1 of 2

স্বর্ণলিপ্সা – ৪০

চল্লিশ

হেঁটে চলেছে রানা ও জেসিকা। চারপাশে কোথাও নেই বাড়ি, কটেজ বা খামার। ডানে গেলেই ভাল হতো, ভাবছে রানা। পাশে নীরবে হাঁটছে জেসিকা। শীতের প্রকোপে আপেলের মত লালচে হয়েছে ওর দুই গাল। কোনও দিকেই নেই জনমানবের চিহ্ন। রানা বুঝল, ওর মত একই কথা ভাবছে মেয়েটা।

আরও কয়েক মাইল পেছনে ফেলল ওরা। তারপর দূর- পাহাড়ের ওপার থেকে অগ্নিঝড়ের মত ছিটকে এল ভোরের সূর্যের লাল-সোনালি-বেগুনি আলোকচ্ছটা। শুরু হলো মন ভাল করে দেয়ার মত চমৎকার একটা সকাল। কিন্তু রানার মনে হলো আড়াল থেকে কে যেন চরম দুশমনি করছে ওর সঙ্গে। একটু আগেও সময়কে মনে হচ্ছিল ধীরগতি। এখন হাতঘড়ির দিকে চেয়ে বুঝল, বড়বেশি দ্রুত ঘুরছে কাঁটা। আর মাত্র তিনঘণ্টা পর দেখা করতে হবে স্টুয়ার্টের সঙ্গে।

রানা ও জেসিকা যখন ভাবছে শেষ নেই সীমাহীন এই জঙ্গুলে এলাকার, সেই সময়ে তুষারে ভরা সরু এক পথের শেষে ওরা দেখতে পেল মাঝারি একটা খামারবাড়ি।

গ্রাম্য এলাকায় পৌঁছে গেছে ওরা। ফাটল ধরা সিমেন্টের চাতালের ওদিকে প্রায় ধসে পড়া বাড়ি। পাথুরে দেয়ালে সবুজ শেওলা। সেই কবে গায়েব হয়ে গেছে জানালার কাঁচগুলো। দু’দিকের ছোট ঘরগুলোও বোধহয় পরিত্যক্ত। রানার মনে হলো, অন্তত তিরিশ বছর আগে এখান থেকে চলে গেছে জমির মালিক। তবে সেটা ভাবতে গিয়েও দ্বিধা এল মনে, কারণ বাড়ির সামনের উঠানে দেখা যাচ্ছে দুটো গাড়ি। প্রথমটা পুরনো এক মরিস মাইনর, অন্যটা চোখকানা প্রাচীন এক ফোক্সভাগেন বিটল। জং ধরে এখানে-ওখানে খসে পড়ছে ওটার বডি। এবড়োখেবড়ো সব গর্তে অনায়াসেই মুঠো ভরে দিতে পারবে রানা।

‘ভাবছ এটা কারও বাড়ি?’ জানতে চাইল জেসিকা।

‘গিয়ে দেখি।’ ওই দুই গাড়ি কিনে নেয়ার টাকা রানার কাছে আছে। লাগবে যদিও মাত্র একটা। মরিস মাইনরটার দিকেই মন টানছে ওর। দুই পুরনো গাড়ি পাশ কাটিয়ে খামারবাড়ির দরজায় গিয়ে টোকা দিল রানা। অনেকেই অচেনা কারও কাছে গাড়ি বিক্রি করতে রাজি হয় না। কিন্তু হাসিভরা মুখে প্রচুর টাকা নিয়ে কেউ হাজির হলে তার কথা আলাদা। দুই কানের কাছে দুই ঠোঁট নিয়ে বিশাল এক হাসি মেলল রানা। দেখা যাক কী ঘটে।

বার কয়েক টোকা দিলেও ভেতর থেকে সাড়া দিল না কেউ। এবার আগের তিনগুণ জোরে নক করল রানা। তাতে বাড়ির ভেতর শুরু হলো জুতো পরা পায়ের আট-দশটা ধুপধাপ আওয়াজ। কে যেন চাপা স্বরে বলল, ‘আসছি!’ কয়েক মুহূর্ত পর কয়েক ইঞ্চি খুলে গেল দরজার কবাট। সেই ফাঁকে দেখা দিল মাথা-ন্যাড়া, শুকনো এক মাঝবয়সী লোক। জড়ানো কণ্ঠে বলল সে, ‘কে? জোনাস নাকি?’

একপলকে রানা বুঝে গেল ড্রাগসে ডুবে আছে লোকটা দরজার ওদিক থেকে ভকভক করে আসছে গাঁজা, চরস ও নানান ড্রাগের ধোঁয়া। জলে ভরা দুই ঝাপসা চোখে দরজার সামনে অচেনা দু’জন মানুষকে দেখে লোকটা বুঝল, এরা কোনমতেই জোনাস নয়। তাতে ভীষণ চমকে গেল সে। টলমল করে আবারও বন্ধ করে দিল দরজা। ফাটা গলায় হেঁকে উঠল, ‘অ্যাই, জলদি পালাও! বাইরে শালার পুলিশ!’

বাইরে থেকে বলল রানা, ‘ভয় পাবেন না। আমরা পুলিশ নই।’ অর্ধসত্য বলেছে ও।

কিন্তু ওর কথা সত্যি কি না তা জানার আগ্রহ নেই বাড়ির মানুষগুলোর। হাউমাউ করে উঠেছে সবাই মিলে, কী বলছে বোঝা যাচ্ছে না। আঁউ-আঁউ করে বিশ্রী আওয়াজে কেঁদে উঠল এক নারীকণ্ঠ। আরেকজন ধমকে উঠল, ‘গাধা-শুয়োর কোথাকার, তুই দরজা খুলতে গেলি কেন?’

জবাবে মধ্যবয়স্ক বলল, ‘ভেবেছি হারামজাদা জোনাস! তুইও তো তাই ভেবেছিলি!’

‘জমজমাট পার্টি ভেঙে গেছে,’ শুকনো গলায় বলল জেসিকা।

কয়েক সেকেণ্ড পর ওরা শুনল খুলে গেছে বাড়ির পেছন দরজা। পায়ের ধুপধাপ আওয়াজ এল ওদিক থেকে।

দরজা খুলে সামনের ঘরে পা রাখল রানা। মেঝেতে ধুলোভরা ঝুল। দেয়ালে দেয়ালে সবজেটে-ধূসর ফাংগাস- দরজার কাছের দেয়ালে তিনটে পেরেকে ঝুলছে কয়েকটা চাবি। তার ভেতর থেকে মরিস মাইনর গাড়িটার চামড়া দিয়ে তৈরি রিংটা নিল রানা। খুশিমনে বলল, ‘সহজেই পেলাম। গাড়ি চালু হলে বেশিক্ষণ লাগবে না গ্রামে পৌঁছে যেতে।’

‘তুমি তো বলেছিলে গাড়ি কিনে নেবে,’ আপত্তির সুরে বলল জেসিকা।

‘তাই কিনতাম। কিন্তু ওদেরকে টাকা দিলেই ড্রাগ্‌স্‌ কিনে শরীরের ক্ষতি করবে। আমি অত খারাপ মানুষ নই যে সেটা হতে দেব।’

‘কথাটা বোধহয় ঠিক।’

ওদের অমন ক্ষতি করা একদম অনুচিত।’

‘নৈতিক দায়িত্ব আছে না একটা?’

‘হ্যাঁ, ঠিক, সেজন্যেই গাড়িটা ধার নিচ্ছি।’

‘আমি তোমাকে ভোট দিলাম।’

বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল ওরা। তুষার ও কাদাভরা মাঠে পরের দূরের বাড়ির দিকে ছপছপ শব্দে ছুটছে চারজন পুরুষ ও ছিঁচকাঁদুনে এক মহিলা। পেছনের দু’জন রীতিমত টলছে। দুই মুহূর্ত তাদেরকে দেখে নিয়ে মরিস মাইনরের দরজায় চাবি ঢোকাল রানা। তবে দরজা খোলা। পেছনের সিটে ব্যাগ রেখে স্টিয়ারিং হুইলের সামনে বসল ও। ইগনিশনে চাবি ভরে বিড়বিড় করে বলল, ‘চালু হও, বাছা!’ চাবি মুচড়ে দিতেই সত্যিই খকখক করে কেশে চালু হয়ে গেল মরিস মাইনরের ইঞ্জিন।

‘সেরেছে!’ বিড়বিড় করল জেসিকা। ‘চলে যাওয়া এত সহজ নয়!’

ওর তাক করা আঙুল অনুসরণ করে তাকাল রানা। পালিয়ে যাওয়ার একপর্যায়ে ঘুরে চেয়েছে দুই নেশাখোর। বুঝেও গেছে, ওদেরকে গ্রেফতার করতে আসেনি কেউ। বরং ওদের গাড়িটা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে দুই বাটপার। ন্যাড়া- মাথা, কাঠির মত চিকন লোকটা কী যেন বলছে সঙ্গীকে। তাতে রেগে গেল তার দোস্ত ভারী শরীরের গণ্ডার। উঠানের দিকে ছুটে এল তারা। তবে আগে ঢুকল টুলশেডে। সেটা মাত্র পাঁচ সেকেণ্ডের জন্যে, তারপর কোদাল আর শাবল হাতে উড়ে আসতে লাগল গাড়িটার দিকে।

‘ক্ষতি করতে পারবে না,’ জেসিকাকে ভরসা দিল রানা।

‘হয়তো। কিন্তু পিছু নিতে পারবে ফোক্সভাগেনে চেপে।’

‘যদি ওটা চালু হয়।’

‘এমনিতেই আমাদেরকে পুলিশ খুঁজছে। পেছনে কানা হেডলাইটওয়ালা গাড়ি এলে ধাওয়া করবে স্টুয়ার্টের লোক।’

ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। ‘দুর্ভাগ্য কাকে বলে!’

‘এখন ঠোঁট ফোলাচ্ছ কেন, তুমিই তো ডেকে এনেছ এই পরিণতি।’

মরিস মাইনরের কাছ থেকে এখনও তিরিশ গজ দূরে ন্যাড়া ও গণ্ডার। ছুটে আসছে মেইলট্রেনের মত। ব্যাগ থেকে ক্রসবো আর নল কাটা বন্দুক নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল রানা। ওর হাতে দুই ধরনের অস্ত্র দেখে হার্ড ব্রেক কষে থেমে গেল দুই নেশাখোর। ক্রসবো কাঁধে ঝুলিয়ে পুরনো ফোক্সভাগেনের দিকে বন্দুক তাক করেই দুই ট্রিগার টিপে দিল রানা। বিকট ‘বুম!’ আওয়াজে দুই ব্যারেলের গুলি গিয়ে লাগল গাড়িটার পেছনের বনেটে। ক্ষত-বিক্ষত হলো জংধরা ঢাকনি। গর্ত থেকে ঝরঝর করে মাটিতে পড়ছে কালচে মোবিল।

বন্দুক খুলে ধোঁয়া ওঠা খালি গুলির খোসা মাটিতে ফেলল রানা। নতুন করে ব্যারেলে ভরল তাজা দুটো কার্তুজ। কিন্তু হাত থেকে কোদাল ও শাবল ফেলে ঘুরেই পাঁই-পাঁই করে ফিরতি পথে ছুটছে দুই নেশাখোর। রানার বন্দুকের পরের দুই গুলি লাগল ফোক্সভাগেন গাড়ির সামনের চাকায়। একটা হাব ভেঙে গড়িয়ে গেল দূরে। প্রচণ্ড আওয়াজ মিলিয়ে যাওয়ার পর বন্দুক মেঝেতে নামিয়ে কাঁধ থেকে ক্রসবো নিল রানা। তূণ থেকে তীর নিয়ে আটকে নিল ঠিক জায়গায়। বলল, ‘এবার খুশি?’,

‘যা করার তা তো করতেই হবে,’ আড়ষ্ট মুখে বলল জেসিকা।

‘বুঝি না তুমি কোন্ জাতের পুলিশ!’ মন্তব্য করল রানা।

‘এবার কী?’ গাড়ি থেকে জানতে চাইল জেসিকা।

‘ড্রাগ খারাপ, ওদের উচিত ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করা, বলেই গণ্ডারের পশ্চাদ্দেশ লক্ষ্য করে ক্রসবোর তীর ছুঁড়ল রানা।

অন্তত এক শ’ গজ দূরে পৌঁছে গেছে লোক দু’জন। তবে পুচ করে গণ্ডারের নিতম্বের নরম মাংসে গিয়ে বিধল শিকারি তীর। করুণ প্রলম্বিত আর্তনাদ ছেড়ে একহাতে পাছা ধরে দৌড়ের গতি বাড়াল লোকটা। পেছনে বাংলাদেশের জাতীয় পাখি দোয়েলের লেজের মত নাচতে নাচতে চলেছে তীরের পালক।

‘তুমি আসলে খুব নিষ্ঠুর লোক,’ বলল জেসিকা।

‘এ-কথা বলে আমার নরম মনে কষ্ট দিয়ো না। আসলে ওর ভালর জন্যেই ডাক্তারের কাছে পাঠাচ্ছি।’ বন্দুক কুড়িয়ে নিয়ে গাড়ির পাশে পৌঁছুল রানা। ব্যাগে ক্রসবো আর শটগান রেখে চেপে বসল ড্রাইভিং সিটে। পরক্ষণে রওনা হলো কিনলোকার্ড গ্রামের উদ্দেশে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *