1 of 2

স্বর্ণলিপ্সা – ৩৮

আটত্রিশ

টয়োটাতে চেপে রওনা হলো রানা ও জেসিকা। পেছনে রইল জ্বলন্ত পেট্রল কার এবং পথের ধারে দুই অচেতন পুলিশ। ভুরু কুঁচকে চুপ করে বসে আছে জেসিকা, ডুবে গেছে গভীর ভাবনার সাগরে। নিজেও চুপচাপ ড্রাইভ করছে রানা। এখনও দেরি আছে ভোর হতে। মাথার ওপর থেকে বিদায় নিয়েছে তুষারভরা ভারী ধূসর মেঘ। কুচকুচে কালো আকাশে ঝিকমিক করছে হাজারো নক্ষত্র। দু’মাইল যাওয়ার পর একদিকে অপেক্ষাকৃত সরু পথ দেখে সেদিকে বাঁক নিল রানা। একটু পর পর সামনে পড়ছে সরু গলি। তবে আরও এগোতেই সামনে পড়ল কালো পাহাড়ের কোলে বড় এক হ্রদ। ওটার নিথর কালো পানিতে সামান্য দুলছে আকাশের প্রতিফলিত নক্ষত্ররাজি।

স্যাটালাইট নেভিগেশন সিস্টেম অনুযায়ী ওরা পৌঁছে গেছে লক বা-র তীরে বুনো এলাকায়। পথ থেকে লকের তীরে পাথুরে জমিতে নেমে পানির দিকে টয়োটার নাক তাক করল রানা। হ্যাণ্ডব্রেক টেনে নিচু গলায় বলল, ‘ভাল জায়গা।’

‘প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার জন্যে?’ জানতে চাইল জেসিকা ‘না, এবার গাড়িটা ফেলে যেতে হবে,’ বলল রানা। ‘এটা দেখলেই সতর্ক হয়ে উঠবে পুলিশের লোক। তা ছাড়া, গুলি লাগা গাড়ি রেন্টাল কোম্পানিকে ফেরত দিলেও বিপদ।’

‘বলবে যে ডাকাতের কবলে পড়েছিলে। তারাই গুলি করেছে।’

নিরীহ সুরে বলল রানা, ‘এদিকে যখন-তখন ডাকাতি হয়, তাই না?’

হাল ছেড়ে বড় করে শ্বাস ফেলল জেসিকা। ‘গাড়িটা ভাল লেগেছিল। তা ছাড়া, বহু মাইলের ভেতর কিছুই নেই। হেঁটে যেতে হলে বারোটা বেজে যাবে।’

‘বেশি হাঁটব না,’ বলল রানা। ‘প্রথম সুযোগেই জোগাড় করে নেব অন্য কোনও গাড়ি।’

‘ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটলেও কোনও বাস পাবে না।’

‘আমি বাসের কথা ভাবছি না।’

‘এদিকে কার রেন্টাল কোম্পানিও খুব কম। ওখানে যেতে হলেও তোমাকে হাঁটতে হবে মাইলের পর মাইল।’

‘এভাবে আমার মনটা ভেঙে দিয়ো না, প্লিয!’ চাপা শ্বাস ফেলল রানা। গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। বিরক্ত চেহারায় নিজেও নামল জেসিকা। লক বা-র ওপর আবছা আলো ফেলেছে সহস্র তারা। রানার দেখাদেখি গাড়ি থেকে দরকারি জিনিসপত্র নামিয়ে ফেলল জেসিকাও। বাড়তি ওজন নিয়ে হাঁটা অনর্থক, তাই মন খারাপ হলেও গাড়ির ভেতরেই রানা রেখে দিল ঘিলি সুট আর অব্যবহৃত নাইট-ভিশন গগল্‌স্। মায়ায় পড়ে নিজের কাছে রাখল ক্রসবো। গাড়ির গিয়ার নিউট্রাল করে হ্যাণ্ডব্রেক ছেড়ে দিল। পারে দাঁড়িয়ে চুপচাপ ওরা দেখল ঢালু জমিতে গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে টয়োটা। প্রথমে ধীর হলেও ক্রমেই বাড়তে লাগল নেমে যাওয়ার গতি। পাথর ও তুষারের ওপর দিয়ে এক্কা-দোক্কা খেলার ভঙ্গিতে লাফ দিতে দিতে সোজা গিয়ে ঝপাস্ করে নামল ওটা লকে। ভাল জায়গা বেছে নিয়েছে রানা। মাত্র কয়েক মুহূর্তে টয়োটার বনেট ছাপিয়ে ছাত ডুবিয়ে দিল রাশি রাশি কালো পানি। গাড়ির কোনও চিহ্ন থাকল না। একসময় ঢেউগুলোও স্থির হয়ে গেল। মনে হচ্ছে, যেন কেউ কিচ্ছু জানে না একটু আগে কী ঘটে গেছে।

জেসিকা দুশ্চিন্তায় পড়েছে টের পেয়ে ওর কাঁধে হাত রাখল রানা। নরম সুরে বলল, ‘সময় হলো যাওয়ার। আমার ওপর ভরসা রাখো। চিন্তার কিছু নেই।’

ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল জেসিকা। ‘দুশ্চিন্তার কিচ্ছু নেই? যা ঘটছে তার কিছুই তো বিশ্বাস করতে পারছি না! মনে হচ্ছে যে-কোনও সময়ে জেগে উঠব দুঃস্বপ্ন থেকে।’

‘একবার ফোন দিলেই বুঝবে স্বপ্ন দেখছ না,’ বলল রানা।

‘কাকে ফোন দেব?’

‘আমি দেব। তবে জানি না কে ধরবে।’ পুলিশ সদস্য গ্রাহামের ফোন বের করে স্ক্রিন আনলক করল রানা। খেয়াল করল লেক, পাহাড় ও জঙ্গলে রিসেপশন খুব খারাপ। মাত্র একটা বার দেখাচ্ছে ফোন। গ্রাহামের কল করা সেই নাম্বারে রিডায়াল করল রানা। ক’বার বাজার পর ওর মনে হলো, ওদিক থেকে ধরবে না কেউ। ভয়েসমেইল পাঠাবে কি না ভাবছে, এমনসময় তিক্ত, কর্কশ গলায় ঘুমে কাতর একলোক জবাব দিল, ‘ইন্সপেক্টর মুরে। গ্রাহাম, কী হয়েছে? ওদেরকে ধরতে পেরেছ?’

ঠিকই ধারণা করেছে রানা। স্পিকারে মৃদু হেসে বলল, ‘ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর মুরে?’ জেসিকার দিকে তাকাল ও। কুঁচকে গেছে মেয়েটার ভুরু। চড় খেলেও এত চমকে যেত না।

জেসিকা একমাত্র মানুষ নয় যে অবাক হয়েছে। ফোনের ওপ্রান্ত থেকে কোনও সাড়াশব্দ নেই। বুদ্ধিমান কেউ চট্ করে ফোন রেখে দিত। কিন্তু এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।

‘গ্রাহাম আপাতত কথা বলতে পারবে না,’ বলল রানা। ‘তোমার দেয়া টাকায় পার্টি দিচ্ছে। বেশি ব্যস্ত। টাকাগুলো বোধহয় তোমার নয়। তুমি শুধু হাত বদল করেছ। আমি কি ভুল বললাম?’

‘রা… রানা?’ তুতলে উঠে জানতে চাইল মুরে।

‘তোমার বসকে একটা কথা জানিয়ে দিয়ো,’ বলল রানা। ‘ওর কিছু জিনিস আমার কাছে রয়ে গেছে। সে যদি আগ্রহী হয়, ওই বিষয়ে আমরা আলাপ করতে পারি।’ ফোন রেখে দিল রানা।

উত্তেজনার ছাপ পড়েছে জেসিকার মুখে, কী যেন ভাবছে।

‘সরি, জেসিকা, প্রথম থেকেই তোমার দুই বস এইসবে জড়িত ছিল,’ বলল রানা। ‘পুলিশের লোকদের নিয়মিত ঘুষ দিচ্ছে এক লোক।’

‘রন স্টুয়ার্ট!’ চাপা স্বরে বলল জেসিকা।

মৃদু মাথা দোলাল রানা। ‘এ ব্যাপারে আমি এক শ’ ভাগের ভেতর নিরানব্বুই ভাগই নিশ্চিত। ম্যাকগ্রাকে খুন করতে ডিযঅনারেবলদেরকে ভাড়া করেছে। তাদের মাধ্যমে চেষ্টা করেছে আমাদেরকে খুন করতে। আগেই টাকা দিয়ে জন মুরে আর ডানকান রিডকে কিনে নিয়েছে। রবার্ট উইলসন খুনের সঙ্গে জড়িত এরা। বাজেভাবে আহত করেছে পিটার হ্যাননকে। টাকার জোরে যা খুশি করছে রন স্টুয়ার্ট। সহজেই কিনে নিয়েছে স্থানীয় আইন।

‘আমরা আধুনিক সময়ের মানুষ। এটা তো আর বুনো পশ্চিম নয়। অথচ…

‘সময় বদলে গেলেও মানুষ তো বদলে যায়নি,’ বলল রানা। ‘ক্ষমতা ও টাকার জোরে যে কাউকে শেষ করে দেয়া যায়। যুগে যুগে প্রতিটা দেশে এমনই ঘটেছে, ঘটছে।’

‘তা ঠিক,’ বলল জেসিকা। ‘তবে তোমার একটা কথা বুঝতে পারিনি। ‘ওর কিছু জিনিস আমার কাছে রয়ে গেছে। সে যদি আগ্রহী হয়, ওই বিষয়ে আমরা আলাপ করব।’ এসব বলে জন মুরেকে কী বোঝাতে চেয়েছ?’

‘লোভ দেখালাম, যাতে তার বসকে হাতের মুঠোয় পাই,’ বলল রানা। ‘এবার কথাগুলো তাকে জানিয়ে দেবে জন মুরে। আমরা কী পেয়েছি না জানলেও ভীষণ কৌতূহলী হবে স্টুয়ার্ট। ওই লোক একবার যোগাযোগ করলে আমরা নিশ্চিত হব, আসলে এসবের পেছনে সে আছে। তখন আর ওই এক পার্সেন্ট অনিশ্চয়তাও থাকবে না।’

‘কিন্তু অনির্দিষ্ট সময় ধরে তো আমরা অপেক্ষা করতে পারব না,’ তিক্ত স্বরে বলল জেসিকা।

‘বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না। যোগাযোগ করবে ওই লোক। চলো, ততক্ষণে এখান থেকে সরে যাই। কিনলোকার্ড এখনও বহু দূরে।’

হ্রদের যেখানে ডুবে গেছে টয়োটা, তারার আলোয় দেখা যাচ্ছে ওখানে এখনও একটা-দুটো বুদ্বুদ উঠছে। এ ছাড়া বোঝার উপায় নেই হারিয়ে গেছে আস্ত একটা গাড়ি। ব্যাগ কাঁধে তুলে ক্রসবো হাতে পথের দিকে রওনা হলো রানা। ওর পিছু নিয়ে জানতে চাইল জেসিকা, ‘এবার কোন্ দিকে?’

‘বামে,’ আঙুল তুলে ওদিকটা দেখাল রানা।

‘বিশেষ কোনও কারণ আছে?’ জানতে চাইল জেসিকা।

‘তা নয়। তবে দ্বিধা এলে বেশিরভাগ সময় বামদিক বেছে নিই। আসলে কোন্ দিকে যাব সেটা এখন বড় কথা নয়। আগে বা পরে বাড়ি, খামার বা গ্রামের কাছে পৌঁছে গেলেই হলো।’

‘ঠিক আছে, তো বামে,’ রানার পাশাপাশি হাঁটতে লাগল জেসিকা।

পথের যেদিকে তুষার কম, সেদিক ধরে হাঁটছে ওরা। কোনও গাড়ি এলে ড্রাইভারকে কাছের শহর বা গ্রামে পৌঁছে দিতে অনুরোধ করবে ভেবে রেখেছে রানা। এই নির্জন এলাকায় ইঞ্জিনের আওয়াজ পাবে অন্তত একমাইল দূর থেকে। কিছুক্ষণ হাঁটার পরেও বাতাসের মৃদু স্ ও পায়ের নিচে তুষারের কুড়মুড় ছাড়া কোনও আওয়াজ পেল না ওরা। গ্রাহামের ফোনটা হাতে রেখেছে রানা। অপেক্ষা করছে যে-কোনও সময়ে বেজে উঠবে ওটা।

অবশ্য ফোন দিল না কেউ। হাঁটতে গিয়ে নিজেদের ভেতর তেমন কথা হচ্ছে না ওদের। শরীর গরম করতে আগের চেয়ে জোরে হেঁটে চলল। অন্ধকার, আঁকাবাঁকা পথে একমাইল পেছনে ফেললেও কোথাও দেখল না মানব-বসতির চিহ্ন। তারপর পেরোল আরও দুই মাইল। নীরবতা ভেঙে জানতে চাইল জেসিকা, ‘তোমার কি মনে হয় বেন হ্যানন এখনও বেঁচে আছেন?’

‘তাই ভাবতে চাই,’ জবাব দিল গম্ভীর রানা।

‘তাঁকে বন্দি করে রেখেছে রন স্টুয়ার্ট?’

‘আমার তা-ই মনে হয়।’

‘এরা যদি ধরে নেয় তিনি জানেন কোথায় আছে সোনার কয়েন…’ বাতাসে মিলিয়ে গেল জেসিকার কণ্ঠ।

‘নির্যাতন করবে অসুস্থ মানুষটাকে,’ খেই ধরল রানা। ‘দিনের পর দিন। যতক্ষণ না মুখ খোলে।

‘কারা এরা, এত ভয়ঙ্কর?’

‘ওরা জিন্দালাশের মত,’ বলল রানা। ‘বিবেক মরে গেছে অনেক আগেই।’

চুপচাপ হাঁটছে ওরা। তারপর সূর্য ওঠার আধঘণ্টা আগে সকাল আটটায় গ্রাহামের ফোন বেজে উঠল রানার হাতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *