ছত্রিশ
রানা ও জেসিকা ফিরতি পথে রওনা হয়েছে, ওই একইসময়ে মিসেস ক্লার্কের সেই কটেজে লিয়ন বেনেট ও গ্রেগরি বেলের কাছে ফোন দিল বাক ওয়াকি। বেনেট কল রিসিভ করতেই জানতে চাইল, ‘কী, ফিরেছে মাসুদ রানা আর থমসন মেয়েটা?’
জবাবে অধৈর্য বেনেট বলল, ‘তোমার কি মনে হচ্ছে, ওরা ফিরলে আমি যোগাযোগ করতাম না? এই বরফের মত ঠাণ্ডা কটেজে আর কতক্ষণ আমাদেরকে বসে থাকতে হবে?’
‘নালিশ বাদ দাও, এই কাজের জন্যে যথেষ্ট টাকা পাচ্ছ। কিছু ঘটলেই ফোন দেবে।’ কল কেটে স্টুয়ার্টের দিকে তাকাল ওয়াকি। দুই হাত পেছনে বেঁধে তিক্ত চেহারায় দুর্গের কিচেনে পায়চারি করছে বিলিয়নেয়ার। বাতাসে ভাসছে ইতালিয়ান কফির সুবাস। কাউন্টারে বগবগ আওয়াজ তুলছে বিশাল পারকোলেটর। টেবিলের একমাথায় বসেছে অ্যালান কোয়ার্ট। সামনে ধোঁয়া ওঠা কফির মগ। তামার তারের তৈরি ব্রাশ দিয়ে পরিষ্কার করছে পার্ট খুলে নেয়া একটা পিস্তল।
‘বাইরে কোথাও আছে রানা আর ওই মেয়ে,’ মন্তব্য করল বাক ওয়াকি।
‘তা জানি,’ পায়চারি বন্ধ না করেই ধমকে উঠল স্টুয়ার্ট। ‘আমি তো আর বোবা বা কালা নই। সেজন্যেই জন মুরের সঙ্গে কথা বলেছি। ওই গ্রামের পঞ্চাশ মাইলের ভেতর প্রতিটা গাড়ি সার্চ করবে রিড আর সে।’
‘মাত্র দু’জন মিলে?’
নাক দিয়ে ঘোঁৎ করে বিশ্রী এক আওয়াজ ছাড়ল স্টুয়ার্ট। ‘শুধু ওরা কেন, অনেকেই তো মাসওয়ারি ভাতা পাচ্ছে। এবার কাজ করে দেখাক। আইন ভাঙতে রাজি পুলিশেরা দ্বিতীয় বাড়ি কিনতে গিয়ে ব্যাঙ্ককে দিচ্ছে মর্টগেজের টাকা। কারও কারও আছে জুয়ার নেশা। আবার কেউ কেউ নামকরা ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রি চায়। চাই মেলা টাকা। ভাবছে সার্টিফিকেট পেলেই ব্যবসা খুলে, বা ভাল চাকরি পেয়ে লাখ লাখ পাউণ্ড আয় করবে। এরা এসব করতে পারছে আমার কাছ থেকে পয়সা পাচ্ছে বলে। অথচ, রানা আর ওই মেয়ের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত ভাল কোনও সংবাদ পেলাম না। কোথায় গেছে হারামজাদাটা? কী করছে সে? এসব না জানলে চলবে না আমার। ওয়াকি, তুমি বলেছিলে, সহজেই এদিকের সমস্যা সামলে নেবে। অথচ এখন কী দেখছি? কিছুই তো করতে পারছ না তোমরা!’
বকা শুনে চট করে কোয়ার্টের দিকে তাকাল ওয়াকি। লাল হয়ে গেছে মুখ। পিস্তলের যন্ত্রাংশ পরিষ্কার বাদ দিয়ে মুখ তুলে তাকাল কোয়ার্ট। বোঝা গেল কান পেতে সব শুনছে সে।
‘আমরা সাধ্যমত করছি,’ বলল ওয়াকি, ‘এরই ভেতর মারা গেছে দলের একজন। দু’জনকে পাঠিয়ে দিয়েছি গ্রামে। যখন-তখন দরকার হতে পারে বলে অন্তত দু’জনকে রাখতে হবে এই দুর্গে। আমাদের যথেষ্ট লোকবল নেই। আপনি যখন আমাকে ডেকে আনলেন, বলেছেন বুড়ো এক লোককে খুঁজে বের করতে হবে। তা আমি করেছি। হৃৎপিণ্ড নষ্ট লোকটাকে ধরে এনেছি এখানে। সে আছে এখন আপনার ডানজনে। কিন্তু তারপর হাজির হলো মাসুদ রানা। সেজন্যে সম্পূর্ণ বদলে গেল পরিস্থিতি। মুরের পুলিশেরা বা আমরা তাকে ধরতে পারব কি না, নিশ্চিত হয়ে বলা কঠিন।’
পায়চারি বন্ধ করে ওয়াকির দিকে তাকাল রন স্টুয়ার্ট। ‘আমি তো অন্তত তিনবার তোমার মুখে শুনেছি, নাস্তার সঙ্গে মাসুদ রানাকে চিবিয়ে খেয়ে নিতে পারবে তোমার দলের লোকেরা।’
‘সত্যিই পারবে। কিন্তু আপাতত এদিকে আছি শুধুমাত্র আমি।’
‘অর্থাৎ তোমার আরও লোক চাই? ভাল কথা! তো আরও লোক ডাকো! চট করে চলে আসতে পারবে কতজন?’,
আবারও কোয়ার্টের দিকে তাকাল ওয়াকি। মুখ তুলে তাকে দেখছে লোকটা। নিচু গলায় বলল, ‘কাজ নেই নিল মার্লো আর ফিন হ্যামারের। গত সপ্তাহে কিংস্ ক্রসের এক পাবে দেখা হয়েছিল।’
একই রেজিমেন্টের লোক বাক ওয়াকি আর নিল মার্লো। দু’জনই চরম হারামি লোক। একই সঙ্গে চাকরি গেছে সরকারি মালখানা থেকে অস্ত্র সরিয়ে বিক্রির দায়ে। কিছু দিন আগেও ড্রাগস্ চোরাচালানি করত মার্লো। ওয়াকি বলল, ‘শুনেছি মার্লো আর হ্যামার এখন ইউক্রেনে। রাশান আর্মির বিরুদ্ধে লড়ছে।’
‘তাই করছিল। কিন্তু ইউক্রেনিয়ান আর্মির শালারা ঠিকমত টাকা দিচ্ছিল না। তাই বিরক্ত হয়ে ইংল্যাণ্ডে ফিরে এসেছে। খোঁজ নিলেই বোধহয় ওদেরকে পেয়ে যাবে। এ ছাড়াও কাজ নেই আরও বেশ কয়েকজনের।’
মাথা দোলাল ওয়াকি। ‘মাসুদ রানা এসএএস ফোর্সের সঙ্গে ট্রেইনিং করেছে। তাকে শেষ করতে হলে ওদেরকেই চাই।’
‘ডেকে পাঠাও,’ বলল স্টুয়ার্ট, ‘পাঁচ, দশ, বিশ… যতজনকে লাগে। অস্ত্র এনে পাহারা দিক দুর্গ। আমার সঙ্গে লাগতে এসেছে মাসুদ রানা! খুঁজে বের করুক হারামজাদা শুয়োরটাকে! ধরে আনুক তাকে! তবে তাকে শুধু খুন করলে হবে না, পুড়িয়ে ছাই করতে হবে কুকুরটাকে। সেটা করবে এমনভাবে, যেন পৃথিবীতে ছিলই না সে। আমি ফিরে পেতে চাই পূর্বপুরুষদের সমস্ত সম্পদ। আমার কথা বুঝতে পেরেছ, ওয়াকি?’
.
শীতল ডানজনে পাথরের মূর্তির মত থম মেরে বসে আছে বেন হ্যানন। পিঠ ঠেকে আছে বরফ-ঠাণ্ডা দেয়ালে। গত কয়েক দিনে ঘুটঘুটে অন্ধকার সয়ে গেছে চোখে। নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে এই ভেজা, বদ্ধ পরিবেশে। মনে চাপা আতঙ্ক। বুকে গনগনে আগুন। শেষবার ক’জন মিলে এসে খাবার দিল, তা-ও চব্বিশ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। পেটে এখন ভীষণ খিদে। বরাবরের মত ঠাণ্ডা ভাত আর মটরশুঁটি পেলেই খুশি থাকত। খাবারে হার্টের ওষুধ মিশিয়ে দেয় বলে ঠোঁটে লেগে আছে তিক্ত ভাব। পায়ের কাছে পড়ে আছে প্লাস্টিকের চামচ ও প্লেট।
কেন ওকে বাঁচিয়ে রেখেছে এরা, ভালই বুঝতে পারছে *বেন। পিটারের কাছে যা জানতে চেয়েছে, সেই একই তথ্য চায় ওর কাছ থেকে। কিন্তু যেটা জানে না, সেটা জানাবে কী করে সে? জিনিসটা আসলে কী সেটা বুঝতে পারলেও না হয় একটা কথা ছিল।
বেন বুঝেছে, ক্রমেই হতাশ হয়ে উঠছে লোকগুলো। কী বা কাকে যেন ভয় পাচ্ছে। ভেস্তে যাচ্ছে তাদের পরিকল্পনা। নতুন কিছু ঘটেছে। মুখে কিছু না বললেও, কেউ ভয় পেলে সেই অনুভূতির একটা গন্ধ পাওয়া যায় তার শরীরে। সেটা পাচ্ছে বেন লোকগুলোর গা থেকে। ফলে আশার আলো জ্বলে উঠেছে ওর মনে। একই সঙ্গে পড়েছে দুশ্চিন্তায়। ওর কাছ থেকে কিছুই জানতে না পেরে যে-কোনও সময়ে মিরাণ্ডার ওপর হামলা করতে পারে লোকগুলো।
কিছু একটা করতে হবে।
মুক্ত হতে হবে এই ডানজন থেকে।
এবং সেজন্যেই নিরলস কাজ করে চলেছে বেন। দেয়ালের ওপাশে ঝরঝর পানির আওয়াজ পেয়েছে সে, ওই পানি কোথায় যাচ্ছে আঁচ করে নিয়েছে। এরপর থেকেই গত দু’দিন ধরে খালি হাতে খুলতে চাইছে দেয়ালের পাথর। বারবার রক্তাক্ত হয়েছে দুই হাত। কাজ করতে গিয়ে হৃৎপিণ্ডে যেন লেগেছে হাতুড়ির আঘাত। হাজারবার মনে হয়েছে মরে যাচ্ছে সে। ক্লান্তিতে নেতিয়ে পড়েছে মেঝেতে। তারপর আবারও একটু সুস্থ হলেই নেমে পড়েছে কাজে। দিন নেই রাত নেই উপড়ে আনতে চেষ্টা করছে দেয়ালের পাথরখণ্ড। জানে, একটা খুলতে পারলেই সহজ হয়ে যাবে বাকি কাজ।
বিশ্রাম হয়েছে বুঝে ঘুরে বসল বেন। ক্ষত-বিক্ষত আঙুলে আঁকড়ে ধরে হ্যাঁচকা টান মারল পাথরখণ্ডের একটা দিক। একদিন হয়তো খুলে আসবে ওটা। তা হলে ডানজন থেকে বেরোবার পথ পাবে বেন?