সাঁইত্রিশ
উত্তর দিকে ছুটে চলেছে টয়োটা আরএভি। গাড়ির হ্যাণ্ডস্-ফ্রি সিস্টেমে মোবাইলের সংযোগ দিয়ে মিরাণ্ডাকে ফোন করল রানা। বারকয়েক রিং হওয়ার পর কোনও মোবাইলে রিডাইরেক্ট হলো কলটা। কয়েক মুহূর্ত পর ওদিক থেকে এল মিরাণ্ডার ক্লান্ত গলা, ‘হ্যালো?’,
চট্ করে হাতঘড়ি দেখল রানা।
ইতালিতে এখন অনেক রাত।
লজ্জা পেয়ে বলল রানা, ‘সরি, ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম।’
‘না, ঘুমাচ্ছিলাম না। ক’দিন হলো চোখ বুজতে পারি না।’ ফুঁপিয়ে উঠল মিরাণ্ডা। ধরা গলায় বলল, রোমে এসেছে ভাইয়ের বাড়িতে। একা খামারে পাগল হয়ে যাচ্ছিল সে। এখন অন্তত সঙ্গ দেয়ার কেউ না কেউ আছে। যদিও বেনের কোনও খবর না পেয়ে বুক আঁকড়ে আসছে তার।
কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মিরাণ্ডা যোগাযোগ করেনি শুনে স্বস্তি পেল রানা। নরম সুরে বলল, ‘মাত্র আর দু’একটা দিন, মিরাণ্ডা, তারপর বোধহয় ভাল কোনও সংবাদ দিতে পারব।’
‘ওকে খুঁজে পেয়েছ?’ আশান্বিত কণ্ঠে বলল মিরাণ্ডা।
বেচারিকে হতাশ করতে হবে ভেবে মন ছোট হয়ে গেল রানার। ‘ঠিক তা বলিনি, মিরাণ্ডা। আরও কিছু তথ্য পেলেই আপনাকে সবই জানাব। একটু ধৈর্য ধরুন।’
ফোনে বিদায় নিয়ে ড্রাইভিঙে মন দিল রানা। ওর দিকে তাকাল জেসিকা। ‘দেখে মনে হচ্ছে তুমি খুব ক্লান্ত। শেষ কখন ঘুমিয়েছ? তোমার বিশ্রাম দরকার।
ঠিকই বলেছে, ভাবল রানা। কর্নেল বলেছিলেন রাতটা যেন তাঁর বাড়িতে ওরা কাটিয়ে দেয়। কিন্তু রাজি হয়নি ও। ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে কয়েক ঘণ্টা আগে। এখন ঘড়িতে বাজে রাত তিনটে। শরীরটা ক্লান্তিতে নেতিয়ে পড়তে চাইলেও বুঝতে পারছে সচেতন থাকতে হবে ওকে। এবার হয়তো বেন হ্যাননকে খুঁজে পাবে ওরা। ‘একবার কাজটা শেষ হলে তিনদিন পড়ে পড়ে ঘুমাব,’ বলল রানা।
‘আমি ড্রাইভ করি? কিনলোকার্ড তো বহু দূরের পথ।’
‘ড্রাইভ করতে সমস্যা হচ্ছে না,’ বলল রানা। ‘তুমি কথা বললেই ঘুমিয়ে পড়ব না।’
‘কী বিষয়ে কথা বলব?’
‘তোমার যা ইচ্ছে। গলার আওয়াজ পেলেই আমি খুশি।’ মিষ্টি হাসল জেসিকা। ‘প্রেমেট্রেমে পড়ে যাচ্ছ না তো আবার, রানা?’ মনে মনে বলল, আমি তো ডুবেছি ক’দিন আগেই! কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ‘আগে বাক্সটনে যাইনি। তুমি কখনও গিয়েছ?’
‘মনে তো পড়ে না।’
‘ঐতিহাসিক জায়গা। বহুদিন ছিলেন স্কটদের রানি মেরি।’
রানার আবছাভাবে মনে পড়ল পত্রিকার এক আর্টিকেল। ‘পড়েছি একের পর এক দুর্গে বন্দি করে রাখা হতো তাঁকে। সেটা করেছিলেন ইংরেজদের রানি এলিযাবেথ।’
‘ঠিকই বলেছ। তবে মানুষ হিসেবে ভাল ছিলেন না মেরি। অসুস্থ ওই রানির শরীর ভাল রাখতে বাক্সটনে বারবার পাঠিয়ে দিতেন রানি এলিযাবেথ। রোগেশোকে কাবু হলেও বাক্সটনের খনিজ পানির গুণে নাকি চট করে সেরে উঠতেন মেরি।’
‘সত্যিই কি ওষুধ হিসেবে কাজ করে খনিজভরা পানি?’
‘মনে হয় না। তবে একসময় তাঁকে আর ওখানে যেতে দিলেন না রানি এলিযাবেথ। কারণ ওখানে বসেও তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিলেন মেরি। ইংল্যাণ্ডের রানি বুঝে গিয়েছিলেন যে অতিরিক্ত স্বাধীনতা দিয়ে বসেছেন তিনি।’
‘আর সেজন্যে জানটাই কেড়ে নেন।’
‘সেটা আরও ক’বছর পর। ইংল্যাণ্ডের ক্ষমতাসীন দল রানি মেরিকে প্রাণদণ্ড দিলেও তাদের হয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশে সই করতে চাননি রানি এলিযাবেথ। যতদিন পেরেছেন দেরি করেছেন। তারপর একসময় বুঝলেন, রাজনৈতিকভাবে তাঁর সামনে আর কোনও উপায় নেই।’
‘জানতাম না,’ বলল রানা। ‘তুমি এত তথ্য কোথায় পেলে?’
‘স্কুল-কলেজে মনোযোগী ছাত্রী ছিলাম। ভাল লাগত স্কটল্যাণ্ডের ইতিহাস জেনে নিতে। বিখ্যাত মানুষগুলোর ব্যাপারে বইয়ে পড়তাম। উইলিয়াম ওয়ালেস, রবার্ট দ্য ব্রুস, রব রয়, বনি প্রিন্স চার্লি, ফ্লোরা ম্যাকডোনাল্ড… ‘
‘এই মহিলা আবার কে?’
‘সতেরো শ’ ছেচল্লিশ সালে ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে কুলোডেন যুদ্ধে হেরে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন প্রিন্স চার্লি। তাঁকে এ- কাজে সহায়তা করেন ফ্লোরা ম্যাকডোনাল্ড। মহিলার পোশাক পরিয়ে নৌকায় তুলে নিয়ে যান আইল অভ স্কায়েতে।’
ড্রাইভিং থেকে মন সরিয়ে জেসিকাকে দেখল রানা। ‘স্কটদের মস্ত হিরো ইংরেজদের তাড়া খেয়ে এক মহিলার সঙ্গে মেয়েলি পোশাক পরে পালিয়ে গেল? যাহ্!’
মাথা দোলাল জেসিকা। ‘মিথ্যা নয়। পরনে পেটিকোট, স্টকিং, গার্টার… সবই। নাম নেন বেটি বার্ক। এক আইরিশ মেয়ে। কেন, তোমার পছন্দ হলো না? পালিয়ে যেতে হলে ওটা তো ভাল কায়দা।’
ঢাকার মহাপ্রতারক সাহেদ করিমের কথা মনে পড়ল রানার। হাজারখানেক অপরাধ করে ধরা পড়বে বুঝে বোরখা পরে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল সে ভারতে।
‘প্রিন্স চার্লি কিন্তু স্কটল্যাণ্ডের মানুষ নন,’ বলল জেসিকা।
‘তা হলে?’
‘তাঁর বাবা অর্ধেক ফ্রেঞ্চ। মা পোল্যাণ্ডের। অদ্ভুত সুরে ইংরেজি বলতেন বনি প্রিন্স। ইতালি থেকে এসে স্কটল্যাণ্ডের রাজা হতে চেয়েছিলেন। ইউরোপের অভিজাত পরিবারের মানুষগুলো কেমন যেন বিদঘুটে।’
‘তুমি বলো, আমি শুনছি,’ ড্রাইভ করতে করতে বলল রানা।
ইতিহাসের মজার সব গল্প বলতে লাগল জেসিকা। পথে আবারও সেই সার্ভিস স্টেশনে থামল রানা। আগের মত একই খাবার নিল ওরা। পঁচিশ মিনিট পর রওনা হলো কিনলোকার্ড গ্রামের দিকে। ঘণ্টাখানেক পর গ্লাসগোর ব্যস্ত মোটরওয়ে উত্তর দিকে ফেলে এল। তখন থেকেই ওদের গাড়ির হেডলাইট ছাড়া নিকষ কালো শূন্য আঁধারে অন্য কোনও আলো থাকল না। জেসিকা বারবার অনুরোধ করল ড্রাইভ করবে, সে-সময়ে রানা যেন চোখ বুজে বিশ্রাম নেয়, কিন্তু রাজি হলো না ও। শেষে ক্লান্ত হয়ে নিজেই ঘুমিয়ে পড়ল জেসিকা। আবারও নিঃসঙ্গ হয়ে গেল রানা। ওর মনে এল নানান দুশ্চিন্তা। সরু পথে ছুটে চলল গাড়ি। যত উত্তর দিকে চলেছে, বাড়ছে শীতের প্রকোপ। বরফের মত শীতল বৃষ্টির সঙ্গে থেকে থেকে শুরু হলো শিলাবৃষ্টি ও তুষারপাত। রাজপথ ছেয়ে গেল পিচ্ছিল জমাট বরফে। কখনও কখনও বাধ্য হয়ে গতি কমিয়ে নিল রানা। বহুক্ষণ কেটে গেল নীরবে। তারপর হাইল্যাণ্ডের পথে হঠাৎ ঘটল অস্বাভাবিক এক ঘটনা।
ক্রিয়ানলারিচ আর গ্লেন অর্চির মাঝে হঠাৎ করেই পেছনে পুলিশের সাইরেন শুনল রানা। রিয়ারভিউ মিররে দেখল ছুটে আসছে লাল-নীল আলো। সিটে কাত হয়ে ঘুমাচ্ছিল জেসিকা। সাইরেনের কর্কশ আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। চমকে গিয়ে বলল ও, ‘আরেহ্! এত আওয়াজ কীসের!’
‘বোধহয় থামতে বলছে,’ জানাল রানা। গত কয়েক মিনিট খেয়াল করেছে, পিছু নিয়েছে পুলিশের পেট্রল কার। অ্যাক্সেলারেটর থেকে চাপ কমিয়ে রানা ভাবল, হয়তো ওদেরকে পাশ কাটিয়ে বিপজ্জনক কোনও অপরাধীকে ধরতে চলেছে তারা।
কিন্তু পুরো একমিনিট পেরোলেও আরভিকে পাশ কাটিয়ে গেল না গাড়িটা। আগের মতই বাজছে সাইরেন। ঝিকমিক করছে নীল আলো। ভাল নাগরিকের মত আইন মেনে পথের ধারে বরফস্তূপের কাছে গাড়ি রাখল রানা। টয়োটা আরভির পেছনে এসে থামল পুলিশের গাড়িটা। জেসিকা বলল, ‘ব্যাপার কী? তুমি কি বেশি স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছিলে?’
‘না, গতি ছিল বড়জোর ষাট কিলোমিটার,’ বলল রানা। ‘তো এরা আমাদের কাছে কী চায়?’
‘দেখি।’ গাড়ির উষ্ণ ক্যাব থেকে নেমে কনকনে শীতে কেঁপে উঠল রানা। পুলিশের গাড়িটা টয়োটা 4X4. বনেটে ঝলমল করছে Police লেখা শব্দটা। একইসময়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এল দুই পুলিশ অফিসার। বয়স তাদের বড়জোর ত্রিশ। পুলিশের ইউনিফর্মের ওপর পরনে কালো উইন্টার কোট এজন্যে মোটা ভালুকের মত দেখাচ্ছে লোকদু’জনকে। কোমরের বেল্টে ঝুলছে ব্যাটন, কাফ হোল্ডার ও টেইযার হোলস্টার। নিচু করে মাথায় গুণ্ডাদের স্টাইলে পরেছে পুলিশি ক্যাপ। তাদেরকে ক্লান্ত বলে মনে হলো রানার। গভীর রাতে বাধ্য হয়ে ডিউটি দিচ্ছে, সেজন্যে হয়তো মহাবিরক্ত। তাতে চিন্তিত হতো না রানা, ওর সমস্যা হচ্ছে, গাড়ির বডির বুলেটের ক্ষত। ওগুলো দেখলে সন্দেহ করবে এরা। তার ওপর, ওর গাড়িতে আছে বেআইনি অস্ত্র আর গুলি।
পুলিশের গাড়ির হেডলাইট ও টয়োটার ব্যাক লাইটের আলোয় রানার দিকে এল দুই পুলিশ অফিসার। মহিষের মত তাদের নাক থেকে ভুসভুস করে বেরোচ্ছে রেল-ইঞ্জিনের মত সাদা বাষ্প। কড়কড়-ফিজফিজ শব্দ তুলছে রেডিয়ো। দু’জনের হাতে দীর্ঘ দুটো জ্বলন্ত টর্চ। হাঁটার ভঙ্গিতে বেপরোয়া ভাব।
টয়োটার ড্রাইভিং দরজা বন্ধ করে তাদের দিকে এগোল রানা। বুঝে গেছে, কোথাও গুরুতর গোলমাল আছে। নিজের গাড়ির টেইল লাইট দেখল। ওগুলোতে সমস্যা নেই। নাম্বার প্লেট ঠিক আছে। গাড়ির পেছন থেকে দেখা যাচ্ছে না বুলেটের ক্ষত। পঞ্চান্ন বা ষাট কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালাচ্ছিল। কাজেই ওর পথরুদ্ধ করার কোনও কারণ নেই এদের। টয়োটার পেছনে থেমে সহজ সুরে বলল রানা, ‘কোনও সাহায্যে আসতে পারি?’
জবাবে কিছুই বলল না দুই পুলিশ। চোখে কঠোরতা। একজনের ঠোঁটে ফুটল টিটকারির হাসি। অন্যজন গম্ভীর।
‘আপনারা কি পথ হারিয়ে ফেলেছেন?’ বলল রানা, ‘সেক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারব না। আমি নিজেই এখানে নতুন।
এবারও কিছু বলল না দুই পুলিশ। আরও দুই পা এগিয়ে রানার মুখে টর্চের আলো ফেলল টিটকারির হাসিরত অফিসার। অন্যজন গেল টয়োটার প্যাসেঞ্জার সিটের পাশে। জানালা দিয়ে আলো ফেলল ভেতরে। কয়েক মুহূর্ত দেখল গাড়িতে বসে আছে জেসিকা। এবার ঘুরে সঙ্গীর উদ্দেশে মাথা দোলাল সে।
আরেকটু বাঁকা হলো রানার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের টিটকারির হাসিটা। হাসি এত বাঁকা কেন, এর কি বেস্ পালসি রোগ আছে?—ভাবল রানা। ওর ওপর থেকে চোখ সরাচ্ছে না সে। পকেট থেকে ফোন নিয়ে কাকে যেন কল দিল। নিচু গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, ওই লোকই। পেয়েছি। হ্যাঁ। ঠিক। এরাই মাসুদ রানা আর জেসিকা থমসন।’
লোকটা রেডিয়োর বদলে ফোন ব্যবহার করছে বলে সতর্ক হয়ে উঠেছে রানা। তা ছাড়া, জিজ্ঞেস না করেই কীভাবে এরা জেনে গেল টয়োটার আরোহী কারা!
কথাটা মাত্র ভেবেছে রানা, এমনসময় দেখল গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে জেসিকা। সতর্ক হয়ে ওর কাছ থেকে কয়েক ফুট পিছিয়ে গেল গম্ভীর চেহারার পুলিশ। হাতের টর্চ তাক করেছে জেসিকার চোখে-মুখে। শীতল হাওয়ায় উড়ছে মেয়েটার দীর্ঘ চুল। মুখের ওপর থেকে সরিয়ে দিল। পকেট থেকে পুলিশ ওয়ারেন্ট বের করে দুই পুলিশের উদ্দেশে নিচু গলায় বলল, ‘পিসি থমসন। আছি ফোর্ট উইলিয়াম থানায়। এত ভোরে আপনারা এখানে কী করছেন, বলুন তো?’
জবাব দিল না দুই পুলিশ। মুখে সহকর্মীর প্রতি বন্ধুত্বের হাসি নেই। জেসিকার চোখে বিস্ময় দেখল রানা। এটা পরিষ্কার, অস্বাভাবিক আচরণ করছে এরা। গম্ভীর পুলিশের দিকে তাকাল রানা। সে দাঁড়িয়ে আছে জেসিকা থেকে কয়েক ফুট দূরে। বামহাতে টর্চ, ডানহাত ঢুকে গেল ওভারকোটের ভেতর। কয়েক সেকেণ্ড পর বেরিয়ে এল হাত। শক্ত মুঠোয় ধরেছে হাই-ভোল্টেজ ক্যাটল শক প্ৰড!
টিটকারির হাসিরত পুলিশের হাতে একই যন্ত্র বেরোতে দেখল রানা। টয়োটার লাল বাতির আলোয় চকচক করছে লোকটার দুই চোখ।
কেন কী ঘটছে, জানা নেই রানার। তবে এরপর কী ঘটবে সেটা বুঝে গেছে। একলাফে টয়োটার ড্রাইভিং দরজার কাছে উইণ্ডশিল্ডের পাশে পৌঁছে গেল। গাড়ির উইঙে হাতের ভর রেখে শরীর তুলে দিল বরফে ভরা বনেটে। পিছলে সরসর করে গিয়ে নেমে পড়ল গাড়ির আরেক পাশে। ওর পায়ের ধাক্কা খেয়ে ভারসাম্য হারিয়ে সরে গেছে জেসিকা। একইসময়ে রানার বাম পায়ের লাথি ধুম্ করে পড়েছে প্যাসেঞ্জার দরজার ওপর। শক এড হাতে সামনে বেড়েছে গম্ভীর পুলিশ। প্রচণ্ড জোরে ধুপ্ করে তার বুকে লেগেছে গাড়ির দরজা। ব্যথা পেয়ে ঘোঁৎ করে উঠল সে। তাল রাখতে না পেরে বেকায়দাভাবে কাত হয়ে পিচ্ছিল রাস্তায় পড়ল লোকটা।
পরক্ষণে তার ওপর চড়াও হলো রানা। উঠতে গিয়ে ধুপধাপ কয়েক লাথি খেয়ে শুয়ে পড়ল আবার। খপ্ করে তার হাত থেকে শক প্রড কেড়ে নিল রানা। বিপদ বুঝতে পেরে উঠে দাঁড়াতে চাইছে লোকটা। টর্চ দিয়ে বাড়ি দিতে গেল রানার হাঁটুতে। তবে পা দিয়ে ওটা ব্লক করল রানা। পরমুহূর্তে ওর হাঁটুর বাটি ঠাস্ করে নামল পুলিশের বুকে। তাতে ভুস করে বেরিয়ে গেল তার পেট থেকে সব বাতাস। দ্বিধা না করেই উন্মুক্ত গলায় শক প্রড ঠেকিয়ে সুইচ টিপে দিল রানা।
বিন্দুমাত্র সুযোগ পেল না অফিসার। কড়কড় আওয়াজ তুলল রানার হাতের হাই-ভোল্টেজ শক প্রড। কাতরে উঠে ছটফট করতে লাগল লোকটা। দ্বিধা নিয়ে একটু দূর থেকে বলে উঠল জেসিকা, ‘না… রানা!’
কথা না শুনে লোকটার গলায় ক্যাটল শক প্রড চেপে ধরে রেখেছে রানা। তিনসেকেণ্ডে জোরালো বৈদ্যুতিক শকে অবশ হলো লোকটার দেহ। মুখ তুলে রানা দেখল, এখন টিটকারির হাসি নেই অন্য পুলিশের মুখে। ভয় পেয়ে পিছিয়ে গিয়ে ঘুরেই দৌড় দিল সে। তবে পিচ্ছিল পথে হড়কে গেল তার পা। সামলে নিয়েই ছুটে গিয়ে উঠতে চাইল পেট্রল ভেহিকেলে। একবার গাড়িতে উঠতে পারলেই তাকে পায় কে!
তীরবেগে তার পিছু নিল রানা। শুয়োরের ওপর এভাবে পেছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্ষুধার্ত চিতাবাঘ। পেট্রল কারের দরজার কাছে পৌছুবার আগেই লোকটাকে নিয়ে পথের ওপর আছড়ে পড়ল রানা। শক্ত বরফে ছেঁচে গেল অফিসারের নাক-মুখ। হাত থেকে ছুটে গড়িয়ে গেল জ্বলন্ত টর্চ। ওঠার জন্যে দেহ মুচড়ে চিত হতে চাইল সে। দিশেহারা হয়ে ভাবছে দু’হাতে ঠেকাবে বিদ্যুতের শক। নিরীহ শিকার হঠাৎ বিপজ্জনক শিকারি হয়ে উঠতেই আত্মা উড়ে গেছে তার।
বৃথা হলো তার সব চেষ্টা। রানার বাম পায়ের বুট ধপ করে নামল ওর ডান কবজির ওপর। বরফ-ঠাণ্ডা পথে ছটফট করছে লোকটা। সরে যাওয়ার আগেই তার অন্য কবজি চাপা পড়ল রানার হাঁটুর নিচে। আতঙ্ক ফুটল অফিসারের চোখে। পরক্ষণে ফিজফিজ আওয়াজে তার গলায় লাগল রানার সুইচ অন করা ক্যাটল প্রড। করুণ আর্তনাদ ছেড়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল তড়িতাক্রান্ত লোকটা। থুতনি বেয়ে কয়েক হাজার ভোল্টের কারেন্ট মগজে যেতেই চার সেকেণ্ডে জ্ঞান হারিয়ে নিথর হয়ে গেল দেহটা।
টয়োটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে জেসিকা। অবাক চোখে দেখছে রানাকে। ভাবতে পারেনি পুলিশের ওপর হামলা হবে। কয়েক মুহূর্ত পর বলে উঠল, ‘রানা! এসব কী করছ!’
নীরবে পুলিশ অফিসারকে সার্চ করছে রানা। বুঝে গেছে, একটু পর সব ব্যাখ্যা দিতে হবে জেসিকাকে। পুলিশি কোটের পকেটে পেল আইডি ও পঞ্চাশ পাউণ্ডের নোটে ভরা ওয়ালেট। নোটগুলো একবার দেখার পর আইডি চেক করল রানা।
পুলিশ অফিসারের নাম পিসি কেভ গ্রাহাম।
‘তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, গ্রাহাম।’ উঠে জেসিকাকে দেখল রানা। সময় হয়েছে এবার সব বুঝিয়ে বলার। শীতল হাওয়ায় উড়ছে জেসিকার চুল। বিস্ফারিত চোখে বিস্ময়। পেট্রল কারের ছাতের রঙিন আলোয় অদ্ভুত সুন্দরী লাগছে ওকে।
দুই অচেতন পুলিশকে দেখাল রানা।
দেখাল রানা। জানতাম তোমাদেরকে আনআর্মড কমব্যাট শেখানো হয়। তবে এরা এসব কিছুই শেখেনি কেন?’
ঢোক গিলল জেসিকা, শুকিয়ে গেছে গলা। ক’বার চেষ্টার পর বলল, ‘রানা, হামলা করলে যে? এরা তো পুলিশ অফিসার!’
মাথা নাড়ল রানা। ‘পুলিশ নয়, বলো দুর্নীতিপরায়ণ দুই খচ্চর। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা অথবা বিবেক বলতে কিছুই নেই। বহু আগেই বিক্রি হয়ে গেছে টাকার কাছে।’
অবাক চোখে ওকে দেখছে জেসিকা।
পিসি গ্রাহামের ওয়ালেট দেখাল রানা। ‘কতজন পুলিশ দু’মাসের বেতন পকেটে নিয়ে রাতের ডিউটিতে যায়?’ চকচক করছে পঞ্চাশ পাউণ্ডের নতুন নোটগুলো।
‘তুমি আসলে কী বলতে চাইছ?’
পেট্রল কারের আলোয় দ্বিতীয় পুলিশের পাশে থামল রানা। চেতনা ফিরছে বলে চাপা গুঙিয়ে উঠছে লোকটা। মাথার পাশে বুটের লাথি মেরে তাকে আরও গভীর ঘুমে পাঠিয়ে দিল রানা। সার্চ করল কোটের পকেট। এর ওয়ালেটেও প্রচুর পাউণ্ড। একটা নোট শুঁকল রানা। পুলিশ আইডি অনুযায়ী এই লোকের নাম পিসি র্যাব ওয়াটকিন। রানা ছুঁড়ে দেয়ায় ওয়ালেট একহাতে ক্যাচ ধরল জেসিকা। ‘কী দেখব?’
‘নতুন নোটের গন্ধ। মেশিন থেকে বেরিয়েছে বেশিক্ষণ হয়নি। যে-লোক এদেরকে টাকা দিয়েছে, শক এড দিতেও ভুল করেনি সে।’ রানা ছুঁড়ে দেয়ায় অন্যহাতে শক প্রড ধরল জেসিকা। ‘একেক শক চার হাজার ভোল্টের। শুয়োর ও গরুর ওপর ব্যবহার করা হয়। কারণ জন্তুগুলোর চামড়া পুরু। মানুষের ত্বকে ওই শক প্রচণ্ড ব্যথা তৈরি করে। অবশ্য -তোমার বন্ধু পিসি গ্রাহাম আর পিসি ওয়াটকিন ভেবেছিল অস্ত্রটা আমাদের ওপর প্রয়োগ করবে। আমার ভুল না হলে, ওই জিনিস ব্যবহার করে না পুলিশ ডিপার্টমেন্ট।’
ওয়ালেটের পাউণ্ড আর ক্যাটল শক এড দেখছে জেসিকা। ঘুরে দেখল অচেতন দুই পুলিশকে। বিড়বিড় করল, ‘না, আমাদেরকে তো…’
‘আমি জানি, একবার টেইযার ব্যবহার করলে ওপরের অফিসারকে সেটা জানাতে হয়,’ বলল রানা। ‘তবে আইন মেনে চলছিল না এরা। বেআইনি কাজে জড়িত ছিল। সেজন্যেই আজ রাতে সাধারণ টেইযার ব্যবহার করেনি।’ আঙুল তুলে ইউনিফর্ম দেখাল রানা। ‘ইউনিফর্মের সঙ্গে বডি ক্যাম নেই। আজকাল ভাল সব পুলিশ বাহিনী ওটা ব্যবহার করে। ডিউটির সময় তোমাকেও ওটা চালু রাখতে হয়। তবে এদের সঙ্গে ওই জিনিস নেই, কারণ এরা এসেছিল আমাদেরকে ধরে নিয়ে চিরতরে গুম করার জন্যে।’
একহাজার দ্বিধা মনে এলেও জেসিকা বুঝতে পারছে, একটা কথাও মিথ্যা বলেনি রানা।
অচেতন পিসি গ্রাহামের পাশে পৌঁছুল রানা। তার কোটের পকেট থেকে নিল মোবাইল ফোন। একটু আগেও ওটা ব্যবহার করেছে লোকটা। ‘তখন রেডিয়ো ব্যবহার না করে এই ফোনে বসের কাছে কল দিয়েছে। একবার চেহারা দেখেই বুঝে গেছে আমরা কারা। সেটা পেরেছে, কারণ আগে থেকেই এদেরকে আমাদের ছবি দেয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই এসব বুঝতে পারছ, জেসিকা?’
ফোন চেক করল রানা। কল গেছে আরেক মোবাইল ফোনে। ওদিকেরটা বোধহয় ডিসপোযেবল। কেনা হয়েছে নগদ টাকায়। কোথাও মিলবে না মালিকের নাম। কেউ কিছু জানবে না। বড়জোর ক’বার ব্যবহার করে ফেলে দিত।
‘বুঝেছি,’ কয়েক মুহূর্ত পর বলল জেসিকা। ‘তবে এটা জানি না, এবার কী করব আমরা!’
‘এদের দলে হয়তো আরও অনেকে আছে,’ বলল রানা, ‘সুতরাং থানায় এদেরকে নেয়া যাবে না। নিশ্চিত হতে হবে ঘুম থেকে উঠে যেন আমাদের পিছু নিতে না পারে।’
পেট্রল কারের স্টিয়ারিং হুইলের নিচে হাত ভরে বনেট খোলার রিলিয ল্যাচ খুঁজল রানা। ওটা পেয়ে টান দিতেই ধুপ আওয়াজে খুলল বনেটের ঢাকনি। গাড়ি থেকে সরে পথের ধারে পড়ে থাকা গ্রাহামের জ্বলন্ত টর্চ কুড়িয়ে নিল রানা। কালো রঙের ভারী ধাতব জিনিস। গাড়ির সামনে এসে দুই হাঁটুর মাঝে টর্চ চেপে ধরে বনেটের ঢাকনি খুলল রানা। খুঁজে নিল ব্যাটারি। ওটার বারো ইঞ্চি ব্যবধানে আছে দু’প্রান্তে দুই টার্মিনাল। লাল ও কালো দুই প্লাস্টিকের কাভার খুলে দুই তার এক করে দিল রানা। দেখতে না দেখতে গরম হয়ে উঠতে লাগল ব্যাটারি। যে-কোনও সময়ে আগুন ধরবে ইঞ্জিন কম্পার্টমেন্টে। বনেটের ঢাকনি যেন নেমে না যায়, তাই টর্চ দিয়ে ঠেক দিল রানা। ফিরে চলল টয়োটার দিকে। ততক্ষণে পুলিশ কারের বনেটের ওদিক থেকে ভকভক করে বেরোচ্ছে অ্যাসিডের ঝাঁঝাল ধোঁয়া। একটু পর গোটা গাড়িতে ছড়িয়ে পড়বে লেলিহান আগুন। যেন পুড়ে না মরে, তাই ঠ্যাং ধরে পেট্রল কার থেকে পিসি গ্রাহামকে সরাল রানা। আনমনে ভাবল, শত্রুকেও কখনও কখনও দয়া দেখাতে হয়।
পেট্রল কারের ইঞ্জিনে আগুন ধরে যেতেই দু’হাত কোমরে রেখে অসহায় চোখে ওদিকে চেয়ে রইল জেসিকা। তারপর ভুরু কুঁচকে দেখল রানাকে। ‘চাকা ফাঁসিয়ে দিলেও তো পারতে! দুনিয়ার সবই তোমার নষ্ট করতে হবে কেন!’
‘রাতটা খুব ঠাণ্ডা,’ বলল রানা। ‘নিশ্চয়ই চাও না তোমার দুই পুলিশ বন্ধু হাইপোথারমিয়ায় মরুক?’
‘ওরা মরলে তোমার কিছু না, ঠিকই বুঝেছি। তুমি আসলে সবকিছুতেই নাটকীয়তা পছন্দ করো। একদম মিথ্যা বলবে না, রানা!’
‘ধরে নাও, ভবিষ্যতে আরও নানান ধরনের নাটকীয়তা হবে,’ বলল রানা।