেট পেরিয়ে ওরা ঢুকে পড়েছে তুষারভরা উঠানে। একের পর এক ছায়ার মাঝ দিয়ে এগিয়ে চলেছে। রানার বাম কাঁধে ঝুলছে বোমাভরা চটের থলে। ডানে পেছনের অন্ধকারে ছুটছে বেন হ্যানন। প্রথম থেকেই তার হৃৎপিণ্ডের কথা ভেবে দুশ্চিন্তা করছে রানা। তবে এখন পর্যন্ত দুর্ধর্ষ যোদ্ধার তরফ থেকে কোনও দুর্বলতার লক্ষণ দেখেনি।
দুর্গ থেকে এখনও পাল্টা হামলা করেনি শত্রুপক্ষ। রানা বুঝতে পারছে, শীঘ্রিই বোমাবর্ষণের বিস্ময় কাটিয়ে উঠবে তারা। আর তখন আগের চেয়ে অনেক সতর্ক হতে হবে ওদেরকে। উঠানে রাখা মিটসুবিশিগুলোর পাশে পৌছে গেল রানা। দুই আর তিন নম্বর লেখা দুটো বোমা থলে থেকে বের করে গড়িয়ে দিল দুটো গাড়ির নিচে। ওই দুটো বোমার আঘাতে ছিঁড়েখুঁড়ে আকাশে উঠবে তিন গাড়ি। তখন আশপাশে কেউ থাকলে বাঁচবে না। গাড়ির কাছ থেকে সরে গেল রানা। একবার ভাবল ডেটোনেট করবে বোমাগুলো, তারপর স্থির করল কাজটা করবে আরও পরে।
উঠান পেরিয়ে দুর্গের সিঁড়ির কাছে পৌঁছে গেল রানা ও বেন। এখন যে-কোনও সময়ে পাল্টা আক্রমণ করবে শত্রুপক্ষ। দেয়ালের পাশ দিয়ে হেঁটে দুর্গের পশ্চিম প্রাচীরের কাছে গেল ওরা। এদিকটা দুর্গের পেছনদিক। বাঁক নিয়ে ওরা দেখল তুষারের ভেতর স্তূপ তৈরি করেছে একগাদা পাথরখণ্ড ও বড় বোল্ডার। পাথরধসে ভেঙে পড়েছে উত্তর দিকের দেয়ালের একটা অংশ। বড় এক বোল্ডারের নিচে পিষে চ্যাপ্টা হয়ে গেছে দুর্গের কর্মচারীদের গাড়ি। পেছনদিকে ছিল বেশ কয়েকটা গ্যারাজ আর একতলা ঘর। পাথরবর্ষণে বাজে ধরনের ক্ষতি হয়েছে ওগুলোর। একপাশে দুটো শিপিং কন্টেইনারের সমান স্টিলের তৈরি এক দালান। সামনের দিকে লেখা হাই-ভোল্টেজ। রানা বুঝে গেল, ওই ঘর থেকেই সরবরাহ করা হয় দুর্গের বিদ্যুৎ। নিশ্চয়ই ওটার ভেতরে আছে ভোল্টেজ রেগুলেটর, ট্র্যান্সফর্মার আর ব্যাকআপ জেনারেটর। দালানের একপাশের দেয়াল থেকে সিমেন্টের কনডুইটের মাধ্যমে পুরু কেই গেছে দুর্গের ভেতর। প্রায় ছুটতে ছুটতে বিদ্যুৎ ভবনের কাছে পৌঁছুল রানা। ওটার ভেতর থেকে এল চাপা গুঞ্জন। চারপাশে পাথরধস হলেও ঠিকভাবে স্টুয়ার্টের দুর্গে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিচ্ছে যন্ত্রপাতিগুলো।
কিন্তু বেশিক্ষণের জন্যে নয়, ভাবল রানা। থলে থেকে চার নম্বর বোমা নিয়ে লাথি মেরে পাঠিয়ে দিল ইস্পাতের বৈদ্যুতিক দালানের নিচের প্ল্যাটফর্মের তলে। বেনকে ইশারা করে বড় একটা গ্যারাজের আড়ালে সরে গেল রানা। রেডিয়ো রিমোটের চার নম্বর চ্যানেল ডায়াল করে টিপে দিল সেণ্ড বাটন।
পাহাড়ে বোমা বিস্ফোরণের শব্দ দূরে থাকলেও কাছের বিস্ফোরণের বিকট আওয়াজে কাঁপল চারপাশ। ইলেকট্রিকাল দালান থেকে ছিটকে বেরোল শক্তিশালী শকওয়েভ। মুচড়ে গেল ইস্পাতের নিচের প্ল্যাটফর্ম। আকাশে উঠেছে আগুনের গোলা আর একরাশ কালো ধোঁয়া। পেরেকের মত অজস্র লোহার শ্যাপনেল ছুটছে নানাদিকে। একইসময়ে দপ করে নিভে গেল দুর্গের সমস্ত বাতি। রানাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে খুশির হাসি হাসল বেন হ্যানন। তার শেখানো বিদ্যা ঠিকভাবেই মনে রেখেছে প্রিয় শিষ্য।
ছুটতে ছুটতে দুর্গের পেছন দরজায় পৌঁছুল রানা আর বেন, হাতে উদ্যত পিস্তল। দু’জনই ভাবছে, একটু আগের দুই ডাইভার্শনের জন্যে সুবিধে পাবে। প্রথমেই চমকে দিয়েছে প্রস্তরবর্ষণ করে। ফলে দুর্গের ভেতর ছড়িয়ে পড়বে ডিযঅনারেবলরা। খুঁজতে শুরু করবে ওদেরকে। এক এক করে তাদেরকে কাবু করার সুযোগ পাবে ওরা। আর দ্বিতীয় ডাইভার্শনের কারণে, মিলিটারি ট্রেইনিং অনুযায়ী দুই বা তিনজনের দল গড়বে ডিযঅনারেবলরা। ধরেই নেবে, ছোট ছোট দল তৈরি করেছে বলে আগের চেয়ে দক্ষতার সঙ্গে পাল্টা হামলা করতে পারবে আক্রমণকারীর ওপর। সেক্ষেত্রে একে একে দলগুলোর সঙ্গে লড়ার সুযোগ পাবে রানা আর বেন।
একটু পর রানা বুঝল, ঠিকভাবেই কাজ করছে ওর প্ল্যান। পেছনের দরজার তালা বিকল করে দুর্গের ভেতরে ঘুটঘুটে আঁধারে ঢুকে পড়ল ওরা। ভাল করেই জানে, যে- কোনও সময়ে সামনে থেকে আসবে হামলা।
চওড়া করিডোর ধরে এগোতে গিয়ে একটু পর দূরে দুটো ট্যাকটিকাল ওয়েপন লাইট দেখল ওরা। ধীর পায়ে ওদের দিকেই আসছে লোকদু’জন। একবার এদিকে আবার ওদিকে ফেলছে আলো। অন্ধকারে কোনও শত্রুকে দেখলেই গুলি ছুঁড়বে। রানা আগেই ধরে নিয়েছে, ভারী অস্ত্র নিয়ে হাজির হবে ডিযঅনারেবলরা, কাজেই বিস্মিত নয়।
কোনও সুযোগই পেল না শত্রুপক্ষ। তাদের অস্ত্রে সংযুক্ত জ্বলন্ত বাতি দেখিয়ে দিচ্ছে কোথায় আছে তারা। অন্ধকারে শত্রুকে পিস্তলের গুলিতে গেঁথে ফেলার ট্রেইনিংটা ভালভাবেই কাজে লাগাল রানা আর বেন।
সাবমেশিন গানের একপশলা গুলির মত চারবার গর্জে উঠল ওদের হাতের পিস্তল। হোঁচট খেল বাতিদুটো। গুলি লেগে ধুপ করে মেঝেতে পড়ল দুই ডিযঅনারেবল। ছুটে তাদের সামনে পৌঁছে গেল রানা ও বেন। দুই শত্রুর একজন হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে বসতে চাইছে। তবে এখন শত্রুকে দয়া দেখাবার সময় নেই। সরাসরি তার মাথায় গুলি করল রানা। লাশ হয়ে মেঝেতে নেতিয়ে পড়ল লোকটা।
তবে এরা কেউ বাক ওয়াকি নয়। একজনের একটা কান নেই। অন্যজনের মুখের বামদিকে কালো পট্টি। লোকটা ছিল কানা।
‘আগের মতই পাশাপাশি লড়ছি, তাই না, রানা?’ হাসল বেন। নতুন করে লড়তে পেরে খুশি। রানা জবাব দেয়ার আগেই থরথর করে কেঁপে উঠল রানার পকেটে মোবাইল ফোন। কল এসেছে। সামান্য দ্বিধা নিয়ে লোকটার পকেট থেকে ফোন নিয়ে কল রিসিভ করল রানা। চুপ করে আছে। ওদিক থেকে ভারী গলায় বলল কেউ, ‘কানা ফকির? গুলির আওয়াজ পেলাম। কী হয়েছে? ওকে পেয়েছ?’ কণ্ঠস্বর বাক ওয়াকির নয়,।
‘না, আমরা কানা ফকিরকে পেয়েছি,’ বলল রানা। ‘এবার তোমাদেরকেও খুঁজে নেব।’
লোকটা কিছু বলার আগেই কল কেটে দিল রানা। কোমরে পিস্তল গুঁজে পকেটে রাখল মোবাইল ফোন। দুই মৃত ডিযঅনারেবলের অস্ত্র সংগ্রহ করল ওরা। লোকদু’জন ব্যবহার করছিল রোমানিয়ান মিলিটারি একে-৪৭। অস্ত্রগুলোর সঙ্গে আছে আধুনিক প্রতিটি সুযোগ-সুবিধা। ম্যাগাযিনে ত্রিশটা বুলেট। রাইফেল সেট করা ছিল ফুল অটোমেটিক ফায়ার মোডে। স্কটিশ হাইল্যাণ্ডের গ্রাম্য এলাকায় পাওয়া যায় না এই জিনিস।
‘এরা ঝামেলার জন্যে তৈরি,’ বিড়বিড় করল বেন।
‘যা চেয়েছে, পেয়ে গেছে,’ বলল রানা।
অস্ত্রদুটোর বাতি নিভিয়ে নিঃশব্দে এগোল ওরা।
নীরব নয় ওদের শত্রুপক্ষ। একটু দূরে চিৎকার করে দরজা বন্ধ করার শব্দ শুনল রানা ও বেন। করিডোরে বাঁক নিয়ে ভূতের মত চলল ওরা। সামনেই পাথুরে এক খিলান। ওদিকেই একে একে দরজা খুলে ভেতরে আলো ফেলে দেখছে আরও দুই ডিযঅনারেবল। প্রচুর আওয়াজ করছে তারা। মিলিটারিতে চাকরি করলেও ভাল যোদ্ধা ছিল না। তাদের পনেরো ফুটের ভেতর পৌঁছে রাইফেলের বাতি জ্বেলে নিল রানা আর বেন। গাড়ির হেডলাইটের উজ্জ্বল বাতির সামনে পড়া খরগোশের মত চমকে গেছে শত্রুপক্ষ।
তাদের একজন চড়ুই পাখির মত হালকা। চোখও পাখির মত পিটপিট করে। অন্যজন মোষের মত বিরাট। একপশলা গুলির আঘাতে পাখি-চোখের বুক ঝাঁঝরা করল বেন হ্যানন। দানবের মাথায় বিধল রানার তিনটে গুলি। হাত থেকে অস্ত্র ফেলে পিছিয়ে গিয়ে কাত হয়ে মেঝেতে পড়ল লোকটা।
বিড়বিড় করল রানা, ‘বিদায় নিল এদের আটজন। রয়ে গেছে আরও সাতজন।’