আটচল্লিশ
‘ভাল করে দেখে নাও, বাছা,’ মৃদু হেসে বলল বেন হ্যানন। ‘মনটা ভাল হয়ে যাবে।’
মিথ্যা বলেনি প্রাচীন যোদ্ধা।
জানালা দিয়ে যেন আলো বের না হয়, সেজন্যে লণ্ঠনটা হাত দিয়ে আড়াল করে রেখেছে বেন হ্যানন। ঘরের একপাশে সরে গেছে ওরা। ডানজন থেকে মুক্ত হয়ে এই কুটিরে আসার পর বসে থাকেনি প্রাক্তন এসএএস সার্জেন্ট। একটা বেঞ্চির ওপরে এখন খোলা প্যাকিং কেস। ওটার ভেতরে রয়েছে টেপ দিয়ে মুড়িয়ে রাখা হলদে স্প্রে-পেইণ্ট করা ছোট সব ক্যান। একটা তুলে নিয়ে রানার হাতে দিল বেন।
ক্যানের ভেতরে রানা দেখল আধ পাউণ্ডের সাদাটে কাদা। একেকটা প্রমাণ সাইযের আলুর মত। হাতে নিয়েই ও বুঝল, ওটা কাদামাটি নয়। ওর মনে পড়ল, আগেও ব্যবহার করেছে এই জিনিস।
‘যা ভাবছি, এটা কি সেই জিনিসই?’
হাসল বেন হ্যানন। আলো পড়ে ঝিক করে উঠল তার ওপরের পাটির একটা দাঁত। ‘অবশ্যই সেই জিনিস, বাছা।’
গুরুর দিকে তাকাল রানা। ‘এবার বলুন তো, কোথায় পেলেন আরডিএক্স হাই এক্সপ্লোসিভ?’
‘এখানেই। সবমিলে চল্লিশটা। হাফ পাউণ্ডের।’ র্যাকের পাশের বড় ক্রেট দেখাল বেন। ‘আরও আছে একুশটা ডেটোনেটর। অবশ্য শুধু এগুলোই পাইনি, আরও কিছু আছে।’
নিজের কানকে বিশ্বাস করতেও দ্বিধা হলো রানার। চারপাশে তাকাল। কুটিরে আছে বাড়ি তৈরির নানান যন্ত্রপাতি আর রসদ। বুঝে নিল, মাত্র কয়েক বছর আগে উঁচু পাহাড়ের কোলে স্টুয়ার্টের দুর্গ তৈরি করতে গিয়ে পাহাড়ি ঢাল থেকে সরানো হয়েছে হাজার হাজার টন নিরেট পাথর। এবং তা করা হয়েছে আরডিএক্স হাই এক্সপ্লোসিভ ব্যবহার করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ওটা তৈরি করে ব্রিটেনের রয়েল আর্সেনাল। নাম দেয়া হয় রিসার্চ ডিপার্টমেন্ট এক্সপ্লোসিভ। সংক্ষেপে আরডিএক্স। উনিশ শ’ তেতাল্লিশ সালে নাযি জার্মানির নদীর বাঁধ ভাঙতে ওটা ব্যবহার করেছিল ব্রিটিশ আর্মি। এত বছর পরেও বোমা তৈরির জরুরি মশলা হিসেবে নানান দেশের আর্মি ব্যবহার করছে আরডিএক্স। সহজে বিস্ফোরিত হয় না, ফলে টেরোরিস্টদের পছন্দের জিনিস। টিএনটি বা ডিনামাইটের চেয়ে ঢের নিরাপদ। সারাদিন ধরে হাতুড়ি দিয়ে পেটালে, গুলি চালালে বা আগুনে ফেলে দিলেও ফাটবে না। তবে ডেটোনেটর বা ব্লাস্টিং ক্যাপের গুণে ওটা মুহূর্তে হয়ে উঠবে ভয়ঙ্কর বোমা। সেমটেক্স বা প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ তৈরির সময় কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয় আরডিএক্স। পুরনো বাড়ি ধসিয়ে দিতে নিয়মিত কাজে লাগায় কর্মাশিয়াল ডেমোলিশন কোম্পানিগুলো।
‘দুর্গ তৈরির সময় বোধহয় কয়েক ট্রাক আরডিএক্স এনেছিল লোকটা,’ মন্তব্য করল রানা।
‘কাজ শেষে রয়ে গেছে আরও কিছু,’ বলল বেন। ‘ভাল করত নষ্ট করলে বা নিরাপদ কোথাও রাখলে। সত্যিই বড় বাজে জিনিস। আর এটাই হবে তাদের সর্বনাশের কারণ।’ বেঞ্চের ওপর রাখা আরও দুটো কার্ডবোর্ড বক্স দেখাল সে।
দুই বাক্সে আছে ডেটোনেটর যুক্ত বিশটা আরডিএক্স।
প্রতিটা এক পাউণ্ডের বোমা। ডিভাইসগুলোতে হলদে স্প্রে পেইণ্ট দিয়ে সংখ্যা লিখে নিয়েছে বেন হ্যানন। ‘এটা দ্যাখো,’ একটা ওয়াকি-টকি দেখাল। ওটা আসলে রেডিয়ো রিমোট ডেটোনেটর। দূর থেকে বোমা ফাটিয়ে দেয়ার কাজে ব্যবহার হয়।
‘দরকারি খেলনা,’ বলল রানা।
‘গাধাগুলো আরও কিছু জিনিস রেখে গেছে, ‘ বেঞ্চের তলা থেকে গুটিয়ে রাখা নীল নাইলনের দড়ির মত কী যেন বের করল বেন হ্যানন।
‘ডেটোনেটর কর্ড,’ নিচু গলায় বলল রানা।
‘এক শ’ গজেরও বেশি।’
এবার নিজের পরিকল্পনার কথা খুলে বলল বেন হ্যানন। ওরা ব্যবহার করবে বিশ পাউণ্ড আরডিএক্স। সব শেষে জানতে চাইল, ‘তোমার কী মনে হয়, রানা? এতে হবে না?’
‘স্টুয়ার্ট ভাববে, আপনি খেপে আগুন হয়ে যাওয়া খোদ ইবলিস মিঞা,’ বলল রানা।
হাসল বেন হ্যানন রানার প্রশংসায় খুশি হয়ে। ‘তা হলে চলো, বাছা, ওদেরকে একটু দেখিয়ে দিই কীভাবে কাজ করি আমরা!’ রানা হাজির হওয়ার আগে বোমা তৈরির কাজে ব্যস্ত ছিল মানুষটা, প্রস্তুতি নিচ্ছিল একা যুদ্ধ করার।
উষ্ণ হিটারের ধারে বসে পরের দশটা মিনিটে এক শত গজ ডেটোনেটর কর্ডে বিশটা বোমা যুক্ত করল ওরা। প্রতি পাঁচ গজ দূরে একটা করে সাদাটে দলা। কর্ডের শেষমাথায় ব্লাস্টিং ক্যাপ। কাজ শেষ হলে পুরো কর্ড গুছিয়ে নিল বেন হ্যানন। এসময়ে অন্য বিশটা বোমা বাক্স থেকে নিয়ে পুরনো চটের এক ব্যাগে পুরল রানা।
কাজ শেষে ট্র্যান্সপোর্টের দিকে মন দিল ওরা। বাইরে তুষারঝড়ের ভেতর হেঁটে যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে আপত্তি আছে ওদের। কয়েক মুহূর্ত পর রানা বুঝল, আগেই পোলারিস ইউটিলিটি ভেহিকল পরীক্ষা করে রেখেছে ওর ওস্তাদ। গাড়ির টাঙ্কিতে ফিউল যেমন আছে, তেমনি হাওয়াও আছে চাকার ভেতর। যন্ত্রটার ওপর থেকে তারপুলিন সরাল ওরা। যত্নের সঙ্গে গাড়িতে রাখল নীল কর্ডে যুক্ত আরডিএক্স আর বোমাভরা চটের ব্যাগ। পকেটে গ্রেগরি বেলের মোবাইল ফোনের পাশে রেডিয়ো রিমোট কন্ট্রোল রাখল রানা। বেন হ্যাননের হাতে দিল কোয়ার্টের মোবাইল ফোন। ওদের দুই ফোন স্পিড-ডায়াল করে নিয়েছে ওরা। যুদ্ধের সময় জরুরি আলাপ করতে পারবে নিজেদের ভেতর।
স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান তৈরি করে পোলারিসে উঠল ওরা। হুইলের দায়িত্ব নিল রানা। পাশের সিট থেকে ওকে হাতের ইশারা করল বেন হ্যানন। রানা ইগনিশনের চাবি মুচড়ে দিতেই চালু হলো ছয় শ’ সিসির সিঙ্গেল-সিলিণ্ডার ইঞ্জিন। কুটিরের দরজায় গিয়ে পড়ল উজ্জ্বল হেডলাইট। সিটবেল্ট বেঁধে নিল ওরা। ওস্তাদের দিকে চেয়ে হাসল রানা, ‘রেডি?’
‘আবার জিগায়!’
‘তো চললাম!’ গিয়ার দিয়ে অ্যাক্সেলারেটর মেঝের সঙ্গে চেপে ধরল রানা। চাবুক খাওয়া ঘোড়ার মত লাফিয়ে এগোল গাড়িটা। পরক্ষণে পলকা দরজা উড়িয়ে বেরিয়ে গেল তুমুল তুষারঝড়ের ভেতর। চারপাশে উড়ছে সফেদ তুষারকণার তৈরি পুরু চাদর।
এবড়োখেবড়ো জমিতে নাচতে নাচতে ছুটছে পোলারিস ভেহিকেল। তুষার যেখানে গভীর, বাধ্য হয়ে নিচু গিয়ার ব্যবহার করছে রানা। মাটি কামড়ে গড়িয়ে চলেছে পুরু চার চাকা। তুষারঝড় ভেদ করে দূরে গেছে হেডল্যাম্পের শক্তিশালী সাদা রশ্মি। এরই ভেতর দিন শেষে নেমে গেছে সন্ধ্যার আঁধার। এখন ঝড়ের ভেতর সহজে ওদেরকে দেখতে পাবে না কেউ।
রানা বুঝে গেছে, দুর্গে যারা নিজেদেরকে নিরাপদ ভাবছে, জানে না একটু পর কী ধরনের বিপর্যয় শুরু হবে!