চার
দু’বার রিং বাজতেই ওদিক থেকে খুট করে একটা আওয়াজ হলো। এরপর এল বেন হ্যাননের কণ্ঠ: ‘কে বলছেন?’
‘আমি, চাচা…’ পিটারের গলা ভেসে এল।
ভাতিজার কণ্ঠ চিনতে দেরি হলো না বেন হ্যাননের।
পরের দুই মিনিট কুশল বিনিময় শেষে সরাসরি মূল কথায় গেল পিটার, ‘চাচা, আমি বিপদে পড়েছি।’
‘কী ধরনের বিপদ, ভাতিজা?’ আদরমাখা সুরে জানতে চাইল বেন হ্যানন।
‘আসলে এখনও জানি না। তবে মনে হলো তোমার সঙ্গে আলাপ করা উচিত।’
নীরবে অপেক্ষা করল অবসরপ্রাপ্ত এসএএস সার্জেন্ট বেন হ্যানন।
সংক্ষেপে প্রথম থেকে সব খুলে বলল পিটার। তারপর জানাল, ‘প্রথমে ভেবেছি আত্মহত্যা করেছে রবার্ট। কিন্তু রাতে এই লোকটা জানাল, খুনিগুলো ডুবিয়ে মেরেছে ওকে। নিজ চোখে সব দেখেছে সে।
‘তোর সঙ্গে মজা করেনি তো কেউ?’ জানতে চাইল ওর চাচা। ‘ওই লোকের পরিচয় জেনেছিস?’
‘নাম-ঠিকানা কিছু বলেনি,’ বলল পিটার, ‘বলবেও না। ‘তোর যখন মনে হচ্ছে বিপদ হতে পারে, তো অবশ্যই চিন্তার বিষয়,’ বলল বেন হ্যানন।
‘কথাগুলো ঠাট্টা বলে ধরে নিতে পারলে খুশি হতাম, ‘ জানাল পিটার।
‘ওই লোক তোর পরিচিত, তাই না?’ চিন্তিত স্বরে বলল ওর চাচা।
‘তেমনই মনে হয়েছিল। আগে কোথায় যেন গলাটা শুনেছি। কিন্তু পরে আর কিছুই মনে পড়ল না। কথা বলার সময় খুব চিন্তার ভেতর ছিলাম। চাচা, আমার আসলে এখন কী করা উচিত?’
‘তোর কিছুই করতে হবে না,’ দ্বিধাহীনভাবে বলল বেন হ্যানন। ‘চুপ করে বসে থাক। দু’এক দিনের ভেতরই তোর ওখানে পৌঁছে যাব। তারপর দেখব কী করা যায়।’
ওর জন্যে সব কাজ ফেলে ছুটে আসবে চাচা ভেবে লজ্জা পেল রবার্ট। ইতস্তত করে বলল, ‘না, তোমাকে আসতে হবে না। আসলে কী করব ভেবে পাচ্ছি না। তাই ফোন দিয়েছি। আমার উচিতই হয়নি তোমাকে এসব জানিয়ে চিন্তায় ফেলা।’
‘বাজে কথা বলবি না,’ ধমক মারল বেন হ্যানন। একটার চেয়ে দুটো মাথা সবসময় ভালভাবে কাজ করে। এদিকের কাজগুলো একটু গুছিয়ে রেখেই সোজা চলে আসব তোর ওখানে।
‘কিন্তু… তুমি এসবে জড়াবে ভাবতে আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে।’
‘আরে রাখ! শীতে খামারে বেশি কাজ থাকে না,’ বলল হ্যানন। ‘তাই তোর লজ্জা পাওয়ারও কিছু নেই। দু’এক দিনের ভেতর চলে আসব। তারপর দু’জন মিলে জেনে নেব রবার্ট খুন হয়েছে না আত্মহত্যা করেছে।’
‘পুলিশের কাছে যাবে ভাবছ?’ জানতে চাইল পিটার।
‘শক্ত প্রমাণ পেলে হয়তো যাব। এখন থেকে সাবধানে এক পা এক পা করে এগোতে হবে।’
‘অনেক ধন্যবাদ, চাচা। তুমি আসছ শুনে বুক থেকে ভারী একটা পাথর নেমে গেছে। আজ রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারব।’
‘তোর বাপ মরার আগে আমার হাতটা ধরে বলেছিল, বেন, তোর ভাতিজাকে আগলে রাখিস। আর আমি তখনই কথা দিয়েছি, তোর কোনও বিপদ হলে তোর পাশে থাকব। তুই তো আমার শুধু ভাস্তে নোস, নিজের ছেলের মত। তুই আর বাঙালি একটা ভাল ছেলে, এই দু’জনের জন্যে মরতেও দ্বিধা নেই আমার।’
‘ওই ছেলে কে, চাচা?’ জানতে চাইল রবার্ট।
‘চিনবি না, ওর নাম মাসুদ রানা। ওর মত সৎ মানুষ আগে দেখিনি আর।’ আনমনে হাসল বেন হ্যানন। ‘এবার শোন, আমি না আসা পর্যন্ত কিচ্ছু করবি না, চুপচাপ বাড়িতে বসে থাকবি। তারপর দেখছি কী করা যায়।’
‘ঠিক আছে।’
‘এদিক-ওদিক আবার ঘুরতে বেরোবি না তো?’
‘না, কসম!’
‘ঠিক আছে, যত দ্রুত সম্ভব পৌঁছে যাব,’ বিদায় নিয়ে ফোন রেখে দিল বেন হ্যানন।
চাচাকে কথা দিয়েছে রবার্ট। তবে কয়েক ঘণ্টা বাড়িতে বসে থেকেই হাঁফ লেগে গেল ওর। দীর্ঘ সকাল যেন পার হবে না। এদিকে বুকে পাকিয়ে উঠছে দুশ্চিন্তা, হতাশা আর ভয়। তিলতিল করে পেরোচ্ছে সময়। তারপর সাড়ে এগারোটায় হঠাৎ বাজল ফোন। নীরবতার ভেতর ওটা যেন পাঁচ ফুট দূরে দাঁড়ানো রেল-ইঞ্জিনের হুইস্!
লাফিয়ে সোফা ছেড়ে একদৌড়ে গিয়ে রিসিভার কানে ঠেকাল পিটার। ভাবছে, নিশ্চয়ই কল দিয়েছে স্যামন-শিকারি সেই লোকটা। বোধহয় জরুরি কিছু বলবে। অথবা, এরই ভেতর এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেছে চাচা। ফোন করেছে গ্রামে নিয়ে আসার জন্যে।
তবে স্যামন-শিকারি বা বেন হ্যাননের ফোন নয়।
‘জী, উইলসন আঙ্কেল,’ ঢোক গিলে বলল পিটার।
রবার্টের বাবার গলা শোকে ভারাক্রান্ত। যেন কবরের ভেতর থেকে কথা বলছেন। ছেলে হারিয়ে যেন মরেই গেছেন তিনি। ‘রবার্টের ভ্যানের ব্যাপারে ফোন দিলাম,’ কাঁপা গলায় বললেন মিস্টার উইলসন। ‘ওটা এখনও ওর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। ব্যবসার জিনিস, তোমার বোধহয় ওটা নিয়ে যাওয়া উচিত।’
ভ্যানটার কথা ভুলে গিয়েছিল পিটার। বিস্ময়কর কোনও কারণে গাড়িটা রবার্টের বাড়ির সামনে এনে রেখেছে পুলিশের লোক। ব্যবসার দ্বিতীয় পার্টনার বেঁচে নেই, তাই দুটো ভ্যানও আর লাগবে না পিটারের। তবে তা না বলে নরম সুরে জানাল, ‘জী, উইলসন আঙ্কেল, পরে নিয়ে আসব।’ দীর্ঘশ্বাস চেপে জিজ্ঞেস করল, ‘আন্টি আর আপনি এখন কোথায়, আঙ্কেল? এখন কি আগের চেয়ে ভাল আছেন আণ্টি?’
জবাবে বৃদ্ধ জানালেন, তিনি আপাতত আছেন রবার্টের বাড়িতেই। তাঁরা বুড়োবুড়ি কেউ ভাল নেই। তাঁর স্ত্রী জুডিকে কড়া ঘুমের ওষুধ দিয়েছেন ডাক্তার। বেচারি এখন ইনভার্নেস শহরের এক ক্লিনিকে। ক’দিন পর গ্রামে ফিরবেন। তখন যেন পিটার দেখা করে। ওকে দেখলে রবার্টকে হারানোর কষ্ট হয়তো একটু কমবে জুডির।
বিদায় জানিয়ে ফোন রেখে দিলেন বৃদ্ধ।
ওই ভ্যান নিয়ে আসা জরুরি নয়, তবে অন্তত বাড়ি থেকে বেরোবার একটা ছুতো তো পাওয়া গেছে, ভাবল পিটার।
কিনলোকার্ড গ্রামের কিনারায় মর্টগেজ করা একতলা ছোট এক বাড়িতে থাকত রবার্ট। সামান্য দূরেই ডাবল আর্ম পাব। নিজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে দশ মিনিট হেঁটে ওখানে পৌছে গেল পিটার। উত্তর থেকে আসছে হু-হু হাওয়া, বড্ড শীতল। ওর মনে হলো আবারও শুরু হবে তুষারপাত।
রবার্টের বাড়ির কাছে পৌঁছে কাদামাখা সাদা ভ্যানটা চোখে পড়তেই গলার ভেতর দলা পাকিয়ে গেল পিটারের। বাড়ির জানালার পর্দা সরিয়ে ওর দিকেই চেয়ে আছেন বৃদ্ধ উইলসন, থমথম করছে চেহারা। একমিনিট পেরোবার আগেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন তিনি। গাড়ির চাবি তুলে দিলেন পিটারের হাতে। দু’চার কথা শেষে বিদায় নিল পিটার। গাড়ি নিয়ে রওনা হয়ে তিক্ততা বাড়ল ওর মনের। বাড়ি ফিরে করার মত কোনও কাজ নেই। ভাল লাগছে না কিছুই।
একটু পর নিজের বাড়ির সামনে ভ্যান রেখে নেমে পড়ল পিটার। মনস্থির করল, ভাল করে সাফ করবে ভ্যানের কাদা ও ধুলোবালি। বড় অগোছাল ছিল রবার্ট। গাড়ির মেঝেতে পটেটো-চিপসের ছেঁড়া প্যাকেট, তুবড়ে যাওয়া কোকের ধাতব ক্যান, পানির স্বচ্ছ বোতল, কাগজের তৈরি কফির খালি কাপ, কেএফসির মোড়ক ইত্যাদি ছড়িয়ে আছে। বাড়ি থেকে ভ্যাকিউয়াম ক্লিনার ও পানি এনে ভ্যানে ঢুকে কাজে নামল পিটার। আনমনে মাথা নাড়ছে। মিনিটখানেক পর মেঝে আর ড্রাইভিং সিটের নিচে শুকিয়ে যাওয়া কাদা পরিষ্কার করতে গিয়েই ধাতব কী যেন ঠেকল ওর হাতে। ওটা তুলে নাকের সামনে ধরতেই বিস্ফারিত হলো পিটারের দু’চোখ। বিড়বিড় করে বলল, ‘হায়, ঈশ্বর!’