1 of 2

স্বর্ণলিপ্সা – ৩৩

তেত্রিশ

নিষ্ঠাবান ও বিবেচক মানুষ কর্নেল কার্ল হপকিন্স। আর্মিতে, চাকরির সময় জানতে পারেন, গ্রেট ব্রিটেনের রানির সামরিক বাহিনী থেকে একদল অফিসার ও সৈনিককে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হলে তারা গড়ে তুলেছে দুর্বৃত্তদের নিষ্ঠুর একটি সংগঠন। হেন কুকীর্তি নেই যা করে বেড়াচ্ছে না। ফলে ভূলণ্ঠিত হচ্ছে সামরিক বাহিনীর সম্মান। তাই আর্মি থেকে অবসর নেয়ার পর কর্নেলের একমাত্র নেশা হয়ে ওঠে ডিযঅনারেবল হওয়া সেই লোকগুলোর বিরুদ্ধে লড়বার জন্যে জরুরি তথ্য সংগ্রহ করা। আর এই খবরটা জানে রানা। আর সেজন্যেই চার্লি জন্সটনের মাধ্যমে জোগাড় করেছে কর্নেলের ফোন নাম্বার। তাঁর সঙ্গে সংক্ষেপে পরিচয় শেষে সরাসরি চলে গেছে মূল বিষয়ে। ‘কর্নেল, ভুল না হলে ডিযঅনারেবল দলের একজনের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। তবে আমার ধারণা ঠিক কি না, তা জানতেই আপনাকে বিরক্ত করছি।’

‘ভ্রাতৃসঙ্ঘের বিষয়ে বহুদিন ধরেই তথ্য কালেক্ট করছি, ‘ জবাবে বললেন কর্নেল, ‘সেজন্যে ডিযঅনারেবল হওয়া বেশ কয়েকজনের ফাইলও তৈরি করেছি। তুমি আসলে কী জানতে চাইছ, মেজর রানা?’

‘যার কথা ভাবছি, সে ডিযঅনারেবলদের একজন কি না, সেটা কি আপনি আমাকে জানিয়ে দিতে পারবেন?’

‘হয়তো। যদি তার ফাইল আমার কাছে থাকে। তুমি হয়তো ওই লোকের কোনও ছবি দেখাতে পারবে?’

‘আজই গোলাগুলির পর ছবি তুলেছি,’ বলল রানা। ভাল করেই জানে, কর্নেল বুঝে নেবেন যে রক্তাক্ত লাশের ছবি দেখাতে চাচ্ছে ও। ‘কোনও সমস্যা না থাকলে আপনার কাছে ছবিটা পাঠিয়ে দেব।’

‘বুঝতে পারছি ওটা একটা বড় ধরনের প্রমাণ,’ বললেন কর্নেল। ‘মেজর, তুমি কি ওটা ডিজিটাল মিডিয়ার মাধ্যমে পাঠাতে চাও? তুমি কিন্তু ঝুঁকির ভেতর পড়বে।’

‘আপনি ঠিকই বলেছেন, স্যর। ছবিটা হয়তো পাঠাব ই-মেইলে।’

‘কিন্তু ই-মেইলও হ্যাক হতে পারে।’

‘তা হলে আপনার আপত্তি না থাকলে মুখোমুখি সাক্ষাতে দেখাতে পারি,’ বলল রানা। ‘এদিকে নানান সমস্যার কারণে হাতে বেশি সময়ও পাব না।’

‘বুঝেছি, তবে নিজের নিরাপত্তার কথা আমাকে ভাবতে হবে। ডিযঅনারেবলরা অত্যন্ত বিপজ্জনক। তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ খুঁজছি বলে যে-কোনও সময়ে হয়তো খুন হব। এদিকে তোমার কথা সত্যি হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে। আমি তো জানি না, তুমিও হয়তো ওই দলেরই কেউ। আসলে বলতে চাইছি: দশ বছর আগে হলেও এত ভাবতাম না। প্রয়োজনে লড়তাম। তবে এখন বয়স হয়েছে। আগের দৈহিক বা মানসিক শক্তি আর নেই।’

‘আমি বুঝতে পেরেছি, কর্নেল।’

‘তুমি মেজর জেনারেলের কথা বলেছ, তাই ঠিক করেছি সরাসরি কথা বলর তাঁর সঙ্গে। তিনি যদি বলেন এই ফোনটা তোমার, সেক্ষেত্রে বড় কোনও ঝুঁকিতে পড়ব না।’ চুপ হয়ে গেলেন কর্নেল কার্ল হপকিন্স। ‘সেক্ষেত্রে আমার বাড়ির ঠিকানা তোমাকে জানিয়ে দেব। তখন এসে ছবিটা দেখাতে পারবে।’

‘ঠিক আছে, স্যর,’ বলল রানা, ‘আপনি আমার বসের সঙ্গে কথা সেরে নিন। আমি আধঘণ্টা পর কল দেব।’

‘মেজর জেনারেলের সঙ্গে কথা বলার পর আমিই ফোন দেব,’ লাইন কেটে দিলেন কর্নেল কার্ল হপকিন্স।

তোমার কি মনে হয় উনি সত্যিই ফোন দেবেন?’ রানার কাছে জানতে চাইল জেসিকা।

কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘আশা তো করি।’

এরপর প্রতিটা মুহূর্ত পার হতে লাগল তিলতিল করে। কটেজের জানালা দিয়ে আঁধার পথে চেয়ে রইল রানা। পেরিয়ে গেল বিশ মিনিট। তারপর বলল জেসিকা, ‘লোকটার ব্যাপারে অন্য কোনও পথে তথ্য পাওয়া যাবে না?’

‘মিচ ম্যাকডোনাল্ড আর তার দলের লোকগুলোকে জেল ভেঙে বের করে বেধড়ক পেটালে হয়তো কিছু জানা যাবে,’ চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। ‘সেটা যখন পারছি না, অপেক্ষা করতে হবে কর্নেলের জন্যে।’

চুপ হয়ে আগুনের দিকে হাত বাড়িয়ে সেঁক নিতে লাগল জেসিকা। এক এক করে পেরিয়ে গেল আরও দশ মিনিট। তারপর হতাশ সুরে বলল জেসিকা, ‘নাহ্, উনি বোধহয় আর ফোন দেবেন না।’

এবারও জবাব দিল না রানা।

কর্নেলের সঙ্গে ওর কথা হওয়ার পর পেরিয়ে গেল পঁয়তাল্লিশ মিনিট।

‘কল যে করবেন না, এটা পরিষ্কার,’ মন খারাপ করে বলল জেসিকা।

চুপ করে থাকল রানা।

‘তুমি তা হলে বাংলাদেশ আর্মির একজন মেজর?’ বলল জেসিকা, ‘অবাক হয়েছি। বেন হ্যাননের সঙ্গে তোমার কীভাবে বন্ধুত্ব হলো?’

‘দীর্ঘ কাহিনী। তুমি গ্রেফতারের ভয় দেখালে তো সব খুলে বলতেই হবে! কিন্তু এখন না, পরে। আমি এখন আর মেজর নই। অবসর নিয়েছি।’

‘এত কম বয়সে অবসর নিলে কেন?’

‘অন্য পেশায় চলে গেছি।’

আরও পাঁচ মিনিট পর হঠাৎ করেই বেজে উঠল রানার স্মার্টফোন। চট্ করে কল রিসিভ করল রানা। ‘হ্যালো?’

‘জানতাম না মেজর জেনারেল কারও এত প্রশংসা করতে পারেন,’ অপ্রাসঙ্গিকভাবে বললেন কর্নেল হপকিন্স। ‘তিনি আসলে তোমার গল্প বলতে ভালবাসেন। যাক, রানা, তুমি সরাসরি চলে এসো ডার্বিশায়ারের বাক্সটনে। তারপর ফোন করে জেনে নিয়ো আমার বাড়ির ঠিকানা।’

‘অনেক ধন্যবাদ, কর্নেল।’

ফোন রেখে দিলেন কার্ল হপকিন্স।

‘বাক্সটন কতটা দূরে?’ রানার মনের কথাই বলল জেসিকা। সন্ধ্যা হয়ে গেছে বলে ইনভার্নেস এয়ারপোর্ট থেকে বিমানে করে ম্যানচেস্টারে যেতে পারবে না ওরা।

‘গাড়িতে করে গেলে বড়জোর ছয়ঘণ্টা,’ কয়েক মুহূৰ্ত পর বলল রানা। ‘আমি একাই যাব।’

মিষ্টি মুখটা কঠোর হলো জেসিকার। সামনে বাড়িয়ে দিয়েছে চিবুক। ‘জীবনেও তোমাকে একা যেতে দেব না!’

‘কিন্তু আমি যে কাউকে বিয়ে করতে তৈরি নই?’ মৃদু হাসল রানা।

‘আমি কি তাই বলেছি?’ লালচে হলো জেসিকা। ‘আমি তো বলেছি, আমরা একসঙ্গে যাব এই অভিযানে।’

‘বেশ। তো তোমার বাড়ি থেকে কাপড়চোপড় বা দরকারি জিনিসপত্রগুলো সংগ্রহ করে নাও ঝপট্। তারপর রওনা হব।’

‘বাড়ি থেকে কিছুই নিতে হবে না, আমি তৈরি,’ বলল জেসিকা।

‘তা হলে চলো, যাওয়া যাক।’

বিকেল সোয়া পাঁচটায় টয়োটায় চেপে বাক্সটনের উদ্দেশে রওনা হলো রানা ও জেসিকা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *