বেয়াল্লিশ
মা-বাবা গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যাবার পর থেকে বহুদিন পর্যন্ত প্রায়-রাতেই দুঃস্বপ্ন দেখত রানা। আটকা পড়েছে বিশাল এক বাড়িতে। করিডোরগুলো অন্ধকার ও ভুতুড়ে। প্রতিটা দরজা বন্ধ। রানা যতই চেষ্টা করুক, কোনও দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে পারত না। চিরকালের জন্যে বন্দি থাকত। এটাও বুঝত, দরজা খুললেই ভয়ঙ্কর কোনও দানব শেষ করে দেবে ওকে। এক এক করে প্রতিটি দরজায় গিয়ে দাঁড়াত। তখনই টের পেত অন্ধকারে ওর দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে সাক্ষাৎ মৃত্যু। তবে দুঃস্বপ্ন বলে কথা, একসময় না একসময় চমকে উঠে ফুপুর বাড়িতে নিজের বেডরুমে ঘুম ভাঙত ওর। দরদর করে ঘামলেও আসলে মারধর করেনি কোনও দানব।
অবশ্য এই মুহূর্তে যা ঘটছে, তা দুঃস্বপ্ন নয়। জেগে উঠলেই রেহাই পাবে না এ থেকে। ওর সামনে আছে একের পর এক দরজা, যে-পথে আসবে নিদারুণ ব্যথা ও কষ্টকর মৃত্যু। ও সত্যিই বড় একা। হাতে এত সময় নেই যে বন্ধুদের কাছে সহায়তা চাইবে। দ্রুত ফুরিয়ে আসছে সময়। পুলিশের কাছে যেতে পারবে না। তাদের কে যে ভাল, আর কারা দুর্নীতিপরায়ণ, বোঝার উপায় নেই। বিকৃত রুচি আর জঘন্য মন-মানসিকতার নিষ্ঠুর জানোয়ার রন স্টুয়ার্ট ও তার সাক্ষাৎ পিশাচ অনুচরদের হাতে বন্দি জেসিকা আর বেন হ্যাননকে ফেলে নিজের প্রাণ বাঁচানোর কথা ভাবতেই পারবে না ও।
আসলে এই মুহূর্তে মাত্র একটা পথই খোলা আছে রানার সামনে। স্টুয়ার্টের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে ওকে। পরে সুযোগ পাওয়া গেলে পাল্টে দেবে পাশার দান। অথবা, মৃত্যুর আগে ভেবে নেবে, ওর গুরু আর জেসিকাকে একা সহ্য করতে হয়নি মরণযন্ত্রণা।
এই মুহূর্তে ভেবেচিন্তে কোনও পরিকল্পনা তৈরি করার কোনও সুযোগ নেই। মুদি দোকানের বাইরে ফুটপাথে ব্যাগটা রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল রানা। খাবারগুলো আর কাজে লাগবে না। ওর হাতের চাপে মুড়মুড় করে ভাঙল গ্রাহামের মোবাইল সেট। ওটাও আর চাই না। হঠাৎ করে খুব শান্ত হয়ে গেল রানার মন। কয়েক পা গিয়ে উঠে পড়ল মরিস মাইনর গাড়িতে। ইঞ্জিন চালু করে ভাবল, এবার যেতে হবে শৈশবের সেই দানবের আস্তানায়।
মনের আয়নায় যে ম্যাপ আগেই এঁকেছে রানা, তাতে কিনলোকার্ড গ্রামের দক্ষিণে কয়েক মাইল গেলেই পৌঁছে যাবে স্টুয়ার্টের দুর্গে। ঝড়ের বেগে গ্রাম থেকে বেরিয়ে এল মরিস মাইনর। তুষারের কণা পড়তে না পড়তেই সাঁই-সাঁই করে উইণ্ডস্ক্রিন পরিষ্কার করছে দুই ওয়াইপার। পিচ্ছিল পথে হড়কে যাচ্ছে ক্ষয়ে যাওয়া চাকা। কেন যেন রানার মনে কোনও উত্তেজনা নেই।
বেশ কিছুক্ষণ পর অরণ্যের মাঝে সরু এক পথ দেখে বুঝল, কাছেই স্টুয়ার্টের এস্টেট। জঙ্গুলে পথে ক’বার বাঁক নেয়ার পর সামনে পড়ল উঁচু রট আয়ার্নের বন্ধ ফটক। ওটার দু’দিকে দূরে চলে গেছে বিশফুট উঁচু প্রাচীর। ফটকের দু’দিকের গেটপোস্টে আছে প্রমাণ আকৃতির দুটো ধূসর পাথরের সিংহ। ফটকের সামনে রানা থামতেই খুলে গেল কবাটের মাঝে ছোট এক দরজা। ওই পথে এল এক লোক। অন্যজন রয়ে গেল গেটের ওদিকে। তাদের দেখে ডিযঅনারেবল বলে মনে হলো না রানার। এরা বোধহয় সিকিউরিটি স্টাফের সদস্য। প্রথমজন এসে দাঁড়াল রানার পাশের জানালার ধারে। চোখে-মুখে দ্বিধা। আগে কখনও এই এস্টেটে পঞ্চাশ বছরের পুরনো গাড়িতে চেপে কাউকে আসতে দেখেনি। নিজের নাম জানাল রানা। সোজা হয়ে দাঁড়াল সিকিউরিটির লোকটা। ঘুরে হাতের ইশারা করল সঙ্গীর প্রতি। কয়েক সেকেণ্ড পর খুলে গেল দুই ফটক। হাতের ইশারায় জানিয়ে দেয়া হলো, দুর্গের দিকে যেতে পারে রানা।
সবুজ গাছে ছাওয়া বিশাল উঁচু এক পাহাড়ের দিকে গেছে স্টুয়ার্টের ব্যক্তিগত জঙ্গুলে পথ। কয়েক ধাপে ওপরে উঠেছে পাহাড়। চূড়াটাকে ঘিরে নিয়েছে কুয়াশার চাদর। কর্মচারীদের কটেজ পাশ কাটিয়ে এগোল রানা। দু’পাশে তুষারে ছাওয়া সবুজ মাঠে চরছে হাইল্যাণ্ডের প্রকাণ্ড সব গরু। একটু পর জঙ্গলের মাঝে বাঁক নিল সরু পথ। ওদিকে একটু দূরেই দেখা গেল প্রিন্স (?) রন স্টুয়ার্টের সাধের দুর্গ।
ইন্টারনেটের গুণে এ দৃশ্যের ছবি আগেও দেখেছে রানা। তবে দুর্গ আর এই এলাকা যে এতটা বিশাল, আগে ভাবতে পারেনি। কারও বোঝার সাধ্য নেই তুষারে ছাওয়া পাহাড়ের কোলে ওই দুর্গ আসলে মাত্র কয়েক বছর আগে তৈরি। নানাদিকে টারেট, টাওয়ার ও ব্যাটেলমেন্ট। হলিউডের শত শত কোটি ডলারের সিনেমার দৃশ্য হলেই বেশি মানিয়ে যেত। রানার মনে হলো, যে-কোনও সময়ে দুর্গের ভেতর থেকে সাদা ঘোড়ায় চেপে তলোয়ার ও বর্শা হাতে তেড়ে আসবে একদল প্রাচীন স্কটিশ যোদ্ধা। প্রকাণ্ড দুর্গটাকে দূর থেকে ঘিরে রেখেছে উঁচু প্রাচীর। খোলা উঁচু ফটক পেরিয়ে উঠানে এসে গাড়ি থামাল রানা। সামনেই দুর্গের প্রথমতলায় উঠে গেছে চওড়া পাথরের সিঁড়ি। ওখানে দাঁড়িয়ে কঠোর চোখে ওকে দেখছে তিনজন লোক। বামেরজনকে আগে দেখেনি রানা। একটু আগে মেইন গেটে যে দু’জনকে দেখেছে, এই লোক তাদের মত নয়। ডানে দাঁড়িয়ে আছে পরিচিত এক খুনি। ওই লোকই বিলি ম্যাকগ্রা খুন হওয়ার পর ট্রেইলার থেকে লাফিয়ে নেমে পালিয়েছিল।
তিনজনের দলের মাঝে আছে বাক ওয়াকি। অন্য দু’জনের তুলনায় কিছুটা বয়স্ক। কর্নেল কার্ল হপকিন্সের ফাইলের সেই ছবির চেয়ে একটু চিকন। পরনে সুট। গলায় টাই। তাকে কেন যেন করপোরেট বডিগার্ড বা সিক্রেট সার্ভিস এজেণ্ট বলেই মনে হলো রানার। হোলস্টার সহ আগ্নেয়াস্ত্র ফুলে আছে টেইলার দিয়ে তৈরি করা দামি সুটের একপাশে। অন্য দু’জনের কোমরেও পিস্তল। এরা যে ভাড়াটে খুনি, বুঝতে দেরি হলো না রানার। ওকে দেখে সামান্য হলেও নার্ভাস হয়েছে তারা। গাড়ির দরজা খুলে নেমে পড়ল রানা।
‘দু’হাত দু’দিকে মেলে দাও,’ বলল বাক ওয়াকি। ‘দুই পা ফাঁক করে দাঁড়াবে।’
ওকে সার্চ করতে দিল রানা। টের পেল, নিজের কাজে অত্যন্ত দক্ষ বাক ওয়াকি। তার দুই লোক তল্লাসী করল গাড়ি। ব্যাগের ভেতরে চোখ বোলাল। আসার পথে লক আরডাইকের তীরে থেমে সব অস্ত্র পানিতে ফেলেছে রানা। ওগুলোর সঙ্গে পানির নিচে ঠাঁই পেয়েছে গোলাগুলি ও তীর।
ওর ওয়ালেট আর ফোন নিয়ে বলল বাক ওয়াকি, ‘এর কাছে কোনও অস্ত্র নেই।’
‘এখানেও কিছু নেই,’ গাড়ির কাছ থেকে বলল বিলি ম্যাকগ্রার খুনি। সন্তুষ্ট হয়ে মাথা দোলাল বাক ওয়াকি। কয়েক পা পিছিয়ে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেখল রানাকে। ‘তা হলে তুমিই সেই এসএএস ফোর্স থেকে ট্রেইনিং নেয়া বাংলাদেশি অফিসার। তোমাকে দেখার জন্যে অধীর আগ্রহে ছিলাম।’
‘তো, তুমিই সেই পাথফাইণ্ডার, যে কি না নিজের পথ হারিয়ে ফেলেছ?’
রানার কথা শুনে লালচে হলো বাক ওয়াকির মুখ। ‘ঠিক আছে, এসো। বস্ তোমার জন্যে অপেক্ষা করছেন।
রানাকে পথ দেখাল তারা, সতর্ক। সিঁড়ি বেয়ে উঠে কারুকাজ করা ওক কাঠের ডাবল দরজার সামনে গিয়ে থামল। খুলে গেল কবাট। ভেতরে প্রকাণ্ড গ্র্যাণ্ড হল। মেঝে কে ফ্ল্যাগস্টোনের। দরজার দু’পাশে বর্শা ও কুঠার সহ দুটো-দুটো করে চারটে আর্মার সুট। রানার মনে হলো, হয়তো খুব কঠিন হবে না আর্মার সুটের একটা বর্শা নিয়ে এই তিনজনকে খতম করে দেয়া। তবে মনের কথা মনেই রাখল ও।
‘এদিকে,’ পথ দেখাল ওয়াকি। হলওয়ে পেরিয়ে চওড়া এক করিডোরে পড়ল ওরা। দু’দিকের দেয়ালে ঝুলছে শিংওয়ালা হরিণের স্টাফ করা মাথা। চকচকে কাঁচের চোখগুলো যেন দেখছে রানাকে। ডানে-বামে পেছনে পড়ছে পালিশ করা ওক কাঠের দরজা। দৃশ্যটা যেন রানার ছোটবেলায় দেখা সেই দুঃস্বপ্নের অংশ। এখান থেকে রেহাই নেই ওর। কোনভাবেই বাঁচাতে পারবে না বেন হ্যানন বা জেসিকাকে। শেষমেশ মরবে ওরা চরম কষ্ট পেয়ে। গলা শুকিয়ে গেলেও নির্বিকার মুখে হেঁটে চলেছে রানা। করিডোর ফুরিয়ে এলে সামনে পড়ল আরেকটা চওড়া ডাবল ডোর। চারজনের দলটা থেমে যেতেই রানার পেছনে রয়ে গেল বিলি ম্যাকগ্রার খুনি এবং তার সঙ্গী। বিপদ এলেই প্রতিহত করবে তারা। কয়েক পা বেড়ে দরজায় টোকা দিল বাক ওয়াকি। তারপর দরজা খুলে ঘুরে তাকাল রানার দিকে। ‘ভেতরে ঢোকো।’
চুপচাপ রাজকীয় ঘরটার ভেতর পা রাখল রানা।
দেয়ালে দেয়ালে কালচে কারুকাজ করা দামি কাঠের প্যানেল। ছাত থেকে নেমেছে দামি পর্দা। পার্কুয়েট মেঝে ঝিকঝিক করছে আয়নার মত। ঘরের মাঝে হাতে বোনা কেল্টিক নট ডিযাইনের পুরু কার্পেট। দেয়াল ঘেঁষে একের পর এক চকচকে আর্মার সুট। ওগুলোর সঙ্গে রয়েছে দু’হাতে ব্যবহার করতে হয় এমন চওড়া ফলার ক্লেমোর তলোয়ার। একপাশের র্যাকে সারি সারি পুরনো ফ্লিন্টলক মাস্কেট ও স্কটিশ ড্যাগার। ঘরের পেছনে কারুকাজ করা প্রকাণ্ড ফায়ারপ্লেসে জ্বলছে গনগনে আগুন। ওপরের ম্যান্টলপিসে সোনাপানি করা বড় এক অয়েল পেইন্টিঙের লোকটা বোধহয় ঐতিহাসিক কোনও চরিত্র।
ফায়ারপ্লেসের উল্টোদিকে ছাতছোঁয়া জানালার সামনে দাঁড়িয়ে তুষার ছাওয়া দুর্গের উঠান দেখছে স্টুয়ার্ট।